Monday, June 2, 2014

নজরুল জীবনের শেষ পর্যায় - বাঁধন সেনগুপ্ত

কাজী নজরুলের জীবনের শেষ চৌত্রিশটা বছর ছিল বড় মর্মান্তিক । কোন সৃষ্টিশীল মানুষ নজরুলের মত অবহেলা আর বঞ্চনার যন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন কিনা জানি না। মধুসূদন দত্ত জীবনের শেষ দিনগুলো আত্মীয়-পরিজনহীন, চরম দারিদ্র ও অবহেলার মুখোমুখি হয়েছিলেন সত্য, কিন্তু নজরুল ইসলামের শেষ জীবন আরো বেশি মর্মন্তুদ,বেদনাদায়ক ।

নজরুলের অসুস্থ হয়ে পড়ার দিন নিয়েও সঠিক তথ্য জানা যায় না । কেউ বলেন রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিবসে (৭ই অগস্ট ১৯৪১) কলকাতা রেডিওতে ‘রবিহারা’ কবিতাটিঐদিনই লিখে আবৃত্তি করার সময় কবির কন্ঠস্বর জড়িয়ে আসে, কবি অসুস্থ হয়ে পড়েন । হতেপারে একটা প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিয়েছিল ঐদিন থেকে । একবছর পর ১০ই জুলাই নজরুল তাঁরসুহৃদ জুলফিকার হায়দারকে একটি চিঠি লিখেছিলেন “তুমি এখনি চলে এসো ... আমি কাল থেকেঅসুস্থ” । অতয়েব আমরা ধরে নিতে পারি ১৯৪২এর ৯ই অগষ্ট থেকেই কবি অসুস্থ হয়ে পড়েন ।কবি তখন আক্ষরিক ভাবেই কপর্দকহীন । সংসারে দুই শিশু পুত্র, পক্ষাঘাতগ্রস্ত স্ত্রীপ্রমীলা, সর্বক্ষণের অভিভাবক শাশুড়ি গিরিবালা । ১৭০০ গানের রেকর্ডে লক্ষলক্ষ টাকা মুনাফার সন্ধান দেওয়া গ্রামফোন কোম্পানী কোন রয়ালটি, প্রাপ্য পারিশ্রমিক দিচ্ছেনা,তাঁর লেখার প্রকাশকরা ফিরেও তাকাচ্ছে না । ১৭ই জুলাই ১৯৪২, শারীরিক যন্ত্রণাউপেক্ষা করে এক বন্ধুকে পত্র লেখেন কবি । লিখেছিলেন -  “আমি blood pressureএ শয্যাগত, অতিকষ্টে চিঠি লিখছি । আমার বাড়িতে অসুখ, ঋণ,পাওনাদারদের তাগাদা, প্রভৃতি worries, সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত খাটুনি । তারপর নবযুগের worries ৩/৪মাস পর্যন্ত । এইসব কারণে আমার nerves shattered হয়ে গেছে । ... কথা বন্ধ হয়ে গিয়ে অতি কষ্টে দু’একটা কথা বলতেপারি,বললে যন্ত্রণা হয় সর্ব শরীরে”।

কবির অসুস্থতার কারণ বা কি ছিল তাঁর অসুখ, তা নিশ্চিত ভাবে কেউজানাননি । নানারকম কথা নানান জনে লিখে গেছেন । শোনা যায় ‘নবযুগ’ সম্পাদনা কালে একবার কবি উত্তরপাড়ায় এক দুষ্কৃতি দলেরকাছে প্রহৃত হয়েছিলেন, কয়েকজন যুবক উত্তরপাড়া থানার হেপাজত থেকে, ঘাড়ে ও মাথায় কঠিন আঘাত পাওয়া নজরুলকে বাড়ি পৌছে দিয়েছিলেন । এই আঘাতের কথা কোন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি । শোনা যায় নির্বাক কবি যখন বাংলাদেশে (১৯৭২), তখন নাকি তাঁরচিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ড, কবির ঘাড়ে পুরাতন কঠিন আঘাতের চিহ্নটি সনাক্ত করেছিলেন । 

বিস্ময়েহতবাক হয়ে হয় - কি নিদারুণ অব্যবস্থা হয়েছিল তাঁর অসুস্থতা প্রকট হওয়ার পর । প্রথমসাতদিন চিকিৎসা করেন হোমিওপ্যাথিক মতে, নজরুলেরই বাড়িওয়ালা ডাক্তার ডি এল সরকার ।অথচ মাত্র তিনদিন চিকিৎসার পর অতি উৎসাহী হয়ে নজরুলের সেই বন্ধু জুলফিকার হায়দার খবরের কাগজে কবির অসুস্থতার সংবাদ দিয়ে পাঠিয়ে প্রচার করে দেন নজরুল ‘উন্মাদ’ হয়ে গেছেনবলে । বাইশ বছর পরে লেখা তাঁর গ্রন্থে (‘নজরুল জীবনের শেষ অধ্যায় – ১৯৬৪) জুলফিকারহায়দার এই মিথ্যা সংবাদ প্রচারের সাফাই দিয়েছিলেন যে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ‘হয়তোঅসুখের সংবাদ পেয়ে কাজীদার অনেক বন্ধুবান্ধব এবং ভক্ত অনুরক্তদের মধ্যে একটা সাড়া পড়ে যাবে,দেখতে আসবে’ । অথচ জুলফিকার হায়দার প্রচারিত কবির ‘মস্তিষ্ক বিকৃতি’রমিথ্যা সংবাদ প্রচারের দুইবছর পরেও ১৯৪৪এর ২৭শে ফেব্রুয়ারি একজন নুরুল ইসলামকে একটা কাগজে লিখে নজরুল জানিয়েছিলেন - “শ্রীমান মোহম্মদ নুরুল ইসলাম, তুমি চিরঞ্জীবহয়ে থেকো । আমায় ও আমার ছেলে দুটিরে চিরদিন মনে রেখো”।

শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের আর্থিক সহায়তায় কবিকে স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য মধুপুর পাঠানো হল১৯৪২এর ১৯শে জুলাই, কিন্তু অর্থ শেষ হয়ে যাবার পর কলকাতায় ফিরিয়ে আনা হয় ২১শেসেপ্টেম্বর । ১৯৪৪এর ২৪শে মে আনন্দবাজার পত্রিকার ‘কবি নজরুল পীড়িত’ শিরোনামে একটিআবেদন প্রচারিত হয় । আবেদনে বলা হয়েছিল ‘বাংলার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বহুদিন যাবত পক্ষাঘাতে শয্যাগত । অসক্ত হইয়া পড়ায় তিনি এখন নিঃস্ব ও কপর্দকহীন । তাঁহার স্ত্রীও পক্ষাঘাতে শয্যাশায়িনী । চিকিৎসা দূরের কথা,এমন সঙ্গতি নাই যে শিশু পুত্রদ্বয়,রুগণা পত্নী ও নিজের আহার্যটুকু জোটে। বাংলার জাতীয় কবির প্রাণরক্ষায় সহৃদয় সর্বসাধারণের অকুন্ঠ সাহায্য একান্ত আবশ্যক’ । 

এরপর কয়েকটি সাহায্য সমিতি গঠিত হয় । কলকাতার সুখ্যাত চিকিৎসকেরা কবিকেদেখেন একাধিকবার, কিন্তু নিরাময়ের কোন লক্ষণ দেখা যায় না । কবি কাজী আবদুল ওদুদেরউদ্যগে গঠিত ‘নজরুল নিরাময় সমিতি’র উদ্যোগে কবিকে রাঁচির মানসিক চিকিৎসালয়ে পাঠানোহয় ১৯৫২র ২৫শে জুলাই । কিন্তু চার মাস চিকিৎসাধীন থেকেও কোন উন্নতি না হওয়ায়ফিরিয়ে আনা হয় কলকাতায় । পরের বছর ১০ই মে ১৯৫৩ কবিকে নিয়ে যাওয়া হয় লন্ডনে ।সেখানকার চিকিৎসকেরা মতপ্রকাশ করেন যে কবির ব্রেন কুঁকড়ে গেছে অর্থাৎ মষ্টিস্কেরসংকোচন হয়েছে । লন্ডন থেকে ১০ই ডিসেম্বর নজরুলকে নিয়ে যাওয়া হয় ভিয়েনায় । সেখানেওচিকিৎসকের অভিমত ছিল কবিকে আর সুস্থ করে তোলা যাবে না । এরপরেও পূর্ব জার্মানীর বন বিশ্বিবিদ্যালয়ের ছাত্ররা এক রুশ ডাক্তারকে দিয়ে পরীক্ষা করিয়েছিলেন । তাঁর অভিমতছিল যে অনেক দেরি করে রোগীকে আনা হয়েছে । সাতমাস বিদেশে বৃথা চেষ্টার পর কবিকে ফিরিয়ে আনা হয় কলকাতায় ১৯৫৩’র ১৪ই ডিসেম্বর ।

এর পরেও ২৩বছর জীবিত ছিলেন নজরুল । অভাবের তাড়না, মানসিক কষ্ট,নিঃসঙ্গতা, পরিচিত বন্ধুদের দূরে চলে যাওয়া, অবহেলা এসবই ছিল কবির শেষ জীবনেরসঙ্গী । পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক বিনা ভাড়ায় থাকার জন্য ফ্ল্যাটের বন্দোবস্ত ও দুইবাংলা থেকেই লিটারারি পেনশনের ব্যবস্থা হওয়ার পর কিছুটা স্বস্তি এসেছিল । ১৯৬২র ২৩শে জুন দীর্ঘ ২৩বছর ধরে পক্ষাঘাতে শয্যাগত স্ত্রী প্রমীলার দেহাবসান হ’ল, কবি আরো নিঃসঙ্গ হয়ে গেলেন ।

জীবনের শেষ চারটি বছর কবি বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদায় তাঁর প্রাপ্য সমাদর পেয়েছিলেন । মৃত্যুর সাত ঘন্টার মধ্যেই তাঁর আপনজনেরউপস্থিতির আগেই রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় নীরব কবিকেসমাহিত করলেন সে দেশের সরকার

[ তথ্যসূত্র– নজরুল জীবনের শেষ পর্যায় / বাঁধন সেনগুপ্ত, পশ্চিমবঙ্গ পত্রিকা , কাজী নজরুলইসলাম শতবার্ষিকী সংখ্যা ]

ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক: কাজী সেলিম


১৯৮৩ সালের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বাংলাদেশে জনগণ ও সরকারগুলো গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম, অর্থের উৎস, ব্যাংকঋণের সুদের পরিমাণ ও সুদ আদায় পদ্ধতি, চেয়ারম্যান মহাব্যবস্থাপক, বোর্ড সদস্য পদ্ধতি ও বয়স মেয়াদসহ ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ সকল বিষয়ে সম্পূর্ণভাবে অজ্ঞ এক অন্ধ ধারণা পোষণ করছিল। ২০১০ সালের ৩ নবেম্বর নরওয়ে টেলিভিশনের ধারণকৃত একটি পূর্ণাঙ্গ ডকুমেন্টারি ছবি প্রচারণার মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংকের সকল গোপন, অবৈধ, অপ্রকাশিত কার্যক্রম, লেনদেন ঘুমন্ত বাংলাদেশের সরকার ও জনগণকে জাগ্রত করে তোলে। বিশ্বের প্রায় অধিকাংশ দেশেই গ্রামীণ ব্যাংকের উপর প্রচারিত উক্ত প্রামাণ্য চিত্রের মূল ও প্রধান বিষয়সমূহ ফলাও করে প্রচারিত হয়, যা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে শুধু কলুষিত ও কলঙ্কিতই করেনি, নোবেল পদক, পদকপ্রাপ্ত ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের উপর বিশ্বব্যাপী সৃষ্টি করেছে সন্দেহ, বিতর্ক ও দাতা দেশসমূহের নজরদারি ও জবাবদিহিতার চরম গাফিলতির। পুরস্কারপ্রাপ্ত ডেনমার্কের ডকুমেন্টারি ছবি প্রস্তুতকারক, টম হেইনিম্যানের পরিচালনায় প্রামাণ্য চিত্র ‘মাইক্রো ঋণের খপ্পরে’ তৈরির সময় পরিচালক টম বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সফর করে গ্রামীণ ব্যাংকের অর্র্থঋণ গ্রহণকারীদের সঙ্গে ব্যাপক আলাপ আলোচনা ও সাক্ষাতকার গ্রহণ করেছেন। টম হেইনিম্যান তাঁর বহুল প্রচারিত ও সমালোচিত উক্ত প্রামাণ্য ছবিতে গ্রামীণ ব্যাংকের কি কি স্পর্শকাতর বিষয় কয়েক যুগ পরে ফাঁস করে বিশ্বব্যাপী সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে ব্যাপক প্রচার করে ইউনূস সাহেবকে ও গ্রামীণ ব্যাংককে বিতর্কিত, সমালোচিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।

নরওয়ের টেলিভিশনে প্রচারিত ওই প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শন করে দেখানো হয়েছে যে, ১৯৯৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. ইউনূস সাহেব গ্রামীণ ব্যাংকের নামে নরওয়ে ও অন্য দাতা দেশসমূহের কাছ থেকে প্রাপ্ত প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার (মার্কিন) নরওয়ে ও অন্যান্য দাতা দেশসমূহের বিনা অনুমতি ও অনুমোদন ব্যতীত ‘গ্রামীণ কল্যাণ’ নামে অপর একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান নামে স্থানান্তর করে যা মাইক্রো ঋণের সঙ্গে কোন প্রকার সম্পর্ক বা লেনদেন ছিল না।

 ওই প্রামাণ্য চিত্রে দাবি করা হয় যে, ঢাকার নরওয়ের দূতাবাস, নরওয়ের দাতা সংস্থা, নোরাড এবং বাংলাদেশে সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের চাপের ফলে, গ্রামীণ ব্যাংক ও ইউনূস সাহেব ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের মধ্যে ৩০ মিলিয়ন ডলার ফেরত প্রদান করেছে, যা ছিল নরওয়ে, সুইডেন ও জার্মানির প্রদত্ত অর্থের অংশবিশেষ। ওই প্রামাণ্য চিত্রের পরিচালক টম দাবি করেছেন যে, ড. ইউনূস সাহেবের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে নরওয়ের দাতা সংস্থা নোরাড, বাংলাদেশস্থ নরওয়ের দূতাবাস ও বাংলাদেশ সরকার গ্রামীণ ব্যাংকের বিভিন্ন অনিয়ম ও অবৈধ কার্যকলাপ সম্পর্কে নীরবতা পালন করছিল বলে প্রামাণ্য চিত্রে দাবি করে আরও বলা হয়েছে যে, উল্লেখিত ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার নরওয়ে, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস ও জার্মানির নিকট হতে ১৯৯৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংককে প্রদান করা হয়েছিল, গ্রামীণ কল্যাণ নামে অপর কোন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাকে নয়।

 ওই ডেনিশ সাংবাদিক ও প্রামাণ্য চিত্র নির্মাতা টম হেইনিম্যান কয়েকবার গ্রামীণ ব্যাংকের উপর প্রামাণ্য চিত্র নির্মাণ কাজে বাংলাদেশ সফর করেছিলেন এবং কয়েকজন আন্তর্জাতিক অর্থ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলাপ করেছিলেন, তিনি তার প্রামাণ্য চিত্রে দাবি করেছেন যে, গ্রামীণ ব্যাংকের কঠিন ঋণের শর্তের যাঁতাকলে বহুসংখ্যক মহিলা পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। প্রামাণ্য চিত্রে টম দাবি করেছেন যে তিনি বহুবার ইউনূস সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাত করার জন্য চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। প্রামাণ্য চিত্রটি গ্রামীণ ব্যাংকের প্রকৃত চিত্র ধরে তুলে প্রচার করে যে, গ্রামের দরিদ্র মহিলাগণ শতকরা ৩০ শতাংশ সুদ প্রদান করে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অর্থঋণ গ্রহণ করেন এবং এক সপ্তাহ পরই ঋণের সুদের টাকা শোধ করা শুরু হয়। ওই প্রামাণ্য চিত্রে কয়েকজন ঋণগ্রহীতার সাক্ষাতকার তুলে ধরা হয়েছে। কিভাবে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গ্রামের গরিব মহিলাদের ঋণের টাকা পরিশোধ ও আদায় করার জন্য ভয়ভীতি ও বল প্রয়োগ করে থাকে। সাংবাদিক টম দাবি করেছেন যে, প্রামাণ্য চিত্র তৈরি করার পূর্বে গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যপদ্ধতি ও দৈনন্দিন লেনদেনের উপর বিভিন্ন গবেষণা পরিচালনা করতে গিয়ে বিতর্কিত ও বহুল সমালোচিত ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার গ্রামীণ কল্যাণে স্থানান্তরের চিঠিপত্র এবং তথ্য প্রমাণাদি দেখতে পেয়ে আঁতকে উঠেন। তিনি বলেন যে, ওই তথ্য প্রমাণাদি অসলোস্থ নোরাড ও নরওয়ের সাহায্য সংস্থার আর্কাইভ বা গ্রন্থশালা থেকে সংগ্রহ করেছেন।

প্রামাণ্য চিত্রে ৯০ দশক থেকে শুরু করে চিত্র প্রদর্শন পর্যন্ত সাহায্য সংস্থা নোরাড অনেক গোপন তথ্যাদি প্রকাশ বা প্রচার করে বিশেষভাবে গোপন করে রেখেছিল, যা নরওয়ের জনগণ সরকার ও পার্লামেন্ট সদস্যদের বৈদেশিক ঋণ প্রদান ও তার অপব্যবহারের সংবাদ জানার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিল বলে প্রামাণ্য চিত্রে দাবি করা হয়। প্রামাণ্য চিত্রটি প্রচারিত ও প্রদর্শনের পর নরওয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, এরিক সোল হেইম এই বলে মন্তব্য করেছিলেন যে, ‘প্রামাণ্য চিত্রে উল্লেখিত বিষয়গুলো সত্য ও সঠিক এবং ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।’ এর পরই নরওয়ের পার্লামেন্ট গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর প্রচারিত প্রামাণ্য চিত্রের বিষয়গুলোর ওপর ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা করে এবং নরওয়ের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কার্যক্রম শুরু করে। নওয়ের প্রামাণ্য চিত্র প্রস্তুতকারী সংস্থা, এন আর কের তরফ থেকে দাবি করা হয়েছে যে, প্রামাণ্য চিত্রটি প্রদর্শনের ছয় সপ্তাহ পূর্ব থেকে ড. ইউনূসের সঙ্গে ই-মেইল করে তার মতামত জানার চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্ত ড. ইউনূস কখনই তাদের ই-মেইলের জবাব প্রদান করেন নি।
বিশ্বব্যাপী গ্রামীণ ব্যাংকের অনিয়ম ও দাতা সংস্থার ও দেশের অর্থ অপব্যবহারের ওপর প্রামাণ্য চিত্র সংবাদ আকারে প্রচারিত হওয়ার পর বাংলাদেশ সরকার ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক পরিচালিত বার্ষিক তদন্ত ও অনুসন্ধানের উপস্থাপিত রিপোর্টের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অপসারণের আদেশ জারি করে।

 প্রামাণ্য চিত্রের অভিযোগ ও সরকারের পরিচালিত তদন্ত সাপেক্ষে যে বিষয়গুলো অভিযোগ হিসেবে নির্দিষ্টভাবে উদঘাটন করা হয় সেগুলো হলো :

১. দরিদ্র ঋণ গ্রহীতাদের নিকট থেকে জোরজবরদস্তি ভয়ভীতি ও হয়রানি করে ঋণের সুদের অর্থ আদায় করা হয়। ২. ঋণের টাকার সুদের হার সম্পর্কে বানোয়াট ও বিভ্রান্তমূলক ড. ইউনূসের স্বাক্ষরযুক্ত তথ্য সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছিল। ৩. ড. ইউনূস বেআইনীভাবে ৫৪টি কোম্পানি গঠন করেন যার সঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংকের নাম ব্যবহার করেন। এ সম্পর্কে ড্যানিয়েল পার্ল ফাউন্ডেশনের ওয়েব সাইটে একটি প্রতিবেদন ছাপানো হয়েছিল। কিন্তু ইতোমধ্যে উক্ত প্রতিবেদনটি ওয়েবসাইট থেকে ব্লগ করে রাখা হয়েছে যাতে কেউ আর প্রতিবেদনটি পড়তে না পারেন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায় যে, মিরপুরের গ্রামীণ ব্যাংক কার্যালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা দেশী-বিদেশেী সাংবাকিদের নিকট গোজামিল তথ্য প্রদান করেন এবং ড. ইউনূস তাদের সঙ্গে সাক্ষাত প্রদান না করে লুকোচুরি খেলেছেন।
দেশ-বিদেশের সংবাদ মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূস সম্পর্কে বিরূপ সংবাদ প্রচারিত হওয়ায় বাংলাদেশ ও দেশের জনগণের ভাবমূর্তিকে আন্তর্জাতিকভাবে কলঙ্কিত করেছে। স্বভাবতই কোন সরকারই এ ক্ষেত্রে হাত-পা গুটিয়ে চুপচাপ বসে থেকে দেশ- বিদেশে গ্রামীণ ব্যাংকের অনিয়ম, দুনীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার সংবাদ ও সচিত্র প্রতিবেদনকে নীরবে হজম করতে পারে না। তা হলে সেটা হতো বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের জন্য এক লজ্জাকর জঘন্য অন্যায় ও রীতি নীতিবিবোধী জাতীয় অপরাধ। 

২০০৯ সালের জানুযারি মাসে তদানীন্তন সরকার গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সকল অনিয়ম, ক্ষমতার অব্যবহার এবং ড. ইউনূসের বয়স অতিক্রম করার পরও গ্রামীণ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক হিসেবে অনির্দিষ্টকালের জন্য নিয়োগ প্রদানসহ সকল বিষয় তদন্ত শেষে, গঠিত কমিটি তিন মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট সরকারের নিকট দাখিল করে। যেহেতু বাংলাদেশ সরকার গ্রামীণ ব্যাংকের ২৫% শতাংশ মালিকানার অংশীদার, সে ক্ষেত্রে দেশের সকল বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান নিয়ন্ত্রণ “বাংলাদেশ ব্যাংক”ও দীর্ঘদিন পর নড়েচড়ে বসে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও কয়েক যুগ নাসিকায় সরিষার তেল দিয়ে গভীর নিদ্রায় মগ্ন ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক তার নিজস্ব মুনাফা প্রতিষ্ঠা ও কর্তব্য পালনের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে সরকার প্রতিষ্ঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের পদ থেকে অপসারণ করার নির্দেশ জারি করে বলে যে, ড. ইউনূস অবসর গ্রহণ আইন ৬০ বছর লঙ্ঘন করে ৭০ বছর বয়স পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধান হিসেবে বহাল তবিয়তে অবস্থান করছেন। বাংলাদেশের ব্যাংক কোম্পানির ধারা মোতাবেক কেন্দ্রীয় বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের যে কোন ব্যাংক বীমা ও আর্থিক লেনদেন ও যে কোন অর্থ লগ্নি সংস্থা বা সংগঠনের গচ্ছিত কর্তা বা সঞ্চয় কর্তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করার ক্ষমতা রাখে।

গ্রামীণ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপকের পদ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অপসারণপত্র প্রাপ্তির পর ড. ইউনূস স্ব-প্ররোচিত হয়ে (সরকার নয়) স্বেচ্ছায় বাংলাদেশের হাইকোর্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের অপসারণ নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে একটি আপীল করেন। ২০১৩ সালের ৮ মার্চ হাইকোর্ট বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ড. ইউনূসের অপসারণ সংক্রান্ত আদেশকে যথাযথ বলে সমর্থন করে এই মর্মে মত প্রকাশ করে যে, ২০০০ সালে ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রয়োজনীয় অনুমোদন ব্যতীত ও পুনর্নিয়োগ প্রদান করা হয়েছিল, যা সরকারের আংশিক মালিকানাধীন ব্যাংকের লিখিত আইন বা বিধির প্রকাশ্য লংঘন ও ভঙ্গ করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র অথবা ইউরোপের কোন একটি এ ধরনের ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক বা চেয়ারম্যান যদি এভাবে বিদেশের প্রাপ্ত ঋণ বা সাহায্যের অর্থ অবৈধভাবে অন্য যে কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে লগ্নি করত তাহলে তাকে নিশ্চয়ই যুক্তরাষ্ট্রেও কংগ্রেসের সিনেট অর্থ সংক্রান্ত সাব কমিটি অথবা ব্রিটেনের হাউস অব কমন্স অথবা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পার্লামেন্টের অর্থসংক্রান্ত সাব কমিটির সম্মুখে গলদের টাই ধরে টেনে হিঁচড়ে অপরাধী আসামি হিসেবে সশরীরে হাজির হয়ে জবাবদিহি করতে বাধ্য করা হতো।

ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক কেন ১০০ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ৩০ মিলিয়ন ডলার ফেরৎ প্রদান করেছেন? ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নীরবতা পালন করার মধ্যে যে একটি গভীর বড় ধরনের রহস্য বিদ্যমান, দেশের সচেতন ও শিক্ষিত জনগণ ও বিদেশে ড. ইউনূসের বন্ধুদের এটাই বাস্তবভাবে অনুধাবন করা উচিত। বাংলাদেশে সরকারকেও এই স্পর্শকারত বিষয়ে চুপচাপ না থেকে, যেহেতু প্রচারিত প্রামাণ্য চিত্রের বিষয়াবলী দেশের সুনাম ও মর্যাদাকে কলঙ্কিত করেছে, তাই বাংলাদেশ সরকারের উচিত নরওয়ের টেলিভিশনের পরিচালক প্রামাণ্য চিত্র নির্মাতা ও সংশ্লিষ্ট সকলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে কয়েক শত মিলিয়ন ইউরো দাবি করে মামলা দায়ের করা উচিত ও দেশের ও বিশ্ব জনগণকে জানিয়ে দেওয়া উচিত যে, ড. ইউনূস সাহেবকে গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্যদের প্রধান পদ থেকে অপসারণ করা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রচলিত আইন কানুন বিধি মোতাবেক সঠিক ছিল, এ ব্যাপারে কোন দেশ, পরিবার, বা গোষ্ঠীর অহেতুক আস্ফালন করার কোন অধিকার নেই।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা

ব্যর্থ জনকের পুত্রঋণ -রণজিৎ বিশ্বাস


সংসারে কোন্ পিতা সবচেয়ে হতভাগ্য? সেই পিতা যাকে কাঁধে তুলতে হয় আপন সন্তানের প্রাণহীন দেহ। তেমন কাউকে কি আপনি দেখেছেন? নিয়তই দেখি। প্রায় প্রতিদিনই দেখি। সেদিন চট্টগ্রাম যাওয়ার সময় একই বাহনে ছিলেন আমার এক সহকর্মী, যার মেধাবী সন্তান সেন্ট মার্টিনস দ্বীপে বন্ধুদের সঙ্গে স্নান করতে নেমে আর কূলে ফিরতে পারেনি। চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাওয়া পুত্রের দেহটি অন্তত পাওয়া যায় কিনা দেখার জন্য কয়েক দিনের ব্যবধানে আবার সেই সেন্টমার্টিনসে যাচ্ছেন। উন্মাদপ্রায় স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে।
: আপনার নিজের জীবনে কি এমন কিছু ঘটেছে? আপনি কখনও কি এমন অবস্থার মুখোমুখি হয়েছেন?
: হয়েছি। বড় অকালে অসময়ে ও অপ্রয়োজনে হয়েছি। ষোলোটি বছর ধরে সে যন্ত্রণা পুষে চলেছি ও সে যন্ত্রণা আমি বয়ে মরছি। যে আমার হাতের কাজ কেড়ে নিত, সে তার একমাত্র বোনের বিয়ের সময় বলতে পারত- একটুও কাঁদবিনে বুড়ি, তোর সঙ্গে আমি আছি। বাবার কথা কিছুও ভাববিনে তুই, বাবাকে বোঝাবার দায়িত্ব আমার, মেধা বিচারে যে হতে পারত বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সেরা শিক্ষক, সে আমার সঙ্গে নেই। তার কাছে আমার ঋণের কোন শেষ নেই। সে অনেকটা বছর ধরে আমার আনন্দে নেই, আমার ক্রন্দনে আছে কিন্তু ক্রন্দনসিক্ত পিচ্ছিল পদযাত্রায় নেই; আমার উদ্বেগে আছে কিন্তু পরিকল্পনায় নেই; বঞ্চনায় আছে কিন্তু আমার স্বপ্নে নেই; আমার ভাবনায় আছে কিন্তু সম্ভাবনায় নেই। যে দিন থেকে সে নেই, সেদিন যদি তার পিতৃত্বের অভিষেক হতো, একদিন এক বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অসামান্য সুন্দর একটি বক্তৃতা দিয়ে বিজিত দলের যে মেয়েটির মনিবন্ধ চোরাচুরি করে মুঠোয় নিতে গিয়ে তার বাবার কাছে ধরা পড়েছিল, সেই কান্তিময়ী মেয়েটিই যদি তার জীবনের সঙ্গী হতো, এতদিনে তাদের ঘরে দশবারো বছরের অন্তত একজন পৌত্র বা পৌত্রী আমার থাকতে পারত।
যা হোক এসব নিয়ে এখন আর খুব বেশি ভাবি না আমি। মাঝেমাঝে কাঁদি, কান্নার সে জল মাটিতে পড়ার আগেই বাষ্প হয়ে উবে যায়।
সে হয়ত এখন পরপারের সিংদুয়ারে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে তার বাবাকে আর মাকে গ্রহণ করার জন্য। হয়ত সে পরিকল্পনা সাজিয়ে বসে আছে কী সেবা করবে তার বাবাকে, কী সেবা করবে তার মাকে অথবা কী শাসন করবে তাদের দু’জনকে, তার বয়স্ক ও অবাধ্য দু’সন্তানকে।
এই পুত্রের কাছে আমার ঋণ অপরিসীম। সে তার বাবাকে তৃপ্তপরিতৃপ্ত; সম্মানিত, ব্যর্থ, সমৃদ্ধ, পরিচিত, অভিজ্ঞতাঋদ্ধ, আঁধিমুক্ত, তর্কিত-বিতর্কিত, বিধ্বস্ত, হতাশাগ্রস্ত ও চিরদিনের জন্য ক্রন্দনশীল করে রেখে গেছে। জীবনের বাকি সময়ের জন্য সে তার বাবাকে অরণ্যবিদীর্ণ নির্জন ও শ্বাপদসঙ্কুল পথ বড় অসময়ে বড় অপ্রয়োজনে বড় উদারভাবে উপহার দিয়ে গেছে। এখন অসামান্য ও অমেয় মূল্যের উপহার সংসারে খুব বেশি লোকের জোটে না। যখনই সে আমার মনে আসে, তখনই সে বুঝিয়ে ছাড়ে- সন্তানের কারণে তো মা-বাবার ভোগবিপাক দুর্যোগ দুর্ভোগ অনেক হয়, সন্তান যদি রোগে ভোগে জরায় পড়ে, যদি সে উপযুক্ত না হয়, যদি সে ঝাপটাশিল্পী হননশিল্পী পেশীশিল্পী কিংবা কর্তনশিল্পী হয়, যদি তাকে ঘনঘন প্রহৃত হতে হয় ও ‘রাজবাড়ির অতিথি’ হয়, যদি তার কারণে মা-বাবাকে ক্যামেরার সামনে বা কাঠগড়ায় জবাবদিহির জন্য দাঁড়াতে হয়, যদি তার ভাল একটা চাকরি না জোটে মা-বাবাকে কত দুয়ারে ধর্ণা দিতে হয়, কত অঘাটকে ঘাট মানতে হয়- তাতো তোমাদের জানা আছে বাবা। তাহলে আমার অকাল প্রস্থান নিয়ে এত ভাবাভাবি আর কাঁদাকাঁদি কেন কর! আমি তো তোমাদের অনেক বিপদ অনেক দুশ্চিন্তা ও অনেক খরচাখরচ থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছি বাপ! তাহলে আর আমার ‘আর্লি ডিপার্চার’-এর জন্য আফসোস কেন! তুমি কি পত্রপত্রিকা পড় না। তুমি কি দেখনা সন্তানের হাতে পিতামাতা আলাদা আলাদা অথবা জোড়াজোড়া খুন হয়ে যাচ্ছে। অথবা, পিতার হাতে সন্তানের জীবন যাচ্ছে! দেখ না তুমি! দেখে না আমার মা! এইসব ঝুঁকি থেকে আমি তোমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছি। আমি তো বাবা ‘রক’-এ বসে আড্ডা দিতে পারতাম, ইভটিজিঙে এক্সপার্ট হয়ে উঠতে পারতাম, পাশের বাড়ির মেয়েটির অথবা আমার বন্ধুর বোনটির জন্য আতঙ্ক হয়েও উঠতে পারতাম। আমি তো পরীক্ষায় নকল করে ধরা পড়তে পারতাম, চুরিডাকাতি, বদমাশি, খুন খারাবি, রাহাজানি করে এক নিরীহ হাবাগোবা আর ইডিয়টিক টাইপের শ্রমজীবী কথাসাহিত্যিক আর তার শিক্ষক স্ত্রীর মাথা কাটাতে পারতাম, তার জীবনের সমস্ত অর্জন ধুলোয় বালিতে ও আবর্জনে কাদায় মিশিয়ে দিতে পারতাম। আমি তো নষ্ট ও ভ্রষ্টদের পদপ্রান্তে তোমাকে মাথা নইয়ে চলার ব্যবস্থা নির্দয়ভাবে পাকা করে দিতে পারতাম। আমার তো একটা বিকলাঙ্গ সন্তান হতে পারত, আমার স্ত্রী তো একটি অটিস্টিক বাচ্চার মা হতে পারত, আমার দাম্পত্যজীবনে অশান্তি ও অবিশ্বস্ততা থাকতে পারত, আমাকে বারবার হয়ত বিবাহ বিচ্ছেদে জড়াতে হতো, তোমার বৌমা একজন ক্যান্সার পেসেন্ট হতে পারত, চাকরিজীবনে তোমার মতোই হয়ত বঞ্চনা, অবিচার আর দলনপীড়নের শিকার হতে হতো। আমি এ্যাকসিডেন্টে কিংবা হরতালে অবরোধে কিংবা হার্ট-এ্যাটাক’-এ প্রাণ হারাতে পারতাম।
এই সব তো বটেই, আরও তিন হাজার সাঁইত্রিশ রকম ঘটন দুর্ঘটন আমাকে নিয়ে হতে পারত, তোমাদের ছেড়ে অসময়ে চলে আসায় আমার কারণে এসব পোহানোর ঝুঁকি থেকে তোমরা মুক্ত আছো। চলে আসার আগে যদি কোন কারণে অথবা একাধিক কারণে তোমাদের ভুগিয়ে থাকি, যদি আমাকে দেয়া স্বাধীনতার অপব্যবহার করে থাকি; যদি তোমার ও তোমাদের দেয়া স্নেহপ্রশ্রয়ের অপচয় আমি করি, এখন মনে হয় যে করেছিও; আমাকে ক্ষমা করো। সেটি করতে পারো না পারো, এটুকু অন্তত বুঝে নিও, আমি কিন্তু অনেকগুলো কারণে তোমাদের কৃতজ্ঞও করে এসেছি, দায়মুক্তি আর স্বস্তি সোয়াস্তিতও দিয়ে এসেছি। আমাকে নিয়ে তোমাদের যে অনেক সুখস্মৃতি আর নন্দনন্দ আনন্দ স্মৃতিও আছে, তাও তোমরা অস্বীকার করতে পারবে না বাপ! সবকিছু মিলিয়ে মনে হয়, আমার কাছে তোমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। জীবনের অকাল অবসানের জন্য কোন দুঃখ নেই। এখন বুঝতে পারি, এর জন্য কতটুকু দায় এই অপোগ-জনার ছিল। দুঃখ শুধু পাঁচ বছরের ছোট বোনটির জন্য। দুঃখ ছাড়া ওর দাদার কাছ থেকে কিছুই সে পায়নি। তাও পেয়েছে বড় ছোট বয়সে। ঐ শিশুটির কাছে ক্ষমা চাওয়ার কোন মুখ আমার নেই। তবে, আমি মানি এবং ভালমতোই মানি, জীবন এরকমই, জীবন জীবনের মতোই, তার মতো আর কিছু নেই।

লেখক : শ্রমজীবী কথাসাহিত্যিক।

Sunday, May 25, 2014

ব্রিটিশ রাজবিরোধী বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর ১২৮ তম জন্ম বার্ষিকী তে বিনম্র শ্রদ্ধা - সুমি খান

বিয়ের পর স্ত্রী তোশিকোর সঙ্গে  রাসবিহারী বসু

বর্ধমান জেলায় ১৮৮৬ সালের ২৫ মে রাসবিহারী বসুর জন্ম । মাত্র ১৫ বছর বয়স থেকেই স্বাধীনতামন্ত্রে উদীপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। ১৯০৮ সালে তিনি ‌‌'আলীপুর বোমা বিস্ফোরণ' মামলায় অভিযুক্ত হয়ে জেলে ছিলেন। কারাগার থেকে বের হয়ে দেরাদুনে যান। সেখানে বন গবেষণা ইনস্টিটিউটে হেডক্লার্ক হিসাবে কাজ করেন। দেরাদুনে থাকার সময়ে তাঁর সঙ্গে বাংলা, উত্তর প্রদেশ ও পাঞ্জাবের বিপ্লবীদের দেখাসাক্ষাৎ ঘটে। তরুণ বয়সে এই বাঙালি বীর ভারতে বৃটিশ ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জকে (Lord Hardinge, Viceroy of India, ১৯১০-১৯১৬) হত্যা এবং আর একটি সিপাহি বিপ্লব ঘটানোর লক্ষ্যে মহাষড়যন্ত্র করেছিলেন, যা ইতিহাসে দিল্লী-লাহোর ষড়যন্ত্র (Delhi-Lahore Conspiracy, ১৯১২) নামে খ্যাত। দুর্ভাগ্যক্রমে দুটো পরিকল্পনাই বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়। রাসবিহারী বসু জাপানে পালিয়ে আসেন ১৯১৫ সালের ৫ই জুন। সেই সময়ে তাঁকে ধরিয়ে দেবার জন্য তাঁর মাথার উপর তৎকালীন বৃটিশ সরকারের ১২,০০০ রুপী তথা ৫ হাজার বৃটিশ পাউন্ডের মহাপুরস্কার ঘোষনার খড়গ ঝুলছিলো।

১৯১১ সালে ভারতের বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ দিল্লির দরবারে ঘোষণা করেন, ১৯১২ সালে ভারতের সমস্ত প্রভাবশালী ও বিত্তবান ব্যক্তিকে নিয়ে তিনি শোভাযাত্রা করবেন। ঘোষণা অনুযায়ী ১৯১২ সালের শীত কালে একটি শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ সস্ত্রীক হাতির পিঠে বসে এই শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন। শোভাযাত্রাটি কুইন্স গার্ডেন হয়ে চাঁদনীচক দিয়ে দেওয়ান-ই-আমের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো, শোভাযাত্রা  দেখছিলো রাজ্যের সকল মানুষ । 

সেই সময় পূর্ব পরিকল্পনানুযায়ী বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর পাঠানো ছদ্মবেশী এক ষোড়শী  বালিকা লীলাবতী বড়লাটকে মারার জন্য মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংক ভবনে বোমা নিয়ে অপেক্ষা করছিলো। অসংখ্য মহিলা সূরম্য পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংক ভবনের তৃতীয় তলায় শোভাযাত্রা দেখার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। লীলাবতী চাদর গায়ে মহিলাদের মাঝে মিশে গেলেন। শোভাযাত্রা ভবনের প্রায় নিকটে চলে আসে।

ন্যাশনাল ব্যাংক ভবনের সম্মুখের আরেকটি ভবনে  বসে  রাসবিহারী বসু সবকিছু সর্তকতার সাথে তীক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। লীলাবতীকে বোমা মারার ইঙ্গিত প্রদানের অপেক্ষায় ছিলেন । লীলাবতীও রাসবিহারী বসুর ইঙ্গিতের জন্য অপেক্ষা করছিলো । এমন সময় এক মহিলা লীলাবতীকে জিজ্ঞেস করে "তেরি নাম ক্যা বহিনী?" লীলাবতী রাসবিহারীর দিকে দৃষ্টি রেখে বলেন, "মেরী নাম লীলাবতী'। ততক্ষণে শোভাযাত্রাটি ভবনের একেবারে নিকটে চলে আসে। রাসবিহারী মহিলাদের দৃষ্টি শোভাযাত্রা অথবা তাঁর দিকে ফেরানোর জন্য জোরে বলে উঠেন, বড় আজব, সামনে দেখ বাহিনী। মহিলারা অন্যদিকে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি লীলাবতীকে ইঙ্গিত দেন। লীলাবতী তৎক্ষণাৎ বড়লাটকে লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ করেন। প্রচন্ড শব্দে সবাই এদিক-সেদিক দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। আক্রমণ থেকে বড়লাট বেঁচে যান। তাঁর একজন চৌকিদার (রাজদরবারের পেয়াদা) মারা পড়ে। পুলিশ আততায়ীকে ধরার জন্য খোঁজ শুরু করে। রাসবিহারী বসু বসন্তকুমার বিশ্বাসকে লীলাবতীর বেশ পরিবর্তন করিয়ে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে ডেরাডুনে চলে যান। 

এই ঘটনার পর ব্রিটিশ পুলিশ এলোপাথাড়ি গ্রেফতার অভিযান চালায়। পুলিশ যাতে রাসবিহারীকে সন্দেহ না করে সে জন্য তিনি বড়লাটের উপর বোমা হামলার নিন্দা জানিয়ে দেরাদুনে গিয়ে এক প্রতিবাদ সমাবেশ করেন।

 অবিভক্ত ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্নিযুগের সশস্ত্র বিপ্লবীদের একজন অন্যতম বিপ্লবী রাসবিহারী বসু।  ব্রিটিশ শাসনের কবল থেকে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার জন্য তিনি সারা জীবন বিভিন্ন দেশ হতে অস্ত্র, অর্থ সরবরাহ ও বিপ্লবী কর্মী তৈরীর কর্মযজ্ঞে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বিপ্লবী আদর্শ ও কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। 

রাসবিহারী বসুর জন্ম পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের সুবলদহ গ্রামে। বাবা বিনোদবিহারী বসু। তিনি ছিলেন ভারত সরকারের প্রেসের একজন উচ্চ পদস্থ কর্মচারী। তিনি চন্দননগরে বসবাস করতেন আর চাকরি করতেন সিমলায়। এজন্য তাঁকে ছয় মাস কলকাতায় ও ছয় মাস সিমলায় থাকতে হতো। বিনোদবিহারী বসু।ছিলেন মানবদরদী ও সমাজহিতৈষী ব্যক্তি। স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবীদের নানাভাবে তিনি সহযোগিতা করতেন।

রাজবিহারীর পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। তারপর পাঠশালায়। প্রাথমিক পাঠ শেষ করে চন্দননগরের ডুপ্লে কলেজের প্রবেশিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু শৈশবে রাসবিহারী বসুর পড়াশুনার প্রতি তেমন মনোযোগ ছিল না। তবে ইংরেজী-ফার্সী ভাষার প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল। ভারতবর্ষে শুধু ফার্সী ভাষা শিখলে চলবে না, তাই তাঁর বাবা তাঁকে কলিকাতা মটন স্কুলে ভর্তি করান। এই স্কুলে পড়ার সময় তিনি ইংরেজী ভাষা শিক্ষা, খেলাধুলা ও ব্যায়ামের প্রতি আগ্রহী হন। 
বাল্যকাল থেকে তিনি ইংরেজী ভাষায় প্রবন্ধ রচনা করতেন যা তৎকালীন পত্র-পত্রিকায় ছাপা হত। তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করতে পারেননি। কিন্তু সুন্দরভাবে ইংরেজী বলতে ও লিখতে পারতেন। 

স্কুলে পড়াশুনার সময় চন্দননগরের মতিলাল রায়ের সাথে রাসবিহারী বসুর সৌহার্দ গড়ে উঠে। বন্ধু মতিলাল রায়ের মাধ্যমে তিনি অরবিন্দ ঘোষের সাথে পরিচিত হন। শ্রী অরবিন্দের সংস্পর্শে তিনি যোগতত্ত্বের (দেশমাতৃকার তরে জীবন উৎসর্গ করা) সন্ধান পান। তখন থেকেই রাসবিহারী বসু দেশমাতৃকার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার সিদ্বান্ত নেন। ১৯০৮ সালে বড়লাটকে মারার জন্য ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী বোমা নিক্ষেপ করে। এই ঘটনার পর পুলিশ মানিকতলা মুরারীপুকুর উদ্যানে তল্লাশি চালায়। এসময় পুলিশ রাসবিহারীর হাতে লেখা দু'টি চিঠি পায়। ওই বছর রাসবিহারী বসুকে 'আলীপুর বোমা বিস্ফোরণ মামলা'য় গ্রেফতার করে বেশ কিছুদিন কারাগারে রাখা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় তিনি মুক্তি পান। 
সেই সময় শশীভূষণ রায় চৌধুরী নামে এক দেশপ্রেমিক দেরাদুনে শিক্ষকতা করতেন। তিনি রাসবিহারীর বিপদ দেখে নিজের চাকরিটি তাঁকে দিয়ে দেরাদুনে পাঠিয়ে দেন। দেরাদুনে শিক্ষকতা করার সময় রাসবিহারী বসু বাংলা, উত্তর প্রদেশ ও পাঞ্জাবের বিপ্লবীদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তবে ছুটি পেলেই তিনি চন্দনগরে চলে আসতেন। 

এই চন্দননগরেই বাল্য বয়সে তাঁর সশস্ত্র বিপ্লববাদী রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি হয়েছিল। বছর দেড়েক শিক্ষকতা করার পর তিনি দেরাদুনে বন বিভাগের গবেষণাগারে কেরানির চাকরি নেন। ১৯১০ সালে তিনি বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের হেডক্লার্ক হয়েছিলেন। এসময় তিনি গোপনে বিপ্লবীদের সাথে যুক্ত হয়ে কাজ করেন। 

ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্রস্থল ছিল কলকাতা এবং হুগলি জেলার চন্দননগর। চন্দননগরকে গুপ্ত সশস্ত্র কর্মকাণ্ড, আগ্নেয়াস্ত্রের লেনদেন এবং বোমা তৈরির কেন্দ্রস্থল হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন বিপ্লবী রাসবিহারী বসু। বাইরে তাঁর বেশবাস সরকারি চাকরিজীবী ভদ্রলোকের মতো হলেও গোপনে তিনি ব্রিটিশদের নিদ্রাহরণকারী ভয়ানক বিপ্লবী ছিলেন। 

১৯১২ সালে রাসবিহারী বসু দিল্লীতে ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জকে হত্যার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন, যার বর্ণনা শুরুতেই দেয়া হয়েছে। রাসবিহারী বসুর একান্ত অনুগত শিষ্য কিশোর বসন্তকুমার বিশ্বাস লীলাবতীর বেশ ধরে বোমা নিক্ষেপকারীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কয়েক মাস পর বসন্ত কুমার বিশ্বাসসহ ১০ জন পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। ১৯১৫ সালের ১১ মে ব্রিটিশ সরকার এই মামলায় বসন্ত কুমার বিশ্বাসসহ ৩ জনকে অবৈধভাবে গোলাবারুদ বহনের অপরাধে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে।

এই ষড়যন্ত্রের ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার কারণে মূল পরিকল্পক রাসবিহারী বসুর উপর ব্রিটিশ পুলিশ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারিসহ তাঁর মাথার মূল্য ১২ হাজার রুপী পুরস্কার স্বরূপ ঘোষণা করে। অনেক চেষ্টা করেও পুলিশ তাঁকে ধরতে ব্যর্থ হলে পরে পুরস্কারের অর্থের সঙ্গে আরও ৫ হাজার রুপী যোগ করা হয়। কিন্তু বিপ্লবী রাসবিহারীকে কেউ ধরিয়ে দিতে পারেনি। তিনি এই ঘটনার পর বারাণসী (বেনারস) শহরে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে গুপ্ত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু তিনি বাইরে বেরুতে পারতেন না। কেননা তাঁর ছবিসহ পোস্টার ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল সর্বত্র।

দিল্লীতে লর্ড হার্ডিঞ্জ-হত্যা পরিকল্পনা ছিল বিপ্লবীদের প্রথম সশস্ত্র বিপ্লবের পদক্ষেপ কিন্তু সেটা ব্যর্থ হওয়ার পর দ্বিতীয় সুযোগ তাঁরা খুঁজে পেলেন লাহোরে। বিপ্লবী শচীন্দ্রনাথ সান্যালের গুপ্তদলের সঙ্গে যৌথভাবে ১৯১৩ সালে রাসবিহারী বসু পাঞ্জাবের ক্যাপ্টেন গর্ডনকে হত্যা করার পরিকল্পনা নেন। এজন্য চন্দননগর হতে কয়েকটি বোমা আনেন। ১৩ মে লাহোরের লরেন্স পার্কে গর্ডন সাহেবের আসার কথা ছিল। রাসবিহারী বসন্তগুপ্ত নামক এক বালককে এই হত্যায় নিয়েজিত করেন। ওই দিন সন্ধ্যার সময় বসন্তগুপ্ত লরেন্স পার্কে সভামঞ্চস্থলের কাছের রাস্তায় একটি বোমা রেখে আসেন। কিন্তু বোমাটি গর্ডন সাহেব চলে যাওয়ার পর বিস্ফোরিত হওয়ার কারণে তিনি বেঁচে যান। এতে মারা যান রাম নামক এক ব্যক্তি।

লাহোরে এই ঘটনার পর পুলিশের নজরদারী আরো বহুগুণে বেড়ে যায়। বারাণসীও অনিরাপদ হয়ে ওঠে। ওই বছর রাসবিহারী সন্ন্যাসীর বেশে তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে কাশী চলে যান। সেই সময় শচীন্দ্রনাথ সান্যাল কাশীতে ঢাকা 'অনুশীলন সমিতি'র একটি শাখা স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু দিল্লী ও লাহোর ষড়যন্ত্রের পর ব্রিটিশ সরকার 'অনুশীলন সমিতি'কে নিষিদ্ধ করে। যার কারণে শচীন্দ্রনাথ সান্যাল 'অনুশীলন সমিতি'র নাম পরিবর্তন করে 'ছাত্র-যুব সঙ্ঘ' নামকরণ করেন। রাসবিহারী কাশীতে এসে এই 'ছাত্র-যুব সঙ্ঘ'-এর সাথে যুক্ত হন এবং এক পর্যায়ে এই সঙ্ঘের নেতৃত্বের দায়িত্ব নেন। তিনি এই সঙ্ঘের সদস্যদের অস্ত্র চালানো ও বোমা নিক্ষেপ প্রশিক্ষণ দিতেন। তিনি কাশীতে থাকাকালীন দিনে বের হতেন না। 

বিভিন্ন নামে এবং ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়ে রাসবিহারী চলাফেরা করতেন। এসময় তিনি সুরেন্দ্রনাথ দত্ত ও নরেন্দ্র সেন নামে অমৃতবাজার পত্রিকায় কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেন।
বিষ্ণু গনেশ পিঙ্গলু নামে মুম্বাই প্রদেশের দুই মারাঠী দেশপ্রেমিক ও বিনায়ক রাও কাপলের সাথে কাশীতে রাসবিহারীর পরিচয় ঘটে। যারা আমেরিকায় ছিলেন দীর্ঘদিন। 

তাঁরা রাসবিহারী বসুকে জানান, গদার পার্টির চার হাজার সদস্য আমেরিকা থেকে বিদ্রোহের জন্য ভারতে এসেছেন। বিদ্রোহ শুরু হলে আরো ২০ হাজার সদস্য ভারতে আসবে। আমরাও দেশের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। ইতিমধ্যে আমেরিকা থেকে সত্যেন্দ্রনাথ বসু ভারতে এসে তাঁর সাথে যোগাযোগ করেন। 

১৯১৪ সালে যুদ্ধসংক্রান্ত ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে ভারতীয় বংশোদ্ভূত সৈন্যবাহিনীর মধ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহের জাগরণ সৃষ্টি করতে অবিরত কাজ করেন রাসবিহারী বসুসহ অন্যান্য বিপ্লবীরা। গোপনে গোপনে সেনাবাহিনীর এইসব সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন রাসবিহারী বসু। দেশ-বিদেশ থেকে বিপ্লবী গদার পার্টির হাজার হাজার সশস্ত্র সদস্যের অংশগ্রহণও নিশ্চিত হয়। সংগ্রহ করা হয় বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ। ১৯১৫ সালে রাসবিহারী 'ছাত্র-যুব সঙ্ঘে'র একটি সভা করে দলের সভ্যদেরকে 'দেশের জন্য মৃত্যুবরণ করার প্রস্তুতি নিতে বলেন'। তিনি সমগ্র ভারত নিয়ে একটি বিপ্লবের চিন্তা করেন। তিনি শচীন্দ্রণাথ সান্যালের সহযোগিতায় বেনারস, দানাপুর, সিকোল, এলাহাবাদ, জব্বলপুর, মীরাট, দিল্লী, রাওয়ালপিন্ডি, লাহোর, আম্বালা, পাঞ্জাব প্রভৃতি স্থানের সৈন্যদের 'জাতীয় অভ্যুত্থানের' জন্য অনুপ্রাণিত করে তাঁদেরকে প্রস্তুতি নিতে বলেন।

১৯১৫ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। বিদ্রোহ ঘটানোর দিন ধার্য করা হয় ১৯ ফেব্রুয়ারি। প্রধান লক্ষ্যস্থল পাঞ্জাব প্রদেশের লাহোর। সেইসঙ্গে বারাণসী ও জব্বলপুর সেনা ঘাঁটিও প্রস্তুতি নিয়ে অধীর হয়ে অপেক্ষা করে। রাসবিহারী বসু লাহোর শহরের ৪টি গুপ্তস্থানে এই সশস্ত্র বিপ্লবী বাহিনীর প্রধান গুপ্ত দপ্তর স্থাপন করেন। অবাঙালি বিপ্লবী রামশরণ দাসের বাড়িতে বিদ্রোহের আদেশ প্রদানের সময়টুকুর প্রতীক্ষায় ছিলেন তাঁরা। কিন্তু বিদ্রোহের ঠিক ৪ দিন পূর্বে এই ষড়যন্ত্রের খবর ফাঁস করে দেয় রামশরণ দাস। 

ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সৈন্য পাঠিয়ে যেখানে যেখানে সম্ভব ভারতীয় সৈন্যদেরকে অস্ত্রহীন করে এবং ১৯ ফেব্রুয়ারি ৪ প্রধান দপ্তরের একটিতে অকস্মাৎ হামলা চালায়। বিপ্লবীদের একটি দল ১৯ তারিখ সন্ধ্যেবেলায় লাহোরে নিযুক্ত ব্রিটিশ সেনানিবাসে হামলা চালিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এই সশস্ত্র হামলায় দুপক্ষের অনেক লোক মারা যায়। দ্রুত সমস্ত লাহোরব্যাপী এই ঘটনার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। প্রশাসন সমস্ত শক্তি দিয়ে এই সশস্ত্র বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র দমন করতে সক্ষম হয়।

এটাই ঐতিহাসিক 'লাহোর ষড়যন্ত্র' নামে পরিচিত। এই ষড়যন্ত্রের ব্যর্থতায় অনেক বিপ্লবী গ্রেপ্তার এবং মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। এই সময় তিনি কাশী থেকে চলে আসেন কলকাতায়। তারপর চন্দননগর, নবদ্বীপ প্রভৃতি স্থানে খুব সর্তকতার সাথে ঘুরে ঘুরে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিতে তিনি কখনো নারী বেশে, কখনো দারোয়ান, কাজের লোক, সন্ন্যাসি বেশে চলাফেরা করতেন। তিনি এমনভাবে চলতেন যাতে কেউ কোন ধরনের সন্দেহ না করতে পারে। এরপর সশস্ত্র বিপ্লবকে সফল করার উদ্দেশ্যে বেছে নেন জাপান দেশটিকে।

১৯১৫ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে সন্ন্যাসীর বেশে কলকাতাগামী ট্রেনে জাপানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। স্টেশনে স্টেশনে তাঁর ছবিসহ পোস্টার লাগানো থাকায় রাসবিহারী বসু নানা কৌশল অবলম্বন করে ভিন্ন ভিন্ন পথ অবলম্বন করে জাপানে পৌঁছেন। ১৯১৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে ভারতের পত্রপত্রিকায় এশিয়ার প্রথম নোবেল বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাপান ভ্রমণে যাচ্ছেন এরকম সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর সেটা দেখে রাসবিহারী বসু জাপানে থাকার সিদ্ধান্ত নেন এবং রবীন্দ্রনাথের সচিব হিসেবে (মতান্তরে আত্মীয়) পি. এন. ঠাকুর (প্রিয়নাথ ঠাকুর) নাম ধরে জাপানে বসবাস শুরু করেন।

জাপানে এসে তিনি জানতে পারেন চীনা জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী-নেতা ড. সান-ইয়াৎ সেন জাপানে অবস্থান করছেন। তিনি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ড. সান-ইয়াৎ সেন এবং প্যান্-এশিয়ানিজমের অন্যতম প্রধান উদ্গাতা তোয়ামা মিৎসুরুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। গুরু তোয়ামা এই বিপ্লবীকে জাপানে আশ্রয় এবং সর্বপ্রকার সহযোগিতার আশ্বাস দেন। তোয়ামা এসময় গুপ্ত সমিতি 'কোকুরিউকাই' এর প্রধান পরিচালক কুজো য়োশিহিসা ও প্রধান কর্মকর্তা উচিদাকে রিয়োহেইকে-এর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তাঁদের ওপর এই বিপ্লবীর রক্ষণাবেক্ষণের ভার অর্পণ করেন। সেদিন থেকে জাপান তথা বিদেশে বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর নতুন রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয়।

জাপানে রাসবিহারী বসু তোয়ামা মিৎসুরুর তত্ত্বাবধানে একটি বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের মালিকের বড় কন্যা সোমা তোশিকোকে বিয়ে করেন। তাঁদের পরিবারে এক ছেলে ও এক মেয়ে সন্তানের জন্ম হয়। তাঁর স্ত্রী তোশিকো বসু দীর্ঘদিন রোগে ভোগার পর ১৯২৫ সালের ৪ঠা মার্চ মাত্র ২৬ বছর বয়সে মারা যান। ওই বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের দেখভাল করা আর সেইসঙ্গে অক্লান্তভাবে স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করেন তিনি।

ভারতীয়দেরকে সংঘবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে ১৯২১ সালে রাসবিহারী বসু জাপানে সর্বপ্রথম 'ভারতীয় স্বাধীনতা সংঘ' প্রতিষ্ঠা করেন এবং এই সংঘের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

১৯২৬ সালের ১ আগস্ট রাজনৈতিক দল 'সেইয়ুকাই' এর প্রধান সাংসদ ইমাজাতো জুনতারো এর উদ্যোগে নাগাসাকি শহরে প্রথম এশিয়া জাতিগোষ্ঠী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে ভারতীয় প্রতিনিধি হিসেবে রাসবিহারী বসু উপস্থিত ছিলেন। এই সম্মেলন জাপানে এশিয়ার শীর্ষনেতাদের প্রথম সম্মেলন হিসেবে পরিচিত।

১৯৩২ সালে ইংরেজ-বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলন বৃটিশদের পক্ষে অসহনীয় হয়ে উঠে। কাজেই তারা সুযোগ খুঁজছিল কিভাবে পলাতক বিপ্লবীদেরকে গ্রেপ্তার করা যায়। রাসবিহারী বসু জাপানে বিয়ে করে জাপানি নাগরিকত্ব গ্রহণ করার ফলে সে সুযোগ নস্যাৎ হয়।

১৯৪১ সালে বহু বছরের পরাধীন ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারতবর্ষের মুক্তির সুযোগ সৃষ্টি হয়। রাসবিহারী বসু বিশ্বস্ত এম. এন. রায়কে মাঞ্চুরিয়াতে দূত হিসেবে পাঠিয়ে ভারতীয়দেরকে সংগঠিত করার দায়িত্ব দেন। ওই বছর রাসবিহারী বসুর উদ্যোগে টোকিও, য়োকোহামা, ওসাকা, কোবে, নাগাসাকি প্রভৃতি জায়গায় বসবাসরত ৭০ জনেরও বেশি ভারতীয় জড়ো হয়ে 'ভারতীয় স্বাধীনতা সংঘ'র মহাসভা আহবান করেন এবং লীগের পতাকা উত্তোলন করেন।

১৯৪২ সালের জানুয়ারি মাসের ১৫ তারিখে রাসবিহারী বসুর উদ্যোগে টোকিওতে 'ভারতীয় স্বাধীনতা সংঘ'র আয়োজনে একটি মহাসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার শিরোনাম ছিল: 'আমেরিকা-বৃটেন ধ্বংস করো।' সম্মেলনের পর রাসবিহারী বসু রাজকীয় সেনা বাহিনীর দপ্তরে উপস্থিত হয়ে কর্তৃপক্ষকে ভারতীয় স্বাধীনতা অর্জনের উপায় বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য অনুরোধ জানান।

১৯৪৩ সালের ৪-৭ জুলাই সিঙ্গাপুরস্থ মহাএশিয়া মিলনায়তনে 'ভারতীয় স্বাধীনতা সংঘ'র প্রধান নেতৃবৃন্দের মহাসভা অনুষ্ঠিত হয়। শারীরিক অসুস্থতা এবং বার্ধক্যজনিত কারণে এই মহাসভায় রাসবিহারী বসু 'ভারতীয় স্বাধীনতা সংঘ'র নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে সুভাষচন্দ্র বসুকে স্থলাভিষিক্ত করেন।

এ সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী 'আজাদ হিন্দ ফৌজ' গঠিত হয়। বস্তুত 'আজাদ হিন্দ ফৌজ' গঠনে রাসবিহারি বসুর অবদান অপরিসীম। পরে তিনি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে মিলিত হন। ১৯৪৩ সালের অক্টোবর মাসের ২৪ তারিখে সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বাধীনে 'স্বাধীন ভারত সরকার' গঠিত হলে সেই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হন রাসবিহারি বসু।

১৯৪৪ সালের ২১ মার্চ 'আজাদ হিন্দ ফৌজ' ভারত ভূমির মনিপুরে প্রবেশ করে। এই ফৌজের কার্যাবলী খুব দ্রুত ভারতব্যাপি ছড়িয়ে পড়ে। তখন রাসবিহারি বসু খুবই আনন্দিত হন। কিন্তু যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত অসুস্থ রাসবিহারী বসু ১৯৪৫ সালের ২১ জানুয়ারি টোকিওর নিজগৃহে মারা যান।

১৯৪৫ সালে ১৫ আগস্ট দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হয়েছে কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন তখনও চূড়ান্ত পর্যায়ে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু হিন্দ ফৌজকে ভেঙ্গে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যান । কেউ জানে না কোথায় আছেন তিনি। তন্ন তন্ন করে খুঁজছে তাঁকে বৃটিশ সরকার (কিছুদিন পর জানা যায় নেতাজি বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান)। এ সময় কর্নেল ভোঁসলে ঘোষণা করেন, নেতাজি না থাকলেও, জাপানিরা হেরে গেলেও আজাদ হিন্দ ফৌজ শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়াই করে যাবে। কয়েক হাজার ভারতীয় সেনা নিহত হওয়ার পরও কোহিমা পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিল আজাদ হিন্দ বাহিনীর কোনো কোনো দল। বৃটিশদের আর কোনো শক্তি ছিল না ভারতীয়দেরকে দাবিয়ে রাখার। শেষ পর্যন্ত ১৯৪৭ সালে বৃটিশ শাসকগোষ্ঠী দ্বিজাতি তত্বের ভিত্তিতে  পাক-ভারত ভাগ করে  সাম্প্রদায়িকতার বীজ বুনে লেজ গুটায়। অর্জিত হয় বহুকাঙ্খিত ভারতের স্বাধীনতা, যে স্বাধীনতার জন্য রাসবিহারী বসুসহ অসংখ্য বিপ্লবী জীবন বিপন্ন করে লড়াই- সংগ্রাম করেছেন।

কিন্তু বহুকাঙ্খিত স্বাধীন ভারতকে দেখার সৌভাগ্য না হলেও রাসবিহারী বসুর আজন্মলালিত স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে একথা ভেবেই সমগ্র ভারতবর্ষের জনগণ শান্তি লাভ করে।

তথ্য ও ছবিসূত্র :
১। বাংলার পাচ স্মরণীয় বিপ্লবী: সম্পাদনা-দেবপ্রসাদ জানা, দীপ প্রকাশন-কলকাতা। প্রকাশকাল ৫ জানুয়ারী ২০০৮ সাল।
২। স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবীদের ভূমিকা: সুধাংশু দাশগুপ্ত, ন্যাশনাল বুকস এজেন্সি কলকাতা। প্রকাশকাল ২০০৯ সাল।
৩। বাংলার মুক্তি সন্ধানী: সব্যসাচী চট্টপাধ্যায়/ রাখী চট্টপাধ্যায়, কলকাতা। প্রকাশকাল মে ২০০৫ সাল।
৪। অগ্নিবিপ্লবী হেরাম্বলাল গুপ্ত এবং ভারতের স্বাধীনতা: প্রবীর বিকাশ সরকার, উইকলি বেঙ্গলী'তে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়, প্রকাশকাল ২০০৯-২০১০ সাল।

Saturday, May 24, 2014

১১৫ তম জন্মদিনে যুগোত্তীর্ণ কালোত্তীর্ণ বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম প্রণাম তোমায়


 ১১৫ বছর আগে এই দিনে পরাধীন বাঙালির মুক্তির বাণী নিয়ে ধূমকেতুর মতো অবিভক্ত বাংলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন এ কবি। তাই বাঙালির নিজেকে নতুন করে সৃষ্টি করার দিনও এটি। দ্রোহ, প্রেম, সাম্য, মানবতা ও শোষিত মানুষের মুক্তির বার্তা নিয়ে আসা কবির ১১৫ তম জন্মবার্ষিকীর দিনটি এবং কবির অমর সৃষ্টি ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ৯০ বছর পূর্তিও জাতি গভীর শ্রদ্ধা ও বিনম্র ভালোবাসায় আজ উদযাপন করবে। উল্লেখ্য, বাধার দুর্লংঘ পর্বত পাড়ি দেয়া এ কবির জন্ম ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ বর্ধমান জেলার আসানসোলের জামুরিয়া থানার চুরুলিয়া গ্রামে। তার ডাক নাম ‘দুঃখু মিয়া’। পিতার নাম কাজী ফকির আহমেদ ও মাতা জাহেদা খাতুন। নজরুল বিশেষজ্ঞদের মতে, নজরুলের কাব্যসাধনা শুরু হয়েছিল একটি ক্রান্তিকালে। তার উদ্দেশ্য ছিল অত্যাচার, অবমাননার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আর প্রতিবাদ এবং মানবিক জীবনের গভীরে মঙ্গলদায়ি শক্তিরূপে বিরাজমান যে প্রেম ও সৌন্দর্যের চেতনা রয়েছে তার উদ্বোধন করা। আর তা করতে গিয়েই এক সময় সকলকে চমকে দিয়ে তিনি বাংলার সাহিত্যাকাশে আত্মপ্রকাশ।

সবার উপরে মানুষ সত্য, মানুষের  প্রাণের ভেতরের যে সত্য , যে ধর্ম, তার উপর কোন ধর্ম নেই- এ কঠিন সত্যটি নজরুল বারবার আমাদের শিখিয়ে গেছেন । কবি তাঁর প্রথম সন্তানের নাম রাখেন "কৃষ্ণমোহাম্মদ"--ধর্মের উপরে যে মানুষ সত্য, ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে সবার আগে আমরা যে মানুষ , সেটাই বারবার বলে গেছেন নজরুল।

অগ্রণী বাঙালি কবি, বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় বাঙালি কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, সংগীতস্রষ্টা, দার্শনিক, যিনি বাংলা কাব্যে অগ্রগামী ভূমিকার সঙ্গে সঙ্গে প্রগতিশীল প্রণোদনার জন্য সর্বাধিক পরিচিত কাজী নজরুল ইসলাম (মে ২৪১৮৯৯ – আগস্ট ২৯১৯৭৬)(জ্যৈষ্ঠ ১১, ১৩০৬ - ভাদ্র ১২, ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ)। আজ তাঁর ১১৫ তম জন্মদিন।  তিনি বাংলা ভাষার অন্যতম সাহিত্যিক, দেশপ্রেমী এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ – দুই বাংলাতেই তাঁর কবিতা ওগান সমানভাবে সমাদৃত। তাঁর ' বিদ্রোহী' কবিতা তাঁকে বিদ্রোহী কবি নামে আখ্যা দেয়। তাঁর কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার এবং সামাজিক অনাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ। 


বঙ্গবন্ধু ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ করে কবিকে নিয়ে আসেন ঢাকায় ।কবির জন্যে বাড়ি বরাদ্দ করেন- পাশাপাশি পিজি হাসপাতালে কবির চিকিৎসা চলে।স্বাধীন দেশে কবির গানকে  রণসংগীত করলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ।   ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাশে অন্তিম শয়নে কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

নজরুল তাঁর শেষ ভাষণে বলেছেন, "যদি আর বাঁশি না বাজে... আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন, ভুলে যাবেন..."ভুলে যেতে বলাটাই কবিকে মনে করিয়ে দেয় বারবার। আমরা ভুলতে পারিনা সাম্যের গান । আমরা ভুলতে পারিনা বৈষম্য বিরোধী গান । আমরা ভুলতে পারিনা কী দারুণ সাহসে কবি বলে গেছেন -- "তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান,সকল শাস্ত্র খুঁজে পাবে সখা, খুলে দেখ নিজ প্রাণ !" 

“যদি আর না ফিরি” শিরোনামে কবির ভাষণটি  এখানে উল্লেখ করছি। কবি নির্বাক হওয়ার আগে এটিই সম্ভবত তাঁর শেষ বক্তব্য, যেখানে তাঁর সকল হতাশা, বেদনা আর কষ্টের কথা অকপটে উঠে এসেছে। এবং যা আজো সত্য!

বন্ধুগন,

আপনারা যে সওগাত আজ হাতে তুলে দিলেন তা আমি মাথায় তুলে নিলুম। আমার সকল তনুমন প্রান আজ বীণার মতো বেজে উঠেছে, তাতে শুধু একটি মাত্র সুর ধ্বনিত হয়ে উঠেছে-আমি ধন্য হলুম, আমি ধন্য হলুম। আমায় অভিনন্দিত আপনারা সেইদিনই করেছেন, যেদিন আমার লেখা আপনাদের ভালো লেগেছে। বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের যুগে আমি জন্মগ্রহন করেছি। এরই অভিযান সেনাদলের তুর্য বাদকের আমি একজন,এই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়।

আমি এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলেই আমি এই দেশেরই এই সমাজেরই নই,আমি সকল মানুষের। কবি চায় না দান;কবি চায় অঞ্জলী ,কবি চায় প্রীতি। সুন্দরের ধ্যান, তার স্তব গানই আমার ধর্ম ।
তবু বলছি আমি শুধু সুন্দরের হাতে বীণা পায়ে পদ্মফুলই দেখিনি,তার চোখে চোখ ভরা জলও দেখেছি। শ্বশানের পথে, গোরস্থানের পথে  তাকে ক্ষুধা-দীর্ন মুর্তিতে ব্যথিত পায়ে চলে যেতে দেখেছি! যুদ্ধভূমিতে তাকে দেখেছি,কারাগারের অন্ধকূপে তাকে দেখেছি,ফাঁসির মঞ্চে তাকে দেখেছি।

আমাকে বিদ্রোহী বলে খামাখা লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। এই নিরীহ জাতটাকে আঁচড়ে-কামড়ে তেড়ে নিয়ে বেড়াবার ইচ্ছা আমার কোনদিনই নেই। আমি বিদ্রোহ করেছি ,বিদ্রোহের গান গেয়েছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে -অত্যাচারের বিরুদ্ধে। যা মিথ্যা, কলুষিত, পুরাতন,পঁচা, সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে । ধর্মের নামে  ভন্ডামি ও  কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। 

কেউ বলেন, আমার বাণী যবন, কেউ বলেন , কাফের! আমি বলি,ও দু'টোর কোনটিই নয় । আমি কেবলমাত্র  হিন্দু -মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি। গালাগালি কে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি ।সে হাতে হাত মেলানো যদি হাতাহাতির চেয়ে অশোভন হয়ে থাকে, তাহলে  ওরা আপনিই আলাদা হয়ে যাবে। আমার গাঁটছড়ার বাঁধন কাটতে তাদের কোন বেগ পেতে হবে না। কেননা , একজনের হাতে আছে লাঠি, আরেকজনের আস্তিনে  আছে ছুরি। 

হিন্দু মুসলমানে দিনরাত হানাহানি , জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ- বিগ্রহ।জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ যুদ্ধ বিগ্রহ, মানুষের জীবনের একদিকে কঠোর দারিদ্র-ঋন-অভাব, অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষানস্তুপের মত জমা হয়ে আছে। 

এই অসাম্য, ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্যে, সংগীতে কর্মজীবনে অভেদ ও  সুন্দর- সাম্যকে প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। আমি যশ চাইনা ,খ্যাতি চাইনা, প্রতিষ্ঠা চাইনা ,নেতৃত্ব চাইনা। জীবন আমার যত দুঃখময়ই হোক আনন্দের গান,বেদনার গান গেয়ে যাব আমি। দিয়ে যাবো নিজেকে নিঃশেষ করে সকলের মাঝে বিলীন। সকলের বাঁচার মাঝে থাকবো আমি বেঁচে। এই আমার ব্রত- এই আমার সাধনা- এই আমার তপস্যা।

রবীন্দ্রনাথ আমায় প্রায়ই বলতেন, “দ্যাখ্  উন্মাদ , তোর জীবনে শেলীর মতো,কীট্‌সের মতো খুব বড়ো একটা ট্র্যাজেডি আছে-তুই প্রস্তুত হ",জীবনে সেই ট্র্যাজেডি দেখবার জন্য  আমি কতোদিন  অকারণে  অন্যের জীবনকে অশ্রুর বরষায় আচ্ছন্ন করে দিয়েছি। কিন্তু আমারই  জীবন রয়ে গেল বিশুষ্ক মরুভূমির মত তপ্ত। মেঘের উর্ধে শূন্যের মতো। কেবল হাসি, কেবল গান, কেবল বিদ্রোহ।

আমার বেশ মনে পড়ছে, একদিন আমার জীবনের মহাঅনুভূতির কথা- আমার ছেলে মারা গেছে, আমার মন যখন তীব্র পুত্রশোকে যখন ভেঙ্গে পড়েছে ঠিক সেই দিনই ,সেই সময়ে আমার বাড়ীতে হাস্নাহেনা ফুটেছে। আমি প্রানভরে সেই হাস্নাহেনার গন্ধ উপভোগ করেছিলাম। আমার কাব্য আমার গান আমার জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছে। 

যদি কোনদিন আপনাদের প্রেমের প্রবল টানে আমাকে আমার একাকীত্বের পরম শুন্য থেকে অসময়ে নামতে হয় তাহলে সেদিন আমায় মনে করবেন না আমি সেই নজরুল; সেই নজরুল অনেকদিন আগে মৃত্যুর খিড়কি দুয়ার দিয়ে পালিয়ে গেছে। মনে করবেন পূর্ণত্বের তৃষ্ঞা নিয়ে যে একটি অশান্ত তরুন এই ধরায় এসেছিল, অপূর্ণতার বেদনায় তারই বিগত আত্না যেন স্বপ্নে আমাদের মাঝে কেঁদে গেল।
যদি আর বাঁশি না বাজে- আমি কবি বলে বলছিনে,  আমি আপনাদের ভালবাসা পেয়েছিলাম সেই অধিকারে বলছি-আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন ,আমায় ভুলে যাবেন। 

বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি আমি নেতা হতে আসিনি,আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম। সেই প্রেম পেলামনা বলে আমি এই প্রেমহীন নীরব পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম। 
যেদিন আমি চলে যাব সেদিন হয়তোবা বড় বড় সভা হবে। কত প্রশংসা কত কবিতা হয়ত বেরুবে আমার নামে-দেশপ্রেমিক-ত্যাগী, বীর-বিদ্রোহী - বিশেষনের পর বিশেষন, টেবিল ভেঙ্গে ফেলবে থাপ্পর মেরে,বক্তার পর বক্তা!

 এই অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রাদ্ধ দিনে-বন্ধু তুমি যেন যেওনা। যদি পারো, চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোন একটি কথা স্মরণ করো, তোমার আঙ্গিনায় বা আশেপাশে যদি একটা ঝরা পায়ে পেষা ফুল পাও , সেটিকে বুকে চেপে বলো, বন্ধু আমি তোমায় পেয়েছি—-“তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিবনা,কোলাহল করি সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙ্গিবনা-নিশ্চুল-নিশ্চুপ আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধ বিধুর ধূপ!"

 সন্তানের মৃত্যু, সমাজের ধর্মান্ধ এবং ক্ষমতাসীন দের অত্যাচার এবং নিপীড়নে প্রচন্ড আঘাত  এবং বেদনা সয়ে র্নির্বাক হয়ে গিয়েছিলেন কবি, তবু তিনি বেঁচে আছেন, চিরকাল থাকবেন বাংলার মানুষের মনে,হৃদয়ে।তিনি তাই তিনি  অমর।

কবির স্মৃতিকে তাঁর সাহিত্যকে আমাদের নিজেদের স্বার্থে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, সে সবের চর্চা করতে হবে।পাকিস্তান সরকারের বাঙ্গালী সংস্কৃতি বিনাশী হীন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নজরুল কে বিকৃত ভাবে উপস্থাপনের অপচেষ্টা  করা হয়েছিলো। সেই কালো ইতিহাস এই প্রজন্মের কাছে তুলে ধরে  এই প্রজন্মের কাছে  স্বমহিমায় স্বরূপে উপস্থাপন করতে হবে কবি কে ।উপস্থাপন করতে হবে এক ধর্মনিরপেক্ষ,অসাম্প্রদায়িক, উদার গণতান্ত্রিক,সাম্যবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ বিশ্ব নাগরিক,মানবতাবাদী বাঙালী কবিকে।

  একথা বারবার উঠে এসেছে , বিংশ শতাব্দীর বাংলা মননে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক হিসেবে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে নজরুল সর্বদাই ছিলেন সোচ্চার। তাঁর কবিতা ও গানে এই মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে। অগ্নিবীণা হাতে তাঁর প্রবেশ, ধূমকেতুর মতো তাঁর প্রকাশ। যেমন লেখাতে বিদ্রোহী, তেমনই জীবনে –- এ কারণে  "বিদ্রোহী কবি", তাঁর জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকী বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে উভয় বাংলাতে প্রতি বৎসর উদযাপিত হয়ে থাকে। পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরায় নজরুল একাডেমী  গবেষণা কাজের জন্যে বিশেষ ভাবে সমৃদ্ধ। 


বাংলা কাব্যে ভক্তিগীতি রচনা  করে  তিনি এক নতুন ধারার জন্ম দেন। ইসলামী সঙ্গীত তথা গজল, এর পাশাপাশি তিনি অনেক উৎকৃষ্ট শ্যামাসংগীত ও হিন্দু ভক্তিগীতিও রচনা করেন। নজরুল প্রায় ৩০০০ গান রচনা এবং অধিকাংশে সুরারোপ করেছেন যেগুলো এখন নজরুল সঙ্গীত বা "নজরুল গীতি" নামে পরিচিত এবং বিশেষ জনপ্রিয়। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে ‘নোবেল পুরস্কার’ পান তখন কাজী নজরুল ইসলামের বয়স মাত্র ১৪ বছর। অনুজ নজরুলের ‘ধূমকেতু’ ১৯২২ সালের ১১ আগস্ট (১৩২৯ বঙ্গাব্দের ২৪ শ্রাবণ) প্রকাশিত হলে ১৯২২-এর ১১ আগস্ট (১৩২৯ বঙ্গাব্দের ২৪ শ্রাবণ) রবীন্দ্রনাথ এই পত্রিকার আশীর্বাণী লিখে দেন। রবীন্দ্রনাথের হস্তলিপিতে প্রথম ৬টি সংখ্যায় প্রথম পৃষ্ঠায় ৭ম সংখ্যা থেকে ৩য় পৃষ্ঠায় সম্পাদকীয় স্তম্ভের ওপর তা ছাপা হয়- “আয় চলে আয়, রে, ধূমকেতু,/র্আধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,/ দুর্দিনের এই দুর্গশিরে/উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।/অলক্ষণের তিলক রেখা/রাতের ভালে হোক না লেখা,/জাগিয়ে দে'রে চমক মেরে/আছে যারা অর্ধচেতন!” রবি ঠাকুর তাঁর রচিত ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যটি কাজী নজরুলকে উৎসর্গ করেছিলেন। সেটি ছিল রবীন্দ্র পরিবারের বাইরে প্রথম কাউকে একটি বই উৎসর্গ করার ঘটনা। 

 সমাজে ধর্মের নামে মানবতার অবমাননাকারী ধর্মবেসাতি করে যারা, তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন নজরুল।  তাঁর 'আমার কৈফিয়ত কবিতায় লিখেছেন," মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘ মোল্‌-লা’রা ক’ন হাত নেড়ে’,
‘দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও বজাত মেরে!/ফতোয়া দিলাম- কাফের কাজী ও,
যদিও শহীদ হইতে রাজী ও!/‘আমপারা’-পড়া হাম-বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে!
হিন্দুরা ভাবে,‘ পার্শী-শব্দে কবিতা লেখে, ও পা’ত-নেড়ে!’"

ব্রিটিশ সরকারের পীড়নের কথা তুলে ধরেছেন এই কবিতায়-"বন্ধু! তোমরা দিলে না ক’ দাম,
রাজ-সরকার রেখেছেন মান!/যাহা কিছু লিখি অমূল্য ব’লে অ-মূল্যে নেন! আর কিছু/শুনেছ কি, হুঁ হুঁ, ফিরিছে রাজার প্রহরী সদাই কার পিছু?" 

লিখেছেন ক্ষুধাকাতর শিশুর কথাও ,"  ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন,/বেলা ব’য়ে যায়, খায়নি ক’ বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন।/কেঁদে ছুটে আসি পাগলের প্রায়,
স্বরাজের নেশা কোথা ছুটে যায়!/কেঁদে বলি, ওগো ভগবান তুমি আজিও আছে কি? কালি ও চুন
কেন ওঠে না ক’ তাহাদের গালে, যারা খায় এই শিশুর খুন?" 

কষ্টের কথা লিখতে গিয়ে লিখেছেন, "বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে!/দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে।
রক্ত ঝরাতে পারি না ত একা,/তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা,/বড় কথা বড় ভাব আসে না ক’ মাথায়, বন্ধু, বড় দুখে!/অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে!/পরোয়া করি না, বাঁচি বা না-বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে,/মাথায় উপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে।/প্রার্থনা ক’রো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,/যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ!"  এভাবেই নিজের রক্ত দিয়ে হলেও অত্যাচারীর সর্বনাশ চেয়েছেন নজরুল।

অসাম্প্রদায়িক জাতি , সমাজ প্রত্যাশায় তাঁর 'কান্ডারী হুঁশিয়ার কবিতায় লিখেছেন,"অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরন/কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পণ।/হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?/কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা'র।...কান্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর,/বাঙালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!/ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর!/উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পূনর্বার/ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান,/আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন্ বলিদান/আজি পরীক্ষা, জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ?/দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুশিয়ার!"


“আমি চিরতরে দূরে চলে যাব,তবু আমারে দেব না ভুলিতে” _ এই আত্মপ্রত্যয় ছিল যার মরণোত্তর অস্তিত্ব নিয়ে,তিনি চিরবিদ্রোহী,চিরবিরহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

প্রেমে ও বিদ্রোহে, কোমলে-কঠিনে গড়া এক আশ্চর্য প্রতিভার নাম কাজী নজরুল ইসলাম।আজও দ্বিধাবিভক্ত সমাজে, শোষক আর শোষিতে বিভক্ত পৃথিবীতে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা, গান, প্রবন্ধ, গল্প-উপন্যাসসহ বিচিত্র রচনা মানবমুক্তির প্রেরণা জোগায়। তাই যথার্থ অহঙ্কারেই তিনি বলতে পেরেছিলেন ‘আমারে দেব না ভুলিতে’।

 আর তাই ,জাতীয় কবিকে কখনও ভোলা সম্ভব নয়। বাংলা কাব্যে আর গানে যে নতুন জোয়ার তিনি এনেছেন, শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্য যে অবিস্মরণীয় প্রেরণাসঞ্চারী দ্রোহের বাণীতে উচ্চকিত করে তুলেছেন অবিভক্ত বাংলার কোটি কোটি মানুষের চিত্ত, সে বাণীর শাশ্বত দর্শন চিরপ্রাসঙ্গিক। ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসক-শোষকদের ভিত্তিমূল কাঁপিয়ে দিয়েছিল তার আগুন ঝরানো কবিতা আর শেকল ভাঙার গান। ‘বিদ্রোহী’ ‘অগি্নবীণা’, ‘বিষের বাঁশী’, ‘ফণীমনসা’, ‘ভাঙার গান’, ‘সাম্যবাদী’, ‘প্রলয় শিখা’র মতো কবিতার ঝঙ্কারে শুধু শোষক-শাসকের ভিত্তিমূলই কাঁপেনি, কেঁপে উঠেছিল সমগ্র বাংলাও।কারণ এমন কবিতা প্রথম শুনল বাঙালি।

স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ স্বাগত জানালেন এই নতুন কবিকণ্ঠকে। ‘বসন্ত’ নাটক উৎসর্গ করলেন কারাবন্দি নজরুলকে।’বিদ্রোহী’ কবিতায় এমন আশ্চর্য এক নতুন সুর আর নতুন ছন্দের দোলা, হিন্দু-মুসলিম ঐতিহ্য আর পুরাণের এমন অপূর্ব প্রয়োগ, প্রেম আর বিদ্রোহের এমন আশ্চর্য সমন্বয়, এর তুলনা অতীতে ছিল না, পরবর্তীকালেও দেখা যায়নি।এই একটি মাত্র কবিতার মধ্যে নিহিত রয়েছে সমগ্র নজরুলের জীবনদর্শন আর অসাম্প্রদায়িক মানবিক মূল্যবোধ।’বিদ্রোহী’ কবিতার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে অসাম্প্রদায়িক মানবতার বাণী, মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের অহঙ্কার আর চিরস্বাধীনতার স্বপ্ন।

তাঁর আবির্ভাব ঝড়ের মতোই। তিনি নিজেই লিখেছেন আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড়।তবে তাঁর লেখা অমর কবিতা ‘বিদ্রোহী’র জন্যই তিনি বিদ্রোহী কবিরূপে পরিচিত হয়ে ওঠেন।কবিতাটি আলোড়ন তোলে বাংলার সাহিত্যের ধারায়।তখন উপমহাদেশ ভাগ হয়নি। চলছে দোর্দ- প্রতাপে ইংরেজ ঔপনিবেশিকদের শাসন।যিনি দাঁড়িয়েছেন সব ধরনের অন্যায়-অত্যাচারের বিরম্নদ্ধে,অবিচারের বিরম্নদ্ধে,মানুষের পূর্ণ মুক্তির পৰে।তাঁর সাহিত্য সাধনার মাধ্যমে তিনি দেশের মানুষের অনত্মরে স্থায়ীভাবে আসন লাভ করেন। আজ এমন একটা দিন নাই যেদিন তাঁকে কোন না কোনভাবে স্মরণ করা হয় না।তিনি সত্যিকার অর্থেই প্রাতঃস্মরণীয়। কবি নজরম্নল আমাদের গর্ব। তাঁকে আমরা এখন প্রতিদিন স্মরণ করি।

পাকিস্তানী স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও সংগ্রামের দীর্ঘ সময়কালে তাঁর কবিতা উচ্চারণ হয়েছে, তাঁর গান গেয়ে উদ্দীপনা লাভ করেছে মানুয।তাঁর ‘শিকল পরা ছল, মোদের এ শিকল পরা ছল’, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট’, ‘দুর্গম গিরি কানত্মার মরম্ন দুসত্মর পারাবার/লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার’ গানগুলো মানুষের মনে হৃদয়ে শক্তি যুগিয়েছে,মনে জয়ের প্রত্যাশা জাগিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের তাঁর এসব এবং অন্যান্য গান মুক্তিযোদ্ধাদের মনে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুখোমুখি  যুদ্ধে প্রেরণা ও সাহস যুগিয়েছে।

 জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর  শেখ মুজিবর রহমানের কাছে কবি নজরুলের বিশেষত্ব ছিল কবির বিদ্রোহী চেতনা। কলকাতায় পড়ার সময় হোস্টেল প্রতিবেশী কবি গোলাম কুদ্দুসের কাছে  বঙ্গবন্ধু জেনেছেন কবি সম্পর্কে। তাঁর বন্ধু পল্লীকবি  জসীমুদ্দিনও  নজরুল সম্পর্কে অনেক কিছু জানিয়েছেন। নজরুলের অপর শুভানুধ্যায়ী কবি জুলফিকার হায়দারের সাথে বঙ্গবন্ধুর গভীর সখ্য ছিল । যাকে সম্পাদক করে বঙ্গবন্ধূ ১৯৬৮-১৯৭০ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত  ট্যাবলয়েড আকারে সাপ্তাহিক “নতুন দিন” বের করতেন (লালরঙের লোগো)।
পাকিস্তান জাতীয় গণপরিষদে ৫০দশকে বঙ্গবন্ধু প্রথম দাবি তোলেন কলকাতায় বাসরত কবি নজরুলকে মাসিক ভাতা প্রদানের। তার দাবি গ্রাহ্য হলেও টাকা পূর্বপাকি সরকারকে প্রদান করতে হয়। ১৯৬৫’র যুদ্ধকালে ভাতা পাটানো বন্ধ ছিল। 

বঙ্গবন্ধু ১৯৬৮,৬৯ ও ৭০ সালে  পার্টির লোক পাঠিয়ে কবির জন্য কাপড়চোপড় -খাবার , টাকা পাঠাতেন। মুস্তফা সারওয়ার দুবার গেছেন। মুজিবনগর সরকার মাসিক ২৫০টাকা দিত। সরকারী প্রতিনিধি পাঠিয়ে কবির খোঁজ নিতেন।স্বাধীনতার পর ১০০০টাকা ভাতা দেওয়া হয়। 

  বঙ্গবন্ধু ইন্দিরা গান্ধীকে  বিশেষ  অনুরোধ করে কবি নজরুলকে নিয়ে আসেন ঢাকায় । তাঁর জন্যে বাড়ি বরাদ্দ করেন-পিজি হাসপাতালে চিকিৎসা চলে। অসুস্থ  নির্বাক কবিকে অতি উৎসাহি বাঙ্গালী নানা অনুষ্ঠানে নিয়ে যেন শাস্তি দিতেন। তাঁকে দেখার জন্য ঢল পড়ে যেতো,কেউ  কেউ গান শোনাতেন।  বঙ্গবন্ধুর পাঠের তালিকায় নজরুল ছিলেন। জেলখানায় বঙ্গবন্ধু  কবিকে পেয়েছেন নিবিড় করে।

 ব্রিটিশ শাসনামলেই অসুস্থ হয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন কবি । বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে কবিকে কলকাতা থেকে  সপরিবারে স্বাধীন বাংলাদেশে আনা হয়।এসময়ে তাকে বাংলাদেশের জাতীয়তা প্রদান করা হয়।এর কিছুদিন পর তাঁকে 'জাতীয় কবি' ঘোষণা করা হয়।তখন থেকেই তাঁর ঢাকায়  বসবাস এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।আজ  আমাদের  প্রাণপ্রিয় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৫ তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি জানাই প্রাণের প্রণতি, গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।