Thursday, January 9, 2014

আগামী সরকারের জন্য ১০ নম্বর বিপদ সংকেত: আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী


৫ জানুয়ারির নির্বাচনের দিনটা কেমন কাটল? রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলি, 'ভালোয় মন্দে আলোয় আধারে গিয়েছে মিশি।' এই নির্বাচন গণতন্ত্রের ব্যাকরণসম্মতভাবে হয়নি। কিন্তু গণস্বার্থ ও স্বাধীনতার পরিপূরকভাবে হয়েছে। এই নির্বাচনের বৈধতা হয়তো সীমাবদ্ধ, কিন্তু নৈতিকতা নয়। নৈতিক দিক থেকে এই নির্বাচনটির অনুষ্ঠান ছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলা, তার স্বাধীনতার আদর্শ রক্ষার জন্য অপরিহার্য। এই নির্বাচনের বিকল্প ছিল দেশে গণতন্ত্রের মুখোশে জঙ্গিবাদের প্রতিষ্ঠা। বাংলাদেশের আবার অঘোষিতভাবে পাকিস্তানের রাজনৈতিক কলোনিতে পরিণত হওয়া। যার পরিণাম ফল হতো মার্কিন ড্রোন হামলার সম্প্রসারিত এলাকা হওয়া।

এই সত্যটি এখন এক শ্রেণীর মতিভ্রষ্ট সম্পাদক, সাংবাদিক, টক শোর বক্তা, সুধীসমাজের নেতা নিজেদের স্বার্থে অথবা অপরের স্বার্থে অস্বীকার করতে পারেন, কিন্তু ইতিহাস একদিন সাক্ষ্য দেবে, শেখ হাসিনা একজন নারী রাজনীতিক ও সংসদীয় গণতন্ত্রের অনুসারী হয়েও এই গণতন্ত্র রক্ষার জন্য যে অসম সাহস ও অটল মনোবলের পরিচয় দিয়েছেন, তা শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় গণতন্ত্র ও গণরাজনীতিকে সুরক্ষা দিয়েছে।

বিভিন্ন ফ্রন্টে এত শত্রুর বিরুদ্ধে এত কম লোক যুদ্ধের জন্য দাঁড়িয়েছে- এমন নজির সাম্প্রতিক বিশ্বে বিরল। এই নির্বাচনে বাংলাদেশ সেই নজির স্থাপন করেছে। ঐতিহাসিক আর্নল্ড টয়েনবি বলেছেন, 'গণতন্ত্র কেবল মেষশাবক হলে টিকে থাকতে পারত না। আত্মরক্ষার জন্য তাকেও মাঝেমধ্যে বাঘের মূর্তি ধারণ করতে হয়।' 
আমার মতে, বাংলাদেশকে বিএনপির সাম্প্রদায়িকতা ও জামায়াতের হিংস্র ধর্মান্ধতা থেকে রক্ষার জন্য হাসিনা সরকার যদি সত্য সত্যই আসল বাঘের মূর্তি ধারণ করত, তাহলেও আপত্তি করার কিছু ছিল না।

৫ জানুয়ারির নির্বাচনের ফলে যে নতুন সংসদ গঠিত হতে যাচ্ছে এবং অনতিকাল পরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে নতুন সরকার গঠিত হবে, তাকে আগাম অভিনন্দন জানাই। প্রার্থনা করি, এবারের নির্বাচনের নৈতিকতার শক্তিতে তারা যেন বৈধতার সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে এবং দেশ ও জাতিকে শুধু সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত করা নয়, প্রকৃত সুশাসন (good governance) উপহার দিতে পারে।

গত পাঁচ বছর মহাজোট সরকার দেশের জন্য অভূতপূর্ব উন্নয়নের কাজ সমাধা করেও যে জনসমর্থন ও জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারেনি, তার বড় কারণ, কিছু যোগ্য মন্ত্রীর সঙ্গে মন্ত্রিসভায় অসংখ্য অযোগ্য, অসৎ ও অনভিজ্ঞ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ এবং মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও এক বিরাটসংখ্যক আওয়ামী এমপির দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও সন্ত্রাসে তাদের নির্বাচকমণ্ডলীর মধ্যে তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি হওয়া। ফলে শেষদিকে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছিল, এই শ্রেণীর মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও এমপিরা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় জনরোষের ভয়ে যেতে পারতেন না।

২০০৮ সালে শেখ হাসিনার দ্বিতীয় দফার মন্ত্রিসভায় সদস্যদের নামের তালিকা দেখেই যেমন কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলাম, আজও তেমনি আগামী সরকারের সদস্যদের নামের তালিকা দেখার আগেই আরো বেশি কঠোর ভাষায় শেখ হাসিনাকে সতর্ক করতে চাই। কারণ এবার যদি মন্ত্রিসভা গঠনে বা উপদেষ্টা নিয়োগে তিনি আগেরবারের নীতি অনুসরণ করেন, তাহলে তা হবে নিজের জন্য, তাঁর সরকারের জন্য ও তাঁর দলের জন্য 'ফ্যাটাল মিসটেক' বা চূড়ান্ত ভুল।

শেখ হাসিনা আমার চেয়েও ভালো করে জানেন, এবারের নির্বাচন দুটি গণতান্ত্রিক দলের মধ্যে নির্বাচনযুদ্ধ ছিল না। ছিল একাত্তরের পরাজিত শক্তি ও তাদের নব্য দোসরদের মরিয়া হয়ে ক্ষমতা দখলের সন্ত্রাস ও বর্বরতার বিরুদ্ধে স্বাধীনতার পক্ষ শক্তির প্রতিরোধ। ফলে শেখ হাসিনাকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার স্বীকৃত কোনো কোনো পন্থা এড়িয়ে চলতে হয়েছে। তাতে দেশপ্রেমিক জনগণের আপত্তি থাকার কথা নয়। যদি কারো আপত্তি থাকে আগামী সরকার গঠনের প্রক্রিয়ার মধ্যে নৈতিকতার ভিত্তি দৃঢ় করে তা শেখ হাসিনাকে কাটিয়ে উঠতে হবে। আর এই নৈতিকতার ভিত্তি জোরদার করার একমাত্র পথ জনগণকে তাদের পছন্দসই একটি সৎ ও যোগ্য সরকার এবং সেই সরকারের সুশাসন উপহার দেওয়া।

নির্বাচন তরীটি কোনোমতে ঠেলেঠুলে তীরে নিয়ে আসতে পারায় আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট ও তার নেত্রী শেখ হাসিনা যেন না ভাবেন, তাঁরা বিপদ ও সংকটমুক্ত হয়েছেন। সামনে আরো বড় বিপদ ও বড় লড়াই অপেক্ষা করছে। আমি আগেও বলেছি, জনসমর্থন না থাকলে কেবল সন্ত্রাস দ্বারা কোনো আন্দোলনে সাফল্য লাভ করা যায় না। বিএনপি-জামায়াতও তাই সাফল্য লাভ করতে পারেনি। এ জন্য নির্বাচনের পরও তারা থেমে থাকবে, তা নয়। সর্বশক্তি নিয়ে তারা মরণছোবল দেওয়ার চেষ্টা করবে।

এই চেষ্টা করার প্রমাণ, নির্বাচন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপি হরতাল ডেকেছে। এই হরতালে জনগণের সমর্থন না থাকলেও তারা সন্ত্রাসী জামায়াতিদের কাজে লাগাচ্ছে। আবার অগ্নিসংযোগ, হত্যা ও নির্যাতন দ্বারা প্রশাসন অচল করতে না পারুক, দেশের অর্থনীতিতে বিপর্যয় বাড়িয়ে তুলবে। এই সন্ত্রাস যদি বন্ধ করা না যায়, তাহলে জনগণের ধৈর্যের সীমা ভেঙে যাবে। তারা সরকারের প্রতি আস্থা হারাবে এবং বিক্ষুব্ধ হবে। চাইলে কি তাদের একটা বড় অংশ সন্ত্রাসমুক্ত হওয়ার আশায় সন্ত্রাসীদের সমর্থন জানাতে পারে। যদি তা হয়, তাহলে আগামী সরকার চরম বিপদে পড়বে। তাদের জন্য রাজনৈতিক আবহাওয়া দপ্তরের দশ নম্বর বিপদ সংকেত আমি এখনই দেখতে পাচ্ছি।

এই বিপদ সংকেত অগ্রাহ্য করা শেখ হাসিনা ও তাঁর আগামী সরকারের জন্য হবে চরম ভ্রান্তি। গত ছয় মাসের বেশি সময় ধরে তারা নির্বাচনবিরোধী সন্ত্রাসের মোকাবিলা করেছে। এটা ছিল তাদের জন্য সাত, আট বা ৯ নম্বর বিপদ সংকেত। এখন নির্বাচনের পর তাদের জন্য যে বিপদ সংকেত দেখা যাচ্ছে, তা দশ নম্বরের। এই ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস ঠেকাতে হলে কেবল আইন প্রয়োগ, পুলিশ ও র‌্যাব মাঠে নামিয়ে কাজ হবে না। জামায়াতি সন্ত্রাসীরা এখন অনেক বেশি সশস্ত্র ও ট্রেনিংপ্রাপ্ত। তারা এতটাই সংগঠিত যে ইলেকট্রিক বা বৈদ্যুতিক করাত এনে বড় বড় গাছ কেটে রাস্তায় ফেলে অবরোধ সৃষ্টি করতে পারে। কলকাতায় একটি কাগজে খবর দেখেছি, এই জামায়াতি সন্ত্রাসীরা পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত অঞ্চলে গিয়ে মাওবাদী ও সাবেক নকশালপন্থী সন্ত্রাসীদের কাছে বোমা বানানো ও অন্যান্য সন্ত্রাসের ট্রেনিং নিচ্ছে। ভারত সরকার সীমান্তে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েও তাদের ঠেকাতে পারছে না।

বাংলাদেশের আগামী সরকারকেও তাই কৌশল পাল্টাতে হবে। এই কৌশলটি হবে শুধু আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর দ্বারা নয়, এই সন্ত্রাস দমনের জন্য জনপ্রতিরোধ গড়ে তোলা। গত পাঁচ বছরে বিএনপি-জামায়াত যেমন তাদের সন্ত্রাসের পক্ষে জনসমর্থন আদায় করতে পারেনি; তেমনি আওয়ামী লীগ সরকারও পারেনি এই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে। কারণ সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকার ছিল ব্যর্থ। অধিকাংশ মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও এমপি ছিলেন জনগণের কাছে দুর্নীতি ও অন্যান্য অসাধু কার্যকলাপের জন্য বিতর্কিত, এমনকি নিন্দনীয়। তা ছাড়া আওয়ামী লীগও সংগঠন হিসেবে এখন অত্যন্ত দুর্বল। ছাত্রলীগ ও যুবলীগের আগের সুনাম ও প্রতিষ্ঠা নেই সাধারণ মানুষের কাছে।

আমি বয়সে বড় হয়েও শেখ হাসিনার পায়ে পড়ি। এবার যেন মন্ত্রিসভা গঠনে তিনি জেদ, কানকথা ও চাটুকারিতাকে প্রশ্রয় না দেন। যোগ্যতা ও সততাকে মন্ত্রী ও উপদেষ্টা পদে নিয়োগের মাপকাঠি করেন। সাধারণ মানুষের পছন্দসই ও আস্থাভাজন ব্যক্তিদের দ্বারা একটি ছোট অথচ কর্মক্ষম মন্ত্রিসভা গঠন করেন। উপদেষ্টার সংখ্যা যেন পাঁচজনের বেশি না হয় এবং তাঁরা বিতর্কিত ব্যক্তি না হন। আল্লাহর দোহাই শেখ হাসিনা, এবার যেন ঢাকা ক্লাবে বসে যাঁরা সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ঢুলু ঢুলু চোখে 'সরকারি দায়িত্ব পালন' করেন, তাঁদের কোনো কারণেই মন্ত্রিসভায় স্থান না দেন।

দেশের সামরিক ও অসামরিক প্রশাসনে বিএনপি-জামায়াত আমলে ঢুকে পড়া অনেক 'সাবোটিয়ার' আছে। তা সত্ত্বেও এবার আমাদের সেনাবাহিনী, অসামরিক প্রশাসন, র‌্যাব, পুলিশ, আনসার প্রমুখ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নির্বাচিত সরকারের প্রতি যে আনুগত্য ও দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছে, তা অতুলনীয়। 

সন্ত্রাসী-হামলা ঠেকাতে বহু পুলিশ আত্মদান করেছে। আগামী সরকারকে তাদের দেশপ্রেম, কর্তব্যনিষ্ঠা ও আনুগত্যেরও মূল্যায়ন করতে হবে। সন্ত্রাস ও দুর্নীতি দমনে প্রশাসন ও জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে এবং তা পারবে একটি দক্ষ, যোগ্য ও সৎ সরকার।

শেখ হাসিনা যদি এবার একটি সৎ ও দক্ষ সরকার দেশবাসীকে উপহার দিতে পারেন, তাহলে বর্তমান নির্বাচনের বৈধতার সীমাবদ্ধতা তিনি কাটিয়ে উঠতে পারবেন। আর যে 'হিজ মাস্টার্স ভয়েসের' মতো এক শ্রেণীর মিডিয়া ও টক শোর অবিরাম প্রলাপোক্তি তা-ও বন্ধ হবে। সন্ত্রাস যত সিংহমূর্তি ধারণ করুক, তাকে লেজ গুটিয়ে পালাতে হবে। শেখ হাসিনা, দেশকে একটি মোটামুটি অনেস্ট গভর্নমেন্ট উপহার দিন, যে গভর্নমেন্ট দেশকে সুশাসন দিতে পারবে। রাতারাতি দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হবে, তা বলি না। কিন্তু আগামী সরকার তার শুভ সূচনা করুক।

নির্বাচনের দিনটি পার হওয়া গেছে। কিন্তু নতুন যে সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে, তার জন্য আগাম দশ নম্বর বিপদ সংকেতও দেখতে পাচ্ছি। দেশপ্রেমিক চক্ষুষ্মান ব্যক্তিমাত্রই তা দেখতে পাচ্ছে। আবারও বলি-

সামনে আছে ঝড় তুফান

শেখ হাসিনা, সাবধান!! 

(কালের কণ্ঠে প্রকাশিত)

No comments:

Post a Comment