Tuesday, February 3, 2015

জামায়াত সহ অন্যদের জঙ্গি কর্মকাণ্ডের সমন্বয় ও অর্থায়ন করার অভিযোগে বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহার পাকি কূটনীতিক



 
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস-এর অন্যতম সংগঠকের দায়িত্ব পালন করছিলেন ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশনের সহকারী ভিসা কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাযহার খান ।দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে জঙ্গি কর্মকাণ্ডের সমন্বয় ও অর্থায়ন করেন তিনি। গোয়েন্দা তথ্যে প্রকাশ, মাযহার খান পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন বাংলাদেশে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীর, আনসারউল্লাহ বাংলা টিম এবং জামায়াত-শিবিরকে। একই সাথে বাংলাদেশের মুদ্রাবাজার ধ্বংস করার লক্ষ্যে ভারতীয় জাল রুপির বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন পাকি কর্মকর্তা মাযহার খান।এই পাকি কর্মকর্তার কর্মকাণ্ডে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এর সম্পৃক্ততার সন্দেহ করছেন গোয়েন্দারা। গোপন বৈঠক করাকালীন মাযহার ধরা পড়েন গোয়েন্দা সংস্থার হাতে। কিন্তু কূটনৈতিক আইনের সুবিধা নিয়ে তাকে  পুলিশের থেকে ছাড়িয়ে বাংলাদেশ বিরোধী তৎপরতায় জড়িত এই কর্মকর্তাকে গোপনে পাকিস্তান পাঠিয়ে দেয় ঢাকার পাকিস্তান দূতাবাস।

গোয়েন্দা সূত্র মতে মাযহার খান পাকিস্তান দূতাবাসের অন্যান্য কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বাংলাদেশের মুদ্রা বাজারে জাল নোট ছড়িয়ে দেন। এর মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীর, আনসার উল্লাহ বাংলা টিম ও জামায়াত-শিবিরের বিভিন্ন নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগ করা হয়। মূলত বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বাংলাদেশে ব্যাপকহারে এ ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়, যা এখনো ধারাবাহিকভাবে চলছে।  
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের মন্তব্য অংশে বলা হয়েছে, পাকিস্তান হাইকমিশনে ২ বছর দায়িত্ব পালনের বাইরে মোহাম্মদ মাযহার খান নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীর, আনসার উল্লাহ বাংলা টিম ও জামায়াত-শিবিরের কর্মকাণ্ড, পৃষ্টপোষকতা, প্রশিক্ষণ ও অর্থায়নের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত।  

 পাকি কূটনীতিক মাযহার খানের বাংলাদেশবিরোধী ভয়ঙ্কর এসব গোপন তৎপরতার তথ্য-প্রমাণ পেয়েছেন  দেশের গোয়েন্দারা। এসব তথ্য প্রকাশিত হবার পর সরকারের বিভিন্ন মহলে তোলপাড় চলছে। জঙ্গি তৎপরতাই শুধু নয়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ মুদ্রাবাজার ধ্বংস করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেন তিনি।এ জন্যে পরিচালনা করেন ভারতীয় জাল রুপির এক বিশাল নেটওয়ার্ক।

দেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তানি দূতাবাস কর্মকর্তার সহযোগী মজিবুর রহমান নামে বাংলাদেশি একজন নাগরিক গ্রেফতার হওয়ার পর ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ ও ধারাবাহিক তদন্তের সূত্র ধরেই বেরিয়ে এসেছে জঙ্গি তৎপরতা ও জাল রুপি নেটওয়ার্কে থাকা ব্যক্তিদের কার্যক্রমের ক্রমধারা ও রূপরেখা। পাওয়া গেছে তাদের তালিকা ও কথোপকথনের সারাংশ। ওই প্রতিবেদনে তিনটি সুপারিশ করা হয়েছে। যাতে কড়া ভাষায় পাকিস্তান হাইকমিশনের শিষ্টাচারবহির্ভূত কার্যক্রমের নিন্দা জানানোর অনুরোধ করা হয়েছে। একই সঙ্গে ভিসা কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাযহার খানকে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার ও পাকিস্তান হতে বাংলাদেশের আসা ব্যক্তিদের ওপর কড়া নজরদারির সুপারিশ করা হয়েছে।  
 
সংশ্লিষ্ট সূত্রে প্রকাশ, নাশকতার সঙ্গে পাকিস্তান দূতাবাসের সহকারী ভিসা কর্মকর্তা মাযহার খানের সম্পৃক্ততার বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় দীর্ঘ অনুসন্ধান পরিচালনা করে বাংলাদেশের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। তদন্তে জানা যায়, মাযহার খান জাল নোট (রুপি) তৈরি ও সংগ্রহ করে কতিপয় বাংলাদেশী নাগরিকের মাধ্যমে ভারতে পাচার করেন। এতে তিনি প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। গোয়েন্দারা অনুসন্ধানে আরও নিশ্চিত হন যে, মাযহার খানের সঙ্গে জলিল   আখতার ও মো. মজিবুর রহমানসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন মহলের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। এদের মধ্যে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, পুলিশের কর্মকর্তা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের (পিআইএ) কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও সীমান্তবর্তী এলাকায় বসবাসরত বিশেষ করে লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, যশোর, বেনাপোল এলাকার বাংলাদেশি নাগরিকরা রয়েছেন।

‌এ সংক্রান্ত তথ্য নিশ্চিত হবার পর গোয়েন্দা কর্মকর্তারা তাকে নজরদারীতে রাখেন। সেই ধারাবাহিকতায়  গত ১২ জানুয়ারি সোমবার রাতে রাজধানীর বনানীর মৈত্রী মার্কেট এলাকায় মজিবুর রহমান ও পাকিস্তান দূতাবাসের ভিসা কর্মকর্তা মাযহার খানকে গোপন বৈঠকের সময় আটক করে। সে সময়ে পাকি কূটনীতিক মাযহার তার সঙ্গে থাকা বেশ কিছু কাগজপত্র ছিঁড়ে ফেলেন। ছিঁড়ে ফেলা কাগজ সংগ্রহ করে গোয়েন্দারা কিছু বাংলাদেশি পাসপোর্ট নম্বর পান। ওই পাসপোর্টের সূত্র ধরে আরও অনুসন্ধান করে জানতে পারেন যে, পাসপোর্টধারীদের এমন তিন ব্যক্তি রয়েছেন, যাদের নাম বিভিন্ন সময়ে প্রস্তুত করা হিযবুত তাহরীরের তালিকায় আছে। এরপরই গোয়েন্দারা মজিবুর ও মাযহারকে আটক করে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বনানী থানায় নিয়ে যান।

মাযহারের গ্রেফতারের খবর পেয়ে তাৎক্ষনিক ভাবে সেদিন রাত ১০টার দিকে ঢাকার পাকিস্তান হাইকমিশনের প্রথম সচিব সামিনা মাহতাব বনানী থানায় উপস্থিত হয়ে মাযহার খানকে নিজের হেফাজতে নিয়ে যান। বাংলাদেশী নাগরিক মজিবুর রহমানকে পুলিশ হেফাজতে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

 প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, মজিবুর রহমানের সঙ্গে মাযহার খানের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন মাযহার খানের পূর্বসূরি সহকারী ভিসা কর্মকর্তা। গত ১০ বছরে  পাকিস্তানে ২২ বার,  ভারতে ১১ বার ও  থাইল্যান্ডে ২২ বার ভ্রমন করেছেন মজিবুর রহমান। পরবর্তীতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবিন্দতে মজিবুর জানান, মাযহার খান এক লাখ ৮০ হাজার ভারতীয় জাল রুপি বাজারে ছাড়তে দেন তাকে। একইভাবে মাযহার  জাহিদ, ইমরান ও আরও কয়েকজনকে দিয়ে বড়ো অংকের ভারতীয় জাল রুপি বাংলাদেশের বাজারে ছাড়িয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রের তথ্যমতে, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে গত ১৫ জানুয়ারি পাকিস্তানি নাগরিক মোহাম্মদ ইমরানকে আশি লাখ জাল রুপিসহ আটক করা হয় হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে। ইমরানের পাসপোর্টের ভিসাও ছিল জাল। আগের ঘটনাগুলোর সঙ্গে ইমরানের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়।

পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই'র পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাংলাদেশের মুদ্রাবাজার ধ্বংস করার লক্ষ্যে বিশাল জাল রুপির নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন মাযহার । এই নেটওয়ার্কের অন্যতম সদস্য মুজিবুর রহমান জঙ্গিসংগঠনগুলোর জন্য অর্থ পাচার কাজে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। এ জন্যই তিনি ঘন ঘন ভারত, পাকিস্তান ও থাইল্যান্ডে আসা-যাওয়া করেছেন। পাকিস্তানে বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে ভিসা প্রদান না করায় জাল ভিসার সংখ্যা বাড়ছে বলেও মন্তব্য করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, পাসপোর্ট অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোতে পাঠানো হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অতি জরুরিভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশও করা হয় বলে জানা গেছে।

No comments:

Post a Comment