Tuesday, October 22, 2013

বেগম জিয়ার উচিত জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া -আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী


হাসব, না কাঁদব? আজ লিখতে বসেই চতুরঙ্গের সহৃদয় পাঠকদের কাছে এই প্রশ্নটা করছি। সোমবার (২১-অক্টোবর) ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার একটি বক্তব্য শুনে হাসব, না কাঁদব, তখনও স্থির করতে পারিনি, এখনও স্থির করতে পারছি না। নবপ্রযুক্তির কল্যাণে লন্ডনে বসে স্বকর্ণে তাঁর বক্তব্যটি শুনেছি।
বেগম জিয়া বলেছেন, তাঁর পরিবার পরিজনদের ওপর যারা অত্যাচার-নির্যাতন করেছেন, তাদের সকলের জন্য তিনি ক্ষমা ঘোষণা করছেন। অর্থাৎ তাঁর পরিবারের সদস্যদের (নিশ্চয়ই দুই পুত্রসহ) ওপর যারা অত্যাচার-নির্যাতন করেছেন তাঁদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষিত হলো। এই ঘোষণাটি শুনেই ধান্ধায় পড়ে গেছি। ‘এ কি কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে?’ এটা তো ব্যাঙদের জাতশত্রু সাপের ঘোষণার মতোÑ হে ভেককুল, আমাদের ওপর নির্যাতনের জন্য তোমাদের ক্ষমা করে দিলাম। এ সাপেরাই ব্যাঙ নিধন ও ভক্ষণ করে থাকে।
বেগম জিয়ার ঘোষণাটি স্বকর্ণে শুনে প্রথমে হাসব ভেবেছিলাম। কারণ বিশ্ব-রাজনীতির ইতিহাসে পীড়ক-পীড়িত সেজে ক্ষমা করার ঘোষণা দেয় আগে কোনদিন শুনিনি। প্রথমে ভেবেছি, এই ঘোষণা শুনে হাসি। তারপর ভেবেছি কাঁদি। কারণ, যে বিএনপি সরকারের হাতে দেশের বড় বড় বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক, ধর্ষিতা নারী এবং রিক্সাচালক ও রাজপথের নিরীহ পথিকের নৃশংস হত্যার রক্ত লেগে আছে, ২৪ অক্টোবরের (২০০৪) ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার রক্ত যখন ঢাকার মাটি থেকে শুকায়নি, সেই দলের নেত্রী যদি এমনভাবে সংবাদ সম্মেলনে দাঁড়িয়ে নিজেদের অপরাধের জন্য ক্ষমা না চেয়ে নিরপরাধীদের ক্ষমা করার ঘোষণা দিতে পারেন, তার নির্লজ্জতা দেখে আমার মতো কেউ কাঁদতে চাইলে অন্যায় হবে কি?
মনস্তাত্ত্বিকেরা বলেন, যাঁরা গুরুতর অপরাধ করেন, তাঁদের অনেকে এই অপরাধের জন্য প্রকাশ্য শাস্তি এড়াতে পারলেও অপ্রকাশ্য মানসিক শাস্তি এড়াতে পারেন না। তাঁরা অপরাধ কবুল করেন না। কিন্তু এমন সব স্ববিরোধী কথাবার্তা বলেন, যাতে তাঁদের মানসিক অবস্থার কথা বোঝা যায়। এদের মধ্যে যারা নিষ্ঠুর এবং বিবেকবিহীন, তারা নিজের অপরাধ অন্যের ওপর চাপিয়ে মনের জ্বালা নিবারণের চেষ্টা করেন।
বিএনপি নেত্রীর বর্তমান মানসিক অবস্থা যদি কোন মনস্তত্ত্ববিদের দ্বারা পরীক্ষা করানো হয়, তাহলে হয়ত দেখা যাবে, তার মনে অপরাধবোধ দু’টি বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। এক, নিজেদের অপরাধ যে জনসাধারণের কাছে ধরা পড়ে গেছে এবং গোপন করার চেষ্টা চালিয়ে কোন লাভ নেই, সেটা বুঝতে পেরে নির্বাচনের আগে দেশের মানুষকে নতুন করে ধোঁকা দেয়ার জন্য বার বার বলছেন, ‘আমরা আর প্রতিহিংসার রাজনীতি করব না।’ অর্থাৎ এতকাল যে তিনি এবং তাঁর দল প্রতিহিংসার রাজনীতি করেছেন তার এক ধরনের প্রকাশ্য স্বীকৃতি। এটা হয়ত তিনি বুঝতে পারছেন না। তাঁর এই বক্তব্য হচ্ছে, ‘ঠাকুর ঘরে কে, আমি কলা খাই না’ গোছের উক্তির মতো।
তার মনের দ্বিতীয় এবং বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, তারা ক্ষমতায় বসে দিনের পর দিন যে নৃশংস ও ভয়াবহ অপরাধগুলো করেছেন, তার দায় অন্যের ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের ‘ভিকটিম’ সাজিয়ে দেশের মানুষের কাছ থেকে সহানুভূতি অর্জনের (ভোটের জন্য) চেষ্টা। এটাকে বলা হয়, ভিকটিম সিনড্রোম। এ ক্ষেত্রে অপরাধী ভাবে, তার অপরাধের কথা মানুষ ভুলে গেছে এবং নিজেকেই এই অপরাধের ভিকটিম বা শিকার সাজাতে পারলে মানুষকে প্রতারণা করা যাবে। এটা আত্মপ্রতারণাও।
নাৎসি জার্মানির কোন নেতা আজ যদি কবর থেকে উঠে এসে ইহুদি জাতিকে বলে, ‘তোমরা এতকাল আমাদের ওপর যে অত্যাচার নির্যাতন করেছ, যে হলোকাস্ট ঘটিয়েছ, সেজন্য তোমাদের ক্ষমা করে দিলাম। তোমাদের জন্য ক্ষমা ঘোষণা করলাম’ তাহলে কেমন হয়? বিশ্বের তাবৎ মানুষ তা শুনে হাসবে, না কাঁদবে? বাংলাদেশের মানুষও আজ বেগম খালেদা জিয়ার ‘ক্ষমা ঘোষণা’ শুনে ভাবছে তারা হাসবে, না কাঁদবে? তাদের কাছে এই ধৃষ্ট উক্তির হয়ত একটিমাত্র জবাবই রয়েছে, বেগম খালেদা জিয়াকে তার এবং তার দুই আমলের সরকারের গণনির্যাতন এবং ‘৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে কোলাবরেসনের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।
বেগম জিয়া কোন্ মুখে বলছেন, তাঁর পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজনের ওপর নির্যাতন চলেছে? তিনি তিন তিনবার দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ক্যান্টনমেন্টে বসে রানীর হালতে রাজত্ব চালিয়েছেন। তাঁর গায়ে বা তাঁর পরিবারের সদস্য বা দুই পুত্রের গায়ে ফুলের টোকাটি পড়েনি। বরং হাওয়া ভবনে বসে তাঁর ‘যুবরাজপুত্র’ দেশে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছে। তাঁর দুই পুত্রের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও লুটপাটের মামলা আওয়ামী লীগ করেনি। করেছে সেনা তাঁবেদার এবং খালেদা জিয়ার পছন্দসই তত্ত্বাবধায়ক সরকারই। তারপরও গুরুতর সব অপরাধে তাদের দ- দেয়ার বদলে অসুস্থতার ছুঁতোয় প্যারোলে বিদেশে পাঠিয়ে সেখানে অনির্দিষ্টকালের জন্য বসবাসের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে।
এক এগারোর সময় লোক দেখানোভাবে বেগম জিয়াকে গ্রেফতার করে সুরম্য সাবজেলে রেখে দুই বেলা পঞ্চব্যঞ্জন খাওয়ানো হয়েছে। অন্যদিকে শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে একটার পর একটা মামলা দিয়ে হয়রানি, বিদেশে পাঠিয়ে দেশে ফিরতে না দেয়া, তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি ইত্যাদি হেন হয়রানি নেই যা করা হয়নি। তাছাড়া আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতাকর্মীদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন তো ছিলই।
খালেদা জিয়ার শাসনামলেই শেখ হাসিনার ওপর ভয়াবহ গ্রেনেড হামলাসহ ছয়বার ছোট বড় হামলা হয়েছে। এই হামলার সঙ্গে বিএনপি সরকারের কোন কোন শীর্ষ ব্যক্তি এমনকি তারেক রহমানের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে বেগম জিয়ার অসংখ্য জনসভার কোনটিতে কোনদিন একটা পটকাও ফোটেনি। তাঁর গায়ে একটি ফুলের আঁচড়ও লাগেনি। তবু তিনি প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলনে নির্যাতন-নিপীড়নের ভিকটিম সেজে মায়াকান্না জুড়েছেন; তাঁর কল্পিত নির্যাতকদের জন্য ক্ষমা ঘোষণার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছেন।
আমাকে এক বন্ধু বলেছেন, বেগম জিয়ার এই ‘ক্ষমা ঘোষণা’র মধ্যেও দারুণ চালাকি থাকতে পারে। আওয়ামী লীগ সরকার তাকে জেলে নেয়নি। নিয়েছিল এক এগারোর ক্যান্টনমেন্ট পরিচালিত সরকার। তারেক রহমানকে জেলে থাকার সময় নির্যাতনের খবরটি যদি সঠিক হয়ে থাকে, সেই নির্যাতনও চলেছে এক শ্রেণীর সেনা অফিসারের দ্বারাই। খালেদা জিয়া কি এখন সেই সেনা অফিসারদের জন্যই কৌশলে ক্ষমতা ঘোষণা দ্বারা আবার ক্যান্টনমেন্টের সমর্থন ও সহানুভূতি ফিরে পেতে চাইছেন? তবে এখন তা চাইলেও পাবেন কি?
বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে দেশে যত শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, সাংবাদিক, কৃষক হত্যা ঘটেছে, বীভৎস নারী নির্যাতন হয়েছে, তার একটিও আওয়ামী লীগ আমলে ঘটলে বিএনপির গর্জনে এখন কান পাতা দায় হতো। এক ইলিয়াস আলীর অপহরণ অথবা গুম-হত্যার অভিযোগ নিয়ে তাদের কত নর্তনকুর্দন। অথচ তাদের আমলে আহসানউল্লাহ মাস্টার, এএমএস কিবরিয়া, হুমায়ুন আজাদসহ অসংখ্য বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক হত্যার কোন তদন্ত ও বিচার হয়নি। সার চাইতে আসা ১৮ জন কৃষক-হত্যার কোন প্রতিকার করা হয়নি। আইয়ুব ইয়াহিয়ার আমলেও যা ঘটেনি, ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবে পুলিশ ঢুকিয়ে সাংবাদিকদের বেধড়ক মারধরের ঘটনায় খালেদা জিয়া নিশ্চুপ ছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রী হলে মাঝরাতে পুলিশ ঢুকিয়ে ছাত্রীদের বিবস্ত্র করা, লাঠিপেটার ঘটনা সভ্যজগতে ঘটে না। বিএনপির আমলে বাংলাদেশে ঘটেছে। সর্বোপরি ২০০১ সালে ক্ষমতায় বসার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণিমা শীলসহ অসংখ্য নাবালিকা তরুণীর ওপর বিএনপির ক্যাডাররা যে বর্বর গণধর্ষণ ঘটিয়েছিল, তাদের কাছে বেগম জিয়া ক্ষমা চাইবেন, না, তাদেরই অপরাধী সাজিয়ে তাদের জন্য ক্ষমা ঘোষণার চরম নির্লজ্জতা দেখাবেন? মানবতাবিরোধী অসংখ্য অপরাধের জন্য আজ সর্বাগ্রে জাতির কাছে বেগম জিয়ার মাথা নত করে ক্ষমা চাওয়া উচিত।
দেশের মানুষ দেখছেন, বর্তমান সরকার তাদের অনেক ভুলভ্রুটি সত্ত্বেও উন্নয়নমূলক অনেক কাজ করেছেন, যা গত ৪০ বছরে কোন সরকারের আমলে হয়নি। কিন্তু খালেদা জিয়ার চোখে তা পড়ছে না। তার চোখে পড়েছে হলমার্ক, ডেসটিনি ইত্যাদি দুর্নীতির ব্যাপার। এই দুর্নীতির সূচনা তার সরকারের আমলেই। তিনি এদের ধরার ব্যবস্থা করেননি, তদন্ত ও বিচারের ব্যবস্থাও করেননি। আওয়ামী লীগ আমলেই এই দুর্নীতি ধরা পড়েছে এবং রাঘববোয়ালদের বিচারের ব্যবস্থা হচ্ছে। এই বিচার বিলম্বিত হচ্ছে একথা সত্য। কিন্তু সেই সঙ্গে একথাও সত্য যে, এই বিচার নানা বাধাবিপত্তি এড়িয়ে ধীরে হলেও চলবে এবং রাঘববোয়ালদের অনেকেই দ- হতে রেহাই পাবেন না। বিএনপির আমল হলে এদের দ- দূরের কথা বিচারই শুরু হতো না। সা.কা. চৌধুরীর মতো যুদ্ধাপরাধী ও গণনিপীড়ক যে দলের অন্যতম নেতা, তারা কি করে নিজেদের নির্যাতিত সাজিয়ে মায়াকান্না কাঁদে তা এক আজব ঘটনা।
আগামী নির্বাচন সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তা ইতিবাচক বলে সকল মহলে অভিনন্দিত হয়েছে। সেই প্রস্তাবের পাল্টা যে প্রস্তাব বেগম জিয়া সোমবার সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করেছেন, তা শুধু হাস্যকর নয়, ‘ডেইলি স্টারের’ মতো বিএনপি সমর্থক ইংরেজী দৈনিকটি পর্যন্ত বলেছে ‘অবাস্তব।’
বিএনপির এই প্রস্তাব যে গ্রহণযোগ্য নয় এবং অবাস্তব তা খালেদা জিয়াসহ তার দলের শীর্ষ নেতারাও জানেন। তবু একটি সূক্ষ্ম চাল চালার জন্য এই প্রস্তাবটি দিয়েছেন এবং এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার জন্য বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের কাছে একটি চিঠিও পাঠিয়েছেন। তিনি সেই চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার করে বলেছেন, তিনি সভানেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে এ সম্পর্কে তার প্রতিক্রিয়া জানাবেন। আজ (বুধবার) আওয়ামী লীগ যে সংবাদ সম্মেলন ডেকেছে সম্ভবত তাতে দলের সাধারণ সম্পাদক বিএনপির প্রস্তাব সম্পর্কে তার দলের মতামত জানাবেন।
আওয়ামী লীগ খালেদা জিয়ার প্রস্তাব সম্পর্কে কি বলবে তা অনুমান করতে কারোই অসুবিধা নেই। কারণ, সংবাদ সম্মেলনে ঘোষিত বেগম জিয়ার প্রস্তাবটি একমাত্র তার নিজের দল ছাড়া আর কোন মহলেই বাস্তব প্রস্তাব বলে স্বীকৃত হয়নি। তথাপি এ সম্পর্কে আওয়ামী লীগ তাদের সংবাদ সম্মেলনে কি বলে তা জানার পরই এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা উচিত। আমিও তা করব। প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের জবাবে বেগম জিয়ার পাল্টা প্রস্তাব পর্বতের মূষিক প্রসবের মতো। দেখা যাক এই মূষিকের ভাগ্যে কি আছে?

No comments:

Post a Comment