Sunday, February 16, 2014

এই পরাজয় শুধু বিএনপির নয়, সুশীল সমাজেরও -আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী


আমার যেসব বন্ধু ঢাকার ‘ডেইলি স্টার’ কাগজটি পাঠ করেন, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ইদানীং আমাকে জিজ্ঞাসা করতে শুরু করেছেন, ‘পত্রিকাটির সম্পাদক মাহফুজ আনাম হঠাৎ এত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন কেন? আগে তাঁর লেখায় আওয়ামী ও হাসিনাবিদ্বেষ থাকলেও তাতে একটা সংযম ও শালীনতার বাঁধ ছিল। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের কিছু আগে থেকে সেই বাঁধটি হঠাৎ ভেঙ্গে গেল কেন? নিরপেক্ষতার ভান করে স্টারের সহোদরা প্রথম আলোর সম্পাদক আওয়ামী-বেসিংয়ের কাজটি চালাতেন। হঠাৎ সেই কাজটি মাহফুজ আনাম কেন আরও উলঙ্গভাবে করতে শুরু করেছেন?’

এই প্রশ্নটির জবাব দিতে আমাকে যে ভাবতে হয়নি তা নয়। কিন্তু দিয়েছি। নিজের বিচার-বিবেচনা অনুযায়ীই আমার এই জবাব। ‘স্টারের’ পাঠক বন্ধুদের বলেছি, মানুষ রাগলে তার আসল চরিত্রটা বেরিয়ে আসে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন হতে পারাটা এবং আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থেকে যাওয়াটা মাহফুজ আনামকে এতটাই ক্রুদ্ধ ও হতাশ করেছে যে, তাঁর সৌম্য শান্ত ভদ্র চেহারার আড়াল থেকে চরিত্রের আসল রূপটি বেরিয়ে এসেছে।

ক্রুদ্ধ হয়েছেন অবশ্য প্রথম আলোর মতিউর রহমানও। তিনি চালাক। তাঁর আওয়ামীবিদ্বেষী চেহারাটা বাইরে বেশি এক্সপোজড হয়ে যাওয়ায় তিনি এখন দুজন মুন্সি নিয়োগ করেছেন তাঁর হয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তীর ছোঁড়ার জন্য। তাতে পাল্টা তীরের প্রত্যাঘাত থেকে নিজে বেঁচে যাবেন ভাবছেন। তবে একটু কম চালাক মাহফুজ আনাম প্রচন্ড রাগে হঠাৎ স্বরূপে আবির্ভূত হয়েছেন।

তাঁর এই রাগের কারণও আছে। দীর্ঘকাল ধরে তাঁরা একটি স্বপ্নের চাষ করে আসছেন। সেটি হলো বাংলাদেশে রাজনৈতিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থপুষ্ট বিগ এনজিওগুলোর কর্তৃত্বাধীন একটি অনির্বাচিত সরকার গুড গবর্নেন্স বা সুশাসনের নামে প্রতিষ্ঠা করা। এটা সামরিক শাসনের যুগ নয়। তাই আমেরিকাও এখন কোন দেশে তার স্বার্থরক্ষা ও আধিপত্য রক্ষার জন্য সামরিক ডিক্টেটরশিপ প্রতিষ্ঠা করতে চায় না। সাবেক তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে তারা সামরিক বাহিনীর স্থলাভিষিক্ত করেছে বিগ এনজিও।

সামরিক বাহিনী থেকে কোন জেনারেলকে লৌহমানব সাজিয়ে ক্ষমতায় বসানোর বদলে তারা এই অনুগত এনজিওর কর্তাব্যক্তিদের মধ্য থেকে কাউকে নাইটহুড, কাউকে নোবেল পুরস্কার পাইয়ে দিয়ে দেশটির মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলে ক্ষমতায় বসিয়ে সে দেশে তাদের সাম্রাজ্যবাদী ও ধনবাদী বিশ্বস্বার্থ ও আধিপত্য স্থায়ী করতে চায়। এ জন্যই আগের বাতিস্তা, পিনোচেট, আইয়ুব, ইয়াহিয়ার বদলে মালিকি, কারজাই প্রমুখ অসামরিক ব্যক্তিদের আবির্ভাব ও ক্ষমতা লাভ। অবশ্য তাঁদের ক্ষমতায় আনার জন্য মার্কিন সেনাবাহিনীর পাহারায় নির্বাচন-প্রহসনও করতে হয়েছে। এখন আমেরিকা বাংলাদেশের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচনায় মুখর। কিন্তু তাদের প্রত্যক্ষ অথবা প্রচ্ছন্ন পাহারায় ইরাক, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে যে ধরনের নির্বাচন হয়েছে, তার প্রক্রিয়া সম্পর্কে নীরব।

তবে একটা ব্যাপারে মার্কিন তাঁবেদার সামরিক ডিক্টেটরদের মুখে যে সেøাগান শোনা গেছে, তা এখন আমেরিকার সমর্থনপুষ্ট বিগ এনজিওগুলোর কর্তাব্যক্তি এবং তাদের অর্থ ও অনুগ্রহপুষ্ট একশ্রেণীর সুশীল সমাজের মুখেও শোনা যায়। সেøাগানটি হলো ‘রাজনীতি খারাপ। রাজনৈতিক সরকার সুশাসন দিতে পারে না। তারা সকলেই দুর্নীতিপরায়ণ’-উপমহাদেশে এই সেøাগানটি প্রথম শোনা গিয়েছিল পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খানের মুখে। তিনি বন্দুকের জোরে ক্ষমতা দখল করে সেøাগান তুলেছিলেন, ‘উবাবষড়ঢ়সবহঃ ৎধঃযবৎ ঃযবহ ফবসড়পৎধপু’ (গণতন্ত্রের চাইতে উন্নয়ন দরকার)। 
আইয়ুবের দীর্ঘ দশ বছরের স্বৈরাচারী শাসনে দেখা গেল, রাজনৈতিক আমলের চাইতে পঞ্চাশগুণ বেশি দুর্নীতিতে তাঁর সব উন্নয়ন রাঘব বোয়ালে খেয়ে ফেলেছে। যে ‘নিউইয়র্ক টাইমস্্’ পত্রিকাটি তাদের দ্বারা সৃষ্ট লৌহমানব আইয়ুবের গুণগানে মুখর ছিল, সেই পত্রিকা আইয়ুবের পতনের আগে তাঁকে খেতাব দিয়েছিল। ‘থিফ অব বাগদাদ।’ তাঁর ছেলে গওহর আইয়ুবের সামান্য ক্যাপ্টেন পদ থেকে রাতারাতি ধনকুবের ও শিল্পপতি হওয়ার কাহিনীতে সংবাদপত্রের পৃষ্ঠা ভরে উঠেছিল।

বাংলাদেশে রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে আইয়ুবের সেøাগানের পুনরাবৃত্তি করেন ‘ক্ষুদে বাংলাদেশী আইয়ুব’ জেনারেল জিয়াউর রহমান। ‘রাজনীতিকরা সকলেই খারাপ’ শুধু এই কথা বলেই তিনি ক্ষান্ত হননি, ধমক দিয়ে বলেছিলেন, ‘ও রিষষ সধশব ঢ়ড়ষরঃরপং ফরভভরপঁষঃ ভড়ৎ ঢ়ড়ষরঃরপরধহং’ (আমি রাজনীতিকদের জন্য রাজনীতি করা কষ্টকর করে তুলব)। সেটা তিনি করেছিলেনও। ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’ ধ্বনি তুলে সরকারী ব্যাংক, বেসরকারী ব্যাংক, বিদেশী উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ এবং পেট্রোডলার দু’হাতে ছড়িয়ে দেশে চরিত্রহীন নব্য ধনপতি শ্রেণীর বিকাশ ঘটান এবং সেই সঙ্গে সৎ ও প্রকৃত রাজনীতিকদের রাজনীতি থেকে তাড়িয়ে এমন সব নব্য রাজনীতিককে বাজারে এনে প্রতিষ্ঠা দেন যাঁদের দুর্নীতি ও সন্ত্রাস-অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।
ইতিহাস একদিন সাক্ষ্য দেবে বাংলাদেশের মূল রাজনীতি, ছাত্র রাজনীতি ও যুব রাজনীতিকে জিয়াউর রহমানই প্রথম ‘পলুয়েটেড’ করার সূচনা করেন। তার পরবর্তী শাসক জেনারেল এরশাদ তাঁকে পূর্ণতা দেন। দুর্নীতিতে দেশ ভরে গেছে এই অজুহাত তুলে যিনি ক্ষমতা দখল করেছিলেন, তাঁর শাসনামলে দেখা গেল তিনি যাঁদের দুর্নীতির দায়ে জেলে পুরেছেন, তাঁদেরই জেল থেকে ছাড়িয়ে এনে তাঁর মন্ত্রী, ভাইস প্রেসিডেন্ট ইত্যাদি পদে বসাচ্ছেন। দুর্নীতির বিশ্ব রেকর্ড ভঙ্গের অভিযোগ নিয়ে গণ-অভ্যুত্থানের মুখে জেনারেল এরশাদকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে।

রাজনৈতিক শাসনেও দুর্নীতি হয়। এমন যে পবিত্র মক্কা শরীফ, সেখানেও চুরি, দুর্নীতির দায়ে প্রতিসপ্তাহে মানুষের কল্লা কাটা হয়। চীনে কমিউনিস্ট শাসনও দুর্নীতি উচ্ছেদ করতে পারেনি। কমিউনিস্ট পার্টি ও সরকারের বাঘা বাঘা নেতার দুর্নীতির দায়ে ফাঁসি হয়। রাজনীতিকরাও সকলে ফেরেশতা নন। তবে অরাজনৈতিক ও অনির্বাচিত শাসকদের মতো তাঁরা দু’হাতে শোষণ-লুণ্ঠন চালাতে পারেন না। তাঁদের একটা জবাবদিহিতা আছে, দায়বদ্ধতা আছে নির্বাচকমন্ডলীর কাছে। প্রতি ৫ বছর অন্তর তাঁদের নির্বাচকমন্ডলীর সামনে দাঁড়াতে হয়। তাঁদের দুর্নীতি ধরা পড়লে শুধু আদালতের বিচারেই দন্ডিত হন না, নির্বাচকম-লীর দ্বারাও প্রত্যাখ্যাত হন। সকল রাজনীতিকই যে ধরা পড়েন ও শাস্তি পান তাও নয়। সেটা রাজনীতির দোষ নয়; সমাজ ব্যবস্থার দোষ।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক শাসনে প্রচুর দুর্নীতি হয়েছে। তার একটা বড় কারণ, অস্ত্রের জোরে প্রকৃত রাজনীতি ও রাজনীতিকদের রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে হটিয়ে দিয়ে সামরিক ও স্বৈরাচারী শাসকরা বেপরোয়া লুটপাটের যে কলুষ প্রশাসনে ও রাজনীতিতে ছড়িয়ে দিয়ে যান, প্রকৃত রাজনীতিকরা ক্ষমতায় এসে তাঁর লেগাসি থেকে সহজে মুক্ত হতে পারেন না। মুক্ত হওয়ার জন্য রাজনৈতিক শাসনকে, তা যতই ভাল কিংবা মন্দ হোক একটা দীর্ঘ সময় দিতে হবে। বারংবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর ক্ষমতার হাত বদলই দেশে দুর্নীতির প্রকোপ ধীরে ধীরে হ্রাস করতে পারে। দুর্নীতি দূর করা গেলে সুশাসন প্রতিষ্ঠাও সম্ভব। কারণ, একটি অন্যটির সঙ্গে সম্পৃক্ত। কোন দেশে দুর্নীতির জোয়ারে শুধু উন্নয়ন নয়, সুশাসনও ভেসে যায়।

ভারতের মতো প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রের দেশে অব্যাহত রাজনৈতিক শাসনেও দুর্নীতির প্লাবন রোধ করা যায়নি। কিন্তু এই দুর্নীতির প্লাবন রোধে আন্না হাজারের মতো প্রতিবাদী কণ্ঠ কোটি মানুষের সমর্থন পেয়েছে। আম-জনতার পার্টি গঠিত হয়েছে। তারা দিল্লীর মতো রাজ্যে ক্ষমতা দখলও করেছে। কেন্দ্রে শাসক কংগ্রেস দল এখন দুর্নীতির অভিযোগে বিব্রত এবং নিজেদের সংশোধনে ব্যস্ত। ভারতে রাজনৈতিক শাসনের বদলে অনির্বাচিত সুশীল সমাজের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেও এটা হতে পারত না।

বাংলাদেশেও দুর্নীতি এবং আমলাতান্ত্রিক অপশাসন এতটা ঘাঁটি গেড়ে বসতে পারত না যদি রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক শাসনকে (তা যত ভাল অথবা খারাপ হোক) বার বার উচ্ছেদ করে সামরিক ও স্বৈরাচারী শাসন প্রতিষ্ঠা করা না হতো, সামরিক শাসকরা তাদের ক্ষমতার স্বার্থে রাজনীতিকদের একটা অংশকে চরিত্রভ্রষ্ট ও দুর্নীতিগ্রস্ত করার সুযোগ না পেতেন। তারপরও দুর্নীতি থাকত, যেমন আছে ভারতে, ব্রিটেনে কিংবা আমেরিকায়। কিন্তু নির্বাচন ও নির্বাচকম-লীর পাহারায় তার থাবা হতো নিয়ন্ত্রিত। গণতান্ত্রিক বা রাজনৈতিক শাসন নিয়মিত সময়ের নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেই নিজেকে সংশোধন করে। অন্য কোন শাসনে সেই সংশোধনের সুযোগ নেই। গণতান্ত্রিক রাজনীতির এখানেই মাহাত্ম।

বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ ও ধনবাদ তাই সাবেক তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে প্রকৃত রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক শাসনকে ভয় পায়। তাঁরা জানে রাজনৈতিক শাসন যত খারাপ হোক, জনগণের কাছে তাঁদের দায়বদ্ধতার দরুন তাঁরা সাম্রাজ্যবাদীদের একেবারে আজ্ঞাবহের ভূমিকা পালন করতে পারেন না; তাঁদের যে কোন গণবিরোধী কাজে সায় দিতে পারেন না। এটা পারে একটা অনির্বাচিত ও অরাজনৈতিক সরকার; যাদের অস্তিত্ব বিদেশীপ্রভুদের মদদ ও সমর্থনের ওপর নির্ভর করে। এ জন্যই অবিভক্ত পাকিস্তানের খাজা নাজিমউদ্দীন সরকারের চরিত্র অনেকটাই আধা নির্বাচিত ও রাজনৈতিক হওয়াতে ১৯৫৩ সালে প্রচণ্ড চাপের মুখেও আমেরিকার সঙ্গে সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরে সাহসী হননি। তখন ওয়াশিংটন থেকে বগুড়ার মোহাম্মদ আলীকে করাচীতে উড়িয়ে এনে অবৈধ ও অনির্বাচিতভাবে ক্ষমতায় বসিয়ে এবং পার্লামেন্টকে এড়িয়ে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি সম্পাদন করতে হয়েছিল।

বিশ্বময় সামরিক শাসন ডিসক্রেডিট হয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশেও আমেরিকা আর সামরিক শাসন বহাল রাখায় উৎসাহী হয়নি। তদ্দিনে দেশের ভেতরে বিগ এনজিওগুলো প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। আসলে এর অনেকই নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের পাল্টা অনির্বাচিত ও অদৃশ্য সরকার। এর নিয়ন্ত্রণ বিদেশীদের হাতে। সামনে একজন নেটিভ স্যার বা নোবেল লরিয়েটকে শিখ-ি খাঁড়া করা হয়। এই বিগ এনজিও, নব্যধনী গোষ্ঠী এবং তাদের আর্থিক ও অন্য সর্বপ্রকার সাহায্যে গড়ে ওঠা শহুরে এলিটক্লাস বা সুশীল সমাজ এই তিনের সমন্বয়ে যে ‘দেশীয় সামাজিক অভিজাত শক্তি’ গড়ে ওঠে সাম্রাজ্যবাদ ও ধনবাদ অধুনা সামরিক বাহিনীর বদলে তাদের ওপরে নির্ভর করতে চায় এবং তাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় বসিয়ে তাদের স্বার্থ ও আধিপত্য কায়েম রাখতে চায়। মুখে গণতন্ত্রের জন্য বড় বড় বুলি আওড়ালেও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ও ধনবাদ এশিয়া-আফ্রিকার কোন দেশেই প্রকৃত এবং শক্তিশালী রাজনৈতিক শাসন পছন্দ করে না।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সাধারণ নির্বাচনের সময়েও আমেরিকা ও ইউরোপের এই চাতুরির খেলা এবং সেই সঙ্গে তাদের স্টুজ একটি সুশীল সমাজ এবং এই সুশীলদের মুখপত্র দুটির ভূমিকাও আমরা দেখেছি। এই চাতুরির খেলা এবং চক্রান্তের রাজনীতি ও সাংবাদিকতা এবার ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতার জ্বালা ও হতাশাই মাহফুজ আনাম সংবরণ করতে পারছেন না। তিনি জানেন, ৫ জানুয়ারির ঘটনায় যে বড় পরাজয়টি হলো তা শুধু বিএনপির নয়, সুশীল সমাজেরও। এ সম্পর্কে একটু বিশদ আলোচনা প্রয়োজন। 

লন্ডন ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ বুধবার ॥
যুগটা সামন্ত বা ফিউডাল হোক, কিংবা ধনবাদ বা ক্যাপিটালিজমের হোক, সকল সময়ই দেখা গেছে সংশ্লিষ্ট দেশের এলিট ক্লাসের বড় অংশ রাজদরবারের বা এসটাবলিশমেন্টের অনুগত ভূমিকা পালন করেছে। তিনি রাজা বিক্রমাদিত্য হোন, সম্রাট অশোক হোন, কিংবা সম্রাট আকবর হোন, তাঁরা প্রধান সভাসদ হিসেবে দেশের এলিট ক্লাস বা বুদ্ধিজীবীদের মধ্য থেকে লোক বাছাই করতেন এবং তাদের দিয়ে ‘নবরত্নসভা’ বসাতেন।
এ যুগে আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডিকে দেখা গেছে, তিনি তাঁর প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠানে কবি রবার্ট ফ্রস্টকে আমন্ত্রণ করে এনেছিলেন তাঁর বন্দনা করে একটি কবিতা পাঠের জন্য। পরে এই রবার্ট ফ্রস্টের সঙ্গে হোয়াইট হাউসের সম্পর্ক ভাল থাকেনি।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে ইউরোপে ফ্যাসিবাদের উত্থানে সবচাইতে বেশি সহায়তা যুগিয়েছে ব্রিটেনসহ ইউরোপের উন্নত দেশগুলোর সুশীল সমাজের বড় অংশ। অক্সফোর্ড, কেমব্রিজের অধ্যাপকদের একটা বড় অংশ কমিউনিজম ও সোস্যালিজমের জোয়ার ঠেকানোর জন্য সেøাগান তুলেছিলেন ‘better dead then Red’ (লাল বা কমিউনিস্ট হওয়ার চাইতে মরে যাওয়া ভাল) পরে ফ্যাসিবাদী জার্মানিকর্তৃক ব্রিটেনসহ গোটা ইউরোপ আক্রান্ত হওয়ার পর এই পণ্ডিতকুলের মুখে আর রা সরেনি। 
পাকিস্তান আমলে আইয়ুবের ফৌজি শাসনের সময়ে তৎকালীন পাকিস্তানে সুশীল সমাজকে বশ মানিয়ে সামরিক শাসনের অনুকূলে জনসমর্থন তৈরির জন্য নাৎসি জার্মানির হিটলারের অনুসরণে সরাসরি সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় যে ‘রাইটার্স গিল্ড’ প্রতিষ্ঠা করা হয়, তার পূর্ব পাকিস্তান শাখায় লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের প্রগতিশীল অংশটির অধিকাংশকে যুক্ত করা হয় এবং তাঁরাও সানন্দে তাতে যোগ দেন। এই রাইটার্স গিল্ড ছিল প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুবের প্রিন্সিপাল অফিসার কুদরততুল্লা শেহাবের (পরে আলতাফ গওহরের) প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে। পাশাপাশি ছিল ব্যুরো অব ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশন নামে আরেকটি সংস্থা, এটি ছিল অর্থ ও সুযোগ-সুবিধা বিলিয়ে বুদ্ধিজীবী ক্রয়ের সংস্থা। এই সংস্থার সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন সুশীল সমাজের তখনকার একটি অংশ। কিন্তু তাতে কি তাঁরা বাঁচতে পেরেছিলেন? অপ্রীতিকর হলেও কথাটা সত্য, পরে ’৭১ সালে বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধ দমনে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞে এই প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদেরও অন্যদের সঙ্গে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশে গণহত্যার অন্যতম নায়ক পাকিস্তানের সেনা কর্মকর্তা রাও ফরমান আলী পাকিস্তানে (লাহোরে) প্রত্যাবর্তনের পর এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ঢাকায় বুদ্ধিজীবীদের হত্যার জন্য তাঁকে লোক খুঁজতে হয়নি। জামায়াত নেতাদের বলতেই তারা রাইটার্স গিল্ডের শীর্ষ নেতাদের নামের তালিকা সেনাবাহিনীকে দিয়েছিল। তাতে আরও কিছু নাম তারা যুক্ত করেছিল, রাইটার্স গিল্ডের সঙ্গে যাঁরা সম্পর্কিত ছিলেন না। করাচীর ‘দি লিডার’ নামক সান্ধ্য দৈনিকটি এই খবর প্রকাশ করেছিল।

সন্দেহ নেই, বর্তমানেও আওয়ামী লীগ ও হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে বর্তমান সুশীল সমাজের যে অংশটি উঠেপড়ে লেগেছেন, তাঁরা হয়ত কালিদাস পণ্ডিতের মতো গাছের যে ডালে বসে আছেন, সেই ডালটিই কাটার অবার্চীন সুলভ তৎপরতায় লিপ্ত আছেন। হাসিনা সরকার ভাল হোক আর মন্দ হোক, তাঁরা ক্ষমতায় না থেকে জামায়াত-বিএনপি ক্ষমতা দখল করতে পারলে এবং ক্ষমতায় পাকাপোক্ত হয়ে বসতে পারলে এই সুশীলদের অবস্থা কী হতো, একাত্তরের সুশীল সমাজের একটি বড় অংশের পরিণতি দেখেও তা তাঁরা উপলব্ধি করতে পারছেন না।

আমি আগেও লিখেছি, আমাদের তথাকথিত সুশীল সমাজের একটি বড় অংশই এখন বিগ এনজিওগুলোর গোপন রাজনৈতিক অভিসন্ধি পূরণের বাহন। এদের ওপর ইউনূস শিবিরেরই আধিপত্য বেশি। ইউনূস শিবিরের অঘোষিত ইংরেজী মুখপত্র ‘দি স্টার’। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনেও ইউনূস শিবিরের সকল তৎপরতা ব্যর্থ হওয়ায় স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের গাত্রদাহ বেশি। এখন গল্পের পাগলা মেহের আলীর মতো অবস্থা তাঁর। 

ব্যবসায় সংক্রান্ত (গ্রামীণ ব্যাংক) ও ব্যক্তিগত কারণে ড. ইউনূস কতটা হাসিনাবিদ্বেষী তার প্রমাণ মেলে গত নির্বাচনের সময় বিএনপি-জামায়াতের সমর্থনে তাঁর প্রকাশ্য ভূমিকা গ্রহণে। এই প্রকাশ্য ভূমিকা ছাড়া তাঁর আরও ভয়ঙ্কর একটি অপ্রকাশ্য ভূমিকা ছিল। সেটি হলো এবার মাইনাস টু নয়, মাইনাস ওয়ান ফর্মুলা (অর্থাৎ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে উচ্ছেদ করা) সফল করার জন্য যে কোন পন্থার আশ্রয় গ্রহণ।

আমি খবরটা লন্ডনে বসে নির্ভরযোগ্য সূত্রে পেয়েছি। কতটা সঠিক হলপ করে বলতে পারব না। কিন্তু যিনি বলেছেন তিনিও ড. ইউনূসকর্তৃক আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। তবু খবরটা সঠিক না হলে সংশ্লিষ্ট মহল যদি প্রতিবাদ করেন, তাহলে আমার পরবর্তী লেখায় তা উল্লেখ করে ভুল শোধরাব। খবরটা হলো নির্বাচনের কিছুদিন আগে ড. ইউনূস কয়েকজন বুদ্ধিজীবীকে আলাচনার নামে আমন্ত্রণ জানান। তাদের মধ্যে রেহমান সোবহান ও ড. আনিসুজ্জামানও ছিলেন। শেখ হাসিনাকে যে কোনভাবে হোক দেশের রাজনীতি থেকে সরাতে হবে- এই কথাটি যখন ড. ইউনূস ব্যাখ্যা করছিলেন, তখন রেহমান সোবহান নাকি রেগে উঠে বলেন, "এবানডন দিস আইডিয়া (এই মতলব বাদ দাও)। "এই মন্তব্যের পর বৈঠকটি ভন্ডুল  হয়ে যায়। 

এই খবরটি আমার কাছে সঠিক মনে হয়েছে এ কারণে যে, ইউনিভার্সিটিতে ড. ইউনূসের শিক্ষক ছিলেন রেহমান সোবহান। তিনি ড. ইউনূসকে ধমকানোর সাহস রাখেন। আমার শুধু বিস্ময় এই যে, হাসিনাবিরোধী চক্রান্ত বন্ধ করার জন্য ড. ইউনূসকে যে রেহমান সোবহান ধমকাতে পারেন, তিনি তার কিছুদিন পরই ‘স্টপ দ্য ইলেকশন’ এ দাবি তুলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সভাতে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ও মাহফুজ আনামদের মতো ইউনূস শিবিরের শিখন্ডিদের সঙ্গে কী করে গলা মেলান?

এখানেই আমাদের সুশীল সমাজের চরিত্রভ্রষ্টতার প্রশ্নটি এসে যায়। অতীতেও এরা যতই প্রগতিশীলতার মুখোশ ধারণ করুন না কেন, এদের বড় অংশই ছিল এসটাবলিশমেন্টের দাস। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে এদের একটা অংশের চরিত্র-বৈশিষ্ট্যে ব্যতিক্রম দেখা যায়, যেমন তখনকার ফোরাম গ্রুপের (ঋড়ৎঁস মৎড়ঁঢ়) ভূমিকা। তার কারণ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় এসটাবলিশমেন্টের পূর্ব পাকিস্তানের সুশীল সমাজের প্রতি উপেক্ষা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সুশীল সমাজের মতো তাদের সুযোগ-সুবিধা না দেয়া।

ইত্যবসরে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানেও বাঙালীদের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠিত কায়েমী স্বার্থ ও বড় ব্যবসায়ীদের প্রতিযোগী একটি নব্য পুঁজিপতি শ্রেণীর বিকাশ শুরু হয়। পূর্ব পাকিস্তানের শীর্ষ অর্থনীতিবিদরা (সুশীল সমাজেরও নেতা) যেমন রেহমান সোবহান, ড. নূরুল ইসলাম প্রমুখ এই নতুন পূর্ব পাকিস্তানী বিত্তবানদের মুখপাত্র সেজে ভবিষ্যতে অধিকতর লাভবান হওয়ার কৌশল গ্রহণ করেন। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের নব্য পুঁজিপতিদের অধিকাংশের সঙ্গে রেহমান সোবহানের মতো অর্থনীতিবিদরা বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার সরব সমর্থক হয়ে ওঠেন। তখনকার তরুণ আইনজীবী ড. কামাল হোসেনও এই দলে এসে জোটেন। তাদের উদ্যোগে যে ইংরেজী সাপ্তাহিক ফোরাম পত্রিকা প্রকাশিত হয়, তা কার্যত ছয় দফা আন্দোলনের শক্তিশালী সমর্থক হয়ে ওঠে।

বাঙালীর রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক স্বাধিকারের দাবি ছিল ছয় দফাতে। পূর্ব পাকিস্তানের নব্য পুঁজিপতিরা ভেবেছিলেন, এই অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের সুযোগে পশ্চিম পাকিস্তানের বিগ বিজনেসের প্রতিযোগিতামুক্ত যে বিরাট বাজার তাঁরা পাবেন, তাতে রাতারাতি তাঁরা বাঙালী আদমজী, ইস্পাহানি হয়ে উঠবেন। ছয় দফা দাবি সমর্থনের মুখোশের আড়ালে রেহমান সোবহানরা তখন ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের এই উদীয়মান ও নব্যপুঁজির মুখপাত্র।

তখন এই পুঁজিপতিরা বুঝতে পারেননি ছয় দফাই বঙ্গবন্ধুর কাছে শেষ কথা নয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি এ দেশীয় পুঁজিপতিদেরও (তাঁর দলের ভেতরেও তারা ছিল) অবাধ লুণ্ঠন বন্ধ করার জন্য বাকশাল পদ্ধতির শাসন প্রবর্তন করে কমান্ড অর্থনীতি ও রাজনীতি অনুসরণ করবেন। এই বাকশাল পদ্ধতি প্রবর্তিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন মন্ত্রিসভায় শপথ না নিয়ে কিছুকালের জন্য অক্সফোর্ডে নানা অজুহাতে পালিয়ে গিয়ে থাকেন ড. কামাল হোসেন। এর পর বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে সঙ্গে রেহমান সোবহানের গ্রুপটিও অক্সফোর্ডে গিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য আশ্রয় নেন। দেশে ফ্যাসিস্ট মিলিটারি শাসন প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে সুশীল সমাজের প্রতিরোধ গড়ার কোন চেষ্টাই তখন দেখা যায়নি। সুশীল সমাজের শীর্ষ নেতারাই পালিয়ে গেলে বাকিরা আর কী করবেন? তাদের কেউ কেউ তখন আবার সামরিক জান্তার অনুমোদনে আন্তর্জাতিক সংস্থায় চাকরিও নিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর লন্ডনের রেডিক্যাল এশিয়া বুকস পাবলিকেশন্স বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত একটি ইংরেজী বই প্রকাশ করেন। তাতে প্রকাশিত নিজের লেখায় রেহমান সোবহান বলেন, শেখ মুজিবের হত্যাকা-ের একটা বড় কারণ যে নব্য বাঙালী পুজিপতি শ্রেণীর সমর্থন ভিত্তি করে তাঁর নেতৃত্বের বিকাশ, সেই শ্রেণী তাঁকে তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধাচারী (পষধংং-ঃৎধরঃড়ৎ) মনে করেছিল। তাঁর জাতীয়করণ নীতি ও বাকশাল শাসন প্রতিষ্ঠা এই পুঁজিপতিদের বিকাশের পথ বন্ধ করে দিয়েছিল।’
কথাটা সত্য। রেহমান সোবহান কেবল বলেননি, তাঁরাও ছিলেন এই নব্য উদীয়মান বণিক স্বার্থের সহযোগী। বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক শোষণ-মুক্তির রাজনৈতিক পথের সহযাত্রী নন। সে দিনও গণতন্ত্রের নামে বাকশাল পদ্ধতির সমর্থনে তাঁরা দ্বিধা ও অসন্তোষ দেখিয়েছেন। বর্তমানেও তাঁরা গণতন্ত্রের নামে দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য শেখ হাসিনার কঠিন সংগ্রামের বিরোধিতা করছেন। 

No comments:

Post a Comment