Saturday, November 30, 2013

বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিরুদ্ধে বঙ্গভবন ও ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের অফিসারদের প্রতিরোধ- হাজারো সেনা হত্যাকারী জিয়া: মুসা সাদিক



১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর খুনীরা তড়িঘড়ি করে খন্দকার মোশতাককে প্রেসিডেন্ট হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে দেশবাসী ও বিশ্ববাসীর সামনে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নেয়। সেনাবাহিনী, রক্ষী বাহিনী ও দেশবাসীর সামনে তারা দেখাতে চায় যে, বঙ্গবন্ধু জীবিত নেই বলে বাংলাদেশে কোন ক্ষমতার বা প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের শূন্যতা সৃষ্টি হয়নি।


১৫ আগস্ট বিকেলে বঙ্গভবনে খুনী খন্দকার মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠানের তোড়জোড় শুরু করেন রাষ্ট্রপতির সচিব আব্দুর রহিম এবং স্বঘোষিত মুখ্য সচিব মাহবুব-উল-আলম চাষী (সিআইএ'র চর বলে প্রমাণিত হওয়ায় পাকিস্তান আমলে চাকরিচ্যুত) এবং তাদের আদেশে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খুনী মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠানের ভাব-গাম্ভীর্য বৃদ্ধির জন্য খুনী মোশতাক-ডালিম-ফারুকদের সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠক হয়। 
বঙ্গভবনে খুনীদের একদিন পার হলো। ১৬ আগস্ট সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্টের ফটোগ্রাফার আমির খসরুর কাছ থেকে খবর পেয়ে আমি ও কুমার শংকর হাজরা (খুনী মোশতাকের অফিসার) দোতলায় গেলাম খুনীদের মাতলামি করার ঘটনা দেখতে। আমরা দু'জন দোতলায় লিফটের দরজা খুলতেই দেখলাম লিফট থেকে ১০-১২ হাত দূরে বঙ্গবন্ধুর এক খুনী রিসালদার মহিউদ্দিনের এক হাতে মদের বোতল, আরেক হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। রাতে জানলাম আর্মি চীফ জেনারেল শফিউল্লাহ বঙ্গভবনে বন্দী। রাত ১১টার পরে খুনীদের দুটি মাইক্রোবাসে সুন্দরী মহিলারা এসে বঙ্গভবনে নামল। তাদের দোতলায় কিলারদের কক্ষের দিকে নিয়ে যাওয়া হলো। বলা হলো কিলারদের স্ত্রীরা এসেছেন। অনেকে বিশ্বাস করতে পারল না। 

১৭ আগস্ট সকাল ৯/১০টার দিকে বঙ্গভবন থেকে ফোন করে ঢাকার পত্রিকার সম্পাদকদের বঙ্গভবনে আসার ফরমান জারি হলো। ঢাকার সম্পাদকরা প্রবীণতম সম্পাদক জনাব ওবায়দুল হক সাহেবের নেতৃত্বে ১০-১২ জন সম্পাদক এলেন বঙ্গভবনে। বঙ্গভবনের গেট পেরিয়ে আসার পর বঙ্গভবনের সিঁড়িতে তাঁদের আটকে আধা ঘণ্টারও বেশি সময় দাঁড় করিয়ে রাখল অস্ত্রধারীরা। আমরা তাদের সেখান থেকে আনার জন্য গেলাম। কিন্তু অস্ত্রধারী খুনীরা হাতের ইশারায় আমাদের দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে বলল। বাংলাদেশ অবজারভারের সম্পাদক জনাব ওবায়দুল হক সবার পক্ষ থেকে অস্ত্রধারীদের বললেন, বঙ্গভবনের বৈঠকের জন্য তাঁদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তাঁদের যদি ভেতরে যেতে না দেয়া হয়, তবে তাঁরা চলে যাবেন।
 এ কথা বলামাত্র মাথায় খুন চেপে থাকা বঙ্গভবনের অস্ত্রধারী খুনীরা তাদের দিকে হিংস্রভাবে তেড়ে এসে তাদের মাথার ও বুকের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে চিৎকার করে বলে উঠল : “Shut up, shut up you bustards, if you say a word, you are dead, all of you are dead. 

সম্পাদকরা সেই রক্ত পিপাসু খুনীদের আগ্নেয়াস্ত্রের মুখে ভয়ে আতঙ্কে ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে সিঁড়ির ওপর পড়ে যান। কেউ কেউ কাঁপতে কাঁপতে সিঁড়ির ওপর বসে পড়েন। দেশের গুণী সম্পাদকরা নিজেদের আত্মসম্মান বাঁচাতে বঙ্গভবনে খুনীদের হাতে তাঁদের লাঞ্ছিত হবার ও নিগৃহীত হবার ঘটনা সেদিন জনসম্মুখে প্রকাশ করেননি!! (গত ২০ জুলাই, ২০০৩ হোটেল শেরাটনে দৈনিক ভোরের কাগজের যুগপূর্তি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসন অলঙ্কৃত করেন দেশের প্রবীণতম সম্পাদক ৯৮ বছরের বর্ষীয়ান এই বিবেকের কণ্ঠস্বর জনাব ওবায়দুল হক।) 
অনুষ্ঠান শেষে আমি তাঁকে জানালাম যে, ''৭৫-এর ১৭ আগস্ট বঙ্গভবনে খুনীরা সম্পাদকদের বুকের ওপর যে আগ্নেয়াস্ত্র ধরেছিল, সেটা আমি বহুবার ১৫ আগস্টের পত্র-পত্রিকায় লিখেছি।' তিনি আমার হাত জড়িয়ে ধরে টেনে নিয়ে তাঁর পাশে বসালেন। তখন সেখানে বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মমতাজউদদীন সাহেবও তাঁর আরেক পাশে ছিলেন। তিনি তাঁর পাশে বসিয়ে আমাকে বললেন, "মুসা সাদিক, আপনি 'খুনীদের মাথার মুকুট' শিরোনামে দৈনিক জনকণ্ঠে যেটা লিখেছেন, সেটা লেখার সাহস এদেশে আর কেউ দেখাতে পারেনি।

 সেজন্য আপনাকে আমি ধন্যবাদ দেই। আপনার অসীম সাহস। '৭১-এর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসটা আপনাকে দেখলে চেনা যায়। আমি দোয়া করি, আল্লাহতায়ালা যেন আমার চেয়েও আপনার আয়ু বেশি দেন।" তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, "আচ্ছা জিয়ার সময় আইএসপিআরের ডিরেক্টর কে ছিল যেন? ওর নাম কি যেন? ওর নামটা কি ছিল? দেখুন না, বয়স হয়েছে, এখন আর কিছু মনে করতে পারি নে!" আমারও তখন নামটা মনে পড়ছিল না। তিনি নামটি মনে করার জন্য অনেকক্ষণ চেষ্টার পর বললেন, "হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে, জাহিদ। আপনার লেখায় জাহিদের একটা কথা লিখে দেবেন যে, জিয়ার সময় জাহিদ ১৯৮১ সালে একদিন অবজারভার অফিসে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে। এসে সে বলে যে, "ক'দিন আগের ক্যু'র জন্য আর্মির দু'হাজার অফিসার ও র‍্যাঙ্কার্স দের (জওয়ান) মৃত্যুদণ্ডের একটি ফাইলে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান আজ সই করে দিলেন। ফাইল স্বাক্ষরের সময় আমি সেখানে ছিলাম। জানেন, এই ফাইল স্বাক্ষরের সময় তার মধ্যে আমি কোন ভাবান্তর দেখলাম না।" জাহিদ আমাকে আরও বলল, "তার বিরুদ্ধে এটা নিয়ে ১৮-১৯টা ক্যু হয়েছে।" প্রত্যেক ক্যুতে হাজার হাজার আর্মি অফিসার ও জওয়ানের মৃত্যুদণ্ড হলে জিয়া কত হাজার জওয়ান ও অফিসারের মৃতু্দন্ড দিয়েছে ঠান্ডা মাথায়, নিজের গদির জন্য, ভেবে দেখুন ...।" (২০০৩ সালের আগস্ট মাসে এ তথ্যসহ আমার এ আর্টিকেল অবজারভার পত্রিকাসহ দেশের অন্যান্য বাংলা ও ইংরেজী পত্রিকায় ছাপা হয় শ্রদ্ধেয় ওবায়দুল হক সাহেব বেঁচে থাকতে।) 
বঙ্গভবনে খুনীদের ২য় দিন পার হলো ঘন ঘন মিটিং করে এবং হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের থেকে আনা গাড়ি গাড়ি মদের বোতল ও হোটেল পূর্বাণীর রাশি রাশি অন্ন ধ্বংস করে। (খুনীরা আগ্নেয়াস্ত্রের মুখে ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে গাড়ি ভর্তি করে মদ এনে বঙ্গভবনের দোতলায় বোঝাই করে ফেলে। এসব মদের কোন টাকা পরিশোধ করেনি খুনীরা। হোটেল পূর্বাণীর খাবারের কোন টাকা দেয়নি তারা। উক্ত দুই হোটেল থেকে মদ ও খাবার অস্ত্রের মুখে হাইজ্যাক করে আনত তারা।) বঙ্গভবনের দোতলায় অতিথিদের থাকার রম্নমের সবগুলোতেই খুনীরা থাকতে শুরম্ন করে। সেখানে বঙ্গবন্ধুর খুনীরা ১৮ আগস্ট সোমবার রাতে হঠাৎ কয়েক রাউন্ড ফায়ার করে বসলে সমগ্র বঙ্গভবনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। প্রেসিডেন্টের পিএস-২ জনাব আব্দুল মান্নান (আমরা উভয়ে পশ্চিমবঙ্গের হিসেবে আমার সঙ্গে তার আস্থাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল এবং আমরা পারস্পরিক বিশ্বাসভাজন ছিলাম) পরদিন সকালে আমাকে বললেন : "কাল রাত ৯টার দিকে দোতলায় খুনীদের মধ্যে মাতলামো শুরু হয়। তারা আকাশে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুঁড়ে চিৎকার করে বলতে থাকে, "মীরজাফর শেখ মুজিব শেষ, বাংলাদেশ শেষ। কোন কুত্তাকা বাচ্চা শেখ মুজিবের বাচ্চার নাম লিয়া তো উয়ো বাস্টার্ড কো খতম কর দেংগে। উয়ো বাঙালী বাচ্চাকে হাম খতম কর দেংগে। বাংলাদেশ মর গিয়া। ইসলামী দেশ হো গিয়া ....। কোইয়ি, কাহা, কোন শালা মাদার...হঁযায়, হাম লোগোকে রোখেংগে। মুজিব কা বাচ্চা কোইয়ি, কাহা হঁযায় ...।" মদ খেয়ে মাতাল হয়ে অটোমেটিক মেশিন গান হাতে উদর্ুতে খিসত্মিখেউড় করে বঙ্গবন্ধুকে ও বাঙালী জাতিকে তারা গালাগাল দিচ্ছিল। বঙ্গভবনের সব সিভিল অফিসার ও স্টাফরা ভয়ে দূরে দূরে গিয়ে পিলার আড়াল করে তাদের এসব উদর্ু অশ্রাব্য গালাগাল শুনছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় টিক্কা-নিয়াজীরা বঙ্গভবনে বসে বাঙালী জাতির মা-বোন তুলে যেভাবে অশ্রাব্য গালাগাল করত সেভাবেই তারা আমাদের মা-বোনের জাত তুলে পাক সেনাদের কণ্ঠস্বরে গালাগাল করছিল।" 
বঙ্গভবনে তৃতীয় দিন পার হলো খুনী মোশতাকের কেবিনেট মিটিং করে। ওই মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয় যে, শেখ মুজিবের অর্থ ও ধন-সম্পদের বিবরণী রেডিও-টিভি এবং পত্রিকায় প্রকাশ করা হবে। বিকেলে সব ব্যাংকের এমডিকে বঙ্গভবনে ডাকা হলো। 
কর্নেল রশিদ নিজে দরবার হলে তাঁদের সবাইকে ১৫-২০ জওয়ানের স্টেনগান এবং এসএলআরের সামনে দাঁড় করিয়ে বলল : "মীরজাফর শেখ মুজিবের কোন ব্যাংকে কত টাকা আছে, আপনারা তার বিবরণী নিয়ে এসেছেন?" সব এমডি বললেন যে, তাদের কারও ব্যাংকে ওঁনার কোন এ্যাকাউন্ট বা টাকা-পয়সা নেই। সোনালী ব্যাংকের এমডি বললেন যে, সোনালী ব্যাংক, ধানমন্ডি শাখায় ওঁনার ৩৩০০/- (তিন হাজার তিন শ') টাকা আছে। তখন কর্নেল রশিদ স্টেনগান এবং এসএলআর তাক করে রাখা সৈনিকদের চিৎকার করে বললেন : They are bustard, dogs of Sheikh Mujib, fire them (তারা সব জারজ, শেখ মুজিবের কুত্তা, তাদের গুলি করে মেরে ফেলো।) এ কথা শোনা মাত্র এক ব্যাংকের জনৈক এমডি অজ্ঞান হয়ে বঙ্গভবনের দরবার হলের মেঝেতে ধপাস করে পড়ে গেলেন। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে তখন আরেক ব্যাংকের এমডি বলে উঠলেন : "স্যার, স্যার, মারবেন না। স্যার, আমার ব্যাংকে একটা আছে?" 


কর্নেল রশিদ তার কাছে এগিয়ে গিয়ে টাইসহ তার কোটের কলার চেপে ধরে হুঙ্কার দিল, You bustard, now open your mouth. (তুমি জারজ, এখন তোমার মুখ খোল।) তিনি বললেন : "স্যার, আমি হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের এমডি। হাউস বিল্ডিং থেকে উনি (ভয়ে আতঙ্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামটাও উচ্চারণে অপারগ) ৩২ নম্বরের বাড়ি করার জন্য লোন নিয়েছিলেন। সে লোন পরিশোধ করেননি এবং সুদে আসলে তা এখন ৫-৬ লাখ টাকা হবে। এই টাকা ওঁনার কাছে সরকারের পাওনা আছে।" খুনী রশীদ হুকুম দিল : "বাড়ি এক্ষুনি জব্দ করে নিন।" এমডি সাহেব বললেন : "স্যার, নিউজ পেপারে একটা নোটিস দিয়ে দিতে হবে।" খুনী রশিদ বলল : "এক্ষুনি দিয়ে দিন। পত্রিকার লোক কে আছে এখানে?" সবার আগে সেই মার্শাল'র ধামাধরা ইবলিশ কুদ্দুস ছুটে এল। সে তৎক্ষণাৎ ড্রাফট করে দিল "মৃত শেখ লুৎফর রহমানের পুত্র মৃত শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির ঋণ বাবদ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের কাছে সুদে আসলে ৫-৬ লাখ টাকা ... বছর যাবত অপরিশোধ্য থাকার প্রেক্ষিতে উক্ত বাড়ি আগামী ৪৫ দিনের পরদিন প্রথম কার্যদিবসে হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন কর্তৃক প্রকাশ্যে নিলামে তোলা হবে। আগ্রহী ক্রেতাগণ ... তারিখে উক্ত বাড়ির সম্মুখে ডাকা প্রকাশ্য নিলামে অংশ গ্রহণ করতে পারেন। নিলামে সর্বোচ্চ দর ডাকার কাছে বাড়িটি বিক্রি করা হবে। খুনী মোশতাকের আরেক ডান হাত খ্যাত তাহের উদ্দীন ঠাকুরের নির্দেশে সেখানে উপস্থিত মর্নিং নিউজের সম্পাদক জনাব শামসুল হুদার হাতে এই নিলামের নোটিস এইচবিএফসির এমডি স্বাক্ষর করে দিয়ে দিলেন। ১ দিন পর ১৯ আগস্ট অথবা ২০ আগস্ট দৈনিক মর্নিং নিউজের পেছনের পাতায় বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়ির নিলামের বিজ্ঞপ্তি ছাপা হয়। এই হলো খুনী মোশতাক-রশিদ-ডালিম-ফারুক চক্রের জিঘাংসার শিকার বাংলার মুকুটহীন সম্রাটের অর্থ-বিত্ত ও ধন-সম্পদের সরকারীভাবে প্রকাশিত তথ্য বিবরণী। 
১৯৭৫-এর ১৭ আগস্ট কয়েকজন ডিসিকে বঙ্গভবনে ডাকা হলো। সে বিষয়ে আমাকে গত ১৭ আগস্ট (২০১১) সচিব মোকাম্মেল হকের বাসায় এক ইফতার পার্টিতে সে সময়ের (১৯৭৫ সালে) ডিসি জনাব হাসনাত আব্দুল হাই ১৫ আগস্ট প্রসঙ্গে আমাকে বললেন, "সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে প্রায় ১৫ জন ডিসির সঙ্গে আমাকে প্রেসিডেন্ট মোশতাকের কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো। প্রেসিডেন্ট মোশতাক আমাদের বললেন, 'শেখ মুজিবের ৩২ নম্বরের বাড়িতে ২০ ভরি সোনা পাওয়া গেছে। এগুলো আপনারা অফিসারদের সব জানাবেন। এসব অবৈধ সোনা এবং তাঁর দুর্নীতির প্রমাণ।' মিটিং শেষে আমার সহকর্মীরা সকলে বলাবলি করলেন যে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে মাত্র ২০ ভরি সোনা পাওয়া গেছে, যখন তাঁর দুই পুত্র শেখ জামাল ও শেখ কামালের বিয়ে হয়েছে মাত্র কয় মাস আগেই। এরপর এই ২০ ভরি সোনার গহনার কথা আমাদের অজস্র অফিসারের কাছে তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুর দুর্নীতি প্রমাণের চেষ্টা করা হলে তাদের কাছে ডিসিদের আর কোন মান-সম্মান থাকবে না। আমার সহকর্মীরা প্রায় কোরাস কণ্ঠে বললেন, খুন-খারাবি করে খুনী মোশতাকের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুর চেয়ারে বসার স্বপ্ন সে কী করে দেখে?" 
১৮ আগস্ট সোমবার প্রথমবারের মতো ভারতীয় রাষ্ট্রদূত শ্রী সমর সেন বঙ্গভবনে আসেন প্রেসিডেন্ট মোশতাকের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করতে। ১৫ আগস্ট ক্যুর সময় তিনি ভারতে ছিলেন। ১৭ আগস্ট বিকেলে তিনি কলকাতা থেকে ঢাকা আসেন। পরদিন দুপুরে আসেন বঙ্গভবনে। সমর সেন বঙ্গভবনে প্রবেশের পর সেখানকার সবাই জানত যে, প্রেসিডেন্ট তাকে ডাকেননি। তিনি স্বেচ্ছায় দেখা করতে এসেছেন। তখন প্রেসিডেন্টের সহকারী একান্ত সচিব মান্নান সাহেব জানালেন, "আগের রাতে পাকিস্তান ফেরত সেনাদের চাপে জেনারেল জিয়া ও খুনী মোশতাক বাংলাদেশকে "ইসলামী প্রজাতন্ত্রের' ঘোষণা অথবা 'পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনের' ঘোষণা দেবার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারই ফলস্বরূপ বঙ্গভবনের দোতলায় খুনীরা সারারাত পিপে পিপে মদ গিলেছে, আনন্দ-ফুর্তি করেছে আর পাক সেনারা যেভাবে গালাগালি দিতে, সেভাবে বাঙালী মা-বোনদের অশ্রাব্য ভাষায় উর্দুতে তারা গালাগাল করেছে। বঙ্গবন্ধুকে গালাগাল করেছে ...।" 
রাষ্ট্রদূত সমর সেন আসার পর প্রেসিডেন্টের কক্ষের চারপাশে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেল। তখন আমাদের সহকর্মী মোশতাকের অফিসার শ্রী কুমার শংকর হাজরার মুখ থেকে সমর সেনের আগমনের মূল কারণ জানতে পারলাম। সে আমাকে বলল : "দোস্ত, 'ইসলামী প্রজাতন্ত্র' অথবা 'পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনের' যে কোন একটি ঘোষণা হলে আমি চাকুরি ছেড়ে ভারতে চলে যাব।" (জেল হত্যাকাণ্ডের পরই ক্ষুব্ধ চিত্তে মুক্তিযোদ্ধা হাজরা সত্যি সত্যি চাকুরি ছেড়ে দিয়ে ভারতে চলে যায়।) 
১৮ আগস্ট সোমবার কখন কি ঘোষণা হয়!! কি ঘোষণা হয়!! তা জানার জন্য বঙ্গভবনের মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা উদ্বেলিত চিত্তে সারাক্ষণ একতলা থেকে দোতলা এবং এ কক্ষ থেকে ওই কক্ষে ছোটাছুটি করতে লাগলাম। আমরা সবাই সারাক্ষণ চোখ কান পেতে রাখলাম। খুনী মোশতাককে সমর সেন কি বলে, কি বলে, সারাক্ষণ আমরা জপ করতে থাকলাম। 

জেনারেল জিয়া তখন বঙ্গভবনে। জেনারেল শফিউল্লাহ তখন বঙ্গভবনে বন্দী। সমর সেন সাক্ষাত শেষে চলে গেলেন। জিয়া খুনী মোশতাকের বঙ্গভবনের পেছনের কক্ষে (নিরাপত্তার জন্য প্রেসিডেন্টের জন্য নির্ধারিত সামনের কক্ষে না বসিয়ে প্রেসিডেন্টকে তখন খুনীরা বঙ্গভবনের পেছনের কক্ষে বসান) ঢুকলেন। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ডজন ডজন জেনারেল ও ব্রিগেডিয়াররা এসে তার সঙ্গে যোগ দিলেন। সারা বিকেল ও সারা সন্ধ্যা গ্রুপ, গ্রুপের সেনা অফিসাররা মিটিংয়ের পর মিটিং করল বঙ্গভবনে। ক্যান্টনমেন্ট থেকে এক গ্রুপ যায়, আরেক গ্রুপ আসে। 
১৮ আগস্ট রাত ১১টায় বন্ধু হাজরার মুখ থেকে যখন জানতে পারলাম 'ইসলামী প্রজাতন্ত্র' অথবা 'পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন' এর কোনটাই হবে না ...
 তখন স্বস্তির  নিঃশ্বাস ফেলে আনন্দাশ্রুতে  বুক ভাসিয়ে আমরা বঙ্গভবন থেকে বের হলাম। চোখের ওপর ভেসে  উঠল একাত্তরের রণাঙ্গনে, রণাঙ্গনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শত-সহস্র বীর মুক্তিযোদ্ধার লাশ, আর বাঙালী ভাই-বোনের রক্তে ভেসে যাওয়া কালো পিচ্ছিল দূর্বা ঘাস, মাঠ-ঘাট।

বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিরুদ্ধে বঙ্গভবন ও ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের অফিসারদের প্রতিরোধ
খুনী মোশতাকের অফিসার বীর মুক্তিযোদ্ধা শ্রী কুমার শংকর হাজরা জানাল সে ইতিহাস। ১৮ আগস্ট দুপুরে দিল্লীর কঠিন ও কঠোর বার্তা নিয়ে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হাসি হাসি মুখে খুনী মোশতাকের কক্ষে প্রবেশ করে। হাসি হাসি মুখে বিটিভির ক্যামেরার সামনে ও ফটোগ্রাফার আমির খসরুর সামনে পোজ দেয়। 

তারা বের হওয়া মাত্র খুনী মোশতাককে সমর সেন দিল্লীর অনুশাসনমূলক প্রথম বার্তাটি জানিয়ে দেন : Any change of the name of the “People’s Republic of Bangladesh” and any “Confederation” with any country, the Indian Army shall take appropriate measures in accordance with the legal and valid deed, which India possess. But if you abstain form changing the name of ‘Bangladesh’ and so called ‘Confederation’ idea, India will consider what ever had happened since August 15 as your internal matter." 'ইসলামী প্রজাতন্ত্র' বা 'কোন দেশের সঙ্গে কনফেডারেশনের' ঘোষণা দেয়া হলো ভারতের সেনাবাহিনী '৭১-এর মিত্রবাহিনীর পরম্পরায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার অধিকার রাখে এবং এ রূপ পদক্ষেপের অনুকূলে আন্তর্জাতিকভাবে বৈধ দলিল ভারত সরকারের কাছে সংরক্ষিত আছে। উল্লিখিত ধরনের কোন কিছু পরিবর্তন করা না হলে এবং সবকিছু অব্যাহতভাবে অবিকল ও অপরিবর্তিত থাকলে বাংলাদেশে ইতোমধ্যে যা কিছু ঘটেছে, তা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে গণ্য করা হবে।" 
১৮ ডিসেম্বর বঙ্গভবনে বাজ পড়ার মতো এসে পড়ল দিল্লীর হুকুম নামা! বঙ্গভবন থেকে জরুরী ডাক পেয়ে খুনী মোশতাক-জিয়া-ফারুক-রশিদদের মদদদাতা পাকিস্তান প্রত্যাগত ব্রিগেডিয়ারা-কর্নেলরা-মেজররা ১৭ ডিসেম্বরে বঙ্গভবনে দলে দলে হুমড়ি খেয়ে এসে পড়তে লাগল! বঙ্গভবনে ঢুকেই কবি সমর সেনের বার্তা জানতে পেরে তাদের হাঁটু কাঁপতে শুরু করল। ভিমরি খাওয়া রোগীর মতো গড়িয়ে দিয়ে পড়ল বঙ্গভবনের ফ্লোরে ও মাঠে। অথচ ২৪ ঘণ্টা আগে ১৭ ডিসেম্বর তারাই দলে দলে এসে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের সঙ্গে কোলাকুলি করে বলেছে, "সিকিম-ভুটান হবার হাত থেকে বাংলাদেশকে বাঁচাতে 'পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনের' ঘোষণা দিতেই হবে। ইহা আমাদের জন্য ফরজ কাজ। আর ইহা করা না গেলে 'ইসলামী প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ' ঘোষণা দেয়াই হইবে বাংলাদেশের সকল মুমিন-মুসলমানের জন্য ফরজ, ফরজ এবং ফরজ কাজ।" 
সকল ক্যু ও মার্শাল'ল ঘোষণার সময় তাদের যে তোস্য দালাল ন্যায় সর্বদা প্রস্তুত উপ-সচিব কুদ্দুসকে দেখলাম হাতে কলম ও প্যাড নিয়ে খুনী ডালিম-ফারুকদের সঙ্গে লাটিমের মতো ঘুর ঘুর করছে ... বাংলাদেশের নাম পাল্টিয়ে কখন 'ইসলামী প্রজাতন্ত্র' বা 'পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন'-এর ড্রাফটে প্রেসিডেন্টের স্বাক্ষর নেয়া যায় সেজন্য!! কিন্তু তখনও বাংলাদেশের পথে প্রান্তরে, বন্দরে-নগরে ৩০ লাখ বাঙালী ভাই-বোনের সঙ্গে শহীদ হয়ে যাওয়া হাজার হাজার ভারতীয় বীর জওয়ানদের রক্ত শুকায়নি ... সেখানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ভারতীয় সেনাবাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করে টিকে থাকার সম্ভাবনার চেয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার আশঙ্কা অধিক উপলব্ধি করে খুনী মোশতাক-জিয়া ও তাদের অনুসারী পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত সেনারা সেই হঠকারী ঘোষণা থেকে বাধ্য হয়ে পিছিয়ে আসে। ৩০ লাখ শহীদের রক্তস্নাত পুণ্যময় বাংলাদেশ সেদিন আল্লাহর অশেষ রহমতে রক্ষা পায়। আলহামদুলিল্লাহ। 
বঙ্গভবনের সেই গোপন অধ্যায় অজানা থাকায় বাংলাদেশের কিছু লোক এ যাবতকাল বলে এসেছে যে, মোশতাক-জিয়ার ক্ষমতারোহণকে ভারত সরকার সেদিন মেনে নিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের পক্ষ থেকে বঙ্গভবনের বহু গোপন অধ্যায়ের একটা অধ্যায় প্রিয় দেশবাসীর সামনে আজ উন্মোচিত করে দিলাম। ভারত সরকার কেন সেদিন খুনীদের সরকারকে ক্ষণস্থায়ীভাবে সময় দিয়েছিল_যখন বাংলাদেশের ওপর ভারত সরকারের যে কোন সামরিক পদক্ষেপের বিপরীতে বাংলাদেশের জন্মকালীন শত্রু আমেরিকা ভারতের রাজধানী দিল্লীর ওপর পারমাণবিক কার্যক্রমের হুমকি দিয়েছিল_সে অধ্যায় উন্মোচনের আগ্রহ আপাতত সংবরণ করলাম। 
১৯ আগস্ট ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বিবিসির সংবাদদাতা বিখ্যাত সাংবাদিক মার্ক টালির সঙ্গে দেখা করলাম। বিবিসিতে প্রচারের জন্য তাকে Mukthi Bahini and Mujib Bahini are organising in Dhaka against the killers of BangaBandhu. They will attack them any time in and around Dhaka. The killers of BangaBandhu are Pakistani agents and enemy of Bangladesh. People of Bangladesh shall never accept the killer. The killers shall be hanged by the people at the Race Course of Dhaka very soon. Freedom Fighters are now taking full preparations in and around Dhaka. Resistance will start at any moment. Killers will not be able to escape. People will hang them in race course you will see it.
১৮ আগস্ট বিবিসির দিল্লী ব্যুরো চীফ মার্ক টালি ঢাকা আসেন। এসেই বঙ্গভবনে আমাকে ফোন করে তার হোটেলে আসতে বলেন। স্বাধীন বাংলা বেতারের 'ওয়ার করেসপন্ডেন্ট' হিসেবে '৭১ সালে রণাঙ্গনের বহু সংবাদ আমি তাঁকে স্বতঃপ্রণোদিত চিত্তে দিয়ে দিয়েছি এবং পরে স্বাধীন বাংলাদেশে আমি তাঁকে বহু সার্ভিস দিয়েছি। তিনি আমাকে চিনতেন এবং আমার ওপর তাঁর আস্থা অগাধ ছিল। 

দীর্ঘ ৩৫ বছর পর আমি যখন আবার এই তথ্য উল্লেখ করছি, তখন ও must salute Mr. Mark Tully on behalf of all the Freedom Fighter Officers & Employees of the Republic for his kind favour to broadcast the news over the B.B.C on that evening. The news inspired all the Freedom-Fighters in resisting the killers in Dhaka and all over Bangladesh. 
মার্ক টালি আমাকে বললেন, "মুজিব বাহিনী কোথায় প্রস্তুতি নিচ্ছে, সেখানে আমাকে নিয়ে চলো।" সেখানে এক্ষুনি নিয়ে যাওয়া সম্ভব না বলে জানিয়ে বললাম, "তুমি এক্ষুনি বিবিসি থেকে এই নিউজ প্রচার করিয়ে দাও। তাহলে পরে তোমাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।" 
বিবিসির মাধ্যমে প্রচারিত সেই প্রথম সংবাদে দেশবাসী রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। বাংলার ঘরে ঘরে ৬৮ হাজার গ্রামে এই সংবাদে আনন্দের জোয়ার বয়ে গেল যে, ঢাকায় মুক্তিবাহিনী ও মুজিববাহিনী বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ধরবে এবং ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ফাঁসিতে ঝুলাবে। বিবিসি সেদিন মার্ক টালির বরাতে সংবাদ প্রচার করল, "ঢাকার ঘরে ঘরে মুজিব বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী প্রস্তুত হচ্ছে এবং তারা যে কোন সময় সাঁড়াশি আক্রমণ চালিয়ে ঢাকা দখল করে ফেলবে এবং শেখ মুজিব হত্যার প্রতিশোধ নেবে মর্মে প্রতিজ্ঞা নিয়েছে বলে জানা যায়।" 
বিবিসিতে এই সংবাদ প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গভবনে খুনী মোশতাক ও তার সহযোগী খুনী ডালিম-ফারুকদের  হৃদকম্পন শুরু  হয়ে যায়। তারা বিডিআর থেকে অতিরিক্ত ফোর্স আনে বঙ্গভবন গার্ড দেবার জন্য। 
বিবিসির এই সংবাদে ঢাকার মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বেড়ে যায় এবং খুনী মোশতাক-ডালিম-ফারুকদের বিরুদ্ধে ঢাকাসহ আশপাশের জেলাগুলোয় প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সবাই যে যার সাধ্যমতো চেষ্টা করতে থাকে। ১৯ আগস্ট ফেনীতে মুক্তিযোদ্ধারা রেল লাইন উপড়ে ফেলে। পরদিন ২০ আগস্ট খুলনা পোর্টে আগুন ধরায়। একই দিনে মিরপুরে এবং আসাদগেটে আর্মির ট্রাকে বোমা পড়ে। টাঙ্গাইলে বীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের কব্জায় চলে যায় টাঙ্গাইল। হালুয়াঘাটে বীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কামানের গোলা নিক্ষেপ হয়। কাদের সিদ্দিকী ঘোষণা করে "বঙ্গবন্ধুর চতুর্থ সন্তান কাদের সিদ্দিকী পিতার খুনীদের রক্তে বাংলাদেশের মাটি সিক্ত না করে মাংস খাবে না"। চট্টগ্রামে যুবলীগের জঙ্গী নেতা এসএম ইউসুফের নেতৃত্বে রেজিস্টেন্স শুরু হয়ে যায় চট্টগ্রামব্যাপী। এসএম ইউসুফের দাপটে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের সেনারা সন্ধ্যার পূর্বেই ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যেত আর সকালের আগে কেউ বেরুবার সাহস পেত না। 
এ সময় তথ্য মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব বঙ্গবন্ধুর আত্মীয় ড. সেলিমুজ্জামান সাহেবের সঙ্গে ১৯ আগস্ট হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আমার সাক্ষাত হয়। আমি তাঁকে বললাম : Don’t worry, we will fight them back insha Allah. Resistance has started in Dhaka and all over the country, তিনি আমাকে বললেন, "তাহের উদ্দীন ঠাকুর আমার ক্ষতি করতে পারে। অন্য মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের বলে রেখো।" তিনি আমাকে আরও বললেন, "বঙ্গবন্ধুর কিলারদের বিরুদ্ধে আমি ধানমণ্ডি থানায় জিডি করব।" 
আমি তাঁকে আমার বাসার ও বঙ্গভবনের টেলিফোন নম্বর দিলাম এবং তাঁর অফিসের ও বাসার নম্বর নিলাম। যদিও তিনি বললেন যে, তিনি তখন বাসায় থাকেন না। বিএসএসের জেনারেল ম্যানেজার হাজারী ভাইয়ের বাসায় লুকিয়ে থাকেন। তাঁকে আরও বললাম, "আমরা এখন সিজিএস খালেদ মোশাররফ স্যারের দিকে তাকিয়ে আছি। আর্মির সকল মুক্তিযোদ্ধা অফিসার এখন তাঁর সঙ্গে আছে। কিছু একটা হতেই হবে। তিনি যেন খালেদ মোশাররফ সাহেবের ভাই রাশেদ মোশাররফের কলাবাগানের বাসায় যোগাযোগ রাখেন।
 আমরা ঢাকার মুক্তিযোদ্ধা সিভিল অফিসাররা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে সব কিছু এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। দূতাবাসগুলোর সাথেও আমাদের মাধ্যমে তাঁর যোগাযোগ রক্ষা করছি। বঙ্গভবন থেকে খুনীদের ভেতরে বসে আমি তাদের সব মুভমেন্ট খালেদ মোশাররফ স্যারদের দিয়ে যাচ্ছি।"
সেলিমুজ্জামান সাহেব ছলছল চোখে বললেন, "আমাদের হারাবার আর কিছুই নেই। বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে আমরা এতিম হয়ে গেছি।" আমি বললাম : "মুক্তিযোদ্ধারা মনোবল হারায়নি। হিমালয়ের মতো বঙ্গবন্ধু আবার ফিরে আসবে ঘূর্ণিঝড়ের মধ্য থেকে। ঢাকার মুক্তিযোদ্ধারা ও আমরা শপথ নিয়েছি খুনীদের ওপর আঘাত হানব। মরতে হলে তাদের মেরে মরব। কাদের সিদ্দিকী তার কাদেরীয়া বাহিনী নিয়ে যে কোন সময় ঢাকায় প্রবেশ করবে। সচিবালয় ও বঙ্গভবন কাদেরীয়া বাহিনীর ভয়ে মৃগী রোগীর মতো কাঁপছে ....।" ২০ আগস্ট হারেস উদ্দীন সরকার বীরপ্রতীকের সঙ্গে দেখা হলো।
 '৭১-এ তিস্তার পাড়ের অসীম সাহসী বীর হারেস উদ্দীনের কথা শুনে বুক ভেঙ্গে গেল। তিনি বললেন যে, "তাদের মিশন ব্যর্থ হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলীকে জিঞ্জিরা দিয়ে উত্তরবঙ্গে নিয়ে গিয়ে সরকার গঠনের যে পরিকল্পনা তারা নিয়েছিলেন তা ব্যর্থ হয়ে গেছে। সেনাবাহিনীর বীর মুক্তিযোদ্ধারা লে. কর্নেল দেলওয়ার হোসেন, লে. কর্নেল নওয়াজেশ, লে. কর্নেল ইয়াজদানী, লে. কর্নেল মোসলেম উদ্দীন প্রমুখ বাঙালী জাতির বীরদের নেতৃত্বে পবিত্র কোরআন শরীফ ছুঁয়ে শপথ করে বেরিয়ে এসেছিলেন।" লে. কর্নেল দেলওয়ারের বনানীর স্টাফ কোয়ার্টারে বসে তাঁরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন-ছাত্র, জনতা ও আওয়ামী লীগকে সঙ্গে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলীর নেতৃত্বে উত্তরবঙ্গে খুনী মোশতাকের বিরুদ্ধে পাল্টা সরকার গড়ে তুলবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই মহান বীর যোদ্ধাদের, সেই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে আওয়ামী লীগের নেতারা সাড়া না দিয়ে পিছিয়ে গিয়েছিলেন। "বঙ্গবন্ধুকে যারা মেরে ফেলেছে, আমাদেরও তারা মেরে ফেলবে"- এই ধুয়া তুলে কাপুরুষের মতো তাঁরা পিছিয়ে গিয়েছিলেন।শেক্সপীয়ারের অমর বাণী তাঁরা সেদিন বাস্তবে প্রমাণ করে ছেড়েছিলেন। যদিও ঢাকার বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। 
ঢাকাবাসী ও ছাত্র-জনতা, রিকশাওয়ালা, শ্রমিক, দিনমজুর তখন ক্রোধে রাগে ফুঁসছিল। বঙ্গবন্ধুর অনুসারীরা কাপুরষতা না দেখালে খুনীরা ঢাকাবাসীর রুদ্ররোষে কর্পুরের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যেত। কবর দেবার জন্য এই সব ভাড়াটে খুনীদের কারও লাশ পাওয়া যেত না। ঢাকার বাতাসে মিশে যেত।
এখানে বিশেষ করে, আমি এক বঙ্গ জননীর কথা গর্বের সঙ্গে উল্লেখ করতে চাই, যিনি লে. কর্নেল দেলওয়ারের বনানী স্টাফ কোয়ার্টারে আগত ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার ও মেজর বজলুল হুদাকে প্রবেশ করতে দেখে চিৎকার করে বলেছিলেন, "তোমরা, বঙ্গবন্ধুর কিলার, এখানে কি জন্য এসেছ?" মেজর হুদা তাঁকে বলেছিলেন, "ভাবি, চা খেতে এসেছি।" উত্তরে ময়মনসিংহ মহিলা ক্যাডেট কলেজের অধ্যাপিকা সেই নির্ভীক বেগম নুরজাহান দেলওয়ার বলেছিলেন, "তোমরা এখনই বেরিয়ে যাও। তোমাদের মুখ যে দেখবে তার কবরে দোজখের আগুন জ্বলবে।"
সেখানে উপস্থিত হারেস উদ্দীন সরকার বীরপ্রতীকের সামনে এই ঘটনা ঘটে। অতঃপর কিলাররা হাসতে হাসতে চলে যায়। কিন্তু তারপরেও জাতির এই সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তানরা প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলীকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তাঁরা প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলীকে খুঁজে পাবার আগেই তাঁর সঙ্গে কর্মরত এক সিভিল অফিসার বিশ্বাসঘাতকতা করে (তিনি তাঁর বিশ্বাসঘাতকতার বড় পুরস্কার পেয়ে পরবর্তীতে সচিব ও যুক্তরাজ্যে রাষ্ট্রদূত হয়ে গাড়িতে বাড়িতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ান। যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিশ্বাস করেন না) খুনীদের কাছে তাঁর গোপন আস্তানার তথ্য জানিয়ে দিয়ে তাঁকে ধরিয়ে দেয়। খুনী মোশতাক মনসুর আলীকে তাঁর অধীনে প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য অনেক পীড়াপীড়ি করে ব্যর্থ হয়ে তাঁকে কারাগারে নিক্ষেপ করেন। 
খুনী মোশতাকের জনসংযোগ কর্মকর্তা, আমার বিশ্বস্ত বন্ধু ও মুক্তিযোদ্ধা কুমার শংকর হাজরা আমাকে বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্টের সেই পীড়াপীড়ির ঘটনাবলী বর্ণনা করে বলেছিলেন, "প্রেসিডেন্ট মোশতাক হুঙ্কার দিয়ে মনসুর আলী স্যারকে বললেন, এবার যারা জেলে যাবে, তারা কেউ জীবন নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারবে না। প্রেসিডেন্ট মোশতাকের ও বঙ্গভবনের খুনীদের হুঙ্কার এবং প্রধানমন্ত্রী হবার প্রলোভন মনসুর আলী সাহেব ঘৃণাভরে দু'পায়ে দলে বঙ্গভবন থেকে চলে যান।" কুমার শংকর হাজরা তাঁর সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা নিবেদন করে মনসুর আলী সম্পর্কে বলেছিলেন, "মৃত্যুর পরোয়ানা -আর প্রধানমন্ত্রীর সিংহাসন '- এ্ই দু'য়ের মধ্যে কেউ যে মৃত্যু পরোয়ানা বেছে নিতে পারে- এমন মানুষ এই দুর্ভাগা দেশে আছে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না, দোস্ত।" ট্র্যাজেডি হলো, এই ঘটনার ক'মাস পরে দুঃখে-শোকে জর্জরিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধা অফিসার কুমার শংকর হাজরা সিভিল সার্ভিসের চাকরি ইস্তফা দেন।

২১ আগস্ট বৃহস্পতিবার বঙ্গভবন থেকে প্রথম যেদিন সচিবালয়ে গেলাম সেদিন এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের সমবায় বিভাগের সচিব খোরশেদ আলম সাহেবের রুমে তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাত হয়। তিনি জানতেন যে, আমি মুক্তিযোদ্ধা ও মুজিবনগর অফিসারদের সংগঠন করি। আমাকে দেখে বঙ্গবন্ধুর নাম বলতে বলতে তিনি কেঁদে ফেললেন। তাঁর বিপদ হবে ভেবে আমি তাড়াতাড়ি তাঁর রুমের দরজার নব টিপে বন্ধ করে দিলাম।

 তিনি আমাকে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, "বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন না করলে পাঞ্জাবী সিএসপিরা আমাদের দিয়ে তাদের জুতা মোছাতো আর এই সচিবালয়ে টিবয় করে চা আনিয়ে খেত। আমাদের বাঙালী সিএসপি এবং ইপিসিএস অফিসারদের এই দশাই হতো।" 

ওই দিন দুপুরে পিআইডির তৎকালীন সিনিয়র কর্মকর্তা মকবুল আহমেদের সামনে সচিবালয়ের মেডিকেল অফিসার উঁচু, লম্বা, কৃষ্ণ বর্ণের, স্বাস্থ্যবতী ডা. ফজিলা নবী পিআইডির শেডে এসে সজল চোখে বললেন, "দেখুন, আমরা ডাক্তার। আমাদের কাছে কোন ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নেই। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আজ সচিবালয়ে আসার পথে শেরেবাংলা নগর থেকে আমি যখন আমার মাইক্রোবাসে আসছিলাম, তখন ৩২ নম্বর রোডের মুখে নির্মম নির্যাতন দেখে এলাম। এমন নির্যাতন নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। আমার মাইক্রোবাস যখন ৩২ নম্বর রোডের মুখে আসে, তখন দেখলাম সেখানে বয়স্কা মহিলা, কিশোরী ও শিশুরা কিছু ফুল হাতে এসেছিল বঙ্গবন্ধুর রক্তের ওপর তাদের শ্রদ্ধা জানাতে। কিন্তু সেখানে কি বর্বরতা দেখলাম জানেন? ৩২ নম্বর রোডের মুখে পাহারারত আর্মিরা পাঞ্জাবী আর্মির চেয়েও নিষ্ঠুরভাবে তাদের বুট দিয়ে লাথি মারছে এবং রাইফেল-বন্দুকের বাঁট দিয়ে বুকে, ঘাড়ে, পিঠে, মাথায় যে যেভাবে পারছে, মারছে। থেতলে দিচ্ছে! সেই মা-বোনদের আর্তনাদ চিৎকার সহ্য করা যায় না! আমাদের মা-বোনরা-শিশুরা সেখানে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। তাদের হাতের সাদা, লাল ফুল পিচের রাস্তার ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে। এক জননী বাচ্চাদের আগলাতে যাচ্ছে দেখে এক 'শয়তান' বুট দিয়ে তার গলায় চেপে দাঁড়িয়ে তার জিভ বের করে ফেলেছে। এমন পাপিষ্ঠ, দেখে মনে হয় মাতৃগর্ভে যেন এদের জন্ম হয়নি! পাকসেনাদের মতো এ রকম অত্যাচার যখন চলছিল, তখন গাড়ি থেকে দ্রুত নেমে আমি এপ্রোন পরা অবস্থায় সচিবালয়ের ডাক্তার পরিচয় দিয়ে দু'হাত দিয়ে আগলে সেই আহত মা-বোন ও শিশুদের সেখান থেকে সরিয়ে আনি। আর আহত কয়েকজনকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে আসি।"
খুনী মোশতাক-ডালিম-ফারুকদের শ্বেত সন্ত্রাস ও নির্যাতনে সচিবালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, মতিঝিল, ব্যাংক, কোর্ট, কর্পোরেশনসহ সমগ্র রাজধানী ঢাকা কম্পমান এবং রাজধানীর মোড়ে মোড়ে ট্যাঙ্ক, ঢাকার সকল রেজিস্টেন্স ব্যর্থ প্রায়। 
তখন ঢাকার সচিবালয়ের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে চট্টগ্রামের যুবলীগের দুর্ধর্ষ কমান্ডো মুক্তিযোদ্ধা এসএম ইউসুফের যোগাযোগ হয়ে যায়। চট্টগ্রামে আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে  তিনি খুনীদের বিরুদ্ধে অনেক সফল অপারেশন চালাচ্ছিলেন। 
চট্টগ্রামে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছিল, টাঙ্গাইলে যেমন বীর কাদের সিদ্দিকীর রেজিস্টেন্স খুনী মোশতাক-ডালিম-ফারুকদের মাথা ব্যথার কারণ হয়েছিল। টাঙ্গাইল থেকে বীর কাদেরীয়া বাহিনীর এক লিফলেট এসে পৌঁছায় শাহবাগের বিসিএস একাডেমীর প্রশিক্ষণার্থীদের কাছে। তার ঠেলায় বঙ্গভবন দুলে ওঠে। সচিবালয় কেঁপে ওঠে। জেনারেল ওসমানী তখন খুনী মোশতাকের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা। তিনি বিডিআরের ডিজি ব্রিগেডিয়ার খলিল সাহেবকে ফোন করে এক ঘণ্টার মধ্যে কয়েক ট্রাক বিডিআর আনালেন বঙ্গভবনের চারপাশে দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তোলার জন্য। বঙ্গভবনে খুনী মোশতাকের পিআরও ('৭২ সাল থেকে মন্ত্রী মোশতাকের পিআরও পদে কর্মরত ছিল) কুমার শংকর হাজরা ও আমি দেখলাম যে, "বঙ্গভবনের ভেতরে কাদের সিদ্দিকীর আতঙ্ক ঢুকে গেছে। বঙ্গভবনের সর্বত্র খুনীরা কাদেরীয়া বাহিনীর ভূত দেখছে। বঙ্গভবনে গাছের পাতার ফাঁকে পাখি উড়লেও গুলি করছে তারা। বঙ্গভবনের পুকুরে মাছ লাফানোর শব্দ হলে কয়েক ডজন সশস্ত্র বিডিআর পুকুরের চারপাশে মোতায়েন করা হলো পানির মধ্যে কাদেরীয়া বাহিনী ডুব মেরে আছে কিনা তা নিষ্পলক চোখে পাহারা দেবার ও গুলি করার জন্য। বঙ্গভবনের ছাদেই শুধু না, বঙ্গভবনের ভেতরে বড় বড় আম গাছের ডালে ডালে এসএলআর/স্টেনগান হাতে বিডিআরকে তুলে দেয়া হয়েছে কাদেরীয়া বাহিনীকে খোঁজার ও গুলি করার জন্য।" এদিকে সচিবালয়ে দৌড়াদৌড়ি ও তল্লাশি শুরু হলো কাদের সিদ্দিকীর লিফলেটের সন্ধানে। 
প্রেসিডেন্ট মোশতাকের ফটোগ্রাফার আমির খসরু (গবর্নর মোনেম খানের আমল থেকে বঙ্গভবনে নিয়োজিত) বঙ্গভবনের দোতলা থেকে নেমে এসে এমএসপির রুমে আমাকে পেয়ে ডেকে নিয়ে জানালেন যে, "কাদেরীয়া বাহিনী ঢাকা প্রবেশ করেছে শুনে বঙ্গবন্ধুর খুনী মাজেদ-ফারুক-ডালিমরা বঙ্গভবনের দোতলায় তাদের শয়ন কক্ষে গিয়ে আতঙ্কে সিদ্ধ হয়ে নোংরা-অশ্লীল মুখ খিস্তি করছে আর মদের বোতল খুলে ঢক ঢক করে মদ গিলছে। কাদের সিদ্দিকীর পায়ের ধুলাও আসেনি ঢাকায়, তার লিফলেট ঢাকায় এসে পড়ায় বঙ্গভবন ও সচিবালয়ে সেদিন ভূমিকম্প হয়ে গিয়েছিল।
অপরদিকে, চট্টগ্রামের রেজিস্টেন্সের নায়ক এসএম ইউসুফ, সেই দুর্ধর্ষ কমান্ডো মুক্তিযোদ্ধা, যিনি চট্টগ্রাম সেক্টরে ১৯৭১ সালে মুজিব বাহিনী গঠনের প্রক্রিয়ায় বাধাদান করার কারণে সেখানে এক মেজরকে রিভলবারের মুখে হ্যান্ডসআপ করিয়েছিলেন ('৭১-এর সেক্টর কমান্ডাররা তাঁর নাম জানেন ও ঘটনা জানেন)। ১৫ আগস্টের পর খুনীদের বিষয়ে ঢাকার কোন প্রেসে তখন হ্যান্ডবিল বা কোন লিফলেট ছাপা সম্ভব হচ্ছে না। সবাই আতঙ্কে ঠকঠক করে কাঁপছে। অথচ লন্ডন থেকে বঙ্গবন্ধুর মুখ্য সচিব আমার মামা রুহুল কুদ্দুস বার বার লিফলেট বিতরণের কথা, বিশেষ করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বিতরণের জন্য আমাকে ফোনে নির্দেশ দিচ্ছিলেন। আমি যখন ঢাকার অবস্থা বললাম। তখন তিনি চট্টগ্রাম থেকে লিফলেট ছাপানোর ব্যবস্থা করে ঢাকায় পাঠান। (চট্টগ্রাম দক্ষিণ আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট এই লিফলেট ছাপানোর জন্য লন্ডন থেকে রুহুল কুদ্দুসের নির্দেশ পান। তিনি এটা চট্টগ্রামের এক প্রেস থেকে ছাপিয়ে মনি ভাইয়ের বিশ্বস্ত ইউসুফকে দেন বলে ইউসুফ আমাকে পরে জানিয়েছেন।) এই লিফলেট ইউসুফের মাধ্যমে চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনযোগে মুখে শাকের ‌আঁটি দিয়ে ৪ বস্তা  ২ রকমের লিফলেট তিনি ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন। 
খুনী মোশতাক-ডালিম-ফারুকের সরকারকে উৎখাত করে মুক্তিযুদ্ধের সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার আহ্বান সম্বলিত সেই লিফলেট ঢাকার কমলাপুর রেল স্টেশনে ঠিকমতো ডেলিভারি হয়েছিল। আমার নামে বঙ্গভবনের ঠিকানায় সেই লিফলেটের বস্তা পাঠানোয় কমলাপুর কর্তৃপক্ষ তা না দেখেই ডেলিভারি দিয়ে দেয় (ছাত্রনেতা এসএম ইউসুফ লিফলেটটি লেখেন)।

এই লিফলেট ঢাকায় আসার পর সচিবালয়ের বীর তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের মুজিবনগর সেলের প্রধান সিনিয়র সহকারী সচিব রাখাল দা'র কলাবাগানের স্টাফ কোয়ার্টারে আমরা গোপন বৈঠকে বসি। সে বৈঠকে হাজির ছিলেন তথ্য অফিসার গাজী মনসুর স্যারের অফিসার, খুনী মোশতাকের অফিসার কুমার শংকর হাজরা, তাজউদ্দীন স্যারের অফিসার আলী তারেক, নজরম্নল ইসলাম স্যারের অফিসার আমি এবং শেখ ফজলুল হক মণি ভাইয়ের দুই বিশ্বস্ত অফিসার ফকীর আব্দুর রাজ্জাক এবং শফিকুল আজিজ মুকুল (দৈনিক বাংলার বাণী বন্ধ হয়ে গেলে সরকারী সিদ্ধান্তে এই তিন সাংবাদিক তথ্য অফিসার হিসেবে সরকারী চাকুরিতে যোগ দান করেন)। আমাদের সবার শ্রদ্ধেয় ও বয়োজ্যেষ্ঠ রাখাল দা' সেই গোপন বৈঠকে আমাদের পবিত্র কোরান শরিফ এবং ত্রিবেদী ও হাজরাকে পবিত্র গীতা ছুঁয়ে এই মর্মে শপথ করান যে, আমাদের কেউ ধরা পড়লে আমরা '৭১-এর বীর শহীদদের মতো আমাদের জীবন দেব, কিন্তু একে-অন্যের নাম বলব না। এই বৈঠকের কোন গোপনীয়তা ফাঁস করব না বা আমাদের সহযোদ্ধাদের কারও নাম প্রকাশ করব না। বৈঠকে ঠিক হয়, এই লিফলেট ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, বঙ্গভবন ও ঢাকার সচিবালয়ে গোপনে গভীর রাতে ছড়িয়ে দিতে হবে। 
ঠিক হয় বঙ্গভবনে কুমার শংকর হাজরা, সচিবালয়ে আলী তারেক, ত্রিবেদী, রাজ্জাক ও মুকুল এবং ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে গাজী মনসুর ও আমি বিতরণ করব। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ২৭ ও ২৮ আগস্ট আমরা দু'জন এক সঙ্গে রেকি করি সুশীল বাবুর জলপাই রঙের টয়োটা গাড়ি নিয়ে। কিন্তু ২৯ আগস্ট যখন লিফলেট সামনের ও পেছনের সিটে ভরা হয় তখন জায়গার অভাবে রাখাল দা' একজনকে যেতে বলেন। তখন প্রশ্ন ওঠে_ কে সে? রাখাল দা' মনসুরকে প্রশ্ন করেন তারা কয় ভাই। মনসুর বলে তারা দুই ভাই। আমাকে প্রশ্ন করলে আমি বলি আমরা ছয় ভাই। রাখাল দা' তখন সিদ্ধান্ত দেন_ "মুসা যাবে"। আমি তখন জোরে জোরে আয়াতুল কুরসি পড়তে শুরু করি এবং আমার চোখে তখন আমার প্রিয় জননীর মুখ ভেসে ওঠে।কিন্তু কিছুটা ভুল প্ল্যানিংয়ের কারণে ঢাকার মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে ঢাকার সর্বত্র সে লিফলেট বিতরণ করা সম্ভব হয়নি।
 প্রথম প্রচেষ্টায় বঙ্গবন্ধুর মুখ্য সচিব রুহুল কুদ্দুসের (তিনি তখন লন্ডনে চিকিৎসাধীন) স্নেহভাজন মতিঝিলের এক হিন্দু ব্যবসায়ী শ্রী সুশীল বাবুর আর্মির জলপাই রঙের নতুন টয়োটা গাড়ি নিয়ে ২৯ আগস্ট রাত ১০টায় গাড়িভর্তি লিফলেট নিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ঢুকি। ড্রাইভার জানতো না লিফলেটে কি আছে। এর আগে ২ দিন ক্যান্টনমেন্টের ভেতর আমরা রেকি করি। দেখা যায় যে, রাত ১০টার পর ক্যান্টনমেন্টের ভেতরের রাস্তাঘাট ভয়ে-আতঙ্কে জনশূন্য হয়ে যায়। অফিসার ও জওয়ানরা যে যার কোয়ার্টারে ঢুকে পড়ত রাত ১০টার আগেই। তাই পূর্ব পরিকল্পনা মতো রাত ১০টার দিকে আমি ক্যান্টনমেন্টের গেটে সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ স্যারের সঙ্গে এ্যাপয়েন্টমেন্টের নাম করে (খালেদ মোশাররফ স্যারের 'কড'-এর দেয়া পাস নিয়ে) স্যুটেড বুটেড হয়ে ঢুকে পড়ি। 
ক্যান্টনমেন্টের ভেতরের জনশূন্য রাস্তায় ড্রাইভারকে ফুল স্পিডে গাড়ি চালাতে বলে পেছনের সিটে বসে আমি দু'হাতে পাগলের মতো লিফলেট দু'দিকে ছুড়ে দিতে থাকি। খুনী মোশতাক-ডালিম-ফারুকদের উৎখাতের আহ্বান সংবলিত লিফলেট ছড়িয়ে আমি ক্যান্টনমেন্টের উত্তরে অফিসার কোয়ার্টারের গেটের দিক দিয়ে বেরিয়ে যেতে সমর্থ হই।  (সে গেটটি জেনারেল মাহবুবুর রহমান যখন আর্মির চীফ হন, তখন তা বন্ধ করে দেয়া হয়।) ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে আমি কোথাও বাধাপ্রাপ্ত হইনি_এটা আমার সৌভাগ্য বলতে হবে। তবে তখনকার বাসত্মব অবস্থা ছিল এরূপ যে, ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে রাত ১০টার পর রাসত্মা জনশূন্য হয়ে যেত। আর্মিরাও ভয়ে ব্যারাক থেকে বের হতো না। যত কিছু সিকিউরিটি এ্যাকটিভিটিজ, তখন সব কিছু ছিল বঙ্গভবন ও নাজিমউদ্দীন রোডে বন্দী ৪ জাতীয় নেতাকে নিয়ে।
২য় পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩০ আগস্ট দিবাগত রাতে সচিবালয়ে ও বঙ্গভবনে উক্ত লিফলেট বিলি করার দায়-দায়িত্ব মুজিবনগর-মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের ছিল। তা তাঁরা পুরোপুরি করতে পারেননি। ওই রাতে বঙ্গভবনে লিফলেট বিতরণের দায়িত্ব ছিল কুমার শংকর হাজরার। হাজরা ৭-৮শ' লিফলেট বঙ্গভবনের নিচতলার মুখ্য সচিবের পিএ-এর রুম ও আশপাশের প্রশাসনিক কয়েকটি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের রুমে ফেলে রাখতে সমর্থ হয়। অন্যান্য উল্লেখিত তিনজন অফিসারের দায়িত্ব ছিল সচিবালয়ে লিফলেট বিতরণের। ওই রাতে তারা লিফলেট নিয়ে পিআইডির গাড়িতে সচিবালয়ের ভেতরে রাত ১০টায় তারা ঠিকই ঢুকেছিলেন। কিন্তু আগের রাতে ক্যান্টনমেন্টে লিফলেট বিতরণ হওয়ায় সচিবালয়ে এনএসআই এবং এসবির অস্বাভাবিক উপস্থিতি টের পেয়ে সচিবালয়ের ২নং নয়তলা ভবনের ও পূর্ত মন্ত্রণালয়ের কলাপসিবল গেটের ভেতরে কিছু লিফলেট তারা ছুড়ে দিয়ে দ্রুত সচিবালয়ের মসজিদের ওজুখানার পাশের টিনের ছোট দরজা দিয়ে প্রেসক্লাবের পেছনের ডোবা দিয়ে পালিয়ে যেতে সমর্থ হন ('৭৫ সালে সচিবালয়ের মসজিদের পশ্চিমের বর্তমান সচিবালয় লিংক রোড ছিল না এবং প্রেসক্লাবের পেছনে বড় ডোবা ছিল)।
 কিন্তু সচিবালয়ের এই ব্যর্থতার সেই পরিণতি ভোগ করতে হয় সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের মুজিবনগর সেলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বীর মুক্তিযোদ্ধা শ্রী রাখাল ভট্টাচার্যকে। এই ঘটনার কয়েকদিন পরেই জেনারেল জিয়ার নির্দেশে আর্মির গোয়েন্দারা রাখাল দা'কে ধরে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করে এবং পরবর্তীতে তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করে। কারাগারেও বর্বরভাবে তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়। কিন্তু কোন মুক্তিযোদ্ধার বিষয়ে তিনি মুখ খোলেননি।মাষ্টার'দা সূর্যসেন,  ক্ষুদিরামের ন্যায় এই মহান দেশপ্রেমিক বীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসার রাখাল'দা কারাগারের নির্যাতন শেষে হাসপাতালে হস্তান্তরের কয়েকদিনের মধ্যে হাসপাতালেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

 আমার মনে পড়ে, ১৮ আগস্ট রাখাল দা'র সঙ্গে টেলিফোনে আমার ও প্রণোদিৎ দা'র কথা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, "মুসা কিছু একটা করো। বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলবে, আর আমরা বেঁচে থাকব তা হয় না..."। এইটুকু বলে তিনি কাঁদছিলেন। তাঁর সেই কান্নার মর্যাদা বঙ্গবন্ধুর জন্য জীবন দিয়ে তিনি প্রমাণ করে গেছেন। রাখাল দা'র নাম সচিবালয়ের মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের কাছে চিরকাল প্রাতঃস্মরণীয় নাম হয়ে থাকবে।তাঁর নেতৃত্বে সেদিন বঙ্গভবন ও সচিবালয়ের ক'জন তরুণ বীর মৃত্যুজ্ঞয়ী মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবন্ধুর খুনীদের রুখতে জীবন বাজি ধরেছিলেন_তার সুদূরপ্রসারী পরিণতি ঘটেছিল_যা তখন কেউ কল্পনাও করতে পারেনি।

 প্রথমত, নিরাপত্তার নিশ্ছিদ্র বেড়াজাল ভেদ করে আতঙ্কগ্রস্ত মৃত্যুপুরী ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বহিরাগত কেউ সামরিক-বেসামরিক অফিসারদের পক্ষে আহ্বান সংবলিত লিফলেট ছড়িয়ে আসতে পারে_কোন জওয়ান ও অফিসার এমনটা ভাবেনি বা বিশ্বাস করেনি। দ্বিতীয়ত, উক্ত লিফলেট ৩০ আগস্ট প্রত্যুষে ক্যান্টনমেন্টের বিভিন্ন রাস্তায় পেয়ে জওয়ান ও অফিসাররা উক্ত লিফলেট তারা নিজেরা দিয়েছে বলে প্রচার চালায়। 
তার মূল কারণ, খুনীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার অহঙ্কারে এমন উন্মত্ত হয়ে ওঠে যে, সৈনিকদের কাছে তাদের স্ব স্ব রেজিমেন্টের সিনিয়র কমান্ডিং অফিসার কর্নেল, ব্রিগেডিয়ার ও জেনারেলদের অবজ্ঞা ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে ডাস্টবিনের মল-মূত্রের বস্তুতে পরিণত করে!! সেজন্য মানসম্মানে আঘাত পড়ায় ভেতরে ভেতরে সেনা অফিসাররা আগুন হয়েছিল ও টগবগ করে ফুটছিল।

লেখক : কলামিস্ট ও সাবেক সচিব
৫,৭,৮,৯ সেপ্টেম্বর ২০১৩, দৈনিক জনকন্ঠ

মৃত্যুর মিছিলের শব যাত্রীরা মহিমান্বিত ক্ষমতার ভাগাভাগিতে! : জান্নাতুল বাকেয়া কেকা

মৃত্যুর মিছিলে প্রতিদিনই যোগ হচ্ছে নতুন নতুন নাম। আনোয়ারা বেগম, মোজাম্মেল, মনির অথবা পল্টুরা। সরকার ও বিরোধী রাজনীতির পালে জোর হাওয়া দিচ্ছে শব মিছিলের এই যাত্রীরা। ক্ষমতাসীনরা বুক ফুলিয়ে বলতে পারছে, মানুষ মারা আর হত্যার রাজনীতি করছে বিরোধী দল। আর বিরোধী দল ভাবছে, আগুনে-পেট্রোলে জ্বলে পুড়ে ছাড়খার হওয়া যন্ত্রণা শেষে জীবন থেকে প্রাণ যাওয়া শব গুলো সরকারের বিরুদ্ধে তাদের হরতাল-অবরোধের রাজনীতির জলন্ত সাফল্য ! কারণ ? গরিব-খেটে খাওয়া-অসহায় মানুষ গুলো যে প্রাণ দিয়ে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের জয়োগান গাইছে ! তাই তো রাজনীতিকে আরো সহিংস করছে ক্ষমতালোভী আর ক্ষমতাভোগীরা। চলন্ত লেগুনায়-সিএনজিতে পেট্রোল ঢেলেই ক্ষান্ত হচ্ছে না ১৯-২০ বছর বয়সী যে ছেলেটি বাঁচার তাগিদে পালিয়ে বাঁচতে চাইছে তাকে জোর করে গাড়ীতে আটকে জ্বালিয়ে দিচ্ছে। হায় ! মোজাম্মেল হায় ! তুমি মরলে তবে জানলে না তোমার মৃত্যু ক্ষমতাভোগী আর ক্ষমতালোভীদের সাফল্যেরও ভাগাভাগিতে কতটা দামী ? হায় ! তুমি জানলে না মোজাম্মেল ? আর তোমার অন্ধ মা যে তোমার প্রতিক্ষায় ? তুমি যে ছিলে সেই অন্ধের যষ্টি এক মাত্র অবলম্বন !
আর সিএনজি চালক সাবেত আলী- তুমিও মৃত্যুর লাইনে দাঁড়িয়ে, অপেক্ষায়, সরকার আর বিরোধীদের সাফল্যের ভাগিদার হবার। তোমার পাঁচ আর নয় বছরের ছেলে দুটি আব্বা কখন ফিরবে সেই প্রতীক্ষায় ? তুমি তো জানো না সাবেত আলী কার আহ্বানে সাড়া দিয়ে তোমার প্রতীক্ষার অবসান ঘটাবে ? তা তুমি জানবেও না সাবেত আলী। তুমি হাসপাতালের বিছানায় চিৎকার করো। যন্ত্রনায় গোঙ্গাতে থাকো। যন্ত্রনাময় গোঙ্গানীর স্বরে আধো আধো স্বরে বলতে থাকো ‘জ্বলে, জ্বলে, জ্বলে-জ্বলে যায় ডাক্তার ডাকো। আর তোমার চিকিৎসার খরচ যোগাতে গিয়ে দেয়ালে মাথা খুটে রক্তারক্তি কান্ড ঘটায় তোমার প্রিয়তম স্ত্রী। যেমনটি দুর্বৃত্তরা যেদিন তোমার শরীরে আগুনে জ্বালিয়ে দগ্ধ করেছিলো আর সেই খবরে মাটিতে গড়িয়ে কেঁদে-কেটে এলাহি কান্ড করেছিলো তোমার ঘরের লোক। মানুষ জমিয়ে কারো বা সহানুভুতি পেয়েছিলে। আর কেউ কেউ মজাও লুটেছিলো। কারণ ? কান্নার দাপটে বেদিশা সেই বেটি লোকের বুকের কাপড় সরে বেরিয়ে পড়েছিলো তুল তুলে নরম বুকের এক পাশ। সাবেত আালী একসময় কেউ একজন তোমার প্রিয়তম সেই স্ত্রীর হাতে ক’টাকা গুজে তোমার শুন্য স্থান পুরণের চেষ্টা চালাবে। প্রিয় সেই শরীরে ভাগ বসাবে। তাতে কি দোষের কিছু হবে কি সাবেত আলী ? না তুমি জানবে না সাবেত আলী। তোমার চিকিৎসা ব্যয়, অভুক্ত সন্তানের মুখ চেয়ে তোমার প্রিয়তম যদি কারো গুজে দেয়া ক’টাকার জন্য তার শরীরটি বিকিয়ে দেয় তাহলে তুমি কি কষ্ট পাবে সাবেত আলী ? একমাত্র উপার্জনকারী সাবেত তুমিই যে এখন উল্টো বোঝা হয়ে অভুক্ত রেখেছো মা স্ত্রী আর দুই সন্তানকে। বাঁচার জন্য আলোয়ারা যদি শরীর বেচেঁ-কিডনী বেঁচে শরীরের রক্ত বেঁচে তাতে কার কি এসে যায় সাবেত আলী ?
পিকেটারদের দেয়া আগুনে পুড়ে যাওয়া মানুষ(ফােইল ছবি)
পিকেটারদের দেয়া আগুনে পুড়ে যাওয়া মানুষ(ফােইল ছবি)
কুমিল্লার মতলবের সিএনজি চালক রুবেল হোসেন। তোমার স্ত্রী দারুণ‘ অসহায় অবস্থা তার বেচারি ঢাকা শহরের রং তামাসা কোখনোই দেখেনি। জীবনে প্রথম ঢাকায় আসা তাও আগুনে ঝলসে যাওয়া স্বামীর দেখভালের প্রযোজনে। খবর পেয়ে এক কাপড়ে। সম্বল এক হাজার টাকা। তাও প্রতিবেশীর কাছে ধার করে আনা, সেই টাকাও ফুরিয়েছে। স্বজন বলতেও কেউ নেই। নাবালক তিন বাচ্চাকে রেখে এসেছেন ঘরের পাহারায়। মতলবের সেই ছোট সংসারের পাহারায় থাকা বাবা-মা ছাড়া সেই বাচ্চারা আজ কদিন ধরেই অভুক্ত। মা হাসপাতালে বাবার শয্যা পাশে। শুন্য হাতে স্বামীর শিয়রে বসে অভুক্ত বাচ্চাদের মুখ মনে করে সকাল-সন্ধা নিয়ম করে চোখের জল ফেলছেন  স্নেহময়ী সেই মা সাজেদা। আর ভাবছে ক্লাস ফাইভে পড়া ছেলেটা বরাবরই ভালো রেজাল্ট করেছে। এখন চলছে প্রাথমিক সমাপনি পরীক্ষা। পরীক্ষার্থী যে ছেলেটি আজ কদিন ধরেই অভুক্ত। এই কদিন একবারও পড়া বা পরীক্ষার কথা মুখেই আনেনি। বাবা যে হাসপাতালের মৃত্যু শয্যায়। কদিন বাদেই পরীক্ষা না দিয়ে পথে নামবে পেটের দায়। হায় ? আরেকটি শিশু ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়ে একটি সনদ অর্জনের পথে গিয়েও ঝরে গেল ! তাতে কি রুবেল হোসেন তুমি তো জানো না রাজনীতির মাঠের গোলে তোমার অবদান লেখা রবে রাজনীতির ভাগাভাগিতে, তুমি হয়তো তোমার জীবন দিয়ে দলাদলির-ভাগাভাগির সাফল্যে মহিমান্বিত্ব হবে। আর সেই মহিমাময় অবদানের ভাগিদার হয়ে তোমার সন্তানেরা প্রাথমিক সমাপনির বাকী পরীক্ষাটা নাই বা দিলো ? আর কদিনই বা মা-বাবার পথ চেয়ে অভুক্ত হয়ে মায়ের গোছানো সংসার জোগাবে ? নাকি কদিন বাদেই পথে নামবে পেটের দায়। আর্তনাদে ক্ষুধায়-যন্ত্রনায় তোমার সন্তান না হয়ে নতুন ডেরার সন্ধান করবে খুঁজবে খাদ্য আর আশ্রয়। অভিবাসিত হবে। ছুটে আসতে পারে আলোক সজ্জার এই রাজধানীতেও। শিশু অধিকার আইনকে বৃদ্ধাঙ্গলী দেখিয়ে বাসে-লেগুনায় হেলপারের কাজে লাগতে পারে। বনে যেতে পারে চোর-বাটপার বা পকেট মারও। তাতে কি রুবেল হোসেন ? কে তোমায় দিব্বি দিয়েছে তোমার সন্তানদের লেখাপড়া শিখে মানুষ হতেই হবে ? পেতে হবে খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান আর শিক্ষার অধীকার ? ক্ষমতাসীন আর ক্ষমতালোভীরা আছেন না যাদের সন্তানেরা, বাবার অঢেল অর্থে জন্মের পর মুখে সোনার চামচ নিয়ে জন্মেছে। এখন রানী এলিজাবেথের মতো অবকাশকালীন উদযাপনের মতো লন্ডন-ইতালী-আমেরিকা-ইউরোপে কোথাও নিরাপদে বিত্ত-বৈভব্যের মধ্যে আয়েশী-বিলাসে জীবন ধারণ করছে। চলছে বিদ্যা অর্জনও। সময় মতো এদেশের মুক্ত বাতাসে, প্রজেক্ট পরিচালক হয়ে বা উচ্চ পদে আসীন হয়ে দেশে ফিরলেও ফিরতে পারেন। আর না ফিরলে বা কি ? উত্তরাধিকারীর সূত্রেই তাদের বাপ-দাদার সম্পত্তিসম এই দেশটির নির্যাস তো রূপে রুসে ভোগ করছে তারাই।
সাতেব আলীরা দেখে নিও এই সোনার বাংলার চুঁইয়ে পড়া সোনা ফলন নির্যাসে একদিন উদর পূর্তি করবে তোমার সন্তানেরাও। দু:খ করো না রুবেল হোসেন, দুদু মিয়ারা মোজাম্মেল-আনোয়ারা-আর পলটুদের মতো..অগ্নিদগ্ধ হও…যন্ত্রণা সহো ..প্রাণ দাও একদিন সব পাবে । সব । শুধু পাবে না খুব প্রিয় প্রাণ ভোমরাটা।
জান্নাতুল বাকেয়া কেকা
সিনিয়র রিপোর্টার, চ্যানেল আই ঢাকা।

Saturday, November 23, 2013

সংখ্যালঘু রক্ষা করবে জামায়াত-শতাব্দীর তামাশা: হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদ



 এবার দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে মাঠে নামছে দলগতভাবে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ক্রিমিনাল সংগঠন জামায়াত! বাংলাদেশে বসবাসকারী ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জানমাল ও উপাসনালয়ের পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবিতে আজ দেশজুড়ে বিক্ষোভ সমাবেশেরও ঘোষণা দিয়েছে একাত্তরে গণহত্যার জন্য দায়ী এই উগ্রপন্থী সংগঠনটি। নির্বাচন সামনে রেখে জামায়াতসহ উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর সংখ্যালঘু নির্যাতন ও তাদের বিতাড়নের যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে ঠিক সেই মুহূর্তেই বিএনপির এ উগ্রপন্থী রাজনৈতিক মিত্র ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের রক্ষার নামে মাঠে নামছে। কেবল তাই নয়, দেশের সংখ্যালঘু নির্যাতনের জন্য রীতিমতো পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও ১৪ দলকে দায়ী করেই দেশজুড়ে বিএনপি-জামায়াতপন্থী উগ্রবাদী সংগঠনের উদ্যোগে কথিত ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা সভা, সমাবেশ ও সর্বধর্মীয় সম্প্রীতি সভার’ নামে গোয়েবলসীয় মিথ্যাচারের কৌশল নেয়া হয়েছে। জামায়াতের এ ন্যক্কারজনক অপতৎপরতার অংশ হিসেবেই শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবে সংখ্যালঘু নির্যাতনের দায় ভারতের ওপর চাপানো হয়েছে এক জাময়াতী সংগঠনের তথাকথিত সর্বধর্মীয় সম্প্রীতি সভা থেকে। যেখানে মৌলবাদী সংগঠন হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদকে। 
জামায়াতের এ ধরনের তৎপরতাকে নাটক ও বিশ্ববাসীকে ধোঁকা দেয়ার অপচেষ্টা বলে অভিহিত করেছেন দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ। এ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত জামায়াতের এ তৎপরতাকে নাটক অভিহিত করে বলেছেন, এরা দেশকে তালেবানী রাষ্ট্র বানানোর স্বপ্ন দেখছে। গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন ধ্বংস করতে সদা তৎপর। এরাই নির্বাচনকে সামনে রেখে সংখ্যালঘুদের বিতাড়নের মাধ্যমে দেশকে তালেবানী রাষ্ট্রে পরিণত করার স্বপ্নে বিভোর। জামায়াতের এ ধরনের তৎপরতা নাটক ও বিশ্ববাসীকে ধোঁকা দেয়ার অপচেষ্টা। কিন্তু মানুষ জানে এরা কারা। জানা গেছে, আজ দেশজুড়ে বিক্ষোভ-সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে একাত্তরে গণহত্যার জন্য দায়ী এই উগ্রবাদী সংগঠনটি। জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান শুক্রবার ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশে বসবাসকারী ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জানমাল ও উপাসনালয়ের পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবিতে সারাদেশের সকল মহানগরী, জেলা ও উপজেলায় বিক্ষোভ কর্মসূচী হবে। বাংলাদেশে বসবাসকারী ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জানমাল ও উপাসনালয়ের নিরাপত্তাহীনতায় আমি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি। যখনই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আরোহন করে তখনই তারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে বিশেষ করে জামায়াতÑশিবিরকে ঘায়েল করার হীন উদ্দেশ্যে দেশের সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান সম্প্রদায়কে রাজনৈতিক দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। যে সরকার ক্ষমতায় থাকে সে সরকারেরই পবিত্র দায়িত্ব সংখ্যালঘুদের জানমাল ও উপাসনালয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনার সঙ্গে জামায়াতÑশিবির কখনও জড়িত ছিল না। বরং যখনই সংখ্যালঘুদের ওপর কেউ আঘাত দিয়েছে তখনই জামায়াতÑশিবিরের নেতাকর্মীরা সংখ্যালঘুদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। দেশে সকল সংখ্যালঘু নির্যাতনের জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করে তিনি বলেন, এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী ক্যাডারদের কোন বিচার হয়নি। আমি এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের আহ্বান জানাচ্ছি। উদাহরণ আর না বাড়িয়ে আমি স্পষ্টভাষায় বলতে চাই, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে কিস্তিমাত করতে সিদ্ধহস্ত। জামায়াত নেতা বলেন, ইসলাম সব সময়ই সংখ্যালঘুদের জানমাল ও উপাসনালয়ের নিরাপত্তা বিধানের জন্য তাগিদ দেয়। কাজেই কোন সত্যিকারের মুসলমান কখনও সাম্প্রদায়িক হতে পারে না। বাংলাদেশের কোন ইসলামী দলের নেতাকর্মীরা কখনও সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, উপাসনালয়, দোকানপাটে হামলা করে না। বরং হামলা প্রতিরোধ করে। আওয়ামী লীগের লোকরাই সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, জমা-জমি দখল করেছে এবং সংখ্যালঘুদের সব সময়ই রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে থাকে। 
জানা গেছে, জামায়াতের এ ন্যক্কারজনক অপতৎপরতার অংশ হিসেবেই শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবে সংখ্যালঘু নির্যাতনের দায় ভারতের ওপর চাপানো হয়েছে এক জামায়াতী সংগঠনের তথাকথিত সর্বধর্মীয় সম্প্রীতি সভা থেকে। যেখানে মৌলবাদী সংগঠন হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদকে। সংগঠনটি হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদকে সাম্প্রদায়িক সংগঠন আখ্যায়িত করে বলেছে মুসলমান ও আদিবাসী প্রতিনিধি যে সংগঠনে নেই সেটা কী করে অসাম্প্রদায়িক সংগঠন হয়। জাতীয় প্রেসক্লাবে এ গোলটেবিল আলোচনায় বক্তব্য রাখেন বিচারপতি মোহাম্মদ আব্দুর রউফ, সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী গৌতম চক্রবর্তী, মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মোঃ আব্দুর রব, কবি আব্দুল হাই শিকদার, অধ্যাপক ফাদার তপন ডি রোজারিও, ড. সুকোমল বড়ুয়া, সঞ্জীব চৌধুরী, সুশীল বড়ুয়া প্রমুখ। আলোচনায় বক্তারা ১৯৪৭ সাল পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত দেশে সংখ্যালঘু কমে যাওয়ায় আফসোস করতে শোনা গেলেও ২০০১ সাল-পরবর্তী সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন সুকৌশলে। এমনকি কাদের কারণে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় মাতৃভূমিতে না থাকতে পারার যন্ত্রণা নিয়ে পার্শ¦বর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় তা উঠে আসেনি আলোচনায়। অধিকাংশ বক্তার আলোচনার মূল মেসেজ ছিল দেশে জামায়াত-শিবির নয়, আওয়ামী লীগই সংখ্যালঘুদের নিয়ে রাজনীতি করে। তারাই নির্যাতন করে সংখ্যালঘুদের ওপর। বক্তারা বলেন, স্বাধীনতার পর দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর যত নির্যাতন হয়েছে তা রাজনৈতিক কারণে হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে একটি দল ফায়দা লুটতে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন করে। তারা দাবি করেন, বর্তমান মহাজোট সরকারের সময়ে যেভাবে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন হয়েছে এমন ঘটনা আগে ঘটেনি। এভাবে সংখ্যালঘু নির্যাতন অব্যাহত থাকলে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌম হুমকির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তাঁরা। রামু, পাবনার সাঁথিয়াসহ যত বড় বড় হামলা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর করা হয়েছে সব ঘটনার সঙ্গে ক্ষমতাসীন দল জড়িত বলে তারা দাবি করেন। তাঁরা বলেন, মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী ঘটনাগুলো ঘটার আগে স্থানীয় প্রশাসন ও সরকারী গোয়েন্দা সংস্থার চরম ব্যর্থতা রয়েছে। বক্তারা বলেন, ঘটনা ঘটিয়ে জামায়াত এবং নিরীহ আলেম সমাজের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করা হয়। প্রকৃত অপরাধীদের রক্ষা করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত কোন ঘটনায় অপরাধীদের বিচার হয় না। তবে আলোচকরা সকল ঘটনা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করার দাবি করলেও তাদের আলোচনায় রাজনীতির চিত্র ফুটে ওঠে।
 আলোচনায় অংশ নিয়ে রিপন দে নামের একজন বলেন, ২০০১ সালে নির্বাচন-পরবর্তী যেভাবে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন ও অত্যাচার করা হয়েছে গোলটেবিল আলোচনায় লিখিত বক্তব্যে তা তুলে ধরা হয়নি। এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান রিপন নামের এ তরুণ। তাঁর এ বক্তব্যে আয়োজকরা এক ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে যায়। এমনকি সঞ্চালক রিপনের বক্তব্যের কোন ধরনের ব্যাখ্যা প্রদান না করে আরেকজন বক্তার কাছে চলে যান। নিজেদের অসাম্প্রদায়িক সংগঠন হিসেবে জাহির এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করতে তারা সব ধর্মের মহান পুরুষদের মানবকল্যাণে বলা বাণী বা বক্তব্য তুলে ধরেন আলোচনায়।
 দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করতে জামায়াতের অর্থায়নে গড়ে ওঠা এ প্রতিষ্ঠান ঢাকার বাইরে বিভিন্ন শহর, অন্তত তিনমাস অন্তর ঢাকায় একটি করে আলোচনাসভা করার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে তুলে ধরা হয়। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের বিষয়ে বলা হয়, এ সংগঠন একটি সাম্প্রদায়িক সংগঠন। ভারতের এজেন্ডা অনুযায়ী এ সংগঠন সাম্প্রাদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে কাজ করে। তাঁরা বলেন, দেশে মুসলিম ধর্ম ও আদিবাসীরা রয়েছে তাদের সংগঠনে না রাখলে এ সংগঠন কোনভাবে অসাম্প্রদায়িক সংগঠন হতে পারে না। 
 দেশজুড়ে নানা কৌশলে উস্কানি দিয়ে পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর জন্য কাজ করছে জামায়াত-শিবিরসহ উগ্রবাদী গোষ্ঠী। জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর বিচারের পর চালানো সংখ্যালঘু নির্যাতনের ধারাবাহিকতায় জামায়াত-শিবিরসহ উগ্রবাদীদের নক্সা অনুযায়ীই চলছে নাশকতা। নাশকতার ছকে রেখেছে হিন্দু, বৌদ্ধসহ সকল সংখ্যালঘু পরিবার ও উপাসনালয়। কক্সবাজারের রামুর সংখ্যালঘু নির্যাতনের ভয়াবহতার পর রবিবারও একই কায়দায় পরিকল্পিতভাবে ফেসবুকে মহানবীকে (স) কটূক্তির খবর ছড়িয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ চালানো হতে পারে আরো বিভিন্ন স্থানে। বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত যুদ্ধাপরাধীর বিচার ঠেকাতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও সংঘাত সৃষ্টির পরিকল্পনা নিয়েছে জামায়াত-শিবির ও জঙ্গীরা। দুটি উদ্দেশ্য সামনে রেখে সংখ্যালঘুদের ওপর তারা হামলা করছে বলে মনে করছে পুলিশও। এক. সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা করে অরাজকতার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন। দুই. হামলার প্রত্যুত্তরে সংখ্যালঘুরা পাল্টাহামলা চালালে ধর্মের দোহাই দিয়ে সারাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির ক্ষেত্র তৈরি করা।

Friday, November 22, 2013

চরম বিভ্রান্ত তারিক আলি হতাশ করেছেন শ্রোতাদের :আবদুল মান্নান

আমাদের যৌবনকালের একজন নায়ক দীর্ঘ প্রায় ৪৩ বছর পর বাংলাদেশে ঘুরে গেলেন। এই নায়ক কোনো সিনেমার নায়ক নন, রাজনৈতিক অঙ্গনের নায়ক, পাকিস্তানের বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক তারিক আলি। ষাটের দশকে দুই পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন আর যুক্তরাষ্ট্র প্রচণ্ড ঠান্ডা লড়াইয়ে ব্যস্ত। একদিন এক দেশ পারমাণবিক বোমা ফাটায় তো আরেক দিন অন্য দেশ। তখন একটি প্রচলিত বিশ্বাস ছিল যে যৌবনে সবাইকে মার্ক্সবাদে দীক্ষিত হতে হবে। ঢাকার স্টেডিয়াম মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স চুটিয়ে বাংলায় মার্ক্সবাদী বই বিক্রি করছে। কলকাতা থেকে এল নীহার কুমার সরকারের ছোটদের রাজনীতি আর ছোটদের অর্থনীতি। বলা যেতে পারে, মার্ক্সিস্ট হওয়ার সহজ পাঠ।
ষাটের দশকের শেষের দিকে যখন ভিয়েতনাম যুদ্ধ তুঙ্গে, তখন প্রথমে আমাদের সামনে রাজনৈতিক নায়ক হিসেবে আবির্ভূত হলেন উত্তর ভিয়েতনামের রাজনৈতিক গুরু হো চি মিন। তরুণদের সামনে তখন কিউবা আর দক্ষিণ আমেরিকার মার্ক্সিস্ট বিপ্লবী চে গুয়েভারা এক মহানায়ক। আজকের মতো ঘরে ঘরে তখন টেলিভিশন ছিল না। বিত্তবানদের বাড়িতে ছিল রেডিও। আর ছিল হাতে গোনা কয়েকটি খবরের কাগজ। হঠাৎ একদিন খবর এল, সোভিয়েত ইউনিয়নের প্ররোচনায় পূর্ব বার্লিনের মাঝ বরাবর কাঁটাতারের বেড়া তুলে পুরো বার্লিন শহরটাকেই পূর্ব জার্মানি দুই ফালি করে দিয়েছে। সে এক লোমহর্ষক খবর বটে। শহর দুই ভাগ মানে পরিবার দুই ভাগ, জায়গা-জমিন-সম্পদ দুই ভাগ। ব্যাপারটা যেহেতু সোভিয়েত-মন্ত্রে দীক্ষিত পূর্ব জার্মানি করেছে, সেহেতু দেশের মার্ক্সবাদে দীক্ষিত ব্যক্তিরাও বেশ শিহরণ অনুভব করল। ঘটনা থেমে থাকল না; বছর না ঘুরতেই কাঁটাতারের বেড়া জায়গা করে দিল আস্ত একটা দেয়ালকে।
ভিয়েতনাম তো বটেই, যেখানেই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন, সেখানেই সোভিয়েত ইউনিয়নের মদদ। অ্যাঙ্গোলা, কিউবা, বলিভিয়া, চিলি—কোনো জায়গাই বাদ যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, সব দেশেই লাল ঝান্ডার জয়জয়কার। যুক্তরাষ্ট্র অনেকটা আত্মরক্ষার ভূমিকায়। ইউরোপের তরুণেরা শুরু করলেন ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন। সামনে থেকে যাঁরা এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন পাকিস্তানের লাহোর থেকে বিলেতে পড়ালেখা করতে আসা দারুণ বুদ্ধিদীপ্ত তরুণ, তারিক আলি। পারিবারিকভাবে আলি পরিবার পাঞ্জাবের ক্ষমতাশালী ভূস্বামী হলেও বাবা সাংবাদিক মাজহার আলি খান বাম রাজনীতির সঙ্গে আজীবন জড়িত। আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে তিনি আর তাঁর স্ত্রী তাহেরা মাজহার আলি খান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। মওলানা ভাসানীর সঙ্গে পরিবারটির একটি সুসম্পর্ক ছিল। তাহেরার বাবা সরদার সেকান্দার হায়াত খান একসময় (১৯৩৭-৪২) পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তিনিও বাম রাজনীতির একজন সমর্থক ছিলেন।
ইউরোপে ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের একপর্যায়ে সেই আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ল আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে। আন্দোলনের মশাল তখন যুক্তরাষ্ট্রের বাম আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী অ্যাঞ্জেলা ডেভিসের হাতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে ক্যাম্পাসে সেই আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছে। ১৯৭০ সালের ৪ মে কেন্ট স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভরত ছাত্রদের ওপর ন্যাশনাল গার্ড গুলি চালালে চারজন ছাত্র ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন। কেন্টের কয়েক হাজার মাইল দূর থেকে আমরা মৃত কমরেডদের লাল সালাম জানালাম। এ সময় পশ্চিমা বিশ্ব দুনিয়ার অন্য প্রান্তে আরেকটি অগ্ন্যুৎপাতের সূত্রপাতের সঙ্গে পরিচিত হলো, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন। সেই বিশ্বের মানুষ জানল, এই আন্দোলনের সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন পূর্ববঙ্গের ছাত্র-জনতা এবং তাঁদের অন্যতম সেনাপতি তোফায়েল আহমেদ। তারিক আলি, জন লেনন (বিটলস খ্যাত) ইকো ওনো, অ্যাঞ্জেলা ডেভিসের পাশাপাশি লন্ডন-নিউইয়র্কের পত্রপত্রিকায় ছাপা হতে লাগল বাংলা আর বাঙালির খবর। সত্তরের নির্বাচনের পর দৃশ্যে আবির্ভাব ঘটল আরেকজন কালজয়ী মহানায়কের, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
সত্তরে তারিক আলি এলেন ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলা ভবনের সামনে বটতলায় তিনি যখন লাখো ছাত্র-জনতার জনসমুদ্রে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করছিলেন, তখন মনে হচ্ছিল তিনি তাঁর পরনের লম্বা কুর্তার পকেট থেকে বিপ্লবের আগুন বের করে তা চারদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন। তারিক আলির সেই অপরাহের বক্তৃতা কী যে এক উন্মাদনা সৃষ্টি করেছিল, তা এখন বোঝানো যাবে না। ইউরোপে ফেরার আগে দেখা করতে ভুললেন না বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু বটতলায় তারিক আলির দেওয়া বক্তৃতার প্রশংসা করলেন।
১৯৭০ থেকে ২০১৩—দীর্ঘ ৪৩ বছরের ব্যবধানে বিশ্ব অনেক পাল্টে গেছে। পতন হয়েছে বার্লিন দেয়ালের, সঙ্গে ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে গেছে পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের। বাম রাজনীতি এখন অনেকটা গৃহবন্দী। তারিক আলি এখন আর মার্ক্সবাদ প্রচার করেন না; ইতিহাস আর সাহিত্যচর্চা করেন। সময় পেলে সিনেমা বানান। থাকেন বিলেতে। সময় পেলে পত্রিকায় বিশ্লেষণধর্মী কলাম লেখেন। নিজ দেশে মৌলবাদীদের কাছে অবাঞ্ছিত। কারণ, তাদের মতে তিনি একজন নাস্তিক; যদিও তিনি ইসলাম নিয়ে একাধিক বই লিখেছেন। ঢাকায় হে উৎসব উপলক্ষে সম্প্রতি ঢাকা ঘুরে গেলেন ৭০ বছর বয়সী তারিক আলি। একটি উঁচু মাপের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এক পড়ন্ত বিকেলে তারিক আলির জন্য ‘হিস্টোরি অ্যান্ড ফিকশন’ (ইতিহাস ও কল্পকাহিনি) শিরোনামে একটি সেমিনার আয়োজন করেছিল। বেশ প্রশংসনীয় উদ্যোগ। হলভর্তি শ্রোতাদের উপচে পড়া ভিড়। ৭০ বছর বয়সেও তারিক আলির গলার জোর এবং বলার ভঙ্গি এতটুকু বদলায়নি। প্রায় এক ঘণ্টা দর্শক-শ্রোতাদের ধরে রেখেছিলেন। বললেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে তিনি অবাক হননি। কারণ, এটি অনিবার্য ছিল।
তাঁর মতে, সোভিয়েত রাষ্ট্রকাঠামো অতিমাত্রায় আমলাতান্ত্রিক হয়ে পড়েছিল। সামরিক বাহিনীর পেছনে তাদের বিশাল ব্যয় ছিল সম্পূর্ণভাবে অযৌক্তিক। এর ফলে একসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন আর্থিক সংকটে পড়লে তার পতন ত্বরান্বিত হলো। মানুষ ভুলভাবে মনে করল, সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একমাত্র বিকল্প মুক্তবাজার অর্থনীতি। তিনি আরও বললেন তার পরিণতি কী হতে পারে, এর জ্বলন্ত প্রমাণ গ্রিস, পর্তুগাল, স্পেন আর ইতালির চরম অর্থনৈতিক সংকট আর দেউলিয়া হওয়া। তাঁর মতে, ভেনেজুয়েলা, বলিভিয়া, কোস্টারিকা ও ব্রাজিলের একটা অংশ ২০০৭-০৮-এর বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা থেকে মুক্ত থাকতে পেরেছে। কারণ, তারা সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একটা সংমিশ্রণ ঘটাতে পেরেছে। এক রহস্যজনক কারণে তিনি কিউবা সম্পর্কে একটি বাক্যও উচ্চারণ করেননি।
একজন শ্রোতা তাঁর কাছে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে মতামত জানতে চাইলে তিনি নির্দ্বিধায় বললেন, বঙ্গবন্ধু বাকশাল কায়েম করে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত করেছিলেন। সুতরাং, এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড অবধারিত ছিল। তাঁর হয়তো এটি জানা নেই, বাকশাল ব্যবস্থাটি কখনো কার্যকর করার সুযোগ বঙ্গবন্ধু পাননি। আর বাকশাল ব্যবস্থাকে সময়ের প্রেক্ষাপটে বিচার করতে হবে। তিনি একবারও বললেন না বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে নিক্সন প্রশাসনের ভূমিকা অথবা সে সময়কার যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশে খাদ্য চালান নিয়ে নোংরা রাজনীতি, যার ফলে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ। তাঁর কথায় মনে হয়েছে, তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনাটি দুঃখজনকভাবে অত্যন্ত ক্ষুদ্র দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন। বাকশাল গঠনে বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকাকে তিনি সমালোচনা করে বলেন, এটি ছিল একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। তাঁর মতে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নেই।
তারিক আলি শ্রোতাদের জানালেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের কোনো ভবিষ্যৎ নেই এবং এর বারোটা বাজিয়েছে পিএলও আর হামাস। সময় থাকতে ফিলিস্তিন নেতাদের উচিত এক ইসরায়েল-ফিলিস্তিন রাষ্ট্র মেনে নেওয়া। একপর্যায়ে বললেন, ইউরোপের ইতিহাস বইয়ে ইউরোপীয় সভ্যতায় মুসলমানদের কোনো অবদানের কথা পড়ানো হয় না। সেখানে মুসলমানদের ইতিহাস এক প্যারাগ্রাফে সীমাবদ্ধ। 
দুঃখজনকভাবে তিনি একবারও বলেননি, পাকিস্তানে ইতিহাসই পড়ানো হয় না। বাংলাদেশ সম্পর্কে সেই দেশের সত্তর-পরবর্তী প্রজন্ম সম্পূর্ণ অজ্ঞ। তাঁর এসব বক্তব্য শ্রোতাদের হতাশ করেছে।
তারিক আলি সেদিন দু-একটি চরম সত্য কথা বলেছেন। তাঁর মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক সংকট, সেটি অনেকটা ১৯৪৭ সালের চেতনা বনাম ১৯৭১ সালের চেতনার লড়াই। ১৯৪৭ সালের চেতনা চরমভাবে ভুল ছিল। কারণ, শুধু ধর্মের ভিত্তিতে কোনো রাষ্ট্রের জন্ম হতে পারে না।
 বললেন, সৌদি আরব দুটি বস্তু বিশ্বকে উপহার দেয়। প্রথমটি তেল আর দ্বিতীয়টি ওয়াহাবি মতবাদনির্ভর জঙ্গিবাদ। খোদ সৌদি আরবে ওয়াহাবিদের সংখ্যা তেমন উল্লেখযোগ্য না হলেও এই মতবাদ তারা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে পেরেছে, যা বিশ্বকে অস্থিতিশীল করেছে। ইরাক, আফগানিস্তান অথবা ইয়েমেনে গণতন্ত্র রপ্তানি করতে যুক্তরাষ্ট্র বেশ উৎসাহী, কিন্তু সৌদি আরবের ব্যাপারে নিশ্চুপ। এ ক্ষেত্রে তাদের অভিমত, মুসলমানেরা গণতন্ত্রের জন্য প্রস্তুত নয়।
 তবে এই তারিক আলির সঙ্গে আমার দেখা এবং জানা তারিক আলির অনেক তফাত। মনে হলো, তিনি চরমভাবে বিভ্রান্ত। হয়তো বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চিন্তা-চেতনাও বদলে যায়। সবশেষে সেদিনের জন্য আয়োজকদের ধন্যবাদ দিতেই হয়।
আবদুল মান্নানসাবেক উপাচার্যচট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

সহকর্মী ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত তেহেলকা প্রকাশক-সম্পাদক তেজপাল :অভিযোগকারিণীর ভূমিকা রহস্যজনক

তেহেলকা সংবাদ পত্রের সম্পাদক তরুণ তেজপালের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করতে গেছে গোয়া পুলিশ।  তেজপাল পুলিশের তৎপরতাকে স্বাগত জানিয়ে অনুরোধ করেছেন সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে  এই অভিযোগের বাস্তবতা নিশ্চিত করতে।এ  ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংবাদ জগতে তোলপাড় চলছে।ধর্ষণ এবং যৌন নির্যাতনের অভিযোগ এনে  তার বিরুদ্ধে এফআইআর করেছে গোয়া পুলিশএফআইআর করার পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে  গণমাধ্যম জগতের আলোচিত এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৎপর গোয়া পুলিশ। তারা তেজপালের বিরুদ্ধে উপযুক্ত প্রমাণের সন্ধানও করছেন। গোয়ায় ওই পাঁচ তারা হোটেলটির সিসিটিভি ফুটেজ থেকে উক্ত ঘটনার সূত্র খুঁজছে পুলিশ। 
   অভিযোগ কারিণী মেইল করেছেন তেহেলকার ম্যানেজিং এডিটর সোমা চৌধুরীর কাছে। তিনি বলেছেন,৭ এবং ৮ নভেম্বরগোয়ায় তেহেলকার একটি অনুষ্ঠান চলাকালীন তেজপাল তার শ্লীলতাহানি করেছেন। এই ঘটনাটি প্রকাশ পেলে ঝড় ওঠে সংবাদ মহলে।তরুণ তেজপাল জানান তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগের কথা জানতে পেরে তিনি খুবই দুঃখিত, তিনি এরকম কিছু আশা করেননি। তাই শাস্তি স্বরূপ তিনি ছয় মাসের কর্মবিরতি নিচ্ছেন।  এ দিকে তেহেলকার ম্যানেজিং এডিটর সোমা চৌধুরী  রহস্যজনক ভাবে এই বিষয়ে আপত্তি করে বলেন-“তার বক্তব্যকে বিকৃত করে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই দাবি করে তিনি বলেন, তেজপালের সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ ভুল; তিনি ঘটনাটিকে অন্য ভাবে দেখছেন।" সোমা বলেন, তার এরকম কোন উদ্দেশ্য ছিল না এবং  তিনি ঠিক এমনটি বলতে চাননি। " তুমুল আলোচনায় এখন তেজপাল-সোমা   এবং ধর্ষণের অবিযোগকারিনীর  বক্তব্য!!
Tarun_Tejpal_20131024.jpg20050114006401801

 তেজপালের এই বক্তব্যকে ঘিরেও জল্পনার উৎপত্তি হয়। জাতীয় মহিলা কমিশন তেজপালের সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করে বলেন-“তিনি অভিযুক্ত তাই তার কিরূপ শাস্তি হওয়া উচিত তা তিনি নির্ধারণ করার কে? শুধুমাত্র দুঃখ প্রকাশ করলে চলবে না। তাকে উপযুক্ত শাস্তি পেতেই হবে।” 

তেহেলকার ম্যানেজিং ডাইরেক্টরও এই কথাতেই সুর মেলান। এমনকি ঘটনাটির পুলিশি তদন্তের দাবীতে সরব হন তহেলকার বহু সদস্য।  এডিটর গিল্ড অফ ইন্ডিয়াও ঘটনাটির উপযুক্ত তদন্তের দাবী করেছে। 
তরুণ তেজপাল যিনি সংবাদ জগতের একটি পরিচিত মুখ, তার বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থা এবং ধর্ষনের অভিযোগ ওঠায় দেশের রাজনৈতিক মহলেও এর প্রভাব পড়েছে।  তেহেলকার উপর  ক্ষুব্ধ  অনেকে তেজপালের শাস্তির দাবীতে সরব। বিজেপি এদের মধ্যে অন্যতম! দাবি উঠেছে  কংগ্রেস সমর্থক বলেই তেজপালের বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র হচ্ছে কিনা খতিয়ে দেখতে !!
 তবে এই ঘটনার  শেষ পরিণতি কি হবে তা পুলিশী  তদন্ত এবং সোমা চৌধুরীর ভূমিকা ই বলে দেবে।
- See more at: http://indiajournal.in/?p=7246#sthash.4ZC3Uk9a.dpuf

Thursday, November 21, 2013

বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রকৃত নায়ক ড. কিসিঞ্জার এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো




বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে নিজ হাতে হত্যা করেছিল মোহাম্মদী বেগ, তার অর্থ এই নয়, মোহাম্মদী বেগই সিরাজ হত্যার আসল ব্যক্তি। ঠিক তেমনি ডালিম, ফারুক, রশীদ, মেজর নূর বঙ্গবন্ধু হত্যা-নাটকের মূল চরিত্র নয়। সিরাজ হত্যার মূল পরিকল্পক ছিল ব্রিটিশ বেনিয়া শক্তির প্রতিনিধি লর্ড ক্লাইভ। বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল পরিকল্পক ছিল মার্কিন প্রতিনিধি তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কিসিঞ্জার এবং তার দোসর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো। এরা দুজনই বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে ১৯৭১ সালে পরাজিত হয়েছিলেন।মাহমুদুল বাসার চলছে শোকাবহ আগস্ট মাস। আর ১৫ আগস্ট, জাতীয় শোক দিবস। ১৯৭৫ সালের এই দিনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে, সপরিজনে হত্যা করা হয়। পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম হত্যাকা-ের অন্যতম একটি ১৫ আগস্টের হত্যাকা-। বাংলাদেশের একদল বিভ্রান্ত সেনাসদস্য এই হত্যা সংঘটিত করেছে। এরা ছিল ক্রীড়নক। দেশি-বিদেশি শক্তিশালী ষড়যন্ত্রকারী একটি চক্র এই হত্যার পেছনে ভূমিকা রেখেছে।
বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে নিজ হাতে হত্যা করেছিল মোহাম্মদী বেগ, তার অর্থ এই নয়, মোহাম্মদী বেগই সিরাজ হত্যার আসল ব্যক্তি। ঠিক তেমনি ডালিম, ফারুক, রশীদ, মেজর নূর বঙ্গবন্ধু হত্যা-নাটকের মূল চরিত্র নয়। সিরাজ হত্যার মূল পরিকল্পক ছিল ব্রিটিশ বেনিয়া শক্তির প্রতিনিধি লর্ড ক্লাইভ। বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল পরিকল্পক ছিল মার্কিন প্রতিনিধি তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কিসিঞ্জার এবং তার দোসর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো। এরা দুজনই বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে ১৯৭১ সালে পরাজিত হয়েছিলেন। 
খুব অপমানিত হয়েছিলেন এরা। একটা অপমানিত বোধ থেকে কিসিঞ্জার ও ভুট্টো বঙ্গবন্ধু হত্যার নীলনকশা প্রণয়ন করেন। বঙ্গবন্ধুকে বাঁকা নজরে দেখতেন খন্দকার মোশতাক এবং জিয়াউর রহমান। এর প্রমাণ ইতিহাসে আছে। দুজনই ছিলেন ক্ষমতালিপ্সুু, উচ্চাভিলাষী এবং ষড়যন্ত্রকারী, এর প্রমাণও ইতিহাসে আছে।
মোশতাক চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হতে, তারপর মুজিব নগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতারে নিজেকে অস্থায়ী সরকারের প্রধান বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। তুমুল প্রতিবাদের মুখে তা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এরপর কলকাতা গিয়ে তিনি ড. আনিসুজ্জামানের কাছে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অশ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন। ড. আনিসুজ্জামানের 'আমার একাত্তর' বইতে তা লেখা আছে। ১৯৭১ সালে খন্দকার মোশতাক পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন করার যে চক্রান্ত করেছিলেন, এর সঙ্গে জিয়াউর রহমানও জড়িত ছিলেন।
মোশতাক এবং জিয়া দু'জনই বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছেন। একজন রাজনৈতিক অঙ্গনে বসে, অন্যজন সেনাবাহিনীর পরিম-লে বসে। যতদিন বঙ্গবন্ধু ক্ষমতায় ছিলেন, ততদিন দু'জনই বঙ্গবন্ধুর কাছাকাছি থেকে নিখুঁত অভিনয় করেছেন। যাতে আঘাতটা ভেতর থেকে করতে পারেন।
ড. ওয়াজেদের বই পড়ে জানা যায় যে, মোশতাকের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর প্রবল তর্ক হয়েছে বাকশাল গঠন নিয়ে। তারপরও মোশতাক, তাজউদ্দীন, জেনারেল ওসমানী, ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেনের মতো মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেননি। জিয়া বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী তার 'ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা' গ্রন্থে বলেছেন, জিয়াউর রহমান ভবনে যেতেন। বঙ্গবন্ধুর সামনে জিয়াউর রহমান নতজানু হয়ে বঙ্গবন্ধুকে খোশামোদ করে কথা বলতেন। খামাখা অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলতেন, 'আগে আমার বুকে গুলি লাগবে, তারপর বঙ্গবন্ধুর বুকে লাগবে'। (অধ্যাপক আবু সাইয়িদ- বঙ্গন্ধু হত্যাকা- ফ্যাক্টস্ অ্যান্ড ডকুমেন্টস্)। অর্থাৎ জিয়া জানতেন বঙ্গবন্ধুর বুক টার্গেট করা হয়েছে।
১৯৭৫ সালের প্রথম দিকে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা জিয়ার সঙ্গে গোপনে দেখা করেন। তারা জিয়ার কাছে বঙ্গবন্ধু সরকার উৎখাতের প্রস্তাব করেন। জিয়া বলেন, 'আমি এ সবে থাকতে পারি না, তোমরা জুনিয়ররা এ সব করলে করতে পারো'। অর্থাৎ তোমরা এগিয়ে যাও; আমি আছি পেছনে।
বঙ্গবন্ধুর শিক্ষক, দার্শনিক ও অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান একটি বই লিখেছেন, নাম "শতাব্দীর স্মৃতি"। সেখানে স্মৃতিচারণায় সাইদুর রহমান বলেছেন যে, ১৯৭৪ সালে তার ভাইরার বাসায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তার দেখা হয়। জিয়া তার কাছে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সাংঘাতিক ক্ষোভ প্রকাশ করেন ও বিষোদগার করেন।
অথচ প্রজাতন্ত্রের সেবক হয়ে জাতির পিতার বিরুদ্ধে এবং সরকার প্রধানের বিরুদ্ধে এমন ক্রুদ্ধতা প্রকাশ করতে পারেন না। জিয়ার সৎ সাহস থাকলে তিনি চাকরি থেকে পদত্যাগ করে রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারতেন।
জিয়ার কুটিল চেহারা চেনার জন্য নিরন্তর গবেষণা করা উচিত। আমার বন্ধু সাংবাদিক স্বদেশ রায় একবার বলেছিলেন যে, তিনি 'মেজর জেনারেল গণতন্ত্র' নাম দিয়ে জিয়াউর রহমানের ওপর বই লিখবেন। লিখেছেন কিনা জানি না।
মেজর রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম প্রণীত 'লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে', সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্তের গ্রন্থের ভাষায় ইতিহাসের তিনি একজন খলনায়ক। তিনি বঙ্গবন্ধুর খুনিদের উস্কানি দিয়েছিলেন এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর সেনা অভ্যন্তরে ফারুক ও রশীদের ডিফেন্স দিয়েছিলেন। তখন সেনাবাহিনীর মধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যার মতো নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া গড়ে ওঠার বিপক্ষে তিনি জোরালো ভূমিকা রেখেছিলেন। এছাড়া জিয়া সেনাবাহিনীতে বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে লবিং করে ১৫ আগস্ট হত্যাকা-ের পরিবেশ তৈরি করে রেখেছিলেন।
জিয়া ও মোশতাক দুজনই মতলববাজ ও সম্প্রদায়িক। একটি সেক্যুলার রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তারা বঙ্গবন্ধুকে মেনে নিতে পারেননি। তাই দেখা গেল, জিয়া ১৫ আগস্ট সকালে নির্বিকারভাবে, উৎফুল্ল মনে সেভ করতে বসেছেন। খবর এলো রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি বললেন, সো হোয়াট। ওইদিন তিনি সেনাছাউনিতে গিয়ে খুনি ফারুককে বললেন, ঋধবঁয়ব পড়সব ঃড় সব ধহফ শরংং সব, ুড়ঁ যধাব ফড়হব ধ মৎবধঃ লড়ন, (বঙ্গবন্ধু হত্যাকা- ফ্যাক্টস অ্যান্ড ডকুমেন্টস)।
জিয়া ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে যে ঘোষণাটি পাঠ করেছিলেন তার পুরস্কার দিতে বঙ্গবন্ধু কার্পণ্য করেননি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতেন না। তাই তাকে সেনাবাহিনীর প্রধান না বানিয়ে জেনারেল সফিউল্লাহকে বানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু জিয়াকে তেমন আমল দিতেন না। একবার বলেছিলেন, আমাদের জিয়া বড় মুক্তিযোদ্ধা, কেবল আমার বিরুদ্ধে একটু আধটু ষড়যন্ত্র করে। অর্থাৎ জিয়ার চোখের ভাষা বঙ্গবন্ধু বুঝতেন, তাই গুরুত্ব দিতেন না। এই ক্ষোভ জিয়ার মনে সাপের বিষের মতো কাজ করেছিল।
বঙ্গবন্ধু গবেষক, লন্ডন প্রবাসী লেখক আবদুল মতিন বিজয় দিবসের পর ও বঙ্গবন্ধু বইতে দেখিয়েছেন, কেন জেনারেল ওসমানী জিয়াকে গুলি করে হত্যা করতে চেয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের হস্তক্ষেপে তার মীমাংসা হয়। আবদুল মতিন আরো জানিয়েছেন যে, জিয়া ভারতের কয়েকটি শরণার্থী শিবিরে ভারত সরকার এবং বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিয়েছেন।
ধূর্ত, চতুর, উচ্চাভিলাষী জিয়া জেনারেল সফিউল্লাহর দৌর্বল্যেরও সুযোগ নেন। '৭৫ পরবর্তী রাজনীতিতে তিনি হজরত মাবিয়া ও সম্রাট আওরঙ্গজেবের মতো দক্ষতার সঙ্গে ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট কাজে লাগান। কিছুদিন আগে বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ড. মুনতাসীর মামুন একটি কলামে বলেছেন, দেশে এখন ৫০ ভাগ পাকিস্তান সমর্থিত লোকজন আছে।
এই কৃতিত্ব জিয়াউর রহমানের। পাকিস্তান সমর্থিত লোকজন, আমলা-আর্মি ও এলিটদের নিয়ে তিনি দল গঠন করেছেন। তিনি যেভাবে ১৯৭১ সালের ম্যান্ডেট পরিবর্তন করেছেন তা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা না করে সম্ভব ছিল না। তার রাজত্বে ফারুক-রশীদরা ফ্রিডম পার্টি নাম দিয়ে দল গঠন করে কুড়াল মার্কা নিয়ে বন্দুক উঁচিয়ে রাজনীতি করেছে। এই আস্কারা জিয়াউর রহমান দিয়েছেন। এখনো তার স্ত্রী এবং তার দল যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থন করে যাচ্ছেন।
অনেকে বলেন, দুই নেত্রীর সমঝোতার দরকার। বেগম জিয়া যদি ১৫ আগস্টের মতো জাতীয় শোক দিবসে কাল্পনিক জন্মদিন পালন করেন তাহলে সমঝোতা হবে কেমন করে? এই আদর্শিক সংঘাত সহজে মিটবে বলে মনে হয় না। ১৯৭৮ সালে এক কলামে আবদুল গাফফার চৌধুরী বলেছিলেন, জিয়াউর রহমানই বঙ্গবন্ধু হত্যার পালের গোদা। গবেষকদের উচিত শুধু চোখের পানি না ফেলে এই পথে আরো গবেষণা করা।

মাহমুদুল বাসার: প্রাবন্ধিক, গবেষক

Wednesday, November 20, 2013

বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে সিএনএনঃ পরিকল্পনা আইএসআইয়ের, বাস্তবায়নে সা কা চৌধুরী


 image_70790 বিডিআর বিদ্রোহের সময় পিলখানা হত্যা মামলায় পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা-আইএসআই জড়িত বলে যুক্তরাষ্ট্রের টেলিভিশন সিএনএনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক খবরে দাবি করা হয়েছে। 
ভারত সরকারের সচিবালয় সাউথ ব্লকের বরাত দিয়ে এই তথ্য প্রকাশ করেছে সিএনএন।
২৯ অক্টোবর প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই বিদ্রোহের মূল পরিকল্পনায় ছিল শেখ হাসিনা এবং সে সময়ের সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদকে হত্যা। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিদ্রোহ হলেও তা করার পরিকল্পনা ছিল আগের দিন। সেদিন শেখ হাসিনা এবং মইন ইউ আহমেদ বিডিআর দরবার হলে গেলেও ষড়যন্ত্রকারীরা অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিতে পারেনি।
আইএসআই শেখ হাসিনার মধ্যপন্থী মতাদর্শিক অবস্থানের কারণে শঙ্কিত হয়েই এই পরিকল্পনার আদেশ দেয় বলেও প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘রক্তক্ষয়ী এই ষড়যন্ত্রের খেসারত ঢাকাকে বেশ ভালোভাবেই দিতে হয়েছে। অন্যদিকে  তৎকালীন মাত্র দুই মাস মেয়াদ অতিক্রান্ত  শেখ হাসিনার সরকারের স্থিতিশীলতার জন্য যা ছিল এক বিশাল চ্যালেঞ্জ।
পিলখানা হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশ রাইফেলসের (বিডিআর)  উচ্চপদস্থ ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭০ জন নিহত হন । ২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআরের একদল সদস্য তাদের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের লাইন করে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। হত্যাকাণ্ডটি এতই বর্বর ছিল যে, শুধু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদেরই নয় তাদের পরিবারের সদস্যদেরও হত্যা করে ম্যানহোলের মধ্যে স্তুপ করে রাখা হয়েছিল। এর বাইরে গণকবরও দেয়া হয়েছিল অনকে লাশ।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী জড়িত: বিডিআর বিদ্রোহের পরিকল্পনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী জড়িত ছিলেন বলেও সিএনএনের প্রতিবেদনে জানানো হয়। এতে বলা হয়, ‘ভারত এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থার কাছে এই ঘটনায় প্রভাবশালী বিএনপি নেতা এবং আইএসআইয়ের চর সালাইদ্দিন কাদের চৌধুরীর জড়িত থাকার প্রমাণ আছে’। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই বিএনপি নেতাকে প্রতিবেদনে এই অঞ্চলের অপরাধ জগতের সাথে ওতপ্রতোভাবে জড়িত।
বাংলাদেশে সালাউদ্দিন চৌধুরী একজন  বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠ সহযোগিদের মধ্যে একজন বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। ২০০৪ সালে চট্টগ্রামে দশট্রাক অস্ত্র চোরাচালান ঘটনার সঙ্গেও তিনি জড়িত বলে অভিযোগ আছে। যদিও তিনি এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ভারতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানোর উদ্দেশ্যে অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র চোরাচালান হচ্ছিল বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিডিআরের সদস্যদের মধ্যে নানা বিষয়ে ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে পিলখানা হত্যা ঘটানো হয়। এর পাশাপাশি সেনাবাহিনীতেও পাকিস্তানপন্থী কর্মকর্তারা অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেছিলেন। এই পরিকল্পনা এতটাই সূচারু ছিল যে, কোনো গোয়েন্দা সংস্থা তা ধরতে পারেননি। এই ঘটনায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বিডিআরের সাবেক মহাপরিচালক ফজলুর রহমানকেও ব্যবহার করেন।
ফজলুর রহমানকে সালাইদ্দিন কাদের চৌধুরী ৪০ কোটি টাকা দেন বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। আর ফজলুর রহমান সে সময় বিডিআরের চারজন উপসহকারী পরিচালককে পাঁচ কোটি কারা করে দেন। আর চারশজন সিপাইকে দেয়া হয় পাঁচ লাখ টাকা করে। কেউ কেউ ৫০ লাখ টাকা করে পেয়েছেন বলেও গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘটনা চলাকালে বাংলাদেশকে নিয়ে ভারত সরকারে উদ্বেগ বাড়তে থাকে। ২৮ ফেব্রুয়ারি ভারত শেখ হাসিনাকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার প্রস্তুতিও নেয়। ভারতের সে সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী (বর্তমান রাষ্ট্রপতি) প্রণব মুখার্জি শেখ হাসিনার সাথে যোগাযোগ রেখেছেন।
পাকিস্তানি চরের ফোনে আঁড়ি পেতে তথ্য উদ্ধার: সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকায় পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা সাজ্জাদ রসুলের সাথে টেলিফোন কলে আঁড়ি পেতে তার সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছে গোয়েন্দারা। এই কর্মকর্তার সাথে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর যোগাযোগ ছিল।
গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, ওই পাকিস্তানি কর্মকর্তা ঢাকার গুলশান এলাকা থেকে গোটা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং পাকিস্তানকে সব জানিয়েছেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি বেলা সাড়ে ১২টায় সাজ্জাদ রসুল আইএসআইয়ের সদরদপ্তরে ফোন করে সে সময় বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদকে হত্যার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যখন বাংলাদেশ সরকার এবং সেনা কর্মকর্তা কিছুই জানতে পারেননি, তখন পাকিস্তানী প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা কীভাবে ভেতরের সব ঘটনাপ্রবাহ জানলেন, তা একটি বড় প্রশ্ন’। ওই সময় জামায়াতে ইসলামীর বেশ কজন শীর্ষস্থানীয় নেতাও ফোনে দুবাই, লন্ডন এবং ইসলামাবাদে আইএসআইয়ের চরদের সাথে ঘটনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলের তুলনায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার মধ্যপন্থী। ধর্মীয় উগ্রবাদ এবং জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার অবস্থান কঠোর। এই সরকার টিকে থাকলে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এ দেশীয় দোসরদের বিচারের ভয়ও পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের মধ্যে ছিল। গোটা বিদ্রোহে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আসামি জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদও নানা সহযোগিতা করেছেন বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত নীতি এবং অন্যান্য অবস্থানের কারণে শেখ হাসিনা সরকারকে নিয়ে পাকিস্তান উদ্বিগ্ন ছিল। এ জন্যই পথের কাটা দূর করার চেষ্টা করেছে আইএসআই।

একুশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি র উদ্যোক্তা রফিকুল ইসলামের প্রয়াণে বিনম্র শ্রদ্ধা - সুমি খান

আজ সকালে ভ্যানকুয়েভারের একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন বাংলা কে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে
 প্রতিষ্ঠার  প্রথম উদ্যোক্তা 
কানাডাপ্রবাসী রফিকুল ইসলাম!!
 তার প্রয়াণে আমাদের গভীর শোক এবং  বিনম্র শ্রদ্ধা

                                     স্বরব্যঞ্জন পদকের স্বীকৃতি পেলেন  অন্তিম শয্যায়  

একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রথম দাবি ওঠে ১৯৯৭ সালে, ভাষাশহীদ আবদুল জব্বারের জন্মস্থান ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলায়। স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন গফরগাঁও থিয়েটার ওই দাবির পক্ষে শোভাযাত্রা করে দেয়াল ও বাস-ট্রেনে পোস্টার সেঁটে দেয়। দুই বছর পর তাদের একুশের সংকলনেও স্লোগান ছাপে-বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস চাই! একুশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাই!' 
১৯৯৮ সালের ৯ জানুয়ারি কানাডাপ্রবাসী  মুক্তিযোদ্ধা  রফিকুল ইসলাম জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানকে একটি চিঠি লেখেন। চিঠিতে ১৯৫২ সালে ভাষাশহীদদের অবদানের কথা উল্লেখ করে একুশে ফেব্রুয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব করেন।
 সে সময় জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত হাসান ফেরদৌসের নজরে আসে চিঠিটি। তিনি ১৯৯৮ সালের ২০ জানুয়ারি রফিককে অনুরোধ করেন জাতিসংঘের অন্য কোনো সদস্য রাষ্ট্রের কারো কাছ থেকে একই ধরনের প্রস্তাব আনার ব্যবস্থা করতে। এরপর আরেক কানাডাপ্রবাসী আবদুস সালামকে সঙ্গে নিলেন রফিক। তাঁরা 'অ্যা গ্রুপ অব মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ অব দ্য ওয়ার্ল্ভ্র' নামে একটি সংগঠন দাঁড় করান। 
১৯৯৮ সালের ২৯ মার্চ কফি আনানকে এ সংগঠনের পক্ষ থেকে লেখা একটি চিঠিতে প্রস্তাব করেন, যার উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে, �The Bengali have played a very important role in protecting their Mother Language from serious crisis related to its existence. In today's world there are many nations and/or communities still facing serious crisis and threat against their Mother Languages.�
প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেন সাতটি ভাষার ১০ জন প্রতিনিধি। তাঁরা হলেন অ্যালবার্ট ভিনজন ও কারমেন ক্রিস্টোবাল (ফিলিপিনো), জ্যাসন মোরিন ও সুসান হজিন্স (ইংরেজ), ড. কেলভিন চাও (ক্যান্টনিজ), নাজনীন ইসলাম (কাচ্চি), রেনাটে মার্টিনস (জার্মান), করুণা জোসি (হিন্দি) এবং রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম (বাংলা)।
 এর জবাবে জাতিসংঘ জানায়, এসব সাংস্কৃতিক বিষয় দেখভাল করে ইউনেসকো। সুতরাং দাবিটা ওখানে পাঠাতে হবে। ১৯৯৯ সালের মাঝামাঝি সময় হাসান ফেরদৌস রফিক ও সালামকে উপদেশ দেন ইউনেসকোর ভাষা বিভাগের জোসেফ পডের সঙ্গে দেখা করতে। জোসেফের সঙ্গে দেখা করার পর তিনি বলেন, ইউনেসকোর আনা মারিয়ার সঙ্গে দেখা করতে। এই আনা মারিয়া নামের ভদ্রমহিলা রফিক-সালামের কথা মন দিয়ে শুনে বলেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের চিন্তাটা বেশ যুক্তিযুক্ত, তবে কোনো সংগঠনের দাবি তারা আমলে আনতে পারেন না। জাতিসংঘের কোনো সদস্য রাষ্ট্র প্রস্তাব পাঠালে তবেই একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়া যেতে পারে।
এবার রফিকুল ইসলাম চিঠি লিখলেন আমাদের দেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রণালয় ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝে তাড়াতাড়ি একটি প্রস্তাব বানিয়ে পাঠিয়ে দিল প্রধানমন্ত্রীর কাছে। তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শিক্ষামন্ত্রী এ এস এইচ কে সাদেক দ্রুত পদক্ষেপ নিলেন। শিক্ষাসচিব কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ, অধ্যাপক কফিলউদ্দিন আহমেদ, মসিউর রহমান (প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের তৎকালীন পরিচালক), সৈয়দ মোজাম্মেল আলী (ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত), ইকতিয়ার চৌধুরী (কাউন্সেলর), তোজাম্মেল হকসহ (ইউনেসকোর সেক্রেটারি জেনারেলের শীর্ষস্থানীয় উপদেষ্টা) অন্য অনেকেই এতে জড়িত হন। তাঁরা দিনরাত পরিশ্রম করে আরো ২৯টি দেশকে প্রস্তাবটির পক্ষে নিয়ে আসেন। অন্য বাংলাদেশি ও প্রবাসীদের কাছে ব্যাপারটা অগোচরেই ছিল। কয়েকজন ছাড়া কেউ টের পেল না, বাংলা ভাষাকে গৌরবান্বিত করতে পর্দার অন্তরালে কী ধুন্ধুমার কাজ চলছে।
১৯৯৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ইউনেসকোর কাছে প্রস্তাব উত্থাপনের শেষ দিন। তখনো প্রস্তাব এসে পৌঁছায়নি। শেষ পর্যন্ত কি স্বপ্নটি অধরাই থেকে যাবে? রফিক-সালাম তখন নাওয়া-খাওয়া ভুলে গেছেন। টেলিফোনের সামনে বসে আছেন, কখনো চোখ রাখছেন ই-মেইলে। কই, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তো কোনো সাড়াই আসছে না! আসলে লিখিত প্রস্তাবটিতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর সইটাই বাকি ছিল। আর প্রধানমন্ত্রী তখন পার্লামেন্টে। ওদিকে পার্লামেন্টের সময়সূচির পর ইউনেসকোতে প্রস্তাব উত্থাপনের সময়সীমা পার হয়ে যাবে। সব পরিশ্রম বোধ হয় জলেই গেল! প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে অনুরোধ করা হলো, তিনি যেন দ্রুত প্রস্তাবটিতে সই করেন। এরপর ফ্যাক্স করতে হবে ইউনেসকোর দপ্তরে। না হলে শেষরক্ষা আর হবে না। সময়সীমা শেষ হওয়ার মাত্র এক ঘণ্টা আগে ফ্যাক্সবার্তা পৌঁছাল ইউনেসকোর অফিসে। আহ্, শান্তি! প্যারিসে, ইউনেসকোর সদর দপ্তরে ১৬ নভেম্বর বসল ৩০তম সম্মেলন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে বহুল প্রত্যাশিত প্রস্তাবটি সেখানে উত্থাপিত হলো না। রফিক-সালামরা আরো একটি হতাশ দিন পার করলেন। দেখা যাক, পরদিন কী হয়!
১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ সভার শুরুতেই প্রস্তাবটি উত্থাপন করল বাংলাদেশ ও সৌদি আরব। অন্য ২৫টি দেশের সদস্যরা সেটিকে অনুমোদন করেন। এমনকি ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষার মূলোৎপাটনের ষড়যন্ত্রে যারা লিপ্ত হয়েছিল, সেই পাকিস্তানও একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সমর্থন জানায়। 
২০০০ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো পালিত হলো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ইউনেসকোর পর জাতিসংঘও একুশে ফেব্রুয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০০৮ সালের ৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে এই স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এখন কিন্তু দিনটি আর শুধু আমাদের নয়, সমগ্র বিশ্বের। বিশ্বের সব জাতির মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার দিন- আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ইংরেজ-ফরাসি-চাকমা-সাঁওতাল- সবাই যাতে তাদের মাতৃভাষায় কথা বলতে পারে, গর্ব করতে পারে, সে লক্ষ্যেই জাতিসংঘ এ দিবসটি করেছে। পাশাপাশি সবাই জানতে পারবে- এই দিনেই বীর বাঙালিরা প্রাণ দিয়ে দাম দিয়েছিল মাতৃভাষার।
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি !
সকল ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা  এবং ভালবাসা ! দুঃখ হয় , তার জীবদ্দশায় রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেন না। এর চেয়ে হতাশার আর কী আছে!! সবশেষে বাংলাদেশ সরকার এবং সুধী সমাজের কাছে প্রত্যাশা তারা যেন  বাংলার বীর সন্তান কৃতি সন্তান  রফিকুল ইসলাম এর অবদানের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেন!!

 মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের রূপকার রফিকুল ইসলামের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে শোকবার্তা দিয়েছেন। বার্তায় প্রধানমন্ত্রী একালের ভাষাবীর রফিকুল ইসলামের অসীম অবদানের কথা উল্লেখ করে বলেন, মাতৃভাষার জন্য এক রফিক রক্ত দিলেন, আরেক রফিক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এনে দিলেন। যা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত। মাননীয় প্রধান তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। এ দিকে, বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁকে জাতীয় পতাকায় রাষ্ট্রীয় ভাবে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য অটোয়াস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে একজন প্রতিনিধি ভ্যাঙ্কুভারে গেছেন।