Thursday, August 15, 2013

মুজিব কে হত্যা করেছে কে? -এ এল খতিব


১৯৭৫-এর আগস্ট মাস বাংলাদেশের জন্য ছিল পরিবর্তনের সময়। এমন সব মৌলিক প্রশাসনিক পরিবর্তন করছেন মুজিব যে সেগুলো প্রচন্ড সামাজিক প্রভাবের সূচনা করবে। দেশে একটি মাত্র রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল)।
সমাজের সব স্তরের মানুষ এমন কী সশস্ত্র বাহিনী এবং পুলিশেরও প্রতিনিধিত্ব ছিল বাকশাল-এ। ১৯৭৫-এর ১ সেপ্টেম্বর জেলা গভনর-মনোনীতরা দায়িত্ব গ্রহণের পর আমলাদের গুরুত্ব হরাস পাবে। সেনাবাহিনী জেলা পর্যায়ে উৎপাদনশীল কাজে অবদান রাখবে। এটি ছিল একটি বৈপ্লবিক পদক্ষেপ।১৯৭৫-এর ১৪ আগস্টের সন্ধ্যাটি মাসের অন্যান্য দিনের সন্ধ্যার চেয়ে ভিন্ন কিছু ছিল না।পরদিন মুজিবকে অভ্যর্থনা জানানো হবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেই আয়োজনের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত।১৯৪৮ সালে আইনের ছাত্রকালীন সময়ে মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার আবেগী দাবিতে জিন্নাহর বিরুদ্ধে কালো পতাকা মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুজিব। পরের বছর মুজিবকে আবারও গ্রেফতার করা হলো। এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের ধর্মঘটে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে। কারাগার থেকে বেরিয়ে মুজিব দেখলেন ইতিমধ্যে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। পরদিন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন চ্যান্সেলর হিসেবে।
ক্যাম্পাসে গ্রেনেড বিস্ফোরণের পর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হলো। অবশ্য ১৯৭১-এর মার্চের ২৫/২৬ রাতে বাঙালির ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের পর থেকে বোমা অথবা গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঢাকাবাসীর জীবনের অংশ হয়ে গেছে, এর জন্য কারো ঘুমের ব্যাঘাত হয় না। কিন্তু গুজব, গুজব ছড়িয়ে পড়ছিল ....।রাত সাড়ে আটটা নাগাদ মুজিব গণভবন থেকে বাসায় ফিরলেন।

রাসেল মুজিবের দশ বছরের পুত্র ভীষণ উত্তেজিত। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুজিব এলে যে ছয়জন তাকে অভ্যর্থনা জানাবে, বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরী স্কুলের প্রিন্সিপাল তাকেও একজন হিসেবে মনোনীত করেছেন।

কাদের সিদ্দিকী, মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের জন্য বাঘা সিদ্দিকী হিসেবে যিনি অধিক পরিচিত, একজন জেলা গভর্নর-মনোনীত। ১৪ আগস্ট সন্ধ্যায় পিজিতে অসুস্থ মাকে দেখতে যাওয়ার সময় কারওয়ান বাজারের কাছে একটি ট্যাংক দেখতে পেলেন। আরেকটি ট্যাংক দেখলেন পিজি হাসপাতালের কাছে, রেডিও স্টেশনের প্রায় উল্টোদিকে। মাকে দেখে কাদের সিদ্দিকী মতিঝিল গেলেন, সেখানেও আরেকটি ট্যাংক, এক কিলোমিটারের মধ্যে তিনটি ট্যাংক। গাড়ি ঘুরিয়ে নিলেন তিনি। ইঞ্জিনিয়ার্সের কাছে আরেকটি ট্যাংক, পিজি হাসপাতাল থেকে খুব বেশি হলে মাত্র দুইশ' মিটার দূরত্বে। রাত তখন ১১টা পেরিয়ে গেছে। কাদের সিদ্দিকী শেরেবাংলা নগরে রক্ষীবাহিনী ক্যাম্পে গেলেন। আনওয়ারুল আলম শহীদ, রক্ষীবাহিনীর উপ-পরিচালক কাদের সিদ্দিকীকে বলল, বেঙ্গল ল্যান্সারকে তিনটি ট্যাংক বের করার অনুমোদন দেয়া আছে। কিন্তু চারটি ট্যাংক কেন? শহীদ বলল, 'আপনি হয়তো একটি ট্যাংক দু'বার দেখেছেন।' হয়তোবা। শহীদ সাবেক ছাত্রনেতা এবং মুক্তিযোদ্ধা তার কথায় সন্দেহ করবার কোন কারণ নেই।ট্যাংকের মহড়া বৃহস্পতিবার রাতের নিয়মিত এক্সারসাইজ। এবং বেঙ্গল ল্যান্সার আর দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি মাসে দুইবার যৌথ মহড়া করে থাকে।বেশ রাত করে বাসায় ফিরলেন কাদের সিদ্দিকী। বোনকে বললেন সকালে তাকে যেন ঘুম থেকে জাগানো না হয়। অনেক দিন ধরেই ভোরে বের হতে হচ্ছে, কাল জেলা গভর্নর-মনোনীতদের প্রশিক্ষণ শেষে মধ্যাহ্নভোজন, সব মন্ত্রী উপস্থিত থাকবেন অনুষ্ঠানে। ধীরে সুস্থে গেলেই চলবে।
ব্রিগেডিয়ার জামিল, রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা প্রধান, অস্থিরভাবে রাত কাটালেন। তার স্ত্রী অসুস্থ এবং কাল সকালে তাকে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হবে। দায়িত্বটা নতুন কিছু নয়, কিন্তু তার কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। তাকে ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের পরিচালক নিয়োগ করা হয়েছে; কিন্তু তাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া হয়নি। জামিলের স্ত্রী তাকে ঘুমোতে বললেন। 'আমি ঘুমোতে পারছি না'-বললেন জামিল।

খন্দকার মোশতাকও নিদ্রাহীন রাত্রি অতিবাহিত করল। পুরনো ঢাকার ৫৪, আগামসিহ লেনে মোশতাকের বাসায় বেশকিছু মানুষের সমাগম দেখা গেল। তাদের মধ্যে একজন তার ভ্রাতৃষ্পুত্র মেজর রশীদ।
তাহের উদ্দিন ঠাকুর যেন উত্তপ্ত পাথরের ওপর বিড়াল একটি। যে কোন ডাকেই লাফিয়ে উঠছে। নামাজ পরে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। গোসল করে একেবারে তৈরি হয়ে রয়েছে যেন অপার্থিব সময়ে তাকে কারও সঙ্গে দেখা করতে হবে। বাড়ির একজন অতিথি ভাবলেন তাহের ঠাকুরের এই চাপা উত্তেজনা কেন।

কামাল, মুজিব-পুত্র, মধ্যরাতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরল, পরদিন মুজিবকে অভ্যর্থনা জানানোর আয়োজনে শেষ মুহূর্তের তদারকি সেরে। একই সময় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টেও একটি ষড়যন্ত্রে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছিল। তখনও অন্ধকার, বেঙ্গল ল্যান্সার যাদের কর্নেল ফারুক হত্যাকারীর দল হিসেবে প্রশিক্ষণ দিয়েছে, তাদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখল। কালো পোশাকের ল্যান্সারদের মনে হচ্ছিল যেন মিল্টনের প্যারাডাইস লষ্ট-এর এক দঙ্গল শয়তান। বিষ আর আগুন উগড়ে দিচ্ছে ফারুক। বলল সে, মুজিব দেশকে বিদেশি শক্তির কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। সেনাবাহিনী বিভক্ত করবে, ল্যান্সার ভেঙে দেবে। তাদের ভীতিকে নিয়ে খেলা করল ফারুক, উস্কে দিল তাদের ইসলামের নামে। আঘাত হানার এই সময়।

তিনটি কলামে ভাগ হয়ে তারা অগ্রসর হলো। দুই কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে তাদের লক্ষ্যস্থল।
ভোরের আগের ক্ষীণ আলোতে শেরে বাংলা এমএনএ হোস্টেলের কাছে তাদের ক্যাম্পের সামনে তড়িঘড়ি করে অবস্থান নিল রক্ষীবাহিনী। বেশিরভাগই লুঙ্গি পরিহিত এবং খালি পায়ে। এলাকাবাসীর কেউ কেউ তখনও ভাবছেন কী হচ্ছে এসব। রক্ষীবাহিনীকে প্রত্যাহার করা হলো। বিমানবন্দরের রানওয়ে ধরে একটি ট্যাংক এগিয়ে গেল দ্রুতগতিতে, দেয়াল ভেঙে রক্ষীবাহিনী ক্যাম্পের দিকে কামান তাক করল।

নগরীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ত্রিশটি ট্যাংক মোতায়েন করা হয়েছে।একই সঙ্গে মুজিব, তার ভগি্নপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত এবং ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণির বাড়ি ঘেরাও করা হলো।মুজিবের বাড়ি লক্ষ্য করে সৈন্যরা চারদিক থেকে গুলি ছুড়তে আরম্ভ করল। দ্বিতীয় তলায় সব শোওয়ার ঘর, জানালার ভেতর দিয়ে হিসহিস করে গুলি ঢুকছে। মুজিবের ছোট ভাই শেখ নাসেরের হাত আঁচড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল।
মুজিবের ড্রেসিং রুমটি মোটামুটি আড়ালে, সবাই গিয়ে সেখানে আশ্রয় নিল। এ যেন ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ যখন পাকিস্তানি সৈন্যরা বাড়ি ঘেরাও করেছিল তার পুনরাবৃত্তি।

কয়েকজন কর্মকর্তাকে ফোন করলেন মুজিব।

বেগম মুজিব শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে নাসেরের হাত বেঁধে দিলেন।

কামাল নিচে নেমে গার্ডদের প্রতিরোধ করার জন্য বলল, কিন্তু ইতিমধ্যেই তাদের নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। কামাল তখনও গার্ডদের প্রতিরোধে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করছে, কয়েকজন সেনা নিয়ে মেজর হুদা ঢুকল ঘরে। গার্ডরা তাকে স্যালুট করল।

হুদার এক সঙ্গী কামালকে গুলি করল।

ইতিমধ্যে ব্রিগেডিয়ার জামিল দ্রুতগতিতে মুজিবের বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন। মুজিবের বাড়ি পৌঁছানোর যখন আর কয়েকশ' মিটার বাকি, সোবহানবাগ মসজিদের কাছে অবস্থান নেয়া কয়েকজন সেনা চিৎকার করল 'থামো'। জামিল নিজের পরিচয় দিলেন। তারা জানত তার পরিচয়, তাকে আটকানোর জন্যই ওদেরকে এখানে দাঁড় করানো হয়েছে। 'এর আগে যে যাবে তাকে গুলি করার নির্দেশ রয়েছে আমাদের ওপর,' হুমকি দিল ওরা। জামিল তাদের কথা শুনলেন না, তাকে গুলি করল ওরা।

ততক্ষণে সৈন্যরা দলে দলে ঢুকে পড়েছে মুজিবের বাড়ির ভেতরে। একটা কক্ষ পেল তারা চারদিক থেকে বন্ধ রেহেনার বেডরুম। দরজা ভেঙে ঢুকলো সেনারা, এক কাপবোর্ড ভর্তি জিনিস ভেঙে চুরমার হয়ে মেঝেতে পড়ল।

'আমাকে দেখতে দাও, ওরা কী চায়, মুজিব বেরিয়ে এলেন কামরা থেকে, যেমনটি বেরিয়ে এসেছিলেন ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। পাকিস্তানি সৈন্যও মোকাবিলা করেছিলেন, কিন্তু এরা তো তারই লোক।

মুজিবের পরনে চেক লুঙ্গি এবং সাদা 'কুর্তি'।

সিঁড়িতে হুদার দেখা পেলেন। 'ও, তুমি, কী চাও তুমি?' মুজিব জিজ্ঞাসা করলেন। 'আমরা আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি' জবাব দিল হুদা। 'তুমি কি মনে কর এটা তামাশা?' গর্জে উঠলেন মুজিব। 'আমি দেশ ধ্বংস হতে দেব না।' হুদা অবিচলিত। একটি চাকর চিৎকার করে উঠল : 'কামাল ভাইকে মেরে ফেলেছে।' হাবিলদার মোসলেমউদ্দিন নিচ থেকে যে উঠে আসছিল, অটোমেটিক অস্ত্র দিয়ে পেছন থেকে গুলি করে মুজিবের শরীরটাকে ঝাঁজরা করে দিল।

যা কিছু পাচ্ছিল সৈন্যরা তুলে নিচ্ছিল। 'যা চাও সবকিছু নাও, আমাদের মেরো না।' বেগম মুজিব অনুনয় করলেন। কিন্তু গুলির শব্দে বেরিয়ে এলেন। 'ওকে মেরে ফেলেছ আমাকেও মেরে ফেল।' বিলাপ করে উঠলেন বেগম মুজিব। চিরতরে তাকে নীরব করে দেয়া হলো।

জামাল, তার স্ত্রী রোজি এবং সুলতানা কামালের স্ত্রী তখনও ড্রেসিং রুমে ছিল। স্টেনগানের এক ঝাঁক গুলি এবং তিনজনই মৃত।

সেনারা নাসেরকে বাথরুমে পেল এবং তাকে হত্যা করল। ভীতসন্ত্রস্ত রাসেল এক কোণায় গুটিসুটি হয়ে বসে ছিল। 'আমাকে মার কাছে নিয়ে যাও,' ফুঁপিয়ে উঠল রাসেল। উন্মত্ত এক নরঘাতক বলল, 'আমরা তোমাকে তোমার মার কাছেই নিয়ে যাব।' এক পুলিশ কর্মকর্তা রাসেলের জীবনের জন্য অনুনয় করল, 'ও একটা শিশু মাত্র।' পুলিশ কর্মকর্তাকে গুলি করে হত্যা করা হলো। গুলিতে রাসেলের এক হাত বিচ্ছিন্ন করল এক ঘাতক, তারপরও তার অনুনয়, 'আমাকে মেরো না, আমাকে মেরো না।' জবাবে পেল বুলেটে।

মায়ের পাশে পড়ে রইল রাসেল, মৃত।

মুজিবের বাড়িতে দেরি করে এলো ফারুক এবং রশীদ। উপরে উঠে গেল ফারুক, নিজেকে নিশ্চিত করল সবাইকেই হত্যা করা হয়েছে। একজনকে টেলিফোন করল সে।

শেখ মণি সাহায্যের জন্য ফোন করল, কিন্তু কোন সাহায্য এলো না। ঘরের দরজা ভেঙে এরই মধ্যে ঢুকে পড়েছে সৈন্যরা, ড্রয়িং রুমে এলো শেখ মণি। ওরা শেখ মণিকে গুলি করতে উদ্যত, তার স্ত্রী আরজু তীরবেগে আরেক প্রান্ত থেকে তার কাছে ছুটে এলো। 'এক পাশে সরে যাও,' ঘেউ করে উঠল এক সেনা সদস্য, তারপরই গুলি করল।

স্বামী এবং স্ত্রী একসঙ্গে রক্তের ধারার ওপর গড়িয়ে পড়ল।

মণি মারা গেল সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু আরজু তখনও বেঁচে ছিল। 'পানি দাও,' অতি কষ্টে শ্বাস টেনে বলল। 'মা তুমি আর বাবা কেন মেঝেতে শুয়ে আছ?' জিজ্ঞাসা করল তার তিন বছরের ছেলে তাপস। কোন জবাব নেই। 'কেন কথা বলছ না?' হতবুদ্ধি শিশু জিজ্ঞাসা করল। আরজুর মাতৃত্ব জেগে উঠল, 'আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাও, আমাকে বাঁচাও। আমার ছোট দুটি বাচ্চা রয়েছে।' অনুনয় করল। ক্ষীণ, শেষ কান্না।

তৃতীয়বারের মতো সন্তান সম্ভবা ছিলেন আরজু।

সেরনিয়াবাত যখন দেখলেন সৈন্যরা বাড়ি ঘেরাও করে ফেলেছে, মুজিবকে ফোন করলেন। মুজিব বললেন টেলিফোন করবেন তিনি, সেরনিয়াবাত তার জামাতা শেখ মণিকেও ফোন করলেন। ফোন বাজতেই থাকল, কিন্তু কোন জবাব নেই।

নিচে ড্রয়িং রুমে নেমে এলেন সেরনিয়াবাত। তার স্ত্রী, ছেলেমেয়েরা, আত্মীয় শহীদ, অতিথি এবং বাড়ির কাজের লোকরা সবাই, তাকে ঘিরে রয়েছে। শুধু একজন তার পুত্র হাসনাত ছাড়া। হাসনাত, মুক্তিযোদ্ধা, সামনের দরজা ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে, বেপরোয়া সে হুমকি দিয়েছে সামনে কেউ এগোলেই গুলি করবে। কিন্তু পরিস্থিতি খুবই হতাশাব্যঞ্জক। পেছনের জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়তে চেয়েছিল। সবখানেই সৈন্য। ফাঁদে আটকে গেছে হাসনাত। এক কক্ষে অপেক্ষা করতে লাগল হাতে রিভলভার নিয়ে মরার আগে অন্তত একজনকে মেরে মরবে।

মেজর শাহরিয়ার এবং হুদার (সেনাবাহিনীতে ছিল না) নেতৃত্বে একদল সেনা সবেগে বাড়িতে ঢুকল। 'তোমাদের কমান্ডিং অফিসারের সঙ্গে আমাকে কথা বলতে দাও,' বললেন সেরনিয়াবাত। শাহরিয়ার বলল, 'আমাদের কোন কমান্ডিং অফিসার নেই। কিন্তু আপনি কে?' যখন সেরনিয়াবাত নিজের পরিচয় দিলেন, শাহরিয়ারের ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। পর মুহূর্তেই বুলেটের আঘাতে মেঝেতে পড়ে গেলেন সেরনিয়াবাত। হামিদা ওর বাবার ওপর পড়ে গেল বাবাকে রক্ষা করার জন্য। তার পেছনে আর পায়েও গুলি লাগল। বাবু হাসনাতের শিশুপুত্র, ভয়ে কেঁদে উঠল। শহীদ ওকে তুলে নিল, দুজনকেই গুলি করল ওরা। উন্মত্তের মতো গুলি ছুটছে চারদিকে। আরও যাদেরকে হত্যা করা হলো, তারা হচ্ছে সেরনিয়াবাতের চৌদ্দ বছরের মেয়ে বেবী, নয় বছরের ছেলে আরিফ এবং তিনজন অতিথি।

সেরনিয়াবাতের স্ত্রী আমিনা, কন্যা হামিদা এবং পুত্র খোকন আহত হলো।

নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, হুদার এক ভাই সেরনিয়াবাতের বাড়ির ভেতর খুঁজে এসে জিজ্ঞাসা করল, 'হাসনাত কোথায়?'

হত্যাকারীরা সেরনিয়াবাতের আত্মীয় শহীদকে হাসনাত বলে ভুল করেছে।

হাসনাতকে খোঁজা শুরু হলো।

রমনা থানার ওসি বেগম সেরনিয়াবাত, হামিদা এবং খোকনকে হাসপাতালে পাঠালেন।

গুলির আওয়াজে, ধানমন্ডিতে বসবাসকারী এক ভারতীয় কূটনীতিক ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালেন। মাত্র কয়েক হাত দূরে আরেকটি ব্যালকনিতে মুক্তিযোদ্ধা এক ব্যবসায়ী টান টান উত্তেজনায় কিছু একটা প্রত্যাশা করছিলেন।

একটা রকেট ছোড়ার শব্দ পাওয়া গেল। 'অপারেশন লিক্যুইডেশন' সম্পন্ন হয়েছে এটা তারই সংকেত।

ব্যবসায়ী-মুক্তিযোদ্ধা মাথা নাড়লেন, যেন কোন অভিনন্দন গ্রহণ করছেন। মুখে হাসি নিয়ে বলল, 'সব শেষ, রেডিও শুনুন।'

সকাল ৬.০১ মিনিট।

ঢাকা রেডিও ঘোষণা করছে সেনাবাহিনী মুজিব সরকারকে উৎখাত করেছে। ঘোষক, যে নিজেকে মেজর ডালিম হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে, বলছে : খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানকে আটক করা হয়েছে এবং তার সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে।'

এর পরপরই আবার এক ঘোষণায় বলা হলো : 'আজ সকালে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের সময় উচ্ছেদ করা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান তার বাসভবনে নিহত হয়েছেন।'

মোহাম্মদপুরের একটি বস্তি এলাকায় আটজন নিহত হন। প্রচ- শব্দে আশপাশের সবাই জেগে উঠল। আলী আকসাদ ভাবলেন এটি আরেকটি অন্তর্ঘাতমূলক ঘটনা, মুজিবের বাড়িতে ফোন করলেন। টেলিফোন বাজছে, কিন্তু কোন জবাব নেই। শেখ মণির বাড়িতে ফোন করলেন। আবার টেলিফোন বাজছে, কিন্তু আবারও কোন জবাব নেই। টেলিফোনের আওয়াজটাই যেন অশুভ। ফোন করলেন মুজিব সরকারের মন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ এবং আরও দু'একজনকে। ফিরতি ফোন করে তারাও জানালেন মুজিবের বাড়ি থেকে কোন জবাব পাওয়া যাচ্ছে না।

আকসাদ রেডিওটা ছাড়লেন। রেডিও তখন ঘোষণা করছে যে মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। ভয় গ্রাস করল আকসাদকে। আরেকটি ইন্দোনেশিয়া?

টেলিফোনে এক বন্ধু আকসাদকে জিজ্ঞাসা করলেন, 'খবরটা শুনেছ?' 'শুনেছি', আকসাদের জবাব। 'এক্ষুনি বাড়ি ছাড়ো' বলেই বন্ধুটি টেলিফোন বিচ্ছিন্ন করে দিলেন।

আকসাদকে আর বলার দরকার হলো না। দুই সন্তান এবং স্ত্রীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। বাচ্চাদের বললেন, ওদের বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

অন্ধ ভয়ে দ্বিতীয়বারের মতো দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেন।

কাদের সিদ্দিকীর বোন চিৎকার করে উঠল, 'এই ওঠো। তোমাকে কে ফোন করেছে।' ফোনে তার আর এক বোন। 'অভ্যুত্থান হয়ে গেছে,' বলল সে। 'অভ্যুত্থান?' জিজ্জাসা করল কাদের সিদ্দিকী কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই। 'এই মুহূর্তে বাড়ি ছাড়। যে কোন মুহূর্তে ওরা তোমার খোঁজে আসতে পারে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে।' টেলিফোনের ভেতর দিয়ে রেডিওর ঘোষণা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।

একটা হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে বাড়ি ছাড়ল কাদের সিদ্দিকী। কিন্তু ড্রাইভার তাকে নিয়ে যাবে না। যে মানুষটি তিন বছর ধরে বিশ্বস্ততার সঙ্গে কাজ করছে, সংকটের সময় গাড়ি চালাতে অস্বীকার করছে। একটু চিন্তা করল কাদের সিদ্দিকী। ড্রাইভারকে বলল, 'চাবিটা আমাকে দাও।' কোন জবাব দিল না গাড়ির চালক; সে পাশের বাড়ির গাড়িটি নিয়ে এসে প্রায় কর্তৃত্বের সুরে বলল, 'উঠুন।'

গাজী গোলাম মোস্তফা, রেডক্রসের প্রধান, দেয়াল টপকে পাশের বাড়ির গরুর খোঁয়াড়ে লুকালো। প্রায় ভেঙে পড়েছে মানুষটি। তার প্রতিবেশীরা প্রাণে ধরে তাকে ধরিয়ে দিতে পারবে না, কিন্তু তাকে আশ্রয় দেয়াও বিপজ্জনক।

আমেরিকান রাষ্ট্রদূত ইউজিন বোস্টার-এর সহকারীরা পাগলের মতো চেষ্টা করছে মুজিব হত্যার খবর তাকে দিতে। কিন্তু তিনি বাসায় নেই, এমনকি তার নিয়মিত আস্তানাগুলোতেও তিনি নেই। ভোর ছয়টায় কোন জাহান্নামে থাকতে পারে সে?

রশীদ সঙ্গে সঙ্গে তার চাচা মোশতাককে জানাল মিশন সম্পন্ন হয়েছে। তারপরও রশীদ যখন কয়েকজন সৈন্য নিয়ে তাকে রেডিও স্টেশনে নিয়ে আসতে গেল, মোশতাক একাধিকবার ভ্রাতৃষ্পুত্রকে জিজ্ঞাসা করল, 'তুমি নিশ্চিত যে সে মারা গেছে?'

পদ্মা নদীর এক মাঝির তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল : 'কোন বাপের ব্যাটা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারবে না।'

মোশতাকের মন্ত্রিসভার এক কর্মকর্তা তার স্ত্রীকে বলেছিলেন, 'মোশতাকের চোখগুলো দেখেছ? সাপের মতো চোখ। এই লোক যা চায় তা পাওয়ার জন্য যে কাউকে হত্যা করতে পারে। তাকে দেখলেই আমার অশ্বস্তি লাগে।'

তার স্ত্রী তার ভয় দেখে হেসেছিলেন, কিন্তু মোশতাক তখন রাষ্ট্রপতি। কী হবে এখন?

বিষদাঁত বের করেছে সাপ।

মাহবুবুল আলম চাষী ১৩ আগস্ট কুমিল্লা থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। কুমিল্লা একাডেমিতে তার সহকর্মীরা ভেবে অস্থির কাউকে কিছু না বলে কোথায় যেতে পারে সে। তবে ১৫ আগস্ট সকালে মোশতাক এবং তাহের ঠাকুরের সঙ্গে ঢাকা রেডিও স্টেশনে আবার উদয় হলো সে।

১৯৭১ সালে তিনজনের যে অশুভ চক্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধকে ব্যর্থ করে দিতে চেয়েছিল এবার তারা বিজয়ী হলো।

নয়াদিলি্লতে, যখন মিসেস গান্ধী স্বাধীনতা দিবসের সমাবেশে ভাষণ দেয়ার জন্য লালকেল্লার উদ্দেশে যাত্রা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন শুনলেন মুজিব হত্যার কথা। হতভম্ব হয়ে পড়লেন তিনি।

মুজিবকে সতর্ক করেছিলেন তিনি যে, তার জীবনের হুমকি রয়েছে, কিন্তু হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন এই বলে : 'ওরা আমার সন্তানের মতো।'

নিচের ঘোষণাটি নিয়মিত বিরতিতে বারবার ঢাকা রেডিও স্টেশন থেকে ঘোষিত হতে থাকল : দুর্নীতি, অন্যায় এবং স্বৈরতন্ত্র খতম হওয়ার পর এখন জনগণের সুযোগ হবে দেশের জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করার। চলুন আমরা সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করি।'

'জাহান্নামে যাক!' নিজের রেডিওর ওপর ঘুষি মেরে চিৎকার করে উঠল আশরাফ, মুক্তিযোদ্ধা। 'সুযোগ! সুযোগ! শেষ পর্যন্ত মোশতাকের ষড়যন্ত্রই সফল হলো। দালালগুলো সব বেরিয়ে আসবে। আবার তাদের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ করতে হবে।'

কাঁদছিল আশরাফের স্ত্রী।

মুজিবের জন্য অনেক স্ত্রীলোকই প্রকাশ্যে কেঁদেছে।

এক সাংবাদিক আনন্দের সঙ্গে প্রতিবেশীকে বলল : 'মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।' হঠাৎ তার মনে হলো আনন্দটা আগেই করে ফেলছে কী না, উদ্বিগ্ন হলো সে। 'যদি আসলেই তার মৃত্যু না হয়ে থাকে তাহলে কী হবে?' বলল সে। রেডিও ছাড়ল সে আবার নিশ্চিত হতে চায় যে মুজিব নিহত হয়েছেন। রেডিও তাকে নিশ্চিত করল। ভয় পাওয়ার মতো এই মুহূর্তে কিছু নেই।

সাংবাদিকটি মুসলিম লীগার। কিন্তু মুজিবের অনেক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও তার জন্য শোক করেছে।

সাভারে, ঢাকা থেকে প্রায় পনের কিলোমিটার দূরে, রক্ষীবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে কেউ কেউ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেয়েছিল। অনেকেই [হত্যাকারী] মেজরদের বিরুদ্ধে দ্বিধা করেছে। 'আমাদের কোন ট্যাংক-বিধ্বংসী কামান নেই,' দ্বিতীয় গ্রুপটি বলেছে। রক্ষীবাহিনীর মহাপরিচালক নুরুজ্জামান দেশের বাইরে লন্ডনে। সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো কেউ ছিল না। মুজিবের রাজনৈতিক সহকারী তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করল রক্ষীবাহিনী। কিন্তু তাদের প্রতিরোধ করার জন্য নির্দেশ কিভাবে দেবে প্রচ- মর্মাহত তোফায়েল আহমেদ।

ঢাকায় অবস্থানরত এক ভারতীয় সাংবাদিককে তার স্ত্রী ঘুম থেকে তুললেন। 'ওঠো। কিছু একটা হয়েছে। কারফিউ জারি করা হয়েছে। রেডিও শোন।' মুজিবকে যে হত্যা করা হয়েছে সেটা স্বামীকে আর বললেন না তিনি।

রেডিও বারবার ঘোষণা করছে, মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে এবং খন্দকার মোশতাক নতুন রাষ্ট্রপতি।

সাংবাদিক একটি রিপোর্ট টাইপ করলেন, সচকিতভাবে তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় টেলিগ্রাফ অফিসে গেলেন। স্টেডিয়ামের সামনে একটি ট্যাংক রয়েছে, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ কভার করার জন্য।

এখানে সেখানে মানুষের ছোট ছোট জটলা।

টেলিগ্রাফ অফিসে তাকে বলা হলো, 'টেলিগ্রামটি রেখে যেতে পারেন, কিন্তু ওটা পাঠানো হবে না। আমাদের ওপর নির্দেশ রয়েছে কোন টেলিগ্রাম পাঠানো যাবে না।' এরই মধ্যে টেলিগ্রাফ অফিসে এক সেনা কর্মকর্তা চলে এসেছে।

গভীর ঘুমে ছিল এক রেডিও কর্মকর্তা। তাকে জাগালো একটা টেলিফোন কল, কিন্তু আলসেমি করে ফোনটি ধরল না। তার স্ত্রী বললেন, 'তোমাকে জরুরিভাবে রেডিও স্টেশন থেকে ডেকে পাঠিয়েছে।' 'এই মুহূর্তে চলে এসো,' কর্তৃত্বের সুরে আদেশ হলো। সে ভাবল কী হয়েছে। এখন প্রথম সম্প্রচারের সময় হয়নি, কিন্তু অভ্যাসবশত রেডিওটি অন করলেন। ওহ, আল্লাহ! ভয়াবহ, ভয়ানক।

রেডিও স্টেশনে পৌঁছে দেখল মেজর শাহরিয়ার চার্জে রয়েছে। সামনের টেবিলে একটি স্টেনগান। এক কর্মকর্তা বিনীতভাবে বললেন, 'সবাই কাজ করছে।' 'সবাই কাজ করবে, যতক্ষণ এখানে অস্ত্রটি রয়েছে' শাহরিয়ারের ঔদ্ধত্য মন্তব্য। অস্ত্রটির ওপর হাত বুলিয়ে নিল কথায় জোর দেয়ার জন্য।

একই ঔদ্ধত্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মতো, যখন সামরিক শাসন জারি করা হয়েছিল দেশটিতে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর।

একজন কর্নেল যখন অফিসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, তখন ফোন পেল এক সহকর্মীর। 'তুমি কি রেডিওর খবর শুনেছ।' শোনেনি, জানাল সে। তাহলে শোন।'

একটি আমেরিকান বার্তা সংস্থা ঘটনার কয়েক মিনিটের মধ্যেই মুজিব হত্যা এবং অভ্যুত্থানের খবর প্রচার করেছে। রিপোর্টে উল্লেখ করা হলো 'বাংলাদেশ ইসলামিক রিপাবলিক' হয়ে গেছে। একেবারে সম্পূর্ণ বিপরীত?

অজ্ঞাতনামা কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে রেডিও পাকিস্তানও জানাল বাংলাদেশ এখন একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র।

এসব খবরের কোন তাৎক্ষণিক স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতি কোনটাই ছিল না। তবে মোশতাক যখন ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতায় এসেছে তখন এটা বাহুল্য মাত্র। বাংলাদেশ বেতার এরই মধ্যে রেডিও বাংলাদেশ হয়ে গেছে।

পশ্চিম ইউরোপীয় একটি দেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত চিন্তা করছিলেন, এই অভ্যুত্থানে ভুট্টো কী ভূমিকা পালন করেছেন। ভুট্টো যখন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, তখন তাকে তেহরানে পাঠিয়েছিলেন ইরানের রাজধানীতে ভুট্টোর 'লোকটির' কাছ থেকে একটি প্যাকেট নিয়ে আসতে। তখন তরুণ কূটনীতিক সে, সেই প্যাকেটটি তার রুম থেকে গায়েব হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তার কাছে মনে হয়েছিল সেটা অর্থহীন একটা কাজ।

হাসিনা এবং রেহেনা, ১১ আগস্ট থেকে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত মুজিবের দুই কন্যা, ছিল ব্রাসেলসে। রেহেনা চেয়েছিল সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফিরে আসতে। ১২ আগস্ট বোনকে বলল, 'আমি ভীতিকর সব স্বপ্ন দেখছি। আমি দেখছি মানুষজন আবার পালাচ্ছে। আমি ভয় পাচ্ছি। দেশে ফিরে যেতে চাই।'

যাহোক, ১৪ আগস্ট সন্ধ্যায় হাসিনা-রেহেনা দু'জনই বেশ উৎফুল্ল ছিল।

একটা দাওয়াত থেকে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। সকালে তারা ফ্রান্সের উদ্দেশে যাত্রা করবে, তারপরও রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের কন্যার সঙ্গে আড্ডা মারছে। কুসংস্কারের ভীতি হাসিনাকে যেন পেয়ে বসল। 'আমরা এত হাসছি। ভাবছি পরে না কাঁদতে হয়।' বলল হাসিনা।

সকালে বন থেকে হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদের কাছে টেলিফোন এলো। তিনি তার স্ত্রীকে বললেন ফোন ধরতে। না, শুধু ড. ওয়াজেদের সঙ্গেই কথা বলবেন টেলিফোনকারী। ভয়ানক কিছু এটা হয়েছে, ভাবলেন ড. ওয়াজেদ।

'এই মুহূর্তে বন-এ ফিরে আসুন,' টেলিফোনকারী বললেন।

যখন হাসিনাকে বলা হলো, বাংলাদেশে অভ্যুত্থান হয়েছে, তার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, 'কেউ বেঁচে নেই।'

সশস্ত্র বাহিনীর সিনিয়র অফিসাররা জেনারেল হেডকোয়ার্টার্সে (জিএইচকিউ) তর্ক করছে, মেজর যারা শুধু অভ্যুত্থানই ঘটায়নি, ঔদ্ধত্যভাবে ঘোষণাও করেছে যে সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। তারা অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক দিকটি হয়তো উপেক্ষা করতে পারে কিন্তু শৃঙ্খলার প্রশ্ন তো রয়েছে। কয়েকজন মেজরকে আগেই অসম্মানজনকভাবে সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, কিন্তু অন্যরা তো সার্ভিসে রয়েছে। তাদের যদি ছাড় দেয়া হয় তবে সশস্ত্র বাহিনীতে চেইন অফ কমান্ড বলে কিছু থাকবে না। তখন সিনিয়র অফিসারদের অবস্থান কোথায় হবে?

দুই-একজন অফিসার মেজরদের বিরুদ্ধে তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলল। কিন্তু অন্যরা দ্বিধাগ্রস্ত, পরিস্থিতি পরিষ্কার বোঝা পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করার পক্ষপাতি। যতক্ষণ পর্যন্ত চাকরি নিশ্চিত, ততক্ষণ ঝুঁকি নেয়া কেন?

আর্মি চিফ অফ স্টাফ মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ, কিন্তু তিনি একজন উদ্যমহীন মানুষ এবং তার কর্তৃত্ব সব সময়ই চ্যালেঞ্জ হয়েছে তারই ডেপুটি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান দ্বারা।

[কিলার] মেজরদের বিষয়ে কোন অবস্থান নেয়া হবে এটা নিয়ে স্টাফ অফিসাররা তর্ক করেই চলেছে, ডালিম জিপ চালিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ঢুকল, সিনিয়রদের বলল দ্রুত মনস্থির করতে। ষড়যন্ত্রকারীরাই কমান্ডে চলে এলো।

তখন সকাল ১০টা বেজে গেছে। চার ঘণ্টা নষ্ট হয়ে গেছে। সিনিয়র স্টাফ অফিসাররা যদি কোন ব্যবস্থা আদৌ নিতে চাইত তাহলে আরও অনেক আগেই তারা কাজে নেমে পড়ত।

সব বাহিনীর প্রধানরা নতুন সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করল।

দ্বিতীয় আর্টিলারি রেজিমেন্টের একজন অফিসার সকালেই কর্নেল তাহেরকে ফোন করে বলল যে মেজর রশীদ তাকে বাংলাদেশ বেতারে উপস্থিত থাকতে বলেছে। আর্টিলারি অফিসার তাহেরকে এও জানায় যে, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।

শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে এবং খন্দকার মোশতাক ক্ষমতা দখল করেছে, খবরটি তাহেরকে আঘাত করল। 'আমি ভাবলাম,' বলল তাহের, 'এই ঘটনা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্ম দেবে, এই এই পরিস্থিতে আমরা আমাদের স্বাধীনতাও হারাতে পারি।'

তাহের আরও বলছে : গভীর উদ্বেগ নিয়ে সকাল সাড়ে ১১টায় আমি বাংলাদেশ বেতার ত্যাগ করলাম। ধারণা করলাম জাতির জনকের হত্যাকা-ের পেছনে বহিঃশক্তি জড়িত ছিল।' সেইদিন যা ছিল তাহেরের ধারণা, তাই বিশ্বাসে পরিণত হবে দু'দিনে।

রেডিও স্টেশন থেকে মোশতাক আর তাহের ঠাকুর বায়তুল মোকাররম মসজিদে গেল। ওদের গাড়ির সামনে একটি ট্যাংক এবং পেছনে দুটি সামরিক যান। মোশতাকের চোখ বন্ধ, যেন গভীর ধ্যানে মগ্ন, তাহের ঠাকুর ঠোঁটে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

মোশতাকের গাড়ি জাতীয় প্রেসক্লাব পেরোবার সময় কয়েকজন সাংবাদিক দৌড়ে বেরিয়ে এলো তার দিকে হাত নাড়ল। এক কবি [এই সাংবাদিকদের উদ্দেশে] ক্ষোভে ফেটে পড়লেন, 'আপনাদের কি আত্মসম্মানবোধও নেই। গতকালও আপনারা শেখ মুজিবকে জিন্দাবাদ দিচ্ছিলেন।'

কেউ জবাব দিল না। এক সাংবাদিক, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের দালাল হিসেবে কাজ করেছে, সাফল্যের জন্য মোশতাককে অভিনন্দন জানাল। ' ভয়ে ভয়ে রেডিও ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানি অভ্যুত্থান সফল হয়েছে। না হলে ওরা আমাকে ধরবার জন্য আসত।' বলল দালাল সাংবাদিকটি।

কয়েকজন ছিল যারা আনন্দিত হয়েছে, কিন্তু হাজার হাজার ভেবেছে ব্যক্তিগত ক্ষতি হয়ে গেল।

ক্ষমতা দখলের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মোশতাক মোহাম্মদ উল্লাহকে উপ-রাষ্ট্রপতি বানাল। মুজিবের সর্বশেষ মন্ত্রিসভায় দু'জন সাবেক রাষ্ট্রপতি ছিলেন আবু সাঈদ চৌধুরী এবং মোহাম্মদ উল্লাহ। মোশতাক দু'জনকেই অন্তর্ভুক্ত করেছে। আবু সাঈদ চৌধুরী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে কামাল হোসেনের স্থলাভিষিক্ত হলো।

নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান এবং মোশতাক ১৯৭১ সালে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠন করেছিলেন। মোশতাক তার সহকর্মীদের অজ্ঞাতে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে আপস করবার চেষ্টা করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় মোশতাক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল সহকর্মীদের কাছ থেকে। এখন সফল হলো ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে।

তাজউদ্দীন মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন ১৯৭৪-এর অক্টোবরে। দল অথবা সরকার কোথাও তার কোন অবস্থান ছিল না। যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি অত্যন্ত তেজস্বী ছিলেন, কিন্তু এখন তিনি এক বিধ্বস্ত মানব।

সৈন্যরা যখন তাজউদ্দীনের বাসায় গেল, তিনি বললেন,'তোমরা আমার নেতাকে হত্যা করেছ, আমাকেও হত্যা কর।' তার ভয়ই সত্য হলো, তার চরম শত্রু এখন ক্ষমতায়। অন্য কোন পরিস্থিতি হলে হয়তো প্রতিরোধ যুদ্ধ করতে পারতেন, কিন্তু এখন তিনি কীইবা করতে পারেন?

মুজিবের মৃত্যুর পর সংবিধান অনুযায়ী সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি। কিন্তু তিনি সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়ার মানুষ ছিলেন না। এক বন্ধু সৈয়দ নজরুল ইসলামকে কিছু একটা করবার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন, কিন্তু সামনের চিন্তা করার প্রশ্ন্ তে;িনি ছিলেন অতিরিক্ত নার্ভাস।

এএইচএম কামরুজ্জামান চমৎকার একজন আরামপ্রিয় মানুষ। একজন প্রতিরোধ নেতা হিসেবে তাকে কল্পনা করা কঠিন।

এম মনসুর আলী, মুজিব সরকারের প্রধানমন্ত্রী, মনে করেননি কেউ তার নির্দেশ মেনে চলবে, কিন্তু আত্মসমর্পণ করবেন না। লুকিয়ে থাকলেন, কিন্তু দুইদিন পর সৈন্যরা তাকে খুঁজে বের করল কলাবাগান থেকে, তার বাড়ির খুব দূরে নয়।

ড. কামাল অভ্যুত্থান সম্পর্কে জানতে পারলেন যখন তিনি বেলগ্রেড ঢাকার পথে রওনা হয়েছেন। হামিদা, তার স্ত্রী সম্প্রতি ঢাকায় ফিরেছেন, কিন্তু তার ফিরে যাওয়াটা বিপজ্জনক হবে।

বন-এ নেমে গেলেন তিনি।

না, কোন বিবেচনাতেই তিনি মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দেবেন না। 'আমাদের সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে হবে, অথবা সম্মানের সঙ্গে মরতে হবে।' কয়েকজন বন্ধুকে বললেন তিনি।

বিলাতেই ফিরে যাচ্ছেন তিনি।

মুজিবের মন্ত্রিসভার কয়েকজন ইতোমধ্যেই মোশতাকের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে অথবা হাত মেলানোর জন্য অধীর হয়ে পড়েছে। অবশ্য অন্যদেরকে সেনাদেরই নিয়ে যেতে হয়েছে বঙ্গভবনে শপথ অনুষ্ঠানে।

ফণী মজুমদার, হৃদরোগে আক্রান্ত, পিজি হাসপাতালে, সৈন্যরা যখন এলো তাকে বঙ্গভবনে নিয়ে যেতে তার সঙ্গের রোগী, কবি জসীমউদদীন তাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলেন শক্ত করে, যেতে দেবেন না। 'একজন ভালো মানুষ, তাকে নিয়ে যেও না।' অনুনয় করেছিলেন কবি।

অপরাহ্নে ১৬ সদস্যের মন্ত্রিসভা, যার মধ্যে ১০ জন কেবিনেট মন্ত্রী এবং ছয় জন প্রতিমন্ত্রী। তাদেরকে শপথ পাঠ করালেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি জাস্টিস এ.ই. মোহাম্মদ হোসেন।

কেবিনেট মন্ত্রীদের মধ্যে দু'জন ছিল ফণী মজুমদার এবং মনোরঞ্জন ধর, তাদের প্রয়োজন ছিল মোশতাকের। সে যারপরনাই চেষ্টা করছিল এমন একটা ধারণা দিতে যে মুজিবের জায়গায় তার রাষ্ট্রপতি হওয়া ছাড়া আর কিছুই বদলায়নি।

তাহের উদ্দিন ঠাকুর এত ফিটফাট ছিল যে, কোন কোন মহিলা তাকে 'দুলা মিয়া' বলেই ডাকতে লাগল। সে এখন 'বরের সঙ্গী' মোশতাকের মিতবর।

মাত্র একজন প্রতিমন্ত্রী, কিন্তু সন্দেহের কোন অবকাশই নেই যে সে নতুন সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।

বাংলাদেশের রক্তাক্ত ঘটনাবলিতে ভারতের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে উদ্বিগ্ন নতুন সরকার ভারতের কাছে আলোচনার প্রস্তাব পাঠাল। প্রথম সংবাদ সম্মেলনেই তাহের ঠাকুর জোর দিয়েই বলল, ইতিমধ্যেই তারা ভারতের সঙ্গে কথা বলছে, কিন্তু সে পাকিস্তানের কথা উল্লেখ করেনি। আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের নামটিও যেন তার মন থেকে মুছে গেল। 'আমেরিকান রাষ্ট্রদূত কি যেন তার নাম?' জিজ্ঞাসা করল। 'বোস্টার' একজন সাংবাদিক বলল। 'বোস্টার' পুনরাবৃত্তি করল তাহের ঠাকুর। 'বোস্টার, ইউজিন বোস্টার,' যোগ করল সাংবাদিক।

ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ফোন করল কর্নেল ফারুককে, যেন দাফন করার জন্য কর্নেল জামিলের মৃতদেহ ফিরিয়ে দেয়া হয়। এক শর্তে ফারুক সম্মত হলো, কর্নেল জামিলকে ঢাকা সেনানিবাসে দাফন করতে হবে।

মুজিবের স্ত্রী, তিন পুত্র এবং দুই পুত্রবধূকে গোপনে দাফন করা হলো রক্তমাখা কাপড়েই বনানী কবরস্থানে। ধর্মীয় আচার অনুসরণ করে কোন শেষকৃত্যানুষ্ঠান করা হলো না। কবরগুলোকেও চিহ্নিত করা হয়নি।

মুজিবের জন্যও বনানী কবরস্থানে কবর খোঁড়া হয়েছে, কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা ঠিক করল মুজিবকে ঢাকায় দাফন করা বিপজ্জনক।

জাতির উদ্দেশে দেয়া মোশতাকের ভাষণের কপি রেডিও স্টেশনে উপস্থিত সবার মধ্যেই বিতরণ করা হলো। মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ [তখনও] সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ, কিন্তু নিজের প্রকৃত অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত নয়, মোশতাকের ভাষণের বক্তব্যের প্রশংসা করল। 'তুমি কি মনে করো এসব কিছু একদিনে হয়েছে?' মোশতাক জবাব দিল। অন্তত একবার হলেও মোশতাক তার ভেতরের কথাটা চেপে রাখতে পারল না।

জাতির উদ্দেশে দেয়া প্রথম ভাষণে মোশতাক ঘাতক [মেজরদের] 'সূর্য সন্তান' এবং 'অকুতোভয় হৃদয়ের বীর' হিসেবে প্রশংসা করল। কিন্তু সাফল্যের সময়ও সে কাপুরুষ। সে বলার চেষ্টা করল 'ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই' রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে 'তাকে সরকারের দায়িত্ব নিতে হয়েছে'। সে বলল, 'আমাদের স্বাধীনতা পাওয়ার প্রচেষ্টায় বন্ধুপ্রতিম দেশের অনেককেই জীবন দিতে হয়েছে।' মোশতাক ভারত, বন্ধুপ্রতিম দেশটির নাম উল্লেখ করল না। বলল,'স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে ত্রিশ লক্ষ শহীদের পবিত্র রক্ত এবং দুই লক্ষ মা ও বোনের সম্মানের বিনিময়ে।' তারপরও মোশতাক তার ভাষণ শেষ করল, 'বাংলাদেশ জিন্দাবাদ' বলে। 'জয় বাংলা'-দ্রোহের রণধ্বনি, বিজয়ের রণধ্বনি, তার এবং তার সহ-ষড়যন্ত্রকারীদের জন্য নয়। তারা মারাত্মকভাবে ভীতসন্ত্রস্ত, সেই সেস্নাগানের, যে সেস্নাগান দিয়ে হাজারও মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে গিয়ে।

বাংলাদেশের রক্তাক্ত ঘটনাবলি সম্পর্কে ভুট্টোর প্রতিক্রিয়ায় যদিও কোন আবেগ ছিল না, তবে সঠিক ছিল। তার বক্তব্য, 'আমি মর্মাহত, যে শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের সদস্যদের এমন মর্মান্তিক মৃত্যু হলো।' ১৫ আগস্টই ভুট্টো শুধু বাংলাদেশের নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি, ব্যক্তিগত আহ্বানও জানিয়েছে তৃতীয় বিশ্বের কাছে বিশেষত মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর কাছে বাংলাদেশের নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য। এই আহ্বানে সে বলেছে, 'যে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র আমাদের দেশকে বিচ্ছিন্ন করেছে, যে ষড়যন্ত্র পরবর্তী সময়ে আগ্রাসনে রূপ লাভ করে, সেই ঘটনা থেকে সৃষ্ট তীব্র মনোকষ্টের সচেতনতা থেকে উৎসারিত।'

ঢাকা গণহত্যার দিনে, ভুট্টো বাংলাদেশের মানুষের জন্য 'উপহার' ঘোষণা করল। বলল ভুট্টো_ 'বাংলাদেশের মানুষের প্রতি স্বতস্ফূর্ত সদিচ্ছা হিসেবে আমরা পাকিস্তানের মানুষের পক্ষ থেকে দ্রুতই ৫০,০০০ টন চাল, এক কোটি গজ সুতি কাপড়, ৫০ লাখ গজ সূক্ষ্ম কাপড় উপহার হিসেবে বাংলাদেশে পাঠাচ্ছি।' ভবিষ্যতে 'সামর্থ্য অনুযায়ী আরও উপহার' দেয়ারও প্রতিশ্রুতি দিল ভুট্টো।

'উপহার' মুজিবকে হত্যা করবার জন্য উপহার?'

১৬ আগস্ট সকালে, হত্যাকা-ের একদিন পর, হেলিকপ্টারে করে একজন মেজর, একজন লেফটেন্যান্ট এবং আরও কয়েকজন সৈন্য টুঙ্গিপাড়ায় নামল। তারা গ্রামের মসজিদের পেশ ইমামকে ডাকল, জিজ্ঞাসা করল তারা শেখ মুজিবুর রহমানকে দাফন করবে কি না, যদি মৃতদেহ তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

গ্রামবাসীদের বলা হলো তাদের হয়তো দশ-বারোটা কবর খুঁড়তে হবে, তবে উপস্থিত ক্ষেত্রে একটি কবর প্রস্তুত করলেই চলবে।

বেলা আড়াইটার দিকে সেনা কর্মকর্তারা কফিনে করে শেখ মুজিবুর রহমানের মৃতদেহ নিয়ে টুঙ্গিপাড়ায় ফিরে এলো। ইতোমধ্যে একটি শক্তিশালী পুলিশ দল নিয়ে গোপলগঞ্জের সাব-ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত হলো।

মেজর চাইল [সঙ্গে সঙ্গেই] মৃতদেহ কবরে নামিয়ে দিতে। কিন্তু এটা অনৈসলামিক। গ্রামবাসীরা ভীত-শিহরিত হলো। গ্রামবাসীরা জোর করল, 'আমাদের মৃতদেহ দেখতে হবে। 'তোমরা মৃতদেহ না দেখে কবর দিতে পার না' মেজরের প্রশ্ন। 'আমরা পারি,' বললেন মৌলভী শেখ আবদুল হাকিম, পেশ ইমাম, 'যদি আপনারা তাকে শহীদ ঘোষণা করেন।' সেনা কর্মকর্তা নিশ্চুপ। 'শেখ আবদুল হাকিম দাবি করলেন, 'আপনারা কি ইসলামী রীতি অনুযায়ী দাফন-কাফন করে মাটি দিবেন?'

নীরবতা।

উত্তেজনার মুহূর্ত। সেনা কর্মকর্তারা সংকটে পড়েছে। তাদের নির্দেশ অত্যন্ত পরিষ্কার : গ্রামবাসীকে মুজিবের মৃতদেহ দেখতে দেয়া যাবে না। কিন্তু একজন মুসলমানকে ইসলামী রীতি অনুযায়ী দাফন না করলে [গ্রামবাসী] মুসলমানরা বিদ্রোহ করতে পারে। মেজর বলল, 'হ্যাঁ, দাফন-কাফন হবে, কিন্তু তাদের উপস্থিতিতে হতে হবে।'
কফিন খোলা হলো।

মুজিবের শরীর বুলেটে ঝাঁজরা। বরফ দেয়া কফিন রক্তে লাল।

পাথরের নীরবতায় গ্রামবাসী কফিন ঘিরে দাঁড়াল।

এই নীরবতা বিপজ্জনক। প্রতি মুহূর্তে আশপাশের গ্রাম থেকে শত শত লোক আসছে। [পুলিশ বেষ্টনী দিয়ে] ওদেরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হলো। কিন্তু যে কোন মুহূর্তে বেষ্টনী ভেঙে ফেলতে পারে। 'তাড়াতাড়ি করো। কী হলো। আমাদের তো ফিরতে হবে,' চিৎকার করল লেফটেন্যান্ট। 'তোমাদের পাঁচ মিনিট দেয়া হচ্ছে।' মেজর খেঁকিয়ে উঠল।
গ্রামের বাড়ির বারান্দায় মুজিবের মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হলো। তার দেহে ২৯টি বুলেটের আঘাত ছিল। একটি বুলেট, সম্ভবত কোন অটোমেটিক রিভলভার থেকে বেরিয়েছে পেছন থেকে ছেদ করে বেরিয়ে গেছে। তার 'কুর্তার' পকেটে পাওয়া গেল পাইপ আর ভাঙা চশমা।

মুজিবের গ্রামের বাড়িতে কেউ নেই। সব দোকান বন্ধ। একজন এক টুকরা সাবান নিয়ে এলো। শেষ গোসলের জন্য পানি গরম করারও সময় নেই। রক্তের সব দাগ মোছার আগেই মেজর চিলি্লয়ে উঠল, 'জলদি করো। আর কত সময় নেবে তোমরা।'

কয়েকজন গ্রামবাসী মুজিবের মা সায়েরা খাতুনের নামে স্থাপিত হাসপাতাল থেকে চারটা শাড়ি নিয়ে এলো। তারা লাল পাড়গুলো ছিঁড়ে ফেলল। কিন্তু কাফন সেলাই করবার সময়টুকুও মেজর তাদের দেবে না।

জানাজা হবে? হ্যাঁ, বলল মেজর। একজন পুলিশকে জিজ্ঞাসা করল সে [মেজর] জানাজায় অংশগ্রহণ করতে পারবে কি না। পুলিশটি জবাব দিল পারবে, যদি পাক-সাফ থাকে। তারা জানাজায় অংশগ্রহণ করল না।
পিতার কবরের পাশে মুজিবকে দাফন করা হলো।
[সাংবাদিক ও কবি এ এল খতিব। জন্ম ভারতের মহারাষ্ট্রের রত্নগিরি জেলায়। কাজ করেছেন বাংলাদেশের মর্নিং নিউজ পত্রিকায় দীর্ঘদিন। জীবনের সবচেয়ে বর্ণাঢ্য সময় কাটিয়েছেন বাংলাদেশে। পরিচিতি তাই সিনিয়র সাংবাদিকদের জগতে। বঙ্গবন্ধু হত্যা নিয়ে বই লিখেছেন ডযড় শরষষবফ গঁলরন? প্রকাশিত হয়েছে ১৯৮১ সালে। প্রকাশনার প্রথম দিনেই ১০,০০০ কপি বিক্রি হলেও পরবর্তী সময়ে বইটি আর পাওয়া যায়নি বইয়ের দোকানে। শেষ জীবনে এ এল খতিব তার জন্মস্থানে ফিরে গিয়েছিলেন। ১৯৮৪ সালে কোলকাতায় বন্ধু সঞ্জীব দত্তের বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। সংবাদের পাঠকদের জন্য ডযড় শরষষবফ গঁলরন?-এর বাংলা অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে। আজ প্রথম কিস্তি।

আওয়ামী লীগ পরাজিত হলে হতাশা বা দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই- মুনতাসির মামুন



আজ আমাদের সময়ের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য জাতীয় শোক পালিত হবে। আওয়ামী লীগ বা ১৪ দল আজ ক্ষমতায়। সুতরাং, সাধারণ মানুষ স্বস্তিতে শোক প্রকাশ করবেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে রাখা উচিত আজ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনীতির নেত্রীর জন্মদিবসও পালিত হবে। এটি জাতির জনকের স্মৃতিকে তুচ্ছ জ্ঞান করার প্রতীক। যদি বিএনপি বা ১৮ দল ক্ষমতায় থাকে তাহলে মানুষ স্বাভাবিকভাবে ধরে নেন, জাতীয় শোক দিবস পালিত হবে না, পালনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে। বরং পালিত হবে জাতীয় জন্মদিবস।অনেকে, এ বিষয়টি এমনকি মিডিয়াও আমলে আনতে চায় না। পত্র-পত্রিকায় এক সঙ্গে দু’টি খবরই ভালভাবে পরিবেশন করা হবে। কারও মনে হবে না এটি আপত্তিকর, অরুচিকর, একদিক থেকে দেখলে দেশদ্রোহিতাও বটে।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বুনন ক্ষতি করেছেন এমন ১০ ব্যক্তির তালিকা করলে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের নাম কিছুতেই বাদ দেয়া যাবে না। তার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য তার লেখা গ্রন্থাদি, তার যে রাজনৈতিক চরিত্র আমরা দেখি তার বিপরীত। দীর্ঘদিন ধরে তিনি মুক্তিযুদ্ধ চেতনাবিরোধী অপ ও অপরাধমূলক রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ও এই ধারার রাজনীতির একজন নেতা। কারাগারে বসে ২০০৮ সালের ১৫ আগস্ট রোজনামচায় তিনি লিখছেন, ‘আজ জাতীয় শোক দিবস। ১৯৭৫ সালের এই দিনে বাংলাদেশের স্থপতি বন্ধবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ধানমন্ডির বাড়িতে স্ত্রী ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে খুন হন। জাতির ইতিহাসে এ এক মহাশোকের দিন। বিতর্কিত একটি জন্মদিনের হিসেবে আজ বেগম জিয়ার ৬৩তম জন্মদিন। সঠিক হলেও আমার জন্মদিন বোধহয় একদিন আগে বা পরে পালন করতাম ও শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যা দিবসের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতাম। এটা একটা রুচিবোধের বিষয়। বেগম জিয়া তা করলে তিনি সকল শ্রেণীর জনগণের কাছ থেকে আরও বেশি শ্রদ্ধা অর্জন করতে পারতেন।’ [কারাগারে কেমন ছিলাম? ৩২৪-৩২৫]

অর্থাৎ বিষয়টি অশ্রদ্ধেয় মওদুদের মতো লোকের চোখেও, কিন্তু এই কাজটি তাদের করতে হবে। এটিই অপরাজনীতির একটি বৈশিষ্ট্য। দৃষ্টিভঙ্গির যে ১০টি উদাহরণ দিলাম, তা হচ্ছে আমাদের দেশের রাজনীতির মৌল বিষয়। এটি উপেক্ষা করার অর্থ, শেষোক্তটিকে পরোক্ষ সমর্থন। বিষয়টি সাদা অথবা কালো চোখে দেখতে হবে। ধূসরের কোন স্থান এখানে নেই।
এ দেশের স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগপ্রধান ছিলেন। [পরে দলীয় পদ তিনি ত্যাগ করেন বটে] কিন্তু ১৯৬৯ সালের পর থেকে তিনি আর দলীয় প্রধান হিসেবে নন, জাতীয় বীর বা বঙ্গবন্ধু হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ১৯৭১ সাল থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বা মুক্তিযুদ্ধকে একটি প্রত্যয় হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এ প্রত্যয়ের মূল ছিল ধর্মরাষ্ট্র ভেঙ্গে একটি সেক্যুলার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন, যেখানে মানুষের ধর্ম মূল বিষয় নয়; মূল বিষয় মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক মুক্তি।

স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বিএনপি কোনভাবেই জড়িত নয়। জামায়াত জড়িত হত্যাকারী দল হিসেবে। জামায়াত পাকিস্তানবাদ বজায় রাখতে চেয়েছে। পাকিস্তান বা পাকিস্তানবাদও একটি প্রত্যয়। এ প্রত্যয়ের মূল বিষয়, পাকিস্তান যে ধরনের ধর্ম রাষ্ট্র ছিল [বা আছে] সে কাঠামো সমর্থন। ধর্মরাষ্ট্র্রের অর্থ ধর্ম ব্যবহৃত হবে সাধারণ মানুষকে দমন ও পীড়নে। অর্থাৎ সাধারণের সব কিছু ধর্মের নামে ভায়োলেন্সের সাহায্যে দমন করা হবে। সিভিলিয়ান শাসন হবে সামরিক শাসনের কর্তৃত্বাধীন। এ ‘ধর্মরাষ্ট্র’ যারা সমর্থন করবে তারাই শাসন করবে।
১৯৭১ সালের দ্বন্দ্বটা এখানেই নিহিত। কিন্তু আমরা মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতিটা তো অক্ষুণ রাখতে পারিনি। এই রাজনীতির যে আধিপত্য বিস্তার করার কথা তাতো করতে পারেনি। যে কারণে জাতীয় শোক দিবসও বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে পরিণত হয় এক ব্যক্তির মৃত্যু দিবসে।


এ বিষয়গুলো খতিয়ে দেখলে বর্তমান রাজনীতির সঙ্কট উপলব্ধি করা সহজ হবে। আমাদের কিছু বোধহীন মানুষ, মতলববাজ মানুষ, পাশ্চাত্যের অনেকে মনে করেন, দু’টি দল বা ১০ নেতা মিলে-মিশে কাজ করে না কেন? তাহলেই তো রাজনীতি সরল হয়ে যায়। তাহলে প্রশ্ন জাগে, ফ্যাসিস্ট বা নাজি দল বা নতুন নাৎসিদের রাজনীতি করতে দেয়া হয় না কেন?কারণ যে আদর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয় সে আদর্শের বিরোধিতা করা রাষ্ট্রের বিরোধিতা। সেটি আধুনিক, সভ্য রাষ্ট্রে সম্ভব নয়।

বিএনপির প্রতিষ্ঠা হঠাৎ নয়, বঙ্গবন্ধু হত্যাও স্বতঃস্ফূর্ত বা হঠাৎ নয়। এর সঙ্গে আদর্শ, প্রতিশোধ, পুঁজি ও ভূকৌশলগত বিষয় জড়িত। বাংলাদেশ ছিল একটি আদর্শ; পাকিস্তান, সৌদি আরব ও ইসলামী দেশসমূহ তা মানতে রাজি ছিল না। আমেরিকা, চীন এ রাষ্ট্রের বিরোধিতা করেছে। কিন্তু দেখা গেল লুঙ্গি ও গেঞ্জি পরা সামান্য কিছু লোক পৃথিবীর অন্যতম সুসজ্জিত সেনাবাহিনীকে হারিয়ে দিল। আমেরিকা, চীন এ রাষ্ট্র্র চায়নি; কিন্তু এ রাষ্ট্র্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এটি ছিল তাদের জন্য অপমান। বঙ্গবন্ধুর মৈত্রী ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের সঙ্গে; আবার রাষ্ট্র্রের মূলনীতি ছিল সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। সাম্রাজ্যবাদ বা পুঁজির বিকাশে ছিল তা প্রতিবন্ধকতা। এ সব মিলে সৃষ্টি হয়েছিল জিঘাংসার ও প্রতিশোধের। বাংলাদেশের প্রতীক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। সে জন্য তার বিনাশ ছিল ষড়যন্ত্রের লক্ষ্য। কিন্তু, তারা দূরদর্শীও ছিল। সে কারণে তাদের প্রতীক এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী প্রতীক প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন ছিল। তারা জিয়াউর রহমানকে খুঁজে পেয়েছিল।

এভাবে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের নায়করা তাদের এজেন্ট খুঁজে পেল বাংলাদেশে। তারা এতটাই দূরদর্শী ছিল যে, এমন একজনকে বেছে নিয়েছিল যিনি মুক্তিযুদ্ধে জড়িত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী গোলাম আযম টাইপের কাউকে বসালে যে তা চলবে না এটি বুঝতে তাদের অসুবিধা হয়নি।

পাকিস্তানী মানসিকতা তো একেবারে বিলুপ্ত করা যায়নি। সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রবলভাবে তা ছিল। এ সব পাকিস্তানীমনাদের একত্রিত করার জন্য দরকার ছিল একটি মঞ্চের। মার্কিন দলিলপত্রেই আছে কী ভাবে এ কারণে বিএনপির প্রতিষ্ঠা করা হলো। পাকিস্তানীমনারা বিএনপির পতাকাতলে একত্রিত হলেন। মুক্তিযোদ্ধা ভাবটা থাকায় এক ধরনের বিভ্রান্তি জনমানসে সৃষ্টি করা গেছে। সে কারণে মতলববাজরা বা মওদুদ, বদরুদ্দোজা, হুদা টাইপের লোকজনকেও আনা সম্ভব হয়েছিল। যেমন, দেখুন, মওদুদ লিখছেন : ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন করা রুচি-বিগর্হিত। অর্থাৎ, তিনি তো বিবেকবান, স্বচ্ছ চিন্তার লোক। কিন্তু রাজনীতি করেন তিনি যারা ১৫ আগস্ট জন্মদিবস পালন করে তাদের সঙ্গে।

বিএনপির ভিত্তি শক্ত করার জন্য জামায়াতকে রাজনীতিতে জিয়া নিয়ে এলেন যে দলকে ক্রিমিনাল অর্গানাইজেশন হিসেবে বঙ্গবন্ধু নিষিদ্ধ করেছিলেন। ভিন্ন দল হলেও যেই জামায়াত-বিএনপি কখনও বিচ্ছিন্ন হবে না। তারা একে অপরের পরিপূরক। তাদের সুকৌশলী স্ট্র্যাটেজির কারণে আজ তারা শক্তিশালী দল। বঙ্গবন্ধু দেশকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। অপ ও অপরাধমূলক রাজনীতির স্বার্থে জিয়াউর রহমান দেশ ও জাতিকে বিভক্ত করলেন। আমরা যখন এ দু’টি রাজনৈতিক দলের কর্মকান্ড বিবেচনা করি তখন এ মূল বিষয়টি সযতনে এড়িয়ে কোন্ দল অপকর্ম করছে বা করছে না তা বিচার করে, তর্ক বাধিয়ে বিভ্রান্তির রাজনীতি প্রসারিত করি।

সে কারণে, ১৫ আগস্টে যখন পেছন ফিরি তখন মনে হয়, ১৯৭১ সালে আমরা ভেবেছিলাম, জাতিরাষ্ট্র গঠন সম্পন্ন হয়েছে; আসলে তা হয়নি। আমরা ভেবেছিলাম, ধর্মরাষ্ট্র থেকে মুক্তি পেলাম; আসলে পেলাম না এবং জনসংখ্যার একটি বড় অংশ ক্রমান্বয়ে মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতির বিপক্ষে অংশ নিল। এটি বাঙালীর বড় ট্র্যাজেডি। দুঃখের বিষয়, আমরা, সমাজের সব অংশের কিছু মানুষজন এ ট্র্যাজেডি সৃষ্টিতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছি। প্রমাণ করেছি, মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া যতটা সহজ ছিল মুক্তিযোদ্ধা থাকাটা তত সহজ ছিল না। প্রমাণ করেছি, আমরা যতটা না বাঙালী তার চেয়ে বেশি মুসলমানÑ পরে বাঙালী মুসলমান। গত প্রায় পাঁচ শ’ বছর মুসলমান সমাজ পৃথিবীকে তেমন কিছু দিতে পারেনি। এখন তো মনে হচ্ছে সেটি আরও অসম্ভব হয়ে উঠছে।

১৫ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধের সৈন্যরা যদি রাস্তায় নেমে আসতেন তাহলে কি ফারুক-ডালিমরা বেঁচে থাকতেন? তারা নামেননি, কেন নামেননি তার ইঙ্গিত করেছি। সিভিলিয়ান মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা, যারা বঙ্গবন্ধু বলতে ছিলেন পাগল এবং বঙ্গবন্ধুর নামে সে সুবিধা নিয়েছিলেন তারাও নামেননি। বঙ্গবন্ধু হত্যা হয়ত তাদের বিমূঢ় করেছিল কিন্তু তারপরও তো নামার সুযোগ ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ প্রথম ছাত্র ইউনিয়নই করেছিল যাদের কিছু পত্রিকায় আজ নাম ধরে গালাগালি করে বলা হয় আওয়ামী লীগকে তারা ধ্বংস করেছে। সাবেক বামপন্থীরা আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে দলকে শক্তিশালী করেছে। শুধু তাই নয়, জিয়াউর রহমানের আমলে যখন ধর্মনিরপেক্ষ কল্যাণমুখি রাষ্ট্রকে ক্রমেই পাকিস্তানী আদলে রূপান্তরিত করা হয় তখন আমাদের একাংশই তাতে সায় দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা কি সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে গিয়ে জিয়া ও এরশাদকে মহিমান্বিত করেননি? সুতরাং প্রশ্ন জাগে বাংলাদেশের আদর্শ কি এতই ঠুনকো ছিল?

না, ঠুনকো ছিল না। ঠুনকো হলে লুঙ্গি-গেঞ্জি পরা মানুষজন জিততে পারতেন না। এক লাখ শহীদ হলেই হাল ছেড়ে দিতেন। তাতো ছাড়েননি।
মনে রাখা বাঞ্ছনীয় যে, পাকিস্তানী আদর্শ ভায়োলেন্স ও অর্থের সাহায্যে প্রাথমিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। তাদের সাহায্যার্থে ২০ বছরের মধ্যে বিত্তশালী একটি শ্রেণী সৃষ্টি করা হয়েছে যারা আবার রাষ্ট্রযন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং ভাবনার জগতে আধিপত্য সৃষ্টি করেছে। এ কৌশল অসফল হয়েছে বলা যাবে না; কেননা নতুন জেনারেশনের একটি বড় অংশ বিভ্রান্তির রাজনীতি গ্রহণ করেছে। আর মুক্তিযুদ্ধ এখন অতীতের বিষয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বড় দল আওয়ামী লীগ কখনও দূরদর্শী কোন পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি, ভাবনার জগতে আধিপত্য বজায় রাখার চেষ্টা করেনি বরং আত্মপক্ষ সমর্থনে ব্যস্ত থেকেছে।

পাকিস্তানী আমল থেকে এখন ধর্মের জোর বেশি। ধর্মীয় পক্ষের যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের জীবনচর্চার সঙ্গে ইসলামী জীবনচর্চার কোন মিল নেই; কিন্তু তাদেরই ইসলামের রক্ষক মনে করা হচ্ছে। যারা এদের সমর্থক তাদের সন্তান-সন্ততির কেউ মাদ্রাসায় পড়েনি, কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষাকে তারা পরিপুষ্ট করেছে হাতিয়ার হিসেবে এবং সাধারণকে অধস্তন রাখার জন্য। এর মধ্যে শ্রেণীগত একটি ব্যাপারও আছে। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ, ভোগী ও সুবিধাভোগী জীবন যাপনের অন্তিমে মাদ্রাসা-মসজিদ প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হন; কিন্তু মেয়েদের বা প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনে উৎসাহী হন না। কারণ, তাহলে তাদের উত্তরসূরিরা সাধারণের প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে।

রাজনৈতিক যুদ্ধের কৌশল হিসেবে বিএনপি-জামায়াত বা পাকিপন্থীরা আওয়ামী লীগ বা বামদের অধার্মিক হিসেবে চিহ্নিত করতে আগ্রাসী সব পন্থা গ্রহণ করেছে। বিপরীতে আওয়ামী লীগ বা মধ্যপন্থী বা উদার বা মৃদুবাম এ ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে বলেনি, আমার মুসলমানত্ব প্রমাণের দরকার নেই। যারা আমাদের অধার্মিক বলে তারাই অমুসলমান। কিন্তু মধ্যপন্থা এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ না করে সমঝোতা ও নিজেদের মুসলমানত্ব প্রমাণে ব্যস্ত থেকেছে। এটি রাজনৈতিক ভুল যার মাসুল মুক্তিযুদ্ধ চেতনাপন্থীদের গুনতে হচ্ছে।

এই দ্বন্দ্বে নতুন এক গ্রুপের সৃষ্টি হয়েছে। তারা কিন্তু বিএনপি-জামায়াত আমলেই শক্তিশালী হয়েছে। এরা নিজেদের নিরপেক্ষ বা সুশীল সমাজ বলে জাহির করে। এরা পাকিস্তানপন্থী তা বলার সুযোগ নেই। কারণ, নিয়ত তারা এমন সেক্যুলার ডেমোক্র্যাটিক রাষ্ট্রের কথা বলেন যা নিয়ন্ত্রণ করবেন রাজনীতিবিদরা নয়, তারা। মিডিয়া তাদের পছন্দ করে। তাদের ইচ্ছা, রাজনীতিবিদ যদি ক্ষমতায় থাকেনই তাহলে তিনি যেন আওয়ামীপন্থী না হন। অধিকাংশ সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার গত কয়েক বছরের প্রতিবেদন, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় বিশ্লেষণ করলে এর সত্যতা প্রমাণিত হবে। একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ আমি অনেকবার দিয়েছি, এখনও দিচ্ছি, তাহলে এই সুশীল মিডিয়ার ভূমিকাটি পরিস্ফুট হবে। বিশ্বজিৎ হত্যাকান্ডের ভয়াবহ দৃশ্যটি বারবার দেখানো হয়েছে প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে। কিন্তু, কেউ কখনও প্রশ্ন করেননি, এতজন সাংবাদিক সেখানে ছিলেন, দলবদ্ধভাবে তারা তাড়া করলে ওই ক’জন হত্যাকারী পালানোর পথ পেত না এবং সাধারণ মানুষ তখন এদের গণপিটুনিতেই লম্বা করে ফেলত। কিন্তু, বিশ্বজিৎকে রক্ষায় কেউ এগিয়ে আসেনি। বিশ্বজিতের হত্যাকারীদের গ্রেফতার করে যে বিচার করা হলো সে বিষয়টিও উপেক্ষিত হলো। কারণ, সেটি আমলে আনলে বলতে হয়, এ আমলে আইনের শাসন বাস্তবায়নে প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে, পূর্ববর্তী আমলে ছিল যা অনুপস্থিত। এরপর হেফাজতীরা যখন সমাবেশ করছে তখন টিভির রিপোর্টাররা সমানে বয়ান করেছেন তাদের ‘তৌহিদী জনতা’, ‘ধর্মপ্রাণ’ ‘মুসল্লি’ ইত্যাদি হিসেবে।
এরা যখন কোরান পোড়াল এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালাল সে দৃশ্য ওই একদিন বা দু’দিন দেখানো হয়েছে, বারবার নয়, কারণ তাহলে প্রমাণিত হবে এরা ধর্মপ্রাণ নয়, এরা ধর্ম ব্যবহারকারী এবং এর ফলে বিভ্রান্ত রাজনীতির মুখোশ উন্মোচিত হবে। বরং গুরুত্ব দেয়া হয়েছে কয় হাজার মারা গেছে সে বিতর্ক উপস্থাপন করে এবং বিএনপি-জামায়াত যে এই নাটকটি পরিবেশন করেছে তা নিপুণভাবে আড়াল করা হলো। মাহমুদুর রহমান দৈনিক দেশের সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘদিন অপপ্রচার চালিয়ে দেশজুড়ে দাঙ্গা সৃষ্টির পর ১৫ সম্পাদক তার পক্ষে বিবৃতি দেন যাদের অধিকাংশ সমাজে ধর্ম-নিরপেক্ষ ও গণতন্ত্রের অবতার হিসেবে পরিচিত। এর ব্যাখ্যা কী হবে? এসব ভাবার সময় হয়েছে। সবশেষে, একটি উদাহরণ দেই। ১২ তারিখ জামায়াত নিষিদ্ধ করার জন্য আদালতে আপীল করা হয়েছে যেটি বাংলাদেশের জন্য শুধু নয় উপমহাদেশের জন্য প্রধান সংবাদ। ১৩ তারিখে প্রকাশিত মাত্র দু’টি সংবাদপত্রÑদৈনিক জনকণ্ঠ ও কালের কণ্ঠে তা শিরোনাম হয়েছে; অন্য কোন পত্রিকায় নয়। আমি প্রথমে যা আলোচনা করেছি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ এ ঘটনা।

১৯৪৭ সালে এ ভূখন্ড একটি ধর্মরাষ্ট্রের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ ধরনের ধর্ম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার একটি স্বপ্ন ধর্মীয় প্রচারকরা বহুদিন ধরে লালন করছিলেন। অনেকে হিজরতও করেছিলেন ১৯ শতকে। যদিও তা বলা হয়ে থাকে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম, কিন্তু আসলে তা ছিল মুসলমানদের ‘স্বাধীনতা’র আকাঙ্খা। এ ধর্মরাষ্ট্র গঠনের বিপরীতেও অবস্থান ছিল অনেকের। অবশ্য তারা ছিল সংখ্যালঘু। সেই সংখ্যালঘুদের ধর্মরাষ্ট্র-বিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত করা হয়েছিল ১৯৪৮ সাল থেকেই। এবং এর সূত্রপাত করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের মতো তরুণরা। মওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী জড়িত হয়েছেন পরে। সোহরাওয়ার্দীকে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর গুরু হিসেবে যতই প্রচার করুক, সোহরাওয়ার্দী বাঙালীর জন্য তেমন কিছু করেননি। বরং তাঁর থেকে বাঙালীর জন্য বেশি করেছেন মওলানা ভাসানী। এমনকি মানিক মিয়াও। ধর্মরাষ্ট্র মানুষকে মহীয়ান করে না, বরং অমানবিক করে তোলে। এটি উপলব্ধিতে হয়ত এনেছিলেন জাতীয়তাবাদী ও মার্ক্সীয় নেতারা। যে কারণে আমরা দেখি, আওয়ামী লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টি বা ন্যাপ পরস্পরকে সাথী করে আন্দোলন করেছে এবং সেই সব আন্দোলন সফল হয়েছে। চরম বাম বরং চরম ডানে পরিণত হয়ে দেশের ক্ষতি করেছে।

ধর্মরাষ্ট্র ভেঙ্গে ১৯৭১ সালে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পত্তন করা হয়েছিল। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, বিদেশ থেকেও দাবি এসেছিল বাংলাদেশ যেন সেক্যুলার রাষ্ট্র হয়। সেই ১৭ জুলাই ১৯৭১ সালে লন্ডন থেকে ন্যাশনাল সেক্যুলার সোসাইটি নামে একটি সংগঠনের সভাপতি মিসেস ই. ভেন্টন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে এক চিঠিতে জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশ যে প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র গঠন করতে চাচ্ছে তাতে তারা আশাবাদীÑ বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হবে। কারণ ধর্মরাষ্ট্র Òis outmoded, infact gives expression to the worst elements in religion, and that the ties of language, common territory and common economic interest are far more important.” মিসেস ভেন্টনের চিঠি লেখার কারণ? তারা শুনতে পাচ্ছিলেন বাংলাদেশ হয়ত আরেকটি মৃদু ধর্মরাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে-Ômay become a milder version of an Islamic state, because of the possible reluctance of predominantly Hindu refugees in India to return to their homeland.’ হিন্দু বাস্তুহারারা ফিরেছিল, কিন্তু বাংলাদেশ ধর্মরাষ্ট্র হওয়াতে আবার অনেকে দেশত্যাগ করেছেন। ভারতও একটি সেক্যুলার গণতান্ত্রিক দেশ আশা করেছিল।
৩০ লাখ মানুষ শহীদ হলেন যে সেক্যুলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সে রাষ্ট্র চার বছরের শেষে কেন যাত্রা করল ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, সেটি আমরা খুব একটা খতিয়ে দেখিনি। আমিও যে এ বিষয়ে পড়াশোনা করে গভীর উপলব্ধিতে পৌঁছেছি তা নয়, তবে সামান্য কিছু পর্যবেক্ষণ আছে।
বাংলাদেশ আন্দোলন বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ করেছিলেন এটা ঠিক; তবে মনে রাখা বাঞ্ছনীয়, ভোটের হিসাবে (১৯৭০) ২৫ ভাগ বাঙালী এর বিরুদ্ধে ছিল। এই ২৫ ভাগের অধিকাংশ বাঙালী মুসলমান এবং তারা মুক্তিযুদ্ধের সময় গরিষ্ঠ বাঙালী মুসলমানদের হত্যা, মুসলমান নারীদের ধর্ষণে মেতে উঠেছিল। ইসলামের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত এত অল্প সময়ে এতো বিশাল হত্যাযজ্ঞ বাঙালী মুসলমানরাই করেছিল [না, আমি পাকিস্তানী বাহিনীর কথা ভুলিনি, কিন্তু বাঙালী মুসলমানদের একাংশ তাদের সহযোগিতা না করলে এত বড় হত্যাযজ্ঞ সম্পন্ন করা সম্ভব হতো না ]।
এবং তা করা হয়েছিল ধর্মের নামে।
বাঙালী যখন জিতে এলো তখন এই মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং শৈথিল্য দেখানো হয়েছে। ১৯৭২ সালের ৫৪ নং আদেশে পাকিস্তানের সবকিছু অটুট রাখা হয়েছে- ‘‘...ধষষ ষধংি যিরপয বিৎব রহ ভড়ৎপব ড়হ ঃযব ২৫ঃয ফধু ড়ভ গধৎপয ১৯৭১ ... ঝযধষষ পড়হঃরহঁব ঃড় নব রহ ভড়ৎপব...’’ এর সূত্র ধরেই পাকিস্তানী প্রশাসন ব্যবস্থা অটুট রাখা হয় এবং পাকিস্তানের মতোই আমলাতন্ত্রে আস্থা অটুট রাখা হয়। ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে জীবন ও সম্পদের ক্ষয়-ক্ষতি নির্ধারণে যে কমিটি করা হয় (১২ সদস্য) তার প্রধান করা হয় পাকিস্তান পুলিশ সার্ভিসের সদস্য জনাব রহিমকে। সদস্যদের মধ্যে সাতজন ছিলেন আমলা। ৪ জন রাজনীতিবিদের মধ্যে তিনজন ছিলেন জনপ্রতিনিধি; কিন্তু তাদের কাউকে সভাপতি করা হয়নি। আমাদের মানসিকতা যে খুব পরিবর্তন হয়নি তার প্রমাণ, এখনও জনপ্রতিনিধিদের ওপর আমলাদের স্থান-যা পাকিস্তানী মানসিকতা। এ মানসিকতা থেকে খালেদা জিয়া দূরে থাক, শেখ হাসিনাও মুক্ত হতে পারেননি। তবে, জনপ্রতিনিধিরা এতই মেরুদন্ডহীন যে, তারা কখনও এর প্রতিবাদ করেননি। এই দাসসুলভ মনোভাবও পাকিস্তানী মানসিকতার প্রতিফলন।
তৎকালীন নেতৃত্ব ধর্মনিরপেক্ষতার নামে যুদ্ধ করলেও, কখনও মাদ্রাসা শিক্ষা অবলেপন বা সংস্কারের কথা বলেননি; সবচেয়ে আগে ইসলামিক ফাউন্ডেশন করেছেন, ইসলামী সংস্থায় যোগদানের জন্য আকুল হয়েছেন। ধর্মনিরপেক্ষ শাসনতন্ত্র প্রবর্তন করলেও ধর্মরাষ্ট্রের উপাদানসমূহ সম্পূর্ণভাবে রহিত করেননি। কিন্তু সুযোগ তখনই ছিল। উল্লেখ্য, মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক, কোন কথিত মৌলানা, মুফতি, পীর এবং ইসলামী দেশসমূহ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করেনি। বঙ্গবন্ধু সাহসী মানুষ হিসেবে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, অপরাধীদের শাস্তি দেয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু সেই উপাদানসমূহকে সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট না করায় তা গোকুলে বেড়েছে।

স্বাধীন দেশে ঐ পাকিস্তানী পরিপ্রেক্ষিত অটুট রাখা ও মানবিকতা দেখিয়ে পাকিস্তান ফেরত সৈন্যদের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদানের সুযোগ করে দেয়া ছিল মস্ত ভুল। পরবর্তীকালে এই পাকিস্তানী ফেরতরাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে এবং তাদের সমর্থন করে মুক্তিযুদ্ধ ফেরত সৈন্যরা, আওয়ামী লীগের একাংশ ও বেসামরিক আমলারা। আজকে যত অজুহাতই দেখানো হোক, ২৪ ঘণ্টা ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর লাশ সিঁড়িতে পড়ে ছিল; সেনাবাহিনীর কেউ, এমনকি পদক পাওয়া ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ সৈনিকরাও ৩২ নম্বরে আসেনি। বরং পরবর্তী ৩০ বছর ঐ পাকিস্তানী সেনারা ধাপে ধাপে সেক্যুলার রাষ্ট্রকে ধর্মরাষ্ট্রে পরিণত করেছে। এ জন্য দায়ী এবং তা পরিষ্কারভাবে বলা উচিত লে. জেনারেল জিয়াউর রহমান, লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও খালেদা জিয়া। এদের অভিযুক্ত করা যায় বাংলাদেশের মৌলিক আদর্শ বিনষ্ট করার জন্য। পাকিস্তানকে যেমন সৈনিকরা ধর্মরাষ্ট্রে পরিণত করে তা ধ্বংস করে দিয়েছে বা দিচ্ছে, বাংলাদেশের তৎকালীন সৈনিকরাও গত ৩০ বছর একই কাজ করেছে। সে মানসিকতা বলবত এই অর্থে যে, সিভিলিয়ান কর্তৃত্ব বিনষ্ট করে সামরিক কর্তৃত্ব স্থাপন এবং এর মাধ্যমে যাবতীয় অর্থ আত্মসাত বা নিয়ন্ত্রণ বা গ্রহণ। এটি এখন শুধু অটুট নয় আরো তীব্র। ঠিকাদারি ব্যবসা থেকে ট্যাক্সি ব্যবসা সব তাদেরই দিতে হয়েছে এ সরকারকে। এমনকি জিয়াউর রহমান নামে বিমানবাহিনী প্রধানের (জানি না বিমানের সংখ্যা দু’ডজন হবে কিনা? ডিকটাট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মেনে নিতে বাধ্য করা হয়েছে মেট্রোরেলের গতিপথ পরিবর্তনে। যে কারণে রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়েছে কোটি কোটি টাকা। এটিও পাকিস্তানী মানসিকতা। ফিদেল ক্যাস্ট্রো সে জন্য বঙ্গবন্ধুকে পরামর্শ দিয়েছিলেন পাকিস্তানফেরত সেনা ও আমলাদের বাদ দিতে। ক্যাস্ট্রোও তাই করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ক্যাস্ট্রোর অভিজ্ঞতা কাজে লাগাননি। পাকিস্তান তার পরাজিত সৈনিকদের সেনাবাহিনীতে ফেরত নেয়নি।

বাংলাদেশ হওয়ার পর পর বাংলাদেশের বিরোধীদের সম্পূর্ণভাবে বিচার না করার কারণে, পাকিস্তানী মানসিকতার বিকাশ শুধু নয়, পৃথিবীজুড়ে ইসলামের নামে সন্ত্রাস শুরু হয়েছে। আজকের তালেবান, আল কায়েদা প্রভৃতি এক হিসেবে জামায়াতে ইসলামীরই উত্তরসূরি। জামায়াতের অপরাধমূলক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করার প্রধান দায় বিএনপি ও জাতীয় পার্টির। খুন করলে পুরস্কৃত করা হবে- পাকিস্তানের এই নীতি প্রথম চালু করেন জিয়াউর রহমান, তারপর এরশাদ সেই ধারা এগিয়ে নিয়ে যান। এই নীতি পরিপুষ্ট করেন বেগম খালেদা জিয়া। এর সঙ্গে দায়ী আমাদের ও আমাদের পূর্ববর্তী জেনারেশনের একাংশ।

এ দেশে সব সময়ই সঙ্কটকাল চলছে। তার মধ্যেও দেশটি অগ্রসর হচ্ছে। এটি সাধারণ মানুষের কৃতিত্ব। তবে, রাজনীতি বিবেচনা করলে বলতে হবে, আওয়ামী লীগের তিন আমলেই দেশ সবচেয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে। বঙ্গবন্ধু একেবারে নিঃস্ব-বিধ্বস্ত দেশের একটি ভিত্তি গড়েছিলেন মাত্র তিন বছরে যার ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জিয়াউর রহমানের শাসনকাল। শেখ হাসিনার দুই আমলে দেশের প্রবৃদ্ধি যেভাবে বেড়েছে সামরিক এবং খালেদা জিয়ার আমলে তা হয়নি। বিএনপি-জামায়াতের নিয়ত জনবিরোধী কর্মকা- সত্ত্বেও তা থামেনি। সামরিক শাসন দেশে শান্তিশৃঙ্খলা ও স্থাায়িত্ব এনেছে এবং বিএনপি-জামায়াত শাসন আওয়ামী লীগ থেকে উন্নতÑ তা একটি অসত্য প্রচার বা ধারণা। প্রতিনিয়ত আওয়ামী লীগের ‘অপকর্ম’ তুলে ধরা হচ্ছে; তারপরও এ অগ্রগতি কিভাবে হচ্ছে? তাহলে ঐসব আমলে অপকর্মের সংখ্যা বেশি? তাহলে, ঐ আমল বা শাসন আমরা চাইব কেন? এর উত্তর কেউ দেবেন বলে মনে হয় না।
অধিকাংশ মিডিয়া [মিডিয়ার কথা আসছে এ কারণে যে, ‘শিক্ষিত’ সমাজের মন তারা অনেকটা প্রভাবিত করে] বড় সংখ্যক মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বা মানস গত তিন দশকে এভাবে রূপান্তর করেছে বা আমাদের ধমনীতে ঐ পাকিস্তানের বীজ রোপন করেছে, যা এখনও বিদ্যমান। দু’একটি উদাহরণ দিই।
মওদুদ আহমদ তার পূর্বোক্ত গ্রন্থে ২০০৭ সালের ১৫ আগস্ট লিখছেন [রোজনামচায়]: বঙ্গবন্ধুর “সমস্ত ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমি তাঁকে ‘আমাদের ইতিহাসের মহানতম নায়ক’ হিসেবে উল্লেখ করেছি। ‘তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়েই তাঁর সমাধি রচিত হয়নি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তাঁর নাম প্রবাদবাক্যের মতোই ভাস্বর হয়ে থাকবে।’ কিন্তু আজ বঙ্গবন্ধুকে বিতর্কিত এবং খ-িত করার জন্য আওয়ামী লীগ এবং তাদের কিছু বুদ্ধিজীবীরাই দায়ী।” [পূ.১৪১] কিন্তু কিভাব? সেটি তিনি ব্যাখ্যা করেননি।
পাঁচটি সিটি কর্পোরেশনে ভোটাররা বিএনপিকে বেছে নিয়েছেন। প্রায় প্রত্যেক ভোটারই বলেছেন, আওয়ামী লীগের মেয়ররা যা কাজ করেছেন বলার নয়। তাহলে সেসব মেয়রকে ভোট দিলেন না কেন? তারা যে আওয়ামী লীগ করে! সুশীল সমাজ কোন আওয়ামী লীগকে সমর্থন করতে পারে না। কারণ, তারা মনে করে, আওয়ামী লীগ তাদের এবং তাদের প্রতিনিধি ড. ইউনূস বা ড. কামাল হোসেনকে যথার্থ মূল্যায়ন করেনি। এ কথা কখনও বলা হয় না, সুশীল সমাজ কিভাবে সেই দুর্ভাগ্যজনক সামরিক তত্ত্ব¡াবধায়ক সরকার সমর্থন করেছিল হাসিনা-খালেদার বিপরীতে? তারা মাইনাস টু, নিদেনপক্ষে মাইনাস হাসিনার পক্ষে ছিল। এ আশা পূরণ না হওয়ার ক্ষোভ তারা কিছুতেই ভুলতে পারেননি। এ সমস্ত মিলে ধারণা করা যেতে পারে, জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে; আসলে তা নয়। দ্বন্দ্ব সেই ১৯৭৫-পরবর্তী দ্বন্দ্ব। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন সেই দ্বন্দ্বেরই বহিঃপ্রকাশ। এই দ্বন্দ্বের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে যুদ্ধাপরাধ বিচার প্রশ্নে।
শেখ হাসিনা যখন যুদ্ধাপরাধ বিচারে ট্রাইব্যুনাল করেন তখন আওয়ামী লীগের দক্ষিণপন্থীরা তা চায়নি। এই দক্ষিণপন্থীরা যদিও আওয়ামী লীগ করেন [হয়ত সুবিধার কারণে], তাদের মানসিক গড়ন তাদের বিরোধীদের মতন। তাঁরা মনে করেন বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতাটা ভাল, বিএনপি-জামায়াতকে আলাদা করা উচিত; তাতে ভোটের বাক্স প্রসারিত হবে। এই চিন্তাধারা কিন্তু আওয়ামী নেতৃত্বের একাংশে এখনও বিদ্যমান। যা হোক, যুদ্ধাপরাধ বিচার শুরু হয়েছে। বিএনপি সরাসরি যুদ্ধাপরাধী ও যুদ্ধাপরাধকে সমর্থন করছে, যেমন করছে পাকিস্তানীরা। তাদের ধারণা, যুদ্ধাপরাধ বিচারের কারণে তারা দুর্বল হয়ে পড়বে; কারণ, তাদের সমর্থকদের একটি বড় অংশ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সেই ২৫%।
তারা এতদিন মুক্তিযুদ্ধের যে মুখোশ পরে ছিল তা সম্পূর্ণ খুলে ফেলতে হবে [খোলা হয়ে গেছে অনেক পরিমাণে]।
এতে যে নীরব গরিষ্ঠ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষরা ছিলেন তাঁরা আর বিভ্রান্ত হবেন না। ১৯৭১ সালের সেক্যুলার ও গণতান্ত্রিক আদর্শ প্রতিষ্ঠার দিকে সেটি একটি পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপ সফল হলে তাদের রাজনীতি আর থাকে না, তারা আবার ক্ষীণধারায় পরিণত হবে।
সুশীল সমাজ যুদ্ধাপরাধ বিচার সমর্থন করে। কিন্তু, আওয়ামী লীগকে তারা সমর্থন করতে পারে না। কারণ, আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এলে তাদের অস্তিত্ব আরও দুর্বল হয়ে পড়বে, মুখোশ আরও উন্মোচিত হবে। সেটি তারা হতে দিতে পারে না। সুতরাং নির্বাচনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের অবস্থান তারা মেনে নিতে পারে না। কারণ, তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচন হলে তাদের প্রতিনিধিরা সরকার নিয়ন্ত্রণ করবে এবং সেই নিয়ন্ত্রিত সরকার বিএনপি-জামায়াতের পক্ষে যাবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার কখনই নিরপেক্ষ থাকেনি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ঐভাবে জিততে পারেনি। প্রশ্ন করতে পারেন ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ জিতল কিভাবে? জেতার মূল কারণ খালেদা-নিজামী-তারেক এবং ইয়াজউদ্দিন, মঈনউদ্দিন, ফখরুদ্দীনের শাসনকালে মানুষ এমন নিষ্পিষ্ট হয়েছিল যে, তারা আওয়ামী লীগকে ভোট দিতে বাধ্য হয়েছিল। মনের ইচ্ছায় দিয়েছেÑ তা নয়। সুশীল সমাজ সরাসরি তখন বিএনপি-জামায়াতকে সমর্থন দেয়ার সাহস পায়নি; যদিও সমবেদনাটি ছিল তাদের পক্ষেই। এখন ১৮ দল ও সুশীলদের ধারণা, যে কোন প্রকারে আওয়ামী লীগ বা ১৪ দলকে নামাতে হবে। তাতে যদি দেশজুড়ে বিশৃঙ্খলা হয় তাও সই এবং সেজন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করা হবে। উদাহরণ দিই। জামায়াত যে সুনির্দিষ্টভাবে দাঙ্গা, হত্যা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে তার জন্য হরতাল দেয়াকে মুখ্য বিবেচনা করা হচ্ছে। যারা দিচ্ছে তাদের কিন্তু প্রবলভাবে অপরাধী সংগঠন হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে না। বরং জামায়াত-বিএনপির সহিংসতা রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোন ব্যবস্থা নিলে সেটি মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। টিভি চ্যানেলগুলোতে ইচ্ছাকৃতভাবে যুদ্ধাপরাধ, যুদ্ধাপরাধের বিচার, বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য বিতর্কের পর বিতর্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। নিরপেক্ষতার নামে ১৮ দলকে ‘ভিকটিম’ হিসেবে চিহ্নিত করে এক ধরনের নির্বাচনী প্রচার চালানো হচ্ছে।
অন্যদিকে পরিস্থিতি এত সঙ্কটময় এ কারণে যে, আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচনে হারে তাহলে আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। ১৮ দল ও সুশীল সমাজ ১৪ দলের মতাদর্শকে একেবারে বিলুপ্ত করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করবে; যদিও তা সম্ভব হবে না। তাদের আধিপত্য বিস্তারে সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনে এমন শুদ্ধি অভিযান চালানো হবে যে, তা একেবারের জন্য পাকিস্তানী কাঠামোয় পরিণত হবে। অনেককে হত্যা করা হবে। কারণ, বিচারের ঝামেলায় তারা যাবে না। শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকার যাদের সুবিধা দিয়েছেন তাঁরা নিরপেক্ষ হয়ে যাবেন, এখনই যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগের দক্ষিণপন্থীদের একটি অংশ বিএনপিতে যোগ দেবে, কিছু মিলে নতুন দল সৃষ্টি করবে। শেখ হাসিনা যাঁদের নেতৃত্বে এনেছেন তাঁদের একটি বড় অংশ বিদেশ [গতবারের মতো] চলে যাবেন বা হঠাৎ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বেন। সুতরাং নিজ নিজ অস্তিত্বের কারণেই দু’দল নিজ নিজ অবস্থান থেকে লড়বে কী না সন্দেহ। এক হিসেবে, ১৯৭৫ সালে যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করা হয়েছিল বর্তমান নির্বাচনে জয়-পরাজয়ে সেই দ্বন্দ্ব খানিকটা হলেও হ্রাস পাবে। দ্বন্দ্ব থাকবেই, কিন্তু সেই দ্বন্দ্ব সমানে সমানে হবে না এখনকার মতো, এক পক্ষ নিতান্ত সংখ্যালঘিষ্ট হয়ে থাকবে। মতাদর্শগত আধিপত্য এক পক্ষেরই জোরালো হবে।
আমরা যারা এখনও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, মতাদর্শগতভাবে চাই ধর্মনিরপেক্ষ, গণতন্ত্রী ও উদার একটি সমাজ ও রাষ্ট্র, তাদের জন্যও এই লড়াইটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ১৮ দল ও সুশীল সমাজের জয় আমাদের মতাদর্শকে দীর্ঘদিনের জন্য দমিত করে রাখবে। আমাদের অস্তিত্বও হবে বিপন্ন।

অপপ্রচার বাজারে চলে বেশি, এর প্রতি সাধারণের আগ্রহ বেশি। সুকর্মের প্রচার এ দেশে তেমন গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের মতো দেশে একটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় না থেকে এবং থেকে কিছু অপকর্ম করবেই। সরকারে থাকলে নিজেকে গরম মিয়া মনে হয়। এবং সব সময় গরম থাকলে নিজের ক্ষতি হবেই। কিন্তু মিডিয়াতে কোন রাজনৈতিক দল বা সরকার ইতিবাচক কিছু করলে তা খবর হয় না। অপকর্ম করলে তো অবশ্যই হবে এবং হোক, সেটি আমরা চাই। কিন্তু ইতিবাচক বিষয় না তুললে পত্রিকা ভারসাম্য হারায়।
আওয়ামী লীগ সরকারে থেকে অপকর্ম অনেক করেছে। সেগুলো ডিফেন্ড করে কোন লাভ নেই। আমাদের বিবেচনা করতে হয় বিএনপি-জামায়াতের তুলনায় কত কম অপকর্ম করেছে। রাজনৈতিক দলের নেতারা তা করবেনই; কারণ, রাজনীতি এখন মূলত আদর্শের বদলে পেশা। গত কয়েক বছরের পত্র-পত্রিকা দেখুন, মনে হবে এ সরকার ক্ষমতায় এসেছে শুধু অপকর্ম করতেই। কিন্তু সত্য ভিন্ন। উদাহরণস্বরূপ দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত অধ্যাপক এবিএম নাসিরের (১৪.৮.১৩) প্রবন্ধটি উল্লেখ করব। সেখানে কিছু উপাত্ত দেয়া আছে।
নাসির লিখেছেন, ১৯৯০ সালের পর বাংলাদেশে চারটি নির্বাচিত সরকার ও একটি অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থেকেছে। দীর্ঘ ২৫ বছরে সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘন ও হত্যার ঘটনা ঘটেছে বিএনপি আমলে। এর কারণ, জামায়াত চিরজীবন ভায়োলেন্সে বিশ্বাসীনÑ বিএনপির জন্ম ভায়োলেন্সের মাধ্যমে। বিএনপি-জামায়াতের সহযোগী হলো সব মৌলবাদী সংগঠন। খালেদা, নিজামী, তারেকের আমলে বাংলাদেশে সাবেক মন্ত্রী, জনপ্রতিনিধিসহ নিহত হন ‘‘১৩৭ জন, আহত হন ১৪৫৮ জন।’’ গুলিতে মর্মান্তিকভাবে নিহত হন এএসএম কিবরিয়ার মতো অজাতশত্রু মানুষ, আহসানউল্লাহ মাস্টারের মতো জনপ্রতিনিধি, আইভি রহমানের মতো রাজনৈতিক নেত্রী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ইউনুস। আহত হন, এমন কি ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতও। গত চার বছরে কি এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে? বলতে পারেন চৌধুরী আলম বা ইলিয়াস আলীর কথা। কথিত আছে, মেয়র খোকার আমলে টোকাই আলম গুলিস্তানে নাকি বঙ্গবাজার পুড়িয়ে দেয়। তারপর তা দখল করে এক দানে কোটি কোটিপতি হয়ে যায়। বিএনপির দাবি, র‌্যাব তাকে গুম করেছিল। এখন জানা গেছে, আলমের প্রতিদ্বন্দ্বী আরেক টোকাই থেকে কোটিপতি তাকে গুম করে। ইলিয়াস আলী কী উপায়ে অর্থ ও পেশিশক্তির মালিক হয়েছিলেন তা তার সমসাময়িক সবাই জানেন। বিএনপি সরকারই তাকে খুনের দায়ে গ্রেফতার করেছিল। তাকে গুম করে সরকারের লাভ কি? গুম করলে তো তাদের করতে হবে, যাতে রাজনৈতিক ফায়দা আছে। গু-াপা-া গুম করে রাজনৈতিক ফায়দাটা কী? এএসএম কিবরিয়া, আইভি রহমান বা আহসানউল্লাহ মাস্টারের ব্যাকগ্রাউন্ড কি সেরকম? সরকারী প্রচেষ্টায় প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খুনের চেষ্টা তো বিএনপি আমলেই ঘটেছে। যখন বর্তমান সরকারের অপকর্মের কথা ফলাও করে ছাপা হয় তখন সযতনে এসব কথা এড়িয়ে যাওয়া হয় এ বলে যে, পুরনো কথা থাক। পুরনো কথা বাদ দিলে বর্তমান বুঝব কিভাবে?
সাংবাদিক নির্যাতনের কথা আসে। বিএনপি আমলে সাংবাদিক হত্যা করা হয় ১৩ জন। এ আমলে ৭ জন। রাজনৈতিক ভায়োলেন্সে বিএনপি আমলে মৃত্যু ১২৬৫ জন, আর এ আমলে ৭৫৮ জন। [ক্রসফায়ারে আওয়ামী লীগ আমলে ৩৪৬ জন [এ পর্যন্ত], বিএনপি আমলে ৭৯৬ জন। ভায়োলেন্সেও আওয়ামী লীগ হার মানাতে পারেনি বিএনপিকে। তাহলে বুঝুন, দু’একটি ছাড়া অধিকাংশ মানবাধিকার সংস্থার ব্যবসাটি কি রকম!]
না, আমি কোন মৃত্যু, হত্যা, গুম কোন আমলেরই সমর্থন করি না। কিন্তু মিডিয়া এবং রাজনৈতিক দল (বিএনপি-জামায়াত) কিভাবে অপপ্রচার চালায় তার একটি উদাহরণ দিলাম মাত্র। কারণ, পরিসংখ্যানের চেয়ে জোরালো সাক্ষী আর কিছু নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তরুণ অধ্যাপক ছোট একটি নিবন্ধে যা প্রমাণ করেছেন, আওয়ামী লীগের বাঘা বাঘা নেতা-মন্ত্রী-উপদেষ্টা তার কিছুই পারেননি। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস শাখা ও মন্ত্রণালয় [ইনুর আগে] যে কতটা অযোগ্য এটি তার ছোট একটি উদাহরণ। কিন্তু, মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে, অযোগ্যদের এত যোগ্য ভাবেন কেন রাজনৈতিক নেতারা? তারা কি ভাবেন যোগ্য লোক এলে নেতার নেতৃত্ব খাটো হয়ে যাবে? পাশাপাশি ভারতের প্রধানমন্ত্রী বা সোনিয়া গান্ধী কাদের পাশে রাখেন দেখুন।
গত চার বছরে আওয়ামী লীগ যা করেছে গত ২৫ বছরে কোন সরকার তা করেনি। বিলবোর্ডের প্রচার ঠিকই ছিল, কিন্তু মাথামোটা লোকজন পাশে থাকলে যা হয় তাই হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ভেবে অবাক হতে পারেন যে, কার জন্য এত করলাম? তিনি এত করেছেন ঠিকই আছে, কিন্তু সব মানুষ জানবে কিÑ কিভাবে যেখানে তার আশপাশে প্রচার অনভিজ্ঞদের দেয়া হয় প্রচারের দায়িত্বে?
আওয়ামী লীগ যে নির্বাচনে ক্রমাগত হারছে তার কারণ কখনও খতিয়ে দেখা হয়নি। সরকার নীতি নির্ধারণ করে অগ্রাধিকার ঠিক করে তা বাস্তবায়নে জোর দিয়েছে। দেশের অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় দলকে দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। দলের যে নতুন নেতৃত্ব গঠন করা হয়েছে তার একটি উদ্দেশ্য ছিল বটে, কিন্তু তা সফল হয়নি। এর একটি কারণ, সব কিছু দলীয় সভানেতৃত্বে কেন্দ্রীভূত। সমষ্টিগত নেতৃত্ব নেই। যে দলের সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকরা নিষ্ক্রিয় সে দল চলবে কিভাবে? এখন দলের সাংগঠনিক অবস্থা বিপর্যস্ত। এ মন্তব্যে দলের নেতারা ক্ষুব্ধ হতে পারেন। তাতে কিছু আসে যায় না। এ সব মতামত বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় নেতারাই আমাদের জানিয়েছেন। দলের কর্মীরা টাকা ছাড়া এক পা নড়তে নারাজ। এ অবস্থার জন্য দলীয় নেতারাই দায়ী। বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু করলেও বঙ্গবন্ধুর অধিকাংশ আদর্শ থেকে বর্তমান নেতৃত্ব সরে এসেছে। আদর্শের জায়গাটা অনেকটা নড়বড়ে হয়ে গেছে। দলে ত্যাগীদের থেকে অর্থবানদের ইজ্জত বেড়েছে এবং কেন্দ্রীয় সংগঠন জোরালো না হওয়ায় দলের অবস্থা নড়বড়ে হয়ে গেছে। এ কথাটা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে নেতৃত্ব যে, কোন শক্তি কোন দলকে ক্ষমতায় বসায় না। গণতান্ত্রিক নির্বাচনে মানুষই দলকে ক্ষমতায় নেয়। সেই মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে এগিয়ে নেয় সংগঠন। গত চার বছরে সরকার হয়ত উপকৃত হয়েছে, কিন্তু দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যারা ভোট দেবেন স্থানীয় এমপি-নেতাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নেই, রনি-বদিরা এর উদাহরণ। শহুরে সির্ভিল সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষীণ। এলিট সমর্থকরাও উপেক্ষিত। অর্থ ছাড়া সব কিছু যেন অর্থহীন। আওয়ামী লীগ সমর্থক, এলিট ও অর্থবান এফবিসিসিআইয়ের প্রাক্তন সভাপতি যদি পুলিশের পিটুনি খায় তাহলে অবস্থা কী হতে পারে তা অনুমেয়।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ঢাকায় এসেছেন। তিনি বলছিলেন, শেখ হাসিনা বলছেন জিতবেন। আর তার নেতারা নিজ দলকে ৩০/৪০টির বেশি সিট দিতে রাজি নয়, ব্যাপারটা কী? ব্যাপার কেউ জানে না। তবে এটা জানে যাদের নিয়ে শেখ হাসিনা লড়বেন বলে ঠিক করেছেন, ৪ সিটি কর্পোরেশনে হারার পর তারা মানসিকভাবে পরাজিত হয়ে পড়েছেন। এ ধরনের পরিস্থিতিতে দল, হয় লড়াইর জন্য চাঙ্গা হয় না হয় মিইয়ে পড়ে; কিন্তু আওয়ামী লীগ মিইয়ে পড়েছে। এর অন্যতম কারণ দলে এখন কোন দিকনির্দেশনা নেই। এক ঘেরাটোপে আটকে আছেন সভানেত্রী।
আওয়ামী লীগ কী করবে তা আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ঠিক করবে, সেখানে আমাদের বলার কিছু নেই। আমরা কোন পরামর্শ দিচ্ছি না। আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে মনে করে আওয়ামী লীগেরই নেতাকর্মীরা আমাদের যা বলেন তার সারাংশ তুলে ধরলাম। আওয়ামী লীগ এত ইতিবাচক কাজ করেও যদি নেতৃত্বের অকারণ জেদ, অহমিকা ও ভুলের কারণে [ভুল দেখিয়ে দিলেও, ‘আমি যা বলছি তাই ঠিক’Ñ এটিই জেদ, ভুল স্বীকার না করায় কোন মাহাত্ম্য নেই] যদি ১৪ দল পরাজিত হয় তাতে তো আমরা আনন্দিত হব না। খানিকটা হতাশ হই এ ভেবে যে, এত অপপ্রচারের জবাব দেয়ার মতো কোন ব্যক্তি বা দল নেত্রী সৃষ্টি করতে পারেননি। এ জন্য বলা হয়, মূর্খ যোগ্যতাহীন চামচা বন্ধু থেকে বুদ্ধিমান শত্রু শ্রেয়।
অপপ্রচারের কথা বলছি বারবার এ কারণে যে, তা জনমনে শুধু বিভ্রান্তি নয়, দলেও বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। যে প্রচারটি চালানো হয়েছে তাহলো, আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতের সখ্য। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কারণ জামায়াতের ওপর চাপ সৃষ্টি করা; যাতে তারা বিএনপির সঙ্গ ছেড়ে দেয়। বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি আওয়ামী লীগের অনেকে তা বিশ্বাস করে। তারা বিশ্বাস করে, মাদ্রাসা-মক্তবকে তোষণ করলে ভোট আসবে। যে কারণে, নুরুল ইসলাম নাহিদের মতো মানুষ শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার পরও মাধ্যমিক কারিকুলামে ধর্মশিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নয়। মাদ্রাসাকে যে এত তোষণ করা হয়েছে তাতে কি ভোট বেড়েছে? নিতান্ত গবেট না হলে এ ধারণা কিভাবে হয়: যারা জামায়াত করে তারা আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে? বিএনপির সঙ্গে জোট না থাকলেও দেবে না। পাকিস্তান তাদের ফাদার-মাদার। সেই পাকিস্তানকে কাঁচকলা দেখিয়ে বাংলাদেশ হয়েছে, পাকিদের অপমানের চূড়ান্ত করেছে; এটি একজন ট্রু জামায়াতী, ট্রু বিএনপি মেনে নিতে পারে না। হেফাজত কখনও ভোট দেবে না আওয়ামী লীগকে। নারী দেখলে যে আহমদ শফীর লালা ঝরে তাকে তোয়াজে কি ফল হয়েছে? কিন্তু আওয়ামী লীগ তোয়াজ করতে চেয়েছে এবং ঝাঁপটা খেয়েছে। এই অপপ্রচার আওয়ামী লীগের ক্ষতি করেছে। এবং এই বিশ্বাস আওয়ামী লীগের মূল আদর্শ বা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ম্লান করেছে। দলের নেতা শেখ হাসিনা বটে, কিন্তু দলের যে নেতৃত্ব তিনি সৃষ্টি করেছেন তা তাঁর নিয়ন্ত্রণে নেই।
হেজাবিরা যখন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে তখন শেখ হাসিনা [হঠাৎ সৈয়দ আশরাফ] বলেছিলেন, জামায়াত-হেফাজতকে কোন ছাড় দেয়া হবে না। এই উক্তি দলের আদর্শের নড়বড়ে স্থানটা ঠিক করে দিয়েছিল। দলের তৃণমূল নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা চাঙ্গা হয়ে উঠেছিলেন। তার মত অনুসরণ করে একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন শুধু স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী। কিন্তু তাঁর অন্য কোন মন্ত্রী, কোন বড় বা পাতি নেতা, কোন উপদেষ্টা, কোন এমপি এ কথা বলেননি। এমনকি চার পরাজিত মেয়র হেফাজতী ও জামায়াতীদের তোয়াজ করেছেন এবং লাথি খেয়েছেন।
যুদ্ধাপরাধ বিচারের পর এসেছে জামায়াত নিষিদ্ধকরণ ও গোলাম আযমের দ- বৃদ্ধি প্রসঙ্গ। আমরা জেনেছি, এ প্রশ্নেও ছাড় দিতে চেয়েছিল পার্টির কিছু ব্যক্তি [যাদের মিত্র মনে করা হবে আরেকটি ভুল]।
কিন্তু এ দু’টি ক্ষেত্রেই সরকার আপীল করার পর এখন আর অপপ্রচারের কোন সুযোগ নেই। এবং এই কার্যক্রম শেখ হাসিনার নির্দেশ ছাড়া হয়েছে, এটি কোন পাগলও বিশ্বাস করবে না। আদালতের রায় কী হবে জানি না। কিন্তু শেখ হাসিনা যে এই পথটি বেছে নিয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের জায়গাটায় পৌঁছাবার পদক্ষেপ নিয়েছেন, সে কারণেই অন্তত ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনাকে সমর্থন করব।
এ দীর্ঘ পটভূমি দিতে হলো সামান্য একটি কথা বলার জন্য। সেটি হলো যুদ্ধাপরাধ বিচার, জামায়াত নিষিদ্ধকরণ, আওয়ামী লীগের ভূমিকা এবং সম্ভাব্য ফলাফল ও আমাদের অভিজ্ঞতা।
যুদ্ধাপরাধ বিচারের আন্দোলন আমরা দীর্ঘদিন করেছি। বাংলাদেশের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিকদের অধিকাংশ কোন না কোনভাবে জড়িত ছিলেন এ আন্দোলনের সঙ্গে, তাঁদের অনেকে প্রয়াত। তাঁদের অশেষ আকাক্সক্ষা ছিল যুদ্ধাপরাধ বিচার দেখা যাওয়া। আমরা অনেকে এর সঙ্গে থাকলেও এর সাংগঠনিক সব দায়িত্ব পালন করেছেন শাহরিয়ার কবির। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রাণ তিনি, আমাদের অবস্থান প্রান্তিক।
এই আন্দোলন যখন শুরু হয় তখন জামায়াতের মিত্র বিএনপি ক্ষমতায়। সে অবস্থায় এ ধরনের আন্দোলনের সূত্রপাত ব্ল্যাসফেমির মতো। যে কারণে গণআদালত সফল হলে উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা করতে দ্বিধা করেনি খালেদা সরকার। শুরু থেকেই আমরা বলেছিলাম, সিভিল সমাজ এ আন্দোলনের উদ্যোক্তা কিন্ত লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে রাজনৈতিক সমর্থন ও অঙ্গীকার দরকার। রাজনৈতিক দলগুলো যাদের আমরা মিত্র ভাবি তারা সহায়তা করেছিল।
এ কথা বলতে দ্বিধা নেই, শেখ হাসিনা গণআদালত সফল করতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং আওয়ামী লীগের সমর্থক ও কর্মীরাও।
জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পর আন্দোলনে ভাটা পড়লেও আন্দোলন বন্ধ হয়নি। সে সময় রাজনৈতিক কোন সমঝোতা ব্যর্থ হলে শেখ হাসিনা ছাড়া দলের অন্যান্য নেতা আমাদের দোষী করে বলেছেন আমরা অনেক কিছুর জন্য দায়ী। এখনও যখন নেতা বলে পরিচিত, যাদের তত্ত্ব সমঝোতা, তারা বলছেন, নির্মূল কমিটি ও শাহবাগ আন্দোলন হেফাজত-জামায়াতের উত্থানের জন্য দায়ী।
শেখ হাসিনা অনেক সময় রাজনৈতিক কারণে আমাদের আন্দোলনের বিষয়ে নিষ্ক্রিয় থেকেছেন। কখনও সক্রিয় হয়েছেন কিন্তু কখনও নেতিবাচক কোন মন্তব্য করেননি। আন্দোলন চালাবার জন্য পয়সাকড়ি দরকার। তা দিয়েছেন আমাদের সদস্যরা। বোঝা সব সময় ছিল শাহরিয়ারের কাঁধে। আওয়ামী লীগ নেত্রী কখনও কখনও সাহায্য হয়ত পাঠিয়েছেন বলে শুনেছি [সত্যমিথ্যা জানি না] কিন্তু যার মারফত পাঠিয়েছেন তিনি সে সাহায্য মেরে দিয়েছেন। যেহেতু শেখ হাসিনার সঙ্গে আমাদের কোন যোগাযোগ ছিল না সে জন্য বিষয়টি জানা যায়নি। অধ্যাপক কবীর চৌধুরী তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের চিঠি দিয়ে অপেক্ষা করতে করতে মারাই গেলেন। অনেক মুক্তিযোদ্ধা ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর কাছে সাহায্যের জন্য গেছি, অপেক্ষা করিয়েছেন তারপর উপদেশ দিয়ে বিদায় করেছেন। কোন প্রকাশনার জন্য অর্থসাহায্য চাইলে কেউ কেউ সাহায্য করেছেন কিন্তু তাদের নাম উল্লেখ করতে নিষেধ করেছেন। এই ছিল অবস্থা।
আমরা দমিনি। লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হইনি। ব্যঙ্গবিদ্রƒপ, অপমান, উপেক্ষা, সহ্য করেছি কিন্তু লক্ষ্য বিচ্যুত হইনি। তারপর এক সময় দেখলাম যুদ্ধাপরাধ বিচারে সমাজ সক্রিয় হচ্ছে বিশেষ করে তরুণরা আমাদের প্রতি আস্থা রাখছে এবং বিষয়টি এক সময় এমন পর্যায়ে এলো যে ২০০৮ সালের নির্বাচনে ১৪ দলের, এমনকি এরশাদের ম্যানিফেস্টোতেও যুদ্ধাপরাধ বিচারের দাবি অন্তর্ভুক্ত হলো।
বিএনপি-জামায়াতের প্রবল অত্যাচার এই আন্দোলনকে আরও বেগবান করেছে এ অর্থে যে, সমাজের গরিষ্ঠ অংশ অনুভব করেছে, জামায়াত একটি অশুভ শক্তি এবং বিএনপি এর সঙ্গে যুক্ত।
১৪ দল ক্ষমতায় যাওয়ার পর অপপ্রচার শুরু হলো, বিচার হবে না। যেহেতু শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু কন্যা সেহেতু আমরা আশা রেখেছিলাম, বিষয়টি তিনি ভুলবেন না, কথার খেলাপ করবেন না। না, তিনি করেননি।
বিচার শুরু হলে বলা হলো, তদন্তে দেরি হবে। তদন্ত শেষ হলে বলা হলো, লোক দেখানো বিচার। আসলে জামায়াতের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। বিচার শেষ হলে বলা হলো রায় কার্যকর হবে না। বিষয়টি এখন এ পর্যায়ে আছে।
জামায়াতের নিবন্ধীকরণ বাতিলে নির্বাচন কমিশনে আমরাই প্রথমে এর বিরুদ্ধে আবেদন করি। তানিয়া আমীর আমাদের হয়ে শুনানি করেছিলেন। আমাদের কয়েকজনও। নির্বাচন কমিশনাররা আমাদের দাবি যৌক্তিক জেনেও তা নাকচ করে দেন। কারণ নিবন্ধীকরণ নাকচ করার সাহস তাদের ছিল না। আজ দেখি তারা প্রায়ই নির্বাচন নিয়ে আমাদের পরামর্শ দেন। আমাদের মধ্যবিত্তের যে স্বরূপ আগে আলোচনা করেছি তার সঙ্গে এদের সাযুজ্য মিলিয়ে দেখুন। আজ জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে।
নির্মূল কমিটি শুরু থেকেই জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি তুলেছে। এ দাবিকে সবাই অসম্ভব বলেছেন। আজ আদালতের চারটি রায়েই তাদের অপরাধী সংগঠন বলা হচ্ছে। জামায়াতের সাম্প্রতিক কার্যকলাপ এই রায়কে সমর্থন করেছে। বলা হচ্ছিল, যেহেতু জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতা হচ্ছে তাই নিষিদ্ধকরণের ব্যাপারে সরকার নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করবে। এখন দেখা যাচ্ছে সেই নিষিদ্ধকরণের আবেদনও করা হয়েছে। আশা করা যায় ১৫/১৬ সেপ্টেম্বর কাদের মোল্লার আপীলের রায়ও হবে। তখন হয়ত বলা হবে রায় কার্যকর করা হবে না।
আওয়ামী লীগ অন্তত এ ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিয়ে অপপ্রচার রোধ করেছে যে কারণে, তা আগেই উল্লেখ করেছি। মিডিয়া বিষয়টিকে সে কারণে গুরুত্ব দিচ্ছে না।
আমার ধারণা, আওয়ামী লীগের একটি অংশ এ আপীল পছন্দ করবে না। যুুক্তিটা হবে, নিষিদ্ধ করলে জামায়াত আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাবে তখন তাদের চিহ্নিত করা যাবে না। এটি ভুল ধারণা। জামায়াত সংলগ্ন জঙ্গী সংগঠনগুলো আন্ডারগ্রাউন্ডেই আছে এবং তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে।
জামায়াত যদি নিষিদ্ধ হয় তাহলে নতুন নামে তারা নতুন দল করবে। বিএনপিতে একটি অংশ একীভূত হয়ে যাবে। তার দরকষাকষির ক্ষমতা কমে যাবে। লাভ হবে বিএনপির। নির্বাচনে তাদের জামায়াতের সঙ্গে সিট ভাগাভাগি করতে হবে না। অনেক বিএনপি নেতা ফিসফাস করে বলছেন, সরকার এদের নিষিদ্ধ করে না কেন? জামায়াত নিষিদ্ধ হলেও বিএনপিতে ভোট দেবে। লাভবান হবে আওয়ামী লীগও। কারণ গোপন সংস্থা হিসেবে জামায়াত তেমন কার্যকর কর্মপন্থা নিতে পারবে না। যেমনটি হয়েছে হিজবুত তাহরীর ক্ষেত্রে। তবে, বিএনপিতে প্রবলভাবে অনুপ্রবেশের পর বিএনপিকে তারা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করবে।
জামায়াত নিষিদ্ধ হলেও জামায়াতের অর্থনৈতিক ক্ষমতা থেকে যাবে। রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধ হলে প্রকাশ্যে জামায়াত সমাজে যেভাবে প্রভাব বিস্তার করছিল তা হ্রাস পাবে, সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক ক্ষমতাও। একটু সময় লাগবে, এই যা।
রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ সবচেয়ে লাভবান হবে এবং এটি মধুর প্রতিশোধও হবে। বঙ্গবন্ধু জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেছিলেন। রাজাকার বন্ধু জিয়া সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু কন্যার সময় [যদি রায় অনুকূল হয়] জামায়াত আবার নিষিদ্ধ হতে পারে। এতে এ কথা প্রমাণিত হবে যে, শেখ হাসিনা আদর্শের জায়গাটা আবার ফিরিয়ে আনতে যাচ্ছেন যা রাষ্ট্রের জন্য শুভ। তরুণদের সম্পূর্ণ সমর্থন আওয়ামী লীগ পাবে যা হেফাজতের থেকে বেশি। সিভিল সমাজের এ ধরনের আন্দোলনে সর্বতোভাবে ১৪ দলের সাহায্য করা ফরজ। কারণ তাতে তাদের লোকসান নেই, লাভই বেশি।
আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জিতবে কি জিতে না তা জানি না কিন্তু ভোট সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, এটি বলতে পারি। এদেশে এখনও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিরাট সমর্থন রয়ে গেছে। এ শক্তি সক্রিয় করতে পারলে জয় সুনিশ্চিত।
জামায়াত যখন বিএনপি হবে বা বিএনপি যখন জামায়াত হবে তখন তাদের অপ ও অপরাধমূলক রাজনীতি অব্যাহত থাকবে। আমাদের লড়াইটা এখন হবে সাধারণকে বোঝানো যে, অপরাধীদের রাজনীতি এ দেশে চলতে দেয়া উচিত নয়। ক্রিমিনাল অর্গানাইজেশনকে যারা সমর্থন করে তাদের রাজনীতি করতে দেয়া উচিত নয় বরং ভোটের মাধ্যমে তাদের এতিম করে দেয়া উচিত।
এ ধরনের দীর্ঘ আন্দোলনের পথ কণ্টকপূর্ণ ও নিঃসঙ্গ। আমাদের অভিজ্ঞতা তাই বলে। কিন্তু অভিজ্ঞতা আরও বলে রাস্তায় নামলেই তো লক্ষ্যে পৌঁছান যায়, পথ যতই নিঃসঙ্গ আর কণ্টকাকীর্ণ হোক না কেন।
আওয়ামী লীগ অনেক কাজ করেছে কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে ইতিবাচক কাজ হয়েছে যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও জামায়াত নিষিদ্ধকরণে পদক্ষেপ। আমরা যে ধরনের রাষ্ট্র চাচ্ছি, এ ক্ষেত্রে এটি একটি নিশ্চিত পদক্ষেপ। এ পথ বন্ধুর এবং নির্জন। কেননা, এ ক্ষেত্রে দলের সম্পূর্ণ বিশেষ করে দক্ষিণপন্থীদের সমর্থন পাওয়া যাবে না। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও হয়ত প্রতিক্রিয়া হবে। যদি আওয়ামী লীগ পরাজিত হয় তখন শেখ হাসিনার ওপর দোষ চাপানো হবে এবং মন্ত্রী, এমপি ও নেতারা নিজেদের জনবিচ্ছিন্নতা ও অপকর্ম ঢাকার জন্য বলবেন, যুদ্ধাপরাধী বিচার, জামায়াত নিষিদ্ধের প্রক্রিয়া ও হেফাজত দমন পরাজয়ের কারণ। আসলে, পরাজিত হলে পরাজয়ের কারণ যে তা নয়, তা আমরা জানি। সে জন্যই তরুণদের এবং আমাদের পক্ষ থেকে বলতে পারি, যদি পরাজিত হয় ১৪ দল তাহলে দলের সমর্থক ও অধিকাংশ কর্মী দুঃখিত বা হতাশ হবেন না। তারা বরং চাঙ্গা হবেন এ ভেবে যে, অপরাজনীতির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ দাঁড়িয়েছে এবং আবারও একটি উদার গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের দিকে এগুচ্ছে। আদর্শ ক্ষেত্রে আর দোলাচল নেই। এবং তারা গর্ব করে বলতে পারবে, আওয়ামী লীগেরই সাহস আছে এ কাজ করার এবং এ পথ বেছে নেয়ার। মানুষ আজ তা বুঝতে না পারলেও আগামীকাল বুঝবে এবং তখন যে জয় হবে সেটি বিশাল এবং সেই বিশালত্বে হারিয়ে যাবে অপরাজনীতির অপদেবতারা। তরুণদের ভবিষ্যত হবে আরও সম্ভাবনাময়।
মরার আগে মরে কোন লাভ নেই। আওয়ামী লীগ বা ১৪ দলের সমর্থকদের বলব, ব্যক্তিগত মূল্যায়ণের মতো ক্ষুদ্র জিনিস ভুলে যান, সামান্য মানষই এসবকে অসামান্য ভাবে। বাংলাদেশে এখন সময় এসেছে সেøাগান দেয়ারÑঅপ ও অপরাধমূলক রাজনীতি নিপাত যাক। যদি দলীয় নেতারা তাতে যোগ না দেন তাদের ফেলে এগিয়ে যান। তরুণরা যেন শাহবাগ বা ঢাকার দিকে তাকিয়ে না থাকেন, যার যার এলাকায় নিজেরাই সংঘবদ্ধ হয়ে কাজ করুন। হেফাজত, জামায়াত ও বিএনপির বিরুদ্ধে নারীদের বলুনÑহেজাবীরা এলে শফিদের হারেমে যেতে হবে। বলুন, জামায়াতকে সমূলে বিনাশ করে দেশে শান্তি আনতে হলে, দেশকে এগিয়ে নিতে হলে বিএনপির অপ ও অপরাধমূলক রাজনীতি প্রতিরোধ করতে হবে।
জীবনে জয়-পরাজয় বড় ব্যাপার নয়, লড়াই করে যাওয়াটাই আসল। এবং লড়াই করে গেলে জয় আসবেই। কারণ, ইতিহাস আমাদের পক্ষে। দৈনিক জনকন্ঠ

অধিকার, টিআইবি প্রভৃতির কাজ পর্যালোচনা- কেউই আইনের আওতার বাইরে থাকতে পারে না-স্বদেশ রায়


১৫ আগষ্ট ২০১৩
অধিকার নামক এনজিওটির প্রতিষ্ঠা ১৯৯৪ সালে। এর প্রতিষ্ঠাতা হাসান আরিফ ২০০১ সালে জামায়াত-বিএনপি ক্ষমতায় আসার পরে ওই সরকারের আইন উপদেষ্টা বা এ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পান। এবং ওই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম ভোকাল সদস্য আদিলুর রহমান ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পান। কোন রাজনৈতিক দলের সর্বোচ্চ বিশ্বস্ত না হলে কেউ তাকে ওই সরকারের আইন উপদেষ্টা বা সহকারী আইন উপদেষ্টা নিয়োগ করে না। তাই হাসান আরিফ এবং আদিলুর রহমান যে জামায়াত ও বিএনপির বিশ্বস্ত ও তাদের মতাদর্শী তাতে কারও কোন সন্দেহ থাকা উচিত নয়। এবং তাদের এই প্রতিষ্ঠানটি সব সময় তাদের পক্ষে অর্থাৎ জামায়াত-বিএনপির পক্ষে কাজ করে।
যেমন আমরা জানি ২০০১-এর নির্বাচনে নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ওই নির্বাচন আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবার জন্যে। যদিও এসব তথ্য অনেকেরই জানা তারপরেও বলতে হয়, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচন করার পরে তীব্র গণআন্দোলনের মুখে বিএনপি সরকারকে পদত্যাগ করতে হয়। এই পদত্যাগের সময় পর্দার অন্তরালে কিছু কাজ হয়েছিল। বিশেষ করে বিএনপি কিভাবে পদত্যাগ করবে এবং ভবিষ্যত বাংলাদেশ কিভাবে চলবে তার একটি শর্তনামা। ওই শর্তনামা তৈরি করেন আমেরিকান ফরেন রিলেশন কমিটির দু’জন মেম্বার। এদের একজন ডেমোক্র্যাট পার্টির সিনেটর অপর জন রিপাবলিকান পার্টির সিনেটর। প্রভাবশালী এই সিনেটর পেল ও লুগার যে শর্তনামা তৈরি করেন তার তৃতীয় ধারায় বলা হয়, বাংলাদেশের যাবতীয় নির্বাচন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। তাই ২০০১-এর জাতীয় নির্বাচনে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের ভূমিকা ছিল অনেক বেশি। ওই নির্বাচনে অধিকার পর্যবেক্ষক হিসেবে কাজ করে।
২০০১-এর নির্বাচনে যে সীমাহীন অনিয়ম ও কারচুপি হয়েছিল সেটা এখন প্রমাণিত এবং নির্বাচনের আগে ও পরে বাংলাদেশে ঘটেছিল অবর্ণনীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন ও নারী নির্যাতন। নির্বাচনের আগের ওই সহিংসতা নির্বাচনকে কিভাবে প্রভাবিত করেছিল সেটাও কারও অজানা নয়। ওই নির্বাচনকে অধিকার সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হিসেবে সার্টিফিকেট দেয়। যদিও ২০০৩ থেকে অধিকার বার্ষিক প্রতিবেদন বের করা শুরু করেছে। কিন্তু তারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে মতামত দিয়ে আসছে শুরু থেকেই। ২০০১-এর নির্বাচনের আগে ও পরের কোন ঘটনা নিয়ে, কোন সহিংসতা নিয়ে, পূর্ণিমা ধর্ষণ নিয়ে এই মানবাধিকার সংস্থাটির কোন বিবৃতি বা বক্তব্য নেই। বরং ওই সময়ে ২০০১-এর নির্বাচনী কারচুপি ও সহিংসতাকে ‘সুষ্ঠু ও সুন্দর’ বলে সার্টিফিকেট দেবার পুরস্কার হিসেবে হাসান আরিফ এবং আদিলুর রহমান যথাক্রমে জামায়াত-বিএনপি সরকারের দ্বারা এ্যাটর্নি জেনারেল ও ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পান। পাশাপাশি আরেকটি বিষয় ১৯৯৬-এ আওয়ামী লীগ ঐকমত্যের সরকার গঠন করার পর অসমের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার নেতা অনুপ চেটিয়া গ্রেফতার হয়। এই অনুপ চেটিয়ার মানবাধিকার নিয়ে এই সংগঠনটির কম বেশি ভূমিকা আছে। শুধু তাই নয়, অসমের এক সাংবাদিক আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, আদিলুর রহমান শুভ্র এবং ফরহাদ মযহারের সঙ্গে উলফার যোগাযোগ খুব ঘনিষ্ঠ এ বিষয়ে আমি কী জানি। তার প্রশ্নের ভিতর এ বিষয়টি লুক্কায়িত ছিল যে তিনি জানেন তাদের যোগাযোগ খুব ঘনিষ্ঠ। তার প্রশ্নের এক পর্যায়ে আমি বলতে বাধ্য হয়েছিলাম যে, দেখুন এই দুই ব্যক্তির নেত্রী খালেদা জিয়া অনুপ চেটিয়াসহ নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়ার সকল বিচ্ছিন্নতাবাদীকে স্বাধীনতা যোদ্ধা বলেন। ফরহাদ মযহার লিখিতভাবে ও আদিলুর রহমান ব্যক্তিগত পর্যায়ে আলোচনায় একই কথা বলেন। তারা তাদের মানবাধিকার নিয়ে অবশ্যই চিন্তিত থাকে।
অনুপ চেটিয়ার মানবাধিকার নিয়ে চিন্তিত থাকলেও দেশের ভিতর পূর্ণিমাকে জামায়াত-বিএনপি কর্মীর গণধর্ষণ ও সংখ্যালঘু নির্যাতন, হত্যা ও তাদের নারীদের রেপ করার প্রতিবাদে শাহরিয়ার কবির গ্রেফতার হলে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার এ নিয়ে প্রতিবাদ করলেও অধিকারের পক্ষ থেকে কিছুই বলা হয়নি। কিছুই বলা হয়নি কিবরিয়া হত্যা, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলায় তৎকালীন সরকারের মতে ২১ জন নিহত হবার পরেও। যেমন দিন দুয়েক আগে বিএনপি নেতা মেজর হাফিজ বলেছেন, ৫ মে শাপলা চত্বরের ঘটনার পর নাকি হোস পাইপ দিয়ে রক্ত ধুতে হয়েছিল সকাল বেলায়। প্রকাশ্যে এই ঘটনা ঘটল আর একটি টিভি ক্যামেরা সেটা দেখতে পেল না? হাফিজ অবশ্য আন্দাজ করে বলেছেন, কারণ এই কাজটি করতে হয়েছিল ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরে। সে ঘটনার পরেও কিন্তু অধিকারের কোন বিবৃতি ছিল না। আবার দেখা যায় ২০০৬ সালে ১ কোটি ৩৩ লাখ ভুয়া ভোটার তালিকাভুক্ত করে নয় কোটি ৭০ লাখের এক ভোটার তালিকা প্রস্তুত করা হলেও ২০০১-এর নির্বাচনে সার্টিফিকেট দেয়া এই এনজিও অধিকার কোন প্রতিবাদ করেনি। কারণ জামায়াত-বিএনপি একটি কারচুপির নির্বাচন অনুষ্ঠান করার জন্যে এ কাজ করেছিল।
পাশাপাশি হেফাজতের ৫ এপ্রিল সমাবেশ কভার করতে গিয়ে শুধু মাত্র নারী সাংবাদিক হবার কারণে চরমভাবে হেফাজতীদের হাতে নিগৃহীত হন সাংবাদিক নাদিয়া শারমিন ও জাকিয়া আহমেদ। নাদিয়া এখন পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে বাসায় দিন কাটাচ্ছেন। শুধু মাত্র নারী সাংবাদিক বলে এই হামলা যে কত বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন, এই কাজ যে আফগান তালেবানদের কাজের সমতুল্য এ নিয়ে কিন্তু কোন বক্তব্য অধিকারের কোন রিপোর্টে কেউ পাবেন না। এমনকি ৫ মে শাপলা চত্বরে হেফাজতের ওপর হামলা বলে অধিকার যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে সে রিপোর্ট ওয়েবসাইটে আছে যে কেউ দেখলে বুঝতে পারবেন সেখানে কটি সত্য ছবি ও কটি বিদেশী ছবি। শুধু তাই নয়, মৃত বলে চাঁদপুরের এক তরুণের ছবি দেয়া হয়েছে, ওই তরুণ এখন চাঁদপুর মাদ্রাসায় ক্লাস করছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ওই রিপোর্টে হেফাজত ও জামায়াতের মিছিলে গুলি চালাচ্ছে বলে একটি ছবি প্রকাশ করা হয়েছে যেখানে ক্যাপশন দেয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা এ কাজ করছে। কিন্তু ওই রিপোর্টে কোথাও যেমন হেফাজতের তা-ব, তাদের লাশ পলিথিনে জড়িয়ে লুকানো, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দোকান পুড়িয়ে দেয়া, কোরান শরিফ পোড়ানোর মতো যে সব কাজ হেফাজত ও জামায়াত করেছিল তার কোন ছবি নেই। এ সম্পর্কে কোন কথা নেই।
সংক্ষেপে উল্লেখ করলে এমন একটি চিত্র পাওয়া যায়, অধিকারের কাজের ভিতর। অর্থাৎ তাদের কাজের সঙ্গে মূলত জামায়াত ও হেফাজতের কাজের কোন পার্থক্য নেই। অর্থাৎ জামায়াত-বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে এদের আচরণ ভিন্ন হয়ে যায়। অথচ স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তি ক্ষমতায় থাকলে এরা মানবাধিকারের নামে, এনজিও হিসেবে আন্তর্জাতিক ফোরামসহ নানানভাবে এমন তথ্য ও মতামত প্রকাশ করে যা শুধু দেশের ভিতর শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সমস্যা হয় না, দেশের ভাবমূর্তিও নষ্ট করে।
অবশ্য শুধু মাত্র অধিকার নয়, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালসহ কিছু এনজিও আছে যারা স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তি ক্ষমতায় থাকলে মৌলবাদীদের পক্ষে এমন বিকৃত তথ্য ও মতামত প্রকাশ করে। শুধু মাত্র বিকৃত তথ্য নয়, এমন এমন বিষয়ে মতামত প্রকাশ করে যা তাদের আওতার বাইরে। যেমন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল তাদের মূল রিপোর্টে দুর্নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান যা ছিল আর বাংলাদেশের রিপোর্টে ভিন্ন হিসেবে প্রকাশ করেছে। তারা দেশের যাবতীয় সংসদ সদস্য সম্পর্কে ঢালাও মন্তব্য করেছে। তারা তাদের এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে মতামত দিতে পারে অথচ হেফাজতের তা-ব, শফির নারী বিদ্বেষী বক্তব্য বা নারী সাংবাদিকদের ওপর হামলা নিয়ে কোন বক্তব্য দেয় না। তখন তারা তাদের সীমা রেখা দেখে চলে। তাই দেশের সুনাম রক্ষা ও আইনের শাসন বিবেচনা করলে শুধু মাত্র অধিকারের কর্মকর্তা নয়, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের কর্মকর্তারা তথ্য বিকৃতি ও ভুল তথ্য প্রচার করে একই আইসিটির অপরাধ করছে। তারাও আইনের বাইরে থাকতে পারে না। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে এদের অপরাধকেও অপরাধ হিসেবে সমানভাবে গণ্য করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
অন্যদিকে বিষয়টি শুধু যে সরকার আইনের আওতায় আনবে তা নয়, দেশের মানুষকেও বিবেচনায় নিতে হবে। মৌলবাদীরা ক্ষমতায় থাকলে এই সব এনজিও কোন ধরনের বিবৃতি দেয়, তখন অধিকার বা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বিবৃতিগুলো, বক্তব্যগুলো কী হয় আর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকলে কেমন হয়? এ দেশের মানুষ অর্থাৎ আমাদের স্মৃতি শক্তি একটু দুর্বল। আমরা সহজে ভুলে যাই। এবং আওয়ামী লীগেরও প্রথম চার বছর তথ্য মন্ত্রণালয়ে কোন সত্যিকার মন্ত্রী না থাকায়, এগুলোর তুলনামূলক বিচার করা হয়নি। প্রচার করা হয়নি। যে কারণে মানুষ আরো দ্রুত এগুলো ভুলে গেছে। বর্তমান তথ্যমন্ত্রী অধিকারের বিষয় নিয়ে যে তথ্যপূর্ণ ও যুক্তিপূর্ণ বিবৃতি দিয়েছেন সেটা যথার্থ। তিনি বলেছেন, অধিকার মূলত জামায়াত-বিএনপি ও হেফাজতের পক্ষে প্রচারণার অংশ হিসেবে তাদের অঙ্গ সংগঠন হিসেবে কাজ করেছে। পাশাপাশি তিনি এখন অধিকার, টিআইবি প্রভৃতি এনজিওগুলোর জামায়াত বিএনপি আমলের বক্তব্য বিবৃতি ও বর্তমান সরকারের সময়ের বক্তব্য বিবৃতিগুলোর চিত্র মানুষের সামনে তুলে ধরতে পারেন। বিশ্লেষণ তুলে ধরতে পারেন।
কারণ, আজ দেশের মানুষ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এদেরকে দেশের সুশীল সমাজের ভয়েস হিসেবে মনে করছে। এদের বক্তব্যকে দেশের সুশীল সমাজের বক্তব্য হিসেবে মনে করে। কিন্তু বাস্তবে এরা যে ছদ্মমৌলবাদী। এরা যে বাস্তবে প্যান্ট শার্ট পরা হেফাজতী এই সত্যটি তথ্যসহকারে প্রচার করে দেশের মানুষ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভুল ভাঙ্গানো প্রয়োজন দেশকে মৌলবাদমুক্ত করার জন্য। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশে গণতন্ত্র চায়। কিন্তু যতদিন মৌলবাদীদের এই ছদ্মবেশী সুশীল বন্ধু থাকবে ততদিন উদার গণতন্ত্র এখানে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয়। তাদেরও সত্য জানতে হবে।
swadeshroy@gmail.com সূত্র: দৈনিক জনকন্ঠ

Wednesday, August 14, 2013

নাফিস ঢাকায় থাকাকালে জঙ্গী নেতা মুফতি জসীমউদ্দিনের খুতবা শুনতে বছিলায় যেতেন :রাজীবের খুনিদের স্বীকারোক্তি


১৪ আগষ্ট ২০১৩
ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যার সময় ঘটনাস্থলে মুফতি জসীমউদ্দিন উপস্থিত না থাকলেও তিনি হত্যায় জড়িত নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ করেছেন। রাজীব হত্যায় গ্রেফতার হওয়া পাঁচ শিক্ষার্থী জিজ্ঞাসাবাদে ডিবিকে জানিয়েছিল, তাঁদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে ৩০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত কাজী রেজওয়ানুল আহসান নাফিস ঢাকায় থাকাকালে মুফতি জসীমউদ্দিনের খুতবা শুনতে বছিলায় যেতেন। জসীমউদ্দিনের বক্তব্যে তাঁরা ‘নাস্তিক’ ব্লগারদের হত্যা করতে অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
হঠাৎ গজিয়ে ওঠেনি উগ্র সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। রাজশাহীর বাংলা ভাই খ্যাত জমিয়তুল মুজাহিদীনের শীর্ষ নেতাদের একের পর এক ফাঁসি কাযর্কর হওয়ার পর থেকেই কঠোর গোপনীয়তায় সংগঠিত হতে থাকে নতুন আবিষ্কৃত এ সংগঠনটি। এ দিকে গোয়েন্দা সংস্থার সাঁড়াশি অভিযানে রাজধানী ও বরগুনার আস্তানা থেকে উদ্বারকৃত কাগজপত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান মনিরুল ইসলাম জানিয়েছেনÑ বাংলা টিমের হিট লিস্টে বেশ কয়েক জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের নাম পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে রয়েছে মন্ত্রী, সাংসদ, নেতা, ব্লগারসহ অন্যেরা। তাদের নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলেও জানা গেছে। তবে এত গোয়েন্দা তৎপরতা থাকা সত্ত্বেও ঢাকা ও বরগুনায় জঙ্গী বাংলা টিমের উত্থানে তোলপাড় চলছে।মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, রাজধানীর আরও কয়েকটি এলাকায় জসীমের বেশ কয়েক শিষ্যকে গ্রেফতারের জন্য অভিযান চালানো হয়েছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) মঙ্গলবার রাজধানীর বছিলা মসজিদসংলগ্ন মুফতি জসীমের কার্যালয়ে প্রায় দেড় ঘণ্টা তল্লাশি চালায়। এ সময় কম্পিউটার, ল্যাপটপ, বেশকিছু বই ও অর্ধ শতাধিক সিডি উদ্ধার করা হয়। আদালত থেকে তল্লাশি পরোয়ানার অনুমতি নিয়ে অতিরিক্ত উপকমিশনার মশিউর রহমানের (এডিসি) নেতৃত্বে ডিবির একটি দল মোহাম্মদপুরের বছিলা রোডে মেট্রো হাউজিং এলাকায় ওই মাদ্রাসায় অভিযান চালায়। এ সময় কর্তব্যরত কর্মচারী হেলালউদ্দিন মাদ্রাসার তালা খুলে দিলে ডিবি পুলিশ তল্লাশি শুরু করে। উদ্ধারকৃত মালামাল ট্রাকে ভরে ডিবি কার্যালয়ে এনে জব্দ তালিকা তৈরি করা হয়।
তবে এ সময় বছিলায় মারকাজুল উলুম আল ইসলামিয়া মাদ্রাসার পাশে জসীমের টিনশেডে অফিসে কাউকে পায়নি পুলিশ। গোয়েন্দা পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে তারা আগেই সটকে পড়ে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেÑ অভিযানের আগের রাতেও সেখানে বেশ কয়েজনকে অবস্থান করতে দেখা গেছে।
উল্লেখ্য, গত সোমবার দুপুরে বরগুনার দক্ষিণ খাজুরতলা এলাকায় গোপন বৈঠক করার সময় বাংলাদেশে আনসারুল্লাহ প্রধান মুফতি জসীমসহ ৩১ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। মঙ্গলবার দুপুরে মুফতি জসীমকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড চায় পুলিশ। আদালত ২১ আগস্ট শুনানির দিন রেখে তাঁকে জেল হাজতে পাঠায়।
এ ব্যাপারে বরগুনার পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথ বলেন, মুফতি জসীম উদ্দিন রাহমানী একজন উগ্রপন্থী নেতা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাঁর কাছ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। তাঁর বিরুদ্ধে ঢাকার পল্লবী ও উত্তরা থানায় দুটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে পল্লবী থানার মামলায় ব্লগার রাজীব হত্যা মামলার সন্দেহভাজন আসামি। উত্তরা থানায় দায়েরকৃত আসিফের ওপর হামলার মামলায়ও আসামি তিনি। গ্রেফতারকৃত ৩০ জনই মুফতি জসীমের অনুসারী। তাদের সবার বিরুদ্ধে বরগুনা থানায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনেও একটি মামলা করা হয়েছে। জানা যায়, মুফতি জসীমউদ্দিন এ মাদ্রাসার পরিচালক। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান আস্তানা হিসেবে মাদ্রাসায় সব কাজ চলত। এলাকায় এটা মারকাজ নামে পরিচিত। বিভিন্ন এলাকা থেকে তাঁর মতাদর্শের অনুসারীরাসহ আনসারুল্লাহর সদস্যরা শুক্রবার সেখানে জুমার নামাজ পড়েন। নামাজ শেষে পাঠচক্রে অংশ নেন। এ ছাড়া বিভিন্ন নির্দিষ্ট দিনে তাঁদের সাংগঠনিক আলোচনা-বয়ান ও বৈঠক হতো।
আলোচিত এই জসীম বরগুনার দক্ষিণ হেউলিবুনিয়া গ্রামের নূর হাওলাদারের ছেলে। তিনি এক সময় ভারতের দেওবন্দে পড়াশোনা করেছেন।পরে হায়দরাবাদের সাবেলুস সালাম মাদ্রাসা থেকে মুফতি (ফিকা শাস্ত্রে) পাস করেন। তারপর তিনি ঢাকার জামেয়া রাহমানিয়া মাদ্রাসায় ও বরিশালের মাহমুদিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। কিছুদিন বরগুনা কেন্দ্রীয় সদরঘাট জামে মসজিদে প্রধান খতিব হিসেবেও চাকরি করেন। পরে সৌদি আরবের মদিনায় লিসানস বিশ্ববিদ্যালয়ে খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। সেখান থেকে দেশে ফিরে প্রথমে ধানমন্ডির হাতেমবাগ মসজিদের খতিব ছিলেন। এরপর তিনি মোহাম্মদপুরের বছিলায় মারকাজুল উলুম আল ইসলামিয়া মাদ্রাসা ও মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। মারকাজুল উলুম আল ইসলামিয়া নামে একটি প্রতিষ্ঠানও চালান তিনি। ওই মাদ্রাসা ও মসজিদ থেকে দীর্ঘদিন ধরেই উগ্র মতবাদ প্রচার করে তরুণদের জিহাদে উদ্বুদ্ধ করে আসছেন জসীম। তাঁর বিরুদ্ধে জঙ্গী সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ গোয়েন্দারা তদন্ত করে দেখছেন। জসীমউদ্দিন আগে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের বরিশাল জেলার সভাপতি ছিলেন। তবে মতবিরোধের দরুন তিনি ১৯৯৭ সালে ওই দল থেকে পদত্যাগ করেন। তারপর থেকেই তিনি খিলাফত তথা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে প্রচার করতে থাকেন। বাংলা টিমের আড়ালে জসীমউদ্দিন যে এত বড় একটা গোপন উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর নেতা ছিলেন তা জানতো না এলাকাবাসী।

প্রসঙ্গত, গত ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পল্লবীর পলাশনগরের নিজ বাসার কাছে ব্লগার রাজীব হায়দারকে (৩৪) কুপিয়ে ও ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির পাঁচ শিক্ষার্থী ফয়সাল বিন নাঈম ওরফে দীপ, মাকসুদুল হাসান ওরফে অনিক, এহসান রেজা ওরফে রুম্মান, নাঈম সিকদার ওরফে ইরাদ ও নাফিস ইমতিয়াজ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতেও মুফতি জসীমের কাছে যাওয়ার কথা বলেছেন। জসীম ইতিমধ্যে তরুণ চিকিৎসক, শিক্ষক ও প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং শ্রমজীবী মিলে বেশ কিছু অনুসারীদের যুক্ত করে বিস্তৃত করেন জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম।

বঙ্গবন্ধুর ধর্মানুভূতি ও কিছু কথা :অধ্যক্ষ আলহাজ্ব ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী




১৫ আগস্ট জাতীয় শোকদিবস। মানব ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডে সপরিবারে শাহাদত বরণ করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। কালের চক্রে একুশটি বছর পার হয়েছে। কিন্তু অপবাদের চাকা এখনো থামেনি। মিটিং, মিছিলে, নির্বাচনে, এমনকি সিরাতুন্নবী সম্মেলনে চলছে অপপ্রচার। স্বার্থান্বেষী মহল যারা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চায় বা ধর্মের বেসাতি করে রাজনৈতিক অঙ্গনে টিকে থাকার অপপ্রয়াস চালায়, তারাই জীবিত মুজিবের চেয়ে মৃত মুজিবকে ভয় পায়। তাই মৃত ব্যক্তিকে নিয়েও এই টানা হেঁচড়া। এমনকি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর জেনারেল জিয়া ফরমান জারি করেছিলেন, মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে রাজনীতি করা চলবে না। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, কিছুদিন যেতে না যেতেই বেগম জিয়াকেও মৃত ব্যক্তির নামে রাজনীতি করতে হয়।

কি অপরাধ ছিলো এই রাখাল রাজার, এই মুকুটহীন সম্রাটের? যৌবন গেছে জেলে। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন বেশ ক’বার। মাথা নোয়াননি। আপস করেননি পশ্চিমা শোষকের সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রীত্বের টোপও তাঁকে কাবু করতে পারেনি। তাইতো হাজার বছরের পরাধীন বাঙালি আজ স্বাধীন। ইতিহাসের মহানায়ক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ একুশটি বছর সরকারিভাবে অনাদৃত, অবহেলিত, রেডিও টেলিভিশন থেকে নির্বাসিত তাঁরই সৃষ্টি স্বাধীন দেশে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চাওয়া যাবে না, কি অদ্ভুত ফরমান। সত্যি বিচিত্র এদেশ সেলুকাস! মুক্তিযোদ্ধারা পথে পথে ক্ষমতার মসনদে রাজাকার।

বঙ্গবন্ধুর অপরাধ সংবিধানে জাতীয় চার মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র শব্দ দু’টি সংযোজন করেছিলেন। যদিও তিনি বার বার বলেছিলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। যার ধর্মে সে বিশ্বাসী হয়ে নিজ নিজ ধর্ম নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করার আহবান জানিয়েছিলেন। তাঁর এই সহজ সরল কথাগুলোকে অপব্যাখ্যা করে তাঁকে কেউ নাস্তিক, কেউ হিন্দু ঘেষা আবার কেউ ইসলাম ধর্মের প্রতি তাঁর কোন অনুরাগ ছিলো না বলে অপপ্রচার চালায়। সরলপ্রাণ বাঙালি মুসলমানেরা অনেকাংশে বিভ্রান্তও হয়। এহেন হীন ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করার জন্যে বঙ্গবন্ধুর চেতনা ও ধর্মানুভূতির সঠিক মূল্যায়ন করার বাস্তব চেষ্টা তেমন হয়নি। এর দায়ভার আপনার আমার সবার। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির। তিনি আজ আমাদের মধ্যে নেই। আজ সময় এসেছে জনমনের সেই সংশয় সন্দেহ দূর করার।

“লাকুম দ্বীনকুম অলিঅদিন।” “লা ইকরা ফিদ্দিন”।
এগুলোতো কোরআনেরই আয়াত। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা স্বয়ং স্রষ্টাই নিষিদ্ধ করেছেন। ইসলামের ইতিহাসের দিকে তাকালেও আমরা দেখি, রসুলে করিম (সঃ) যখন মক্কা থেকে মদিনায় হিযরত করেন, তখন তাঁর সঙ্গে যাঁরা ছিলেন, তাঁরাই শুধু মুসলমান। মদিনায় যাঁরা ছিলেন তাঁরা সবাই ইহুদি, নাছারা। আল্লাহর সবচেয়ে পেয়ার নবী ইচ্ছা করলে সবাইকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে মদিনা শরীফে ইসলামি শাসন কায়েম করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি ইহুদি নাছারাদের ডেকে এক জায়গায় বসে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে একটি চুক্তিতে উপনীত হয়ে মদিনা শরীফের জন্যে একটি বিশেষ শাসন ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। সেই চুক্তির নাম ‘মদিনাসনদ’-দুনিয়ার প্রথম লিখিত সংবিধান। এই সনদের প্রথম শর্তে মদিনার সকল অধিবাসীর ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করে যার ধর্ম সে বিনা বাধায় পালন করার অধিকার দিয়েছিলেন। হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিষ্টানদের মিলিত রক্ত স্রোতের মধ্যে দিয়ে যে দেশের জন্ম বঙ্গবন্ধু সেই দেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি সংযোজন করলে কেমন করে ইসলাম বিরোধী কাজ হয়, আমার বোধগম্য নয়।

আমি বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের একজন নগণ্য কর্মী হলেও তাঁর সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ হয়েছিলো। তাঁকে অত্যন্ত কাছ থেকে দেখেছি। তাঁর জীবনের বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহ লক্ষ্য করেছি। কর্মকাণ্ড দেখেছি এবং বক্তব্য শুনে আমার এই দৃঢ় প্রতীতি জন্মেছে যে, তিনি ছিলেন একজন খাঁটি মুসলমান এবং মানব প্রেমিক। আল্লাহর প্রতি তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস না থাকলে ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায়, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের সেই ভয়াল রাতে গুলির মুখে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে পারতেন না। পারতেন না পাকিস্তানি কারাগারে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাঙালির প্রাণের দাবি স্বাধীনতা প্রশ্নে অনঢ় থাকতে। তিনি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতেন-হায়াত, মউত, রিজিক ও দৌলত একমাত্র আল্লাহর হাতে। আল্লাহ না মারলে কেউ তাঁকে মারতে পারবে না তাইতো ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কথা না ভেবে রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও প্রটোকল বেষ্টনীর বেড়াজাল ছিন্ন করে মানুষের মাঝে চলে যেতেন। সম্পূর্ণ নিরাপত্তাহীন অবস্থায় নিজ বাসভবনে অবস্থান করতেন। তাঁর ধর্মের প্রতি অনুরাগ ছিল বলেইতো বাংলাদেশের সংবিধান পাস করিয়েছিলেন শবে-কদর রাতে। অনৈসলামিক ভেবেই তো মদ জুয়ার বিরুদ্ধে আইন করে নিষিদ্ধ করেছিলেন। কোরআন হাদিসের উপর গবেষণা করার জন্যেই তো বাংলাদেশ ইসলামী ফাউন্ডেশনের সৃষ্টি করেছিলেন। পাকিস্তান আমলে কওমী মাদ্রাসাগুলো কোনদিন সরকারি সাহায্য পায়নি। ইসলামী শিক্ষা বিস্তারের জন্যেইতো বঙ্গবন্ধু সরকারি বেসরকারি মাদ্রাসা নির্বিশেষে টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন এবং পৃথক মাদ্রাসা বোর্ড সৃষ্টি করে সকল মোদাররেসিন কে সরকারী কর্মচারীর মতো রেশন ভাতা দেওয়ার নীতি চালু করেছিলেন। তাবলীগের জামাতের লোকদের সুবিধার্থে কাকরাইল মসজিদটি সম্প্রসারণের ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। তুরাগ নদীর পাড়ে বিশ্ব এস্তেমার জন্য পাঁচশত একর জমি বন্দোবস্তি দিয়েছিলেন যিনি, তিনিইতো বঙ্গবন্ধু।

সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশ। সৌদি সরকারের স্বীকৃতি নেই। ভাণ্ডারে বৈদেশিক মুদ্রারও দারুণ অভাব। হাজিদের যাতায়াতের জন্যে স্টিমার বা বিমান কিছুই ছিল না। বাঙালি মুসলমানদের হজ্বে যাবার দাবিও ওঠেনি। হজ্বের মৌসুম এলে শুধু ধর্মানুভূতির কারণেই লন্ডন থেকে একটি বিমান ভাড়া করে প্রতি হাজী থেকে ৪৭০০/= টাকা করে নিয়ে পাঁচ হাজার হাজীর হজ্ব প্রতিনিধিদলে নেতা করে আমাকেই সৌদি আরব পাঠিয়েছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে ঘোষনা করলেও বাংলাদেশকে অরগানাইজেশন অব ইসলামিক কান্ট্রিস (ওআইসি)-এর সদস্য করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। রাশিয়াতে কোনদিন তাবলিগ জামাত যেতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টায় ১৯৭৩ সালে রাশিয়াতে প্রথম তাবলীগ জামাত যাবার সুযোগ পায়। বায়তুল মোকাররম মসজিদটি খাস জমির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। সেই জমিটুকু বায়তুল মোকাররম মসজিদের নামে বন্দোবস্ত দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।

১৯৭৩ সালে ইহুদিরা যখন মিশর আক্রমন করে, এই বাংলাদেশ থেকেই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী বঙ্গবন্ধু প্রথম আওয়াজ করেছিলেন, “আরব ভাইরা, আমি জানতে পেরেছি, গত রাতে ইহুদিরা তোমাদের উপর আক্রমন করেছে। আমার নতুন স্বাধীনপ্রাপ্ত দেশ। আমার কিছুই নেই। আমার আছে রক্ত। রক্ত নিয়ে যাও। আহত আরব ভাইদের বাঁচাও। আমার আছে চা, চা পাঠালাম। আর আছে মুক্তিযোদ্ধা, তাদের পাঠালাম। তারা তোমাদের পাশে দাঁড়িয়ে ইহুদির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। আরব ভূমি মুক্ত রাখবে।” আজো তো সেই মুক্তিযোদ্ধা মাঝে মাঝে লাশ হয়ে ফিরে আসে বাংলার মাটিতে।

এছাড়াও দু’একটি ঘটনা উল্লেখ করলে স্পষ্টত অনুধাবন করা যাবে, কি ছিল বঙ্গবন্ধুর মন মানসিকতা, কি ছিল তাঁর ধর্মানুভূতিতে? বাকশাল গঠিত হওয়ার পরেরদিন। ২৬ জানুয়ারি ১৯৭৫ সন্ধ্যা ৭টা। মন্ত্রিরা শপথ নিলেও দফতর বন্টন তখনো বাকি। কি একটা কাজে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্য গণভবনে গিয়েছি। দেখি, বঙ্গবন্ধু, সর্ব জনাব ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, কোরবান আলী, আবদুল মোমিন তালুকদারের সঙ্গে গল্প গুজবে মেতে আছেন। আমি আস্তে আস্তে করে দরজা ঠেলে ঢুকে সোফার একপাশ বসে তাঁদের কথা শুনেছিলাম। এমনি সময় বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব ফরাসউদ্দিন একটি ফাইল হাতে ঘরে ঢুকলেন। তাঁর হাত হতে ফাইলটি নিয়ে বঙ্গবন্ধু সেক্রেটারিয়েট টেবিলের পেছনের চেয়ারে গিয়ে বসলেন এবং ফাইলের উপর চোখ বুলাচ্ছিলেন। হঠাৎ দেখি, তিনি তাঁর পরিহিত মুজিব কোট থেকে একটি তজবিহ জপছেন এবং তজবিহ শেষ করে বিছমিল্লাহির রহমানির রহিম বলে ফাইল দস্তখত করে বললেন, “আল্লাহ এইবার হলেও তাঁদের সঠিক ভাবে কাজ করার তৌফিক দিন।” এই দৃশ্য আমার চোখে নতুন। তাই আনমনে একটি মুচকি হেসে ফেলেছিলাম। তিনি দেখে ঈষৎ রাগতস্বরে বললেন, “হাসলে কেনো? আফটার অল আই এম এ মুসলিম। আরবীতে একটি আয়াত পড়ে বাংলায় তর্জমা করে বললেন, লোক দেখানো ধর্ম পালন করা পূন্যের চেয়ে গুণাহ বেশি। আমি এমন কিছু করি না যা লোক দেখানো।” তখন আমি তো ভয়ে চুপসে গেছি। এক পর্যায়ে ফরাস উদ্দিন বললেন, স্যার আপনি কোরআন তেলাওয়াত করছেন যে আমি দেখেছি। কোথায় দেখেছো? কেমন করে দেখেছো, এই ধরনের প্রশ্ন অবতারণা তিনি করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। তা না করেই পসঙ্গান্তরে চলে গেলেন। বঙ্গবন্ধু প্রায় সময় কোরআন তেলাওয়াত করতেন সেই কথা খোন্দকার মোশতাক সাহেবের (খুনি) মুখে একবার শুনেছিলাম। ১৯৭৮ সালে কক্সবাজারে বার্মিজ রিফিউজি আসলে রেডক্রমের অফিসারদের মুখেও শুনেছি। ঘূর্ণিঝড়ের সংকেত পড়লে তিনি জায়নামাজ বিছিয়ে বসে যেতেন, এবাদত করতেন, কোরআন তেলাওয়াত করতেন আর মাঝে মাঝে পার্শ্বে রক্ষিত টেলিফোন ধরে উপকূলীয় অঞ্চলের খবরাখবর নিতেন। তারই প্রমাণ আমি নিজে পেয়েছিলাম।

১৯৭৫ সালে আমি একদিন ঢাকায়। তার কয়েকদিন আগেই ঘূর্ণিঝড় কক্সবাজারে আঘাত হেনেছে। তিনি আমাকে দেখে ঘূর্ণিঝড়ের খবরাখবর নিলেন এবং হেসে বললেন তোমার ভাবী কি বলেছে জান? ‘এবার তোমার এবাদতে কোন কাজ হলো না।’ এর থেকে বোঝা যায়, ঘূর্ণিঝড়ের রাতে তিনি যে এবাদতে করতেন। আমি তাঁকে জামায়াতে তারাবীর নামাজ আদায় করতেও দেখেছি। চৌদ্দশত বছর আগে রসুলে করিম (সঃ) মক্কা বিজয়ের পর কেরায়েশদের যেভাবে সাধারণ ক্ষমা ঘোষনা করেছিলেন, তারই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে অপেক্ষাকৃত কম অপরাধী স্বাধীনতা বিরোধী আল বদর রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যদের জন্যে তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষনা করেছিলেন। এ ধরনের নজির চৌদ্দশত বছরের মধ্যে মুসলমানদের ইতিহাসে আছে কি? দুঃখজনক হলেও সত্য, যারাই তাঁর সাধারণ ক্ষমার মাধ্যমে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত, তারাই বেশি তাঁর সমালোচনায় মুখর। স্বয়ং আল্লাহই বলেছেন অকৃতজ্ঞ ব্যক্তিকে আল্লাহ ভালোবাসেন না।

যিনি সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা তুলে দিয়ে, মুখবন্ধে বিছমিল্লাহির রহমানির রহিম লিখেছিলেন, তাঁর আমলে কি দেখেছি? মদ জুয়া আবার জায়েজ হয়েছে। জায়গায় জায়গায় আনন্দ মেলার আয়োজন করে হাউজি বাম্পার, প্রিন্সেস জরিনা সুন্দরী, প্রিন্সেস লাকি খানের নাচ দেখিয়েছেন আর যুব সমাজের চরিত্র হনন করেছেন। কওমী মাদ্রাসাগুলোকে সরকারি সাহায্য থেকে করেছিলেন বঞ্চিত।

কেউ কেউ বলতে পারেন, বঙ্গবন্ধু যদি এতই ইসলাম প্রেমিক হন, রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা যোগ করলেন কেনো? তারও জুতসই জওয়াব আছে। ইসলামী অর্থনীতির মূল কথা কি? শ্রমিকের ঘাম শুকাবার আগে পারিশ্রমিক দিতে হবে। সবার খাওয়া পরা, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের সুযোগ সৃষ্টির জন্যেই বায়তুল মাল। অর্থ্যাৎ রাষ্ট্রীয় তহবিল। জাকাত ফেতরা প্রদানের নির্দেশ নামার লক্ষ্যই হচ্ছে সম্পদের সুষম বন্টন। আর সম্পদের সুষম বন্টনের কথাই বলেছে সমাজতন্ত্র। ইসলামী অর্থনীতি ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মূল কথাই হচ্ছে, সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর এবং মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা। দু’টির মধ্যে প্রক্রিয়াগত ভিন্নতা আছে, আদর্শ উদ্দেশ্য এক। ইসলামী অর্থনীতি আবর্তিত হয় আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও আনুগত্য নিয়ে, আর সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি নিয়ন্ত্রিত হয় বস্তু জগতের আইনের শাসনে। লক্ষ্য বিচার বিশ্লেষণে অর্থনৈতিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার সমাজতান্ত্রিক আবেদন রেখেছে এই পৃথিবীতে সর্বপ্রথম ইসলাম। সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা কার্লমার্কস, এঙ্গেলস, লেনিনের জন্মতো অনেক অনেক পরের ঘটনা। বর্তমান জামানায় ক’জনই বা নীতিগতভাবে জাকাত দেয়? আল্লাহকে আমরা সবাই ভয় করি। সত্যিকার অর্থে যেমন ভয় করা উচিৎ, তেমন ভয় করে আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবন নিয়ন্ত্রণ করি কি? নিশ্চয় করে না বলেই মালিক শ্রমিককে ঠকায়। জিনিসে ভেজাল দেয়। মানুষকে অভুক্ত রেখে সম্পদের পাহাড় গড়ে। তাই প্রয়োজন হয় রাষ্ট্রীয় আইনের। এই আইনের মাধ্যমেই বৈষম্য দূরীকরণের প্রক্রিয়া নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাই তিনি ঘোষনা করেছিলেন, “কোন দেশ থেকে আমার সমাজতন্ত্র জন্ম নেবে”।
তিনি শুধু একথাই বুঝাতে চেয়েছিলেন যে, বাংলাদেশের অর্থনীতি শুধু বস্তুজগত নিয়েই আবর্তিত হবে না। আধ্যাত্মিক ভাবধারা দিয়েও নিয়ন্ত্রিত হবে।

বিগত একুশটি বছর ধরে কারা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত? একটু পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, কিছু জমিদার-জোতদার, কিছু ধনিক-বণিক এবং কিছু স্বার্থান্বেষী ধর্ম ব্যবসায়ী। কেনো তারা একুশ বছর পরেও তাকে ক্ষমা করতে পারছেন না? তার কারণ শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধু কিছু আইন রচনা করেছিলেন, যেগুলো তাদের স্বার্থে আঘাত করেছিল। ভূমির সিলিং বসিয়ে একশত বিঘার ঊর্ধ্বের জমি সরকারিকরণ এবং সরকারি খাসজমি ধনিক শ্রেনীকে না দিয়ে ভূমিহীন কৃষকদের মাঝে দেড় একর করে বিনা সালামিতে বিতরণের ব্যবস্থা করেছিলেন। এতে ক্ষুব্ধ হয় জমিদার জোতদার। পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত ব্যাংক বীমা কলকারখানা জাতীয়করণ করে শ্রমিক কর্মচারিদের অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা নিয়ে ধনিক বণিকের বিরাগ ভাজন হয়েছিলেন। ধর্ম ব্যবসায়িরা এতদিন ধর্মকে শোষন নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ধর্মের নামে পাকিস্তান টিকিয়ে রাখার জন্যে আমার মা বোনের ইজ্জত লুটেছে। হত্যা করেছে লাখো বাঙালি। তাই বঙ্গবন্ধু ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। এতে ক্ষীপ্ত হয়, স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি আলবদর-রাজাকার। এই স্বার্থান্বেষী মহলের ভয়-মৃত মুজিব যদি আদর্শের মুজিব হয়ে বাংলার ঘরে ঘরে আবার আসে, তাদের আর রক্ষা নাই। তাই অপপ্রচার চালিয়ে বঙ্গবন্ধুকে খাটো করতে চায়। মানুষের মন থেকে তাঁকে দূরে রাখতে চায়। সেজন্যে ইতিহাস বিকৃতি। সেজন্যেই ধর্মের নামে হাত কাটে, রগ কাটে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির। আজ তারা ব্যর্থ। দীর্ঘদিন পরে হলেও বাংলার মানুষ বুঝেছে। তাই ১২ জুনের নির্বাচনে বাংলার বীর জনতা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে, বঙ্গবন্ধু আদর্শের পক্ষে রায় দিয়েছে। সেই সুবাদে আজ তাঁরই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।

বস্তুত বাংলাদেশটা স্বাধীন হয়েছে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ খ্রিস্টানের, মিলিত রক্ত দানে। ইসলাম নীতির ধর্ম। ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইনসাফের ধর্ম। সেই ইনসাফই কায়েম করতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি ধর্মভীরু মানুষ চেয়েছিলেন, ধর্মান্ধ নয়।

স্মৃতি বড়ো মধুর। স্মৃতি বড়ো বেদনাদায়ক। সেই বেদনাদায়ক স্মৃতির কথাই বলছি। ১৯৭৫ সালের ৮ জুলাই। বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের মাত্র কটা দিন আগে। আমাকে গণভবনে দেখে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “সরওয়ার, এবার আমি হজ্বে যাব”।
তখন অনেক মন্ত্রী, গভর্নর তার পাশে। মন্ত্রী সোহরাব হোসেন বললেন, “এবার আমাকে পাঠান স্যার আমাকে পাঠান”।
প্রত্যুত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “নারে না, তোদের অনেক সময় রয়েছে, আমার সময় ফুরিয়ে আসছে, এবার আমি হজ্বে যাব” সে কথাগুলো আজো আমার মনে বাজে। পঁচাত্তরের ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে সে সুযোগ দান করেনি।


রেফারেন্স: সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে, লুৎফর চৌধুরী সম্পাদিত, পৃষ্ঠা ৫৩।

Wednesday, August 7, 2013

আমাদের ঈদ- সুমি খান


বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আমাদের ঈদ
১৯৭১ সাল। চট্টগ্রামের পশ্চিম পটিয়ার বরউঠান গ্রামের জমিদার এবং গভর্নমেন্ট প্লীডার মৌলভী ফজলুর রহমান খাঁর মসজিদ ও স্কুলের মাঠে ঈদের নামাজ শুরু হয়েছে। মসজিদ পুকুরের সিঁড়িতে দুই শিশুকে গোসল করাচ্ছেন এক বিপ্লবী!
এক বছর ও তিন বছর বয়সী দুই শিশুকে গোসল করাতে গিয়ে বিপ্লবী বারবার বলে যাচ্ছেন-“ আহা! একটু তাড়াতাড়ি করো! আমি তো ঈদের নামাজটা মিস্ করলাম মনে হয় আজ!”
এই বিপ্লবী এবং মুক্তিযোদ্ধার নাম কমরেড পূর্ণেন্দু কানুনগো। পটিয়ার কেলিশহর জমিদার পরিবারের সন্তান তিনি । ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি–ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা দলের অন্যতম সংগঠক সাইফুদ্দিন খানের সূত্রে তার বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এবং এর আগে আশ্রয় নিয়েছিলেন অনেক পরিবার।
একটা চিরকুটে স্বাক্ষর করে নাকি আব্বু ( সাইফুদ্দিন খান) অনেককে পাঠিয়ে দিতেন তার বাড়িতে আশ্রয় দেওয়ার জন্যে। এমন দুর্যোগের মাঝেও কনিষ্ঠ সন্তানের এমন ‘অন্যায় আব্দার’ এর ঝড় –অবলীলায় মেনে নিতেন তার বাবা মৌলভী ফজলুর রহমান খাঁ এবং বাড়ির অন্যরা।
সাইফুদ্দিন খানকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে আলবদর রাজাকার বাহিনী। বাবার খোঁজে বাড়িতে রেইড দিয়ে গেছে পাকি সেনারা- “ কালাইয়া কাঁহা হ্যায়?” বাড়ির তরুণদের এলোপাতাড়ি পিটিয়ে গেছে। সিন্দুক লুট করে বাড়ির বৌ-ঝি দের হীরে আর সোনার গয়না লুট করে নিয়ে গেছে । পরে কিছু গয়না নাকি ফিরিয়েও দিয়ে গেছে শুনেছি।
আমার দাদু মৌলভী ফজলুর রহমান খাঁ কোলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজের আইন বিভাগের ছাত্র । দাদুমণি গ্রামে হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদ, কালভার্ট, রাস্তাঘাট অনেক কিছুই করেছেন। শর্ত ছিল- কখনো যেন তার নামে কিছু করা না হয়।
তার বাবার নামে তিনি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাকে আমি দেখিনি। তবু বাবার কাছে শুনে জেনেছি কিছুটা। তার দীক্ষায় আমাদের শৈশব কেটেছে অসাম্প্রদায়িক পরিবেশে। একাত্তরে সবাই মিলে অসাম্প্রদায়িক ঈদ উদযাপন করেছেন-এমন ই স্মৃতিচারণ করতেন আমার বাবা-মা। দাদুমণি মৌলভী ফজলুর রহমান খাঁ সে বছরই মারা যান।
আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট নেতা কমরেড পূর্ণেন্দু কানুনগোকে ‘সেলিম ভাই’ নামে চেনে তখন সবাই। যে শিশুদের তিনি গোসল করাচ্ছিলেন, তাদের মধ্যে ছোট জন আমি। অনেক বড়ো হয়ে জেনেছি, আমার জীবনের আদর্শ -আমার সবচেয়ে প্রিয় সেলিম চাচ্চুর আসল নাম পূর্ণেন্দু কানুনগো।
ঈদের দিন সবার মাঝে চাচ্চু নিজের পরিচয় আড়াল করার জন্যে আমাকে আর ভাইয়াকে খুব ধীরে সুস্থে গোসল করাচ্ছিলেন আর তাড়া দিয়ে বলছিলেন, তার নামাজের দেরি হয়ে যাচ্ছে! আব্বু- আম্মু খুব মজা পাচ্ছিলেন এসব দেখে! গ্রামের লোকজনও অনেক পরে জেনেছে চাচ্চুর আসল পরিচয়!
শৈশবের স্মৃতিতে মনে পড়ে, আমাদের বিশাল বাড়িতে সাত গ্রামের হিন্দু-মুসলিম- জেলেপাড়া সব ধরনের মানুষ আসতো । ঘরের গরুর দুধে তৈরি সেমাই , গুরাপিঠা আরো নানান নাশতা দিয়ে বড়ো জে-আম্মা, মেজ আম্মা, আম্মু অক্লান্ত আতিথেয়তা করছেন।
কতো মানুষ ছুটে বেড়াচ্ছেন ঢেঁকি ঘর, রান্নাঘর, দেউড়ি ঘর, পূবের ঘর- সবখানে বড়ো আপা, বড়ো ভাইয়ারা আড্ডা দিচ্ছেন- কী মধুর সব স্মৃতি!
আমাদের বাপ্পু ডা. কামাল এ খান ছিলেন ক্রীড়া এবং সাংস্কৃতিক সংগঠক –এক অসাধারণ মানবতাবাদী! চট্টগ্রাম বন্দর এর প্রধান চিকিৎসক হিসেবে কর্ণফুলী নদীর পাড়ে বিশাল বাংলো ছিল তার । ঈদের চার/পাঁচ দিন আগে সেখান থেকে চার সাম্পানে করে আমরা বাড়ি যেতাম।
আমাদের পারিবারিক মাঝি ছিল। মতলব মাঝি ছিল তাদের প্রধান। দাদুমণির পর বাপ্পুর প্রখর ব্যক্তিত্ব আর অসাধারণ নেতৃত্ব পুরো পরিবারকে অসাম্প্রদায়িক রাখতে শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছিলো। আর ছোট ভাই হিসেবে আব্বু নিজের মতো করে নিভৃতে কাজ করে যেতেন গ্রামের সাধারণ মানুষের মাঝে।
আরেকটি স্মৃতি খুব মনে পড়ে। চট্টগ্রাম শহরের পাথরঘাটা অন্নদাচরণ দত্ত লেনে আমাদের তিন/চার পুরুষের ভিটে। যার অনেকটাই দখল হয়ে গেছে। ১৯৭৬ সালে বাবা আর মা তাদের ব্যাংকের চাকরির বেতন থেকে হোমলোন কেটে খুব সাধারণ একটি বাড়ি করেন এই জায়গায়। নিতান্ত মাথা গোঁজার ঠাঁই যাকে বলে।
এই বাড়ির চিলেকোঠায় একটা ছোট্ট রুম করে বাবা বলেছিলেন, এই ঘরটি চিরজীবন আন্ডারগ্রাউন্ড বাম নেতাদের জন্যে। ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ভাষা সৈনিক মওলানা আহমেদুর রহমান আজমী ছিলেন এই ঘরটিতে।
আজমী চাচ্চু খেতেন আমাদের সঙ্গে, ঘুমাতেন এই চিলেকোঠায়।
১৯৮৩ সালের দিকে সেই বাড়িটির গ্রাউন্ডফ্লোর ভাড়া নেন ‘যুগান্তর’কর্মী ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী সীতানাথ দাস এর পুত্র স্কুল শিক্ষক রঞ্জন রশ্মি দাস। আমাদের অনেক শ্রদ্ধার অনেক প্রিয় ‘দাদা’। তার স্ত্রী সুচন্দা দাস দোলা- আমাদের চিরদিনের ভীষণ প্রিয় ‘দিদি’ চট্টগ্রাম বন্দরে চাকরি করতেন। তার প্রথম সন্তান টুম্পা তখন আড়াই বছরের ফুটফুটে এক মেয়ে। ১৯৮৪ সালে এ ঘরেই জন্ম নিলো দাদা এবং দিদির একমাত্র পুত্র জনি। আমাদের সবকিছুতে তাদের সম্পৃক্ততা আর অংশগ্রহণ অনিবার্য।
আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। কেন যেন সেবার আমাদের বাড়ি যাওয়া হয় নি। আব্বুর গ্যাস্ট্রোলজি প্রবলেমের কারণে বড়ো রকমের অপারেশন হয়েছিলো সেবার । তাই মনে হয় যেতে পারি নি আমরা বাড়িতে।
যে কারণে এতোগুলো বিষয়ের অবতারণা- ১৯৮৪ সালের ঈদের দিন দিদি আমাকে, আমার ছোটভাই অমিকে আর ভাইয়াকে ডাকলেন। ঈদের দিনের সেই সকালে কপালে লাল সিঁদুরের বড় ফোঁটা, পাটভাঙ্গা শাড়ি পরা সদ্যস্নাতা সুন্দর দিদিকে কী যে স্নিগ্ধ আর সুন্দর লাগছিলো দেখতে!
আমরা কিছু বুঝে উঠার আগেই দিদি কিছু টাকা গুঁজে দিলেন আমাদের হাতে! কতো টাকা সেটা মনে নেই। শুধু মনে আছে এই টাকা বা ‘বখশিশ’ এর মধ্যে কী পরম ভালোবাসা আর আন্তরিকতা ছিল দিদির! প্রশ্ন আসে মনে –কেন দিদি প্রতি বছর ঈদে আমাদের ‘বখশিশ’ দিতেন?
খুব সামান্য চাকরি করতেন। দাদা-দিদির টানাটানির সংসারে আমরা তিন ভাই-বোন কে? কেন দিদি প্রত্যেক বছর ঈদের বখশিশ দিতেন? দিদির চেহারায় একটা অসহায়ত্ব ছিল- লুকিয়ে টাকাটা দিয়ে যেন তার অতৃপ্তি রয়ে গেছে- যতোটা চাইছেন যেন পারেন নি!
আমার অনেক স্মৃতি দিদির প্রতিদিনের জীবনযুদ্ধের সঙ্গে! অন্নদাচরণ দত্ত ছিলেন মাস্টার’দা সূর্যসেনের আইনজীবী। তার বাড়িটি দখল হয়ে নিশ্চিহ্ণ এখন। তার নামে করা রাস্তাটি এখন কাগজেপত্রে এ সি দত্ত লেন- সেই নাম ও মানুষের মুখে বিলীন। আদালত ভবন, কোতোয়ালী থানা, সিএমপি হেড কোয়ার্টার, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার, লালদীঘির সঙ্গে সংযুক্ত গুরুত্বপূর্ণ এই রাস্তা চট্টগ্রাম শহরের সবচেয়ে বড়ো সুইপার কলোনির নামে পরিচিত হয়েছে গত ২৫ বছর । কী দুর্ভাগ্য আমাদের!
সেই রাস্তাটি দিয়ে হাঁটলেই দিদির কথা মনে পড়ে। আমাদের সঙ্গে আত্মার সম্পর্কে সম্পৃক্ত দিদি হঠাৎ কবে যেন মারা গেছেন। আমরা জানতেও পারি নি। টুম্পা আর জনির বিয়েতে নিমন্ত্রিত অতিথি হয়ে গেছি । আর দিদির শূন্যতা অনুভব করে নিজের অজান্তেই বারবার চোখ ভরে গেছে জলে।
আরেকটা ঘটনা মনে পড়ছে। ১৯৮৪ সালে আব্বু চট্টগ্রাম মেডিকেলে অপারেশনের জন্য ভর্তি। কমরেড অনঙ্গ সেন আব্বুকে দেখতে গেছেন প্রতিদিনের মতো। আব্বুর পাশের বেডের বয়স্ক রোগী অনঙ্গ চাচ্চুর সঙ্গে খুব আড্ডা জমালেন। কারণ- লম্বা, সাদা দাড়ি নিয়ে চাচ্চু দেখতে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো।
চাচ্চু তো আরবী ভাষা, হাদিস কোরান সবই জানতেন। আড্ডা বেশ জমে গেলো। আব্বু খুব মজা পেলো- যখন মাগরেবের আজান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনঙ্গ চাচ্চুকে পানি আর ইফতার সাধলেন সেই রোগী। চাচ্চু বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে অচেনা নিরীহ মানুষটির অনুরোধ রক্ষা করলেন।
এই তো আমাদের সমাজ! এই তো আমাদের সাধারণ মানুষ! ধর্ম- বর্ণ নির্বিশেষে ভালোবাসা আর আন্তরিকতা যেখানে সবার আগে!! জয় হোক মানবতার! জয় হোক ভালোবাসার!

সুমি খান: সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, sumikhan29bdj@gmail.com

Tuesday, August 6, 2013

৭২তম প্রয়াণ দিনেও অনিবার্য চিরদিনের রবীন্দ্রনাথ



রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর ৭২তম প্রয়াণ দিবস আজ বাইশে প্রাবণ। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের এই দিনে চিরপ্রস্থান করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার বিপুল কর্মযজ্ঞ বাঙ্গালীর মন আর মননে চিরঅম্লান । মৃত্যুঞ্জয়ী মানুষের ওপর দৃঢ়ভাবে আস্থাশীল রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, মানুষই পারে অসুরের উন্মত্ততাকে ধ্বংস করে পৃথিবীতে সুরের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে। তাই ‘সভ্যতার সঙ্কট’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেনÑ ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।’ ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে 'নাইট' উপাধিতে ভূষিত করে। কিন্তু ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকা-ের প্রতিবাদে সেই উপাধি বর্জন করেন রবীন্দ্রনাথ।
সমাজের কল্যাণেও নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সমাজকল্যাণের উপায় হিসেবে তিনি গ্রামোন্নয়ন ও গ্রামের দরিদ্র জনসাধারণকে শিক্ষিত করে তোলার পক্ষে মতপ্রকাশ করেন। এর পাশাপাশি সামাজিক বৈষম্য, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের দর্শনচেতনায় ঈশ্বরের মূল হিসেবে মানব সংসারকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে। তিনি দেববিগ্রহের পরিবর্তে কর্মী অর্থাৎ মানুষ ঈশ্বরের পুজোর কথা বলেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ চিরদিনের। চির নতুন তিনি। সবসময় প্রাসঙ্গিক। বাঙালীর চেতনার রঙ স্পষ্ট হয়েছিল রবির আলোয়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বহুমাত্রিক অবদানে সমৃদ্ধ করা এই রবীন্দ্রনাথ। বাঙালীর প্রতিটি আবেগ আর সূক্ষ্ম অনুভূতিকে স্পর্শ করে আছেন। আজ ৭২তম মৃত্যুবার্ষিকীর দিনেও অনিবার্য তিনি। তাঁকে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় স্মরণ করবে সারা বিশ্বের বাঙালী।

হাজার বছরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর সাহিত্য। ১৯১৩ সালে ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। তাঁর এ প্রাপ্তি বাংলা সাহিত্যকে বিরল গৌরব এনে দেয়।
কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ জন্ম নেয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজ কর্মের মাধ্যমে সূচনা করে গেছেন একটি কালের। একটি সংস্কৃতির। কৈশোর পেরোনোর আগেই বাংলা সাহিত্যের দিগন্ত বদলে দিতে শুরু করেন তিনি। ১৪ বছর বয়সে ব্রজবলী ভাষায় লিখেছেন ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী।

বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস ও ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসঙ্কলন প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর সর্বমোট ৯৫টি ছোটগল্প ও ১৯১৫টি গান যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতান সঙ্কলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত ও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খ-ে রবীন্দ্ররচনাবলী নামে প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কাব্যসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য ভাবগভীরতা, গীতিধর্মিতা চিত্ররূপময়তা, অধ্যাত্মচেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, রোমান্টিক সৌন্দর্যচেতনা, ভাব, ভাষা, ছন্দ ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্য, বাস্তবচেতনা ও প্রগতিচেতনা। রবীন্দ্রনাথের গদ্যভাষাও কাব্যিক। ভারতের ধ্রুপদ ও লৌকিক সংস্কৃতি এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞানচেতনা ও শিল্পদর্শন তাঁর রচনায় গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিজ মতামত প্রকাশ করেছিলেন। সাহিত্যের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের গান বাংলা সঙ্গীত ভান্ডারকে দারুণভাবে সমৃদ্ধ করেছে।

বিপুল ঐশ্বর্য নিয়ে টিকে আছে রবীন্দ্রসঙ্গীত। এর আবেদন কোন দিন ফুরোবার নয়। বরং যত দিন যাচ্ছে ততই রবীন্দ্রসঙ্গীতের বাণী ও সুরের ইন্দ্রজালে নিজেকে জড়িয়ে নিচ্ছে বাঙালী। তাঁদের আবেগ অনুভূতি কবিগুরুর গানের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের জাতীয় সঙ্গীতেরও রচয়িতা তিনি। বহু প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রায় সত্তর বছর বয়সে নিয়মিত ছবি আঁকা শুরু করেন। ১৯২৮ থেকে ১৯৩৯ সালের মধ্যে অঙ্কিত তাঁর স্কেচ ও ছবির সংখ্যা আড়াই হাজারের বেশি। দক্ষিণ ফ্রান্সের শিল্পীদের উৎসাহে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রথম চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় প্যারিসের পিগাল আর্ট গ্যালারিতে। এরপর সমগ্র ইউরোপেই কবির একাধিক চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। তাঁর আঁকা ছবিতে আধুনিক বিমূর্তধর্মিতাই বেশি প্রস্ফুটিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ চার বছর ঘন ঘন অসুস্থতার মধ্য দিয়ে গেছে। এ সময়ের মধ্যে দু’বার অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী থাকতে হয়েছিল কবিকে। ১৯৩৭ সালে একবার অচৈতন্য হয়ে গিয়েছিলেন। আশঙ্কাজনক অবস্থা হয়েছিল। তখন সেরে উঠলেও ১৯৪০ সালে অসুস্থ হওয়ার পর আর তিনি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি। প্রথম জীবনে ভানুসিংহের পদাবলীতে কবি লিখেছিলেন- মরণ রে,/ তুঁহু মম শ্যামসমান... মৃত্যু অমৃত করে দান। একইভাবে মৃত্যুকে জীবনের নিস্তাররূপে বর্ণনা করে তিনি উচ্চারণ করেন- প্রেম বলে যে যুগে যুগে, তোমার লাগি আছি জেগে, মরণ বলে আমি তোমার জীবনতরী বাই। জীবনের শেষ দিকে এসে কবি জীবনের প্রতি নিজের তৃষ্ণার কথা জানিয়ে লেখেন বিখ্যাত সেই পঙ্ক্তি- মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে/ মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই। বলাই বাহুল্য, মানবের মাঝে রবীন্দ্রনাথের বেঁচে থাকার স্বপ্ন শতভাগ পূর্ণতা পেয়েছে।
মহাপ্রয়াণ দিবসে আজ মঙ্গলবার বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সঙ্গীতের কিংবদন্তি পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করবে সারা বিশ্বের বাঙালী। তবে রমজানের কারণে এবার আনুষ্ঠানিকতা থাকবে কম।