Sunday, February 16, 2014

এক রাজাকারের আত্মজীবনী - মুনতাসীর মামুন


॥ ১ ॥
‘রাজাকার’, ‘দালাল’, যোগসাজশকারী বা ‘কোলাবরেটর’, ‘আল-বদর’, ‘আল-শামস’ শব্দগুলোর সঙ্গে ১৯৭১ সালের আগে বাঙালীর কোন পরিচয় ছিল না। দালাল শব্দটির সঙ্গে অবশ্য পরিচয় বাঙালীর অনেক দিনের। তবে, ১৯৭১ সালে ‘দালাল’ বা ‘দালালি’ যে অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে সে অর্থে নয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বিভিন্ন গ্রুপের গঠন, গ্রুপের সদস্যদের মন-মানসিকতার ভিত্তিতে উদ্ভব হয়েছে শব্দগুলোর।

১৯৭১ সালের পরিপ্রেক্ষিতে দালাল কে? জানুয়ারি ১৯৭২ সালে দালাল অধ্যাদেশ ‘বাংলাদেশ কোলাবরেটরস স্পেশাল ট্রাইব্যুনালস অর্ডার ১৯৭২’ জারি করা হয়। এতে দালাল বা যোগসাজশকারী বা কোলাবরেটরদের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে-
“১. পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে বাংলাদেশে বেআইনী দখল টিকিয়ে রাখার জন্য সাহায্য করা, সহযোগিতা বা সমর্থন করা।
২. প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দখলদার পাকবাহিনীকে বস্তুগত সহযোগিতা প্রদান বা কোন কথা, চুক্তি ও কার্যাবলীর মাধ্যমে হানাদার বাহিনীকে সাহায্য করা।
৩. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা বা যুদ্ধের চেষ্টা করা।
৪.মুক্তিবাহিনীর তৎপরতার বিরুদ্ধে এবং মুক্তিকামী জনগণের কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা।
৫. পাকবাহিনীর অনুকূলে কোন বিবৃতি প্রদান বা প্রচারণায় অংশ নেয়া এবং পাকবাহিনীর কোন প্রতিনিধি, দল বা কমিটির সদস্য হওয়া। হানাদারদের আয়োজিত উপনির্বাচনে অংশ নেয়া।” 
উল্লেখিত সমস্ত গ্রুপই এর আওতায় পড়ে। যে অর্থে রাজাকার, কোলাবরেটর, আল-বদর বা পাকিস্তানপন্থী-সবাইকেই দালাল বলা হয়।

রাজাকার বাহিনী বা রাজাকারদের সংগঠন করেছিল তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। জেনারেল টিক্কা খান ১৯৭১ সালের জুন মাসে রাজাকার অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন।
 পূবর্তন আনসার, মুজাহিদদের নিয়ে প্রাথমিকভাবে এ দল গঠিত হয়। কিন্তু পরে বিভিন্ন শ্রেণীর পাকিস্তানপন্থীরা এই বাহিনীতে যোগ দেয়। এরা ছিল সশস্ত্র। হানাদার বাহিনীর দোসর হিসেবেই তারা মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে লড়েছে। জেনারেল নিয়াজী এক সাক্ষাতকারে আমাকে বলেছিলেন যে, রাজাকার বাহিনীর তিনিই স্রষ্টা। তারা যথেষ্ট খেদমত করেছে পাকিস্তানী বাহিনীকে, যে কারণে তাঁর বইটি তিনি তাদের উদ্দেশেই উৎসর্গ করেছেন।
আল-বদররা ছিল ডেথ স্কোয়াড। রাজাকার বাহিনীর পর পরই এটি গঠিত হয়। তবে, রাজাকার অধ্যাদেশের মতো কোন আইনগত বিধান এর ভিত্তি নয়। কিন্তু, পাকিস্তানী বাহিনীর প্রেরণায় এরা সংগঠিত হয় এবং হানাদার বাহিনীর সঙ্গে এদের যোগাযোগ ছিল গভীর। আল-বদর বাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য উপকরণ হানাদার বাহিনীই যুগিয়েছে। রাও ফরমান আলির নোটে আল-বদরদের উল্লেখ আছে।
অবশ্য, সরকারীভাবে পাকিস্তানী বাহিনী তা অস্বীকার করেছে। আল-বদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন বর্তমান জামায়াতে ইসলামীর নেতা মতিউর রহমান নিজামী। ৭ নবেম্বর ১৯৭১ সালে তারা ‘আল-বদর দিবস’ পালন করে। ১৪ নবেম্বর ১৯৭১ সালে নিজামী ‘দৈনিক সংগ্রাম’-এ আলবদর বাহিনী সম্পর্কে লেখেন-
“...আমাদের পরম সৌভাগ্য বলতে হবে। পাকসেনার সহযোগিতায় এদেশের ইসলামপ্রিয় তরুণ ছাত্র সমাজ বদর যুদ্ধের স্মৃতিকে সামনে রেখে আল-বদর বাহিনী গঠন করেছে। বদর যুদ্ধে মুসলিম যোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল তিন শত তেরো। এই স্মৃতিকে অবলম্বন করে তিন শত তেরোজন যুবকের সমন্বয়ে এক একটি ইউনিট গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বদর যোদ্ধাদের সেই সব গুণের কথা আমরা আলোচনা করেছি, আল-বদরের তরুণ মুজাহিদদের মধ্যে ইনশাআল্লাহ, সেই সব গুণাবলী আমরা দেখতে পাব।”

“পাকিস্তানের আদর্শ ও অস্তিত্ব রক্ষার দৃঢ় সঙ্কল্প নিয়ে গঠিত আল-বদরের যুবকেরা এবারের বদর দিবসে নতুন করে শপথ নিয়েছে, তাদের তেজোদীপ্ত কর্মীদের তৎপরতার ফলেই বদর দিবসের কর্মসূচী দেশবাসী তথা দুনিয়ার মুসলমানের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। ইনশাআল্লাহ বদর যুদ্ধের বাস্তব স্মৃতিও তারা তুলে ধরতে সক্ষম। তরুণ যুবকেরা আমাদের সশস্ত্রবাহিনীর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হিন্দু বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে হিন্দুস্তানকে খতম করে সারা বিশ্বে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করবে।”

রাজাকারদের সঙ্গে আল-বদরদের খানিকটা তফাত ছিল। রাজাকাররা সামগ্রিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরোধিতা করেছে, সংঘর্ষ হলে খুন করেছে, লুটপাট ও ধর্ষণ করেছে। অনেকে যুদ্ধকালীন দুরবস্থার কারণে বাধ্য হয়েও রাজাকার হয়েছে, কিন্তু, আল-বদরদের লক্ষ্য ছিল স্থির। প্রকৃতিতে তারা ছিল অতীব হিংস্র ও নিষ্ঠুর। তারা বাঙালী বুদ্ধিজীবীদের সম্পূর্ণভাবে নিকেশ করে দিতে চেয়েছে। কারণ, তারা অনুধাবন করেছিল, যে ধরনের শাসন তারা করতে চায়, বুদ্ধিজীবীরা হয়ে উঠবে তার প্রধান প্রতিবন্ধক। মুক্তিযুদ্ধ তো ছিল একটি আদর্শগত লড়াইও। বাঙালী বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল বাংলাদেশ তত্ত্বে বিশ্বাসী যা পরে প্রতিফলিত হয়েছিল ১৯৭২ সালের সংবিধানে। দালালরা ছিল পাকিস্তান তত্ত্বে বিশ্বাসী। এই তত্ত্বে যারা বিশ্বাসী তাদেরও বিভিন্ন পর্যায় ছিল। রাজাকারদের মন-মানসিকতা বুঝতে হলে পাকিস্তান তত্ত্ব বা প্রত্যয় এবং এর বিভিন্ন পর্যায়ের খানিকটা ব্যাখ্যা দরকার। তা হলে বুঝতে পারব, কারা দালালি করেছে, কেন করেছে?
বাকি রইল আল-শামস। এরা আল-বদর ধরনেরই আরেকটি স্কোয়াড। হত্যাই ছিল যাদের মূল লক্ষ্য।

॥ ২ ॥
এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে এক ধরনের স্বাতন্ত্র্য বোধ কাজ করেছে সেই ষষ্ঠ শতক থেকেই। ১৯৪৭-এর আগে এই আঞ্চলিকতা বোধ রূপান্তরিত হতে থাকে বাঙালী মুসলিম জাতীয়তাবাদে। এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, বাঙালী হলেও আগে মুসলমান হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তান চেয়েছিল। গত শতকের শেষার্ধ থেকে বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় হিসেবে মুসলমানদের স্বাতন্ত্র্যবোধের সৃষ্টি হয়েছিল। সম্প্রদায় হিসেবে সে ছিল অধস্তন। একজন বর্ণহিন্দু একজন শূদ্রের সঙ্গে যে ব্যবহার করে একজন মুসলমানের সঙ্গেও সে ব্যবহারে কোন তারতম্য ছিল না।
আজিজুর রহমান মল্লিক ও সৈয়দ আনোয়ার হোসেন একটি প্রবন্ধে বিষয়টির আরও ব্যাখ্যা দিয়েছেন-“মুসলমানদের এই পৃথক পরিচয় দাবি বাহ্যত ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক প্রকৃতির বলে প্রতীয়মান হলেও মূলত তা ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের আর্থ-রাজনৈতিক সমাজ-পরিবেশে একটি প্রান্তিকীকৃত অর্থাৎ ন্যায্য অধিকার বঞ্চিত সম্প্রদায়ের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম।

এর ফলে, উপমহাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিম-লে জনসংখ্যার অবস্থানগত বাস্তবতা এখানকার হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়কে পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড় করায়, যেখানে হিন্দুরা ছিল প্রায় সকল সুযোগ-সুবিধার অধিকারী এবং মুসলমানরা ছিল ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত।”

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর উঠতি বাঙালী মধ্যবিত্ত মুসলমান অর্থনৈতিক সুবিধা পেয়েছিল। মুসলিম লীগ ছিল নেতৃত্বে। কিন্তু সমগ্র পাকিস্তান ভিত্তিতে বাঙালী মুসলিম লীগ নেতারা ছিল অধস্তন। অন্যদিকে, বাঙালী হিন্দুদের দেশত্যাগ বেশ একটা বড়সংখ্যক বাঙালী মুসলমানকে সুযোগ করে দিয়েছিল সম্পদের ভিত্তি গড়ার। 

রাজনৈতিক যোগাযোগ ছিল যাদের সুবিধাটি তারাই পেয়েছিল। এভাবে আদর্শের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল কায়েমি স্বার্থ। তবে, পাকিস্তানী আদর্শকে সামনে রেখে অর্থাৎ ধর্মকে ব্যবহার করে ‘ইসলামপন্থী’ কিছু দলের সৃষ্টি হয়, যেমন-জামায়াতে ইসলাম, নেজামে ইসলাম প্রভৃতি। মুসলিম লীগের সঙ্গে এদের লড়াইটা ছিল আদর্শ থেকে ক্ষমতা করায়ত্তের।

এর বিরুদ্ধে সংস্কৃতির প্রশ্নেই দ্বন্দ্বটি প্রকট হয়ে ১৯৪৭-এর পর থেকে যার বিস্ফোরণ ঘটে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে। এর সঙ্গে যুক্ত হলো অর্থনীতি। মধ্যবিত্ত তো বটেই সাধারণ বাঙালীর প্রসারণের সুযোগই সংকুচিত হয়ে গেল। ফলে, সংস্কৃতির সত্তায় স্বাধীনতা ও প্রসারণের দাবিতে এগিয়ে এল পাকিস্তান কাঠামোর ভেতরেই অন্যান্য দল, যার মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টি, আওয়ামী লীগ, ন্যাপ প্রধান। 

পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী সবসময় ইসলামকেই শোষণ ও কায়েমি স্বার্থ বজায় রাখার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। শাসকদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ হলেই তা দেখা হতো ইসলামদ্রোহী হিসেবে। সমীকরণটি ছিল এরকম-ইসলামের বিরোধিতা মানে ভারতকে সমর্থন। ইসলামের প্রতীক পাকিস্তান, হিন্দুত্বের প্রতীক ভারত। পাকিস্তানী শাসকদের বিরোধিতা করার অর্থ হচ্ছে হিন্দুত্ব সমর্থন। কেন্দ্রের অধস্তন বাঙালী সহযোগীরাও তা বিশ্বাস করত এবং প্রচার করত (যেমন মুসলিম লীগ, জামায়াত)।

 অধস্তন হলেও তারা তৃপ্তি পেত এই ভেবে যে, তারাও ক্ষমতার সহযোগী, কখনও কখনও অংশীদার এবং সে সুযোগে অর্থনৈতিক উপায়েরও সুবিধাভোগী। তবে, তাদের সবাই অর্থনৈতিক সুবিধার অংশীদার ছিল তা নয়, কিন্তু মনোজগতে যে আধিপত্য সৃষ্টি করেছিল দল তা ভাঙ্গা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।

১৯৫৮ সালে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের পর পাকিস্তান প্রত্যয়ে নতুন কিছু উপাদান যুক্ত হলো। ধর্ম ছাড়াও শাসনের উপাদান হিসেবে যুক্ত হলো আমলা, বিশেষ করে সামরিক আমলাতন্ত্রের আধিপত্য। এর অর্থ, আমলাতন্ত্র, বিশেষ করে সামরিক আমলাতন্ত্র কর্তৃক সিভিল সমাজ ও রাজনীতিবিদদের ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা, অভ্যন্তরীণ লুটের প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ (বিশেষ করে পাকিস্তানবিরোধী) এ আদর্শ, আরও অনেক বাঙালীকে যুক্ত করতে পেরেছিল শাসকদের সঙ্গে।

এই সামগ্রিক বঞ্চনার আবেগ পাকিস্তানের পরিসরে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালীর মনে সেই পুরনো আঞ্চলিকতার রেশ ফিরিয়ে আনে অর্থাৎ পূর্ববঙ্গ একটি একক যা বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা বা স্বায়ত্তশাসনের রূপরেখা তারই প্রতিফলন। ছয় দফা প্রত্যাখ্যাত হলে সৃষ্টি করা হয় ‘পাকিস্তান’-এর বিপরীতে সোনার বাংলা মিথ। আঞ্চলিকতা বোধ উত্তরিত হয় জাতীয়তাবাদে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালী সোনার বাংলার স্বপ্ন মেনে নিতে থাকে। প্রশ্ন ওঠে সোনার বাংলা শ্মশান কেন? 

লিখেছেন বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর-“এভাবে পুনর্নিমিত, পুনর্গঠিত হয়েছে ইতিহাসের দিক থেকে মৌল এবং স্থায়ী এক প্রতিরোধ পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্গত পূর্ব পাকিস্তান/বাংলাদেশের মধ্যে। সোনার বাংলার এই নির্মাণের ফলে পাকিস্তানের কেবল কথা বলার অধিকার আছে এবং পূর্ব বাংলা/পূর্ব পাকিস্তান/বাংলাদেশ কেবল নীরব, স্তব্ধ, মৌন, এই ধারণা যায় বদলে। এটি বদলে দেয় পরিস্থিতি এবং সাব অলটার্ন বাঙালীদের অভিজ্ঞতা, ইতিহাস, সংস্কৃতি, সমাজের বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যার মধ্যে স্পষ্ট হতে শুরু করে দ্বৈরথের সম্মুখীন হয়ে, নিশ্চিতভাবেই জাতীয়তাবাদী ইতিহাস তত্ত্বের ভিত্তিতে।

শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর নেতৃত্বে বাঙালী নতুন আদর্শ প্রতিষ্ঠার সঙ্কল্প নেয়। মানসিকভাবে বাঙালী প্রস্তুত হয়ে ওঠে দ্বৈরথের জন্য। অন্যদিকে, ১৯৭০-এর নির্বাচনের আগে সংখ্যাগরিষ্ঠের মনোজগতে পরিবর্তন আসা শুরু করলেও পাকিস্তান আদর্শের ধ্বজাধীরারা তা গ্রাহ্যের মধ্যে আনেনি। কারণ, তাদের ধারণা ছিল মনোজগতে এবং কায়েমি স্বার্থ কেন্দ্রগুলোতে তাদের আধিপত্য কেউ ভাঙতে পারবে না, তা অটুট।


॥ ৩ ॥
১৯৭০-এর নির্বাচনের পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। পাকিস্তান আদর্শের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে বাংলাদেশ আদর্শ। পাকিস্তান আদর্শ যারা অটুট রাখতে চেয়েছিল তারা গুরুত্ব দেয় পেশীশক্তির ওপর। পরিণামে শুরু হয় তাদের ভাষায় ‘গৃহযুদ্ধ’।
 বাংলাদেশ আদর্শের পতাকাবাহীদের ভাষায় মুক্তিযুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধ পাকিস্তান আদর্শবাদীদের জন্য বিপন্ন অবস্থার সৃষ্টি করে। এদের মধ্যে যাঁরা নিষ্ক্রিয় জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন তাঁরা মানসিক কষ্টের শিকার হলেও নিষ্ক্রিয়ই ছিলেন। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধকে পাকিস্তান আদর্শের বিপর্যয় হিসেবেই দেখেছিলেন। কারণ, তাঁদের কাছে কখনও মনে হয়নি বাঙালী পরিচয়টি প্রথম, পাকিস্তানী পরিচয় আসে তার পরে।

রাজনীতির সঙ্গে যারা যুক্ত ছিল তারা ফিরতে চায়নি। কারণ, পাকিস্তান আদর্শ ও কেন্দ্রের সেনাবাহিনীর শক্তি তাদের কাছে ছিল অজেয়। তাদের মনে হয়েছিল, বাংলাদেশের আদর্শ জয়ী হলে তাদের স্থান হবে বিপন্ন। যে রাজনীতি করে তারা ক্ষমতার অংশীদার বা কায়েমি স্বার্থের অংশীদার হয়েছিল সেটি থাকবে না। নতুন বাংলাদেশে তাদের স্থান থাকবে না। এর চেয়ে পাকিস্তানে অধস্তন হিসেবে ক্ষমতার সহযোগী হওয়া ছিল শ্রেয়। এখানে আদর্শ বা ধর্মের প্রশ্ন আসতে পারে। কিন্তু সেটি গৌণ।

 সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালী কি মুসলমান ছিল না? বা ইসলামে বিশ্বাস করত না? তবে ধর্মটিকে ঢাল হিসেবে রাখা ছাড়া তাদের উপায় ছিল না। একটা উদাহরণ দিলেই তা স্পষ্ট হবে। তারা যা করেছে তা কি ইসলামী আদর্শে অনুমোদিত? ফলে, অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে যা করার করেছে। ড. সাজ্জাদ হোসায়েনের পক্ষে সম্ভব ছিল না, সাধারণ আল-বদরের মতো অস্ত্র হাতে ঘোরা। কিন্তু লক্ষ্য ছিল এক। ফলে, যার যার অবস্থান থেকে সে সে কাজ করে গেছে। এভাবে সৃষ্টি হয়েছে পাকিস্তানীদের দালালদের, দালালদের মধ্যে অবস্থানগত কারণে আবার বিভিন্ন গ্রুপের। এর মধ্যে সবচেয়ে হিংস্র ও ফ্যাসিস্ট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে জামায়াতে ইসলাম ও তার অঙ্গ সংগঠন ছাত্রসংঘ। 

পাকিস্তানের অ্যাকাডেমিশিয়ান আব্বাস রশীদ ‘পাকিস্তান : মতাদর্শের পরিধি’ শীর্ষক প্রবন্ধে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন- “উলেমাগোষ্ঠীর নিকট আইউব খানের নির্ভরশীলতার মধ্য দিয়ে সামরিক বাহিনী এবং সনাতনপন্থী সংগঠনের মাঝে অসম হলেও পারস্পরিক ফলপ্রসূ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তবে, সনাতনপন্থীদের প্রতিনিধি হিসেবে অগঠিত, অসংঘবদ্ধ উলেমাগোষ্ঠী নয় বরং তাদের স্থান ইতোমধ্যে দখল করে নেয় সুসংগঠিত জামায়াতে ইসলামী। জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্ব পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞকে কেবল সমর্থনই করেনি, তাদের কর্মী ও সদস্যরা শান্তি কমিটিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। সামরিক বাহিনী কর্তৃক সৃষ্ট এই শান্তি বাহিনীর দায়িত্ব ছিল বিদ্রোহ দমনে সামরিক কর্মকর্তাদের সহায়তা করা। আদর্শগত পর্যায়েও জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত সামরিক বাহিনী স্বাগত জানিয়েছিল সর্বান্তকরণে।” তাই আমরা দেখি, আল-বদর ও আল-শামসদের মধ্যে জামায়াতের কর্মীই বেশি।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পরই দালালদের দ্বারা গঠিত হয় শান্তি কমিটি। ২৬ এপ্রিল, ১৯৭১ সালের ‘দৈনিক পাকিস্তানে’র সংবাদ অনুসারে “স্বাভাবিক জীবনযাত্রা দ্রুত পুনর্প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রবিরোধী ও সমাজবিরোধী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে জনগণকে সজাগ রাখা ও গুজব রচনাকারীদের দুরভিসন্ধি প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে এই কমিটি গঠিত হয়েছে।” এর সদস্যরা ছিল পাকিস্তান আদর্শের অনুসারী বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, এলিট, যারা অস্ত্রহাতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ করতে যায়নি। কিন্তু হত্যাকান্ডে  পরিকল্পনায় বা অংশগ্রহণে তারা নিষ্ক্রিয় ছিল না অনেক ক্ষেত্রে।
বিভিন্ন পেশায় বা পদে থেকে এবং রাজনীতিবিদ হিসেবে যারা হানাদারদের সহযোগিতা করেছে সেই সময়, তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে ‘কোলাবরেটর’ হিসেবে। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক অনেকেই ছিলেন।

এরপর ছিল রাজাকার। আসলে এর শুদ্ধ উচ্চারণ ‘রেজাকার’- ফারসী শব্দ। ‘রেজা’ হলো স্বেচ্ছাসেবী, ‘কার’ অর্থ কর্মী। এক কথায় স্বেচ্ছাসেবী। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় হায়দরাবাদের নিজাম অনিচ্ছুক ছিলেন ভারতের সঙ্গে মিলনে। আত্মরক্ষার জন্য তিনি গঠন করেছিলেন একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী যার নাম দেয়া হয়েছিল রেজাকার বাহিনী।

মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াত নেতা এ.কে.এম. ইউসুফ শব্দটি ধার করেন এবং খুলনায় রেজাকার বাহিনীর সূত্রপাত করেন। ‘একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়’ গ্রন্থের তথ্য অনুযায়ী, ৯৬ জন জামায়াত কর্মী নিয়ে এই বাহিনীর সূত্রপাত যা পরে পুরো বাংলাদেশ ছড়িয়ে পড়ে। পূর্বোক্ত গ্রন্থ অনুযায়ী- “প্রশাসনিকভাবে এই বাহিনীতে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর লোক অন্তর্ভুক্ত হলেও তাদেরকে তিনভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথমত যারা ‘পাকিস্তান’ ও ইসলামকে রক্ষার জন্য বাঙালী হত্যা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধ করাকে কর্তব্য করেছিল, দ্বিতীয়ত, যারা লুটপাট, প্রতিশোধ গ্রহণ, নারী নির্যাতন করার একটি সুযোগ গ্রহণ করতে চেয়েছিল এবং তৃতীয়ত, গ্রামের দরিদ্র অশিক্ষিত জনগণ যারা সীমান্তের ওপারে চলে যেতে ব্যর্থ হয় এ ধরনের লোককে প্রলুব্ধকরণ, বল প্রয়োগ বা ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে রাজাকার বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।”
রাজাকার বাহিনী যাদের নিয়েই গঠিত হোক না কেন, এই বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করত জামায়াতে ইসলামী। আবু সাইয়িদ তাঁর সাধারণ ঘোষণার প্রেক্ষিত ও গোলাম আজম’ গ্রন্থে জনৈক রাজাকারের পরিচয়পত্র তুলে দিয়েছেন যেখানে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে-
‘‘This is to certify that Mr. haroon-ur-Rashid khan. S/o. Abdul Azim Khan, 36 Purana Paltan Lane. Dacca-2 is our active worker. He is ture Pakistani and dependable. He is trained Razakar. He has been issued a Rifle No-776.. with ten round ammunition for self-protection.
Sd/illegible
INCHARGE
RAZAKAR AND MUZAHID JAMAT-E-ISLAM
91/92 Siddique Bazar, Dacca.”
রাজাকারদের বিভিন্ন স্থাপনা পাহারা দেয়া, মুক্তিবাহিনীর খোঁজ করা প্রভৃতি কাজে ব্যবহার করা হতো। বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে এরাই ছড়িয়ে পড়েছিল। সে কারণে, বাঙালীদের কাছে রাজাকার শব্দটি বেশি পরিচিত হয়ে ওঠে।

॥ ৪ ॥
১৯৭১ সালে তো বটেই, তারপর প্রায় চার দশক পর্যন্ত, এ দেশে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি কিভাবে কাজ করে বা মনোজগতে আধিপত্য বিস্তার করে যাচ্ছে সে ব্যাপারে গভীরভাবে কেউ চিন্তা করেছেন বলে জানি না।
আগেই উল্লেখ করেছি মুক্তিযুদ্ধের বা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বা স্বায়ত্তশাসনেরও বিরোধিতা করেছেন অনেকে ১৯৭১ সালের আগে। ঐ বিরোধিতা, যুক্তির খাতিরে অগ্রহণযোগ্য এমন বলা যাবে না। কিন্তু, ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর এবং স্বাধীনতার পর এ যুক্তি কোনক্রমেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সংবিধানের প্রথম পাতাতেই লেখা আছে-
“আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধের (সংশোধিত পাঠ) মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি।”

এরপর স্বাধীনতাসংক্রান্ত কোন বিষয় আদালতের এখতিয়ারে পর্যন্ত আসতে পারে না। কিন্তু, বাংলাদেশ যেহেতু পৃথিবীর একমাত্র সব সম্ভবের দেশ সেহেতু এখানে এর উল্টোটাই ঘটেছে। পৃথিবীতে একমাত্র বাংলাদেশেই স্বাধীনতাপক্ষের ও বিপক্ষের শক্তি আছে। এ প্রশ্ন অবশ্যই অনেকে করতে পারেন যে, স্বাধীনতালাভের পর একটি দেশে আবার স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি হয় কিভাবে? পৃথিবীতে, এ দেশেরই একমাত্র সরকার ও বিরোধীদল একই সঙ্গে স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তির সঙ্গে নমনীয় ব্যবহার করে।পৃথিবীতে একমাত্র বাংলাদেশেই স্বাধীনতার বিপক্ষের পত্রিকাসমূহ অবাধে প্রকাশিত হয় এবং স্বাধীনতার বিপক্ষীয়রা স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিষোদগার করে যেতে পারছে। 

শুধু তাই নয়, প্রাক্-মুক্তিযুদ্ধ পর্বের পাকিস্তান প্রত্যয়ের বিভিন্ন উপাদান আবার যুক্ত হচ্ছে রাজনীতিতে। বাংলাদেশ আদর্শের বিপরীতে সে বিষয়গুলো তুলে ধরা হচ্ছে, যে দেশের ভবিষ্যতের জন্য ভয়ঙ্কর। এই আদর্শের নাম দেয়া যেতে পারে পাক-বাংলা আদর্শ। এ আদর্শের যারা ধারক তাদের বাংলাদেশের অস্তিত্ব মেনে নিতে হচ্ছে। 

কিন্তু, বাংলাদেশ আদর্শ তাদের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না হীনম্মন্যতার কারণে। কায়েমি স্বার্থ যা সৃষ্টি হয়েছে গত ত্রিশ বছরে তা বজায় রাখতে গেলেও পাক-বাংলা আদর্শ ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। এর প্রধান উপাদান পাকিস্তানে বিশ্বাস, ভারতকে ইহজগতের প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা কিন্তু ভারতকে গোপনে সুযোগ দেয়া, ইসলাম ধর্মকে ক্ষমতা দখলের স্বার্থে ব্যবহার করা, সামরিক আধিপত্যে বিশ্বাস ইত্যাদি। এই আদর্শের স্রষ্টা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শত্রুরা। এদের পুনর্বাসিত করে জিয়াউর রহমান এই আদর্শের প্রবক্তা হয়ে ওঠেন, পরে হুসাইন মুহম্মদ এরশাদ তাঁকে অনুসরণ করেন। আরো পরে খালেদা আসেন। তিনি রাজাকারদের ক্ষমতায় নিয়ে আসেন। পৃথিবীতে এ ধরনের ঘটনা বিরল। জিয়া ও এরশাদ যুক্ত করেন কাকুল কালচার। কাকুলে যৌবনে তারা প্রশিক্ষিত হয়েছিলেন এবং তা মগজে গেঁথে গিয়েছিল। সেটিরও আবার ক্লোন তৈরিতে তাঁরা সমর্থ হয়েছেন। পাকিস্তানে আদর্শের স্রষ্টাদের অনেকের মৃত্যু হলেও তাদের দলে নতুন ক্লোন সৃষ্টি করা হয়েছে। এই ক্লোনরা যে সবাই সে আদর্শে বিশ্বাসী তা নয়। তারা বিশ্বাসী কায়েমি স্বার্থ বজায় রাখা, স্বার্থের নতুন মানচিত্র তৈরি করায়।
এ প্রসঙ্গে পাকিস্তানী একাডেমিশিয়ান পারভেজ আলী হুদোভয় আবদুল হামিদ নায়ার ‘পাকিস্তানের ইতিহাস পুনর্লিখন’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন “দেশ বিভাগের ৩০ বছর পর পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের পুনর্জাগরণে এটাই প্রমাণ করে যে ধর্মীয় কোন মহৎ উদ্দেশ্য নয়, রাজনৈতিক মতলববাজিই এখানে বৃহত্তর ভূমিকা পালন করেছে। সমাজের চিরস্থায়ী সামরিকীকরণের জন্য চাই একজন চিরস্থায়ী শত্রু। অনেক কারণেই পাকিস্তানের অন্যান্য প্রতিবেশীরা এই কাজের জন্য উপযুক্ত নয়। অপরদিকে ভারত ও পাকিস্তানের শাসকবর্গ এই পারস্পরিক শত্রুতা ও উত্তেজনাকে একটি অপরিহার্য রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে দেখে আসছে।”

এখানে সৃষ্ট পাকি ক্লোনরা ঠিক একই কাজ করছে কিনা সচেতন নাগরিক মাত্রই তা বিচার করতে পারবেন। গত বিশ বছরে এ দেশে সৃষ্ট নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিই এর প্রমাণ।
এসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা হলে হয়ত কিছু জানা যেত। কিন্তু হয়নি এবং তথ্যের স্বল্পতাও লক্ষণীয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের কার্যকলাপের বিবরণ সংগ্রহ করা এখন প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীরাই এগুলো নষ্ট করে ফেলেছে বা ফেলছে। মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ বছর পর, এ. এস. এম.শামসুল আরেফিন ‘রাজাকার ও দালাল অভিযোগে গ্রেফতারকৃতদের তালিকা’ প্রণয়ন করেছেন যার কয়েকটি খ- মাত্র প্রকাশিত হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতাবিরোধী যাঁরা আত্মজীবনী লিখেছেন এবং পাক-বাংলা আদর্শের হয়ে কাজ করেছেন তাঁদের গ্রন্থের ওপর ভিত্তি করে রচনা করেছিলাম- ‘রাজাকারের মন’ বা অন্যভাবে বলা যেতে পারে, ‘রাজাকারের দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধ’। সরল ভাষায়, একজন রাজাকার বা স্বাধীনতাবিরোধী কিভাবে বিচার করেছে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বা বাংলাদেশ? সে কি এখনও বিশ্বাস করে বংলাদেশে? তার গ্রন্থে সত্যের ভাগ কতটুকু? কিইবা তারা লিখেছেন বা অধিকাংশই কেন লেখেননি, এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছিল। আমার লেখা রাজাকারের মন (২ খ-) গ্রন্থে। এ প্রবন্ধেও সেই বিষয়গুলো এসেছে।

প্রশ্ন উঠতে পারে যাদের বই নিয়ে আলোচনা করেছিলাম বা এখন যার বই নিয়ে আলোচনা করছি তাদের কেউ ছিল কোলাবরেটর, কেউ আল-বদর বা অন্যকিছু। কিন্তু আগেই বলেছি কাগজপত্রে বিভিন্ন বিভাগ থাকলেও মূলত এরা সব একই লক্ষ্যের অনুসারী। এই বিভাজন বিভ্রান্তিও সৃষ্টি করতে পারে মাঝে মাঝে। শামসুল আরেফিন নিজেও এ সমস্যায় পড়েছিলেন তাঁর উপযুক্ত গ্রন্থ লিখতে গিয়ে। লিখেছেন তিনি “বিভিন্ন পরিচয়ে এদের ভাগে ভাগে না দেখিয়ে গড়পড়তা সবাইকে ‘দালাল’ পরিচয়ে চিহ্নিত করার প্রয়াসের পেছনে একটা কারণও রয়েছে। সবচেয়ে বড় কারণ যেটি তা হলো, যে সব সরকারী কাগজের আলোকে এই তালিকাটি প্রস্তুত হয়েছে সেই সবের ছক অভিন্ন ছিল না। কোথাও গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির অপরাধের কারণ সংক্ষেপে বলা হয়েছে, কোথাও শুধু বলা হয়েছে কোলাবরেটর অথবা দালাল অথবা পাকিস্তান বাহিনীর সহযোগী। কোন কোন তালিকায় তাদের পরিচয় এরূপও রয়েছে যে, “Arrested Razakars. Al-Badars and Mujahids’, ‘ Arrested on.. as they were either members of Razakars, Al-Badars, Al-Shams or Mujahid organisation and also supported the Pak Army in killing innocent public. looting, arson etc”

এ পরিপ্রেক্ষিতে এক কথায়, মোটাদাগে স্বাধীনবিরোধীদের আমি ‘রাজাকার’ নামে অভিহিত করেছি। রাজাকার, আগেই উল্লেখ করেছি, যারা বাংলাদেশে ছিল এবং মানুষ এই নাম ও তাদের কার্যকলাপের সঙ্গে পরিচিত হয়ে সাধারণের ভাষ্যে চলে আসে। হুমায়ূন আহমেদের একটি নাটকের সংলাপ ছিল- ‘তুই রাজাকার’।
এসব কারণে, স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তি সে আলবদরই হোক বা দালালই হোক বা শান্তি কমিটিই- পরিচিত হয়ে ওঠে রাজাকার হিসেবে। তাঁরা ‘রাজাকার’ ছিলেন না, ছিলেন ‘রেজাকার’।
 হতে পারে রেজাকার শুদ্ধ, কিন্তু মানুষের কাছে অশুদ্ধ রাজাকারই পরিচিত। তাই আমিও রেজাকার-কে রাজাকারই লিখলাম।

তিনি সাধারণ পরিবার থেকে এসেছেন। মাসে যা বেতন পেতেন তা স্ত্রী নার্গিসের হাতে তুলে দিতেন। তিনি নিজেকে ভাবতেন আল্লাহর সৈনিক হিসেবে, যিনি নিজেকে রসুলের (সঃ) যোদ্ধা সাহাবা হিসেবে ভাবতেন। তিনি জানিয়েছেন, ১৯৬৩ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত দলের জন্য এমন ব্যস্ত থেকেছেন যে ঋতু পরিবর্তন বুঝতে পরেননি। এমন কী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ঘুরে দেখারও সুযোগ পাননি। একবার শুধু রমনা পার্কে গিয়েছিলেন। তার স্ত্রী মাত্র তিন মাস তাঁর সঙ্গে একত্রে কাটিয়েছেন। জামায়াত গড়ার জন্য তিনি হাতিয়া, সোনাগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া, ফেনী, কোম্পানীগঞ্জ, রায়পুর, রামগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালীর অন্যান্য অঞ্চল সফর করেছেন।

মহিউদ্দিন জানাচ্ছেন, ১৯৬৯ সালে জামায়াত ব্যস্ত ছিল আওয়ামী লীগের ছয় দফা, ছাত্রদের ১১ দফার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি আরও লিখেছেন, আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ করার মতো একটি বড় দলই ছিল। তাহলো জামায়াতে ইসলামী। সে কারণে আওয়ামী লীগের টার্গেট হয়ে দাঁড়ায় জামায়াত। মহিউদ্দিন নিজে দাঁড়িয়েছিলেন প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে। তিনি লেখেছেন, পল্টনে যেমন আওয়ামী লীগ মওদুদীর সভা আক্রমণ করে ভেঙ্গে দিয়েছিল, তেমনি নির্বাচনের আগে নোয়াখালীতে আওয়ামী লীগ জামায়াতের সব সভায়ই হামলা চালিয়েছে।

১৯৭০ সালেই প্রয়ংকরী ঝড়ে পূর্ব পাকিস্তানের একটি অংশ লন্ডভন্ড হয়ে যায়। কেন্দ্রীয় শাসক, রাজনীতিবিদ, এমনকি প্রেসিডেন্ট গভর্নরও দুর্যোগময় এলাকা পরিদর্শনে সুযোগ পাননি। ফলে, তার মতে, শেখ মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে বলার জন্য আরেকটি অজুহাত পেলেন। অথচ তিনি নিজে কোন এলাকা পরিদর্শনে যাননি। জামায়াত নেতা গোলাম আযম একমাত্র রাজনীতিবিদ যিনি দুর্গত এলাকা পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। তিনি গোলাম আযমের সঙ্গে গিয়েছিলেন হাতিয়া। দু’দিন পর ঈদ। তাদের ফেরার কথা ছিল ঢাকা। কিন্তু নোয়াখালীতেই আত্মীয়-পরিজন ছাড়া তাদের দু’জনকে ঈদ করতে হলো। এটিকে তিনি জনগণের খেদমতের এক বিরল দৃষ্টান্ত বলে উল্লেখ করেছেন।

এই ঘটনাটিকে তিনি বিশদভাবে দেখেছেন ও বর্ণনা করেছেন। নোয়াখালী ছিল আওয়ামী লীগের দুর্গ। এর বিপরীতে জামায়াতের নিয়মিত কর্মী ছিলেন ছয়জন। একজন সামান্য কাপড় ব্যবসায়ী, একজন দর্জি, প্রাইমারি স্কুলের একজন শিক্ষক, নোয়াখালী পৌরসভার একজন কেরানি ও দু’জন বেকার। কোন কোন কমিটিতে কলেজের দু’একজন শিক্ষককে পাওয়া যেত। মহি উদ্দিনের মতে, তার সদস্যরা গরিব ছিলেন কিন্তু জনগণের বিশাল সমর্থন ছিল তাদের পিছে। যদি জানমালের ভয় না থাকত তাহলে সাধারণ মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ জামায়াতকে ভোট দিত। আসলে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তো জামায়াতেরই জেতার কথা কিন্তু নির্বাচন তো সুষ্ঠু হয়নি। জামায়াত জিতবে কীভাবে? ফ্যান্টাসি আর কাকে বলে।

সেই ঈদের দিন গোলাম আযম ও তিনি ক্যান্টিন থেকে দু’প্লেট মাংস আর দুটি পরাটা এনে নাস্তা সারলেন। মহি উদ্দিন এ পরিপ্রেক্ষিতে লিখেছেন, যাদের আছে তারা কখনও জামায়াতকে সমর্থন করেনি। গোলাম আযম বা আবদুর রহিম অনেকদিন নোয়াখালী এসেছেন কিন্তু কোথায়ও আশ্রয় পাননি। তাদের পার্টি অফিসে থাকতে হয়েছে।
মহি উদ্দিনের আফসোস, আওয়ামী লীগের অনেকে জানতেন যে গোলাম আযম নোয়াখালীতে আছেন। কিন্তু, কারও নৈতিক সাহস হলো না, তাকে এসে বলা ঈদ মোবারক। তিনি আর গোলাম আযম কয়েক টুকরো গরুর মাংস, ভাত আর মসুরের ডাল দিয়ে দুপুরের খাওয়া সারলেন। আরও দু’বার কোরবানির ঈদের সময় মহিউদ্দিন নোয়াখালী শহরে ছিলেন। তখন তিনি বা তার গরিব কর্মীরা কোরবানি দিতে পারেনি। শহরের কেউ তাকে ঈদে আমন্ত্রণ জানিয়ে খাওয়ায়নি। প্রায় না খেয়ে থেকেছেন।
নিজেই প্রশ্ন রেখেছেন, তা হলে লক্ষ্মীপুরে বৌ-ছেলেমেয়ে রেখে তাকে কে বাধ্য করেছিল নোয়াখালী থাকতে। এর উত্তর তিনি নিজেই দিয়েছেন- কেউই নয়, জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার জন্যই শহরে থেকেছেন। ঈদ জামায়াতে বক্তৃতা দিয়ে কোরবানির ফযিলত বুঝিয়েছেন। কিন্তু, প্রশ্ন ওঠে নোয়াখালীতে ছয়জন নিয়মিত কর্মী ছাড়া জামায়াতের তেমন সংগঠন ছিল না। সেখানে ঈদের জামায়াতে তাদের বক্তৃতা দিতে কে আমন্ত্রণ করবে? কেনই বা আমন্ত্রণ জানাবে? 

॥ ৮ ॥

আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হবার পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের কিছু নেতা পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে থাকে। আরেকটি গ্রুপও একই ধরনের কাজ করতে থাকে। আর দু’টি গ্রুপকে সহায়তা করছিল প্রতিবেশী রাষ্ট্র অর্থাৎ ভারত। কারণ, ভারত পাকিস্তানকে ভাঙতে চাচ্ছিল। মহিউদ্দিনের মতে, আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো ইসলামী রেনেসাঁয় ভীত হয়ে পাকিস্তানের শত্রুকে সহায়তা করছিল।
মহিউদ্দিন এরপর মুসলমান চরিত্র বিশ্লেষণ করেছেন। তার মতে, ভারতীয় মুসলমানরা ছিল ‘পারভারটেড’ তাদের বলা হয়েছিল পাকিস্তানে ভোট দেওয়ার জন্য। কিন্তু “আমাদের চরিত্র তো ইসলামিক নয়।” খেদ জানিয়েছেন তিনি। তিনি লিখেছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানীরা মিথ্যাচার করেননি, পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানরা সত্যিকারের মুসলমান নয়, তারা হিন্দুদের ছেলেপিলে, ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব শিক্ষালয়ে হিন্দু শিক্ষকরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। স্কুল-কলেজে পড়ানো হয় হিন্দু দর্শন। হিন্দু গবেষক শিক্ষকরাই বই লেখেন। বাংলা [পূর্ব পাকিস্তান] হচ্ছে একটি জাদুর দেশ..., প্রত্যেক মুসলমান মেয়ে গায়িকা এবং নর্তকী, পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের ভারস্বরূপ। দেশটি হচ্ছে, সাইক্লোন আর বন্যার দেশ। একটি অভিশপ্ত প্রদেশ। আল্লাহ পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে খুশি নয়। খুশি হলে ঐ এলাকায় এত প্রাকৃতিক দুর্যোগ কেন হবে?

এ প্রসঙ্গে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের একটি বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন। সাধারণ নির্বাচনের [১৯৭০] নোয়াখালীর মাইজদী কোর্টে টাউন হলে তিনি বজ্র কঠিন গলায় বলেছিলেন- “করাচি হয়ে গেছে একটি সোনালী শহর; মরুভূমি রূপান্তরিত হয়েছে সোনালী মরূদ্যানে; ইসলামাবাদ নির্মিত হচ্ছে সোনা দিয়ে। এ সবই করা সম্ভব হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদের কারণে। তারা মংলাবাঁধ নির্মাণ করেছে, নির্মাণ করেছে তারবেলা বাঁধ, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের জন্য কিছুই না; আমি যখন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য দাবি তুললাম, তখন তারা মানুষকে ইসলামের নামে ভোলাবার জন্য মওদুদীকে পাঠালো। 

এখানেই আসে স্বদেশ রায়ের লেখা- জনকণ্ঠে প্রকাশিত ‘‘এ সরকারের ভেতর এখনও ‘পাকিস্তান’ আছে।’’ এ লেখাটি প্রচুর মানুষ পড়েছেন এবং মতবিনিময় করেছেন এবং সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। স্বদেশ রায়ের ভাগ্য ভাল যে, রাজনীতিবিদরা এসব পড়েন না, জনকণ্ঠ তো না-ই। তাঁরা যদি পড়েনও, তাহলে প্রথম আলো পড়েন বা ডেইলি স্টার উল্টে দেখেন। যে প্রশ্নগুলো গত পাঁচ বছর এবং এখনও আলোচিত হচ্ছে তার নির্যাস তিনি তুলে ধরেছেন। এখানেই আসে দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্ন। স্বদেশ যেহেতু সাংবাদিক সেহেতু অনেক হোমরাচোমরার সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব আছে, তাঁর সাম্প্রতিক লেখা পড়লে তাঁরা তাঁকে এড়িয়েই চলবেন। কারণ, সমালোচনা আওয়ামী লীগের নেতারা একদম বরদাশত করতে পারেন না, অসহিষ্ণু, সমালোচনা ভাবেন বিরোধিতা এবং কোন বিষয়ে আলোচনা তাঁদের সঙ্গে করা নিষ্ফল।

প্রথমেই যে দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলেছিলাম সেই দৃষ্টিভঙ্গির কথায় আসি। গাফ্ফার চৌধুরীর দৃষ্টিভঙ্গি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের কাছাকাছি, স্বদেশের নয়। একুশে পদক নিয়ে এক প্রতিক্রিয়ায় স্বদেশ লেখাটি লিখেছেন।
প্রথমেই বলে রাখি, পদক নিয়ে সব সময় বিতর্ক থাকবেই। এবং পুরস্কারের অপব্যাখ্যা থাকবেই। যেমন, অর্থনীতিতে কোন নোবেল প্রাইজ নেই। সেটি একটি ব্যাংকের পুরস্কার যেটিকে নোবেল বলে চালানো হচ্ছে। যাহোক, পদক বিতরণের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ যথেষ্ট সতর্কতার পরিচয় দিয়েছে। গত ৭ বছরে যাঁরা রাষ্ট্রীয় পদক পেয়েছেন তাঁদের অধিকাংশকে নিয়ে বিতর্ক হয়নি। অন্তত শর্ষিনার পীরের মতো যুদ্ধাপরাধীদের এ সরকার পদক দেয়নি। কিন্তু, দু’একটি ব্যতিক্রম অনেক সম্মান হ্রাস করে।

সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার ও ইকবাল সোবহানকে নিয়ে স্বদেশ কিছু মন্তব্য করেছেন। এঁরা সবাই আমাদের দীর্ঘদিনের পরিচিত, কারও সঙ্গে ব্যক্তিগত অসদ্ভাবও নেই। কিন্তু, আমরা পরিচিতজনের বিচ্যুতি নিয়ে সাধারণত আলোচনা করি না। যা আলোচনা তা নীতিগত, কিন্তু আমাদের সমাজে সে পার্থক্য নেই। সব আলোচনাই ব্যক্তিগত আক্রমণ বলে বিবেচনা করা হয়।

 স্বদেশ সেই প্রথা ভাঙ্গার সাহস দেখিয়েছেন দেখে তাঁর লেখা এত আদৃত হচ্ছে। এটি আরেকটি বার্তা প্রদান করছে। বর্তমান রাজনীতিবিদ বা সুশীলরা যে দৃষ্টিভঙ্গি লালন করছেন সেটির গ্রহণযোগ্যতা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে যা তাঁরা অনুধাবন করতে পারছেন না।
স্বদেশ সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কথা বলছেন। তাঁর মতে, গোলাম সারওয়ারকে সাংবাদিকতার জন্য একুশে পুরস্কার দিয়ে সরকার প্রমাণ করল,  তাঁদের ভেতর পাকিস্তানী সংস্কৃতির কদর এখনও কমেনি। তাঁর শুধু নয়, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শিবিরের একটি প্রশ্ন, সরকার এখন ক্ষমতায় গিয়ে নিজেদের যা খুশি করার ক্ষমতা আছে বলে ভাবছে। এ রকমটি বিএনপি-জামায়াতও ভেবেছিল। গোলাম সারওয়ার সেই ১৫ জনের একজন। এই ১৫ জন কে? যারা সরকারের চূড়ান্ত বিপদের সময় মৌলবাদীদের সমর্থন দিয়েছিল। স্বদেশ লিখেছেন-
এ দেশের মানুষ বিশেষ করে প্রগতিশীল মানুষ বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করে ওই মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করা হলে দেশের ১৫ জন সম্পাদক তার মুক্তি দাবি করে বিবৃতি দেয়। মাহমুদুর রহমান সেদিন যে কাজটি করেছিল সেটা এই ১৫ সম্পাদকের অজানা, সেটা একজন বালকও বিশ্বাস করবেন না। কারণ, এই ১৫ সম্পাদক শিশু নন। তাঁরা কেউ ফিডার খান না। তাই সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সঙ্গে সাংবাদিকতার স্বাধীনতার সঙ্গে মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতারকে জড়ানোর কোন যুক্তি থাকতে পারে না। আগেও এই কলামে লিখেছি, আবারও বলব এই ১৫ সম্পাদক ভবিষ্যতে বহুভাবে সম্মানিত হতে পারেন। কিন্তু জাতির ইতিহাসে তাঁরা রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধের দাবিতে যে বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানী চিন্তার পক্ষ হয়ে বিবৃতি দিয়েছিলেন ইতিহাস এই ১৫ সম্পাদককে অবশ্যই সেই কাতারে রাখবে। বরং আরও খারাপভাবে দেখবে। কারণ তাঁরা সেই ব্যক্তির পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন, যিনি সন্ত্রাসের মাধ্যমে সরকার উৎখাত ও সরকারপ্রধান হত্যা পরিকল্পনার অন্যতম। তারা দেশের প্রগতিশীলতার এক ভয়াবহ দুর্দিনে পাকিস্তানী আইএসআইয়ের ক্রীড়নক এই জঙ্গীবাদীর মুক্তির দাবিতে বিবৃতি দিয়েছিল। তাই হাজার যুক্তি দাঁড় করানো হোক না কেন, এই ১৫ সম্পাদক ও আইএসআই-এর ক্রীড়নকরা যে একই সূত্রে গাঁথা এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। এবং এ নিয়ে বাংলাদেশের প্রগতিশীল সমাজের অবস্থানও স্পষ্ট। তারা জানে যে বাংলাদেশের ভেতর এই যে পাকিস্তানী এজেন্টরা রয়ে গেছে, এদের বিরুদ্ধেই বাংলাদেশের প্রগতিশীল শক্তিকে লড়াই করে যেতে হবে আরও দীর্ঘ দিন। এবং লড়াইয়ের ফসল হিসেবে তারা বর্তমান সরকারকে মনে করে।

কিন্তু এই সরকার ক্ষমতায় এসে প্রথমবারেই মাহমুদুর রহমানের মুক্তি দাবি করা ১৫ সম্পাদকের একজনকে একুশে পদক দিয়ে বাংলাদেশের প্রগতিশীল সমাজের প্রতি কী বার্তা দিলেন? সরকারের নিজের চরিত্রের কী প্রকাশ পেল? এই ১৫ সম্পাদকের একজনকে একুশে পদক দেয়ার ভেতর দিয়ে সরকারের এই চরিত্র প্রকাশ পেল যে, বর্তমান সরকারের ভেতরও ‘পাকিস্তান’ আছে। এই সরকারও ‘পাকিস্তান’ মুক্ত নয়।”
এ যুক্তি সরকারের পক্ষে খন্ডানো সম্ভব নয়। পদক দেয়ার সঙ্গে জড়িত সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং একটি কেবিনেট কমিটি আছে সেটির। সবশেষ প্রধানমন্ত্রীকে সম্মতি দিতে হয় তাদের সুপারিশে। বিষয়টি অন্যভাবেও দেখা যেতে পারে।

গোলাম সারওয়ার একুশে পদক পাওয়ার যোগ্য নয় এ মন্তব্য যিনি করবেন আমি তার প্রতিবাদ করব। এবং সাংবাদিকতায় তিনি যথেষ্ট সিনিয়র। এবিএম মূসাও তো তারেক জিয়ার একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। তিনিও বর্তমান সরকারের আমলে পদক পেয়েছেন।

 কিন্তু প্রশ্ন, তোয়াব খান কেন পাননি? গত দু’দশক যিনি একনিষ্ঠভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে পত্রিকা পরিচালনা করেছেন। চরম দুর্দিনেও পক্ষ ছাড়েননি। তিনি এদের সবার সিনিয়র। আমি ধরে নিলাম, ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী বা সংস্কৃতিমন্ত্রী পছন্দ করেন না। কিন্তু এই দলই কি শু-মেকার হিসেবে খ্যাত আসম আবদুর রবকে মন্ত্রী করেনি, এরশাদ বা জাতীয় পার্টির লোকজনকে মন্ত্রী করেনি, চরম আওয়ামী বিরোধী সাম্যবাদী দল, জাপা (মঞ্জু), ওয়ার্কার্স পার্টি বা জাসদ থেকে মন্ত্রী করেনি? তাহলে কি ব্যাপারটা এ রকম দাঁড়ায় ,আমি যাকে পছন্দ করি না তাঁর যত অবদানই থাকুক, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনীতিতে বা স্বদেশে তিনি গ্রহণযোগ্য নন। কিন্তু তাকেই পছন্দ করি যে অহরহ আমাদের নিন্দা করে, ঘৃণা করে এবং ব্যাম্বু দেয়। যদি এটি ঠিক হয় তবে, এটি সুস্থ কোন দৃষ্টিভঙ্গি নয়।

জনাব গাফ্ফার চৌধুরী ও আওয়ামী লীগের দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে বলতে পারি-মতিউর রহমান বা মাহফুজ আনামকেও কেন পুরস্কারের জন্য বিবেচনা করা হবে না? তাঁরা শূন্য থেকে দুটি পত্রিকাকে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী পত্রিকায় পরিণত করেছেন এবং গণতন্ত্র প্রশ্নে বিএনপি-জামায়াতকে অকুণ্ঠ সমর্থন করেছেন এবং ঐ ১৫ জনেরও তাঁরা দলভুক্ত। প্রাক-নির্বাচনের ৬ মাস কিন্তু দৈনিক সমকালও একই ভূমিকা রেখেছে, তবে ততটা কঠোরভাবে নয়। আবেদ খানও তো বিবেচিত হলেন না। এই প্রশ্নগুলোই উঠেছে সমাজের বিভিন্ন পর্যায় থেকে।

স্বদেশ বেশ কঠোরভাবে তথ্য উপদেষ্টা সম্পর্কেও লিখেছেন। তাঁর মতে, “শেখ হাসিনার পাশে গোলাম আযমের নাগরিকত্বের দাবিতে বিবৃতিদানকারীও আছেন।... এই বার্তা নিশ্চয়ই এটাই জানিয়ে দেয় যে, বর্তমান সরকার জীবন বাজি রেখে প্রগতিশীলতার পক্ষে সাংবাদিকতা চায় না।” 
এই বিষয়টি গুরুতর। আমরা দেখেছি, যখন শেখ হাসিনা সংবিধানের কথা বলেছেন তখন জামায়াত-বিএনপির সহিংসতা সত্ত্বেও টকশো ও সংবাদপত্রে তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গির তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতরাও এতে সুর মিলিয়েছেন। তখন গুটিকয় পত্রিকা, সেখানে কয়েকজন কলামিস্ট ও গুটিকয় টিভি চ্যানেল, গুটিকয় বক্তা তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করেছেন। এবং তাঁদের জোরালো বক্তব্য ও লেখা জনমতের দৃষ্টি অনেকটা ঘুরিয়ে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, হতাশ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অনেকের বুকে সাহস যুগিয়েছে। সরকারের নেতৃবৃন্দ তা অস্বীকার করতে পারেন, কিন্তু সেটিই সত্য।
যদি উদাহরণ এ রকম দু’একটি হতো তা হলে কথা ছিল না বা এত লেখারও দরকার ছিল না। কিন্তু, বিএনপি-জামায়াতপন্থীদের বা বিএনপি-জামায়াতপন্থী না হোক, আওয়ামী লীগবিরোধীদের তোষণের দিকে একটি ঝোঁক রয়েই গেছে যেটি খুব একটা ইতিবাচক নয়। স্বদেশ সে কথাও উল্লেখ করেছেন-
‘‘২০০৯-এ শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পরে ঠিক একই বার্তা তাঁর সরকারের পক্ষ থেকে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ দিয়েছিলেন। তিনি দায়িত্ব নিয়ে প্রথম গিয়েছিলেন সেই পত্রিকা অফিসটিতে যে পত্রিকার সম্পাদক লিখেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা মিথ্যে বলেন’, লিখেছিলেন, শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে বিদায় নিতে হবে। প্রথম যে টেলিভিশন চ্যানেলটিতে গিয়েছিলেন ওই চ্যানেলটি বঙ্গবন্ধুর খুনী রশীদের সাক্ষাতকার সম্প্রচার করে। ২০০৯-এর তথ্যমন্ত্রীর বার্তার শেষ পরিণতি কী হয়েছিল সেটা পাঁচ বছরে শেখ হাসিনার সরকার হাড়ে হাড়ে টের পায়। মিডিয়ার পাকিস্তানপন্থীরাই শক্তিশালী হয়ে ওঠে। শেখ হাসিনার সরকারের কোন ভাল কাজ সেদিনের অধিকাংশ মিডিয়াই প্রচার করেনি। বরং যতভাবে সরকারকে ক্ষতি করা যায় এবং শেখ হাসিনার ক্ষতি করা যায় সেটাই ছিল সেদিন তাদের চেষ্টা।’’
আরও উল্লেখ্য, সরকারী বিজ্ঞাপন এখন লাভজনক না হওয়া সত্ত্বেও জনকণ্ঠ কিন্তু সে আমলে সরকারী বিজ্ঞাপনও কম পেয়েছে, অথচ জনকণ্ঠ একমাত্র পত্রিকা যা গত দেড়দশক নিরবচ্ছিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এবং আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে এসেছে।
৪.
যখন জামায়াত-বিএনপি নেতাকর্মীরা সাতক্ষীরা ও সুন্দরগঞ্জে হত্যাকান্ড ঘটাচ্ছিল তখন টিভি চ্যানেল ‘সময়’ একটি প্রতিবেদন তুলে ধরে। তাতে বলা হয় ‘জামায়াত নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পর ২৮ ফেব্রুয়ারি দুপুরে বামনডাঙ্গা রেলস্টেশন জালিয়ে দেয় জামায়াত-শিবিরের কয়েক হাজার সশস্ত্র নেতাকর্মী। লুটপাট করে শত শত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। পরে বামনডাঙ্গা পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমণ করে চার পুলিশ সদস্যকে নির্মমভাবে খুন করা হয়। এই ঘটনার প্রতিবাদ করায় দরিদ্র এক রিক্সা চালককেও হত্যা করা হয়। তার জিহ্বা কেটে, চোখ উপড়ে ফেলা হয়। একইদিন সুন্দরগঞ্জ উপজেলা পরিষদ ভবন ও থানা ভবনসহ সরকারী অফিস-আদালত লুট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।”

মামলা হলেও আসামিরা বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়ায়। প্রতিবেদন অনুসারে- এখানে ভয়ঙ্কর যে বিষয়টি শুধু পুলিশ নয়, আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গেও জামায়াতের শক্ত কানেকশন ধরা পড়েছে। ২৮ ফেব্রুয়ারির নাশকতায় সরাসরি জড়িত জামায়াত নেতা মাওলানা সাখাওয়াত হোসেনকে ওলামা লীগের সাধারণ সম্পাদক বানিয়ে দেয়া লিখিত কাগজ আদালতে জমা দেয়া হয়েছিল।

গত জুন মাসের দিকে জামায়াতের অর্থদাতা হিসেবে পরিচিত ব্যবসায়ী আজিম ঘটনার দিন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সহিংসতার নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু পুলিশ যখন তাকে গ্রেফতার করে তখন আবার বামনডাঙ্গায় পুলিশকে আক্রমণের চেষ্টা করা হয়। আশ্চর্য বিষয় হলো, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মঞ্জুরুল ইসলাম নিটন মাইকিং করে রাস্তাঘাট অবরোধ করে তাঁকে পুলিশের কাছ থেকে উদ্ধারের আহ্বান জানান।
বিভিন্ন সময় টাকার বিনিময়ে মামলা থেকে আসামিদের নাম কাটার অভিযোগ উঠেছে। এই অভিযোগ যেমন পুলিশের বিরুদ্ধে তারচেয়ে বেশি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।

রংপুর অঞ্চলে দল পরিচালনার জন্য অর্থের সংস্থান করে থাকে বান্না এন্টারপ্রাইজ নামে জামায়াত নেতাদের পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান। মূলত বেসরকারী পরিচালনার জন্য ট্রেন লিজ নিয়ে তাঁরা পরিচালনা করেন। বিএনপি-জামায়াত আমলে বান্না নাম ব্যবহার করলেও আওয়ামী লীগ আমলে তা হয়ে গেছে তাজ এন্টারপ্রাইজ। এই প্রতিষ্ঠানটি এখনও ১২টি ট্রেন পরিচালনা করছে। ২৮ ফেব্রুয়ারি স্টেশন পোড়াতে পার্বতীপুর থেকে ধানের খড় এনে আগের দিন স্টেশন ভবনে ঢোকানো হয়েছিল। আর এরই একটি ট্রেনে করে আনা হয়েছিল খড়গুলো। বোনারপাড়া স্টেশনের কাছে রেলে নাশকতায় পাঁচ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। পদ্মরাগ নামে এই ট্রেনটি পরিচালনা করে তাজ এন্টারপ্রাইজ।
বান্না এন্টারপ্রাইজ: নজরুল ইসলাম, জেলা জামায়াতের নেতা।
তাজ এন্টারপ্রাইজ: হারুনুর রশিদ, জেলা জামায়াতের নেতা।
হোপ এ্যাগ্রো লিমিটেড: প্রভাষক আজাদুল ইসলাম, সাংগঠনিক।
মূল প্রতিষ্ঠান বান্না এন্টারপ্রাইজ। বিএনপি আমলে ট্রেনগুলো বান্না এন্টারপ্রাইজের নামে ছিল। এখন চলছে তাজ এন্টারপ্রাইজের নামে। উল্লেখিত তিন জনই ২৮ ফেব্রুয়ারির ৪ পুলিশ হত্যা ও পুলিশ ফাঁড়ি হামলার মামলার আসামি। তাদের পরিচালিত একটি ট্রেনে করে খড় আনা হয়েছিল, স্টেশনে আগুন লাগানোর কাজে ব্যবহার করা হয়েছিলো।”
আওয়ামী লীগ একটি বড় দল। সেখানে কোন্ উপজেলায় কী হচ্ছে তার অনেক খবরই হয়ত কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে পৌঁছায় না। কিন্তু যখন পৌঁছায় তখন কি কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়? সুন্দরগঞ্জের ঘটনায় যেসব আওয়ামী লীগ নেতা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কি কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে? বা রেল যে জামায়াতী সংস্থাকে ট্রেন লিজ দিয়েছে তার লিজ কি বাতিল হয়েছে?
উপজেলার কথা বাদ দিই। নির্বাচনের আগে কেন্দ্রীয় দু’এক নেতা কি জামায়াত নেতাদের বরণ করেননি? বা অনেক জামায়াত কর্মীকে আওয়ামী লীগে অন্তর্ভুক্ত করেননি?

কয়েকদিন আগে, নির্মূল কমিটির এক আলোচনা সভায় যেখানে অর্থমন্ত্রীও উপস্থিত ছিলেন, শহীদ জায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী অভিযোগ করে বললেন, আমার স্বামী ডা. আলীম চৌধুরীকে হত্যা করেছিল যে আলবদর আবদুল মান্নান, সেই মান্নানের এক স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় এমপি ও আওয়ামী লীগ নেতা। ওই নেতা অনুষ্ঠান বলেন, মান্নানের আত্মত্যাগ এ দেশের মানুষ ভুলবে না। বাংলাদেশের জন্য তার অবদান অনেক। মানুষ তা মনে রাখবে।

আলবদর মান্নান বেঁচে থাকলে যুদ্ধাপরাধের জন্য আজ তার বিচার হতো। সেই মান্নানের স্মরণসভা হয় এ দেশে এবং এ আমলে এবং সেখানে উপস্থিত থাকেন আওয়ামী লীগ নেতা ও এমপি এবং স্মরণ করেন এ দেশের জন্য আত্মত্যাগের কথা। মানুষ কতটা অবিবেচক ও নিষ্ঠুর হলে এ ধরনের কাজ করতে পারে এবং তা কতটা মর্মান্তিক একটি শহীদ পরিবারের জন্য।

এই যে ঝোঁক, এটিই ভয়ঙ্কর এবং যে সব কাজ আওয়ামী লীগ নেতারা [জামায়াত বরণ] ও সরকার [যেমন পদায়ন ও পদকায়ন] করছে তা আওয়ামী লীগকে খাদের কিনারায় নিয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, বিএনপি ও আওয়ামী লীগে কোন পার্থক্য থাকবে না। এবং তখন মানুষ বিএনপিকেই পছন্দ করবে। কারণ বিএনপি নেতারা তাদের কর্মী ও সমর্থকদের পৃষ্ঠপোষকতা করে। আওয়ামী লীগ নেতারা প্রায়ই কেড়ে নেয়, দেয় না তেমন কিছু। আর রাজনীতির অন্য নাম তো পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানও। আওয়ামী লীগ মানুষ করে আদর্শের কারণে।

এ প্রসঙ্গে অনেকে ভোটের রাজনীতির কথা বলতে পারেন। বিএনপি-জামায়াত যুক্ত হলে বিএনপির ভোট কমবে। এটি এক ধরনের ফাযলামি এবং অবিবেচক আওয়ামী লীগাররাই একথা বলেন। যুদ্ধাপরাধের বিচার না করলে এবং যাদের মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে তাদের মুক্তি দিলেও কোন জামায়াত কর্মী বা নেতা আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না। বিএনপির কেউ কেউ হয়ত দিলেও তা দিতে পারে। তা ছাড়া জামায়াতের ভোট কয় পার্সেন্ট? পাঁচ? এই পাঁচ পার্সেন্ট ভোটের জন্য এত বছরের আদর্শ ত্যাগ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। যে বঙ্গবন্ধুকে এখনও নিয়ত বিক্রি করতে হয় আওয়ামী লীগকে। এর চেয়ে মন ঠিক না করা ভোটারদের দিকে মনোসংযোগ করলে সেই ভোট পার্সেন্টের বেশি বাড়তেও পারে। এদিক থেকে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা যে বক্তব্য রেখেছে সেটিই সঠিক যে, জামায়াতকে কোন ছাড় দেয়া হবে না। কিন্তু একই সঙ্গে এ কথাও তাঁকে জানাতে হবে, তার দলের যারা ছাড় দিচ্ছে তাদের ক্ষেত্রে তার নীতি কী হবে?

এ প্রশ্ন তুলতে হচ্ছে এ কারণে যে, মিডিয়া এখন অনেকে স্বাধীন এবং তাদের ঝোঁক আওয়ামী লীগ বিরোধিতা। আওয়ামী লীগপন্থী মনে করে যাদের টিভি লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল তা তারা বিক্রি করছে বিএনপি ও জামায়াতপন্থীদের কাছে। বিএনপিপন্থীরা যারা বিএনপি আমলে লাইসেন্স পেয়েছিল তারা কিন্তু তা বিক্রি করেনি। এই হচ্ছে আওয়ামীপন্থী ও বিএনপিপন্থীদের মধ্যে পার্থক্য। শুধু তাই নয়, আওয়ামী মন্ত্রীদের একটি ঝোঁক আছে বিএনপিপন্থীদের সাহায্য করা।১৯৯৬-২০০০ সালে বিএনপি নেতা মোরশেদ খানকে মোবাইল ফোনের মনোপলি দেয়া এর একটি উদাহরণ। 

আর একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। সাগর-রুনি হত্যাকান্ড। এ জন্য ব্যথিত না এ রকম একটি পাষন্ডও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এবং এক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশ ও র‍্যাব কর্মকর্তাদের আওয়াজ বিষয়টিকে আরো জটিল করে তুলেছে। এবং এটি সরকারের একটি ব্যর্থতা। বিএনপি-জামায়াত সাংবাদিকরা চেয়েছেন এটি সরকারের একটি বড় ব্যর্থতা হিসেবে প্রমাণ করতে। এবং এতে প্রবলভাবে সাহায্য করেছেন সোবহান-বুলবুল নেতৃত্ব। এ কারণে, জনাব সোবহানকে পুরস্কৃত করা হয়েছে, বুলবুলও হবেন।

 কিন্তু যে প্রশ্নটা থেকে যায়, জামায়াত-বিএনপি আমলে শামছুর রহমান, বালু থেকে আরও অনেক সাংবাদিককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, পেটানো হয়েছে কতজনকে তার ইয়ত্তা নেই, কিন্তু সোবহান-বুলবুল গ্রুপ কি তখন এত সোচ্চার ছিলেন? বিএনপি-জামায়াতীরা কি তাদের হাত ধরে দুই বছর রাস্তায় রাস্তায় স্লোগান দিয়েছে। বা এখন তাদের কথাও বা কেন অনুল্লিখিত থাকছে? কারণ একটিই, আওয়ামী লীগকে বা শেখ হাসিনাকে যে যত ক্রসিফাই করতে পারে তার তত কদর। এ রকম একটি বিকৃত ঝোঁক আওয়ামী নেতৃত্বের মধ্যে বলবৎ।
আওয়ামী লীগ জোট সরকারের হেজাবি তোষণ নীতি যদি বন্ধ হয় তাহলে অবস্থা কী দাঁড়াতে পারে অন্তত মিডিয়ার ক্ষেত্রে তা স্বদেশ তাঁর প্রবন্ধের উপসংহারে উল্লেখ করেছেন-

‘‘এবারও প্রথমে শেখ হাসিনার সরকারের পক্ষ থেকে মাহমুদুর রহমানের মুক্তি দাবি করা ১৫ সম্পাদকের একজনকে একুশে পদকে ভূষিত করে একই কাজ করা হয়েছে। সরকার যদি এখনই ভুল সংশোধন না করে এ পথেই চলে তাহলে আগামী পাঁচ বছরে মিডিয়ায় এই পাকিস্তানপন্থীরাই দাপিয়ে বেড়াবে। পাশাপাশি এই বার্তার মাধ্যমে এটাও পরিষ্কার হলো যে, শেখ হাসিনার সরকার ‘পাকিস্তান’ মুক্ত নয়। শেখ হাসিনার এখনও নিজের ঘরে অনেক কাজ বাকি। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর এমনিভাবে নিজের ঘর পরিষ্কার করা হয়নি। যার ফলে ধরে রাখা সম্ভব হয়নি স্বাধীনতাকে। ১৯৭৫-এর ১৫আগস্ট শেষ হয়ে যায়। এবারও যদি সরকারের ভেতরের এই ‘পাকিস্তান’ পরিষ্কার করা না হয়, যদি ১৫ সম্পাদকের মতো আইএসআই-এর ক্রীড়নককে সমথর্নকারীদের তোষণ করা হয় ,তাহলে ভবিষ্যত ভাল নয়।”

এ প্রসঙ্গে আরও বলা দরকার, আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছে বটে তবে তার সাংগঠনিক অবস্থা খুবই নড়বড়ে। উপজেলা নির্বাচনে তার আলামত পাওয়া যাচ্ছে। এর একটি কারণ, বর্তমান নেতৃত্ব গড়ে উঠেছে প্রধানত পৃষ্ঠপোষকতায়, ওপর থেকে তা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। আগের মতো তা নিচ থেকে উঠে আসেনি। এলে এ মন্তব্য করতে হতো না।

এসব আলোচনার ক্ষেত্রে অনেক ভোটের রাজনীতির প্রসঙ্গ টেনে আনেন এবং বলেন, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। এ আপ্ত্যবাক্য সুবিধাবাদীদের। এ সুবিধাবাদী রাজনীতির কারণে জাতীয় পার্টির সঙ্গে আঁতাত করতে হয়েছে। আমরা কখনই এরশাদের রাজনীতিতে বিশ্বাসী নই এবং রাজনীতি থেকে তাকে অপসারণ জাতির জন্য মঙ্গল বলে মনে করি। এই লোকটিও আলবদর মান্নানকে মন্ত্রী করেছিলেন। হেজাবিদের পানি খাওয়ানোর জন্য মতিঝিলে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু, এই জোকারকেও ছাড় দেয়ার তেমন প্রতিবাদ করা হয়নি, তার একটি কারণ, এরশাদ বা জাতীয় পার্টি সেই রাজনীতি থেকে অনেকটা সরে এসেছেন। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধী বিচারের প্রশ্নে তাঁরা বিচারের পক্ষ সমর্থন করেছেন এবং এ ক্ষেত্রে বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। সম্প্রতি এটি একটি বড় নিরিখ তো বটেই। নির্বাচনের প্রশ্নে এরশাদ ক্লাউনের মতো আচরণ করলে তাঁর দলের সিংহভাগ তাকে প্রত্যাখ্যান করে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন।

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ও স্বদেশ রায়ের লেখার প্রসঙ্গ নিয়েই এই দীর্ঘ নিবন্ধের ইতি টানব। যদি জনাব চৌধুরী ও আওয়ামী/জোট নেতৃত্বের বক্তব্য ও নীতিতে গুরুত্ব দিতে হয় তা হলে বিষয়টা দাঁড়াবে এমনÑ যারা আওয়ামী লীগ আমলে নানা প্রশ্নে কারণে অকারণে তাদের বিরোধিতা করে তাদের গুরুত্ব দিতে হবে। প্রয়োজনে পদ ও পদকায়ন। জামায়াত-বিএনপি আমলেও আবার তারা বহাল তবিয়তে থাকে। পদায়ন ও পদকায়ণ ঘটে ব্যবসা-বাণিজ্য হয় এবং বিএনপি-জামায়াত তাদের ‘সংরক্ষণ’ করে। ঐ আমলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কাউকে ছাড় দেয়া হয় না। আমাকে বা শাহরিয়ার কবিরের ক্ষেত্রে কী হয়েছিল তা এর উদাহরণ। তৎকালীন একুশে টিভি বন্ধ এর একটি উদারহণ। সে আমলে প্রচুর সাংবাদিক আহত, নিহত হয়েছেন। তাঁদের পন্থী কোন সাংবাদিক রাস্তায় নামেনি, সংহতির খাতিরেও। ইকবাল সোবহান গোলাম আযমের পক্ষে স্বাক্ষর করা সত্ত্বেও তাকে ছাড় দেয়া হয়নি। তত্ত্বাবধায় এবং সামরিক আমলেও তাদের রবরবা লক্ষণীয়। অর্থাৎ তারা সব সময় ভাল থাকবে। সমাজ-রাষ্ট্র তাদের সম্মানিত করবে। আর যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের জন্য চিৎকার করছেন, পদায়ন বা পদকায়ণ ঐ আমলে বা সামরিক তত্ত্বাবধায়ক আমলে তাদের কপালে জোটা দূরে থাকুক, তারা নিষিদ্ধ। আর মুক্তিযুদ্ধের শক্তির আমলে আমলে তারা শারীরিকভাবে নিরাপদ থাকে, তাদের সরাসরি পদাঘাত করা হয় না বটে, কখনও হয়ত করাও হয়। কিন্তু উপেক্ষাটি নিশ্চিত তাদের কপালে জোটে। স্বদেশ এ কথাটিই বলতে চেয়েছেন।

স্বদেশ যে রকম আবেগাক্রান্ত হয়ে লিখেছেন আমি সে রকম লিখব না। আমি আর তরুণ নই, সাহসও নেই তেমন। গোলাম সারওয়ার বা ইকবাল সোবহান তো একটি ভুল করতেও পারেন। সে জন্য কি আজীবন কাফফারা দেবেন? হ্যাঁ, আজীবন কাফফারা দেবেন না। এবং সেটি উচিতও না। কিন্তু একবার তো দেবেন। কাফফারা একেবারে না দিয়ে পুরস্কৃত হলে যে পুরস্কৃত করেছেন তিনি তো ধর্মবিরোধী কাজ করছেন বলেই তা বিবেচিত হবে। বিষয়টা এ রকম, সুশীল বাটপাররা জামায়াত-বিএনপি আমলে পদায়িত হবে, ভাল থাকবে এবং আওয়ামী আমলে পদায়িত ও পুরস্কৃত হবে। যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ বলে চেঁচাবে, একপাও নড়বে না, তাকে বিএনপি আমলে লাঞ্ছিত হতে হবে এবং আওয়ামী আমলে লাঞ্ছিত না হলেও অপমানিত বা পদাঘাতের সম্মুখীন হতে হবে।

সবশেষে একটি গল্প দিয়ে শেষ করি। আমার এক বাল্যবন্ধু গল্পটি আমাকে শুনিয়ে বলেছেন, এটি নাকি এখন খুব প্রচলিত। গল্পটি হলো দুই বন্ধু, ছেলেবেলার বন্ধু, পানশালায় গেছেন। তাদের একজন বিএনপি, অন্যজন আওয়ামী লীগ সমর্থক। দু-এক পেগ পেটে পড়ার পর তারা আলোচনা করতে লাগলেন সাম্প্রতিক রাজনীতি নিয়ে।

বিএনপি : দোস্ত, তোমরা তো দ্যাশটা দখল কইরা লইলা।
আওয়ামী : খালি মাঠ থাকলে গোল তো খাইতেই হইব।
বিএনপি : তবে সময় বেশি নাই, ম্যাডাম প্রিন্সের জন্য অপেক্ষা করছেন। প্রিন্স আইলেই খেল খতম।
আওয়ামী : কেমতে।
বিএনপি : তখন কি আর সরকার থাকতে পারব। আওয়ামীরা পলাইয়া দিশা পাইব না। ঘাবড়াও মাৎ। আমি তোমারে টাকা ছাড়া প্রোটেকশন দিমু।
আওয়ামীদের ম্যাংগো আর ম্যাক কোনটাই থাকবা না।
আওয়ামী : দোস্ত, বিএনপি দেইখাই পলিটিক্সটা বোঝলা না। শোন, ব্রান্ডিং বোঝ। বোঝ না; একেবারে মাথায় গাটনা দেয়।
বিএনপি : হ্যাঁ, বুঝলাম।
আওয়ামী : আমরা কিছু ব্রান্ডিং করছি। এই ব্রান্ডিং থেইকা ফিউচার জেনারেশনেরও মুক্তি নাই। তোমাগো তো নাই-ই। সব সময় এই ব্রান্ডিংগুলোর বিরুদ্ধে তোমাগো যুদ্ধ করন লাগব। ব্রান্ডিংগুলো শুনÑ মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, ত্রিশ লাখ শহীদ, যুদ্ধাপরাধের বিচার ও জয়বাংলা।

তো এই যে ব্রান্ডিং, এই ব্রান্ডিংয়ের সিংহভাগ কৃতিত্ব লেখক, সংস্কৃতি ও মিডিয়া কর্মীদের। বঙ্গবন্ধু ব্রান্ডিংয়ের কৃতিত্ব আওয়ামী লীগের সিংহভাগ। অপরগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও আওয়ামী লীগেরও অংশ আছে। কিন্তু এসব ব্রান্ডিংয়ে লেখক-সংস্কৃতিকর্মী, সিভিল সমাজ, মিডিয়া কর্মীদের কৃতিত্ব সিংহভাগ। এ সত্য স্বীকার করতেও পারেন, নাও পারেন, কিন্তু এটিই সত্য।

আমাদের শ্রদ্ধেয় কলামিস্ট ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনীতিবিদরা এখন এটি ভাবার কোন কারণ নেই যে, সব সময় এ রকম চলবে। দিন যেমন বদলাচ্ছে তেমনি মানুষের মনও বদলাচ্ছে। আমরা ব্রান্ডিং না করলে, প্রতিরোধ না করলে কী হতে পারে তা বুঝলে এ ধরনের আত্মঘাতী পদক্ষেপ থেকে আওয়ামী লীগ বা সরকার বিরত থাকবে।
এরপর মহিউদ্দিন যা লিখেছেন, আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে তার বক্তব্যটি সঠিক কিন্তু বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, অনুচ্ছেদটি এমনভাবে লেখা হয়েছে যাতে পশ্চিম পাকিস্তানী, তাদের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, কলোনির শোষণ চাপা পড়ে যায়।
তিনি লিখেছেন, ১৯৭১ সালে সেনাবাহিনীর এ্যাকশনের কারণে পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। ১৯৪৭ সাল থেকেই এর শুরু। শহীদ-ই-মিল্লাতকে [লিয়াকত আলী খান] খুন, মওদুদীকে ফাঁসিতে ঝোলানোর নির্দেশ, বাংলাভাষা আন্দোলন, নারায়ণগঞ্জ পাট কারখানা আন্দোলন, কর্ণফুলী কাগজকল আন্দোলন, শিল্পাঞ্চলে সংঘর্ষ, সংবিধান পরিত্যাগ, সামরিক শাসন জারি, মৌলিক গণতন্ত্রের প্রবর্তন, এবডো এবং সর্বশেষে আর্মি এ্যাকশন। এ সব বিষয় বিচ্ছিন্ন কোন বিষয় নয়। বরং তারা একটি শেকলের মতো। এই শেকলটি কালো হাতে কেউ ধরেছিল কিন্তু আমরা সামনে দেখেছি জেড এ ভুট্টো এবং শেখ মুজিবকে। আমরা দেখেছি ডাল রুটি, ডাল ভাতের জন্য তাদের দাবি, তাদের জীর্ণ শালওয়ার, শার্ট, লুঙ্গি বিশ্বাস করেছি তাদের, তাদের শিকার হয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাকিস্তানকে খ-িত করেছি। (পৃ-৮১]
প্রথমেই বলে নেয়া হচ্ছে ১৯৭১ সালের কর্মকাণ্ডের জন্য পাকিস্তানী সেনাবাহিনী দায়ী নয়, শেষেও একই কথা বলা হচ্ছে। লিয়াকত আলী ও মওদুদীর বিষয়কে একইভাবে দেখা হয়েছে। যদিও দু’টি বিষয় সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং এ অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে এর বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। নারায়ণগঞ্জ এবং কাপ্তাইয়ে কারখানায় কোন আন্দোলন হয়নি। হয়েছিল বাঙালী বিহারি দাঙ্গা এবং তা উসকে দিয়েছিল অবাঙালী কর্মকর্তারাই। এখানে পাকিস্তানী রাজনীতিবিদ আমলাদের চক্রান্ত, কলোনি শাসন, সর্বক্ষেত্রে বৈষম্য ও নিপীড়ন, জামায়াত-মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি অনুপস্থিত। অদৃশ্য কালো হাত যে পাঞ্জাবীদের সেটি বাদ দেয়া হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, ইয়াহিয়ার কথা একবারও উল্লেখ নেই। ১৯৭১ জামায়াত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হয়ে কাজ করেছিল।
জামায়াতের মজলিসে শূরার অধিবেশন হলো ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে। অধিবেশনে অংশগ্রহণ করে নোয়াখালী জেলায় সাংগঠনিক সফর করলেন মহিউদ্দিন। কী হবে কী হবে সবাই এ চিন্তায় ব্যস্ত।
ঢাকা জ্বলছে, পূর্ব পাকিস্তান জ্বলছে লিখেছেন মহিউদ্দিন, সবাই উত্তেজিত, কিন্তু মহিউদ্দিনের কোন উত্তেজনা নেই। স্বাভাবিকভাবেই দিন যাপন করছেন যেন কিছুই হয়নি। কর্মীদের শুধু বললেন, রাজনীতির যা-ই হোক না তারা যেন জামায়াতের সঙ্গে বন্ধন শক্তিশালী করে। কী ঘটবে মহিউদ্দিন জানতেন কীনা জানি না। এ সম্পর্কে তিনি কিছু জানাননি। না জানলে ধরে নিতে হবে, রাজাকারের রক্ত অতি ঠা-া। যে কারণে ১৯৭১ সালে তারা ঠা-া মাথায় গণহত্যা করতে পেরেছিল।

॥ ৯ ॥
নোয়াখালী শহরে ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে জামায়াত অফিসে মহিউদ্দিন বসেছিলেন। হঠাৎ দেখেন দু’জন অফিসে ঢুকলেন। তাদের দেখে তিনি খুব অবাক হলেন। এদের একজন হলেন চট্টগ্রামের ভূতপূর্ব আমির শফিউল্লাহ, তখন জামায়াতের শ্রম সম্পাদক। মহিউদ্দিনকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন;
‘আপনি এখনও এখানে?’
‘কেন, কী হয়েছে?’
‘কিছু একটা ঘটবে। উঠুন, চলুন লক্ষ্মীপুরে যাই।’
তারপর তিনি ঠিক করলেন কী ভাবে যাবেন। সোজাপথে না গিয়ে তিনি ঠিক করলেন, গ্রামের রাস্তায় রিক্সা করে যাবেন। বিদায় নিয়ে তিনি রওয়ানা হলেন। অর্থাৎ শফিউল্লাহ জানতেন কী হতে যাচ্ছে। মহিউদ্দিন বিকেলে লক্ষ্মীপুর পৌঁছলেন। ২৫ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি লক্ষ্মীপুরে নিজ বাড়িতে ছিলেন। সেখানে তিনি সেনাবাহিনীর ‘নির্যাতন’ ‘নিষ্ঠুরতা’-বিডিআর ও পুলিশদের দমন। বিভিন্ন সেনানিবাসেব বাঙালী পাক সেনাদের আক্রমণ ও প্রতিআক্রমণের কথা শুনেছেন। এখানে লক্ষণীয়, হানাদার বাহিনীর ‘নির্যাতন’ ও নিষ্ঠুরতা’ তিনি বিশ্বাস করেন না।
এবার রাজাকারের দিকের বয়ান শুনুন। তিনি লিখেছেন, “আমি এক শ‘ ভাগ নিশ্চিত যে একটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কারণে আর্মি এ্যাকশন হয়েছে। যদি তা না হয় তাহলে যাদের পূর্বপুরুষরা পাকিস্তানের জন্য লড়াই করেছে, তাদের কেন শত্রু বানানো হবে? শত্রু বানানোর কারণ, তাহলে বাঙালীরা ক্ষুব্ধ হবে, পাকিস্তানী সেনাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেবে এবং এক সময় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে যেখান থেকে ফেরা যাবে না।’
মহিউদ্দিন মনে করেন, পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে গ্রাম, বিভিন্ন শহর ও ঢাকা থেকে আওয়ামী লীগের নেতারা আশ্রয়ের নামে ভারত চলে যায়। ইকবাল হল ও অন্যান্য হল যা ছিল নেতাদের দুর্গ তা ২৫ মার্চ বিকেলেই খালি হয়ে যায়। শহরে তো লোক বেশি ছিল না। সেগুলোও খালি হয়ে যায়।
বিনা কারণে রাজাকার মহিউদ্দিন বর্ণনা দেননি। এর পরে শুনলে বোঝা যাবে কোন মিথ্যা অনুচ্ছেদটি লেখা হয়েছে। তার ভাষায়, সেনারা খালি হলগুলোতে অভিযান চালায়। ঢাকায় তারা এক বিশেষ ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করে যার ফলে আলোর ফুলঝুরি উঠত। এই অস্ত্র ছিল নিরস্ত্রদের ভয় দেখানোর জন্য। মানুষজন হেঁটে গ্রামের দিকে রওনা দিল। হ্যাঁ, কিছু মানুষ মারা গেছে কিন্তু তা পরিকল্পনার বোকামির কারণে। কিন্তু সেই বোকামি নিরস্ত্র মানুষের না সশস্ত্র পাকিদের তা লিখতে ভুলে গেছেন মহিউদ্দিন। তিনি লিখছেন, না বোকামি বলব না বরং বলব চতুর। রেল লাইনের পাশে যদি গরিব শ্রমিকদের কয়েকজন মারা যায় বা গ্রেফতার করা হয়। তা হলে নিশ্চিতভাবে সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হবে। যদি হিন্দু এক দার্শনিক অধ্যাপক মারা যায়, তা হলে পুরো হিন্দু সম্প্রদায় ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেবে, যার অজুহাতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে। এবং বাস্তবে তাই ঘটেছিল। এতক্ষণে বোঝা গেল, মহিউদ্দিন প্রথমে উল্লেখিত আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের রেফারেন্স দিচ্ছেন। অর্থাৎ ষড়যন্ত্রকারীরা চতুরতার সঙ্গে এই কাজ করেছিল যাতে বাঙালীরা ক্ষুব্ধ হয় ভারত ক্ষুব্ধ হয়। বলিহারি রাজাকারের কল্পনা শক্তি।
২৫ মার্চ ও তার পরবর্তী ঘটনাগুলোর বিবরণ যেভাবে মহিউদ্দিন দিয়েছেন তাতে মনে হতে পারে মার্চ-এপ্রিলে যা ঘটেছে বলে প্রকাশিত হয়েছে আসলে তা গুজব। লিখেছেন তিনি, ‘একদিন সকালে একলা গ্রামের রাস্তা ধরে ভবানিগঞ্জ যাচ্ছিলাম। এক লোকের সঙ্গে দেখা। তার সঙ্গে আলাপ শুরু করলাম। তিনি বললেন, আমি চট্টগ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে আসছি। হাজার হাজার শিশু, নারী, বৃদ্ধ একইভাবে খাওয়া-পানি ছাড়া হেঁটে আসছে। চাঁটগায় পাঞ্জাবীরা লাখ লাখ হত্যা করেছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। জিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।’
‘এ সময় দেখলাম জাতিসংঘের একটি গাড়ি আসছে। হাত তুলে থামালাম। চালক বিদেশী। আমি তাকে অনুরোধ জানালাম, ঐ লোককে গাড়িতে একটা লিফট দিতে যার মতে, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে, চাঁটগায়ে লাখ লাখ লোক মারা গেছে, পাঞ্জাবী সৈন্যরা হেরে গেছে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জিতছে এবং জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রের কর্ণধার হয়েছে।’ (পৃ. ৮৫]
২৫ মার্চ গণহত্যা নিয়ে বেশ একটা ব্যঙ্গ করা হয়েছে। কিন্তু তার মধ্যেও লক্ষ্য করুন। দু’টি অনুচ্ছেদে নিজে নিজেই শব্দের মানে বদলে ফেলেছেন। প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, পাঞ্জাবীরা হত্যা করছে, পরাজিত হয়েছে এমন কথা বলা হয়নি। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর কথা নেই, জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হয়েছেন তার উল্লেখ নেই।
১৫ এপ্রিল তিনি খবর পেলেন তার দূর সম্পর্কের এক শ্যালক মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেছেন। মহিউদ্দিনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। তারপরও মহিউদ্দিন যেচে গেলেন সেখানে। তাকে দেখা মাত্র বোঝা গেল শ্যালক ক্ষুব্ধ হলেন, যদিও মুখে কিছু বললেন না। তাকে স্বাগতও জানালেন না। মহিউদ্দিন বসা মাত্র শ্যালক পাকিস্তানী সৈন্যরা যে হত্যা লুট অগ্নিসংযোগ করছে তার কয়েকটি ঘটনা বললেন। মহিউদ্দিন খান বলেছেন, এসব গুজব, প্রোপাগা-া।’
এটি শোনা মাত্র মহিউদ্দিনের ভাষায় শ্যালক তাকে আমার্জিত ভাষায় গালাগাল করে বললেন, ‘আমার বাড়ি থেকে বের হও রাস্কেল, পাঞ্জাবী এজেন্ট, বের হও ইত্যাদি।’
মহিউদ্দিন পরে ঘটনাটি বিশ্লেষণ করে লিখেছেন, এরকম প্রতিক্রিয়ার কারণ কী? সেই একই কৌশল। তার জামাই ঢাকায় কোন এক জায়গায় কেরানির কাজ করে। ঢাকা থেকে পায়ে হেঁটে বাড়ি রওনা হয়েছিল। তিনদিন হেঁটে বাড়ি পৌঁছে সে জানিয়েছে, ঢাকা ধ্বংস্তূপে পরিণত হয়েছে। সব হিন্দু এবং প্রায় সব আওয়ামী লীগারকে মেরে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে বুড়িগঙ্গায়। রাজশাহী, দিনাজপুর, বগুড়া, পাবনা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রামেও একই ঘটনা ঘটেছে। হাজার হাজার লোক ঢাকা ত্যাগ করে গ্রামে গঞ্জে পৌঁছে এ ধরনের প্রচার করছে। তারা এমনভাবে বলছে যেন সব ঘটনা তাদের চোখের সামনেই ঘটেছে।
এরই সূত্র ধরে মহিউদ্দিন জানাচ্ছেন, এ ধরনের শত শত গল্পগাছা তখন পল্লবিত হয়েছে। মানুষকে বোকা বানানো হয়েছে। পাকিস্তানের শত্রুরা এতে সফল হয়েছে। এই ধরনের একটি কাহিনীর তিনি উল্লেখ করেছেন।
“টিক্কা খান নয়ফুট লম্বা এবং তিন ফুট পাশে। দিনে তিনি তিন কিলো মানুষের রক্ত পান করেন, সকালের নাস্তায় তিনি মানুষের মগজ খান। তিনি বলেছেন, আমি সব বাঙালীকে হত্যা করব। আমি মাটি চাই মানুষ চাই না।”

ঐ সময়ে এ ধরনের কাহিনী আমি শুনিনি। শেষ বাক্যটি সত্য। ঐ বাক্যটি ইচ্ছে করে দেয়া হয়েছে যাতে মানুষের মনে হয় এ ধরনের গুজব রটেছিল। মহিউদ্দিন আবার তার যুক্তি তুলে ধরেছেন এভাবে
যুগ যুগ ধরে মানুষ শুনে আসছে শিরির মুখে এক আজলা পানি তুলে দেয়ার জন্য ফরহাদ বিশাল এক পাথুরে পাহাড় কেটে পানির নহর এনেছেন। হযরত আলীর তরবারির ওজন তিন মণ, তার পুত্র হযরত হানিফা সকালে এক মণ চিড়া খেতেন। সোনাভান যে আলখাল্লা পরে যুদ্ধে নেমেছিলেন তার ওজন ছিল ছয় মণ। শেখ সাদী বাঘের পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়াতেন। বায়েজিদ বোস্তামী পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন কা’বাতে গিয়ে। অশিক্ষিত মানুষ এসব কল্পকথা বিশ্বাস করে। কেউ তার প্রতিবাদ জানালে তাকে কাফের ঘোষণা করা হয়।

 মহিউদ্দিন বলতে চাচ্ছেন, এসব যেমন সত্য নয়; পাকিস্তানীদের হত্যাযজ্ঞও সত্য নয়। তবে, কথা হচ্ছে মহিউদ্দিন যেসব কাহিনীর উল্লেখ করেছেন সেগুলোর পুঁথির কল্পকথা। মানুষ এভাবেই তা নেয়। হয়ত কিছু বিশ্বাস করে। কিন্তু সেগুলো চ্যালেঞ্জ করলে কেউ কাফের ভূষিত হয়েছে শুনি নাই।

একবিংশ শতকেও তো কিছু মানুষ বিশ্বাস করেছে, সাঈদী চাঁদে; ১৬ কোটির সবাই তা বিশ্বাস করলে তো সেদিন আর সরকার থাকে না। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান কী করেছে তা রাজাকার আর আল বদর ছাড়া সবাই জানে, বিশ্বাসও করে। মহিউদ্দিন বলছেন, নিজের মা-বোন বা স্ত্রীর ধর্ষিত হওয়ার বা দু’একটি বাড়ি পোড়ানোর ঘটনা ঘটায় সবার বিশ্বাস হলো যে, ঢাকা শেষ তার মানুষজনও শেষ। ঘটনা আরও বিশ্বাসযোগ্য হলো এ কারণে যে, কিছু কিছু ছাত্র গ্রামে এসে যখন বলল, ইতিহাসে মুসলমান কর্তৃক মুসলমান হত্যার ঘটনা আছে।

 দিল্লীতে তৈমুর লঙ ৫০ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে, মুঘলরা পাঠানদের হত্যা করেছে। এবং সবাই মুসলমান। তা’ হলে পাঞ্জাবী সৈন্যরা ৩০ লাখ মুসলমানকে হত্যা করলে অবিশ্বাসের কী আছে?

এরপর মহিউদ্দিন রাজাকার আলবদর ও ধর্ষণ সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন তাতে চমৎকৃত হতে হয়। তিনি লিখেছেন, ধর্ষণের কথা বলা হয়, কিন্তু আমি আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি। একজন রাজাকার-আলবদরও এ ধরনের কার্যে লিপ্ত হয়নি। আমরা সেটার চিন্তা করতে পারিনি। আল্লাহ আমাদের এ ধরনের পাপ থেকে রক্ষা করেছেন।”
এটি যে সর্বৈব মিথ্যা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমার লেখা ‘বীরাঙ্গনা ৭১’ ও ‘শান্তি কমিটি ১৯৭১’-এ বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা আছে কেস স্টাডিসহ। তাই এখানে সে বিষয় আর বিশদ উদাহরণ দিলাম না।
মহিউদ্দিন লিখছেন, তারা নিজেরাই নাকি নিজেদের নিয়ে ভয় পাচ্ছিলেন। জামায়াত ও মুসলিম লীগের লোকদের লাইন করে মারা হয়েছে। হ্যাঁ, রাজাকার আল বদররা যুদ্ধে মারা গেছে। কিন্তু মুসলিম লীগমনা বা জামায়াত সমর্থক লোক যারা নিষ্ক্রিয় ছিলেন তাদের হত্যা করা হয়েছে এমন ঘটনা বিরল। আফসোস করে লিখেছেন- ভুট্টো-মুজিব যদি এ ধরনের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি না করতেন তা’হলে গ্রামে-গঞ্জে আর্মির আগমন ঘটত না। কিন্তু কেন ঘটল? এবার রাজাকারী ব্যাখ্যা শুনুন।
আওয়ামী লীগ পাকিস্তানী আর্মিকে প্রতিরোধ করতে চাইল। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বাঙালী অফিসাররা দলত্যাগ করে বিভিন্ন জায়গায় তাদের সহযোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। এর আগে আওয়ামী লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করে তাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। “আমাদের এলাকায়। অর্থাৎ নোয়াখালী] ভারতীয় সেনারা ছদ্মবেশে উপস্থিত হলো। ফেনী, চৌমুহনী, মাইজদি কোর্টে শ’য়ে শ’য়ে ভারতীয় সেনা ছদ্মবেশে অবস্থান নিল। পাকিস্তান বাহিনী এসব জায়গায় পৌঁছলে ভারতীয়রা গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিল।” মহিউদ্দিনকে তার কর্মীরা জানিয়েছেন নিজ চোখে তারা এসব সৈন্যকে দেখেছেন।

এবার রাজাকার হত্যার বর্ণনা শুনুন
মুক্তিবাহিনী তার আক্রমণ শুরু করল। তাদের নীতি ছিল পাকিস্তানী বাহিনীকে অ্যামবুশ করা ও পাকিস্তানপন্থীদের হত্যা করা। “তারা আমাদের সাহসী ও কর্মচঞ্চল শ্রমিক নেতা মোহাম্মদ শফিককে গ্রেফতার করে ধানক্ষেতে নিয়ে গেল। সেখানে প্রথমে তাকে নির্যাতন করা হলো। এখানে তারা তার গোড়ালি কাটল, তারপর হাঁটু, তারপর কোমর, তারপর গলা কর্তন করল। সে তারস্বরে সাহায্যের জন্য আবেদন করছিল আর অনুরোধ জানাচ্ছিল তাকে যেন এক কোপে মেরে ফেলা হয়। আমাদের জেলায় এটি ছিল প্রথম শাহাদতের কাহিনী। [পৃ. ৯৩]
ফেনীর মতো জায়গায় এ ধরনের ঘটনা ঘটান যে কত অসম্ভব তা যারা ১৯৭১ ছিলেন এ দেশে তারা জানেন। তারা কারো কোমর দ্বিখ-িত করে ফেললে সাহায্যের জন্য চিৎকারের প্রশ্নই তো আসে না।
এরপর তিনি আরও দু’তিনটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। এরা ছিলেন স্থানীয় জামায়াত নেতা, মুক্তি-বাহিনী যাদের তুলে নিয়ে হত্যা করে। সেটি অস্বাভাবিক কিছু নয়। শত্রুদের কে না ঘায়েল করতে চাইবে।
১০ জুন তিনি ফেনী গেলেন সেনাবাহিনীর সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে কথা বলতে। সেখান থেকে এলেন মাইজদি কোর্ট শান্তি কমিটির সহ-সভাপতি ও এ্যাডভোকেট সিদ্দিকুল্লাহ্র সঙ্গে কথা বলতে। এক সঙ্গে তারা মাগরেব পড়লেন। এমন সময় নোয়াখালী জামায়াতের দফতর সম্পাদক মওলানা নুরুল্লাহ এসে খবর দিলেন খলিফার হাটের এক জামায়াতকর্মী খবর দিয়েছে মুক্তিবাহিনী মাইজদি কোর্ট আক্রমণ করবে। নোয়াখালী কলেজ ইউনিয়নের সভাপতি ছাত্র সংঘের তোফায়েল আহমদ ও ছিলেন সেখানে। তারা ঠিক করলেন নিরাপদ জায়গায় তারা সরে যাবেন। জামায়াতে ইসলামের অফিসের পাশে ছিল মহিউদ্দিনের বাসা। সেখানে গেলেন তোফায়েল ও শামসুল আলম। একজন সরকারি অফিসের বাসায় আশ্রয় নিলেন মৌলানা নুরুল্লা ও একজন জামায়াতকর্মী। নোয়াখালী কলেজের এক শিক্ষকের বাসায় আশ্রয় নিলেন মহিউদ্দিন, অধ্যাপক ফজলে আজিম এবং এ্যাডভোকেট আনোয়ার হোসেন। গভীর রাতে ঐ তিনজনকে দেখে বেচারা অধ্যাপক খুবই নার্ভাস বোধ করছিলেন। যা হোক, নোয়াখালী কলেজে যেহেতু দু’জনে চাকরি করেছেন সেহেতু আর অমত করেননি।
রাত দু’টোর সময় মুক্তিবাহিনী সত্যি সত্যিই মাইজদি কোর্টে পাকিস্তানী দালালদের খোঁজে বিভিন্ন জায়গায় আক্রমণ করলেন। মহিউদ্দিনের ভাষ্য অনুযায়ী এ্যাডভোকেট আশরাফুল হক যিনি পরিচিত ছিলেন সারা উকিল নামে তার বাসা মুক্তিবাহিনী আক্রমণ করে। তিনি পালাতে পারেননি। তাকে নাকি বারবার মহিউদ্দিনের কথা জিজ্ঞেস করা হয়। তিনি কোন খোঁজ দিতে পারেননি। তিনি, তার স্ত্রী, এক সন্তান ও গৃহভৃত্যকে মুক্তিবাহিনী গুলি করে হত্যা করে।
মহিউদ্দিন উল্লেখ করেছেন, এরপর থেকে এ ধরনের ঘটনা নিত্যনৈমত্তিক হয়ে উঠল। এ সব ঘটনা সামাল দেবার জন্য পাকিস্তানপন্থীদের নিয়ে গঠিত হলো রাজাকার বাহিনী। পূর্ব পাকিস্তানে এ ধরনের ‘এক্সপেরিমেন্ট’ ছিল নতুন এবং তা সফল হলো। এই কৌশলকে ভিত্তি করে সারা পূর্ব পাকিস্তানে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হলো। পরে এই বাহিনীর নামকরণ করা হয় আল বদর, আল শামস এবং আর মুজাহিদ। ইসলামী ছাত্র সংঘ যারা করতেন তাদের বলা হতো আল বদর। জামায়াতী ইসলাম, মুসলিম লীগ, নেজামী ইসলামী প্রভৃতির ‘দেশ প্রেমিক জনগণ’ ছিল আল শামস এবং বিহারিরা আল মুজাহিদ।
এখানে খানিকটা বিভ্রান্তি হতে পারে। রাজাকার সব সময় আলাদা বাহিনীই ছিল। বাকি তথ্যগুলো সঠিক। এই প্রথম একজন রাজাকার লিখিতভাবে স্বীকার করেছেন ইসলামী ছাত্র সংঘ সম্পূর্ণভাবে আল বদর বাহিনীতে রূপান্তরিত হয়েছিল যার প্রধান ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী। পরবর্তীকালে নিজামী ও অন্যান্য আলবদর নেতা মুজাহিদ, কামারুজ্জামান, কাদের মোল্লা প্রমুখ এই সত্যটি অস্বীকার করেছেন।
নোয়াখালীতে তার ভাষ্য অনুযায়ী রাজাকারদের সাত দিনের রাইফেল ট্রেনিং দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় মোতায়েন করা হয়েছিল। মুক্তিবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য। মহিউদ্দিন স্বীকার করেছেন, একবার রাজাকার বাহিনীতে কেউ যোগ দিলে একা নিজ গ্রামে যেতে পারত না। কারণ, মুক্তিবাহিনীও সাধারণ জনগণ মনে করতেন, রাজাকার হচ্ছে পাঞ্জাবীদের এজেন্ট, সুতরাং বাঙালীদের শত্রু। এবং তাই তাকে হত্যা করতে হবে।
মহিউদ্দিন জানাচ্ছেন, প্রচ্ছন্ন গর্বের সুরে যে, এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই অবস্থা চলেছে। আমাদের দিনরাত্রি এই রকম আর্মি অপারেশন অবস্থায় জরুরী অবস্থার মতো কাটাতে হয়েছে। জনগণ আমাদের সমর্থন করেনি কিন্তু আমাদের ভারতে ঠেলে দিতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের দমন করা হয়েছে। তারা মর্টার, স্টেনগান, ভারি অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে আমাদের ঘাঁটি আক্রমণ করেছে। আমাদের ছিল শুধু থ্রি নট থ্রি। গ্রামবাসীরা তাদের গোপন আশ্রয়ে থেকেছে কিন্তু বাজার হাট বা শহর আমাদের নিয়ন্ত্রণে থেকেছে।” শেষোক্ত মন্তব্য সত্য হলে রাজাকারদের পরাজিত হওয়ার কোন কারণ ছিল না।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ‘ঢাকা পতনের’ আগে মুক্তি বাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী নোয়াখালী আক্রমণ করে। মহিউদ্দিন তখন চিকিৎসার কারণে ছিলেন ঢাকায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাজাকারদের সম্মুখযুদ্ধে পাঠাল। মহিউদ্দিনের ভাষ্য অনুযায়ী ‘তারা বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে শহীদ হলো। ৮ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী নোয়াখালী দখল করে রাজাকার ঘাঁটিগুলো আক্রমণ করে। বেশিরভাগ রাজাকারই মারা পড়ে। মহিউদ্দিন জানাচ্ছেন, ঢাকার পতনের পর ১০ হাজার পাকিস্তানপন্থীদের হত্যা করা হয়, তার মধ্যে ৫০০০ ছিল নোয়াখালীর।
জামায়াতের ২০ জন জেলা আমীর, শান্তি কমিটির সভাপতি ও সম্পাদকদের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার মাত্র একজনের নাগরিকত্ব বাতিল করে এবং জীবিত বা মৃত ব্যক্তিটির জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে। ব্যক্তিটি হলেন মহিউদ্দিন। তার এই মন্তব্য থেকে বোঝা যায়, নোয়াখালীতে কী ত্রাসের রাজত্ব চালিয়ে ছিলেন তিনি।
বিষয়টি আরো পরিষ্কার হয় পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে যেখানে দেখা যায় নোয়াখালীতে পাকিস্তানীদের পক্ষে তিনিই ছিলেন প্রধান স্তম্ভ। 
॥ ১১ ॥
নোয়াখালী থেকে মহিউদ্দিন তার স্ত্রী নার্গিস, দুই শিশু সন্তান ও কিশোর শ্যালক শাব্বিরকে জুন মাসে ঢাকা পাঠিয়ে দিলেন। এর অর্থ নোয়াখালী মহিউদ্দিনের কাছেও আর নিরাপদ ঠেকছিল না।
রেল ব্যবস্থা তখন বিপর্যস্ত। কুমিল্লা পর্যন্ত যেতে পারলেন নার্গিস। তার মামাকে আসতে বলেছিলেন স্টেশনে। কারফিউয়ের কারণে, মামা আসতে পারেননি। মহিউদ্দিন লিখেছেন, সেখানে এই চারজন ছাড়া আর কোন স্ত্রীলোক ছিল না। নিশুতি রাত, কারফিউ তারপর সম্মান ও পবিত্রতা (সতীত্ব) রক্ষার প্রশ্ন থাকা সত্ত্বে¡ও ‘ইসলামী আন্দোলনের অকুতোভয় মহিলা সৈন্য’ এক শিশুকে কোলে আরেক শিশু কন্যার হাত ধরে তিন মাইল পথ হেঁটে মামাবাড়ি পৌঁছান।
জুলাই বা আগস্ট মাসে জেনারেল টিক্কা খান নোয়াখালী এলেন। ডেপুটি কমিশনার সরকারী কর্মচারী ও শান্তি কমিটির সদস্যদের সভা করলেন। শান্তি কমিটির সদস্যরা সভাপতি এ্যাডভোকেট সৈয়দুর রহমানের বাসায় সভা করলেন। সিদ্ধান্ত হলো, টিক্কা খানকে সাদরে অভ্যর্থনা জানানো হবে এবং তাকে অভিনন্দনপত্র দেয়া হবে। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর ভয়ে কেউ আর অভিনন্দনপত্র পড়তে রাজি নন। মহিউদ্দিনই জানালেন, তিনিই অভিনন্দনপত্র পাঠ করবেন।
জুন থেকে অক্টোবর মহিউদ্দিন নোয়াখালীতে বিভিন্ন রাজাকার ক্যাম্পে অবস্থান করেছেন। অক্টোবরে তিনি আলসারে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং গোলাম আজমের কাছে অনুমতি চান ঢাকায় চিকিৎসা করার। গোলাম আজম অনুমতি দেন। মকবুল আহমেদকে নোয়াখালীর আমীর করা হয়। মহিউদ্দিন কর্মী এবং রাজাকারদের থেকে বিদায় নিয়ে চট্টগ্রাম গেলেন, সেখান থেকে প্লেনে ঢাকা। প্রতীয়মান হয় যে, পাকিস্তানী দালাল এবং ত্রাস হিসেবে মহিউদ্দিন পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন এবং তার আশঙ্কা ছিল তার ওপর আক্রমণ হতে পারে। সে কারণে, রাজাকার ক্যাম্পে থাকতে তিনি স্বস্তি বোধ করতেন। তিনি চালাক লোক, বুঝেছিলেন, পাকিস্তানীরা হটে যেতে পারে তাই তিনি ঢাকা চলে যেতে চাইছিলেন। অসুখটা ছিল অজুহাত।
ঢাকায় তিনি স্ত্রী, পুত্র নিয়ে নাখালপাড়া থাকতেন। শ্বশুরকে বলেছিলেন- বাসাবো থেকে মালিবাগ চলে আসতে নিরাপত্তাজনিত কারণে। ভারতীয় আক্রমণ শুরু হলে তিনি এক আল বদরকে নির্দেশ দেন একটা বাস পাঠাতে।


No comments:

Post a Comment