Tuesday, May 6, 2014

প্রাণের পরে চলে গেলো ফারিহা- বসন্তের বাতাসটুকুর মতো -- সুমি খান




 রবীন্দ্রনাথ  অমৃতের সন্তান ছিলেন- মৃত্যুশোককে  সহজে মেনে নেবার অসীম ক্ষমতা ছিল তার!  কৈশোর থেকে তার মাতৃমৃত্যুর মধ্যে দিয়ে শুরু হয়  কবিগুরুর মৃত্যুশোক! 

এমন মানসিক জোর আজ  বড়ো প্রয়োজন  সদ্য সন্তান হারা  সৈয়দ আবু শাকের পাপ্পু এবং ফারাহ দিবার।  


 আকাশের এক  ধ্রুবতারার নাম ফারিহা জাহান !মাত্র সতেরো বছর বয়সে স্বজন পরিবার বন্ধুদের  শোকের সাগরে ভাসিয়ে আকাশে হারিয়ে গেলো গত ৩ মে, ২০১৪ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়!

ফারিহার মা দিবা স্বাভাবিক ভাবেই ভেঙ্গে পড়েছে খুব। প্রথম সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে দশ মাস দশ দিন যে কষ্ট পায় একজন মা, ১৭ বছরের হতেই মেয়েটা চলে গেলে কী থাকে আর মায়ের স্বান্তনা?? ফারিহা যখন ৬ মাসের , দিবা তার বাবা-মা কে একসাথে হারায়। এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তারা মৃত্যুবরণ করেন।

৩ মে  ২০১৪, বিকেল ৫ টার দিকে হঠাৎ ঝড় এলো আকাশ কাঁপিয়ে।পাশের বাড়ির খেলার সাথী  ফারিহাকে ডাকতে এলেই ছাদে ছুটে যায় ফারিহা। প্রচন্ড ধুলিঝড়...কৈশোরের অনাবিল আনন্দের বানের তোড়ে মৃত্যুবাণ ছিল কি সেই ঝড়? 


দু'দিন ধরে এজমার টানে কষ্ট পাচ্ছিলো, সেদিন শ্বাসের কষ্টটা একটু কম মনে হওয়াতে ছুটে বেড়াচ্ছিলো কিশোরী মেয়েটা।এরপর আবার বাড়ীতে ঢুকে কী মনে করে ময়দা দিয়ে ঝাল পিঠা বানিয়ে বাবা- মা,দাদী, ছোট বোন ফাইরুজ - সবাইকে খাওয়ালো।কেউ বুঝতে পারলো না দ্বিতীয় বারের মতো ডাষ্ট ইনহেইল করে সর্বনাশ ডেকে আনলো মেয়েটা! প্রচন্ড শ্বাসকষ্টে ছটফট করলো মেয়েটা। ইনহেলার, নেবুলাইজার কোন কাজই করলো না, শ্বাসনালীতে পানি জমে গেছে ইতিমধ্যে। 
বাঁচার আকুতিতে অসহায় আমাদের ফারিহা চিৎকার করে বাড়ির এই কামরা থেকে ঐ কামরা...ডাইনিং থেকে ড্রইং রুমের এপ্রান্ত ওপ্রান্ত আছড়ে পড়লো,"আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না, আমি কি বাঁচবো না? আমি বাঁচতে চাই..."!

খবর পেয়ে গলির মুখ থেকে ছুটে ঘরে ফিরে এলো অসহায় পিতা!  পিতা মাতা , আদরের ছোটবোন, দাদীমা, খেলার সাথী  সবার সামনেই  মৃত্যুযন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে ঘরের দরজায় পড়ে গেলো ফারিহা।

আবার উঠে প্রিয়তম বাবার বুকে ঝঁপিয়ে পড়ে বললো, "আব্বু আমাকে বাঁচাও, আব্বু আমি বাঁচতে চাই, আব্বু, আমি বাঁচতে চাই!!"  সৈয়দ আবু শাকের পাপ্পুর ডাকে নিমেষে ছুটে এলো বন্ধু ডাক্তার মঈনুদ্দীন।কোলে করে গাড়িতে উঠানো হলো, গলি পেরুতেই সদরঘাট পোষ্ট অফিস। গাড়ি স্টার্ট দিতেই বড়ো একটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে গেলো প্রাণোচ্ছল কিশোরী মেয়েটি.! 


ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন  ফারিহার দাদীমা সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা  শওকত আরা জাফর।  তার চোখের দৃষ্টি ছিল পৌত্রী  ফারিহা। রাতে  দাদিমার গায়ে কাঁথা তুলে দেয়া , সকালে তাকে  পত্রিকা পড়ে শোনানো, খাওয়ার সময় বা কোথাও বেড়াতে গেলে  নজরদারী করা -সবকিছু যেন ফারিহার করতে হবে। আজ এ শূন্যতা বড়ো কঠিন হয়ে বাজে দাদীমার বুকে!


আদরের ছোট বোন  ফাইরুজ ষষ্ঠ শ্রেণীর মেধাবী ছাত্রী। পড়ালেখা ছাড়া বাইরের জগত তার খুব চেনা নেই ! সারা দিন খুনসুটি করা একমাত্র বোনের আকস্মিক প্রয়াণে নির্বাক নিস্তব্ধ ফাইরুজ!  ৩ মে দুপুরে ও একই রকমের টপস পরে ছবি তুলে ফারিহা। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই সব শূন্য করে চলে গেলো বোন টি!! ফাইরুজের  নিদ্রাহারা রাতের প্রহর কেটে যায়, খেতে বসলে মুরগীর মাংস দেখলেই বুকে মোচড় দেয়, আদরের বোনটি মুরগীর মাংস ছাড়া খেতেই চাইতো না। ফারিহার স্মৃতিতাড়িত ফাইরুজ আর খেতে পারে না! কী করে চলে গেলো আদরের বোন টি!! কী করে খাবো আমি!


 অবিরল অশ্রুধারায়  ভেসে মায়ের মনে পড়ে  আদরের কন্যাটি দু'দিন আগে ৩০এপ্রিল মায়ের জন্মদিন পালন করেছে ! রাত প্রথম প্রহর -১২ টা ১ মিনিটে ফারিহা 'হ্যাপী বার্থডে টু ইউ' গানটা ছেড়ে মাকে জন্মদিনের শুভকামনা জানালো। দুপুরে   শওকত আরা জাফর অনেক কিছু রান্না করলেন একমাত্র পুত্রবধুর জন্মদিন উপলক্ষে । ।ফারিহা বললো, " দাদী, আজকে তোমার রান্না অনেক মজা হয়েছে! আম্মু,  দ্যাখো, দাদি তোমার জন্মদিনে কী মজা করে রান্না করেছে!"

 এসব বলে অঝোর ধারায় কেঁদে চলেছে সন্তান হারা মা দিবা!...একটা ডিপিএস ম্যাচিউরড হয়েছে ১২ বছরে, দিবার স্বপ্ন ছিল, ফারিহার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান এই টাকায় করবে!!দিবার সবকিছুতে নমিনি করেছিলো ফারিহাকে! প্রথম সন্তান, সবাইকে দেখে শুনে রাখবে-এমন স্বপ্নে ! সব আজ ধুলায় হয়েছে ধুলি!! কী স্বান্তনা আছে সন্তানহারা এই মায়ের??

রবীন্দ্রসঙ্গীতশিখতো  ফারিহা। দাদিমা বললেই হারমোনিয়াম নিয়ে বসে যেতো গাইতে!
রবীন্দ্রনাথের ভাষায় , যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে মুক্ত করো হে বন্ধ- এই বানী চিরন্তন হয়ে গেঁথে ছিলো ফারিহার মনে। আর তাই এইটুকু বয়সেই সবার একজন করে গড়ে তুলেছিলো নিজেকে! 

শুধু কি পরিবারে? প্রতিবেশী , শিক্ষক সবার কাছেই ফারিহা ছিল একান্ত স্বজন! ফ্ল্যাট সংস্কৃতির এই বন্ধ্যা সময়ে  ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবেশীদের অন্তর দিয়ে র্হাদিক বন্ধনে আত্মার আত্মীয় করে নেবার অসাধারণ বিশালত্ব ছিল ফারিহা নামের কিশোরীটির অন্তরে!! যা  আত্মকেন্দ্রীকতার এই নষ্ট সময়ে সত্যিই বিরল! 

চট্টগ্রামের সদরঘাট পোষ্ট অফিস গলি  সনাতন ধর্মবলম্বীদের আদি এলাকা।  সাম্প্রতিক সময়েও তরুণ দের মাঝে এলাকায় অসাম্প্রদায়িক বন্ধন ধরে রেখেছিলো যারা , তাদের মধ্যে ফারিহা ছিল সবার আগে। প্রতিটা পূজা পার্বনে ফারিহার সরব উপস্থিতি মাতিয়ে রাখতো প্রতিবেশীদের!! তাদের আত্মার আত্মীয় ছিল যেন  চঞ্চলা হরিনী এই কিশোরী।  কলা পাতায় করে দেয়া পূজার প্রসাদ তার ভীষণ প্রিয় ছিল। 

পাঁচিলের ওপারে সঙ্গীতা বিশ্বাস পলিরা সপরিবারে থাকে। এই দুই পরিবার গত চার দশকের ও বেশি একসাথে আছেন। হিন্দু-মুসলিম অকৃত্রিম অসাম্প্রদায়িক বন্ধনের চার দশকে এসেও অটুট থাকার প্রধান সূত্র ছিল ফারিহা। ফারিহার বাবার সহপাঠী পলিকে  পাঁচিলের এপার থেকে চিৎকার করে  ডেকে বলতো, "পলি ফুপু, নিরামিষ রেঁধেছো, আমাকে দিও কিন্তু!" পলির ফিজিওথেরাপিষ্ট ছিল ফারিহা। পলিকে প্রতিদিন চলে আসতে হতো। ফারিহার টেবিলে বসে ফারিহার হাতে ফিজিওথেরাপী নিতে হতো। একদিন ফারিহার মা দিবা বললো, আজকে আমি দিই থেরাপী। সেদিন প্রচন্ড হাতে ব্যথা হয় দিবার। মায়ের মন, ফারিহা কে বলে, " আমার একদিনেই হাতে কী প্রচন্ড ব্যথা হচ্ছে, ফারিহা, তুমি প্রতিদিন এভাবে পলিকে  থেরাপি দিওনা, তোমার অনেক কষ্ট হয়!"  ফারিহা হেসে জবাব দেয়, " না, আম্মু, পলি ফুপুর হাতে অনেক ব্যথা। আমি থেরাপি দিলে ব্যথাটা ভালো হয়ে যাবে। সদরঘাট পোষ্ট অফিসের সামনে , গলির ভেতর কালো ব্যানার আর  ফারিহার জন্যে শোক চোখে পড়ার মতো ! মনে করিয়ে দেয় , মানুষের প্রাণের পরে চলে গেলো যে, বসন্তের বাতাস টুকুর মতো ...সে যে চঞ্চলা কিশোরী ফারিহা!   

 ৫ মে তার একাদশ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলো।কথা ছিলো  পরীক্ষা শেষ করে ফারিহা চিরাচরিত নিয়মে আনন্দে মেতে উঠবে। ২য় বর্ষে ক্লাস শুরু করার মানসিক প্রস্ততি নেবে।ওসবের কিছুই হলো না।পরীক্ষার কক্ষে তার আসনটি শূণ্য পড়ে থাকলো।ফারিহার সহপাঠীরা তার জন্য কলেজ ক্যাম্পাসে ঝুলালো কালোরঙ ব্যানার। মৃত্যুর কাছে আমরা কত অসহায়।

প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়ানো চঞ্চলা কিশোরী ফারিহা চোখের পলকে প্রাণহীন নীরব শবদেহে পরিণত হবার রূঢ় বাস্তবতা  এলাকার যারা তার আত্মার আত্মীয় ছিল- শিশু থেকে বৃদ্ধ নারী-পুরুষ !! এদের কেউ  মেনে নিতে পারছেন না -ফারিহা আর কখনো খেলতে আসবে না, পূজা দেখতে আসবে না!  প্রতিবেশীদের   কাছে তার প্রিয় খাবার খেতে আসবে না!! !!

প্রচন্ড শ্বাসকষ্টে সময়মতো জরুরী চিকিৎসার অভাবে অকালে প্রাণ হারাতে হলো এই কিশোরীকে। বাঁচবার আকুল আকুতিতে পিতার বুকে আছড়ে পড়েছিলো ফারিহা! অসহায় পিতা  নিকটস্থ  হাসপাতালে ছুটে গেলেও  তাৎক্ষণিকভাবে  অক্সিজেন এবং জরুরী চিকিৎসা পেতে ব্যর্থ হন। মৃত্যুর অমোঘ নিয়তি কেড়ে নেয় দিবা-পাপ্পুর বুকের ধন , তাদের প্রথম সন্তান ফারিহাকে। ফারিহার মা দিবা এবং বাবা সৈয়দ আবু শাকের পাপ্পুর বুকে পাথর সমান এ ভার বয়ে বেড়াতে হবে আমৃত্যু । ফারিহার প্রাণ ছিল তার দাদীমা শওকত আরা জাফর । অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা শওকত আরা জাফর কোন ভাবেই ভুলতে পারেন না প্রিয়তম নাতনীর বাঁচার আকুতি !, তার দুই কন্যা নুসরাত জাহান রুমা এবং ইসরাত জাহান কণাও  প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রীর আকস্মিক প্রয়াণে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত!
 ফারিহার বালিশ, জামা কাপড় নিয়ে  অবিরল অশ্রুধারায় নির্ঘুম প্রহর কাটছে তার মা  দিবার। কী স্বান্তনা আছে , যা দিয়ে মায়ের শূন্য বুকে ফিরিয়ে আনা যায়, এমন প্রানবন্ত সন্তানকে?

আর প্রিয়তম পিতা -যাকে চোখে হারাতো ফারিহা? সেই পিতার বুকেই বারবার আছড়ে পড়েছে বাঁচবার আকুতি তে। সবার সাথে খুব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে সদস্য সন্তান হারা পিতা সৈয়দ আবু শাকের পাপ্পু । শূন্যতার  জগদ্দল পাথর বুকে হাল্কা রসিকতা , সবসময়ের মতো- তার বুকের ভেতরের ফাঁকা জায়গাটা কখনোই পূরণ হবার নয়! তবু জীবন বয়ে যায় নিত্য, অনন্ত ধারায়!!


স্বজনদের বেদনার ঝড় কাটাতে শরণাপন্ন হলাম রবীন্দ্রনাথের। 


 রবীন্দ্রনাথের জীবনে পর পর ১৩ স্বজন কে হারাতে হয় !  কবিগুরুর জীবনের সবচেয়ে বড়ো অধ্যায়, শোকবিধুর সেই অধ্যায় স্মরণ করছি।যাকে স্বজন হারানোর শোকে আক্রান্ত হতে হয়েছে বারবার। 

রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন তেরো বছর দশ মাস, তখন তিনি মাকে হারান। 

 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ে করার চার মাস পর ১৮৮৪ সালের ১৯ এপ্রিল আত্মহত্যা করেন  জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্নী কাদম্বরী দেবী ।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আট বছর বয়স থেকে যিনি তার খেলার সাথী ছিলেন। 

  পরিণত বয়সে রবীন্দ্রনাথের বিচ্ছেদশোকের অশ্রুমালায়  যুক্ত হলেন কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী৷   প্রথম সন্তান প্রসবের সময় মৃনালিনীর বয়স কম ছিল বলে কবি যেন ভরসা পেতেন না ।তাই সন্তানের দেখা শোনা অনেকাংশেই রবীন্দ্রনাথ করতেন। তিনি পিতা হয়েও কন্যাকে লালন পালন করতেন মাতৃরূপে। শিশুকে খাওয়ানো, কাপড় পড়ানো, বিছানা বদলানো এসবই তিনি করতেন নিজ হাতে।

১৩০৯ সালে ৭ই অগ্রহায়ণ, ইংরেজী ১৯০২ সালের ২৩শে নভেম্বর, রবিবার মৃনালিনী দেবী  মৃত্যু বরণ করেন। স্ত্রীর  মৃত্যু শয্যায় নিজ হাতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সেবা-যত্ন করতেন। প্রায় দুমাস তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন, ভাড়া করা নার্সদের হাতে পত্মীর সুস্থ্যতার ভার তিনি একদিনের জন্যও দেননি। স্বামীর সেবা পাওয়া সৌভাগ্যের বিষয়! মৃনালিনী দেবী সেটা পেয়েছিলেন ভাগ্যগুনে। তখনকার দিনে ইলেকট্রিক ফ্যান আসেনি । হাত পাখা দিয়ে দিনের পর দিন তিনি বাতাস করেছেন স্ত্রীকে। এক মুহুর্তের জন্যেও হাতের পাখা ফেলেননি।অকালে চলে গেলেন তিনি৷ বয়স তখন তাঁর বয়স মাত্র ঊনত্রিশ৷ 

স্ত্রীর মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ ছাদে চলে গেলেন, নিষেধ করে গেলেন যেন কেউ তাঁর কাছে না যায়৷ মৃণালিনীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে রচিত হলো ‘স্মরণ' কবিতাগুচ্ছ৷ ভাষায় আড়ম্বর নেই, উপমা অলংকারের আয়োজন নেই, জীবনের টুকরো টুকরো ছবিগুলোর মধ্য দিয়ে কবি তাঁর প্রিয়াকে মৃত্যুর পর উপলব্ধি করার যে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন, তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ‘স্মরণ'-এর অনেকগুলো কবিতায়৷ ‘যুগল মিলন' কবিতায় লিখেছেন, ‘‘মিলন সম্পূর্ণ হল তোমা সনে, এ বিচ্ছেদ বেদনার নিবিড় বন্ধনে৷''

রবীন্দ্রনাথের দুই ছেলে, তিন মেয়ে – মাধুরীলতা, রথীন্দ্রনাথ, রেণুকা, মীরা ও শমীন্দ্রনাথ৷ মাধুরীলতার ডাক নাম বেলা, রেনুকার ডাক নাম রাণী৷ স্ত্রী বেঁচে থাকতেই তিনি মাধুরীলতা ও রেনুকার বিয়ে দেন, তাদের অল্প বয়সে৷ বিয়ের পর বছর না ঘুরতেই রেণুকা গুরুতর অসুস্থ হলো। ডাক্তাররা রোগ পরীক্ষা করে রায় দিলেন – যক্ষ্মা৷ ডাক্তারদের পরামর্শে রবীন্দ্রনাথ রেণুকাকে নিয়ে হাওয়াবদল করলেন দু'বার৷

 অসুস্থ রেণুকাকে শোনানোর জন্য লিখলেন ‘শিশু' কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুচ্ছ৷ অবশেষে  মাত্র বারো বছর বয়সে চলে গেলো রেণুকা; মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর দশ মাসের মধ্যে৷ 

১৯০৫-এ পরিণত বয়সে মৃত্যু হলো পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের৷ 

এর মাত্র দু'বছর পর রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ পুত্র এগারো বছর বয়সি শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর মুত্যুবরণ করলো । মুঙ্গেরে বেড়াতে গিয়ে কলেরায় আক্রান্ত হলো শমীন্দ্রনাথ৷ খবর পেয়ে শান্তিনিকেতন থেকে মুঙ্গেরে পৌঁছানোর আগেই মারা গেলো শমীন্দ্রনাথ।

 রবীন্দ্রনাথ তখনো পথে। বলে দিলেন তার জন্যে অপেক্ষা না করে শমীন্দ্রনাথকে দাহ করে ফেলতে। আদরের ছেলে কে শেষ দেখা ও দেখতে পারলেন না কবিগুরু।

 রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘‘...শমী যে রাত্রে চলে গেল তার পরের রাতে রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে, কোথাও কিছু কম পড়েছে তার লক্ষণ নেই৷ মন বললে কম পড়েনি, সমস্তর মধ্যে সবই রয়ে গেছে৷ আমিও তার মধ্যে৷' সে সময়ে রচিত হলো তার অমর সৃষ্টি ," আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে !

আজ জ্যোত্স্নারাতে সবাই গেছে বনে

বসন্তের এই মাতাল সমীঁরণে ।।

যাব না গো যাব না যে, রইনু পড়ে ঘরের মাঝে-

এই নিরালায় রব আপন কোণে

যাব না এই মাতাল সমীরণে ।।

আমার এ ঘর বহু যতন ক'রে

ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে ।

আমারে যে জাগতে হবে, কী জানি সে আসবে কবে

যদি আমায় পড়ে তাহার মনে

বসন্তের এই মাতাল সমীরণে ।।

বড়ো মেয়ে মাধুরীলতার সংসার জীবন শেষ পর্যন্ত সুখের ছিলো না৷ রবীন্দ্রনাথের জীবনে এটাও এক বেদনাত্মক অধ্যায়৷ জামাতা শরতের অন্যায় গর্হিত আচরণ আর মাধুরীলতার প্রতি চরম নির্যাতন সইতে না পারলে ও অসহায় পিতা রবীন্দ্রনাথ কিছুই করতে পারেন নি।
জামাতার সাথে তাঁর সম্পর্ক তিক্ততায় পৌঁছেছিলো৷ মেয়ের বাড়িতে তাঁর যাওয়া আসাও তেমন ছিলো না৷ কন্যার কষ্ট সইতে না পেরে বলতেন." ছোটকালে মাধুরীলতার কঠিন অসুখ হয়েছিলো, সেদিন সে মরে যেতো যদি, আমাকে তার এমন কঠিন সময় দেখতে হতো না।"

একদিন হঠাৎ খবর এলো মাধুরীলতা অসুস্থ৷ রাজরোগ যক্ষ্মায় আক্রান্ত মাধুরীলতা । শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় এসে রবীন্দ্রনাথ প্রায় রোজই মেয়েকে দেখতে যান৷  জামাতার চরম অপমান জনক আচরণ নীরবে সয়ে গেছেন বিশ্বজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর!  লেখিকা হেমলতা দেবী জানাচ্ছেন, ‘‘অতি আদরের মেয়ে বেলা মৃত্যুশয্যায়, সব অপমান চেপে তিনি দেখা করতে যেতেন তার কন্যা বেলা (মাধুরীলতা) র সাথে। শ্বশুর মশাইকে দেখে  শরৎ  টেবিলের ওপর পা তুলে দিয়ে সিগারেট খেত৷ পা নাবাতো না পর্যন্ত – এমনি করে অপমান করত৷ উনি সব বুকের মধ্যে চেপে মেয়ের পাশে বসতেন...৷''মাধুরীলতার মৃত্যু হলো বত্রিশ বছর বয়সে৷

 রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'পিতৃস্মৃতি' গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ‘‘সেদিন ২ জ্যৈষ্ঠ – যখন তিনি শ্রীরামপুরের বাড়িতে পৌঁছলেন, তিনি বুঝতে পারলেন যা হবার তা হয়ে গেছে৷ গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন৷ সেদিন সন্ধ্যা বেলায় বিচিত্রার বৈঠক ছিল৷ বাবা সকলের সঙ্গে হাসিমুখে গল্পসল্প যেমন করেন, সেদিনও তাই করলেন৷ তাঁর কথাবার্তা থেকে একজনও কেউ ঘুণাক্ষরে জানতে পারল না যে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা হয়ে গেছে, মনের কী অবস্থা নিয়ে বাবা তাদের সঙ্গে সদালাপ করছেন৷''


১৯২৩-এ মৃত্যু হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের, ১৯২৫ সালে মারা যান  জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর,  ১৯২৬-এ দ্বিজেন্দ্রনাথ, ১৯৩২-এ দিদি স্বর্ণকুমারী মুত্যুবরণ করেন ৷ 

১৯৩২-এ একাত্তর বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ হারালেন কন্যা মীরার পুত্র কুড়ি বছর বয়সি আদরের নাতি নীতিন্দ্রনাথকে৷ উচ্চতর শিক্ষার জন্য নীতিন্দ্রনাথ গিয়েছিলো জার্মানিতে৷ টেলিগ্রামে নীতুর মৃত্যু সংবাদ এলো৷  শান্তিনিকেতনে তখন 'বর্ষা মঙ্গল' উৎসবের আয়োজন চলছে৷


আয়োজন বন্ধ হলো না৷ রবীন্দ্রনাথ মীরাকে দীর্ঘ চিঠিতে লিখলেন, ‘‘নীতুকে খুব ভালবাসতুম, ... অনেকে বললে, এবার বর্ষামঙ্গল বন্ধ থাক আমার শোকের খাতিরে৷  আমি বললুম, সে হতেই পারে না; আমার শোকের দায় আমিই নেব৷''

শোকের দায় আবার নিতে হলো রবীন্দ্রনাথকে , তার মৃত্যুর এক বছর আগে৷ আরেক প্রিয় ভাইপো সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অকাল মৃত্যুর সংবাদ পেলেন মংপু-তে বসে৷ জন্মদিনের আয়োজন চলছিলো তখন৷ ভাইঝি ইন্দিরাকে লিখলেন, ‘‘তোরা বোধহয় জানিস আমার নিজের ছেলেদের চেয়ে সুরেনকে আমি বেশি ভালোবেসেছিলুম৷'' কবিতা লিখলেন সুরেনের স্মৃতিতে, ‘‘আজি জন্মবাসরের বক্ষ ভেদ করি/ প্রিয়মৃত্যুবিচ্ছেদের এসেছে সংবাদ...''

রবীন্দ্রনাথ একবার চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘‘সাহস যেন থাকে, অবসাদ যেন না আসে, কোন খানে কোন সূত্র যেন ছিন্ন হয়ে না যায়৷ যা ঘটে তাকে যেন সহজে স্বীকার করি৷'' রবীন্দ্রনাথ সকল মৃত্যুশোককে এ ভাবেই সহজ করে বরণ করে নিয়েছিলেন৷ অনায়াসে তাই বলতে পেরেছিলেন, ‘‘ঈশ্বর যাহা দিয়াছেন তা গ্রহণ করিয়াছি৷ আরো দুঃখ যদি দেন তো তাহাও শিরোধার্য করিয়া লইব৷ আমি পরাভূত হইব না৷''

‘কোথাও সান্তনা নেই, পৃথিবীতে শান্তি নেই আজ’ - আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

গতকাল (মঙ্গলবার) ঢাকার অন্য একটি দৈনিকে প্রকাশিত আমার লেখার শিরোনাম দিয়েছিলাম জীবনানন্দ দাশের কবিতা থেকে- ‘মধ্যযুগ এত রক্ত দেখেছে কখনও?’ লেখাটি ছিল নারায়ণগঞ্জের সাম্প্রতিক নরবলি নিয়ে। আজও লিখছি একই হত্যা প্রসঙ্গ নিয়ে, তবে একটু বিস্তৃত পরিসরে। আজও লেখার শিরোনামের জন্য জীবনানন্দ দাশের শরণাপন্ন হয়েছি। আমার এই লেখার শিরোনামটিও জীবনানন্দ দাশের কবিতা থেকে নেয়া- ‘কোথাও স্বান্তনা নেই, পৃথিবীতে শান্তি নেই আজ।’ নারায়ণগঞ্জের নরবলি নিয়েই লেখাটি শুরু করতে চাই।


আজ লেখার টেবিলে বসে লেখার শুরুতেই খোঁজ নিলাম, নারায়ণগঞ্জ ট্র্যাজেডির হোতা বলে অভিযুক্ত নূর হোসেন গ্রেফতার হয়েছেন কিনা। তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গ বলে বর্ণিত ১১ জন গ্রেফতার হলেও নূর হোসেন এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হননি। তিনি আত্মগোপন করেছেন অথবা সীমান্ত পাড়ি দিয়েছেন বলে অনুমান করা হচ্ছে। এটাও যেন বাংলাদেশের সেই চিরাচরিত ঘটনা। ভয়ানক কোন অপরাধীও যদি ক্ষমতাসীন দলের আশ্রিত হয়, সে পালিয়ে যাবার সুযোগ পায়। তারপর বেশ কিছুদিন আরাম-আয়েশে বিদেশে থাকার পর টাকার জোরে অথবা ক্ষমতাসীনদের মদদের জোরে সব অভিযোগমুক্ত হয়ে দেশে ফিরে আসে এবং নতুন করে আরও বড় অপরাধে যুক্ত হয়। বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। 


নূর হোসেনের বেলাতেও যদি তাই হয় তাহলে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। নারায়ণগঞ্জের ঘটনাটি ঘটার তিনদিনের মধ্যে নূর হোসেনকে কেন গ্রেফতার করা গেল না? তিনি তো সাত ব্যক্তির লাশ শীতলক্ষ্যায় ভেসে ওঠার পরও নিজের এলাকাতেই ছিলেন এবং তিনি এই হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী নন এই মর্মে কথাবার্তাও বলছিলেন, এখন প্রশ্ন, তাকে পালাবার সুযোগ কারা দিয়েছেন এবং কেন দিয়েছেন? 
নারায়ণগঞ্জের নরবলির ঘটনায় র‌্যাবও অভিযুক্ত হয়েছে। র‌্যাবের মহাপরিচালক এই ব্যাপারে দ্রুত তদন্তের ব্যবস্থা করেছেন। এ জন্য তাঁকে ধন্যবাদ। উচ্চ আদালতও এই ব্যাপারে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত অনুষ্ঠানের নির্দেশ দিয়েছে। এখন প্রশ্ন, এই সব তদন্তের কাজ কি দ্রুত শেষ হবে, কিংবা শেষ হলেও তার রিপোর্ট কি কখনও দিনের আলোর মুখ দেখবে? নাকি লালফিতার বন্ধনেই অনির্দিষ্টকাল বন্দী হয়ে থাকবে? এবং ধীরে ধীরে নারায়ণগঞ্জের বীভৎস হত্যাকা-ও অন্যান্য গুম, হত্যাকা-ের ঘটনার মতো ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে মানুষের স্মরণ থেকে মুছে যাবে? 
বাংলাদেশ আর কতদিন এভাবে অপরাধ ও অপরাধীদের পুষবে? দেশে আইন আছে, তার শাসন নেই। অপরাধ আছে। শুধু আছে নয়, তার রাজত্ব ক্রমবর্ধমান। কিন্তু অপরাধীর বিচার নেই। অর্থবল ও ক্ষমতাবানদের মদদ থাকলে যে কোন ব্যক্তি যে কোন গুরুতর অপরাধে অপরাধী হয়েও পার পেতে পারেন; সমাজের মুকুটমণি হয়ে থাকতে পারেন। তা না হলে তারেক রহমান, যার বিরুদ্ধে মহাদুর্নীতি, গুম, খুন, সন্ত্রাস, অবৈধ অর্থ পাচারের অসংখ্য গুরুতর মামলা রয়েছে, তিনি কী করে আদালতের জামিন নিয়ে বছরের পর বছর বিদেশে একজন প্রিন্সের মতো বাস করতে পারেন, বিচার ও দন্ড এড়িয়ে চলতে পারেন? কোথায় তাঁর বিচার ও দন্ড? তিনি এখন বিদেশে বসে ‘ইতিহাসবিদ’ সেজেছেন এবং এই অসত্য ইতিহাস চর্চা দ্বারা তিনি অনারারি ডক্টরেট পাওয়ার চেষ্টা করলে (কারণ প্রকৃত ডক্টরেট পাওয়ার শিক্ষাগত যোগ্যতা তাঁর নেই) বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। 
নারায়ণগঞ্জের ঘটনাটির মূল অপরাধী কারা তা এখনও জানা যায়নি। তবে সন্দেহ করা হয়েছে এটা আওয়ামী লীগেরই দুই গ্রুপের স্বার্থদ্বন্দ্বের ফল। এদের এক গ্রুপের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভূমিদস্যুতা ও সন্ত্রাসের অভিযোগ উঠেছে। এই চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির বিবাদে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের ভেতরে রক্তক্ষয়ী গ্রুপ-দ্বন্দ্ব চলছে। এই দ্বন্দ্বে খুন-খারাবিও হচ্ছে বিস্তর। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের ভেতরে একে অন্যের গলা কাটছে।
সম্প্রতি ছাত্রলীগের দুই কেন্দ্রীয় নেতা (সভাপতি সোহাগ এবং সেক্রেটারি নাজমুল) লন্ডনে এসেছিলেন সাংগঠনিক কাজের অজুহাতে। তাঁদের কার্যকলাপ দেখে বিস্মিত হয়েছি। এঁরা যদি দেশের কোন ছাত্র সংগঠনের নেতা হন তাহলে দেশে ছাত্র রাজনীতির ভবিষ্যত কী? এ সম্পর্কে পরে বিস্তারিত লিখব। আসল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আওয়ামী লীগের সবচাইতে বড় শত্রু এখন আওয়ামী লীগ। আমাকে ঢাকার এক তরুণ কলামিস্ট (যিনি আওয়ামী লীগেরও সমর্থক) সখেদে বলেছেন, আওয়ামী লীগ সম্ভবত যদু বংশের মতো নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস করবে। আত্মকলহ, স্বার্থের দ্বন্দ্বই হবে এদের বিপর্যয়ের কারণ। বিএনপি-জামায়াতকে আর নতুন করে তৎপর হতে হবে না।
আমার এই লেখাটির শিরোনাম ‘কোথাও সান্তনা নেই, পৃথিবীতে শান্তি নেই আজ।’ কথাটি কেবল বাংলাদেশের জন্য নয়, সারা পৃথিবীর জন্যই সত্য। পৃথিবীজুড়ে চলেছে সন্ত্রাস ও দুর্নীতি। পত্রিকার পাতাজুড়ে এখন শুধু হত্যা, রক্তপাতের খবর। আগেকার যুদ্ধে একটা নিয়ম-কানুন ছিল। যুদ্ধ ঘোষণা করতে হতো। বেসামরিক এলাকায় বোমাবর্ষণ নিষিদ্ধ ছিল। এখন যুদ্ধ ঘোষণা ছাড়াই যেভাবে এক দেশ অপর দেশে হামলা চালিয়ে হত্যা, ধ্বংস চালাচ্ছে, তার নজির ঘোষিত যুদ্ধেও নেই। সন্ত্রাস দমনের নামে বিনা যুদ্ধ ঘোষণায় পাকিস্তানে ও আফগানিস্তানে বেসামরিক এলাকায় আমেরিকা যেভাবে ড্রোন হামলা চালিয়ে হাজার হাজার নিরীহ সিভিলিয়ান হত্যা করেছে তার উদাহরণ মধ্যযুগেও নেই। তারপরও মার্কিন রাষ্ট্রদূতেরা দেশে দেশে শান্তি, স্বাধীনতা ও মানবতার বাণী ছড়ায়। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মজেনা সাহেব নিত্যই বাংলাদেশকে গণতন্ত্র ও মানবতার উপদেশ দিচ্ছেন। কিন্তু তাঁর দেশটিই যে আজ বিশ্বে শান্তি ও মানবতার বড় শত্রু এবং একটি ‘রে‌্যগ-স্টেট’ সে সত্যটি তিনি নিত্য আড়াল করে চলেছেন।
মিসরে চলছে আরও জঘন্য গণহত্যা। তাকে অনেকেই বলছেন জুডিসিয়াল মাস-মার্ডার। সাইদ ইউসুফ নামে এক মিসরীয় বিচারক ৭২০ ব্যক্তিকে একসঙ্গে ফাঁসির আদেশ দিয়ে ‘জাজ বুচার’ (কসাই বিচারক) আখ্যা লাভ করেছেন। তাঁর আদালতে আরও ৯১৯ ব্যক্তি বিচারাধীন রয়েছে। তাদেরও বিচার প্রহসনে ফাঁসি দেয়া হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই বিচারকের কার্যকলাপে মিসরের ঘরে ঘরে কান্নার রোল পড়েছে। দন্ডিত ও বিচারাধীন ব্যক্তিদের কেউই সামাজিক অপরাধী নয়; তারা রাজনৈতিক বন্দী। তারা মুসলিম ব্রাদারহুড এবং পদচ্যুত প্রেসিডেন্ট মুরসির সমর্থক। এরা মুরসির সমর্থনে রাজপথে বিক্ষোভ-মিছিলে শামিল হয়েছিল।
মিসরের পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অবস্থা বিচার্য। বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামায়াত একটানা ছয় মাস ধরে রাজপথে সন্ত্রাস চালিয়ে যে রক্ত ঝরিয়েছে, আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মেরেছে, সেজন্য এই দল দু’টির সমর্থক, নেতা বা কর্মীদের একজনেরও ফাঁসির আদেশ হয়নি। ’৭১-এ যারা গুরুতর যুদ্ধাপরাধ করেছে, তাদের মধ্যে মাত্র একজনের ফাঁসি হয়েছে। আরও দু’একজনের দণ্ডাদেশ হয়েছে। দণ্ড এখনও কার্যকর হয়নি। তাতেই বিশ্বব্যাপী আমেরিকা থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন- সকলের কী মায়াকান্না। বাংলাদেশে মাত্র একজনের ফাঁসি (তাও প্রমাণিত গুরুতর অপরাধে) হওয়ায় আমেরিকা ও জাতিসংঘ পর্যন্ত দুঃখে কাতর হয়েছে। আর মিসরে রাজনৈতিক বিক্ষোভ দমনের নামে সাত শ’র বেশি মানুষকে ফাঁসির আদেশ দেয়ার পরও বিশ্বে তেমন চাঞ্চল্য নেই। ব্রিটেন, আমেরিকা এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এই গণ-ফাঁসির আদেশের দায়সারা গোছের একটি প্রতিবাদ জানিয়েই ক্ষান্ত রয়েছে। এই হচ্ছে তথাকথিত বিশ্ব বিবেকের আসল চেহারা।উন্নত অনুন্নত নির্বিশেষে বিশ্বের সকল দেশেই এখন সন্ত্রাসের তা-ব চলছে। নানা চেহারার সন্ত্রাস। আমেরিকায়, জাপানে মানসিক বিকারগ্রস্ত ব্যক্তি বন্দুক হাতে স্কুলে ঢুকে শিক্ষকসহ বাচ্চা ছেলেমেয়েদের নির্বিচারে হত্যা করছে; ভারতে চলছে দেশী এবং বিদেশী নাগরিকদের অপহরণ ও ধর্ষণ, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে হত্যা; মাওবাদী সন্ত্রাস। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল ও বামপন্থী সমর্থকদের মধ্যে চলছে নিত্য হানাহানি, খুন-খারাবি। কোন দেশ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে জর্জরিত, কোন দেশ ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক সন্ত্রাসে নিত্য রক্তাক্ত।ইউরোপ ও আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের পার্থক্য; ইউরোপ ও আমেরিকায় অপরাধ যেমন হয় তেমনি অপরাধী যত উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তি (প্রেসিডেন্ট নিকসন হলেও) হন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার বিচার ও দ- হয়। বাংলাদেশ, ভারত বা পাকিস্তানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা হয় না। ব্রিটেনে বর্ণবিদ্বেষী রাজনীতির জন্য ইউনুস পাওয়েলের মতো নেতাকে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয়েছিল; আমেরিকায় বর্ণদাঙ্গায় জড়িত অভিযোগে রিপাবলিকান নেতারও কারাদ- হয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমানের বিচার ও দন্ড বিলম্বিত হয় এবং তাঁর গাড়িতে মন্ত্রিত্বের পতাকা ওড়ে। পাকিস্তানে লিয়াকত হত্যা, ডা. খান সাহেব হত্যা, বেনজির হত্যাসহ অসংখ্য রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের অপরাধীদের বিচার ও দন্ড হয়নি। ভারতের গুজরাটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে দু’হাজার সংখ্যালঘু হত্যার দায়ে অভিযুক্ত নরেন্দ্র নাথ দামোদর দাস মোদি এখন নির্বাচনে ভারতের প্রধানমন্ত্রিত্বের পদপ্রার্থী। তিনি জিতেও যেতে পারেন।
সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে যদি মানুষের চেতনা জাগ্রত না হয়, তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে না ওঠে, তাহলে তাকে উচ্ছেদ করা অসম্ভব। বাংলাদেশে দু’টি প্রধান রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, তারা ক্ষমতায় গেলে একইভাবে সন্ত্রাস ও দুর্নীতি প্রশ্রয় পায়। ফলে এই দু’টি মহাব্যাধি থেকে দেশকে মুক্ত করা যাচ্ছে না। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার অনেক ভাল কাজ করেও দেশের মানুষের কাছে কল্কে পাচ্ছে না। কারণ, বড় বড় দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের দায় এখন আওয়ামী লীগের ঘাড়েই।
নারায়ণগঞ্জের এই নির্মম ঘটনাটি কোন মহলের কারসাজিতেই যেন ধামাচাপা না পড়ে, সেদিকে আওয়ামী লীগ সরকারকে কঠোর দৃষ্টি রাখতে হবে। নূর হোসেন পালাতে পেরেছেন, তাতে কী হয়েছে? রানা প্লাজার পলাতক মালিককে যদি ভারত থেকে ধরে আনা যায়, তাহলে নূর হোসেনকে কেন পারা যাবে না? তাকে অবশ্যই আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হবে। অন্যথায় শাস্তি পেতে হবে। সবচাইতে বড় কথা, আওয়ামী লীগ থেকে একসময় সন্ত্রাসীদের দূর করার নামে জয়নাল হাজারী ও আরও কিছু ব্যক্তিকে বহিষ্কৃত করা হয়েছিল, তাতে লাভ হয়েছে কি? মাছের অসংখ্য ছানার মতো আওয়ামী লীগের ভেতরেও এখন নানা ধরনের অপরাধী, সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজেরা রীতিমতো সিন্ডিকেট গড়ে তুলে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। বঙ্গবন্ধু এদের নাম দিয়েছিলেন ‘চাটার দল।’ এই চাটার দল এখন লুটেরা ও খুনী গ্রুপে পরিণত হয়েছে। শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতারা ভেবে দেখুন এদের কবল থেকে কেমন করে দল, দেশ ও জাতিকে মুক্ত করবেন।


Friday, May 2, 2014

প্রেস ফ্রিডম থাকতে নেই??- সুমি খান



3 May 2014 1.30 a.m Uttara
রাত প্রথম প্রহর

রাজাকারের ও প্রেস ফ্রিডম আছে
ঘাতক খুনির ও প্রেস ফ্রিডম আছে
 কিন্তু স্বাধীনতা সবার জন্যে আসে না
তাই মুক্ত সাংবাদিকতা ও সবার জন্যে নয়!

প্রেস ফ্রিডম থাকতে নেই বলেই
জামাতের রামরাজত্বের প্রতিবেদন লেখার দায়ে -
নিজামী শাসিত সরকার জেলের গরাদে ঢুকাতে পারে অবলীলায়-
ইন্টারোগেশানে প্রশ্ন করে - 'তালেবান কোথায় আছে' ??
  প্রেস ফ্রিডম নেই বলেই হলুদ খামের পিঠে  লাল কালিতে গোল্লা করে
 সুমি খানের 'মৃত্যুপরোয়ানা' পাঠায় জামাত শিবির -হেফাজত!!

প্রেস ফ্রিডম থাকতে নেই বলেই
নিজামী মুজাহিদ কে 'একাত্তরের ঘাতক 'বলার অপরাধে বিচার বসে নিউজ রুমের কনফারেন্স টেবিলে
অথবা
হুজি আমীর ইয়াহিয়ার স্কুপ ইন্টারভিউ নেবার অপরাধে
  অশ্লীল  নোংরা গল্পে একাট্টা ব্যর্থ সাংবাদিকের দল
সাথে জোটে নপুংসক নারী পুরুষ  বার্তাপ্রধান ক'জনা

প্রেস ফ্রিডম থাকতে নেই বলেই

নিজেদের ব্যর্থতার গ্লানি ভুলতে র‍্যাবের ইফতার পার্টি  বর্জন করে-
উচ্ছিষ্ট ভোগী  হলুদ সাংবাদিকের দল

প্রেস ফ্রিডম থাকতে নেই বলেই
 রাজশাহীতে আমে ফরমালিন মেশানোর প্রতিবেদন তৈরির অপরাধে
 হেড অব নিউজ অথবা মালিকের কাছে -
 জবাবদিহি করতে হয় বারবার
 "একাত্তরে তোমার জন্ম হয়েছে? কী করে জানো নিজামী গোলাম ঘাতক ছিল একাত্তরে ? "
অথবা -


 প্রেস ফ্রিডম নেই বলেই মনগড়া কল্পকাহিনীর ফুলঝুড়ি নামে মিডিয়ার মাথা  আকাশে বসে থাকা সাংবাদিক নেতা দের ঝুলি থেকে!


প্রেস ফ্রিডম নেই বলেই  রিপোর্টার নয় , ম্যাসেঞ্জার বা 'উভ রিপোর্টার ' করে
 বসিয়ে রাখার ষড়যন্ত্রের বলি হতে হয়
 ওয়ান ইলেভেনের টিয়ার গ্যাস আর পুলিশি তাড়া খেয়ে খর রোদে ৬ ঘন্টা  ছুটে এক্সক্লুসিভ ফুটেজ সংগ্রহ
 এর পর? জ্বালা ধরা চোখে এ্যাসাইনমেন্ট করে  মাইল পথ পাড়ি দিয়ে
 অফিসে ঢুকেই
 চীফ রিপোর্টারের  ভিলেন মার্কা হাসি-
নির্দেশ দেয়া হয়- গুন্ডালা কালারুণের হাতে তুলে দিতে হবে  ভিডিও টেপ-
  সেই করবে রিপোর্ট !
 প্রেস ফ্রিডম নেই বলেই  ন্যাশনাল গ্রীড অচল হবার এক্সক্লুসিভ ফুটেজ আর রিপোর্ট তুলে দিতে হয়
চীফ রিপোর্টারের  বিবির হাতে টেপ তুলে দেবার 'চীপ সিদ্ধান্ত'
মেনে নিতে হয়-
ইটিভির ছাদে বসে  অন্যের কাজে রিনরিনে কন্ঠ বসিয়ে চীপ'  রিপোর্টারের গরবিনী বিবি এক্সক্লুসিভ  রিপোর্ট দেখান'!
প্রেস ফ্রিডম নেই বলেই কি  চীফ রিপোর্টারের তস্কর বৌ 'অনন্যা শীর্ষদশে' র গরবিনী একজন!

 প্রেস ফ্রিডম থাকতে নেই বলেই  কি
২৪ ঘন্টা চ্যানেলের বার্তা প্রধান  অথবা ষাটোর্ধ  নির্লজ্জ  সাংবাদিক-মালিক

 চাকরির কথা বলে  অফিসে ডেকে রঙ্গ-তামাশা করে মজা পান!

প্রেস ফ্রিডম থাকতে নেই বলেই  বার্তাপ্রধান মালিককে সতর্ক করে দেন-
যে একবার  বিযুক্ত, তাকে নতুন করে যুক্ত করা নিষ্প্রয়োজন
( বুকের ভেতর ধুকপুক- মালিকের লোক হাউসে না থাকাই নিরাপদ) !!
প্রেস ফ্রিডম নেই বলেই সো- কল্ড 'সক্রেটিস' ধর্ষকের পাহারাদার হয়ে

ধর্ষিতা কিশোরীর সংবাদ প্রকাশের  দায়ে বিচার বসায় আর
 মিলিয়নিয়ারে পরিণত করেন ধর্ষককে!
 আর সেই সাথে নিজে নাহয় বিলিয়নিয়ার ই হলেন!

প্রেস ফ্রিডম নেই বলেই  দাদন -সাংবাদিকের মুঠো ভরে কড়ির পাহাড়ে
দাদনের ফাঁদ নক্ষত্রচ্যুত করে  পেশাদার সাংবাদিকতা কে!

প্রেস ফ্রিডম নেই বলেই কি
অফিসরুমে জায়নামাজ আর  তসবিহ   -
ধর্মের মুখোশে মুখ ঢাকে চাঁদাবাজ সাংবাদিক

প্রেস ফ্রিডম নেই বলেই  কি
চারকোণা আর গোলটেবিলে বসা উপস্থাপক
মাত্রাহীন বিত্ত বৈভবের মালিক!!

শিলাইদহের কুঠিবাড়ির মূল ফটক দখল করে বাজার বসিয়েছে বিএনপি নেতা পৌর চেয়ারম্যান
সেই রিপোর্টে কুঠিবাড়ির ছাদ থেকে পিটিসি দেবার অপরাধে
 ২৪ দিন ডেস্কে বসিয়ে রাখেন  রচৌধুরী
প্রেস ফ্রিডম নেই বলেই -  রাষ্ট্রীয় সম্মানে মোদো মাতাল দিলশাদ চৌধুরী এখন
প্রেস মিনিষ্টার!

প্রেস ফ্রিডম নেই বলেই কি  -

বাম অতিবাম মুখোশে সাংবাদিক নেতারা
 জামাত শিবির বা দাদন সাংবাদিকদের
পদায়নে ব্যস্ত দিন রাত!

প্রেস ফ্রিডম নেই বলেই কি

  আইরিন নিয়াজী মান্না
অথবা উম্মুল ওয়ারা সুইটি -
বা  সুমি খানের চলন বাঁকা !

অথবা মিডিয়া জগতের নীতি নির্ধারকদের
বদনজরে অবস্থান!
নাকি অতি নজরদারীতে !

প্রেস ফ্রিডম নেই বলেই কি
মেধাবী রাজীব , দীপ বর্বর হত্যার শিকার হয়ে ও
চুদুর বুদুর ডলির তেতুঁল সাংবাদিকতার ঘৃন্য শিকার?

প্রেস ফ্রিডম নেই বলেই কি
চুদুর বুদুরের অশ্লীল সাংবাদিকতার সমর্থনে ১৫ সম্পাদক নির্লজ্জ বিবৃতি দেন!
বগল বাজায় নষ্ট প্রতিবেদকের দল!

প্রেস ফ্রিডম নেই বলেই কি
ক্ষমতার কাছাকাছি
ঘুরঘুর করে টাকার কুমির বনে যায়  দুধের মাছির দল?

প্রেস ফ্রিডম নেই বলেই  ২৩ বছর বয়সী কাবুলের পুলিশ কমান্ডার
আনিয়া নিদ্রিংহাসের গাড়িতে ঢুকে
'লা ই লাহা ইল্লাল্লাহু 'বলে একে -৪৭ এর ব্রাশ ফায়ারে ঝাঁঝরা করে দেয়
 জার্মান ফটো সাংবাদিক আনিয়া নিদ্রিংহাস কে!

প্রেস ফ্রিডম নেই বলেই কি 'আলেদা ' সাংবাদিক দিন ঠিকে ৭৫ টাকায়  'চীপ রিপোর্টারের' পদে  কাজ করেন আর ফাল হয়ে মালিক কে বিঁধে দিয়ে
মদের আড্ডার বিল তোলেন
একাত্তরের ঘাতক দালাল আর যুদ্ধাপরাধী দের থেকে?

প্রেস ফ্রিডম নেই বলেই কি
শারমীন হোসেন বঙ্গবন্ধু-তাজ অন্তরঙ্গ জুটিতে কলঙ্ক লিপে দিলেন?

প্রেস ফ্রিডম নেই বলেই কি
 ঘাতক দালালের  ভাত রেডি হয়ে গেলো?

কাশ্মীর বিতর্ক -মোদি যে কারণে ঝুঁকিপূর্ণ:কুলদীপ নায়ার

লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দুই-তৃতীয়াংশ আসনের মধ্যে সৌভাগ্যক্রমে কাশ্মীরের নামটা নেই। ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) তার নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছে, তারা ক্ষমতায় গেলে সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদটি মুছে ফেলা হবে। এই অনুচ্ছেদে এই রাজ্যটিকে বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। এটা কোনো নতুন ব্যাপার নয়। বিজেপি অনেক দিন ধরেই এ কথা বলে আসছে। কিন্তু তা খুব একটা হালে পানি পায়নি। এর পরই নরক নেমে এল। এমনকি পাকিস্তানি সেনাপ্রধানও এই তর্কে নেমে গিয়ে ঘোষণা করলেন, কাশ্মীর হচ্ছে তাঁর দেশের ‘রক্তনালি’।

বিহারের বিজেপি নেতা গিরিরাজ সিং যে মন্তব্য করলেন, যাঁরা মোদিকে ভোট দেবেন না, তাঁদের পাকিস্তানে চলে যাওয়া উচিত, তাঁর এই কথায় পুরো পরিস্থিতিটা কিছুটা হলেও নষ্ট হলো। কিন্তু বিজেপি এই বক্তব্যকে গ্রহণ না করায় যে ধুলা জমেছিল, তা কেটে যেতে শুরু করল।

সন্দেহ নেই, কাশ্মীরের নেতা ফারুক আবদুল্লাহর মন্তব্যে জল আরও ঘোলা হলো। তিনি বলেন, যাঁরা মোদিকে ভোট দেবেন, তাঁদের সমুদ্রে ঝাঁপ দেওয়া উচিত। তার পরও আবদুল্লাহ যে মন্তব্য করলেন, তাতে পরিবেশটা নষ্ট হয়নি, কারণ তিনি আগেও এরূপ সুরে কথা বলেছেন। তা কখনো গুরুতরভাবে নেওয়া হয়নি।

বড় ক্ষতিটা করেছেন মোদি নিজে, ভোট পাওয়ার জন্য তিনি এহেন কাজ নেই, যা করতে দ্বিধাবোধ করেন। তিনি পরিবেশকে এমনভাবে বিষিয়ে তুলেছেন যে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যকার এই দূরত্ব ঘোচাতে অনেক সময় লেগে যাবে। কাশ্মীরের বিরাজমান পরিস্থিতির জন্য মোদি শেখ আবদুল্লাহকে আক্রমণ করেছেন। ঐক্য-প্রক্রিয়াবিষয়ক কোনো তথ্য মোদির কাছে নেই। কিন্তু শেখ সাহেবের কাছে এমন কোনো জনপ্রিয় ও ঋজু নেতা নেই, যিনি মুসলমান-অধ্যুষিত কাশ্মীরের সঙ্গে হিন্দু-অধ্যুষিত ভারতের সম্মিলন ঘটাতে পারেন।


শেখের ছেলে ফারুক আবদুল্লাহ বলেছেন, কাশ্মীর সাম্প্রদায়িক ভারতের অংশ হবে না। এ কথায় সাম্প্রদায়িকতার ইঙ্গিত। সব অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে একত্র হয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়তে হবে। ফারুককেও এ লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হবে। এ দেশকে আমাদের অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে।

এ সমস্যার সমাধানে তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। একই সঙ্গে পাকিস্তানেও যাঁরা স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের জন্যও এটা গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু পাকিস্তানের স্বার্থের গুরুত্বের কথা বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি শেখ আবদুল্লাহকে ইসলামাবাদে পাঠিয়েছিলেন, একটি অভিন্ন স্বার্থ খোঁজার লক্ষ্যে। শেখ পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সঙ্গে দেখা করেছিলেন।

১৯৬৪ সালে শেখ আইয়ুব খানের সঙ্গে দেখা করেন, অচলায়তন ভাঙার এটাই ছিল শেষ প্রচেষ্টা। আইয়ুব ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে ইসলামাবাদে আমাকে বলেছিলেন, ‘নেহরু জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতায় আসার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর চোখে সে উদ্বেগও দেখা গেছে।’

কিন্তু শেখের সফর থেকে তেমন ইতিবাচক কিছু আসেনি। আলোচনা যখন চলছে, নেহরু তখন মৃত্যুশয্যায়। সুতাটাকে টেনে লম্বা করার ব্যাপারে পাকিস্তানের উদ্বেগ ছিল। কিন্তু শাস্ত্রী-আইয়ুব বৈঠকে কোনো সমাধান আসেনি। শাস্ত্রী কাশ্মীর বিষয়ে আলোচনা করতে না চাইলে এক হতাশা এসে ভর করে। এমনকি এ বিষয়টি যৌথ ঘোষণায়ও আসেনি। অথচ এ বিষয়ে ভারত-পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক হওয়ার কথা ছিল।

আজাদীর কথা বললে, জঙ্গিরা এটা বুঝতে পারে না যে তালেবানরা যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, এর ফলে কাশ্মীরের বিদ্রোহীরা মৌলবাদী হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। চরমপন্থী শাহ আবদুল গিলানি এ ধারণাকেই তেল-জল দিয়ে পুষ্ট করেছেন যে রাজ্যের স্বাধীনতার দাবি ও ধর্মীয় আবেগ একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।

পাকিস্তানে যারা কাশ্মীরের স্বাধীনতার ঘোরতর বিরোধী ছিল, তারা এখন শান্ত। ক্ষমতাসীনদের কেউ কেউ স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলে থাকেন, এই আশায় যে স্বাধীন কাশ্মীর হয়তো শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দেবে।
যারা এ দাবি তুলেছে, তাদের এটা বুঝতে হবে, কাশ্মীর উপত্যকায় বসবাস করে তারা দুটি অঞ্চল জম্মু ও লাদাখের ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারবে না। তাদের দাবি যতই সৎ হোক। প্রথমোক্তটি স্বরাজ্যেও ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করার সময় ভারতের সঙ্গেই যোগ দেবে। দ্বিতীয়টি ভারতের ইউনিয়ন রাজ্যে রূপান্তরিত হতে চাইবে। সে কারণে স্বাধীনতার দাবি উপত্যকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এই ভূমি দ্বারা আবদ্ধ উপত্যকা অর্থনৈতিকভাবে দাঁড়াতে পারবে কি না, সে তর্কে আমি যাব না। কিন্তু জম্মু ও লাদাখে কোনো অনুসারী না থাকা সত্ত্বেও এই দাবি করা সমীচীন কি না, এই প্রশ্ন তাদের কাছে আমি রাখতে চাই।
এ কারণেই কাশ্মীরের মূল উপত্যকার বাইরে আর কোনো স্বাধীনতাকামীদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। নরমপন্থী মিরওয়াইজ উমর ফারুক যে কাশ্মীর প্রশ্নে অভ্যন্তরীণ নীতির ঊর্ধ্বে ওঠার আহ্বান জানিয়েছেন, তা তেমন হালে পানি পায়নি। তিনি বলেন, ‘আমরা একত্রে একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হব।’ কিন্তু ভারতে তাঁর কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। তাঁর বাবা বরং বাস্তববাদী ছিলেন। তিনি ভারতীয় ইউনিয়নের মধ্যে, তবে এর সংবিধানের বাইরে কোনো সমাধান চাইতেন। পরে জঙ্গিরা তাঁকে হত্যা করে।

মোদি ও বিজেপির জয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার মানসিকতাকে আমি সমর্থন করি। কিন্তু নয়াদিল্লিতে আগেও বিজেপি সরকার ছিল। হিন্দুত্ববাদের তীব্র একটা রূপ হচ্ছে মোদি। কিন্তু সংবিধান হচ্ছে সর্বেসর্বা, এই সংবিধান আইনের চোখে সবার সম-অধিকারের কথা বলে। এ ছাড়া ভারত হাজার হাজার বছর ধরে একটি বহুধর্মীয় সমাজ।
মোদি তাঁর বক্তৃতায় বলেন, নির্বাচিত হলে সবাইকে সঙ্গে নিয়েই তিনি উন্নয়নে মাঠে নামবেন, এটা তাঁর এজেন্ডাও বটে। তিনি যদি এই বহুত্বকে বিনষ্ট করেন, তাহলে এই দেশের গণতান্ত্রিক ও উদার শক্তিগুলোর অন্তত এতটা শক্তি ধারণ করে যে তাঁরা বহুত্বের পক্ষে, স্বাধীনতাসংগ্রামের চেতনার পক্ষে লড়াইয়ে নামতে পারবেন।
ভারতের সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদে জম্মু ও কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। মোদি ও তাঁর দল এটা বাতিল করতে পারবে না, কারণ রাজ্যটি এই শর্তেই ভারতীয় ইউনিয়নে যোগদান করেছিল। রাজ্যটি চাইলে এই শর্ত পরিবর্তন করতে পারে। কাশ্মীর সমস্যা তিন পক্ষেরই আয়ত্তের বাইরে—ভারত, পাকিস্তান ও কাশ্মীর। এটা কঠিন, কারণ বিজেপি এই ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিলের দাবি জানিয়েছে। এটা করলে, নেহরু ও আবদুল্লাহর মধ্যকার বোঝাপড়ার সঙ্গে বেইমানি করা হবে।

৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল করা হলে ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের যুক্ত হওয়া নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠবে, ফারুক আবদুল্লাহ যার হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন। এতে একটা বিষয় আছে। আদিতে এই অনুচ্ছেদ কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সমর্পণ করেছে। এর সঙ্গে সম্পর্কিতভাবে অনেক ভারতীয় আইন এখানে প্রযোজ্য হয়েছে, এমনকি রাজ্য আইনসভার অনুমোদন ছাড়াই। এগুলোকে সরাতে হবে। ভারতীয় ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরপরই রাজ্যটি যে মর্যাদা ভোগ করত, তা পুনরুদ্ধার করা গেলে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত: প্রথম আলো
কুলদীপ নায়ার: ভারতের সাংবাদিক।

Monday, April 28, 2014

ইট মারলে পাটকেল খেতে হয় -কামাল লোহানী


এমনিতেই এবি সিদ্দিকের অপহরণকে অনেকেই নাটক বলতেও ছাড়ছেন না, তার ওপর আবার ম্যাডাম খালেদা জিয়ার পরোক্ষ ইঙ্গিতবহ এক মন্তব্য দেশবাসীকে নতুন করে সন্দেহ, নাটকীয়তা এবং বিভ্রান্তির গোলক ধাঁধায় ফেলে দিয়েছে। তিনি বেশ জোরগলায়ই বলেছেন, অবৈধ সরকার পতনের ভয়ে এবি সিদ্দিককে ছেড়ে দিয়েছে। তাকে ছেড়ে দিয়ে সরকার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। (যা হোক, বৈধ কি অবৈধ প্রশ্নটি না তুলে এই বুঝি প্রথম সরকারের প্রশংসাই করলেন ম্যাডাম)।
 অবশ্য পরেই বলেছেন, না হলে এখান থেকেই সরকার পতনের আন্দোলন শুরু হতো। পরে আবার এ অপহরণ ও ছেড়ে দেয়ার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন।

কিন্তু ম্যাডাম আমার প্রশ্ন, বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সিলেটের ইলিয়াস আলী আজ দু’বছর হলো অপহৃত হয়েছেন, সে ব্যাপারে তো আন্দোলন শুরুর কোন কথা গত দু’বছরে বলেছেন বলে তো আমার মনে পড়ে না। তো সিদ্দিক সাহেব অপহৃত হওয়ায় এতই ক্ষুব্ধ হলেন কেন যে, একেবারে সরকার পতনের আন্দোলনই শুরু করে দিবেন? আর কতবার সরকার পতনের আন্দোলনের হুমকি দেবেন? নাকি, সত্যিই এবার শুরু করেই ফেলবেন? প্লিজ, শুরু করুন না। 

আমরাও সংক্ষুব্ধ, সঙ্গ দিতে পারব না তবে দূর থেকে হাততালি দেব। নাকি আপনাদের ‘আন্দোলন’ ‘আন্দোলন’ ফানুসটা ফুটে হয়ে গেছে? শুনলাম, জামায়াত কিছুটা বৈরী। হয়ত জোট (১৯ দল) ছাড়তেও পারে। তাই বোধহয় ‘অনাস্থা’ দেখা দিয়েছে মনে কারণ গত সময়ের আন্দোলনে আপনাদের নেতাদের ময়দানে-রাজপথে দেখা যায়নি। আপনি তাতে ক্ষোভও প্রকাশ করেছিলেন। গত বছরের তথাকথিত আন্দোলন নামের সহিংসতা তা-ব তাই তো দেখা যায় যে হিংস্রতায় ঘটিয়েছেন, মানুষ পুড়িয়ে মেরেছেন, ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছেন, তা তো আপনাদের জোটের পেয়ারা দোস্ত জামায়াতই ঘটিয়েছে। এবারের ‘পতন আন্দোলন’ কাকে নিয়ে করবেন? দিশেহারা হয়ে মায়ে-ব্যাটায় পাগলের প্রলাপ বকে চলেছেন। শেষ পর্যন্ত বেচারা সিদ্দিককেও ভর করতে চেয়েছিলেন বলে বক্তব্য দিয়েছেন।

বুঝলাম না, সিদ্দিক সাহেব বিএনপির কি আন্ডারগ্রাউন্ড সদস্য যে তাকে না মুক্ত করতে পারলে সরকার পতনের আন্দোলনই করে ফেলতেন। ভাগ্যিস, করেননি। তবে ম্যাডামের এমত আস্ফালন বেচারা সিদ্দিক সাহেবের অপহরণ ও মুক্তির ঘটনাকে আরও সন্দেহগ্রস্ত করে তুলেছে সাধারণ নাগরিকদের কাছে। সামাজিক গণমাধ্যমে যে যা ভাবছে, লিখে যাচ্ছেন। ভাল-মন্দ কোনটাই বিচার করার সুযোগ তো জনগণের নেই, তাই যারা বিত্তশালী সংশ্লিষ্ট সংগঠক-কর্মী তারাই কেবল কথা বলছেন, তা কিন্তু নয়, এখন তো কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হচ্ছে অনেকক্ষেত্রেই।


এর মধ্যে খালেদা জিয়ার সিদ্দিক-রিজওয়ানা প্রসঙ্গে বক্তৃতবাজি আগুনে যেন ঘি ঢেলে দিয়েছে। মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি বলেই ভাবছেন বহুজন। তাই সবার ধারণা ডাল মে কুছ হ্যায়। অন্যদিকে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, বেলার নির্বাহী প্রধান, ঃধষশবফ ধনড়ঁঃ পরিবেশবাদী সংগঠক-আইনজীবী, যিনি সাহসের সঙ্গে পরিবেশ শুদ্ধ রাখার কাজে অসাধারণ কৃতিত্ব ও মেধার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি কিন্তু সরকারের সমালোচক হয়েও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী নিজেই এই ঘটনাটি তদারক করেছে বলে এত চটজলদি তার স্বামী মুক্তি পেয়েছেন বলে প্রশংসাও করেছেন। 


ভদ্রমহিলা কুশলী পরিবেশ নেত্রী, তিনি গণমাধ্যম, নিরাপত্তারক্ষী বাহিনী ও র‌্যাব পুলিশদের সাধুবাদ জানিয়েছেন। আবার তিনিই নারায়ণগঞ্জ থানায় কর্তাদের ওখানকার টর্চার সেলও খুঁজে দেখতে নাকি বলেছিলেন। এতসব বলেকয়েও ওরা দু’জনাই সিদ্দিক এবং রিজওয়ানা বহু সন্দেহের উদ্রেক করেছেন। তদন্তকারী কর্মকর্তারা তো সিদ্দিকের অসংলগ্ন তথ্য দেয়ায় রীতিমতো বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। 

ওদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা বলেছেন, রিজওয়ানা কার স্বার্থে এমন করেছেন? ম্যাডাম খালেদা জিয়া না হয় রাজনৈতিকভাবে শাসক দলকে শায়েস্তা করার অজুহাত সুযোগ খুঁজছেন। ক্ষমতায়, যখন ১৪ দল অর্থাৎ গণতান্ত্রিক ঐক্যের সরকার; তখন খালেদা তো অবশ্যই তাকে খোঁচাতে পারলে ছাড়বেন কেন? কিন্তু সে খোঁচা যে তার বা তাদের ওপরই পড়বে, সেটা তো ভাবেননি। তিনি এবং তার পলাতক জ্যেষ্ঠ পুত্র যে ইতিহাস বিকৃতির অপপ্রয়াসে মত্ত হয়ে উঠেছিলেন, তাকে খুব একটা জমাতে বা জনগণকে খাওয়াতে ব্যর্থ হয়ে ডুবন্ত ব্যক্তির মতন খড়কুটো ধরে বাঁচার চেষ্টা করেছিলেন। সেটা একেবারেই ব্যর্থ হয়েছেন। ধুয়া ধরেছিলেন পরিষদ দলে কোরাসেও কিন্তু কোন ফায়দা হলো না। তাই যখন তিস্তা অভিমুখে লংমার্চ করতে যাচ্ছেন এবং আগেই চিৎকার করতে শুরু করেছেন যদি বাধা দেয়া হয় তবে তার দায় সরকারকেই নিতে হবে। এসব উল্টাপাল্টা এবং আগাম হুমকি ধমকি দিয়েছেন।

মাননীয় ম্যাডাম, এমন কথা যে বলবেন এবং এরই অছিলায় নানান ঝঞ্ঝাট বাধাবেন, তা তো আমরা জানিই, আপনার কথা শুনতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারলাম না। আজ থেকে আট বছর আগে যখন আপনারা গদিতে ছিলেন, তখন কেন কোন উদ্যোগ, পদক্ষেপ বা আন্দোলন শানাননি? তখন কি ভেবেছিলেন? ভারতকে কোনভাবে তোষণ করা যায় কিনা! ম্যাডাম বিরোধীদলীয় নেত্রী (সংসদে না গিয়েও) নিজেকে যখন দিল্লী গিয়ে লাল গালিচা সংবর্ধনা নিয়ে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে স্বার্থ নিয়ে কথা বলছিলেন, তখন কি করে তিস্তার মতন এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলাপ করতে ভয় পেলেন? লাল গালিচা কালো হয়ে যাবে সেই ভয়ে?


আবার গ্যাস, বিদ্যুত নিয়ে যখন কথা বলেন, তখন কি খেয়াল থাকে না কী সব কেলেঙ্কারী করেছেন সেই আপনাদের জমানায়? বিদ্যুতের জন্যে তো ১০-১০টা তরজাতা জোয়ান মরদকে মেরে ফেলেছিলেন, সে কথা কি খেয়াল আছে? এখন এ সরকারের বিদ্যুত সংকট সমাধানের উপায় দেখে এত গোস্বা হন কেন? বর্তমান সরকার তো তবু সংকট সমাধানে চেষ্টা চালাচ্ছে। সেখানে আপনারা সহযোগিতা তো দূরের কথা, সমালোচনা করছেন। কারণ উন্নয়ন রুখতে পারলে নিজেদের গৌরব বাড়বে বলে মনে করছেন বুঝি। জানুয়ারির নির্বাচন বয়কট করে মার্কিনীদের তেলাতে গিয়ে কী সর্বনাশটাই না নিজেদের করেছেন, এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছেন। তাই মাথা খুটে মরবেন আর সভা-সমাবেশে মিথ্যাচার-অপপ্রচার দিয়ে সে অজ্ঞতা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞার দীনতা ঢাকতে চেষ্টা করছেন। এতে কোন লাভ হবে না। সত্যিই গাড়ি মিস্ করেছেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আগে শেখ হাসিনা আপনাদের অংশগ্রহণের জন্য এমনকি আলোচনায় বসার দাওয়াতও দিয়েছিলেন কিন্তু গ্রাহ্য করলেন না। যদি রাজনৈতিকভাবে গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন তাহলে নির্বাচনে অংশ নিতেন এবং সত্যিই জনগণের কল্যাণ ও ভালো চাইলে করার জন্য ক্ষমতা বসতে পারতেন। 


আসলে বিএনপির আন্দোলনের সাহস এবং শক্তি তো জামায়াতই। তাই এই রাজনৈতিক টানাপোড়েনের সময় জামায়াত কোনক্রমেই বিএনপিকে ত্যাগ করবে না এটা যেমন সত্য, তেমনি এটাও ধ্রুব সত্য যে, বিএনপিও জামাতকে ছেড়ে ডাঙ্গায় ইলিশ এর প্রাণ। কি কোরে এই পূত পবিত্র বন্ধন ছিন্ন করবে তারা? তাই তো আওয়ামী ঝাঁক ধরে যোগ দেয়াটা যেমন লোক দেখানো, তেমনি এই যোগদানকে কৌশল হিসেবেই বিবেচনা করা উচিত আওয়ামী লীগেরও। এতে পুলকিত হবার কিংবা ফুল দিয়ে বরণ করার বিষয় এটা নয়। জামায়াতীরা নিষিদ্ধ হবার আগে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছে। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগে যোগ দিলে দুটো লাভ ওদের। এক. নিরাপদ আশ্রয় মিলল; দুই. আওয়ামী লীগ থেকে জামায়াতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন সহজ হবে। এ কৌশল নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ বুঝতে পারছে, তাই ওদের সতর্ক হওয়া উচিত। কারণ এর ফলে আওয়ামী লীগের জনভিত্তি নড়বড়ে হতে থাকবে ওদের নানান নাশকতামূলক কার্যক্রমে। ক্ষতি আওয়ামী লীগেরই হবে আর জামায়াত চক্রের লাভ হবে। ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’। 


আওয়ামী লীগকেই লোকে দোষারোপ করতে থাকবে। তাতে পরোক্ষ কেন বিএনপিরই সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক ফায়দা হবে। যতই আওয়ামী মহল বলুক না কেন এগুলো জামায়াতী বা শিবির গোপনে ঢুকে এ সহিংসতা বা গণবিরোধী কাজ করে আওয়ামী লীগের ফুটহোল্ড দুর্বল করে গেছে। তাই সাবধান!

বিভিন্ন পত্রিকার খবরে জানতে পারলাম যে বিএনপি’র গাড়ি বহরের ঢাকা থেকে তিস্তায় পৌঁছতে কোন সরকারী বাধা, দলীয় সন্ত্রাসের মোকাবিলা করতে নাকি হয়নি। 


বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারের সমালোচনা করে বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা করে জনগণ বিশেষ করে দলীয় সমর্থকদের উসকে দেবার চেষ্টা করেছেন কিন্তু জনগণ তাঁদের কথা শুনেছেন কিন্তু রুষ্ট বা রুদ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি। তাই মোটরে চড়ে লংমার্চ শান্তিপূর্ণ হয়ে গেল। হায়রে বিএনপি, এত গর্জন করে নানা দোষারোপ করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চেষ্টা করেছিল। ব্যর্থ হলো। আশঙ্কা বাস্তব হলো না। তাহলে কি করতে হবে? এই অবৈধ সরকার ব্যর্থ পানি আনতে তো এদের সরিয়ে জনগণের সরকার আনলে পানি সমস্যা দূর হবে। 

মির্জা ফখরুলের সরকার পতনের আন্দোলন সেভাবে সাড়া পেল না। নীলফামারীর বিএনপি নেতা কেউ নাকি একটি বিশেষ চ্যানেলকে বলেছিল, ডালিয়া পয়েন্টে তিন লাখ লোকের সমাগম ঘটবে। এই আশাবাদ প্রচার করে বিএনপি সমর্থকেরা ভেবেছিল জনগণকে ভাঁওতা দেয়া যাবে। কিন্তু তা তো হলো না। কত লোক জমায়েত হয়েছিল বিএনপি সমর্থক চ্যানেলগুলোই বলুক না কেন! আবার এদেরকে তিস্তায় পানি বাড়তে দেখে বিএনপি পাছা চাপড়ে বলেছে, তাদের মার্চের কারণেই তিস্তায় পানি ছেড়ে দিয়েছে। সত্যিই, মমতা অথবা মনমোহন ভয় পেয়েছে বিএনপির গাড়ি মার্চকে, তাই পানি ছেড়েছে। 

মনে রাখবেন, মমতার জন্যে অনেক সমস্যা বাংলাদেশের, হাল হয়নি। কিন্তু ঐ ভদ্রমহিলার কপটতার কারণে আমরা সাফার করছি এতকাল। হঠাৎ কেন জল ছেড়ে দিল? ভারতে নির্বাচন। পশ্চিমবঙ্গেও ভোটগ্রহণ চলছে। শেষ হবে ১২ মে। তো কপটতার আশ্রয় নিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে তিনি পারঙ্গম। তাই হয়ত, এবার এমনি একটি হঠাৎ মমতা দেখিয়েছেন। আমার ধারণা, সবাই তো জানে মমতার কারণেই তিস্তাচুক্তি হচ্ছে না। পানিও যথাযথ পাচ্ছি না। সেই হয়ত উদারতার মমত্ব দেখিয়েছে। না, তা নয়।

 মনে রাখবেন, পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমকে যেভাবেই হোক ঠেকাতে মমতা বদ্ধপরিকর, যে ছলে বলে কৌশলে, সেভাবেই হোক না কেন নির্বাচনে জয়ী হবার জন্য ছিটমহল সম্পর্কে যে কৌশল নিয়েছে একই কৌশল হয়ত এখানেও নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে বেকায়দায় ফেলবার জন্য হয়ত এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাহলে যদি বিএনপি চক্র নির্বাচন করেই এবং জয়লাভ করে যায়, তাহলে যেন মিত্রতার হাত বাড়িয়ে মমতা বলবেন, দেখুন কেরামতি। কেন্দ্র আমার ওপর দোষারোপ করছিল আমি নাকি চুক্তি হতে দিচ্ছি না। তাহলে এ পানি এলো কোত্থেকে?

 যাক গে, এত কষ্টের মধ্যে থেকেও বিএনপির জনসমাবেশে মানুষের যে ঢল নামবার কথা নাকি ছিল, তা কেন হলো না? তবে কি সেই পুঁথির পাঠ মনে করব। লাখে লাখে লোক মরে, শুমার করিয়া দেখে চল্লিশ হাজার। এবার তিস্তাপাড়ে মানুষ আসলেন না, তাতে মনঃকষ্ট বাড়ত বৈ কমত না। না গিয়ে ভালই করেছেন। লোকে বলছেন, এতদিন হয়ে গেল, ম্যাডাম পলিটিক্স বুঝতে পারছেন, তাই এই সরকারের বিরুদ্ধে যাবার প্রশ্নে দলের জনসম্পৃক্ততা বাড়লো সেটা যাচাই করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যাক, সফলভাবেই শেষ হয়েছে মোটরযান যাত্রা। 

বর্তমান সরকার এক গেলাস পানিও আনতে পারেনি বলে বিএনপি নেতারা বক্তৃতায় গলা উঁচিয়ে কথা বলেছেন। জিয়ার সময় বিএনপি পেরেছিল। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলো এমনি পাল্টাপাল্টি বক্তব্য-সন্ত্রাস করে থাকে। এতে রাজনৈতিক ঘোলাটে হয় এবং পরিবেশ দূষিত হয়। ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতা, অসন্তোষ বাড়ে এবং জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ায়। এসব দূরাচারী নিপীড়নমূলক আচরণ বন্ধ করতে হবে। না হলে কলঙ্কিত রাজনৈতিক দিনপঞ্জির পৃষ্ঠা বাড়তেই থাকবে। ইট মারলে পাটকেল খেতে হয়। সে কি আদৌ রাজনীতি? জনগণের?


লেখক : সাংবাদিক

Sunday, April 27, 2014

সাম্রাজ্যবাদের অভিশপ্ত সেবাদাসেরা রক্তের জামা পরিয়ে মুজিবকে বিদ্ধ করেছে বুলেটে - বালুচ কবি গুল খান নাসির

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা - ভোর কোথায়?


বেলুচিস্তানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি 

মীর গুল খান নাসির (১৯১৪-১৯৮৩)


  বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত

 ছিলেন।   নিজ জনগোষ্ঠীর 

স্বাধীনতার পক্ষে  কথা বলার কারণে 

এই বালুচ  কবি  পাকিস্তানি 

শাসকদের হাতে নির্যাতিত হন। 


১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট


 বাংলাদেশে একদল কুলাঙ্গার

সেনার  হাতে যখন  জাতির পিতা

 বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত

 হন, তখন  মীর  গুল খান নাসির ছিলেন 

হায়দ্রাবাদের কেন্দ্রীয় কারাগারে 

বন্দী। কারাগারে বসে, বঙ্গবন্ধু হত্যার ১৪ দিন পর ২৯ আগস্ট 

তিনি এই কবিতাটি লেখেন। 


বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এটাই সম্ভবত প্রথম কবিতা, 

যাতে মীর গুল খান নাসির যথার্থভাবেই জাতীয় জীবনে এই 

হত্যার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এবং সাম্রাজ্যবাদী চক্রের মুখোশ 

উন্মোচন করেছেন।



 ইতিহাসের নৃশংসতম এই হত্যাকাণ্ড যে বাংলাদেশের 

রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অপূরণীয় ক্ষতি 

বয়ে এনেছে, মীর গুল খান নাসিরের কবিতায় তারই আগাম 

প্রতিধ্বনি ছিল। বালুচ ভাষায় লেখা কবিতাটি ইংরেজিসহ বিভিন্ন 

ভাষায় অনূদিত হয়।


 এখানে ইংরেজি থেকে বাংলা ভাষান্তর প্রকাশ করা হলো:

চিৎকার, ক্রন্দন আর শশব্যস্ত আহ্বানের মাঝে 

উল্লাস করছে অন্ধ জনতা।


ওরা বলে, ‘এখন ভোর’, কিন্তু জীবনপানে তাকিয়ে 

আমি দেখি রাত্রি, ঘোর অমানিশা। 


বিদ্যুৎ চমকানো আর বজ্রপাতে মনে হয় দূরে বৃষ্টি হচ্ছে, 

কিন্তু বাতাসে বৃষ্টির নাম-গন্ধ নেই 

রক্তের ধারা বইছে প্রবল। 


হে নির্বোধের দল, কোথায় উজ্জ্বল প্রভাত? 


এখানে এখনো ক্রুদ্ধ রাত

এজিদরূপী সাম্রাজ্যবাদীরা এখনো চূর্ণ করছে

সাহসী দেশপ্রেমিকের হাড়, 

জনবহুল, চিত্রময় বাংলাদেশে আবারও রক্তের ঝড়। 

সাম্রাজ্যবাদের দালালেরা আবারও জ্বালিয়ে দিচ্ছে গ্রাম-নগর, 

মহান দেশপ্রেমিক মুজিব নিজ রক্তের সাগরে শায়িত

সাম্রাজ্যবাদের অভিশপ্ত সেবাদাসেরা তাঁকে 

রক্তের জামা পরিয়ে দিয়েছে এবং বিদ্ধ করেছে বুলেটে

এজিদের বিরুদ্ধে হোসেনের কাহিনির পুনরাবৃত্তি। 


হে সাহসী কমরেডগণ, এজিদ থেকে সতর্ক হও, 

তোমরা যদি ঐক্যবদ্ধ হও, পরাস্ত হবে তারা 

তাদের মুখ তাদেরই কিন্তু জবান সাম্রাজ্যবাদীদের।

সেবাদাসেরা ব্যর্থ হয়েছে এবং তাদের পকেট স্ফীতকায়

এবং সাহসী দেশপ্রেমিকদের খতম করে দিতে 

সাম্রাজ্যবাদীদের কাছ থেকে জোগান আসতেই থাকবে

তারা পাঠাবে ভাড়াটে লোক ও অস্ত্র

এই কাপুরুষদের কোনো দয়া-মায়া নেই, 

এদের কারণেই বিশ্বে এখন ঘোর অন্ধকার। 


মুক্তির শিখা কোথাও জ্বলে উঠলে এরা তা নিভিয়ে দেয় দ্রুত 

বঙ্গবন্ধু মুজিব সপরিবারে নিহত ওদের হাতে

আবারও, স্বাধীনতার পতাকা অর্ধনমিত। 

সাম্রাজ্যবাদীরা আবারও ফিরে গেছে তাদের সেই পুরোনো

চক্রান্তে, বিশ্বাসঘাতকতায় 

আবারও দ্বন্দ্বের ফয়সালা হচ্ছে বন্দুকের নলে

আবারও সোনার জমিনে জ্বলছে আগুন 

হে বন্ধুরা, এভাবেই সময়ের মুখোমুখি আমরা 

আমার মাতৃভূমি বেলুচিস্তানও জ্বলছে এখন 

ভয় পেয়ো না হে সাহসী যোদ্ধারা, থেমে যেয়ো না, 

কণ্টকিত দুর্গম পথ এখনো অনেক বাকি। 


মুজিবের রক্ত কখনোই বৃথা যাবে না, 

দেশপ্রেমিকের জন্য এ এক অগ্নিপরীক্ষা। 

বেশিক্ষণ নয়; কুয়াশা ও আঁধার সত্ত্বেও

এই ভয়াল রাত্রি দ্রুত কেটে যাবে

হৃদয় দিয়ে নাসির স্পষ্ট দেখতে পায়

বিজয়-পতাকা উড়ছে। 


অনুবাদ: রিজওয়ান উল আলম

৩০ লাখ শহীদ ॥ এ সময়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে কেন? -মুনতাসীর মামুন

ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান যখন যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে প্রথম ডকুমেন্টারিটি করেন তখন তিনি বাংলাদেশের আইনবিদ ও রাজনীতিবিদ ড. কামাল হোসেনের জ্যেষ্ঠ কন্যাকে বিয়ে করেননি। ডেভিড-কে নিয়ে তখন আমরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছি স্বাভাবিকভাবেই। কারণ, যুদ্ধাপরাধ বিচার নিয়ে তখন আন্দোলনের শুরু। লন্ডনেও তখন ড. কামালের কন্যা সারাহ্্ ও বাঙালী তরুণ-তরুণীরা এ প্রক্রিয়ায় অংশ নিচ্ছেন। ডেভিড-কেও তখন তাদের সঙ্গে দেখেছি। এর পর ডেভিড এসেছেন এদেশে মাঝে মাঝে, যোগাযোগ হয়েছে আমাদের অনেকের সঙ্গে, তারপর একসময় ড. কামাল হোসেনের জামাতা হিসেবে এ দেশেই ফিরে এসেছেন। এখন ইংরেজী দৈনিক দি নিউএজে কাজ করছেন। 

যুদ্ধাপরাধ বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ নিয়ে ডেভিড বিভিন্ন প্রতিবেদন লেখা শুরু করলেন পত্রিকায় এবং এ প্রতিবেদনগুলোতে আমরা দেখলাম, আগের ডেভিড নেই। যে প্যাশন নিয়ে তিনি এক সময় যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে নেমেছেন এখন দেখা যাচ্ছে, সেই একই প্যাশন নিয়ে যুদ্ধাপরাধ বিচারের বিরুদ্ধে নেমেছেন। এর কারণটি কী তা আমরা বুঝতে অক্ষম। জামায়াতের লবিস্ট/আইনজীবীরা বিদেশে বিচার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে যা বলছিল, ডেভিডের ভাষাও ক্রমে দেখা গেল সেরকম হয়ে যাচ্ছে। জামায়াত প্রচুর পয়সা দিয়েছে এবং দিচ্ছে লবিস্টদের। এক প্রতিবেদনে দেখেছিলাম, মীর কাশেম আলী ২৫ মিলিয়ন ডলার দিয়েছেন লবিস্টদের। সত্য মিথ্যা জানি না। ডেভিডের মতো একইরকমভাবে ইকোনমিস্ট ও আল জাজিরাও যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে প্রচার করছে। একসময় আল জাজিরা যুদ্ধাপরাধের বিচারের পক্ষে বলেছিল। এ দু’টি প্রতিষ্ঠানেরই মালিক নাকি কাতারের শেখ পরিবার। এসবের সঙ্গে ডেভিডের সম্পর্ক আছে কী না জানি না, কিন্তু তার বক্তব্য তাদের মতোই। 


যুদ্ধাপরাধ বিচার নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করায় ডেভিড-কে ইতোমধ্যে আদালত তলব করেছে। ডেভিড-কে দমানো যায়নি কারণ তার বোধহয় এই প্রতীতি জন্মেছে যে, দেশের সেরা আইনবিদ ও সুপরিচিত আইনবিদের তিনি পরিবারভুক্ত। তার কেশাগ্র কেউ স্পর্শ করতে পারবে না। 

সম্প্রতি ট্রাইব্যুনালে আবারও ডেভিডকে তলব করা হয়েছে আদালত অবমাননার জন্য। কোন একটি লেখায় ডেভিড মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। এ নিয়ে ২৪ তারিখে ‘দি হিন্দু’ পত্রিকায় ডেভিড একটি কলামও লিখেছেন। বর্তমান নিবন্ধ সেই প্রবন্ধ নিয়ে। প্রথমে দেখা যাক ডেভিডের বক্তব্য কী? 
বাংলাদেশ সরকার সবসময় বলে আসছে পাকিস্তানী ও তার সহযোগীরা ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে এটি কি ঠিক? [তার ভাষায় এটি কি ‘ফেয়ার এস্টিমেট’?]

এটিই মূল বক্তব্য এবং তারপর এই বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য নানা ‘তথ্য প্রমাণ’ হাজির করেছেন। তার মতে, স্বাধীনতার ৪০ বছর পেরিয়ে গেলেও বিষয়টি এখনও স্পর্শকাতর। এ স্পর্শকাতরতার কারণ, জন্ম থেকেই একটি শিশু এ কথা শুনছে স্কুলে এটি পড়ানো হয়। দেশের কবিতা-সংস্কৃতির বুননে তা ঢুকে গেছে। সুতরাং এ নিয়ে প্রশ্ন করা একটি গভীর বিশ্বাসকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা।


ডেভিডের মতে, যিনি এ কথা প্রথম বলেছেন তিনি এদেশের স্বাধীনতার নেতা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। এভাবে বাক্য বিন্যাসের কারণে বোঝা যায়, আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনাকে তার খুব একটা পছন্দ নয়। কারণ, পরবর্তী বাক্যে লিখেছেন, এ সংখ্যাটি বেশি বলে আওয়ামী লীগের নেতা ও সমর্থকরা। 

ডেভিড লিখেছেন, ১৯৭১ সাল নিয়ে রক্ষণশীল যে জাতীয়তাবাদী ডিসকোর্স তৈরি হয়েছে তা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অবস্থানের অংশ বা বিরোধী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের বিপরীত। এমনকী, তার মতে, এ সংখ্যা নিয়ে কেউ সন্দেহ প্রকাশ করলে অনেক আওয়ামী লীগার তাকে স্বাধীনতাবিরোধী বা ‘অপজিশনাল মাইন্ডসেট’ বলে আখ্যা দেবে।
সুতরাং বাংলাদেশে ৩০ লক্ষ মৃত-কে নিয়ে যে প্রশ্ন করবে তার মাথা নিচু করে থাকতে হবে, ভীত থাকতে হবে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও ব্যক্তিগত আক্রমণের আশঙ্কায়। 

ডেভিড বার্গম্যানের এ বক্তব্য নিয়ে প্রথমে আলোচনা করা যাবে। এটি ঠিক, আমাদের হৃদয়ে এবং ১৯৭১ সালের পর যাদের জন্ম তাদের মাথায় ৩০ লক্ষ শহীদ শব্দটি গেঁথে গেছে। কিন্তু, এতে অস্বাভাবিক কী আছে? ডেভিডও নিশ্চয় বড় হয়েছেন ‘হলোকাস্ট’ শব্দটি শুনে। হলোকাস্ট বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার কর্তৃক ইহুদী ও নাজি বিরোধীদের নিধন হলো হলোকাস্ট। এটি বিশ্ববাসী বা ইউরোপীয়দের মধ্যে বিশ্বাস যে, ৩ লক্ষ মানুষ মারা গেছেন হলোকাস্টে। নাজি বা ফ্যাসিবিরোধী ডিসকোর্সের তা অন্তর্গত এবং ইউরোপের যেকোন রাজনৈতিক দল হলোকাস্টের কথা বললে কি মনে হয় যে তা অর্থোডক্স ন্যাশনালিস্ট ডিসকোর্সের অংশ বা কোন দলের বিশ্বাস? হ্যাঁ, হলোকাস্টে মৃতের সংখ্যা নিয়েও মাঝে মাঝে প্রশ্ন করা হয়েছে, কিন্তু যারা এ প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা কি মেইনস্ট্রিম এ্যাকাডেমিকসে জায়গা পেয়েছেন? এবং জার্মানিতে, যে জার্মান সরকার একসময় এ নিধন চালিয়েছে, সে জার্মানিতে কেউ এ প্রশ্ন করলে কি তাকে জার্মান সমাজ গ্রহণ করবে? তাকে কি নাজি সমর্থক মনে করবে না? সে মনে করাটি কি ‘অপজিশনাল’ মাইন্ড সেট’? আমেরিকাতে ইহুদী বিদ্বেষী দু’একজন লেখক এ নিয়ে কথা তুলেছেন এবং খোদ আমেরিকাতে তাদের নিয়ে নিন্দার ঝড় বয়ে গেছে, হাসি ঠাট্টা করা হয়েছে তাদের ‘পান্ডিত্য’ নিয়ে। তারা পরিশীলিত, তাই এ ধরনের ব্যক্তিদের রিভিশনিস্ট বলেছেন। আমাদের দেশের মানুষজন অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত, অতটা পরিশীলিত নয়, তাই যারা ৩০ লক্ষকে অস্বীকার করে তাদের হারামজাদা বলে। শব্দগত বা ভাবগত তফাৎ আর কি!


ডেভিড তাঁর শ্বশুরের মতো আওয়ামী লীগকে পছন্দ করেন না। সেটি স্বাভাবিক। কিন্তু ৩০ লাখ শহীদ নিয়ে প্রশ্ন করলে কি শুধু আওয়ামী লীগ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায়? না। ডেভিডের আওয়ামী লীগকে অপছন্দের কারণে মনে হয়েছে, খালি আওয়ামী লীগ-ই প্রতিক্রিয়া জানাবে। কমিউনিস্ট পার্টি তো ঘোর আওয়ামী লীগ বিরোধী। ডেভিড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমকে জিজ্ঞেস করতে পারেন, ৩০ লক্ষ শহীদে তিনি বিশ্বাস করেন কিনা? বিএনপি-জামায়াত ছাড়া আর কেউ এ নিয়ে প্রশ্ন করে কিনা সেটি ডেভিড পর্যালোচনা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করবেন না দেখেই আগে ভাগে জানিয়েছেন, এটি আমাদের সংস্কৃতির বুননে মিশে আছে। ডেভিড তাঁর শ্বশুর ড. কামাল হোসেনকে একবার জিজ্ঞেস করলে পারতেন, তিনি এটা বিশ্বাস করেন কিনা? আওয়ামী লীগ করার সময় তো নিশ্চয় বিশ্বাস করতেন। না করলে কি প্রকাশ্যে তিনি তা বলবেন?


ডেভিডের নিবন্ধের প্রথম ভাগ দেখে মনে হচ্ছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যে আওয়ামী লীগ করছে সে জন্য তিনি খানিকটা কুপিত। ডেভিড, তাঁর স্ত্রী শ্বশুর-শাশুড়ি, আমরা সবাই এতে বিশ্বাস করতাম এখনও করি। ডেভিড করেন না, তাঁর বিশ্বাস ভঙ্গ হয়েছে, আমাদের বিশ্বাস এখনও অটুট। ডেভিড কেন, আমাদের সবাইর একটি বিষয় মনে রাখা উচিত, এ বিচারটা আওয়ামী লীগ না করলে তাদের অনেক নেতাকর্মী হয়তো খুশি হতেন। আওয়ামী লীগ সবসময় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়েছে কিন্তু প্রথম আমলে তা করেনি। ২০০৮ সালে, তারা জনগণের ম্যান্ডেট চেয়েছে। বিচারে এবং তা পেয়েছে। তারপরেও কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বিচার কাজ শুরু হয়নি। পরে জনচাপে সেই ম্যান্ডেট আওয়ামী লীগ কার্যকর করছে মাত্র। এটি দলীয় কোন সিদ্ধান্ত কার্যকরের মতো নয়।


নিবন্ধের দ্বিতীয় ভাগে ডেভিড বলছেন, সাংবাদিক বা গবেষকদের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ যে এই যে ‘আইকনিক ফিগার’ পর্যালোচনা করবেন। ডেভিড বুদ্ধিমান, পরের লাইনে লিখেছেন, এই পর্যালোচনা পাকিস্তানী ও তাদের সহযোগীদের নিষ্ঠুরতা কম করে দেখানোর জন্য নয়। তার ভাষায়, This is not in order to minimise the extent of atrocities committed by the pakistan military and its collaborators which were undoubtedly very significant, but for the purposes of a more accurate representation of history that is not thrall to partisan interest. শেষ বাক্যটি লক্ষ্য করুন, ইতিহাসের স্বার্থে এবং যা পক্ষপাতমূলক স্বার্থের পক্ষে [পড়ুন আওয়ামী লীগ] যাবে না। অর্থাৎ ৩০ লক্ষ নিয়ে প্রশ্ন ওঠালেই তা আওয়ামী লীগের স্বার্থের বাইরে যাবে। এ ধরনের বাক্য গঠন দেখেই বোঝা যায় একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই লেখাটি রচিত হয়েছে- সেটি হচ্ছে অপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া সুষ্ঠু নয়, অভিযোগগুলো বিশেষ করে হত্যার, সুষ্ঠু নয় এবং রাজনৈতিক উদ্দেশেই বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। 


৩০ লক্ষ শহীদের ব্যাপারটি কীভাবে এলো তারপর তা ব্যাখ্যা করেছেন ডেভিড। ১৯৭২ সালে ১৮ জানুয়ারি ডেভিড ফ্রস্টকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বঙ্গবন্ধু বলেন-‘3 million people have been killed, including children, women, intellectuals, peasants, warkers, students...’ ফ্রস্ট তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, সংখ্যাটি যে ৩ মিলিয়ন তিনি তা কীভাবে বুঝলেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমি ফেরার আগেই আমার লোকজন তথ্য সংগ্রহ করছে, বিভিন্ন জায়গা থেকে খবরা খবর আসছে, এখনও সঠিক সংখ্যায় উপনীত হইনি তবে তা কিন্তু ৩ মিলিয়নের নিচে হবে না। এর আগে ১০ জানুয়ারিও তিনি একই সংখ্যার কথা বলেছিলেন। 


এরপর ডেভিড এ প্রসঙ্গে কট্টর মুজিব ও আওয়ামী লীগ বিরোধী মাহমুদুর রহমান মার্কা সাংবাদিক, বিবিসির এককালীন কর্মী সিরাজুর রহমানের মন্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। সিরাজ লিখেছেন, ৩ লক্ষকে শেখ মুজিব ইংরেজীতে ৩ মিলিয়ন বলেছেন। সিরাজ এ মন্তব্য করে বঙ্গবন্ধুর ইংরেজী জ্ঞানের প্রতি কটাক্ষ করতে চেয়েছেন। সিরাজুর রহমানের বই পড়েছি। ইংরেজী নিশ্চয় ভাল জানেন লন্ডনে থাকার কারণে। বঙ্গবন্ধুর ইংরেজী ভাষণও পড়েছি। সিরাজুর রহমানের ইংরেজী এর চেয়ে উত্তম এমন দাবি করা যায় না। বাংলা গদ্য তো নয়ই। সিরাজুর রহমানের যে দৃষ্টিভঙ্গি তাতে তিন লাখও তার কাছে বেশি মনে হওয়া স্বাভাবিক। সংখ্যাটি ৩০ হাজার হলে বোধহয় তিনি সন্তুষ্ট হতেন। 


এসএ করিমের প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর জীবনী থেকেও ডেভিড উদ্ধৃতি দিয়েছেন। তিনিও লিখেছেন, ৩০ লক্ষ ‘no doubt a gross exaggeration’। এ বিষয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দফতরে খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, প্রাভদায় সংবাদটি ছাপা হয়েছিল।

 বার্গম্যান বলছেন, প্রাভদার হিসেবটা গোলমেলে [কমিউনিস্টদের কাগজ সেজন্য; ইহুদী বা ইউরোপীয়দের হলে না হয় মানা যেত।] কারণ প্রাভদা লিখেছিল, পাকিন্তান সামরিক বাহিনী আত্মসমর্পণের ঠিক পূর্ব মুহূতে [days immediately] ৮০০ বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হয়েছিল। আসলে ঠিক সংখ্যা হবে ২০। বুদ্ধিজীবী নিধন শুরু হয়েছিল ২৫ মার্চ থেকে। এই বুদ্ধিজীবীর অন্তর্গত [দেখুন রশীদ হায়দার সম্পাদিত শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ] বিভিন্ন পেশার মানুষ। ১ ডিসেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র ২০ জন বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হয়েছে?


ব্রিটিশ সাংবাদিক ও ড. কামাল হোসেনের জামাতা ডেভিড বার্গম্যান ২৪ এপ্রিল ‘দি হিন্দু’ পত্রিকায় স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হওয়া ৩০ লাখ বিষয়টিকে নিয়ে প্রশ্ন তুলে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। স্বাধীনতার ৪২ বছর পর এসেও একটি প্রতিষ্ঠিত সত্যকে প্রতিক্রিয়াশীল মহলকে খুশি করতে ডেভিড বার্গম্যান এই সন্দেহ করেছেন। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ইতিহাসের ঐতিহাসিক আলোকে বার্গম্যানের কল্পনাপ্রসূত সন্দেহের চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন।

জামায়াতীদের কাছেও অপমানজনক মনে হবে। শেখ মুজিবুর রহমানকে সামান্য একটু প্রশংসা করেছেন ডেভিড। ফ্রস্টের সাক্ষাতকারের পর পরই তিনি দু’টি কমিটি করেছিলেন মৃতের সংখ্যা জানার জন্য। কমিটি নাকি প্রাথমিক রিপোর্টও দিয়েছিল। সে রিপোর্টে নাকি ৫৭,০০০ জন মৃতের খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল। সেজন্য এরপর সরকার এ নিয়ে এগোয় নি। প্রশ্ন জাগে, নিয়াজি যে ১৫ লক্ষের কথা বলেছিলেন সেটি কি কারণে?

এরপর ডেভিড কলেরা হাসপাতাল, যা এখন আইসিডিডিআরবি নামে পরিচিত তাদের একটি জরিপের উল্লেখ করেছেন। মতলব থানা নিয়ে জরিপটি পরিচালিত হয়েছিল। ঐ থানায় তাদের অনুমান ৮৬৮ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ঐ হিসাবে মৃতের সংখ্যা তারা ৫ লাখ বলে অনুমান করেছে। ২০০৮ সালে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল অনুসারে, ১৯৭১ সালে নিহতের সংখ্যা ১,২৫,০০০ থেকে ৫,০৫,০০০ জন। আর জে রুমেন বলছেন ১৫ লক্ষ আর শর্মিলা বোসের হিসাব অনুযায়ী ৫০ হাজার ১০০,০০০।

এরকম আরও কিছু হিসাব দিয়েছেন তিনি। উপসংহারে তিনি লিখেছেন, যে কোন সংঘাতে নিহতের সংখ্যা নিরূপণ করা মুশকিল । বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি বেশি প্রযোজ্য এর ‘পার্টিজান পলিটিকসের’ কারণে। এবং এ কারণে এ বিষয়ে স্বাধীন গবেষণা করা কঠিন। এটা ঠিক পাকিস্তানীরা অনেক হত্যা করেছে। মৃতের সংখ্যা যাই হোক সরকারের বর্তমান নীতি যে অপরাধীর বিচার তাতে [এই সংখ্যা] কোন অভিঘাত হানবে না। তার ভাষায়-This is pity- as the number of civilians who were killed in atrocities by the Pakistan military in 1971 was, without doubt, very high. Whatever might be the actual figure. it would not affect the government’s current policy for the need for crimimal accountability for these offences. 

॥ দুই ॥

বার্গম্যান যে সব যুক্তি দিয়েছেন এগুলো যে খুব নতুন তা নয়। আমরা এর বিপরীতে যেসব যুক্তি দেব তাও নতুন নয়। রবার্ট পেইন সেই ১৯৭২ সালে যেমন ম্যাসাকারে লিখেছেন- প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেছিলেন. ‘৩০ লক্ষ হত্যা করো, বাকিরা আমাদের হাত থেকে খাবার খুটে খাবে।’ এখন যদি বলি সামরিক বাহিনীর প্রধানের আদেশ তার সৈন্যরা মেনে ত্রিশ লক্ষ হত্যা করেছে তাহলে এ যুক্তি অসার এমন কথা কি বলা যাবে? প্রাভদা ইয়াহিয়ার কথার আলোকেও এই সংখ্যা উল্লেখ করে থাকতে পারে।

মুক্তমনা ওয়েবসাইটে আবুল কাসেম একটি প্রবন্ধে জানাচ্ছেন, ১৯৮১ সালে জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার জরিপে লেখা হয়েছে, বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে কম সময়ে সবচেয়ে বেশি মানুষ হত্যা করা হয়েছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে। প্রতিদিন গড়ে ৬ থেকে ১২ হাজার মানুষ মারা হয়েছে। গণহত্যার ইতিহাসে এই হার সবচেয়ে বেশি।
[Among the genocides of human history, the highest number of people killed in lower span of time is in Bangladesh in 1971. An average of 6000 (six thousand) to 12000 (twelve thousand) people were killed every single day .... This is the higest daily average in the history of genocides.] 

জাতিসংঘের হিসাব ধরে আবুল কাসেম একটি হিসাব করেছেন। তার মতে হত্যা হয়েছে ২৬০ দিন। সে হিসাবে জাতিসংঘের সর্বনিম্ন হিসেব ধরলে তা দাঁড়ায় ৬০০০X২৬০ = ১৫৬০ ০০০ বা ১৫ লক্ষ ৬০ হাজার। আর সর্বোচ্চ মাত্রা ধরলে = ১২০০০X২৬০ = ৩১২০০০০ বা ৩১ লক্ষ ২০ হাজার। তার মতে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ৪০% পরিবারের কেউ না কেউ মারা গেছেন এবং পাকিস্তানী প্রতিটি সৈন্য প্রতি ১০ দিনে ১জন করে হত্যা করেছে। ১৯৭২ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক লিখেছিল, বাংলাদেশে ৩০ লক্ষের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এখানে রাজাকার, আলবদর কর্তৃক হত্যার সংখ্যা ধরা হয়নি।

পাকিস্তানী সেনা অফিসার কর্নেল নাদের আলী যিনি ১৯৭১ সালে এখানে ছিলেন এবং গণহত্যা করে ও দেখে সাময়িকভাবে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিলেন। লিখেছেন, তাকে আদেশ দেয়া হয়েছিল ‘মুজিবের জেলায় [হোম ডিস্ট্রিকট] যত বেজন্মাকে পাওয়া যায় তাদের হত্যা করো এবং কোন হিন্দু যেন বাদ না যায়।’ এ ধরনের আদেশ যখন দেয়া হয় তখন পাকিস্তানী সৈন্যরা কি পরিমাণ হত্যা করতে পারে তা অনুমেয়।

আমি ব্যক্তিগতভাবে ন্যাশনাল জিওগ্রাফির সংখ্যার সঙ্গে একমত। যখন ঐ সংখ্যা দেয়া হয় তখন দেশটি সবে স্বাধীন হয়েছে, মানুষের স্মৃতি দুর্বল হয়ে যায়নি। সে সংখ্যা গ্রহণীয়। আজ থেকে বছর ১৫ আগে আমি স্বরূপকাঠির এক গ্রামে গিয়েছিলাম। বরিশালের বাসা থেকে টেম্পোয় স্বরূপকাঠির বাসস্ট্যান্ড। সেখান থেকে বাসে করে স্বরূপকাঠি। তারপর হেঁটে প্রায় মাইলখানেক ভেতরে এক খালের তীরে গ্রামে পৌঁছলাম।

 সেই গ্রামে মূলত হিন্দু চাষীরা বসবাস করেন। তারা জানালেন, ১৯৭১ সালে পাকিরা সেখানে এসেও মানুষ হত্যা করেছে। এত অভ্যন্তরে ঢুকে যদি পাকিরা হত্যা করতে পারে তাহলে বাংলাদেশের অধিকাংশ জায়গাই হত্যাযজ্ঞ চলেছে। এ ছাড়া, বেশি হত্যা করা হয়েছে রেলওয়ে ব্রিজ বা খাল/নদীর ওপর ব্রিজ বা নদী তীরে। এসব জায়গায় মানুষ মেরে পানিতে ফেলে দিলে ঝামেলা চুকে যায়। চিহ্ন থাকে না। চিহ্ন না থাকলে হিসাবও থাকে না। অন্যখানে হত্যা করলে গণকবর দিতে হয়, ঝামেলা। সবখানে যে গণকবর দেয়া হয়েছে তা নয়।

 গণহত্যার ছবি দেখলে তা বোঝা যায়। আরেকটি বিষয় আমাদের খেয়াল থাকে না, বিভিন্ন জেলায় অন্য জেলার মানুষজন ছিল। তাদের হত্যার পর তাদের আত্মীয়স্বজনরা জানতেও পারেনি। এসব লাশ ও সংখ্যা থেকে হারিয়ে গেছে। এতো গেল পাকিস্তানী হার্মাদদের হত্যার কথা। এর সঙ্গে বাঙালী হারামজাদা যেমন রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তিবাহিনী, বিহারিরা যে হত্যাকান্ড চালিয়েছে তাতো বলা হয় না বা সেই সব সংখ্যা ‘পন্ডিত’রা যে সংখ্যা বলেন তার সঙ্গে যুক্ত হয় না। এসব হিসেব ধরলে ৩০ লক্ষ কমই বলা হবে।

এক কোটি মানুষ শরণার্থী হয়ে গিয়েছিলেন বাধ্য হয়ে। সীমান্ত অতিক্রম করার সময় এবং শরণার্থী শিবিরে কত মানুষ মারা গেছেন সে হিসাব কিন্তু গণহত্যার অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। সে হিসাবও কিন্তু গণহত্যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে। এ রকম অনেক তথ্য উপাত্ত ৩০ লক্ষ শহীদের পক্ষে দেয়া যায় কিন্তু আমি দেব না। কারণ, এগুলো কুতর্ক। বিশেষ উদ্দেশ্যে এ সব বির্তক উত্থাপন করা হয়। বলতে পারেন তা’হলে আমি বিতর্কে যোগ দিচ্ছি কেন? না, যোগ দিতে চাইনি। কিন্তু বার্গম্যানের লেখা পড়ে অনেকে অনুরোধ করেছেন কিছু লিখতে এ কারনে যে, তা’হলে,বার্গম্যানরা একই কথা বার বার বলবে। পুরনোরা না হোক, নতুনদের অনেকের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। অন্তত, তাদের যুক্তি যে উদ্দেশ্যমূলক এ বক্তব্যটি আসা উচিত।


॥ তিন ॥

গণহত্যা নিয়ে জনকণ্ঠে আমি কিছুদিন আগে দীর্ঘ লেখা লিখেছি। ঐ প্রবন্ধের সব বিষয়ের অবতারণা করব না, কিছু বিষয় তুলে ধরব বর্তমান নিবন্ধে সম্পূর্ণতা দেয়ার জন্য।

কোন গণহত্যারই নির্দিষ্ট সংখ্যা কখনও নির্দিষ্ট করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যে-সব গণহত্যার সংখ্যা দেয়া হয়েছে তার সবগুলোই আনুমানিক। এই অনুমানের ভিত্তি প্রত্যক্ষভাবে দেখা, বিভিন্ন প্রতিবেদন, অভিজ্ঞতা। যে দেশ/ জাতি গণহত্যার যে সংখ্যা নিরূপণ করে তা মোটামুটি এ কারণে মেনে নেয়া হয়।
ফতে মোল্লা যেমন লিখেছেন, সংখ্যা একেবারে সঠিক হবে এমন কথা বলা যাবে না, মূল বিষয় হচ্ছে সংখ্যা আমরা ব্যবহার করি গণহত্যাটি বোঝার জন্য (to address the issue of genocide). তার ভাষায়, All numbers are not absolute we do use arbitrary numbers extensively all the time in our lives.” 

কম্বোডিয়া থেকে রুয়ান্ডা, বা হলোকাস্ট থেকে ইন্দোনেশিয়া কোথায় চুলচেরা হিসাব দেয়া হয়েছে? সুহার্তো ইন্দোনেশিয়ায় যে গণহত্যা চালিয়েছিলেন ১৯৬৫-৬৬ সালে, তাতে অনুমান করা হয় ১০ লক্ষ থেকে ১৫ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। সেটি মানা না মানা অন্য কথা, কিন্তু সুহার্তো কি পরিমাণ হত্যা করেছিলেন সেটিই মূল বিষয়। ধরা যাক, কেউ বললেন বাংলাদেশে ২৯ লক্ষ ৯০ হাজার ৫১৯ জন মারা গেছেন। তাতে কি আসে যায়?

সংখ্যার নির্দিষ্টকরণের পেছনে এক ধরনের রাজনীতি আছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামে নাপাম দিয়ে যে গণহত্যা চালিয়েছে সেটিকে পাশ্চাত্যের কেউ গণহত্যা বলেন না, বলেন যুদ্ধ। কারণ, যুদ্ধ বললে হত্যার দায় হ্রাস পায়। দু’পক্ষে যুদ্ধ হলে তো মারা যাবেই। কিন্তু ভিয়েতনামে কি খালি যুদ্ধ হয়েছিল? নিরীহ সিভিলিয়ানদের হত্যা করা হয়নি বছরের পর বছর? সুহার্তোর হত্যা নিয়ে কখনও কথা বলা হয় না।

 ঐ গণহত্যা স্মৃতি থেকে মুছে ফেলার চিন্তা করা হয়েছে, কেউ এ বিষয়ে কথা বলেন না, কারণ কাজটি আমেরিকার সাহায্যে করা হয়েছে। অন্যদিকে, কম্বোডিয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অর্থাৎ পশ্চিমা বিশ্ব সোচ্চার কারণ, পলপট ছিলেন কম্বোডিয়ার এবং মার্কিন বিরোধী। কমিউনিস্ট শাসন যে কত খারাপ তা বোঝানোর জন্য কম্পোডিয়ার কথা বার বার আসে। বাংলাদেশে গণহত্যার ৩০ লক্ষ শহীদকে নিয়ে এতদিন কোন প্রশ্ন ওঠানো হয়নি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলে গণহত্যার চেয়েও বিচার পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বার্গম্যান বা ক্যাডমান বা অন্য কেউ। কিন্তু তা ধোপে টেকেনি। গত নির্বাচনের পর থেকেই হঠাৎ গণহত্যার বিষয়টি তোলা হচ্ছে। এখানে আরও মনে রাখা উচিত, আমেরিকা এই নির্বাচন সমর্থন করেনি। হঠাৎ গত একমাস ধরে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তারেক রহমান, খালেদা জিয়া প্রশ্ন তুলছেন। 

গণহত্যায় যে ৩০ লক্ষ শহীদ হয় নি সে কথা খালেদা জিয়া প্রথম বলেছেন যা আগে কখনও বলেননি। এখন ডেভিড বার্গম্যান বিদেশের কাগজে এই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এগুলো কি কাকতালীয়? না, এর পেছনে অন্য কোন রাজনীতি আছে। তার আগে বলা দরকার কেন বাংলাদেশের গণহত্যার বিষয়টি এতদিন চাপা পড়ে গিয়েছিল? এর একটি কারণ আমরা নিজে, অন্য কারণ, আমেরিকা, পাকিস্তান, সৌদি আরব বা চীনের মনোভঙ্গি।