Thursday, August 15, 2013

অধিকার, টিআইবি প্রভৃতির কাজ পর্যালোচনা- কেউই আইনের আওতার বাইরে থাকতে পারে না-স্বদেশ রায়


১৫ আগষ্ট ২০১৩
অধিকার নামক এনজিওটির প্রতিষ্ঠা ১৯৯৪ সালে। এর প্রতিষ্ঠাতা হাসান আরিফ ২০০১ সালে জামায়াত-বিএনপি ক্ষমতায় আসার পরে ওই সরকারের আইন উপদেষ্টা বা এ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পান। এবং ওই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম ভোকাল সদস্য আদিলুর রহমান ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পান। কোন রাজনৈতিক দলের সর্বোচ্চ বিশ্বস্ত না হলে কেউ তাকে ওই সরকারের আইন উপদেষ্টা বা সহকারী আইন উপদেষ্টা নিয়োগ করে না। তাই হাসান আরিফ এবং আদিলুর রহমান যে জামায়াত ও বিএনপির বিশ্বস্ত ও তাদের মতাদর্শী তাতে কারও কোন সন্দেহ থাকা উচিত নয়। এবং তাদের এই প্রতিষ্ঠানটি সব সময় তাদের পক্ষে অর্থাৎ জামায়াত-বিএনপির পক্ষে কাজ করে।
যেমন আমরা জানি ২০০১-এর নির্বাচনে নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ওই নির্বাচন আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবার জন্যে। যদিও এসব তথ্য অনেকেরই জানা তারপরেও বলতে হয়, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচন করার পরে তীব্র গণআন্দোলনের মুখে বিএনপি সরকারকে পদত্যাগ করতে হয়। এই পদত্যাগের সময় পর্দার অন্তরালে কিছু কাজ হয়েছিল। বিশেষ করে বিএনপি কিভাবে পদত্যাগ করবে এবং ভবিষ্যত বাংলাদেশ কিভাবে চলবে তার একটি শর্তনামা। ওই শর্তনামা তৈরি করেন আমেরিকান ফরেন রিলেশন কমিটির দু’জন মেম্বার। এদের একজন ডেমোক্র্যাট পার্টির সিনেটর অপর জন রিপাবলিকান পার্টির সিনেটর। প্রভাবশালী এই সিনেটর পেল ও লুগার যে শর্তনামা তৈরি করেন তার তৃতীয় ধারায় বলা হয়, বাংলাদেশের যাবতীয় নির্বাচন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। তাই ২০০১-এর জাতীয় নির্বাচনে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের ভূমিকা ছিল অনেক বেশি। ওই নির্বাচনে অধিকার পর্যবেক্ষক হিসেবে কাজ করে।
২০০১-এর নির্বাচনে যে সীমাহীন অনিয়ম ও কারচুপি হয়েছিল সেটা এখন প্রমাণিত এবং নির্বাচনের আগে ও পরে বাংলাদেশে ঘটেছিল অবর্ণনীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন ও নারী নির্যাতন। নির্বাচনের আগের ওই সহিংসতা নির্বাচনকে কিভাবে প্রভাবিত করেছিল সেটাও কারও অজানা নয়। ওই নির্বাচনকে অধিকার সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হিসেবে সার্টিফিকেট দেয়। যদিও ২০০৩ থেকে অধিকার বার্ষিক প্রতিবেদন বের করা শুরু করেছে। কিন্তু তারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে মতামত দিয়ে আসছে শুরু থেকেই। ২০০১-এর নির্বাচনের আগে ও পরের কোন ঘটনা নিয়ে, কোন সহিংসতা নিয়ে, পূর্ণিমা ধর্ষণ নিয়ে এই মানবাধিকার সংস্থাটির কোন বিবৃতি বা বক্তব্য নেই। বরং ওই সময়ে ২০০১-এর নির্বাচনী কারচুপি ও সহিংসতাকে ‘সুষ্ঠু ও সুন্দর’ বলে সার্টিফিকেট দেবার পুরস্কার হিসেবে হাসান আরিফ এবং আদিলুর রহমান যথাক্রমে জামায়াত-বিএনপি সরকারের দ্বারা এ্যাটর্নি জেনারেল ও ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পান। পাশাপাশি আরেকটি বিষয় ১৯৯৬-এ আওয়ামী লীগ ঐকমত্যের সরকার গঠন করার পর অসমের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার নেতা অনুপ চেটিয়া গ্রেফতার হয়। এই অনুপ চেটিয়ার মানবাধিকার নিয়ে এই সংগঠনটির কম বেশি ভূমিকা আছে। শুধু তাই নয়, অসমের এক সাংবাদিক আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, আদিলুর রহমান শুভ্র এবং ফরহাদ মযহারের সঙ্গে উলফার যোগাযোগ খুব ঘনিষ্ঠ এ বিষয়ে আমি কী জানি। তার প্রশ্নের ভিতর এ বিষয়টি লুক্কায়িত ছিল যে তিনি জানেন তাদের যোগাযোগ খুব ঘনিষ্ঠ। তার প্রশ্নের এক পর্যায়ে আমি বলতে বাধ্য হয়েছিলাম যে, দেখুন এই দুই ব্যক্তির নেত্রী খালেদা জিয়া অনুপ চেটিয়াসহ নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়ার সকল বিচ্ছিন্নতাবাদীকে স্বাধীনতা যোদ্ধা বলেন। ফরহাদ মযহার লিখিতভাবে ও আদিলুর রহমান ব্যক্তিগত পর্যায়ে আলোচনায় একই কথা বলেন। তারা তাদের মানবাধিকার নিয়ে অবশ্যই চিন্তিত থাকে।
অনুপ চেটিয়ার মানবাধিকার নিয়ে চিন্তিত থাকলেও দেশের ভিতর পূর্ণিমাকে জামায়াত-বিএনপি কর্মীর গণধর্ষণ ও সংখ্যালঘু নির্যাতন, হত্যা ও তাদের নারীদের রেপ করার প্রতিবাদে শাহরিয়ার কবির গ্রেফতার হলে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার এ নিয়ে প্রতিবাদ করলেও অধিকারের পক্ষ থেকে কিছুই বলা হয়নি। কিছুই বলা হয়নি কিবরিয়া হত্যা, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলায় তৎকালীন সরকারের মতে ২১ জন নিহত হবার পরেও। যেমন দিন দুয়েক আগে বিএনপি নেতা মেজর হাফিজ বলেছেন, ৫ মে শাপলা চত্বরের ঘটনার পর নাকি হোস পাইপ দিয়ে রক্ত ধুতে হয়েছিল সকাল বেলায়। প্রকাশ্যে এই ঘটনা ঘটল আর একটি টিভি ক্যামেরা সেটা দেখতে পেল না? হাফিজ অবশ্য আন্দাজ করে বলেছেন, কারণ এই কাজটি করতে হয়েছিল ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরে। সে ঘটনার পরেও কিন্তু অধিকারের কোন বিবৃতি ছিল না। আবার দেখা যায় ২০০৬ সালে ১ কোটি ৩৩ লাখ ভুয়া ভোটার তালিকাভুক্ত করে নয় কোটি ৭০ লাখের এক ভোটার তালিকা প্রস্তুত করা হলেও ২০০১-এর নির্বাচনে সার্টিফিকেট দেয়া এই এনজিও অধিকার কোন প্রতিবাদ করেনি। কারণ জামায়াত-বিএনপি একটি কারচুপির নির্বাচন অনুষ্ঠান করার জন্যে এ কাজ করেছিল।
পাশাপাশি হেফাজতের ৫ এপ্রিল সমাবেশ কভার করতে গিয়ে শুধু মাত্র নারী সাংবাদিক হবার কারণে চরমভাবে হেফাজতীদের হাতে নিগৃহীত হন সাংবাদিক নাদিয়া শারমিন ও জাকিয়া আহমেদ। নাদিয়া এখন পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে বাসায় দিন কাটাচ্ছেন। শুধু মাত্র নারী সাংবাদিক বলে এই হামলা যে কত বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন, এই কাজ যে আফগান তালেবানদের কাজের সমতুল্য এ নিয়ে কিন্তু কোন বক্তব্য অধিকারের কোন রিপোর্টে কেউ পাবেন না। এমনকি ৫ মে শাপলা চত্বরে হেফাজতের ওপর হামলা বলে অধিকার যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে সে রিপোর্ট ওয়েবসাইটে আছে যে কেউ দেখলে বুঝতে পারবেন সেখানে কটি সত্য ছবি ও কটি বিদেশী ছবি। শুধু তাই নয়, মৃত বলে চাঁদপুরের এক তরুণের ছবি দেয়া হয়েছে, ওই তরুণ এখন চাঁদপুর মাদ্রাসায় ক্লাস করছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ওই রিপোর্টে হেফাজত ও জামায়াতের মিছিলে গুলি চালাচ্ছে বলে একটি ছবি প্রকাশ করা হয়েছে যেখানে ক্যাপশন দেয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা এ কাজ করছে। কিন্তু ওই রিপোর্টে কোথাও যেমন হেফাজতের তা-ব, তাদের লাশ পলিথিনে জড়িয়ে লুকানো, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দোকান পুড়িয়ে দেয়া, কোরান শরিফ পোড়ানোর মতো যে সব কাজ হেফাজত ও জামায়াত করেছিল তার কোন ছবি নেই। এ সম্পর্কে কোন কথা নেই।
সংক্ষেপে উল্লেখ করলে এমন একটি চিত্র পাওয়া যায়, অধিকারের কাজের ভিতর। অর্থাৎ তাদের কাজের সঙ্গে মূলত জামায়াত ও হেফাজতের কাজের কোন পার্থক্য নেই। অর্থাৎ জামায়াত-বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে এদের আচরণ ভিন্ন হয়ে যায়। অথচ স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তি ক্ষমতায় থাকলে এরা মানবাধিকারের নামে, এনজিও হিসেবে আন্তর্জাতিক ফোরামসহ নানানভাবে এমন তথ্য ও মতামত প্রকাশ করে যা শুধু দেশের ভিতর শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সমস্যা হয় না, দেশের ভাবমূর্তিও নষ্ট করে।
অবশ্য শুধু মাত্র অধিকার নয়, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালসহ কিছু এনজিও আছে যারা স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তি ক্ষমতায় থাকলে মৌলবাদীদের পক্ষে এমন বিকৃত তথ্য ও মতামত প্রকাশ করে। শুধু মাত্র বিকৃত তথ্য নয়, এমন এমন বিষয়ে মতামত প্রকাশ করে যা তাদের আওতার বাইরে। যেমন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল তাদের মূল রিপোর্টে দুর্নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান যা ছিল আর বাংলাদেশের রিপোর্টে ভিন্ন হিসেবে প্রকাশ করেছে। তারা দেশের যাবতীয় সংসদ সদস্য সম্পর্কে ঢালাও মন্তব্য করেছে। তারা তাদের এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে মতামত দিতে পারে অথচ হেফাজতের তা-ব, শফির নারী বিদ্বেষী বক্তব্য বা নারী সাংবাদিকদের ওপর হামলা নিয়ে কোন বক্তব্য দেয় না। তখন তারা তাদের সীমা রেখা দেখে চলে। তাই দেশের সুনাম রক্ষা ও আইনের শাসন বিবেচনা করলে শুধু মাত্র অধিকারের কর্মকর্তা নয়, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের কর্মকর্তারা তথ্য বিকৃতি ও ভুল তথ্য প্রচার করে একই আইসিটির অপরাধ করছে। তারাও আইনের বাইরে থাকতে পারে না। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে এদের অপরাধকেও অপরাধ হিসেবে সমানভাবে গণ্য করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
অন্যদিকে বিষয়টি শুধু যে সরকার আইনের আওতায় আনবে তা নয়, দেশের মানুষকেও বিবেচনায় নিতে হবে। মৌলবাদীরা ক্ষমতায় থাকলে এই সব এনজিও কোন ধরনের বিবৃতি দেয়, তখন অধিকার বা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বিবৃতিগুলো, বক্তব্যগুলো কী হয় আর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকলে কেমন হয়? এ দেশের মানুষ অর্থাৎ আমাদের স্মৃতি শক্তি একটু দুর্বল। আমরা সহজে ভুলে যাই। এবং আওয়ামী লীগেরও প্রথম চার বছর তথ্য মন্ত্রণালয়ে কোন সত্যিকার মন্ত্রী না থাকায়, এগুলোর তুলনামূলক বিচার করা হয়নি। প্রচার করা হয়নি। যে কারণে মানুষ আরো দ্রুত এগুলো ভুলে গেছে। বর্তমান তথ্যমন্ত্রী অধিকারের বিষয় নিয়ে যে তথ্যপূর্ণ ও যুক্তিপূর্ণ বিবৃতি দিয়েছেন সেটা যথার্থ। তিনি বলেছেন, অধিকার মূলত জামায়াত-বিএনপি ও হেফাজতের পক্ষে প্রচারণার অংশ হিসেবে তাদের অঙ্গ সংগঠন হিসেবে কাজ করেছে। পাশাপাশি তিনি এখন অধিকার, টিআইবি প্রভৃতি এনজিওগুলোর জামায়াত বিএনপি আমলের বক্তব্য বিবৃতি ও বর্তমান সরকারের সময়ের বক্তব্য বিবৃতিগুলোর চিত্র মানুষের সামনে তুলে ধরতে পারেন। বিশ্লেষণ তুলে ধরতে পারেন।
কারণ, আজ দেশের মানুষ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এদেরকে দেশের সুশীল সমাজের ভয়েস হিসেবে মনে করছে। এদের বক্তব্যকে দেশের সুশীল সমাজের বক্তব্য হিসেবে মনে করে। কিন্তু বাস্তবে এরা যে ছদ্মমৌলবাদী। এরা যে বাস্তবে প্যান্ট শার্ট পরা হেফাজতী এই সত্যটি তথ্যসহকারে প্রচার করে দেশের মানুষ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভুল ভাঙ্গানো প্রয়োজন দেশকে মৌলবাদমুক্ত করার জন্য। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশে গণতন্ত্র চায়। কিন্তু যতদিন মৌলবাদীদের এই ছদ্মবেশী সুশীল বন্ধু থাকবে ততদিন উদার গণতন্ত্র এখানে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয়। তাদেরও সত্য জানতে হবে।
swadeshroy@gmail.com সূত্র: দৈনিক জনকন্ঠ

No comments:

Post a Comment