Saturday, January 11, 2014

আত্মদানের ৮৯ বছর; মাষ্টার 'দা, তোমার দেশ আজো হিন্দু-মুসলিম প্রশ্নে রক্তগঙ্গায় ভাসছে- সুমি খান

'উদয়ের পথে শুনি কার বাণী ,ভয় নাই ওরে ভয় নাই!নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান-ক্ষয় নাই  তার ক্ষয় নাই!"


 লাল সালাম মাষ্টার'দা সূর্যসেন !! বীর চট্টগ্রামের সূর্যসন্তান মাস্টার’দার প্রতি তাঁর আত্মদানের ৮৯ তম দিবসে গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। 
১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ এপ্রির ৬৫ জন বিপ্লবী  সহযোদ্ধা নিয়ে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করে পরাধীন অবিভক্ত  ভারতকে চারদিন স্বাধীন রেখেছিলে তুমি । আজ তোমার জয়ে স্বাধীন তোমার বাংলা, তুমি দেখে যেতে পারো নি। তোমার উত্তরসূরিরা তোমার আত্মদান বিশ্বদরবারে তুলে ধরেছে। তোমার বাংলায়  অসাম্প্রদায়িক বাংলা প্রতিষ্ঠার লড়াইযে সোচ্চার তোমার উত্তরসূরীরা। চিরকাল এ বাংলায় অন্যায় অসত্য এবং সাম্প্রদায়িক অন্ধকারের শক্তির পরাজিত করে অসাম্প্রদায়িক ,মানবতার বাংলার ঝান্ডা উড়বে।, যার ভিত গড়ে দিয়েছো তুমি এবং তোমার অপ্রতিরোধ্য সহযোদ্ধা বিপ্লবীরা। 
 মাতৃভূমিকে মুক্ত করার সংগ্রামে নেতৃত্ব দানের সফলতায় ভীত বৃটিশ সরকার ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারী চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে  মাষ্টার'দা সূর্যসেনকে হত্যা করে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। 
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, বর্বর ব্রিটিশ রাজের পুলিশ বাহিনী মাষ্টার'দা র পবিত্র দেহ বঙ্গোপসাগরে নিক্ষিপ্ত করেছিলো। সেদিন প্রাণহীন মাস্টার'দা সূর্যসেন ও ব্রিটিশ রাজের কাছে মূর্তিমান আতংক ছিল, এখনো অন্ধকারের শক্তি মাস্টার’দার সাহস ও দেশপ্রেম কে ভয় পায় !!
এ কারণে এখনো এদেশে সাম্প্রদায়িক শক্তি উন্মাদ। সমাজ, সভ্য়তা ধর্মান্ধতা এবং সাম্প্রদায়িক বিষে জর্জরিত।
মাষ্টার 'দার জীবনী বারবার পড়তে হবে আমাদের; জানাতে হবে পরবর্তী প্রজন্মকে! সারা দেশে তার ভাস্কর্য স্থাপন করে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দিতে হবে বীরগাথা!
মাষ্টার'দা  সূর্যসেন। ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবের অমর নায়ক। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনসহ বহু বিপ্লবের অধিনায়ক। পুরো নাম সূর্য কুমার সেন। সংক্ষেপে সূর্যসেন নামে অধিক পরিচিত। 'মাষ্টার 'দা' নামে সহযোদ্ধাদের কাছে পরিচিত ছিলেন। সূর্যকুমার সেন, ডাকনাম কালু, যিনি মাস্টারদা নামে সমধিক পরিচিত । ভারত উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের বীর ব্যক্তিত্ব।

’ হিন্দু- না ওরা মুসলিম?  সাম্প্রদায়িক শক্তি এই প্রশ্ন দিয়ে হিংসা বিদ্বেষ বিভাজনে পরিবার পরিবেশ ,সমাজ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে।


২০১৪ সালে মাস্টার'দার আবক্ষ মূর্তিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

মাষ্টার'দার বীরগাথা

 মাষ্টার'দার বীরত্বের পথ বেয়ে আমরা আজ পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত। 
স্বাধীন দেশে লাল সবুজের পতাকা উড়িয়ে আত্মপরিচয়  বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে পেরেছি মাষ্টার'দার আত্মদানের পথ বেয়ে! 
  এই বাঙালি বিপ্লবী তৎকালীন ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে নেতৃত্বদেন এবং হাসিমুখে ফাঁসিতে আত্মদান করেন।














২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারী  মাস্টার'দার আবক্ষ মূর্তিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পন করেন যাঁরা  ইরাবান আলীম অতুলন, ঋতবান আলীম গহন, আলেক্স  আলীম সহ চট্টগ্রাম বাসী



বাংলাদেশে তাঁর সম্মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি করে আবাসিক হলের নামকরণ করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে সূর্য সেনের স্মরণে বাঁশদ্রোণী মেট্রো স্টেশনটির নামকরণ করা হয়েছে “মাস্টারদাসূর্য সেন মেট্রো স্টেশন”






































সূর্য সেন ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় অর্থনৈতিক ভাবে অস্বচ্ছল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রাজমনি সেন এবং মাতার নাম শশী বালা সেন। রাজমনি সেনের দুই ছেলে আর চার মেয়ে। সূর্য সেন তাঁদের পরিবারের চতুর্থ সন্তান। দুই ছেলের নাম সূর্য ও কমল।চার মেয়ের নাম বরদা সুন্দরী, সাবিত্রী, ভানুমতি ও প্রমিলা। শৈশবে পিতা মাতাকে হারানো সূর্য সেন কাকা গৌরমণি সেনের কাছে মানুষ হয়েছেন। সূর্য সেন ছেলেবেলা থেকেই খুব মনোযোগী ছাত্র এবং ধর্মপ্রাণ গম্ভীর প্রকৃতির ছিলেন।
১৯১৬ সালে বহররমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে সূর্য সেন সরাসরি রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত হন। বিপ্লবীদের গোপন ঘাঁটি এই কলেজ়ে তিনি অধ্যাপক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তীর সান্নিধ্যে আসেন। তিনি যুগান্তর দলের সাথে যুক্ত ছিলেন। সূর্য সেনকে তিনি বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষা দেন। 
 মাস্টার’দা সূর্য সেন ১৯১৮ সালে শিক্ষাজীবন শেষ করে চট্টগ্রামে এসে গোপনে বিপ্লবী দলে যোগ দেন। 
৪৯নং বেঙ্গল রেজিমেন্টের নগেন্দ্রনাথ সেন ১৯১৮ সালে চট্টগ্রামে এসে সূর্য সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী ও চারুবিকাশ দত্তের সাথে দেখা করেন। 
সূর্য সেন এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী অম্বিকা চক্রবর্তী পাশাপাশি গ্রামের ছাত্র হিসেবে ছোটবেলা থেকেই পরস্পরের পরিচিত ছিলেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) শেষের দিকে অনুরূপ সেন, চারুবিকাশ দত্ত, অম্বিকা চক্রবর্তী, নগেন্দ্রনাথ সেন প্রমুখদের সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রামে গোপন বিপ্লবী দল গঠন করা হয়। 
এখানে উল্লেখ্য, শুরুতে চট্টগ্রামের বিপ্লবী দল একটিই ছিল। তারা বাংলার প্রধান দু'টি বিপ্লবী দল "যুগান্তর" এবং "অনুশীলন"- কোনটির সাথে একেবারে না মিশে স্বতন্ত্র কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। 
বিপ্লবী নেতা মাস্টার’দা সূর্য সেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তী তখন চট্টগ্রাম শহরের দেওয়ানবাজার দেওয়ানজী পুকুরপারে 'সাম্য আশ্রম' প্রতিষ্ঠা করে ওখানে থাকেন।সেখানে গোপনে বিপ্লবীরা জমায়েত হয়। 
পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিপ্লবী দলের অন্যতম নেতা চারুবিকাশ দত্ত তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে "অনুশীলন" দলের সাথে যুক্ত হন। এভাবে চট্টগ্রামেও বাংলার অন্যান্য জেলার মত দু'টি বিপ্লবী দল গড়ে ওঠে। দুই দলে বিভক্ত হওয়ার পর চট্টগ্রামে যে বিপ্লবী দলটি স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে কংগ্রেসের প্রকাশ্য আন্দোলনে কোলকাতার "যূগান্তর" দলের সঙ্গে সহযোগিতা করত, সে দলের সাংগঠনিক কমিটির সভাপতি ছিলেন সূর্য সেন; সহসভাপতি- অম্বিকা চক্রবর্তী; শহর সংগঠনের দায়িত্বে ছিলেন গণেশ ঘোষ ও অনন্ত সিংহ; গ্রামের সংগঠনের দায়িত্বে ছিলেন  নির্মল সেন।  লোকনাথ বলকে ছাত্র আন্দোলন ও ব্যায়ামাগার গঠন সহ বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়। 
অনুরূপ সেন বিপ্লবীদলের সংবিধান লিখলেন এবং তাঁকে ও নগেন্দ্রনাথ সেনকে কলকাতার অন্য দলগুলোর সাথে যোগাযোগ এবং অস্ত্র সংগ্রহের দায়িত্ব দেয়া হয়।

নাগরখানা পাহাড় খন্ডযুদ্ধ
১৯২০ সালে গান্ধীজী- কর্তৃক অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে অনেক বিপ্লবী এই আন্দোলনে যোগ দেন। গান্ধীজীর অনুরোধে বিপ্লবীরা তাদের কর্মসূচি এক বছরের জন্য বন্ধ রাখেন।সূর্য সেন অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিলেন। 
চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল স্কুলের দশম শ্রেনীর ছাত্র বিপ্লবী অনন্ত সিংহ ছাত্র ধর্মঘট পরিচালনা করার দায়ে স্কুল থেকে বহিস্কৃত হন।
মহাত্মা গান্ধী ১৯২২ সালে অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করলে বিপ্লবী দলগুলো আবার সক্রিয় হয়ে উঠে। তখন চট্টগ্রাম কোর্টের ট্রেজারী থেকে পাহাড়তলীতে অবস্থিত আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কারখানার শ্রমিক ও কর্মচারীদের বেতন নিয়ে যাওয়া হতো। 
১৯২৩-এর ১৩ ডিসেম্বর টাইগার পাস  সড়ক এর মোড়ে সূর্য সেনের গুপ্ত সমিতির সদস্যরা প্রকাশ্য দিবালোকে  রেল শ্রমিকদের বেতন ১৭,০০০ টাকার বস্তা ছিনতাই করেন। ছিনতাইয়ের প্রায় দুই সপ্তাহ পর গোপন বৈঠক চলাকালীন পুলিশ খবর পেয়ে বিপ্লবীদের আস্তানায় হানা দিলে পুলিশের সাথে বিপ্লবীদের খন্ডযুদ্ধ হয় যা "নাগরখানা পাহাড় খন্ডযুদ্ধ" নামে পরিচিত। সেই সম্মুখযুদ্ধের পর গ্রেফতার হন মাস্টার'দা সূর্য সেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তী। 

রেলওয়ে ডাকাতি মামলা শুরু হয় সূর্য সেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে। অনন্ত সিং  এবং গণেশ ঘোষের নামে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হয়। কলকাতা হাইকোর্টের ব্যারিস্টার দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত এই মামলায় আসামি পক্ষের আইনজীবি ছিলেন। সূর্য সেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তী এ মামলা থেকে ছাড়া পেয়ে যান। গ্রেফতার করার পর বিপ্লবীদের উপর নির্যাতনের কারনে কলকাতা পুলিশ কমিশনার টেগার্টকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে বিপ্লবীরা। এ পরিকল্পনার কথা পুলিশ আগে থেকেই জানতে পারে। এ কারনে ২৫ অক্টোবর ১৯২৪ সালে গ্রেফতার হন গণেশ ঘোষ, নির্মল সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, অনন্ত সিং সহ আরো কয়েকজন। পুলিশকে বার বার ফাঁকি দিয়ে শেষ পর্যন্ত ১৯২৬ সালের ৮ অক্টোবর সূর্য সেন কলকাতার ওয়েলিংটন স্ট্রীটে গ্রেফতার হন। বন্দী হবার পর তাঁকে মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে রাখা হয়। পরে বোম্বের রত্নগিরি জেলে পাঠানো হয়, সেখান থেকে বেলগাঁও জেলে। ১৯২৭ সালে নির্মল সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, অনন্ত সিং মুক্তি পান। আর ১৯২৮ সালের শেষভাগে সূর্য সেন ও গণেশ ঘোষ জেল থেকে ছাড়া পান।
বিপ্লবী ভাবধারায় দীক্ষিত সূর্য সেন দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগকে একমাত্র তপস্যা হিসেবে নিয়েছিলেন। তাই তিনি বিয়েবিরুদ্ধছিলেন। কিন্তু  স্নাতক পাশ করে চট্টগ্রামে আসার পর থেকেই তাঁর অভিভাবকরা বিয়ের কথা তোলেন। এক পর্যায়ে তাঁর বড় ভাই শিক্ষক চন্দ্রনাথ সেন (সহোদর নয়) ও অন্যান্য আত্মীয়দের বিশেষ অনুরোধে ১৯১৯ সালে তিনি চট্টগ্রামের কানুনগো পাড়ার নগেন্দ্রনাথ দত্তের ষোল বছরের কন্যা পুষ্পকুন্তলা দত্তকে বিয়ে করেন। আত্মীয়-স্বজনের চাপে বিয়ে করলেও মাস্টারদার মনে এ ধারণা ছিল যে, বিবাহিত জীবন তাকে কর্তব্যভ্রষ্ট করবে, আদর্শচ্যুত করবে। স্ত্রীর সংগে একদিনও তিনি কথা বলেন নি।  হিন্দুপ্রথামতে  বিবাহের তৃতীয় দিনে ফুলশয্যা।সেদিন মাস্টার'দা তাঁর বৌদিকে বলেন, তিনি স্বপ্ন দেখেছেন স্ত্রীর সংগে সহবাসে তাঁর মৃত্যু অনিবার্য।সেদিনই গ্রামের বাড়ি ছেড়ে শহরে চলে আসেন এবং স্ত্রীর সাথে আর কোনদিন দেখা করেন নি মাস্টার’দা। 
১৯২০ সালে গান্ধীজী স্বরাজ এনে দেওয়ার জন্য বিপ্লবীদের কাছ থেকে এক বছর সময় চেয়ে নেন। তৎকালীন বিপ্লবীরা অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী না হলেও গান্ধীজির কথায় অনেকেই সহযোগিতা করেছিলেন।ঘোষিত এক বছর সময়সীমার মধ্যে অহিংস আন্দোলন ভারতের স্বরাজ আনতে ব্যর্থ হলে বিপ্লবীরা আবার সশস্ত্র বিপ্লবের পথ বেছে নেন।
 অসহযোগ আন্দোলনের সময় স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় মাস্টার'দা জাতীয় বিদ্যালয় গড়ে তোলেন এবং নন্দনকাননের প্রাথমিক  বিদ্যালয়ে  শিক্ষকতার কাজ শুরু করেন। তিনি খ্যাত হন 'মাস্টার'দা 'নামে। এই বিদ্যালয়টিই পরে তাঁর বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল।
১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই ডিসেম্বর চট্টগ্রাম শহরে একপ্রান্তে বাটালি পাহাড় এলাকায় সরকারি রেলের টাকা লুণ্ঠন করেন বিপ্লবী রা। এই লুণ্ঠনে অংশগ্রহণ করেন অনন্ত সিং, দেবেন দে ও নির্মল সেন। অম্বিকা চক্রবর্তী ও দলিলুর রহমান (পরবর্তীতে তিনি বিশিষ্ট চিকিৎসক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন) রেল ডাকাতির সতের হাজার টাকা নিয়ে অস্ত্র কেনার জন্য কলকাতায় চলে যান। সে সময় শুলকবহর এলাকায়  বিপ্লবীদের সদর দপ্তর ছিল। ২৪শে ডিসেম্বর এই দফতরে পুলিশ হানা দেয়। এখান থেকে তাঁরা পালিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের সাথে সংঘর্ষ হয়। তাঁরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।  পালানোর পর মাস্টার'দা প্রথমে নগরকানা পাহাড়ে আশ্রয় নেন। 
পুলিশের হাতে ধরা পড়া প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেলে মাস্টারদা, অম্বিকা চক্রবর্তী ও রাজেন দাস তাঁদের পকেটে রাখা পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান। অন্যান্যরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও মৃতপ্রায় মাস্টারদা ও অম্বিকা চক্রবর্তী পুলিশের হাতে ধরা পড়েন।  পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়েছিলেন, কিন্তু ভালো থাকার সময় সীমা পেরিয়ে যাওয়ার কারণে কার্যকারিতা হারিয়েছিল। ফলে এই তীব্র বিষ খেয়ে ও তাঁরা বেঁচে গিয়েছিলেন। পরে পুলিশ হাসপাতালে তাঁদের চিকিৎসার পর তাঁরা সুস্থ হয়ে ওঠেন। এঁদের বিরুদ্ধে পুলিশ ডাকাতির মামলা রুজু করেছিল।  মাষ্টার'দা সহ বিপ্লবীদের পক্ষে ব্যারিষ্টার যতীন্দ্র্র মোহন  সেন এই মামলা পরিচালনা করেন এবং প্রায় ৯ মাস কারাবন্দী থাকার পর মামলা থেকে তাঁরা খালাস পান।
১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের নোয়াপাড়ায় একটি অস্ত্রলুটের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় মাস্টারদার নাম শোনা যায়। এই কারণে ১ নং বেঙ্গল অর্ডিনেন্স ঘোষণা করে সারা বাংলায় বিপ্লবীদের ব্যাপকহারে গ্রেফতার করা হয়। শুধু  ২৫ অক্টোবর তারিখেই বাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় ২০০ বিপ্লবী কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। এই সময় গ্রেফতার হন নেতাজী সুভাষ, অনিলবরণ রায় প্রমুখ নেতারাও।
 চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের নিয়ে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে মাস্টারদা কলকাতা শোভাবাজার এলাকায় আশ্রয় নেন। ওই সময় তাঁরা কলকাতার দক্ষিণেশ্বরে বোমা তৈরীর প্রশিক্ষণ নিতেন। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই নভেম্বর সেখানে পুলিশ হানা দেয়। সূর্যসেন গায়ের জামা খুলে খালি গায়ে একটা অপরিষ্কার ময়লা গামছা কাঁধে ফেলে চায়ের কেতলি হাতে ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে আসেন। পুলিশ তাঁকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি সাদাসিধেভাবে বলেন, বাবু লোকদের জন্য চা আনতে যাচ্ছি। পুলিশের দারোগা কিছুক্ষণ জেরা করার পর সন্দেহ করার মতো কোনো কিছু না পেয়ে তাঁকে ছেড়ে দেয়। 
এর প্রায় একবছর পর ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের ৮ অক্টোবর কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিটের এক মেস থেকে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। তাঁদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় ‘মুরারিপুকুর ষড়যন্ত্র মামলা’।
এ মামলায় ১৯২৮ সাল পর্যন্ত দু’বছর তাঁকে মেদিনীপুর প্রেসিডেন্সি জেল, পুনার রায়েরোড়া জেল ও বম্বের রত্নগিরি জেলে কারাবাস করতে হয়।
১৯২৮ সালের শেষের দিকে তাঁর স্ত্রী পুষ্পকুন্তলা মূমূর্ষু থাকার সংবাদ পেয়ে সূর্যসেন তাঁকে দেখতে আসবার অনুমতি প্রার্থনা করেন। এই আবেদন মঞ্জুর করা হলে তিনি জেল থেকে ছাড়া পান।তাঁকে নজরবন্দী রাখা হয়।  মাস্টার'দা বাড়ি পৌঁছার পর তাঁর স্ত্রী পুষ্প কুন্তলা মৃত্যুবরণ করেন।এরপরই মাস্টার'দা টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে তিন মাস শয্যাশায়ী থাকলেন। এ সময় একজন ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট তাকে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর পরামর্শ দেন এবং এর বিনিময়ে সংসারের খরচ ব্রিটিশ সরকার চালাবে বলে জানানো হয়।মাস্টার'দা সূর্যসেন তার কোনো জবাব দেন নি। সূর্যসেনের দাদা চন্দ্রনাথ সেন বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে সময় চেয়ে নেন। এরপর একদিন পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয় েসূর্যসেন পালিয়ে যান।কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকেন।
১৯২৯ সালের প্রথম দিকে তিনি চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ সময় সূর্য সেনের দলের উদ্যোগে চারটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।১৯৩০ সাল থেকেই তাঁর উদ্যোগে ভবিষ্যৎ সশস্ত্র আন্দোলনের ব্যাপক প্রস্তুতি শুরু হয়।

এরপর থেকে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের জন্য পরিকল্পনা করতে থাকেন। এর চূড়ান্ত রূপ লাভ করে ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই এপ্রিল। ১৮ এপ্রিল ১৯৩০, শুক্রবার রাত ৮টা বিদ্রোহের দিন হিসাবে ঠিক হয়। পরে তা দশটা করা হয়। চারটা বাড়ি হতে চারটা দল আক্রমণের জন্য বের হয়। সে রাতেই ধুম রেলস্টেশনে একটা মালবহনকারী ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে উল্টে যায়। একদল বিপ্লবী আগে থেকেই রেল লাইনের ফিসপ্লেট খুলে নেয়। ফলে চট্টগ্রাম সমগ্র বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অন্য একটি দল চট্টগ্রামের নন্দনকাননে টেলিফোন এবং টেলিগ্রাফ অফিস আক্রমণ করে। হাতুড়ি দিয়ে তারা সব যন্ত্রপাতি ভেঙ্গে দেয় এবং পেট্রোল ঢেলে সেখানে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। আরেকটি দল পাহাড়তলীতে অবস্থিত চট্টগ্রাম রেলওয়ে অস্ত্রাগার দখল করে নেয়। উন্নতমানের রিভলবার ও রাইফেল গাড়ীতে নিয়ে অস্ত্রাগারটি পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগানো হয়। তবে সেখানে কোনো গুলি পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ পরিকল্পনা অনুযায়ী বিপ্লবীরা দামপাড়ায় পুলিশ রিজার্ভ ব্যারাক দখল করে নেয়। ৬৫ জন যোদ্ধা নিয়ে প্রায় রাত দশটার দিকে আক্রমণ করে চট্টগ্রাম পুলিশ লাইনে অবস্থিত অস্ত্রাগার দখল করেন তাঁরা। তখন তাঁদের পরনে ছিল সেনাবাহিনীর পোষাক। তাঁরা ব্যবহার করেছিলেন কয়েকটি রিভলবার এবং সাধারণ বন্দুক। অস্ত্রাগার ভেঙে তাঁরা মাস্কেট্রি রাইফেল, রিভলবার এবং কার্তুজ লাভ করেন। এই আক্রমণের শুরুতেই তাঁরা টেলিফোন লাইন কেটে দিয়েছিলেন। ফলে আক্রমণের সময়, ব্রিটিশ পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা শহরের অন্য প্রান্তের সৈন্যদের কাছে এই আক্রমণের যথার্থ সংবাদ পাঠাতে ব্যর্থ হয়। এই সময় বিপ্লবীরা এত দ্রুত আক্রমণ করে দখল করে নেয় যে, সার্জেন্ট ব্লাকবার্ন, কলোন, সার্জেন্ট মেজর ফেরেল-সহ অনেক অফিসার প্রতিরোধ করার আগেই মৃত্যুবরণ করেন। বিপ্লবীরা সফলভাবে টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে সক্ষম হন এবং রেল চলাচল বন্ধ করে দেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী গণেশ ঘোষের নেতৃত্বে একদল বিপ্লবী পুলিশ অস্ত্রাগারের এবং লোকনাথ বাউলের নেতৃত্বে দশজনের একটি দল সাহায্যকারী বাহিনীর অস্ত্রাগারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। এই দুঃসাহসী কাজের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে ছিলেন বিপ্লবের স্বপ্নপুরুষ মাস্টারদা সূর্য সেন।

 এতে ব্রিটিশ শাসকেরা ভয় পেয়ে যায়। তারা বুঝতে পারেবাংলা মায়ের সন্তানেরা পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙ্লো,  প্রায় দেড়শ বছরের মিথ্যা গৌরব ধুলোয় মিশে যায়। 

বিপ্লবীদের কাছে ব্রিটিশ আর্মি পরাজিত হয়ে পিছু হঠে যায়। সফল অভিযানের পর বিপ্লবী দলটি পুলিশ অস্ত্রাগারে সমবেত হয়ে মাস্টারদা সূর্য সেনকে মিলিটারি স্যালুট প্রদান করে। এ সময় সূর্য সেন জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার ঘোষণা করেন। এই আক্রমনে অংশ নেয়া বিপ্পবীরা দামপাড়া পুলিশ লাইনে সমবেত হয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। মিলিটারি কায়দায় কুচকাওয়াজ করে সূর্য সেনকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সূর্য সেন অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার গঠনের ঘোষনা দেন। 

মাস্টার’দা তাঁর ঘোষনায় বলেন:"The great task of revolution in India has fallen on the Indian Republican Army. We in Chittagong have the honour to achieve this patriotic task of revolution for fulfilling the aspiration and urge of our nation. It is a matter of great glory that today our forces have seized the strongholds of Government in Chittagong…The oppressive foreign Government has closed to exist. The National Flag is flying high. It is our duty to defend it with our life and blood". 

 ব্রিটিশ পরাধীনতা থেকে বীর চট্টগ্রাম মুক্ত ছিল চারদিন। কিন্তু এরমধ্যে বিপ্লবীদের খাদ্যসংকট দেখা দিল।সূর্য সেন সহ অন্যদের কচি আম, তেঁতুল পাতা, কাঁচা তরমুজ এবং তরমুজের খোসা খেয়ে কাটাতে হয়। সূর্য সেন সহ ছয়জন শীর্ষস্থানীয় বিপ্লবীকে ধরার জন্য ইংরেজ সরকার ৫,০০০ টাকা পুরস্কার ঘোষনা করে।

 ১৯৩০ সালের ২২ এপ্রিল বিপ্লবীরা যখন জালালাবাদ পাহাড়ে ( বর্তমানে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের পাহাড়) অবস্থান করছিল সে সময় সশস্ত্র ইংরেজ সৈন্যরা তাঁদের আক্রমণ করে। দুই ঘন্টার প্রচন্ড যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর ৭০ থেকে ১০০ জন এবং বিপ্লবী বাহিনীর ১২ জন নিহত হয়। জালালাবাদ যুদ্ধের পর বিপ্লবী নেতাদের ধরার জন্য রেলস্টেশন, স্টীমারঘাট থেকে শুরু করে সব জায়গায় অভিযান চলছিলো। বিপ্লবীরা তখন বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে আত্মগোপন করেছিলো।

মাস্টার’দা সূর্য সেন ১৬ জন বিপ্লবীকে নিয়ে ২৪ এপ্রিল রাতে নিজ বাড়িতে ছিলেন। এর মধ্যে অনন্ত সিং পুলিশের কাছে স্বেচ্ছায় ধরা দেন এবং কয়েকজনকে পুলিশ আটক করে এদের বিরুদ্ধে অস্ত্রাগার লুন্ঠন মামলা শুরু করে। মামলা শুরু হওয়ার পর অসুস্থ অম্বিকা চক্রবর্তী পটিয়া থানার চক্রশালা গ্রামে গ্রেপ্তার হন। অম্বিকা চক্রবর্তী এবং সেসময় গ্রেপ্তার হওয়া অন্য বিপ্লবীদের নিয়ে দ্বিতীয় অস্ত্রাগার লুন্ঠন মামলা শুরু হয়। প্রায় ১৯ মাস বিচারের পর ১৯৩২ সালের ১লা মার্চ অস্ত্রাগার লুন্ঠন মামলার রায়ে অনন্ত সিং, লোকনাথ বল এবং গনেশ ঘোষসহ ১২ জনকে দ্বীপান্তর বাসের আদেশ দেয়া হয়। অপর মামলায় অম্বিকা চক্রবর্তীর প্রাণদন্ডের আদেশ হয়, পরে হাইকোর্টে আপিলের রায়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়। 

রায়ের পর সূর্য সেনকে ধরার জন্য পটিয়া এবং গোমদন্ডীতে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়। ব্রিটিশ সরকার ৫০০০টাকার দ্বিগুণ ১০,০০০ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করে মাস্টার’দা কে গ্রেফতার করবার জন্যে।১৯৩২ সালের ১৩ জুন রাত ৯টায় পটিয়ার ধলঘাট গ্রামে সাবিত্রী চক্রবর্তীর বাড়িতে তাঁকে ধরার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন ক্যামেরনকে গুলি করে সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত পালিয়ে যেতে সক্ষম হন কিন্তু নির্মল সেন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।

 ব্রিটিশ সৈন্যরা সশস্ত্র যুদ্ধে মাস্টার'দার বাঙ্গালী সহযোদ্ধাদের কাছে  গোহারা হেরে ইংরেজ সরকার  মাস্টার’দা কে ধরিয়ে দেয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে।  সেই পুরস্কারের লোভে ১৯৩৩ সালে আত্মগোপনে তাঁর বাড়িতে অবস্থানের সময় মাস্টার'দার প্রতিবেশী নেত্র সেন বিশ্বাসঘাতকতা করে মাস্টার’দা কে ধরিয়ে দেন পুলিশের হাতে ।ধরা পড়েন বিপ্লবী মাস্টার'দা সূর্যসেন। 

মাস্টার'দা কে ধরিয়ে দেয়ার পুরস্কারের টাকা দিয়ে বিশাল আকৃতির মাছ কিনে  এনে  রান্না করে খাওয়ার সময়ে সেই মাছের মাথার পাশেই বিশ্বাসঘাতক নেত্র সেনের খন্ডিত মস্তক পড়ে থাকে। মাস্টার'দা কে ধরিয়ে দেবার দন্ড এভাবেই ভোগ করতে হয় বিশ্বাসঘাতক নেত্র সেনকে।

১৯৩৩ সালের মার্চে বিপ্লবীরা জেল থেকে সূর্য সেনকে মুক্ত করার জন্য কয়েকবার চেষ্টা চালায়। প্রতিবারই ফাঁস হয়ে যায় তাদের গোপন পরিকল্পনা। 
সূর্য সেন, তারকেশ্বর দস্তিদার এবং কল্পনা দত্তকে বিচারের জন্য ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ১২১/১২১এ ধারা অনুযায়ী স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। 
১৪ আগস্ট ১৯৩৩ সালে সূর্য সেন ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। ট্রাইব্যুনাল সূর্য সেনকে ১২১ ধারা অনুসারে দোষী সাব্যস্ত করে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করে। ওই একই ধারায় তারকেশ্বর দস্তিদারেরও প্রাণদণ্ডের আদেশ হয়। কুমারী কল্পনা দত্তকে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২১ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়।সূর্য সেনকে কনডেম সেলে কড়া পাহারায় নির্জন কুঠুরিতে রাখা হত। 

ফাঁসিতে দন্ডিত হবার আগে জেলে আটক বিপ্লবী কালীকিঙ্কর দে’র কাছে সূর্য সেন পেন্সিলে লেখা একটি বার্তা পাঠান। ধরে নেওয়া হয় এটি জীবদ্দশায় মাস্টারদার শেষ চিঠি। সে বার্তায় তিনি লেখেন “আমার শেষ বাণী-আদর্শ ও একতা”। তাঁর ভাষায় “ভারতের স্বাধীনতার বেদীমূলে যে সব দেশপ্রেমিক জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের নাম রক্তাক্ষরে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে লিখে রেখো’।
সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের লাশ তাদের আত্মীয় স্বজনদের হাতে হস্তান্তর করা হয়নি এবং ধর্মীয় নিয়ম অনুযায়ী পোড়ানোও হয়নি। ফাঁসির পর লাশদুটো জেলখানা থেকে ট্রাকে করে তৎকালীন ৪ নম্বর স্টিমারঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর মৃতদেহের বুকে লোহার টুকরা বেঁধে বঙ্গোপসাগর আর ভারত মহাসাগরের সংলগ্ন কোনো স্থানে ফেলে দেয়া হয়।
অস্ত্রাগার লুন্ঠন  মামলায় ইন্ডিয়ান পেনাল কোড ১২১/১২১এ ধারা অনুযায়ী স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল ১৪ আগষ্ট ১৯৩৩ সালে মামলার রায় ঘোষনা করে। এবং ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জানুয়ারী তাঁর ফাঁসি কার্যকর করা হয়। 
অস্তমিত হয় বীরত্বের মহান সূর্য! 

যিনি রচনা করে গেছেন এমন ইতিহাস  যা চিরদিন বাঙ্গালীর শৌর্য আর গৌরবের প্রমাণ হয়ে জ্বলজ্বল করবে বিশ্ববাসীর কাছে, নিপীড়িত মানুষের অন্তরে !!মাষ্টার দা সূর্যসেন চিরজীবী হোন।

মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে তিনি সহযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে যে চিঠি পাঠিয়েছিলেন, তাতে লেখা ছিল- 

"আমার শেষ বাণী – আদর্শ ও একতা। ফাঁসির রজ্জু আমার মাথার উপর ঝুলছে। মৃত্যু আমার দরজায় করাঘাত করছে। মন আমার অসীমের পানে ছুটে চলছে। এই তো আমার সাধনার সময়। এই তো আমার 
বন্ধুরূপে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার সময়, হারানো দিনগুলোকে নতুন করে স্মরণ করার এই তো সময়।
কত মধুর তোমাদের সকলের স্মৃতি। তোমরা আমরা ভাই-বোনেরা তোমাদের মধুর স্মৃতি বৈচিত্র্যহীন আমার এই জীবনের একঘেয়েমিকে ভেঙে দেয়। উৎসাহ দেয় আমাকে। এই সুন্দর পরম মুহূর্তে আমি তোমাদের জন্য দিয়ে গেলাম স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন। আমার জীবনের এক শুভ মুহূর্তে এই স্বপ্ন আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। জীবনভর উৎসাহভরে ও অক্লান্তভাবে পাগলের মতো সেই স্বপ্নের পেছনে আমি ছুটেছি। জানি না কোথায় আজ আমাকে থেমে যেতে হচ্ছে। লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগে মৃত্যুর হিমশীতল হাত আমার মতো তোমাদের স্পর্শ করলে তোমরাও তোমাদের অনুগামীদের হাতে এই ভার তুলে দেবে, আজ যেমন আমি তোমাদের হাতে তুলে দিয়ে যাচ্ছি। আমরা বন্ধুরা – এগিয়ে চল, এগিয়ে চল – কখনো পিছিয়ে যেও না। পরাধীনতার অন্ধকার দূরে সরে যাচ্ছে। ঐ দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতার নবারুণ। কখনো হতাশ হয়ো না। সাফল্য আমাদের হবেই। ভগবান তোমাদের আশীর্বাদ করুন।
১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই এপ্রিলের চট্টগ্রাম ইস্টার বিদ্রোহের কথা কোনো দিনই ভুলে যেও না। জালালাবাদ, জুলধা, চন্দননগর ও ধলঘাটের সংগ্রামের কথা সব সময় মনে রেখো। ভারতের স্বাধীনতার বেদিমূলে যেসব দেশপ্রেমিক জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁদের নাম রক্তাক্ষরে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে লিখে রেখো।
আমাদের সংগঠনে বিভেদ না আসে– এই আমার একান্ত আবেদন। যারা কারাগারের ভেতরে ও বাইরে রয়েছে, তাদের সকলকে জানাই আমার আশীর্বাদ। বিদায় নিলাম তোমাদের কাছ থেকে।বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক বন্দেমাতরম্।
চট্টগ্রাম কারাগার, ১১ জানুয়ারি ১৯৩৪ সকাল ৭টা।"


পরিশেষে বলতে হয়,  মাষ্টার'দা,  আপনার স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ আজ  'সংখ্যালঘু- সংখ্যাগুরু' প্রশ্নে সন্ত্রাস আর হত্যায় রক্তাক্ত! তবু আমরা বিশ্বাস করি,  স্বাধীনতার পতাকা হাতে সাম্য  আর পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্তির জন্য আপনার বীরত্বপূর্ণ লড়াই নতুন প্রজন্মের চেতনায় অগ্নিমশাল জ্বালাবেই।   মাস্টারদা সূর্যসেন অমর . চিরজীবী । মাষ্টার'দা, আপনার আত্মোৎসর্গের এই দিনে জানাই প্রণতি আর  শ্রদ্ধাঞ্জলি। প্রত্যাশা করি আমাদের নতুন প্রজন্ম আপনার আদর্শে দীক্ষা নেবে-  আপনার দীক্ষা আপনার আত্মদান ব্যর্থ হতে পারে না!
শত প্রণাম তোমার চরণে মাস্টার'দা সূর্য সেন!!!!

১২ জানুয়ারী ,২০১৪
পুনলিখন-১২ জানুয়ারী,২০২৩ 
সুমি খান, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান
মাস্টার’দা সূর্যসেন ফাউন্ডেশন
সূর্য  মানসিক স্বাস্থ্যসহায়তা ও সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট

Thursday, January 9, 2014

আগামী সরকারের জন্য ১০ নম্বর বিপদ সংকেত: আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী


৫ জানুয়ারির নির্বাচনের দিনটা কেমন কাটল? রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলি, 'ভালোয় মন্দে আলোয় আধারে গিয়েছে মিশি।' এই নির্বাচন গণতন্ত্রের ব্যাকরণসম্মতভাবে হয়নি। কিন্তু গণস্বার্থ ও স্বাধীনতার পরিপূরকভাবে হয়েছে। এই নির্বাচনের বৈধতা হয়তো সীমাবদ্ধ, কিন্তু নৈতিকতা নয়। নৈতিক দিক থেকে এই নির্বাচনটির অনুষ্ঠান ছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলা, তার স্বাধীনতার আদর্শ রক্ষার জন্য অপরিহার্য। এই নির্বাচনের বিকল্প ছিল দেশে গণতন্ত্রের মুখোশে জঙ্গিবাদের প্রতিষ্ঠা। বাংলাদেশের আবার অঘোষিতভাবে পাকিস্তানের রাজনৈতিক কলোনিতে পরিণত হওয়া। যার পরিণাম ফল হতো মার্কিন ড্রোন হামলার সম্প্রসারিত এলাকা হওয়া।

এই সত্যটি এখন এক শ্রেণীর মতিভ্রষ্ট সম্পাদক, সাংবাদিক, টক শোর বক্তা, সুধীসমাজের নেতা নিজেদের স্বার্থে অথবা অপরের স্বার্থে অস্বীকার করতে পারেন, কিন্তু ইতিহাস একদিন সাক্ষ্য দেবে, শেখ হাসিনা একজন নারী রাজনীতিক ও সংসদীয় গণতন্ত্রের অনুসারী হয়েও এই গণতন্ত্র রক্ষার জন্য যে অসম সাহস ও অটল মনোবলের পরিচয় দিয়েছেন, তা শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় গণতন্ত্র ও গণরাজনীতিকে সুরক্ষা দিয়েছে।

বিভিন্ন ফ্রন্টে এত শত্রুর বিরুদ্ধে এত কম লোক যুদ্ধের জন্য দাঁড়িয়েছে- এমন নজির সাম্প্রতিক বিশ্বে বিরল। এই নির্বাচনে বাংলাদেশ সেই নজির স্থাপন করেছে। ঐতিহাসিক আর্নল্ড টয়েনবি বলেছেন, 'গণতন্ত্র কেবল মেষশাবক হলে টিকে থাকতে পারত না। আত্মরক্ষার জন্য তাকেও মাঝেমধ্যে বাঘের মূর্তি ধারণ করতে হয়।' 
আমার মতে, বাংলাদেশকে বিএনপির সাম্প্রদায়িকতা ও জামায়াতের হিংস্র ধর্মান্ধতা থেকে রক্ষার জন্য হাসিনা সরকার যদি সত্য সত্যই আসল বাঘের মূর্তি ধারণ করত, তাহলেও আপত্তি করার কিছু ছিল না।

৫ জানুয়ারির নির্বাচনের ফলে যে নতুন সংসদ গঠিত হতে যাচ্ছে এবং অনতিকাল পরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে নতুন সরকার গঠিত হবে, তাকে আগাম অভিনন্দন জানাই। প্রার্থনা করি, এবারের নির্বাচনের নৈতিকতার শক্তিতে তারা যেন বৈধতার সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে এবং দেশ ও জাতিকে শুধু সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত করা নয়, প্রকৃত সুশাসন (good governance) উপহার দিতে পারে।

গত পাঁচ বছর মহাজোট সরকার দেশের জন্য অভূতপূর্ব উন্নয়নের কাজ সমাধা করেও যে জনসমর্থন ও জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারেনি, তার বড় কারণ, কিছু যোগ্য মন্ত্রীর সঙ্গে মন্ত্রিসভায় অসংখ্য অযোগ্য, অসৎ ও অনভিজ্ঞ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ এবং মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও এক বিরাটসংখ্যক আওয়ামী এমপির দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও সন্ত্রাসে তাদের নির্বাচকমণ্ডলীর মধ্যে তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি হওয়া। ফলে শেষদিকে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছিল, এই শ্রেণীর মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও এমপিরা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় জনরোষের ভয়ে যেতে পারতেন না।

২০০৮ সালে শেখ হাসিনার দ্বিতীয় দফার মন্ত্রিসভায় সদস্যদের নামের তালিকা দেখেই যেমন কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলাম, আজও তেমনি আগামী সরকারের সদস্যদের নামের তালিকা দেখার আগেই আরো বেশি কঠোর ভাষায় শেখ হাসিনাকে সতর্ক করতে চাই। কারণ এবার যদি মন্ত্রিসভা গঠনে বা উপদেষ্টা নিয়োগে তিনি আগেরবারের নীতি অনুসরণ করেন, তাহলে তা হবে নিজের জন্য, তাঁর সরকারের জন্য ও তাঁর দলের জন্য 'ফ্যাটাল মিসটেক' বা চূড়ান্ত ভুল।

শেখ হাসিনা আমার চেয়েও ভালো করে জানেন, এবারের নির্বাচন দুটি গণতান্ত্রিক দলের মধ্যে নির্বাচনযুদ্ধ ছিল না। ছিল একাত্তরের পরাজিত শক্তি ও তাদের নব্য দোসরদের মরিয়া হয়ে ক্ষমতা দখলের সন্ত্রাস ও বর্বরতার বিরুদ্ধে স্বাধীনতার পক্ষ শক্তির প্রতিরোধ। ফলে শেখ হাসিনাকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার স্বীকৃত কোনো কোনো পন্থা এড়িয়ে চলতে হয়েছে। তাতে দেশপ্রেমিক জনগণের আপত্তি থাকার কথা নয়। যদি কারো আপত্তি থাকে আগামী সরকার গঠনের প্রক্রিয়ার মধ্যে নৈতিকতার ভিত্তি দৃঢ় করে তা শেখ হাসিনাকে কাটিয়ে উঠতে হবে। আর এই নৈতিকতার ভিত্তি জোরদার করার একমাত্র পথ জনগণকে তাদের পছন্দসই একটি সৎ ও যোগ্য সরকার এবং সেই সরকারের সুশাসন উপহার দেওয়া।

নির্বাচন তরীটি কোনোমতে ঠেলেঠুলে তীরে নিয়ে আসতে পারায় আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট ও তার নেত্রী শেখ হাসিনা যেন না ভাবেন, তাঁরা বিপদ ও সংকটমুক্ত হয়েছেন। সামনে আরো বড় বিপদ ও বড় লড়াই অপেক্ষা করছে। আমি আগেও বলেছি, জনসমর্থন না থাকলে কেবল সন্ত্রাস দ্বারা কোনো আন্দোলনে সাফল্য লাভ করা যায় না। বিএনপি-জামায়াতও তাই সাফল্য লাভ করতে পারেনি। এ জন্য নির্বাচনের পরও তারা থেমে থাকবে, তা নয়। সর্বশক্তি নিয়ে তারা মরণছোবল দেওয়ার চেষ্টা করবে।

এই চেষ্টা করার প্রমাণ, নির্বাচন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপি হরতাল ডেকেছে। এই হরতালে জনগণের সমর্থন না থাকলেও তারা সন্ত্রাসী জামায়াতিদের কাজে লাগাচ্ছে। আবার অগ্নিসংযোগ, হত্যা ও নির্যাতন দ্বারা প্রশাসন অচল করতে না পারুক, দেশের অর্থনীতিতে বিপর্যয় বাড়িয়ে তুলবে। এই সন্ত্রাস যদি বন্ধ করা না যায়, তাহলে জনগণের ধৈর্যের সীমা ভেঙে যাবে। তারা সরকারের প্রতি আস্থা হারাবে এবং বিক্ষুব্ধ হবে। চাইলে কি তাদের একটা বড় অংশ সন্ত্রাসমুক্ত হওয়ার আশায় সন্ত্রাসীদের সমর্থন জানাতে পারে। যদি তা হয়, তাহলে আগামী সরকার চরম বিপদে পড়বে। তাদের জন্য রাজনৈতিক আবহাওয়া দপ্তরের দশ নম্বর বিপদ সংকেত আমি এখনই দেখতে পাচ্ছি।

এই বিপদ সংকেত অগ্রাহ্য করা শেখ হাসিনা ও তাঁর আগামী সরকারের জন্য হবে চরম ভ্রান্তি। গত ছয় মাসের বেশি সময় ধরে তারা নির্বাচনবিরোধী সন্ত্রাসের মোকাবিলা করেছে। এটা ছিল তাদের জন্য সাত, আট বা ৯ নম্বর বিপদ সংকেত। এখন নির্বাচনের পর তাদের জন্য যে বিপদ সংকেত দেখা যাচ্ছে, তা দশ নম্বরের। এই ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস ঠেকাতে হলে কেবল আইন প্রয়োগ, পুলিশ ও র‌্যাব মাঠে নামিয়ে কাজ হবে না। জামায়াতি সন্ত্রাসীরা এখন অনেক বেশি সশস্ত্র ও ট্রেনিংপ্রাপ্ত। তারা এতটাই সংগঠিত যে ইলেকট্রিক বা বৈদ্যুতিক করাত এনে বড় বড় গাছ কেটে রাস্তায় ফেলে অবরোধ সৃষ্টি করতে পারে। কলকাতায় একটি কাগজে খবর দেখেছি, এই জামায়াতি সন্ত্রাসীরা পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত অঞ্চলে গিয়ে মাওবাদী ও সাবেক নকশালপন্থী সন্ত্রাসীদের কাছে বোমা বানানো ও অন্যান্য সন্ত্রাসের ট্রেনিং নিচ্ছে। ভারত সরকার সীমান্তে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েও তাদের ঠেকাতে পারছে না।

বাংলাদেশের আগামী সরকারকেও তাই কৌশল পাল্টাতে হবে। এই কৌশলটি হবে শুধু আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর দ্বারা নয়, এই সন্ত্রাস দমনের জন্য জনপ্রতিরোধ গড়ে তোলা। গত পাঁচ বছরে বিএনপি-জামায়াত যেমন তাদের সন্ত্রাসের পক্ষে জনসমর্থন আদায় করতে পারেনি; তেমনি আওয়ামী লীগ সরকারও পারেনি এই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে। কারণ সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকার ছিল ব্যর্থ। অধিকাংশ মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও এমপি ছিলেন জনগণের কাছে দুর্নীতি ও অন্যান্য অসাধু কার্যকলাপের জন্য বিতর্কিত, এমনকি নিন্দনীয়। তা ছাড়া আওয়ামী লীগও সংগঠন হিসেবে এখন অত্যন্ত দুর্বল। ছাত্রলীগ ও যুবলীগের আগের সুনাম ও প্রতিষ্ঠা নেই সাধারণ মানুষের কাছে।

আমি বয়সে বড় হয়েও শেখ হাসিনার পায়ে পড়ি। এবার যেন মন্ত্রিসভা গঠনে তিনি জেদ, কানকথা ও চাটুকারিতাকে প্রশ্রয় না দেন। যোগ্যতা ও সততাকে মন্ত্রী ও উপদেষ্টা পদে নিয়োগের মাপকাঠি করেন। সাধারণ মানুষের পছন্দসই ও আস্থাভাজন ব্যক্তিদের দ্বারা একটি ছোট অথচ কর্মক্ষম মন্ত্রিসভা গঠন করেন। উপদেষ্টার সংখ্যা যেন পাঁচজনের বেশি না হয় এবং তাঁরা বিতর্কিত ব্যক্তি না হন। আল্লাহর দোহাই শেখ হাসিনা, এবার যেন ঢাকা ক্লাবে বসে যাঁরা সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ঢুলু ঢুলু চোখে 'সরকারি দায়িত্ব পালন' করেন, তাঁদের কোনো কারণেই মন্ত্রিসভায় স্থান না দেন।

দেশের সামরিক ও অসামরিক প্রশাসনে বিএনপি-জামায়াত আমলে ঢুকে পড়া অনেক 'সাবোটিয়ার' আছে। তা সত্ত্বেও এবার আমাদের সেনাবাহিনী, অসামরিক প্রশাসন, র‌্যাব, পুলিশ, আনসার প্রমুখ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নির্বাচিত সরকারের প্রতি যে আনুগত্য ও দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছে, তা অতুলনীয়। 

সন্ত্রাসী-হামলা ঠেকাতে বহু পুলিশ আত্মদান করেছে। আগামী সরকারকে তাদের দেশপ্রেম, কর্তব্যনিষ্ঠা ও আনুগত্যেরও মূল্যায়ন করতে হবে। সন্ত্রাস ও দুর্নীতি দমনে প্রশাসন ও জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে এবং তা পারবে একটি দক্ষ, যোগ্য ও সৎ সরকার।

শেখ হাসিনা যদি এবার একটি সৎ ও দক্ষ সরকার দেশবাসীকে উপহার দিতে পারেন, তাহলে বর্তমান নির্বাচনের বৈধতার সীমাবদ্ধতা তিনি কাটিয়ে উঠতে পারবেন। আর যে 'হিজ মাস্টার্স ভয়েসের' মতো এক শ্রেণীর মিডিয়া ও টক শোর অবিরাম প্রলাপোক্তি তা-ও বন্ধ হবে। সন্ত্রাস যত সিংহমূর্তি ধারণ করুক, তাকে লেজ গুটিয়ে পালাতে হবে। শেখ হাসিনা, দেশকে একটি মোটামুটি অনেস্ট গভর্নমেন্ট উপহার দিন, যে গভর্নমেন্ট দেশকে সুশাসন দিতে পারবে। রাতারাতি দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হবে, তা বলি না। কিন্তু আগামী সরকার তার শুভ সূচনা করুক।

নির্বাচনের দিনটি পার হওয়া গেছে। কিন্তু নতুন যে সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে, তার জন্য আগাম দশ নম্বর বিপদ সংকেতও দেখতে পাচ্ছি। দেশপ্রেমিক চক্ষুষ্মান ব্যক্তিমাত্রই তা দেখতে পাচ্ছে। আবারও বলি-

সামনে আছে ঝড় তুফান

শেখ হাসিনা, সাবধান!! 

(কালের কণ্ঠে প্রকাশিত)

Sunday, January 5, 2014

পোষ্টমর্টেম নির্বাচন - সুমি খান

এভাবে মানুষকে জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ করে পিটিয়ে হত্যা করে ও ভোট দেয়া ঠেকাতে পারলো না সন্ত্রাসী রা.....


 প্রাণভয়ে ভোটাররা অনেকেই যায় নি ভোট কেন্দ্রে। অনেকে দ্বিধান্বিত... তার ওপরে আবার অবরোধ-হরতাল। 

 আমার ভাইয়া কৃতি গবেষক চিন্তাবিদ হাসান মাহমুদ জানালেন, ইংল্যাণ্ডে ২১% ভোটারের ভোটে সরকার গঠন হয়েছিল কবে যেন, কিন্তু ওসব দেশে, ক্যানাডাতেও বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম লোক ভোট দেয়. আমাদের জন্য কমপক্ষে ৪০% হলে চলে যায় বোধহয় ।

3:30 PM - আজ এ পর্য্যন্ত নিহত ১৩জন ও মোট ১৮১০৮টি কেন্দ্রের মধ্যে ১৫২ টি স্থগিত। 

3:00 PM - SAME AS BEFORE. খুলনায় সর্বোচ্চ ভোট পড়েছে ২০% 

2:30 PM - মোট নিহত ১২জন। সি-ই-সি জানাচ্ছে মোট ভোট কেন্দ্র ১৮১০৮ টি, স্থগিত ১৪৩ - স্থগিত কেন্দ্রগুলোতে ২৪ শে জানুয়ারীর মধ্যে আবার নির্বাচন হবে. 

2:00 PM - এখনো এ পর্য্যন্ত নিহত ৯ জন ও মোট ১৮২০৮ টি কেন্দ্রের মধ্যে ১৪০টি স্থগিত। অর্থাৎ ভোট গ্রহণ চলছে ৯৯.২৫% কেন্দ্রে, স্থগিত ০.৭৫% কেন্দ্রে। 

1:30PM - এখনো মোট ১৪০টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত - এ পর্য্যন্ত নিহত ৯ জন - বেশী সহিংস এলাকার মধ্যে আছে ফেনী, মুন্সিগঞ্জ, দিনাজপুর, লক্ষ্মীপুর, রংপুর ও নীলফামারী। শুধু চোখ-খোলা চেহারা-ঢাকা নেকাবী নারী-ভোটারও দেখা গেছে - দক্ষিন এশীয় ২ দেশের পর্য্যবেক্ষক দল সন্তুষ্ট। 

1:00 PM - এখনো মোট ১৪০টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত - এ পর্য্যন্ত সর্বমোট নিহত ৮জন - কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ চলছে - বোমা বানাতে গিয়ে শিবির আহত, ব্যালট বাক্স ছিনতাই-এর সময় যুবদল নেতা গুলিবিদ্ধ ইত্যাদি।... 

12:45 PM - (১) বেগম খালেদা জিয়া জাতির প্রতি ভিডিও বার্তা দিতে পারেন। (২) পার্বতীপুরে জামাতের হামলায় এক আনসার নিহত। (৩) সামগ্রিকভাবে নারী-ভোটারের উপস্থিতি বেশী। 

12:30 PM - এখনো মোট ১৪০টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত; নীলফামারীতে ডিমলা ও জলঢাকায় পুলিশের সাথে সংঘর্ষে ২জন জামাত নেতা নিহত। দেশে সর্বমোট ভোটকেন্দ্র কতো কেউ জানাবেন? 

12 NOON - বিভিন্ন জায়গায় নিহত ৬ - এখনো মোট ১৪০টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত - ফেনীতে ব্যালট বাক্স ছিনতাই চেষ্টায় পুলিশের গুলিতে নিহত একজন 

11:30 AM - মোট ১৪০টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত 

11:15 AM - মোট ১৩৮টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত.. সর্বমোট ১৪৭ আসন, ভোটার সাড়ে ৪ কোটি। দেশে সর্বমোট ভোটকেন্দ্র কতো তা বলতে পারছি না. 

11:00 AM - মোট ১৩৬টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত - বিভিন্ন জায়গায় আগুন দেয়া, ককটেল বিস্ফোরণ, আহত, কয়েকজন নিহত, ককটেল সহ আটক কয়েকজন - পটুয়াখালীর খাসেরহাট স্কুলের ভোটকেন্দ্র থেকে ২২টি ককটেল সহ অন্যান্য জায়গায় ককটেল, ভারী বোমা ও পেট্রল বোমা উদ্ধার।

ব্যালট ছিনতাই আগুন দেয়া সহ সর্বাত্মক সহিংসতার মধ্যে চলছে ভোট - মোট ৩৭টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত - আজিমপুরে রাস্তায় পড়ে থাকা ককটেলে শিশু আহত - BD time 10 AM.

10:15 AM - জামাতের শক্তি বিশেষে কোন জায়গায় হিংস্রতা বেশী ও ভোট স্থগিত, অন্যান্য জায়গায় ভোট ভালই চলছে। কেউ জানেন সারা দেশে সব মিলিয়ে কতো ভোট কেন্দ্র? 

রংপুর ভোটকেন্দ্র দখলের চেষ্টায় ২জন নিহত। 

10:22 AM - মোট ১২৬টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত - এ পর্য্যন্ত মোটামুটি ৫% ভোট দেয়া হয়েছে - খুলনার পুলিশ কর্মকর্তা। ভোট চলবে বিকেল ৪টা পর্য্যন্ত। কোথাও কোথাও শীত প্রচণ্ড 
10:30 AM - মোট ১৩৩টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত -

Friday, January 3, 2014

চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকী


বাংলাদেশের মফস্বল সাংবাদিকতার পথিকৃত মোনাজাতউদ্দিন। আজ রবিবার চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি ছিলেন একজন আপাদমস্তক সাংবাদিক। মূলত তার আগ্রহের জায়গা ছিল অনুসন্ধানী সংবাদ এবং তার ফলোআপ ।  ১৯৯৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে তিনি ফেরি থেকে পড়ে গিয়ে মৃত্যবরণ করেন।

মোনাজাতউদ্দিন-এর জন্ম ১৯৪৫ সালের ১৮ জুন রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলার মরনিয়া গ্রামে। পিতা আলিমউদ্দিন আহমদ , মাতা মতিজাননেছা। পিতা আলিমউদ্দিন ছিলেন চাকুরিজীবি। তিনি রংপুর পৌরসভার উর্ধ্ব-করণিক, রংপুর পুলিশ দপ্তরে প্রধান-করণিক এবং রংপুর কারমাইকেল কলেজের হিসাব রক্ষক হিসেবে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন।

আলিমউদ্দিন ‘আম্বিয়া চরিত’ নামে একখানা গ্রন্থ রচনা করেন। অপ্রকাশিত ‘আধুনিক যোদ্ধা’ নামে একটি বইয়ের পান্ডুলিপিও রচনা করেছিলেন।

মোনাজাতউদ্দিনের পড়াশোনা শুরু গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে। রংপুরের কৈলাসরঞ্জন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে রাজশাহী বোর্ডের অধীনে মাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষা পাশ করেন। রংপুর কারমাইকেল কলেজে থেকে মানবিক শাখায় ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। কারমাইকেল কলেজে বি.এ পড়াকালীন হঠাৎ করেই পিতার মৃত্যুতে পরিবারের দায়-দায়িত্ব নিতে হয় মোনাজাতউদ্দিনকে। তিনি লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।

চাকুরি নেন নিশাতগঞ্জ সরকারি প্রাইমারি স্কুলে। কিছুদিন পরে সেই চাকুরি ছেড়ে দিয়ে পিডিবি অফিসে একজন একাউনটেন্ট হিসেবে যোগ দেন । কিন্তু এই চাকুরিতে তাঁর মন বসেনি। তিনি কিছুকাল কাজ করেন রংপুর পাবলিক লাইব্রেরির ক্যাটালগার হিসেবে। হাতের লেখা সুন্দরের কারণে এই কাজটি তিনি অনায়াসেই পরিছন্নভাবে করতে পারতেন।

পারিবারিক কারণে বিভিন্ন স্থানে কাজ করলেও প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে বি.এ পাশ করেন ।

মোনাজাতউদ্দিনের সাংবাদিকতা জীবনের শুরু ছাত্র অবস্থাতেই। তিনি তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন ‘বগুড়া বুলেটিন’ পত্রিকার মাধ্যমে। ১৯৬২ সালে তিনি ঢাকার ‘দৈনিক আওয়াজ’ পত্রিকার স্থানীয় সংবাদদাতা হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন।

পরে ১৯৬৬ সালে ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকার উত্তরাঞ্চল প্রতিনিধি হিসেবে কাজে যোগদান করেন। এর আগে কিছুদিন ‘দৈনিক পূর্বদেশ’ পত্রিকায়ও কাজ করেন।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের মার্চে স্বাধীন চিন্তা, বিশ্বাস আর আদর্শের ভিত্তিতে প্রকাশ করেন ‘দৈনিক রংপুর’। শুধুমাত্র স্থানীয় সংবাদের ভিত্তিতে তিনি এই পত্রিকাটি বের করার চিন্তা করেন। ‘দৈনিক রংপুর’ ছিল মিনি সাইজের পত্রিকা, দাম মাত্র পাঁচ পয়সা। মোনাজাতউদ্দিন ছিলেন এর সম্পাদক-প্রকাশক।

এর অর্থ যোগাতেন একজন স্থানীয় ব্যবসায়ী। বাহ্যিকভাবে সেই ব্যবসায়ী সৎ মনে হলেও, প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন একজন অসৎ ব্যবসায়ী। যে কারণে তাঁর সঙ্গে মোনাজাতউদ্দিনের সম্পর্কের ইতি ঘটে। অবধারিতভাবেই এই পত্রিকাটির করুণ মৃত্যু হয়।

তখন ঢাকায় ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকাও বন্ধ । তাই বাধ্য হয়ে মোনাজাতউদ্দিনকে জীবিকার তাগিদে একটি কীটনাশক কোম্পানিতে চাকুরি নেন।

১৯৭৬ সালে ‘দৈনিক সংবাদ’-এ কাজ করার সুযোগ পান। তারপর থেকে একটানা প্রায় বিশ বছর সেখানেই কাজ করেছেন । ‘সংবাদ’ই ছিল তাঁর ঠিকানা।

বিশ বছর একটানা ‘সংবাদ’-এ কাজ করার পর তিনি দৈনিক জনকন্ঠে সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে যোগদান করেন ১৯৯৫ সালের ২৪ এপ্রিল। মৃত্যুর সময় পর্যন্ত তিনি সেখানেই কর্মরত ছিলেন।

১৯৯৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর ফুলছড়ি থানাধীন যমুনা নদীতে কালাসোনার ড্রেজিং পয়েন্টে দু’টি নৌকাডুবির তথ্যানুসন্ধান করতেই অসুস্থ শরীর নিয়ে যাত্রা শুরু করেন গাইবান্ধায়। যাবার পথে ‘শেরেবাংলা’ নামক ফেরিতেই তিনি দুর্ঘটনার মুখে পতিত হন।

ফেরির ছাদ থেকে হঠাৎ করেই পানিতে পড়ে যান। স্থানীয় নৌকার মাঝিরা তাঁর দেহ তাৎক্ষনিকভাবে উদ্ধার করতে পারলেও তাঁকে বাঁচানো যায়নি। ধারণা করা হয়, পানিতে পড়ার সাথে সাথেই তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

৩০ ডিসেম্বর তাঁকে রংপুর শহরের মুন্সীপাড়া কবরস্থানে দাফন করা হয়।

সাংবাদিকতার পাশাপাশি মোনাজাতউদ্দিন প্রচুর সমাজসেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ করেছেন। গ্রামীণ এলাকায় মানুষের কুসংস্কার, অন্ধতা দূর করতে তিনি তরুণদের নিয়ে সংগঠন করেছেন। কখনো তাদের নিয়ে নাটক করিয়েছেন, উৎসাহ দিয়েছেন সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলতে। তিনি নিজেও ছিলেন একজন গীতিকার ও নাট্যকার।

রংপুর বেতারে নিয়মিত কাজ করতেন। তাঁর একাধিক নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে।

যদিও চারুশিল্পে তাঁর তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না কিন্তু নিজের অধ্যাবসায়ের ফলে তিনি অনেক বই ও ছোট কাগজের প্রচ্ছদ করেছেন। একজন দক্ষ ফটোগ্রাফারও ছিলেন ।

মোনাজাতউদ্দিন তাঁর কর্ম জীবনের সাধনা ও স্বীকৃতিস্বরূপ নানা পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর মধ্যে রয়েছে ১৯৭৭ সালে রংপুর নাট্য সমিতি কর্তৃক সংবর্ধণা, ১৯৮৪ সালে পান সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী স্মৃতি পদক, আলোর সন্ধানে পত্রিকা তাঁকে ১৯৮৫ সালে সংবর্ধণা দেয়, ১৯৮৬ সালে ফটোগ্রাফিক সোসাইটি অব বগুড়া কর্তৃক সম্মাননা সার্টিফিকেট অর্জন করেন, দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত ‘মানুষ ও সমাজ’ শীর্ষক প্রতিবেদনের জন্য বাংলা ১৩৯৩ সালে পান ঐতিহ্যবাহী ফিলিপস্ পুরস্কার, ১৯৮৭ সালে সংবাদপত্রে প্রভূত অবদান রাখার জন্য বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স পুরস্কার পান, রংপুর পদাতিক গোষ্ঠী তাঁকে গুণীজন হিসেবে সংবর্ধণা দেয় ১৯৮৮ সালে, বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার পান ১৯৯০ সালে, একই সালে লেখনির মাধ্যমে প্রযুক্তির অন্তর্নিহিত শক্তিকে প্রত্যক্ষ ও জনপ্রিয় করার দুরূহ প্রচেষ্টা চালানোর জন্য সমাজ ও প্রযুক্তি বিষয়ক পত্রিকা ‘কারিগর’ সম্মাননা পান, ১৯৯৫ সালে মর্যাদাশালী অশোকা ফেলোশিপ লাভ করেন, রংপুরের নাগরিক নাট্যগোষ্ঠী কর্তৃক তাঁকে পুরস্কার প্রদান করা হয় ১৯৯৬ সালে, ১৯৯৬ সালে তিনি লালমনিরহাট ফাউন্ডেশন ও উন্নয়ন সমিতি স্বর্ণপদক পান, ঢাকাস্থ রংপুর জেলা সমিতি তাঁকে গুণীজন হিসেবে সংবর্ধিত করে ১৯৯৫ সালে, ১৯৯৭ সালে পান রংপুর জেলা প্রসাশন কর্তৃক গুণীজন সংবর্ধণা।

১৯৯৭ সালে অর্জন করেন রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পদক একুশে পদক।

খুলনায় তাঁকে রুমা স্মৃতি পদক প্রদান করা হয় ১৯৯৮ সালে। এছাড়া ওয়াশিংটনের পদ্মার ঢেউ বাংলা সম্প্রচার কেন্দ্র সম্মননা প্রদান করা হয় মোনাজাতউদ্দিনকে। তবে মোনাজাতউদ্দিন এই পুরস্কারের চাইতেও বড় পুরস্কার মনে করতেন মানুষের স্নেহ-শ্রদ্ধা ও ভালবাসাকে, যা তিনি অকুন্ঠই পেয়েছেন।

মোনাজাতউদ্দিন নাসিমা আক্তার ইতির সাথে ১৯৭০ সালের ১৪ ডিসেম্বর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। মোনাজাতউদ্দিন ও নাসিমা আক্তার ইতি’র দুই মেয়ে ও এক ছেলে। মাহফুজা মাহমুদ চৈতি ও হোসনাতুল ফেরদৌস দুই বোন। দুজনেই ডাক্তার। একমাত্র ছেলে আবু ওবায়েদ জাফর সাদিক সুবর্ণ (১৯৭৪-১৯৯৭) ছিলেন বুয়েটের মেধাবী ছাত্র। সে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র থাকাবস্থায় আত্মহত্যা করে।

মোনাজাতউদ্দিন তাঁর সংবাদিক জীবনে নানা মাত্রিকতার রিপোর্ট করেছেন। এসব নিয়ে বইও হয়েছে। পাশাপাশি লিখেছেন জীবনের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ নানা ঘটনা। যা পাঠক সমাজকে মোহতায় আবিষ্ট করে রাখে এখনো।

তাঁর বইগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘পথ থেকে পথে’, ‘সংবাদ নেপথ্য’, ‘কানসোনার মুখ’, ‘পায়রাবন্দের শেকড় সংবাদ’, ‘নিজস্ব রিপোর্ট’, ‘ছোট ছোট গল্প’, ‘অনুসন্ধানী রিপোর্ট’: ‘গ্রামীণ পর্যায়’, ‘চিলমারীর এক যুগ’, ‘শাহ আলম ও মজিবরের কাহিনী’, ‘লক্ষীটারী’, ‘কাগজের মানুষেরা’।

এছাড়াও মাসিক মোহাম্মদি, দৈনিক আজাদ, সওগাত ও অন্যান্য পত্র-পত্রিকায় তাঁর বেশ কয়েকটি গল্প প্রকাশিত হয়। নাটকের একমাত্র প্রকাশিত বই ‘রাজা কাহিনী’। 
এছাড়া তিনি প্রচুর ছড়া লিখেছেন।

***
তথ্যসূত্র: বাংলা একাডেমী প্রকাশিত জীবনী গ্রন্থ- ‘মোনাজাতউদ্দিন’ , লেখক- মোহাম্মদ জয়নুদ্দিন।

‘জয় বাংলা’ বলব ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলব না এ দীনতা ক্ষমা কর প্রভু : মুহম্মদ শফিকুর রহমান

জানতাম বাঙালী কৃতজ্ঞ জাতি। সে তার উপকারীকে মনে রাখে। জন্মদাতা পিতাকে তো ভোলার প্রশ্নই ওঠে না। এখন দিন পাল্টে গেছে। বরং উপকারীকে বাঘে খায়, ক্ষতিকারক পুরস্কৃত হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বলতেন যত অপকর্ম শিক্ষিত সাদা কাপড়অলারাই করে। আমাদের শিক্ষার হার অনেক বেড়েছে, আমরা এখন সাদা কাপড় পরি। তার মানে অপকর্ম করা লোকের সংখ্যা বেড়ে গেছে। 

১৬ ডিসেম্বর ২০১৩। মহান বিজয় দিবস। আমাদের সুদীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত অধ্যায় মহান মক্তিযুদ্ধের ৪৩তম বিজয়ের দিন। আবেগাপ্লুত হবার দিন। একদিকে ৩০ লাখ শহীদ ও ৬ লাখ মা বোনের আত্মত্যাগের বেদনা, আরেকদিকে হানাদার পাকি-মিলিটারি জান্তাকে পরাজিত করে বিজয় অর্জনের আনন্দ-এমনি আনন্দ-বেদনা-মিশ্রিত মহাকালের পথে যাত্রা শুরুর দিন এই ১৬ ডিসেম্বর। আমরা যারা এ পুরো প্রক্রিয়ার বিশেষ মুহূর্তের সঙ্গে জড়িত হবার সুযোগ পেয়েছি, গণঅভ্যুত্থানে, মুক্তিযুদ্ধে, আমাদের কাছে মহাকাল যাত্রার আবেগ-অনুভূতি এক রকম, পরবর্তী প্রজন্ম যারা কেবল বয়সের কারণে জড়িত হতে পারেনি, তাদের আবেগানুভূতি অন্য রকম। রাজাকাররা তো রাজাকারই।

দিনভর প্রেসক্লাব, শাহবাগ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘুরে ঘুরে বাড়ি ফিরলাম, বিষণœ মন নিয়ে। আগে প্রতিটি বিজয় দিবসে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে যেতাম। জিয়া-এরশাদের মিলিটারি শাসনের মধ্যেও। একবার তো এরশাদের মিলিটারির পিটুনি থেকে বেঁচে গেছি কেবল সাংবাদিক পরিচয়ে। তবে সেবার স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী জাতীয় নেতৃবৃন্দের ওপর বাঙালী মিলিটারির নির্যাতন প্রত্যক্ষ করেছি। সঙ্গে ছিল সংবাদের রিপোর্টার (লন্ডন প্রবাসী) আবু মূসা হাসান।
১৯৮২ সালের ১৬ ডিসেম্বর। তার আগে বছরের গোড়ার দিকে স্বাধীনতা দিবসের মাত্র দু’দিন আগে ২৪ ডিসেম্বর এরশাদ রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে ক্যুর মাধ্যমে। রক্তপাতহীন ক্যু। তখন রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিচারপতি আবদুস সাত্তার। সাত্তার সাহেব সহজেই এরশাদ সাহেবকে ক্ষমতা তুলে দিয়েছিলেন (পরবর্তীতে দুই মিলিটারি কর্নেল জাফর ইমাম ও জেনারেল মাজেদুল হকের কাছে দলের চেয়ারপার্সনের ক্ষমতাটিও খালেদা জিয়াকে দিয়েছিলেনÑ সেটিও ছিল আরেক রক্তপাতহীন ক্যু)। সেবার (১৯৮২) জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা স্মৃতিসৌধ এলাকা ছেড়ে যাবার পর সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, বেগম মতিয়া চৌধুরী, তোফায়েল আহমেদ, মুহম্মদ নাসিম, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং আরও অনেকে (সবার নাম এ মুূহূর্তে মনে পড়ছে না)। তারা একযোগে সেøাগান দিতে শুরু করেন ‘সামরিক শাসন-মানি না, মানব না’ ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’। সঙ্গে সঙ্গে লোকজন সরে যেতে থাকলেন। গেলেন না কেবল নেতৃবৃন্দ। তাঁরা তখনও সেøাগান দিচ্ছিলেন। এ সময় আমাদের পরিচিত একজন এএসপি বা এসবি (নাম মনে নেই) কাছে এসে আমাদের অদূরে তার পাশে দাঁড়াতে বললেন। প্রথম দিকে বুঝতে পারিনি। বুঝলাম পরে-যে দৃশ্য ছিল বেদনাদায়ক। দেখলাম একদল তরুণ, হাতে রাবারের রড, হকিস্টিক, ইলেকট্রিক তার পাকানো রড ইত্যাদি নিয়ে দৌড়ে স্মৃতিসৌধের গেটের দিকে আসছে এবং এসেই নেতৃবৃন্দকে বেধড়ক পেটাতে শুরু করে? অমানুষিক নির্যাতন। মুহম্মদ নাসিমের সাদা পাঞ্জাবির নিচে পিঠে চামড়া ফেটে রক্ত ঝরছে, আমরা অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে দেখলাম শুধু। এসপি বললেন-কোন মন্তব্য করবেন না, ওরা ডিজিডিএফআই-এর লোক। রড হাতে এক তরুণ আমাদের সামনে এসে কর্কশ কণ্ঠে বলল- দডযড় ধৎব ুড়ঁ’? এএসপি সাহেব নিজের পরিচয় দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দু’জনেরও পরিচয় দিলেন সাংবাদিক বলে। বললেন আমরা ডিউটি করছি। দডযধঃ ফঁঃু’ বলে দু’জন সিপাইকে ডেকে বললেন এঁদের বাইরে রেখে এসো। সিপাই দু’জন আর্মি কম্বেট ইউনিফরম পরা। তারা আমাকে ও হাসানকে বললেন, ‘স্যার আপনারা বোধ হয় অফিসার? ওরাও বড় অফিসার তাই না? ওদের ছবি খবরের কাগজে দেখেছি। দেখলেন আমাদের অফিসাররা ওদের কিভাবে মারল, এটা কি ঠিক করেছে? এরপর তারা দু’জন আমাদের ছেড়ে চলে যান। আমরাও ঢাকাগামী বাস পেয়ে উঠে বসি। তারপরও বহুবার সাভার স্মৃতিসৌধে গেছি। গত কয়েক বছর ধরে আর যাওয়া হয়নি। এবারও না। তবে আগেই বলেছি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে সৃষ্ট বিজয়ের আনন্দ উপভোগ করতে যেয়ে হোঁচট খেয়েছি। কোথায় যেন একটা অপূর্ণতা?

বাড়ি ফিরেও স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। রাইটিং প্যাড টেনে লিখতে শুরু করলাম, এগোলো না। জাতি হিসেবে আমরা কি তবে অকৃতজ্ঞ হয়ে গেছি? বাঙালী কৃতজ্ঞ জাতি- তা কি তবে ঘুছে গেছে? ভাবলাম কারও সঙ্গে শেয়ার করে মনটা হাল্কা করব। সেলফোন তুলে বন্ধু স্থপতি বদরুল হায়দারকে ডায়াল করলাম। বদরুলও আমার সঙ্গে একমত-আমরা কি তবে অকৃতজ্ঞ জাতি? বদরুলের সঙ্গে কথা শেষ করে ফোন রাখতেই বেজে উঠল। এবার অপরপ্রান্তে এ্যাডভোকেট আবদুস সালাম, মাঝে মধ্যে মালেক ভাইর বাসায় (আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা এবং বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক) বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা হয়। আবদুস সালাম ছাত্রজীবনে ক্যাম্পাসে ছাত্রনেতা ছিলেন। টেলিফোন তুলেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন- আমরা কি তবে সত্যি সত্যি অকৃতজ্ঞ?

এবারের ১৬ ডিসেম্বর দেশে তিনটি বড় ধরনের ঘটনা ঘটে গেল। দীর্ঘদিন মনে রাখার মতো। তিনটি বিশেষ ঘটনার কারণে। নতুন প্রেক্ষিতের কারণে অন্য রকম মাত্রা পেয়েছিল :

এক. বাঙালী জাতির সুদীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও আপন জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অনেক ঘটনাবহুল স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইমরান-লাকি-মারুফ রসুলদের গণজাগরণ মঞ্চের বিজয় উদ্যাপন সমাবেশে লাখো মানুষের অংশগ্রহণ এবং তাদের আহ্বানে দেশব্যাপী কোটি বাঙালীর একসঙ্গে দাঁড়িয়ে এককণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন। একই মঞ্চ থেকে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম-এর ডাকে একইভাবে কোটি কণ্ঠে রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার শপথ গ্রহণ। জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন এবং শপথ বাক্য পাঠের সময় (পাঠ করেন ফোরাম চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ. কে. খন্দকার) দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত টেলিভিশন বেতারের সামনে দাঁড়িয়ে মানুষ জাতীয় সঙ্গীত গেয়েছে, শপথ বাক্য পাঠ করেছে।
দুই. দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি হলো ২৭,১৩৭ জনের হাতে লাল-সবুজ কার্ড, নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জাতীয় পতাকার রূপ নেয়, যা ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ জাতীয় পতাকা। এটি গিনেস বুক অব রেকর্ডস-এ স্থান লাভ করেছে।
তিন. তৃতীয় ঘটনাটি হলো মিরপুরের কসাই কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর। এ সেই মিরপুরের কসাই কাদের মোল্লা যে শত শত লোককে হত্যা করেছে, নারী ধর্ষণ করেছে, মেহেরুন্নিসা নামে একজন কবিকে ধর্ষণ করে হত্যা করেছে, আলবদর বাহিনী গঠিত হলে তাতে যোগ দিয়ে দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। তার ফাঁসি কার্যকরও হলো ১৩ ডিসেম্বর রাত ১০টা ০১ মিনিটে, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের একদিন আগে ও বিজয় দিবসের তিন দিন আগে। 

এই পুরো ঘটনাবলীতে ভিন্নমাত্রা ভিন্ন আবেগ যোগ হলেও সর্বত্র একটি ঘাটতি থেকে গেল সব ক্ষেত্রে ‘জয় বাংলা’ সেøাগানটি উচ্চারিত হলেও কোথাও ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ উচ্চারিত হয়নি। অথচ ‘জয় জনতা’ ‘জয় মুক্তিযুদ্ধ’ এসব সেøাগানও শোনা যায়। এর নাম কি তবে নিরপেক্ষতা? অথচ ‘জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু’ এই দুই সেøাগান দু’টি একটি আরেকটি ছাড়া আধুরা, অসম্পূর্ণ। সেøাগান দুটির একটি ইতিহাস আছে। যে ইতিহাস এবারের বিজয় দিবসের প্রধান অনুষ্ঠানস্থল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সঙ্গে জড়িত।
বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নামও এই নাম ছিল না। ছিল না স্বাধীনতা স্তম্ভ, ছিল না গগণচুম্বী গ্লাস টাওয়ার এবং তা একদিনে গড়ে ওঠেনি। এই নাম এই অবয়বে গড়ে ওঠার পেছনে রয়েছে বাঙালী জাতির ইতিহাসের কয়েকটি বিশাল ঘটনা এবং যে ঘটনাগুলো গড়ে ওঠে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কেন্দ্র করে তাঁর নেতৃত্বে ও কর্তৃত্বে।
পাকিস্তান আমলে এর নাম ছিল রেসকোর্স। এখানে ঘোড় দৌড়ের জুয়া খেলা হতো। অর্থাৎ ঘোড়ার দৌড়ের ওপর বাজি ধরা হতো। যার ঘোড়া প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় হতো সে বা সেই সব লোক কয়েক মিনিট বা ঘণ্টার মধ্যে বিশাল অঙ্কের টাকার মালিক হয়ে যেত। যাদের বাজির ঘোড়া হেরে যেত তারা একইভাবে কয়েক মিনিট বা ঘণ্টার মধ্যে ফকির হয়ে যেত। এমন গল্পও শোনা গেছে, এই রেস খেলায় হারতে হারতে কেউ বউকে পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছে (যদিও এ কথার কোন তথ্যভিত্তিক প্রমাণ নেই)।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু দেশ থেকে মদ, জুয়া, হাউজি, ঘোড় দৌড় ইত্যাদি অসামাজিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করে দেন। মানবতাবিরোধী সংগঠন জামায়াত-মুসলিম লীগ-নেজামে ইসলামীও নিষিদ্ধ করেছিলেন। একইসঙ্গে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স-এর নাম পাল্টে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নামকরণ করেন। জাতির দুর্ভাগ্য বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মিলিটারি জিয়া রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে একদিকে সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ..... রাহিম’ সংযোজন করেন, পাশাপাশি পুনরায় মদ-জুয়া-হাউজি চালু করলেও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নাম পাল্টাবার ধৃষ্টতা দেখাননি। এখানে রেসকোর্স তথা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে ঘিরে সংঘটিত কিছু উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ করছি।
তবে শিশুপার্ক বানিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান তথা বঙ্গবন্ধুর নাম আড়াল করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু উপাধি

এই সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান যেখানে সমবেত বাঙালী তাদের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব লাহোরে সর্বদলীয় বৈঠকে বাঙালী জাতির পক্ষে ‘বাঙালীর মুক্তি সনদ’ ঐতিহাসিক ৬ দফা পেশ করেন। এক কথায় বলতে গেলে এই ৬ দফা ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন এবং তা থেকেই স্বাধিকার আন্দোলনের পথ ধরে স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালীর সুদীর্ঘ সংগ্রাম ও স্বপ্নের আপন জাতি রাষ্ট্র স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়।
৬ দফা দেয়ার পর তৎকালীন পাকিস্তানের মিলিটারি শাসক আইয়ুব প্রথমে বঙ্গবন্ধুকে এবং পরে একে একে সকল প্রথম সারির আওয়ামী লীগ নেতাকে গ্রেফতার করে। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে তথাকথিত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ দিয়ে ফাঁসিতে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। গোটা বাংলাদেশ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। ডাকসুর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ এবং ৬ দফার আলোকে ছাত্রদের ১১ দফাভিত্তিক আন্দোলন তখন ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক চলতে থাকে। সারা বাংলায় সৃষ্টি হয় এক সাহসী গণঅভ্যুত্থান। বাঙালীর প্রতিবাদের ভাষা বুঝতে পারে আইয়ুবের মিলিটারি প্রশাসন। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে কারাগার থেকে মুক্ত করে। ২৩ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় সংবর্ধনা এবং সংবর্ধনাও হয় এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্সে)। সংবর্ধনায় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক তৎকালীন ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদ ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত ১০ লাখ মানুষের ২০ লাখ উত্থিত হাত তা সমর্থন করে। বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান হন ‘বঙ্গবন্ধু’। সঙ্গে সঙ্গে ‘জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু’ এক সেøাগানে পরিণত হয়।

৭ মার্চের ভাষণ

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের কথা নতুন করে বিস্তারিত বলার আছে বলে মনে করি না। কেবল এটুকুই বলব, ৭ মার্চের ভাষণটিও বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই। এই ভাষণ বিশ্বের ২/৩টি শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণের একটি। তবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ অডিও-ভিডিও-সিডি বা মাইকে গত ৪৩ বছরে যতবার বাজানো হয়েছে বিশ্বে এর কোন দ্বিতীয় নজির নেই। একাত্তরের মার্চ মাসব্যাপী বঙ্গবন্ধুর ডাকে ইতিহাসের এক তাক লাগানো নজিরবিহীন অসহযোগ আন্দোলনের মাঝে ৭ মার্চের ভাষণ ছিল স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণা, কিভাবে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় অর্জন করতে হবে তারও রাজনৈতিক, সামরিক ও প্রশাসনিক দিকনির্দেশনা ছিল।

পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ

বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে রাত দেড়টায়। এর পর পরই পাকি মিলিটারি জান্তা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর সেই আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় তিনি “যার যার আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার এবং সর্বশেষ পাকি হানাদার আর্মিটিও বাংলার মাটি থেকে নিশ্চিহ্ন হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবার নির্দেশ দেন”। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী বাঙালী যে যেভাবে পেরেছে যুদ্ধে গেছেন, ভারতে যেয়ে ট্রেনিং ও অস্ত্র নিয়ে এসে যুদ্ধে শামিল হয়েছেন এবং ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়। এই বিজয়ের পেছনে আত্মত্যাগও ছিল সীমাহীন। ৩০ লাখ মানুষ শহীদ এবং ৬ লাখ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন। তার মধ্যে পৌনে ৩ লাখকে ধর্ষণ করে করে হত্যা করা হয়েছিল।
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার মিলিটারি জান্তা এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই বাঙালী মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর কাছে অবনত মস্তকে আত্মসমর্পণ করেছিল।

স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার মিলিটারি জান্তার আত্মসমর্পণের মাধ্যমে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর বিশ্ববিবেকের চাপে এবং বিশেষভাবে উল্লেখ্য ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধীর ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপে পাকিস্তান বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানের কারাগারে দুইবার বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেয়ার চেষ্টা করা হয়, কবরও খোড়া হয়েছিল, কিন্তু পারেনি (বাঙালী জাতির লজ্জা পাকিস্তান যা করতে সাহস পায়নি বাঙালীর কুলাঙ্গার সন্তান খুনী মোশতাক-জিয়া তা করেছিলেন)।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বিমানে প্রথমে লন্ডনে গেলে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এ্যাডওয়ার্ড হিথ বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা জানান। সেখান থেকে দিল্লীর পালাম বিমানবন্দরে অবতরণ করলে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভিভিগিরি (ভরাহ গিরি ভেংকট গিরি) ও প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। সেখানে মিসেস গান্ধীর (ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী) সঙ্গে ৪০ মিনিট একান্ত বৈঠক করেন (এই বৈঠকেই বঙ্গবন্ধু ভারতীয় সৈন্য বাংলার মাটি থেকে নিয়ে যাবার অঙ্গীকার আদায় করেন)। ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে সরাসরি এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এসে যুদ্ধ জয়ের জন্যে জাতিকে অভিনন্দন জানান এবং আল্লাহ পাকের শোকরিয়া আদায় করেন।
সেদিন বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান তথা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত যেন গোটা বাংলাদেশ ভেঙ্গে পড়েছিল। কত লোক হয়েছিল তার তুলনাও কেবল বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সাড়ে ৬ বছর প্রবাসী জীবন শেষে আওয়ামী লীগ সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সঙ্গেই হতে পারে। সেদিনও সারাদেশ যেন ভেঙ্গে পড়েছিল রাজধানীতে।

ইন্দিরা মঞ্চ

বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সফরে এলে তাঁকেও সংবর্ধনা দেয়া হয় এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে। এ উপলক্ষে যে সংবর্ধনা মঞ্চটি করা হয়েছিল তার নামও দেয়া হয়েছিল ‘ইন্দিরা মঞ্চ’। এখানে একটা কথা বলে রাখিÑ ১৯৭১ সালে মিসেস গান্ধী যেভাবে যুদ্ধ জয়ে সহযোগিতা করেছেন, যে যুদ্ধে ভারতের ১৭ হাজার সৈন্যও শহীদ হয়েছিল এবং যেভাবে এক কোটি শরণার্থীকে মাতৃস্নেহে দীর্ঘ ৯ মাস লালন করেছেন তার তুলনাও কেবল তিনিই। যে কারণে ইন্দিরা গান্ধী চিরকাল শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

শিখা চিরন্তন

মিলিটারি জিয়া ছিলেন চরম আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু বিদ্বেষী। তিনি প্রথম থেকেই বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার চক্রান্তে লিপ্ত হন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর দাফন না করার চক্রান্ত করেন। তারপর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান জুড়ে বঙ্গবন্ধুর নাম জিয়া তা মুছে দেয়ার জন্য শিশুপার্ক নির্মাণ করেন। যেমন তার স্ত্রী আজ গোপালগঞ্জের নাম মুছে দিতে চান। শিশুপার্ক যেহেতু বাচ্চাদের বিনোদনের ব্যাপার সেহেতু স্পর্শকাতর-এই সুযোগটিই জিয়া নিয়েছিলেন। কিন্তু বাঙালী জাতি ১৯৯৬ ও ২০০৮-এ ভোট দিয়ে জিয়ার সেই চক্রান্ত নস্যাত করার ম্যান্ডেট দেয় শেখ হাসিনাকে। শেখ হাসিনাও জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ইতিহাস ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনেন।
আজ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ। এখানে রয়েছে স্বাধীনতার ইতিহাস; শিখা চিরন্তন এবং গগণচুম্বী স্বাধীনতা (গ্লাস) টাওয়ার। আর এই শিখা চিরন্তনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে যোগ দেন বিশ্ব বরেণ্য নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, ইয়াসির আরাফাত ও সুলেমান ডেমিরেল। তাঁরা শিখা চিরন্তন প্রজ্বলন ও স্বাধীনতা টাওয়ারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে অংশ নেন।

গণআদালত

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধী ট্রাইব্যুনাল গঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্য শুরু হয়। ৩৮ হাজার গ্রেফতার হয় এবং তন্মধ্যে ১১ হাজারের বিরুদ্ধে যুদ্ধপরাধের চার্জ আনা হয় এবং তন্মধ্যে ৬ শতাধিকের মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদী সাজা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়া বিচার বন্ধ করে দেন এবং আটক ও সাজ্জাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করে দেন।
আজ সেই কালো দিন (৩১ ডিসেম্বর ১৯৭৫) যেদিন মিলিটারি জিয়া যুদ্ধাপরাধী বিচারের লক্ষ্যে গঠিত ৬৩ জেলা ৬৩টি ট্রাইব্যুনাল ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। বিচার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
তারপর দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পর শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, সর্বজন শ্রদ্ধেয় কবি বেগম সুফিয়া কামাল, জাতীয় অধ্যাপক কবির চৌধুরী, প্রধান কবি শামসুর রাহমানের নেতৃত্বে ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণআদালত বসানো হয় এবং তাতে যুদ্ধাপরাধের দায়ে গোলাম আযমের ফাঁসির (প্রতীকী) রায় দেয়া হয়। এই পুরো তৎপরতার পেছনে ছিলেন সেদিনের বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা, যার নেতৃত্বে আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে।
এসব ঘটনা উল্লেখ করলাম কেবল তরুণ প্রজন্মকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য। ইতিহাস লেখা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার কথা হলো বাঙালী জাতির হাজার বছর ধরে স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছে, বহুবার জিতেও ধরে রাখতে পারেনি। সে সব সংগ্রাম ছিল বিচ্ছিন্ন সংগ্রাম। একটি মাত্র মানুষ একটি মাত্র বজ্রকণ্ঠ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া থেকে উঠে এসে সকল বিচ্ছিন্ন সংগ্রাম এক মোহনায় প্রবাহিত করিয়ে বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এবং তা এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই।

ইতিহাসের সেই মহানায়কের নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-স্বাধীন সার্বভৌম বাঙালী জাতি ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা পিতা। তারই পদভারে আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাঙালীর বিজয় উদযাপিত হবে, আমাদের দীর্ঘ মুক্তি সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান  ‘জয় বাংলা’ উচ্চারিত হবে, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ উচ্চারিত হবে না, এ ক্ষেত্রে কেবল এ টুকুই বলব ‘এ দীনতা ক্ষমা কর প্রভু’।

Monday, December 30, 2013

স্মরণ ॥ বিচারপতি কেএম সোবহান এবং খালেদা জিয়ার ২৯ ডিসেম্বর অভিযাত্রা : শাহরিয়ার কবির


’৭১-এর গণ-হত্যাকারী, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং জামায়াতে ইসলামীর মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের চলমান আন্দোলনের পুরোগামী নেতা ছিলেন বিচারপতি কেএম সোবহান। আজ ৩১ ডিসেম্বর (২০১৩) তাঁর ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী। আমৃত্যু তিনি সক্রিয় ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ গড়বার এ আন্দোলনে।
২২ বছর আগে ১৯৯১-এর ২৯ ডিসেম্বর ’৭১-এর শীর্ষস্থানীয় গণহত্যাকারী ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী পাকিস্তানী নাগরিক গোলাম আযমকে দেশের সংবিধান লঙ্ঘন করে দলের আমির ঘোষণা করে যুদ্ধাপরাধীদের প্রধান দল জামায়াতে ইসলামী। গোলাম আযম ১৯৭১ সালেও জামায়াতের আমির ছিলেন এবং পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে যেমন সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেছেন তেমনি নিজেও ‘রাজাকার’, ‘আলবদর’, ‘শান্তি কমিটি’ প্রভৃতি ঘাতক বাহিনী গঠন করে গণহত্যায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। একজন শীর্ষস্থানীয় গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীর রাজনীতিতে অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে সারাদেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। মুক্তিযোদ্ধারা মিছিল করে গোলাম আযমের কুশপুতুল দাহ করেছেন। সংসদের ভেতরে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের অন্যান্য দলের সাংসদরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সমাবেশ ও বিক্ষোভ হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯২-এর ১৯ জানুয়ারি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।’ এরপর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনুসারী ৭২টি রাজনৈতিক দল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি।’ জাহানারা ইমাম এ সমন্বয় কমিটিরও আহ্বায়ক ছিলেন, যে সংগঠনের উদ্যোগে ’৯২-এর ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত গণআদালতে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের প্রতীকী বিচার হয়েছিল। খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকারের সকল বাধা অগ্রাহ্য করে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সেদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাঁচ লাখেরও অধিক মানুষের সমাগম হয়েছিল।
গণআদালতে গোলাম আযমের বিচারের অভূতপূর্ব কর্মসূচী সফল হওয়ার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের আন্দোলন সারাদেশে এবং বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমা অতিক্রম করে বাঙালী অধ্যুষিত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। নাগরিক সমাজের দাবি পরিণত হয়েছিল জাতীয় আন্দোলনে। গণআদালতের প্রথম বার্ষিকীতে কবি সুফিয়া কামালকে চেয়ারপার্সন করে অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের যাবতীয় অপরাধের তদন্ত ও তথ্য সংগ্রহের জন্য ‘জাতীয় গণতদন্ত কমিশন’ গঠন করা হয় বরেণ্য আইনজ্ঞ ও বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে। ১২ সদস্যবিশিষ্ট এ কমিশনের অন্যতম ছিলেন বিচারপতি কেএম সোবহান, যিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রাজপথের আন্দোলনেও সমানভাবে সক্রিয় ছিলেন।
১৯৯১-এর ২৯ ডিসেম্বর গোলাম আযমকে দলের আমির ঘোষণা করে জামায়াত জানিয়ে দিয়েছিল তারা বাংলাদেশের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান কিছুই মানে না। নির্মূল কমিটি এ কারণে ২৯ ডিসেম্বর ‘ঘৃণা দিবস’ হিসেবে পালন করেছে ২০০১ সাল পর্যন্ত, যতদিন গোলাম আযম জামায়াতের আমির ছিলেন। ২০০৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর আমাদের আন্দোলনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। সেদিন ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’সহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার ৭১টি সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এক যুক্ত ঘোষণায় স্বাক্ষর করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কেন জরুরী এবং কী ভাবে হবে সে বিষয়ে দেশবাসীকে অবহিত করেছেন এবং দ্রুত বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আরম্ভের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।
২৯ ডিসেম্বর এ ঘোষণা প্রদানের জন্য বেছে নেয়া হয়েছিল ঘৃণা দিবসের কারণে। জাতিকে আমরা মনে করিয়ে দিতে চেয়েছি ১৯৯১-এর ২৯ ডিসেম্বর জামায়াত কী ভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও সংবিধানের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিল। এ ঘোষণা প্রদানের আগে দীর্ঘ দুই মাস অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সকল সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দফায় দফায় আমাদের বৈঠক হয়েছে। তখন ড. ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যৌক্তিকতা মেনে নিলেও নিজেরা বিচারের উদ্যোগ গ্রহণে অনিচ্ছুক ছিলেন। জামায়াত যথারীতি বিচারের বিরুদ্ধে তাদের মিথ্যা প্রচারণা অব্যাহত রেখেছিল। আমাদের সমমনাদের কেউ কেউ বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে উত্থাপনের কথা বলছিলেন, কেউ স্বপ্রণোদিত হয়ে প্রচলিত আদালতে মামলা দায়েরের প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন। আমাদের ঘোষণায় এসব বিভ্রান্তি দূর করে ১৯৭৩-এ বঙ্গবন্ধুর সরকার কর্তৃক গৃহীত ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন’-এর অধীনে কী ভাবে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বাংলাদেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা যায় সে বিষয়ে সরকার ও দেশবাসীকে স্বচ্ছ ধারণা দিতে চেয়েছিলাম। এ জটিল ও অস্বচ্ছ আইনী বিষয়টিকে স্বচ্ছতা প্রদানের ক্ষেত্রে যাঁর অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি তিনি বিচারপতি কেএম সোবহান।
২০০৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর ধানমন্ডির বিলিয়া মিলনায়তনে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে ৭১ সংগঠনের এ ঘোষণা প্রদান করা হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার করুন।’ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছিলেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ও বিচারপতি কেএম সোবহান। প্রধান অতিথি ছিলেন সদ্য গঠিত ‘সেক্টস কমান্ডার্স ফোরাম’-এর প্রধান, মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি এয়ার ভাইস মার্শাল (অব) একে খন্দকার বীরোত্তম। নির্মূল কমিটির নেতৃবৃন্দ ছাড়াও এ ঘোষণা প্রদানের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মহিলা পরিষদের সভাপতি হেনা দাস, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসিরউদ্দিন ইউসুফ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ আবদুল আহাদ চৌধুরী, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদের চেয়ারম্যান কর্নেল (অব) শওকত আলীসহ নাগরিক আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ।
৭১ সংগঠনের এ ঘোষণায় বলা হয়েছিল, ‘ সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীর নেতা আলী আহসান মোঃ মুজাহিদ, আবদুল কাদের মোল্লা ও জামায়াতী বুদ্ধিজীবী ও সাবেক আমলা শাহ আবদুল হান্নান বলেছেনÑ ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে কোন যুদ্ধাপরাধের ঘটনা ঘটেনি, দেশে কোন স্বাধীনতাবিরোধী বা যুদ্ধাপরাধী নেই। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধকে গৃহযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের লম্পট ও চোর আখ্যায়িত করে তারা যেসব বক্তব্য প্রদান করেছেনÑ সারাদেশ প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। জামায়াত নেতাদের এসব চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ উক্তি এটাই প্রমাণ করে যে, তারা এখনও ’৭১-এর অবস্থান থেকে সরে আসেননি, বাংলাদেশকে এখনও তারা পাকিস্তান মনে করেন। ’৭১-এ তারা যে ভাষায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি বিষোদগার করতেন এখনও তারা তাই করছেন।
’৭১-এ বাংলাদেশে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের ঘটনা ঘটেনি এবং আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধ বলার অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশের সংবিধান অমান্য করা, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের উপহাস করা, ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান লাঞ্ছিত করা এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্তিত্ব অস্বীকার করা। আমাদের ইতিহাসে এবং সংবিধানে স্বাধীনতার যুদ্ধে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের কথা বলা হয়েছে, কোথাও বলা হয়নি তখন গৃহযুদ্ধ হয়েছিল। সংবিধানের প্রস্তাবনার প্রথম লাইনেই বলা হয়েছে, আমরা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছি। বাংলাদেশের কোন নাগরিক যদি বাংলাদেশের সংবিধান মানতে অস্বীকার করে তার বিচার হওয়া উচিত রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে।’
ঘোষণায় এরপর জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতৃবৃন্দের গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততার তথ্য প্রমাণ উত্থাপন করে বলা হয় বঙ্গবন্ধুর সরকার কী ভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আরম্ভ করেছিলেন এবং জেনারেল জিয়া দালাল আইন বাতিল করে কী ভাবে সে বিচার বন্ধ করে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর যেসব সরকার ক্ষমতায় ছিল তারা কেউ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করেনি, এটা জাতির জন্য নিঃসন্দেহে দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু এর অর্থ এটা নয় যে অতীতে কোন সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেয়নি বলে বিচার তামাদি হয়ে গেছে কিংবা যুদ্ধাপরাধী বলে বাংলাদেশে কেউ নেই। যুদ্ধাপরাধের বিচার কখনও তামাদি হয় না। ৬০-৬৫ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য খুঁজে বের করে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের পর জামায়াতের শীর্ষ নেতারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন, তাই তখন তাদের গ্রেফতার ও বিচার সম্ভব হয়নি। বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমান দালাল আইন বাতিল এবং সংবিধান সংশোধন করে তাদের দেশে ফেরার পথ সুগম করেছেন। এখন যেহেতু তারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে ষড়যন্ত্রের কলকাঠি নাড়ছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব এবং সংবিধানকে উপহাস করে বক্তৃতা বিবৃতি অব্যাহত রেখেছেন তাদের বিচার করা অতীতের যেকোনও সময়ের চেয়ে জরুরী হয়ে উঠেছে।
‘৩১ অক্টোবর (’০৭) সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠকে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমেদ বলেছেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ অনভিপ্রেত।’ ১ নবেম্বর সকল দৈনিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তাঁর এ মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। এর আগে সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলেছেন। নির্বাচন কমিশনও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার যোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জামায়াত নেতাদের ধৃষ্টতাপূর্ণ উক্তির জন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গোটা জাতি আবার ফুঁসে উঠেছে, যেমনটি আমরা দেখেছিলাম ’৯২-এ শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আন্দোলনের সূচনাপর্বে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি জামায়াত-শিবির চক্রের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের দাবিও আবার সর্বমহলে উচ্চারিত হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো যুদ্ধাপরাধী ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের দল জামায়াতে ইসলামীকে নিবন্ধিত না করার জন্য নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। ক্রমবর্ধমান জনরোষে ভীত হয়ে জামায়াত নেতারা উন্মাদের মতো আচরণ করছেন।
‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সারাদেশ যখন বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে তখন এ বিচার কী ভাবে হবে এ নিয়ে সুধীমহলেও তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রতিদিন এ বিষয়ে মন্তব্য প্রতিবেদন, ভাষ্য, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় লেখা হচ্ছে, যেখানে অসাবধানবশত কিছু বিভ্রান্তিমূলক কথাও বলা হচ্ছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত মন্তব্যে এবং বিভিন্ন টেলিভিশনের ‘টকশো’তে কোন কোন আইনজীবীও বলছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দুইভাবে শুরু হতে পারেÑ প্রথমতঃ সরকার বাদী হয়ে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু করতে পারেন, দ্বিতীয়তঃ বিদ্যমান ভুক্তভোগী বা সংক্ষুব্ধ কেউ তথ্যপ্রমাণ থাকলে আদালতেও যেতে পারেন। শেষোক্ত বক্তব্য আইনের দৃষ্টিতে সঠিক হলেও রাজনৈতিক বা অপরাধের গুরুত্বের বিবেচনায় যথাযথ নয় এবং তা প্রকৃত বিচারের অন্তরায়।
‘যুদ্ধের সময় সংঘটিত ‘গণহত্যা’, ‘যুদ্ধাপরাধ’, ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’, ‘শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ’ প্রভৃতি সাধারণ অপরাধ বা ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে অপরাধ নয়। এ অপরাধসমূহের চূড়ান্ত ভিকটিম হচ্ছে রাষ্ট্র, সরকার ও জনসাধারণ। গণহত্যার অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে জাতি, সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর আংশিক অথবা সম্পূর্ণ নির্মূলন। যুদ্ধের সময় ব্যক্তিবিশেষের ওপর নির্যাতন বা হত্যা হচ্ছে জাতি/সম্প্রদায়/গোষ্ঠী নিশ্চিহ্নকরণের অন্তর্গত। একইভাবে জনপদ ধ্বংস, ব্যাপক হত্যা সন্ত্রাস সৃষ্টির দ্বারা বিপুলসংখ্যক মানুষকে উদ্বাস্তু হতে বাধ্য করা ইত্যাদি সব কিছু যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অন্তর্গত। ব্যক্তি আপাত ভিকটিম হলেও চূড়ান্ত ভিকটিম হচ্ছে জাতি ও গোষ্ঠী এবং সেই জাতি ও গোষ্ঠীর যদি কোন সরকার বা রাষ্ট্র থাকে তা-ও। ’৭১-এর ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর এবং ১০ এপ্রিল স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার কর্তৃক গৃহীত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা অনুমোদনের পর থেকে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে পাকিস্তানী শাসন ব্যবস্থা, পাকিস্তানী সংবিধান এবং পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব বাতিল হয়ে গেছে। এ কারণেই পাকিস্তানী সামরিক জান্তার যে প্রতিনিধিরা ২৬ মার্চের পর বাংলাদেশে অবস্থান করছিল তারা দখলদার/হানাদার বাহিনীতে রূপান্তরিত হয়। এ দখলদার বাহিনীকে এদেশীয় যারা সাহায্য সহযোগিতা করেছে তারা দালাল বা কোলাবরেটর হিসেবে পরিচিত। যেকোন যুদ্ধে কোলাবরেটরদের কর্মকাণ্ড যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবে গণ্য করা হয়। জামায়াতে ইসলামী শুধু কোলাবরেটর ছিল না, ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা পাকিস্তানি সামরিক জান্তার অংশ ছিল; তাদের দুজন নেতা মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। ’৭১-এ তারা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের বৈধ সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল।
’৭১-এ জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে গণহত্যা ও নির্যাতনসহ যাবতীয় ধ্বংসযজ্ঞে সহযোগিতা ও প্ররোচিত করার পাশাপাশি নিজেরা উদ্যোগী হয়ে রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি ঘাতক বাহিনী গঠন করে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞে সমানভাবে অংশগ্রহণ করেছে। তাদের অপরাধ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চেয়েও বেশি, কারণ তারা এদেশের নাগরিক। জামায়াতের আলবদররা লেখক সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সার, সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হোসেন, ডা. আলীম চৌধুরী ও অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর মতো শ’ শ’ বরেণ্য ব্যক্তিকে বাড়ি থেকে ধরে বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করেছে। জামায়াতের ঘাতক খালেক মজুমদার, আশরাফউজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনউদ্দীনদের সঙ্গে শহীদুল্লা কায়সার বা মুনীর চৌধুরীদের কোন ব্যক্তিগত শত্রুতা ছিল না। তাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন বলেই তাদের হত্যা করা হয়েছে। আলবদরের নেতারা পাকিস্তানী জেনারেলদের সঙ্গে বসে দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের তালিকা প্রস্তুত করে হত্যা করেছে, যা ছিল গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অন্তর্গত। ঘাতকরা বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও বাঙালী জাতিকে মেধাশূন্য করার জন্যই এ হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল। এ কারণেই এসব হত্যাকাণ্ডের বিচারের ক্ষেত্রে ব্যক্তিকে নয় রাষ্ট্রকে বাদী হতে হবে। ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা ট্রাইব্যুনালে যাবেন সাক্ষী হিসেবে। ১৯৭৩-এর ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) এ্যাক্টে সরকারকেই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা এবং বিচারক ও প্রসিকিউটর নিয়োগের দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে।
‘মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে জামায়াতের কয়েকজন শীর্ষনেতার ধৃষ্টতাপূর্ণ মন্তব্যের প্রতিবাদে সারাদেশ যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে, যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন যুদ্ধাপরাধীদের নির্বাচনে দাঁড়ানো অনভিপ্রেত, যখন সেনাপ্রধান বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া প্রয়োজন তখন এ সরকারের কোন কোন উপদেষ্টা বলছেন অতীতে কোন সরকার যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেনি, কেন বর্তমান সরকারকে তা করতে হবে, এ সরকারের প্রধান কাজ হচ্ছে ঘোষিত সময়ের ভেতর নির্বাচন সম্পন্ন করা।
‘এ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য হচ্ছেÑ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সরকার যেসব রাজনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তারই অন্তর্গত। এ সরকার বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক হিসেবে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সংযোজনের প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করার উদ্যোগ নিয়ে এ সরকার শুধু দেশের ভেতরে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রশংসিত হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং তাদের ভোটাধিকার বাতিলের দাবি শুধু রাজনৈতিক দল বা নির্মূল কমিটির নয়, সর্বস্তরের জনগণ আজ এ দাবিতে সোচ্চার।’
৭১ সংগঠনের এ ঘোষণার ঐতিহাসিক তাৎপর্য বিবেচনা করে ২৯ ডিসেম্বর তারিখটি আমরা বেছে নিয়েছিলাম। কাকতালীয়ভাবে এর এক বছর পর ২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছে ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনে প্রধানতঃ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকারের জন্যই শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট তিন চতুর্থাংশ আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছে এবং বিশেষ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আরম্ভ করেছে। পাঁচ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্য বেগম খালেদা জিয়া ২৯ ডিসেম্বর তারিখটি নির্বাচন করেছেন ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা’র জন্য। বিএনপি প্রতিষ্ঠাতাদের ভেতর অনেক ‘বীরোত্তম’, ‘বীরবিক্রম’, ‘বীরপ্রতীক’ মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন। তাদের অনেকে এখন বেঁচে নেই। যাঁরা আছেন তারা কোণঠাসা হয়ে গেছেন খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়ার কারণে। বিএনপির ক্ষমতাধর প্রবাসী নেতা খালেদা তনয় তারেক মনে করেন জামায়াত ও বিএনপি সহোদর ভ্রাতা। এ কারণে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকারত্ব বিসর্জন দিয়ে বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষাসহ জামায়াতের সকল অপরাধ ও সহিংসতার দায় স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছে। জামায়াতের যাবতীয় এজেন্ডা কার্যকরের দায়িত্ব এখন বিএনপি বহন করছে। যার ফলে তৃণমূল পর্যায়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের ক্ষোভ ক্রমশ দৃশ্যমান হচ্ছে।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সভা সমাবেশ এবং সরকারের গণবিরোধী, অগণতান্ত্রিক বা অসাংবিধানিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অধিকার যেকোনও দলের বা ব্যক্তির সংবিধানপ্রদত্ত মৌলিক অধিকার। কিন্তু সে অধিকার অন্যের অধিকার হরণ করে, মানুষের জীবনজীবিকা বিপন্ন করে ভোগ করা যায় না। বিএনপি-জামায়াত যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্য যত কর্মসূচীই দিক না কেন মানুষ তাতে সাড়া দিচ্ছে না। এ কারণেই সরকারবিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচীর নামে সাধারণ মানুষকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়, সরকারী-বেসরকারী সম্পদ ধ্বংসসহ জননিরাপত্তা বিপর্যস্ত করা হয়, আঘাত করা হয় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ভিত্তিমূলে। জামায়াতের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক ও প্রতিহিংসার রাজনীতি নিষিদ্ধ না হলে এ সন্ত্রাস ও হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত থাকবে।
মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক, যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের চলমান আন্দোলনে বিচারপতি কেএম সোবহানের অবদান সব সময়ে উজ্জ্বল ধ্রুবতারার মতো পথ প্রদর্শন করবে।

৩০ ডিসেম্বর ২০১৩