Thursday, April 4, 2013

২০ সেপ্টেম্বর ১৯৯৩ সংসদে বিএনপির দাবি ছিল-দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে ধর্মের নামে বাণিজ্য করা দল জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে


জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে সেদিন বিএনপির সংসদ সদস্যরা যা বলেছিলেন-

সাড়ে ষোল বছর আগে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বধীন বিরোধী দলের মূলতবী প্রস্তাবের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে বিএনপির সংসদ সদস্যরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন । মসজিদের ইমামতি নিয়ে তর্ক-বিতর্কের সামান্য ঘটনায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মধ্যরাতে শিবিরের তান্ডব ও নৃশংসভাবে ছাত্র হত্যার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে একই ভাষায় বক্তব্য দেন শাসক বিএপির সংসদ সদস্যরা। ১৯৯৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর সংসদে দাঁড়িয়ে তাদের দাবি ছিল-ধর্মের নামে বাণিজ্য করা দলটিকে আর বাড়তে দেয়া যায় না। দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। দেশের সেনাবাহিনীতে যেন কোনভাবে এ দলের অনুসারী ঢুকে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সুযোগ না পায় সেজন্য নাগরিক সনদের পাশাপাশি বিশেষ সনদ চালুরও দাবি জানান বিএনপির সংসদ সদস্যরা।
সেদিন এ ঘটনা নিয়ে বিরোধী দল ৩৩টি মূলতবী প্রস্তাবের নোটিশ দেয়। সংসদের ইতিহাসে এক ঘটনায় এত বেশি সংখ্যক মূলতবী নোটিশ দেয়ার ঘটনাও বিরল। মূলতবী প্রস্তাব হিসাবে বিরোধী দল প্রিভিলেজ চাইলেও সরকারী দল আলোচনায় অংশ নেয়ার দাবি জানালে আলোচনা শুরু হয় ৬২ ধারায়। সরকার ও বিরোধী দলের ক্রমাগত আক্রমনাত্বক বক্তব্যের এক পর্যায়ে জামায়াত নেতা মতিউর নিজামীসহ দলের অন্য সংসদ সদস্যরা সংসদের বৈঠক ত্যাগ করেন।
বিরোধী দলের পক্ষে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম প্রস্তাব তুলে ধরে বলেন ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুমন্ত ছাত্রদের ওপর নিশুতি রাতে জামাত-শিবিরের নারকীয় তান্ডবে নিহত জোবায়ের চৌধুরী রীমু হত্যাকান্ড এবং শতাধিক আহত ছাত্রদের আর্তনাদ বিষয়ক আলোচনা এবং দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দেয়ার উদ্দেশ্যে আইনগত ব্যবস্থা অবলম্বনের স্বার্থে অবিলম্বে সংসদ মূলতবী করা হোক’।
প্রস্তাব অনুযায়ী রাত ৮ টা ৩ মিনিটে সংসদের বৈঠক মূলতবী হয়ে যায়। আলোচনা শুরু হয় ৮ টা ২০ মিনিটে।
আলোচনা শুরু করে আওয়ামী লীগের অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ঘটনার বণর্না করে বলেন, গত ৪৮ ঘন্টার মধ্যে রাজশাহী মেডিক্যাল ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিমর্ম হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে। একাত্তরের মতো জামায়াত আজ দেশকে মেধাশুন্য করতে চায়।
বিএনপির আবদুল আলী মৃধা বলেন, আজকে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি জামায়াত শিবির রাতের অন্ধকারে যে নারকীয় ঘটনা ঘটিয়েছে সমস্ত জাতি তার জন্য উদ্বিগ্ন। আজকে এই রগ কাটার দল, গলা কাটার দল পাশের গ্রামে অস্ত্রেও ট্রেনিং করে। আমাদের সন্তান যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে তাদের লেখাপড়া শিখতে দিতে চাইছে না। তারা একাত্তরে পাকবাহিনীকে সহায়তা করে যেভাবে দেশের মানুষকে হরণ করেছিল, তা আবার ঘটাতে চাইছে। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দেশে যখন রাজনৈতিকভাবে উৎপাদন ও উন্নয়ন শুরু হয়েছে তখন বাংলাদেশকে একটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত করতে উদ্যোগ নিয়েছে জামাত-শিবির চক্র।
তৎকালীন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য বর্তমানে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মেজর (অব) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বলেন, জামাত-শিবিরের রাজনীতি একটি প্রগতি বিরোধী রাজনীতি। এদেশে তারা সাম্প্রদায়িকতার বিষ বাষ্প ছড়িয়ে আসছে। দিনের পর দিন প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা ছাত্রদের রগ কেটে অমানুষিক অত্যাচার করে হত্যা করছে। আজকে আমরা জানতে চাই, তাদের শক্তির উৎস কোথায়? দু’চারজন বাদে এ সংসদের প্রতিটি সদস্য, ট্রেজারী বেঞ্চের সদস্যরাও এ হত্যাকান্ডের বিচার চায়।
সংসদের হুইপ আশরাফ হোসেন বিরোধী দলকে কটাক্ষ করে বলেন, একযোগে শান্তি প্রতিষ্টায় যে সহায়তা করার কথা ছিল তাদের তা ত্রাা করেননি। জামায়াতে ইসলামী তার ছাত্র সংগঠনের নামে যে নারকীয় হত্যাকান্ড ঘটিয়ে চলেছে তা রোধে সহায়তা না করে অনেকে অবস্থাকে সংকটময় করার কাজে লিপ্ত ছিলেন।
তবে এর জবাবে পাল্টা আক্রমন করে জাতীয় পার্টির আবু লেইছ মোঃ মুবিন চৌধুরী বলেন, আজকে প্রশ্ন উঠছে সন্ত্রাস বন্ধের ব্যাপারে সরকারের কতটুকু আন্তরিকতা ছিল। আজকে তাদের নিজেদের ঘরে আগুন লেগেছে। জামাত-শিবিরের হাতে তাদের ঘরের ছেলেরা মার খাচ্ছে বলে তাদের মুখে জামাত-শিবিরের বিরুদ্ধে খই ফুটছে। যাদের সাহায্যে সরকার গঠন করেছেন তাদের বিরুদ্ধে আজ বাধ্য হয়ে কথা বলছেন।
বিএনপির আরেক সংসদ সদস্য শাজাহান ওমর জামায়াতের প্রতি বিষোদগার করে বলেন, আজকে আশ্চর্যের সঙ্গে দেখলাম যে, এ প্রস্তাব আনার সঙ্গে সঙ্গে মাননীয় সদস্য নিজামী সাহেবও দাঁড়িয়েছেন। তার মানে তিনি নিশ্চয় স্বীকার করছেন না যে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এ নারকীয় হত্যাকান্ড তাদের ছাত্র শিবির করেছে। এ অপকর্ম যদি শিবির না করে থাকে তাহলে তিনি যেন দাঁড়িয়ে বলেন যে ওরা ছাত্র শিবির নয়। তিনি বলুন যে, ওই ছাত্রদের ছাত্র শিবির হিসাবে গ্রহন করি না। তাঁর যদি সাহস থাকে, মনে বল থাকে, তিনি এই এখানে বলুন।
জাসদের সংসদ সদস্য পরে বিএনপিতে যোগদানকারী শাজাহান সিরাজ বলেন, আজ আমরা আর একটি মুর্হুতও দেশকে এভাবে চলতে দিতে পারি না। ছাত্রদলের নেতৃত্বে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত ছাত্ররা আজ এক হয়েছে। জামাত-শিবির ছাড়া সমস্ত রাজনৈতিক দল এক হয়েছে।
সংরক্ষিত নারী আসনের বিএনপির সংসদ সদস্য ফরিদা রহমান জামায়াত-শিবিরের কর্মসূচী সর্ম্পূনভাবে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে বলেন, ২২ বছরের রীমুকে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে। আমরা জানতাম, মানুষ গরু ছাগল জবাই করে। এখন জামাত-শিবির নামক একটি দল মানুষ জবাই করতে শুরু করেছে। আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ করব তিনি যেন ঠান্ডা মাথায় ধীরস্থিরভাবে এ সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তাহলে আমরা খুশি হব, জনগণ খুশি হবে এবং দেশে একটি নিরাপত্তা আসবে।
বিএনপির আবু ইউসুফ মোঃ খলিলুর রহমান বলেন, আজ এ সংসদে জামায়াতে ইসলামীর যেসব সংসদ সদস্য বন্ধুরা আছেন তাদের বিবেককে একটু জিজ্ঞাসা করতে চাই, ধরো, ধরো বিএনপি ধর, জবাই কর, এ সেøাগানটি ইসলামিক না অনৈসলামিক? মধ্যরাতে রাজশাহী বিশ্ববিদালয়ের দুইশ কামরায় অগ্নি সংযোগ করল, লুটপাট করল এগুলো কি ইসলামিক না অনৈসলামিক? আমি জিজ্ঞাসা করতে চাই, ঘুমন্ত অবস্থায় নিরীহ ছাত্রদের এক এক করে রগ কেটে দেয়া কি ইসলামিক না অনৈসলামিক? আপনাদের বিবেককে প্রশ্ন করুন বিভিন্ন পর্যায়ে ট্রেনিং দিয়ে, ক্যাডার তৈরি করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছেড়ে দিয়েছেন এটা কি মানবতার বিরোধী না মানবতার পক্ষে? তিনি বলেন, শিবির বহু মায়ের কোল খালি করে দিয়েছে। এ হাউজে আজ যে ঐক্যমতের সৃষ্টি হয়েছে সেই ঐক্যমতের দিকে লক্ষ্য রেখে অনতিবিলম্বে এ বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হোক।
বিএনপির সংসদ সদস্য আলমগীর কবির ধর্ম নিয়ে রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানান। তিনি বলেন, প্রয়োজনে এ মহান সংসদে বিল আনতে হবে। জামাত-শিবিরের নারকীয় হত্যাকান্ড শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নয়, সমগ্র রাজশাহীর আকাশ-বাতাস মোথিত হয়ে উঠছে। আমি থুথু নিক্ষেপ করে জামায়াতের সমালোচনা করব না। আমি গণতন্ত্রের ভাষায় ঘৃনা প্রকাশ করব, নিন্দা জানাব এবং আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের দিকে লক্ষ্য রেখে জামায়াতকে নিন্দা জানাব।
বিএনপির মেজর (অব) আখতারুজ্জামান বলেন, আমি বিরোধী দলের বন্ধুদের বলব, স্বাধীনতা বিরোধী মৌলবাদী চক্রকে রাজনীতিসহ সব জায়গায় নিষিদ্ধ করে প্রস্তাব আনেন। আপনাদের ভোট দিতে হলে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে হলেও আপনাদের ভোট দেব। আসুন আমরা আজ তাদের সঙ্গে আর এক কক্ষে না বসার অঙ্গীকার করি।
বিএনপির সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমি আজকে প্রস্তাব করতে চাই সামরিক বাহিনী, বিডিআর, পুলিশ, এনএস, আইডিএফআই সহ সকল বাহিনীতে নাগরিক সনদের পাশাপাশি আরও একটি সনদ যোগ করতে হবে। জামাত-শিবিরের কোন সদস্য এ বাহিনীতে যোগ দিতে পারবে না। তা না হলে বিশ বছর পর তারা এ বাহিনী দখল করে আবার এদেশের ক্ষমতা দখল করবে। একাত্তরে তারা যেভাবে এদেশের মানুষকে হত্যা করেছিল। সেই একই কায়দায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নেতাশুন্য করতে ঘুমন্ত ছাত্রদের ওপর আক্রমন করেছিল।
বিএনপির সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট খায়রুল এনাম জামায়াতকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে বলেন, জামায়াতের উদ্দেশ্য কি? কি কারণে তারা নিরীহ সাধারণ মানুষ বিশেষ করে ছাত্র সমাজের ওপর তান্ডব লীলা চালাচ্ছে?
বিরোধী দলের প্রতি আহবান জানিয়ে বিএনপির জিয়াউল হক বলেন, বিরোধী দলের বন্ধুদের বলতে চাই, আমাদেরকে জোর করে অপশক্তির সঙ্গে হাত মেলাতে বলবেন না। স্বাধীনতার স্বার্থে রাজনৈতিক স্বার্থে আপনাদের সঙ্গে ঐক্যমত পোষণ করি। আমাদেরকে জোর করে জামায়াতের সঙ্গে ঠেলে দেবেন না।
হুইপ শাজাহান মিয়া বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে জামায়াত শিবির যে নারকীয় ঘটনা ঘটিয়েছে তা বণর্না করার ভাষা আমার জানা নেই। জামাত-শিবির সীমা লংঘন করছে। তারা একাত্তরের নারকীয় ঘটনা আবার ঘটাতে চায়। আজ কোন গোষ্ঠী বিশেষ নয় আমাদের সবাইকে রাজনৈতিকভাবে সামাজিকভাবে এ জামাত-শিবিরকে দাঁত ভাঙ্গা জবাব দেয়ার সুযোগ এসেছে।
সব শেষে রাত সোয়া ১২ টায় সংসদ উপনেতা ডাঃ বদরুদোজ্জা চৌধুরী বলেন,উভয় তরফের বক্তব্য খুব কাছাকাছি ছিল। আমি দুঃখিত যে জামায়াতে ইসলামীর সদস্যরা এখানে নেই। তাদের এখানে থাকা উচিত ছিল এবং তাদের বক্তব্য কি ছিল সেটা জানতে পারলে আমাদের আরও সুবিধা হত। আমরা তাদের বক্তব্য খন্ডন করতে পারতাম। তিনি বলেন, ঘুমন্ত ছাত্রদের ওপর রাজনৈতি বিশ্বাসের অজুহাতে ধর্মকে বর্ম হিসাবে ব্যবহার করে যে বর্বর হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে তা পৈশাচিক। এটা ইসলাম ধর্মের মূলনীতির বিরুদ্ধে। সবচেয়ে বড় কথা বিবেক বিরোধী। এ হত্যাকান্ডে সমস্ত জাতি স্তম্ভিত। রগ কাটা, হাত কাটা, জবাই করা এটা কি ধরনের রাজনীতি? স্বাধীন দেশে এটা চলতে দেয়া যায় না।
তিনি বলেন, জামাত-শিবিরের রাজনীতি বন্ধের প্রস্তাব সংবিধান দিয়ে ভাল করে পরীক্ষা করার অবকাশ আছে। জনগণের ইচ্ছার প্রতিধ্বণি করে সংসদ এ ব্যাপারে দৃঢ় ঘোষণা দেবে এবং সরকার দৃঢ় পদক্ষেপ নেবে।

No comments:

Post a Comment