Thursday, September 18, 2014

বাংলাদেশের গণমাধ্যমের জবাবদিহিতা, দায়বদ্ধতা-মহিউদ্দিন আহমেদ:


সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৪
Dr. Mohiuddin Ahmedবাংলাদেশ সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের প্রতি বছর সংবাদপত্র ও সাময়িকীর একটি বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করার কথা। এই প্রতিবেদনটিতে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে যেসব দৈনিক, সাপ্তাহিক অর্ধ-সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক এবং ত্রৈমাসিক পত্রপত্রিকা বাংলা ও ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়, তার তালিকা থাকে। পত্রিকার আরও কিছু বর্ণনার মধ্যে থাকে, পত্রিকার নাম, কী ভাষায় প্রকাশিত হয়, প্রথম প্রকাশের তারিখ, সম্পাদকের নাম, প্রকাশকের নাম ঠিকানা, কোথায় মুদ্রিত হয়, সেই ছাপাখানার নাম ও ঠিকানা, পত্রিকার আকার– ‘ব্রডশিট’ নাকি ‘ট্যাবলয়েড’ এবং প্রতি কপির মূল্য।
এই বার্ষিক প্রতিবেদনটি প্রতি বছর প্রকাশ করা সম্ভব হয় না, এই প্রকাশনার কাজটি সহজও নয়। তারপরও আমি ২০০৮, ২০১০ ও ২০১১ সালের প্রতিবেদন তিনটি জোগাড় করতে সফল হয়েছি। ২০১১ সালের সর্ব সাম্প্রতিক প্রতিবেদনটির শুরুতে, ৬ নম্বর পৃষ্ঠায় দেখা যায়, ১৯৭২ এ সারা দেশে দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা ছিল ৩০, সব ধরনের পত্রিকা এবং সাময়িকীর সংখ্যা ৩০০। আর ২০১১ সালে সারা দেশে দৈনিক পত্রিকার এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫১৮এ; আর সব ধরনের সাময়িকীর সংখ্যা হচ্ছে ৯৪৩।
২০১১ সালের ১১৫ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনটিতে জেলাওয়ারি পত্রপত্রিকার বর্ণনাও আছে। আছে আগের বছরগুলোর বর্ণনাও। তবে আমার আজকের আলোচনার জন্য শুধু ঢাকা জেলার দৈনিক পত্রিকার সংখ্যাটিই বেশি প্রাসঙ্গিক। ঢাকা জেলা, মানে ঢাকা মহানগর থেকেই, দেখতে পাচ্ছি প্রায় সবগুলো দৈনিক প্রকাশিত হচ্ছে। এই সংখ্যাটি হচ্ছে ২৩০। আর একটি সূত্র থেকে জেনেছি এই সংখ্যাটি এখন ৩০০ এরও উপর। তবে আমি ২৩০ সংখ্যাটি নিয়েই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখতে চাই।
এই তালিকার এক নম্বরে আছে কয়েক বছর আগে বন্ধ হয়ে যাওয়া দৈনিক বাংলাদেশ অবজারভার। এই পত্রিকাটির পরে নাম আছে দৈনিক ‘সংবাদ’, ২ নম্বরে এবং তারপর ইত্তেফাক। দৈনিক ‘সংবাদ’ সম্পর্কে এই তথ্যগুলো আছে প্রতিবেদনটির ১২ পৃষ্ঠায়: পত্রিকাটির ভাষা: বাংলা; প্রথম প্রকাশের তারিখ ১৯৫১ এর ১৭ মে। সম্পাদকের নাম আলতামাস কবির; প্রকাশক, আলতামাস কবির, ৮৭, বিজয়নগর, ঢাকা; মুদ্রণ: দি সংবাদ লিমিটেড, ৩৬ পুরানা পল্টন, ঢাকা; আকার ৫৬/৩৫ এবং দাম প্রতিকপি ৮ টাকা।
২৩০টি দৈনিক পত্রিকার এই তালিকার ১৭ নম্বরে আছে ইংরেজি দৈনিক ‘ডেইলি স্টার’, ২৭ নম্বরে দৈনিক ‘ভোরের কাগজ’, ৬৭এ ট্যাবলয়েড দৈনিক ‘মানবজমিন’, ৬৯এ দৈনিক প্রথম আলো, ৭৪এ যুগান্তর এবং সবশেষে, ২৩০ নম্বরে আছে ‘পূর্ব আলো’ নামের একটি পত্রিকা। এই পত্রিকাটির সম্পাদকের নামের কলামে লেখা আছে ‘‘বেস্টওয়ে মিডিয়া এন্ড কম্যুনিকেশন লি: পক্ষে: মোহাম্মদ মিজানুর রহমান, বসতি কন্ডোমিনিয়াম, লেভেল নং: ৭, বাড়ি নং: ১৫, সড়ক নং ১৭, বনানী-বা/এ, ঢাকা– ১২১৩’’।
পত্রিকার কত রকমের অদ্ভূত ও উদ্ভট নাম হতে পারে, তা এই প্রতিবেদনেও দেখা যায়। এমন একটি পত্রিকার নাম ‘ক খ গ’; তালিকার ১৫৭ নম্বরে। পত্রিকাটির বর্ণনায় ২০১১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনটির ২৭ পৃষ্ঠায় এই কথাগুলো আছে: ভাষা: বাংলা; প্রথম প্রকাশ ০৯-০১-২০০৮; সম্পাদক শওকত মাহমুদ, ফোন: ০১৭১৫-১৬৭০৯২; প্রকাশক শওকত মাহমুদ, ৭০ পাইওনিয়ার রোড, নয়াপল্টন ঢাকা-১০০০। মুদ্রণ: টিউলিপ প্রিন্টার্স, ৩৪, সোনারগাঁও রোড, হাতিরপুল, ঢাকা। পত্রিকার আকার ৫৬/৪০, দাম প্রতি কপি ৪.০০ টাকা।
বাংলাদেশের বিএনপি জামায়াতপন্থী, জাতীয়তাবাদী সাংবাদিকদের নেতা শওকত মাহমুদ ঠিক কোন্ পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন, আমার জানার আগ্রহ অনেকদিনের। কিন্তু কোথাও পাচ্ছিলাম না। এখন এই প্রতিবেদনে দেখলাম।
২.
বাংলাদেশে জনসংখ্যার বিস্ফোরন ঘটছে, আর বিস্ফোরন ঘটছে আমাদের পত্রপত্রিকা ও সাময়িকীর প্রকাশনায়ও। এই বিস্ফোরনটা প্রকটভাবে দেখা যাচ্ছে ঢাকা শহরে। এক ঢাকা শহরে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরে নিবন্ধিত আছে ২৩০টি ইংরেজি ও বাংলা দৈনিক!! ঢাকা শহরের বিপরীতে দুনিয়ার আর কোনো দেশের আর কোনো শহরে কি এতগুলো দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়? আমার জানামতে লন্ডনের মত এত বড় বিখ্যাত ও বড় শহরে ‘ব্রডশীট’ ও ‘ট্যাবলয়েড’ মিলিয়ে আছে গোটা ১৫ দৈনিক; নিউইয়র্কে আছে মাত্র দুটো দুনিয়াজোড়া বিখ্যাত দৈনিক– ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ এবং ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’। ওয়াশিংটনে আছে মাত্র একটি, ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’। ওয়াশিংটন শহরে ‘ওয়াশিংটন টাইমস’ নামের আর একটি দৈনিক আছে; কিন্তু এই দৈনিক ‘ওয়াশিংটন টাইমস’ অন্য দৈনিক ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ এর ধারে কাছেও নেই নামে এবং প্রভাবে।
তো ঢাকা শহরে এতগুলো দৈনিক কেন আছে, কেন প্রকাশিত হয়, তার ব্যাখ্যা আমাদের পত্রিকা মালিকদের সমিতি– ‘নিউজ পেপার্স্ অওনার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’, নোয়াব, বা সম্পাদকের সংগঠন ‘সম্পাদক পরিষদ’ কখনও স্পষ্টভাবে দেয় না। এমন ব্যাখ্যা দিলে যে তাদের অনেক গোমর, পত্রিকা জগতের অনেক অ-জানা কথা, কেলেংকারি এবং দুর্নীতি, অনিয়ম বেনিয়মও বেরিয়ে আসবে।
আমাদের মিডিয়া জগতের মানুষজন অন্যের কেলেংকারি সন্ত্রাস দুর্নীতি, প্রকাশ করতে যেমন ফুলটাইম, ওভারটাইম আগ্রহী, তার হাজার ভাগের এক ভাগও নয় নিজেদের অন্যায় অবৈধ কাজকর্ম তুলে ধরতে।
আমাদের দেশের সম্পাদক সাংবাদিকরা কঠোরভাবে একটি নীতি মেনে চলার চেষ্টা করেন: কাকের মাংস কাকে খায় না। বাংলাদেশে সম্পাদক সাংবাদিকরা নিজেদের কাকের সঙ্গে প্রায়ই তুলনা করতে ভালোবাসেন এবং যেহেতু কাক কাকের মাংস খায় না, তারাও একে অন্যের মাংস খাবেন না। মানে, একে অন্যের দুর্নীতি, সন্ত্রাস, ঘুষ এবং অন্যায় ও অবৈধ সুযোগ সুবিধা গ্রহণ– তার কোনো খবর তাদের পত্রিকায় প্রকাশ করবেন না, করা যাবে না।
বাংলাদেশের এই সব সম্পাদক-সাংবাদিক যারা এই নীতিতে বিশ্বাস করেন তারা লক্ষ্য করেননি যে কাক কোনো প্রিয় প্রাণি, পাখি নয়, তার আওয়াজটা কর্কশ, কাককুল কোনো বাড়ির আশে পাশে ডাকতে থাকলে, মানুষজন দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। তবে কাকের সঙ্গে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রচণ্ড মিল দেখতে পাই– কাক যেমন কর্কশ আমাদের কিছু কিছু সাংবাদিকও কর্কশ চরিত্রের, কথায় কথায় হুমকি ধামকি দিয়ে থাকেন। তারা যে পত্রিকার মালিকের বেতনভূক্ত সাংবাদিক তা তাদের কথাবার্তায় চাপা পড়ে যায় তাদের দাম্ভিক আচরণে। তারা প্রায়ই হুমকি দেন অমুকের খবর কাভার করব না, অমকুকে বর্জন করব, অমুককে সাংবাদিকদের কাছে মাফ চাইতে হবে, ইত্যাদি। কিন্তু পত্রপত্রিকার কাজ তো সংবাদ ‘কভার’ করা, সেজন্য সাংবাদিককে তো বেতন ভাতা দেওয়া হয়। সংবাদ জোগাড় না করতে পারলে, তা তো সংশ্লিষ্ট সংবাদিক বা সাংবাদিকদের ব্যর্থতা, অযোগ্যতা। তাহলে তাকে কেন পত্রিকার মালিক বেতন ভাতা দেবেন?
এই প্রসঙ্গে আমার খুবই মনে পড়ছে সাত আট বছর আগে চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামে সাংবাদিকদের এক নেতা, ফটোসাংবাদিক হিসেবে বেশি পরিচিত মরহুম হাজী জহির পুলিশের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। বাংলাদেশি সাংবাদিক এবং ফটোসাংবাদিকরা প্রতিবাদে কর্মবিরতির সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক একটি সংবাদ সংস্থায় কর্মরত গোধূলী নামের আর এক ফটোসাংবাদিক এই সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে তার দায়িত্ব ঠিকই নিয়মিতভাবে পালন করতে থাকলেন। বিষয়টা হল, গোধুলী যদি ‘স্ট্রাইক’ করতে থাকেন, তাকে হয়ত চাকুরীচ্যুত হতে হত। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা বলে তার বেতনভাতাও নিশ্চয়ই বেশি ছিল। সুতরাং গোধূলী কিছুতেই তার চাকুরী হারাতে চাইলেন না। তার উপর উন্নত দেশগুলোতে, আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলোতে প্রতিবাদে ধর্মঘটে যাওয়া বা কর্মবিরতির ঘোষণা দেয়া তারা চিন্তাও করতে পাওে না।
৩.
সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক থেকে একটি বই জোগাড় করেছি। বইটির নাম FLAT EARTH NEWS; লিখেছেন নিক ডেভিস (Nick Davies) নামের এক সাংবাদিক। চাট্টো এন্ড উইন্ডাস (Chatto & Windus) প্রকাশিত ৪০৮ পৃষ্ঠার এই বইতে এককালের লন্ডন ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকার সাংবাদিক এই নিক ডেভিস তার এই পত্রিকাটিকেও বিভিন্ন ব্যর্থতা অনিয়ম বেনিয়েম এবং ধান্দাবাজীর জন্য কঠোর সমালোচনা করেছেন। বিশ্ববিখ্যাত ইংরাজি সাপ্তাহিক ‘দি সানডে টাইমস’এর উপর তার এই বইটিতে প্রায় ৪৫ পৃষ্ঠায় যে ‘অধ্যায়টি’ আছে তার শিরোনাম ‘ইনসাইট ইনটু দি সানডে টাইমস’ (Insight into the Sunday Times)। (এই পত্রিকাটিতেই ১৯৭১ এর ১৩ জুন এন্থনী ম্যাসকারেনহাসের সেই সাড়াজাগানো প্রায় ১০ হাজার শব্দের রিপোর্টটি পত্রিকাটির প্রথম পৃষ্ঠাসহ ভিতরের আরও কয়েকটি পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়েছিল বাংলাদেশের গণহত্যার ওপর। তার চাক্ষুষ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই দীর্ঘ বিবরণ সারা দুনিয়াতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। পরে এই বিবরণ The Rape of Bangladesh নামের বইতে আরও বিস্তারিত বর্ণনাসহ প্রকাশিত হয়েছিল।)
নিক ডেভিসের এই হার্ডকভার বইটির মলাট উল্টালেই ফ্ল্যাপে ফ্ল্যাপে ঘনকালো বড় হরফে এই কথাগুলো আছে: Finally I was forced to admit that I work in a corrupted profession.
পশ্চিমা দেশের এক সাংবাদিক, এই নিক ডেভিস বলছেন তিনি সাংবাদিকতার যে পেশায় আছেন সেটি দুর্নীতিগ্রস্ত। তো এইসব উন্নত দেশে গণমাধ্যমের দুর্নীতি নিয়ে এটি প্রথম বা শেষ বই নয়। এমন প্রকাশনা, এমন আত্মস্বীকৃতি হাজার হাজার আছে। কিন্তু বাংলাদেশে ‘কাকের মাংস কাক খায় না’ এমন এক উদ্ভট যুক্তিতে আমাদের সম্পাদক সাংবাদিকরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের অন্ধকার জগতকে আর কতদিন আড়াল করে রাখবেন?
৪.
২০১১ এর প্রতিবেদনের হিসাব মতে বাংলাদেশে এখন ৭১২টি পত্রপত্রিকা এবং সাময়িকী প্রকাশিত হচ্ছে। ১৬ কোটি জনসংখ্যার জন্য এই সংখ্যাটি হয়ত মোটেও বেশি মনে হবে না। কিন্তু দেশের শিক্ষার হার এবং আর্থিক সঙ্গতি, কয়জন মানুষ প্রতিদিন ১০ টাকা দিয়ে একটি পত্রিকা কিনতে পারে, এই প্রশ্নগুলো বিবেচনায় নিলে পত্রপত্রিকার এই সংখ্যাটি অবশ্যই বিশাল। আমাদের কোন কোন জেলা শহরেও এখন দৈনিক পত্রিকার বিস্ফোরণ ঘটছে। এগুলোতে কি সৎ সাংবাদিকতার চর্চা হচ্ছে? এই পত্রিকাগুলোর সাংবাদিক-সম্পাদক কর্মচারীরা কি নিয়োগপত্র, নিয়মিত বেতন-ভাতা, সাংবাদিকদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন? তাহলে কেন এতগুলো পত্রপত্রিকা?
কবি আবু হাসান শাহরিয়ার বাংলাদেশে পত্রপাত্রিকার এমন বিস্ফোরনের একটা কারণ দিয়েছেন। আবু হাসান শাহরিয়ার তার ‘অর্ধসত্য’ (প্রকাশক: সাহিত্য বিকাশ) বইটিতে ‘‘কৃপণের মুঠিধরা হিসেবের গোপন চালাকি’’ শিরোনামের একটি লেখায়, বইয়ের ৩২ পৃষ্ঠায় বাংলাদেশের দৈনিক পত্রিকাগুলোর কোন কোনটির চরিত্র এবং অসৎ উদ্দেশ্য সম্পর্কে এই কথাগুলো লিখেছেন: ‘‘সম্পদ পাহারায় বড়লোকরা আগে কুকুর পুষত, এখন পোষে দৈনিক। একুশ শতকের দৈনিক হচ্ছে বড় লোকের বাড়ীর পোষা কুকুর।’’
ভূমিদস্যুরা যেভাবে তাদের মালিকানার পত্রিকাগুলোর অপব্যবহার করে চলেছে, আবু হাসান শাহরিয়ারের একটু আগের উদ্ধৃতির কথাগুলোতে তার যথার্থ প্রমাণ এবং সত্যতা পাওয়া যায়। ভূমিদস্যুরা যেমন একপক্ষকে হামলা করে, আবার প্রতিপক্ষও তার পত্রিকাকে হামলা মোকাবেলায় ব্যবহার করে এমন অপব্যবহারে এই গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমটির প্রতি মানুষজনের আস্থা-বিশ্বাসই যে সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ এদিকে ‘নোয়াব’ বা ‘সম্পাদক পরিষদ’ বা সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোরও কোনো দায়-দায়িত্ব আছে বলে মনে হয় না।
আমাদের পত্রিকাগুলো ছাড়া গত পনের বিশ বছরে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার অগ্রযাত্রাও লক্ষ্যণীয়। ইতোমধ্যে ২৭টির মতো প্রাইভেট চ্যানেল প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টার সম্প্রচারে আছে। আছে পনের বিশটির মত এফএম রেডিও চ্যানেল। আছে অনলাইন নিউজ চ্যানেলও অনেকগুলো। এগুলোর সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ছে।
এই যে এত বিশাল একটি গণমাধ্যম বাংলাদেশের মানুষজনকে দিন দুনিয়া সম্পর্কে অবহিত রাখার সার্বক্ষণিক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তাদের এই চেষ্টাগুলো কতটুকু সফল, কোথায় কোথায় তাদের ব্যর্থতা, কোথায় মালিক-সম্পাদকদের ব্যবসায়িক, রাজনৈতিক এবং অন্যান্য ধরনের ধান্দাবাজি তার মনিটরিং এর জন্য নিয়মিত কোনো ব্যবস্থা আমাদের কোনো পত্রিকা বা টিভি চ্যানেলে নেই। বিবিসি বাংলায় প্রতি সপ্তাহে, সাধারণত মঙ্গলবার ভোর ৬-৩০এর ‘প্রভাতী’তে, ‘প্রীতিভাজনেষু’ নামের প্রায় পনের মিনিটের একটি অনুষ্ঠানে বিবিসি বাংলায় প্রচারিত অনুষ্ঠানগুলোর উপর শ্রোতাদের মন্তব্য, পরামর্শ, উপদেশ এবং সমালোচনাও প্রচারিত হয়। এসব মন্তব্য সমালোচনার জবাবও দেওয়া হয় বিবিস বাংলার পক্ষ থেকে। কোনো কোনো সমালোচনা গ্রহণ করা হয়, শ্রোতাদের ধন্যবাদ দেওয়া হয় ভুল ধরিয়ে দেওয়ার জন্য।
‘আলজাজিরা’ টিভি চ্যানেলে প্রতি শনিবার দুপুর ২-৩০ এ, রোববার রাত ৮-৩০ এ এবং সোমবার ১০-৩০-এ লিসেনিং পোস্ট (Listening Post) নামের আধঘন্টার একটি অনুষ্ঠান আমার খুব প্রিয়। এই অনুষ্ঠানে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমে কোনো বিশেষ ইস্যুকে কেমন ‘কভারেজ’ দেওয়া হয়েছে, ‘কভারেজ’ পক্ষপাতিমূলক না নিরপেক্ষ তার উপর আলোচনা হয়। গাজায় ইসরায়েল প্রায় দুই মাস যেমন হামলা চালিয়েছে তাতে পশ্চিমা গণমাধ্যম যে নিরপেক্ষ ছিল না তা এই অনুষ্ঠানে সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে কয়েক সপ্তাহ ধরে। গত সপ্তাহে দেখলাম পাকিস্তানে ইমরান খান এবং তাহেরুল কাদরীর বিক্ষোভকে ‘জিও নিউজ’ আর ‘এ আর ওয়াই’ চ্যানেল দুটির পারস্পরিক বিরোধী অবস্থান নিয়ে আলোচনা। জিও নিউজ সমর্থন দিয়েছে নেওয়াজ শরীফের পক্ষে, গণতন্ত্রের পক্ষে; আর এ আর ওয়াই সমর্থন দিয়েছে ইমরান খান এবং সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণকে। এই বিষয়টির উপর চমৎকার বাংলাদেশের জন্য শিক্ষণীয় কথাবার্তা ছিল।
আমাদের দেশে এমন অনুষ্ঠান জরুরি হয়ে উঠেছে। আমাদের দেশের গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসাবে গুরুত্ব চাইবে, ক্ষমতা প্রয়োগ করবে; কিন্তু কারও কাছে দায়বদ্ধ থাকবে না তা তো হতে পারে না। আমাদের গণমাধ্যমে কতটুকু সাংবাদিকতা থাকছে আর কতটুকু মালিকের বিভিন্ন কিসিমের স্বার্থের পক্ষে প্রতিপক্ষকে হামলা হুমকি চলছে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কি মালিকের স্বাধীনতা এমন বিষয় নিয়ে আলোচনা সমালোচনা এখন ফরজ। আগামী দিনগুলোতে এই কলামে এই বিষয়গুলো গুরুত্ব পাবে।
আমাদের অকার্যকর জাতীয় সংসদের বিপরীতে আমাদের গণমাধ্যম জনমানুষের পক্ষে বিশেষ করে যারা অবহেলিত নির্যাতিত, যারা এই দেশের সংখ্যালঘু, প্রবল ভূমিকা রাখছে। আমার এই কলামে তাদের নন্দিত ভূমিকার কথাও উদাহরণসহ অবশ্যই থাকবে।
মহিউদ্দিন আহমেদ:
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সচিব, কলাম লেখক।
ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের দাবি, বাংলাদেশের মৌলবাদী গোষ্ঠী জামায়াতকে দেশের ভেতর অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য কয়েক মিলিয়ন ডলার দিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। তৃণমূল এমপি আহমেদ হাসান ইমরানের মাধ্যমে  অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান সারদার কেলেঙ্কারির টাকা বাংলাদেশে জামায়াতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ হয়েছে।

ভারতের কেন্দ্রীয়  স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ তদন্তের নির্দেশ দেওয়ায় অভিযোগটি যে গুরুতর, তা প্রমাণ করে। বিষয়টি বন্ধু-প্রতিম ভারত এবং বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুবই সংবেদনশীল। তেমন গুরুতর না হলে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের মাথাব্যথা হওয়ার কথা নয়।

আহমেদ হাসান ইমরান ২০০১ সালে ভারতে নিষিদ্ধ মৌলবাদী সংগঠন ‘স্টুডেন্টস ইসলামিক মুভমেন্ট অফ ইন্ডিয়া’ (সিমি)-র পশ্চিমবঙ্গ শাখার সভাপতি ছিলেন। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক মনে করে, সিমি বহুগুণে শক্তিশালী হয়ে ভারত-বিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। সিমির প্রাক্তন অনেক নেতা এখন তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনীতিতে যুক্ত।

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নিজস্ব গোয়েন্দা বিভাগও ইমরানের বিরুদ্ধে সরকারের কাছে একই ধরনের রিপোর্ট করেছিল। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার নলিয়াখালিতে জঙ্গি-গোষ্ঠীর সংঘর্ষের ঘটনায় ইমরানের সক্রিয় সম্পৃক্ততাও পাওয়া যায়। রিপোর্টটি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে দেওয়ার পরেও কেন মনোনয়ন দিয়ে ইমরানকে রাজ্যসভায় নিয়ে আসা হল, সেই প্রশ্নের উত্তর একমাত্র মমতাই দিতে পারবেন।

ahmed_hasan_imranইমরানের সাথে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত গোলাম আজমের ছেলে মামুন আল আজমের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। ইমরান ভারতের জামায়াতে ইসলাম-ই হিন্দ-এর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন বেশ কয়েক বছর। আল আজম আইডিবি ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর থাকা অবস্থায় ভারতের পূর্বাঞ্চলে ব্যাংকটির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন ইমরান। সেই থেকে ইমরান আর আল আজমের সম্পর্ক।

যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসি হওয়ায় কলকাতার ধর্মতলায় কিছু ইসলামিক সংগঠন প্রতিবাদ মিছিল করেছিল। পরে জানা যায়, বাংলাদেশের জামায়াত ও সিমির মদদেই মিছিলগুলি হয়। আহমেদ হাসান ইমরান এই মিছিলে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা কেন্ত্রীয় সরকারকে তা নিশ্চিত করে।

তৃণমূলের আরেক এমপি অভিনেত্রী মুনমুন সেন ও পাকিস্তানের তেহরিক-ই ইনসাফ নেতা ইমরান খানের মধ্যে এখনো নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে বলে ভারতীয় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দার সংস্থার দাবি। পাকিস্তানের আইএসআই’র সাথে মুনমুন সেন সরাসরি জড়িত, সেই সন্দেহও রয়েছে কিছু কিছু মহলের। গোয়েন্দারা বলছেন, ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের প্রমাণ তাদের হাতে রয়েছে।

ধর্মীয় উগ্রবাদী-অধ্যুষিত প্রদেশ খাইবার পাখতুনখাওয়াতে ইমরানের তেহরিক-ই ইনসাফের ক্ষমতায় শরিক পাকিস্তানি জামায়াত। প্রদেশটি উগ্র জঙ্গি গোষ্ঠীর স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। অতি সম্প্রীতি নওয়াজ শরীফ সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আইএসআই’র প্রেসক্রিপশনে আজাদি মার্চ করে ইমরানের পিটিআই। আন্দোলনটি যে আইএসআইয়ের নির্দেশনায় হয়েছে, তা ইমরানের উদ্যোগে অন্যায়ভাবে বহিষ্কৃত তেহরিক-ই ইনসাফের চেয়ারম্যান জাভেদ হাশ্মিরই গণমাধ্যমকে বলেছেন।

যে প্রশ্নটি সবার সামনে চলে আসে, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেইসব জানতেন কি না?’। তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের উগ্র-গোষ্ঠীর মধ্যকার নিবিড় যোগাযোগ মুখ্যমন্ত্রী মমতার গোচরেই হয়েছে বলে মনে হয়। যদিও তাঁর দল অস্বীকার করছে। বলছে, এটি বিজেপির রাজনীতি।

কিন্তু তাদের দাবি তেমন গ্রহণযোগ্য মনে হয় না। সারদার মাধ্যমে জামায়াতের কাছ থেকে টাকা নেওয়া দেওয়া ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি বিশ্বাসযোগ্য ঘটনা তাই প্রমাণ করে।

imranপ্রথমতঃ পাকিস্তানি হাইকমিশনারের কলকাতা সফর ও মমতার সাথে সাক্ষাতের পেছনে মুনমুন সেন ও ইমরান খানের  আগ্রহ এবং ঘনিষ্ঠতা ক্যাটালিস্ট হিসাবে কাজ করেছে। চির বৈরি পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের সাথে একজন মুখ্যমন্ত্রীর দেখা হতেই পারে। কিন্তু সেই সাক্ষাৎটি যখন আইএসআইপন্থি পাকিস্তানি রাজনীতিবিদ এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুর আগ্রহে অনুষ্ঠিত হয়, তখন এর পেছনের উদ্দেশ্য বেশ পরিষ্কার হয়ে যায়।

দ্বিতীয়ত, সাক্ষাতের পরপরই কলকাতার একটি সাংবাদিক দলকে পাকিস্তান সফরের ব্যবস্থা করা হয়। ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে তেমন প্যারা-ডিপ্লোমেসি স্থান পায় না। কেন্দ্রকে আড়ালে রেখে পাকিস্তানের সাথে স্বপ্রণোদিত হয়ে প্যারা-ডিপ্লোমেসি চালিয়ে যাওয়ার সাথে অন্যান্য পাকিস্তানপ্রেমি কর্মকাণ্ডগুলি মিলে যায়। খোদ পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ জনগণই বিশ্বাস করে যে, মমতা সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপে এই অঞ্চলের উগ্রপন্থিদের আশা আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিন হচ্ছে।

তৃতীয়ত:  কলকাতায় পাকিস্তানি ডেপুটি হাইকমিশনারের কাছে রাজ্যের মুসলিমদের জন্য পাকিস্তানে যাওয়ার ভিসা প্রসেস সহজ করার অনুরোধের অভিযোগও রয়েছে মমতার বিরুদ্ধে। ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও মুসলিম বাস করেন। সেই প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীরা পাকিস্তানি ভিসা সহজ করার অনুরোধ করেন নি। আজ যদি মমতা সারা ভারতের মুসলিমদের জন্য ভিসা পদ্ধতি সহজ করার কথা বলতেন, কারো তেমন কিছু বলার থাকত না।

চতুর্থতঃ উর্দুভাষী মানুষের আনাগোনা কলকাতায় উল্লেখ্যযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে, যা সন্দেহকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সাধারণ মানুষের ধারণা, মমতার উগ্র রাজনীতি প্রীতির জন্যই রাজ্যের ভেতর অন্য দেশের মানুষের আনাগোনা বেড়ে গেছে।

পশ্চিমবঙ্গ আমাদের প্রতিবেশী হওয়ায় মমতার এ ধরনের কর্মকাণ্ডে আমরাও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ এবং ভারতের সীমান্তে গরু চোরাচালান ও মাদক ব্যবসায় সারদা কেলেঙ্কারির টাকার একটি বিরাট অংশ বিনিয়োগ হয়েছে। বিনিয়োগের লভ্যাংশ দেশের ভেতর অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য ব্যয় হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। উদ্দেশ্য, শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত করা। 

গোয়েন্দা তথ্যে আরও জানা যায়, তৃণমূল কংগ্রেসও নির্বাচনে জামায়াতের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়েছিল। গোয়েন্দারা এ ব্যাপারে নিশ্চিত বলা যায়। সারদা কেলেঙ্কারির অন্যতম মূল অভিযুক্ত কুণাল ঘোষ অর্থের আদান প্রদান বিষয়ে মুখ খুলতে চাইলেও মমতা সরকারের নির্দেশে গঠিত কল্যাণ কমিশন তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। কল্যাণ নিজে থেকেই কমিশনের সাথে এ বিষয়ে কথা বলার অনুরোধ জানিয়ে আসছেন।

বিধানসভা এবং লোকসভার নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় বাংলাদেশের জামায়াতের নেতা-কর্মীরা তৃণমূল পক্ষে কাজ করেছিল। বিশেষ করে মালদা, দক্ষিণ ও উত্তর দিনাজপুর (৬০-৮০%), মুর্শিদাবাদ জেলাতে (৯০%)সহ বাংলাদেশের সাথে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী এলাকায় জামায়াতের কর্মীরা তৃনমূলের পক্ষে গণসংযোগ করেন।

ভারতের জাতীয়, আঞ্চলিকও স্থানীয় নির্বাচনে সংখ্যালঘু ভোট ব্যাংকটির ইলেকটোরাল বিহেভিয়ার পর্যালোচনা করলে মমতার বিতর্কিত রাজনৈতিক পদ্দক্ষেপগুলোর কারণ বোঝা যায়।

ঐতিহাসিকভাবে ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (বাংলাদেশের মত সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস হয় না) প্রবল। বিশেষ করে সিপিএম ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা প্রায়ই হত এবং সংখ্যালঘু মুসলমানরা নিরাপত্তাহীনতায় দিনানিপাত করত। সিপিএম ক্ষমতায় আসার পর তেমন দাঙ্গা হয়নি এবং ফলে সংখ্যালঘু ২৭ শতাংশ ভোট সিপিএমের কোষাগারে যায়। সিপিএম মুসলমানদের মধ্যে ভূমি বিতরণ করেও মুসলমান সম্প্রদায়ের আস্থা অর্জন করেছিল। একই সাদৃশ্য দেখা যায় বিহারে। ১৯৯০ সালে লালু প্রসাদ যাদব ক্ষমতায় আসার পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। দীর্ঘ ১৫ বছর সংখ্যালঘু ভোট ব্যাংকটি ব্যবহার করে লালু ক্ষমতায় থাকেন। একই পদ্ধতিতে উত্তর প্রদেশে মুলায়েম সিং যাদব ক্ষমতায় আসেন।

এখন নিরাপত্তা সংখ্যালঘু মুসলমানের অগ্রাধিকার তালিকায় নেই। তাদের সচেতনতা বেড়েছে। তারা শিক্ষা, চাকরি ও দারিদ্র অগ্রাধিকার তালিকায় নিয়ে এসেছে।

সেসব ইস্যুকে গুরত্ব না দেওয়ার জন্য লালু প্রসাদ যাদবের ক্ষমতা চলে যায় নিতিশের হাতে। ঠিক একই কারণে মুলায়েম সিং ইউপিতে মায়াবতীর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। 

পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু মুসলমানরাও আগের মত নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত নন। সিপিএমের জমানায় সরকারি চাকরিসহ অন্যান্য আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে পিছিয়ে থাকার কারণেই বামফ্রন্টের মুখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেন ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা। যেখানে সারা ভারতে স্বাক্ষরতার হার ৬৫ শতাংশ, সেখানে পশ্চিমবঙ্গের ২৭ শতাংশ ভোটের মালিক সংখ্যালঘু মুসলমানদের হার ৫৭.৫। এমনকি বাম শাসিত কেরালায় সংখ্যালঘুদের স্বাক্ষরতার হার ৮৯.৪ শতাংশ। একটি গবেষণায় দেখা যায়, কেরালায় মুসলমানদের দারিদ্র ১৫ বছরে (১৯৮৭-২০০৪) ৫৬ থেকে ৩১ এ নেমে এলেও পশ্চিমবঙ্গে নেমেছে ৫৩ থেকে ৪৪ শতাংশে।

Mamataমুসলমানদের প্রতি অবহেলার কারণেই সিপিএম ২০১১ সালে ক্ষমতা হারায়। মমতা ২৯৪ তে ২২৫ আসন পেয়ে রাজ্যের ক্ষমতায় যান। রাজ্যসভার মত লোকসভার নির্বাচনেও সিপিএমের শোচনীয় পরাজয় হয়। পশ্চিমবঙ্গের ৪২ টি আসনের মধ্যে ২০টিতে জয় নির্ধারণই ভোটের মালিক সংখ্যালঘুরা। ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল ৩৪ আসন পায়, যেখানে ২০০৯ সালে ১৯ এবং ২০০৪ সালে একমাত্র নিজের আসনটিতে জিতে আসেন মমতা।

পাশাপাশি মমতার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও ব্যক্তিগত আচার আচরণ নির্মোহ-ভাবে বিশ্লেষণ করলে অসহনশীলতা, নীতিহীনতা, রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতা মমতার রাজনৈতিক বিকাশ ধারায় প্রবলভাবেই পাওয়া যায়।

জীবনের প্রারম্ভিক পর্যায়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি শুরু করলেও, কংগ্রেসের রাজনীতি দিয়েই মমতার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু। মমতা ১৯৮৪ সালে বর্ষীয়ান কমিউনিস্ট নেতা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হয়ে জাতীয় পর্যায়ে সাড়া ফেলে দেন। এরপর সারা ভারতের যুব কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদকও নির্বাচিত হন।

১৯৯১ সালে লোকসভায় আবার নির্বাচিত হয়ে নরসিমা রাওয়ের মন্ত্রিসভায় মানব সম্পদ ও ক্রীড়ামন্ত্রী হিসাবে স্থান পান মমতা।কিন্তু পরে কলকাতায় ক্রীড়া উন্নয়নের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের উদাসীনতার অভিযোগ এনে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেন। ১৯৯৬ সালের দিকে নিজ দল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সিপিএমকে সহযোগিতার অভিযোগ আনেন এবং পরিচ্ছন্ন কংগ্রেসের দাবি জানিয়ে প্রকাশ্য জনসভায় শাল পেঁচিয়ে আত্মহত্যার হুমকি দেন।

১৯৯৬ সালে পেট্রোলের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে মমতা সমাজবাদী পার্টির নেতা অমর সিংহের জামার কলার ধরে টানা-হেঁচড়া করেন মমতা। রেলের প্রতি অবহেলার অভিযোগে ১৯৯৭ সালে সংসদে তৎকালীন রেল-মন্ত্রী রাম বিলাসের দিকে নিজের শাল ছুঁড়ে মারেন। ১৯৯৮ সালে লোকসভায় নারী সংরক্ষণ বিলের বিরোধিতা করতে গিয়ে সমাজবাদী পার্টির এমপি দারোগা প্রসাদ সরোজকে জামার কলার ধরে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে আসেন।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৯৭ সালে তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করে। তৃণমূল কংগ্রেস খুব অল্প সময়ে বামফ্রন্টের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে প্রকাশ পায়।

তৃণমূল ১৯৯৯ সালে বিজেপির নেতৃত্বের সরকারে সামিল হলে রেলের দায়িত্ব পান মমতা। কিন্তু রাজনৈতিক মতানৈক্যের কারণে সরকার থেকে বের হয়ে যায় তৃণমূল।

২০০১ সালের শেষের দিকে বিধানসভা নির্বাচনের আগে মমতা কংগ্রেসের সাথে নির্বাচনী জোট করেন। তারপরেও নির্বাচনে বামফ্রন্ট জয় লাভ করে। ২০০৬ সালের বিধানসভার নির্বাচনেও বড়োসড়ো বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে মমতার তৃণমূল।

মমতা ২০০৪ সালে আবার ফিরে যান বিজেপির কোয়ালিশন সরকারে। তখন কয়লা এবং খনির দায়িত্বে ছিলেন। এটিই হিন্দুত্ববাদী বিজেপির সাথে মমতার শেষ কোয়ালিশন। কারণ বর্তমান ভোটের রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিজেপির সাথে জোট করা আর মমতার পক্ষে সম্ভব নয়।

২০০৬ সালে সিপিএম সরকারের শিল্পনীতির বিরোধিতা এবং ২০০৭ সালের নন্দী গ্রামের গণহত্যার প্রতিবাদের ফলে মমতার জনপ্রিয়তা অনেক বেড়ে যায়। কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের একটি বৃহৎ অংশ বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে চলে যায়। বামফ্রন্টের জনপ্রিয়তা কমতে থাকে।

২০০৯ সালে লোকসভার নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের ৪২ আসনের মধ্যে ১৯টি জয় করে তৃণমূল। নিজেদের উত্থানের ঘণ্টা বাজায়। কংগ্রেসের নেতৃত্বে সরকারে আবারও রেলের দায়িত্ব পান মমতা। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ৩৫ বছরে ক্ষমতায় থাকা সিপিএমকে হারিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসে। অভিযোগ রয়েছে, সারদা ১৩০ কোটি টাকা তৃণমূলের নির্বাচনে অর্থায়ন করেছিল, যার একটি বড় অংশ বাংলাদেশের জামায়াতকে  দিয়েছিল।

সংখ্যালঘুদের ভোট ব্যাংকটিই মমতার ক্ষমতার প্রাণশক্তি। নির্বাচনের আগে জামা মসজিদ শাহির ইমাম বুখারি এবং টিপু সুলতান মসজিদের ইমাম বারখাতি তৃণমূলের পক্ষে ভোট দেওয়ার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে মুসলমানদের তৃণমূলকে ভোট দেওয়ার আহবান জানান।

মমতার মত পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ জানেন, কেন লালু প্রসাদ যাদবকে সরিয়ে নীতিশ, মুলায়েম সিংকে সরিয়ে মায়াবতী ক্ষমতায় ছিল। এমনকি খোদ পশ্চিমবঙ্গেও কংগ্রেসের কাছ থেকে সিপিএম, এবং সিপিএমের কাজ থেকে নিজের দল তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় এবং লোকসভায় দ্বিতীয় বিরোধী দল।

মমতা এমন কিছু করতে চাইবে না যেন ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা তার বিপক্ষে চলে যায়। ক্ষমতায় আসার পরেই ৩০০০০ হাজার ইমামকে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ভাতা প্রদান হাইকোর্ট দ্বারা অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হলেও মমতার প্রতি সংখ্যালঘুদের বিশ্বাস বেড়ে যায়। তিস্তা পানি চুক্তি না করার পেছনেও অন্যতম কারণ হল- তিস্তার তীরে বসবাসকারী মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশই ধর্মীয় সংখ্যালঘু। মমতা জানেন ভারতের সংখ্যালঘু ভোট ব্যাংকটি কোনো দলের জন্য নির্দিষ্ট নয়। আগে প্রোগ্রেসিভ অল্টারনেটিভ তেমন ছিল না, এখন অনেক আছে।

মমতার নিজেও জানেন, ইমরানের মত সিমির অনেক প্রাক্তণ নেতার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কি? সংখ্যালঘু ভোট ব্যাংকটি ব্যবহার করে ইমরান খানের মত সিমির নেতারা ভারতের ভেতরে ও বাইরে ভারতের স্বার্থ বিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত, তা খোদ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের গোয়েন্দারই সন্দেহ করে।

সারদা কেলেঙ্কারিতে তার নিজ দলের জঙ্গি-বান্ধব রাজনীতিবিদ ইমরান থেকে শুরু করে মুনমুন সেনের মত অনেক সেলিব্রেটি জড়িত। যদি ইমরানের মাধ্যমে বাংলাদেশের জামায়াত টাকা নিয়ে ২০১১ সালের বিধান সভা ও ২০১৪ সালে লোকসভার নির্বাচন করা যায়, প্রশ্ন থেকে যায় কোন নৈতিক ক্ষমতার জোরে সারদার টাকা জামায়াতকে দিতে না করবেন মমতা?

অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, দেশের ভেতর জঙ্গি উত্থান ঘটল কিনা, তাও মমতার কাছে মুখ্য নয়।  মুখ্য সংখ্যালঘু ভোটের কিছু সুবিধাবাদী প্রতিনিধিকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় থাকা। এক্ষেত্রে শেখ হাসিনা আর বাংলাদেশ, অনেক দূরের বিষয়।

মমতা এমন এক রাজনীতিবিদ, যার কাছে নিজ দলের স্বার্থই প্রাধান্য পায়। নিজের স্বার্থের জন্য প্রথমে বিজেপি, পরে কংগ্রেস, আবার বিজেপি, আবার কংগ্রেস জোটে গিয়েছিল। চলতি বছরের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের আগে বিজেপি থেকে কোয়ালিশনের জন্য ইঙ্গিত দিলেও মমতার সাড়া পাওয়া যায়নি। কারণ বিজেপির বিপক্ষে গিয়ে সংখ্যালঘু ভোট ব্যাংকটি হারাতে হবে এই ভয়ে। 

ড: বিজন সরকার: গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, চন্নাম ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, সাউথ কোরিয়া, bipoly3001@yahoo.com - See more at: http://www.banglanews24.com/beta/fullnews/bn/324435.html#sthash.ve6ugkh2.dpuf

No comments:

Post a Comment