Saturday, June 14, 2014

বাবা দিবসে প্রিয়তম বাবা এবং চাচ্চুর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা- সুমি খান

আজ বাবা দিবস!

নশ্বর এ পৃথিবীতে কেউ চিরদিন থাকে না। আমিও থাকবো না।  আমার বাবা ও নেই ।


কিন্তু  ২০০৭ সালের ২৮ জুনের অন্ধকার ভোরের পর থেকে এক প্রগাঢ় শূন্যতার হাহাকার বুকের গহনে  ফিরে ফিরে আসে বারবার। আমার পরিশ্রম আর কাজের দায়বদ্ধতা যার কাছে অসীম ভালোবাসা আর সম্মানের ছিল। আমার অনুসন্ধানী  রিপোর্ট,  টপটেররদের এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ ....আমার  কাজ , মেধা, শ্রম আর সততার প্রতিটা স্বীকৃতি যিনি মাথার মুকুট হিসেবে পরে নিতেন নিজের সম্মান ভেবে-তিনি আমার বাবা সাইফুদ্দিন খান!



মিষ্টি মধুর বন্ধুত্ব নয়, ঝগড়াও হতো অনেক।

তবু আমার বাবা  আমার প্রাণের দোসর ছিলেন ।

 সেই শৈশব থেকেই আমার খেলাধুলা, দুরন্তপনা , ফাঁকিবাজি , রাজপথে আন্দোলন , সংগ্রাম , রিপোর্টিং য়ের চ্যালেঞ্জ, বেপরোয়া স্বভাব-সবকিছুতেই বাবার  যে কী অসীম প্রশ্রয় আর আত্মবিশ্বাস পেয়েছি! আজ প্রতি মুহুর্তে    বাবার অভাব প্রতিটি রক্তক্ষরণে আমি শিরায় শিরায় টের পাই! স্নায়ুতে স্নায়ুতে বলে উঠি-তোমার এ অক্ষম সন্তান তোমার আদর্শের বাস্তবায়ন ঘটাতে পারলো না বাবা! তুমি যে চলে গেলে!

আর যে কেউ নেই  যে আমায় হৃদয় উজাড় করে ভালোবেসে আমার কাজকে মাথার মুকুট করে আমার কাজ এগিয়ে নেবে দূর বহুদূর !

এসো না আব্বু ,  আমায় একটু আশীর্বাদ করে যাও! তোমার হাতের ছোঁয়া আমার মাথায় টের পাচ্ছি আব্বু!


তোমার সাথে যারা দিনের পর দিন অন্যায় অত্যাচার করে গেছে, সেই ঘাতকদের বিচার কাজ চলছে।  যদিও এই বিচার কাজ পদে পদে বাধা পাচ্ছে। আমি বিশ্বাস করি তোমার সহযোদ্ধাদের ঘাতক-তোমার অত্যাচারীদের বিচার হবেই ।


আমার কাজ যে  এগিয়ে নিতে হবে আরো আরো অনেক দূর! দূর আকাশে তাকিয়ে আছি- সেই ধ্রুবতারাটার দিকে। তোমার হাতটা দাও না , আব্বু! চোখের জল যে বাধ মানে না! অনেক অনেক কথা আজ বেদনার ঢল হয়ে অবিরল অশ্রুধারায় ঝরে পড়ছে!

বাবা দিবসেই শুধু নয়-সবসময়, সবখানে তুমি আছো আমার সাথে।

আমাকে পিছুটান বলতেন এক আন্ডারগ্রাউন্ড বিপ্লবী সেলিম চাচ্চু। তার প্রকৃত নাম পূর্ণেন্দু কানুনগো। কেলিশহরের বিশাল জমিদার পরিবারের এই সন্তান তাঁর সমস্ত জমিদারী মুসলিম প্রজাদের উৎসর্গ করে শ্রেণীভেদ প্রথা বিলুপ্ত করেছিলেন। কমিউনিষ্ট পার্টির কাজ করতে গিয়ে পাকিস্তান সরকারের রোষানলে পড়ে নির্যাতিত নিগৃহীত হয়েছেন। অনেক বছর আন্ডারগ্রাউন্ড থেকেছেন।  একাত্তরে আমাদের বাসায় যখন ছিলেন -বেরুবার সময়ে পিছু ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে নাকি বলতেন, আমিই তার পিছুটান। বড়ো হয়েও চাচ্চুকে দেখেছি -অসীম মেধা আর ব্যক্তিত্ব ছিল তাঁর ।  তাঁকে আদর্শ হিসেবেই প্রতিটি  কাজে স্মরণ করেছি। নিজেকে সমাজের হিতের জন্যে পরের স্বার্থে বলি দিয়েছেন যাঁরা-এই প্রজন্মের কাছে তাঁদের অবদান তুলে ধরবার কোন কাজ কমিউনিষ্ট পার্টি করছে না। বড়ো দুর্ভাগ্যজনক!

আজ বাবা দিবসে আমার বাবা সাইফুদ্দিন খান এবং আমার  চাচ্চু পূর্ণেন্দু কানুনগো কে অনেক মিস্ করছি।
তাঁদের  দিকনির্দেশনা বড়ো প্রয়োজন ছিল আজকের দিনে।


এই দু'টি মানুষের মানবতা এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা সমাজকে এগিয়ে নিয়েছে অনেক দূর! তাদের আদর্শ নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা জরুরী।  এর ফলে আমরা নতুন প্রজন্মে নিশ্চয়ই আরো অনেক পূর্ণেন্দু কানুনগো অথবা সাইফুদ্দিন খান কে খুঁজে পাবো। এই সমাজ কে যারা এগিয়ে  নেবে!!


লাল সালাম  চাচ্চু, লাল সালাম আব্বু!


sumikhan29bdj@gmail.com



Friday, June 13, 2014

মেজর জেনারেল মঞ্জুর কি জিয়া হত্যার সঙ্গে আদেী জড়িত ছিলেন?


মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর হত্যাকাণ্ড 'অভ্যুত্থান' ঢাকাতেই হয়েছে, চট্টগ্রামে নয় :লরেন্স লিফশুলৎজ 

পরবর্তী কয়েক বছরে এরশাদ ও তাঁর সহযোগীরা 'বিক্ষুব্ধ সেনা', 'উত্তেজিত জনতা' এবং 'বিক্ষুব্ধ মানুষের' হাতে মঞ্জুর হত্যার অনেক কাহিনি ফেঁদেছেন।
২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে বার্তা সংস্থা বিডিনিউজ-২৪ এই মামলার হাজিরায় এরশাদের এই বক্তব্য উদ্ধৃত করেছে, 'চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে আনার পর উত্তেজিত জনতা মঞ্জুরকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এই টানাহ্যাঁচড়ার মধ্যে নিরাপত্তারক্ষীরা গুলি ছুড়তে বাধ্য হয়। একপর্যায়ে মঞ্জুর গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান।' এরশাদের এক সহকর্মী মোস্তফা—লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোস্তফা কামাল ২০১৩ সালে আদালতে বলেছিলেন, 'কিছু বিক্ষুব্ধ মানুষ চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে
মঞ্জুরকে নেওয়ার পথে তাঁকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এতে নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে তাদের গুলিবিনিময় হয়। একপর্যায়ে মঞ্জুরের গায়ে বুলেট বিঁধে। হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান।'
এরশাদ ও তাঁর সহযোগীরা যে গল্প ফেঁদেছেন এবং ৩০ বছর ধরে ভাঙা রেকর্ডের
মতো বাজিয়ে চলেছেন, তার প্রধান দুর্বলতা হলো বাস্তবের সঙ্গে এর কোনো মিল
নেই। সে সময় চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন বা এ ঘটনা
প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁরা কেউই কখনো বলেননি যে তাঁরা 'বিক্ষুব্ধ মানুষ' বা
'বিক্ষুব্ধ অস্ত্রধারী' ব্যক্তিদের দেখেছেন, যাঁরা মঞ্জুরকে ছিনিয়ে
নেওয়ার চেষ্টা করলে গোলাগুলি হয়; আর মঞ্জুর এই 'টানাহ্যাঁচড়া'র কারণে
গুলিবিদ্ধ হন। কেউ কেউ বলেছেন, মঞ্জুরের 'নিরাপত্তারক্ষীরা' গুলি করেছিল;
আর কেউ বলেছেন, 'হাসপাতালে নেওয়ার পথে মঞ্জুর মারা যান।' কিন্তু কোনো
হাসপাতালেই মঞ্জুরকে সেদিন জীবিত বা মৃত বা আহত অবস্থায় দেখা যায়নি। কেবল
একজন সেনা চিকিৎসক তাঁকে দেখেছেন। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের
ব্রিগেডিয়ার আজিজ, ক্যান্টনমেন্টের দায়িত্বে তখন ছিলেন তিনি, দাফনের জন্য
মরদেহ প্রস্তুত করাতে তাঁকে মঞ্জুরের 'ক্ষত ব্যান্ডেজ' করে দিতে বলেন।
জিয়াউদ্দীন চৌধুরী তাঁর বইয়ে ফটিকছড়িতে মঞ্জুরের শান্তিপূর্ণ আত্মসমর্পণ
এবং তাঁর গতিবিধির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন। তাঁর বিবরণ বা
চট্টগ্রামের প্রত্যক্ষদর্শীদের কারও কথার সঙ্গেই এরশাদ ও তাঁর সহযোগীদের
গল্পের ন্যূনতম কোনো মিল নেই। চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক হিসেবে
জিয়াউদ্দীন চৌধুরী ১ জুন মঞ্জুরের গ্রেপ্তার হওয়া থেকে শুরু করে
হাটহাজারী থানায় সেনাবাহিনীর হাতে তাঁকে সোপর্দ করা পর্যন্ত প্রতিটি
ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন বা ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেছেন। এমনকি মঞ্জুর নিরাপদে
ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছালেন কি না, সেটিও দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ারের কাছ
থেকে তিনি শুনে নিশ্চিত হয়েছেন।
জিয়াউদ্দীন চৌধুরীর ভাষ্যের সঙ্গে এরশাদের ভাষ্যের তুলনা করা যাক:
'মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের পরদিন সরকারি তথ্য বিবরণীতে বলা হয়, তাঁকে
ক্যান্টনমেন্টে নেওয়ার পথে বিক্ষুব্ধ সৈন্যদের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে
মঞ্জুর মৃত্যুবরণ করেছেন। এই প্রতিবেদন ছিল একটি ডাহা মিথ্যা।
'ক্যান্টনমেন্টে নেওয়ার পথে মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়নি। ব্রিগেডিয়ার আজিজ
পুলিশের ডিআইজিকে বলেছিলেন, ২ জুন সকালবেলা মঞ্জুরকে চট্টগ্রাম
ক্যান্টনমেন্টে হত্যা করা হয়। আজিজ এ কথা বলেননি যে মঞ্জুর বিক্ষুব্ধ
সৈন্যদের হাতে মারা পড়েছেন...
'চিকিৎসককে যখন মঞ্জুরের "ক্ষত ব্যান্ডেজ" করতে বলা হয়, তখন তিনি দেখতে
পেলেন, একটিমাত্র গুলির আঘাতে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। গুলিটি তাঁর মাথা ফুঁড়ে
বেরিয়ে যায়। তাঁর মৃত্যুর জন্য একঝাঁক বুলেট দরকার হয়নি...ঢাকা থেকে আসা
এক সেনা কর্মকর্তা মঞ্জুুরকে হত্যা করেন, বিক্ষুব্ধ সৈন্যরা নয়। তাঁকে
কেন হত্যা করা হবে? কেন বিচারের মুখোমুখি করা হবে না? তিনি কি এমন কিছু
জানতেন, সেনাবাহিনী যা প্রকাশিত হতে দিতে চায়নি?'
এ ধরনের মিথ্যা ও প্রচ্ছদকাহিনির সমস্যা হচ্ছে, এর প্রণেতারা অনেক সময়
নিজেদের লেখা চিত্রনাট্য নিজেরাই ভুলে যান। নিজেদের গা বাঁচাতে
'বিক্ষুব্ধ সৈন্য'দের হাতে মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের যেসব গল্প এরশাদ ও তাঁর
সহযোগীরা ফেঁদেছেন, তার প্রতিটিতে বলা হয়েছে যে পুলিশ তাঁকে সেনাবাহিনীর
বিশেষ ইউনিটের কাছে হস্তান্তর করার পর চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে 'নেওয়ার
পথে' তাঁকে হত্যা করা হয়।
তার পরও, সিআইডির কাছে দেওয়া সাক্ষ্যে পুলিশের আইজি এ বি এম জি কিবরিয়া
জানিয়েছেন, তিনি এরশাদকে সরাসরি প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন,
'চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে আনার পরই মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়।'
কিবরিয়া এর আগের দিনই মঞ্জুরকে পুলিশের কাছ থেকে সেনা হেফাজতে আনার
সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি এরশাদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন,
মঞ্জুরকে কীভাবে হত্যা করা হয়?
সাক্ষ্যে কিবরিয়া বলেন, '২ জুন বিকেলবেলা বঙ্গভবনে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির
সভাপতিত্বে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে আমি চিফ অব আর্মি স্টাফের কাছে
জানতে চাই, মঞ্জুরকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে? আদতে তো তাঁর প্ররোচনায়
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি মঞ্জুরকে সেনা হেফাজতে নেওয়ার নির্দেশ দেন, যাঁদের
হাতে—এক অর্থে তাঁরই হেফাজতে—মঞ্জুরের মৃত্যু হলো। এরশাদের জবাব ছিল,
চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়ার পরপরই বিক্ষুব্ধ সেনাদের
গুলিবর্ষণে মঞ্জুর নিহত হন। এয়ার ভাইস মার্শাল সদরুদ্দীনের মতো কিবরিয়াও
এরশাদের 'বিক্ষুব্ধ সেনা'দের হাতে মঞ্জুর হত্যার গল্প বিশ্বাস করেননি।
কিবরিয়া তাঁর সাক্ষ্যে এরশাদের নিজের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতেই বলেছেন যে
মঞ্জুরকে 'ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়ার পথে' হত্যা করা হয়নি। এটা একটা
তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য। এরশাদের স্বীকারোক্তির পর কিবরিয়া কীভাবে ত্বরিত
পদক্ষেপ নিয়েছেন, তা-ও তিনি বলেছেন। প্রথমে একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ
কর্মকর্তাকে তিনি চট্টগ্রামে পাঠান। পরে নিজেই সেখানে যান। চট্টগ্রামে
অবস্থিত তাঁর সহকর্মীদের তিনি বঙ্গভবনের বৈঠকের কথা জানিয়ে পুলিশ হেফাজতে
থাকা সেনা কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা নিয়ে এই শঙ্কা প্রকাশ করেন যে
সেনাবাহিনী হয়তো এদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিতে পারে।
কিবরিয়া ব্যাখ্যা করেন, মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের পর 'বেসামরিক কর্তৃপক্ষের
হাতে গ্রেপ্তার হওয়া সেনা কর্মকর্তাদের সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার
জন্য এরশাদের দাবি অগ্রাহ্য করে' তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ
নিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে তিনি কীভাবে প্রভাবিত করেন। স্পষ্টভাবেই তাঁর
মনে ভয় ছিল, সেনা হেফাজতে নিয়ে গেলে এদেরও মঞ্জুরের ভাগ্য বরণ করতে হবে।
সত্যিই তাই। পরের কয়েক মাসে বহু সেনা কর্মকর্তাকে সেনা হেফাজতে এনে
ব্যাপক নির্যাতন করা হয়। এরপর চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে অনুষ্ঠিত
ফিল্ড কোর্ট মার্শালে তাঁদের বিচার করা হয়। ফাঁসিতে ঝোলানো হয় ১৩ জনকে।
তৎকালীন অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরীর
ভাষ্যমতে, এই হতভাগারা নিরপেক্ষ বিচার ও যথাযথ আইনি সুরক্ষা পাননি, যা
ছিল তাঁদের মৌলিক অধিকার। আগেই বলেছি, জুলফিকার আলী মানিক তাঁর সেই সাহসী
বইয়ে এসব কথা লিপিবদ্ধ করেছেন।
নোংরা সত্যটি হচ্ছে এই যে ওই মানুষগুলোকে এমন এক 'অভ্যুত্থানের' অভিযোগে
বিচার করা হয়, যেটি আদতে কোনো 'অভ্যুত্থান' ছিল না বা সেই বিদ্রোহ কোনো
দিন সম্পন্ন হয়নি। কিন্তু জিয়া আবুল মঞ্জুরের হাতে নিহত হননি; কিংবা
যাঁদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে, তাঁদের হাতেও নন।
সেনাবাহিনীতে এরশাদের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার অভিপ্রায়ে তাঁদের ভিত্তিহীন ও
নিষ্ঠুরভাবে প্রাণ দিতে হয়। বলির পাঁঠা বানানোর জন্য এরশাদের দরকার ছিল
একটি 'অপরাধী চক্র'।
জেনারেল মইন ও জুলফিকার আলী মানিক তাঁদের বইয়ে জানিয়েছেন, এরশাদ নির্যাতন
করে 'স্বীকারোক্তি আদায় করেছেন, কিন্তু তথাকথিত বিচারটি চলেছে
উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে, কোনো তদন্ত ছাড়াই। মেজর জেনারেল মহব্বতজান চৌধুরীর
নির্দেশে বিচার ও শাস্তির প্রক্রিয়াটি পরিচালিত হয়।
খালেদা জিয়া কি সত্যি সত্যিই এরশাদকে তাঁর স্বামী হত্যার জন্য অভিযুক্ত
করেছিলেন? প্রকৃত 'অভ্যুত্থান' তাহলে ঢাকাতেই হয়েছে, চট্টগ্রামে নয়।
লেখাটি ছাপাখানায় যাওয়ার পর প্রথম আলোর হাতে থাকা কিছু দলিল আমার হাতে
এসেছে। দলিলগুলো হচ্ছে ১৯৮১ সালের মে-জুন মাসের সেই নিয়তি-নির্ধারক
দিনগুলোতে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যেসব সদস্য চট্টগ্রামে ছিলেন, সিআইডির
কাছে দেওয়া তাঁদের সাক্ষ্য। এসব সাক্ষ্য আমাদের সামনে কিছু নতুন প্রশ্ন
উত্থাপন করেছে। এই লেখা শেষ হওয়ার পর একটি উপসংহার পর্বে সেগুলো নিয়ে আমি
আলোচনা করব।
হত্যা মামলা
এসব সাক্ষ্য-প্রমাণ কী অগ্রাহ্য করা হবে? বিচারপতি কি আমার সোর্সের
চূড়ান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে, নতুন এই প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য না
নিয়ে তাঁর রায় ঘোষণা করবেন? যে মানুষটি বললেন, তিনি চট্টগ্রাম
ক্যান্টনমেন্টে উপস্থিত ছিলেন, একজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাকে মঞ্জুরের
সেলে ঢুকতে দেখেছেন, আর সেখানেই নাকি মঞ্জুর খুন হন—তাঁর সাক্ষ্য কি
উপেক্ষা করা হবে?
বিচারপতি ফিরোজ বা কোনো উচ্চ আদালত কি এই সাক্ষীর নিরাপদে সাক্ষ্য দেওয়ার
পরিবেশ সৃষ্টি করবেন? এয়ার ভাইস মার্শাল সদরুদ্দীন, আইজিপি কিবরিয়া এবং
অন্যদের দশক দশক ধরে চাপা পড়ে থাকা সাক্ষ্য কি শোনা হবে, নাকি অগ্রাহ্য
করা হবে?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি তাঁর সদ্য নিযুক্ত 'বিশেষ দূত' জেনারেল
এরশাদ, যিনি এ মামলার অন্যতম সন্দেহভাজন, তাঁর সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে
সুবিধাজনক সমীকরণের স্বার্থে আপসরফা চালিয়ে যাবেন? নাকি প্রজ্ঞা জয়ী হবে?
অথবা এই নিশ্চয়তা প্রতিষ্ঠিত হবে যে বিচার বিভাগের কাজে নির্বাহী বিভাগ
আর হস্তক্ষেপ করবে না।
শেখ হাসিনা কি এই নতুন তথ্যের ভিত্তিতে একজন হত্যা মামলার সন্দেহভাজনের
সঙ্গে রাজনৈতিক আপসরফা বন্ধ করবেন?
এরশাদ শুধু হত্যা মামলার প্রধান সন্দেহভাজনই নন, সেনাপ্রধান হিসেবে বহু
সেনা কর্মকর্তাকে নির্যাতন করে তাঁদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করার
ঘটনায়ও তিনি একজন হুকুমের আসামি। এসব স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে তাঁদের
'দণ্ডিত' এবং পরবর্তীকালে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। এ ধরনের কাজ একদিকে
বাংলাদেশের সংবিধানের খেলাপ, অন্যদিকে নির্যাতন এবং অন্যান্য অমানবিক ও
অবমাননামূলক আচরণবিরোধী আন্তর্জাতিক রীতি-নীতিরও পরিপন্থী। তদুপরি, এরশাদ
সেনাপ্রধান থাকাকালে বেশ কয়েকটি ফিল্ড কোর্ট মার্শালে বিবাদীর অধিকার
লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এই সবগুলো অপকর্মের বিরুদ্ধেই
ব্যবস্থা গ্রহণের অবকাশ রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীকে আমি বহু দিন ধরেই চিনি-জানি। আমার মনে হয় না, তাঁর সব
ঔচিত্যবোধের মৃত্যু ঘটেছে। তিনিও হত্যাকাণ্ডের নির্মম শিকার হওয়া একজন
মানুষের কন্যা। তাঁর নিহত স্বজনদের হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার পেতে তিনি
বহু দিন ধরে অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়েছেন। মঞ্জুরের সন্তানদের চেয়ে কি
তিনি অধিকতর সুবিধাভোগী যে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারী একই রাজনৈতিক
শক্তির হাতে মঞ্জুর নিহত হওয়ার পরও তাঁরা ন্যায়বিচার পাবেন না?
মঞ্জুরের পরিবারও সেই জবাবদিহি দেখতে চায়, যা প্রধানমন্ত্রী তাঁর পিতা,
মাতা, ভাই, বোনদের হত্যাকাণ্ডের জন্য দাবি করেছিলেন। নতুন তথ্যের আলোকে
আমরা এই প্রত্যাশা করি যে শেখ হাসিনা তাঁর 'বিশেষ দূত'-এর কাছ থেকে সরে
এসে মঞ্জুরের সন্তানদের পাশে এসে দাঁড়াবেন; তাদের বলবেন, 'তোমাদের
ন্যায়বিচারের দাবিতে আমি বিপক্ষে নই, বরং পাশে আছি।'
শেখ হাসিনার সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ দিল্লিতে ১৯৮০ সালের প্রথম দিকে।
তিনি তখন একটি সাদামাটা ঔপনিবেশিক কেতার বাংলোয় বসবাস করতেন। তাঁর
নিরাপত্তা ছিল সুনিশ্চিত, তবে গোপন। দুর্বল হলেও তাঁকে
আত্মমর্যাদাসম্পন্ন একজন নারী বলেই আমার মনে হলো। তখনো তিনি তাঁর
স্বজনদের মৃত্যুর শোক বয়ে চলেছেন। কে-ই বা এর ব্যতিক্রম? তাঁর চোখেমুখে
শোক ও আতঙ্কের ছাপ ছিল স্পষ্ট। ঘরের ভেতর একটি শোকের আবহ সৃষ্টি হলো।
প্রায় প্রতিটি কথাতেই তিনি অশ্রুসজল হয়ে উঠছেন। হূদয়বিদারক! ১৯৭৫ সালের
'অভ্যুত্থানে'র পেছনের ঘটনা উন্মোচন করার জন্য আমি যে বইটি লিখেছিলাম,
শেখ হাসিনা তার জন্য আমাকে ধন্যবাদ জানান।
আগস্টের সেই ঘটনার পর অনেকটা দিন চলে গেছে। তবু তাঁর সঙ্গে সেই প্রথম
সাক্ষাতে অপরিমেয় সেই শোকের প্রতি আমি আমার সমবেদনা জানাই। তিনি আমার কথা
শোনেন। আমি কথা বলার পর তিনি বেশ নীরব ছিলেন। ভাঙা গলায় ধন্যবাদ ও
শুভেচ্ছা জানানোর পর তিনি প্রায় কোনো কথাই বলতে পারছিলেন না। আমরা তখন
শোকাবহ স্মৃতি দূরে ঠেলে রেখে চা পান করতে করতে সামান্য কথা বলার চেষ্টা
করি।
ঢাকায় ১৯৭৩-৭৪ সালে একজন তরুণ প্রতিবেদক হিসেবে তখনকার বিক্ষোভ ও
দুর্ভিক্ষ নিয়ে আমি বেশ সমালোচনামুখর ছিলাম। তার পরও সেই 'অভ্যুত্থান'
এবং তাতে নিহত নিরীহ মানুষের মৃত্যুর বিনিময়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যে
ভূত আবারও জেগে ওঠে, তার খপ্পর থেকে মুক্ত হওয়ার কোনো পথই খোলা ছিল না।
পরবর্তী বছরগুলোতে শেখ হাসিনা দৃঢ় সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭৫ সালের
হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে তবেই থেমেছেন।
কিছুদিন আগে মঞ্জুরের বড় মেয়ে রুবানার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে শেখ হাসিনার
সঙ্গে আমার দিল্লির সেই বৈঠকের কথা মনে পড়ে গেল। আবারও দেখলাম, পিতার
মৃত্যু এবং এর পরবর্তী তিনটি দশক ধরে তাঁরা যে অমানুষিক যন্ত্রণার মধ্য
দিয়ে গেছেন, সেসব কথা বলতে গিয়ে তাঁর গলা ভেঙে আসছে।
সেই আলাপচারিতার কথা বলার স্বাধীনতা আমার নেই। কিন্তু আমি জানি, সেই
শোকের গভীরতা যদি অল্প কেউ উপলব্ধি করে থাকেন, তাহলে শেখ হাসিনাই তা
করেছেন।
শেখ হাসিনা চাইলে তাঁর পিতা-মাতার কবরে যেতে পারেন। সব পিতা-মাতাহীন
সন্তানই তা করে থাকেন। তাঁদের শেষ বিশ্রামস্থলে যাওয়া প্রতিটি মানুষের
জন্যই এক গভীর সান্ত্বনার বিষয়। এটি আরও বিশেষ হয়ে ওঠে, যদি কেউ সহিংসতার
কারণে মারা যান। জেনারেল মঞ্জুরের স্ত্রী ও সন্তানেরা জানেন না, তাঁদের
স্বামী ও পিতার আদৌ কোনো কবর আছে কি না। সেখানে গিয়ে তাঁদের প্রার্থনা
করার সুযোগটুকুও নেই।
মৃত্যুর মামলা ও সংশ্লিষ্ট সেই পরিবারের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির
আকাঙ্ক্ষাকে কারোরই রাজনৈতিক ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা উচিত নয়। এটি
বিবেচনাবোধহীন একটি ব্যাপার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন করব,
দয়া করে আপনার যে পরামর্শকেরা এর বিপরীত কথা ভাবেন, তাঁদের কথা শুনবেন
না।

'অভ্যুত্থান' ঢাকাতেই হয়েছে, চট্টগ্রামে নয় (পরের অংশ )
অপরাধী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ
আমি মনে করি, জেনারেল এরশাদ ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে জেনারেল মঞ্জুর
হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা
নির্দোষ। তাঁদের বিচার স্বচ্ছ হওয়া উচিত। এর ভিত্তি হবে পেশাদারির
ভিত্তিতে পাওয়া তথ্য-প্রমাণ ও যোগ্য প্রসিকিউশন।
আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একটি পবিত্র ব্যাপার।
যদিও তথাকথিত সেই চট্টগ্রাম বিদ্রোহের ঘটনায় যে তরুণ সেনা কর্মকর্তাদের
এরশাদ নির্যাতন করে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন, তাঁদের তিনি এ অধিকারের সুযোগ
দেননি। কিন্তু যে অধিকার এরশাদ তাঁদের দেননি, ন্যায়বিচারের স্বার্থে
তাঁকে সেই অমূল্য অধিকারটি দিতে হবে।
মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত এমন আরও অনেকে থাকতে পারে, যাদের
বিরুদ্ধে এখনো পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করা হয়নি। আমার ধারণা, আমার
সাক্ষী যে ব্যক্তির নাম বলেছিলেন, তিনি অভিযোগপত্রে নেই। কথিত আছে, সেই
ব্যক্তিই মঞ্জুরকে হত্যা করেন। তিনি একজন উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা।
মঞ্জুরকে হত্যা করতেই তিনি ঢাকা থেকে এসেছিলেন। আবার মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডে
একমাত্র তিনিই নন, আরও অনেকেই জড়িত থাকতে পারেন। এ অভিযোগ সত্য হলে যে
ব্যক্তিটি ট্রিগার চেপেছিলেন, তিনি একাই নিশ্চয়ই সবকিছু করেননি।
তদুপরি ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী আমার সেই সোর্সই এ ঘটনার একমাত্র
প্রত্যক্ষদর্শী নন। মঞ্জুরের সেলে সেই ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাকে অনেকেই
প্রবেশ করতে দেখেছেন। তাঁর সেই প্রবেশাধিকারকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ভয়ের
কারণে অনেকে গত ৩০ বছরে মুখ খোলেননি। এই ভীতি দূর করার মতো একটি
পরিস্থিতি কি সৃষ্টি হয়েছে বা তা কি সৃষ্টি করা সম্ভব? যাঁরা এ
হত্যাকাণ্ড পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করেছেন, এভাবে তাঁদের পার পাওয়ার সময়
কি শেষ হবে?
বড় একটি পরিবর্তনের সময় এসেছে। নিম্ন আদালতে এ মামলাটি যেভাবে পরিচালনা
করা হয়েছে, তাতে ন্যায়বিচারকে প্রহসন করা হয়েছে। আর যাঁরা এটি পরিচালনা
করেছেন, তাঁরা নিজের পেশার সঙ্গে গুরুতর অসদাচরণ করেছেন। দুই দশকে ২২ জন
বিচারক এ মামলার শুনানিতে অংশ নিয়েছেন। পরে আবার তাঁদের অন্য দায়িত্বে
পাঠানো হয়েছে। রাজনৈতিক ফুটবল হিসেবে মামলাটিকে নিয়ে খেলাধুলা চলছেই।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমে খোলাখুলিই বলা হচ্ছে যে এই মামলাটিকে জেনারেল
এরশাদের সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা
হচ্ছে। বিনিময়ে এরশাদ সরকারকে তাঁর পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন এই আশায়, যাতে
মামলাকে পুরোপুরি হাওয়া করে দেওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
মঞ্জুরের ভূত এরশাদকে তটস্থ করে রেখেছে। এ মামলার সমাপ্তি নেই।
সম্প্রসারণশীল বাজারে পণ্যের মূল নির্ধারণ করতে গিয়ে বাংলাদেশের
রাজনীতিতে বারবার যা মার খেয়েছে, তা হলো নৈতিকতা। আর এই পণ্য হচ্ছে
ন্যায়বিচার। এর বিকিকিনি হয়েছে বন্ধ দরজার অন্তরালে। বাংলাদেশে একটিমাত্র
প্রতিষ্ঠানই এই পণ্যের বাজার বন্ধ করে দিতে পারে, সেটি হলো সুপ্রিম
কোর্ট।
'জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট' হলে সুপ্রিম কোর্ট যেকোনো মামলাকে নিম্ন আদালত থেকে
তাঁর ক্ষমতাবলে সরিয়ে নিতে পারেন। এই মামলাটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে।
এই মামলার মধ্যে বাংলাদেশে এক দশকের সামরিক শাসনের বীজ নিহিত রয়েছে।
মঞ্জুরের হত্যকাণ্ড সেই বীজের প্রাণকেন্দ্র। এই মামলাটি যদি
'জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট' মামলার আওতায় না পড়ে, তাহলে আর কোন মামলা পড়তে
পারে, তা আমি জানি না। হয়তো অন্য কোনো বেশি গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড রয়েছে।
তাদের পিতা 'খুনি' ও 'বিশ্বাসঘাতক'—এই অশেষ কানাকানিতে চারটি সন্তান
বাংলাদেশ ছেড়েছে। এই ফিসফিস তাদের প্রতিনিয়ত আহত করেছে। এটি তাদের স্কুলে
তাড়া করে ফিরেছে। যে বাসায় তারা গেছে, সেখানে তাড়া করেছে। তাদের অনেক
পুরোনো বন্ধুও এ কারণে তাদের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।
বাংলাদেশ কীভাবে 'মিথ্যার ভাইরাস'-এ আক্রান্ত হয়েছে, তা সত্যিই খতিয়ে
দেখার মতো বিষয়। কিন্তু এই মিথ্যার বলি হয়েছে এক নির্দোষ মানুষের
সন্তানেরা। তাদের পিতাকে যথাযথভাবে সমাধিস্থ করার অধিকার তাদের দিতে হবে।
এরপর বাকি জীবনটা নির্বিঘ্নে যাপন করার জন্য যে দেশে তাদের ঘর, সেখানে
তাদের প্রত্যাবর্তন করতে দিতে হবে।
মঞ্জুরের আসল 'অপরাধ', সামরিক শাসনের পাঁয়তারা করা ক্ষমতামদমত্ত কিছু
মানুষের তিনি বিরোধিতা করেছিলেন। আসলে সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ
কর্মকর্তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন স্বল্পসংখ্যক গণতন্ত্রমনা
'সংবিধানপন্থী'দের একজন, যেমন ছিলেন জেনারেল মইনও, যাঁরা কখনোই আইয়ুব
খানের বাংলাদেশি কোনো সংস্করণকেই বঙ্গভবনের মসনদে আসীন দেখতে চাননি, তা
সে জিয়া বা এরশাদ যে নামেই হোক না কেন। উপরন্তু তাঁরা ছিলেন
ক্যান্টনমেন্টভিত্তিক কোনো রাজনৈতিক দলের উত্থানের বিরোধী। এটা কি
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য অভিশাপ হয়ে ওঠেনি? পাকিস্তানের জন্যও কি এটা
এখনো অভিশাপ নয়? এ দুই ব্যক্তি দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য লড়াই
করেছেন। তাঁরা গণতান্ত্রিক দেশে পেশাদার সেনাবাহিনীর পক্ষে ছিলেন।
পরিশেষে, মঞ্জুরের বিধবা স্ত্রী মার্কিন মুলুক থেকে কখনোই দেশে ফিরতে চান
না। কারণ, কখনোই তিনি ন্যায়বিচার পাবেন বলে মনে করেন না। তাঁর স্বামীকে
হত্যাকারী পার পেয়ে গেছে। সাক্ষ্য-প্রমাণও তা-ই বলে।
হয়তো আরেকটি পথ খোলা আছে। সে পথ গিয়ে ঠেকেছে সুপ্রিম কোর্টে। মঞ্জুরের
ভাই বা তাঁর সন্তানেরা আদালতের সামনে দাঁড়িয়ে নিম্ন আদালতের অন্তহীন জাল
থেকে মামলাটি বের করে আনার আবেদন করলে, তা অনুমোদন করা উচিত। গত ২০ বছরে
এই মামলাটি সেখানে আশা-প্রত্যাশাহীনভাবে মাটিচাপা পড়েছে।
তাহেরের মামলায় বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দীন চৌধুরী ও বিচারপতি জাকির
হোসেন অনন্য নজির স্থাপন করে দেখিয়েছেন যে ঘটনার বহু বছর পরও কীভাবে একটি
মামলার নিষ্পত্তি করা সম্ভব। তাঁরা নিজেরা উদ্যোগী হয়ে জটিল বিষয়গুলোর
তদন্ত ও সাক্ষী নির্বাচন করে তাঁদের আদালতের সামনে হাজির হওয়ার নির্দেশ
দিয়েছিলেন।
প্রয়োগ করার মতো বিপুল ক্ষমতা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের হাতে রয়েছে।
ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য জরুরি মনে করলে আদালত তা করে থাকেন। তাহের
ও মঞ্জুর হত্যা মামলা এক রকম নয়।
তাহেরের বিচার সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু বলা হয়েছে, সেটি ছিল অবৈধ ও
অসাংবিধানিক। উপরন্তু সেই বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগেই তাহেরের
মৃত্যুদণ্ডের বিধান সুনির্দিষ্ট করে রাখা হয়েছিল। আদালত মত দিয়েছিলেন,
সেই বিচারটি নিজেই ছিল একটি অপরাধ। সেটি ছিল একটি অবৈধ বিচারপ্রক্রিয়া।
সে কারণে তাহেরের মৃত্যুদণ্ডাদেশ ছিল হত্যাকাণ্ডের সমতুল্য।
মঞ্জুরের ক্ষেত্রে বিষয়টি তা নয়। এটি এখনো একটি চলমান বিচারপ্রক্রিয়া। ২০
বছর চলার পরও এখনো পর্যন্ত এ মামলায় কোনো রায় দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশের
অসামান্য এক অ্যাটর্নি জেনারেল আমিনুল হক ১৯৯০-এর দশকের প্রথম ও মধ্যভাগে
এ মামলার এক পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তপ্রক্রিয়ার সূচনা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর
অকালমৃত্যুর পর সেসবের আর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।
এয়ার ভাইস মার্শাল সদরুদ্দীনের মতো মানুষদের সাক্ষ্য সবে আলোর মুখ দেখতে
শুরু করেছে। এটি যে সম্ভব হয়েছে, তার পেছনে আছে সেই সময়ে আমিনুল হকের
অভিভাবকসুলভ সতর্ক পদক্ষেপ। সর্বোচ্চ আদালতের হাতে এই মামলার সূত্রগুলো
একত্র করে জেনারেল আবুল মঞ্জুরের হত্যাকারীকে খুঁজে বের করার ক্ষমতা আছে।
মঞ্জুর হত্যা মামলা বাংলাদেশের বিবেককে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। এটা
কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, তা-ই এখন দেখার বিষয়।
'জেনারেল এরশাদ, আমি কি জানতে পারি, আপনি কোন পরিকল্পনার কথা বলছেন?'
এয়ার ভাইস মার্শাল সদরুদ্দীনের সাক্ষ্য
মঞ্জুর হত্যা মামলায় ২৫ মার্চ ১৯৯৫ সিআইডিকে দেওয়া জবানবন্দির চুম্বক অংশ
'তাঁরা আমাকে বলেন যে এখানে মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে [জিয়া হত্যাকাণ্ডে]
ফাঁসানোর একটা পরিকল্পনা চলছে'
৩১ মে ১৯৮১
আমি এয়ার ভাইস মার্শাল সদরউদ্দীন (অব.), সাবেক বিমানবাহিনী
প্রধান।...সকাল আনুমানিক সাড়ে সাতটার সময় আমাকে জানানো হয় যে জেনারেল
এরশাদ টেলিফোনে আমার সঙ্গে কথা বলবেন। আমি টেলিফোন ধরি। জেনারেল এরশাদ
আমাকে আগের রাত্রে চিটাগাং সার্কিট হাউসে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত
হওয়ার সংবাদ দেন এবং দ্রুত ঢাকায় ফিরে আসার জন্য অনুরোধ করেন। আমি
কিছুক্ষণ পর ঢাকার উদ্দেশে হেলিকপ্টারযোগে রওনা হই এবং আনুমানিক ১০টার
সময় ঢাকায় ফিরে আসি।
আমি সরাসরি আর্মি হেডকোয়ার্টারে সেনাপ্রধানের অফিসে যাই। আমি তাঁর অফিসে
গিয়ে বেশ কিছু ঊর্ধ্বতন আর্মি অফিসারকে তাঁর অফিসে দেখি। তাঁদের মধ্যে
মেজর জেনারেল মীর শওকত আলী, মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী, মেজর
জেনারেল মান্নাফ, মেজর জেনারেল নূরউদ্দীনসহ অন্য আরও কিছু আর্মি অফিসারকে
দেখি। সেখানে তাঁরা চিটাগাংয়ে প্রেসিডেন্ট নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে আলোচনা
করছিলেন। জেনারেল এরশাদ আমাকে ঘটনা দ্রুত জানালেন। আমি সেখানে আনুমানিক
২০ মিনিট ছিলাম। সেখান থেকে বের হয়ে আসার পথে মেজর জেনারেল শওকত ও মেজর
জেনারেল মইন আমার পেছনে পেছনে আসেন। আসার পথে করিডরে তাঁরা আমাকে বলেন যে
এখানে মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে ফাঁসানোর একটা পরিকল্পনা চলছে।
......
'স্যার, দয়া করে নিশ্চিত করুন যাতে মঞ্জুরের কিছু না হয়'
১ জুন ১৯৮১
বিকেল আনুমানিক সাড়ে পাঁচটার সময় আমি বঙ্গভবনে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির
[বিচারপতি আবদুস সাত্তার] অফিসে ছিলাম। তখন সেখানে লে. জেনারেল এরশাদও
ছিলেন। আমরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলাম। এই সময় টেলিফোন আসে।
প্রেসিডেন্ট টেলিফোনে কথা বলেন। প্রেসিডেন্ট টেলিফোন রেখে জানান, আইজিপি
কিবরিয়া জানিয়েছেন যে মেজর জেনারেল মঞ্জুর এবং অন্যরা পুলিশের হাতে ধরা
পড়েছেন।
সংবাদটি বলার সঙ্গে সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে জেনারেল এরশাদ উত্তেজিত অবস্থায়
চেয়ার থেকে উঠে পড়েন। আর কিছু না বলে সরাসরি প্রেসিডেন্টের পাশে রেড
টেলিফোনের কাছে যান এবং একটি নাম্বারে ডায়াল করেন। টেলিফোনে তাঁর যে
কথাটি শুনতে পেলাম তা হলো, 'মঞ্জুরকে পুলিশ আটক করেছে। এক্ষুনি তাঁকে
নিয়ে নাও। তারপর পরিকল্পনামতো কাজ করো।' বলেই তিনি টেলিফোন রেখে দেন।
তখন আমি বলি, 'জেনারেল এরশাদ, আপনি কোন পরিকল্পনার কথা বলছেন, আমি কি
জানতে পারি?' এতে তিনি আবার বেশ উত্তেজিত হয়ে বলেন, 'এয়ার চিফ, আপনি
কিছুই বোঝেন না।' আমি বলি, 'আমি কী বুঝি না বুঝি, আপনার কাছ থেকে জানতে
হবে না।'
পরে আমি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির উদ্দেশে বলি, 'স্যার, দয়া করে নিশ্চিত করুন,
যাতে মঞ্জুরের কিছু না হয় আর তিনি ন্যায্য বিচার পান। মঞ্জুরের কিছু হলে
জাতির কাছে আপনাকে জবাব দিতে হবে।' এর উত্তরে সাত্তার সাহেব বিচার করা
হবে বলে জানান।
......
'আপনারা জেনারেল মঞ্জুরকে মেরে ফেললেন'
২ জুন ১৯৮১
ভোর রাত্রি আনুমানিক দেড়টা-দুইটার দিকে উইং কমান্ডার কামাল, ডিরেক্টর,
এয়ার ইন্টেলিজেন্স, টেলিফোনে মেজর জেনারেল মঞ্জুরের হত্যার খবর দেন। আমি
সকাল আনুমানিক ছয়টা-সাতটার সময় এরশাদ সাহেবকে টেলিফোনে বলি, 'এরশাদ
সাহেব, আপনারা জেনারেল মঞ্জুরকে মেরে ফেললেন?' (শেষ)
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন

লরেন্স লিফশুলৎজ
ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউর (হংকং) দক্ষিণ এশিয়া প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি
দ্য গার্ডিয়ান, লে মঁদ দিপ্লোমাতিক, দ্য নেশন (নিউইয়র্ক) ও বিবিসির পক্ষে
লিখেছেন। তিনি বেশ কিছু বই রচনা ও সম্পাদনা করেছেন; এর মধ্যে রয়েছে
বাংলাদেশ: দি আনফিনিশ্ড্ রেভল্যুশন, হিরোশিমা'জ শ্যাডো ও হোয়াই বসনিয়া?
OpenDoor.Lifschultz@gmail.com

মেজর জেনারেল মঞ্জুর জিয়া হত্যার সঙ্গে কী আদেী জড়িত ছিলেন?
মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর হত্যাকাণ্ড
'অভ্যুত্থান' ঢাকাতেই হয়েছে, চট্টগ্রামে নয়
লরেন্স লিফশুলৎজ |
পরবর্তী কয়েক বছরে এরশাদ ও তাঁর সহযোগীরা 'বিক্ষুব্ধ সেনা', 'উত্তেজিত
জনতা' এবং 'বিক্ষুব্ধ মানুষের' হাতে মঞ্জুর হত্যার অনেক কাহিনি ফেঁদেছেন।
২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে বার্তা সংস্থা বিডিনিউজ-২৪ এই মামলার
হাজিরায় এরশাদের এই বক্তব্য উদ্ধৃত করেছে, 'চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে
আনার পর উত্তেজিত জনতা মঞ্জুরকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এই
টানাহ্যাঁচড়ার মধ্যে নিরাপত্তারক্ষীরা গুলি ছুড়তে বাধ্য হয়। একপর্যায়ে
মঞ্জুর গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান।'
এরশাদের এক সহকর্মী মোস্তফা—লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোস্তফা কামাল ২০১৩ সালে
আদালতে বলেছিলেন, 'কিছু বিক্ষুব্ধ মানুষ চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে
মঞ্জুরকে নেওয়ার পথে তাঁকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এতে
নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে তাদের গুলিবিনিময় হয়। একপর্যায়ে মঞ্জুরের গায়ে
বুলেট বিঁধে। হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান।'
এরশাদ ও তাঁর সহযোগীরা যে গল্প ফেঁদেছেন এবং ৩০ বছর ধরে ভাঙা রেকর্ডের
মতো বাজিয়ে চলেছেন, তার প্রধান দুর্বলতা হলো বাস্তবের সঙ্গে এর কোনো মিল
নেই। সে সময় চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন বা এ ঘটনা
প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁরা কেউই কখনো বলেননি যে তাঁরা 'বিক্ষুব্ধ মানুষ' বা
'বিক্ষুব্ধ অস্ত্রধারী' ব্যক্তিদের দেখেছেন, যাঁরা মঞ্জুরকে ছিনিয়ে
নেওয়ার চেষ্টা করলে গোলাগুলি হয়; আর মঞ্জুর এই 'টানাহ্যাঁচড়া'র কারণে
গুলিবিদ্ধ হন। কেউ কেউ বলেছেন, মঞ্জুরের 'নিরাপত্তারক্ষীরা' গুলি করেছিল;
আর কেউ বলেছেন, 'হাসপাতালে নেওয়ার পথে মঞ্জুর মারা যান।' কিন্তু কোনো
হাসপাতালেই মঞ্জুরকে সেদিন জীবিত বা মৃত বা আহত অবস্থায় দেখা যায়নি। কেবল
একজন সেনা চিকিৎসক তাঁকে দেখেছেন। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের
ব্রিগেডিয়ার আজিজ, ক্যান্টনমেন্টের দায়িত্বে তখন ছিলেন তিনি, দাফনের জন্য
মরদেহ প্রস্তুত করাতে তাঁকে মঞ্জুরের 'ক্ষত ব্যান্ডেজ' করে দিতে বলেন।
জিয়াউদ্দীন চৌধুরী তাঁর বইয়ে ফটিকছড়িতে মঞ্জুরের শান্তিপূর্ণ আত্মসমর্পণ
এবং তাঁর গতিবিধির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন। তাঁর বিবরণ বা
চট্টগ্রামের প্রত্যক্ষদর্শীদের কারও কথার সঙ্গেই এরশাদ ও তাঁর সহযোগীদের
গল্পের ন্যূনতম কোনো মিল নেই। চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক হিসেবে
জিয়াউদ্দীন চৌধুরী ১ জুন মঞ্জুরের গ্রেপ্তার হওয়া থেকে শুরু করে
হাটহাজারী থানায় সেনাবাহিনীর হাতে তাঁকে সোপর্দ করা পর্যন্ত প্রতিটি
ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন বা ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেছেন। এমনকি মঞ্জুর নিরাপদে
ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছালেন কি না, সেটিও দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ারের কাছ
থেকে তিনি শুনে নিশ্চিত হয়েছেন।
জিয়াউদ্দীন চৌধুরীর ভাষ্যের সঙ্গে এরশাদের ভাষ্যের তুলনা করা যাক:
'মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের পরদিন সরকারি তথ্য বিবরণীতে বলা হয়, তাঁকে
ক্যান্টনমেন্টে নেওয়ার পথে বিক্ষুব্ধ সৈন্যদের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে
মঞ্জুর মৃত্যুবরণ করেছেন। এই প্রতিবেদন ছিল একটি ডাহা মিথ্যা।
'ক্যান্টনমেন্টে নেওয়ার পথে মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়নি। ব্রিগেডিয়ার আজিজ
পুলিশের ডিআইজিকে বলেছিলেন, ২ জুন সকালবেলা মঞ্জুরকে চট্টগ্রাম
ক্যান্টনমেন্টে হত্যা করা হয়। আজিজ এ কথা বলেননি যে মঞ্জুর বিক্ষুব্ধ
সৈন্যদের হাতে মারা পড়েছেন...
'চিকিৎসককে যখন মঞ্জুরের "ক্ষত ব্যান্ডেজ" করতে বলা হয়, তখন তিনি দেখতে
পেলেন, একটিমাত্র গুলির আঘাতে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। গুলিটি তাঁর মাথা ফুঁড়ে
বেরিয়ে যায়। তাঁর মৃত্যুর জন্য একঝাঁক বুলেট দরকার হয়নি...ঢাকা থেকে আসা
এক সেনা কর্মকর্তা মঞ্জুুরকে হত্যা করেন, বিক্ষুব্ধ সৈন্যরা নয়। তাঁকে
কেন হত্যা করা হবে? কেন বিচারের মুখোমুখি করা হবে না? তিনি কি এমন কিছু
জানতেন, সেনাবাহিনী যা প্রকাশিত হতে দিতে চায়নি?'
এ ধরনের মিথ্যা ও প্রচ্ছদকাহিনির সমস্যা হচ্ছে, এর প্রণেতারা অনেক সময়
নিজেদের লেখা চিত্রনাট্য নিজেরাই ভুলে যান। নিজেদের গা বাঁচাতে
'বিক্ষুব্ধ সৈন্য'দের হাতে মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের যেসব গল্প এরশাদ ও তাঁর
সহযোগীরা ফেঁদেছেন, তার প্রতিটিতে বলা হয়েছে যে পুলিশ তাঁকে সেনাবাহিনীর
বিশেষ ইউনিটের কাছে হস্তান্তর করার পর চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে 'নেওয়ার
পথে' তাঁকে হত্যা করা হয়।
তার পরও, সিআইডির কাছে দেওয়া সাক্ষ্যে পুলিশের আইজি এ বি এম জি কিবরিয়া
জানিয়েছেন, তিনি এরশাদকে সরাসরি প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন,
'চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে আনার পরই মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়।'
কিবরিয়া এর আগের দিনই মঞ্জুরকে পুলিশের কাছ থেকে সেনা হেফাজতে আনার
সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি এরশাদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন,
মঞ্জুরকে কীভাবে হত্যা করা হয়?
সাক্ষ্যে কিবরিয়া বলেন, '২ জুন বিকেলবেলা বঙ্গভবনে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির
সভাপতিত্বে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে আমি চিফ অব আর্মি স্টাফের কাছে
জানতে চাই, মঞ্জুরকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে? আদতে তো তাঁর প্ররোচনায়
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি মঞ্জুরকে সেনা হেফাজতে নেওয়ার নির্দেশ দেন, যাঁদের
হাতে—এক অর্থে তাঁরই হেফাজতে—মঞ্জুরের মৃত্যু হলো। এরশাদের জবাব ছিল,
চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়ার পরপরই বিক্ষুব্ধ সেনাদের
গুলিবর্ষণে মঞ্জুর নিহত হন। এয়ার ভাইস মার্শাল সদরুদ্দীনের মতো কিবরিয়াও
এরশাদের 'বিক্ষুব্ধ সেনা'দের হাতে মঞ্জুর হত্যার গল্প বিশ্বাস করেননি।
কিবরিয়া তাঁর সাক্ষ্যে এরশাদের নিজের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতেই বলেছেন যে
মঞ্জুরকে 'ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়ার পথে' হত্যা করা হয়নি। এটা একটা
তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য। এরশাদের স্বীকারোক্তির পর কিবরিয়া কীভাবে ত্বরিত
পদক্ষেপ নিয়েছেন, তা-ও তিনি বলেছেন। প্রথমে একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ
কর্মকর্তাকে তিনি চট্টগ্রামে পাঠান। পরে নিজেই সেখানে যান। চট্টগ্রামে
অবস্থিত তাঁর সহকর্মীদের তিনি বঙ্গভবনের বৈঠকের কথা জানিয়ে পুলিশ হেফাজতে
থাকা সেনা কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা নিয়ে এই শঙ্কা প্রকাশ করেন যে
সেনাবাহিনী হয়তো এদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিতে পারে।
কিবরিয়া ব্যাখ্যা করেন, মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের পর 'বেসামরিক কর্তৃপক্ষের
হাতে গ্রেপ্তার হওয়া সেনা কর্মকর্তাদের সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার
জন্য এরশাদের দাবি অগ্রাহ্য করে' তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ
নিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে তিনি কীভাবে প্রভাবিত করেন। স্পষ্টভাবেই তাঁর
মনে ভয় ছিল, সেনা হেফাজতে নিয়ে গেলে এদেরও মঞ্জুরের ভাগ্য বরণ করতে হবে।
সত্যিই তাই। পরের কয়েক মাসে বহু সেনা কর্মকর্তাকে সেনা হেফাজতে এনে
ব্যাপক নির্যাতন করা হয়। এরপর চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে অনুষ্ঠিত
ফিল্ড কোর্ট মার্শালে তাঁদের বিচার করা হয়। ফাঁসিতে ঝোলানো হয় ১৩ জনকে।
তৎকালীন অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরীর
ভাষ্যমতে, এই হতভাগারা নিরপেক্ষ বিচার ও যথাযথ আইনি সুরক্ষা পাননি, যা
ছিল তাঁদের মৌলিক অধিকার। আগেই বলেছি, জুলফিকার আলী মানিক তাঁর সেই সাহসী
বইয়ে এসব কথা লিপিবদ্ধ করেছেন।
নোংরা সত্যটি হচ্ছে এই যে ওই মানুষগুলোকে এমন এক 'অভ্যুত্থানের' অভিযোগে
বিচার করা হয়, যেটি আদতে কোনো 'অভ্যুত্থান' ছিল না বা সেই বিদ্রোহ কোনো
দিন সম্পন্ন হয়নি। কিন্তু জিয়া আবুল মঞ্জুরের হাতে নিহত হননি; কিংবা
যাঁদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে, তাঁদের হাতেও নন।
সেনাবাহিনীতে এরশাদের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার অভিপ্রায়ে তাঁদের ভিত্তিহীন ও
নিষ্ঠুরভাবে প্রাণ দিতে হয়। বলির পাঁঠা বানানোর জন্য এরশাদের দরকার ছিল
একটি 'অপরাধী চক্র'।
জেনারেল মইন ও জুলফিকার আলী মানিক তাঁদের বইয়ে জানিয়েছেন, এরশাদ নির্যাতন
করে 'স্বীকারোক্তি আদায় করেছেন, কিন্তু তথাকথিত বিচারটি চলেছে
উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে, কোনো তদন্ত ছাড়াই। মেজর জেনারেল মহব্বতজান চৌধুরীর
নির্দেশে বিচার ও শাস্তির প্রক্রিয়াটি পরিচালিত হয়।
খালেদা জিয়া কি সত্যি সত্যিই এরশাদকে তাঁর স্বামী হত্যার জন্য অভিযুক্ত
করেছিলেন? প্রকৃত 'অভ্যুত্থান' তাহলে ঢাকাতেই হয়েছে, চট্টগ্রামে নয়।
লেখাটি ছাপাখানায় যাওয়ার পর প্রথম আলোর হাতে থাকা কিছু দলিল আমার হাতে
এসেছে। দলিলগুলো হচ্ছে ১৯৮১ সালের মে-জুন মাসের সেই নিয়তি-নির্ধারক
দিনগুলোতে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যেসব সদস্য চট্টগ্রামে ছিলেন, সিআইডির
কাছে দেওয়া তাঁদের সাক্ষ্য। এসব সাক্ষ্য আমাদের সামনে কিছু নতুন প্রশ্ন
উত্থাপন করেছে। এই লেখা শেষ হওয়ার পর একটি উপসংহার পর্বে সেগুলো নিয়ে আমি
আলোচনা করব।
হত্যা মামলা
এসব সাক্ষ্য-প্রমাণ কী অগ্রাহ্য করা হবে? বিচারপতি কি আমার সোর্সের
চূড়ান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে, নতুন এই প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য না
নিয়ে তাঁর রায় ঘোষণা করবেন? যে মানুষটি বললেন, তিনি চট্টগ্রাম
ক্যান্টনমেন্টে উপস্থিত ছিলেন, একজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাকে মঞ্জুরের
সেলে ঢুকতে দেখেছেন, আর সেখানেই নাকি মঞ্জুর খুন হন—তাঁর সাক্ষ্য কি
উপেক্ষা করা হবে?
বিচারপতি ফিরোজ বা কোনো উচ্চ আদালত কি এই সাক্ষীর নিরাপদে সাক্ষ্য দেওয়ার
পরিবেশ সৃষ্টি করবেন? এয়ার ভাইস মার্শাল সদরুদ্দীন, আইজিপি কিবরিয়া এবং
অন্যদের দশক দশক ধরে চাপা পড়ে থাকা সাক্ষ্য কি শোনা হবে, নাকি অগ্রাহ্য
করা হবে?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি তাঁর সদ্য নিযুক্ত 'বিশেষ দূত' জেনারেল
এরশাদ, যিনি এ মামলার অন্যতম সন্দেহভাজন, তাঁর সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে
সুবিধাজনক সমীকরণের স্বার্থে আপসরফা চালিয়ে যাবেন? নাকি প্রজ্ঞা জয়ী হবে?
অথবা এই নিশ্চয়তা প্রতিষ্ঠিত হবে যে বিচার বিভাগের কাজে নির্বাহী বিভাগ
আর হস্তক্ষেপ করবে না।
শেখ হাসিনা কি এই নতুন তথ্যের ভিত্তিতে একজন হত্যা মামলার সন্দেহভাজনের
সঙ্গে রাজনৈতিক আপসরফা বন্ধ করবেন?
এরশাদ শুধু হত্যা মামলার প্রধান সন্দেহভাজনই নন, সেনাপ্রধান হিসেবে বহু
সেনা কর্মকর্তাকে নির্যাতন করে তাঁদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করার
ঘটনায়ও তিনি একজন হুকুমের আসামি। এসব স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে তাঁদের
'দণ্ডিত' এবং পরবর্তীকালে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। এ ধরনের কাজ একদিকে
বাংলাদেশের সংবিধানের খেলাপ, অন্যদিকে নির্যাতন এবং অন্যান্য অমানবিক ও
অবমাননামূলক আচরণবিরোধী আন্তর্জাতিক রীতি-নীতিরও পরিপন্থী। তদুপরি, এরশাদ
সেনাপ্রধান থাকাকালে বেশ কয়েকটি ফিল্ড কোর্ট মার্শালে বিবাদীর অধিকার
লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এই সবগুলো অপকর্মের বিরুদ্ধেই
ব্যবস্থা গ্রহণের অবকাশ রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীকে আমি বহু দিন ধরেই চিনি-জানি। আমার মনে হয় না, তাঁর সব
ঔচিত্যবোধের মৃত্যু ঘটেছে। তিনিও হত্যাকাণ্ডের নির্মম শিকার হওয়া একজন
মানুষের কন্যা। তাঁর নিহত স্বজনদের হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার পেতে তিনি
বহু দিন ধরে অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়েছেন। মঞ্জুরের সন্তানদের চেয়ে কি
তিনি অধিকতর সুবিধাভোগী যে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারী একই রাজনৈতিক
শক্তির হাতে মঞ্জুর নিহত হওয়ার পরও তাঁরা ন্যায়বিচার পাবেন না?
মঞ্জুরের পরিবারও সেই জবাবদিহি দেখতে চায়, যা প্রধানমন্ত্রী তাঁর পিতা,
মাতা, ভাই, বোনদের হত্যাকাণ্ডের জন্য দাবি করেছিলেন। নতুন তথ্যের আলোকে
আমরা এই প্রত্যাশা করি যে শেখ হাসিনা তাঁর 'বিশেষ দূত'-এর কাছ থেকে সরে
এসে মঞ্জুরের সন্তানদের পাশে এসে দাঁড়াবেন; তাদের বলবেন, 'তোমাদের
ন্যায়বিচারের দাবিতে আমি বিপক্ষে নই, বরং পাশে আছি।'
শেখ হাসিনার সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ দিল্লিতে ১৯৮০ সালের প্রথম দিকে।
তিনি তখন একটি সাদামাটা ঔপনিবেশিক কেতার বাংলোয় বসবাস করতেন। তাঁর
নিরাপত্তা ছিল সুনিশ্চিত, তবে গোপন। দুর্বল হলেও তাঁকে
আত্মমর্যাদাসম্পন্ন একজন নারী বলেই আমার মনে হলো। তখনো তিনি তাঁর
স্বজনদের মৃত্যুর শোক বয়ে চলেছেন। কে-ই বা এর ব্যতিক্রম? তাঁর চোখেমুখে
শোক ও আতঙ্কের ছাপ ছিল স্পষ্ট। ঘরের ভেতর একটি শোকের আবহ সৃষ্টি হলো।
প্রায় প্রতিটি কথাতেই তিনি অশ্রুসজল হয়ে উঠছেন। হূদয়বিদারক! ১৯৭৫ সালের
'অভ্যুত্থানে'র পেছনের ঘটনা উন্মোচন করার জন্য আমি যে বইটি লিখেছিলাম,
শেখ হাসিনা তার জন্য আমাকে ধন্যবাদ জানান।
আগস্টের সেই ঘটনার পর অনেকটা দিন চলে গেছে। তবু তাঁর সঙ্গে সেই প্রথম
সাক্ষাতে অপরিমেয় সেই শোকের প্রতি আমি আমার সমবেদনা জানাই। তিনি আমার কথা
শোনেন। আমি কথা বলার পর তিনি বেশ নীরব ছিলেন। ভাঙা গলায় ধন্যবাদ ও
শুভেচ্ছা জানানোর পর তিনি প্রায় কোনো কথাই বলতে পারছিলেন না। আমরা তখন
শোকাবহ স্মৃতি দূরে ঠেলে রেখে চা পান করতে করতে সামান্য কথা বলার চেষ্টা
করি।
ঢাকায় ১৯৭৩-৭৪ সালে একজন তরুণ প্রতিবেদক হিসেবে তখনকার বিক্ষোভ ও
দুর্ভিক্ষ নিয়ে আমি বেশ সমালোচনামুখর ছিলাম। তার পরও সেই 'অভ্যুত্থান'
এবং তাতে নিহত নিরীহ মানুষের মৃত্যুর বিনিময়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যে
ভূত আবারও জেগে ওঠে, তার খপ্পর থেকে মুক্ত হওয়ার কোনো পথই খোলা ছিল না।
পরবর্তী বছরগুলোতে শেখ হাসিনা দৃঢ় সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭৫ সালের
হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে তবেই থেমেছেন।
কিছুদিন আগে মঞ্জুরের বড় মেয়ে রুবানার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে শেখ হাসিনার
সঙ্গে আমার দিল্লির সেই বৈঠকের কথা মনে পড়ে গেল। আবারও দেখলাম, পিতার
মৃত্যু এবং এর পরবর্তী তিনটি দশক ধরে তাঁরা যে অমানুষিক যন্ত্রণার মধ্য
দিয়ে গেছেন, সেসব কথা বলতে গিয়ে তাঁর গলা ভেঙে আসছে।
সেই আলাপচারিতার কথা বলার স্বাধীনতা আমার নেই। কিন্তু আমি জানি, সেই
শোকের গভীরতা যদি অল্প কেউ উপলব্ধি করে থাকেন, তাহলে শেখ হাসিনাই তা
করেছেন।
শেখ হাসিনা চাইলে তাঁর পিতা-মাতার কবরে যেতে পারেন। সব পিতা-মাতাহীন
সন্তানই তা করে থাকেন। তাঁদের শেষ বিশ্রামস্থলে যাওয়া প্রতিটি মানুষের
জন্যই এক গভীর সান্ত্বনার বিষয়। এটি আরও বিশেষ হয়ে ওঠে, যদি কেউ সহিংসতার
কারণে মারা যান। জেনারেল মঞ্জুরের স্ত্রী ও সন্তানেরা জানেন না, তাঁদের
স্বামী ও পিতার আদৌ কোনো কবর আছে কি না। সেখানে গিয়ে তাঁদের প্রার্থনা
করার সুযোগটুকুও নেই।
মৃত্যুর মামলা ও সংশ্লিষ্ট সেই পরিবারের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির
আকাঙ্ক্ষাকে কারোরই রাজনৈতিক ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা উচিত নয়। এটি
বিবেচনাবোধহীন একটি ব্যাপার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন করব,
দয়া করে আপনার যে পরামর্শকেরা এর বিপরীত কথা ভাবেন, তাঁদের কথা শুনবেন
না।

'অভ্যুত্থান' ঢাকাতেই হয়েছে, চট্টগ্রামে নয় (পরের অংশ )
অপরাধী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ
আমি মনে করি, জেনারেল এরশাদ ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে জেনারেল মঞ্জুর
হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা
নির্দোষ। তাঁদের বিচার স্বচ্ছ হওয়া উচিত। এর ভিত্তি হবে পেশাদারির
ভিত্তিতে পাওয়া তথ্য-প্রমাণ ও যোগ্য প্রসিকিউশন।
আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একটি পবিত্র ব্যাপার।
যদিও তথাকথিত সেই চট্টগ্রাম বিদ্রোহের ঘটনায় যে তরুণ সেনা কর্মকর্তাদের
এরশাদ নির্যাতন করে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন, তাঁদের তিনি এ অধিকারের সুযোগ
দেননি। কিন্তু যে অধিকার এরশাদ তাঁদের দেননি, ন্যায়বিচারের স্বার্থে
তাঁকে সেই অমূল্য অধিকারটি দিতে হবে।
মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত এমন আরও অনেকে থাকতে পারে, যাদের
বিরুদ্ধে এখনো পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করা হয়নি। আমার ধারণা, আমার
সাক্ষী যে ব্যক্তির নাম বলেছিলেন, তিনি অভিযোগপত্রে নেই। কথিত আছে, সেই
ব্যক্তিই মঞ্জুরকে হত্যা করেন। তিনি একজন উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা।
মঞ্জুরকে হত্যা করতেই তিনি ঢাকা থেকে এসেছিলেন। আবার মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডে
একমাত্র তিনিই নন, আরও অনেকেই জড়িত থাকতে পারেন। এ অভিযোগ সত্য হলে যে
ব্যক্তিটি ট্রিগার চেপেছিলেন, তিনি একাই নিশ্চয়ই সবকিছু করেননি।
তদুপরি ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী আমার সেই সোর্সই এ ঘটনার একমাত্র
প্রত্যক্ষদর্শী নন। মঞ্জুরের সেলে সেই ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাকে অনেকেই
প্রবেশ করতে দেখেছেন। তাঁর সেই প্রবেশাধিকারকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ভয়ের
কারণে অনেকে গত ৩০ বছরে মুখ খোলেননি। এই ভীতি দূর করার মতো একটি
পরিস্থিতি কি সৃষ্টি হয়েছে বা তা কি সৃষ্টি করা সম্ভব? যাঁরা এ
হত্যাকাণ্ড পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করেছেন, এভাবে তাঁদের পার পাওয়ার সময়
কি শেষ হবে?
বড় একটি পরিবর্তনের সময় এসেছে। নিম্ন আদালতে এ মামলাটি যেভাবে পরিচালনা
করা হয়েছে, তাতে ন্যায়বিচারকে প্রহসন করা হয়েছে। আর যাঁরা এটি পরিচালনা
করেছেন, তাঁরা নিজের পেশার সঙ্গে গুরুতর অসদাচরণ করেছেন। দুই দশকে ২২ জন
বিচারক এ মামলার শুনানিতে অংশ নিয়েছেন। পরে আবার তাঁদের অন্য দায়িত্বে
পাঠানো হয়েছে। রাজনৈতিক ফুটবল হিসেবে মামলাটিকে নিয়ে খেলাধুলা চলছেই।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমে খোলাখুলিই বলা হচ্ছে যে এই মামলাটিকে জেনারেল
এরশাদের সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা
হচ্ছে। বিনিময়ে এরশাদ সরকারকে তাঁর পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন এই আশায়, যাতে
মামলাকে পুরোপুরি হাওয়া করে দেওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
মঞ্জুরের ভূত এরশাদকে তটস্থ করে রেখেছে। এ মামলার সমাপ্তি নেই।
সম্প্রসারণশীল বাজারে পণ্যের মূল নির্ধারণ করতে গিয়ে বাংলাদেশের
রাজনীতিতে বারবার যা মার খেয়েছে, তা হলো নৈতিকতা। আর এই পণ্য হচ্ছে
ন্যায়বিচার। এর বিকিকিনি হয়েছে বন্ধ দরজার অন্তরালে। বাংলাদেশে একটিমাত্র
প্রতিষ্ঠানই এই পণ্যের বাজার বন্ধ করে দিতে পারে, সেটি হলো সুপ্রিম
কোর্ট।
'জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট' হলে সুপ্রিম কোর্ট যেকোনো মামলাকে নিম্ন আদালত থেকে
তাঁর ক্ষমতাবলে সরিয়ে নিতে পারেন। এই মামলাটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে।
এই মামলার মধ্যে বাংলাদেশে এক দশকের সামরিক শাসনের বীজ নিহিত রয়েছে।
মঞ্জুরের হত্যকাণ্ড সেই বীজের প্রাণকেন্দ্র। এই মামলাটি যদি
'জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট' মামলার আওতায় না পড়ে, তাহলে আর কোন মামলা পড়তে
পারে, তা আমি জানি না। হয়তো অন্য কোনো বেশি গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড রয়েছে।
তাদের পিতা 'খুনি' ও 'বিশ্বাসঘাতক'—এই অশেষ কানাকানিতে চারটি সন্তান
বাংলাদেশ ছেড়েছে। এই ফিসফিস তাদের প্রতিনিয়ত আহত করেছে। এটি তাদের স্কুলে
তাড়া করে ফিরেছে। যে বাসায় তারা গেছে, সেখানে তাড়া করেছে। তাদের অনেক
পুরোনো বন্ধুও এ কারণে তাদের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।
বাংলাদেশ কীভাবে 'মিথ্যার ভাইরাস'-এ আক্রান্ত হয়েছে, তা সত্যিই খতিয়ে
দেখার মতো বিষয়। কিন্তু এই মিথ্যার বলি হয়েছে এক নির্দোষ মানুষের
সন্তানেরা। তাদের পিতাকে যথাযথভাবে সমাধিস্থ করার অধিকার তাদের দিতে হবে।
এরপর বাকি জীবনটা নির্বিঘ্নে যাপন করার জন্য যে দেশে তাদের ঘর, সেখানে
তাদের প্রত্যাবর্তন করতে দিতে হবে।
মঞ্জুরের আসল 'অপরাধ', সামরিক শাসনের পাঁয়তারা করা ক্ষমতামদমত্ত কিছু
মানুষের তিনি বিরোধিতা করেছিলেন। আসলে সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ
কর্মকর্তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন স্বল্পসংখ্যক গণতন্ত্রমনা
'সংবিধানপন্থী'দের একজন, যেমন ছিলেন জেনারেল মইনও, যাঁরা কখনোই আইয়ুব
খানের বাংলাদেশি কোনো সংস্করণকেই বঙ্গভবনের মসনদে আসীন দেখতে চাননি, তা
সে জিয়া বা এরশাদ যে নামেই হোক না কেন। উপরন্তু তাঁরা ছিলেন
ক্যান্টনমেন্টভিত্তিক কোনো রাজনৈতিক দলের উত্থানের বিরোধী। এটা কি
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য অভিশাপ হয়ে ওঠেনি? পাকিস্তানের জন্যও কি এটা
এখনো অভিশাপ নয়? এ দুই ব্যক্তি দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য লড়াই
করেছেন। তাঁরা গণতান্ত্রিক দেশে পেশাদার সেনাবাহিনীর পক্ষে ছিলেন।
পরিশেষে, মঞ্জুরের বিধবা স্ত্রী মার্কিন মুলুক থেকে কখনোই দেশে ফিরতে চান
না। কারণ, কখনোই তিনি ন্যায়বিচার পাবেন বলে মনে করেন না। তাঁর স্বামীকে
হত্যাকারী পার পেয়ে গেছে। সাক্ষ্য-প্রমাণও তা-ই বলে।
হয়তো আরেকটি পথ খোলা আছে। সে পথ গিয়ে ঠেকেছে সুপ্রিম কোর্টে। মঞ্জুরের
ভাই বা তাঁর সন্তানেরা আদালতের সামনে দাঁড়িয়ে নিম্ন আদালতের অন্তহীন জাল
থেকে মামলাটি বের করে আনার আবেদন করলে, তা অনুমোদন করা উচিত। গত ২০ বছরে
এই মামলাটি সেখানে আশা-প্রত্যাশাহীনভাবে মাটিচাপা পড়েছে।
তাহেরের মামলায় বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দীন চৌধুরী ও বিচারপতি জাকির
হোসেন অনন্য নজির স্থাপন করে দেখিয়েছেন যে ঘটনার বহু বছর পরও কীভাবে একটি
মামলার নিষ্পত্তি করা সম্ভব। তাঁরা নিজেরা উদ্যোগী হয়ে জটিল বিষয়গুলোর
তদন্ত ও সাক্ষী নির্বাচন করে তাঁদের আদালতের সামনে হাজির হওয়ার নির্দেশ
দিয়েছিলেন।
প্রয়োগ করার মতো বিপুল ক্ষমতা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের হাতে রয়েছে।
ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য জরুরি মনে করলে আদালত তা করে থাকেন। তাহের
ও মঞ্জুর হত্যা মামলা এক রকম নয়।
তাহেরের বিচার সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু বলা হয়েছে, সেটি ছিল অবৈধ ও
অসাংবিধানিক। উপরন্তু সেই বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগেই তাহেরের
মৃত্যুদণ্ডের বিধান সুনির্দিষ্ট করে রাখা হয়েছিল। আদালত মত দিয়েছিলেন,
সেই বিচারটি নিজেই ছিল একটি অপরাধ। সেটি ছিল একটি অবৈধ বিচারপ্রক্রিয়া।
সে কারণে তাহেরের মৃত্যুদণ্ডাদেশ ছিল হত্যাকাণ্ডের সমতুল্য।
মঞ্জুরের ক্ষেত্রে বিষয়টি তা নয়। এটি এখনো একটি চলমান বিচারপ্রক্রিয়া। ২০
বছর চলার পরও এখনো পর্যন্ত এ মামলায় কোনো রায় দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশের
অসামান্য এক অ্যাটর্নি জেনারেল আমিনুল হক ১৯৯০-এর দশকের প্রথম ও মধ্যভাগে
এ মামলার এক পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তপ্রক্রিয়ার সূচনা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর
অকালমৃত্যুর পর সেসবের আর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।
এয়ার ভাইস মার্শাল সদরুদ্দীনের মতো মানুষদের সাক্ষ্য সবে আলোর মুখ দেখতে
শুরু করেছে। এটি যে সম্ভব হয়েছে, তার পেছনে আছে সেই সময়ে আমিনুল হকের
অভিভাবকসুলভ সতর্ক পদক্ষেপ। সর্বোচ্চ আদালতের হাতে এই মামলার সূত্রগুলো
একত্র করে জেনারেল আবুল মঞ্জুরের হত্যাকারীকে খুঁজে বের করার ক্ষমতা আছে।
মঞ্জুর হত্যা মামলা বাংলাদেশের বিবেককে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। এটা
কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, তা-ই এখন দেখার বিষয়।
'জেনারেল এরশাদ, আমি কি জানতে পারি, আপনি কোন পরিকল্পনার কথা বলছেন?'
এয়ার ভাইস মার্শাল সদরুদ্দীনের সাক্ষ্য
মঞ্জুর হত্যা মামলায় ২৫ মার্চ ১৯৯৫ সিআইডিকে দেওয়া জবানবন্দির চুম্বক অংশ
'তাঁরা আমাকে বলেন যে এখানে মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে [জিয়া হত্যাকাণ্ডে]
ফাঁসানোর একটা পরিকল্পনা চলছে'
৩১ মে ১৯৮১
আমি এয়ার ভাইস মার্শাল সদরউদ্দীন (অব.), সাবেক বিমানবাহিনী
প্রধান।...সকাল আনুমানিক সাড়ে সাতটার সময় আমাকে জানানো হয় যে জেনারেল
এরশাদ টেলিফোনে আমার সঙ্গে কথা বলবেন। আমি টেলিফোন ধরি। জেনারেল এরশাদ
আমাকে আগের রাত্রে চিটাগাং সার্কিট হাউসে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত
হওয়ার সংবাদ দেন এবং দ্রুত ঢাকায় ফিরে আসার জন্য অনুরোধ করেন। আমি
কিছুক্ষণ পর ঢাকার উদ্দেশে হেলিকপ্টারযোগে রওনা হই এবং আনুমানিক ১০টার
সময় ঢাকায় ফিরে আসি।
আমি সরাসরি আর্মি হেডকোয়ার্টারে সেনাপ্রধানের অফিসে যাই। আমি তাঁর অফিসে
গিয়ে বেশ কিছু ঊর্ধ্বতন আর্মি অফিসারকে তাঁর অফিসে দেখি। তাঁদের মধ্যে
মেজর জেনারেল মীর শওকত আলী, মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী, মেজর
জেনারেল মান্নাফ, মেজর জেনারেল নূরউদ্দীনসহ অন্য আরও কিছু আর্মি অফিসারকে
দেখি। সেখানে তাঁরা চিটাগাংয়ে প্রেসিডেন্ট নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে আলোচনা
করছিলেন। জেনারেল এরশাদ আমাকে ঘটনা দ্রুত জানালেন। আমি সেখানে আনুমানিক
২০ মিনিট ছিলাম। সেখান থেকে বের হয়ে আসার পথে মেজর জেনারেল শওকত ও মেজর
জেনারেল মইন আমার পেছনে পেছনে আসেন। আসার পথে করিডরে তাঁরা আমাকে বলেন যে
এখানে মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে ফাঁসানোর একটা পরিকল্পনা চলছে।
......
'স্যার, দয়া করে নিশ্চিত করুন যাতে মঞ্জুরের কিছু না হয়'
১ জুন ১৯৮১
বিকেল আনুমানিক সাড়ে পাঁচটার সময় আমি বঙ্গভবনে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির
[বিচারপতি আবদুস সাত্তার] অফিসে ছিলাম। তখন সেখানে লে. জেনারেল এরশাদও
ছিলেন। আমরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলাম। এই সময় টেলিফোন আসে।
প্রেসিডেন্ট টেলিফোনে কথা বলেন। প্রেসিডেন্ট টেলিফোন রেখে জানান, আইজিপি
কিবরিয়া জানিয়েছেন যে মেজর জেনারেল মঞ্জুর এবং অন্যরা পুলিশের হাতে ধরা
পড়েছেন।
সংবাদটি বলার সঙ্গে সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে জেনারেল এরশাদ উত্তেজিত অবস্থায়
চেয়ার থেকে উঠে পড়েন। আর কিছু না বলে সরাসরি প্রেসিডেন্টের পাশে রেড
টেলিফোনের কাছে যান এবং একটি নাম্বারে ডায়াল করেন। টেলিফোনে তাঁর যে
কথাটি শুনতে পেলাম তা হলো, 'মঞ্জুরকে পুলিশ আটক করেছে। এক্ষুনি তাঁকে
নিয়ে নাও। তারপর পরিকল্পনামতো কাজ করো।' বলেই তিনি টেলিফোন রেখে দেন।
তখন আমি বলি, 'জেনারেল এরশাদ, আপনি কোন পরিকল্পনার কথা বলছেন, আমি কি
জানতে পারি?' এতে তিনি আবার বেশ উত্তেজিত হয়ে বলেন, 'এয়ার চিফ, আপনি
কিছুই বোঝেন না।' আমি বলি, 'আমি কী বুঝি না বুঝি, আপনার কাছ থেকে জানতে
হবে না।'
পরে আমি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির উদ্দেশে বলি, 'স্যার, দয়া করে নিশ্চিত করুন,
যাতে মঞ্জুরের কিছু না হয় আর তিনি ন্যায্য বিচার পান। মঞ্জুরের কিছু হলে
জাতির কাছে আপনাকে জবাব দিতে হবে।' এর উত্তরে সাত্তার সাহেব বিচার করা
হবে বলে জানান।
......
'আপনারা জেনারেল মঞ্জুরকে মেরে ফেললেন'
২ জুন ১৯৮১
ভোর রাত্রি আনুমানিক দেড়টা-দুইটার দিকে উইং কমান্ডার কামাল, ডিরেক্টর,
এয়ার ইন্টেলিজেন্স, টেলিফোনে মেজর জেনারেল মঞ্জুরের হত্যার খবর দেন। আমি
সকাল আনুমানিক ছয়টা-সাতটার সময় এরশাদ সাহেবকে টেলিফোনে বলি, 'এরশাদ
সাহেব, আপনারা জেনারেল মঞ্জুরকে মেরে ফেললেন?' (শেষ)
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন

লরেন্স লিফশুলৎজ
ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউর (হংকং) দক্ষিণ এশিয়া প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি
দ্য গার্ডিয়ান, লে মঁদ দিপ্লোমাতিক, দ্য নেশন (নিউইয়র্ক) ও বিবিসির পক্ষে
লিখেছেন। তিনি বেশ কিছু বই রচনা ও সম্পাদনা করেছেন; এর মধ্যে রয়েছে
বাংলাদেশ: দি আনফিনিশ্ড্ রেভল্যুশন, হিরোশিমা'জ শ্যাডো ও হোয়াই বসনিয়া?
OpenDoor.Lifschultz@gmail.com

Thursday, June 12, 2014

মঞ্জুর হত্যাকারীদের বিচার করা হোক :ড. মোঃ আনোয়ার হোসেন

তিন বছর বয়সী একটি মেয়ে ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই রাতে তার পিতা-মাতা, কয়েক মাসের ছোট ভাই এবং বাবার বন্ধু কয়েকজন সাহসী মানুষের সঙ্গে এক অনিশ্চিত, দুর্গম যাত্রায় শামিল হয়েছিল। সে মেয়েটির পরিচয় জানতে একটু পেছনে যেতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ। মুক্তিযুদ্ধের ঘাঁটি বলে পরিচিত প্রত্যন্ত কাজলায় আমাদের গ্রামের বাড়িতে প্রতি সন্ধ্যার মতো সেদিনও অনেকে এসেছেন স্বাধীন বাংলা বেতারের খবর শুনতে। পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্ত অতিক্রম করে চারজন বাঙালী সামরিক অফিসার মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন। এ খবরটি প্রচারিত হলো সে রাতে। অফিসারদের নাম বলা না হলেও আমরা বুঝে নিলাম এঁদের মধ্যে আমাদের অগ্রজ মেজর তাহের অবশ্যই আছেন। বলতে কি এমন একটা খবরের জন্য আমরা অপেক্ষা করছিলাম। এর আগে আম্মাকে ডাকে পাঠানো চিঠিতে তাহের ভাই লিখেছিলেন, “যখনই সম্ভব হবে আমি আপনাদের কাছে পৌঁছব” (‘একাত্তরের চিঠি’, পৃষ্ঠা ১২৬)। আমাদের অনুমান ভুল হয়নি। এর অল্প কিছুদিন পর আমরা জানতে পারি তাহের ভাইয়ের সাথে মেজর মঞ্জুর, মেজর জিয়াউদ্দিন এবং ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন।
১৯৭২-এর শেষে কর্নেল তাহেরের লেখা ‘এবোটাবাদ থেকে দেবীগড়’ প্রকাশিত হয়েছিল দৈনিক বাংলার সাপ্তাহিক সাময়িকী ‘বিচিত্রায়’। সে দুঃসাহসিক রোমাঞ্চকর কাহিনীর শ্রুতিলিখনের কাজটি আমি করেছিলাম। শিয়ালকোট সেনানিবাস পাক-ভারত সীমান্ত থেকে দূরে নয়। মেজর মঞ্জুর সপরিবারে আছেন সেখানে। মেজর তাহের, মেজর জিয়াউদ্দিন এবং ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী একটি ভোক্সওয়াগনে এবোটাবাদ থেকে শিয়ালকোটে মেজর মঞ্জুরের বাড়িতে এসেছেন দিনের বেলাটা কাটাতে। ঐ রাতেই তারা সীমান্ত পাড়ি দেবেন। তাহের লিখছেন, ‘মঞ্জুরের সঙ্গে অনেক আলাপ-আলোচনা হলো। শেষ পর্যন্ত আমাদের পালাবার পরিকল্পনা তাকে বললাম এবং তাকেও আমাদের সঙ্গী হতে অনুরোধ জানালাম। মঞ্জুরের স্ত্রী, তিন বছরের মেয়ে ও কয়েক মাসের একটি ছেলে সে সময় তার সঙ্গেই ছিল। এ অবস্থায় পালানো মঞ্জুর বিপজ্জনক মনে করল এবং আমাদের সঙ্গে যেতে রাজি হলো না। কিন্তু মঞ্জুরের স্ত্রী আমাদের সঙ্গে আসার জন্য জেদ ধরে বসলেন। 
রাত পৌনে ৯টায় কোন রকমে চাপাচাপি করে আমরা গাড়িতে বসে রওয়ানা হলাম। চলার পূর্বে মিসেস মঞ্জুর বাচ্চা দুটোকে শান্ত রাখার জন্য স্লিপিং পিল খাইয়ে দিলেন। রাত দুটোর সময় একটা শুকনো খালের পাড়ে আমরা উপস্থিত হলাম। খালের ভেতর টর্চ জ্বালিয়ে আবার ম্যাপটি ভাল করে দেখা হলো। এবার আমরা ভুল করিনি। সীমান্ত থেকে ৩ মাইল ভেতরে চলে এসেছি। কয়েক শত গজ দূরেই ভারতীয় সীমান্ত ঘাঁটি দেবীগড়। মিসেস মঞ্জুর তার বাচ্চাদের একটি গাছের নিচে শুইয়ে দিলেন। ভোরের প্রত্যাশায় আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলাম।’
প্রত্যাশার সে ভোর এসেছিল। মুক্তিযুদ্ধে চার সেনানী অসীম সাহসিকতায় যুদ্ধ করেছেন। মেজর মঞ্জুর আট নম্বর সেক্টর অধিনায়ক, মেজর তাহের ১১ নম্বর সেক্টরের। মেজর জিয়াউদ্দিন জেড ফোর্সের ব্যাটালিয়ন কমান্ডার এবং ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী কোম্পানি কমান্ডার। তিন বছরের মেয়েটি মুক্তিযুদ্ধ পার করেছে। হয়ত আবছা কোন স্মৃতি সে এখনও ধরে রেখেছে। মেয়েটির নাম রুবানা মঞ্জুর। ওকে দেখেছিলাম ১৯৮১ সালের জুন মাসে কোন এক দিনে। ঢাকার ভূতের গলিতে তাদের এক আত্মীয়ের বাসায়। ৩ বছরের মেয়েটি তখন ১৩ বছরের কিশোরী। ঘোর দুর্দিন তাদের। ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই শত্রুদেশ পাকিস্তান থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বন্ধু দেশে আশ্রয় পেয়েছিলেন মঞ্জুর, রুবানা ও তাদের পরিবার। আর যে দেশ স্বাধীন করতে মঞ্জুর জীবনপণ লড়াই করেছেন, জয়লাভ করেছেন, সেই দেশ আজ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শত্রুদের দখলে। তারা তাকে হত্যা করবে। ১৯৮১ সালের পয়লা জুন ঐ শত্রুদের হাত থেকে জীবন বাঁচাতে মঞ্জুর ও তার পরিবারের কোন নিরাপদ আশ্রয় পাওয়া গেলনা স্বদেশ ভূমিতে। ফটিকছড়ির অরণ্য থেকে গ্রেফতারের পর রুবানা, তার ভাইবোন ও মায়ের কাছ থেকে বাবাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেছে ঘাতকেরা। সে রাতেই তাঁকে হত্যা করেছে সেই চট্টগ্রাম ক্যান্টমেন্টে, যার জিওসি ছিলেন রুবানার সদা হাস্যময় পিতা জেনারেল মঞ্জুর। শুধু শোকের নয়, চোখের সামনে ঘটে যাওয়া এক অবিশ্বাস্য নিষ্ঠুরতার ভয়াবহ দৃশ্য সে, তার ছোট তিন ভাইবোন এবং মাকে স্তব্ধ করে রেখেছে। অবিশ্বাস ও আতঙ্ক তাদের চোখেমুখে। মিসেস মঞ্জুর জানালেন, ভয়ে কেউ দেখা করতে আসে না। এরপর বেশ কয়েকবার মিসেস মঞ্জুরের সঙ্গে দেখা করেছি। সর্বশেষ তাঁর সঙ্গে দেখা হয় ১৯৮১ সালের নবেম্বর মাসের শেষে। লন্ডনে যাবার একটি আমন্ত্রণ পাই আমি সে সময়। ১৯৮০ সালের শেষে প্রায় ৫ বছর কারাভোগের পর মুক্তিলাভ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় আবার যোগ দিয়েছি। মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফৎশুলজ আছেন সেখানে, ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভাবলাম মিসেস মঞ্জুরের একটি সাক্ষাতকার নিয়ে যাই। লিফৎশুলজকে তা পৌঁছে দেব। ১৯৭৫-এর ৭ নবেম্বর তাহেরের নেতৃত্বে সিপাহী অভ্যুত্থান, ঢাকা কারাগারে গোপন বিচার, জিয়ার ষড়যন্ত্রে ফাঁসিতে তাহেরের হত্যাকা-- এসব নিয়ে লরেন্স লিফৎশুলজের ‘টহভরহরংযবফ জবাড়ষঁঃরড়হ– ঞধযবৎ’ং খধংঃ ঞবংঃধসবহঃ’ লন্ডনের জেড প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়েছে ১৯৭৯ সালের জুলাই মাসে। তাহেরের ’৭১-এর সহযোগী জেনারেল মঞ্জুরের নির্মম হত্যাকা- বিষয়ে প্রকৃত ঘটনা অনুসন্ধান করার জন্য লরেন্সকেই একমাত্র যোগ্য ও নির্ভরশীল মানুষ বলে মনে হলো। মনে আছে ভূতের গলির বাড়িতে সারারাত জেগে মিসেস মঞ্জুর চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে জেনারেল জিয়ার হত্যাকা-ে তাঁর স্বামী জেনারেল মঞ্জুরের যে কোন সম্পৃক্ততা ছিল না সে বিষয়ে বিশদে লিখেছিলেন। ইংরেজীতে মিসেস মঞ্জুরের হাতে লেখা বিবরণ নিয়ে ১৯৮১ সালের ২৭ নবেম্বর তারিখে আমি লন্ডনে যাই। লরেন্স লিফৎশুলজের সঙ্গে দেখা হলে তাঁকে তা প্রদান করে অনুরোধ করি সত্য উদ্ঘাটনে এগিয়ে আসতে। যেমনটা তিনি করেছিলেন তাহের হত্যাকা- নিয়ে। ইতোমধ্যেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদের ষড়যন্ত্রে জিয়া ও মঞ্জুর নিহত হয়েছেন। রহস্যজনক গুলিতে নিহত হন জিয়া হত্যায় সরাসরি অংশগ্রহণকারী বলে কথিত লে. কর্নেল মতিউর রহমান ও লে. কর্নেল মাহবুব। এরপর তড়িঘড়ি কোর্ট মার্শাল করে ১৯৮১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর তারিখ রাতে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয় আরও ১৩ জন অফিসারকে। এদের মধ্যে ১১ জনই মুক্তিযোদ্ধা। এ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ৫ জন বীরত্বসূচক খেতাব পেয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের জন্য। যেমনটা পেয়েছিলেন মতিউর রহমান ও মাহবুব। ফাঁসিতে নিহত ২ জন কনিষ্ঠ অফিসার ১৯৭৬ এবং ১৯৭৮-এ কমিশন পেয়েছিলেন।
২০১৪ সালের পয়লা জুন জেনারেল মঞ্জুর হত্যাকা-ের ৩৩ বছর পার হবে। তাঁর কন্যা রুবানা একটি মর্মস্পর্শী সাক্ষাতকার দিয়েছে। সে সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন অন্য কেউ নয়, লরেন্স লিফৎশুলজ। ইংরেজীতে দেয়া রুবানার কথাগুলো দুটো জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে। কি বলেছে সে? সে একটি সুষ্ঠু বিচার প্রার্থনা করেছে। এও বলেছে, যারা তার বাবাকে হত্যা করেছে, তাদের যেন আইনের আওতায় আনা হয় এবং তাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হয়। তাহলেই মা এবং তারা চার ভাইবোন এত বছর পরেও শান্তি পাবে। ৩৩ বছর ধরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে রুবানা ও তার পরিবারের। তারপরও রুবানার কথায় কোন বিদ্বেষ বা অভিযোগ নেই। বলেছে, বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা সেই শক্ত অবস্থানে দাঁড়াক যাতে সবার জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়। আরও বলেছে, শুধুমাত্র তার বাবার মতো মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ন্যায়বিচার নয়, যে দেশ তারা সৃষ্টি করেছেন, তার প্রতিটি নাগরিকের জন্য তা প্রসারিত হোক। বাবার হাসিটির কথা সবচেয়ে বেশি তার মনে পড়ে। চার ভাইবোন বাবার বিশেষ কোন বৈশিষ্ট্যটি পেয়েছে, তা বলেছে রুবানা।
বিষাদের সেই দিন, ১৯৮১’র পয়লা জুনের মর্মস্পর্শী বর্ণনা আছে রুবানার ভাষ্যে। আমি বাবার কোমর জড়িয়ে ধরে ছিলাম। আর সবাই মিলে কাঁদছিলাম। ওরা জোর করে বাবাকে ছিনিয়ে নিল। আর তাকে দেখিনি। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বাবাকে খুন করে তারা। তাকে বড় ভালবাসি।
রুবানা বলেছে, যখন কোন বাবা বা স্বামী খুন হয়ে যান, তখন হয়ত অনেকে কষ্ট পায়, সমব্যথী হয়, বিচারের দাবিও জানায় কিন্তু সন্তান বা স্ত্রীর জন্য তা বয়ে আনে সারা জীবনব্যাপী গভীর দুঃখ ও যাতনা। বাবাকে কোথায় কূপে রাখা হয়েছে তা জানতে চায় রুবানা। সে কবরে তারা যেতে চায়, বাবার জন্য দোয়া করতে চায়। এক বীরউত্তম মুক্তিযোদ্ধাকে কেন অজ্ঞাত জায়গায় কূপে রাখা হবে? সরকার ও সেনাবাহিনীর কাছে সে দাবি করেছে সেই জায়গাটি খুঁজে বের করার, যেখানে তাঁর মুক্তিযোদ্ধা পিতা শায়িত আছেন। মুক্তিযুদ্ধের একজন অন্যতম সেক্টর কমান্ডার, একজন বীর উত্তম পিতার জন্য কন্যার একি খুব বড় চাওয়া? সাক্ষাতকার শেষ করেছে সে এই বলে যে এদেশের মানুষের বিচার চাওয়ার আওয়াজটি আবারও উচ্চকিত হবে এবং সবাই তা শুনবে।
আমার লেখাটি এখানেই শেষ করতে পারতাম। কিন্তু কয়েকটি জরুরী কথা বলা প্রয়োজন। সেটি জেনারেল এরশাদকে নিয়ে। লরেন্স লিফৎশুলজের ধারাবাহিক গভীর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, মঞ্জুর হত্যাকা-ের মূল পরিকল্পনাকারী জেনারেল এরশাদ। তাই এ বিষয়ে আর আলোচনা না করে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে এ ব্যক্তিটির ভূমিকা বিষয়ে বলব। ইউপিএল থেকে ১৯৯১ সালে প্রকাশিত মেজর রফিকুল ইসলাম, পিএসসি রচিত পুস্তক ‘স্বৈর শাসনের নয় বছর (১৯৮২-৯০)’-এর সাহায্য নেব। মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধ গবেষক মেজর সামসুল আরেফিনের কাছ থেকে জানলাম, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে প্রথম ব্যাচের অফিসার মেজর রফিকুল ইসলাম আর বেঁচে নেই। পুস্তকের ৩১ থেকে ৩৬ পৃষ্ঠায় মেজর রফিকুল ইসলাম লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ যখন মুক্তিযুদ্ধরত এরশাদ তখন পাকিস্তানে সপ্তম ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক ছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল তাঁর অধিনায়কত্বে যখন পাকিস্তানের হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, তখন ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ডের আওতায় মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশকে স্বাধীন করার মরণপণ লড়াইয়ে লিপ্ত। একাত্তরের ২৫-২৬ মার্চ মধ্যরাত্রিতে যখন পাকিস্তানী সৈন্যরা পাশবিক হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়, তখন এরশাদ রংপুরে ছুটি ভোগরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে যোগদান না করে এপ্রিলের প্রথম দিকে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে পাড়ি জমান এবং সপ্তম ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক হিসেবে পুনরায় যোগদান করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অসুস্থ পিতাকে দেখার জন্য তিনি সেপ্টেম্বরে রংপুরে এসেছিলেন। এবারেও তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ না দিয়ে পাকিস্তানে ফিরে যান। ১৯৭২ সালে পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালী অফিসার ও সৈন্যদের দেশদ্রোহিতার অভিযোগে বিচার শুরু হলে লে. কর্নেল এরশাদকে উল্লেখিত ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়। সুতরাং এইসব কারণে স্বাধীন বাংলাদেশে তার চাকরি থাকার কথা নয়। তবুও তাকে সেনাবাহিনীতে স্থান দেয়া হয় এবং এই বিপজ্জনক ব্যক্তির সেনাবাহিনীতে বহাল থাকার পরিণতি সবার জানা। 
১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ ও বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকারের চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয় এবং মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ও এয়ার ভাইস মার্শাল এমজি তাওয়াবকে যথাক্রমে সেনাবাহিনী প্রধান ও বিমানবাহিনী প্রধান নিয়োগ করা হয়। একই সঙ্গে সেনাবাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা ও অমুক্তিযোদ্ধা এই দু’দলের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার জন্য ডিফেন্স এডভাইজার জেনারেল ওসমানীর পরামর্শে ভারতে কোর্সে অংশগ্রহণরত এরশাদকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে সেনাবাহিনীর উপ স্টাফ প্রধান নিয়োগ করা হয়।
রাষ্ট্রপতি জিয়া প্রশাসনের সর্বস্তরে স্বাধীনতা বিরোধীদের পুনর্বাসিত করেই ক্ষান্ত হলেন না। মেজর জেনারেল এরশাদকে সেনাবাহিনীতে স্টাফ প্রধান হিসেবে নিয়োগ করলেন এবং লে. জেনারেল পদে পদোন্নতি দিলেন। .... জিয়া কর্তৃক তার মন্ত্রিসভায় স্বাধীনতা বিরোধীদের স্থান দেয়া এবং প্রশাসনে স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সোচ্চার ছিলেন জেনারেল মঞ্জুর। মঞ্জুরের এই স্পষ্টবাদিতাকে দাবার ঘুঁটির মতো ব্যবহার করলেন এরশাদ। ....এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, এরশাদ পাকিস্তান ফেরৎ হওয়া সত্ত্বেও ধূর্ততার সঙ্গে অগ্রসর হয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে গঠিত সেনাবাহিনীর প্রধান পদটি দখল করেন।”
উপরে মেজর রফিকুল ইসলামের বর্ণনা থেকে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ভূমিকার জন্য জেনারেল এরশাদকে একজন কোলাবোরেটর হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। তাই জেনারেল মঞ্জুর হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে শুধু নয়, একজন ঘৃণিত কোলাবোরেটর হিসেবে তার বিচার হওয়া প্রয়োজন তিনি জীবিত থাকতেই।
শেষ করব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে একটি আবেদন জানিয়ে। আপনি বিচারহীনতার অপসংস্কৃতির (ঈঁষঃঁৎব ড়ভ রসঢ়ঁহরঃু) বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। সেজন্য জাতির জনকের হত্যাকা-ের সুষ্ঠু বিচার সম্পন্ন হয়েছে। ৩৫ বছর অপেক্ষার পর আমরা তাহের পরিবার জেনারেল জিয়া কর্তৃক তাহের হত্যার বিচার পেয়েছি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। ৩৩ বছর আগে যে ষড়যন্ত্রে মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী জেনারেল মঞ্জুর বীর উত্তমকে খুন করা হয়েছিল, তার বিচার প্রক্রিয়া বহু বছর ধরে থেমে আছে। তার কন্যা রুবানা মঞ্জুর তার মর্মস্পর্শী সাক্ষাতকারে পিতা হত্যার সুবিচারে আপনার সাহায্য চেয়েছে। সাক্ষাতকারে আপনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে সে বলেছে, মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী শক্তির হাতে আপনার পিতা-মাতা, পরিবার-পরিজন নিহত হয়েছেন। নিশ্চয়ই আপনি তাদের অশেষ ব্যথাটি বুঝবেন। সে আরও বলেছে এরশাদের পতনের পর তার মা রানা মঞ্জুর আপনার সঙ্গে সাক্ষাত করেছিলেন। দু’জন নারী যাঁদের পরিবার-পরিজনকে খুন করা হয়েছে তারা কথা বলেছিলেন সমব্যথী হয়ে। সে গভীর আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছে শেখ হাসিনা তাদের গভীর যাতনা উপলব্ধি করে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় অগ্রসর হবেন।
আরও একটি নিবেদন আপনার প্রতি। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে এবং স্বৈরশাসনের নয় বছরে এরশাদের ভূমিকা আপনার এবং গণতন্ত্রকামী দেশবাসী সকলের জানা। জামায়াত-বিএনপির হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে এই স্বৈরশাসকের সঙ্গে নির্বাচনী মোর্চা আপনি করেছেন, মন্ত্রিসভায় তার দলের নেতাদের স্থান দিয়েছেন। এর ভাল-মন্দের বিচার নির্মোহ দৃষ্টিতে জনগণ বিচার করবে। তবে এক অর্থে দেশদ্রোহী এবং কোলাবোরেটর জেনারেল এরশাদকে আপনার বিশেষ দূত নিয়োগ করাতে অনেকে মর্মাহত হয়েছেন। এ পদ থেকে অবিলম্বে এরশাদকে সরিয়ে দিন। মঞ্জুর হত্যাকা-ে জেনারেল এরশাদের সংশ্লিষ্টতা আরও দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করে তাকে বিচারের আওতায় আনার ব্যবস্থা নিতে আপনার সদয় নির্দেশ প্রদান করুন। দেশে বিচারহীনতার বিরুদ্ধে যে কঠিন সংগ্রামে আপনি অবতীর্ণ হয়েছেন, তাতে মঞ্জুর হত্যাকা-ের সুষ্ঠু বিচার এদেশে সকল নাগরিকের বিচার পাওয়ার অধিকার আরও নিশ্চিত করবে। 

লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Tuesday, June 3, 2014

আদম মালিক, জিয়া এবং প্রথম রাষ্ট্রপতি বিতর্ক- আনিস আলমগীর


স্বাধীনতার একযুগের মাথায় রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জিয়াউর রহমানের মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর পর তার দল আবিষ্কার করে যে, জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক। আর স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর জিয়ার স্ত্রী-পুত্র মিলে আবিষ্কার করেছেন জিয়া শুধু ঘোষকই নন, বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি!
মূলত গত ২৫ মার্চ মঙ্গলবার স্থানীয় সময় দেড়টায় পূর্ব লন্ডনের রয়েল রিজেন্সি অডিটরিয়ামে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে যুক্তরাজ্য বিএনপি আয়োজিত ‘বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ও স্বাধীনতার ঘোষক’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তারেক রহমান প্রথম তার আবিষ্কারের কথা বলেন। বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়া তারই প্রতিধ্বনি করেন ঢাকায়। জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট দাবি করে তারেক রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষকে সঠিক ইতিহাস জানানোর সময় এসেছে। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট এটাই সত্যি, এটাই ইতিহাস। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।’
প্রথম রাষ্ট্রপতি বানানোর এই আয়োজন যে হঠাৎ করে আসেনি, এটা যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র সেটা তারেক জিয়ার আলোচনা সভার টাইটেল থেকেই বোঝা যায়, ‘বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ও স্বাধীনতার ঘোষক।’ আমার জানা মতে, বেগম জিয়া ঢাকায় তার ছেলের বক্তব্য প্রতিধ্বনি করার আগে ১৯ দলীয় জোটের নেতাদের সঙ্গেও এটা নিয়ে আলাপ করেছেন এবং তাদেরও একই সুরে কথা বলার অনুরোধ করেছেন। কাজী জাফররা হয়তো শিগগির একই সুরে বাজনা বাজাবেন।
তারেক জিয়া স্বাধীনতাযুদ্ধকালে শিশু ছিলেন। ওই যুদ্ধের স্মৃতি তার তেমন না থাকারই কথা। বেগম জিয়া ভালোভাবেই দেখেছেন ওই যুদ্ধ। তার স্বামী স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নিয়ে যখন ভারতে, তাকে চট্টগ্রামের বাসা থেকে শুভপুর হয়ে আগরতলা নিয়ে যেতে লোক পাঠিয়েছিলেন জিয়া। সেই লোকদের একজন আমাকে বলেছেন, তিনি হাঁটতে পারবেন না। বাসে, হেঁটে এতদূর কীভাবে যাবেন প্রশ্ন তুলেছিলেন। পরে জাহাজে করে ঢাকা চলে গেছেন। দেশের বিজয় অর্জন পর্যন্ত তিনি ঢাকা ক্যান্টমেন্টে ছিলেন। বেগম জিয়ার ক্যান্টমেন্টে অবস্থান নিয়ে নানা কথা চালু আছে। সেই ইতিহাসে না গিয়ে শুধু একটা কথা বলতে চাই, আজ দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার হচ্ছে, ?ফাঁসিও হয়েছে যুদ্ধাপরাধীর। পাকিস্তানি আর্মিকে সহযোগিতার অভিযোগ এনে একদিন কেউ খালেদা জিয়াকেও যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে বিচার দাবি করলে আশ্চর্য হব না। খালেদা জিয়া যখন ইতিহাস বিকৃতিতে নেমেছেন তখন আওয়ামী লীগ মুখ বন্ধ করে বসে থাকবে মনে হয় না। তবে তাতে কী হবে? জাতীয় নেতাদের অতীতের বিতর্কিত জীবন জনসম্মুখে প্রকাশ পেয়ে যাবে। অহেতুক আরেকটি বিতর্কের শুরু হবে, যা দেশের মানুষের মোটেও কাম্য নয়।
উচ্চ আদালত থেকে এ সংক্রান্ত নির্দেশনার পরও যারা জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলেন, এখন প্রথম রাষ্ট্রপতি বলে যারা রাজনৈতিক বিতর্ক করতে চান, তারা আসলে কুতর্কের জন্যই এসব চান। জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতাযুদ্ধে যে অবদান ছিল সেটাকে খাটো করার জন্য, তার স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণের নেপথ্য কাহিনী যে যেভাবেই আবিষ্কার করা হোক না কেন এটা তো বলা যাচ্ছে না, মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার কোনো অবদান ছিল না। এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বেতার থেকে তিনি একটি ঘোষণা দিয়েছেন। এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ওই ঘোষণার প্রথমটিতে জিয়া নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেছিলেন। পরোক্ষণে নিজের ভুল বুঝতে পারেন এবং মরহুম একে খানের পরামর্শে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন, যা জিয়ার আগে আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নানসহ অন্যরাও পাঠ করেছেন। ছাত্রলীগের তৎকালীন সিটি নেতা বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী দাবি করেন, ‘ঘোষণা পাঠ যদি স্বাধীনতার ঘোষণা হয় তাহলে ছাত্রলীগ নেতারাই প্রথম স্বাধীনতার ঘোষক’। ২৫ মার্চ রাতে জহুর আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা করেছেন বলে আমাদের মাইকিং করতে নামিয়ে দেন শহরে। রিকশায় রিকশায় রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত আমরা বাংলাদেশ স্বাধীন বলে প্রচার চালাই।

 প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যানুসারে, জিয়া যখন ২৭ মার্চ কালুরঘাটের ব্রিজের নিচ থেকে রেডিওস্টেশনে আসেন, তার পরিচয় জানতে চান বেলাল মোহাম্মদসহ রেডিও কর্মীরা। তিনি বলেন, আমি মেজর জিয়া। তখন তারা বলেন, আমরা সবাই তো মাইনর, আপনি একজন মেজর আছেন। আপনি কিছু বলেন। আমরা আগ্রাবাদ থেকে রেডিওর সম্প্রচার যন্ত্র খুলে নিয়ে এসেছি। জিয়া তখন নিজেকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান ও স্বাধীনতার অস্থায়ী প্রধান সমরনায়ক বলে তার প্রথম ঘোষণাটি দেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সেই ঘোষণা দিলেই জিয়া দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হয়ে যাবেন? পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতাযুদ্ধকালে সেখানকার নেতা আদম মালিক, যিনি পরে সেদেশের ভাইস প্রেসিডেন্টসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন, নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীন ইন্দোনেশিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি কিন্তু সুকর্ণই ছিলেন, জাতির পিতাও তিনি। যুদ্ধের ডামাডোলে কত ঘটনাই ঘটে, জাতি সেটা ভুলে যায়। জিয়াউর রহমানের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। জিয়াউর রহমানের ঘোষণাটি কি ইনটেনশনাল নাকি নেহায়েত ভুল এ নিয়ে যুদ্ধকালে কলকাতায় প্রবাসী সরকারেও চলছিল নানা আলোচনা। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, জেনারেল ওসমানী, মরহুম জহুর আহমেদ চৌধুরী প্রমুখ এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ ঘোষণার জন্য তাকে কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মিজানুর রহমান চৌধুরী ও আখতারুজ্জামান চৌধুরীর হস্তক্ষেপে তা আর হয়নি।

 বিএনপির নেতা ও বুদ্ধিজীবীরা যুক্তি দিচ্ছেন, যেহেতু কালুরঘাটের সেই ঘোষণা থেকে ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে প্রবাসী সরকার গঠন পর্যন্ত দেশে কোনো সরকার ছিল না,  রাষ্ট্রপ্রধান ছিল না তাই জিয়া ওই সময় পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি ছিলেন। বিএনপি চেয়ারপার্সনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান এ প্রসঙ্গে একটি কলামে  লিখেছেন, ‘জিয়াউর রহমানের ঘোষণা অস্বীকার করলে স্বাধীনতার যুদ্ধকেই অস্বীকার করা হয়, এর ইতিহাস বিকৃত ও ধারাবাহিকতা বিঘিœত হয়। জিয়া নিজেকে তার ঘোষণায় বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান রূপে উপস্থাপন করেছিলেন। তার স্বাধীনতার ঘোষণা বৈধ হলে, প্রবাসী সরকার গঠন না হওয়া পর্যন্ত অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবেও তিনিই বৈধ ছিলেন। তার এই ঘোষণাকে আর কোনো ঘোষণা মারফত কোনো বৈধ কর্তৃপক্ষ কখনো রদ বা রহিত করেননি।’
কি হালকা, হাস্যকর যুক্তি। তিনি এর পরের কাহিনী বেমালুম চেপে গেলেন কেন জানি না। জিয়ার ঘোষণা তো জিয়া নিজেই রদ করেছেন পরোক্ষণে ‘আমি মেজর জিয়া প্রভিশনাল কমান্ড ইন চিফ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করছি’ বলে ভাষণ দিয়ে। এখানে অন্যকে রদ করতে হবে কেন! এই যে যার পক্ষে তিনি তার ঘোষণা রদ করলেন তিনি তাহলে কে? যিনি নিজের ভাষণে নিজেকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বলে পরোক্ষণেই তা বাতিল করে দিয়েছেন, যিনি নিজেকে জীবিত থাকাকালে কোনোদিন স্বাধীনতার ঘোষক বলেননি তাকে জোর করে আরেকজনের সমান বানানোর অসুস্থ প্রতিযোগিতা কতটুকু সন্মান বয়ে আনে ওই মানুষটির জন্য?
স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়টি আর এখন গোপন কোনো দলিল নয়। সবাই জানেন। মনে হচ্ছে জানতে এবং মানতে চান না শুধু বিএনপির কিছু নেতা। তারা এটাও বিশ্বাস করাতে চান যে, শেখ মুজিবের ডাকে নয়, জিয়ার ডাকে এদেশের মানুষ যুদ্ধ করেছে। সবচেয়ে হাস্যকর হচ্ছে, ২৭ মার্চ এবং তার পরের কালুরঘাটের সেই ঘোষণা নাকি সারাদেশের মানুষকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার অনুপ্রেরণা দিয়েছে! রংপুরের বিএনপি নেতারা তেমন দাবি করেন, নিজের কানে শুনেছেন বলে। বাস্তবতা হচ্ছে, কালুরঘাট বেতারের চট্টগ্রাম থেকে ফেনী পর্যন্ত আসা মুশকিল ছিল।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তারেক রহমান বা বেগম জিয়ার ভাষ্যানুসারে ‘জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার  মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল’ কথাটা যদি সত্য হয়, সেনাবাহিনীর মেজরের চাকরির মোহ ত্যাগ করে সেনানিবাস ছেড়ে জিয়াউর রহমান সহকর্মীদের নিয়ে কালুরঘাট ব্রিজের নিচে অবস্থান নিয়েছিলেন কার আহ্বানে? কেন ট্র–পস নিয়ে ব্যাংকারে অবস্থান করে আরাকান রোড দিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা কক্সবাজারের দিকে মার্চ করলে প্রতিরোধ করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি? কার আহ্বানে মেজর শওকত, মেজর রফিক, ক্যাপ্টেন অলি আহমদ, ক্যাপ্টেন শমশের মবিনসহ অন্যরা তার সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন? ক্যান্টনমেন্ট ছেড়েছেন? খালেদা জিয়া এবং তারেক জিয়া না বললেও, এটি বলার অপেক্ষা রাখে না আহ্বানটি ছিল বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের।
আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধটি কোনো নিয়মিত যুদ্ধ ছিল না, এটি ছিল জনযুদ্ধ। ঘরে ঘরে গিয়ে বলে এলে যুদ্ধ হয় না, যুদ্ধের জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রস্তুতি দরকার। দীর্ঘ ২৩ বছর সে প্রস্তুতির কাজটি করেছেন শেখ মুজিবুর রহমান এবং বাংলাদেশের মানুষকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করেছেন। আমরা বাঙালি, ওরা পাকিস্তানি আমরা কখনো এক হয়ে থাকতে পারব না, এই বোধ একদিনে তৈরি হয়নি। যুদ্ধের এই প্রস্তুতি কত তেজদীপ্ত ছিল যে জিয়াউর রহমানের মতো একটি নিয়মতান্ত্রিক বাহিনীর সদস্যরা ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে কালুরঘাটে অবস্থান নিয়েছেন, মওলানা ভাসানীর মতো একজন বরেণ্য নেতা পথের ক্লান্তি ভুলে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে আসামে পৌঁছেছিলেন। শেখ মুজিব বাঙালির ধমনীতে স্বাধীনতার যে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন স্বাধীনতা ছাড়া তা নির্বাপিত হতো না। বাঙালির সে আকাক্সক্ষা কারো ঘোষণার মুখাপেক্ষী  ছিল না। কোনো জনগোষ্ঠীর কাজ সফল হতে পারে না যদি না সময় ও আবহাওয়া অনুকূলে না থাকে। শক্তিশালী নেতা আবহাওয়া তৈরি করে সাফল্য আনতে পারেন। শেখ মুজিব ৬ দফা আন্দোলন করে জাতিকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করেছেন স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে তিনি বাঙালি জাতির আইনানুগ অভিভাবকত্ব পেয়েছিলেন। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ মিলে আওয়ামী লীগের আসনসংখ্যা তখন ছিল ৪১৭টি।  মূলত তখন তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের ঋষি হয়ে উঠেছিলেন। বাঙালির জাতির পিতা হিসেবে আভির্ভূত হওয়ার পথে এগিয়ে গিয়েছিলেন।
পরিশেষে বলব, সীমার বাইরে নিজেকে, নিজের পরিবারকে মর্যাদার আসনে বসাতে গিয়ে দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্যকে অস্বীকার করা বেগম জিয়া ও তারেক জিয়ার জন্য সুখকর হবে না। একটি ঐতিহাসিক সত্য তাদের অবগতির জন্য বলে রাখি গান্ধী না থাকলেও ভারত স্বাধীন হতো কিন্তু জিন্নাহ আর শেখ মুজিব না থাকলে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সৃষ্টি হতো না।

Monday, June 2, 2014

পাঠ্যবইয়ে জামায়াতের ভূয়সী প্রশংসা- উবায়দুল্লাহ বাদল



মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) অধিকাংশ বইতে স্থান পেয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর নীতি ও আদর্শ। ইসলামের নামে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে জামায়াত-শিবির যেসব কৌশল অনুসরণ করছে, সেগুলোই সরকারি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করে পরিবর্তন করা হচ্ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মন-মানসিকতা।

মাদ্রাসা শিক্ষার ইবতেদায়ি (প্রাথমিক) থেকে শুরু করে কামিল (স্নাতকোত্তর) পর্যন্ত সব স্তরের পাঠ্যপুস্তক ও নোট-গাইডে সুকৌশলে জামায়াতের দর্শন- মওদুদীবাদ ও তাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয়েছে। এমনকি এসব বই প্রকাশ করেছে জামায়াত-শিবিরের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা ১০টি প্রতিষ্ঠান।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পাঠ্যপুস্তক পর্যালোচনা কমিটির প্রতিবেদন থেকে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। আলিয়া মাদ্রাসার অধিকাংশ পাঠ্যপুস্তক ও গাইড বই পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর প্রণয়ন করা হয়েছে এ প্রতিবেদন। বিশেষজ্ঞ আলেম, মুফতি, মুফাসসির ও মুহাদ্দিস সমন্বয়ে গঠিত ২১ সদস্যের কমিটি ব্যাপক পর্যালোচনার পর প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। জামায়াতি ও মওদুদী দর্শনযুক্ত বই অবিলম্বে বাজার থেকে প্রত্যাহারসহ সাত দফা সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।


এছাড়া মাদ্রাসার বইতে দেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাসকে উপেক্ষা করা, জাতির পিতা শব্দ ব্যবহার না করা এবং ইসলামের মৌলিক শিক্ষার বদলে জামায়াতি দর্শন শেখানো হচ্ছে বলে কমিটির পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়। ২১ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটি সোমবার সরকারের জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ এবং প্রতিকার কমিটির কাছে হস্তান্তর করেছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন।
জানতে চাইলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, এ প্রতিবেদনই প্রমাণ করবে কিভাবে শিক্ষার নামে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জামায়াতি ও মওদুদী দর্শন পড়ানো হচ্ছে। এ প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হলে দেশ ও জাতি জঙ্গিবাদ থেকে রেহাই পাবে।

প্রতিবেদন পাওয়ার বিষয় নিশ্চিত করে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ এবং প্রতিকার সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. কামাল উদ্দিন আহমদ যুগান্তরকে বলেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন পেয়েছি। কমিটির আগামী বৈঠকে তা উত্থাপন করা হবে। তাদের সুপারিশ পর্যালোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে কমিটি।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন পর্যালোচনা কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, আলিয়া মাদ্রাসার প্রথম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তক এনসিটিবির সহযোগিতায় মাদ্রাসা বোর্ডের তত্ত্বাবধানে রচিত ও প্রকাশিত হয়। সাধারণ শিক্ষার ক্ষেত্রে এনসিটিবি বইয়ের যাচাই-বাছাই বা মনিটরিং করতে একটি কমিটি কাজ করলেও মাদ্রাসার ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো কমিটি নেই। এছাড়া মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড শুধু আলিম (একাদশ) শ্রেণীর বইয়ের সিলেবাস প্রণয়ন করে থাকে। কিন্তু বোর্ড নিজেরা কোনো বই প্রকাশ করে না। তবে অধিকাংশ বইয়ে লেখা থাকে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত অথবা মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের সর্বশেষ সিলেবাস অনুযায়ী প্রণীত। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের নামে এসব বই বাজারজাত করা হলেও সিলেবাস প্রণয়ন ও বই প্রকাশের অনুমোদন সংক্রান্ত কোনো তদারকি নেই তাদের।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মাদ্রাসার প্রথম থেকে কামিল শ্রেণী পর্যন্ত সব পাঠ্যপুস্তকের প্রচুর নোট ও গাইড বই বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান প্রকাশ করে থাকে। সেসব নোট-গাইডে সিলেবাসের বাইরে জামায়াত-শিবিরের মতাদর্শ সুকৌশলে তুলে ধরা হয়। কোরআন-হাদিসের উদ্ধৃতি ব্যবহার করে বাংলা অনুবাদ দেয়া হলেও কোনো রেফারেন্স বইয়ে উল্লেখ করা হয় না। এসব অনুবাদের ক্ষেত্রেও দলটির নীতি ও আদর্শ তুলে ধরা হয়।


এসব বই ও গাইড যেসব প্রতিষ্ঠান প্রকাশ করেছে, সেগুলো জামায়াতে ইসলামীর ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা। ইসলামী ব্যাংক ও জামায়াতের আর্থিক সহায়তায় গড়ে ওঠা এমন ১০ প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করেছে কমিটি। এগুলো হচ্ছে- আল-ফাতাহ পাবলিকেশন্স, আল-বারাকা প্রকাশনী, পাঞ্জেরী প্রকাশনী, কামিয়াব প্রকাশনী, আল মদিনা প্রকাশনী, মিল্লাত প্রকাশনী, ইমতেহান প্রকাশনী, ইসলামিয়া কুতুবখানা, মাদ্রাসা লাইব্রেরি ও আল-আরাফা প্রকাশনী।


মাদ্রাসার পাঠ্যপুস্তকে দেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাসকে উপেক্ষা করা হয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, বোর্ডের অনুমোদিত ও এনসিটিবি প্রকাশিত মাদ্রাসার তৃতীয় থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান ও সমাজপাঠ বইয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, দেশ পরিচিতি, ধর্মীয় জীবন, জীবন সংস্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্য বিষয়ে কৌশলে পরিহার করা হয়েছে। সিলেবাস এমনভাবে প্রণীত হয়েছে যাতে বাংলাদেশ অধ্যায় স্থান না পায়। এছাড়া এসব বইয়ে বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান শব্দ পরিহার করে শেখ মুজিবুর রহমান শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আলিম থেকে কামিল শ্রেণীর একাধিক বইয়েও মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, জাতীয় পতাকা, শহীদ মিনার ও স্মৃতিসৌধকে পরিহার করা হয়েছে।

মাদ্রাসার পাঠ্যবইতে প্রচুর তথ্যগত ভুল ও অসংগতি রয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ধর্মীয় ও পারিভাষিক বানানের ক্ষেত্রে কোথাও সমতা রক্ষা করা হয়নি। পাঠ্যপুস্তক রচনায় যাদের নাম রয়েছে তারা অনেকেই লেখক হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত নন। এমনকি আলেম হিসেবেও তাদের অনেকের পরিচিতি নেই। পাশাপাশি তৃতীয় থেকে উচ্চতর শ্রেণী পর্যন্ত বয়সস্তর অনুযায়ী কোন শ্রেণীতে কি ধরনের পাঠ ও বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন তাও বিবেচনায় নেয়া হয়নি।

সুপারিশ : মাদ্রাসার পাঠ্যবই জরুরি ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সংশোধন করতে সাত দফা সুপারিশ করেছে পর্যালোচনা কমিটি। সুপারিশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- 

১. যেসব পুস্তকে জামায়াতি আদর্শ ও মওদুদী দর্শন তুলে ধরা হয়েছে সেগুলো অবিলম্বে বাজার থেকে প্রত্যাহার করা। যারা এসব কাজের সঙ্গে জড়িত তাদের ব্যাপারেও ব্যবস্থা নেয়া সমীচীন। কারণ ইসলামের নাম ব্যবহার করে কোন রাজনৈতিক দলের আদর্শ প্রচার জাতীয় চিন্তা-চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। 


২. বাজারে প্রচলিত পাঠ্য সহায়ক পুস্তকগুলোও পর্যালোচনা করার জন্য জাতীয় পর্যায়ে একটি নিরপেক্ষ কমিটি গঠন করে পর্যলোচনা করা।


 ৩. মাদ্রাসার পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে এনসিটিবির ন্যায় বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কারিকুলাম প্রণয়ন কমিটি, লেখক নির্বাচন কমিটি, সম্পাদক নির্বাচন কমিটি ও পাঠ্যপুস্তক পর্যালোচনা কমিটি থাকা প্রয়োজন। কোরআন-সুন্নাহর আলোকে আলেম ও ইসলামী চিন্তাবিদ তৈরি করতে হলে এসব কমিটিতে বিশেষজ্ঞ আলেম, ওলামা, মুফতি, মুহাদ্দিস ও মুফাচ্ছিরদের অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি লেখক নির্বাচনের ক্ষেত্রেও সতর্ক থাকতে হবে, যাতে পাঠ্যপুস্তকে কেউ উদ্দেশ্যমূলকভাবে নিজেদের হীন দলীয় স্বার্থ হাসিল করতে না পারে।


 ৪. মাদ্রাসার উচ্চ শ্রেণীর বইও সরকারিভাবে প্রণয়ন ও বিতরণের ব্যবস্থা করা। আলিম থেকে কামিল পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র সাড়ে তিন লাখ। তাদের বিনামূল্যে বই দিলে সরকারের যে আর্থিক ব্যয় হবে, তার চেয়ে রাষ্ট্রের কল্যাণ অনেক বেশি হবে।


জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, এটি জটিল সমস্যা। একদিনেই এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। যারা প্রকৃত ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত এবং কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নয়, তাদের দিয়ে কমিটি গঠন করে প্রয়োজনীয় সংশোধন করা যেতে পারে। পাঠ্যবই ও পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করার পাশাপাশি কমিটিকে মাদ্রাসার সার্বিক বিষয় মনিটরিং করার ক্ষমতাও দেয়া যেতে পারে। ওই কমিটি পাঠ্যপুস্তকে ইসলামের মানবিকতা, সহনশীলতা, জ্ঞানতাত্ত্বিক বিষয় ও উদার নৈতিক চিন্তার বিষয়গুলোসহ আধুনিক বিজ্ঞানও প্রযুক্তির বিষয় তুলে ধরবে। দলবাজ লোক দিয়ে এ জটিলতা দূর করা সম্ভব নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নেতা ড. অধ্যাপক আখতারুজ্জামান এ বিষয়ে যুগান্তরকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এভাবেই চলছে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা। হঠাৎ করেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়নি। এতদিন কেউ বিষয়টির প্রতি নজর দেয়নি, এবার তা সরকারের নজরে এসেছে। সুতরাং দেরি না করে যোগ্য ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সংশোধন করে জাতিকে এ বিষয়ে পরিত্রাণ দেয়া উচিত





‘যুগে যুগে ব্যক্তি সমষ্টি তথা সমিতি, সংঘ, দল প্রভৃতিও ইসলামী মূল্যবোধের অনুশীলনে যথেষ্ট অবদান রাখছে। বর্তমান শতাব্দীতে মুসলিম বিশ্বে বহু দেশে বহু সংঘ বা দল সমাজে ইসলামী মূল্যবোধে জাগ্রত করার চেষ্টা করছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইখওয়ানুল মুসলেমীন, ইন্দোনেশিয়ান শরীয়ত পার্টি, মালয়েশিয়ায় প্যান মালেয়ান ইসলামী অ্যাসোসিয়েশন, ভারতীয় উপমহাদেশ ও আফগানিস্তানে জামায়াতে ইসলামী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, নেজামে ইসলাম প্রভৃতি রাজনৈতিক দল এবং ছাত্রদের মধ্যে সাবেক ইসলামী ছাত্রসংঘ, ছাত্রশক্তি পরে ইসলামী ছাত্রশিবির প্রভৃতি ছাত্র সংগঠনের যৌথ প্রচেষ্টায় মুসলিম সমাজে অভূতপূর্ব পরিবর্তন সাধিত হয়েছে বা হচ্ছে।’

এটি কোনো রাজনৈতিক দল বা ইসলামী দলের কোনো ওয়েবসাইট বা দলীয় লিফলেট বা মুখপত্রের ভাষা নয়। খোদ বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড অনুমোদিত নতুন সিলেবাস অনুযায়ী আলিম (একাদশ) শ্রেণীর ‘ইসলামী পৌরনীতি’ বইয়ের ৫৬ পৃষ্ঠার অংশ বিশেষ। বোর্ডের অনুমতি সাপেক্ষে বইটি প্রকাশ করেছে ইসলামী ব্যাংক ও জামায়াত-শিবিরের আর্থিক সহায়তায় গড়ে উঠা আল ফাতাহ পাবলিকেশন্স। এভাবেই মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের পৌরনীতি শিক্ষার নামে কৌশলে ধর্মের দোহাই দিয়ে জামায়াত-শিবির কার্যক্রমের প্রশংসা করা হয়েছে। এমন অসংখ্য চিত্র উঠে এসেছে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ‘আলিয়া মাদ্রাসার পাঠ্যপুস্তক পর্যালোচনা প্রতিবেদন’-এ। সোমবার সরকারের ‘জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ এবং প্রতিকার কমিটি’র কাছে প্রতিবেদনটি জমা দিয়েছে ফাউন্ডেশন।

মাদ্রাসার পাঠ্যবইগুলোতে ইসলামের মৌলিক শিক্ষার পরিবর্তে জামায়াতি আদর্শ প্রচারের নিয়ামক হয়ে উঠেছে উল্লেখ করে পর্যালোচনা কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাধীনতাবিরোধীদের দ্বারা আলিম শ্রেণীর ইসলামের ইতিহাস বইটির সিলেবাস প্রণীত হয়েছে। সচেতনভাবেই ইতিহাসের সিলেবাস থেকে বাংলাদেশ অধ্যায় বাদ দেয়া হয়েছে। এ বইয়ে স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধ কোনো কিছুই অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মাদ্রাসা বোর্ড অনুমোদিত বই প্রকাশের দায়িত্ব বাইরের প্রতিষ্ঠানের কাছে ছেড়ে দেয়া এবং সার্বিক মনিটরিং না থাকায় আলিম শ্রেণীর ইসলামের ইতিহাস ও ইসলামী পৌরনীতি বই মওদুদী দর্শন এবং জামায়াতের রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের মুখপত্রে পরিণত হয়েছে। 


বইগুলোতে কোরআন-হাদিসের যে অর্থ দেয়া হয়েছে তার অনুবাদক কে বা কোন সংস্থা তা উল্লেখ না থাকায় জামায়াতি মতাদর্শের আলোকে অর্থ বিকৃত করা হয়েছে। সার্বিক বিচারে আলিম শ্রেণীর ইসলামের ইতিহাস ও ইসলামের পৌরনীতিকে জামায়াতে ইসলামীর প্রচারপত্র বলা হলেও অত্যুক্তি হবে না বলে মন্তব্য করা হয় প্রতিবেদনে। জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বৃহস্পতিবার নিজ দফতরে যুগান্তরকে বলেন, ‘পাঠ্যবই অভিজ্ঞ আলেম-ওলামাদের দ্বারাই প্রণীত। তারা কোনো ভুল করে থাকলে তা পর্যালোচনা করে সংশোধন করা হবে। আর নোট বা গাইডে কোনো ধরনের ভুল তথ্য থাকলে তার ডাবল শাস্তি হবে। কারণ একে তো নোট-গাইড অবৈধ, তার ওপর ভুল তথ্য দিয়ে আরও বড় অপরাধ করেছে। তাদের ধরে পুলিশে দেয়া হবে।’


ইসলামী ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয়েছে, মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের সর্বশেষ সিলেবাস অনুযায়ী আলিম শিক্ষার্থীদের জন্য রচিত এবং আল-বারাকা লাইব্রেরির প্রকাশিত ‘ইসলামী পৌরনীতি’ প্রথম ও দ্বিতীয়পত্র বইতে জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীকে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, বিংশ শতাব্দীর ইসলামী পুনর্জাগরণ আন্দোলনের নেতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, এই বইতে ‘ইসলামী রাষ্ট্রের সংজ্ঞায়’ আবুল আলা মওদুদী, অধ্যাপক গোলাম আযম, মোহাম্মদ আসাদ ও আবুল কাশেম সিফাতুল্লাহসহ বিতর্কিত ব্যক্তিদের উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়েছে।


বইটির ৪৯১ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘ইসলামী সাহিত্য সৃষ্টির মাধ্যমে ইসলামী চেতনা ও সংস্কৃতির বিকাশে অনবদ্য অবদান রাখেন এ উপমহাদেশে সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী (র.)। ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা, ব্যাংকিং, জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ, রাজনৈতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।’

একই বইয়ের ৩৮৭ পৃষ্ঠায় ধর্মনিরপেক্ষতার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে কোনো কল্যাণমূলক মতবাদ পৃথিবীতে নেই। ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মহীনতার নামান্তর। ধর্মকে ধ্বংস করার কৌশল হিসেবে রচিত একটি অপতন্ত্র। কেননা, ধর্মনিরপেক্ষতার মূলকথা হল কোনো ধর্মই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। সুতরাং রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো ধর্মকেই মডেল হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না। প্রত্যেক ধর্ম থেকে কিছু কিছু মূলনীতি গ্রহণ করে বাকি মূলনীতিগুলো মানব রচিত মতবাদ থেকে গ্রহণ করতঃ রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে। এটি ইসলামী ধর্ম বিশ্বাসের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।’


মাদ্রাসা বোর্ড অনুমোদিত ইসলামিয়া কুতুবখানা প্রকাশিত আলিম শ্রেণীর ‘ইসলামী পৌরনীতি’ বইয়ে জাতির জনকের বিরুদ্ধে বিষোদগার ও জামায়াতের প্রশংসা করে ৫৮২ পৃষ্ঠায় বলা হয়, ‘আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৭৫ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে, কিন্তু ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোকে কাজ করতে না দেয়ায়, তাদের সঙ্গে তৎকালীন সরকারের সম্পর্ক ছিল তিক্ত ও বিদ্বেষপূর্ণ। ...বর্তমান সরকার পরিচালনা করছে চারদলীয় ঐক্যজোট। এ জোটের অন্যতম দুটি দল হল জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোট। তাই বলা যায়, এদেশে ইসলামকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠাকরণের ক্ষেত্রে ইসলামী দলগুলো অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। সময়ের বিবর্তনে এ দেশে হয়তো একদিন তাওহীদের পতাকা উত্তোলিত হবে- এমন ধরণা এদেশের ইসলামপ্রিয় জনগণের।’একই বইতে জামায়াতে ইসলামীর গুণকীর্তন করে ৫৯১ পৃষ্ঠায় আরও বলা হয়, ‘বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতিতে সর্বাধিক বড় রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী। এ দলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী। তিনি তার লেখনীর মাধ্যমে ইসলামী রাজনীতিকে এ উপমহাদেশের মানুষের সামনে তুলে ধরতে প্রয়াস পেয়েছেন। ইসলামের বিভিন্ন দিকের ওপর তার অনেক রচনাবলী রয়েছে। 


জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক কার্যাবলী ছাড়াও সমাজসেবায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগে দুর্গত মানবতার পাশে সব সময়ই জামায়াতে ইসলামী এগিয়ে আসে। এদেশের ইসলামী অর্থনীতি চালুর প্রচেষ্টায় জামায়াতে ইসলামী বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় জামায়াতের বলিষ্ঠ ভূমিকা মুখ্য। জামায়াতে ইসলামী শিক্ষার ক্ষেত্রে অনবদ্য অবদান রেখেছে। তামিরুল মিল্লাত ট্রাস্টের অধীনে ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসা পরিচালিত হচ্ছে। মাদ্রাসাটির শিক্ষাদানের মান বেশ উন্নত। প্রতিবছর বোর্ডের পরীক্ষায় ছাত্ররা বেশ ভালো ফল করে।’


এ বিষয়ে প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ‘এভাবে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও জাতির জনকের বিরুদ্ধে বিষোদগার ও জামায়াতসহ অন্য রাজনৈতিক দলের প্রশংসা করে শিক্ষার্থীদের উস্কে দেয়া পাঠ্যপুস্তকের বিষয় হতে পারে না। পাঠ্যপুস্তক দলীয় মতাদর্শ প্রচারের মুখপত্রও নয়। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে স্বীকৃত একটি রাজনৈতিক দলের পরিচয় পাঠ্যপুস্তকে কিভাবে এবং কেন অন্তর্ভুক্ত হল তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। যদিও লেখাটি দেখে প্রতীয়মান হয়, এ বক্তব্যটি বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু এখনও তা একইভাবে রয়েছে এবং শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে।’


পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, ‘মাদ্রাসা বোর্ডের অনুমোদিত সিলেবাস অনুযায়ী আলিম (একাদশ) শ্রেণীর ইসলামের ইতিহাস ও ইসলামী পৌরনীতি বইয়ে এমন সুকৌশলে প্রণয়ন করা হয়েছে, যাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধসহ ইতিহাস-ঐতিহ্য ও দেশের ধর্মপ্রাণ জনগণের আল্লাহ রাসূলের প্রতি আনুগত্য ও বিশ্বাসের বিষয়গুলো প্রতিফলিত না হয়। যাতে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীই একমাত্র ইসলামের ধারক ও বাহক।’


প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘জামায়াতে ইসলামী একটি যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত। পাঠ্যবই কোনো দলীয় প্রচারপত্র নয়। কিন্তু এসব বক্তব্যের কারণে পাঠ্যপুস্তকগুলো দলীয় প্রচারপত্রে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের ধর্মের মৌলিক শিক্ষা, নিরপেক্ষ ও সৃজনশীল মানসিকতা গঠনের পরিবর্তে এসব লেখা শিক্ষার্থীদের 'জামায়াতি দর্শনে ' অনুপ্রাণিত করেছে। মাদ্রাসা বোর্ডের অনুমোদিত সিলেবাসের আওতায় এসব বক্তব্য তুলে দেয়া হচ্ছে শিক্ষার্থীদের হাতে। আর শিক্ষার্থীরা এসব পড়েই সনদ অর্জন করছে। বিষয়টি জাতির জন্য কাঙ্খিত কিনা তা বিবেচনা করে দেখার প্রয়োজন।’


বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড অনুমোদিত ও মাদ্রাসা লাইব্রেরি থেকে প্রকাশিত আলিম শ্রেণীর ইসলামের ইতিহাস বইয়ের ২০ পৃষ্ঠায় ওহি নাজিল হওয়ার বিবরণে বলা হয়েছে, “আমি জিজ্ঞেস করলাম ‘কি পড়ব’। বললেন, ‘পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি মানুষকে জমাট রক্তপিণ্ড হতে সৃষ্টি করেছেন।’ [সূরা আলাকের শেষ পর্যন্ত]’’ এই তথ্যটি ভুল বলে মন্তব্য করে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয়, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর সূরা আলাকের প্রথম ৫ আয়াত নাজিল হয়েছে। একইভাবে কুতুবখানা এমদাদিয়া থেকে প্রকাশিত মাদ্রাসা বোর্ড অনুমোদিত আলিম ইসলামের ইতিহাস সৃজনশীল বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় আরবের আয়তন উলেখ করা হয়েছে ১০,২৭,০০০ বর্গমাইল। অথচ ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সৌদি আরবের আয়তন ১,৫০,০০০ বর্গকিলোমিটার, যা বর্গমাইলে রূপান্তর করলে দাঁড়ায় ৮,৩০,১১৫ দশমিক ৪৩ বর্গমাইলে।

জানতে চাইলে মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান একেএম সাইফুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, মাদ্রাসা বোর্ড অনুমোদিত বলা হলেও বাস্তবে ওসব বই আমাদের অনুমোদিত নয়। বাইরের এসব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মাদ্রাসা বোর্ডের নামে ব্যবসা করছে। তিনি উল্টো অভিযোগ করে বলেন, ‘প্রতিবেদন তৈরি করার আগে ইসলামিক ফাউন্ডেশন আমাদের সঙ্গে কথা বলতে পারত।’ 

নজরুল জীবনের শেষ পর্যায় - বাঁধন সেনগুপ্ত

কাজী নজরুলের জীবনের শেষ চৌত্রিশটা বছর ছিল বড় মর্মান্তিক । কোন সৃষ্টিশীল মানুষ নজরুলের মত অবহেলা আর বঞ্চনার যন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন কিনা জানি না। মধুসূদন দত্ত জীবনের শেষ দিনগুলো আত্মীয়-পরিজনহীন, চরম দারিদ্র ও অবহেলার মুখোমুখি হয়েছিলেন সত্য, কিন্তু নজরুল ইসলামের শেষ জীবন আরো বেশি মর্মন্তুদ,বেদনাদায়ক ।

নজরুলের অসুস্থ হয়ে পড়ার দিন নিয়েও সঠিক তথ্য জানা যায় না । কেউ বলেন রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিবসে (৭ই অগস্ট ১৯৪১) কলকাতা রেডিওতে ‘রবিহারা’ কবিতাটিঐদিনই লিখে আবৃত্তি করার সময় কবির কন্ঠস্বর জড়িয়ে আসে, কবি অসুস্থ হয়ে পড়েন । হতেপারে একটা প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিয়েছিল ঐদিন থেকে । একবছর পর ১০ই জুলাই নজরুল তাঁরসুহৃদ জুলফিকার হায়দারকে একটি চিঠি লিখেছিলেন “তুমি এখনি চলে এসো ... আমি কাল থেকেঅসুস্থ” । অতয়েব আমরা ধরে নিতে পারি ১৯৪২এর ৯ই অগষ্ট থেকেই কবি অসুস্থ হয়ে পড়েন ।কবি তখন আক্ষরিক ভাবেই কপর্দকহীন । সংসারে দুই শিশু পুত্র, পক্ষাঘাতগ্রস্ত স্ত্রীপ্রমীলা, সর্বক্ষণের অভিভাবক শাশুড়ি গিরিবালা । ১৭০০ গানের রেকর্ডে লক্ষলক্ষ টাকা মুনাফার সন্ধান দেওয়া গ্রামফোন কোম্পানী কোন রয়ালটি, প্রাপ্য পারিশ্রমিক দিচ্ছেনা,তাঁর লেখার প্রকাশকরা ফিরেও তাকাচ্ছে না । ১৭ই জুলাই ১৯৪২, শারীরিক যন্ত্রণাউপেক্ষা করে এক বন্ধুকে পত্র লেখেন কবি । লিখেছিলেন -  “আমি blood pressureএ শয্যাগত, অতিকষ্টে চিঠি লিখছি । আমার বাড়িতে অসুখ, ঋণ,পাওনাদারদের তাগাদা, প্রভৃতি worries, সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত খাটুনি । তারপর নবযুগের worries ৩/৪মাস পর্যন্ত । এইসব কারণে আমার nerves shattered হয়ে গেছে । ... কথা বন্ধ হয়ে গিয়ে অতি কষ্টে দু’একটা কথা বলতেপারি,বললে যন্ত্রণা হয় সর্ব শরীরে”।

কবির অসুস্থতার কারণ বা কি ছিল তাঁর অসুখ, তা নিশ্চিত ভাবে কেউজানাননি । নানারকম কথা নানান জনে লিখে গেছেন । শোনা যায় ‘নবযুগ’ সম্পাদনা কালে একবার কবি উত্তরপাড়ায় এক দুষ্কৃতি দলেরকাছে প্রহৃত হয়েছিলেন, কয়েকজন যুবক উত্তরপাড়া থানার হেপাজত থেকে, ঘাড়ে ও মাথায় কঠিন আঘাত পাওয়া নজরুলকে বাড়ি পৌছে দিয়েছিলেন । এই আঘাতের কথা কোন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি । শোনা যায় নির্বাক কবি যখন বাংলাদেশে (১৯৭২), তখন নাকি তাঁরচিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ড, কবির ঘাড়ে পুরাতন কঠিন আঘাতের চিহ্নটি সনাক্ত করেছিলেন । 

বিস্ময়েহতবাক হয়ে হয় - কি নিদারুণ অব্যবস্থা হয়েছিল তাঁর অসুস্থতা প্রকট হওয়ার পর । প্রথমসাতদিন চিকিৎসা করেন হোমিওপ্যাথিক মতে, নজরুলেরই বাড়িওয়ালা ডাক্তার ডি এল সরকার ।অথচ মাত্র তিনদিন চিকিৎসার পর অতি উৎসাহী হয়ে নজরুলের সেই বন্ধু জুলফিকার হায়দার খবরের কাগজে কবির অসুস্থতার সংবাদ দিয়ে পাঠিয়ে প্রচার করে দেন নজরুল ‘উন্মাদ’ হয়ে গেছেনবলে । বাইশ বছর পরে লেখা তাঁর গ্রন্থে (‘নজরুল জীবনের শেষ অধ্যায় – ১৯৬৪) জুলফিকারহায়দার এই মিথ্যা সংবাদ প্রচারের সাফাই দিয়েছিলেন যে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ‘হয়তোঅসুখের সংবাদ পেয়ে কাজীদার অনেক বন্ধুবান্ধব এবং ভক্ত অনুরক্তদের মধ্যে একটা সাড়া পড়ে যাবে,দেখতে আসবে’ । অথচ জুলফিকার হায়দার প্রচারিত কবির ‘মস্তিষ্ক বিকৃতি’রমিথ্যা সংবাদ প্রচারের দুইবছর পরেও ১৯৪৪এর ২৭শে ফেব্রুয়ারি একজন নুরুল ইসলামকে একটা কাগজে লিখে নজরুল জানিয়েছিলেন - “শ্রীমান মোহম্মদ নুরুল ইসলাম, তুমি চিরঞ্জীবহয়ে থেকো । আমায় ও আমার ছেলে দুটিরে চিরদিন মনে রেখো”।

শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের আর্থিক সহায়তায় কবিকে স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য মধুপুর পাঠানো হল১৯৪২এর ১৯শে জুলাই, কিন্তু অর্থ শেষ হয়ে যাবার পর কলকাতায় ফিরিয়ে আনা হয় ২১শেসেপ্টেম্বর । ১৯৪৪এর ২৪শে মে আনন্দবাজার পত্রিকার ‘কবি নজরুল পীড়িত’ শিরোনামে একটিআবেদন প্রচারিত হয় । আবেদনে বলা হয়েছিল ‘বাংলার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বহুদিন যাবত পক্ষাঘাতে শয্যাগত । অসক্ত হইয়া পড়ায় তিনি এখন নিঃস্ব ও কপর্দকহীন । তাঁহার স্ত্রীও পক্ষাঘাতে শয্যাশায়িনী । চিকিৎসা দূরের কথা,এমন সঙ্গতি নাই যে শিশু পুত্রদ্বয়,রুগণা পত্নী ও নিজের আহার্যটুকু জোটে। বাংলার জাতীয় কবির প্রাণরক্ষায় সহৃদয় সর্বসাধারণের অকুন্ঠ সাহায্য একান্ত আবশ্যক’ । 

এরপর কয়েকটি সাহায্য সমিতি গঠিত হয় । কলকাতার সুখ্যাত চিকিৎসকেরা কবিকেদেখেন একাধিকবার, কিন্তু নিরাময়ের কোন লক্ষণ দেখা যায় না । কবি কাজী আবদুল ওদুদেরউদ্যগে গঠিত ‘নজরুল নিরাময় সমিতি’র উদ্যোগে কবিকে রাঁচির মানসিক চিকিৎসালয়ে পাঠানোহয় ১৯৫২র ২৫শে জুলাই । কিন্তু চার মাস চিকিৎসাধীন থেকেও কোন উন্নতি না হওয়ায়ফিরিয়ে আনা হয় কলকাতায় । পরের বছর ১০ই মে ১৯৫৩ কবিকে নিয়ে যাওয়া হয় লন্ডনে ।সেখানকার চিকিৎসকেরা মতপ্রকাশ করেন যে কবির ব্রেন কুঁকড়ে গেছে অর্থাৎ মষ্টিস্কেরসংকোচন হয়েছে । লন্ডন থেকে ১০ই ডিসেম্বর নজরুলকে নিয়ে যাওয়া হয় ভিয়েনায় । সেখানেওচিকিৎসকের অভিমত ছিল কবিকে আর সুস্থ করে তোলা যাবে না । এরপরেও পূর্ব জার্মানীর বন বিশ্বিবিদ্যালয়ের ছাত্ররা এক রুশ ডাক্তারকে দিয়ে পরীক্ষা করিয়েছিলেন । তাঁর অভিমতছিল যে অনেক দেরি করে রোগীকে আনা হয়েছে । সাতমাস বিদেশে বৃথা চেষ্টার পর কবিকে ফিরিয়ে আনা হয় কলকাতায় ১৯৫৩’র ১৪ই ডিসেম্বর ।

এর পরেও ২৩বছর জীবিত ছিলেন নজরুল । অভাবের তাড়না, মানসিক কষ্ট,নিঃসঙ্গতা, পরিচিত বন্ধুদের দূরে চলে যাওয়া, অবহেলা এসবই ছিল কবির শেষ জীবনেরসঙ্গী । পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক বিনা ভাড়ায় থাকার জন্য ফ্ল্যাটের বন্দোবস্ত ও দুইবাংলা থেকেই লিটারারি পেনশনের ব্যবস্থা হওয়ার পর কিছুটা স্বস্তি এসেছিল । ১৯৬২র ২৩শে জুন দীর্ঘ ২৩বছর ধরে পক্ষাঘাতে শয্যাগত স্ত্রী প্রমীলার দেহাবসান হ’ল, কবি আরো নিঃসঙ্গ হয়ে গেলেন ।

জীবনের শেষ চারটি বছর কবি বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদায় তাঁর প্রাপ্য সমাদর পেয়েছিলেন । মৃত্যুর সাত ঘন্টার মধ্যেই তাঁর আপনজনেরউপস্থিতির আগেই রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় নীরব কবিকেসমাহিত করলেন সে দেশের সরকার

[ তথ্যসূত্র– নজরুল জীবনের শেষ পর্যায় / বাঁধন সেনগুপ্ত, পশ্চিমবঙ্গ পত্রিকা , কাজী নজরুলইসলাম শতবার্ষিকী সংখ্যা ]