Monday, February 2, 2015

সংলাপ-ড. মো আনোয়ার হোসেন


‘বলতে পার মৃত্যু কী ভয়ঙ্কর? সবাই যখন কথা কইবে, রইবে তুমি নিরুত্তর।’

১৯৯৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০ তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানের সমাবর্তন বক্তা অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক অমর্ত্য সেন বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। বিএনপি-জামাত সমর্থিত শিক্ষকদের সমাবর্তন বর্জন এবং ছাত্রদল ও শিবিরের সমাবর্তন বানচালের ঘোষণার মধ্যে অনুষ্ঠিত এই সমাবর্তনে অধ্যাপক অমর্ত্য সেন এসেছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়েই। কার...
ণ বিএনপি-জামাত ঘরানার বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে তাঁকে জানানো হয়েছিল যে, ঢাকায় এলে তাঁর জীবন বিপন্ন হতে পারে।

সে প্রেক্ষাপটে মঞ্চে মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে অমর্ত্য সেন তাঁর সমাবর্তন বক্তৃতায় উপরের উদ্ধৃতিটি দেন। সংঘাতের চাইতে আলাপ-আলোচনা কিংবা বিতর্ক যে ভালো, তার প্রতিই ইঙ্গিত করছিলেন তিনি। মৃত্যু অবধি বিতর্ক করে যাওয়ার স্বাধীনতা, আনন্দ এবং তার মধ্য দিয়ে কোনো সমাধানে পৌঁছানো আধুনিক মানব সভ্যতার ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ।

ছাত্রদল ও শিবিরের সমাবর্তন বানচালের ঘোষণার মধ্যে অনুষ্ঠিত এই সমাবর্তনে অধ্যাপক অমর্ত্য সেন এসেছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে
ছাত্রদল ও শিবিরের সমাবর্তন বানচালের ঘোষণার মধ্যে অনুষ্ঠিত এই সমাবর্তনে অধ্যাপক অমর্ত্য সেন এসেছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে
তবে দূর অতীতেও সংলাপ-কথোপকথন যে সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাও আমরা জানি। আমাদের বাতিঘর প্রয়াত সরদার ফজলুল করিমের অনুবাদ গ্রন্থ ‘প্লেটোর সংলাপ’ বাংলা ভাষা-ভাষী মানুষদের সুযোগ করে দিয়েছিল তা পড়ে দেখবার। শিষ্যদের সঙ্গে সক্রেটিসের আলাপচারিতার কথাও বহুল প্রচারিত।

আমাদের ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত সংলাপটি হয়েছিল ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে। বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের মধ্যে। সংলাপ চলাকালে একদিকে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী গণহত্যা চালিয়ে স্বাধীনতাপ্রত্যাশী বাঙালি জনগোষ্ঠীকে দমন করতে গোপনে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। অন্যদিকে, বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে দেশজুড়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষের বিপুল অধিকাংশ স্বাধীনতা সংগ্রামে জীবন বিসর্জন দেবার প্রস্তুতি গ্রহণ করছিল।

সেই সংলাপ ব্যর্থ হয় ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক গণহত্যা শুরু এবং ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে।সংলাপ ব্যর্থ হয়েছিল, কিন্তু নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পরাজয় ও নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল।

বাংলাদেশে সামরিক স্বৈরশাসনের অবসানে আন্দোলনরত গণতান্ত্রিক শক্তির মধ্যে সংলাপ হয়েছে। তার শুভ প্রভাব পড়েছে আন্দোলনে। এসব সংলাপে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, শেখ হাসিনা এবং বেগম খালেদা জিয়ার মধ্যকার সংলাপ। সংলাপ সফল হয়েছিল। ফলশ্রুতিতে বিজয়ী গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদের পতন এবং গণতান্ত্রিক শাসনের নবযাত্রা সূচিত হয়েছিল। এরপর ক্ষমতার পালাবদল কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময়ে সংলাপ হয়েছে। সে সব সংলাপ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলেও সাফল্যের উদাহরণ আছে। সংলাপের প্রেক্ষাপটগুলো বিবেচনা করা যাক।

৯০’এর গণঅভ্যুত্থানের পর অপ্রত্যাশিতভাবে বিএনপি ক্ষমতাসীন হয়। নতুন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং বিরোধী-দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সফল সংলাপের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের নবযাত্রা সূচিত হয়। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে ক্ষমতার পালাবদল নির্বিঘ্ন হয় না। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে নানাভাবে সংলাপ হলেও তা কোনো ইতিবাচক ফল বয়ে আনে না। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মোর্চার তীব্র আন্দোলনে বেগম খালেদা জিয়া বাধ্য হন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে। ক্ষমতায় আসে শেখ হাসিনার সরকার।

নতুন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং বিরোধী-দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সফল সংলাপের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের নবযাত্রা সূচিত হয়
নতুন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং বিরোধী-দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সফল সংলাপের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের নবযাত্রা সূচিত হয় ।
আমাদের তথাকথিত সুশীল সমাজের কেউ কেউ বলে থাকেন, সেই আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত-ই-ইসলামীর মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য ছিল। কথাটি ভুল। বাস্তবে এই একটি যুগপৎ আন্দোলনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাস্তবায়িত হয়। আওয়ামী লীগ জামায়াতের সঙ্গে এক মঞ্চে কখনওই বসেনি, ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনও করেনি।

হাসিনা সরকারের মেয়াদ শেষে ২০০১ সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি-জামাত জয়ী হয়। নির্বিঘ্নেই ক্ষমতা হস্তান্তর হয়। এরপর ’৯৬ সালের মতোই আবারও স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য এবং অর্থবহ নির্বাচন অনুষ্ঠানে ক্ষমতাসীন খালেদা জিয়ার সরকারের অনীহার মুখে দুই প্রয়াত নেতা আবদুল মানান ভূঁইয়া এবং আবদুল জলিলের মধ্যে দীর্ঘ সংলাপ হলেও তা ব্যর্থ হয়। ফলশ্রুতিতে সেনাচালিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ, দুই নেত্রীর গ্রেপ্তার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সূচিত অভূতপূর্ব ছাত্র-শিক্ষক আন্দোলনের হাত ধরে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিন চতুর্থাংশ আসন নিয়ে সরকার গঠন করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার।

এবারও মেয়াদ শেষে ক্ষমতার পালাবদল নির্বিঘ্ন হয় না। কারণ, ইতোমধ্যে দেশের সর্বোচ্চ আদালত অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে আমাদের সংবিধানের মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্শিক বলে রায় দেয়। সে রায়ের সূত্র ধরে আমাদের জাতীয় সংসদ নির্বাচিত সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে। নির্বাচন ছাড়াও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার জামাত-বিএনপি জোটের সামনে বড় ইস্যু হয়ে দেখা দেয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি তারিখে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনের বহু পূর্ব থেকেই এই জোট ক্ষমতাসীন সরকার পতনের লক্ষ্যে দেশে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। নির্বাচনে জামায়াতে-ই-ইসলামীর অংশগ্রহণ নির্বাচনী আইন বহির্ভূত হয়ে যাওয়া এবং এই দলের শীর্ষনেতাদের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের সম্মুখীন হওয়ায় বিএনপি নির্বাচন বর্জন ও সরকার পতনের সহিংস আন্দোলনে সর্বশক্তি নিয়োগ করে।

সমস্যার শান্তিপূর্ণ নিরসনে দুই নেত্রীর মধ্যে সংলাপের জোরালো দাবি ওঠে। বেগম খালেদা জিয়াকে সরাসরি ফোন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংলাপের সূচনা করেন। যথার্থই একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে শেখ হাসিনা বিনয়, ধৈর্য ও আন্তরিকতা নিয়ে বিরোধী-দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দীর্ঘ টেলিফোন সংলাপ করেন। দুই নেত্রীর টেলিসংলাপ গোপন থাকে না। বেগম খালেদা জিয়ার অত্যন্ত রুঢ় আচরণেও শেখ হাসিনা যে ধৈর্য ও সৌজন্যবোধ দেখান তা জনগণের নজর এড়িয়ে যায় না।

স্বচ্ছ, অবাধ ও অংশগ্রহণকারী সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানে সমঝোতায় পৌঁছাতে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপের দ্বার অবারিত করলেও বেগম খালেদা জিয়া তাতে সাড়া দেন না। জামাত-হেফাজত-জঙ্গিদের নিয়ে তিনি সরকার পতনের আন্দোলনে এগিয়ে যান। কার্যত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ চালিয়ে যায় বিএনপি-জামাত জোট। আন্দোলনের নামে এমন পরিকল্পিত সহিংস অরাজকতা বাংলাদেশে নতুন। টেলিভিশনের পর্দায় দেখা পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া বা আফ্রিকার কোনো কোনো দেশে মানবতার বিরুদ্ধে ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠীর নিষ্ঠুরতার ভয়াবহ চিত্রগুলো বাংলাদেশে ঘটতে দেখে মানুষ আতংকিত হয়ে পড়ে।

ইতোমধ্যে দেশের সর্বোচ্চ আদালত অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সংবিধানের মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে রায় দেয়। ইতোমধ্যে দেশের সর্বোচ্চ আদালত অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সংবিধানের মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে রায় দেয়
এমন একটি পরিবেশে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপি-জামাতের সহিংসতার কারণে নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি কম হলেও নির্বাচন বানচালে বিরোধী গোষ্ঠী ব্যর্থ হয়। তার মূখ্য কারণ, তাদের ডাকে জনগণ সাড়া দেয়নি। বিএনপির মধ্যপন্থী অনেক নেতাই নির্বাচনে অংশগ্রহণের পক্ষে থাকলেও তারেক জিয়া ও জামাতের চাপের কাছে খালেদা জিয়া নতি স্বীকার করেন। সংলাপ ও নির্বাচন বর্জন করে তিনি যুদ্ধের পথই বেছে নেন। সে যুদ্ধে তিনি পরাজিত হন। তৃতীয় বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন শেখ হাসিনা।

যুদ্ধে জয়লাভ করে বিজয়ী শক্তি যে কার্যক্রম গ্রহণ করে শেখ হাসিনা তাই করছেন। শক্তহাতে দেশ পরিচালনা এবং উন্নয়নের গতিশীল কার্যক্রম চালিত করে তিনি ইতোমধ্যেই দেশের জনগণ ও বহির্বিশ্বের সামনে বাংলাদেশকে এক সম্ভাবনার দেশ হিসেবে উপস্থাপিত করেছেন। অগ্রগতির অনেক সূচকেই বাংলাদেশকে রোল মডেলের অবস্থানে নিয়ে গেছেন শেখ হাসিনা।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে জনগণের উল্লেখযোগ্য অংশ এবং বিশ্বজনমত যেখানে নির্বাচন ও নতুন সরকারের প্রতি আস্থা স্থাপনে দ্বিধান্বিত ছিল, গত এক বছরে সেখানে বড় পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। ভারতের মোদী সরকার, আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া, জাপান, চীন ও আরব দেশগুলো বৈরিতার পরিবর্তে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে। উন্নয়নের উচ্চ প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রেখে সর্ব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে থাকে।

যুদ্ধে পরাজিত পক্ষ ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে আপন শক্তি সংহত করতে পারে। সঠিক নীতি-কৌশল অনুসরণ করে পরবর্তী যুদ্ধে জয়লাভের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে পারে। ইতোমধ্যেই বিএনপির কয়েকটি নীতিগত বিষয়ে বোধোদয় হওয়ার কথা ছিল। জামাতে ইসলামী যে তাদের জন্য কোনো আশীর্বাদ নয়, বরং মাথার উপর জগদ্দল বোঝা, তা বেগম খালেদা জিয়া এবং তাঁর পুত্র তারেক জিয়া না বুঝলেও দলের নেতা-কর্মীদের তা না বোঝার কথা নয়। ‘প্রথম আলো’র মতো পত্রিকা যেখানে নানা সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশের সায় থাকত বিএনপির পক্ষে, সেখানে ইদানিং কেন উল্টো চিত্র, তা নিয়ে ভাববার কথা ছিল ওই দলের নীতি নির্ধারকদের।

দুর্ভাগ্যবশত, তা তাঁরা ভেবেছেন বলে মনে হয় না। গত প্রায় এক মাস অব্যাহত অবরোধের পরও সরকার পতনের সম্ভাবনা দেখা না দিলেও বেগম খালেদা জিয়া সংঘাতের পথ থেকে সরে আসেনি। তাঁর ঘোষিত অবরোধ-হরতালের নির্মম শিকার হয়ে অগ্নিদগ্ধ শিশু-যুবা-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটগুলোতে অপরিসীম যন্ত্রণা নিয়ে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছে। পুত্রের মৃত্যুতে গভীর শোকে মুহ্যমান হলেও খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের করুণ মৃত্যু বেগম খালেদা জিয়ার কঠিন হৃদয়ে কোনো দাগই ফেলতে পারে না।

২৯ জানুয়ারি ঢাকা শহরে হরতালের কোনো ঘোষণা না থাকার পরও এতিমদের অর্থ আত্মসাতের মামলায় খালেদা জিয়ার কোর্টে হাজিরা এড়াতে তড়িঘড়ি হরতাল ডেকে দেওয়া হয় নগর বিএনপির পক্ষ থেকে। বিএনপি-জামাতের নিজস্ব ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, কোচিং সেন্টার অবশ্য খোলাই থাকে। অন্যদিকে, অবরোধ-হরতালে কর্মহীন অভাবী মানুষকে আগুনে পোড়ার ঝুঁকি নিয়েও জীবন-জীবিকার সংগ্রামে নামতে হয়। বিএনপি-জামাত পিকেটারদের ছুঁড়ে দেওয়া পেট্রোল বোমার আগুনে পোড়া ট্রাক ড্রাইভার যখন রংপুর মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ইউনিটে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তখন স্ত্রীর আহাজারি, ‘আগুনে তো কোনো নেতা পোড়ে না’ শুনেও বেগম খালেদা জিয়ার চক্ষুলজ্জা হয় না।

অবরোধের কারণে সারা দেশে ক্ষেতের শাক-সবজি ক্ষেতেই নষ্ট; লেখাপড়া বন্ধ; পোশাক শিল্পে ধস; কষ্টের মৃত্যু– এসবের কারণে কৃষকের অভিশাপ, প্রায় পনের লাখ ছাত্রছাত্রীর জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমিক পরীক্ষার মধ্যে লাগাতার হরতাল ঘোষণায় ছাত্র-অভিভাবকদের গভীর হতাশা, কর্মহীন শ্রমজীবী নারী-পুরুষের যাতনা, বিশ্ব ইজতেমায় জড়ো হওয়া লাখ মুসল্লির অনুরোধ, ঈদে-মিলাদুন্নবি কিংবা সরস্বতী পূজা এবং এমনকি ছেলের মৃত্যু বা অপ্রত্যাশিতভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সশরীরে গুলশানের অফিসে এসে পুত্রহারা বেগম খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানাতে আসা– কিছুই টলাতে পারছে না বেগম খালেদা জিয়াকে।

জনগোষ্ঠীর যে অংশ আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে বিএনপিকে সমর্থন করে আসছিল তারাও ভেবে পাচ্ছে না কেন বেগম খালেদা জিয়া সংঘাতের এমন সর্বনাশা পথ যা দিয়ে সরকার পতন হবে না, তা থেকে সরে আসছেন না। যুদ্ধে পশ্চাদপসরণের একাধিক সুযোগ কেন হেলায় হারাচ্ছেন তিনি তাও বুঝতে বেগ পেতে হচ্ছে সচেতন দেশবাসীর।

এমন মরিয়া পরিস্থিতিতে দুই নেত্রীর মধ্যে সংলাপের তাগিদ দিচ্ছেন বিপর্যস্ত মানুষ ও সুশীল সমাজ। এটা অনেকটা এমন যে, জিম্মিকারীদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে হলেও জিম্মিদশা থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করা। সফল কিংবা বিফল, যাই হোক, দূর অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীজুড়ে নানা বিরোধ সমাধানে সংলাপের প্রয়োজনীয়তার কথা উদাহরণ দিয়ে উল্লেখ করেছি। শান্তিপূর্ণ সংলাপ-সমঝোতার জন্য বিবদমান দুই পক্ষকে সেই উপলব্ধিতে আসতে হয় যে, এছাড়া অন্য আর পথ খোলা নেই।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার জন্যে এক পক্ষের পরাজয় বা জেতার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য হয়ে পড়া প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। যেমনটা হয়েছিল ১৯৭১ সালে, নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের পর, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রে। বাংলাদেশে এমন উদাহরণ হল, ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণআন্দোলনের বিজয়ের মুখে ক্ষমতাসীন খালেদা জিয়া সরকারের নতি স্বীকার ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন মেনে নেওয়া। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বেগম খালেদা জিয়া তেমন পরিস্থিতিতে না যাওয়া পর্যন্ত রণে ভঙ্গ দেবেন না। তার কতকগুলো কারণও আছে।

খোদ ক্যান্টনমেন্ট থেকে উচ্ছেদ হওয়ার পর রাষ্ট্রযন্ত্রের শক্তিশালী স্তম্ভ, সেনাবাহিনী এবং সেনা গোয়েন্দা সংস্থা ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার সক্ষমতা তিনি অনেকটা হারিয়েছেন। রাজনীতিতে কখনও অংশ নেবেন না এই মুচলেকা দিয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দুই পুত্রকে তাদের লুণ্ঠিত অর্থসম্পদসহ দেশের বাইরে পাঠিয়েও তিনি শান্তিতে থাকতে পারেননি। খোদ মার্কিন এফবিআই-এর উদ্যোগে কোকোর পাচার করা অর্থের কিছু অংশ বাইরে থেকে বাংলাদেশে ফেরত এসেছে। মানি-লন্ডারিং মামলায় সাজা মাথায় নিয়ে সিঙ্গাপুরে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে তাকে।
অপর পুত্র, তারেক জিয়ার বিরুদ্ধে চলমান মামলার রায় হবে সামনে। হরতাল ও নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেও এতিমদের টাকা আত্মসাতের মামলা থেকে অব্যাহতি পাচ্ছেন না বেগম খালেদা জিয়া। আন্দোলনে জনগণের সমর্থন লাভে ব্যর্থ হয়ে শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে চোরাগুপ্তা আক্রমণে খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়ার প্রধান ভরসা জামায়াত-শিবির যুদ্ধাপরাধ মামলায় অনেকটা পর্যদুস্থ। এমন কোণঠাসা অবস্থায় সরকার পতনে শেষ মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন বেগম খালেদা জিয়া।

জনগণের জীবন-মরণ প্রশ্নে নির্ধারক অবস্থান না নিয়ে ভালো ভালো কথার আড়ালে নিজেদের নিরপেক্ষ চেহারা বজায় রেখে রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চাইছেন এমন সুশীলদের মুখপত্র ড. কামাল হোসেন ও মাহমুদুর রহমান মান্না গিয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে। শুধুমাত্র পুত্রশোকে কাতর একজন মাকে সমবেদনা জানাতেই গুলশানের কার্যালয়ে তাঁরা গিয়েছিলেন, মিডিয়ার সামনে এমন বয়ান দেওয়ার পরও একথা বুঝতে কারও অসুবিধা হয় না যে, মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি প্রত্যাহারে খালেদা জিয়াকে রাজি করাতেই তাঁরা গিয়েছিলেন সেখানে। সফল হননি। ভালোমানুষী নিরপেক্ষতার ঘোমটা অটুট রাখতে হলে পর্দার আড়ালে নয়, খোলাখুলিভাবে বেগম খালেদা জিয়ার উদ্দেশে তাদের বলতে হবে, অবরোধ-হরতাল প্রত্যাহার করুন, সরকারের সঙ্গে সংলাপের পরিবেশ সৃষ্টি করুন। আপনাদের কাছে এমন চাওয়া খুব বড় চাওয়া নয়।

সুশীলদের এমন আহ্বানে বেগম খালেদা জিয়া সাড়া দিলে নিজের এবং দলের জন্য ভালো করবেন। এর অন্যথা হলে পত্রিকার সমীক্ষায় যেমনটা পাওয়া গেছে– রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে শক্ত অবস্থান নিলে বর্তমান অচলাবস্থা কেটে যাবে– এই মতের পক্ষে শতকরা সত্তর ভাগ অংশগ্রহণকারীর সায় অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া। তার মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়া-তারেক জিয়া-জামাত চক্রকে নির্ধারকভাবে পরাজিত করেই সংলাপের পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

বিএনপির সভাপতি বেগম খালেদা জিয়া তার গুলশানস্থ পার্টি অফিস থেকে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সামনে নিজে সারাদেশে লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। সারা দেশের জনগণ তা দেখেছে। প্রায় মাসব্যাপী এই অবরোধে জীবন প্রদীপ নিভে গেছে এখন পর্যন্ত ৪৬ জন সাধারণ মানুষের। বিএনপি-জামাত জঙ্গিদের ছোঁড়া পেট্রোল বোমায় পুড়ে মারা গেছে নিহতদের প্রায় অর্ধেক। দেশের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে। পয়লা ফেব্রুয়ারি তারিখের পত্রিকায় প্রকাশিত কয়েকটি খবর: সিরাজগঞ্জে পেট্রোল বোমায় অটোরিকশা চালক নিহত-দগ্ধ পাঁচ; ঝিনাইদহে গরুর ট্রাকে পেট্রোল বোমা; যশোরে চালবোঝাই ট্রাক ও প্রাইভেট কারে আগুণ; খুলনায় পুলিশ দপ্তরে হাতবোমা বিস্ফোরণ; রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানায় বোমা মেরে পালানোর সময় দুই শিবির কর্মী ধৃত; চাঁদপুরে পেট্রোল বোমাসহ আটক এক।
বেগম খালেদা জিয়া ঘোষিত অবরোধ-হরতালে জানমালের এই ক্ষতির দায়দায়িত্ব তো তাঁকেই নিতে হবে। তাই আর কালবিলম্ব না করে সময়সীমা বেঁধে দিয়ে তাঁকে জানিয়ে দেওয়া হোক, অবরোধ-হরতাল প্রত্যাহার করুন। তা না হলে দেশ ও জনগণকে বাঁচাতে আপনাকে গ্রেপ্তার করা হবে।
 
২০১৪ সালের শুরুতে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট বিএনপির প্রতি আহবান জানিয়েছিল জামাত-হেফাজতের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত দলগুলোকে নিষিদ্ধ করার কথা বলেছিল। জানুয়ারি ১৬ তারিখের প্রকাশিত রেসোলিউশনে বলা হয়:
The European Parliament, [...] whereas the BNP opposition is continuing to cooperate with Jamaat-e-Islami and the splinter group Hafezat-e-Islam, which are regarded as the main instigators of the violence; [...] whereas during and after the elections thousands of citizens belonging to vulnerable minority groups, particularly Hindus, have been violently attacked and chased from their homes, reportedly mainly by Jammat e-Islami militants, for reasons partly linked to the ICT trials, as many of the prosecution witnesses are Hindus; [...] Believes that, in the interest of Bangladesh’s future, parties having a democratic reputation need to develop a culture of mutual respect; urges the BNP to unequivocally distance itself from Jamaat-e-Islami and Hafezat-e-Islam; [...] Stresses that parties which turn to terrorist acts should be banned; [...].

মার্কিন সিভিল ওয়ারের সময় প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন যখন জানতে পারেন মেরিল্যান্ড স্টেটের একটি রেললাইন তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ উপড়ে ফেলতে পারে, তিনি তখন একক সিদ্ধান্তে এবং সাময়িকভাবে রিট অব হেবিয়াস কর্পাস স্থগিত করেছিলেন। একেই বলা হয় গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব। জনগণের জন্য গণতন্ত্র এবং জনগণের শত্রুদের বিরুদ্ধে একনায়কত্ব। আমেরিকা, ইউরোপ, জাপান যেখানে কার্যকর গণতন্ত্র আছে, সেসব দেশে কোনো রাজনৈতিক দল বিএনপি-জামাতের মতো রাষ্ট্র ও জনগণ-বিরোধী সন্ত্রাসী অপতৎপরতা চালালে তাদের পরিণতি যা হত, তাই গ্রহণ করা হোক এদের বিরুদ্ধে। পৃথিবীর সকল গণতান্ত্রিক দেশে এই ব্যবস্থাই কার্যকর আছে।

মার্কিন সিভিল ওয়ারের সময় প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন একক সিদ্ধান্তে ও সাময়িকভাবে রিট অব হেবিয়াস কর্পাস স্থগিত করেছিলেন।

দেশে প্রকৃত ও কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য অবিলম্বে সংলাপ শুরু করা প্রয়োজন। ঠিক করে ফেলতে হবে ‘কার সঙ্গে সংলাপ, কী নিয়ে সংলাপ’, সেই প্রশ্নটি। একটি গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা বাংলাদেশ অর্জন করেছি। এই অর্জনে নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সে জন্যই তিনি জাতির পিতা। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অর্জন আমাদের সংবিধান ও চার মূলনীতিঃ গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র।
এসব মৌলিক বিষয়ে যারা একমত এবং এসব মতের বিরুদ্ধ শক্তি যেমন, জামাত ও ধর্মীয় জঙ্গি চক্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে যারা একমত হবেন, তাদের মধ্যে অর্থপূর্ণ সংলাপ শুরু হওয়া অতি জরুরি। খালেদা-তারেক-জামাতের নির্ধারক পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বিএনপি ও অন্যান্য ডানপন্থী দলের সুস্থ, গণতান্ত্রিক ও সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল অংশের সামনে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। মধ্য-ডান-বাম গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো সংলাপের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ বহু প্রত্যাশিত জাতীয় ঐকমত্য অর্জনে সমর্থ হবে।
গণতন্ত্র ও প্রগতির সম্ভাবনার বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে দ্রুতগতিতে, কিন্তু সুনিশ্চিত পদক্ষেপে।

ড. মো. আনোয়ার হোসেন: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments:

Post a Comment