Thursday, August 15, 2013

মুজিব কে হত্যা করেছে কে? -এ এল খতিব


১৯৭৫-এর আগস্ট মাস বাংলাদেশের জন্য ছিল পরিবর্তনের সময়। এমন সব মৌলিক প্রশাসনিক পরিবর্তন করছেন মুজিব যে সেগুলো প্রচন্ড সামাজিক প্রভাবের সূচনা করবে। দেশে একটি মাত্র রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল)।
সমাজের সব স্তরের মানুষ এমন কী সশস্ত্র বাহিনী এবং পুলিশেরও প্রতিনিধিত্ব ছিল বাকশাল-এ। ১৯৭৫-এর ১ সেপ্টেম্বর জেলা গভনর-মনোনীতরা দায়িত্ব গ্রহণের পর আমলাদের গুরুত্ব হরাস পাবে। সেনাবাহিনী জেলা পর্যায়ে উৎপাদনশীল কাজে অবদান রাখবে। এটি ছিল একটি বৈপ্লবিক পদক্ষেপ।১৯৭৫-এর ১৪ আগস্টের সন্ধ্যাটি মাসের অন্যান্য দিনের সন্ধ্যার চেয়ে ভিন্ন কিছু ছিল না।পরদিন মুজিবকে অভ্যর্থনা জানানো হবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেই আয়োজনের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত।১৯৪৮ সালে আইনের ছাত্রকালীন সময়ে মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার আবেগী দাবিতে জিন্নাহর বিরুদ্ধে কালো পতাকা মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুজিব। পরের বছর মুজিবকে আবারও গ্রেফতার করা হলো। এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের ধর্মঘটে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে। কারাগার থেকে বেরিয়ে মুজিব দেখলেন ইতিমধ্যে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। পরদিন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন চ্যান্সেলর হিসেবে।
ক্যাম্পাসে গ্রেনেড বিস্ফোরণের পর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হলো। অবশ্য ১৯৭১-এর মার্চের ২৫/২৬ রাতে বাঙালির ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের পর থেকে বোমা অথবা গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঢাকাবাসীর জীবনের অংশ হয়ে গেছে, এর জন্য কারো ঘুমের ব্যাঘাত হয় না। কিন্তু গুজব, গুজব ছড়িয়ে পড়ছিল ....।রাত সাড়ে আটটা নাগাদ মুজিব গণভবন থেকে বাসায় ফিরলেন।

রাসেল মুজিবের দশ বছরের পুত্র ভীষণ উত্তেজিত। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুজিব এলে যে ছয়জন তাকে অভ্যর্থনা জানাবে, বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরী স্কুলের প্রিন্সিপাল তাকেও একজন হিসেবে মনোনীত করেছেন।

কাদের সিদ্দিকী, মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের জন্য বাঘা সিদ্দিকী হিসেবে যিনি অধিক পরিচিত, একজন জেলা গভর্নর-মনোনীত। ১৪ আগস্ট সন্ধ্যায় পিজিতে অসুস্থ মাকে দেখতে যাওয়ার সময় কারওয়ান বাজারের কাছে একটি ট্যাংক দেখতে পেলেন। আরেকটি ট্যাংক দেখলেন পিজি হাসপাতালের কাছে, রেডিও স্টেশনের প্রায় উল্টোদিকে। মাকে দেখে কাদের সিদ্দিকী মতিঝিল গেলেন, সেখানেও আরেকটি ট্যাংক, এক কিলোমিটারের মধ্যে তিনটি ট্যাংক। গাড়ি ঘুরিয়ে নিলেন তিনি। ইঞ্জিনিয়ার্সের কাছে আরেকটি ট্যাংক, পিজি হাসপাতাল থেকে খুব বেশি হলে মাত্র দুইশ' মিটার দূরত্বে। রাত তখন ১১টা পেরিয়ে গেছে। কাদের সিদ্দিকী শেরেবাংলা নগরে রক্ষীবাহিনী ক্যাম্পে গেলেন। আনওয়ারুল আলম শহীদ, রক্ষীবাহিনীর উপ-পরিচালক কাদের সিদ্দিকীকে বলল, বেঙ্গল ল্যান্সারকে তিনটি ট্যাংক বের করার অনুমোদন দেয়া আছে। কিন্তু চারটি ট্যাংক কেন? শহীদ বলল, 'আপনি হয়তো একটি ট্যাংক দু'বার দেখেছেন।' হয়তোবা। শহীদ সাবেক ছাত্রনেতা এবং মুক্তিযোদ্ধা তার কথায় সন্দেহ করবার কোন কারণ নেই।ট্যাংকের মহড়া বৃহস্পতিবার রাতের নিয়মিত এক্সারসাইজ। এবং বেঙ্গল ল্যান্সার আর দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি মাসে দুইবার যৌথ মহড়া করে থাকে।বেশ রাত করে বাসায় ফিরলেন কাদের সিদ্দিকী। বোনকে বললেন সকালে তাকে যেন ঘুম থেকে জাগানো না হয়। অনেক দিন ধরেই ভোরে বের হতে হচ্ছে, কাল জেলা গভর্নর-মনোনীতদের প্রশিক্ষণ শেষে মধ্যাহ্নভোজন, সব মন্ত্রী উপস্থিত থাকবেন অনুষ্ঠানে। ধীরে সুস্থে গেলেই চলবে।
ব্রিগেডিয়ার জামিল, রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা প্রধান, অস্থিরভাবে রাত কাটালেন। তার স্ত্রী অসুস্থ এবং কাল সকালে তাকে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হবে। দায়িত্বটা নতুন কিছু নয়, কিন্তু তার কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। তাকে ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের পরিচালক নিয়োগ করা হয়েছে; কিন্তু তাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া হয়নি। জামিলের স্ত্রী তাকে ঘুমোতে বললেন। 'আমি ঘুমোতে পারছি না'-বললেন জামিল।

খন্দকার মোশতাকও নিদ্রাহীন রাত্রি অতিবাহিত করল। পুরনো ঢাকার ৫৪, আগামসিহ লেনে মোশতাকের বাসায় বেশকিছু মানুষের সমাগম দেখা গেল। তাদের মধ্যে একজন তার ভ্রাতৃষ্পুত্র মেজর রশীদ।
তাহের উদ্দিন ঠাকুর যেন উত্তপ্ত পাথরের ওপর বিড়াল একটি। যে কোন ডাকেই লাফিয়ে উঠছে। নামাজ পরে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। গোসল করে একেবারে তৈরি হয়ে রয়েছে যেন অপার্থিব সময়ে তাকে কারও সঙ্গে দেখা করতে হবে। বাড়ির একজন অতিথি ভাবলেন তাহের ঠাকুরের এই চাপা উত্তেজনা কেন।

কামাল, মুজিব-পুত্র, মধ্যরাতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরল, পরদিন মুজিবকে অভ্যর্থনা জানানোর আয়োজনে শেষ মুহূর্তের তদারকি সেরে। একই সময় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টেও একটি ষড়যন্ত্রে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছিল। তখনও অন্ধকার, বেঙ্গল ল্যান্সার যাদের কর্নেল ফারুক হত্যাকারীর দল হিসেবে প্রশিক্ষণ দিয়েছে, তাদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখল। কালো পোশাকের ল্যান্সারদের মনে হচ্ছিল যেন মিল্টনের প্যারাডাইস লষ্ট-এর এক দঙ্গল শয়তান। বিষ আর আগুন উগড়ে দিচ্ছে ফারুক। বলল সে, মুজিব দেশকে বিদেশি শক্তির কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। সেনাবাহিনী বিভক্ত করবে, ল্যান্সার ভেঙে দেবে। তাদের ভীতিকে নিয়ে খেলা করল ফারুক, উস্কে দিল তাদের ইসলামের নামে। আঘাত হানার এই সময়।

তিনটি কলামে ভাগ হয়ে তারা অগ্রসর হলো। দুই কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে তাদের লক্ষ্যস্থল।
ভোরের আগের ক্ষীণ আলোতে শেরে বাংলা এমএনএ হোস্টেলের কাছে তাদের ক্যাম্পের সামনে তড়িঘড়ি করে অবস্থান নিল রক্ষীবাহিনী। বেশিরভাগই লুঙ্গি পরিহিত এবং খালি পায়ে। এলাকাবাসীর কেউ কেউ তখনও ভাবছেন কী হচ্ছে এসব। রক্ষীবাহিনীকে প্রত্যাহার করা হলো। বিমানবন্দরের রানওয়ে ধরে একটি ট্যাংক এগিয়ে গেল দ্রুতগতিতে, দেয়াল ভেঙে রক্ষীবাহিনী ক্যাম্পের দিকে কামান তাক করল।

নগরীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ত্রিশটি ট্যাংক মোতায়েন করা হয়েছে।একই সঙ্গে মুজিব, তার ভগি্নপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত এবং ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণির বাড়ি ঘেরাও করা হলো।মুজিবের বাড়ি লক্ষ্য করে সৈন্যরা চারদিক থেকে গুলি ছুড়তে আরম্ভ করল। দ্বিতীয় তলায় সব শোওয়ার ঘর, জানালার ভেতর দিয়ে হিসহিস করে গুলি ঢুকছে। মুজিবের ছোট ভাই শেখ নাসেরের হাত আঁচড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল।
মুজিবের ড্রেসিং রুমটি মোটামুটি আড়ালে, সবাই গিয়ে সেখানে আশ্রয় নিল। এ যেন ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ যখন পাকিস্তানি সৈন্যরা বাড়ি ঘেরাও করেছিল তার পুনরাবৃত্তি।

কয়েকজন কর্মকর্তাকে ফোন করলেন মুজিব।

বেগম মুজিব শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে নাসেরের হাত বেঁধে দিলেন।

কামাল নিচে নেমে গার্ডদের প্রতিরোধ করার জন্য বলল, কিন্তু ইতিমধ্যেই তাদের নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। কামাল তখনও গার্ডদের প্রতিরোধে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করছে, কয়েকজন সেনা নিয়ে মেজর হুদা ঢুকল ঘরে। গার্ডরা তাকে স্যালুট করল।

হুদার এক সঙ্গী কামালকে গুলি করল।

ইতিমধ্যে ব্রিগেডিয়ার জামিল দ্রুতগতিতে মুজিবের বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন। মুজিবের বাড়ি পৌঁছানোর যখন আর কয়েকশ' মিটার বাকি, সোবহানবাগ মসজিদের কাছে অবস্থান নেয়া কয়েকজন সেনা চিৎকার করল 'থামো'। জামিল নিজের পরিচয় দিলেন। তারা জানত তার পরিচয়, তাকে আটকানোর জন্যই ওদেরকে এখানে দাঁড় করানো হয়েছে। 'এর আগে যে যাবে তাকে গুলি করার নির্দেশ রয়েছে আমাদের ওপর,' হুমকি দিল ওরা। জামিল তাদের কথা শুনলেন না, তাকে গুলি করল ওরা।

ততক্ষণে সৈন্যরা দলে দলে ঢুকে পড়েছে মুজিবের বাড়ির ভেতরে। একটা কক্ষ পেল তারা চারদিক থেকে বন্ধ রেহেনার বেডরুম। দরজা ভেঙে ঢুকলো সেনারা, এক কাপবোর্ড ভর্তি জিনিস ভেঙে চুরমার হয়ে মেঝেতে পড়ল।

'আমাকে দেখতে দাও, ওরা কী চায়, মুজিব বেরিয়ে এলেন কামরা থেকে, যেমনটি বেরিয়ে এসেছিলেন ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। পাকিস্তানি সৈন্যও মোকাবিলা করেছিলেন, কিন্তু এরা তো তারই লোক।

মুজিবের পরনে চেক লুঙ্গি এবং সাদা 'কুর্তি'।

সিঁড়িতে হুদার দেখা পেলেন। 'ও, তুমি, কী চাও তুমি?' মুজিব জিজ্ঞাসা করলেন। 'আমরা আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি' জবাব দিল হুদা। 'তুমি কি মনে কর এটা তামাশা?' গর্জে উঠলেন মুজিব। 'আমি দেশ ধ্বংস হতে দেব না।' হুদা অবিচলিত। একটি চাকর চিৎকার করে উঠল : 'কামাল ভাইকে মেরে ফেলেছে।' হাবিলদার মোসলেমউদ্দিন নিচ থেকে যে উঠে আসছিল, অটোমেটিক অস্ত্র দিয়ে পেছন থেকে গুলি করে মুজিবের শরীরটাকে ঝাঁজরা করে দিল।

যা কিছু পাচ্ছিল সৈন্যরা তুলে নিচ্ছিল। 'যা চাও সবকিছু নাও, আমাদের মেরো না।' বেগম মুজিব অনুনয় করলেন। কিন্তু গুলির শব্দে বেরিয়ে এলেন। 'ওকে মেরে ফেলেছ আমাকেও মেরে ফেল।' বিলাপ করে উঠলেন বেগম মুজিব। চিরতরে তাকে নীরব করে দেয়া হলো।

জামাল, তার স্ত্রী রোজি এবং সুলতানা কামালের স্ত্রী তখনও ড্রেসিং রুমে ছিল। স্টেনগানের এক ঝাঁক গুলি এবং তিনজনই মৃত।

সেনারা নাসেরকে বাথরুমে পেল এবং তাকে হত্যা করল। ভীতসন্ত্রস্ত রাসেল এক কোণায় গুটিসুটি হয়ে বসে ছিল। 'আমাকে মার কাছে নিয়ে যাও,' ফুঁপিয়ে উঠল রাসেল। উন্মত্ত এক নরঘাতক বলল, 'আমরা তোমাকে তোমার মার কাছেই নিয়ে যাব।' এক পুলিশ কর্মকর্তা রাসেলের জীবনের জন্য অনুনয় করল, 'ও একটা শিশু মাত্র।' পুলিশ কর্মকর্তাকে গুলি করে হত্যা করা হলো। গুলিতে রাসেলের এক হাত বিচ্ছিন্ন করল এক ঘাতক, তারপরও তার অনুনয়, 'আমাকে মেরো না, আমাকে মেরো না।' জবাবে পেল বুলেটে।

মায়ের পাশে পড়ে রইল রাসেল, মৃত।

মুজিবের বাড়িতে দেরি করে এলো ফারুক এবং রশীদ। উপরে উঠে গেল ফারুক, নিজেকে নিশ্চিত করল সবাইকেই হত্যা করা হয়েছে। একজনকে টেলিফোন করল সে।

শেখ মণি সাহায্যের জন্য ফোন করল, কিন্তু কোন সাহায্য এলো না। ঘরের দরজা ভেঙে এরই মধ্যে ঢুকে পড়েছে সৈন্যরা, ড্রয়িং রুমে এলো শেখ মণি। ওরা শেখ মণিকে গুলি করতে উদ্যত, তার স্ত্রী আরজু তীরবেগে আরেক প্রান্ত থেকে তার কাছে ছুটে এলো। 'এক পাশে সরে যাও,' ঘেউ করে উঠল এক সেনা সদস্য, তারপরই গুলি করল।

স্বামী এবং স্ত্রী একসঙ্গে রক্তের ধারার ওপর গড়িয়ে পড়ল।

মণি মারা গেল সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু আরজু তখনও বেঁচে ছিল। 'পানি দাও,' অতি কষ্টে শ্বাস টেনে বলল। 'মা তুমি আর বাবা কেন মেঝেতে শুয়ে আছ?' জিজ্ঞাসা করল তার তিন বছরের ছেলে তাপস। কোন জবাব নেই। 'কেন কথা বলছ না?' হতবুদ্ধি শিশু জিজ্ঞাসা করল। আরজুর মাতৃত্ব জেগে উঠল, 'আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাও, আমাকে বাঁচাও। আমার ছোট দুটি বাচ্চা রয়েছে।' অনুনয় করল। ক্ষীণ, শেষ কান্না।

তৃতীয়বারের মতো সন্তান সম্ভবা ছিলেন আরজু।

সেরনিয়াবাত যখন দেখলেন সৈন্যরা বাড়ি ঘেরাও করে ফেলেছে, মুজিবকে ফোন করলেন। মুজিব বললেন টেলিফোন করবেন তিনি, সেরনিয়াবাত তার জামাতা শেখ মণিকেও ফোন করলেন। ফোন বাজতেই থাকল, কিন্তু কোন জবাব নেই।

নিচে ড্রয়িং রুমে নেমে এলেন সেরনিয়াবাত। তার স্ত্রী, ছেলেমেয়েরা, আত্মীয় শহীদ, অতিথি এবং বাড়ির কাজের লোকরা সবাই, তাকে ঘিরে রয়েছে। শুধু একজন তার পুত্র হাসনাত ছাড়া। হাসনাত, মুক্তিযোদ্ধা, সামনের দরজা ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে, বেপরোয়া সে হুমকি দিয়েছে সামনে কেউ এগোলেই গুলি করবে। কিন্তু পরিস্থিতি খুবই হতাশাব্যঞ্জক। পেছনের জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়তে চেয়েছিল। সবখানেই সৈন্য। ফাঁদে আটকে গেছে হাসনাত। এক কক্ষে অপেক্ষা করতে লাগল হাতে রিভলভার নিয়ে মরার আগে অন্তত একজনকে মেরে মরবে।

মেজর শাহরিয়ার এবং হুদার (সেনাবাহিনীতে ছিল না) নেতৃত্বে একদল সেনা সবেগে বাড়িতে ঢুকল। 'তোমাদের কমান্ডিং অফিসারের সঙ্গে আমাকে কথা বলতে দাও,' বললেন সেরনিয়াবাত। শাহরিয়ার বলল, 'আমাদের কোন কমান্ডিং অফিসার নেই। কিন্তু আপনি কে?' যখন সেরনিয়াবাত নিজের পরিচয় দিলেন, শাহরিয়ারের ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। পর মুহূর্তেই বুলেটের আঘাতে মেঝেতে পড়ে গেলেন সেরনিয়াবাত। হামিদা ওর বাবার ওপর পড়ে গেল বাবাকে রক্ষা করার জন্য। তার পেছনে আর পায়েও গুলি লাগল। বাবু হাসনাতের শিশুপুত্র, ভয়ে কেঁদে উঠল। শহীদ ওকে তুলে নিল, দুজনকেই গুলি করল ওরা। উন্মত্তের মতো গুলি ছুটছে চারদিকে। আরও যাদেরকে হত্যা করা হলো, তারা হচ্ছে সেরনিয়াবাতের চৌদ্দ বছরের মেয়ে বেবী, নয় বছরের ছেলে আরিফ এবং তিনজন অতিথি।

সেরনিয়াবাতের স্ত্রী আমিনা, কন্যা হামিদা এবং পুত্র খোকন আহত হলো।

নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, হুদার এক ভাই সেরনিয়াবাতের বাড়ির ভেতর খুঁজে এসে জিজ্ঞাসা করল, 'হাসনাত কোথায়?'

হত্যাকারীরা সেরনিয়াবাতের আত্মীয় শহীদকে হাসনাত বলে ভুল করেছে।

হাসনাতকে খোঁজা শুরু হলো।

রমনা থানার ওসি বেগম সেরনিয়াবাত, হামিদা এবং খোকনকে হাসপাতালে পাঠালেন।

গুলির আওয়াজে, ধানমন্ডিতে বসবাসকারী এক ভারতীয় কূটনীতিক ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালেন। মাত্র কয়েক হাত দূরে আরেকটি ব্যালকনিতে মুক্তিযোদ্ধা এক ব্যবসায়ী টান টান উত্তেজনায় কিছু একটা প্রত্যাশা করছিলেন।

একটা রকেট ছোড়ার শব্দ পাওয়া গেল। 'অপারেশন লিক্যুইডেশন' সম্পন্ন হয়েছে এটা তারই সংকেত।

ব্যবসায়ী-মুক্তিযোদ্ধা মাথা নাড়লেন, যেন কোন অভিনন্দন গ্রহণ করছেন। মুখে হাসি নিয়ে বলল, 'সব শেষ, রেডিও শুনুন।'

সকাল ৬.০১ মিনিট।

ঢাকা রেডিও ঘোষণা করছে সেনাবাহিনী মুজিব সরকারকে উৎখাত করেছে। ঘোষক, যে নিজেকে মেজর ডালিম হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে, বলছে : খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানকে আটক করা হয়েছে এবং তার সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে।'

এর পরপরই আবার এক ঘোষণায় বলা হলো : 'আজ সকালে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের সময় উচ্ছেদ করা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান তার বাসভবনে নিহত হয়েছেন।'

মোহাম্মদপুরের একটি বস্তি এলাকায় আটজন নিহত হন। প্রচ- শব্দে আশপাশের সবাই জেগে উঠল। আলী আকসাদ ভাবলেন এটি আরেকটি অন্তর্ঘাতমূলক ঘটনা, মুজিবের বাড়িতে ফোন করলেন। টেলিফোন বাজছে, কিন্তু কোন জবাব নেই। শেখ মণির বাড়িতে ফোন করলেন। আবার টেলিফোন বাজছে, কিন্তু আবারও কোন জবাব নেই। টেলিফোনের আওয়াজটাই যেন অশুভ। ফোন করলেন মুজিব সরকারের মন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ এবং আরও দু'একজনকে। ফিরতি ফোন করে তারাও জানালেন মুজিবের বাড়ি থেকে কোন জবাব পাওয়া যাচ্ছে না।

আকসাদ রেডিওটা ছাড়লেন। রেডিও তখন ঘোষণা করছে যে মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। ভয় গ্রাস করল আকসাদকে। আরেকটি ইন্দোনেশিয়া?

টেলিফোনে এক বন্ধু আকসাদকে জিজ্ঞাসা করলেন, 'খবরটা শুনেছ?' 'শুনেছি', আকসাদের জবাব। 'এক্ষুনি বাড়ি ছাড়ো' বলেই বন্ধুটি টেলিফোন বিচ্ছিন্ন করে দিলেন।

আকসাদকে আর বলার দরকার হলো না। দুই সন্তান এবং স্ত্রীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। বাচ্চাদের বললেন, ওদের বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

অন্ধ ভয়ে দ্বিতীয়বারের মতো দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেন।

কাদের সিদ্দিকীর বোন চিৎকার করে উঠল, 'এই ওঠো। তোমাকে কে ফোন করেছে।' ফোনে তার আর এক বোন। 'অভ্যুত্থান হয়ে গেছে,' বলল সে। 'অভ্যুত্থান?' জিজ্জাসা করল কাদের সিদ্দিকী কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই। 'এই মুহূর্তে বাড়ি ছাড়। যে কোন মুহূর্তে ওরা তোমার খোঁজে আসতে পারে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে।' টেলিফোনের ভেতর দিয়ে রেডিওর ঘোষণা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।

একটা হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে বাড়ি ছাড়ল কাদের সিদ্দিকী। কিন্তু ড্রাইভার তাকে নিয়ে যাবে না। যে মানুষটি তিন বছর ধরে বিশ্বস্ততার সঙ্গে কাজ করছে, সংকটের সময় গাড়ি চালাতে অস্বীকার করছে। একটু চিন্তা করল কাদের সিদ্দিকী। ড্রাইভারকে বলল, 'চাবিটা আমাকে দাও।' কোন জবাব দিল না গাড়ির চালক; সে পাশের বাড়ির গাড়িটি নিয়ে এসে প্রায় কর্তৃত্বের সুরে বলল, 'উঠুন।'

গাজী গোলাম মোস্তফা, রেডক্রসের প্রধান, দেয়াল টপকে পাশের বাড়ির গরুর খোঁয়াড়ে লুকালো। প্রায় ভেঙে পড়েছে মানুষটি। তার প্রতিবেশীরা প্রাণে ধরে তাকে ধরিয়ে দিতে পারবে না, কিন্তু তাকে আশ্রয় দেয়াও বিপজ্জনক।

আমেরিকান রাষ্ট্রদূত ইউজিন বোস্টার-এর সহকারীরা পাগলের মতো চেষ্টা করছে মুজিব হত্যার খবর তাকে দিতে। কিন্তু তিনি বাসায় নেই, এমনকি তার নিয়মিত আস্তানাগুলোতেও তিনি নেই। ভোর ছয়টায় কোন জাহান্নামে থাকতে পারে সে?

রশীদ সঙ্গে সঙ্গে তার চাচা মোশতাককে জানাল মিশন সম্পন্ন হয়েছে। তারপরও রশীদ যখন কয়েকজন সৈন্য নিয়ে তাকে রেডিও স্টেশনে নিয়ে আসতে গেল, মোশতাক একাধিকবার ভ্রাতৃষ্পুত্রকে জিজ্ঞাসা করল, 'তুমি নিশ্চিত যে সে মারা গেছে?'

পদ্মা নদীর এক মাঝির তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল : 'কোন বাপের ব্যাটা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারবে না।'

মোশতাকের মন্ত্রিসভার এক কর্মকর্তা তার স্ত্রীকে বলেছিলেন, 'মোশতাকের চোখগুলো দেখেছ? সাপের মতো চোখ। এই লোক যা চায় তা পাওয়ার জন্য যে কাউকে হত্যা করতে পারে। তাকে দেখলেই আমার অশ্বস্তি লাগে।'

তার স্ত্রী তার ভয় দেখে হেসেছিলেন, কিন্তু মোশতাক তখন রাষ্ট্রপতি। কী হবে এখন?

বিষদাঁত বের করেছে সাপ।

মাহবুবুল আলম চাষী ১৩ আগস্ট কুমিল্লা থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। কুমিল্লা একাডেমিতে তার সহকর্মীরা ভেবে অস্থির কাউকে কিছু না বলে কোথায় যেতে পারে সে। তবে ১৫ আগস্ট সকালে মোশতাক এবং তাহের ঠাকুরের সঙ্গে ঢাকা রেডিও স্টেশনে আবার উদয় হলো সে।

১৯৭১ সালে তিনজনের যে অশুভ চক্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধকে ব্যর্থ করে দিতে চেয়েছিল এবার তারা বিজয়ী হলো।

নয়াদিলি্লতে, যখন মিসেস গান্ধী স্বাধীনতা দিবসের সমাবেশে ভাষণ দেয়ার জন্য লালকেল্লার উদ্দেশে যাত্রা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন শুনলেন মুজিব হত্যার কথা। হতভম্ব হয়ে পড়লেন তিনি।

মুজিবকে সতর্ক করেছিলেন তিনি যে, তার জীবনের হুমকি রয়েছে, কিন্তু হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন এই বলে : 'ওরা আমার সন্তানের মতো।'

নিচের ঘোষণাটি নিয়মিত বিরতিতে বারবার ঢাকা রেডিও স্টেশন থেকে ঘোষিত হতে থাকল : দুর্নীতি, অন্যায় এবং স্বৈরতন্ত্র খতম হওয়ার পর এখন জনগণের সুযোগ হবে দেশের জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করার। চলুন আমরা সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করি।'

'জাহান্নামে যাক!' নিজের রেডিওর ওপর ঘুষি মেরে চিৎকার করে উঠল আশরাফ, মুক্তিযোদ্ধা। 'সুযোগ! সুযোগ! শেষ পর্যন্ত মোশতাকের ষড়যন্ত্রই সফল হলো। দালালগুলো সব বেরিয়ে আসবে। আবার তাদের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ করতে হবে।'

কাঁদছিল আশরাফের স্ত্রী।

মুজিবের জন্য অনেক স্ত্রীলোকই প্রকাশ্যে কেঁদেছে।

এক সাংবাদিক আনন্দের সঙ্গে প্রতিবেশীকে বলল : 'মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।' হঠাৎ তার মনে হলো আনন্দটা আগেই করে ফেলছে কী না, উদ্বিগ্ন হলো সে। 'যদি আসলেই তার মৃত্যু না হয়ে থাকে তাহলে কী হবে?' বলল সে। রেডিও ছাড়ল সে আবার নিশ্চিত হতে চায় যে মুজিব নিহত হয়েছেন। রেডিও তাকে নিশ্চিত করল। ভয় পাওয়ার মতো এই মুহূর্তে কিছু নেই।

সাংবাদিকটি মুসলিম লীগার। কিন্তু মুজিবের অনেক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও তার জন্য শোক করেছে।

সাভারে, ঢাকা থেকে প্রায় পনের কিলোমিটার দূরে, রক্ষীবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে কেউ কেউ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেয়েছিল। অনেকেই [হত্যাকারী] মেজরদের বিরুদ্ধে দ্বিধা করেছে। 'আমাদের কোন ট্যাংক-বিধ্বংসী কামান নেই,' দ্বিতীয় গ্রুপটি বলেছে। রক্ষীবাহিনীর মহাপরিচালক নুরুজ্জামান দেশের বাইরে লন্ডনে। সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো কেউ ছিল না। মুজিবের রাজনৈতিক সহকারী তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করল রক্ষীবাহিনী। কিন্তু তাদের প্রতিরোধ করার জন্য নির্দেশ কিভাবে দেবে প্রচ- মর্মাহত তোফায়েল আহমেদ।

ঢাকায় অবস্থানরত এক ভারতীয় সাংবাদিককে তার স্ত্রী ঘুম থেকে তুললেন। 'ওঠো। কিছু একটা হয়েছে। কারফিউ জারি করা হয়েছে। রেডিও শোন।' মুজিবকে যে হত্যা করা হয়েছে সেটা স্বামীকে আর বললেন না তিনি।

রেডিও বারবার ঘোষণা করছে, মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে এবং খন্দকার মোশতাক নতুন রাষ্ট্রপতি।

সাংবাদিক একটি রিপোর্ট টাইপ করলেন, সচকিতভাবে তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় টেলিগ্রাফ অফিসে গেলেন। স্টেডিয়ামের সামনে একটি ট্যাংক রয়েছে, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ কভার করার জন্য।

এখানে সেখানে মানুষের ছোট ছোট জটলা।

টেলিগ্রাফ অফিসে তাকে বলা হলো, 'টেলিগ্রামটি রেখে যেতে পারেন, কিন্তু ওটা পাঠানো হবে না। আমাদের ওপর নির্দেশ রয়েছে কোন টেলিগ্রাম পাঠানো যাবে না।' এরই মধ্যে টেলিগ্রাফ অফিসে এক সেনা কর্মকর্তা চলে এসেছে।

গভীর ঘুমে ছিল এক রেডিও কর্মকর্তা। তাকে জাগালো একটা টেলিফোন কল, কিন্তু আলসেমি করে ফোনটি ধরল না। তার স্ত্রী বললেন, 'তোমাকে জরুরিভাবে রেডিও স্টেশন থেকে ডেকে পাঠিয়েছে।' 'এই মুহূর্তে চলে এসো,' কর্তৃত্বের সুরে আদেশ হলো। সে ভাবল কী হয়েছে। এখন প্রথম সম্প্রচারের সময় হয়নি, কিন্তু অভ্যাসবশত রেডিওটি অন করলেন। ওহ, আল্লাহ! ভয়াবহ, ভয়ানক।

রেডিও স্টেশনে পৌঁছে দেখল মেজর শাহরিয়ার চার্জে রয়েছে। সামনের টেবিলে একটি স্টেনগান। এক কর্মকর্তা বিনীতভাবে বললেন, 'সবাই কাজ করছে।' 'সবাই কাজ করবে, যতক্ষণ এখানে অস্ত্রটি রয়েছে' শাহরিয়ারের ঔদ্ধত্য মন্তব্য। অস্ত্রটির ওপর হাত বুলিয়ে নিল কথায় জোর দেয়ার জন্য।

একই ঔদ্ধত্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মতো, যখন সামরিক শাসন জারি করা হয়েছিল দেশটিতে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর।

একজন কর্নেল যখন অফিসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, তখন ফোন পেল এক সহকর্মীর। 'তুমি কি রেডিওর খবর শুনেছ।' শোনেনি, জানাল সে। তাহলে শোন।'

একটি আমেরিকান বার্তা সংস্থা ঘটনার কয়েক মিনিটের মধ্যেই মুজিব হত্যা এবং অভ্যুত্থানের খবর প্রচার করেছে। রিপোর্টে উল্লেখ করা হলো 'বাংলাদেশ ইসলামিক রিপাবলিক' হয়ে গেছে। একেবারে সম্পূর্ণ বিপরীত?

অজ্ঞাতনামা কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে রেডিও পাকিস্তানও জানাল বাংলাদেশ এখন একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র।

এসব খবরের কোন তাৎক্ষণিক স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতি কোনটাই ছিল না। তবে মোশতাক যখন ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতায় এসেছে তখন এটা বাহুল্য মাত্র। বাংলাদেশ বেতার এরই মধ্যে রেডিও বাংলাদেশ হয়ে গেছে।

পশ্চিম ইউরোপীয় একটি দেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত চিন্তা করছিলেন, এই অভ্যুত্থানে ভুট্টো কী ভূমিকা পালন করেছেন। ভুট্টো যখন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, তখন তাকে তেহরানে পাঠিয়েছিলেন ইরানের রাজধানীতে ভুট্টোর 'লোকটির' কাছ থেকে একটি প্যাকেট নিয়ে আসতে। তখন তরুণ কূটনীতিক সে, সেই প্যাকেটটি তার রুম থেকে গায়েব হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তার কাছে মনে হয়েছিল সেটা অর্থহীন একটা কাজ।

হাসিনা এবং রেহেনা, ১১ আগস্ট থেকে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত মুজিবের দুই কন্যা, ছিল ব্রাসেলসে। রেহেনা চেয়েছিল সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফিরে আসতে। ১২ আগস্ট বোনকে বলল, 'আমি ভীতিকর সব স্বপ্ন দেখছি। আমি দেখছি মানুষজন আবার পালাচ্ছে। আমি ভয় পাচ্ছি। দেশে ফিরে যেতে চাই।'

যাহোক, ১৪ আগস্ট সন্ধ্যায় হাসিনা-রেহেনা দু'জনই বেশ উৎফুল্ল ছিল।

একটা দাওয়াত থেকে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। সকালে তারা ফ্রান্সের উদ্দেশে যাত্রা করবে, তারপরও রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের কন্যার সঙ্গে আড্ডা মারছে। কুসংস্কারের ভীতি হাসিনাকে যেন পেয়ে বসল। 'আমরা এত হাসছি। ভাবছি পরে না কাঁদতে হয়।' বলল হাসিনা।

সকালে বন থেকে হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদের কাছে টেলিফোন এলো। তিনি তার স্ত্রীকে বললেন ফোন ধরতে। না, শুধু ড. ওয়াজেদের সঙ্গেই কথা বলবেন টেলিফোনকারী। ভয়ানক কিছু এটা হয়েছে, ভাবলেন ড. ওয়াজেদ।

'এই মুহূর্তে বন-এ ফিরে আসুন,' টেলিফোনকারী বললেন।

যখন হাসিনাকে বলা হলো, বাংলাদেশে অভ্যুত্থান হয়েছে, তার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, 'কেউ বেঁচে নেই।'

সশস্ত্র বাহিনীর সিনিয়র অফিসাররা জেনারেল হেডকোয়ার্টার্সে (জিএইচকিউ) তর্ক করছে, মেজর যারা শুধু অভ্যুত্থানই ঘটায়নি, ঔদ্ধত্যভাবে ঘোষণাও করেছে যে সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। তারা অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক দিকটি হয়তো উপেক্ষা করতে পারে কিন্তু শৃঙ্খলার প্রশ্ন তো রয়েছে। কয়েকজন মেজরকে আগেই অসম্মানজনকভাবে সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, কিন্তু অন্যরা তো সার্ভিসে রয়েছে। তাদের যদি ছাড় দেয়া হয় তবে সশস্ত্র বাহিনীতে চেইন অফ কমান্ড বলে কিছু থাকবে না। তখন সিনিয়র অফিসারদের অবস্থান কোথায় হবে?

দুই-একজন অফিসার মেজরদের বিরুদ্ধে তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলল। কিন্তু অন্যরা দ্বিধাগ্রস্ত, পরিস্থিতি পরিষ্কার বোঝা পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করার পক্ষপাতি। যতক্ষণ পর্যন্ত চাকরি নিশ্চিত, ততক্ষণ ঝুঁকি নেয়া কেন?

আর্মি চিফ অফ স্টাফ মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ, কিন্তু তিনি একজন উদ্যমহীন মানুষ এবং তার কর্তৃত্ব সব সময়ই চ্যালেঞ্জ হয়েছে তারই ডেপুটি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান দ্বারা।

[কিলার] মেজরদের বিষয়ে কোন অবস্থান নেয়া হবে এটা নিয়ে স্টাফ অফিসাররা তর্ক করেই চলেছে, ডালিম জিপ চালিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ঢুকল, সিনিয়রদের বলল দ্রুত মনস্থির করতে। ষড়যন্ত্রকারীরাই কমান্ডে চলে এলো।

তখন সকাল ১০টা বেজে গেছে। চার ঘণ্টা নষ্ট হয়ে গেছে। সিনিয়র স্টাফ অফিসাররা যদি কোন ব্যবস্থা আদৌ নিতে চাইত তাহলে আরও অনেক আগেই তারা কাজে নেমে পড়ত।

সব বাহিনীর প্রধানরা নতুন সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করল।

দ্বিতীয় আর্টিলারি রেজিমেন্টের একজন অফিসার সকালেই কর্নেল তাহেরকে ফোন করে বলল যে মেজর রশীদ তাকে বাংলাদেশ বেতারে উপস্থিত থাকতে বলেছে। আর্টিলারি অফিসার তাহেরকে এও জানায় যে, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।

শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে এবং খন্দকার মোশতাক ক্ষমতা দখল করেছে, খবরটি তাহেরকে আঘাত করল। 'আমি ভাবলাম,' বলল তাহের, 'এই ঘটনা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্ম দেবে, এই এই পরিস্থিতে আমরা আমাদের স্বাধীনতাও হারাতে পারি।'

তাহের আরও বলছে : গভীর উদ্বেগ নিয়ে সকাল সাড়ে ১১টায় আমি বাংলাদেশ বেতার ত্যাগ করলাম। ধারণা করলাম জাতির জনকের হত্যাকা-ের পেছনে বহিঃশক্তি জড়িত ছিল।' সেইদিন যা ছিল তাহেরের ধারণা, তাই বিশ্বাসে পরিণত হবে দু'দিনে।

রেডিও স্টেশন থেকে মোশতাক আর তাহের ঠাকুর বায়তুল মোকাররম মসজিদে গেল। ওদের গাড়ির সামনে একটি ট্যাংক এবং পেছনে দুটি সামরিক যান। মোশতাকের চোখ বন্ধ, যেন গভীর ধ্যানে মগ্ন, তাহের ঠাকুর ঠোঁটে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

মোশতাকের গাড়ি জাতীয় প্রেসক্লাব পেরোবার সময় কয়েকজন সাংবাদিক দৌড়ে বেরিয়ে এলো তার দিকে হাত নাড়ল। এক কবি [এই সাংবাদিকদের উদ্দেশে] ক্ষোভে ফেটে পড়লেন, 'আপনাদের কি আত্মসম্মানবোধও নেই। গতকালও আপনারা শেখ মুজিবকে জিন্দাবাদ দিচ্ছিলেন।'

কেউ জবাব দিল না। এক সাংবাদিক, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের দালাল হিসেবে কাজ করেছে, সাফল্যের জন্য মোশতাককে অভিনন্দন জানাল। ' ভয়ে ভয়ে রেডিও ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানি অভ্যুত্থান সফল হয়েছে। না হলে ওরা আমাকে ধরবার জন্য আসত।' বলল দালাল সাংবাদিকটি।

কয়েকজন ছিল যারা আনন্দিত হয়েছে, কিন্তু হাজার হাজার ভেবেছে ব্যক্তিগত ক্ষতি হয়ে গেল।

ক্ষমতা দখলের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মোশতাক মোহাম্মদ উল্লাহকে উপ-রাষ্ট্রপতি বানাল। মুজিবের সর্বশেষ মন্ত্রিসভায় দু'জন সাবেক রাষ্ট্রপতি ছিলেন আবু সাঈদ চৌধুরী এবং মোহাম্মদ উল্লাহ। মোশতাক দু'জনকেই অন্তর্ভুক্ত করেছে। আবু সাঈদ চৌধুরী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে কামাল হোসেনের স্থলাভিষিক্ত হলো।

নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান এবং মোশতাক ১৯৭১ সালে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠন করেছিলেন। মোশতাক তার সহকর্মীদের অজ্ঞাতে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে আপস করবার চেষ্টা করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় মোশতাক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল সহকর্মীদের কাছ থেকে। এখন সফল হলো ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে।

তাজউদ্দীন মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন ১৯৭৪-এর অক্টোবরে। দল অথবা সরকার কোথাও তার কোন অবস্থান ছিল না। যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি অত্যন্ত তেজস্বী ছিলেন, কিন্তু এখন তিনি এক বিধ্বস্ত মানব।

সৈন্যরা যখন তাজউদ্দীনের বাসায় গেল, তিনি বললেন,'তোমরা আমার নেতাকে হত্যা করেছ, আমাকেও হত্যা কর।' তার ভয়ই সত্য হলো, তার চরম শত্রু এখন ক্ষমতায়। অন্য কোন পরিস্থিতি হলে হয়তো প্রতিরোধ যুদ্ধ করতে পারতেন, কিন্তু এখন তিনি কীইবা করতে পারেন?

মুজিবের মৃত্যুর পর সংবিধান অনুযায়ী সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি। কিন্তু তিনি সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়ার মানুষ ছিলেন না। এক বন্ধু সৈয়দ নজরুল ইসলামকে কিছু একটা করবার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন, কিন্তু সামনের চিন্তা করার প্রশ্ন্ তে;িনি ছিলেন অতিরিক্ত নার্ভাস।

এএইচএম কামরুজ্জামান চমৎকার একজন আরামপ্রিয় মানুষ। একজন প্রতিরোধ নেতা হিসেবে তাকে কল্পনা করা কঠিন।

এম মনসুর আলী, মুজিব সরকারের প্রধানমন্ত্রী, মনে করেননি কেউ তার নির্দেশ মেনে চলবে, কিন্তু আত্মসমর্পণ করবেন না। লুকিয়ে থাকলেন, কিন্তু দুইদিন পর সৈন্যরা তাকে খুঁজে বের করল কলাবাগান থেকে, তার বাড়ির খুব দূরে নয়।

ড. কামাল অভ্যুত্থান সম্পর্কে জানতে পারলেন যখন তিনি বেলগ্রেড ঢাকার পথে রওনা হয়েছেন। হামিদা, তার স্ত্রী সম্প্রতি ঢাকায় ফিরেছেন, কিন্তু তার ফিরে যাওয়াটা বিপজ্জনক হবে।

বন-এ নেমে গেলেন তিনি।

না, কোন বিবেচনাতেই তিনি মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দেবেন না। 'আমাদের সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে হবে, অথবা সম্মানের সঙ্গে মরতে হবে।' কয়েকজন বন্ধুকে বললেন তিনি।

বিলাতেই ফিরে যাচ্ছেন তিনি।

মুজিবের মন্ত্রিসভার কয়েকজন ইতোমধ্যেই মোশতাকের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে অথবা হাত মেলানোর জন্য অধীর হয়ে পড়েছে। অবশ্য অন্যদেরকে সেনাদেরই নিয়ে যেতে হয়েছে বঙ্গভবনে শপথ অনুষ্ঠানে।

ফণী মজুমদার, হৃদরোগে আক্রান্ত, পিজি হাসপাতালে, সৈন্যরা যখন এলো তাকে বঙ্গভবনে নিয়ে যেতে তার সঙ্গের রোগী, কবি জসীমউদদীন তাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলেন শক্ত করে, যেতে দেবেন না। 'একজন ভালো মানুষ, তাকে নিয়ে যেও না।' অনুনয় করেছিলেন কবি।

অপরাহ্নে ১৬ সদস্যের মন্ত্রিসভা, যার মধ্যে ১০ জন কেবিনেট মন্ত্রী এবং ছয় জন প্রতিমন্ত্রী। তাদেরকে শপথ পাঠ করালেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি জাস্টিস এ.ই. মোহাম্মদ হোসেন।

কেবিনেট মন্ত্রীদের মধ্যে দু'জন ছিল ফণী মজুমদার এবং মনোরঞ্জন ধর, তাদের প্রয়োজন ছিল মোশতাকের। সে যারপরনাই চেষ্টা করছিল এমন একটা ধারণা দিতে যে মুজিবের জায়গায় তার রাষ্ট্রপতি হওয়া ছাড়া আর কিছুই বদলায়নি।

তাহের উদ্দিন ঠাকুর এত ফিটফাট ছিল যে, কোন কোন মহিলা তাকে 'দুলা মিয়া' বলেই ডাকতে লাগল। সে এখন 'বরের সঙ্গী' মোশতাকের মিতবর।

মাত্র একজন প্রতিমন্ত্রী, কিন্তু সন্দেহের কোন অবকাশই নেই যে সে নতুন সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।

বাংলাদেশের রক্তাক্ত ঘটনাবলিতে ভারতের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে উদ্বিগ্ন নতুন সরকার ভারতের কাছে আলোচনার প্রস্তাব পাঠাল। প্রথম সংবাদ সম্মেলনেই তাহের ঠাকুর জোর দিয়েই বলল, ইতিমধ্যেই তারা ভারতের সঙ্গে কথা বলছে, কিন্তু সে পাকিস্তানের কথা উল্লেখ করেনি। আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের নামটিও যেন তার মন থেকে মুছে গেল। 'আমেরিকান রাষ্ট্রদূত কি যেন তার নাম?' জিজ্ঞাসা করল। 'বোস্টার' একজন সাংবাদিক বলল। 'বোস্টার' পুনরাবৃত্তি করল তাহের ঠাকুর। 'বোস্টার, ইউজিন বোস্টার,' যোগ করল সাংবাদিক।

ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ফোন করল কর্নেল ফারুককে, যেন দাফন করার জন্য কর্নেল জামিলের মৃতদেহ ফিরিয়ে দেয়া হয়। এক শর্তে ফারুক সম্মত হলো, কর্নেল জামিলকে ঢাকা সেনানিবাসে দাফন করতে হবে।

মুজিবের স্ত্রী, তিন পুত্র এবং দুই পুত্রবধূকে গোপনে দাফন করা হলো রক্তমাখা কাপড়েই বনানী কবরস্থানে। ধর্মীয় আচার অনুসরণ করে কোন শেষকৃত্যানুষ্ঠান করা হলো না। কবরগুলোকেও চিহ্নিত করা হয়নি।

মুজিবের জন্যও বনানী কবরস্থানে কবর খোঁড়া হয়েছে, কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা ঠিক করল মুজিবকে ঢাকায় দাফন করা বিপজ্জনক।

জাতির উদ্দেশে দেয়া মোশতাকের ভাষণের কপি রেডিও স্টেশনে উপস্থিত সবার মধ্যেই বিতরণ করা হলো। মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ [তখনও] সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ, কিন্তু নিজের প্রকৃত অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত নয়, মোশতাকের ভাষণের বক্তব্যের প্রশংসা করল। 'তুমি কি মনে করো এসব কিছু একদিনে হয়েছে?' মোশতাক জবাব দিল। অন্তত একবার হলেও মোশতাক তার ভেতরের কথাটা চেপে রাখতে পারল না।

জাতির উদ্দেশে দেয়া প্রথম ভাষণে মোশতাক ঘাতক [মেজরদের] 'সূর্য সন্তান' এবং 'অকুতোভয় হৃদয়ের বীর' হিসেবে প্রশংসা করল। কিন্তু সাফল্যের সময়ও সে কাপুরুষ। সে বলার চেষ্টা করল 'ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই' রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে 'তাকে সরকারের দায়িত্ব নিতে হয়েছে'। সে বলল, 'আমাদের স্বাধীনতা পাওয়ার প্রচেষ্টায় বন্ধুপ্রতিম দেশের অনেককেই জীবন দিতে হয়েছে।' মোশতাক ভারত, বন্ধুপ্রতিম দেশটির নাম উল্লেখ করল না। বলল,'স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে ত্রিশ লক্ষ শহীদের পবিত্র রক্ত এবং দুই লক্ষ মা ও বোনের সম্মানের বিনিময়ে।' তারপরও মোশতাক তার ভাষণ শেষ করল, 'বাংলাদেশ জিন্দাবাদ' বলে। 'জয় বাংলা'-দ্রোহের রণধ্বনি, বিজয়ের রণধ্বনি, তার এবং তার সহ-ষড়যন্ত্রকারীদের জন্য নয়। তারা মারাত্মকভাবে ভীতসন্ত্রস্ত, সেই সেস্নাগানের, যে সেস্নাগান দিয়ে হাজারও মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে গিয়ে।

বাংলাদেশের রক্তাক্ত ঘটনাবলি সম্পর্কে ভুট্টোর প্রতিক্রিয়ায় যদিও কোন আবেগ ছিল না, তবে সঠিক ছিল। তার বক্তব্য, 'আমি মর্মাহত, যে শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের সদস্যদের এমন মর্মান্তিক মৃত্যু হলো।' ১৫ আগস্টই ভুট্টো শুধু বাংলাদেশের নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি, ব্যক্তিগত আহ্বানও জানিয়েছে তৃতীয় বিশ্বের কাছে বিশেষত মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর কাছে বাংলাদেশের নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য। এই আহ্বানে সে বলেছে, 'যে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র আমাদের দেশকে বিচ্ছিন্ন করেছে, যে ষড়যন্ত্র পরবর্তী সময়ে আগ্রাসনে রূপ লাভ করে, সেই ঘটনা থেকে সৃষ্ট তীব্র মনোকষ্টের সচেতনতা থেকে উৎসারিত।'

ঢাকা গণহত্যার দিনে, ভুট্টো বাংলাদেশের মানুষের জন্য 'উপহার' ঘোষণা করল। বলল ভুট্টো_ 'বাংলাদেশের মানুষের প্রতি স্বতস্ফূর্ত সদিচ্ছা হিসেবে আমরা পাকিস্তানের মানুষের পক্ষ থেকে দ্রুতই ৫০,০০০ টন চাল, এক কোটি গজ সুতি কাপড়, ৫০ লাখ গজ সূক্ষ্ম কাপড় উপহার হিসেবে বাংলাদেশে পাঠাচ্ছি।' ভবিষ্যতে 'সামর্থ্য অনুযায়ী আরও উপহার' দেয়ারও প্রতিশ্রুতি দিল ভুট্টো।

'উপহার' মুজিবকে হত্যা করবার জন্য উপহার?'

১৬ আগস্ট সকালে, হত্যাকা-ের একদিন পর, হেলিকপ্টারে করে একজন মেজর, একজন লেফটেন্যান্ট এবং আরও কয়েকজন সৈন্য টুঙ্গিপাড়ায় নামল। তারা গ্রামের মসজিদের পেশ ইমামকে ডাকল, জিজ্ঞাসা করল তারা শেখ মুজিবুর রহমানকে দাফন করবে কি না, যদি মৃতদেহ তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

গ্রামবাসীদের বলা হলো তাদের হয়তো দশ-বারোটা কবর খুঁড়তে হবে, তবে উপস্থিত ক্ষেত্রে একটি কবর প্রস্তুত করলেই চলবে।

বেলা আড়াইটার দিকে সেনা কর্মকর্তারা কফিনে করে শেখ মুজিবুর রহমানের মৃতদেহ নিয়ে টুঙ্গিপাড়ায় ফিরে এলো। ইতোমধ্যে একটি শক্তিশালী পুলিশ দল নিয়ে গোপলগঞ্জের সাব-ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত হলো।

মেজর চাইল [সঙ্গে সঙ্গেই] মৃতদেহ কবরে নামিয়ে দিতে। কিন্তু এটা অনৈসলামিক। গ্রামবাসীরা ভীত-শিহরিত হলো। গ্রামবাসীরা জোর করল, 'আমাদের মৃতদেহ দেখতে হবে। 'তোমরা মৃতদেহ না দেখে কবর দিতে পার না' মেজরের প্রশ্ন। 'আমরা পারি,' বললেন মৌলভী শেখ আবদুল হাকিম, পেশ ইমাম, 'যদি আপনারা তাকে শহীদ ঘোষণা করেন।' সেনা কর্মকর্তা নিশ্চুপ। 'শেখ আবদুল হাকিম দাবি করলেন, 'আপনারা কি ইসলামী রীতি অনুযায়ী দাফন-কাফন করে মাটি দিবেন?'

নীরবতা।

উত্তেজনার মুহূর্ত। সেনা কর্মকর্তারা সংকটে পড়েছে। তাদের নির্দেশ অত্যন্ত পরিষ্কার : গ্রামবাসীকে মুজিবের মৃতদেহ দেখতে দেয়া যাবে না। কিন্তু একজন মুসলমানকে ইসলামী রীতি অনুযায়ী দাফন না করলে [গ্রামবাসী] মুসলমানরা বিদ্রোহ করতে পারে। মেজর বলল, 'হ্যাঁ, দাফন-কাফন হবে, কিন্তু তাদের উপস্থিতিতে হতে হবে।'
কফিন খোলা হলো।

মুজিবের শরীর বুলেটে ঝাঁজরা। বরফ দেয়া কফিন রক্তে লাল।

পাথরের নীরবতায় গ্রামবাসী কফিন ঘিরে দাঁড়াল।

এই নীরবতা বিপজ্জনক। প্রতি মুহূর্তে আশপাশের গ্রাম থেকে শত শত লোক আসছে। [পুলিশ বেষ্টনী দিয়ে] ওদেরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হলো। কিন্তু যে কোন মুহূর্তে বেষ্টনী ভেঙে ফেলতে পারে। 'তাড়াতাড়ি করো। কী হলো। আমাদের তো ফিরতে হবে,' চিৎকার করল লেফটেন্যান্ট। 'তোমাদের পাঁচ মিনিট দেয়া হচ্ছে।' মেজর খেঁকিয়ে উঠল।
গ্রামের বাড়ির বারান্দায় মুজিবের মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হলো। তার দেহে ২৯টি বুলেটের আঘাত ছিল। একটি বুলেট, সম্ভবত কোন অটোমেটিক রিভলভার থেকে বেরিয়েছে পেছন থেকে ছেদ করে বেরিয়ে গেছে। তার 'কুর্তার' পকেটে পাওয়া গেল পাইপ আর ভাঙা চশমা।

মুজিবের গ্রামের বাড়িতে কেউ নেই। সব দোকান বন্ধ। একজন এক টুকরা সাবান নিয়ে এলো। শেষ গোসলের জন্য পানি গরম করারও সময় নেই। রক্তের সব দাগ মোছার আগেই মেজর চিলি্লয়ে উঠল, 'জলদি করো। আর কত সময় নেবে তোমরা।'

কয়েকজন গ্রামবাসী মুজিবের মা সায়েরা খাতুনের নামে স্থাপিত হাসপাতাল থেকে চারটা শাড়ি নিয়ে এলো। তারা লাল পাড়গুলো ছিঁড়ে ফেলল। কিন্তু কাফন সেলাই করবার সময়টুকুও মেজর তাদের দেবে না।

জানাজা হবে? হ্যাঁ, বলল মেজর। একজন পুলিশকে জিজ্ঞাসা করল সে [মেজর] জানাজায় অংশগ্রহণ করতে পারবে কি না। পুলিশটি জবাব দিল পারবে, যদি পাক-সাফ থাকে। তারা জানাজায় অংশগ্রহণ করল না।
পিতার কবরের পাশে মুজিবকে দাফন করা হলো।
[সাংবাদিক ও কবি এ এল খতিব। জন্ম ভারতের মহারাষ্ট্রের রত্নগিরি জেলায়। কাজ করেছেন বাংলাদেশের মর্নিং নিউজ পত্রিকায় দীর্ঘদিন। জীবনের সবচেয়ে বর্ণাঢ্য সময় কাটিয়েছেন বাংলাদেশে। পরিচিতি তাই সিনিয়র সাংবাদিকদের জগতে। বঙ্গবন্ধু হত্যা নিয়ে বই লিখেছেন ডযড় শরষষবফ গঁলরন? প্রকাশিত হয়েছে ১৯৮১ সালে। প্রকাশনার প্রথম দিনেই ১০,০০০ কপি বিক্রি হলেও পরবর্তী সময়ে বইটি আর পাওয়া যায়নি বইয়ের দোকানে। শেষ জীবনে এ এল খতিব তার জন্মস্থানে ফিরে গিয়েছিলেন। ১৯৮৪ সালে কোলকাতায় বন্ধু সঞ্জীব দত্তের বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। সংবাদের পাঠকদের জন্য ডযড় শরষষবফ গঁলরন?-এর বাংলা অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে। আজ প্রথম কিস্তি।

No comments:

Post a Comment