বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা চিঠিটি কাদের সিদ্দিকীকে লিখেছিলেন ১৯৮২ সালের ১৫ অক্টোবর।এতদিন পর কাদের সিদ্দিকী ঐ চিঠিটি প্রকাশের উদ্দেশ্য কী ,তা জানা না থাকলেও চিঠিটি পড়লে আমরা অজানা এক শেখ হাসিনাকে জানা যায়-
ঐতিহাসিক এই চিঠিটিতে অসাধারন শব্দচয়ন, জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচারের প্রত্যয়, '৭১ এর ঘাতকদের প্রতি বঙ্গবন্ধু কন্যার ঘৃণা আর ক্ষোভ , স্বাধীনতাবিরোধীদের সমূলে ধ্বংস সহ আগামীর বাংলাদেশ কেমন হবে সেটাই প্রকাশ পেয়েছে-
১৯৮১ সালের ১৭ মে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ভারত থেকে বাংলাদেশে এসে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হন। এরপর তিনি ভারতের শিমলায় যান পুত্র সজীব
ওয়াজেদ জয় ও কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল কে দেখতে। তারা সেখানে স্কুলে পড়তেন।
সে সময় কাদের সিদ্দিকী ভারতের কলকাতায় নির্বাসিত ছিলেন।১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হলে কাদের সিদ্দিকী সশস্ত্র
বিদ্রোহ করে ভারতে নির্বাসনে যান।
কাদের সিদ্দিকীকে লেখা শেখ হাসিনার চিঠি ..................
‘জানি খুব রেগে আছ। মনে হয় দূর থেকেও তোমার রাগ দেখতে পাই। আমার
সঙ্গে তো শুধু রাগ অভিমানই করলে আবার
এও জানি যত রাগই কর না কেন আপার সামনে এলে সব রাগ পানি হয়ে যেতে বাধ্য।
চিঠি দেই না দেখে এটা ভেব না যে, মনে করি না।
সব সময় মনে করি। খবরও যে পাই না তা নয়, খবরও পাই।’
‘তাছাড়া ঢাকায় অনেক ভিড়ের মাঝে আমি ভীষণ একা।
প্রায়ই পরশ-তাপসদের (মনি ভাইয়ের বাচ্চারা) কাছে যাই একটু সান্ত্বনা পাই।
কি যন্ত্রণা নিয়ে যে আমি সেখানে থাকি কাউকে বলতে পারব
না।
যখনই অপারগ হই দম বন্ধ হয়ে আসে। এখানে চলে আসি। তাছাড়া অনেক আশা নিয়ে দেশে ফিরেছিলাম।’
‘আজ দেশ বিরাট সঙ্কটের মুখে—স্বাধীনতা বিরোধী চক্র কিভাবে শক্তি সঞ্চয় করেছে …যেখানে সমগ্র দেশ, সমগ্র বিশ্বজাতি জাতির পিতা বলে মানে সেখানে কয়েকটা ক্ষমতা দখলকারীরাই মানতে রাজি নয়…’ ‘যে লক্ষ্য সামনে রেখে স্বাধীনতা চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, সে স্বাধীনতা লক্ষ্য থেকে আজ অনেক দূরে দেশ চলে গেছে।
১৫ই আগস্টের যে ষড়যন্ত্র দেশ ও জাতিকে নিঃশেষ করার ষড়যন্ত্র। আমরা আমাদের মৌলিক অধিকার হারিয়েছি, সেই অধিকার আজও আদায় করতে পারলাম না।
যখন দেশ ও জাতি এই সঙ্কটের সম্মুখীন তখন একটি দল—সব থেকে একটি সংগঠিত দল—জাতির পিতার হাতে গড়া স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক
দলের কি ভূমিকা হওয়া উচিৎ? এখানে আমার দায়িত্ব বড়? না দেশ ও জাতির স্বার্থ বড়? একটি দেশ ও জাতিকে রক্ষা করতে হলে কত ‘আমি’কে বিসর্জন দিতে হয় তবেই
না লক্ষে পৌঁছানো যায়। কিন্তু আমাদের দলের কি ভূমিকা কি চেহারা আমি পেয়েছি?’
‘কারো বাড়া ভাতে ছাই ঢালতে আমি যাই নাই। আমি ‘জাতির পিতার’ মেয়ে—সেই হিসাবে শুধু সেই হিসাবেই যে ভালবাসা যে সম্মান আমি এই বয়সে পেয়েছি।সারাজীবন আমার বাবা সাধনা করেছেন, ত্যাগ করেছেন তারই দানে আমি সমগ্র জাতির ভালবাসা,
সম্মান পেয়েছি—আমার আর পাবার কি আছে? আমি এখন দিতে চাই।’
‘আমি সবই হারিয়েছি, চরম মূল্য দিয়েছি। আমার আর হারাবার কিছু নাই। চরম ত্যাগের মনোভাব নিয়েই যে দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়েছিল, তা পালন করতে গিয়েছিলাম (স্বপ্নেও কখনও ভাবি নাই যে এত বড় গুরুদায়িত্ব আমার উপর পড়বে) কিন্তু সেখানে গিয়ে কি পেয়েছি—সব থেকে বেশী সাহায্য সহযোগিতা যাদের কাছ থেকে পাব
আশা করেছিলাম সেখানে বড় ফাঁক।
এই এক বছরের ঘটনা কিছু বিশ্লেষণ করলেই দেখবে, বুঝবে। যার যা যোগ্যতা কর্মদক্ষতা তার মধ্য দিয়েই উঠবে কিন্তু একজনকে ছোট করে খাটো করে আর একজন উঠবে সেটা তো হয় না।’ ‘আর এখানে তো আমরা দিতে এসেছি। কিন্তু সে মনোভাব কোথায়? অনেক খোঁজ-খবর পেয়েছি—দলের ভিতরেও এজেন্ট আছে স্বাধীনতা বিরোধীচক্রেরই এজেন্ট তারাই দলের ইমেজ নষ্ট করবার জন্য— যাতে এগোতে না পারে সে জন্য, মূল
লক্ষে যাতে পৌঁছাতে না পারে তারই জন্যে কাজ করে যাচ্ছে। কেউ সচেতনভাবে কেউ অবচেতনায় সাহায্য করছে। বুঝতেও পারছে না—আত্মচিন্তায় এতটুকু চেতনাও হচ্ছে না যে কি সর্বনাশ দেশ ও জাতির জন্য করে যাচ্ছে।’ ‘আজকের এই সঙ্কটময় মুহূর্তে সকলকে এক থাকতে হবে, বৃহৎ স্বার্থে কাজ করতে হবে—আজকে সে সময়
নয় যে, ব্যারোমিটার দিয়ে কে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে কতটুকু বিশ্বাসী তা মাপার সময় এখন নয়। সেটা বোঝা যাবে ভবিষ্যতে কাজের মধ্যে দিয়ে কিন্তু কিছু কার্যকলাপ এভাবেই চলছে। তাতে গোটা দলের ইমেজ নষ্ট হচ্ছে। একটা স্থবিরতা এসে যাচ্ছে সে চেতনা কারো নেই। তার উপর সব থেকে বড় কথা হচ্ছে, যারা এই ধরনের কথা তুলে দলকে এগোতে দিচ্ছে না তারা কি সত্যিই বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী না কি জীবনেও যাতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়িত হতে না পারে সেই প্রচেষ্টায় নিমগ্ন, সেই প্রশ্নই আজ মনে আসে।
'গতবারই একটা কথা বলেছিলাম, ভীষণ একা আমি। শাঁখের করাতের ভিতর দিয়ে চলছি। তবে নিরাশ নই যা ঘটছে আমার বিশ্বাস একদিন না একদিন সফলকাম হবই।
হত্যার প্রতিশোধ নেবই। ২/৪টা খুনী মারলেই হবে না। মূল থেকে উপড়াতে হবে সেটা মনে রেখো '। ‘যারা বঙ্গবন্ধুর গায়ে হাত দিতে সাহস করে তাদের দুর্বল ভাবলে চলবে না। মাটির অনেক গভীরে তাদের শিকড় গাড়া সেটা মনে রাখতে হবে। যাক্, অনেক বকবক করলাম। মনের কথা আমি খুব কমই বলি। স্মৃতি রোমন্থনই বেশী করি, আজ অনেক কথা লিখলাম…’
ইতি : আপা
১৫/১০/৮২
No comments:
Post a Comment