Wednesday, August 14, 2013

বঙ্গবন্ধুর ধর্মানুভূতি ও কিছু কথা :অধ্যক্ষ আলহাজ্ব ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী




১৫ আগস্ট জাতীয় শোকদিবস। মানব ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডে সপরিবারে শাহাদত বরণ করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। কালের চক্রে একুশটি বছর পার হয়েছে। কিন্তু অপবাদের চাকা এখনো থামেনি। মিটিং, মিছিলে, নির্বাচনে, এমনকি সিরাতুন্নবী সম্মেলনে চলছে অপপ্রচার। স্বার্থান্বেষী মহল যারা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চায় বা ধর্মের বেসাতি করে রাজনৈতিক অঙ্গনে টিকে থাকার অপপ্রয়াস চালায়, তারাই জীবিত মুজিবের চেয়ে মৃত মুজিবকে ভয় পায়। তাই মৃত ব্যক্তিকে নিয়েও এই টানা হেঁচড়া। এমনকি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর জেনারেল জিয়া ফরমান জারি করেছিলেন, মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে রাজনীতি করা চলবে না। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, কিছুদিন যেতে না যেতেই বেগম জিয়াকেও মৃত ব্যক্তির নামে রাজনীতি করতে হয়।

কি অপরাধ ছিলো এই রাখাল রাজার, এই মুকুটহীন সম্রাটের? যৌবন গেছে জেলে। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন বেশ ক’বার। মাথা নোয়াননি। আপস করেননি পশ্চিমা শোষকের সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রীত্বের টোপও তাঁকে কাবু করতে পারেনি। তাইতো হাজার বছরের পরাধীন বাঙালি আজ স্বাধীন। ইতিহাসের মহানায়ক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ একুশটি বছর সরকারিভাবে অনাদৃত, অবহেলিত, রেডিও টেলিভিশন থেকে নির্বাসিত তাঁরই সৃষ্টি স্বাধীন দেশে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চাওয়া যাবে না, কি অদ্ভুত ফরমান। সত্যি বিচিত্র এদেশ সেলুকাস! মুক্তিযোদ্ধারা পথে পথে ক্ষমতার মসনদে রাজাকার।

বঙ্গবন্ধুর অপরাধ সংবিধানে জাতীয় চার মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র শব্দ দু’টি সংযোজন করেছিলেন। যদিও তিনি বার বার বলেছিলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। যার ধর্মে সে বিশ্বাসী হয়ে নিজ নিজ ধর্ম নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করার আহবান জানিয়েছিলেন। তাঁর এই সহজ সরল কথাগুলোকে অপব্যাখ্যা করে তাঁকে কেউ নাস্তিক, কেউ হিন্দু ঘেষা আবার কেউ ইসলাম ধর্মের প্রতি তাঁর কোন অনুরাগ ছিলো না বলে অপপ্রচার চালায়। সরলপ্রাণ বাঙালি মুসলমানেরা অনেকাংশে বিভ্রান্তও হয়। এহেন হীন ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করার জন্যে বঙ্গবন্ধুর চেতনা ও ধর্মানুভূতির সঠিক মূল্যায়ন করার বাস্তব চেষ্টা তেমন হয়নি। এর দায়ভার আপনার আমার সবার। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির। তিনি আজ আমাদের মধ্যে নেই। আজ সময় এসেছে জনমনের সেই সংশয় সন্দেহ দূর করার।

“লাকুম দ্বীনকুম অলিঅদিন।” “লা ইকরা ফিদ্দিন”।
এগুলোতো কোরআনেরই আয়াত। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা স্বয়ং স্রষ্টাই নিষিদ্ধ করেছেন। ইসলামের ইতিহাসের দিকে তাকালেও আমরা দেখি, রসুলে করিম (সঃ) যখন মক্কা থেকে মদিনায় হিযরত করেন, তখন তাঁর সঙ্গে যাঁরা ছিলেন, তাঁরাই শুধু মুসলমান। মদিনায় যাঁরা ছিলেন তাঁরা সবাই ইহুদি, নাছারা। আল্লাহর সবচেয়ে পেয়ার নবী ইচ্ছা করলে সবাইকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে মদিনা শরীফে ইসলামি শাসন কায়েম করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি ইহুদি নাছারাদের ডেকে এক জায়গায় বসে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে একটি চুক্তিতে উপনীত হয়ে মদিনা শরীফের জন্যে একটি বিশেষ শাসন ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। সেই চুক্তির নাম ‘মদিনাসনদ’-দুনিয়ার প্রথম লিখিত সংবিধান। এই সনদের প্রথম শর্তে মদিনার সকল অধিবাসীর ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করে যার ধর্ম সে বিনা বাধায় পালন করার অধিকার দিয়েছিলেন। হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিষ্টানদের মিলিত রক্ত স্রোতের মধ্যে দিয়ে যে দেশের জন্ম বঙ্গবন্ধু সেই দেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি সংযোজন করলে কেমন করে ইসলাম বিরোধী কাজ হয়, আমার বোধগম্য নয়।

আমি বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের একজন নগণ্য কর্মী হলেও তাঁর সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ হয়েছিলো। তাঁকে অত্যন্ত কাছ থেকে দেখেছি। তাঁর জীবনের বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহ লক্ষ্য করেছি। কর্মকাণ্ড দেখেছি এবং বক্তব্য শুনে আমার এই দৃঢ় প্রতীতি জন্মেছে যে, তিনি ছিলেন একজন খাঁটি মুসলমান এবং মানব প্রেমিক। আল্লাহর প্রতি তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস না থাকলে ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায়, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের সেই ভয়াল রাতে গুলির মুখে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে পারতেন না। পারতেন না পাকিস্তানি কারাগারে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাঙালির প্রাণের দাবি স্বাধীনতা প্রশ্নে অনঢ় থাকতে। তিনি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতেন-হায়াত, মউত, রিজিক ও দৌলত একমাত্র আল্লাহর হাতে। আল্লাহ না মারলে কেউ তাঁকে মারতে পারবে না তাইতো ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কথা না ভেবে রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও প্রটোকল বেষ্টনীর বেড়াজাল ছিন্ন করে মানুষের মাঝে চলে যেতেন। সম্পূর্ণ নিরাপত্তাহীন অবস্থায় নিজ বাসভবনে অবস্থান করতেন। তাঁর ধর্মের প্রতি অনুরাগ ছিল বলেইতো বাংলাদেশের সংবিধান পাস করিয়েছিলেন শবে-কদর রাতে। অনৈসলামিক ভেবেই তো মদ জুয়ার বিরুদ্ধে আইন করে নিষিদ্ধ করেছিলেন। কোরআন হাদিসের উপর গবেষণা করার জন্যেই তো বাংলাদেশ ইসলামী ফাউন্ডেশনের সৃষ্টি করেছিলেন। পাকিস্তান আমলে কওমী মাদ্রাসাগুলো কোনদিন সরকারি সাহায্য পায়নি। ইসলামী শিক্ষা বিস্তারের জন্যেইতো বঙ্গবন্ধু সরকারি বেসরকারি মাদ্রাসা নির্বিশেষে টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন এবং পৃথক মাদ্রাসা বোর্ড সৃষ্টি করে সকল মোদাররেসিন কে সরকারী কর্মচারীর মতো রেশন ভাতা দেওয়ার নীতি চালু করেছিলেন। তাবলীগের জামাতের লোকদের সুবিধার্থে কাকরাইল মসজিদটি সম্প্রসারণের ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। তুরাগ নদীর পাড়ে বিশ্ব এস্তেমার জন্য পাঁচশত একর জমি বন্দোবস্তি দিয়েছিলেন যিনি, তিনিইতো বঙ্গবন্ধু।

সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশ। সৌদি সরকারের স্বীকৃতি নেই। ভাণ্ডারে বৈদেশিক মুদ্রারও দারুণ অভাব। হাজিদের যাতায়াতের জন্যে স্টিমার বা বিমান কিছুই ছিল না। বাঙালি মুসলমানদের হজ্বে যাবার দাবিও ওঠেনি। হজ্বের মৌসুম এলে শুধু ধর্মানুভূতির কারণেই লন্ডন থেকে একটি বিমান ভাড়া করে প্রতি হাজী থেকে ৪৭০০/= টাকা করে নিয়ে পাঁচ হাজার হাজীর হজ্ব প্রতিনিধিদলে নেতা করে আমাকেই সৌদি আরব পাঠিয়েছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে ঘোষনা করলেও বাংলাদেশকে অরগানাইজেশন অব ইসলামিক কান্ট্রিস (ওআইসি)-এর সদস্য করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। রাশিয়াতে কোনদিন তাবলিগ জামাত যেতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টায় ১৯৭৩ সালে রাশিয়াতে প্রথম তাবলীগ জামাত যাবার সুযোগ পায়। বায়তুল মোকাররম মসজিদটি খাস জমির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। সেই জমিটুকু বায়তুল মোকাররম মসজিদের নামে বন্দোবস্ত দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।

১৯৭৩ সালে ইহুদিরা যখন মিশর আক্রমন করে, এই বাংলাদেশ থেকেই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী বঙ্গবন্ধু প্রথম আওয়াজ করেছিলেন, “আরব ভাইরা, আমি জানতে পেরেছি, গত রাতে ইহুদিরা তোমাদের উপর আক্রমন করেছে। আমার নতুন স্বাধীনপ্রাপ্ত দেশ। আমার কিছুই নেই। আমার আছে রক্ত। রক্ত নিয়ে যাও। আহত আরব ভাইদের বাঁচাও। আমার আছে চা, চা পাঠালাম। আর আছে মুক্তিযোদ্ধা, তাদের পাঠালাম। তারা তোমাদের পাশে দাঁড়িয়ে ইহুদির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। আরব ভূমি মুক্ত রাখবে।” আজো তো সেই মুক্তিযোদ্ধা মাঝে মাঝে লাশ হয়ে ফিরে আসে বাংলার মাটিতে।

এছাড়াও দু’একটি ঘটনা উল্লেখ করলে স্পষ্টত অনুধাবন করা যাবে, কি ছিল বঙ্গবন্ধুর মন মানসিকতা, কি ছিল তাঁর ধর্মানুভূতিতে? বাকশাল গঠিত হওয়ার পরেরদিন। ২৬ জানুয়ারি ১৯৭৫ সন্ধ্যা ৭টা। মন্ত্রিরা শপথ নিলেও দফতর বন্টন তখনো বাকি। কি একটা কাজে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্য গণভবনে গিয়েছি। দেখি, বঙ্গবন্ধু, সর্ব জনাব ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, কোরবান আলী, আবদুল মোমিন তালুকদারের সঙ্গে গল্প গুজবে মেতে আছেন। আমি আস্তে আস্তে করে দরজা ঠেলে ঢুকে সোফার একপাশ বসে তাঁদের কথা শুনেছিলাম। এমনি সময় বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব ফরাসউদ্দিন একটি ফাইল হাতে ঘরে ঢুকলেন। তাঁর হাত হতে ফাইলটি নিয়ে বঙ্গবন্ধু সেক্রেটারিয়েট টেবিলের পেছনের চেয়ারে গিয়ে বসলেন এবং ফাইলের উপর চোখ বুলাচ্ছিলেন। হঠাৎ দেখি, তিনি তাঁর পরিহিত মুজিব কোট থেকে একটি তজবিহ জপছেন এবং তজবিহ শেষ করে বিছমিল্লাহির রহমানির রহিম বলে ফাইল দস্তখত করে বললেন, “আল্লাহ এইবার হলেও তাঁদের সঠিক ভাবে কাজ করার তৌফিক দিন।” এই দৃশ্য আমার চোখে নতুন। তাই আনমনে একটি মুচকি হেসে ফেলেছিলাম। তিনি দেখে ঈষৎ রাগতস্বরে বললেন, “হাসলে কেনো? আফটার অল আই এম এ মুসলিম। আরবীতে একটি আয়াত পড়ে বাংলায় তর্জমা করে বললেন, লোক দেখানো ধর্ম পালন করা পূন্যের চেয়ে গুণাহ বেশি। আমি এমন কিছু করি না যা লোক দেখানো।” তখন আমি তো ভয়ে চুপসে গেছি। এক পর্যায়ে ফরাস উদ্দিন বললেন, স্যার আপনি কোরআন তেলাওয়াত করছেন যে আমি দেখেছি। কোথায় দেখেছো? কেমন করে দেখেছো, এই ধরনের প্রশ্ন অবতারণা তিনি করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। তা না করেই পসঙ্গান্তরে চলে গেলেন। বঙ্গবন্ধু প্রায় সময় কোরআন তেলাওয়াত করতেন সেই কথা খোন্দকার মোশতাক সাহেবের (খুনি) মুখে একবার শুনেছিলাম। ১৯৭৮ সালে কক্সবাজারে বার্মিজ রিফিউজি আসলে রেডক্রমের অফিসারদের মুখেও শুনেছি। ঘূর্ণিঝড়ের সংকেত পড়লে তিনি জায়নামাজ বিছিয়ে বসে যেতেন, এবাদত করতেন, কোরআন তেলাওয়াত করতেন আর মাঝে মাঝে পার্শ্বে রক্ষিত টেলিফোন ধরে উপকূলীয় অঞ্চলের খবরাখবর নিতেন। তারই প্রমাণ আমি নিজে পেয়েছিলাম।

১৯৭৫ সালে আমি একদিন ঢাকায়। তার কয়েকদিন আগেই ঘূর্ণিঝড় কক্সবাজারে আঘাত হেনেছে। তিনি আমাকে দেখে ঘূর্ণিঝড়ের খবরাখবর নিলেন এবং হেসে বললেন তোমার ভাবী কি বলেছে জান? ‘এবার তোমার এবাদতে কোন কাজ হলো না।’ এর থেকে বোঝা যায়, ঘূর্ণিঝড়ের রাতে তিনি যে এবাদতে করতেন। আমি তাঁকে জামায়াতে তারাবীর নামাজ আদায় করতেও দেখেছি। চৌদ্দশত বছর আগে রসুলে করিম (সঃ) মক্কা বিজয়ের পর কেরায়েশদের যেভাবে সাধারণ ক্ষমা ঘোষনা করেছিলেন, তারই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে অপেক্ষাকৃত কম অপরাধী স্বাধীনতা বিরোধী আল বদর রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যদের জন্যে তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষনা করেছিলেন। এ ধরনের নজির চৌদ্দশত বছরের মধ্যে মুসলমানদের ইতিহাসে আছে কি? দুঃখজনক হলেও সত্য, যারাই তাঁর সাধারণ ক্ষমার মাধ্যমে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত, তারাই বেশি তাঁর সমালোচনায় মুখর। স্বয়ং আল্লাহই বলেছেন অকৃতজ্ঞ ব্যক্তিকে আল্লাহ ভালোবাসেন না।

যিনি সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা তুলে দিয়ে, মুখবন্ধে বিছমিল্লাহির রহমানির রহিম লিখেছিলেন, তাঁর আমলে কি দেখেছি? মদ জুয়া আবার জায়েজ হয়েছে। জায়গায় জায়গায় আনন্দ মেলার আয়োজন করে হাউজি বাম্পার, প্রিন্সেস জরিনা সুন্দরী, প্রিন্সেস লাকি খানের নাচ দেখিয়েছেন আর যুব সমাজের চরিত্র হনন করেছেন। কওমী মাদ্রাসাগুলোকে সরকারি সাহায্য থেকে করেছিলেন বঞ্চিত।

কেউ কেউ বলতে পারেন, বঙ্গবন্ধু যদি এতই ইসলাম প্রেমিক হন, রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা যোগ করলেন কেনো? তারও জুতসই জওয়াব আছে। ইসলামী অর্থনীতির মূল কথা কি? শ্রমিকের ঘাম শুকাবার আগে পারিশ্রমিক দিতে হবে। সবার খাওয়া পরা, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের সুযোগ সৃষ্টির জন্যেই বায়তুল মাল। অর্থ্যাৎ রাষ্ট্রীয় তহবিল। জাকাত ফেতরা প্রদানের নির্দেশ নামার লক্ষ্যই হচ্ছে সম্পদের সুষম বন্টন। আর সম্পদের সুষম বন্টনের কথাই বলেছে সমাজতন্ত্র। ইসলামী অর্থনীতি ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মূল কথাই হচ্ছে, সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর এবং মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা। দু’টির মধ্যে প্রক্রিয়াগত ভিন্নতা আছে, আদর্শ উদ্দেশ্য এক। ইসলামী অর্থনীতি আবর্তিত হয় আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও আনুগত্য নিয়ে, আর সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি নিয়ন্ত্রিত হয় বস্তু জগতের আইনের শাসনে। লক্ষ্য বিচার বিশ্লেষণে অর্থনৈতিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার সমাজতান্ত্রিক আবেদন রেখেছে এই পৃথিবীতে সর্বপ্রথম ইসলাম। সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা কার্লমার্কস, এঙ্গেলস, লেনিনের জন্মতো অনেক অনেক পরের ঘটনা। বর্তমান জামানায় ক’জনই বা নীতিগতভাবে জাকাত দেয়? আল্লাহকে আমরা সবাই ভয় করি। সত্যিকার অর্থে যেমন ভয় করা উচিৎ, তেমন ভয় করে আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবন নিয়ন্ত্রণ করি কি? নিশ্চয় করে না বলেই মালিক শ্রমিককে ঠকায়। জিনিসে ভেজাল দেয়। মানুষকে অভুক্ত রেখে সম্পদের পাহাড় গড়ে। তাই প্রয়োজন হয় রাষ্ট্রীয় আইনের। এই আইনের মাধ্যমেই বৈষম্য দূরীকরণের প্রক্রিয়া নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাই তিনি ঘোষনা করেছিলেন, “কোন দেশ থেকে আমার সমাজতন্ত্র জন্ম নেবে”।
তিনি শুধু একথাই বুঝাতে চেয়েছিলেন যে, বাংলাদেশের অর্থনীতি শুধু বস্তুজগত নিয়েই আবর্তিত হবে না। আধ্যাত্মিক ভাবধারা দিয়েও নিয়ন্ত্রিত হবে।

বিগত একুশটি বছর ধরে কারা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত? একটু পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, কিছু জমিদার-জোতদার, কিছু ধনিক-বণিক এবং কিছু স্বার্থান্বেষী ধর্ম ব্যবসায়ী। কেনো তারা একুশ বছর পরেও তাকে ক্ষমা করতে পারছেন না? তার কারণ শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধু কিছু আইন রচনা করেছিলেন, যেগুলো তাদের স্বার্থে আঘাত করেছিল। ভূমির সিলিং বসিয়ে একশত বিঘার ঊর্ধ্বের জমি সরকারিকরণ এবং সরকারি খাসজমি ধনিক শ্রেনীকে না দিয়ে ভূমিহীন কৃষকদের মাঝে দেড় একর করে বিনা সালামিতে বিতরণের ব্যবস্থা করেছিলেন। এতে ক্ষুব্ধ হয় জমিদার জোতদার। পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত ব্যাংক বীমা কলকারখানা জাতীয়করণ করে শ্রমিক কর্মচারিদের অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা নিয়ে ধনিক বণিকের বিরাগ ভাজন হয়েছিলেন। ধর্ম ব্যবসায়িরা এতদিন ধর্মকে শোষন নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ধর্মের নামে পাকিস্তান টিকিয়ে রাখার জন্যে আমার মা বোনের ইজ্জত লুটেছে। হত্যা করেছে লাখো বাঙালি। তাই বঙ্গবন্ধু ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। এতে ক্ষীপ্ত হয়, স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি আলবদর-রাজাকার। এই স্বার্থান্বেষী মহলের ভয়-মৃত মুজিব যদি আদর্শের মুজিব হয়ে বাংলার ঘরে ঘরে আবার আসে, তাদের আর রক্ষা নাই। তাই অপপ্রচার চালিয়ে বঙ্গবন্ধুকে খাটো করতে চায়। মানুষের মন থেকে তাঁকে দূরে রাখতে চায়। সেজন্যে ইতিহাস বিকৃতি। সেজন্যেই ধর্মের নামে হাত কাটে, রগ কাটে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির। আজ তারা ব্যর্থ। দীর্ঘদিন পরে হলেও বাংলার মানুষ বুঝেছে। তাই ১২ জুনের নির্বাচনে বাংলার বীর জনতা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে, বঙ্গবন্ধু আদর্শের পক্ষে রায় দিয়েছে। সেই সুবাদে আজ তাঁরই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।

বস্তুত বাংলাদেশটা স্বাধীন হয়েছে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ খ্রিস্টানের, মিলিত রক্ত দানে। ইসলাম নীতির ধর্ম। ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইনসাফের ধর্ম। সেই ইনসাফই কায়েম করতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি ধর্মভীরু মানুষ চেয়েছিলেন, ধর্মান্ধ নয়।

স্মৃতি বড়ো মধুর। স্মৃতি বড়ো বেদনাদায়ক। সেই বেদনাদায়ক স্মৃতির কথাই বলছি। ১৯৭৫ সালের ৮ জুলাই। বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের মাত্র কটা দিন আগে। আমাকে গণভবনে দেখে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “সরওয়ার, এবার আমি হজ্বে যাব”।
তখন অনেক মন্ত্রী, গভর্নর তার পাশে। মন্ত্রী সোহরাব হোসেন বললেন, “এবার আমাকে পাঠান স্যার আমাকে পাঠান”।
প্রত্যুত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “নারে না, তোদের অনেক সময় রয়েছে, আমার সময় ফুরিয়ে আসছে, এবার আমি হজ্বে যাব” সে কথাগুলো আজো আমার মনে বাজে। পঁচাত্তরের ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে সে সুযোগ দান করেনি।


রেফারেন্স: সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে, লুৎফর চৌধুরী সম্পাদিত, পৃষ্ঠা ৫৩।

No comments:

Post a Comment