Sunday, January 26, 2014

শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যার বিচার অবিলম্বে শেষ করতে হবে:মোনায়েম সরকার

বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সফল অর্থমন্ত্রী, সাবেক কূটনীতিক, সরকারি কর্মকর্তা শাহ এএমএস কিবরিয়া ২৭ জানুয়ারি, ২০০৫ রাত ৮টায় ঘাতকের গ্রেনেড হামলায় মৃত্যুবরণ করেন। সেই সময়টায় তিনি ব্যস্ত থাকতেন সিরডাপ ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবৃস্থার সংস্কার’ নিয়ে। বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি এ নিয়ে সিরিয়াস লেখালেখি করছিলেন শেষের দিনগুলোতে। প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানও চেয়ে নিয়ে এ বিষয়ে তার একটি লেখা ছাপালেন শেষ যাত্রার আগের দিন।

আমি প্রস্তাব করেছিলাম, এ বিষয়ে ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে একটা সেমিনার করার জন্য। তিনি রাজি হয়েছিলেন। তারপর সেমিনার পেপারও তৈরি করে ফেললেন। মস্তিষ্ক খুব সক্রিয় ছিল। ওই বয়সেও দ্রুত লিখতে পারতেন। তার ইংরেজি লেখাও ছিল চমৎকার। সারাজীবন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জার্নালে ইংরেজি ভাষায় লিখতেন। অভ্যাসমতো তিনি ওই সেমিনার পেপারটিও বাংলা ও ইংরেজি দু’ভাষাতেই তৈরি করেছিলেন। ফোনে তার সঙ্গে সেমিনারের প্রস্তুতি নিয়েও কথা হল। কিন্তু সিরডাপ মিলনায়তনে ৩১ জানুয়ারি সেমিনার আর করা হল না। এর আগেই চিরবিদায় নিলেন শামস কিবরিয়া।
১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল শাহ এএমএস কিবরিয়ার নেতৃত্বে। তার ইচ্ছায় আমি ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক পদের দায়িত্ব নিই। ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার ১০ বছরে অসংখ্য সেমিনার করেছি তার নেতৃত্বে। মনোগ্রাম, পুস্তক-পুস্তিকাসহ ২৫টি বই প্রকাশিত হয়েছে ফাউন্ডেশন থেকে। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ওপর ২২ পর্বের সিডি-ডিভিডি নির্মিত হয়েছে। শামস কিবরিয়ার উৎসাহ ও প্রেরণায় বঙ্গবন্ধুর জীবনীগ্রন্থ প্রকল্পের পাণ্ডুলিপি তৈরির কাজও সম্পন্ন করেছিলাম আমরা। বাংলা একাডেমির সঙ্গে চুক্তি মোতাবেক দেরিতে হলেও একাডেমি ২০০৮ সালের বইমেলায় গ্রন্থটি প্রকাশ করেছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ (প্রতিরোধ শিবির, মুজিবনগর সরকার ও শরণার্থী শিবিরের) ওপর তিনটি থিমেটিক ম্যাপ, আরও কত কী! কত স্মৃতি, কত কথা! ভাবতে গেলে এই বয়সেও বার বার শিশুর মতো কেঁদে উঠি।
সফল আমলার জীবনশেষে ১৯৯১-এ তার আওয়ামী লীগে যোগদানের পেছনে আমারও বিশেষ ভূমিকা ছিল। শেখ হাসিনা তাকে দলের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য করতে দ্বিধা করেননি। তিনি সভানেত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা পদের দায়িত্বে আসীন হন তার মেধা ও প্রজ্ঞার গুণে। ১৯৯৬ ও ২০০১-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনায় দলের পক্ষ থেকে মেধা ও যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি। তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে আমিও নির্বাচন-পরিচালনা কাজে যুক্ত ছিলাম। সেই সময় রাষ্ট্রপতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে অধিকাংশ সাক্ষাৎ অনুষ্ঠানে তার নেতৃত্বেই আমরা গিয়েছি। প্রেস মিট করেছি কতবার। দেখেছি তার বুদ্ধিমত্তা, ধৈর্য, বলার ও বোঝানোর ক্ষমতা। ২১ বছর পর ক্ষমতায় ফিরে এসে আওয়ামী লীগ তাকে অর্থমন্ত্রী বানিয়ে যে ভুল করেনি, তা প্রমাণ করেছেন তিনি। আমি অর্থনীতি ভালো বুঝি না। কিন্তু কিবরিয়া ভাই যখন বলতেন, পার্লামেন্টে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করতেন কিংবা মৃদুভাষণে বসে বিভুরঞ্জন বা হাসান মামুনকে ব্রিফ করতেন, আমার কাছে খুব সহজবোধ্য মনে হতো।
মৃদুভাষণ বের করার সময় তিনি আমার ওপরই নির্ভর করলেন বেশি, বললেন- যাদের নেয়া হল, আপনিই তো তাদের ভালো করে চেনেন। আমি হয়তো কাজের মধ্য দিয়ে চিনব। তিনি অল্প দিনেই তাদের চিনলেন, তাদের যোগ্যতায় আস্থা রাখলেন। মৃদুভাষণ অফিসে এলে প্রায়ই আমাকে যেতে বলতেন। বিদেশে গেলে বলতেন, আপনি সব দেখবেন। নিজের চেয়ার দেখিয়ে বলতেন, আপনি এখানে বসবেন।
নিহত হওয়ার আগে কিবরিয়া ভাইয়ের শরীর ভালো যাচ্ছিল না। দেশে ও বিদেশে তার চিকিৎসা চলছিল। আমাদের উৎকণ্ঠা ছিল। আবারও নির্বাচনে দাঁড়ানোর দৃঢ় মনোভাব ছিল তার। আমি কিবরিয়া ভাইকে বলেছিলাম, নির্বাচন না করে ’৯৬ সালের মতো অর্থমন্ত্রী হতে পারেন। তিনি বলেছিলেন, ‘সরকার সাহেব, এমপি না হয়ে মন্ত্রী হলে অন্যেরা করুণার দৃষ্টিতে দেখে।’
দেশ নিয়ে, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার গভীর উৎকণ্ঠা ছিল। তিনি বলতেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় সংস্কার না হলে জনগণ চাইলেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যেতে পারবে না। হরতালে তার ব্যক্তিগত আপত্তি ছিল, তারপরও তিনি বলতেন- ওরা যা করছে তাতে হরতাল ছাড়া করবেনটা কী। বেগম জিয়ার সরকারকে তিনি বলতেন, ‘টেফ্লন সরকার’। বলতেন, এর গায়ে কোনো কিছুই যেন লাগছে না, সব পিছলে যাচ্ছে।
দেশে মৌলবাদী উত্থানের শংকা তার মনে ছিল পুরোপুরি। বলতেন, মোনায়েম সাহেব, আপনি তো গ্রামে যান না, তাই বুঝতে পারছেন না, ভেতরে ভেতরে কী সর্বনাশ হয়ে চলেছে। গ্রামগঞ্জে সন্ত্রাসী মৌলবাদীরা মসজিদ ও মাদ্রাসাভিত্তিক ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। ক্ষমতায় গেলেও আমরা এই নেতিবাচক পরিবর্তনের ধারা ঠেকাতে পারব কি না কে জানে। মাঝে মাঝে খুব হতাশও হয়ে পড়তেন। বলতেন, চলেন দেশ-টেশ ছেড়ে চলে যাই। ওরাই থাকুক এ দেশে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার জনসভায় বোমা হামলায় কিবরিয়া ভাইয়ের সতর্ক বাণীর কথা স্মরণ হয়েছিল।
কিন্তু তার কাজকর্মে হতাশার কোনো ছাপ দেখতাম না। দারুণ প্রত্যয়ী হয়ে তিনি লিখতেন, বক্তৃতা করতেন। হবিগঞ্জে জীবনের শেষ যে বক্তৃতা করেছেন, তাতেও রয়েছে সেই প্রত্যয়ী মনোভাব। ‘বাংলাদেশের সামাজিক বিবর্তন কি পশ্চাতমুখী?’ শিরোনামে তার শেষ যে অসমাপ্ত লেখাটি পাওয়া গেছে, তা পড়লে বোঝা যাবে তার উৎকণ্ঠা। দেশের মানুষও তো উৎকণ্ঠিত। মৃদুভাষণ লিখেছে- ‘উদ্বিগ্ন মানুষের পাশে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন। তাকে বেশিদিন দাঁড়িয়ে থাকতে দেয়া হল না।’
কিন্তু দেখতে তো পাচ্ছি, শামস কিবরিয়ার মৃত্যু গোটা জাতিকেই কাঁপিয়ে দিয়েছিল। বিদেশেও তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। তার মতো একজন সজ্জন মানুষকেও যদি এভাবে হত্যা করা হয়, তাহলে এ দেশে কে নিরাপদ? দেশের ভবিষ্যৎই বা কী? তার নৃশংস হত্যাকাণ্ডে উদ্বেলিত হয়েছে জাতি ও বিশ্ব জনমত। মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে নেমে এসেছে রাস্তায়। সরব প্রতিবাদও জানানো হয়েছে একের পর এক হরতাল করে। দেশের বিশিষ্টজনেরা নতুন করে নেমে এসেছিল প্রতিবাদে।
মেধাবী ছাত্র, রাষ্ট্রদূত, পররাষ্ট্র সচিব, অর্থনীতিবিদ, সাবেক অর্থমন্ত্রী এসব অভিধা ছাড়িয়ে তিনি একজন প্রাজ্ঞ দেশপ্রেমিক রাজনীতিক ও দার্শনিক হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। তাই মানুষের শোকে-অশ্র“তে মহীয়ান হয়ে উঠেছে কিবরিয়া ভাইয়ের আত্মদান। আমরা তার প্রিয়জনেরাও শোক ভুলে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হওয়ার অবকাশ পাচ্ছি যেন।
কিবরিয়া পরিবারের সদস্য, বিশেষ করে আসমা ভাবী, ড. রেজা ও ড. নাজলী শোককে শক্তিতে পরিণত করে দেশে-বিদেশে যে সাহসী প্রতিবাদী ভূমিকা রাখছেন- তা কিবরিয়া ভাইয়ের আপসহীন সংগ্রামী ভূমিকারই প্রতিফলন ঘটাচ্ছে। 

No comments:

Post a Comment