Friday, June 13, 2014

মেজর জেনারেল মঞ্জুর কি জিয়া হত্যার সঙ্গে আদেী জড়িত ছিলেন?


মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর হত্যাকাণ্ড 'অভ্যুত্থান' ঢাকাতেই হয়েছে, চট্টগ্রামে নয় :লরেন্স লিফশুলৎজ 

পরবর্তী কয়েক বছরে এরশাদ ও তাঁর সহযোগীরা 'বিক্ষুব্ধ সেনা', 'উত্তেজিত জনতা' এবং 'বিক্ষুব্ধ মানুষের' হাতে মঞ্জুর হত্যার অনেক কাহিনি ফেঁদেছেন।
২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে বার্তা সংস্থা বিডিনিউজ-২৪ এই মামলার হাজিরায় এরশাদের এই বক্তব্য উদ্ধৃত করেছে, 'চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে আনার পর উত্তেজিত জনতা মঞ্জুরকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এই টানাহ্যাঁচড়ার মধ্যে নিরাপত্তারক্ষীরা গুলি ছুড়তে বাধ্য হয়। একপর্যায়ে মঞ্জুর গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান।' এরশাদের এক সহকর্মী মোস্তফা—লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোস্তফা কামাল ২০১৩ সালে আদালতে বলেছিলেন, 'কিছু বিক্ষুব্ধ মানুষ চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে
মঞ্জুরকে নেওয়ার পথে তাঁকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এতে নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে তাদের গুলিবিনিময় হয়। একপর্যায়ে মঞ্জুরের গায়ে বুলেট বিঁধে। হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান।'
এরশাদ ও তাঁর সহযোগীরা যে গল্প ফেঁদেছেন এবং ৩০ বছর ধরে ভাঙা রেকর্ডের
মতো বাজিয়ে চলেছেন, তার প্রধান দুর্বলতা হলো বাস্তবের সঙ্গে এর কোনো মিল
নেই। সে সময় চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন বা এ ঘটনা
প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁরা কেউই কখনো বলেননি যে তাঁরা 'বিক্ষুব্ধ মানুষ' বা
'বিক্ষুব্ধ অস্ত্রধারী' ব্যক্তিদের দেখেছেন, যাঁরা মঞ্জুরকে ছিনিয়ে
নেওয়ার চেষ্টা করলে গোলাগুলি হয়; আর মঞ্জুর এই 'টানাহ্যাঁচড়া'র কারণে
গুলিবিদ্ধ হন। কেউ কেউ বলেছেন, মঞ্জুরের 'নিরাপত্তারক্ষীরা' গুলি করেছিল;
আর কেউ বলেছেন, 'হাসপাতালে নেওয়ার পথে মঞ্জুর মারা যান।' কিন্তু কোনো
হাসপাতালেই মঞ্জুরকে সেদিন জীবিত বা মৃত বা আহত অবস্থায় দেখা যায়নি। কেবল
একজন সেনা চিকিৎসক তাঁকে দেখেছেন। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের
ব্রিগেডিয়ার আজিজ, ক্যান্টনমেন্টের দায়িত্বে তখন ছিলেন তিনি, দাফনের জন্য
মরদেহ প্রস্তুত করাতে তাঁকে মঞ্জুরের 'ক্ষত ব্যান্ডেজ' করে দিতে বলেন।
জিয়াউদ্দীন চৌধুরী তাঁর বইয়ে ফটিকছড়িতে মঞ্জুরের শান্তিপূর্ণ আত্মসমর্পণ
এবং তাঁর গতিবিধির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন। তাঁর বিবরণ বা
চট্টগ্রামের প্রত্যক্ষদর্শীদের কারও কথার সঙ্গেই এরশাদ ও তাঁর সহযোগীদের
গল্পের ন্যূনতম কোনো মিল নেই। চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক হিসেবে
জিয়াউদ্দীন চৌধুরী ১ জুন মঞ্জুরের গ্রেপ্তার হওয়া থেকে শুরু করে
হাটহাজারী থানায় সেনাবাহিনীর হাতে তাঁকে সোপর্দ করা পর্যন্ত প্রতিটি
ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন বা ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেছেন। এমনকি মঞ্জুর নিরাপদে
ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছালেন কি না, সেটিও দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ারের কাছ
থেকে তিনি শুনে নিশ্চিত হয়েছেন।
জিয়াউদ্দীন চৌধুরীর ভাষ্যের সঙ্গে এরশাদের ভাষ্যের তুলনা করা যাক:
'মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের পরদিন সরকারি তথ্য বিবরণীতে বলা হয়, তাঁকে
ক্যান্টনমেন্টে নেওয়ার পথে বিক্ষুব্ধ সৈন্যদের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে
মঞ্জুর মৃত্যুবরণ করেছেন। এই প্রতিবেদন ছিল একটি ডাহা মিথ্যা।
'ক্যান্টনমেন্টে নেওয়ার পথে মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়নি। ব্রিগেডিয়ার আজিজ
পুলিশের ডিআইজিকে বলেছিলেন, ২ জুন সকালবেলা মঞ্জুরকে চট্টগ্রাম
ক্যান্টনমেন্টে হত্যা করা হয়। আজিজ এ কথা বলেননি যে মঞ্জুর বিক্ষুব্ধ
সৈন্যদের হাতে মারা পড়েছেন...
'চিকিৎসককে যখন মঞ্জুরের "ক্ষত ব্যান্ডেজ" করতে বলা হয়, তখন তিনি দেখতে
পেলেন, একটিমাত্র গুলির আঘাতে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। গুলিটি তাঁর মাথা ফুঁড়ে
বেরিয়ে যায়। তাঁর মৃত্যুর জন্য একঝাঁক বুলেট দরকার হয়নি...ঢাকা থেকে আসা
এক সেনা কর্মকর্তা মঞ্জুুরকে হত্যা করেন, বিক্ষুব্ধ সৈন্যরা নয়। তাঁকে
কেন হত্যা করা হবে? কেন বিচারের মুখোমুখি করা হবে না? তিনি কি এমন কিছু
জানতেন, সেনাবাহিনী যা প্রকাশিত হতে দিতে চায়নি?'
এ ধরনের মিথ্যা ও প্রচ্ছদকাহিনির সমস্যা হচ্ছে, এর প্রণেতারা অনেক সময়
নিজেদের লেখা চিত্রনাট্য নিজেরাই ভুলে যান। নিজেদের গা বাঁচাতে
'বিক্ষুব্ধ সৈন্য'দের হাতে মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের যেসব গল্প এরশাদ ও তাঁর
সহযোগীরা ফেঁদেছেন, তার প্রতিটিতে বলা হয়েছে যে পুলিশ তাঁকে সেনাবাহিনীর
বিশেষ ইউনিটের কাছে হস্তান্তর করার পর চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে 'নেওয়ার
পথে' তাঁকে হত্যা করা হয়।
তার পরও, সিআইডির কাছে দেওয়া সাক্ষ্যে পুলিশের আইজি এ বি এম জি কিবরিয়া
জানিয়েছেন, তিনি এরশাদকে সরাসরি প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন,
'চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে আনার পরই মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়।'
কিবরিয়া এর আগের দিনই মঞ্জুরকে পুলিশের কাছ থেকে সেনা হেফাজতে আনার
সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি এরশাদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন,
মঞ্জুরকে কীভাবে হত্যা করা হয়?
সাক্ষ্যে কিবরিয়া বলেন, '২ জুন বিকেলবেলা বঙ্গভবনে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির
সভাপতিত্বে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে আমি চিফ অব আর্মি স্টাফের কাছে
জানতে চাই, মঞ্জুরকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে? আদতে তো তাঁর প্ররোচনায়
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি মঞ্জুরকে সেনা হেফাজতে নেওয়ার নির্দেশ দেন, যাঁদের
হাতে—এক অর্থে তাঁরই হেফাজতে—মঞ্জুরের মৃত্যু হলো। এরশাদের জবাব ছিল,
চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়ার পরপরই বিক্ষুব্ধ সেনাদের
গুলিবর্ষণে মঞ্জুর নিহত হন। এয়ার ভাইস মার্শাল সদরুদ্দীনের মতো কিবরিয়াও
এরশাদের 'বিক্ষুব্ধ সেনা'দের হাতে মঞ্জুর হত্যার গল্প বিশ্বাস করেননি।
কিবরিয়া তাঁর সাক্ষ্যে এরশাদের নিজের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতেই বলেছেন যে
মঞ্জুরকে 'ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়ার পথে' হত্যা করা হয়নি। এটা একটা
তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য। এরশাদের স্বীকারোক্তির পর কিবরিয়া কীভাবে ত্বরিত
পদক্ষেপ নিয়েছেন, তা-ও তিনি বলেছেন। প্রথমে একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ
কর্মকর্তাকে তিনি চট্টগ্রামে পাঠান। পরে নিজেই সেখানে যান। চট্টগ্রামে
অবস্থিত তাঁর সহকর্মীদের তিনি বঙ্গভবনের বৈঠকের কথা জানিয়ে পুলিশ হেফাজতে
থাকা সেনা কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা নিয়ে এই শঙ্কা প্রকাশ করেন যে
সেনাবাহিনী হয়তো এদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিতে পারে।
কিবরিয়া ব্যাখ্যা করেন, মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের পর 'বেসামরিক কর্তৃপক্ষের
হাতে গ্রেপ্তার হওয়া সেনা কর্মকর্তাদের সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার
জন্য এরশাদের দাবি অগ্রাহ্য করে' তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ
নিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে তিনি কীভাবে প্রভাবিত করেন। স্পষ্টভাবেই তাঁর
মনে ভয় ছিল, সেনা হেফাজতে নিয়ে গেলে এদেরও মঞ্জুরের ভাগ্য বরণ করতে হবে।
সত্যিই তাই। পরের কয়েক মাসে বহু সেনা কর্মকর্তাকে সেনা হেফাজতে এনে
ব্যাপক নির্যাতন করা হয়। এরপর চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে অনুষ্ঠিত
ফিল্ড কোর্ট মার্শালে তাঁদের বিচার করা হয়। ফাঁসিতে ঝোলানো হয় ১৩ জনকে।
তৎকালীন অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরীর
ভাষ্যমতে, এই হতভাগারা নিরপেক্ষ বিচার ও যথাযথ আইনি সুরক্ষা পাননি, যা
ছিল তাঁদের মৌলিক অধিকার। আগেই বলেছি, জুলফিকার আলী মানিক তাঁর সেই সাহসী
বইয়ে এসব কথা লিপিবদ্ধ করেছেন।
নোংরা সত্যটি হচ্ছে এই যে ওই মানুষগুলোকে এমন এক 'অভ্যুত্থানের' অভিযোগে
বিচার করা হয়, যেটি আদতে কোনো 'অভ্যুত্থান' ছিল না বা সেই বিদ্রোহ কোনো
দিন সম্পন্ন হয়নি। কিন্তু জিয়া আবুল মঞ্জুরের হাতে নিহত হননি; কিংবা
যাঁদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে, তাঁদের হাতেও নন।
সেনাবাহিনীতে এরশাদের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার অভিপ্রায়ে তাঁদের ভিত্তিহীন ও
নিষ্ঠুরভাবে প্রাণ দিতে হয়। বলির পাঁঠা বানানোর জন্য এরশাদের দরকার ছিল
একটি 'অপরাধী চক্র'।
জেনারেল মইন ও জুলফিকার আলী মানিক তাঁদের বইয়ে জানিয়েছেন, এরশাদ নির্যাতন
করে 'স্বীকারোক্তি আদায় করেছেন, কিন্তু তথাকথিত বিচারটি চলেছে
উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে, কোনো তদন্ত ছাড়াই। মেজর জেনারেল মহব্বতজান চৌধুরীর
নির্দেশে বিচার ও শাস্তির প্রক্রিয়াটি পরিচালিত হয়।
খালেদা জিয়া কি সত্যি সত্যিই এরশাদকে তাঁর স্বামী হত্যার জন্য অভিযুক্ত
করেছিলেন? প্রকৃত 'অভ্যুত্থান' তাহলে ঢাকাতেই হয়েছে, চট্টগ্রামে নয়।
লেখাটি ছাপাখানায় যাওয়ার পর প্রথম আলোর হাতে থাকা কিছু দলিল আমার হাতে
এসেছে। দলিলগুলো হচ্ছে ১৯৮১ সালের মে-জুন মাসের সেই নিয়তি-নির্ধারক
দিনগুলোতে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যেসব সদস্য চট্টগ্রামে ছিলেন, সিআইডির
কাছে দেওয়া তাঁদের সাক্ষ্য। এসব সাক্ষ্য আমাদের সামনে কিছু নতুন প্রশ্ন
উত্থাপন করেছে। এই লেখা শেষ হওয়ার পর একটি উপসংহার পর্বে সেগুলো নিয়ে আমি
আলোচনা করব।
হত্যা মামলা
এসব সাক্ষ্য-প্রমাণ কী অগ্রাহ্য করা হবে? বিচারপতি কি আমার সোর্সের
চূড়ান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে, নতুন এই প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য না
নিয়ে তাঁর রায় ঘোষণা করবেন? যে মানুষটি বললেন, তিনি চট্টগ্রাম
ক্যান্টনমেন্টে উপস্থিত ছিলেন, একজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাকে মঞ্জুরের
সেলে ঢুকতে দেখেছেন, আর সেখানেই নাকি মঞ্জুর খুন হন—তাঁর সাক্ষ্য কি
উপেক্ষা করা হবে?
বিচারপতি ফিরোজ বা কোনো উচ্চ আদালত কি এই সাক্ষীর নিরাপদে সাক্ষ্য দেওয়ার
পরিবেশ সৃষ্টি করবেন? এয়ার ভাইস মার্শাল সদরুদ্দীন, আইজিপি কিবরিয়া এবং
অন্যদের দশক দশক ধরে চাপা পড়ে থাকা সাক্ষ্য কি শোনা হবে, নাকি অগ্রাহ্য
করা হবে?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি তাঁর সদ্য নিযুক্ত 'বিশেষ দূত' জেনারেল
এরশাদ, যিনি এ মামলার অন্যতম সন্দেহভাজন, তাঁর সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে
সুবিধাজনক সমীকরণের স্বার্থে আপসরফা চালিয়ে যাবেন? নাকি প্রজ্ঞা জয়ী হবে?
অথবা এই নিশ্চয়তা প্রতিষ্ঠিত হবে যে বিচার বিভাগের কাজে নির্বাহী বিভাগ
আর হস্তক্ষেপ করবে না।
শেখ হাসিনা কি এই নতুন তথ্যের ভিত্তিতে একজন হত্যা মামলার সন্দেহভাজনের
সঙ্গে রাজনৈতিক আপসরফা বন্ধ করবেন?
এরশাদ শুধু হত্যা মামলার প্রধান সন্দেহভাজনই নন, সেনাপ্রধান হিসেবে বহু
সেনা কর্মকর্তাকে নির্যাতন করে তাঁদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করার
ঘটনায়ও তিনি একজন হুকুমের আসামি। এসব স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে তাঁদের
'দণ্ডিত' এবং পরবর্তীকালে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। এ ধরনের কাজ একদিকে
বাংলাদেশের সংবিধানের খেলাপ, অন্যদিকে নির্যাতন এবং অন্যান্য অমানবিক ও
অবমাননামূলক আচরণবিরোধী আন্তর্জাতিক রীতি-নীতিরও পরিপন্থী। তদুপরি, এরশাদ
সেনাপ্রধান থাকাকালে বেশ কয়েকটি ফিল্ড কোর্ট মার্শালে বিবাদীর অধিকার
লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এই সবগুলো অপকর্মের বিরুদ্ধেই
ব্যবস্থা গ্রহণের অবকাশ রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীকে আমি বহু দিন ধরেই চিনি-জানি। আমার মনে হয় না, তাঁর সব
ঔচিত্যবোধের মৃত্যু ঘটেছে। তিনিও হত্যাকাণ্ডের নির্মম শিকার হওয়া একজন
মানুষের কন্যা। তাঁর নিহত স্বজনদের হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার পেতে তিনি
বহু দিন ধরে অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়েছেন। মঞ্জুরের সন্তানদের চেয়ে কি
তিনি অধিকতর সুবিধাভোগী যে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারী একই রাজনৈতিক
শক্তির হাতে মঞ্জুর নিহত হওয়ার পরও তাঁরা ন্যায়বিচার পাবেন না?
মঞ্জুরের পরিবারও সেই জবাবদিহি দেখতে চায়, যা প্রধানমন্ত্রী তাঁর পিতা,
মাতা, ভাই, বোনদের হত্যাকাণ্ডের জন্য দাবি করেছিলেন। নতুন তথ্যের আলোকে
আমরা এই প্রত্যাশা করি যে শেখ হাসিনা তাঁর 'বিশেষ দূত'-এর কাছ থেকে সরে
এসে মঞ্জুরের সন্তানদের পাশে এসে দাঁড়াবেন; তাদের বলবেন, 'তোমাদের
ন্যায়বিচারের দাবিতে আমি বিপক্ষে নই, বরং পাশে আছি।'
শেখ হাসিনার সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ দিল্লিতে ১৯৮০ সালের প্রথম দিকে।
তিনি তখন একটি সাদামাটা ঔপনিবেশিক কেতার বাংলোয় বসবাস করতেন। তাঁর
নিরাপত্তা ছিল সুনিশ্চিত, তবে গোপন। দুর্বল হলেও তাঁকে
আত্মমর্যাদাসম্পন্ন একজন নারী বলেই আমার মনে হলো। তখনো তিনি তাঁর
স্বজনদের মৃত্যুর শোক বয়ে চলেছেন। কে-ই বা এর ব্যতিক্রম? তাঁর চোখেমুখে
শোক ও আতঙ্কের ছাপ ছিল স্পষ্ট। ঘরের ভেতর একটি শোকের আবহ সৃষ্টি হলো।
প্রায় প্রতিটি কথাতেই তিনি অশ্রুসজল হয়ে উঠছেন। হূদয়বিদারক! ১৯৭৫ সালের
'অভ্যুত্থানে'র পেছনের ঘটনা উন্মোচন করার জন্য আমি যে বইটি লিখেছিলাম,
শেখ হাসিনা তার জন্য আমাকে ধন্যবাদ জানান।
আগস্টের সেই ঘটনার পর অনেকটা দিন চলে গেছে। তবু তাঁর সঙ্গে সেই প্রথম
সাক্ষাতে অপরিমেয় সেই শোকের প্রতি আমি আমার সমবেদনা জানাই। তিনি আমার কথা
শোনেন। আমি কথা বলার পর তিনি বেশ নীরব ছিলেন। ভাঙা গলায় ধন্যবাদ ও
শুভেচ্ছা জানানোর পর তিনি প্রায় কোনো কথাই বলতে পারছিলেন না। আমরা তখন
শোকাবহ স্মৃতি দূরে ঠেলে রেখে চা পান করতে করতে সামান্য কথা বলার চেষ্টা
করি।
ঢাকায় ১৯৭৩-৭৪ সালে একজন তরুণ প্রতিবেদক হিসেবে তখনকার বিক্ষোভ ও
দুর্ভিক্ষ নিয়ে আমি বেশ সমালোচনামুখর ছিলাম। তার পরও সেই 'অভ্যুত্থান'
এবং তাতে নিহত নিরীহ মানুষের মৃত্যুর বিনিময়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যে
ভূত আবারও জেগে ওঠে, তার খপ্পর থেকে মুক্ত হওয়ার কোনো পথই খোলা ছিল না।
পরবর্তী বছরগুলোতে শেখ হাসিনা দৃঢ় সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭৫ সালের
হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে তবেই থেমেছেন।
কিছুদিন আগে মঞ্জুরের বড় মেয়ে রুবানার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে শেখ হাসিনার
সঙ্গে আমার দিল্লির সেই বৈঠকের কথা মনে পড়ে গেল। আবারও দেখলাম, পিতার
মৃত্যু এবং এর পরবর্তী তিনটি দশক ধরে তাঁরা যে অমানুষিক যন্ত্রণার মধ্য
দিয়ে গেছেন, সেসব কথা বলতে গিয়ে তাঁর গলা ভেঙে আসছে।
সেই আলাপচারিতার কথা বলার স্বাধীনতা আমার নেই। কিন্তু আমি জানি, সেই
শোকের গভীরতা যদি অল্প কেউ উপলব্ধি করে থাকেন, তাহলে শেখ হাসিনাই তা
করেছেন।
শেখ হাসিনা চাইলে তাঁর পিতা-মাতার কবরে যেতে পারেন। সব পিতা-মাতাহীন
সন্তানই তা করে থাকেন। তাঁদের শেষ বিশ্রামস্থলে যাওয়া প্রতিটি মানুষের
জন্যই এক গভীর সান্ত্বনার বিষয়। এটি আরও বিশেষ হয়ে ওঠে, যদি কেউ সহিংসতার
কারণে মারা যান। জেনারেল মঞ্জুরের স্ত্রী ও সন্তানেরা জানেন না, তাঁদের
স্বামী ও পিতার আদৌ কোনো কবর আছে কি না। সেখানে গিয়ে তাঁদের প্রার্থনা
করার সুযোগটুকুও নেই।
মৃত্যুর মামলা ও সংশ্লিষ্ট সেই পরিবারের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির
আকাঙ্ক্ষাকে কারোরই রাজনৈতিক ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা উচিত নয়। এটি
বিবেচনাবোধহীন একটি ব্যাপার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন করব,
দয়া করে আপনার যে পরামর্শকেরা এর বিপরীত কথা ভাবেন, তাঁদের কথা শুনবেন
না।

'অভ্যুত্থান' ঢাকাতেই হয়েছে, চট্টগ্রামে নয় (পরের অংশ )
অপরাধী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ
আমি মনে করি, জেনারেল এরশাদ ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে জেনারেল মঞ্জুর
হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা
নির্দোষ। তাঁদের বিচার স্বচ্ছ হওয়া উচিত। এর ভিত্তি হবে পেশাদারির
ভিত্তিতে পাওয়া তথ্য-প্রমাণ ও যোগ্য প্রসিকিউশন।
আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একটি পবিত্র ব্যাপার।
যদিও তথাকথিত সেই চট্টগ্রাম বিদ্রোহের ঘটনায় যে তরুণ সেনা কর্মকর্তাদের
এরশাদ নির্যাতন করে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন, তাঁদের তিনি এ অধিকারের সুযোগ
দেননি। কিন্তু যে অধিকার এরশাদ তাঁদের দেননি, ন্যায়বিচারের স্বার্থে
তাঁকে সেই অমূল্য অধিকারটি দিতে হবে।
মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত এমন আরও অনেকে থাকতে পারে, যাদের
বিরুদ্ধে এখনো পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করা হয়নি। আমার ধারণা, আমার
সাক্ষী যে ব্যক্তির নাম বলেছিলেন, তিনি অভিযোগপত্রে নেই। কথিত আছে, সেই
ব্যক্তিই মঞ্জুরকে হত্যা করেন। তিনি একজন উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা।
মঞ্জুরকে হত্যা করতেই তিনি ঢাকা থেকে এসেছিলেন। আবার মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডে
একমাত্র তিনিই নন, আরও অনেকেই জড়িত থাকতে পারেন। এ অভিযোগ সত্য হলে যে
ব্যক্তিটি ট্রিগার চেপেছিলেন, তিনি একাই নিশ্চয়ই সবকিছু করেননি।
তদুপরি ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী আমার সেই সোর্সই এ ঘটনার একমাত্র
প্রত্যক্ষদর্শী নন। মঞ্জুরের সেলে সেই ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাকে অনেকেই
প্রবেশ করতে দেখেছেন। তাঁর সেই প্রবেশাধিকারকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ভয়ের
কারণে অনেকে গত ৩০ বছরে মুখ খোলেননি। এই ভীতি দূর করার মতো একটি
পরিস্থিতি কি সৃষ্টি হয়েছে বা তা কি সৃষ্টি করা সম্ভব? যাঁরা এ
হত্যাকাণ্ড পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করেছেন, এভাবে তাঁদের পার পাওয়ার সময়
কি শেষ হবে?
বড় একটি পরিবর্তনের সময় এসেছে। নিম্ন আদালতে এ মামলাটি যেভাবে পরিচালনা
করা হয়েছে, তাতে ন্যায়বিচারকে প্রহসন করা হয়েছে। আর যাঁরা এটি পরিচালনা
করেছেন, তাঁরা নিজের পেশার সঙ্গে গুরুতর অসদাচরণ করেছেন। দুই দশকে ২২ জন
বিচারক এ মামলার শুনানিতে অংশ নিয়েছেন। পরে আবার তাঁদের অন্য দায়িত্বে
পাঠানো হয়েছে। রাজনৈতিক ফুটবল হিসেবে মামলাটিকে নিয়ে খেলাধুলা চলছেই।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমে খোলাখুলিই বলা হচ্ছে যে এই মামলাটিকে জেনারেল
এরশাদের সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা
হচ্ছে। বিনিময়ে এরশাদ সরকারকে তাঁর পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন এই আশায়, যাতে
মামলাকে পুরোপুরি হাওয়া করে দেওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
মঞ্জুরের ভূত এরশাদকে তটস্থ করে রেখেছে। এ মামলার সমাপ্তি নেই।
সম্প্রসারণশীল বাজারে পণ্যের মূল নির্ধারণ করতে গিয়ে বাংলাদেশের
রাজনীতিতে বারবার যা মার খেয়েছে, তা হলো নৈতিকতা। আর এই পণ্য হচ্ছে
ন্যায়বিচার। এর বিকিকিনি হয়েছে বন্ধ দরজার অন্তরালে। বাংলাদেশে একটিমাত্র
প্রতিষ্ঠানই এই পণ্যের বাজার বন্ধ করে দিতে পারে, সেটি হলো সুপ্রিম
কোর্ট।
'জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট' হলে সুপ্রিম কোর্ট যেকোনো মামলাকে নিম্ন আদালত থেকে
তাঁর ক্ষমতাবলে সরিয়ে নিতে পারেন। এই মামলাটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে।
এই মামলার মধ্যে বাংলাদেশে এক দশকের সামরিক শাসনের বীজ নিহিত রয়েছে।
মঞ্জুরের হত্যকাণ্ড সেই বীজের প্রাণকেন্দ্র। এই মামলাটি যদি
'জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট' মামলার আওতায় না পড়ে, তাহলে আর কোন মামলা পড়তে
পারে, তা আমি জানি না। হয়তো অন্য কোনো বেশি গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড রয়েছে।
তাদের পিতা 'খুনি' ও 'বিশ্বাসঘাতক'—এই অশেষ কানাকানিতে চারটি সন্তান
বাংলাদেশ ছেড়েছে। এই ফিসফিস তাদের প্রতিনিয়ত আহত করেছে। এটি তাদের স্কুলে
তাড়া করে ফিরেছে। যে বাসায় তারা গেছে, সেখানে তাড়া করেছে। তাদের অনেক
পুরোনো বন্ধুও এ কারণে তাদের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।
বাংলাদেশ কীভাবে 'মিথ্যার ভাইরাস'-এ আক্রান্ত হয়েছে, তা সত্যিই খতিয়ে
দেখার মতো বিষয়। কিন্তু এই মিথ্যার বলি হয়েছে এক নির্দোষ মানুষের
সন্তানেরা। তাদের পিতাকে যথাযথভাবে সমাধিস্থ করার অধিকার তাদের দিতে হবে।
এরপর বাকি জীবনটা নির্বিঘ্নে যাপন করার জন্য যে দেশে তাদের ঘর, সেখানে
তাদের প্রত্যাবর্তন করতে দিতে হবে।
মঞ্জুরের আসল 'অপরাধ', সামরিক শাসনের পাঁয়তারা করা ক্ষমতামদমত্ত কিছু
মানুষের তিনি বিরোধিতা করেছিলেন। আসলে সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ
কর্মকর্তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন স্বল্পসংখ্যক গণতন্ত্রমনা
'সংবিধানপন্থী'দের একজন, যেমন ছিলেন জেনারেল মইনও, যাঁরা কখনোই আইয়ুব
খানের বাংলাদেশি কোনো সংস্করণকেই বঙ্গভবনের মসনদে আসীন দেখতে চাননি, তা
সে জিয়া বা এরশাদ যে নামেই হোক না কেন। উপরন্তু তাঁরা ছিলেন
ক্যান্টনমেন্টভিত্তিক কোনো রাজনৈতিক দলের উত্থানের বিরোধী। এটা কি
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য অভিশাপ হয়ে ওঠেনি? পাকিস্তানের জন্যও কি এটা
এখনো অভিশাপ নয়? এ দুই ব্যক্তি দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য লড়াই
করেছেন। তাঁরা গণতান্ত্রিক দেশে পেশাদার সেনাবাহিনীর পক্ষে ছিলেন।
পরিশেষে, মঞ্জুরের বিধবা স্ত্রী মার্কিন মুলুক থেকে কখনোই দেশে ফিরতে চান
না। কারণ, কখনোই তিনি ন্যায়বিচার পাবেন বলে মনে করেন না। তাঁর স্বামীকে
হত্যাকারী পার পেয়ে গেছে। সাক্ষ্য-প্রমাণও তা-ই বলে।
হয়তো আরেকটি পথ খোলা আছে। সে পথ গিয়ে ঠেকেছে সুপ্রিম কোর্টে। মঞ্জুরের
ভাই বা তাঁর সন্তানেরা আদালতের সামনে দাঁড়িয়ে নিম্ন আদালতের অন্তহীন জাল
থেকে মামলাটি বের করে আনার আবেদন করলে, তা অনুমোদন করা উচিত। গত ২০ বছরে
এই মামলাটি সেখানে আশা-প্রত্যাশাহীনভাবে মাটিচাপা পড়েছে।
তাহেরের মামলায় বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দীন চৌধুরী ও বিচারপতি জাকির
হোসেন অনন্য নজির স্থাপন করে দেখিয়েছেন যে ঘটনার বহু বছর পরও কীভাবে একটি
মামলার নিষ্পত্তি করা সম্ভব। তাঁরা নিজেরা উদ্যোগী হয়ে জটিল বিষয়গুলোর
তদন্ত ও সাক্ষী নির্বাচন করে তাঁদের আদালতের সামনে হাজির হওয়ার নির্দেশ
দিয়েছিলেন।
প্রয়োগ করার মতো বিপুল ক্ষমতা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের হাতে রয়েছে।
ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য জরুরি মনে করলে আদালত তা করে থাকেন। তাহের
ও মঞ্জুর হত্যা মামলা এক রকম নয়।
তাহেরের বিচার সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু বলা হয়েছে, সেটি ছিল অবৈধ ও
অসাংবিধানিক। উপরন্তু সেই বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগেই তাহেরের
মৃত্যুদণ্ডের বিধান সুনির্দিষ্ট করে রাখা হয়েছিল। আদালত মত দিয়েছিলেন,
সেই বিচারটি নিজেই ছিল একটি অপরাধ। সেটি ছিল একটি অবৈধ বিচারপ্রক্রিয়া।
সে কারণে তাহেরের মৃত্যুদণ্ডাদেশ ছিল হত্যাকাণ্ডের সমতুল্য।
মঞ্জুরের ক্ষেত্রে বিষয়টি তা নয়। এটি এখনো একটি চলমান বিচারপ্রক্রিয়া। ২০
বছর চলার পরও এখনো পর্যন্ত এ মামলায় কোনো রায় দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশের
অসামান্য এক অ্যাটর্নি জেনারেল আমিনুল হক ১৯৯০-এর দশকের প্রথম ও মধ্যভাগে
এ মামলার এক পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তপ্রক্রিয়ার সূচনা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর
অকালমৃত্যুর পর সেসবের আর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।
এয়ার ভাইস মার্শাল সদরুদ্দীনের মতো মানুষদের সাক্ষ্য সবে আলোর মুখ দেখতে
শুরু করেছে। এটি যে সম্ভব হয়েছে, তার পেছনে আছে সেই সময়ে আমিনুল হকের
অভিভাবকসুলভ সতর্ক পদক্ষেপ। সর্বোচ্চ আদালতের হাতে এই মামলার সূত্রগুলো
একত্র করে জেনারেল আবুল মঞ্জুরের হত্যাকারীকে খুঁজে বের করার ক্ষমতা আছে।
মঞ্জুর হত্যা মামলা বাংলাদেশের বিবেককে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। এটা
কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, তা-ই এখন দেখার বিষয়।
'জেনারেল এরশাদ, আমি কি জানতে পারি, আপনি কোন পরিকল্পনার কথা বলছেন?'
এয়ার ভাইস মার্শাল সদরুদ্দীনের সাক্ষ্য
মঞ্জুর হত্যা মামলায় ২৫ মার্চ ১৯৯৫ সিআইডিকে দেওয়া জবানবন্দির চুম্বক অংশ
'তাঁরা আমাকে বলেন যে এখানে মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে [জিয়া হত্যাকাণ্ডে]
ফাঁসানোর একটা পরিকল্পনা চলছে'
৩১ মে ১৯৮১
আমি এয়ার ভাইস মার্শাল সদরউদ্দীন (অব.), সাবেক বিমানবাহিনী
প্রধান।...সকাল আনুমানিক সাড়ে সাতটার সময় আমাকে জানানো হয় যে জেনারেল
এরশাদ টেলিফোনে আমার সঙ্গে কথা বলবেন। আমি টেলিফোন ধরি। জেনারেল এরশাদ
আমাকে আগের রাত্রে চিটাগাং সার্কিট হাউসে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত
হওয়ার সংবাদ দেন এবং দ্রুত ঢাকায় ফিরে আসার জন্য অনুরোধ করেন। আমি
কিছুক্ষণ পর ঢাকার উদ্দেশে হেলিকপ্টারযোগে রওনা হই এবং আনুমানিক ১০টার
সময় ঢাকায় ফিরে আসি।
আমি সরাসরি আর্মি হেডকোয়ার্টারে সেনাপ্রধানের অফিসে যাই। আমি তাঁর অফিসে
গিয়ে বেশ কিছু ঊর্ধ্বতন আর্মি অফিসারকে তাঁর অফিসে দেখি। তাঁদের মধ্যে
মেজর জেনারেল মীর শওকত আলী, মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী, মেজর
জেনারেল মান্নাফ, মেজর জেনারেল নূরউদ্দীনসহ অন্য আরও কিছু আর্মি অফিসারকে
দেখি। সেখানে তাঁরা চিটাগাংয়ে প্রেসিডেন্ট নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে আলোচনা
করছিলেন। জেনারেল এরশাদ আমাকে ঘটনা দ্রুত জানালেন। আমি সেখানে আনুমানিক
২০ মিনিট ছিলাম। সেখান থেকে বের হয়ে আসার পথে মেজর জেনারেল শওকত ও মেজর
জেনারেল মইন আমার পেছনে পেছনে আসেন। আসার পথে করিডরে তাঁরা আমাকে বলেন যে
এখানে মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে ফাঁসানোর একটা পরিকল্পনা চলছে।
......
'স্যার, দয়া করে নিশ্চিত করুন যাতে মঞ্জুরের কিছু না হয়'
১ জুন ১৯৮১
বিকেল আনুমানিক সাড়ে পাঁচটার সময় আমি বঙ্গভবনে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির
[বিচারপতি আবদুস সাত্তার] অফিসে ছিলাম। তখন সেখানে লে. জেনারেল এরশাদও
ছিলেন। আমরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলাম। এই সময় টেলিফোন আসে।
প্রেসিডেন্ট টেলিফোনে কথা বলেন। প্রেসিডেন্ট টেলিফোন রেখে জানান, আইজিপি
কিবরিয়া জানিয়েছেন যে মেজর জেনারেল মঞ্জুর এবং অন্যরা পুলিশের হাতে ধরা
পড়েছেন।
সংবাদটি বলার সঙ্গে সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে জেনারেল এরশাদ উত্তেজিত অবস্থায়
চেয়ার থেকে উঠে পড়েন। আর কিছু না বলে সরাসরি প্রেসিডেন্টের পাশে রেড
টেলিফোনের কাছে যান এবং একটি নাম্বারে ডায়াল করেন। টেলিফোনে তাঁর যে
কথাটি শুনতে পেলাম তা হলো, 'মঞ্জুরকে পুলিশ আটক করেছে। এক্ষুনি তাঁকে
নিয়ে নাও। তারপর পরিকল্পনামতো কাজ করো।' বলেই তিনি টেলিফোন রেখে দেন।
তখন আমি বলি, 'জেনারেল এরশাদ, আপনি কোন পরিকল্পনার কথা বলছেন, আমি কি
জানতে পারি?' এতে তিনি আবার বেশ উত্তেজিত হয়ে বলেন, 'এয়ার চিফ, আপনি
কিছুই বোঝেন না।' আমি বলি, 'আমি কী বুঝি না বুঝি, আপনার কাছ থেকে জানতে
হবে না।'
পরে আমি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির উদ্দেশে বলি, 'স্যার, দয়া করে নিশ্চিত করুন,
যাতে মঞ্জুরের কিছু না হয় আর তিনি ন্যায্য বিচার পান। মঞ্জুরের কিছু হলে
জাতির কাছে আপনাকে জবাব দিতে হবে।' এর উত্তরে সাত্তার সাহেব বিচার করা
হবে বলে জানান।
......
'আপনারা জেনারেল মঞ্জুরকে মেরে ফেললেন'
২ জুন ১৯৮১
ভোর রাত্রি আনুমানিক দেড়টা-দুইটার দিকে উইং কমান্ডার কামাল, ডিরেক্টর,
এয়ার ইন্টেলিজেন্স, টেলিফোনে মেজর জেনারেল মঞ্জুরের হত্যার খবর দেন। আমি
সকাল আনুমানিক ছয়টা-সাতটার সময় এরশাদ সাহেবকে টেলিফোনে বলি, 'এরশাদ
সাহেব, আপনারা জেনারেল মঞ্জুরকে মেরে ফেললেন?' (শেষ)
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন

লরেন্স লিফশুলৎজ
ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউর (হংকং) দক্ষিণ এশিয়া প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি
দ্য গার্ডিয়ান, লে মঁদ দিপ্লোমাতিক, দ্য নেশন (নিউইয়র্ক) ও বিবিসির পক্ষে
লিখেছেন। তিনি বেশ কিছু বই রচনা ও সম্পাদনা করেছেন; এর মধ্যে রয়েছে
বাংলাদেশ: দি আনফিনিশ্ড্ রেভল্যুশন, হিরোশিমা'জ শ্যাডো ও হোয়াই বসনিয়া?
OpenDoor.Lifschultz@gmail.com

No comments:

Post a Comment