Saturday, November 30, 2013

মৃত্যুর মিছিলের শব যাত্রীরা মহিমান্বিত ক্ষমতার ভাগাভাগিতে! : জান্নাতুল বাকেয়া কেকা

মৃত্যুর মিছিলে প্রতিদিনই যোগ হচ্ছে নতুন নতুন নাম। আনোয়ারা বেগম, মোজাম্মেল, মনির অথবা পল্টুরা। সরকার ও বিরোধী রাজনীতির পালে জোর হাওয়া দিচ্ছে শব মিছিলের এই যাত্রীরা। ক্ষমতাসীনরা বুক ফুলিয়ে বলতে পারছে, মানুষ মারা আর হত্যার রাজনীতি করছে বিরোধী দল। আর বিরোধী দল ভাবছে, আগুনে-পেট্রোলে জ্বলে পুড়ে ছাড়খার হওয়া যন্ত্রণা শেষে জীবন থেকে প্রাণ যাওয়া শব গুলো সরকারের বিরুদ্ধে তাদের হরতাল-অবরোধের রাজনীতির জলন্ত সাফল্য ! কারণ ? গরিব-খেটে খাওয়া-অসহায় মানুষ গুলো যে প্রাণ দিয়ে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের জয়োগান গাইছে ! তাই তো রাজনীতিকে আরো সহিংস করছে ক্ষমতালোভী আর ক্ষমতাভোগীরা। চলন্ত লেগুনায়-সিএনজিতে পেট্রোল ঢেলেই ক্ষান্ত হচ্ছে না ১৯-২০ বছর বয়সী যে ছেলেটি বাঁচার তাগিদে পালিয়ে বাঁচতে চাইছে তাকে জোর করে গাড়ীতে আটকে জ্বালিয়ে দিচ্ছে। হায় ! মোজাম্মেল হায় ! তুমি মরলে তবে জানলে না তোমার মৃত্যু ক্ষমতাভোগী আর ক্ষমতালোভীদের সাফল্যেরও ভাগাভাগিতে কতটা দামী ? হায় ! তুমি জানলে না মোজাম্মেল ? আর তোমার অন্ধ মা যে তোমার প্রতিক্ষায় ? তুমি যে ছিলে সেই অন্ধের যষ্টি এক মাত্র অবলম্বন !
আর সিএনজি চালক সাবেত আলী- তুমিও মৃত্যুর লাইনে দাঁড়িয়ে, অপেক্ষায়, সরকার আর বিরোধীদের সাফল্যের ভাগিদার হবার। তোমার পাঁচ আর নয় বছরের ছেলে দুটি আব্বা কখন ফিরবে সেই প্রতীক্ষায় ? তুমি তো জানো না সাবেত আলী কার আহ্বানে সাড়া দিয়ে তোমার প্রতীক্ষার অবসান ঘটাবে ? তা তুমি জানবেও না সাবেত আলী। তুমি হাসপাতালের বিছানায় চিৎকার করো। যন্ত্রনায় গোঙ্গাতে থাকো। যন্ত্রনাময় গোঙ্গানীর স্বরে আধো আধো স্বরে বলতে থাকো ‘জ্বলে, জ্বলে, জ্বলে-জ্বলে যায় ডাক্তার ডাকো। আর তোমার চিকিৎসার খরচ যোগাতে গিয়ে দেয়ালে মাথা খুটে রক্তারক্তি কান্ড ঘটায় তোমার প্রিয়তম স্ত্রী। যেমনটি দুর্বৃত্তরা যেদিন তোমার শরীরে আগুনে জ্বালিয়ে দগ্ধ করেছিলো আর সেই খবরে মাটিতে গড়িয়ে কেঁদে-কেটে এলাহি কান্ড করেছিলো তোমার ঘরের লোক। মানুষ জমিয়ে কারো বা সহানুভুতি পেয়েছিলে। আর কেউ কেউ মজাও লুটেছিলো। কারণ ? কান্নার দাপটে বেদিশা সেই বেটি লোকের বুকের কাপড় সরে বেরিয়ে পড়েছিলো তুল তুলে নরম বুকের এক পাশ। সাবেত আালী একসময় কেউ একজন তোমার প্রিয়তম সেই স্ত্রীর হাতে ক’টাকা গুজে তোমার শুন্য স্থান পুরণের চেষ্টা চালাবে। প্রিয় সেই শরীরে ভাগ বসাবে। তাতে কি দোষের কিছু হবে কি সাবেত আলী ? না তুমি জানবে না সাবেত আলী। তোমার চিকিৎসা ব্যয়, অভুক্ত সন্তানের মুখ চেয়ে তোমার প্রিয়তম যদি কারো গুজে দেয়া ক’টাকার জন্য তার শরীরটি বিকিয়ে দেয় তাহলে তুমি কি কষ্ট পাবে সাবেত আলী ? একমাত্র উপার্জনকারী সাবেত তুমিই যে এখন উল্টো বোঝা হয়ে অভুক্ত রেখেছো মা স্ত্রী আর দুই সন্তানকে। বাঁচার জন্য আলোয়ারা যদি শরীর বেচেঁ-কিডনী বেঁচে শরীরের রক্ত বেঁচে তাতে কার কি এসে যায় সাবেত আলী ?
পিকেটারদের দেয়া আগুনে পুড়ে যাওয়া মানুষ(ফােইল ছবি)
পিকেটারদের দেয়া আগুনে পুড়ে যাওয়া মানুষ(ফােইল ছবি)
কুমিল্লার মতলবের সিএনজি চালক রুবেল হোসেন। তোমার স্ত্রী দারুণ‘ অসহায় অবস্থা তার বেচারি ঢাকা শহরের রং তামাসা কোখনোই দেখেনি। জীবনে প্রথম ঢাকায় আসা তাও আগুনে ঝলসে যাওয়া স্বামীর দেখভালের প্রযোজনে। খবর পেয়ে এক কাপড়ে। সম্বল এক হাজার টাকা। তাও প্রতিবেশীর কাছে ধার করে আনা, সেই টাকাও ফুরিয়েছে। স্বজন বলতেও কেউ নেই। নাবালক তিন বাচ্চাকে রেখে এসেছেন ঘরের পাহারায়। মতলবের সেই ছোট সংসারের পাহারায় থাকা বাবা-মা ছাড়া সেই বাচ্চারা আজ কদিন ধরেই অভুক্ত। মা হাসপাতালে বাবার শয্যা পাশে। শুন্য হাতে স্বামীর শিয়রে বসে অভুক্ত বাচ্চাদের মুখ মনে করে সকাল-সন্ধা নিয়ম করে চোখের জল ফেলছেন  স্নেহময়ী সেই মা সাজেদা। আর ভাবছে ক্লাস ফাইভে পড়া ছেলেটা বরাবরই ভালো রেজাল্ট করেছে। এখন চলছে প্রাথমিক সমাপনি পরীক্ষা। পরীক্ষার্থী যে ছেলেটি আজ কদিন ধরেই অভুক্ত। এই কদিন একবারও পড়া বা পরীক্ষার কথা মুখেই আনেনি। বাবা যে হাসপাতালের মৃত্যু শয্যায়। কদিন বাদেই পরীক্ষা না দিয়ে পথে নামবে পেটের দায়। হায় ? আরেকটি শিশু ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়ে একটি সনদ অর্জনের পথে গিয়েও ঝরে গেল ! তাতে কি রুবেল হোসেন তুমি তো জানো না রাজনীতির মাঠের গোলে তোমার অবদান লেখা রবে রাজনীতির ভাগাভাগিতে, তুমি হয়তো তোমার জীবন দিয়ে দলাদলির-ভাগাভাগির সাফল্যে মহিমান্বিত্ব হবে। আর সেই মহিমাময় অবদানের ভাগিদার হয়ে তোমার সন্তানেরা প্রাথমিক সমাপনির বাকী পরীক্ষাটা নাই বা দিলো ? আর কদিনই বা মা-বাবার পথ চেয়ে অভুক্ত হয়ে মায়ের গোছানো সংসার জোগাবে ? নাকি কদিন বাদেই পথে নামবে পেটের দায়। আর্তনাদে ক্ষুধায়-যন্ত্রনায় তোমার সন্তান না হয়ে নতুন ডেরার সন্ধান করবে খুঁজবে খাদ্য আর আশ্রয়। অভিবাসিত হবে। ছুটে আসতে পারে আলোক সজ্জার এই রাজধানীতেও। শিশু অধিকার আইনকে বৃদ্ধাঙ্গলী দেখিয়ে বাসে-লেগুনায় হেলপারের কাজে লাগতে পারে। বনে যেতে পারে চোর-বাটপার বা পকেট মারও। তাতে কি রুবেল হোসেন ? কে তোমায় দিব্বি দিয়েছে তোমার সন্তানদের লেখাপড়া শিখে মানুষ হতেই হবে ? পেতে হবে খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান আর শিক্ষার অধীকার ? ক্ষমতাসীন আর ক্ষমতালোভীরা আছেন না যাদের সন্তানেরা, বাবার অঢেল অর্থে জন্মের পর মুখে সোনার চামচ নিয়ে জন্মেছে। এখন রানী এলিজাবেথের মতো অবকাশকালীন উদযাপনের মতো লন্ডন-ইতালী-আমেরিকা-ইউরোপে কোথাও নিরাপদে বিত্ত-বৈভব্যের মধ্যে আয়েশী-বিলাসে জীবন ধারণ করছে। চলছে বিদ্যা অর্জনও। সময় মতো এদেশের মুক্ত বাতাসে, প্রজেক্ট পরিচালক হয়ে বা উচ্চ পদে আসীন হয়ে দেশে ফিরলেও ফিরতে পারেন। আর না ফিরলে বা কি ? উত্তরাধিকারীর সূত্রেই তাদের বাপ-দাদার সম্পত্তিসম এই দেশটির নির্যাস তো রূপে রুসে ভোগ করছে তারাই।
সাতেব আলীরা দেখে নিও এই সোনার বাংলার চুঁইয়ে পড়া সোনা ফলন নির্যাসে একদিন উদর পূর্তি করবে তোমার সন্তানেরাও। দু:খ করো না রুবেল হোসেন, দুদু মিয়ারা মোজাম্মেল-আনোয়ারা-আর পলটুদের মতো..অগ্নিদগ্ধ হও…যন্ত্রণা সহো ..প্রাণ দাও একদিন সব পাবে । সব । শুধু পাবে না খুব প্রিয় প্রাণ ভোমরাটা।
জান্নাতুল বাকেয়া কেকা
সিনিয়র রিপোর্টার, চ্যানেল আই ঢাকা।

No comments:

Post a Comment