Tuesday, July 2, 2013

একজন নারী সাংবাদিক- সুমি খান



চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন আশৈশব আমার আদর্শ। মনে পড়ে, সেই কিশোরীবেলা থেকেই দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত মোনাজাতউদ্দিনের রিপোর্ট নিয়ে বাবা-মায়ের উচ্ছ্বসিত মন্তব্য শুনতাম। আর মনে মনে ভাবতাম, একদিন আমিও এরকম করে রিপোর্ট করবো, দেশের প্রত্যন্ত জনপদের মানুষের সুখ-দু:খের কথা তুলে ধরবো পত্রিকার পাতায়। তখনো বুঝিনি, আমি এই সমাজের কাছে প্রথমত: ‘মেয়েমানুষ’ - মোনাজাতউদ্দিনের মতো চারণ সাংবাদিক হবার বাস্তবতা আমার নেই।
১৯৮৫ সাল থেকে শুরু করলাম লেখালেখি। ।চট্টগ্রামের স্থানীয় দৈনিক আজাদী, পূর্বকোণে লিখলাম নারী অধিকার, মানবাধিকার, কালো মানুষের অধিকার নিয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকার কালো মানুষের বিপ্লবের গণজাগরণের কবি বেঞ্জামিন মলয়ঁসে কে ১৯৮৫ সালে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়। সেসময়ে স্কুলে পড়ি। মন থেকে মেনে নিতে পারলাম না বিপ্লবের কবি মলয়ঁসের ফাঁসির আদেশ।লিখলাম , “বেঞ্জামিন মলয়ঁসে: মৃত্যুহীন প্রাণ”।
এর আগে রাজধানীতে সোগেরা মোর্শেদ নামে একজনকে সম্ভবত: হত্যা করা হয়েছিলো, এর প্রতিবাদে একটি লিখা দিয়েছিলাম। বলা প্রয়োজন,এই লেখাটি আমাকে লিখে দিয়েছিলেন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম মহানগর শাখার তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আলেক্স আলীম। চিন্তাশীল অনুভূতিকে কাজে লাগানোর এর চেয়ে মোক্ষম উপায় আর কী হতে পারে!
যাই হোক্ দৈনিক পূর্বকোণের জুবলী রোড সিগনেট প্রেস অফিসে গিয়ে এক নারী সহসম্পাদক ‌এর হাতে দিয়ে এলাম লেখাটি। তিনি লিখাটি চিঠিপত্র কলামে ছেপে দিলেন। আমার মতো এক কিশোরীর আবেগঘন প্রতিবাদী লেখাটি কলাম হিসেবে ছাপার যোগ্য মনে করেন নি হয়তো। মনে কিছুটা কষ্ট পেলাম।পূর্বকোণে আর লেখা দিলাম না; আজাদীতে লিখতে থাকলাম। বেঞ্জামিন মলয়ঁসে , ফরাসী বিপ্লবে নারীর অবদান, শ্রমজীবি নারীর শ্রমের অধিকার নিয়ে লিখতে থাকি। একসময়ে দৈনিক পূর্বকোণে লিখতে শুরু করি সাংবাদিক আবুল মোমেনের হাতে লিখা দিয়ে আসতাম।
১৯৯৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক আমার ভাশুরের প্রোমোশান উপলক্ষে বাড়িতে নেমন্তন্ন রক্ষা করতে এলেন অনেকে। তাদের মধ্যে দৈনিক ভোরের কাগজের তৎকালীন চট্টগ্রাম ব্যুরোচীফ আবুল মোমেন অন্যতম। তাকে বললাম, “ মোমেন ভাই, জে এম সেন এর মতো দেশনেতার নামে চট্টগ্রামের একমাত্র এভেনিউ জানতে পারলাম বাবার কাছে। আমি বাবাকে সাথে নিয়ে দেখেছি, দু’য়েকটি হিন্দু মালিকানাধীন দোকান ছাড়া অধিকাংশ দোকানের সাইনবোর্ডেই তার এই নামটি লিখা নেই। এভাবে জে এম সেনের কর্ম, নাম হারিয়ে যাচ্ছে। আমি কি একটা রিপোর্ট করতে পারি , যদি অনুমতি দেন?” আবুল মোমেন তার স্বভাবসুলভ স্মিত হেসে বললেন. “করো”।
তার কাছে কৃতজ্ঞ আমি তিনি আমার রিপোর্টিং এর সুযোগ করে দিয়েছিলেন সেদিন।
আমার অসাধারণ উদ্যমী আর সাহসী বাবা সাইফুদ্দিন খান আমাকে নিয়ে প্রতিটা দোকান মালিক এবং কর্মচারীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। শেখালেন মানুষের সাথে মিশে কী করে তথ্য সংগ্রহ করতে হয়। কোতোয়ালী, লালদীঘি , আন্দরকিল্লা এসব জায়গা বাবার শৈশব, কৈশোর, ভাষা আন্দোলন , শ্রমিক আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি মিছিলের পায়ে পায়ে চেনা। চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থেকে আন্দরকিল্লা পর্যন্ত প্রতিটি দোকানে কথা বললাম। এই এলাকার একমাত্র পেট্রোলপাম্প এর মুসলমান মালিক ( নামটি মনে করতে পারছিনা, তিনি বেঁচে নেই) বললেন এদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অংশ হিসেবে কী করে ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবের অন্যতম সেনানী ব্যারিষ্টার যাত্রা মোহন সেন -জে এম সেনের নাম মুছে ফেলার গভীর ষড়যন্ত্র থেকে সাইনবোর্ডে তার নাম লিখা হয় না। অথচ চট্টগ্রামে তখন পর্যন্ত সেটাই একমাত্র এভেনিউ ছিল। যাই হোক্ জে এম সেনের ইতিহাস এবং জে এম সেন এভেনিউর ইতিহাস তুলে ধরলাম। একটি জাতীয় দৈনিক ভোরের কাগজের চলমান চট্টগ্রামে ১৯৯৩ সালের সম্ভবত: জুন মাসে প্রকাশিত হলো লেখাটি। এর পর নারী বানিজ্যব্যক্তিত্ব, শহীদ পরিবার সহ নানান বিষয় নিয়ে অব্যাহত থাকলো লিখালিখি। বিশ্বজিৎ চৌধুরী বিল করতেন একটা লেখাতে ১০০ টাকা । এসব নিয়ে কোন কথা বলা আমার স্বভাব বিরুদ্ধ। তাই রিপোর্টিং অব্যাহত রাখলাম। বসে থাকতাম রিপোর্টিং য়ের প্ল্যান আর আইডিয়া পাওয়ার জন্যে। না, সে আশার গুঁড়ে বালি। নিজেই ভাবতে থাকি কী করা যায়!
বাবার কাছে শুনেছি ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬২ সাল বাবার প্রথম কারাজীবন কেটেছে দেশের বিভিন্ন কারাগারে। এর পর আরো অনেকবার বাবা গ্রেফতার হয়েছেন। এখনো পংকজ ভট্টাচার্যের লেখায় তার কিছুটা পাওয়া যায়। কারাগার থেকেই বাবা বি.কম পাশ করেছেন।দেশের শীর্ষ অনেক রাজনীতিকের মতো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সাথে ও তার কারাগারে দেখা হয়েছে বলে শুনেছি। রাজবন্দী হিসেবে তারা বেশ সম্মানিত এবং প্রভাবশালী ছিলেন বলেই মনে হতো বাবার প্রাণোচ্ছ্বল গল্পে। তাই কারাগার নিয়ে আমার আলাদা আগ্রহ ছিল।
একদিন বললাম , কারাগার নিয়ে আমি একটা রিপোর্ট করতে চাই। বিশ্বজিৎ চৌধুরী সাথে সাথে বলে উঠলেন, “ কারাগারে আপনাকে ঢুকতে দেবে কেন? রিপোর্ট করতে চাইলেই তো আর করতে দেবে না”।
সামান্য একজন কন্ট্রিবিউটর হয়ে ও কোথা থেকে মনের জোর পেলাম জানি না। জবাবে কিছুটা দৃঢ়তার সাথে বললাম, “আমি করে আনতে পারবো”।
গেলাম চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে। জেল সুপারের রুমের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম বন্দীরা কুয়া থেকে পানি নিয়ে গোসল করছে , হেঁটে বেড়াচ্ছে। বাবার কাছে নাশতার টেবিলে বা খাওয়ার টেবিলে শোনা গল্পগুলো মনে পড়লো।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার এবং জেল সুপার অনেক তথ্য দিলেন। সেসব নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করলাম। বিশ্বজিৎ চৌধুরী চলমান চট্টগ্রামের কাভার ষ্টোরী করলেন। বক্স করে চট্টগ্রাম কারাগারের ইতিহাস আলাদা করে দিলেন। সেটাতে আমার স্বামী আবদুল আলীমের নাম দিলেন। সেদিন প্রথম জানতে পারলাম এবং কিছুটা ধাক্কা খেলাম – আমার কাজ অন্যের নামে প্রকাশ হতে পারে।এভাবে কেটে গেলো দিন।
১৯৯৩ সাল থেকেই প্রগতিশীল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত পত্রিকাগুলোতে চাকরির চেষ্টা করেছি । ভোরের কাগজের কাজ গুলোর ব্যাপক প্রশংসা কাজের স্পৃহা বাড়িয়ে দিতো শতগুণ। কিন্তু চাকরি দেবার আগ্রহ দেখায়না নীতিনির্ধারকেরা।
নারী নেত্রী মালেকা বেগম কে সেই শৈশব থেকে দেখেছি মায়ের সাথে পথে প্রান্তরে নারী আন্দোলনের কাজে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের অন্য সব কেন্দ্রীয় নেত্রীদের মতো মালেকা বেগম ও সাধারণ সম্পাদিকা হিসেবে চট্টগ্রামে গেলে আমাদের বাসাতেই থাকতেন। আমার মা নূরজাহান খান ব্যাংকার ছিলেন। কোনরকমে অফিস পিরিয়ড শেষ হতে না হতেই মালেকা খালাম্মাকে সাথে নিয়ে মা বেরিয়ে পড়তেন । হেঁটে হেঁটে সারা শহরের নারীদের সংগঠিত করতেন। মালেকা খালাম্মার পায়ের চটির দিকে দেখতাম ধুলো- ময়লা মাখামাখি।রাজনৈতিক গল্প, একাত্তরের গল্প, সাংগঠনিক , পারিবারিক গল্প , আড্ডা হৈচৈ করে মা এবং মালেকা খালাম্মা ঘুমাতে যেতেন অনেক দেরিতে। মনে পড়ছে ,এসব করে ও মা আমাদের দেখা শোনা, মেহমান দের জন্যে উপাদেয় রান্না, কোনটাই বাদ দিতেন না। বাবা বেশ উৎসাহের সাথে অনেক বাজার করে আনতেন মেহমানদের জন্যে। ১৯৮৫ সালে প্রথম বান্দরবান যাই ।মালেকা খালাম্মা নিয়ে যান আমাদের। মালেকা খালাম্মার ছেলে সাশা, আমরা তিন ভাই বোন আর মা। খুব আনন্দ করেছিলাম।
১৯৯৩ সালের পর যখন ভোরের কাগজ বা প্রথম আলোর কোন প্রোগ্রামে আসতেন মালেকা খালাম্মা বা মতি চাচা ( প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ), তখন তারা হোটেলে থাকতেন। ১৯৯৫ সালের পর আমার মা মালেকা খালাম্মাকে বলেছিলেন , আমাকে ভোরের কাগজের সাথে যুক্ত করতে। আমি দেখেছি, তিনি কিছুটা বিরক্ত হয়েই বলতেন, “এটা তো মোমেন ই পারে নূরজাহান আপা”।
এর পর একদিন মা আবুল মোমেন কে বললেন, “ মোমেন ভাই, সুমি তো আপনাদের সাথেই কাজ করছে অনেক দিন। আপনারা নতুন ভাবে পত্রিকা শুরু করছেন । ওকে কি আপনাদের কাজের সাথে নিতে পারেন? ওতো কাজ করে ।" আবুল মোমেন হেসে বললেন, “ কাজ একটু বেশী ই করে, কিন্তু এই মুহুর্তে তো সম্ভব না, দেখা যাক্ কী করা যায়।” মাকে এভাবে বারবার বিব্রত হতে দেখে আমার খুব কষ্ট হলো। প্রথম আলো বাজারে এলো। একদিন আমি ই আগ্রহ প্রকাশ করলাম। আবুল মোমেন বললেন, “ চট্টগ্রামে মেয়েদের সাংবাদিকতা করার পরিবেশ নেই। তুমি ফ্রিল্যান্স করছো, করে যাও।” বুঝলাম আমাকে সাংবাদিকতা করার পরিবেশ তৈরি করে নিতে হবে।
একটি কথা প্রসঙ্গক্রমে আনা প্রয়োজন। আমার বড়ো চাচা ডা. কামাল এ খান চট্টগ্রামের আন্দোলন, সংগ্রাম , ক্রীড়া জগৎ, সংস্কৃতিক জগতের নিবেদিতপ্রাণ প্রচারবিমুখ অসাধারণ এক ত্যাগী সংগঠক ছিলেন। দুই বাংলার সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের চট্টগ্রাম সফর মানেই আয়োজক এবং পৃষ্ঠপোষক ছিলেন আমাদের বাপ্পু ডা. কামাল এ খান। তার মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রগবেষক ওয়াহিদুল হক শিল্পকলা একাডেমীতে বলেছিলেন , “ ডা. কামাল এ খানের নামে মেলা হওয়া উচিত এমন নিষ্প্রাণ শোকসভা নয়”।
আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় বাপ্পুর প্রসঙ্গ আনবার কারণ হলো, ভোরের কাগজ এবং প্রথম আলো দু’টি পত্রিকার নীতিনির্ধারক এবং সংবাদকর্মীরা শুরুর সময়ে চট্টগ্রামে প্রথম কিছুদিন অফিস হিসেবে বাপ্পুর চেম্বারেই বসেছেন। কথাটা এজন্যেই বলছি ,বাপ্পু মারা যাবার পর প্রথম আলোতে তার মৃত্যু সংবাদ প্রকাশ করার জন্যে আমাকে বেশ অনেক বার ফোন করতে হয়েছে ঢাকায়। বাপ্পুর পারিবারিক বন্ধু এবং তার অনেক অনুগ্রহের পাত্র হলে ও এই মানুষটির ত্যাগ এবং তিতিক্ষার কথা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার দায়িত্বশীলতা থেকে চট্টগ্রামের সংস্কৃতি সংগঠক এবং সাংবাদিকেরা অনেক দূরে । ডি. কামাল এ খানের মৃত্যুসংবাদ প্রকাশেও ভীষণ হীনমন্যতার প্রকাশ দেখলাম তাদের। সাংবাদিকদের পেশাদারীত্ব আর দায়বদ্ধতার এমন অভাব কাছে থেকে দেখতে হয়েছে আমাকে বার বার।
গোষ্ঠী চিন্তা আর ব্যক্তিকেন্দ্রীকতার উর্ধে উঠে একজন নিবেদিতপ্রাণ মানবাধিকার সংগঠকের স্মৃতির প্রতি সামান্যতম দায়িত্বশীলতার পরিচয় ও দিতে পারলেন না কেউ।আমাদের দুর্ভাগ্য।
যাই হোক্ এক সময়ে ঢাকায় এলাম । দৈনিক সংবাদের বার্তা সম্পাদকের কাছে গেলাম। বললাম আমি মোনাজাত উদ্দিনের মতো কাজ তুলে আনতে চাই প্রত্যন্ত জনপদ থেকে । সম্পাদক আহমেদুল কবীর চাচা তখন গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি । বাবা তার ভীষণ স্নেহভাজন অনুজ। তিনি নিয়মিত বাবাকে ফোন করতেন ল্যান্ড ফোনে। আমি রিসিভ করলে তার ভরাট কন্ঠ শুনে শ্রদ্ধায় নত হয়ে যেতাম।তাকে আমার চাকরির কথা বলতে পারলাম না কেন যেন। বাবা কেও বলি নি।১৯৯৯ সালে যুগান্তরের চট্টগ্রাম ব্যুরোপ্রধান জসীম চৌধুরী সবুজআমাকে বললেন, “ আপনি তো ভালো লিখেন, আমাদের পত্রিকায় আসেন”।
এ্যাপয়েন্টমেন্ট হলো ফিচার এ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে। আরো একজনের একই সাথে এ্যাপয়েন্ট হলো, তাদের কারো আগে কোন রিপোর্টিং য়ের অভিজ্ঞতা নেই। তারা পুরুষ বলেই তাদের রিপোর্টার হিসেবেই চাকরি হলো। নভেম্বর ১৯৯৯ থেকে নভেম্বর ২০০০ ।
এর মধ্যে শিক্ষা বোর্ড এবং নারী নির্যাতন ইস্যুতে অনেক আলোচিত রিপোর্ট করেছি। অনেক রিপোর্ট বাস্কেটে ফেলে দেয়া হতো। এরকম একটি ঘটনা এসিড ছুঁড়ে মারা হয়েছিলো স্ত্রীকে। অপরাধী স্বামীর ছবি জোগাড় করেছি অনেক কষ্টে। দেখলাম সেই ছবি টি ব্যুরোচীফ তার টেবিলের পাশে বাস্কেটে ফেলে দিলেন। অপরাধ কী? এখনো জানি না।একবছরের মাথায় আমাকে যুগান্তর ছাড়তে বাধ্য করা হলো। এর কারণ টি এর আগে আরেকটি লেখায় আমি দিয়েছিলাম। তবু এখানে বলতে হচ্ছে-এক কিশোরী গৃহপরিচারিকা কে ধর্ষণ করে চট্টগ্রামের চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার একটি বাড়ির ছাদ থেকে ফেলে দেয়া হয়েছিলো। সেই রিপোর্ট করে আমি সাংবাদিক সমাজের চোখে অপরাধ করেছিলাম। ধর্ষণকারীর ছোটভাই এবং ভাগ্নী জামাই তখন প্রভাবশালী সাংবাদিক। প্রেসক্লাবে আমার বিচার বসলো আবুল মোমেন এবং অন্যান্য সাংবাদিক দের নেতৃত্বে । যাই হোক্, সে সময়ে সাপ্তাহিক ২০০০ এর চট্টগ্রাম প্রতিনিধির দায়িত্ব পেলাম। প্রথম সারির পত্রিকার সাংবাদিকেরা ও অপেক্ষায় থাকতো আমি সপ্তাহশেষে কী রিপোর্ট দিচ্ছি। দিন রাত খাটনি আর পরিশ্রম করে সপ্তাহের কাভার স্টোরী করতাম। চট্টগ্রাম থেকে একমাসে ৩/৪টা কাভার স্টোরী আমার থাকতো। আমি কাজ করার আগে চট্টগ্রামে পত্রিকার সার্কুলেশন ৭৫/একশ’ কপি ছিল। আমার রিপোর্ট প্রকাশ হতে শুরু করলো আর ৫/৭ হাজার কপি পর্যন্ত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য, জাপান সহ অনেক দেশে সাপ্তাহিক ২০০০ এর সার্কুলেশন । পাঠকদের অনেক চিঠি পাই। অস্ত্র , চোরাচালান , জঙ্গীবাদ, জামাত শিবিরের সন্ত্রাস নিয়ে একের পর এক অনুসন্ধানী প্রতাবেদন করতে থাকি। তরুণ প্রধান প্রতিবেদক গোলাম মোর্তোজা এবং আরো অপেক্ষাকৃত তরুণ নির্বাহী সম্পাদক মোহসিউল আদনান প্রচন্ড সম্মান করেন এবং সহযোগিতা করেন। সাপ্তাহিক ২০০০ চট্টগ্রাম অফিস করা হয় আমাদের বাসার ই একটি ছোট্টরুমে।
২০০২ এর ২৮ নভেম্বর বিকেল ৪টায় আমার অফিস থেকে কোতোয়ালী থানার ও সি রুহুল আমিন সিদ্দিকী এবং এসআই ইয়াসমিন বেগমের নেতৃত্বে একটি দল এসে আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। আমার ছোট ছেলেটার গায়ে সেদিন প্রচন্ড জ্বর। কনভেন্টে প্লে গ্রুপে পড়ে। একা একা পুলিশের গাড়ির পেছনে রাস্তায় চলে যায়, দু’চোখে জলের ধারা। তার মা’কে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে, কারণ কিছুই বুঝতে পারে না । আমার বাবা দুপুর বেলা একটু বিশ্রামে ছিলেন অসুস্থ শরীরে লুঙ্গী পরা অবস্থায় পুলিশের জীপের পেছন পেছন সিএমপি হেডকোয়ার্টারে ছুটে যান। এসি ডিবির রুমে আমাকে দেখে তৎকালীন এসি ডিবি শফিকুর রহমান কে বিনয়ের সাথে প্রশ্ন করলেন , “ আমি তো পাকিস্তান সরকারের সময়ে অনেক জেল খেটেছি, নির্যাতন সয়েছি। এখন স্বাধীন দেশ। আমার মেয়েটাকে কেন ধরে আনলেন?” তিনি বললেন তিনি কিছুই জানেন না। মোর্তোজা ভাইকে মোবাইলে জানালাম। আমার হাতে তখনো মোবাইল ছিল, এর পরেই সীজ করে নেয়। মোর্তোজা ভাই য়ের কাছে এসি ডিবি অস্বীকার করলেন তার রুমে আমার অবস্থানের কথা। সাড়ে ১১ ঘন্টায় দফায় দফায় ইন্টারোগেশান হয়। সিদ্ধান্ত ছিল রাতেই আমাকে ঢাকায় জয়েন্ট ইন্টারোগেশান সেলে পাঠিয়ে দেয়া হবে। রাত সাড়ে তিনটায় আমাকে ছেড়ে দেয়া হয়।
তার দু’দিন আগে সাংবাদিক সালিম সামাদ, প্রিসিলা রাজ, চ্যানেল ফোরের জাইবা মালিক এবং লিও পোল্ডো গ্রেফতার হন ঢাকা এবং বেনাপোল সীমান্ত থেকে। তাদের সাথে আমার কোন চেনা পরিচয় না থাকলেও তাদের সাথে আমাকে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় জড়ানোর চেষ্টা করা হয়। সালিম ভাই পরে বলেছিলেন, ওনাদের কাছে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিলো –তারা যদি সুমি খান কে তাদের কাজের সহযোগী হিসেবে বলেন, তাদের মুক্তি দেয়া হবে। তখন সালিম ভাইয়ের সাথে আমার কোন পরিচয় ছিল না। তিনি এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিস চৌধুরী বিবিসি এবং অন্যান্য মিডিয়াতে বলেন, “সুমি খানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতার যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ আমাদের কাছে আছে । এবার ছেড়ে দিলেও তাকে আবার ধরা হবে”।
পরদিন জানতে পারি আমাকে ছেড়ে দেবার পেছনে আমার সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী, অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ, মাহফুজ আনাম মতিয়া চৌধুরী এবং মালেকা বেগম এবং এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী সহ অনেকে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন । মালেকা খালাম্মা আম্মুকে বলেছেন, “নূরজাহান আপা, আপনি এখন সুমির মা শুধু নন, আপনি মহিলা পরিষদ নেত্রী। একটা মেয়েকে কিছুতেই রাতে থানায় রাখতে দেবেন না”।
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার আমাকে বললেন, “ আমি আইজি কে বলেছি, সুমি কেন্দ্রের সমন্বয়কারী। ওকে ১৯৯৫ সাল থেকে আমি চিনি। যদি ওর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ তোমরা প্রমাণ করতে না পারো, তোমাদের ছেড়ে দেয়া হবে না, মনে রেখো”।
২০০৪ সালের ২৭ এপ্রিল আমি একটি রিপোর্ট নিয়ে রাতের বেলা রিক্সায় করে এস এ পরিবহনে যাবার পথে অন্ধাকার রাস্তায় সন্ত্রাসীরা আক্রমন করে। আমি অজ্ঞান হয়ে রাস্তায় পড়ে ছিলাম। এলাকার ছেলেরা আমায় সেন্টার পয়েন্ট ক্লিনিকে নিয়ে যায় । সাংবাদিকেরা জানতে পেরে আমার বাসায় খবর দেয়।এর আগে থেকে ই আমাকে বেশ কয়েকটা চিঠিতে মৃত্যুপরোয়ানা জারি করে হুমকি দেয়া হয়। আমি মুখে এবং হাতে বেশ আহত হই। আমার বড়ো ছেলে অতুলন ভয়ে আমার দিকে তাকাতো না।আমার ছোট ছেলে গহন তার ছোট ছোট মাটির পুতুল গুলো এনে আমার মাথার কাছে বসে বসে আমাকে খেলতে বলতো, যেন এতে আমার মন ভালো হয়ে যায়। এর মধ্যে ৩ মে ২০০৪ প্রেস ফ্রিডম ডে। হঠাৎ দেখি সালিম সামাদ আমাকে দেখতে চট্টগ্রাম চলে গেছেন। সেদিন ঢাকায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি অতিথি। সব অনুষ্ঠান ফেলে তিনি বললেন চট্টগ্রামে আমার বোন আক্রান্ত হয়েছে, তাকে আমার দেখে আসতে হবে। সেদিন ই প্রথম তার সাথে পরিচয় এবং আপন বড়ো ভাই হিসেবেই তাকে বিপদের সময়ে চট্টগ্রামে পাশে পেলাম। সেই থেকে আজো আমার এই ভাইটির প্রতি আমার এবং আমার পরিবারের প্রত্যেকের বিনম্র শ্রদ্ধা।
কয়েকটা দাঁত ভেঙ্গে গেছে, হাতের আঙ্গুল সোজা করতে পারতাম না। ভেবেছিলাম আর কখনো লিখতে পারবো না। দাঁতের চিকিৎসা চট্টগ্রামে করলাম। হাতের আর নার্ভের চিকিৎসা মাদ্রাজে করলাম। ধীরে ধীরে আমার আঙ্গুল স্বাভাবিক হয়ে আসে। আমার যেন পুনর্জন্ম হলো!
জামাতের শীর্ষসন্ত্রাসী আহমইদ্যা গয়েশ্ব্বর রায়ের হাতে ফুল দিয়ে বিএনপিতে যোগ দিলো। আহমেদুল হক চৌধুরী প্রকাশ আহমদ্যা জামাত সাংসদ শাহজাহান চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ৯০ দিন সময় বেঁধে দিলেন –হয় শাহজাহান চৌধুরী থাকবে, নয়তো আহমদু থাকবে। এসময় আমি চট্টগ্রামের ত্রাস আহমেদুর ইন্টারভিউ নেবার চেষ্টা করি।
তার সাথে যোগাযোগ হয়। আমাকে সময় দিয়েছিলেন সন্ধ্যা ৭টায়, তার লোকজন রেইকি করে আহমদুর নিরাপত্তি নিশ্চিত হবার পর আহমদু আসেন সাড়ে সাতটার দিকে। চট্টগ্রামের জনপ্রিয় ঐ কাবাব হাউজের বাইরে দেখলাম সাংবাদিক নজরুল কবির তার শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের নিয়ে কাবাব খেতে গেছেন। তার সাথে কুশল বিনিময় করে ভেতরে একটি টেবিলে বসলাম ভয়ংকর এ সন্ত্রাসীর ইন্টারভিউ নিতে। খোলামেলা আলাপে বললেন ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়ে ফুলকুঁড়ি আসরের মাধ্যমে তাকে কিভাবে ছাত্র শিবিরের রাজনীতি এবং অস্ত্র হাতে তুলে দেয় শাহজাহান চৌধুরী। লম্বা , ফর্সা আকর্ষনীয় যুবক আহমেদু অকপটে বলে যান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির নেতা কর্মীদের খুন করে তাদের রক্তে হোলিখেলায় শিবির ক্যাডার দের মাতাল করেছেন জামায়াত নেতা এবং সাংসদ শাজহাজান চৌধুরী। বোরকা পরে অত্যাধুনিক অস্ত্র হাতে কয়েকটি খুনের বর্ণনাও দিলেন। গয়েশ্বর রায়ের হাতে ফুলের মালা দিয়ে বিএনপি তে যোগদানের কয়েকটি ছবি ও তিনি আমাকে দিলেন। সাপ্তাহিক ২০০০ টপ কভার ষ্টোরি করলো । মার মার কাট কাট সার্কুলেশন।
এই প্রতিবেদন প্রকাশের পরের শুক্রবার জুমার নামাজের আগ মুহুর্তে র‍্যাবের ক্রসফায়ারে বর্বরোচিত ভাবে হত্যা করা হয় আহমেদু কে। র‍্যাব-৭ এর তৎকালীন পরিচালক কর্ণেল এমদাদ ( পরবর্তীতে বিডিআর বিদ্রোহে নিহত) কে আমি প্রশ্ন করেছিলাম, " কেন আহমেদু কে হত্যা করা হলো ? " তিনি জবাব দিলেন," আপনাকে আহমইদ্যা যা ইন্টারভিউ দিয়েছে এর পর কী আর তাকে বাঁচিয়ে রাখা যায়?" প্রশ্ন করেছিলাম, " তাহলে আহমইদ্যাকে সন্ত্রাসের দীক্ষা যে দিয়েছে, তার মতো অসংখ্য কিশোর তরুণের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছে জামাত নেতা শাহজাহাস চৌধুরী - এই তথ্য নিশ্চিত হয়েই কি শাহজাহান চৌধুরীর জীবনের হুমকি কে সরিয়ে দিলেন?" হাসলেন কর্ণেল এমদাদ। সাপ্তাহিক ২০০০ পরের সংখ্যায় কর্ণেল এমদাদ এর এই ইন্টারভিউ ছাপা হলো।

বিএনপি নেতা এবং সংগঠক জামালউদ্দিন অপহরণ হলেন ২০০৩ সালের ২৬ জুলাই। তিনবছর পর তার কঙ্কাল উদ্ধার করা হয় ফটিকছড়ির জঙ্গল থেকে। এই তিন বছর নানান রকমের গল্প। আমার এক অজানা সোর্সের মাধ্যমে আমি সঠিক তথ্য গুলো পেয়ে যেতাম। জামালউদ্দিনের নব্বইবছর বয়সী মা শুধু আমাকেই ইন্টারভিউ দিলেন। বললেন , “আমাদের রাখালের ছেলে সরওয়ার জামাল নিজাম এমপি আমার ছেলেকে খুন করেছে”।
আমি ধারাবাহিক ভাবে জামালউদ্দিন অপহরণ এবং হত্যা নিয়ে রিপোর্ট করতে থাকি। আক্রান্ত হবান চিকিৎসা করতে গেছি, সরওয়ার জামাল নিজাম সাপ্তাহিক ২০০০ অফিসে ফোন করে মোর্তোজা ভাইকে বললেন, আপনাদের চট্টগ্রাম প্রতিনিধি কী করে চট্টগ্রামে চলাফেরা করে আমি দেখে নেবো। এবার গোলাম মোর্তোজা বিশেষ প্রতিবেদন লিখলেন। সেখানে তিনি আশংকা প্রকাশ করে বললেন এভাবে প্রকাশ্যে আমাদের প্রতিবেদক কে হুমকি দেবার কারণে আমরা তার নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত।আমার কাজ থেমে থাকে নি। কিছু টি শংকা ছিল সন্তান দের নিয়ে। আমি চেষ্টা করতাম তাদের স্কুলে যাওয়া এড়িয়ে চলতে যাতে তাদের উপর হুমকি না আসে।
২০০৫ সালে তিনটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করি।সৎ সাংবাদিকতা এবং প্রেস ফ্রিডম এর জন্যে বিশ্বের একজন কেই এই পুরস্কার দেয়া হয়। ইনডেক্স গার্ডিয়ান হুগো ইয়ং এ্যাওয়ার্ড। লন্ডনের সিটি হলে ২০০৫ এর ৪ মার্চ আমাকে এই পুরস্কার দেয়া হয়। এর পর ই নিউইয়র্ক থেকে পেলাম ইন্টারন্যাশনাল উইমেন মিডিয়া ফাউন্ডেশন এর আই ডব্লিউ এম এফ ‘ক্যারেজ এ্যাওয়ার্ড’।
কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিষ্ট ' সিপি জে 'এ্যাওয়ার্ড পেয়েছি তার আগেই। কিন্তু পুরস্কার পাওয়ার পর অফিসের কারো কারো আচরণ ভীষণ বৈরি হয়ে গেলো। কাজ করা কঠিন হয়ে গেলো । ‘সিপি জে এ্যাওয়ার্ড’ নিতে অস্বীকার করলাম। কর্তৃপক্ষ কে বললাম ,"তোমরা এই পুরস্কার এর ঘোষণা দিও না। আমাকে কাজ করতে দাও। আমি কখনো কোথাও পুরস্কারের জন্যে আবেদন করিনি। পাঠকের স্বীকৃতি ই আমার পুরস্কার। "
‘আইডব্লিউ এমএফ কারেজ এ্যাওয়ার্ড’ নিতে গেছি যখন, তখন সিপিজে থেকে বিশেষ ভাবে অনুরোধ করে তারা একটি চেক দিয়ে আসে আমাকে। এসব নিয়ে পরে বিস্তারিত লিখবার ইচ্ছে আছে ।
এর আগে ডেমোক্রেসী ওয়াচ থেকে আমার কাছে রিপোর্ট চেয়ে পাঠায়। আমি দিতে অস্বীকার করি। পরে তারা ভীষণভাবে চেপে ধরে মানবাধিকার রিপোর্ট পাঠাতে বলে।সেদিন শেষ সময়। তাড়াহুড়ো করে জামালউদ্দিন অপহরণ মামলায় পুলিশ কাস্টডিতে নিহত ফটিকছড়ির কাশেম চেয়ারম্যানের ক্যাশিয়ার অমর কর (সম্ভবত।নামটা এই মুহুর্তে মনে করতে পারছি না) এর উপর সাপ্তাহিক ২০০০ য়ে প্রকাশিত রিপোর্ট পাঠাই। প্রথম আলো , ভোরের কাগজ সহ সব পত্রিকার বাঘা বাঘা রিপোর্টার তাদের রিপোর্ট পাঠায়। একজন অমর করের উপর প্রকাশিত তার রিপোর্টটি পাঠিয়েছিলো। পরে ডেমোক্রেসী ওয়াচ থেকে ফোন করে জানালেন চট্টগ্রাম বিভাগে 'শ্রেষ্ঠ মানবাধিকার রিপোর্ট এ্যাওয়ার্ড 'আমি পেয়েছি। ঢাকায় এসে এই রিপোর্ট নিতে গিয়ে পরিচয় হলো বিখ্যাত রিপোর্টার গৌরাঙ্গ নন্দীর সাথে। খুলনার শ্রেষ্ঠ রিপোর্টার এর পুরষ্কার পেয়েছেন তিনি। পরে ডেমোক্রেসী ওয়াচের এহসান ভাই ফোন করে বললেন, “ সুমি আপা, আপনি যে কিসের মধ্যে কাজ করছেন, আমরা কিছুটা বুঝতে পারছি।“
আমি একটু অবাক হলাম তার কথা শুনে। বললেন , চট্টগ্রামের রিপোর্টার দের যা বকা আমাদের শুনতে হলো! তারা বলছে, “চট্টগ্রামে সুমি খান ছাড়া আর রিপোর্টার নাই আপনাদের চেনা? মেয়েমানুষ বলেই তাকে পুরস্কার টা দিতে হলো”? এহসান ভাই আরো বললেন তাকে কিভাবে বিব্রত করা হয়েছে আক্রমনাত্মক প্রশ্ন করে এবং ‘মেয়েমানুষ’ কে পুরষ্কার দেবার মনগড়া অভিযোগে দায়ী করে। আমি মনে মনে এতো কষ্ট পেলাম, এতো হতাশ হলাম!
কারো সাথে প্রতিযোগিতায় তো নামিনি। কারো কোন কাজে ও ডিসটার্ব করি নি কখনো। নিভৃতে আমার কাজ আমি করে গেছি। তবু কেন তারা আমার উপর এতো ক্ষুব্ধ? কাজ করার পরিবেশ আবো ভেবে ২০০৬ সালে ঢাকায় চলে আসি পুরোপুরি।২০০৬ এর ডিসেম্বর থেকে একুশে টেলিভিশনের সাথে কাজ শুরু করি সম্ভবত: ২০০৭ এর মার্চর ১৯ তারিখ ১৫ মার্চ এর তারিখে আমাকে এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দিতে বাধ্য হয় এইচ আর প্রধান রুহুল আমিন। এ ধরণের ঘটনা ঢাকায় এসেও বার বার আমাকে আঘাত করেছে। সেসব পরে অন্য কোন দিন বলা যাবে । শুভ কামনা থাকলো সকল সাংবাদিক সহকর্মীর প্রতি।১০.০৩.১৩
(ডিআর ইউর নারী দিবস বিশেষ প্রকাশনা তে প্রকাশিত লেখা)

Sunday, June 30, 2013

ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ অনেক বড়ো বিপর্যয় ঠেকাতে পারে। এসো বন্ধুরা - সুমি খান


ফেসবুকে আমার কমেন্ট , পোষ্ট অনেকের মনে অনেক প্রশ্ন জাগায়। প্রতিক্রিয়া জেনে অন্তত তাই বুঝলাম। কাল বিকেলে একুশে টেলিভিশনের পাশের খুপড়ি চায়ের দোকানে বসে পুরনো কলিগদের সাথে চা খেতে খেতে আমার এক অনুজ নারী সাংবাদিক প্রশ্ন করলো ," আপু , আপনার লেখা -পোষ্ট পড়ে মাঝে মাঝে মনে হয় আপনি আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বলছেন। " অতি বাম রাজনীতির সৈনিক আমার এই অনুজ ।তার রাজনৈতিক দীক্ষায় আওয়ামী বিরোধিতা আর ভারত বিরোধিতা বদ্ধমূল ধারণায় গেঁথে রেখেছে। তার যখন এ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়, আমি তখন একুশে টেলিভিশনের প্রধান প্রতিবেদক। আমার অত্যন্ত প্রিয় এবং স্নেহভাজন এই অনুজ কে বললাম, "দ্যাখো, এমন মনে হতেই পারে । কিন্তু আমার কথা গুলো সত্য এবং বাস্তব! কারণ আমরা তো ভুক্তভোগী! ২০০১ থেকে ২০০৫ যারা সাংবাদিকতায় একনিষ্ঠ ছিল, তারা কাছে থেকে দেখেছে জামাত -বিএনপি মানবতা র কী ভয়ানক বিপর্যয় ডেকে আনে। সাংবাদিক নির্যাতন কাকে বলে ....!!" এ কথা গুলো গেলো তিন বছর আরাম আয়েশে বিএনপি বীট করা এ্ই টিভি সাংবাদিক এর কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় নি। তার চোখে বিএনপি নেতা দের 'নিপীড়ন' নির্যাতন' অনেক বড়ো ব্যাপার। তারা তো মানিক সাহা , হুমায়ুন কবির বালু, গৌতম দাস সহ ১৩ সাংবাদিক হত্যা, মুনতাসীর মামুন , শাহরিয়ার কবির , সালিম সামাদ , পিরোজপুরের মিঠু, বরুন বিশ্বাসকে কী ভয়ংকর নির্যাতন সইতে হয়েছে- শুধু সাংবাদিকতা করার অপরাধে- তার কতোটা অনুমান করতে পারবেন এখনকার শখের সাংবাদিকেরা? শখের সাংবাদিক বলতে বাধ্য হলাম। কারণ এখন পর্দায় মুখ দেখিয়ে তারকা হবার জন্যেই টেলিভিশন সাংবাদিকতায় ছুটে আসেন অনেকে। সেই সময়ে জাইবা মালিক, প্রিসিলা রাজ অথবা আমার মতো নগন্য সাংবাদিক কে ও নির্যাতন , গ্রেফতার এবং হত্যার নিরন্তর হুমকির মুখেই বাঁশখালি, সাতকানিয়া, ফটিকছড়ি , সন্দ্বীপ সহ প্রত্যন্ত এলাকার বিপন্ন মানুষের কাছে ছুটে যেতে হয়েছে। বিএনপির বড়ো ডোনার হয়েও অপহরণ, হত্যার শিকার হয়ে তিনবছর গুম রাখা হয়েছে জামালউদ্দিন কে। বাবর শিকার করেছে বিএনপির সাংসদ সারওয়ার জামাল নিজামের থেকে এজন্যে ৫শ'কোটি টাকা নিয়েছে তারেক জিয়া। জামালউদ্দিনের পরিবার এখনো বিপন্ন । কারণ আওয়ামী লীগ নেতাদের কারো তাগিদ নেই এই খুনি কে গ্রেফতার অথবা বিচারের মুখোমুখি করা! এই ঘটনার বিচার হবার জন্যে অন্তত আবার ওয়ান ইলেভেন আসা দরকার বলেই আমার মনে হয়! জামাতের খুনি শাহজাহান চৌধুরীর হত্যাযজ্ঞের প্রধান সাক্ষীআহমদু, প্রকাশ আহমইদ্যা বিএনপি তে যোগ দেয়ার একবছরের মধ্যেই নব্বই দিন সময় বেঁধে হুমকি দিয়েছিলো শাহজাহান চৌধুরী কে। বলেছিলো -" জামাতের এক গুণ- ধর্মের নামে মানুষ খুন। নব্বই দিন পর হয় শাহজাহান চৌধুরী থাকবে, নয় আমি থাকবো। " তার এ ঘোষণার পর আমার সাথে একান্ত সাক্ষাৎকার দেয় আহমেদুল হক চৌধুরী, প্রকাশ আহমইদ্যা। ক্লাস এইটে পদার সময়ে ফুলকুঁড়ি আসরের মাধ্যমে তাকে কিভাবে ধর্মের দোহাই দিয়ে শিবিরের রাজনীতিতে যুক্ত করা হয়। এবং এর অল্পদিন পরেই শাহজাহান চৌধুরী তাকে অস্ত্র হাতে দিয়ে একের পর এক আওয়ামী রীগের নেতা দের হত্যা করিয়েছে- এর বর্ণনা এবং অকপট স্বীকারোক্তি দিয়েছিলো আহমদু। এই সাক্ষাৎকার প্রকাশ হবার সাথে সাথেই আহমদু কে র‍্যাব এর ক্রসফায়ারের মাদ্যমে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করা হয়। এর পর আমার সাথে সাক্ষাৎকারে র‍্যাব-৭ এর তৎকালীন কমান্ডিং অফিসার কর্ণেল এমদাদ ( পরবর্তীতে বিডিআর বিদ্রোহে নিহত) বলেছিলেন," আপনাকে যে সাক্ষাৎ কার দিয়েছ, তার পর তো তাকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না!" আমার প্রশ্ন ছিল , এই সাক্ষাৎকারের পর আপনাদের সুযোগ ছিল সন্ত্রাসের মূলোৎপাটনের- যদি সত্যি আপনারা সন্ত্রাস দূর করতে চান। আপনারা শাহজাহান চৌধুরী কে কেন ক্রসফায়ারে ফেললেন না- যদি সৎসাহস থাকে? উল্টো তার পথের কাঁটা দূর করলেন? " নীরব হাসি ছাড়া আর কোন জবাব ছিল না কর্ণেল এমদাদ এর।
এসব তো এখনকার সৌখিন সাংবাদিকেরা দ্যাখে নি! কী করে ধারণা করবে তারা বিএনপি জামাতের ভয়ংকর রূপ? আওয়ামী সুবিধাবাদী গোষ্ঠী ও একের পর এক হঠকারী ভূমিকা নিয়ে ক্ষুব্ধ করে তুলছে সাধারণ জনগণকে । তাদের ভালো কাজগুলোর চেয়ে অন্যায় আর অপরাধের চিত্র অদূরদর্শী হনগণের কাছে অগ্রগণ্য।... বিএন পির ক্ষমতায়ন তাই তাদের কাছে স্বপ্নের মতো!
.. বিএনপি ক্ষমতায় এলে যদি এই সাংবাদিকরা বিশেষ ভাবে ক্ষমতায়ন না হয়ে সাধারণ সাংবাদিকের কাতারে থাকে- তাদের এই স্বপ্নের ঘোর কাটতে এক ঘন্টা সময় ও লাগবে না... রক্তের বন্যা বয়ে যাবে দেশ জুড়ে!! দেশের বাম নেতা আর বুদ্ধিজীবি তাত্বিকেরা ২০০১-৫ যেমন ঘরে শুয়ে ঘুমাচ্ছিলেন- রোম পুড়লে নিরো বাঁশি বাজায় যেমন - তেমনি অবস্থানে ছিলেন- একই অবস্থানে আবার ফিরে যাবেন তারা !
আর সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার হবে নিরীহ মানুষ আর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি। যারা ৪০ বছর পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এসে পূর্বপুরুষ আর স্বজনদের নারকীয় হত্যার বর্ণনা দিয়ে সাক্ষী দিয়ে গেছে, তাদের এবার কচু কাটা করা হবে! একাত্তরের ঘাতক হায়েনার দল গারদ থেকে বেরিয়ে অট্টহাস্যে ফেটে পড়বে , রক্তপিপাসু জিভে আবার রক্তের স্বাদ নিতে হামলে পড়বে হিন্দু- বৌদ্ধ আর খৃষ্টান দের বাড়ি-ঘর- মন্দিরে....হ্যাঁ, সাথে তাদের জামাত-বিএনপি - আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগীরা সবাই থাকবে- জমি জিরেতের ব্যাপার- ভোগ দখলের ব্যাপার... ভারত সীমান্তে লক্ষ লক্ষ বিপন্ন মানুষ ভীড় করবে প্রাণ বাঁচাতে.... এর প্রতিক্রিয়ায় ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমান দের হত্যা -নির্যাতন করবে বিজেপি আর নরেন্দ্র মোদীর শিষ্যরা। এর প্রতিক্রিয়া সারা বিশ্বের নানান প্রান্তে ছড়িয়ে পড়বে সহিংসতা !! তাই ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধে উঠে আমাদের একটু সচেতনতা, একটু দূরদর্শীতা আর দায়িত্ববোধ নিয়ে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ অনেক বড়ো বিপর্যয় ঠেকাতে পারে। এসো বন্ধুরা মানবতার জয়গানে সব ধরণের সহিংসতা প্রতিরোধ করি!

Friday, June 28, 2013

‘অপাপনারী’ আমি নারীসাংবাদিক; এসেছি পাপের কূলে.. সুমি খান


‘অপাপনারী’ আমি নারীসাংবাদিক; এসেছি পাপের কূলে...
সুমি খান, অতিথি লেখক
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
08 Mar 2012 09:38:29 PM Thursday BdST

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্ঠে ধ্বনিত হয়েছিলো “ওহে, অপাপপুরুষ দীনহীন আমি এসেছি পাপের কূলে, প্রভু দয়া কোরো হে ,দয়া কোরো হে ,দয়া করে লও তুলে। আমি জলের মাঝারে বাস করি, তবু তৃষায় শুকায়ে মরি। প্রভু দয়া করো হে, দয়া করে দাও সুধায় হৃদয় ভরি।..”

আমি একজন মানুষ। পেশায় সামান্য একজন সংবাদকর্মী। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে আমি কাজ করেছি, সেখানে যারা নীতিনির্ধারকের দায়িত্বে ছিলেন এবং এখনো আছেন, তাদের অনেকের কাছে আমার প্রথম পাপ আমি নারী হয়ে এদেশে জন্মেছি, দ্বিতীয় পাপ আমি সাংবাদিকতা পেশায় দায়বদ্ধ থাকতে অঙ্গীকারাবদ্ধ।

মাঝে মাঝে কলম অথবা কী বোর্ডে আঙুল চালাতে গিয়েও হাত থেমে যায়। গভীর বেদনা বাজে কণ্ঠে; এক অন্ধকার থেকে আরো জমাট অন্ধকারের গহ্বর থেকে এক নারীসাংবাদিক আমি বলে উঠি, ‘ আমি কোনো পাপ করিনি। অপাপনারী আমি এসেছি পাপের কূলে।’
আজ মহান নারীদিবস। নারী শ্রমিকদের আত্মদানের স্মৃতিতে বিশ্বজুড়ে আট মার্চ পালিত হয় দিবসটি; তাদের প্রতি আমার লাল সালাম। অচলায়তন ভাঙার কাজটি করেছিলেন জার্মানির কম্যুনিস্টনেত্রী ক্লারা জেটকিন(Clara Zetkin)ও লুইস জাইৎস (Luise Zietz)। প্রতিবছর আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের জন্য ১৯১০ সালের দিকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পেশ করেন জার্মান কম্যুনিস্ট নারীনেত্রী লুইস জাইৎস। আর তাতে সমর্থন দেন অপর জার্মান কম্যুনিস্ট নারীনেত্রী ক্লারা জেটকিন(Clara Zetkin)। পরে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক ব্লকের দেশগুলোতে নারীদিবস পালিত হতে থাকে। রাশিয়ায় তা দিবসটি প্রথম পালিত হয় ১৯১৩ সালে। তার অনেক পরে ১৯৭৪ সালের দিকে জাতিসংঘ দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়। এই দিবসটাকে প্রতিবছর পালন করা উচিত। যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ইতিহাসের রক্তাক্ত সেই অধ্যায়কে জানতে পারে; আর এটা শুধু নারীদের দিন নয়, বরং নারীর ত্যাগের মহিমায় সমুজ্জ্বল এক সর্বজনীন দিন যা নারী-পুরুষ সবার সমঅধিকার ও সম-বিকাশের কথা বলে।
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোরের পুরো পোর্টাল যেন আজ নারী দিবসকে উৎসর্গ করেছে। দেখে বেশ ভালোই লাগলো। এর প্রধান সম্পাদক আমাদের শ্রদ্ধেয় ব্যতিক্রমী সাংবাদিক-ব্যক্তিত্ব আলমগীর হোসেনের প্রতি মনে মনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। এতোদিনে অন্তত মুক্তভাবে কথা বলার একটি জায়গা তৈরি হলো। ভালো লিখছেন ফজলুল বারী ভাই, ফারজানা খান গোধুলী, শাহনাজ মুন্নী, সঞ্জীব রায়, আদিত্য আরাফাত, মাহমুদ মেনন, আমার ছোটবোন জাকিয়াসহ আরো অনেকেই। অব্যাহত থাকুক এই যাত্রা।

তবে বিভিন্ন নিউজপোর্টালসহ জাতীয় এবং চট্টগ্রামের স্থানীয় দৈনিকে নারী দিবস নিয়ে প্রকাশিত লেখাগুলো পড়তে গিয়ে হাসি আটকাতে পারলাম না (আমি বংশগতভাবে হাসির ব্যারামে আক্রান্ত বলেই হয়তো!)।
মিডিয়া হাউজগুলোর দায়িত্বশীলদের ভণ্ডামির (হিপোক্রেসি) বোধহয় কোন সীমা থাকতে নেই। আজকের দিনে তার দরকারও হয়তো নেই। তবে প্রতিবাদী মন জেগে ওঠে।
মনের ভেতর কে যেন ডাক দিয়ে বলে যায়, সৎ সাংবাদিকতায় দায়বদ্ধ থাকবার ‘অপরাধে ’(?) মিডিয়ার ক্ষমতাসীন ‘জিম্মাদার’ সুশীল-কুশীলদের অন্যায়, হীনমন্যতা, মানসিক পীড়নের শিকার হচ্ছি যারা, তাদের কথা বলার সময় এসে গেছে। লেখার প্রচণ্ড তাগিদ অনুভব করলাম।
এই আত্মকথনের ব্যাখ্যা যে যার মতো করে করতে পারেন, (যা আমাদের সহকর্মীরা করে থাকেন) তাতে আমার কিছুই যায় আসে না।
আজ এ মহান দিনে শুরু করলাম ইতিহাস বা আত্মকথন লেখা। যেকোনো সময় আমার মৃত্যু অবধারিত। আমি নিশ্চিত আমার মৃত্যুর পর আমার পরবর্তী প্রজন্মের মাধ্যমে অব্যাহত থাকবে সাংবাদিকতা জগতের অকপট উন্মোচন।
স্কুলজীবনে বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা শুরু করি; সে ১৯৮৫-’৮৬ সালের কথা। ১৯৯১ সালে আমার বিয়ের পর সদ্যবিবাহিত স্ত্রীকে লেখালেখিতে দেখতে চান আলেক্স আলীম (যদিও আমার একই অনুরোধ তার প্রতি, যার এখনো কোনো গুরুত্ব নেই)। তারই নিয়ত অনুপ্রেরণায় (এখনো আমার লেখালেখিতে তার তাগিদই বেশি) রিপোর্টিং শুরু ১৯৯৩ সালে। রক্ষণশীল ঘরের ছোটবৌ, সূর্যাস্ত থেকে মধ্যরাত অব্দি সাংসারিক কাজে বন্দি । তবু একটু মানসিক প্রশান্তির জন্যে ফাঁক বুঝে রিপোর্টিং শুরু করি আলেক্স আলীমের অনুপ্রেরণায়, বাবা ভাষাবীর সাইফুদ্দিন খানের হাত ধরে । যিনি নিজেও দৈনিক সংবাদে বেশকিছু লেখালিখি করেছেন।
দৈনিক ভোরের কাগজের স্থানীয় সাপ্তাহিক পাতা ‘চলমান চট্টগ্রামে’ কাজ করতে থাকলাম ১৯৯৩ সাল থেকে। এর আগে আজাদী,পূর্বকোণে নিয়মিত কলাম এবং প্রতিবেদন লিখেছি। আজাদীর নারীপাতার দায়িত্বে এখনো আমার বন্ধু সানজিদা মালেক। তাকে একদিন অনুরোধ করেছিলাম তার বাবা এবং আজাদীর সম্পাদক এমএ মালেককে আমার কথা যেন বলে, আমি সাংবাদিকতা করতে চাই। এর ক’দিন পর সানজিদা জানায়, “আব্বুকে বলেছি, আব্বু তো কোনোভাবেই রাজী হলো না।” অপরাধ কি জানি না। তবে সেখানে কাজ করার ‘বিশেষ যোগ্যতা ’ দরকার, যা আমার নেই- বুঝে গেলাম। ‘চলমান চট্টগ্রামে’ কয়েকটি মূল প্রতিবেদন প্রকাশিত হবার পর দায়িত্বশীল ব্যক্তির কাছে আবেদন করলাম নিয়মিত সংবাদকর্মী হিসেবে কাজে যুক্ত হবার।
সুশীল সমাজের অন্যতম ধারক-বাহক বুদ্ধিজীবীর পক্ষ থেকে এর যা জবাব পেলাম, এখনো চোখে ভাসে-কানে বাজে। বললেন, “ চট্টগ্রামে তো মেয়েদের সাংবাদিকতা করার পরিবেশ নেই। তুমি এতো পরিশ্রমী, এতো রাত পর্যন্ত কাজ করে রিপোর্ট আমার হাতে দিয়ে যাও!!.. ফ্রিল্যান্স করো, খারাপ কী?” হতোদ্যম হইনি, পূর্ণোদ্যমে কাজ করে যাই নীরবে।
এখন চট্টগ্রামে অনেক নারীসাংবাদিক, সেই বুদ্ধিজীবীর দৃষ্টিতে নারীর জন্যে সাংবাদিকতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে কিনা তিনিই ভালো বলতে পারবেন। তবে কোনও দায়িত্বহীন কাজ না করলেও, আমাকে সুশীল সমাজের যোগ্য কখনোই মনে করেননি সুশীল সমাজের ধারক-বাহকেরা। সে নাহয় নাইবা হলো। কিন্তু নষ্ট সাংবাদিকদের সিন্ডিকেটবাজীর কাছে জিম্মি করা হবে কেন আমাদের?

১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হতে যাচ্ছিলো দৈনিক যুগান্তর। এর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ করে দিলেন চট্টগ্রামের ব্যুরো চিফ জসীম চৌধুরী সবুজ। এজন্যে তার কাছে কৃতজ্ঞ আমি। এর এক বছরের মাথায় ২০০০ সালের নভেম্বরে এক কিশোরী গৃহকর্মীকে ধর্ষণ করে চারতলা থেকে ফেলে দেয়ার অভিযোগ ওঠে যমুনা অয়েলের এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের ২৪ নম্বর বেডে শয্যাশায়ী নির্যাতিত কিশোরীটির কোমর থেকে পা পর্যন্ত প্লাস্টার করা। ভাঙা হাড়ের প্রচণ্ড ব্যথায় কোঁকাচ্ছিলো কিশোরীটি। কয়েকজন সাংবাদিককে দেখলাম হাসপাতালে। নির্যাতিত মেয়েটির ছবি তুললেন প্রথম আলোর ফটোসাংবাদিক। আমার অনুরোধে এক কপি ছবি দিলেন তিনি আমাকে।
অভিযুক্ত সেই কর্মকর্তার সৌভাগ্য, তিনি দুই জাতীয় দৈনিকের দু’জন প্রভাবশালী সাংবাদিকের স্বজন। প্রেসক্লাব, সিইউজে একাট্টা হলো এই ভয়াবহ সংবাদ ধামাচাপা দেয়া হবে। আমি তৎকালীন বার্তা সম্পাদকের মোবাইলে ফোন করে পুরো পরিস্থিতি জানালাম। তিনি রিপোর্টটি পাঠাতে বলেন। সে সময়ে ব্যুরোচিফ সম্পাদকের কন্যার বিয়েতে ঢাকায় ছিলেন। তার পরবর্তী জন বামপন্থী ছাত্রনেতা বেশ গম্ভীর ভাবে বললেন , এই রিপোর্ট আপনি পাঠাবেন না ঢাকায়। পুরুষ হিসেবে তিনি দায়িত্বশীল পদে থাকলেও কাজে তিনি আমার জুনিয়ার। প্রশ্ন করলাম,“ কেন পাঠাবো না? ” কোনও জবাব দিলেন না তিনি। আমি নিজেই বার্তাসম্পাদককে পাঠিয়ে দিই সেই রিপোর্ট এবং ছবি। পরদিন ২০০০ সালের ২৫ নভেম্বর যুগান্তরের ভেতরের পাতার নিচের দিকে ছোট করে সংবাদটি প্রকাশ হয়। একই দিন সংবাদ, আজাদী, মুক্তকন্ঠ, এবং দৈনিক কর্ণফুলী নিজেদের মতো করে সংবাদটি প্রকাশ করেছে। প্রথমআলো, জনকন্ঠ এবং অন্যান্য কিছু পত্রিকার চট্টগ্রাম অফিস থেকে দায়িত্ব নিয়েই হত্যা করা হলো এই সংবাদ। আজাদী ‘জ্বীনের ধাক্কা ?’ শিরোনামে এক কলাম লিড, সংবাদ পেছনের পাতায় শেষ কলাম। দেখলাম একই ছবি ছেপেছে সবাই।অন্য তিনজন পুরুষ হবার সুবাদে বেঁচে গেলেও আমি ‘নারীসাংবাদিক’।
ধর্ষণের হুমকি দিলেন প্রথম শ্রেণীর দৈনিকের তখনকার একজন সিনিয়র সাংবাদিক(বর্তমানে একটি ইলেকট্রনিক মিডিয়ার  অন্যতম প্রধান নীতিনির্ধারক)।
তিন দিন পর্যন্ত অবলীলায় এই হুমকি দিতে থাকলেন সেই সাংবাদিক। শুভাকাঙ্ক্ষীদের উদ্বিগ্ন অনুরোধে আবাসিক সম্পাদককে রাতে ফোন করলাম। প্রশ্ন করলাম, তার উপস্থিতিতে তারই অফিস থেকে একজন সাংবাদিক আরেকজন সহকর্মীকে তিন দিন ধরে প্রকাশ্যে এই হুমকি কী করে দিয়ে যায়? এভাবে আর কতোদিন চলবে? বেশ উত্তেজিত কন্ঠে তিনি আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, “ তোমরাও সাংবাদিকতা শিখেছো, আমাদেরকে সাংবাদিকতা শেখাচ্ছো? একটা কাজের মেয়ে রেপড হলো কি হলো না সেটা নিয়েও রিপোর্ট করতে হয়?..”
এর পরের কথাগুলো সে অনেক বেদনার, অনেক ভয়ংকর কথা; অন্যদিন লিখবো। তবে জানিয়ে রাখি, আবাসিক সম্পাদকের প্রশ্রয় পাচ্ছে বুঝতে পেরে সুশীল সমাজের ধারক-বাহক পত্রিকাটির সম্পাদককে দু’পাতার একটি চিঠি লিখি। সঙ্গে অন্য চারটি পত্রিকায় প্রকাশিত একই সংবাদের ফটোকপি। তাতে লিখেছিলাম, এই সাংবাদিক সম্প্রতি কন্যাসন্তানের জনক হয়েছেন শুনেছি। তার কন্যার নিরাপদ ভবিষ্যৎ কামনা করি আমি।(এই চিঠির কপি এখনো আমার কাছে আছে)।
অবাক ব্যাপার এরপরও প্রকাশ্যে অব্যাহত থাকে এই হুমকি। তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
অথচ আমার বিরুদ্ধে যুগান্তর থেকে পরপর তিনবার শোক’জ করলেন ব্যুরোচিফ।বার্তা সম্পাদক কোনও দায়িত্ব নিলেন না। ইউনিয়নের ভোট হারানোর ভয় ছিলো হয়তো। তার ভোটাররা পুরুষ ছিলেন যে!
যুগান্তরের পিয়ন সিরাজ ভাই তৃতীয়বার শোক’জ এর চিঠি এনে দরোজায় কলিংবেল দিতেই বাবা সেই চিঠির কথা জেনে গেলেন। এতোদিন জানাইনি বাবাকে। বাবা বিস্মিত হলেন। এর কারণ পরে বলা যাবে।তিনি নিজের হাতে আমার রেজিগনেশান লেটার লিখে দিলেন। সেই সাংবাদিকের উন্মত্ততায় উদ্বিগ্ন হয়ে সহকর্মী সুহৃদরা বললেন সেই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানায় সাধারণ ডায়েরি করতে। এক সময়ে অভিযোগটি মামলা হিসেবে নিতে হবে, চট্টগ্রামের চার সিনিয়র এবং শীর্ষ সাংবাদিক এগিয়ে এলেন। বললেন তারা আদালতে দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দেবেন। এতে ভয় পেয়ে পত্রিকার সহকারী আবাসিক সম্পাদক এই হুমকিদাতা সাংবাদিক এবং আমাদের এক বন্ধু পুলিশ কর্মকর্তাকে সাথে নিয়ে আমার বাড়িতে এসে ক্ষমা চাইলে মামলা তুলে নিয়েছিলাম। এরপর সাক্ষীদের কটাক্ষ করে ‘রাজসাক্ষী’ ডাকতেন ধর্ষণের হুমকিদাতা নির্লজ্জ বেহায়া সেই সাংবাদিক। এতোটাই বেহায়া হয় অপরাধীরা, সম্প্রতি ফেসবুকে আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতেও দ্বিধা হয়নি তার।
ধর্ষকগোষ্ঠী এবং চট্টগ্রামের তৎকালীন সাংবাদিকসমাজ প্রেসক্লাবে বৈঠক করলেন। তাদের চাপে আমাকে যুগান্তরের চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা হলো। ২০০০ সালের নভেম্বরেই সাপ্তাহিক ২০০০ এর চট্টগ্রাম প্রতিনিধির দায়িত্ব পেলাম।
সুশীল সমাজের প্রদতনিধি এই বুদ্ধিজীবী এবং সাংবাদিকদের ‘কীর্তিময়’ কিছু কথা আজ মনে পড়ছে খুব। সেই পত্রিকায় লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে ক’জন সাংবাদিক নিয়োগ দেয়া হয়। কোনও এক কারণে পরীক্ষায় প্রথম স্থান পাওয়া ছাত্রটিকে বাদ দিয়ে দ্বিতীয় স্থান পাওয়া এক ছাত্রীকে নিয়োগ দেন দায়িত্বশীল ব্যক্তি ।পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে লাশ পাওয়া গিয়েছিলো এক নারীর । তাকে নিয়ে বেশ রগরগে ‘পরকীয়া ’ র কাহিনী তুলে ধরেছিলো এই নারীসাংবাদিক তার রিপোর্টে । আরেকটি রিপোর্টের কথা মনে পড়ছে; চট্টগ্রাম সরকারী কলেজের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে পরীক্ষার হলে শ্লীলতাহানির অভিযোগ এনে প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয় সেই রিপোর্ট। সেই শিক্ষকের অনেক সহকর্মীর ক্ষুব্ধ প্রশ্ন ছিলো: পরীক্ষার হলে শ্লীলতাহারন সম্ভব কিনা।তাদের বক্তব্য, সেই শিক্ষকের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে একটি গোষ্ঠি এই প্রতিবেদনটি করিয়েছে। যার শাস্তি হিসেবে তাকে উত্তরবঙ্গে বদলি করা হয়। সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে রেখে তাকে চলে যেতে হয়েছিলো। সেই সময়ে দৈনিক পত্রিকায় চট্টগ্রামে একমাত্র নারীসাংবাদিক হবার বিশাল কৃতিত্ব এখনো গর্বের সাথে উচ্চারণ করেন তিনি। যা লিখছিলাম, প্রথম শ্রেণীর দৈনিকে সাংবাদিকতার গরবে গর্বিত এই নারীসাংবাদিক অবশ্য বিয়ের পর সেই চাকরি ছেড়ে কিছুদিন একটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে জনসংযোগ কর্মকর্তার চাকরি করেন। সাংবাদিকতা পাঠ্য হলেও সাংবাদিকতা তাদের ধ্যানজ্ঞান হতে হবে এমন কোনও কথা নেই। সাংবাদিকতার নীতি নৈতিকতাও সবার জন্যে বাধ্যতামূলক নয়।তবু তাদের চাকরি খুবই সহজলভ্য। এই অসম সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন আনন্দের বটে। তবে সততার সাথে হলে আনন্দটি নি:সন্দেহে অন্যরকম হয়!!
নারীসাংবাদিক অথবা পুরুষ সাংবাদিক যেই হই, আমরা যারা এই পেশাকে ধ্যান-জ্ঞান , জীবন-মরণ ভেবে অন্য পেশার সব প্রলোভন ছুড়ে ফেলে দিই, আমাদের জন্যে প্রতিটি মুহূর্ত যারা প্রতিকূল করে তুলেছে, তাদের মুখোশ খুলে দেয়ার দিন এসেছে। কারণ এখনো সৎকাজ তাদের সিন্ডিকেটবাজীর কাছে জিম্মি হয়ে আছে। এভাবে আর চলতে দেয়া যায় না।আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যেন অন্তত তাদের প্রতিকূলতার শিকার না হয়। তাই বন্ধুর পথের সহযাত্রী বন্ধুদের কথা বলে যাবো এভাবেই । শুরু হলো আরো বন্ধুর পথে চলা। সারা দেশে আমার যতো সহকর্মী ভাইবোন সৎ এবং নির্ভীক সাংবাদিকতা প্রতিষ্ঠার জন্যে নিরন্তর সংগ্রাম করে যাচ্ছেন তাদের সবার প্রতি নিরন্তর শুভকামনা । আজকের এই মহান দিনে আসুন হাতে হাত মিলিয়ে প্রতিরোধ করি যতো অন্যায় আর নিপীড়ন।

Tuesday, June 25, 2013

সালাম আম্মা জাহানারা ইমাম !!!


শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ১৯ তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ! দীর্ঘদিন ক্যান্সারে ভুগে ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানের ডেট্রয়েটের একটি হাসপাতালে মারা যান জাহানারা ইমাম । একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূলে নেতৃত্ব দেবার 'অপরাধে' স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের দায়ের করা রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলা মাথায় নিয়েই প্রয়াত হন নিবেদিতপ্রাণ মেধাবী মহিয়সী সাহসী যোদ্ধা এবং শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ।


১৯২৯ সালের মে মাসে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে তার জন্ম। সরকারী কর্মকর্তা সৈয়দ আবদুল আলির সাত সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ সন্তান জাহানারা ইমাম কে সর্বোচ্চ মিক্ষায় শিক্ষিত করার সব রকমের চেষ্টা করেছেন তার পিতা সৈয়দ আবদুল আলি এবং মাতা হামিদা আলি । ১৯৪৫ সালে রংপুরের কারমাইকেল কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পড়েন। এ সময়ে তার সাথে বন্ধুত্ব হয় কলেজের কৃতি ছাত্র শরীফুল আলম ইমাম আহমেদ এর সাথে। উচ্চমাধ্যমিক শেষ করার পর কোলকাতায় লেডি ব্রেবোর্ণ কলেজে ভর্তি হন জাহানারা ইমাম। সেখানে বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন তিনি। সেখান থেকে ১৯৪৭ সালে তার গ্র্যাজুয়েশান শেষ করেন। '৪৭ এর দেশভাগের পর তার বাবা-মায়ের কাছে ময়মনসিংগে এসে বিদ্যাময়ী সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৪৮ সালে তার বিয়ে হয় প্রকৌশলী শরীফুল আলম ইমাম আহমেদ এর সাথে। তারা ঢাকায় চলে আসেন। সিদ্ধেশ্বরী গার্লস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকার পদে যোগ দেন জাহানারা ইমাম।

'খাওয়াতিন' নামে একটি মাসিক পত্রিকার প্রথম সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন জাহানারা ইমাম ১৯৫২ সালে। পরবর্তী কয়েক বছর তিনি সফলতার সাথে এই পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন। ১৯৫২ এবং ১৯৫৪ সালে তার দুই পুত্র রুমী এবং জামীর জন্ম হয়। ১৯৬০ সালে প্রধান শিক্ষকের চাকরি ছেড়ে দিলেন সন্তান দের জন্যে। এসময় বললেন , " আমি হাজার হাজার সন্তানের শিক্ষা দিয়েছি। এখন আমার দুই সন্তানকে গড়ে তোলার জন্যে কিছু সময় দিতে হবে।"

এ সময়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যে এম এ ডিগ্রি অর্জন করেন। এর পর তিনি পুরোপুরি শিক্ষকতায় নিয়োজিত হন। ১৯৬৬ থেকে '৬৮ ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে শিক্ষকতা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউটে খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে ও কয়েক বছর ছিলেন। তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শিক্ষকতায় দেন তিনি। ১৯৬৪-৬৫ সালে ফুলব্রাইট স্কলার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের স্যান ডিয়েগো বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রিত হন। পরবর্তীতে আবারো ১৯৭৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আমন্ত্রনে যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন তিনি।

১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী তাদের এদেশীয় সহযোগী বাহিনী রাজাকার আলবদর দের সাথে নিয়ে নিরীহ বাঙ্গালী দের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লে
তাদের প্রতিহত করতে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন জাহানারা ইমামের পুত্র গেরিলা যোদ্ধা শফি ইমাম রুমি । বেশ কিছু অপারেশনে সরাসরি অংশ নেন তিনি। পাকিস্তানী সেনারা এক রাতে তুলে নিয়ে যায় রুমি এবং তার পিতা প্রকৌশলী শরীফুল আলম ইমাম আহমেদ কে। অত্যাচারিত নির্যাতিত শরীফুল ইমাম মৃত্যুবরণ করেন ১৩ ডিসেম্বর ।মায়ের কোলে আর ফিরে এলেন না রুমি।

১৯৯২ সালে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠনের সময়ে বেগম সুফিয়া কামাল তার বাড়িতে বসে প্রস্তাব করেন জাহানারা ইমামকে এর দায়িত্ব দেবার জন্যে। জননী সাহসিকার সিদ্ধান্ত তখন শিরোধার্য। কারণ , তার দূরদর্শীতার কাছে সবাই পরাজিত হয়েছে।! এর ধারাবাহিকতায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালীন যুদ্ধাপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির নেতৃত্ব দেন শহীদ রুমির মা জাহানারা ইমাম। ক্যান্সার নিয়েও একাত্তরের ঘাতকদের বিচারের দাবিতে সক্রিয় আন্দোলন চালিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্দোলনের প্রতীকে পরিণত হন তিনি । ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত জাহানারা ইমামের আত্মজীবনীমূলক‘ গ্রন্থ একাত্তরের দিনগুলি’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি অসাধারণ দলিল। এছাড়া আরো ৭টি গ্রন্থ রয়েছে তার 'বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার' সহ অনেক পুরস্কারে ভূষিত হন জননী জাহানারা ইমাম! সারা জাতি আজ তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে।

Monday, June 24, 2013

হেফাজতে ইসলাম: কওমি শিক্ষা ও রাজনৈতিক বাস্তবতা: শিক্ষা কোন মিডিয়ামে হবে?


গত ২২ জুন ২০১৩, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম কার্যালয়ে 'হেফাজতে ইসলাম : কওমি শিক্ষা ও রাজনৈতিক বাস্তবতা' শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের শীর্ষস্থানীয় চার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন হেফাজতে ইসলামের একজন প্রতিনিধি। আলোচনায় বাংলাদেশের রাজনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা এবং ধর্মীয় চেতনার পারস্পরিক সম্পর্কের পাশাপাশি বেরিয়ে এসেছে গুরুত্বপূর্ণ বহু পর্যবেক্ষণ ও পরামর্শ।
শিক্ষা যদি চরিত্র গঠন এবং পেশা সৃষ্টিতে সাহায্য করে, তবে ইসলামি শিক্ষারও প্রয়োজন আছে। এটা আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে-- শুধু ইসলামি শিক্ষা দিয়ে হবে না। আরও কিছু শেখা প্রয়োজন। মাদ্রাসা শিক্ষা একপেশে শিক্ষা। শুধু চরিত্র গঠন করে কিছু হবে না। যদি অন্যান্য শিক্ষা গ্রহণ না হয়। তাহলে আপনি আধুনিক পৃথিবীর প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাবেন। --সলিমুল্লাহ খান
অংশগ্রহণ করেছেন

অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমদ : জাতীয় অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম : ইতিহাসবিদ ও বাংলাপিডিয়ার সম্পাদক

মওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : ইসলামি চিন্তাবিদ ও শোলাকিয়ার ইমাম

অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান : অর্থনীতিবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক

মুফতি মিযানুর রহমান সাইদ : অন্যতম আহ্বায়ক, হেফাজতে ইসলাম

কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা : বৈঠক সঞ্চালক

মুহম্মদ নূরুল হুদা :
আজকে আমাদের গোলটেবিল বৈঠকের বিষয় হল কওমি শিক্ষা ও রাজনৈতিক বাস্তবতা। কওমি শিক্ষা আমাদের উপমহাদেশে নতুন কোনো বিষয় নয়। এর রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। সেই ইতিহাস বিষয়ে আমাদের এখানে দুজন ইতিহাসবিদ উপস্থিত আছেন, তারা বলবেন। আর কওমি শিক্ষা সম্পর্কে এখানে উপস্থিত রয়েছেন দুজন ইসলামি চিন্তাবিদ, তারা বলবেন। সেই সঙ্গে আমাদের এখানে উপস্থিত রয়েছেন নতুন প্রজন্মের একজন দার্শনিক ও চিন্তাবিদ। আমরা তার কাছ থেকেও এ বিষয়ে জানব। আমি প্রথমেই অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমদকে তার বক্তব্য প্রদানের জন্য অনুরোধ করছি।


অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমদ :
একজন ইতিহাসবিদ হিসেবে আমার মনে হয় যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার যে উন্মেষ ও বিকাশ ঘটেছে সেটা আমাদের জানা একান্ত প্রয়োজন। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় দুই ধরনের ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এক. আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা বা ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা। দুই. মাদ্রাসা শিক্ষা বা ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থা।

এ দুটি ব্যবস্থা নিয়ে আজকে যে সংকট এবং বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে এতে দুটো মাইন্ডসেট কাজ করে। ফলে দুই ধরনের চিন্তাধারা দেখতে পাওয়া যায়। এ জন্য অবশ্যই শিক্ষার ইতিহাস জানা দরকার।

আমাদের উপমহাদেশে মুসলমানরা শাসন করেছে বহুদিন। প্রাক-ব্রিটিশ যুগে আমাদের দেশে যে শিক্ষাব্যবস্থা ছিল সেটা মুসলমানদের জন্য মক্তব এবং মাদ্রাসাভিত্তিক শিক্ষা ছিল। মক্তবে ছিল প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা আর মাদ্রাসায় উচ্চ শিক্ষাব্যবস্থা। ১৮০০ শতকের শেষ নাগাদ এসে ব্রিটিশ সরকার মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে। তার আগে কিন্তু সরকারি ব্যবস্থায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। এদের পৃষ্ঠপোষকতায় মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়। ওই সময় হিন্দুদের জন্য পাঠশালা এবং টোল ছিল। পাঠশালা হল প্রাইমারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং টোল হল উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রথম সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে উপমহাদেশে ইংরেজরাই প্রতিষ্ঠা করেছে। ১৭৮০ সালে তাদের উদ্যোগে প্রথম ওয়ারেন হেস্টিং কলকাতায় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এটিই ছিল প্রথম সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কেন করলেন? কারণ তখন সরকারি ভাষা ছিল ফার্সি। ইংরেজরা এ দেশে হঠাৎ করে আসেননি। তারা এসেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে ব্যবসায়ী হিসেবে। ঘটনাচক্রে যখন তারা এ দেশে আসেন তখন এখানকার ভাষা জানতেন না। এ দেশে যখন দুই জাতির মধ্যে অরাজকতা সৃষ্টি হয়, সেই সুযোগে তারা ক্ষমতা গ্রহণ করে। যেহেতু তারা ছিল ব্যবসায়ী কাজেই তাদের মূল লক্ষ্য ছিল ব্যবসা। তারা সবকিছুই ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখত। তাই হিন্দু-মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তারা নাক গলাত না। শুধু তাই নয়, প্রতিষ্ঠিত যে শাসনব্যবস্থা ছিল সেটাতেও তারা হস্তক্ষেপ করতে চায়নি। ফার্সি ভাষা ইংরেজরাও জানতেন। তাই এ ভাষাতে প্রশাসনিক কাজ চলত। বিশেষ করে বিচারকাজ। এ ব্যবস্থা বেশ কিছুদিন চলছিল। ১৮৩৭ সাল পর্যন্ত এ ব্যবস্থা ছিল। এ পর্যন্ত মাদ্রাসা ছিল গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৯ শতকের প্রথম দিকে বিলেতে সংস্কার আন্দোলনের শুরু হয়। যার ফলে মানুষের মধ্যে একটা ধারণা জন্মায় যে, এই শিক্ষাব্যবস্থা পুরনো ব্যবস্থা। এই যে ফার্সি ভাষায় জ্ঞানদান হচ্ছে, এটা বদলাতে হবে। এখন দরকার মডার্ন অ্যাডুকেশন। ফার্সি ভাষাকে ট্রান্সফার করতে হবে। প্রশ্ন উঠতে পারে শিক্ষার উদ্দেশ্য কী? যে শিক্ষা কাজে লাগবে সেটা শিখতে হবে। লর্ড ব্যান্টিংয়ের সময় থেকে আরবি ও ফার্সি ভাষায় শিক্ষার সংস্কার কাজ চালু হয়। কেননা এটা ছিল ইউজলেস শিক্ষা। ফার্সি ভাষার মধ্যে যে জ্ঞান রয়েছে সেটা অনেক উঁচু স্তরের। কিন্তু তা যুগের প্রয়োজনে টিকতে পারে না। সে জন্য মাদ্রাসা শিক্ষা তুলে দেওয়ার কথা ওঠে।

১৭৯২ সালে বেনারসে এবং পরে কলকাতায় ইংরেজি ব্যবস্থামুখী আধুনিক শিক্ষা চালু হয়। তখন একটা তীব্র প্রতিবাদ দেখা দিয়েছিল। সুদীর্ঘ মুসলিম আমলে অনেকে ফার্সি শিখেছিলেন। এমনকি রাজা রামমোহন রায়ও ফার্সি শিখেছিলেন। তার প্রথম বই বের হয়েছিল ১৮০৩ সালে। এই উপমহাদেশে তিনিই প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশ করেন ফার্সি ভাষায়। হিন্দুরা মুসলমানদের চেয়ে অনেক বেশি বাস্তবমুখী ছিল। তারা প্রয়োজনে নিজেদের বদলিয়েছে কিন্তু মুসলমানরা সে রকম ছিল না।

১৮১৬ সালে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রথম ইংরেজদের মাধ্যমে এ দেশের মানুষ আধুনিক শিক্ষা ও সভ্যতার সংস্পর্শে আসে। হিন্দুরা এ ক্ষেত্রে প্রতিবাদ করেননি। তারা বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু মুসলমানরা বিষয়টিকে গ্রহণ করে না। তারা তীব্র প্রতিবাদ জানায়। মুসলমানরা মনে করেছে, এতে আমাদের ইসলাম এবং ইসলামি চিন্তাধারা নষ্ট হবে। ইংরেজরা ভাবল, এরা না চাইলে এদের ঘাটাব না। ফলে মাদ্রাসা থেকে গেল। কিন্তু মাদ্রাসায় কীভাবে শিক্ষাব্যবস্থা চলছে? দেখা গেল সেখানে যে সমস্ত বিষয় পড়ানো হয় এবং যেভাবে শিক্ষা দেওয়া হয় তা বাস্তবমুখী নয়। সেগুলো হাজার বছরের পুরনো।

মুহম্মদ নূরুল হুদা :

স্যার আপনি যে পর্যায়ে এসে উপস্থিত হয়েছেন সেটি হল ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থার ধারা। আমরা এবার এই ধারার শুরু ও তা কীভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে এবং সমাজে এর প্রভাব কিরূপ-- এসব বিষয়ে শুনব মওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদের কাছ থেকে।


মওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ :
কওমি মাদ্রাসার শুরুটা হয়েছিল মূলত রসুলে করীম (সা:)-এর সময় থেকে। হিযরতের পর এ শিক্ষার দিকে তিনি নজর দেন। মসজিদে নববির চত্বরে শিক্ষার্থীদের নিয়ে তিনি কওমি মাদ্রাসা চালান। সেখানে যেসব শিক্ষার্থী ছিল তাদের তিনি খোরপোষেরও ব্যবস্থা করেছিলেন। এর মধ্যে আবু হুরায়রা (রা:) ছিলেন। এভাবে অগ্রসর হতে হতে উমাইয়াদের যুগ, আব্বাসীয় যুগসহ আরও অনেক সময় পার হয়ে ওসমানী সাম্রাজ্য অতিক্রম করেও এ শিক্ষাব্যবস্থা চালু ছিল। আমি অত বিস্তারিত যাব না। সংক্ষেপে বলছি। শ্রদ্ধেয় প্রফেসর সালাহউদ্দীন সাহেব যেমন বলেছেন মাদ্রাসা শিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা ছিল। এটি সে সময় শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, অমুসলিমরাও এ শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। প্রচুর অমুসলিম মাদ্রাসা শিক্ষা থেকে ডিগ্রি লাভ করেছেন। সালাহউদ্দীন সাহেব যেমন রাজা রামমোহনের কথা বলেছেন। যিনি ফার্সি শিখেছিলেন।

পরবর্তীতে মুসলমানদের পক্ষ থেকে যখন বহু প্রতিক্রিয়া হয় তখন ইংরেজরা কলকাতায় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে। ঐ প্রতিষ্ঠার একটি বড় উদ্দেশ্য ছিল মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া নয়; বরং তাদের উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের বিদ্রোহ প্রশমন করা। আর ছিল মুসলমানদের পরাধীন করে রাখা। এমনকি আমি বলব, মীর জাফর মনে করেছিলেন, সিরাজুদ্দৌলার মতো তরুণের হাতে যদি ক্ষমতা আসে তাহলে ক্ষমতাকে সংকুচিত করা যাবে না। তাই আমার মতো একজন বয়স্ক বুদ্ধিমানের হাতে ক্ষমতা আসুক। কিন্তু মীর জাফর ক্লাইভের সঙ্গে কুটকৌশলে পেরে ওঠেননি। পরে মীর জাফর তার ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। এ থেকে বেরিয়েও আসতে চেয়েছিলেন কিন্তু পারেননি। মুসলমানরা এরপর থেকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। পরবর্তীতে সিপাহি বিদ্রোহ হয়। সেটা সবাই জানেন। একটি বিষয় লক্ষ্যনীয় যে মুসলমানরা বারবার বিপ্লব, বিদ্রোহ করেছে। ইংরেজরা ভাবল, মুসলমানদের বিদ্রোহ, বিপ্লব দমন করার উপায় একটাই। কলকাতায় যে মাদ্রাসা তারা প্রতিষ্ঠা করেছে সেখানে কিছু করতে হবে। তারা মাদ্রাসা শিক্ষার কারিকুলামে বেশ কিছু কাটছাট করে। এতে জেহাদবিষয়ক যে অধ্যায় ছিল সেখান থেকে তারা অনেক কিছু বাদ দিয়েছে। আরেকটি কাজ করেছে, এই মাদ্রাসাগুলো পরিচালনা করার জন্য তারা প্রথম থেকেই বেশ কিছু অমুসলিম নিয়োগ দিয়েছে। এর মধ্যে কিছু খ্রিস্টানও ছিল।

মুহম্মদ নূরুল হুদা :

হুজুর একটা প্রশ্ন ছিল।

মওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ :

এক মিনিট, বলছি। একসময় মাদ্রাসা শিক্ষার বিরাট ঘাঁটি ছিল দিল্লি। সিপাহি বিদ্রোহের পরে সে ঘাঁটিগুলো নষ্ট হয়ে যায় এবং মাদ্রাসা শিক্ষার যে মূলধারা ছিল সেটা ধ্বংসের মুখে পড়ে। এরপর তারা আলেম-ওলামাদের গায়েবও করেছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি অনেক হত্যাযজ্ঞও চালায় সে সময়। পৃথিবীর সব দেশে হত্যার বিচার হয়েছে; কিন্তু আমাদের আফসোস, ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের এ হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হয়নি। এ বিচারের দাবি না কংগ্রেস করেছে, না মুসলমানরা করেছে। ওই সময় এমন হয়েছে যে, শোনা যায়, একজন মানুষ মারা গেলে তার জানাযার জন্য আলেম খুঁজতে কোনো গ্রামে গেলে শোনা যেত সেই আলেম মারা গেছে। তারা বলত অমুক গ্রামে যান সেখানে আলেম আছে। সেখানে গেলে জানা যেত আলেম অ্যারেস্ট হয়েছে। যখন দেখা যেত লাশের মধ্যে পচন ধরেছে তখন মানুষ সেটাকে করব দিত। ওই সময় আলেমরা অনেক নির্যাতিত হয়েছেন। তাহলে এই দেশে ইসলাম বাঁচিয়ে রাখার উপায় কী? সকল দিকে তো হতাশা। তখন আলেমরা দেখলেন কিছু একটা করতে হবে। ১৮৬৬ সালে দিল্লির একটি নিভৃত গ্রাম (আমবালা), যেটা দিল্লি থেকে প্রায় ১০০ মাইল দূরে, সেখানে একজন ছাত্র নিয়ে একটি ডালিম গাছের নিচে যে মাদ্রাসা শুরু হয়, সেটাই এ উপমাহাদেশে স্থাপিত প্রথম কওমি মাদ্রাসা। সেই ছাত্র পরে অনেক প্রসিদ্ধ লাভ করেছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিল। আধুনিক কালের কওমি মাদ্রাসার সেই শুরু। তাকে কেন্দ্র করে পরে ওই ধারায় আরও অনেক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মাদ্রাসগুলো প্রতিষ্ঠায় সাধারণ মুসলমানদের অনেক সাহায্য ও সহযোগিতা ছিল। তাদের সহযোগিতায় মাদ্রাসাগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব মাদ্রাসা সাধারণত সরকার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। ওই মাদ্রাসাগুলোর কারিকুলাম করেছেন দারসি নিজামি। দারসি নিজামির মধ্যে দুই ধরনের বিষয় দেখা যায়। একটি হল উলুমে আলিয়া এবং অন্যটি হল উলুমে আফিয়া। উলুমে আলিয়া বলতে বোঝায় কোরআন, হাদিস, তাফসির ও ফিকাহ। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু জিনিস যেগুলো একজন মুসলমানের সবসময় প্রয়োজন। সেসব বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে এর মধ্যে কোরআন-হাদিসের মধ্যে কোনো পরিবর্তন হবে না। এতে পরিবর্তনের অবকাশ নেই। ফেকাহর মধ্যে যা আছে, তা পরিবর্তন হবে না। আরেকটা হল উলুমে আফিয়া, মানে ওইগুলোর জন্য হল ভাষা, ব্যকরণ, জ্যোতির্বিজ্ঞান, হিসাববিজ্ঞান ইত্যাদি। এরপরে অনেকবার পাঠ্যসূচিতে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু সেগুলো সহায়ক বিষয়ে। মৌলিক বিষয়গুলোতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। আমাদের মূল উদ্দেশ্য, ইসলামকে বাঁচিয়ে রাখা এবং সাম্রাজ্যবাদ থেকে দূরে থাকা। তিনি বলেছেন যতদিন ভারত সাম্রাজ্যবাদের অধীনে থাকবে, ততদিন সারাবিশ্ব সাম্রাজ্যবাদীদের অধীনে থাকবে। উনি যখন মাল্টা থেকে জাহাজে করে ভারতবর্ষ আসছিলেন, সেই সময় যখন তিনি ভারতের তীর দেখতে পেয়ে তার সঙ্গীকে বলেছিলেন, দেখ এ আমার দেশ।

যতদিন ভারতকে সাম্রাজ্যবাদীদের হাত থেকে মুক্ত করা যাবে না ততদিন পৃথিবী সাম্রাজ্যবাদীর হাত থেকে মুক্তি পাবে না।

মুহম্মদ নূরুল হুদা :

ভারত স্বাধীন হল, উপমহাদেশ স্বাধীন হল; কিন্তু আপনারা অনেকেই এই দ্বিজাতি তত্ত্বের সঙ্গে একমত নন। ভারত, পাকিস্তান পরবর্তীতে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আমাদের যে সংস্কৃতি এবং আমাদের যে চিরায়ত ইসলাম ধর্ম, এর সঙ্গে অন্যান্য ধর্মের কোনো সংঘর্ষ ছিল না। ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতির মধ্যে ঐকমত্য বজায় রেখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে ভাষা কতখানি অবদান রেখেছে সে বিষয়ে এবার বলবেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম।

মওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ :

এক মিনিট। আমি বলতে চাচ্ছি উনি দ্বি-জাতিতত্ত্বের পক্ষে ছিলেন না। উনি দেখেছেন এটা ইসলাম সমর্থিত নয়। এ দেশের সাধারণ মানুষকে স্বাধীনতার স্বাদ বোঝানো দরকার। সুতরাং আমাদের ভাবতে হবে এটা কীভাবে সম্ভব? তখন তিনি দেখলেন এক্ষেত্রে আমাদের নেতা দরকার। কিন্তু নেতা হতে হবে অসাম্প্রদায়িক। হিন্দুদের মধ্যে তখন গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে অনেক কাজ করেছেন। তার কথা ভাবলেন তিনি। গান্ধীকে নেতা বানানো হল। সে সময় তিনি তার পয়সা দিয়ে তাকে সারা ভারত সফর করিয়েছিলেন।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম :
হুজুর যেভাবে বলেছেন, আমি তো সেভাবে বলতে পারি না। আমাদের অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে ব্রিটিশ শাসনের প্রাথমিক যুগে ব্রিটিশরা নিজেরাই মাদ্রাসা স্থাপন করেছে। তবে তাদের উদ্দেশ্য ছিল না ইসলামকে রক্ষা করা। কোম্পানি আমলে সরকারি নীতি ছিল খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সীমিত রাখা। তারা জানত, হিন্দু-মুসলমান এক হয়ে গেলে তাদের অনেক সমস্যা। তাই তাদের মধ্যে বিরোধ লাগিয়ে রাখত। কলকাতায় যখন তারা মাদ্রাসা স্থাপন করেছিল, তখন মুসলমানদের পক্ষ থেকে কোনো প্রস্তাব ছিল না। তারা প্রশাসনিক কাজকর্ম চালানোর জন্য এটা করেছিল। কেননা, সকল আইনকানুন ছিল আরবি, ফার্সি ভাষায়। এবং ব্রিটিশ আমলের আগে তা ছিল আরবি ভাষায়। এই যে ভাষার ঐতিহ্য এটা অক্ষত রাখার জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতায় মাদ্রাসা স্থাপন করে। ওই মাদ্রাসায় আরবি ও ফার্সি ভাষা শেখানো হয়। সেখানে সংস্কৃত ভাষাও ছিল। আদালতে কাজ করার জন্য তাদের এ ভাষা শিক্ষার প্রয়োজন ছিল। কেননা আদালতের ভাষা ছিল ফার্সি এবং স্থানীয় বাংলা। আদালত যখন ইংরেজদের শাসনে চলে গেল, তখন তারা ভাবল, আইন ঠিকভাবে না জানলে দেশে অশান্তি আন্দোলন লেগে থাকবে। তাই তারা আদালতের ভাষা হিসেবে দুটি ভাষা চালু রাখল। ফার্সি এবং বাংলা। এটা ১৮২২ সাল পর্যন্ত ছিল। এরপর এর সঙ্গে যুক্ত হল ইংরেজি। ১৮৩৫ সাল থেকে ইংরেজি ভাষা আদালতের ভাষা হিসেবে যোগ হয়। তখন আদালতে তিনটি ভাষায় রায় হত। ফার্সি, বাংলা, ইংরেজি। এটা চলছিল ১৮৪০ সাল পর্যন্ত। এরপর তারা ১৮৯২ সালে ফার্সি ভাষা তুলে দেয়। পরে বাংলাও তুলে দেয়। থাকল শুধু ইংরেজি। সুতরাং সেই থেকে আদালতের ভাষা হল ইংরেজি, যা অদ্যাবদি চলছে। আমাদের দেশে এখনও ইংরেজিতে রায় হয়। সেই ইংরেজি অনেক দুর্বল। আমাদের ভাষার জন্য অনেক রক্ত দিতে হয়েছে এসব বিষয় সবাই জানেন। কিন্তু এ দেশের আদালতে ইংরেজিতে রায় হয় এটা বেশ হতাশাজনক। একটি দেশের সংস্কৃতির গোড়া হল তার ভাষা।

ভাষা কী? আমার আপনার চিন্তা, বিশ্বাস, আইনকানুন, সংস্কৃতি সবকিছু ধারণ করছে ভাষা।

মুহম্মদ নূরুল হুদা :

স্যার, কওমি শিক্ষার মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে কি না জানি না; কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কওমি শিক্ষা যেমন ছিল তেমনি আছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক বাংলাদেশ এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কী ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা হওয়া উচিত সে বিষয়ে কিছু বলুন।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম :

ইংরেজ শাসন খুব ইন্টারেস্টিং। ইংরেজরা একটা বিশেষ সময়ে হিন্দুদের নিয়ে ছিল। কিন্তু হিন্দুরা যখন জেগে যায়, তখন তারা মুসলমানদের ডেকে আনে। মুসলমানদের শিক্ষার জন্য তারা তৎপর হয়। তারা মাদ্রাসা স্থাপন করে। সেগুলো যেমন ইংরেজি শিক্ষার বাহন, তেমনি মুসলিম সংস্কৃতির বাহনও বলা যায়। ওই ধারায় সবচেয়ে কার্যকর ব্যবস্থা হল মুসলমানদের জন্য জুনিয়র মাদ্রাসা ও সিনিয়র মাদ্রাসা। মিড ফর্টিজে আমি মাদ্রাসার ছাত্র ছিলাম। সেখানে আমি আরবি , ফার্সি, উর্দু, ইংরেজি, বাংলা পড়েছি। আমার আরবি ভাষাটি বেশ ভালো লাগত। জুনিয়র মাদ্রাসায় আরবি উর্দু শেখানো হত। সিনিয়র মাদ্রাসায় আরবি, ফার্সি, উর্দু, ইংরেজি এবং ভালো ইংরেজি শেখানো হত। আমি দেখেছি পাকিস্তান হওয়ার পর প্রশাসন, সিভিল সার্ভিস, পুলিশ সার্ভিসে যারা কাজ করছেন তাদের অনেকেই মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন। ফলে পাকিস্তান আমলে তাদের ভাষাগত কোনো সমস্যা হয়নি। কাজেই শিক্ষার বাহন হিসেবে ইংরেজরা যা শুরু করেছিল, তা বেশ ফলপ্রসু ছিল। তারা সে সময় শুধু সিনিয়র, জুনিয়র মাদ্রাসাই স্থাপন করেননি, গ্রামে গ্রামে জমিদারদের বলেছিলেন মাদ্রাসা স্থাপন করতে। তাই দেখা যেত, প্রত্যেক মুসলমান জমিদার কাছারির পাশে মাদ্রাসা স্থাপন করত। আমাদের প্রফেসর সাজ্জাদ হোসেনের মতো সফিসটিকেটেড ইংলিশম্যানদের মতো মানুষও মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন। আহমদ শরীফ সাহেবও মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন।

আসলে আরবি ভাষা ভীষণ সাইন্টিফিক। বেশ পাওয়ারফুল ল্যাঙ্গুয়েজ। এটা পৃথিবীকে শাসন করেছে বহুদিন। আমরা বাঙালি ছেলে হয়ে আরবি পড়েছি কোনো অসুবিধা হয়নি। কিন্তু জুনিয়র ও সিনিয়র মাদ্রাসা তুলে দেওয়া হয়েছে। তখনই এর ডিপারচারটা আসে। আগের যুগে শিক্ষার যে স্ট্যান্ডার্ড ছিল এখন সেটা নেই। আমি বলছি না যে মাদ্রাসা ভালো, সেটা ফিরে আসুক। মূলকথা হল, এখন আমাদের নিজেদের ভাষার মাধ্যমে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে হবে। ইংরেজরা যেটা করেছিল, প্রায়োগিক দিক দিয়ে সেটা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আমাদের স্বাধীন দেশে কেন আদালতের ভাষা হবে ইংরেজি? ব্রিটিশরা যদি আদালতের ভাষা বাংলা করতে পারে, আমরা বাঙালি হয়ে সেটা কেন পারি না? আমাদের আদালতে যে ভাষা ব্যবহার হয় তা মিক্সড ইংলিশ। যাকে বলে মোক্তারি ইংরেজি।

মুহম্মদ নূরুল হুদা :

আসলে আমাদের একটা শিক্ষানীতি তৈরি করা দরকার। এ দেশে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু রয়েছে। এরই একটি ধারা হচ্ছে কওমি শিক্ষাব্যবস্থা। যা ৪২ বছর ধরে চলছে। এ বিষয়ে আমরা জানব মুফতি মিযানুর রহমানের কাছে।


মুফতি মিযানুর রহমান সাইদ :
সকলকে ধন্যবাদ। আমরা শুনছিলাম কওমি শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে বর্তমান রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা বিষয়ে নানাকথা। যদি বিষয় এটি হয়, তাহলে কওমি শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে বুঝে নিতে হবে। আমাদের মওলানা মাসঊদ সাহেব খুব সুন্দরভাবে এর ইতিহাস বলেছেন। এর মধ্যে আর একটু যোগ করা যায় ১৮৬৬ সালে যেমন কওমি মাদ্রাসার শুরু হয়েছিল ইংরেজদের অপপ্রচারের কারণে। অনেক আলেম একত্র হয়ে ইসলামকে রক্ষা করার জন্য যে চেষ্টা নিয়েছিলেন, সেটা ১৮৫৭ সালে আমবালা ও সামিলির ময়দানে। রসুলে করিমের নির্দেশে স্বপ্নযোগে যে লাঠির মাধ্যমে এর স্থান নির্ধারিত হয়েছিল সেটা ছিল একটি আধ্যাত্মিক ঘটনা। সুরা জুমার তিন নং আয়াতই কওমি মাদ্রাসার সিলেবাসের মূল উৎস। মাদ্রাসার আধ্যাত্মিক প্রতিষ্ঠাতা আল্লাহর রাসুল। বাহ্যিক প্রতিষ্ঠাতা দারসে নিযামি। কওমি মাদ্রাসার সিলেবাস মূলত ছয়টি বিষয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত। সেগুলো হল-- আকিদা, ইবাদত, আখলাক, সামাজিক-অর্থনৈতিক এবং রাষ্ট্র পরিচালনা। এই ছয়টি বিষয়ের উপর কওমি মাদ্রাসার কারিকুলাম প্রতিষ্ঠিত।

এখন আমি বলব ইসলামি রাজনীতি কাকে বলে? ইসলামি রাজনীতি হল প্রতিষ্ঠিত সরকারকে আল্লাহর বিধিবিধান অনুযায়ী পরিচালনার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করা। এতে যদি কোনো ভুলত্রুটি সরকার করে থাকে, তাহলে জাতি ও জনগোষ্ঠীর কল্যাণে আল্লাহর গোলামির মধ্যে আবদ্ধ থেকে তার বিধিবিধানে যত প্রকারের দাবি দাওয়া আছে সেটা সরকারের কাছে তুলে ধরে তাকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে সাহায্য করা। এছাড়া ইনসাফ বা সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা। সকল প্রকারের জুলুম, অন্যায়, অত্যাচার নিরসন করে অকল্যাণ দূরীভূত করা। আর এসবই কোরআন-হাদিসের মাধ্যমে করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী চলতে হবে। কওমি মাদ্রাসার সিলেবাসের সর্বশেষ বিষয় হল রাষ্ট্র পরিচালনা করা। আর এটি আল্লাহর গোলামি, যাকে বলে আল্লাহর ইবাদত করা। এটা বেসিক জিনিস। জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহকে মানার বিষয় রয়েছে। মোটকথা পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক--প্রত্যেক জীবনে আল্লাহর বিধানকে অনুসরণ করা আমাদের কর্তব্য। এসবই কওমি মাদ্রাসার সিলেবাসের মধ্যে থাকে।

রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে রাজনীতি ইবাদতের অন্তর্গত। আমি বিষয়টিকে পরিষ্কার করতে চাই। যারা রাজনীতিকে একদম ধর্মহীন বলতে চান, ইসলাম এর সঙ্গে কখনও একমত নয়। কারণ, ইসলামে রাজনীতি একটি মানুষের জীবনে অনেক প্রয়োজন। জাতির জন্য, জনগণের জন্য ইসলাম কোনো দিক নির্দেশনা দিবে না তা তো হতে পারে না। ইসলাম যেমন সবকিছুর দায়িত্ব মুসলমানকে দিয়েছে, মুসলমানও তেমনি রাজনীতিকে পাশ কাটিয়ে চলতে পারে না। তবে এ দুটি বিষয়ের মধ্যে আজকাল সীমা লংঘন দেখা যায়। কেউ কেউ শুধু রাজনীতি বা রাষ্ট্রনীতি করেন। ইসলামি রাজনীতি এটা সমর্থন করে না। আবার কেউ কেউ মনে করেন, রাজনীতিতে ধর্মের গন্ধ থাকবে না, ইসলাম এটাও সমর্থন করে না।

তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে, রাজনীতি ইসলামের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। ইসলামি রাজনীতি মানে ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠা করা। কওমি মাদ্রাসায় এসব বিষয় শেখানো হয়। এর সঙ্গে সমাজনীতি, পারিবারিক নীতি, আকাইদ ইত্যাদি শেখানো হয়। এর সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত থাকে রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতির বিষয়। এটা যে সকলকে বাস্তবায়ন করতে হবে এমন নয়। আমাদের মধ্যে একটি দল (জামাত) আছে, যারা মাঠে রাজনীতি করছে। আমরা বলেছি আপনারা রাজনীতি করেন, আমরা আত্মশুদ্ধি করব। এছাড়া আমাদের অনেক কাজ আছে। আমরা গ্রুপ করে একেকজন একেক কাজ করব। রিচার্স করব। এসবের মাধ্যমে ইসলামকে ধরে রাখব। যদি কেউ কোরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী খোলামনে রাজনীতি করে, তাতে তার ইবাদতের সওয়াব হবে। প্রচলিত রাজনীতির বিভিন্ন ধারা আমরা সমর্থন করি না। তবে কওমি শিক্ষার মধ্যে রাজনীতি নেই। হেফাজতের প্রসঙ্গে বলি, আমার জানামতে ইসলাম রক্ষার জন্য একটি বিশেষ ইস্যু নিয়ে তারা মাঠে নেমেছে, এতে রাজনীতি নেই।

মুহম্মদ নূরুল হুদা:

খুব সুন্দর বক্তব্য। বিশ্লেষণও চমৎকার। সবশেষে যেকথা বললেন, আমরাও এর সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে চাই যে আপনারা শাপলা চত্বরে অবস্থান করেছিলেন-- সেটা কি ভুল ছিল? সিলেটে হেফাজতের একজন নেতা বলেছেন এই অবস্থান ভুল ছিল। যাহোক, দেশ স্বাধীন হল, ৭৫-এর নারকীয় হত্যা, সামরিক শাসন, স্বৈরশাসন অনেক কিছু হয়েছে এ দেশে তখন আপনারা কিছু করেননি; কিন্তু যুদ্ধাপরাধীর বিচারের প্রসঙ্গ আসাতেই হেফাজতের উত্থান হয়েছে বলে কেউ কেউ বিষয়টিকে বিশ্লেষণ করেছে। রাজনীতিতে হেফাজত সরাসরি আসবে কি না জানতে চাচ্ছি।


মুফতি মিযানুর রহমান সাইদ:
আমি হেফাজতের দায়িত্বশীল কেউ নই। তবে ব্যক্তিগতভাবে কিছুটা দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি। অতীতে আল্লা-রাসুল, কোরআন-সুন্নাহর বিরুদ্ধে এ দেশে অনেক কাজ হয়েছে। প্রত্যেক বড় বড় ইসুতে এ দেশের মানুষ এবং ওলামা ইকরাম কথা বলেছে। সালমান রুশদি এ দেশের মানুষ না, এরপরও তার বিরুদ্ধে আমরা রুখে দাঁড়িয়েছিলাম। আমরা কারও গদি দখল করার জন্য কাজ করি না বা কাউকে গদি থেকে সরানোর জন্যও কাজ করি না।

তবে হঠাৎ কেন হেফাজত আসল, এটা একটা প্রশ্ন বটে। আমাদের একটি বড় দল জামাত মাঠে রয়েছে। আমাদের বড় বড় নেতারা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। এ অবস্থায় যখন দেখি নাস্তিক ব্লগাররা ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলে, তখন আমরা সোচ্চার হই। ওলামা-ইকরাম মিলে আমরা একটি মিটিং করি। ঐ মিটিংয়ে পরিষ্কার একথা বলা হয়েছে, কোনোদিন হেফাজত রাজনীতিতে যাবে না। আমরা দীন রক্ষার জন্য কাজ করব। সরকার যদি কোনোদিন আমাদের মূল্যায়ন করে, ইসলামি দাওয়াত করে-- তাহলে তাদের বোঝাব। তবে বিশাল একটি জনগোষ্ঠী এর সঙ্গে জড়িত হয়ে গিয়েছে। এর মধ্যে কার মুখ বন্ধ রাখবেন?

এর আগে সরকারের সঙ্গে আমাদের কথা ছিল কোরআন-সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন পাস করা যাবে না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে কী? নির্বাচন সম্পর্কে কী বলব। মুসলমানদের হাতে বেশি ভোট রয়েছে। নির্বাচনে এর একটা প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে। তবে এটা সত্যি যে আমাদের কোনঠাসা করার জন্য অন্যায়-অত্যাচার করা হচ্ছে। জুলুম করে আবার মিডিয়ার মাধ্যমে সেটা মিথ্যাচার হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। এর জন্য আমরা আল্লাহর কাছে বলব। মাঠে নেমে হাঙ্গামা করা আমাদের কাজ নয়। আল্লাহ যাকে ইচ্ছে ক্ষমতায় বসান। এতে আমাদের কিছু নেই। আমাদের অনেক কাজ রয়েছে। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে দীনি কাজ করতে চাই।

মুহম্মদ নূরুল হুদা :

এতক্ষণ আমরা ভারত বিভাগ, পাকিস্তানের অভ্যুদয়, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক সংস্কৃতির যে বিস্তার এবং এর সঙ্গে কওমি মাদ্রাসা ও হেফাজত বিষয়ে নানা আলোচনা শুনলাম। এবার আমরা সলিমুল্লাহ খানের কাছে শুনব শাহবাগে তরুণদের জাগরণ, বাংলার সমাজবিবর্তন, হেফাজতের উত্থান এবং তার রাজনৈতিক অবস্থান ইত্যাদি বিষয়।


ড. সলিমুল্লাহ খান :
আমি হেফাজতের কেউ নই। সুতরাং আমি হেফাজতের পক্ষে কিছু বলতে পারব না। আমার কথা নির্ভরযোগ্য হবে না। তারা বলছে, তারা রাজনীতি করতে চায় না। কিন্তু হেফাজতে যা করছে, তা কিন্তু রাজনীতি।

আমি একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই। সেখানে লেখা আছে আমাদের এই ক্যাম্পাস ধূমপান এবং রাজনীতিমুক্ত। অতএব ধূমপান এবং রাজনীতিকে তারা একই পর্যায়ে ফেলেছে। ছাত্ররা রাজনীতি করবে না, এটা এক হিসেবে ঠিক আছে।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন না হলে ৭১ সালে স্বাধীনতা আন্দোলন হত না। ৫২ সালে আন্দোলন করেছে কারা? বয়স্করা তো করেনি, তরুণ ছাত্ররা করেছে। সে সময় তাদের আত্মত্যাগকে তখনকার মূখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন যেভাবে সমালোচনা করেছিলেন, আমরা তো সেই ভাষায় তাদের অপমান করেছি। যদি রাজনীতি করাটা অন্যায় হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের শহীদরা যা করেছেন সেটা ঠিক হয়নি। এখন বলি চীনে একটি পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় আছে আপনারা জানেন। ৭০-এর দশকে পিকিং শব্দটির বানান বদলে গেছে। চীনে এর সঙ্গতিপূর্ণ নাম বেইজিং। আগে পেইজিং লেখা হত। কিন্তু পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় বলছে, আমরা আমাদের নামের বানান বদলাব না। এখনও ওরা পিকিং লেখে। তাই রাষ্ট্র চায় না পিকিং নামটি বেইজিং হয় ইংরেজিতে।

১৯১৯ সালের ৪ঠা মে যখন ভার্সাই চুক্তি হচ্ছিল ইউরোপে, যুদ্ধোত্তর চীনের ভাগ্য কী হবে? চীনের প্রজাতন্ত্র সরকার ১৯১১, ১২ সালে জাতীয় স্বার্থকে বিসর্জন দিতে চেয়েছিল। এতে প্রতিবাদ করে ছাত্র-যুবকরা। প্রায় তিন হাজার ছাত্র রাস্তায় বেরিয়ে মিছিল করে এবং একজন মন্ত্রীর বাড়ির সামনে আগুন ধরিয়ে দেয়। এখন চীনে যে আন্দোলন চলছে সেই আন্দোলন অন্যরকম। কাজেই রাজনীতিকে ছোট করার কিছু নেই। আমি মনে করি এই যে হেফাজতে ইসলাম যদি রাজনীতি করে তাহলে তারা কোনো ভুল করছে না। আসলে রাজনীতিটা কী এটাই বলা দরকার। এখানে কওমি শিক্ষা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিষয়টিতে আমি অন্যায় দেখতে পাচ্ছি। আমাদের আলোচনা করা দরকার জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে। আমরা ধরে নিচ্ছি, রাজনীতিতে কোনো অন্যায় নেই। সেটাই আদর্শ এবং উত্তম। এর মধ্যে কওমি শিক্ষার ত্রুটি বা গ্রহণযোগ্যতা কোথায় এটাই আমরা আলোচনা করছি। আমরা মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং, আর্কিটেকচার পড়াচ্ছি। কওমি মাদ্রাসায় সেগুলো পড়াচ্ছে না। সেখানে কী পড়াচ্ছে তা আমাদের ঠিকমতো জানা নেই। মনে রাখতে হবে, শিক্ষায় কমপক্ষে দুটো জিনিস করে। এক বেকারত্ব দূর, অর্থাৎ এটা আপনাকে ব্যবসা বা চাকরিতে সুযোগ দেবে। আরেকটা হচ্ছে চরিত্র গঠন। আমার পরিচিত একজন বন্ধু নুরুল মোমিন ভূঁইয়া, যিনি পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃতত্ত্ব বিষয়ে পিএইচডি করেছেন। তিনি সিলেটের বিশ্বনাথে একটি মাদ্রাসায় তার থিসিস পেপারের গবেষণার কাজ করেছিলেন। তার সেই থিসিস পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তিনি দেড় বছর সেই মাদ্রাসায় থেকেছেন। তখন সেখানকার শিক্ষকদের জিজ্ঞেস করেছেন যে আপনারা কী উদ্দেশ্যে এই মাদ্রাসা তৈরি করেছেন? সে এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। সে জিজ্ঞেসা করেছিল আপনাদের শিক্ষার উদ্দেশ্য কী? ওরা বলেছে আমরা সাচ্চা মুসলমান তৈরি করতে চাই। আমাদের সেই বন্ধুটি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। সে বলেছে, তারা যদি বলত আমরা সাচ্চা মানুষ তৈরি করতে চাই তাহলে আমিও তাদের সঙ্গে একমত হতে পারতাম। সে তখন দাঁড়ি রেখেছিল, এখনও কাটেনি। তার কথা, আমি যে মাদ্রাসায় ছিলাম সে মাদ্রাসায় ছাত্রদের সঙ্গে যদি কখনও দেখা হয় তারা ভাববে গবেষণা করতে গিয়ে দাড়ি রেখেছিলাম, এখন সেটা কেটে ফেলেছি। আমি তাদের সঙ্গে এই বেইমানি করতে চাই না। সে বলল যে, ওখানে থেকে যে আখলাক বা চরিত্র গঠন শিখেছিলাম সেটা আমাকে পরিবর্তন করে ফেলেছে। আমাদের ইংরেজি শিক্ষার মধ্যে এটা পাই না।

ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত সব লোকই যে চরিত্রহীন, তা বলা ঠিক নয়। দয়া করে আমাকে ভুল বুঝবেন না। শিক্ষা যে চরিত্র গঠন করে সেটা যদি আমরা বারবার মনে করিয়ে না দেই তাহলে আমাদের শিক্ষার মান অর্ধেক হয়। আপনারা জানেন ইংরেজি শিক্ষকদেরও শিক্ষক ফরাসি দেশের দার্শনিক রুশো একটি বই লিখেছেন। তাতে তিনি বলেছেন যে ষোল বছর বয়সের নিচে বাচ্চাদের হাতে একটাও বই দেওয়া দরকার নেই। তারা শিখবে প্রকৃতি থেকে। তারা শিখবে খোলা হাওয়ায়। লেখাপড়া শিখবে তারা প্রকৃতির কাছ থেকে। তার মতে বই হল একটা করাপশন। যাই হোক আমরা যে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা বা ইংরেজি শিক্ষার কথা বলি। এটাকে আমরা সর্বোচ্চ আদর্শ মনে করে মাদ্রাসা শিক্ষার সমালোচনা করি। দিল্লির মামলুক সুলতান মোহাম্মদ বিন তুঘলকের আমলে বেশ কিছু মাদ্রাসা ছিল। বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের জন্য সোনারগাঁয়ে যারা মাদ্রাসা তৈরি করেছিলেন সে মাদ্রাসা চলত কী করে? আইয়ুব সাহেবের একটি বই আছে, ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত, সেটা কিনে আমি পড়েছি। সেখানে লেখা আছে আগে ইংরেজরা আসার আগ পর্যন্ত এ দেশের মোট জমির শতকরা ২৫ ভাগ ব্যবহার হত ওয়াকফ সম্পত্তি হিসেবে। আমাদের তিনটি প্রশ্ন করতে হবে। এক. মাদ্রাসা শিক্ষা চলে কার টাকায়? আমাদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চলে কার টাকায়? আগে ল্যান্ডগ্রান্ডের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পশ্চিমেও তাই হয়। এইখানে মানুষ ধর্মীয় কারণে নিজেদের জমি মাদ্রাসার জন্য দান করেছে। এগুলো ওয়াকফ আকারে চলবে। কলকাতায় হেস্টিং সাহেব আলীয়া মাদ্রাসা করেছেন। ঢাকায় বিভাগোত্তরকালে এখানেও অনেক মাদ্রাসা হয়েছে। সেগুলো তারা করেছে মূলত ফার্সি ভাষার কর্মচারী তৈরি করার জন্য। কিন্তু সেটা দিয়ে তো শিক্ষাব্যবস্থা চলতে পারে না। কিছুদিন পরে তারা ফোর্ড উইলিয়াম কলেজ তৈরি করেছে। এরপরও তারা আরও কিছু কলেজ তৈরি করেছে। এগুলো তো শিক্ষার মডেল হতে পারে না। এখন ইতিহাসকে আমরা মাইনোরিটি করে ফেলি। শুধু একটা এর স্লাইস দেখাই। তাহলে তো অবিচার হয়। আমাদের শিক্ষার মধ্যে কোথাও একটা ক্রটি আছে। ইতিহাসবিদদের ক্রটি আছে। কওমি মাদ্রাসার একজন ভারতীয় গবেষক , উনি আমেরিকায় পড়ান। ভদ্রমহিলা একবার ছাত্রদের জিজ্ঞেস করেছিলেন ১৯৪৭ সন কী? তারা বলে জানি না। ইতিহাস বিষয়ে এসব ছাত্র যে কত নিন্মগামী কী বলব। এরপর তারা বলেছিল কী হয়েছিল যেন? মাওলানারাও নিজেরা জানেন তাদের মধ্যে কোনো ঐকমত্য নেই। মাদ্রাসার সিলেবাস নিয়ে কথা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। ভিতর থেকে দাবি উঠছে এটা বদলাতে হবে। এটা ভেতর থেকে উঠে আসতে হবে। কিন্তু ভেতর থেকে কী উঠে আসবে এটা আমি খুব সংক্ষেপে বলি। আমরা যে সমালোচনা করছি, তারা যে লেখাপড়া করাচ্ছেন-- তারা বলছেন সিলেবাসের দুটো বড় অংশ। একটা হচ্ছে আল উলুম নফলিয়া অর্থাৎ যেটাকে আমরা বলি ‘চলিয়া আসিতেছে’।
সেখানে কোরআন, হাদিস শোনানো হবে, তাফসির শেখানো হবে। তাতে কী আছে? সেটাতে স্টান্ডার্ড সিলেবাস তৈরি করে এমনকি মুসলমানদের মিরাজ এবং সম্পত্তি ভাগাভাগি কীভাবে হবে সেটাও এর সঙ্গে পড়ে। এখানে আরেকটা শব্দ আছে আল উলুমুল আকোলিয়া। যেখানে সাইকোলজি, হিকমত এগুলো থাকবে। আমরা বলি যে দুনিয়াবি শিক্ষা শিখতে হবে। কিন্তু মাদ্রাসার ছেলেরা তা নয়। আগে তো ইউনানি বা কৃষি এগুলোর চল ছিল। এগুলো হল ব্যবহারিক শিক্ষা। এগুলো শিখবে না কেন? তাহলে শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সিলেবাস নিয়ে আমাদের আলোচনা করতে হবে। কি শেখানো হয় মাদ্রাসায় এবং কি শেখানো হয় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে? তুলনা করুন। আমি বলব আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং, এগ্রিকালচার প্যাটার্ন যদি বাদ দেন আমি আইন পড়েছি বিশ্ববিদ্যালয়ে, অর্থনীতি পড়েছি এবং আমি অন্যান্য বিষয়ও পড়ি।
আমি জানি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বা শিক্ষাব্যবস্থার কনটেন্ট এর চেয়ে ভালো নয়। আমি একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পড়াই। সেখানে একজন বিখ্যাত চিত্রগ্রাহক আনোয়ার হোসেনও পড়ান। তিনি সেদিন আমাদের শিক্ষকদের বলছিলেন তার ক্লাসে ৪০ জন ছাত্র আছে। তিনি তাদের চলচ্চিত্র শব্দটি বানান করতে বলেছিলেন, ৪০ জন ছাত্রের মধ্যে একটি ছাত্রও সেটার শুদ্ধ বানান করতে পারেনি। এই হল আমাদের নন-কওমি শিক্ষা। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম ঠিকই বলেছেন, আগে বলুন শিক্ষা কোন মিডিয়ামে হবে? আমাদের বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসা যারা তৈরি করেছেন আমি সবিনয়ে তাদের বিষয়ে দু-একটি সমালোচনা করব। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে আমাদের শিক্ষার ভাষা হল আরবি, উর্দু, ফার্সি কিংবা ইংরেজি। ১৮৮২ সালে হান্টার একটি বিষযে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বলেছেন বাঙালি মুসলমানদের মাতৃভাষা উর্দু। বাঙালি মুসলমানরা, যারা অভিজাত আছেন তারাই মুসলমান, আমাদের তো তারা মুসলমান মনে করেন না। আর ব্রাক্ষণরা তো মনে করেছিল, আমরা মানবজাতির না, দানবজাতির। এই যে অনুমান এগুলোই শ্রেণিবিভেদ। আমাদের মওলানা সাহেবরাও ভুল করলেন। তারা তাদের শিক্ষার মাধ্যম বাংলায় করলেন না। শুধু একা তাদের দোষ দেই না, আমরাও তো বাংলা করি নাই। অন্তত এখন পর্যন্ত করতে পারি নাই। এটা হচ্ছে আমাদের প্রথম ভুল। দুই নম্বর হচ্ছে শিক্ষার বিষয়বস্তু। যেখানে আমি আগেই বলেছি ইলমুল নফলিয়াত চলবে না। নফলিয়াতে দুটো সুন্দর ভাষা আছে। একটা আদব একটা কায়দা। আমরা একসঙ্গে আদবকায়দা বলি। মাদ্রাসার একটি ডিগ্রির নাম ফাজিল। আমরা কথায় কথায় বলি ফাজলামো করিস না। অথচ ফাজিল একটি সন্মানিত ডিগ্রি। আগে এটা মেট্রিকের সমান ছিল। এখন ইন্টারমিডিয়েটের সমান করা হয়েছে। এছাড়া মুন্সি, আলেম, কামেল, মোনতাসে মোহাদ্দিস এমনকি আপনারা অনেকে পিএইচডি ডিগ্রি লেখেন। এই বিষয়গুলো আমরা ঠিকভাবে বুঝতে পারি না। তুরস্কে মোস্তফা কামাল কীভাবে মাদ্রাসা শিক্ষাকে বদলে ফেলেছিলেন ভাবাই যায় না। মোস্তফা কামালের যত দোষ থাকুক, উনি কিন্তু ইংরেজদের নিকট আত্মসমর্পণ করেননি। তিনি বলেছিলেন আত্মসমর্পণ করার যখন উপায় নাই, তখন নিজেই ইংরেজ হয়ে যাই। তিনি হ্যাট পরে নিয়েছিলেন।

আমিও আপনাদের কথার সঙ্গে একমত যে, শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে রাজনীতি থাকতে হবে। হেফাজতে রাজনীতি নেই এটা ঠিক নয়। তারা প্রথম যখন ১৩ দফা প্রকাশ করলেন তখন আমার সৌভাগ্য হয়েছিল একটি টিভি সাক্ষাৎকারে যাওয়ার। আমি একজন মওলানাকে বললাম যে আপনারা বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছেন। ৫ ফেব্রুয়ারি যখন ছাত্ররা গণজাগরণ মঞ্চ করল, আর আপনারা ৯ মার্চ থেকে ১৩ দফা নিয়ে নামলেন। এর আগে নামেন নাই কেন? এরপর আবার মিথ্যা কথা লিখলেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ মিথ্যা কথা পছন্দ করেন না। আপনারা লিখলেন কি? বায়তুল মোকাররম মসজিদসহ দেশের নানা মসজিদে নামাজ পড়তে দেওয়া হচ্ছে না। কথাটি কি আসলে ঠিক ছিল? আসলে ২২ ফেব্রুয়ারি কী হয়েছিল? সেখানে সাংবাদিকসহ অনেক লোক আহত হয়েছে। তাই উত্তর গেট বন্ধ করে পূর্ব ও পশ্চিম গেট খুলে দেওয়া হয়েছিল। আপনারা বিষয়টির অপব্যাখ্যা করলেন। আপনারা মিথ্যা কথা বললেন। বললেন দেশের কোনো মসজিদে নামাজ পড়তে দেওয়া হচ্ছিল না? নিজের ধর্ম পালনে বাধা দিলে শুধু সেই সম্প্রদায়ের লোকরা প্রতিবাদ করবে না, সকল নাগরিকের দায়িত্ব প্রতিবাদ করা । আপনারা শুধু নিজেদের কথা বলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে একশ’য়ের মতো মন্দিরে আগুন দেওয়া হল। তখন আপনারা কি কোনো প্রতিবাদ করেছেন? কেউ প্রতিবাদ করেননি। ফরহাদ মজহার একটি কমিটি করলেন। আমি বলব উনি এক ভণ্ড দেশপ্রেমিক। উনি বললেন, হেফাজতের লোকদের রাস্তায় রাস্তায় পানি দেন, রুটি দেন; কিন্তু মন্দিরে হামলার বিষয়ে কোনো প্রতিবাদ করলেন না। পরে তের দফায় আপনারা সংশোধন করেছেন। সবশেষে লিখেছেন সংখ্যালঘুদের অধিকার সংরক্ষণ করতে হবে। এটা হল বাস্তববুদ্ধির পরিচয়। আমি প্রার্থনা করি আপনাদের বাস্তববুদ্ধির উদয় হোক।

আমাদের দেশের রাজনীতিতে সকলই অংশগ্রহণ করতে পারে। কেন মওলানা সাহেবরা অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। এটা তাদের নাগরিক অধিকার। কিন্তু সেটা হতে হবে ঐকমত্যের ভিত্তিতে। আমি জানি হুকমত শব্দটির অর্থ ন্যায়বিচার। ন্যায়বিচার শব্দটির বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ধর্মহীনতা। আপনি যদি কোনো জায়গায় বিচারক হন আপনার পুত্র কন্যা সেখানে বিচারপ্রার্থী হয়, অভিযুক্ত হয়-- তাহলে আপনি বিব্রতবোধ করবেন, আপনি সরে দাঁড়াবেন। এটা হল ন্যায়বিচারের মাপকাঠি। কাজেই রাষ্ট্র বিশেষ কোনো ধর্মকে বা কোনো ধর্মের গোষ্ঠীকে পক্ষপাত করবে না। শুধু ‘হিন্দু মুসলমান হিন্দু মুসলমান’ করে কিছু হবে না।

আজকে যে কারণে আমাদের আলোচনা করতে এত অসুবিধা হচ্ছে-- সেটা বলি। সারাবিশ্বে দুটো ঘটনা ঘটেছে। এক হচ্ছে রাশিয়া আক্রমণের পর আফগানিস্তানে আমেরিকানরা মুসলমানদের মধ্যে জেহাদি মনোভাব গড়ে তোলার জন্য অনেক টাকা খরচ করেছে। সেদিন হিলারি ক্লিনটন নিজেই বললেন, আল কায়েদা আমাদের তৈরি। এখন আমেরিকা এবং আল কায়েদা দুটোই সারাবিশ্বের মুসলমানদের জন্য শত্রু। কাজেই আপনাদের কোন পথে লড়াই করতে হবে সেটা ঠিক করুন। তবে আল কায়েদার মতো সন্ত্রাসী পথে যাবেন না। তাহলে কোন পথে যাবেন? গণআন্দোলন এবং গণজাগরণ ছাড়া আর কোনো পথ নেই। আপনাদের এত তাড়াহুড়ো কেন? ৫ ফেব্রুয়ারি দেশে গণজাগরণ মঞ্চ হয়েছে। কেননা এর আগে একটি রায় হয়েছে সেটা ছাত্ররা মেনে নিতে পারেনি। আমি তাদের ছাত্রই বলছি। এরপর আপনারা ৯ মার্চ তের দফা দিলেন। সেটা আগে দিলেন না কেন? গণজাগরণ মঞ্চের পরে দিলেন কেন? এর আগে ২০১০ সালে হেফাজতে ইসলাম দলটি গঠিত হয়েছে। কিন্তু তাদের তের দফা করার সময় হল ছাত্ররা আন্দোলন করার এক মাস পাঁচদিন পর। এপ্রিল মাসে সেটা আপনারা সংশোধন করলেন। আবার এ মাসেই একটি প্রোগ্রাম দিলেন। ঢাকায় আসলেন আবার চলেও গেলেন। ৫ এপ্রিল এমন প্রোগ্রাম দিলেন যেন আপনাদের তর সইছে না। কেউ যদি আল্লাহ-রাসুলের প্রতি অপমান করে তাদের খুঁজে বের করুন। একটা বিচার প্রক্রিয়া আছে। এ জন্য অনুসন্ধান দরকার। সরকারের সাহায্য নিন। এ বিষয়ে সরকার কাজ না করলে সরকারকে উস্কে দিতে পারেন। নির্বাচনের দাবি করতে পারেন; অথবা যারা নির্বাচনে ইশতেহার দেবে তাদের বলতে পারেন। যাক, এবার মূল কথায় আসা যাক। শিক্ষা যদি চরিত্র গঠন এবং পেশা সৃষ্টিতে সাহায্য করে, তবে ইসলামি শিক্ষারও প্রয়োজন আছে। এটা আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে-- শুধু ইসলামি শিক্ষা দিয়ে হবে না। আরও কিছু শেখা প্রয়োজন। মাদ্রাসা শিক্ষা একপেশে শিক্ষা। শুধু চরিত্র গঠন করে কিছু হবে না। যদি অন্যান্য শিক্ষা গ্রহণ না হয়। তাহলে আপনি আধুনিক পৃথিবীর প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাবেন।

আমাদের দেশের বিখ্যাত লেখক আহমদ ছফা ১৯৯৮ সালে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সেটা ছিল কামরাঙ্গিরচর মাদ্রাসায় শিক্ষাবিপ্লব। উনি সেখানকার একজন হাফেজ্জি হুজুরের কাছে যেতেন। হাফেজ্জি হুজুরের অনেক শিষ্য ছিলেন। তিনি তাদের সঙ্গে কথা বলতেন। একদিন তাদের সঙ্গে কথা বলে জানেন, তারাও মাদ্রাসার পাশে জিজ্ঞিরায় যেমন টেকনিক্যাল শিল্প হয়, সে রকম টেকনিক্যাল স্কুল খোলার কথা ভাবছেন। এটা শুনে আহমদ ছফা বললেন, মাদ্রাসার ছাত্ররা অন্য কাজ শিখবে না কেন? এটা তো সত্যি যে আমাদের মসজিদের জন্য মওলানা, খতিব, মোয়াজ্জেন হওয়ার জন্য তাদের মাদ্রাসা শিক্ষা দরকার। কিন্তু এর বাইরে যারা আছেন তারা কী করবেন? এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় তিনি ঐ প্রবন্ধটি লিখেছিলেন। আমি যে ইউরোপীয় শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলছি তা নয়। আমাদের দরকার আমাদের মতো শিক্ষাব্যবস্থা। তাহলে মাদ্রাসা শিক্ষার ছাত্ররা কেন রাজনীতি করবে না। তাদের শিক্ষানীতিতে তাদের কী ভূমিকা আছে? আমরা জাতীয় শিক্ষানীতির কথা বলছি। আমার মনে হয় এটা উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া। আমরা যেমন কোরআন হাদিস পারি না। এ বিষয়ে আমরা মুর্খ। তেমনি আপনারা প্রকৃত জগতের বিষয়ে কী পড়েন?

মুহম্মদ নূরুল হুদা :

অত্যন্ত বাস্তবসঙ্গত কথা। কেউ ধর্মগ্রন্থ পড়ে না, আবার কেউ পার্থিব বিষয়ের চর্চা করে না। সলিমুল্লাহ খান একটি বাস্তবতার দিকে ইঙ্গিত করলেন। এবার উপস্থিত সুধীবৃন্দের মধ্য থেকে কোনো প্রশ্ন থাকলে করতে পারেন।

সাজেদুল হক :

রাসুল (সা.) তার সময় যেভাবে বাস্তবতার নিরিখে তার জীবনবোধ থেকে যে শিক্ষা কওমি মাদ্রাসায় দিয়ে গেছেন, আজকে কি সে রকম শিক্ষা দেওয়া হয়?

মুফতি মিযানুর রহমান সাইদ :

আমাদের প্রতিষ্ঠানে ইসলামি অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতির উপর এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থার উপর আমরা ক্লাস নিয়ে থাকি। ছাত্রদের পড়াই। মূল ছয়টি বিষয়কে গুরুত্ব দেই। দাওরা শরীফ থেকে বেশি শিক্ষা দেওয়া সম্ভব হয় না। ফেকাহ বিভাগ থেকেও কম শিক্ষা দেওয়া হয়। ব্যবসা, সুদবিহীন ব্যবসা বা সুদের সমস্যা এসব অর্থ ব্যবস্থার মধ্যে এসে যায়। এছাড়া রাজনীতি এবং রাষ্ট্রনীতি-- এগুলো পড়ানো হয়। এগুলোর কোনো বাস্তবায়ন আপনারা দেখতে পান না। আল্লাহর রাসুল তার সময়কে যেভাবে বদলে দিয়েছেন সে রকম তো আমরা পারব না। এখন আমাদের সমাজে সে রকম বিজ্ঞ আলেম অনেক কম। থাকলেও ইসলামবিরোধী শক্তি এত শক্তিশালী যে তারা অনেক কিছু করতে পারেন না।

সলিমুল্লাহ খান :

আমি একটা কথা বলব। আপনারা মাদ্রাসায় কী পড়ান আমি জানি না। আগে দারসে নিযামির কথা বলেছেন। উনি মারা গেছেন। সেই সময় থেকে পৃথিবী বদলাচ্ছে, সিলেবাস বদলাচ্ছে। আপনাদের কতটা বদল হয়েছে জানি না। ইসলামি ফিলসফিতে যেটা বলা হয় যে, কোরআন হাদিসকে রেফারেন্স দিয়ে প্লেটোর কথাগুলোকে প্রমাণ অথবা অপ্রমাণ করা হয়। এ রকম যদি চলে, তাহলে কি হবে? অ্যাডাম স্মিথ লিখেছেন ‘নানা জাতির ধন-দৌলত’।
সেটা আমাদের মাদ্রাসায় কেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়ানো হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের বয়স হল আশি বছর। আমি বলব অর্থনীতির ইতিহাস জানেন, এমন একজন শিক্ষকও সেখানে নেই। গত নব্বই বছরেও তাদের পক্ষে ওয়েলথ অব নেশন-এর বাংলা অনুবাদও তাদের পক্ষে করা সম্ভব হয়নি। আমি আপনাদের সিলেবাস জানি না। তবে ভারতের একটি মাদ্রাসার একটি সিলেবাস কনসাল করে দেখেছি। যে মহিলা বইটি লিখেছেন তার নাম বারবারা। উনি শুধু সেখানে দেখিয়েছেন ১৮০৭ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত। তার সেই সিলেবাসে দেখলাম প্লেটো অ্যারিস্টটল পড়ানো হবে। কিন্তু হিউম, কান্ট, হেগেলের নাম নেই। ওরা তো মুসলমান ছিলেন না, ওদের বই কেন পড়ানো হবে। অথচ আধুনিক দার্শনিকদের বই পড়ানো যাবে না কেন?

আপনারা বলছেন ব্যাংকিং পড়ানো হয়। কী পড়ান সেখানে? এই যে ইসলামি ব্যাংকের কথা বলছেন, সেখানে সুদের নামে কী হচ্ছে? আমি যদি সুদ নামটা বাদ দিয়ে লাভটা গ্রহণ করি তাহলে এর শোষণচরিত্র বন্ধ হয় না। আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন, কিন্তু সুদকে নিষেধ করেছেন। তাহলে জানতে হবে সুদ কাকে বলে? এর চরিত্র কী? এবং ব্যবসার মধ্যে মুনাফার চরিত্র কী? এই তিনটি জিনিসের চরিত্র কার্ল মার্কস নামে একজন ইহুদি পণ্ডিত নিরূপন করেছেন। তিনি বলেছেন, খাজনা, মুনাফা এবং সুদ তিনটিকে বলে উদ্বৃত্ত মূল্য। শ্রমিককে বঞ্চিত করে মালিকের হাতে যা থাকে তার নাম সারপ্রাস ভেলু। এটাকে নানা নামে মানুষের মধ্যে বন্টন করা হয়। আমরা যে উচ্চ দালানে বসে আছি এর মধ্যে সেই বন্টন আছে। এগুলো তো কার্ল মার্কসের বইতে লেখা আছে। সেটা একটা সাইন্স।মাদ্রাসায় কেন কার্ল মার্কসের দাস ক্যাপিটাল পড়ানো হবে না? আমরা কি সিলেবাসে এসব আলোচনা করতে পারব? তাহলে প্লেটো অ্যারিস্টটল আমরা কীভাবে পড়াব? এই কথাগুলো মোকাবেলা করার মতো সাহস আমাদের হোক এটাই প্রার্থনা করি।

মওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ :

আপনারা যারা কলেজে পড়াচ্ছেন তাদের সঙ্গে আমাদের মাদ্রাসার শিক্ষকদের যে দূরত্ব এটা একটা সমস্যা। এ জন্য আমি বলি, এসব কাগুজে শিক্ষার কথা। বারবারার কথা আমি জানি। ও দীর্ঘদিন মাদ্রাসায় ছিল। আমি একটি ঘটনার কথা বলি। আমেরিকার একজন কর্মকর্তা আমাদের মাদ্রাসায় এসেছিল। এসে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে এদিকওদিক তাকায়। আমি বলি কী হয়েছে? উনি বললেন, আমি এখানে আসার আগে সবাই আমাকে সাবধান করে দিয়েছে যে ওরা তোমার কল্লা নিতে পারে। কিন্তু আমি তো দেখছি এখানে সবাই পড়ালেখা করছে। এ জন্য বলি আমাদের পরস্পরের মধ্যে আদানপ্রদান দরকার। একজন আরেকজন সম্পর্কে জানাও ভীষণ প্রয়োজন।

তাহলে এসব সমস্যা থাকবে না।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম :

আমাদের আগের এবং পরবর্তী আলোচনা বেশ শান্তিপূর্ণভাবেই হয়েছে। তবে একটি জিনিস বুঝতে পারলাম আমাদের মধ্যে আন্ত‍:যোগাযোগের সমস্যা রয়েছে। আমরা একটি জাতি। কিন্তু এর মধ্যে নানা শ্রেণি তৈরি হবে এবং ওই শ্রেণিগুলোর মধ্যে নানা চিন্তাধারা কর্মধারা প্রবাহিত হবে অথচ সেটা কেউ জানবে না-- এটা একটি জাতীয় দুর্বলতা। সলিমুল্লাহ যেভাবে বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন তাতে তার অসাধারণ পাণ্ডিত্য বোঝা গেছে। আমরা তার চিন্তাধারা বুঝতে পেরেছি। আসলে আমরা সবাই শান্তি চাই, ঐক্য চাই। বুঝতে হবে। বুঝতে পারলে অনেক সংগ্রাম, সংঘর্ষ কেটে যাবে। আমাদের আজকের আলোচনা আমার কাছে বেশ ফলপ্রসূ মনে হয়েছে।

অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমদ :

এখানে এসে অনেক কিছু জানলাম, শিখলাম। খোলামনে আলোচনাটার দরকার ছিল। আসলে আমাদের শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য জ্ঞান অর্জন করা। অনেকের ধারণা মাদ্রাসায় বুঝি পুরাতন ঐতিহ্যের জ্ঞানকে সংরক্ষণ করা হয়। নতুন কোনো জ্ঞান সৃষ্টি করা হয় না, এটা ঠিক নয়।


সলিমুল্লাহ খান :
নতুন কথা কিছু নয়। তিনটি প্রশ্ন আছে। এক. আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় কী পড়ানো হবে। দুই. কোন ভাষায় পড়ানো হবে। আমাদের দীনি শিক্ষা যে পড়ানো হচ্ছে, এতে কোনো বিতর্ক নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এটা সমসাময়িক করা যাবে কি না? আমরা বুঝতে পারছি মাদ্রাসা শিক্ষার মাধ্যম এখন বাংলা হওয়া উচিত। আমাদের অন্যান্য শিক্ষা কেন বাংলায় হবে না। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা হল মৌলিক শিক্ষা। উচ্চশিক্ষা অপশোনাল। সারাবিশ্বে মৌলিক শিক্ষার বয়স বার বছর। তবে ইদানিং দেখা যাচ্ছে জাতিসংঘসহ আমাদের বাংলাদেশে তিন চার বছর বস্তির শিশুদের শিক্ষা দেওয়ার পর বলা হচ্ছে তোমার পড়া শেষ। তাদের সনদ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা ঠিক নয়। এটা একটা প্রতারণা। পৃথিবীর সব দেশে মৌলিক শিক্ষার বয়স কমপক্ষে বার বছর। কিন্তু আমাদের এখানে এসব বিষয় ঠিক করতে হবে।

মুহম্মদ নূরুল হুদা :

আমরা যে উদ্দেশে এই বৈঠকের আয়োজন করেছিলাম তা বহুলাংশে সফল। আমরা এ পর্যায়ে এসে পড়েছি। আলোচনা শুরুর আগে এখানে অনেকে কওমি শিক্ষা কী বা এর সিলেবাস কী রকম-- এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তারই পথ ধরে আমরা শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্নতা, তার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত ও সবশেষে বতর্মান রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে হেফাজতসহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উত্থান লক্ষ করছি। সুনীতিশীল ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের বাস্তবায়নে আমাদের সবাইকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে ও আলোচনার মাধ্যমে এগিয়ে আসতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহিত বাংলাদেশে এ পথেই একটি মঙ্গলময় ও সৃষ্টিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।

Sunday, June 23, 2013

আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই


আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই , বঞ্চিত করে বাঁচালে আমায়!
শবে বরাতের রাতে কতো প্রত্যাশা কতো জনের !! প্রত্যাশা মতো ভাগ্য খুলে গেলে প্রাণে খুশির জোয়ার! আর নাহয় তো হতাশায় ডুবে যাওয়া... এই তো জীবন!!...
ছোটবেলায় এই রাত টির জন্যে অপেক্ষায় থাকতাম.... মোমবাতি , আতশবাজি নিয়ে আসতেন বাবা। আর মা সারাদিন ব্যাংকিং, মহিরা পরিষদ এর মামরা মোকদ্দমা - আন্দোলন সংগ্রাম সেরে বুটের ডালের হালুয়া, পরোটা, ঝাল ঝাল মুরগীর মাংস, গরুর মাংস, আরো নানান নাশতা নিয়ে বাপ্পুর বাসা, ফুইয়া দের বাসা, খালাম্মাদের বাসা , মামা দের বাসায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা! কী অপূর্ব বন্ধন! পারিবারিক একাত্মতা ধরে রাখার একনিষ্ঠ প্রয়াস! আমি নিজের অবস্থান থেকে ভাবতে থাকি -আমার বাস্তবতা আমার পারিপার্শ্বিকতা এতো বিরূপ কেন? এখনো আম্মু তার এ চর্চা ধরে রাখতে পেরেছে! আর আমি এখনো অস্তিত্বের সংগ্রাম করে চলেছি!

আব্বু পাথরঘাটার বাড়িটা তোলার পর আমরা নীচতালায় থাকতাম। ঘরের সামনের সিঁড়ি তে সুন্দর করে নানান রঙ্গের মোম জ্বালাতাম। আব্বুর হাতে ছোট ছোট মোম আর অনেক বাজি! আমি ভাইয়া, অমি< ইশতিয়াক... সবার হাতে হাতে মোম আর বাজি!! শিশুদের আনন্দ দেবার জন্যে বাবার যে কী উৎসাহ!!
মোমের আলোয় কী সুন্দর আলোর সারি !! আর অনেক বাজির মধ্যে তারা বাজি হাতে নিলেই কী ভয় যে লাগতো! আবার আনন্দ ও পেতাম খুব!
আব্বুর মনের ভেতর আমৃত্যু এই শিশুতোষ - শিশুপ্রেমী মন ছিল। আমার বিয়ের পর ও শবেবরাতের সন্ধ্যায় বাবা একইভাবে মোম আর বাজি নিয়ে গিয়েছিলেন! আরো কতো কী যে নিতেন! লুডু ও নিয়ে যেতেন! বলতেন বাড়ির বৌয়েরা একটু অবসরে খেলবে বাচ্চাদের নিয়ে!!একটি রক্ষণশীল পরিবারে বাবার এমন প্রস্তাব এর যে কী ভয়াবহ আর বিপরীত প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো! সেসব মনে হলো হঠাৎ নিজেকে এতো বেশী অপরাধী মনে হয়!!

সব থেকেই একদিন বঞ্চিত হতে হয় মানুষ কে!

Saturday, June 22, 2013

PEW জরীপ - বাংলাদেশের শরিয়াকরণ - ১০নং মহাবিপদ সংকেত?- হাসান মাহমুদ


কোনো জরীপই এবসলিউট নয়, কিন্তু নিরপেক্ষ,বস্তুনিষ্ঠ ও একাডেমিক হিসেবে PEW-এর খ্যাতি আছে। গত সপ্তাহে PEW একটা জরীপ প্রকাশ করেছে, নাম The World’s Muslims: Religion, Politics andSociety (বিশ্বমুসলিম - ধর্ম, রাজনীতি ও সমাজ)।
এ জরীপের ওপর কিছু প্রশ্ন পাঠিয়েছি ওদেরকে, এলে সবাইকে জনাব। এতে বাংলাদেশও আছে, আমি প্রধান ৫টি প্রশ্নোত্তর দেখাচ্ছি:-

**প্রথম ৩টি জরীপ সাধারণ মুসলিমের মধ্যে:-

১.শারিয়া আইন হল আল্লাহ'র নাজিলকৃত আয়াত -সর্বোচ্চ - জর্ডন ৮১%, সর্বনিম্ন - আলবেনিয়া ২৪%, বাংলাদেশ ৬৫%, পাকিস্তান ৮১%

২.শারিয়া আইন একটাই, বিভিন্ন নয় বলে মনে করেন - সর্বোচ্চ - তাজিকিস্তান ৭০%, সর্বনিম্ন– তিউনিশিয়া ২০%, বাংলাদেশ ৫৭%, পাকিস্তান ৬১%

৩.নিজের দেশে শারিয়া আইন চান - সর্বোচ্চ - আফগানিস্তান ৯৯%, সর্বনিম্ন আজারবাইজান ০৮%, বাংলাদেশ ৮২%, পাকিস্তান ৮৪%

**পরের জরীপগুলো শুধুমাত্র শারিয়া সমর্থকদের মধ্যে:-

৪. ব্যাভিচারীকে প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করেন - সর্বোচ্চ- পাকিস্তান ৮৯%, সর্বনিম্ন- বসনিয়া ২১%
বাংলাদেশ ৫৫%
৫. মুরতাদ অর্থাৎ ইসলাম-ত্যাগীদের মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করেন - সর্বোচ্চ - আফগানিস্তান ৭৯%, সর্বনিম্ন - কাজাখস্তান ০৪%, বাংলাদেশ ৪৪%, পাকিস্তান ৭৬%
অনেকে বলবেন - "যা: বাংলাদেশ হবে শরিয়া রাষ্ট্র!! উন্মাদের প্রলাপ !!" একথা আমাকে ১৯৭৫ সালের দিকে বলেছিল পাকিস্তানীরা ও ইরানীরাও, আবুধাবীতে। পরে যখন গঠনতান্ত্রিকভাবে ওগুলো শারিয়া-দেশ হয়ে গেল ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে, ওরা শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকেছে আর এখন মোল্লাতন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসার প্রাণান্ত চেষ্টায় রক্ত ঢেলে চলেছে। তাই ভুল যদি করতেই হয় চলুন আমরা দড়িকে সাপ মনে করার ভুল করি, সাপকে দড়ি ভাবার মত ব্লান্ডার না করি। আমাদের শরিয়া-করণ হচ্ছে রাজনীতি নিরপেক্ষ পদ্ধতিতে যা ওদের চেয় ভিন্ন। অর্থাৎ শারিয়া-পন্থীরা ক্ষমতায় থাকুক বা না থাকুক গত বহু বছর ধরে এই প্রক্রিয়ায় দেশ শারিয়ার দিকে এগিয়ে গেছে। আমরা পছন্দ করি বা না করি এর প্রচণ্ড প্রভাব এর মধ্যেই আমরা দেখছি। ক্রমাগত দুর্বল সরকারের ওক্রমবর্ধমান দুর্র্নীতির সুযোগে ধীরে ধীরে তাঁদের প্রস্তাবিত "ইসলামী" সমাধান জনগনের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। শারিয়া সম্বন্ধে জনগণ কিছু জানেই না। তবু বহু লোক শারিয়ার রক্ষাকর্তা হয়ে গেছেন, তাঁদের অনেকেই আবার জামাত-বিরোধীও।

ছোটবেলায় দেখেছি রোজার মধ্যে হোটেলগুলো চাদর দিয়ে ঢাকা থাকত। অমুসলিমেরা তো বটেই কোন কোন মুসলমানও বাইরে খেত তাতে আকাশ ভেঙ্গে পড়ত না। এখন বাইরে কাউকে খেতে দেখলে সাধারণ মানুষের একাংশ হিংস্র হয়ে ওঠে। আমার এক বন্ধু বাসে করে যাচ্ছিল, সে দেখল গাড়িতে ভ্যাপসা গরমের দুপুরে এক যাত্রী পানি খেয়েছে বলে বাসের ড্রাইভার বাস থামিয়ে তাকে অপমান করে পথের মধ্যে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল।
নানা-নানীর কোলে মানুষ, এখন ঢাকায় বসবাসকারী একজনের কন্যার প্রথম আকিকা-উৎসবের সাতদিন আগে গ্রামের বাড়ীতে নানা মারা গেলে সাধারণ মানুষ এসে দাবী করেছে শারিয়া মোতাবেক নানী চার মাস ঘরে থাকবে, নিজের নাতির বাসা হলেও ঢাকায় যেতে পারবে না।
পঙ্গু হয়ে কয়েক বছর শয্যাগত একজনের মৃত্যু হলে সাধারণ মানুষ দাবী করেছে কাফফারা না দিলে তাঁর জানাজা হবে না কারণ তিনি এত বছর নামাজ পড়েন নি।
কোনো এক কলেজের শিক্ষক ছাত্রীদের বোরখা পড়তে বাধ্য করলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও হাইকোর্টকে এগিয়ে আসতে হয়,শিক্ষা মন্ত্রণালয় কঠোর নির্দেশ দিয়ে বলেছে,কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাউকে বোরকা পরতে বাধ্য করা যাবে না - জনকন্ঠ ২৬শ আগস্ট ২০১২।
রংপুরে এক এস-আই ১৯জন মেয়েকে থানায় ধরে নিয়ে আসে বোরখানা পড়ে পার্কে গিয়েছিল বলে। সেখানেও কোর্টকে এগিয়ে এসে সেই পুলিশকে তলব করে ও এ ধরণের অপকর্মকে নিষিদ্ধ করে - জনকন্ঠ ০৩ মার্চ ২০১০।
এরকম অজস্র উদাহরণ প্রমাণ করে সাধারণ মানুষের মধ্যে শারিয়া আইন মেনে চলার উগ্র প্রবণতা ধীরে ধীরে বেড়ে যাচ্ছে। কি কি পদ্ধতিতে এটা হচ্ছে সেদিকে এবার তাকানো যাক।
অসংখ্য মওলানা-মুফতি-মোল্লা নিয়ে দেশজুড়ে যে অনিয়ন্ত্রিত আলেম-সমাজ গড়ে উঠছে তাঁদের প্রায় সবাই নারী-নীতির বিরোধী। এঁদের যোগ্যতার কোন দৃশ্যমান মাপকাঠি নেই, জাতির বা সরকারের কাছে জবাবদিহিতাও নেই। এঁদের বেশীরভাগই আধুনিক রাষ্ট্রপরিচালনার কিছুই জানেন না কিন্তু অবলীলায় বিশ্বের তাবৎ সমস্যার সমাধান পেশ করে থাকেন।
দেশে শরিয়াপন্থীদের শত শত একাগ্র, কর্মতৎপর ও ধনী সংগঠন জাতির চোখের সামনে ধরে রেখেছে শুধুমাত্র ওদেরই ইসলামি-ব্যাখ্যা। ওদের বিপক্ষে সুফী ইসলামী ধর্মতত্বের বইগুলো প্রচার প্রসারের সংগঠন নেই বললেই চলে।
ওদের আছে দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান মসজিদ, প্রতি শুক্রবারে জনতাকে প্রভাবিত করার সুযোগ যা তারা পুরোটাই নিয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও নেবে।
আলিয়া,কওমি,ফোরকানিয়া,হাফিজিয়া ইত্যাদি মাদ্রাসার সংখ্যা হবে কমপক্ষে তিন লাখ–(জনকন্ঠ ১৫ মে ২০১৩ - মুনতাসীর মামুন)।
প্রতি বছর এরা সমাজে ঢেলে দিচ্ছে লক্ষ লক্ষ শরিয়া-সমর্থক যারা উবে যায় না, সরকারী চাকুরী ও সামরিক বাহিনী সহ সমাজের প্রতি স্তরে তাদের প্রভাব খাটাতে থাকে। প্রাথমিক পরীক্ষায় পাশ করার জন্য তাদের বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় বলে খবর উঠেছে। ক’বছরে এ সংখ্যা যা দাঁড়াবে তার প্রভাব জাতি এড়িয়ে যেতে পারবে না।
মধ্যপ্রাচ্যে লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশী দেশে বানিয়েছেন অসংখ্য মাদ্রাসা। মাদ্রাসা আসলে শারিয়াপন্থীদের সংখ্যা বাড়ানো ছাড়া আর কিছুই নয়। সে পরিকল্পনা এখন বেশ সফল, এক নিমেষে বহু হাজার যুদ্ধংদেহী তরুণকে রাস্তায় নামানোর প্রচণ্ড ষ্ট্রীট পাওয়ারের অধিকারী ওরা। গত ৫ই এপ্রিল ২০১৩ ঢাকাত শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের লক্ষ লোকের সমাবেশ তার প্রমাণ। এ বাহিনী আগামীতে অনেক বাড়বে এবং সর্বত্র এর চাপ অনুভুত হবে। এ চাপ ঠেকানোর পদ্ধতি এখনও বাংলাদেশে অনুপস্থিত।
ওদের আছে নিজস্ব দলীয় পত্রিকা এবং সেগুলোতে ইসলামের নামে গোয়েবল্‌সীয় পদ্ধতিতে প্রচারিত হচ্ছে শারিয়া-প্রচার। পক্ষান্তরে ইসলামি দলিলের ভিত্তিতে ওদের প্রচারণার ভিত্তিহীনতা, কোরাণ-বিরোধীতা, ইসলাম-বিরোধীতা ও অসততাকে তুলে ধরার তেমন কোন পত্রিকা নেই। চেষ্টা করে দেখা গেছে অনেক সেকুলার পত্রিকাও এসব দলিল জাতির সামনে তুলে ধরতে ভয় পায়।
এটাও শারিয়াপন্থীদের আর একটা বিরাট সাফল্য।এরা জনগণ, সরকার, মিডিয়া, টিভি-রেডিয়ো-সংবাদপত্র প্রকাশনা সহ সারা জাতিকে ভয় পাওয়াতে সক্ষম হয়েছে। এটা আরো বাড়বে বৈ কমবে না।
২০০৬ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারী ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনষ্টিটিউট-এ জামাত ঘোষণা দিয়েছে দেশ জুড়ে মহাশারিয়া কোর্টের জটাজাল বানানো হবে। গ্রাম উপজেলার নিয়ন্ত্রনে, উপজেলা জেলার নিয়ন্ত্রনে, এভাবে আটষট্টি হাজার শারিয়া-কোর্টের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ থাকবে ঢাকার বায়তুল মোকাররমের খতিবের হাতে। অর্থাৎ আটষট্টি হাজার শারিয়া-কোর্টের জালে মাছের মত আটকে যাবে দেশের ভবিষ্যৎ।
সমান্তরাল বিচার ব্যবস্থা রাষ্ট্রদ্রোহীতার পর্যায়ে পড়ে কিন্তু সম্ভবতঃ এর নাম দেয়া হবে ইসলাম পরামর্শ ব্যবস্থা, মানুষ ইচ্ছে হলে নিক ইচ্ছে না হলে না নিক্‌! ওদিকে টহল দিয়ে বেড়াবে বেসরকারী শারিয়া-পুলিশ, ‘‘স্বেচ্ছাসেবক’’ নাম নিয়ে। গালগল্প নয়, অন্যান্য শারিয়া-দেশে নামাজ-রোজা-দাঁড়ী-বোরখা নিয়ে ভয়াবহ দোজখ সৃষ্টি করেছে এই হিংস্র শারিয়া-বাহিনী। কেউ শারিয়া কোর্টে না গিয়ে দেশের কোর্টে গেলেই ছুটে আসবে মুরতাদ-ফতোয়ার চাবুক। স্বাধীন-চিন্তা ও ভিন্নমতের ওপরে নেমে আসবে ব্ল্যাসফেমি আইনের খড়্গ, জনগণের সাধ্য হবেনা তার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। বন্ধু তো দুরের কথা ভাই ভাইয়ের কাছেও মন খুলে কথা বলতে ভয় পাবে মানুষ। গল্প নয়, এরকম হয়েছে অন্যান্য দেশে।
এর মধ্যেই বিভিন্ন ব্যাপারে সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বায়তুল মুকাররমে গিয়ে গুরুত্বপুর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যা তাঁরা ইমাম-খতিবদের ডেকে সেক্রেটারিয়েটেই নিতে পারতেন। এভাবে সুযোগ দিতে থাকলে ইরাণের শুরায়ে নিগাহ্‌বান-এর মত বায়তুল মুকাররমকে ছায়া-সংসদ করে তোলা হবে, সরকার সেটা ঠেকাতে চাইবে না, চাইলেও পারবে না।
আমাদের বুদ্ধিজীবি ও সুশীল সমাজও সুশীল বালকের মত ইসলামকে ব্যাখ্যা অধিকার ওদের হাতে ছেড়ে দিয়ে বসে আছেন। তাঁরা বিশ হাজার পৃষ্ঠার বই পড়ে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-অর্থনীতিবিদ হবেন কিন্তু দশ হাজার পৃষ্ঠার ইসলামি দলিল পড়ার সময় নেই। তাঁরা ভোগেন ভয়ংকর অহংরোগ, গর্ব, একগুঁয়েমী, ‘‘একলা চলো’’ নীতি ও সাংগঠনিক ব্যর্থতায়। টাকার জোর বা আন্তর্জাতিক সমন্নয়ও তাঁদের নেই।
ইসলামী টিভি চ্যানেল তো আছেই, অন্যান্য প্রায় প্রতিটি টিভি চ্যানেলে এক একেকটা করে ইসলামী প্রোগ্রাম চলে, প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্রে ইসলামী অংশ থাকে। এদের প্রত্যেকটিই শারিয়া-পন্থী। তাঁরা কোরানের অপব্যাখ্যা করে ও নারী-বিরোধী হাদিসগুলো উদ্ধৃতি দিয়ে নারী-বিরোধী শরিয়া আইনগুলোকে ইসলামের নামে বৈধতা দেন। গ্রাম গঞ্জের অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত জনগনের ওপরে এসবের প্রভাব প্রচণ্ড ।
আ-লীগ সরকারী ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করবে - দৈনিক ইনকিলাব ২০শে আগষ্ট ২০১১)।
যে বাংলাদেশে একটা বাংলা বিশ্ববিদ্যালয় নেই, যে বাংলাদেশে কয়েকটা বেসরকারী ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় আছে, প্রতিষ্ঠিত ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শারিয়াবাজদের নিয়ন্ত্রনে, সেগুলোতে আমাদের সুফি ইসলামকে পরাজিত করে নির্ভেজাল মওদুদিবাদ পড়ানো হয়। সরকারী ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়টাও ওদের হাতেই যাবে। অজস্র মাদ্রাসার সাথে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়টাও পরের প্রজন্মের একটা বড় অংশকে পথভ্রষ্ট করবে যারা সমাজে প্রবেশ করবে ও সমাজকে প্রবলভাবে প্রভাবাম্বিত করবে।
হাইকোর্টে ফতোয়ার বিরুদ্ধে রায় বাতিল করে সুপ্রীম কোর্টের রায় - ফতোয়া বৈধ, "শুধুমাত্র বিজ্ঞ মুফতিরাই ফতোয়া দিতে পারবেন" ইনকিলাব ১৪ মে ২০১১।
এটা যে জাতির বিরুদ্ধে কতবড় বিশ্বাসঘাতকতা তা সময়ই বলবে। "বিজ্ঞ মুফতি" কাকে বলে সেটা কে ঠিক করবে?
আলেমরা নাকি "সরাসরি আল্লাহ'র দ্বারা সরাসরি ফতোয়া দিবার অধিকার প্রাপ্ত" (ইনকিলাব ২০শে আগষ্ট ২০১১)।"আলেম" কাহাকে বলে সেটাই ঠিক করা গেলনা গত ১৪০০ বছরে, - লাখো "আলেম"রা পরস্পরের সাথে শুধু গালাগালি হানাহানি কামড়া-কামড়ি করে বিশ্ব-মুসলিমকে শুধু বিভক্তই করেন নি বরং অজস্র হত্যা গণহত্যা ঘটিয়েছেন ওই ফতোয়ার অস্ত্রে, এসব জাতিকে জানানো দরকার।
ওই রায়ে বসতে পারার প্রথম সুযোগেই শোবার দাবী এসেছে ন্যাশন্যাল ফতোয়া বোর্ড গঠনের।
বায়তুল মুকাররমের খতিবকে প্রধান বিচারপতির সাংগঠনিক মর্যাদা দিতে হবে এ দাবী বহু আগে থেকেই ছিল।
সব মিলিয়ে আমরা দেখছি সরকারে থাকলে তো কথাই নেই, না থাকলেও বা আংশিকভাবে থাকলেও তাঁরা গ্রাম গঞ্জে এক অদৃশ্য "ইসলামী সরকার" চালাবার কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। উনাদের দাবীতে অনেক কিছুই আছে, নেই শুধু নারীর কন্ঠ। গত ১৪০০ বছরে একজনও নারী শরিয়া-ইমাম নেই, নারীর ইচ্ছে অনিচ্ছের প্রতিফলন নেই, নেই নারীর জীবনে এসব আইনের প্রভাবের ওপর কোনো সমীক্ষা। হাতীর দুই দাঁত - একপাটি দেখা যায় যা তাকে সুন্দর করে তোলে। আর একপাটি দাঁত আছে লুকোনো, চিবিয়ে হাড় ভাঙ্গার জন্য। শারিয়াপন্থীদেরও ঠিক তাই;চোখের সামনে ধরা আছে মুখমিষ্টি "মায়ের পায়ের নীচে বেহেশত" আর লুকোনো আছে ভয়াবহ নারী বিরোধী আইন। জাতির সুশীল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সমাজের এখনই উচিত নারীনীতি কেন ইসলাম-সমর্থিত, এর বিরোধীতা কেন ইসলাম-বিরোধী, অন্যান্য মুসলিম দেশে মওলানাদের সমর্থনে কি ইসলামি পদ্ধতিতে সাংবিধানিকভাবে নারীনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সে ব্যাপারে কিছু পড়াশুনা করা এবং বিভিন্ন মাধ্যমে তা জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়া।
কিছুটা দেরী হয়েছে কিন্তু এটা এখনও সম্ভব এবং এর বিকল্প নেই।

হাসান মাহমুদ
১৫ই মে, ৪৩ মুক্তিসন (২০১৩)

অত্যাচার করে শিবির উচ্ছেদ হবে না -হাসান মাহমুদ



শিবিরের ওপর সরকারের চণ্ডতার বিরুদ্ধে আমার গত লেখাটা দেখে অনেকে আমার সমালোচনা করেছেন। আমি অবাক হইনি, চারদিকে ঘৃণার যে টর্নেডো চলছে তাতে বোধহয় আমাদের উপলব্ধির সূক্ষতা নষ্টই হয়ে গেছে। গত কয়েক দশকে ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের অনেক নেতা-নেত্রীদের টেন্ডার, ভর্তি, সিট ও যৌন-বাণিজ্য বহুবার কাগজে উঠেছে। সাথে আছে হল দখল ও অস্ত্রের সন্ত্রাস। লীগ-দল সেটা করেছে ব্যক্তিস্বার্থে, সেগুলো অন্যায় তা জেনে শুনেই ও নিজের বিবেকের কাছে অপরাধী হয়েই। কিন্তু শিবির ভর্তি, টেন্ডার, সিট ও যৌন-বাণিজ্য করেছে বলে অভিযোগ নেই। ওরা করেছে প্রধানত: হল দখল ও অস্ত্রের সন্ত্রাস, তাদের আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য। মনের কাছে ওরা অপরাধী তো নয়ই বরং ইসলামের সেবা করছে মনে করে গর্বিত।

এটা বুঝতে কি মহাপণ্ডিত হতে হয় শিবিরের সাথে জাতির বড় একটা অংশের বিরোধটা ধর্মতাত্ত্বিক ? অত্যাচার করে ধর্মবিশ্বাস দমন -কোনদিন ইতিহাসে হয়েছে তা ? হয়নি। ধর্মতাত্ত্বিক সমস্যার ধর্মতাত্ত্বিক সমাধান করার চেষ্টা না করে সরকার অত্যাচার-নিপীড়নের পথধরেছে। যে বিপুল সংখ্যায় শিবিরদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তা হাস্যকর ওঅবাস্তব। অত লোককে গ্রেপ্তার করাও সম্ভব নয়, আমাদের কারাগারেও অত জায়গা নেই আর অত মামলা চালানোর ক্ষমতাও আমাদের বিচার বিভাগের নেই।

রিম্যান্ড মানেই নির্মম প্রহার। শিবিরের সভাপতি শক্ত সমর্থ যুবক, রিম্যান্ড-এর পরে বোধ হয় দুদিন তাকে আদালতে আনা হয়েছিল,শেষের দিন সে ছিল হুইল চেয়ারে প্রায় অজ্ঞান, ওই অবস্থায় তার হাতে পায়ে ডান্ডাবেড়ী পরানো। নিশ্চয় অন্যান্যদেরও একই অবস্থা। আমি বহু বছর বিদেশে আছি, কোনো সভ্য সমাজে এমন বর্বরতা চিন্তাও করা যায় না। এর উদ্দেশ্য ছিলশিবির উচ্ছেদ, এই তো? তা, সেটা হয়েছে বিন্দুমাত্র? হয়নি। ওদের আদর্শ বদলেছে? বদলায় নি। ওরা শিবির করা ছেড়েছে? ছাড়েনি। ওদের অবস্থা দেখে অন্যেরা শিবির করা ছেড়েছে? ছাড়েনি বরং ওদের প্রতিটি সদস্যের ধর্মীয় আবেগ আরো শক্তিশালী হয়েছে। হিংসার যে রাজনীতি আগে থেকে চালু ছিল সেটা দ্বিগুন জ্বলে উঠেছে - ওই আগুনে দেশ ও আওয়ামী লীগ জ্বলে পুড়ে খাক না হয়ে যায়।

সমাজের সরকারের প্রতিটি স্তরে যে ভয়াবহ অনাচার দুর্নীতি তার বিকল্প তরুণ রক্ত খুঁজবেই। জামাত সেটাই ওদের দেয় - মোহময় আপাত: আকর্ষণীয় মৌদুদীবাদ। চারদিকে এত অত্যাচার অনাচারে বিপর্যস্ত মনে ইসলামী রাষ্ট্র, আল্লাহ'র আইন,রসুলের আদর্শ এসব শব্দের আকর্ষণ অপ্রতিরোধ্য। যত অত্যাচার হবে ওদের ইসলামী আবেগ তত শক্তিশালী হবে। শিবির জানে না মৌদুদীবাদ মুখে যত চটকদার আকর্ষণীয় কথাই বলুক সে মানবাধিকার আর ইসলাম-বিরোধী। ওর বিপক্ষে মুসলিম স্কলারদের রিসার্চ(নবম শতাব্দীর হাতিম আল রাজী থেকে শুরু করে এখনকার ড: আবদুল্লা আন নাইম, ড: বাসাম তিবি, ড: ফাদেল এবং আরো অনেকে) পড়ার সুযোগইশিবিরিকে দেয়া হয় না। কিন্তু এখন ইন্টারনেটের যুগ, কোরান-রসুল ও ঐতিহাসিক তত্ত্ব-তথ্য ধরে ধরে মৌদুদিবাদের ইসলাম-বিরোধীতা তুলে ধরলে এ ভুল ওদের কিংবা পরের প্রজন্মের অনেকেরই একদিন ভাঙবেই। একটা জাতির জন্য ওই সময়টা কিছুই নয়। যাঁরা আজ ছ'মাস পরের নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছেন তাঁদের জানা দরকার জামাত তিরিশ বছরের শুধু প্ল্যানই করেনি, লক্ষ্য অর্জনের রোডম্যাপও করে রেখেছে এবং ধীর কিন্তু দৃঢ় পদক্ষেপে সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছে। শিবিরের ধর্মীয় আবেগ তার প্রধান অস্ত্র।

জামাত-শিবিরের উচ্ছেদ আমার চেয়ে বেশী কেউ চায় না। কিন্তু সেটা মানুষ উচ্ছেদ বা নাগরিকঅধিকার লঙ্ঘন করে নয়, রিম্যান্ড-এর নৃশংস অত্যাচার বা মামলার হয়রানী করে নয়। সেটা ইসলামের নামে ওদের অপতত্ত্বের উচ্ছেদ। কোরান-রসুল এবং ইতিহাসের শিক্ষা থেকে সেটা যথেষ্টই সম্ভব।

- See more at: http://www.hasanmahmud.com/2012/index.php/all-articles/articles-in-bangla/islamic/94-%E0%A6%85%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A7%87-%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B0-%E0%A6%89%E0%A6%9A%E0%A7%8D%E0%A6%9B%E0%A7%87%E0%A6%A6-%E0%A6%B9%E0%A6%AC%E0%A7%87-%E0%A6%A8%E0%A6%BE#sthash.GLmIN8yf.dpuf

Monday, June 17, 2013

সাম্প্রদায়িকতা র প্রশ্রয়দাতা আমরা- সুমি খান


সাম্প্রদায়িকতা প্রশ্রয় দিয়ে আমরা দেশের সাধারণ নিরীহ জনগণ কে বিভ্রান্ত হতে বাধ্য করছি না কি? কেউ নগদ টাকার লোভে, কেউ না পাওয়ার বেদনায় ( অনেক পাওয়র পর ও) হাসিনা বিরোধিতা বা আওয়ামী বিরোধিতার নামে। এর প্রমাণ চার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। এর খেসারত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের বোমাবাজী দিয়ে আনন্দউল্লাস! আওয়ামী লীগের ভেতরের উগ্র ডানপন্থী দের আত্মঘাতী ভূমিকা তো আছেই।
বামদলের ভূমিকা নিয়ে আত্মশ্লাঘায় ভুগছেন তারা? যুদ্ধাপরাধী এবং তার দোসর দের ঠেকাতে সুদূর প্রসারী কোন কাজ কি করেছেন তারা ?

Saturday, June 8, 2013

নারীর মানবাধিকার -চলচ্চিত্রে স্পর্ধিত উপস্থাপন :আমার দোসর ঋতুপর্ণ ঘোষ, সেলাম ! - সুমি খান


সুমি খান
৯ জুন ২০১৩ সকাল ১০টা

আমার দোসর ঋতুপর্ণ ঘোষ, গুরু সেলাম তোমায় !!
নারীর মানবাধিকার হননে পুরুষতান্ত্রিকতার ভয়ংকর শোষণের নির্মম চিত্র- মাত্র ১২টি হলেও প্রতিটি চলচ্চিত্রে কী অসাধারণ স্পর্ধিত উপস্থাপন!! কে, কবে করেছে জানি না। বড়ো ক্ষুদ্র মানুষ আমি। চলচ্চিত্র সমালোচক নই। সাধারণ একজন দর্শক মাত্র। মেঘপিয়নের সাথে সাথে মন আজ ছুটে চলেছে তাকে হারিয়ে বেদনায় ডুবেছি বারবার! তার সম্মানে আমার অনুভূতি গুলো লিখতো বসে গেলাম নিজের অজান্তেই!
কবেকার কথা মনে নেই- ১৯৯৮-৯৯ সালের কোন একদিন বিষন্ন দুপুরে হঠাৎ টেলিভিশনে 'দহন' ছবি টা দেখলাম।ছবির নায়িকা ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত রমিতা চরিত্রে অভিনয় করছিলেন। পূজোর বাজার করতে গিয়ে বখাটেদের হাতে লাঞ্ছিত হলো । ইন্দ্রানী হালদার সাহসী সাংবাদিক ঝিনুকের চরিত্রে অভিনয় করলেন। সেই বখাটেদের বাঁচাতে প্রশাসনের সাথে একাট্টা হলো স্বামী পলাশ এবং তার পরিবার। তাদের লান্ছনা আর অপমানের শিকার হলো রমিতা এবং ঝিনুক। বখাটে দের বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ্য দিতে ঝিনুকের প্রেমিক ও সমর্থন দিলো না। বেদনাহত ঝিনুককে তার ঠাকুরমা (কিংবদন্তী রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সুচিত্রা সেন) মানসিক সমর্থন দিলেন। রাতের পর রাত পলাশ ও নিষ্ঠুর ভাবে ধর্ষণ করতে স্ত্রী রমিতাকে ! রকবাজ বখাটে দের সাথে একই ছাদের নিচে একই বিছানার শয্যাসঙ্গী স্বামীটিও একাত্ম হয়ে গেলো! বুকের ভেতর টা চমকে উঠেছিলো। মনে হলো, নারীর মানবাধিকার হননে পুরুষতান্ত্রিকতার ভয়ংকর এই শোষণ কী অসাধারণ উপস্থাপন! কেউ কখনো পারে নি!! নিজে পুরুষ হয়ে কিছু পুরুষের অন্যায় আর বর্বরতার বিরুদ্ধে সাহসিকতার সাথে জেগে ওঠা!! আধুনিকতা বলে একেই!
'দহন' এর পর 'বাড়িওয়ালী' , 'তিতলী', অন্তরমহল', 'চোখের বালি' ..আরো কয়েকটি ছবি দেখলাম! বারবার হাজারবার! মুগ্ধতায়, মোহময়তায় ভাসলাম! উজ্জীবিত হলাম সাহসে- নিজের প্রতি, নিজের শরীরের প্রতি সম্মান বোধে!যে শরীর টি কে নশ্বর বলে কখনো গুরুত্বই দেইনি! এই শরীরের অপরূপ সৌন্দর্য থাকতে পারে, তার প্রতি কেউ অসম্মান করতে পারে- এই বোধটাই তেমন অনুভব করিনি যেই আমি এতোদিন! তাকেই ঘা মেরে জাগিয়ে দিলেন ঋতুপর্ণ! অধিকারবোধ শুধু নয়, নিজের আত্মসম্মানবোধ! নিজের বেদনার দোসর হলাম যেন প্রথমবারের মতো! আর সেই দিন থেকেই মনে মনে এই মানুষটি আমার দোসর হয়ে গেলেন ।

তিনি নিজে সমকামী ছিলেন। সেটা তার একান্তই নিজস্ব ব্যাপার। এ্তই বাস্রতবতা তার বাবা-মা, তার পরিবার খুব সহজে মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু সমাজ তার উপর তার মতো প্রান্তিক মানুষগুলোর উপর এক ধরণের ভায়োলেন্স চাপিয়ে দেয়- যার কোন অধিকার এই সমাজের নেই। এবং সেটা নিয়ে হতাশার কিছুই নেই! বিভিন্ন সময়ে দৃঢ়তার সাথে এ কথা গুলো তুলে ধরেছেন তিনি। বিকল্প যৌনতা নিয়ে তার সাম্প্রতিক চলচ্চিত্র 'চিত্রাঙ্গদা' প্রসঙ্গে আলোচনায় বলেছিলেন, এই অস্তিত্ব মেনে নিতে পারে না আমাদের নির্বোধ সমাজ। এই যুদ্ধে কেউ 'বেচারা' নয়, কেউ তার হাত ধরে পার করে দেবে- এমন অলীক আশা নিয়ে বেঁচে থাকলে বা বসে থাকলে- সেই জীবনের অধিকারী ই সে নয়!'কোন রোমান্টিক সঙ্গী পেলাম না এই জীবনে'- এটা কোন দীর্ঘশ্বাস হতেই পারে না । হোঁচট খেতে খেতে হলে ও তার নিজের জীবন এগিয়ে নিয়ে যাবার দায় তার নিজের!বলেছেন,এই ভায়োলেন্স একতরফা নয়- দু'দিক থেকেই আসছে! কী চমৎকার আত্মবিশ্বাসী কথা! বোঝালেন, আমি কিভাবে বাঁচছি, সেটা বড়ো কথা নয়, আমি কিভাবে বাঁচতে চাই- আমার প্রত্যাশা কি- সেটাই বড়ো কথা!
অন্জন দত্তের কথায় বলি," পৃথিবীতে অনেক সমকামী চিত্র পরিচালক আছেন, অনেক সফল তারা। কিন্তু কে কবে নারী -পুরুষের সেক্সুয়েল সম্পর্ক এবং তার সংকট নিয়ে এতোটা খোলামেলা কথা বলেছে? আমার শরীরের ভালো মন্দ, আমার শরীরের সৌন্দর্য, আমার সৌন্দর্যের প্রতি সম্মানবোধ আর অকৃত্রিম ভালোবাসা থাকবে কারো- এই বিষয়গুলো ভাবার দুয়ার খুলে দিলেন তিনি।রবীন্দ্রনাথের 'নারী অর্ধ নারীশ্বর'বিবেচনার সময় এসে গেছে। একচ্ছত্র অধিকার আমার ! বিয়ের সার্টিফিকেট বা কাবিননামা কবুল করে একজন নারী তার স্বামীর কাছে বিক্রি হয়ে যায় না। মন প্রাণ দিয়ে ভালোবেসে দু'জনে দু'জনার হতে হবে। তবেই শরীর- মন একাকার হয়ে একাত্ম হবে! এতোটা ভাবিয়েছে কে আর? কেন বলবে কেউ?


সমাজের ভ্রুকুটির মুখোমুখি হবার সাহস কার ই বা আছে? ক'জনের আছে? ব্যক্তিকেন্দ্রীকতার সুখ- আনন্দ বর্জন করে একাকিত্ম বরণ করেছিলেন। এমন পরিচালক- যার নিবিড় ভালোবাসায় ভেসেছে সবাই! যদিও তার চারিদিক বড়ো প্রতিকূল ছিল। এই প্রতিকূলতা তিনি নিজেই তৈরি করেছিলেন, নজরুলের ভাষায়, আদি শৃঙ্খল সনাতন শাস্ত্র আচার ভাঙ্গবার জন্যে । রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয়, "অহো, কী দু:সহ স্পর্ধা !!"
নারী, নারীর শরীর কে সম্মান করতে গিয়ে লম্বা চুলের বিনুনীর উইগ পরলেন। অপরূপ সাজে নিজেকে সজ্জিত করলেন।নানান রূপে তার প্রতিটি অনুষ্ঠান কী প্রাণবন্ত!
নারীর রূপ ধারণ করলেন দু:সাহসিকতার সাথে। এসব করতে গিয়ে সমাজের গঞ্জনা- যন্ত্রনা সয়ে যাওয়ার যে সাহস, যে ক্ষ্যাপামী তিনি দেখিয়েছেন- এমনটি তার মতো কারো নেই, ছিল না। আরো অনেক অনেক দিন তার বেঁচে থাকা দরকার ছিল।
ঋতুপর্ণ ঘোষের অকাল প্রয়াণ সবাইকে ভাবাচ্ছে- হয়তো আরো কেউ এবার এগিয়ে আসবে প্রতিভা নিয়ে, সাহস নিয়ে। তার মতো আগুনে পুড়ে সোনা হয়ে আমাদের কথা বলবেন কেউ- অপেক্ষায় রইলাম।

তবে আমরা ঋতু'দা এবং তার অসাধারণ সৃষ্টি কে চিরকাল চিরদিন আমাদের দোসর বলেই জানবো।
বাংলাদেশে গত কিছুদিন ইউটিউব না থাকার কারণে এতো এতো ক্ষতি হয়েছে আমাদের- কতোটা বলা যায়? তাই বেশ দেরি হয়ে গেলো। তবু ঋতুপর্ণ ঘোষের প্রয়াণ এবং তাকে নিয়ে আলোচনা সব নিয়ে বসলাম কাল সন্ধ্যা থেকে। আজ আমার বন্ধুদের সাথে ও শেয়ার করছি।
এ বিষয়ে আরো লিখবো। শুরু করলাম আজ। প্রিয় বন্ধুরা , আপনাদের অংশগ্রহণ কামনা করছি!

Wednesday, June 5, 2013

বাংলা ভাষায় প্রথম মুদ্রিত বই -শাম্ স নূর


ভাষা মানুষের ভাব প্রকাশের প্রধান মাধ্যম। অন্যভাবে বলা যায়, মুখ দিয়ে শব্দ করে ভাব প্রকাশের পদ্ধতিই হল ভাষা। বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা। এ ভাষায় আমরা কথা বলি, পড়ি, লিখি, আবার স্বপ্নও দেখি। মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, আমাদের এ প্রাণের ভাষার প্রথম বই কোনটি?




‘চর্যাপদ’ বাংলা ভাষার সবচেয়ে পুরনো সাহিত্য নিদর্শন, মানে সবচেয়ে পুরনো বই। বাংলা ভাষার এর আগের আর কোনো লিখিত রূপ পাওয়া যায়নি। তবে চর্যাপদ ছাপানো কোনো বই ছিল না, ছিল একটা হাতে লেখা গানের সংকলন। চর্যাপদ যখন লেখা হয়েছিল, তখন পৃথিবীতেই ছাপাখানার প্রচলন হয়নি। তখন পুঁথি বানানো হত তালপাতা বা অন্য কোনো পাতা দিয়ে। তার উপর হাতে লেখা হত। তাড়াতাড়ি লেখার জন্য পুঁথিতে একটা মজাও ছিল; পুঁথিতে বাক্যের শব্দগুলোর মধ্যে কোনো ফাঁকা রাখা হত না। ওভাবে জড়িয়ে জড়িয়ে লিখলে সময় কম লাগত।
চর্যাপদ কবে রচিত হয়েছিল, এ ব্যাপারে বাংলা ভাষার জাঁদরেল পণ্ডিতরা একদমই একমত হতে পারেননি। একেক জন পণ্ডিত একেক মন্তব্য করেছেন। কারও মতে চর্যাপদ ৬৫০-৯০০ খ্রিস্টাব্দে লিখিত, কারও মতে ১০০০-১২০০ সালে; এমনি একেক জনের একেক মত। সবার মত মিলিয়ে অনুমান করা হয়, চর্যাপদ রচিত হয়েছিল ৮৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে।

এই বইটি কিন্তু হারিয়েই গিয়েছিল। ১৯০৭ সালে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যাপদের একটি খণ্ডিত পুঁথি খুঁজে বের করেন। তাও আবার নেপালের রাজদরবারের লাইব্রেরি থেকে! বাংলা ভাষার সবচেয়ে পুরনো এই বইটি নিয়ে কিডজে একটি ফিচার প্রকাশিত হয়েছিল। নিচে ফিচারটির লিঙ্ক দেওয়া হল।

সবচেয়ে পুরনো বাংলা বই: চর্যাপদ
http://kidz.bdnews24.com/mainStory.php?mainstoryid=205

এ তো গেল বাংলা ভাষার সবচেয়ে পুরনো বইয়ের গল্প। এবার আসা যাক, বাংলা ভাষার প্রথম মুদ্রিত বইয়ের গল্পে।

যতদূর জানা যায়, পৃথিবীর প্রথম বাংলা হরফে মুদ্রিত বই প্রকাশিত হয়েছিল ১৬৮২ সালে। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে। তবে বইটি পুরো পাওয়া যায়নি, বইটির কিছু ছেঁড়া পাতা পাওয়া গিয়েছিল। এটিকেই বলা যায় সবচেয়ে পুরনো বাংলা মুদ্রণের নমুনা। এতে যে তামার মুদ্রণের নমুনা পাওয়া যায়, তার বর্ণগুলো ছিল তামার পাত থেকে মুদ্রিত। অর্থাৎ তখনও ঢালাই করা বাংলা বর্ণের প্রচলন হয়নি।


এরপর ১৭২৫ সালে জার্মানিতে সম্ভবত আরেকটি বাংলা বই ছাপা হয়েছিল। সেটিও পাওয়া যায়নি। ছেঁড়া পাতা ইত্যাদি নমুনা পাওয়া গেছে। সেসব থেকেই বইটির কথা জানা গেছে।

বাংলায় লেখা সবচেয়ে পুরনো যে মুদ্রিত বইটি পাওয়া গেছে, তার নাম-- ‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ’।
লিখেছিলেন মনোএল দ্য আসসুম্পসাঁও। তবে বইটি বাংলা বর্ণে নয়, মুদ্রিত হয়েছিল রোমান হরফে। বইটি লেখা হয়েছিল ১৭৩৩ খ্রিস্টাব্দে। তবে স্পেনের লিসবন থেকে ছেপে বের হয় ১৭৪৩ সালে।


এখন পর্যন্ত যে তিনটি মুদ্রিত বাংলা বইয়ের গল্প বললাম, তিনটি-ই ছাপা হয় বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার বাইরে। মানে বাংলা ভাষাভাষীদের অঞ্চলের বাইরে। হয়তো এ কারণেই এই বইগুলো সম্পর্কে তেমন কিছু জানাও যায়নি। আর যা তথ্য পাওয়া গেছে, তা দিয়ে এদের প্রথম বাংলা মুদ্রিত গ্রন্থের সম্মানও দেওয়া যায় না। কারণ, প্রথম দুটো তো পাওয়া-ই যায়নি। আর শেষেরটি বাংলা ভাষায় লেখা বটে, কিন্তু বাংলা বর্ণমালাতে মুদ্রিত নয়।



বাংলা ভাষায় প্রথম মুদ্রিত বই হিসেবে স্বীকৃত দেওয়া হয় A Grammer of the Bengali Language (অ্যা গ্রামার অব দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ বা বাংলা ভাষার ব্যাকরণ) গ্রন্থটিকে। বইটি লিখেছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারি ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড। প্রকাশিত হয় ১৭৭৮ সালে। বইটিতে মোট পৃষ্ঠা ছিল ২১৬টি। আংশিক বাংলা হরফে ছাপা এই বইটি পশ্চিমবঙ্গের হুগলি থেকে কাঠের হরফে ছাপা হয়। কাঠের হরফগুলো তৈরি করেছিলেন ইংরেজ পণ্ডিত ও গ্রন্থকার চার্লস উইলকিনস। বাংলা অক্ষরের জন্য তাকে সহায়তা করেছিলেন পঞ্চানন কর্মকার। বিডিনিউজ

Friday, May 31, 2013

চির তরুণ থাকার কিছু উপায় - জলচিকিৎসা


১• খুব ধীরে ধীরে চেষ্টা করতে করতে কয়েক মাসের মধ্যে সকালে ঘুম থেকে উঠে চার গ্লাস পানি খাওয়ার অভ্যাস করুন। এর পর বাথরুমে যান।

২• বাথরুম থেকে ফিরে এসে আরও এক গ্লাস পানি খান এবং তার পর খান দুধ ছাড়া খুব হালকা এক কাপ চা। আপনার ওজন বেশির দিকে হলে চিনি খাওয়া ছেড়ে দিন। চা কখনোই অতিরিক্ত গরম খাবেন না।

৩• সারা দিনে ৮ থেকে ১২ গ্লাস বাড়তি পানি খাবেন। উপরোক্ত রং চা দিনে কমপক্ষে চার কাপ খাবেন।

৪• ওপরের নিয়মে পানি খাওয়ার নাম হচ্ছে হাইড্রোথেরাপি বা জলচিকিৎসা । মূলত এটি হচ্ছে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার বছরের প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসা। আধুনিক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে- ঘুম থেকে উঠে ধীরে ধীরে চার গ্লাস পানি খাওয়ার অভ্যাস করলে প্রায় ৩৬ ধরণের রোগ হয় না এবং হলেও সেরে যায়।

৫• অপর পক্ষে, দুধহীন এবং দুধ-চিনি-হীন হালকা গরম চা হচ্ছে আড়াই হাজার বছর আগের একটি চায়নিজ হারবাল মেডিসিন। সেকালে এই চা দিয়ে হার্ট, ব্লাড প্রেসার (উচ্চ রক্তচাপ) ও পেটের নানা রকম রোগের চিকিৎসা করা হতো। আবার আধুনিক বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে- চায়ে রয়েছে অ্যান্টিঅিডেন্ট, যা ক্যান্সার প্রতিরোধে নিশ্চিত অবদান রাখে। এ ছাড়াও অন্য বহুগুণ রয়েছে চায়ে। তবে যে চা-টা প্রক্রিয়াজাত হয়নি, সে চায়ের গুণাগুণই অপেক্ষাকৃত ভালো।

৬• ভিটামিন সি একটি বৈপ্লবিক খাদ্যপ্রাণ। অসংখ্য এর গুণাগুণ। জানা গেছে, দিনে ১ হাজার মিলিগ্রাম ভিটামিন সি খেলে মানুষ চির তরুণ থাকে। তবে ট্যাবলেট খেলে কিছুই উপকার পাওয়া যায় না। খেতে হবে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ তাজা ফলমূল। প্রতিদিনই খেতে হবে। ভিটামিন সি ও ক্যান্সার ঠেকাতে সাহায্য করে।

৭• আমলকি, সব ধরনের লেবু, টমেটো, কমলা, পেয়ারা, নানা রকম টক স্বাদের ফলে বিভিন্ন মাত্রায় ভিটামিন সি রয়েছে।

৮• রেডমিট অর্থাৎ গরু, মহিষ, খাসি, ভেড়া ইত্যাদির মাংস খাওয়া ছেড়ে দিতে হবে। ফার্মের মুরগিও চলবে না। শুধু চর্বিহীন বাচ্চা মুরগির মাংস খাওয়া চলতে পারে।

৯• প্রচুর পরিমাণে আধা-সেদ্ধ শাক-সবজি, তরিতরকারি এবং খুব অল্প পরিমাণে ভাত-রুটি, এই হওয়া উচিত আপনার দৈনন্দিন মূল খাদ্য।
ভাজাভুজি খাবেন না। অতিরিক্ত তেল, চর্বি, ঘি, মাখন খাবেন না। মসলার বিভিন্ন ভেষজ গুণ আছে, তবুও রান্নায় খুব বেশি মসলা ব্যবহার করবেন না।

১০• সালাদ হিসাবে প্রতিদিন বেশি করে খাবেন কাঁচা লেটুস পাতা, পুদিনা পাতা, টমেটো ইত্যাদি।

১১• বিধিনিষেধ না থাকলে সকালে খালি পেটে এক চামচ মধু খাবেন।

১২• ছোট-বড় সব ধরনের মাছ খাবেন। সমুদ্রের মাছ খাওয়া অভ্যাস করতে পারলে তো খুবই ভালো। কেননা, ওটা মহৌষধ। গাদা-গাদা মাছের কাটা খাওয়া ঠিক নয়। ওতে পাকস্থলিতে পাথর হতে পারে।

১৩• সূর্যমূখী ফুলের বীজ হচ্ছে হার্টের ভেষজ ওষুধ। রান্নায় সূর্যমূখী তেল ব্যবহার করলে হার্টের সুরক্ষা যেমন হয়, তেমনি হার্টের অসুখ থাকলে তা সারাতে সাহায্য করে।

১৪• প্রতিদিন অল্প একটু টক দই খাওয়ার অভ্যাস করুন। টক দই উচ্চ রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সাহায্য করে।