Wednesday, August 14, 2013

নাফিস ঢাকায় থাকাকালে জঙ্গী নেতা মুফতি জসীমউদ্দিনের খুতবা শুনতে বছিলায় যেতেন :রাজীবের খুনিদের স্বীকারোক্তি


১৪ আগষ্ট ২০১৩
ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যার সময় ঘটনাস্থলে মুফতি জসীমউদ্দিন উপস্থিত না থাকলেও তিনি হত্যায় জড়িত নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ করেছেন। রাজীব হত্যায় গ্রেফতার হওয়া পাঁচ শিক্ষার্থী জিজ্ঞাসাবাদে ডিবিকে জানিয়েছিল, তাঁদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে ৩০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত কাজী রেজওয়ানুল আহসান নাফিস ঢাকায় থাকাকালে মুফতি জসীমউদ্দিনের খুতবা শুনতে বছিলায় যেতেন। জসীমউদ্দিনের বক্তব্যে তাঁরা ‘নাস্তিক’ ব্লগারদের হত্যা করতে অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
হঠাৎ গজিয়ে ওঠেনি উগ্র সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। রাজশাহীর বাংলা ভাই খ্যাত জমিয়তুল মুজাহিদীনের শীর্ষ নেতাদের একের পর এক ফাঁসি কাযর্কর হওয়ার পর থেকেই কঠোর গোপনীয়তায় সংগঠিত হতে থাকে নতুন আবিষ্কৃত এ সংগঠনটি। এ দিকে গোয়েন্দা সংস্থার সাঁড়াশি অভিযানে রাজধানী ও বরগুনার আস্তানা থেকে উদ্বারকৃত কাগজপত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান মনিরুল ইসলাম জানিয়েছেনÑ বাংলা টিমের হিট লিস্টে বেশ কয়েক জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের নাম পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে রয়েছে মন্ত্রী, সাংসদ, নেতা, ব্লগারসহ অন্যেরা। তাদের নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলেও জানা গেছে। তবে এত গোয়েন্দা তৎপরতা থাকা সত্ত্বেও ঢাকা ও বরগুনায় জঙ্গী বাংলা টিমের উত্থানে তোলপাড় চলছে।মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, রাজধানীর আরও কয়েকটি এলাকায় জসীমের বেশ কয়েক শিষ্যকে গ্রেফতারের জন্য অভিযান চালানো হয়েছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) মঙ্গলবার রাজধানীর বছিলা মসজিদসংলগ্ন মুফতি জসীমের কার্যালয়ে প্রায় দেড় ঘণ্টা তল্লাশি চালায়। এ সময় কম্পিউটার, ল্যাপটপ, বেশকিছু বই ও অর্ধ শতাধিক সিডি উদ্ধার করা হয়। আদালত থেকে তল্লাশি পরোয়ানার অনুমতি নিয়ে অতিরিক্ত উপকমিশনার মশিউর রহমানের (এডিসি) নেতৃত্বে ডিবির একটি দল মোহাম্মদপুরের বছিলা রোডে মেট্রো হাউজিং এলাকায় ওই মাদ্রাসায় অভিযান চালায়। এ সময় কর্তব্যরত কর্মচারী হেলালউদ্দিন মাদ্রাসার তালা খুলে দিলে ডিবি পুলিশ তল্লাশি শুরু করে। উদ্ধারকৃত মালামাল ট্রাকে ভরে ডিবি কার্যালয়ে এনে জব্দ তালিকা তৈরি করা হয়।
তবে এ সময় বছিলায় মারকাজুল উলুম আল ইসলামিয়া মাদ্রাসার পাশে জসীমের টিনশেডে অফিসে কাউকে পায়নি পুলিশ। গোয়েন্দা পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে তারা আগেই সটকে পড়ে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেÑ অভিযানের আগের রাতেও সেখানে বেশ কয়েজনকে অবস্থান করতে দেখা গেছে।
উল্লেখ্য, গত সোমবার দুপুরে বরগুনার দক্ষিণ খাজুরতলা এলাকায় গোপন বৈঠক করার সময় বাংলাদেশে আনসারুল্লাহ প্রধান মুফতি জসীমসহ ৩১ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। মঙ্গলবার দুপুরে মুফতি জসীমকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড চায় পুলিশ। আদালত ২১ আগস্ট শুনানির দিন রেখে তাঁকে জেল হাজতে পাঠায়।
এ ব্যাপারে বরগুনার পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথ বলেন, মুফতি জসীম উদ্দিন রাহমানী একজন উগ্রপন্থী নেতা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাঁর কাছ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। তাঁর বিরুদ্ধে ঢাকার পল্লবী ও উত্তরা থানায় দুটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে পল্লবী থানার মামলায় ব্লগার রাজীব হত্যা মামলার সন্দেহভাজন আসামি। উত্তরা থানায় দায়েরকৃত আসিফের ওপর হামলার মামলায়ও আসামি তিনি। গ্রেফতারকৃত ৩০ জনই মুফতি জসীমের অনুসারী। তাদের সবার বিরুদ্ধে বরগুনা থানায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনেও একটি মামলা করা হয়েছে। জানা যায়, মুফতি জসীমউদ্দিন এ মাদ্রাসার পরিচালক। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান আস্তানা হিসেবে মাদ্রাসায় সব কাজ চলত। এলাকায় এটা মারকাজ নামে পরিচিত। বিভিন্ন এলাকা থেকে তাঁর মতাদর্শের অনুসারীরাসহ আনসারুল্লাহর সদস্যরা শুক্রবার সেখানে জুমার নামাজ পড়েন। নামাজ শেষে পাঠচক্রে অংশ নেন। এ ছাড়া বিভিন্ন নির্দিষ্ট দিনে তাঁদের সাংগঠনিক আলোচনা-বয়ান ও বৈঠক হতো।
আলোচিত এই জসীম বরগুনার দক্ষিণ হেউলিবুনিয়া গ্রামের নূর হাওলাদারের ছেলে। তিনি এক সময় ভারতের দেওবন্দে পড়াশোনা করেছেন।পরে হায়দরাবাদের সাবেলুস সালাম মাদ্রাসা থেকে মুফতি (ফিকা শাস্ত্রে) পাস করেন। তারপর তিনি ঢাকার জামেয়া রাহমানিয়া মাদ্রাসায় ও বরিশালের মাহমুদিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। কিছুদিন বরগুনা কেন্দ্রীয় সদরঘাট জামে মসজিদে প্রধান খতিব হিসেবেও চাকরি করেন। পরে সৌদি আরবের মদিনায় লিসানস বিশ্ববিদ্যালয়ে খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। সেখান থেকে দেশে ফিরে প্রথমে ধানমন্ডির হাতেমবাগ মসজিদের খতিব ছিলেন। এরপর তিনি মোহাম্মদপুরের বছিলায় মারকাজুল উলুম আল ইসলামিয়া মাদ্রাসা ও মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। মারকাজুল উলুম আল ইসলামিয়া নামে একটি প্রতিষ্ঠানও চালান তিনি। ওই মাদ্রাসা ও মসজিদ থেকে দীর্ঘদিন ধরেই উগ্র মতবাদ প্রচার করে তরুণদের জিহাদে উদ্বুদ্ধ করে আসছেন জসীম। তাঁর বিরুদ্ধে জঙ্গী সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ গোয়েন্দারা তদন্ত করে দেখছেন। জসীমউদ্দিন আগে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের বরিশাল জেলার সভাপতি ছিলেন। তবে মতবিরোধের দরুন তিনি ১৯৯৭ সালে ওই দল থেকে পদত্যাগ করেন। তারপর থেকেই তিনি খিলাফত তথা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে প্রচার করতে থাকেন। বাংলা টিমের আড়ালে জসীমউদ্দিন যে এত বড় একটা গোপন উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর নেতা ছিলেন তা জানতো না এলাকাবাসী।

প্রসঙ্গত, গত ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পল্লবীর পলাশনগরের নিজ বাসার কাছে ব্লগার রাজীব হায়দারকে (৩৪) কুপিয়ে ও ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির পাঁচ শিক্ষার্থী ফয়সাল বিন নাঈম ওরফে দীপ, মাকসুদুল হাসান ওরফে অনিক, এহসান রেজা ওরফে রুম্মান, নাঈম সিকদার ওরফে ইরাদ ও নাফিস ইমতিয়াজ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতেও মুফতি জসীমের কাছে যাওয়ার কথা বলেছেন। জসীম ইতিমধ্যে তরুণ চিকিৎসক, শিক্ষক ও প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং শ্রমজীবী মিলে বেশ কিছু অনুসারীদের যুক্ত করে বিস্তৃত করেন জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম।

No comments:

Post a Comment