Thursday, September 18, 2014

যুদ্ধাপরাধী এবং ঘৃণ্য ঘাতক সাঈদীর মৃত্যুদন্ডের কোন বিকল্প নেই: দায় একা শেখ হাসিনার নয় - সুমি খান

 আর্টিকেল ৪৯ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি যে কাউকেই ক্ষমা করতে পারেন। এই বিষয়টি আমরা আমজনতা ভুলে যেতে পারি, নীতিনির্ধারকেরা কেন ভুলে যান?  অনুগ্রহ করে মনে রাখবেন একাত্তরের ঘাতক এবং তাদের অনুসারী জামাত শিবিরের ক্যাডার বাহিনী কখনো কোন দুর্বলতম মুহুর্তেও তাদের নিধন যজ্ঞে দেরি করে না। এসবে নীতিনির্ধারকদের ব্যর্থতা চোখে পড়ার মতো। সবাই যদি ভাবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একলার দায় সব, সেটা কি ঠিক ? নিজেরা কেন একটু নিজেদেও দিকে দেখি না?

একাত্তরে নারী ধর্ষণ, হত্যাসহ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে আমৃত্যু কারাদন্ড প্রাপ্ত জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদন্ড  দিলেও আপিলের রায়ে সুপ্রীম কোর্ট তার  সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদন্ড  দিয়েছে। আপিল বিভাগের রায়ে ইব্রাহিম কুট্টি ও বিসাবালী হত্যায় মৃত্যুদন্ড থেকে রেহাই পেলেও জোরপূর্বক ধর্মান্তকরণ ও নারী অপহরণ করে ধর্ষণে সহায়তার দায়ে ‘স্বাভাবিক মৃত্যু না হওয়া’ পর্যন্ত কারাগারে থাকতে হবে জামায়াতের নায়েবে আমির ঘাতক  দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীকে।

এই রায়ের পর প্রতিক্রিয়ায় আইনমন্ত্রী তার  নিজের বাসায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “আমি একজন ব্যক্তি, সরকারের সদস্য ও নাগরিক হিসাবে সর্বোচ্চ আদালতের যে কোনো আদেশ ও রায়ের প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে মানবতাবিরোধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি আমরা আশা করি, সেটা না হওয়ায় আমি মর্মাহত।” দুর্ভাগ্য আমাদের, আইনমন্ত্রী বলেন, তিনি শুনেছেন সাঈদী পিস কমিটির মেম্বার ছিলেন।  আদালতে সাঈদীর বিরুদ্ধে ২০ টি অভিযোগ এনে  তথ্য প্রমাণ উপস্থাপিত হয়েছে। এর মধ্যে ১৭ তম অভিযোগ পিরোজপুর থানার পাশে বিপদ সাহার কন্যা ভানু সাহাকে পাকিস্তানী সেনা ক্যাম্পে নিয়ে জোর করে ধর্ষন  দায়িত্বশীল অবস্থান থেকে তিনি এসব তথ্য জানবার কথা । একই সাথে অনুদ্ঘাটিত তথ্য তার নির্দেশে উদ্ঘাটিত হবে –এমটাই প্রত্যাশা জনগণের। এ প্রেক্ষিতে জনগণের প্রত্যাশা - আইনমন্ত্রী বলতে পারতেন তাদের কাছে তথ্যপ্রমাণ আছে –সাঈদী  পাকিস্তান সরকারের গেজেটভুক্ত জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমীর গোলাম আযমের নেতৃত্বে গঠিত শান্তি কমিটি বা পিস কমিটির সদস্য ছিলেন ।
আপিল বিভাগের এই রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করা হবে কি না জানতে চাইলে আনিসুল হক বলেন, “আগামীতে রিভিউ করতে পারা যাবে কি না তা রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি পাওয়ার আগ পর্যন্ত  বলা যাচ্ছে না। কারণ আব্দুল কাদের মোল্লার রায় রিভিউ করার জন্য আসামিপক্ষ আবেদন করেছিল। তার পুরো রায় এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।” তবে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আমাকে বলেছেন, রিভিউর কোন সুযোগ নেই।

সকালে রায় ঘোষণার পরপরই তা প্রত্যাখ্যান করে শাহবাগে বিক্ষোভ শুরু করে গণজাগরণ মঞ্চ। তাদের অভিযোগ, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আঁতাত করে সরকার এই রায় দিয়েছে।এ অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মন্ত্রী বলেন, “প্রশ্নই আসে না। সমঝোতার ‘স’ ও হয়নি। মানবতাবিরোধী-যুদ্ধাপরাধী, জামায়াত শিবিরের টেরোরিস্টদের সঙ্গে সমঝোতার কোনো অবকাশ নেই।” এদেশের আপামর জনগণ সেটাই বিশ্বাস করতে চায়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় পিরোজপুরে হত্যা, লুণ্ঠনসহ বিভিন্ন অভিযোগে দায়ের করা একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেপ্তার করা হয় সাবেক সংসদ সদস্য সাঈদীকে। পরের বছর ১৪ জুলাই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল।

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আটক জামায়াত নেতাদের মধ্যে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধেই সবার আগে অভিযোগ গঠন হয়। একাত্তরে ৩ হাজারেরও বেশি নিরস্ত্র ব্যক্তিকে হত্যা বা হত্যায় সহযোগিতা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ভাংচুর ও ধর্মান্তরে বাধ্য করাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ২০টি ঘটনায় ২০১১ সালের ৩ অক্টোবর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে তার বিচার শুরুর আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।রাষ্ট্রপক্ষে ২৮ জন এবং আসামিপক্ষে ১৭ জনের সাক্ষ্য শুনে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সর্বোচ্চ সাজার আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।ওই রায়ের বিরুদ্ধে গত বছরের ২৮ মার্চ আপিল করেন সাঈদী। অন্যদিকে প্রমাণিত হলেও সাজা না হওয়া ছয় অভিযোগে এই জামায়াত নেতার শাস্তি চেয়ে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ।দুই পক্ষের আপিল আবেদনের শুনানি শেষে গত ১৬ এপ্রিল তা রায়ের জন্য অপেক্ষমান রাখে আপিল বিভাগ। তার পাঁচ মাস পর বুধবার এই ঘোষণা করা হলো। ৭৪ বছর বয়সী সাঈদী বর্তমানে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে রয়েছেন। ২০১০ সালের ২৯ জুন থেকে কারাবন্দি তিনি। তবে এর মধ্যে মা ও ছেলের মৃত্যুর পর দুই দফায় কয়েক ঘণ্টার জন্য প্যারোলে মুক্তি পেয়েছিলেন পিরোজপুর থেকে দুই বার নির্বাচিত এই সংসদ সদস্য।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর  একাত্তরের ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুর পর একে একে তদন্ত শুরু হয়। এর ভিত্তিতে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদেও ও  গ্রেপ্তার করা হয়। বিচার চলাকালীন  দেশের বিভিন্ন স্থানে জামায়াত মিছিল নিয়ে নামে এবং সেই মিছিল থেকে সহিংসতা ছড়ায়।
২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদন্ড দেবার পর পর ই জামায়াত শিবিরের  সহিংসতায় সারাদেশে ৩৫ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে পুলিশ চারজন, আওয়ামী লীগ ছাত্র লীগের দুই কর্মী।চট্টগ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। বাকিদের প্রায় সবাইকে নিজেদের কর্মী বলে দাবি করেছে জামায়াত।গাইবান্ধায় তিন পুলিশসহ ৬ জন, ঠাকুরগাঁওয়ে ৫ জন, রংপুরে ৫ জন, সাতক্ষীরায় ৪ জন, চট্টগ্রামে এক পুলিশসহ ৩ জন, সিরাজগঞ্জে ২ জন, নোয়াখালীতে ২ জন এবং ঢাকা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কক্সবাজার, দিনাজপুর, বগুড়া, মৌলভীবাজার, নাটোর ও রাজশাহীতে একজন করে নিহত হয়েছেন।দেশব্যাপী সংঘাতে আহত হয়েছে দুই শতাধিক। জামায়াত-শিবিরকর্মীরা বহু গাড়ি ও দোকান পাট ভাংচুর করেছে। কয়েকটি স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি ও মন্দিরেও হামলা হয়েছে। এই ঘটনার পুনরাবৃত্তির

এই রায়ের পর খালেদা জিয়া জামায়াত-আওয়ামী লীগের আঁতাত হয়েছে বিশ্বাস করে মনোক্ষুন্ন হবেন কি? জানিনা  আওয়ামী লীগের সাথে কোনভাবেই এখন তিনি পেরে উঠছিলেন না। তবে তার ভরসার জায়গা জামায়াত তাকে আশ্বস্ত করবে তাদের মতো করে কৌশুলী কথা বলে । তবে হ্যাঁ , সাদা চোখে মনে হচ্ছে  আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপির ক্ষতি বেশি হয়েছেবিএনপির কর্মীদেও মধ্যে অধিকাংশই শিবির বিদ্বেষী। খোদ খালেদা জিয়ার  সমাবেশে তার উপস্থিতিতেই শিবিরের ক্যাডাররা ছাত্রদলের ছেলেদেও আক্রমণ করেছে বিভিন্ন সময়ে।

সাঈদীর আপিলের রায়ের প্রতিক্রিয়ায় সাবেক  আইনমন্ত্রী  ব্যারিষ্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, “সর্বোচ্চ আদালত সব কিছু বিচার বিশ্লেষণ করে রায় দেয়। আদালত সেই চূড়ান্ত রায় দিয়েছে। রায় পছন্দ হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। কিন্তু সব রায়ই আমাদের গ্রহণ করতে হয়, গ্রহণ করতে হবে।” মনে পড়ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন হবার পর ব্যারিষ্টার শফিক আহমেদকে আমরা প্রশ্ন করেছিলাম ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউটর সংকট, অবকাঠামোগত সংকট । প্রসিকিউটর দের ফাইল রাখবার কোন জায়গা ছিলনা প্রায় দু’বছর। গোপনীয় নথি বগলদাবা করে প্রসিকিউটর রা   রাতের বেলা বাড়ি নিয়ে যেতেন ।  সকালে  এনে আবার কাজ করতেন। এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে  একাধিক বার  আমাদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন,“ ট্রাইব্যুনালের পেছনে আমরা অনেক খরচ করেছি, আর খরচ করা সম্ভব না। ৃ” তিনি শুধু নন এই ট্রাইব্যুনালের ব্যাপারে সংশ্লিষ¦ট মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত সম্মানিত নীতিনির্ধারকেরা কখনো কি একাত্ব হয়ে সমস্যা এবং সংকট নিরসনে সিরিয়াসলি ভেবেছেন?

এ মামলার ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের কোনো দুর্বলতা ছিল কিনা প্রশ্ন করেছিলেন সাংবাদিকেরা। তিনি বলেছেন , “আমি রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি না দেখে কাউকে দোষারোপ করতে চাই না। তবে প্রসিকিউশন টিমের যা অবস্থা, সেখানে পরিবর্তন আসা উচিৎ।”মন্ত্রী বলেন, “ট্রাইব্যুনালে কিছু কিছু মামলা চলছে, কিছু রায় অপেক্ষমান আছে। প্রসিকিউশন টিমের যেন কোনো অসুবিধা না হয় এজন্য আমি কোনো পরিবর্তন আনিনি। তবে দ্রুত এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।” মাননীয় আইনমন্ত্রী একা নন- মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী , স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী , অর্থমন্ত্রী সহ এই বিচার প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট দেও জরুরী ভাবে বৈঠক করে ট্রাইব্যুনালের  সকল জটিলতা অবসান প্রয়োজন। আমি এই ট্রাইব্যুনালের প্রথম দিন থেকে এর সাথে গভীর ভাবে সম্পৃক্ত। পেশাগত দায়িত্বের বাইরে  শিরায় শিরায় যেন টান অনুভব করি। পিতার রক্তঋণ শুধবার দায় থেকে হয়তো।  মনে মনে ভাবি -যদি একাত্তরের ঘাতকদের  বিরুদ্ধে  জাতি ন্যায়বিচার পায়- শহীদ এবং যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি কিছুটা হলেও দায় শোধ হতো নিশ্চয়ই।  বাবা দেখে যেতে পারেন নি এই ঘাতকদেও বিচার । এক কাদেও মোল্লার ফাঁসি আমাদেও আত্মবিশ্বাসী করেছে বটে। তবু ভয় হয় -আমরা কি মৃত্যুর আগে দেখে যেতে পারবো অবশিষ্ট শীর্ষঘাতকদের ফাঁসির কাঠে ঝুলানো কার্যকর হয়েছে?
sumikhan29bdj@gmail.com

No comments:

Post a Comment