Sunday, January 26, 2014

স্ট্র্যাটেজিক কারণেই আমেরিকা বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তারে আগ্রহী : কে কে গঙ্গোপাধ্যায়


শেখ হাসিনা বাংলাদেশে তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রীরূপে শপথগ্রহণ করলেন।এই নির্বাচনের পথ পাড়ি দেয়া মোটেই সহজ ছিল না। আগামী দিনেও শাসনক্ষমতা পরিচালনা করা সহজ হবে বলে মনে হয় না। 

কারণ বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বেগম খালেদা জিয়ার বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বিএনপি) নির্বাচন প্রক্রিয়া চলাকালীন প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার সরে যাওয়া এবং নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দ্বারা ওই সময় সরকার এবং নির্বাচন পরিচালনা করার দাবিতে, নির্বাচন বানচাল করার সব রকম প্রয়াস করেছেন।

এ কাজে তিনি ব্যবহার করেছেন জামায়াত, হেফাজতে ইসলাম ইত্যাদি ধর্মীয় কট্টরপন্থী সংগঠনকে। এই দলগুলো পাকিস্তানপন্থী। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সরকারের দমননীতির এরা সহযোগী ছিলেন। লাখ লাখ নিরপরাধ সাধারণ মানুষের সঙ্গে বিদগ্ধ সমাজের জ্ঞানী গুণী ব্যক্তিদের এরা নৃশংসভাবে কতল করেছিল। আন্তর্জাতিক আদালতে তাদের বিচার চলছে। তাদের এক প্রধান কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার ব্রিটিশ এবং মার্কিন সরকার এই রায় কার্যকর না করার জন্য শেখ হাসিনা সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছিল।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে এই বিএনপি সমর্থিত কট্টরপন্থীরা দেশব্যাপী সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছিল সংখ্যাঘু সম্প্রদায়সহ বহু মানুষকে হত্যা, বাড়ি, দোকান বাজার লুট, বিভিন্ন গ্রামে, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটিয়েছে, রাস্তা অবরোধ, বাস অটো জ্বালিয়ে দেশব্যাপী সন্ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। বিএনপি নির্বাচন বয়কট করে কোনস্থানেই প্রার্থী দেয়নি।

কিন্তু শেখ হাসিনা তাঁর সঙ্কল্পে অনড়, অটল ছিলেন। অনন্ত সাহস এবং ধৈর্যের সঙ্গে তিনি পরিস্থিতির মোকাবেলা করেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া চলবে। তিনি ঘোষণা করেছিলেন এবং বিশেষ সুরক্ষার ব্যবস্থা করে নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে করতে নির্বাচন কমিশনকে সর্বপ্রকার সহায়তা করেন। ফলে ১৫০টির অধিক আসনে আওয়ামী লিগ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করে। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে।
ধারণা করা অবাস্তব হবে না, আগামী দিনে বেগম খালেদা জিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় জামায়াত এবং হেফাজতে ইসলাম ইত্যাদি সংগঠন প্রতি পদে সমগ্র রাষ্ট্রে অরাজকতা সৃষ্টি করে চলবে। প্রধানমন্ত্রীকে কঠোর হস্তে আইনের শাসন বলবত করতে হবে। এই ধর্মীয় কট্টরপন্থী সংগঠনগুলো পাকিস্তানের সর্ববিধ সাহায্য এবং সমর্থন লাভ করে চলেছে। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কয়েকটি ধনী ইসলামিক রাষ্ট্র এদের বিভিন্ন এনজিও মারফত অর্থ সাহায্য দিয়ে চলেছে। তাদের উদ্দেশ্য আবার একটু ভিন্ন। যেমন বাংলাদেশে কট্টর ইসলামিক সরকার যাতে ক্ষমতায় আসতে পারে তার প্রয়াস করা। বিশেষ করে বাংলাদেশী সাহিত্য সংস্কৃতির যে ঐতিহ্য এবং ভা-ার বাংলাদেশে বর্তমান, তা ধ্বংস করে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের জায়গায় একমাত্র ইসলামিক জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠা করা। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ থেকে যত বেশি সংখ্যায় সম্ভব ইসলাম ধর্মীয় ব্যক্তিদের ভারতে অনুপ্রবেশ ঘটানোর ব্যবস্থা করা। ফলে ভবিষ্যতে এমন একদিন আসবে, যেদিন ভারতবর্ষে মুসলমান সম্প্রদায় প্রধান জনগোষ্ঠী হয়ে দেখা দেয়।সেজন্য দরিদ্র, ভূমিহীন, শিক্ষাহীন বাংলাদেশীদের হাতে মোটা টাকা এককালীন দান হিসাবে ধরিয়ে দিয়ে ভারতে তাদের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে দেয়া। ভারতে জমি কিনে ঘর করে তারা ভারতীয় হয়ে বসবাস আরম্ভ করবে। বাংলাদেশ সরকার তাদের আর কোনদিন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করবে না। এই বিষয় সেই সব অনুপ্রবেশকারীদের প্রথম থেকেই বুঝিয়ে দেয়া হয়।

ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে ভোটে জয়লাভই প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য। সে কারণে সেই সব দলের সদস্যরা বিভিন্ন প্রশংসাপত্র জুগিয়ে দিয়ে এদের হাতে ভোটার কার্ড ধরিয়ে দিতে কাল হরণ করেন না। একটাই শর্ত, আগামী নির্বাচনে সেই দলের প্রতীক চিহ্নে ভোট দিতে হবে। অন্যায়ভাবে ভারতে অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করার অনেক প্রয়াস থমকে গিয়েছে। কারণ ভোটার পরিচিতি কার্ড দেখানোর পর প্রশাসন কোন কিছু করার পথ খুঁজে পাচ্ছে না। এই সব রাজনৈতকি দলের কাছে ভোটে জয়লাভই একমাত্র লক্ষ্য রাষ্ট্রের উন্নয়ন, অনুন্নয়ন, সুরক্ষা, অসুরক্ষা কোন ধর্তব্যের বিষয় নয়। শুধু এই রাজ্যই নয়, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে, এমনকি জম্মু কাশ্মীর রাজ্যেও এমন ভোটার পাওয়া যাবে বলেই আমার বিশ্বাস।
পাকিস্তান আজও মনে করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী মানুষ পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তান বিভাজিত করে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি করেননি, ভারতীয় সামরিক বাহিনীই এই অবস্থার জন্য দায়ী। অতএব তারা বাংলাদেশের জন্মাবধি সেই রাষ্ট্রে দেশদ্রোহী, পাকিস্তানপন্থীদের সর্বতোভাবে সাহায্য এবং সমর্থন দিয়ে এসেছে, আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন সেই সব কট্টরপন্থী, সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোকে সমর্থন করে চলেছে, বিশেষভাবে বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন রয়েছে পাকিস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদ বিরোধী অভিযানের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। পাক-মার্কিন সম্পর্ক সেই সিয়েটোসেন্টো চুক্তির আমল থেকে চলে আসছে। ভারত জোটনিরপেক্ষ নীতির বিশ্বাসী কিন্তু মার্কিন সরকার অস্ত্র উপকরণ বিক্রয়ে আপেক্ষিক মূল্য ছাড়াও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দানে যেমন ভারতে সেইসব অস্ত্র নির্মাণের লাইসেন্স দেয়া ইত্যাদি বিষয়ে অনীহা প্রদর্শন করায় বাধ্য হয়ে ভারতকে সোভিয়েত ইউনিয়নের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল। অতএব পাকিস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার এবং ভারত শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে একটি বাজার মাত্র। এমনকি পরমাণু চুক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের চুক্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যথেষ্ট সাহায্য করা সত্ত্বেও ভারত নতুন পরমাণু চুক্তির বরাত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দেয়নি। বিদেশী মূলধনের বিনিয়োগের বিষয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আশানুরূপ সুযোগ পায়নি। এর কারণ ভারতের প্রবল বিরুদ্ধ জনমত।


এইসব কারণে পাকিস্তানের ভারতের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধের বিশেষ করে কট্টর জিহাদী সংগঠন, আইএসআই এবং পাক সামরিক বাহিনীর সাহায্যের (২৬/১১ সমেত), অকাট্য প্রমাণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেখতে পায়নি। যদিও হেডলি গ্রেফতার হয়ে তাদেরই হেফাজতে রয়েছে বহুদিন। বর্তমানে চীন সমগ্র দক্ষিণ চীনসমুদ্র তাদের রাষ্ট্রীয় পরিধির অঞ্চল বলে অভিহিত করেছে। জানিয়েছে, ওই অঞ্চল তাদের প্রতিরক্ষার আওতায় আনা হয়েছে। সেনকাকুু দ্বীপগুলোর মালিকানা নিয়ে জাপান ও চীনের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরম সীমায় পৌঁছেছে। স্বভাবতই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের সমর্থনে আসরে পদার্পণ করেছে। এমতাবস্থায় “দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্রের সংগঠন” (এ্যাসোসিয়েশন অব সাউথ ইস্ট এশিয়ান নেশনস) যথেষ্ট সঙ্কটের সম্মুখীন। এই অঞ্চলে তারা কোনভাবেই বৃহৎ শক্তির রেষারেষি পছন্দ করছে না।

বাংলাদেশ ভূখন্ড ভৌগোলিক দিক দিয়ে এই অঞ্চলের প্রবেশদ্বারে অবস্থিত। বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের নিরাপত্তার চুক্তি রয়েছে। চীন তার রাষ্ট্রীয় সীমার চারদিকে বিভিন্ন রাষ্ট্রে অর্থ সাহায্য এবং উন্নয়নের সহায়তা করে তাদের উপস্থিতি এবং প্রভাব বাড়িয়েছে। এমতাবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ ভূখন্ডে তাদের উপস্থিতি এবং প্রভাব বিস্তার করতে আগ্রহী কিন্তু এ কাজটি খুবই সহজ হয়ে যায় যদি জামায়াত সমর্থন নিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় আসতে পারে।


এই সমস্ত কিছু বিবেচনা করলেই কী কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেখ হাসিনা সরকারকে পুনর্নির্বাচনে যাওয়ার উপদেশ দিয়েছেন, তা কিছুটা পরিষ্কার হবে। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকার সেইসব উপদেশে কর্ণপাত করেনি। আগামী দিনে বিএনপি এবং জামায়াত সম্মিলিতভাবে এই সরকারকে গদিচ্যুত করার জন্য কী ধরনের আন্দোলনে নামবে, সে চিন্তাও তারা করেননি। তারা কঠোর হস্তে সেইসব অপচেষ্টার মোকাবেলা করতে বদ্ধ পরিকর।

আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশের মুক্তিসেনা ও তাঁদের সমর্থকরা শেখ হাসিনাকে শক্তি যোগাবে। ইতোমধ্যে ভারত এবং রাশিয়া শেখ হাসিনা সরকারকে সমর্থন জানিয়েছে। দেখা যাক কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।

লেখক : ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল

No comments:

Post a Comment