Thursday, August 15, 2013

আওয়ামী লীগ পরাজিত হলে হতাশা বা দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই- মুনতাসির মামুন



আজ আমাদের সময়ের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য জাতীয় শোক পালিত হবে। আওয়ামী লীগ বা ১৪ দল আজ ক্ষমতায়। সুতরাং, সাধারণ মানুষ স্বস্তিতে শোক প্রকাশ করবেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে রাখা উচিত আজ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনীতির নেত্রীর জন্মদিবসও পালিত হবে। এটি জাতির জনকের স্মৃতিকে তুচ্ছ জ্ঞান করার প্রতীক। যদি বিএনপি বা ১৮ দল ক্ষমতায় থাকে তাহলে মানুষ স্বাভাবিকভাবে ধরে নেন, জাতীয় শোক দিবস পালিত হবে না, পালনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে। বরং পালিত হবে জাতীয় জন্মদিবস।অনেকে, এ বিষয়টি এমনকি মিডিয়াও আমলে আনতে চায় না। পত্র-পত্রিকায় এক সঙ্গে দু’টি খবরই ভালভাবে পরিবেশন করা হবে। কারও মনে হবে না এটি আপত্তিকর, অরুচিকর, একদিক থেকে দেখলে দেশদ্রোহিতাও বটে।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বুনন ক্ষতি করেছেন এমন ১০ ব্যক্তির তালিকা করলে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের নাম কিছুতেই বাদ দেয়া যাবে না। তার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য তার লেখা গ্রন্থাদি, তার যে রাজনৈতিক চরিত্র আমরা দেখি তার বিপরীত। দীর্ঘদিন ধরে তিনি মুক্তিযুদ্ধ চেতনাবিরোধী অপ ও অপরাধমূলক রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ও এই ধারার রাজনীতির একজন নেতা। কারাগারে বসে ২০০৮ সালের ১৫ আগস্ট রোজনামচায় তিনি লিখছেন, ‘আজ জাতীয় শোক দিবস। ১৯৭৫ সালের এই দিনে বাংলাদেশের স্থপতি বন্ধবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ধানমন্ডির বাড়িতে স্ত্রী ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে খুন হন। জাতির ইতিহাসে এ এক মহাশোকের দিন। বিতর্কিত একটি জন্মদিনের হিসেবে আজ বেগম জিয়ার ৬৩তম জন্মদিন। সঠিক হলেও আমার জন্মদিন বোধহয় একদিন আগে বা পরে পালন করতাম ও শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যা দিবসের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতাম। এটা একটা রুচিবোধের বিষয়। বেগম জিয়া তা করলে তিনি সকল শ্রেণীর জনগণের কাছ থেকে আরও বেশি শ্রদ্ধা অর্জন করতে পারতেন।’ [কারাগারে কেমন ছিলাম? ৩২৪-৩২৫]

অর্থাৎ বিষয়টি অশ্রদ্ধেয় মওদুদের মতো লোকের চোখেও, কিন্তু এই কাজটি তাদের করতে হবে। এটিই অপরাজনীতির একটি বৈশিষ্ট্য। দৃষ্টিভঙ্গির যে ১০টি উদাহরণ দিলাম, তা হচ্ছে আমাদের দেশের রাজনীতির মৌল বিষয়। এটি উপেক্ষা করার অর্থ, শেষোক্তটিকে পরোক্ষ সমর্থন। বিষয়টি সাদা অথবা কালো চোখে দেখতে হবে। ধূসরের কোন স্থান এখানে নেই।
এ দেশের স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগপ্রধান ছিলেন। [পরে দলীয় পদ তিনি ত্যাগ করেন বটে] কিন্তু ১৯৬৯ সালের পর থেকে তিনি আর দলীয় প্রধান হিসেবে নন, জাতীয় বীর বা বঙ্গবন্ধু হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ১৯৭১ সাল থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বা মুক্তিযুদ্ধকে একটি প্রত্যয় হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এ প্রত্যয়ের মূল ছিল ধর্মরাষ্ট্র ভেঙ্গে একটি সেক্যুলার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন, যেখানে মানুষের ধর্ম মূল বিষয় নয়; মূল বিষয় মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক মুক্তি।

স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বিএনপি কোনভাবেই জড়িত নয়। জামায়াত জড়িত হত্যাকারী দল হিসেবে। জামায়াত পাকিস্তানবাদ বজায় রাখতে চেয়েছে। পাকিস্তান বা পাকিস্তানবাদও একটি প্রত্যয়। এ প্রত্যয়ের মূল বিষয়, পাকিস্তান যে ধরনের ধর্ম রাষ্ট্র ছিল [বা আছে] সে কাঠামো সমর্থন। ধর্মরাষ্ট্র্রের অর্থ ধর্ম ব্যবহৃত হবে সাধারণ মানুষকে দমন ও পীড়নে। অর্থাৎ সাধারণের সব কিছু ধর্মের নামে ভায়োলেন্সের সাহায্যে দমন করা হবে। সিভিলিয়ান শাসন হবে সামরিক শাসনের কর্তৃত্বাধীন। এ ‘ধর্মরাষ্ট্র’ যারা সমর্থন করবে তারাই শাসন করবে।
১৯৭১ সালের দ্বন্দ্বটা এখানেই নিহিত। কিন্তু আমরা মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতিটা তো অক্ষুণ রাখতে পারিনি। এই রাজনীতির যে আধিপত্য বিস্তার করার কথা তাতো করতে পারেনি। যে কারণে জাতীয় শোক দিবসও বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে পরিণত হয় এক ব্যক্তির মৃত্যু দিবসে।


এ বিষয়গুলো খতিয়ে দেখলে বর্তমান রাজনীতির সঙ্কট উপলব্ধি করা সহজ হবে। আমাদের কিছু বোধহীন মানুষ, মতলববাজ মানুষ, পাশ্চাত্যের অনেকে মনে করেন, দু’টি দল বা ১০ নেতা মিলে-মিশে কাজ করে না কেন? তাহলেই তো রাজনীতি সরল হয়ে যায়। তাহলে প্রশ্ন জাগে, ফ্যাসিস্ট বা নাজি দল বা নতুন নাৎসিদের রাজনীতি করতে দেয়া হয় না কেন?কারণ যে আদর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয় সে আদর্শের বিরোধিতা করা রাষ্ট্রের বিরোধিতা। সেটি আধুনিক, সভ্য রাষ্ট্রে সম্ভব নয়।

বিএনপির প্রতিষ্ঠা হঠাৎ নয়, বঙ্গবন্ধু হত্যাও স্বতঃস্ফূর্ত বা হঠাৎ নয়। এর সঙ্গে আদর্শ, প্রতিশোধ, পুঁজি ও ভূকৌশলগত বিষয় জড়িত। বাংলাদেশ ছিল একটি আদর্শ; পাকিস্তান, সৌদি আরব ও ইসলামী দেশসমূহ তা মানতে রাজি ছিল না। আমেরিকা, চীন এ রাষ্ট্রের বিরোধিতা করেছে। কিন্তু দেখা গেল লুঙ্গি ও গেঞ্জি পরা সামান্য কিছু লোক পৃথিবীর অন্যতম সুসজ্জিত সেনাবাহিনীকে হারিয়ে দিল। আমেরিকা, চীন এ রাষ্ট্র্র চায়নি; কিন্তু এ রাষ্ট্র্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এটি ছিল তাদের জন্য অপমান। বঙ্গবন্ধুর মৈত্রী ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের সঙ্গে; আবার রাষ্ট্র্রের মূলনীতি ছিল সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। সাম্রাজ্যবাদ বা পুঁজির বিকাশে ছিল তা প্রতিবন্ধকতা। এ সব মিলে সৃষ্টি হয়েছিল জিঘাংসার ও প্রতিশোধের। বাংলাদেশের প্রতীক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। সে জন্য তার বিনাশ ছিল ষড়যন্ত্রের লক্ষ্য। কিন্তু, তারা দূরদর্শীও ছিল। সে কারণে তাদের প্রতীক এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী প্রতীক প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন ছিল। তারা জিয়াউর রহমানকে খুঁজে পেয়েছিল।

এভাবে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের নায়করা তাদের এজেন্ট খুঁজে পেল বাংলাদেশে। তারা এতটাই দূরদর্শী ছিল যে, এমন একজনকে বেছে নিয়েছিল যিনি মুক্তিযুদ্ধে জড়িত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী গোলাম আযম টাইপের কাউকে বসালে যে তা চলবে না এটি বুঝতে তাদের অসুবিধা হয়নি।

পাকিস্তানী মানসিকতা তো একেবারে বিলুপ্ত করা যায়নি। সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রবলভাবে তা ছিল। এ সব পাকিস্তানীমনাদের একত্রিত করার জন্য দরকার ছিল একটি মঞ্চের। মার্কিন দলিলপত্রেই আছে কী ভাবে এ কারণে বিএনপির প্রতিষ্ঠা করা হলো। পাকিস্তানীমনারা বিএনপির পতাকাতলে একত্রিত হলেন। মুক্তিযোদ্ধা ভাবটা থাকায় এক ধরনের বিভ্রান্তি জনমানসে সৃষ্টি করা গেছে। সে কারণে মতলববাজরা বা মওদুদ, বদরুদ্দোজা, হুদা টাইপের লোকজনকেও আনা সম্ভব হয়েছিল। যেমন, দেখুন, মওদুদ লিখছেন : ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন করা রুচি-বিগর্হিত। অর্থাৎ, তিনি তো বিবেকবান, স্বচ্ছ চিন্তার লোক। কিন্তু রাজনীতি করেন তিনি যারা ১৫ আগস্ট জন্মদিবস পালন করে তাদের সঙ্গে।

বিএনপির ভিত্তি শক্ত করার জন্য জামায়াতকে রাজনীতিতে জিয়া নিয়ে এলেন যে দলকে ক্রিমিনাল অর্গানাইজেশন হিসেবে বঙ্গবন্ধু নিষিদ্ধ করেছিলেন। ভিন্ন দল হলেও যেই জামায়াত-বিএনপি কখনও বিচ্ছিন্ন হবে না। তারা একে অপরের পরিপূরক। তাদের সুকৌশলী স্ট্র্যাটেজির কারণে আজ তারা শক্তিশালী দল। বঙ্গবন্ধু দেশকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। অপ ও অপরাধমূলক রাজনীতির স্বার্থে জিয়াউর রহমান দেশ ও জাতিকে বিভক্ত করলেন। আমরা যখন এ দু’টি রাজনৈতিক দলের কর্মকান্ড বিবেচনা করি তখন এ মূল বিষয়টি সযতনে এড়িয়ে কোন্ দল অপকর্ম করছে বা করছে না তা বিচার করে, তর্ক বাধিয়ে বিভ্রান্তির রাজনীতি প্রসারিত করি।

সে কারণে, ১৫ আগস্টে যখন পেছন ফিরি তখন মনে হয়, ১৯৭১ সালে আমরা ভেবেছিলাম, জাতিরাষ্ট্র গঠন সম্পন্ন হয়েছে; আসলে তা হয়নি। আমরা ভেবেছিলাম, ধর্মরাষ্ট্র থেকে মুক্তি পেলাম; আসলে পেলাম না এবং জনসংখ্যার একটি বড় অংশ ক্রমান্বয়ে মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতির বিপক্ষে অংশ নিল। এটি বাঙালীর বড় ট্র্যাজেডি। দুঃখের বিষয়, আমরা, সমাজের সব অংশের কিছু মানুষজন এ ট্র্যাজেডি সৃষ্টিতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছি। প্রমাণ করেছি, মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া যতটা সহজ ছিল মুক্তিযোদ্ধা থাকাটা তত সহজ ছিল না। প্রমাণ করেছি, আমরা যতটা না বাঙালী তার চেয়ে বেশি মুসলমানÑ পরে বাঙালী মুসলমান। গত প্রায় পাঁচ শ’ বছর মুসলমান সমাজ পৃথিবীকে তেমন কিছু দিতে পারেনি। এখন তো মনে হচ্ছে সেটি আরও অসম্ভব হয়ে উঠছে।

১৫ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধের সৈন্যরা যদি রাস্তায় নেমে আসতেন তাহলে কি ফারুক-ডালিমরা বেঁচে থাকতেন? তারা নামেননি, কেন নামেননি তার ইঙ্গিত করেছি। সিভিলিয়ান মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা, যারা বঙ্গবন্ধু বলতে ছিলেন পাগল এবং বঙ্গবন্ধুর নামে সে সুবিধা নিয়েছিলেন তারাও নামেননি। বঙ্গবন্ধু হত্যা হয়ত তাদের বিমূঢ় করেছিল কিন্তু তারপরও তো নামার সুযোগ ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ প্রথম ছাত্র ইউনিয়নই করেছিল যাদের কিছু পত্রিকায় আজ নাম ধরে গালাগালি করে বলা হয় আওয়ামী লীগকে তারা ধ্বংস করেছে। সাবেক বামপন্থীরা আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে দলকে শক্তিশালী করেছে। শুধু তাই নয়, জিয়াউর রহমানের আমলে যখন ধর্মনিরপেক্ষ কল্যাণমুখি রাষ্ট্রকে ক্রমেই পাকিস্তানী আদলে রূপান্তরিত করা হয় তখন আমাদের একাংশই তাতে সায় দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা কি সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে গিয়ে জিয়া ও এরশাদকে মহিমান্বিত করেননি? সুতরাং প্রশ্ন জাগে বাংলাদেশের আদর্শ কি এতই ঠুনকো ছিল?

না, ঠুনকো ছিল না। ঠুনকো হলে লুঙ্গি-গেঞ্জি পরা মানুষজন জিততে পারতেন না। এক লাখ শহীদ হলেই হাল ছেড়ে দিতেন। তাতো ছাড়েননি।
মনে রাখা বাঞ্ছনীয় যে, পাকিস্তানী আদর্শ ভায়োলেন্স ও অর্থের সাহায্যে প্রাথমিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। তাদের সাহায্যার্থে ২০ বছরের মধ্যে বিত্তশালী একটি শ্রেণী সৃষ্টি করা হয়েছে যারা আবার রাষ্ট্রযন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং ভাবনার জগতে আধিপত্য সৃষ্টি করেছে। এ কৌশল অসফল হয়েছে বলা যাবে না; কেননা নতুন জেনারেশনের একটি বড় অংশ বিভ্রান্তির রাজনীতি গ্রহণ করেছে। আর মুক্তিযুদ্ধ এখন অতীতের বিষয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বড় দল আওয়ামী লীগ কখনও দূরদর্শী কোন পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি, ভাবনার জগতে আধিপত্য বজায় রাখার চেষ্টা করেনি বরং আত্মপক্ষ সমর্থনে ব্যস্ত থেকেছে।

পাকিস্তানী আমল থেকে এখন ধর্মের জোর বেশি। ধর্মীয় পক্ষের যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের জীবনচর্চার সঙ্গে ইসলামী জীবনচর্চার কোন মিল নেই; কিন্তু তাদেরই ইসলামের রক্ষক মনে করা হচ্ছে। যারা এদের সমর্থক তাদের সন্তান-সন্ততির কেউ মাদ্রাসায় পড়েনি, কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষাকে তারা পরিপুষ্ট করেছে হাতিয়ার হিসেবে এবং সাধারণকে অধস্তন রাখার জন্য। এর মধ্যে শ্রেণীগত একটি ব্যাপারও আছে। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ, ভোগী ও সুবিধাভোগী জীবন যাপনের অন্তিমে মাদ্রাসা-মসজিদ প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হন; কিন্তু মেয়েদের বা প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনে উৎসাহী হন না। কারণ, তাহলে তাদের উত্তরসূরিরা সাধারণের প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে।

রাজনৈতিক যুদ্ধের কৌশল হিসেবে বিএনপি-জামায়াত বা পাকিপন্থীরা আওয়ামী লীগ বা বামদের অধার্মিক হিসেবে চিহ্নিত করতে আগ্রাসী সব পন্থা গ্রহণ করেছে। বিপরীতে আওয়ামী লীগ বা মধ্যপন্থী বা উদার বা মৃদুবাম এ ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে বলেনি, আমার মুসলমানত্ব প্রমাণের দরকার নেই। যারা আমাদের অধার্মিক বলে তারাই অমুসলমান। কিন্তু মধ্যপন্থা এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ না করে সমঝোতা ও নিজেদের মুসলমানত্ব প্রমাণে ব্যস্ত থেকেছে। এটি রাজনৈতিক ভুল যার মাসুল মুক্তিযুদ্ধ চেতনাপন্থীদের গুনতে হচ্ছে।

এই দ্বন্দ্বে নতুন এক গ্রুপের সৃষ্টি হয়েছে। তারা কিন্তু বিএনপি-জামায়াত আমলেই শক্তিশালী হয়েছে। এরা নিজেদের নিরপেক্ষ বা সুশীল সমাজ বলে জাহির করে। এরা পাকিস্তানপন্থী তা বলার সুযোগ নেই। কারণ, নিয়ত তারা এমন সেক্যুলার ডেমোক্র্যাটিক রাষ্ট্রের কথা বলেন যা নিয়ন্ত্রণ করবেন রাজনীতিবিদরা নয়, তারা। মিডিয়া তাদের পছন্দ করে। তাদের ইচ্ছা, রাজনীতিবিদ যদি ক্ষমতায় থাকেনই তাহলে তিনি যেন আওয়ামীপন্থী না হন। অধিকাংশ সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার গত কয়েক বছরের প্রতিবেদন, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় বিশ্লেষণ করলে এর সত্যতা প্রমাণিত হবে। একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ আমি অনেকবার দিয়েছি, এখনও দিচ্ছি, তাহলে এই সুশীল মিডিয়ার ভূমিকাটি পরিস্ফুট হবে। বিশ্বজিৎ হত্যাকান্ডের ভয়াবহ দৃশ্যটি বারবার দেখানো হয়েছে প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে। কিন্তু, কেউ কখনও প্রশ্ন করেননি, এতজন সাংবাদিক সেখানে ছিলেন, দলবদ্ধভাবে তারা তাড়া করলে ওই ক’জন হত্যাকারী পালানোর পথ পেত না এবং সাধারণ মানুষ তখন এদের গণপিটুনিতেই লম্বা করে ফেলত। কিন্তু, বিশ্বজিৎকে রক্ষায় কেউ এগিয়ে আসেনি। বিশ্বজিতের হত্যাকারীদের গ্রেফতার করে যে বিচার করা হলো সে বিষয়টিও উপেক্ষিত হলো। কারণ, সেটি আমলে আনলে বলতে হয়, এ আমলে আইনের শাসন বাস্তবায়নে প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে, পূর্ববর্তী আমলে ছিল যা অনুপস্থিত। এরপর হেফাজতীরা যখন সমাবেশ করছে তখন টিভির রিপোর্টাররা সমানে বয়ান করেছেন তাদের ‘তৌহিদী জনতা’, ‘ধর্মপ্রাণ’ ‘মুসল্লি’ ইত্যাদি হিসেবে।
এরা যখন কোরান পোড়াল এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালাল সে দৃশ্য ওই একদিন বা দু’দিন দেখানো হয়েছে, বারবার নয়, কারণ তাহলে প্রমাণিত হবে এরা ধর্মপ্রাণ নয়, এরা ধর্ম ব্যবহারকারী এবং এর ফলে বিভ্রান্ত রাজনীতির মুখোশ উন্মোচিত হবে। বরং গুরুত্ব দেয়া হয়েছে কয় হাজার মারা গেছে সে বিতর্ক উপস্থাপন করে এবং বিএনপি-জামায়াত যে এই নাটকটি পরিবেশন করেছে তা নিপুণভাবে আড়াল করা হলো। মাহমুদুর রহমান দৈনিক দেশের সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘদিন অপপ্রচার চালিয়ে দেশজুড়ে দাঙ্গা সৃষ্টির পর ১৫ সম্পাদক তার পক্ষে বিবৃতি দেন যাদের অধিকাংশ সমাজে ধর্ম-নিরপেক্ষ ও গণতন্ত্রের অবতার হিসেবে পরিচিত। এর ব্যাখ্যা কী হবে? এসব ভাবার সময় হয়েছে। সবশেষে, একটি উদাহরণ দেই। ১২ তারিখ জামায়াত নিষিদ্ধ করার জন্য আদালতে আপীল করা হয়েছে যেটি বাংলাদেশের জন্য শুধু নয় উপমহাদেশের জন্য প্রধান সংবাদ। ১৩ তারিখে প্রকাশিত মাত্র দু’টি সংবাদপত্রÑদৈনিক জনকণ্ঠ ও কালের কণ্ঠে তা শিরোনাম হয়েছে; অন্য কোন পত্রিকায় নয়। আমি প্রথমে যা আলোচনা করেছি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ এ ঘটনা।

১৯৪৭ সালে এ ভূখন্ড একটি ধর্মরাষ্ট্রের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ ধরনের ধর্ম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার একটি স্বপ্ন ধর্মীয় প্রচারকরা বহুদিন ধরে লালন করছিলেন। অনেকে হিজরতও করেছিলেন ১৯ শতকে। যদিও তা বলা হয়ে থাকে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম, কিন্তু আসলে তা ছিল মুসলমানদের ‘স্বাধীনতা’র আকাঙ্খা। এ ধর্মরাষ্ট্র গঠনের বিপরীতেও অবস্থান ছিল অনেকের। অবশ্য তারা ছিল সংখ্যালঘু। সেই সংখ্যালঘুদের ধর্মরাষ্ট্র-বিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত করা হয়েছিল ১৯৪৮ সাল থেকেই। এবং এর সূত্রপাত করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের মতো তরুণরা। মওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী জড়িত হয়েছেন পরে। সোহরাওয়ার্দীকে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর গুরু হিসেবে যতই প্রচার করুক, সোহরাওয়ার্দী বাঙালীর জন্য তেমন কিছু করেননি। বরং তাঁর থেকে বাঙালীর জন্য বেশি করেছেন মওলানা ভাসানী। এমনকি মানিক মিয়াও। ধর্মরাষ্ট্র মানুষকে মহীয়ান করে না, বরং অমানবিক করে তোলে। এটি উপলব্ধিতে হয়ত এনেছিলেন জাতীয়তাবাদী ও মার্ক্সীয় নেতারা। যে কারণে আমরা দেখি, আওয়ামী লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টি বা ন্যাপ পরস্পরকে সাথী করে আন্দোলন করেছে এবং সেই সব আন্দোলন সফল হয়েছে। চরম বাম বরং চরম ডানে পরিণত হয়ে দেশের ক্ষতি করেছে।

ধর্মরাষ্ট্র ভেঙ্গে ১৯৭১ সালে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পত্তন করা হয়েছিল। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, বিদেশ থেকেও দাবি এসেছিল বাংলাদেশ যেন সেক্যুলার রাষ্ট্র হয়। সেই ১৭ জুলাই ১৯৭১ সালে লন্ডন থেকে ন্যাশনাল সেক্যুলার সোসাইটি নামে একটি সংগঠনের সভাপতি মিসেস ই. ভেন্টন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে এক চিঠিতে জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশ যে প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র গঠন করতে চাচ্ছে তাতে তারা আশাবাদীÑ বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হবে। কারণ ধর্মরাষ্ট্র Òis outmoded, infact gives expression to the worst elements in religion, and that the ties of language, common territory and common economic interest are far more important.” মিসেস ভেন্টনের চিঠি লেখার কারণ? তারা শুনতে পাচ্ছিলেন বাংলাদেশ হয়ত আরেকটি মৃদু ধর্মরাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে-Ômay become a milder version of an Islamic state, because of the possible reluctance of predominantly Hindu refugees in India to return to their homeland.’ হিন্দু বাস্তুহারারা ফিরেছিল, কিন্তু বাংলাদেশ ধর্মরাষ্ট্র হওয়াতে আবার অনেকে দেশত্যাগ করেছেন। ভারতও একটি সেক্যুলার গণতান্ত্রিক দেশ আশা করেছিল।
৩০ লাখ মানুষ শহীদ হলেন যে সেক্যুলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সে রাষ্ট্র চার বছরের শেষে কেন যাত্রা করল ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, সেটি আমরা খুব একটা খতিয়ে দেখিনি। আমিও যে এ বিষয়ে পড়াশোনা করে গভীর উপলব্ধিতে পৌঁছেছি তা নয়, তবে সামান্য কিছু পর্যবেক্ষণ আছে।
বাংলাদেশ আন্দোলন বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ করেছিলেন এটা ঠিক; তবে মনে রাখা বাঞ্ছনীয়, ভোটের হিসাবে (১৯৭০) ২৫ ভাগ বাঙালী এর বিরুদ্ধে ছিল। এই ২৫ ভাগের অধিকাংশ বাঙালী মুসলমান এবং তারা মুক্তিযুদ্ধের সময় গরিষ্ঠ বাঙালী মুসলমানদের হত্যা, মুসলমান নারীদের ধর্ষণে মেতে উঠেছিল। ইসলামের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত এত অল্প সময়ে এতো বিশাল হত্যাযজ্ঞ বাঙালী মুসলমানরাই করেছিল [না, আমি পাকিস্তানী বাহিনীর কথা ভুলিনি, কিন্তু বাঙালী মুসলমানদের একাংশ তাদের সহযোগিতা না করলে এত বড় হত্যাযজ্ঞ সম্পন্ন করা সম্ভব হতো না ]।
এবং তা করা হয়েছিল ধর্মের নামে।
বাঙালী যখন জিতে এলো তখন এই মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং শৈথিল্য দেখানো হয়েছে। ১৯৭২ সালের ৫৪ নং আদেশে পাকিস্তানের সবকিছু অটুট রাখা হয়েছে- ‘‘...ধষষ ষধংি যিরপয বিৎব রহ ভড়ৎপব ড়হ ঃযব ২৫ঃয ফধু ড়ভ গধৎপয ১৯৭১ ... ঝযধষষ পড়হঃরহঁব ঃড় নব রহ ভড়ৎপব...’’ এর সূত্র ধরেই পাকিস্তানী প্রশাসন ব্যবস্থা অটুট রাখা হয় এবং পাকিস্তানের মতোই আমলাতন্ত্রে আস্থা অটুট রাখা হয়। ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে জীবন ও সম্পদের ক্ষয়-ক্ষতি নির্ধারণে যে কমিটি করা হয় (১২ সদস্য) তার প্রধান করা হয় পাকিস্তান পুলিশ সার্ভিসের সদস্য জনাব রহিমকে। সদস্যদের মধ্যে সাতজন ছিলেন আমলা। ৪ জন রাজনীতিবিদের মধ্যে তিনজন ছিলেন জনপ্রতিনিধি; কিন্তু তাদের কাউকে সভাপতি করা হয়নি। আমাদের মানসিকতা যে খুব পরিবর্তন হয়নি তার প্রমাণ, এখনও জনপ্রতিনিধিদের ওপর আমলাদের স্থান-যা পাকিস্তানী মানসিকতা। এ মানসিকতা থেকে খালেদা জিয়া দূরে থাক, শেখ হাসিনাও মুক্ত হতে পারেননি। তবে, জনপ্রতিনিধিরা এতই মেরুদন্ডহীন যে, তারা কখনও এর প্রতিবাদ করেননি। এই দাসসুলভ মনোভাবও পাকিস্তানী মানসিকতার প্রতিফলন।
তৎকালীন নেতৃত্ব ধর্মনিরপেক্ষতার নামে যুদ্ধ করলেও, কখনও মাদ্রাসা শিক্ষা অবলেপন বা সংস্কারের কথা বলেননি; সবচেয়ে আগে ইসলামিক ফাউন্ডেশন করেছেন, ইসলামী সংস্থায় যোগদানের জন্য আকুল হয়েছেন। ধর্মনিরপেক্ষ শাসনতন্ত্র প্রবর্তন করলেও ধর্মরাষ্ট্রের উপাদানসমূহ সম্পূর্ণভাবে রহিত করেননি। কিন্তু সুযোগ তখনই ছিল। উল্লেখ্য, মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক, কোন কথিত মৌলানা, মুফতি, পীর এবং ইসলামী দেশসমূহ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করেনি। বঙ্গবন্ধু সাহসী মানুষ হিসেবে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, অপরাধীদের শাস্তি দেয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু সেই উপাদানসমূহকে সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট না করায় তা গোকুলে বেড়েছে।

স্বাধীন দেশে ঐ পাকিস্তানী পরিপ্রেক্ষিত অটুট রাখা ও মানবিকতা দেখিয়ে পাকিস্তান ফেরত সৈন্যদের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদানের সুযোগ করে দেয়া ছিল মস্ত ভুল। পরবর্তীকালে এই পাকিস্তানী ফেরতরাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে এবং তাদের সমর্থন করে মুক্তিযুদ্ধ ফেরত সৈন্যরা, আওয়ামী লীগের একাংশ ও বেসামরিক আমলারা। আজকে যত অজুহাতই দেখানো হোক, ২৪ ঘণ্টা ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর লাশ সিঁড়িতে পড়ে ছিল; সেনাবাহিনীর কেউ, এমনকি পদক পাওয়া ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ সৈনিকরাও ৩২ নম্বরে আসেনি। বরং পরবর্তী ৩০ বছর ঐ পাকিস্তানী সেনারা ধাপে ধাপে সেক্যুলার রাষ্ট্রকে ধর্মরাষ্ট্রে পরিণত করেছে। এ জন্য দায়ী এবং তা পরিষ্কারভাবে বলা উচিত লে. জেনারেল জিয়াউর রহমান, লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও খালেদা জিয়া। এদের অভিযুক্ত করা যায় বাংলাদেশের মৌলিক আদর্শ বিনষ্ট করার জন্য। পাকিস্তানকে যেমন সৈনিকরা ধর্মরাষ্ট্রে পরিণত করে তা ধ্বংস করে দিয়েছে বা দিচ্ছে, বাংলাদেশের তৎকালীন সৈনিকরাও গত ৩০ বছর একই কাজ করেছে। সে মানসিকতা বলবত এই অর্থে যে, সিভিলিয়ান কর্তৃত্ব বিনষ্ট করে সামরিক কর্তৃত্ব স্থাপন এবং এর মাধ্যমে যাবতীয় অর্থ আত্মসাত বা নিয়ন্ত্রণ বা গ্রহণ। এটি এখন শুধু অটুট নয় আরো তীব্র। ঠিকাদারি ব্যবসা থেকে ট্যাক্সি ব্যবসা সব তাদেরই দিতে হয়েছে এ সরকারকে। এমনকি জিয়াউর রহমান নামে বিমানবাহিনী প্রধানের (জানি না বিমানের সংখ্যা দু’ডজন হবে কিনা? ডিকটাট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মেনে নিতে বাধ্য করা হয়েছে মেট্রোরেলের গতিপথ পরিবর্তনে। যে কারণে রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়েছে কোটি কোটি টাকা। এটিও পাকিস্তানী মানসিকতা। ফিদেল ক্যাস্ট্রো সে জন্য বঙ্গবন্ধুকে পরামর্শ দিয়েছিলেন পাকিস্তানফেরত সেনা ও আমলাদের বাদ দিতে। ক্যাস্ট্রোও তাই করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ক্যাস্ট্রোর অভিজ্ঞতা কাজে লাগাননি। পাকিস্তান তার পরাজিত সৈনিকদের সেনাবাহিনীতে ফেরত নেয়নি।

বাংলাদেশ হওয়ার পর পর বাংলাদেশের বিরোধীদের সম্পূর্ণভাবে বিচার না করার কারণে, পাকিস্তানী মানসিকতার বিকাশ শুধু নয়, পৃথিবীজুড়ে ইসলামের নামে সন্ত্রাস শুরু হয়েছে। আজকের তালেবান, আল কায়েদা প্রভৃতি এক হিসেবে জামায়াতে ইসলামীরই উত্তরসূরি। জামায়াতের অপরাধমূলক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করার প্রধান দায় বিএনপি ও জাতীয় পার্টির। খুন করলে পুরস্কৃত করা হবে- পাকিস্তানের এই নীতি প্রথম চালু করেন জিয়াউর রহমান, তারপর এরশাদ সেই ধারা এগিয়ে নিয়ে যান। এই নীতি পরিপুষ্ট করেন বেগম খালেদা জিয়া। এর সঙ্গে দায়ী আমাদের ও আমাদের পূর্ববর্তী জেনারেশনের একাংশ।

এ দেশে সব সময়ই সঙ্কটকাল চলছে। তার মধ্যেও দেশটি অগ্রসর হচ্ছে। এটি সাধারণ মানুষের কৃতিত্ব। তবে, রাজনীতি বিবেচনা করলে বলতে হবে, আওয়ামী লীগের তিন আমলেই দেশ সবচেয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে। বঙ্গবন্ধু একেবারে নিঃস্ব-বিধ্বস্ত দেশের একটি ভিত্তি গড়েছিলেন মাত্র তিন বছরে যার ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জিয়াউর রহমানের শাসনকাল। শেখ হাসিনার দুই আমলে দেশের প্রবৃদ্ধি যেভাবে বেড়েছে সামরিক এবং খালেদা জিয়ার আমলে তা হয়নি। বিএনপি-জামায়াতের নিয়ত জনবিরোধী কর্মকা- সত্ত্বেও তা থামেনি। সামরিক শাসন দেশে শান্তিশৃঙ্খলা ও স্থাায়িত্ব এনেছে এবং বিএনপি-জামায়াত শাসন আওয়ামী লীগ থেকে উন্নতÑ তা একটি অসত্য প্রচার বা ধারণা। প্রতিনিয়ত আওয়ামী লীগের ‘অপকর্ম’ তুলে ধরা হচ্ছে; তারপরও এ অগ্রগতি কিভাবে হচ্ছে? তাহলে ঐসব আমলে অপকর্মের সংখ্যা বেশি? তাহলে, ঐ আমল বা শাসন আমরা চাইব কেন? এর উত্তর কেউ দেবেন বলে মনে হয় না।
অধিকাংশ মিডিয়া [মিডিয়ার কথা আসছে এ কারণে যে, ‘শিক্ষিত’ সমাজের মন তারা অনেকটা প্রভাবিত করে] বড় সংখ্যক মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বা মানস গত তিন দশকে এভাবে রূপান্তর করেছে বা আমাদের ধমনীতে ঐ পাকিস্তানের বীজ রোপন করেছে, যা এখনও বিদ্যমান। দু’একটি উদাহরণ দিই।
মওদুদ আহমদ তার পূর্বোক্ত গ্রন্থে ২০০৭ সালের ১৫ আগস্ট লিখছেন [রোজনামচায়]: বঙ্গবন্ধুর “সমস্ত ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমি তাঁকে ‘আমাদের ইতিহাসের মহানতম নায়ক’ হিসেবে উল্লেখ করেছি। ‘তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়েই তাঁর সমাধি রচিত হয়নি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তাঁর নাম প্রবাদবাক্যের মতোই ভাস্বর হয়ে থাকবে।’ কিন্তু আজ বঙ্গবন্ধুকে বিতর্কিত এবং খ-িত করার জন্য আওয়ামী লীগ এবং তাদের কিছু বুদ্ধিজীবীরাই দায়ী।” [পূ.১৪১] কিন্তু কিভাব? সেটি তিনি ব্যাখ্যা করেননি।
পাঁচটি সিটি কর্পোরেশনে ভোটাররা বিএনপিকে বেছে নিয়েছেন। প্রায় প্রত্যেক ভোটারই বলেছেন, আওয়ামী লীগের মেয়ররা যা কাজ করেছেন বলার নয়। তাহলে সেসব মেয়রকে ভোট দিলেন না কেন? তারা যে আওয়ামী লীগ করে! সুশীল সমাজ কোন আওয়ামী লীগকে সমর্থন করতে পারে না। কারণ, তারা মনে করে, আওয়ামী লীগ তাদের এবং তাদের প্রতিনিধি ড. ইউনূস বা ড. কামাল হোসেনকে যথার্থ মূল্যায়ন করেনি। এ কথা কখনও বলা হয় না, সুশীল সমাজ কিভাবে সেই দুর্ভাগ্যজনক সামরিক তত্ত্ব¡াবধায়ক সরকার সমর্থন করেছিল হাসিনা-খালেদার বিপরীতে? তারা মাইনাস টু, নিদেনপক্ষে মাইনাস হাসিনার পক্ষে ছিল। এ আশা পূরণ না হওয়ার ক্ষোভ তারা কিছুতেই ভুলতে পারেননি। এ সমস্ত মিলে ধারণা করা যেতে পারে, জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে; আসলে তা নয়। দ্বন্দ্ব সেই ১৯৭৫-পরবর্তী দ্বন্দ্ব। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন সেই দ্বন্দ্বেরই বহিঃপ্রকাশ। এই দ্বন্দ্বের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে যুদ্ধাপরাধ বিচার প্রশ্নে।
শেখ হাসিনা যখন যুদ্ধাপরাধ বিচারে ট্রাইব্যুনাল করেন তখন আওয়ামী লীগের দক্ষিণপন্থীরা তা চায়নি। এই দক্ষিণপন্থীরা যদিও আওয়ামী লীগ করেন [হয়ত সুবিধার কারণে], তাদের মানসিক গড়ন তাদের বিরোধীদের মতন। তাঁরা মনে করেন বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতাটা ভাল, বিএনপি-জামায়াতকে আলাদা করা উচিত; তাতে ভোটের বাক্স প্রসারিত হবে। এই চিন্তাধারা কিন্তু আওয়ামী নেতৃত্বের একাংশে এখনও বিদ্যমান। যা হোক, যুদ্ধাপরাধ বিচার শুরু হয়েছে। বিএনপি সরাসরি যুদ্ধাপরাধী ও যুদ্ধাপরাধকে সমর্থন করছে, যেমন করছে পাকিস্তানীরা। তাদের ধারণা, যুদ্ধাপরাধ বিচারের কারণে তারা দুর্বল হয়ে পড়বে; কারণ, তাদের সমর্থকদের একটি বড় অংশ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সেই ২৫%।
তারা এতদিন মুক্তিযুদ্ধের যে মুখোশ পরে ছিল তা সম্পূর্ণ খুলে ফেলতে হবে [খোলা হয়ে গেছে অনেক পরিমাণে]।
এতে যে নীরব গরিষ্ঠ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষরা ছিলেন তাঁরা আর বিভ্রান্ত হবেন না। ১৯৭১ সালের সেক্যুলার ও গণতান্ত্রিক আদর্শ প্রতিষ্ঠার দিকে সেটি একটি পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপ সফল হলে তাদের রাজনীতি আর থাকে না, তারা আবার ক্ষীণধারায় পরিণত হবে।
সুশীল সমাজ যুদ্ধাপরাধ বিচার সমর্থন করে। কিন্তু, আওয়ামী লীগকে তারা সমর্থন করতে পারে না। কারণ, আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এলে তাদের অস্তিত্ব আরও দুর্বল হয়ে পড়বে, মুখোশ আরও উন্মোচিত হবে। সেটি তারা হতে দিতে পারে না। সুতরাং নির্বাচনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের অবস্থান তারা মেনে নিতে পারে না। কারণ, তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচন হলে তাদের প্রতিনিধিরা সরকার নিয়ন্ত্রণ করবে এবং সেই নিয়ন্ত্রিত সরকার বিএনপি-জামায়াতের পক্ষে যাবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার কখনই নিরপেক্ষ থাকেনি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ঐভাবে জিততে পারেনি। প্রশ্ন করতে পারেন ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ জিতল কিভাবে? জেতার মূল কারণ খালেদা-নিজামী-তারেক এবং ইয়াজউদ্দিন, মঈনউদ্দিন, ফখরুদ্দীনের শাসনকালে মানুষ এমন নিষ্পিষ্ট হয়েছিল যে, তারা আওয়ামী লীগকে ভোট দিতে বাধ্য হয়েছিল। মনের ইচ্ছায় দিয়েছেÑ তা নয়। সুশীল সমাজ সরাসরি তখন বিএনপি-জামায়াতকে সমর্থন দেয়ার সাহস পায়নি; যদিও সমবেদনাটি ছিল তাদের পক্ষেই। এখন ১৮ দল ও সুশীলদের ধারণা, যে কোন প্রকারে আওয়ামী লীগ বা ১৪ দলকে নামাতে হবে। তাতে যদি দেশজুড়ে বিশৃঙ্খলা হয় তাও সই এবং সেজন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করা হবে। উদাহরণ দিই। জামায়াত যে সুনির্দিষ্টভাবে দাঙ্গা, হত্যা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে তার জন্য হরতাল দেয়াকে মুখ্য বিবেচনা করা হচ্ছে। যারা দিচ্ছে তাদের কিন্তু প্রবলভাবে অপরাধী সংগঠন হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে না। বরং জামায়াত-বিএনপির সহিংসতা রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোন ব্যবস্থা নিলে সেটি মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। টিভি চ্যানেলগুলোতে ইচ্ছাকৃতভাবে যুদ্ধাপরাধ, যুদ্ধাপরাধের বিচার, বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য বিতর্কের পর বিতর্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। নিরপেক্ষতার নামে ১৮ দলকে ‘ভিকটিম’ হিসেবে চিহ্নিত করে এক ধরনের নির্বাচনী প্রচার চালানো হচ্ছে।
অন্যদিকে পরিস্থিতি এত সঙ্কটময় এ কারণে যে, আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচনে হারে তাহলে আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। ১৮ দল ও সুশীল সমাজ ১৪ দলের মতাদর্শকে একেবারে বিলুপ্ত করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করবে; যদিও তা সম্ভব হবে না। তাদের আধিপত্য বিস্তারে সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনে এমন শুদ্ধি অভিযান চালানো হবে যে, তা একেবারের জন্য পাকিস্তানী কাঠামোয় পরিণত হবে। অনেককে হত্যা করা হবে। কারণ, বিচারের ঝামেলায় তারা যাবে না। শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকার যাদের সুবিধা দিয়েছেন তাঁরা নিরপেক্ষ হয়ে যাবেন, এখনই যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগের দক্ষিণপন্থীদের একটি অংশ বিএনপিতে যোগ দেবে, কিছু মিলে নতুন দল সৃষ্টি করবে। শেখ হাসিনা যাঁদের নেতৃত্বে এনেছেন তাঁদের একটি বড় অংশ বিদেশ [গতবারের মতো] চলে যাবেন বা হঠাৎ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বেন। সুতরাং নিজ নিজ অস্তিত্বের কারণেই দু’দল নিজ নিজ অবস্থান থেকে লড়বে কী না সন্দেহ। এক হিসেবে, ১৯৭৫ সালে যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করা হয়েছিল বর্তমান নির্বাচনে জয়-পরাজয়ে সেই দ্বন্দ্ব খানিকটা হলেও হ্রাস পাবে। দ্বন্দ্ব থাকবেই, কিন্তু সেই দ্বন্দ্ব সমানে সমানে হবে না এখনকার মতো, এক পক্ষ নিতান্ত সংখ্যালঘিষ্ট হয়ে থাকবে। মতাদর্শগত আধিপত্য এক পক্ষেরই জোরালো হবে।
আমরা যারা এখনও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, মতাদর্শগতভাবে চাই ধর্মনিরপেক্ষ, গণতন্ত্রী ও উদার একটি সমাজ ও রাষ্ট্র, তাদের জন্যও এই লড়াইটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ১৮ দল ও সুশীল সমাজের জয় আমাদের মতাদর্শকে দীর্ঘদিনের জন্য দমিত করে রাখবে। আমাদের অস্তিত্বও হবে বিপন্ন।

অপপ্রচার বাজারে চলে বেশি, এর প্রতি সাধারণের আগ্রহ বেশি। সুকর্মের প্রচার এ দেশে তেমন গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের মতো দেশে একটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় না থেকে এবং থেকে কিছু অপকর্ম করবেই। সরকারে থাকলে নিজেকে গরম মিয়া মনে হয়। এবং সব সময় গরম থাকলে নিজের ক্ষতি হবেই। কিন্তু মিডিয়াতে কোন রাজনৈতিক দল বা সরকার ইতিবাচক কিছু করলে তা খবর হয় না। অপকর্ম করলে তো অবশ্যই হবে এবং হোক, সেটি আমরা চাই। কিন্তু ইতিবাচক বিষয় না তুললে পত্রিকা ভারসাম্য হারায়।
আওয়ামী লীগ সরকারে থেকে অপকর্ম অনেক করেছে। সেগুলো ডিফেন্ড করে কোন লাভ নেই। আমাদের বিবেচনা করতে হয় বিএনপি-জামায়াতের তুলনায় কত কম অপকর্ম করেছে। রাজনৈতিক দলের নেতারা তা করবেনই; কারণ, রাজনীতি এখন মূলত আদর্শের বদলে পেশা। গত কয়েক বছরের পত্র-পত্রিকা দেখুন, মনে হবে এ সরকার ক্ষমতায় এসেছে শুধু অপকর্ম করতেই। কিন্তু সত্য ভিন্ন। উদাহরণস্বরূপ দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত অধ্যাপক এবিএম নাসিরের (১৪.৮.১৩) প্রবন্ধটি উল্লেখ করব। সেখানে কিছু উপাত্ত দেয়া আছে।
নাসির লিখেছেন, ১৯৯০ সালের পর বাংলাদেশে চারটি নির্বাচিত সরকার ও একটি অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থেকেছে। দীর্ঘ ২৫ বছরে সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘন ও হত্যার ঘটনা ঘটেছে বিএনপি আমলে। এর কারণ, জামায়াত চিরজীবন ভায়োলেন্সে বিশ্বাসীনÑ বিএনপির জন্ম ভায়োলেন্সের মাধ্যমে। বিএনপি-জামায়াতের সহযোগী হলো সব মৌলবাদী সংগঠন। খালেদা, নিজামী, তারেকের আমলে বাংলাদেশে সাবেক মন্ত্রী, জনপ্রতিনিধিসহ নিহত হন ‘‘১৩৭ জন, আহত হন ১৪৫৮ জন।’’ গুলিতে মর্মান্তিকভাবে নিহত হন এএসএম কিবরিয়ার মতো অজাতশত্রু মানুষ, আহসানউল্লাহ মাস্টারের মতো জনপ্রতিনিধি, আইভি রহমানের মতো রাজনৈতিক নেত্রী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ইউনুস। আহত হন, এমন কি ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতও। গত চার বছরে কি এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে? বলতে পারেন চৌধুরী আলম বা ইলিয়াস আলীর কথা। কথিত আছে, মেয়র খোকার আমলে টোকাই আলম গুলিস্তানে নাকি বঙ্গবাজার পুড়িয়ে দেয়। তারপর তা দখল করে এক দানে কোটি কোটিপতি হয়ে যায়। বিএনপির দাবি, র‌্যাব তাকে গুম করেছিল। এখন জানা গেছে, আলমের প্রতিদ্বন্দ্বী আরেক টোকাই থেকে কোটিপতি তাকে গুম করে। ইলিয়াস আলী কী উপায়ে অর্থ ও পেশিশক্তির মালিক হয়েছিলেন তা তার সমসাময়িক সবাই জানেন। বিএনপি সরকারই তাকে খুনের দায়ে গ্রেফতার করেছিল। তাকে গুম করে সরকারের লাভ কি? গুম করলে তো তাদের করতে হবে, যাতে রাজনৈতিক ফায়দা আছে। গু-াপা-া গুম করে রাজনৈতিক ফায়দাটা কী? এএসএম কিবরিয়া, আইভি রহমান বা আহসানউল্লাহ মাস্টারের ব্যাকগ্রাউন্ড কি সেরকম? সরকারী প্রচেষ্টায় প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খুনের চেষ্টা তো বিএনপি আমলেই ঘটেছে। যখন বর্তমান সরকারের অপকর্মের কথা ফলাও করে ছাপা হয় তখন সযতনে এসব কথা এড়িয়ে যাওয়া হয় এ বলে যে, পুরনো কথা থাক। পুরনো কথা বাদ দিলে বর্তমান বুঝব কিভাবে?
সাংবাদিক নির্যাতনের কথা আসে। বিএনপি আমলে সাংবাদিক হত্যা করা হয় ১৩ জন। এ আমলে ৭ জন। রাজনৈতিক ভায়োলেন্সে বিএনপি আমলে মৃত্যু ১২৬৫ জন, আর এ আমলে ৭৫৮ জন। [ক্রসফায়ারে আওয়ামী লীগ আমলে ৩৪৬ জন [এ পর্যন্ত], বিএনপি আমলে ৭৯৬ জন। ভায়োলেন্সেও আওয়ামী লীগ হার মানাতে পারেনি বিএনপিকে। তাহলে বুঝুন, দু’একটি ছাড়া অধিকাংশ মানবাধিকার সংস্থার ব্যবসাটি কি রকম!]
না, আমি কোন মৃত্যু, হত্যা, গুম কোন আমলেরই সমর্থন করি না। কিন্তু মিডিয়া এবং রাজনৈতিক দল (বিএনপি-জামায়াত) কিভাবে অপপ্রচার চালায় তার একটি উদাহরণ দিলাম মাত্র। কারণ, পরিসংখ্যানের চেয়ে জোরালো সাক্ষী আর কিছু নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তরুণ অধ্যাপক ছোট একটি নিবন্ধে যা প্রমাণ করেছেন, আওয়ামী লীগের বাঘা বাঘা নেতা-মন্ত্রী-উপদেষ্টা তার কিছুই পারেননি। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস শাখা ও মন্ত্রণালয় [ইনুর আগে] যে কতটা অযোগ্য এটি তার ছোট একটি উদাহরণ। কিন্তু, মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে, অযোগ্যদের এত যোগ্য ভাবেন কেন রাজনৈতিক নেতারা? তারা কি ভাবেন যোগ্য লোক এলে নেতার নেতৃত্ব খাটো হয়ে যাবে? পাশাপাশি ভারতের প্রধানমন্ত্রী বা সোনিয়া গান্ধী কাদের পাশে রাখেন দেখুন।
গত চার বছরে আওয়ামী লীগ যা করেছে গত ২৫ বছরে কোন সরকার তা করেনি। বিলবোর্ডের প্রচার ঠিকই ছিল, কিন্তু মাথামোটা লোকজন পাশে থাকলে যা হয় তাই হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ভেবে অবাক হতে পারেন যে, কার জন্য এত করলাম? তিনি এত করেছেন ঠিকই আছে, কিন্তু সব মানুষ জানবে কিÑ কিভাবে যেখানে তার আশপাশে প্রচার অনভিজ্ঞদের দেয়া হয় প্রচারের দায়িত্বে?
আওয়ামী লীগ যে নির্বাচনে ক্রমাগত হারছে তার কারণ কখনও খতিয়ে দেখা হয়নি। সরকার নীতি নির্ধারণ করে অগ্রাধিকার ঠিক করে তা বাস্তবায়নে জোর দিয়েছে। দেশের অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় দলকে দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। দলের যে নতুন নেতৃত্ব গঠন করা হয়েছে তার একটি উদ্দেশ্য ছিল বটে, কিন্তু তা সফল হয়নি। এর একটি কারণ, সব কিছু দলীয় সভানেতৃত্বে কেন্দ্রীভূত। সমষ্টিগত নেতৃত্ব নেই। যে দলের সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকরা নিষ্ক্রিয় সে দল চলবে কিভাবে? এখন দলের সাংগঠনিক অবস্থা বিপর্যস্ত। এ মন্তব্যে দলের নেতারা ক্ষুব্ধ হতে পারেন। তাতে কিছু আসে যায় না। এ সব মতামত বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় নেতারাই আমাদের জানিয়েছেন। দলের কর্মীরা টাকা ছাড়া এক পা নড়তে নারাজ। এ অবস্থার জন্য দলীয় নেতারাই দায়ী। বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু করলেও বঙ্গবন্ধুর অধিকাংশ আদর্শ থেকে বর্তমান নেতৃত্ব সরে এসেছে। আদর্শের জায়গাটা অনেকটা নড়বড়ে হয়ে গেছে। দলে ত্যাগীদের থেকে অর্থবানদের ইজ্জত বেড়েছে এবং কেন্দ্রীয় সংগঠন জোরালো না হওয়ায় দলের অবস্থা নড়বড়ে হয়ে গেছে। এ কথাটা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে নেতৃত্ব যে, কোন শক্তি কোন দলকে ক্ষমতায় বসায় না। গণতান্ত্রিক নির্বাচনে মানুষই দলকে ক্ষমতায় নেয়। সেই মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে এগিয়ে নেয় সংগঠন। গত চার বছরে সরকার হয়ত উপকৃত হয়েছে, কিন্তু দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যারা ভোট দেবেন স্থানীয় এমপি-নেতাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নেই, রনি-বদিরা এর উদাহরণ। শহুরে সির্ভিল সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষীণ। এলিট সমর্থকরাও উপেক্ষিত। অর্থ ছাড়া সব কিছু যেন অর্থহীন। আওয়ামী লীগ সমর্থক, এলিট ও অর্থবান এফবিসিসিআইয়ের প্রাক্তন সভাপতি যদি পুলিশের পিটুনি খায় তাহলে অবস্থা কী হতে পারে তা অনুমেয়।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ঢাকায় এসেছেন। তিনি বলছিলেন, শেখ হাসিনা বলছেন জিতবেন। আর তার নেতারা নিজ দলকে ৩০/৪০টির বেশি সিট দিতে রাজি নয়, ব্যাপারটা কী? ব্যাপার কেউ জানে না। তবে এটা জানে যাদের নিয়ে শেখ হাসিনা লড়বেন বলে ঠিক করেছেন, ৪ সিটি কর্পোরেশনে হারার পর তারা মানসিকভাবে পরাজিত হয়ে পড়েছেন। এ ধরনের পরিস্থিতিতে দল, হয় লড়াইর জন্য চাঙ্গা হয় না হয় মিইয়ে পড়ে; কিন্তু আওয়ামী লীগ মিইয়ে পড়েছে। এর অন্যতম কারণ দলে এখন কোন দিকনির্দেশনা নেই। এক ঘেরাটোপে আটকে আছেন সভানেত্রী।
আওয়ামী লীগ কী করবে তা আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ঠিক করবে, সেখানে আমাদের বলার কিছু নেই। আমরা কোন পরামর্শ দিচ্ছি না। আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে মনে করে আওয়ামী লীগেরই নেতাকর্মীরা আমাদের যা বলেন তার সারাংশ তুলে ধরলাম। আওয়ামী লীগ এত ইতিবাচক কাজ করেও যদি নেতৃত্বের অকারণ জেদ, অহমিকা ও ভুলের কারণে [ভুল দেখিয়ে দিলেও, ‘আমি যা বলছি তাই ঠিক’Ñ এটিই জেদ, ভুল স্বীকার না করায় কোন মাহাত্ম্য নেই] যদি ১৪ দল পরাজিত হয় তাতে তো আমরা আনন্দিত হব না। খানিকটা হতাশ হই এ ভেবে যে, এত অপপ্রচারের জবাব দেয়ার মতো কোন ব্যক্তি বা দল নেত্রী সৃষ্টি করতে পারেননি। এ জন্য বলা হয়, মূর্খ যোগ্যতাহীন চামচা বন্ধু থেকে বুদ্ধিমান শত্রু শ্রেয়।
অপপ্রচারের কথা বলছি বারবার এ কারণে যে, তা জনমনে শুধু বিভ্রান্তি নয়, দলেও বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। যে প্রচারটি চালানো হয়েছে তাহলো, আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতের সখ্য। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কারণ জামায়াতের ওপর চাপ সৃষ্টি করা; যাতে তারা বিএনপির সঙ্গ ছেড়ে দেয়। বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি আওয়ামী লীগের অনেকে তা বিশ্বাস করে। তারা বিশ্বাস করে, মাদ্রাসা-মক্তবকে তোষণ করলে ভোট আসবে। যে কারণে, নুরুল ইসলাম নাহিদের মতো মানুষ শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার পরও মাধ্যমিক কারিকুলামে ধর্মশিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নয়। মাদ্রাসাকে যে এত তোষণ করা হয়েছে তাতে কি ভোট বেড়েছে? নিতান্ত গবেট না হলে এ ধারণা কিভাবে হয়: যারা জামায়াত করে তারা আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে? বিএনপির সঙ্গে জোট না থাকলেও দেবে না। পাকিস্তান তাদের ফাদার-মাদার। সেই পাকিস্তানকে কাঁচকলা দেখিয়ে বাংলাদেশ হয়েছে, পাকিদের অপমানের চূড়ান্ত করেছে; এটি একজন ট্রু জামায়াতী, ট্রু বিএনপি মেনে নিতে পারে না। হেফাজত কখনও ভোট দেবে না আওয়ামী লীগকে। নারী দেখলে যে আহমদ শফীর লালা ঝরে তাকে তোয়াজে কি ফল হয়েছে? কিন্তু আওয়ামী লীগ তোয়াজ করতে চেয়েছে এবং ঝাঁপটা খেয়েছে। এই অপপ্রচার আওয়ামী লীগের ক্ষতি করেছে। এবং এই বিশ্বাস আওয়ামী লীগের মূল আদর্শ বা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ম্লান করেছে। দলের নেতা শেখ হাসিনা বটে, কিন্তু দলের যে নেতৃত্ব তিনি সৃষ্টি করেছেন তা তাঁর নিয়ন্ত্রণে নেই।
হেজাবিরা যখন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে তখন শেখ হাসিনা [হঠাৎ সৈয়দ আশরাফ] বলেছিলেন, জামায়াত-হেফাজতকে কোন ছাড় দেয়া হবে না। এই উক্তি দলের আদর্শের নড়বড়ে স্থানটা ঠিক করে দিয়েছিল। দলের তৃণমূল নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা চাঙ্গা হয়ে উঠেছিলেন। তার মত অনুসরণ করে একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন শুধু স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী। কিন্তু তাঁর অন্য কোন মন্ত্রী, কোন বড় বা পাতি নেতা, কোন উপদেষ্টা, কোন এমপি এ কথা বলেননি। এমনকি চার পরাজিত মেয়র হেফাজতী ও জামায়াতীদের তোয়াজ করেছেন এবং লাথি খেয়েছেন।
যুদ্ধাপরাধ বিচারের পর এসেছে জামায়াত নিষিদ্ধকরণ ও গোলাম আযমের দ- বৃদ্ধি প্রসঙ্গ। আমরা জেনেছি, এ প্রশ্নেও ছাড় দিতে চেয়েছিল পার্টির কিছু ব্যক্তি [যাদের মিত্র মনে করা হবে আরেকটি ভুল]।
কিন্তু এ দু’টি ক্ষেত্রেই সরকার আপীল করার পর এখন আর অপপ্রচারের কোন সুযোগ নেই। এবং এই কার্যক্রম শেখ হাসিনার নির্দেশ ছাড়া হয়েছে, এটি কোন পাগলও বিশ্বাস করবে না। আদালতের রায় কী হবে জানি না। কিন্তু শেখ হাসিনা যে এই পথটি বেছে নিয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের জায়গাটায় পৌঁছাবার পদক্ষেপ নিয়েছেন, সে কারণেই অন্তত ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনাকে সমর্থন করব।
এ দীর্ঘ পটভূমি দিতে হলো সামান্য একটি কথা বলার জন্য। সেটি হলো যুদ্ধাপরাধ বিচার, জামায়াত নিষিদ্ধকরণ, আওয়ামী লীগের ভূমিকা এবং সম্ভাব্য ফলাফল ও আমাদের অভিজ্ঞতা।
যুদ্ধাপরাধ বিচারের আন্দোলন আমরা দীর্ঘদিন করেছি। বাংলাদেশের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিকদের অধিকাংশ কোন না কোনভাবে জড়িত ছিলেন এ আন্দোলনের সঙ্গে, তাঁদের অনেকে প্রয়াত। তাঁদের অশেষ আকাক্সক্ষা ছিল যুদ্ধাপরাধ বিচার দেখা যাওয়া। আমরা অনেকে এর সঙ্গে থাকলেও এর সাংগঠনিক সব দায়িত্ব পালন করেছেন শাহরিয়ার কবির। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রাণ তিনি, আমাদের অবস্থান প্রান্তিক।
এই আন্দোলন যখন শুরু হয় তখন জামায়াতের মিত্র বিএনপি ক্ষমতায়। সে অবস্থায় এ ধরনের আন্দোলনের সূত্রপাত ব্ল্যাসফেমির মতো। যে কারণে গণআদালত সফল হলে উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা করতে দ্বিধা করেনি খালেদা সরকার। শুরু থেকেই আমরা বলেছিলাম, সিভিল সমাজ এ আন্দোলনের উদ্যোক্তা কিন্ত লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে রাজনৈতিক সমর্থন ও অঙ্গীকার দরকার। রাজনৈতিক দলগুলো যাদের আমরা মিত্র ভাবি তারা সহায়তা করেছিল।
এ কথা বলতে দ্বিধা নেই, শেখ হাসিনা গণআদালত সফল করতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং আওয়ামী লীগের সমর্থক ও কর্মীরাও।
জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পর আন্দোলনে ভাটা পড়লেও আন্দোলন বন্ধ হয়নি। সে সময় রাজনৈতিক কোন সমঝোতা ব্যর্থ হলে শেখ হাসিনা ছাড়া দলের অন্যান্য নেতা আমাদের দোষী করে বলেছেন আমরা অনেক কিছুর জন্য দায়ী। এখনও যখন নেতা বলে পরিচিত, যাদের তত্ত্ব সমঝোতা, তারা বলছেন, নির্মূল কমিটি ও শাহবাগ আন্দোলন হেফাজত-জামায়াতের উত্থানের জন্য দায়ী।
শেখ হাসিনা অনেক সময় রাজনৈতিক কারণে আমাদের আন্দোলনের বিষয়ে নিষ্ক্রিয় থেকেছেন। কখনও সক্রিয় হয়েছেন কিন্তু কখনও নেতিবাচক কোন মন্তব্য করেননি। আন্দোলন চালাবার জন্য পয়সাকড়ি দরকার। তা দিয়েছেন আমাদের সদস্যরা। বোঝা সব সময় ছিল শাহরিয়ারের কাঁধে। আওয়ামী লীগ নেত্রী কখনও কখনও সাহায্য হয়ত পাঠিয়েছেন বলে শুনেছি [সত্যমিথ্যা জানি না] কিন্তু যার মারফত পাঠিয়েছেন তিনি সে সাহায্য মেরে দিয়েছেন। যেহেতু শেখ হাসিনার সঙ্গে আমাদের কোন যোগাযোগ ছিল না সে জন্য বিষয়টি জানা যায়নি। অধ্যাপক কবীর চৌধুরী তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের চিঠি দিয়ে অপেক্ষা করতে করতে মারাই গেলেন। অনেক মুক্তিযোদ্ধা ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর কাছে সাহায্যের জন্য গেছি, অপেক্ষা করিয়েছেন তারপর উপদেশ দিয়ে বিদায় করেছেন। কোন প্রকাশনার জন্য অর্থসাহায্য চাইলে কেউ কেউ সাহায্য করেছেন কিন্তু তাদের নাম উল্লেখ করতে নিষেধ করেছেন। এই ছিল অবস্থা।
আমরা দমিনি। লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হইনি। ব্যঙ্গবিদ্রƒপ, অপমান, উপেক্ষা, সহ্য করেছি কিন্তু লক্ষ্য বিচ্যুত হইনি। তারপর এক সময় দেখলাম যুদ্ধাপরাধ বিচারে সমাজ সক্রিয় হচ্ছে বিশেষ করে তরুণরা আমাদের প্রতি আস্থা রাখছে এবং বিষয়টি এক সময় এমন পর্যায়ে এলো যে ২০০৮ সালের নির্বাচনে ১৪ দলের, এমনকি এরশাদের ম্যানিফেস্টোতেও যুদ্ধাপরাধ বিচারের দাবি অন্তর্ভুক্ত হলো।
বিএনপি-জামায়াতের প্রবল অত্যাচার এই আন্দোলনকে আরও বেগবান করেছে এ অর্থে যে, সমাজের গরিষ্ঠ অংশ অনুভব করেছে, জামায়াত একটি অশুভ শক্তি এবং বিএনপি এর সঙ্গে যুক্ত।
১৪ দল ক্ষমতায় যাওয়ার পর অপপ্রচার শুরু হলো, বিচার হবে না। যেহেতু শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু কন্যা সেহেতু আমরা আশা রেখেছিলাম, বিষয়টি তিনি ভুলবেন না, কথার খেলাপ করবেন না। না, তিনি করেননি।
বিচার শুরু হলে বলা হলো, তদন্তে দেরি হবে। তদন্ত শেষ হলে বলা হলো, লোক দেখানো বিচার। আসলে জামায়াতের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। বিচার শেষ হলে বলা হলো রায় কার্যকর হবে না। বিষয়টি এখন এ পর্যায়ে আছে।
জামায়াতের নিবন্ধীকরণ বাতিলে নির্বাচন কমিশনে আমরাই প্রথমে এর বিরুদ্ধে আবেদন করি। তানিয়া আমীর আমাদের হয়ে শুনানি করেছিলেন। আমাদের কয়েকজনও। নির্বাচন কমিশনাররা আমাদের দাবি যৌক্তিক জেনেও তা নাকচ করে দেন। কারণ নিবন্ধীকরণ নাকচ করার সাহস তাদের ছিল না। আজ দেখি তারা প্রায়ই নির্বাচন নিয়ে আমাদের পরামর্শ দেন। আমাদের মধ্যবিত্তের যে স্বরূপ আগে আলোচনা করেছি তার সঙ্গে এদের সাযুজ্য মিলিয়ে দেখুন। আজ জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে।
নির্মূল কমিটি শুরু থেকেই জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি তুলেছে। এ দাবিকে সবাই অসম্ভব বলেছেন। আজ আদালতের চারটি রায়েই তাদের অপরাধী সংগঠন বলা হচ্ছে। জামায়াতের সাম্প্রতিক কার্যকলাপ এই রায়কে সমর্থন করেছে। বলা হচ্ছিল, যেহেতু জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতা হচ্ছে তাই নিষিদ্ধকরণের ব্যাপারে সরকার নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করবে। এখন দেখা যাচ্ছে সেই নিষিদ্ধকরণের আবেদনও করা হয়েছে। আশা করা যায় ১৫/১৬ সেপ্টেম্বর কাদের মোল্লার আপীলের রায়ও হবে। তখন হয়ত বলা হবে রায় কার্যকর করা হবে না।
আওয়ামী লীগ অন্তত এ ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিয়ে অপপ্রচার রোধ করেছে যে কারণে, তা আগেই উল্লেখ করেছি। মিডিয়া বিষয়টিকে সে কারণে গুরুত্ব দিচ্ছে না।
আমার ধারণা, আওয়ামী লীগের একটি অংশ এ আপীল পছন্দ করবে না। যুুক্তিটা হবে, নিষিদ্ধ করলে জামায়াত আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাবে তখন তাদের চিহ্নিত করা যাবে না। এটি ভুল ধারণা। জামায়াত সংলগ্ন জঙ্গী সংগঠনগুলো আন্ডারগ্রাউন্ডেই আছে এবং তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে।
জামায়াত যদি নিষিদ্ধ হয় তাহলে নতুন নামে তারা নতুন দল করবে। বিএনপিতে একটি অংশ একীভূত হয়ে যাবে। তার দরকষাকষির ক্ষমতা কমে যাবে। লাভ হবে বিএনপির। নির্বাচনে তাদের জামায়াতের সঙ্গে সিট ভাগাভাগি করতে হবে না। অনেক বিএনপি নেতা ফিসফাস করে বলছেন, সরকার এদের নিষিদ্ধ করে না কেন? জামায়াত নিষিদ্ধ হলেও বিএনপিতে ভোট দেবে। লাভবান হবে আওয়ামী লীগও। কারণ গোপন সংস্থা হিসেবে জামায়াত তেমন কার্যকর কর্মপন্থা নিতে পারবে না। যেমনটি হয়েছে হিজবুত তাহরীর ক্ষেত্রে। তবে, বিএনপিতে প্রবলভাবে অনুপ্রবেশের পর বিএনপিকে তারা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করবে।
জামায়াত নিষিদ্ধ হলেও জামায়াতের অর্থনৈতিক ক্ষমতা থেকে যাবে। রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধ হলে প্রকাশ্যে জামায়াত সমাজে যেভাবে প্রভাব বিস্তার করছিল তা হ্রাস পাবে, সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক ক্ষমতাও। একটু সময় লাগবে, এই যা।
রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ সবচেয়ে লাভবান হবে এবং এটি মধুর প্রতিশোধও হবে। বঙ্গবন্ধু জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেছিলেন। রাজাকার বন্ধু জিয়া সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু কন্যার সময় [যদি রায় অনুকূল হয়] জামায়াত আবার নিষিদ্ধ হতে পারে। এতে এ কথা প্রমাণিত হবে যে, শেখ হাসিনা আদর্শের জায়গাটা আবার ফিরিয়ে আনতে যাচ্ছেন যা রাষ্ট্রের জন্য শুভ। তরুণদের সম্পূর্ণ সমর্থন আওয়ামী লীগ পাবে যা হেফাজতের থেকে বেশি। সিভিল সমাজের এ ধরনের আন্দোলনে সর্বতোভাবে ১৪ দলের সাহায্য করা ফরজ। কারণ তাতে তাদের লোকসান নেই, লাভই বেশি।
আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জিতবে কি জিতে না তা জানি না কিন্তু ভোট সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, এটি বলতে পারি। এদেশে এখনও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিরাট সমর্থন রয়ে গেছে। এ শক্তি সক্রিয় করতে পারলে জয় সুনিশ্চিত।
জামায়াত যখন বিএনপি হবে বা বিএনপি যখন জামায়াত হবে তখন তাদের অপ ও অপরাধমূলক রাজনীতি অব্যাহত থাকবে। আমাদের লড়াইটা এখন হবে সাধারণকে বোঝানো যে, অপরাধীদের রাজনীতি এ দেশে চলতে দেয়া উচিত নয়। ক্রিমিনাল অর্গানাইজেশনকে যারা সমর্থন করে তাদের রাজনীতি করতে দেয়া উচিত নয় বরং ভোটের মাধ্যমে তাদের এতিম করে দেয়া উচিত।
এ ধরনের দীর্ঘ আন্দোলনের পথ কণ্টকপূর্ণ ও নিঃসঙ্গ। আমাদের অভিজ্ঞতা তাই বলে। কিন্তু অভিজ্ঞতা আরও বলে রাস্তায় নামলেই তো লক্ষ্যে পৌঁছান যায়, পথ যতই নিঃসঙ্গ আর কণ্টকাকীর্ণ হোক না কেন।
আওয়ামী লীগ অনেক কাজ করেছে কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে ইতিবাচক কাজ হয়েছে যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও জামায়াত নিষিদ্ধকরণে পদক্ষেপ। আমরা যে ধরনের রাষ্ট্র চাচ্ছি, এ ক্ষেত্রে এটি একটি নিশ্চিত পদক্ষেপ। এ পথ বন্ধুর এবং নির্জন। কেননা, এ ক্ষেত্রে দলের সম্পূর্ণ বিশেষ করে দক্ষিণপন্থীদের সমর্থন পাওয়া যাবে না। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও হয়ত প্রতিক্রিয়া হবে। যদি আওয়ামী লীগ পরাজিত হয় তখন শেখ হাসিনার ওপর দোষ চাপানো হবে এবং মন্ত্রী, এমপি ও নেতারা নিজেদের জনবিচ্ছিন্নতা ও অপকর্ম ঢাকার জন্য বলবেন, যুদ্ধাপরাধী বিচার, জামায়াত নিষিদ্ধের প্রক্রিয়া ও হেফাজত দমন পরাজয়ের কারণ। আসলে, পরাজিত হলে পরাজয়ের কারণ যে তা নয়, তা আমরা জানি। সে জন্যই তরুণদের এবং আমাদের পক্ষ থেকে বলতে পারি, যদি পরাজিত হয় ১৪ দল তাহলে দলের সমর্থক ও অধিকাংশ কর্মী দুঃখিত বা হতাশ হবেন না। তারা বরং চাঙ্গা হবেন এ ভেবে যে, অপরাজনীতির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ দাঁড়িয়েছে এবং আবারও একটি উদার গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের দিকে এগুচ্ছে। আদর্শ ক্ষেত্রে আর দোলাচল নেই। এবং তারা গর্ব করে বলতে পারবে, আওয়ামী লীগেরই সাহস আছে এ কাজ করার এবং এ পথ বেছে নেয়ার। মানুষ আজ তা বুঝতে না পারলেও আগামীকাল বুঝবে এবং তখন যে জয় হবে সেটি বিশাল এবং সেই বিশালত্বে হারিয়ে যাবে অপরাজনীতির অপদেবতারা। তরুণদের ভবিষ্যত হবে আরও সম্ভাবনাময়।
মরার আগে মরে কোন লাভ নেই। আওয়ামী লীগ বা ১৪ দলের সমর্থকদের বলব, ব্যক্তিগত মূল্যায়ণের মতো ক্ষুদ্র জিনিস ভুলে যান, সামান্য মানষই এসবকে অসামান্য ভাবে। বাংলাদেশে এখন সময় এসেছে সেøাগান দেয়ারÑঅপ ও অপরাধমূলক রাজনীতি নিপাত যাক। যদি দলীয় নেতারা তাতে যোগ না দেন তাদের ফেলে এগিয়ে যান। তরুণরা যেন শাহবাগ বা ঢাকার দিকে তাকিয়ে না থাকেন, যার যার এলাকায় নিজেরাই সংঘবদ্ধ হয়ে কাজ করুন। হেফাজত, জামায়াত ও বিএনপির বিরুদ্ধে নারীদের বলুনÑহেজাবীরা এলে শফিদের হারেমে যেতে হবে। বলুন, জামায়াতকে সমূলে বিনাশ করে দেশে শান্তি আনতে হলে, দেশকে এগিয়ে নিতে হলে বিএনপির অপ ও অপরাধমূলক রাজনীতি প্রতিরোধ করতে হবে।
জীবনে জয়-পরাজয় বড় ব্যাপার নয়, লড়াই করে যাওয়াটাই আসল। এবং লড়াই করে গেলে জয় আসবেই। কারণ, ইতিহাস আমাদের পক্ষে। দৈনিক জনকন্ঠ

No comments:

Post a Comment