Saturday, September 7, 2013

আমাদের বিবেকভ্রষ্ট বুদ্ধিজীবি-দেলোয়ার হোসেন



অতীতের কথা বাদ দিলাম । বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকারের গৃহীত কোন ইতিবাচক পদক্ষেপ , আহ্বান , অনুরোধকে বিএনপি কখনও শুধু পাত্তাই দেয়নি , উপরন্তু তাকে সব সময় বাকা চোখেই দেখে আসছে এবং সেসব ক্ষেত্রে কোমর বেঁধে তীব্র সমালোচনায় অবতীর্ণ হয়েছে । উদাহরণ হিসেবে সংবিধান সংশোধন, নির্বাচন কমিশন সংস্কার সহ গুরুত্বপূর্ণ অসংখ্য বিষয় রয়েছে । আওয়ামীলীগ যেখানেই হাত দেয় বিএনপি সেখানেই ষড়যন্ত্র, দুরভিসনধের গন্ধ খুঁজে পায় এবং আমলে নেয়ার অনুপোযুক্ত ও অচ্ছুত বলেই উপস্থাপিত বিষয়গুলোকে স্বভাব সুলভ নিয়মে কালিমালিপ্ত করে বসে । অর্থাৎ আওয়ামীলীগের কোন কিছুই ভাল না । এমনকি যে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে, সেটাও তারা স্বীকার করে না , স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকেও কোন ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে মুল্যায়ন করে না । তারা বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে জিয়াকেই স্বাধীনতার প্রধান পুরুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেস্টায় নিরন্তর লিপ্ত থেকে বঙ্গবন্ধুর শাহাদত বরনের দিবসে পৈশাচিক জন্মোৎসব পালন করে সহজাত ঘৃণা ও তীব্র প্রতিহিংসার বহিপ্রকাশ ঘটিয়ে আসছে দীর্ঘকাল থেকেই । সুতরাং শত্রুর অবস্থানে থেকে মনে প্রাণে জিঘাংসায় ব্রতী হলে প্রতিপক্ষের কোন কিছুকেই ইতিবাচক বলে গ্রহণ করা যায় না । তাই বলা হয়, যারে দেখতে নারি , তার চলন বাঁকা । ঠিক একই অবস্থানে রয়েছে আমাদের বাংলাদেশের তথাকথিত সুশীল সমাজ । তারাও আওয়ামীলীগের কোন ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের প্রশংসা তো দূরে থাক, ফাঁকফোকর খুজে বের করে দলটিকে সর্বদাই আসামীর কাঠগড়ায় দাড় করাতে যেন সিদ্ধহস্ত। বিএনপির কলংকময় অতীত , নজিরবিহীন অপকর্ম নিয়ে তারা মোটেও টু শব্দটিও করেন না। শুধু কি তাই স্বাধীনতা কিংবা বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গ এলে জাতির পিতার সম্বোধন দূরে থাক, এই বুদ্ধিজীবিদের অনেকেই বঙ্গবন্ধু নামটি মুখে উচ্চারন করতে কুন্ঠা বোধ এবং শেখ মুজিব সম্বোধনেই বেশি স্বস্তি বোধ করেন । তাদের ভয় থাকে একটাই যাতে গায়ে বিশেষ শিবিরের সিল না লেগে যায় । এছাড়া আওয়ামীলীগ বা সরকারের সমালোচনা এবং বিরোধী দলের অযৌক্তিক দাবির পক্ষে দ্রুত অবস্থান নিয়ে একজোট হয়ে সর্বত্র কথা বলে জনমতকে প্রভাবিত করার এদের একটা অপচেস্টা এখন মোটা দাগে চোখে পড়ার মত একটি নৈমিত্তিক বিষয় বা রুটিন ওয়ার্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে । যদি দুই নেত্রীর মধ্যে সংলাপ অনুষ্ঠান এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল প্রসঙ্গে আলোকপাত করি তাহলে দেখা যাবে, হাজার মুনীর হাজার মত । তবে সব শেয়ালের এক রা এর মতই মুল কথা একটাই, বিরোধী দলের দাবিটিই যৌক্তিক । এ প্রসঙ্গে সংলাপ বিষয়ে একটি উদাহরন দেই । কদিন আগে চ্যানেল আই এ টক শো তৃতীয় মাত্রা দেখছিলাম। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের একজন শিক্ষক, এক সময় যে বিভাগের ছাত্র আমি নিজেও ছিলাম তাই, যাকে নিয়ে গর্ব বোধ করছিলাম , সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যাই বলি তার একটি মন্তব্য বা মুল্যায়নে আমি এতটাই হতাশ হই যে এই ধরনের বুদ্ধিজীবিদের কথা শোনার আগ্রহ এখন একেবারেই হারিয়ে ফেলেছি । দুই নেত্রীর সংলাপ প্রসঙ্গে তিনি বলছিলেন, যেহেতু খালেদা জিয়াকে তার বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে তাই তার মনের ভেতর ক্ষোভ এবং প্রতিহিংসা তুষের আগুনের মত জ্বলছে এবং তা সহজে নেভার মত নয় । আর অপরদিকে ২১ শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার মত ঘটনাটি শেখ হাসিনারও সহজে ভোলার কথা নয় । তাই দুই নেত্রীর মুখ দেখাদেখি এবং সংলাপ অনুষ্ঠানের প্রধাণ বাধাই হলো এটি । আমি আশ্চর্য হলাম ! কি চমৎকার সরলিকরন ! কি অদ্ভুত সমীকরন এইসব নমস্য বুদ্ধিজীবিদের । যে নেত্রী প্রতিপক্ষ নির্মূলে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ তার পার্টির জন্মলগ্ন থেকেই। জাতির জনকের হত্যার সাথে যে দলের পূর্বসূরী কান্ডারী ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং খুনীদের করেছে পুরস্কৃত এবং যে দল সেই খুনীচক্র এবং স্বাধীনতা বিরোধী, যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব , গনতন্ত্র ও মানবাধিকারের বিপক্ষে তৎপর থেকে জাতির সব অর্জনগুলোকে নস্যাত করার কাজে লিপ্ত – সেই বিষয়গুলো তার বিবেচনা এবং মুল্যায়নে স্থান পায়নি এতটুকু । বিবেচনায় আসেনি এই দলের ঐতিহাসিক সুমহান কীর্তি এবং বর্তমানের যুগান্তকারী ইতিবাচক অর্জন ও তার সহনশীল রাজনীতি যার উল্টো পথে সব সময় চলেছে বিএনপি । বিএনপির এসব সুকীর্তির কথা তারা কখনই উল্লেখ করেন না । যত দোষ নন্দঘোষ, তার জন্যে প্রকৃষ্ট উদাহরণ একমাত্র আওয়ামীলীগই । কেবল মাত্র বাড়ি উচ্ছেদের ঘটনা দিয়েই বিএনপি নামক দলটির সকল পৈশাচিক অপকর্ম জায়েজ করে দিলেন এই বুদ্ধিজীবি তার মুল্যায়নে ! পাড়া-গ্রামে একটা প্রবচন আছে, কিসের মধ্যে কি পান্তা ভাতে ঘি । এই বুদ্ধিজীবির মূল্যায়নটাও হয়েছে ঠিক তেমনই।

এবার আসা যাক নির্বাচন প্রসঙ্গে । এই গুণী শিক্ষকের রয়েছে দেশে-বিদেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করার একটি এনজিও সংস্থা । যিনি এ বিষয়ে একজন এক্সপার্ট । এ পর্যন্ত বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের আমলে যতগুলো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তার সিংহ ভাগ ক্ষেত্রেই বিরোধীদল বিএনপিই জয়লাভ করেছে। সর্বশেষ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে—যেখানে তারা শতভাগ সাফল্য অর্জন করেছে সেক্ষেত্রে এবং এর আগের প্রতিটি নির্বাচনে দেখা গেছে বিএনপি তার স্বভাবসুলভ বিকৃত মিথ্যাচার করে বলেছে, ব্যাপক কারচুপির নির্বাচনের নীল নকশা সরকার আগে থেকেই করে রেখেছে। ফলাফলও সরকার নির্ধারণ করে রেখেছে । কিন্তু বিএনপির সুরের সাথে সুর মিলিয়ে তথাকথিত সুশীল সমাজও পক্ষপাতমূলক নেতিবাচক পূর্বাভাস ব্যক্ত করেছিল এবং সেনাবাহিনী মোতায়েন না করার বিষয়ে উভয় পক্ষ (বিএনপি এবং সুশীল) একযোগে যে মনগড়া আশংকা প্রচার করছিল তার কোনোটাই সত্য বলে প্রমাণিত হয়নি । এমনকি জয়লাভের পরেও বিএনপি তার বদ খাসলত অনুযায়ী বার বারই বলেছে সরকার ব্যাপক কারচুপি করেও বিএনপির বিজয় ঠেকাতে পারেনি । সঙ্গত ভাবেই প্রশ্ন আসে , এইসব নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সুশীলবেশধারী বুদ্ধিজীবি এবং গায়ে সিলমারা শ্রেনীবদ্ধ সুশীলরা একবারও ভুল করে বলছেন না , বিএনপির আমলে বিপন্ন হওয়া প্রশাসন এবং সকল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে (যেমন, নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ) সাংবিধানিক নিয়ম- শৃঙ্খলার প্রবর্তন এবং সেগুলোকে পরিপূর্ণরূপে কার্যকর এবং শক্তিশালীভাবে গড়ে তোলার যে কাজ ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার করে যাচ্ছে তার ইতিবাচক ফল ও সুদুরপ্রসারী প্রভাবের কথা । এখনও তারা বিএনপির দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি পুনর্বহালের পক্ষেই তুলছেন সোচ্চার আওয়াজ । অথচ এই বিএনপিই নজিরবিহীন অপকর্মের মধ্য দিয়ে ধ্বংস ও কালিমালিপ্ত করেছিল এই ব্যবস্থাকে । এটা বেমালুম ভুলে গিয়ে আবারও সেই অগণতান্ত্রিক ও পরিত্যক্ত ব্যবস্থাকেই পুনর্বহালের জন্যে প্রাণপাত করছেন আমাদের সুশীল গণতন্ত্রীরা । এই লেখা যখন লিখছি তখন টিভির খবরে ড, কামাল হোসেনের দাবি শুনছি , আরো দুই টার্মের জন্যে এই ব্যবস্থা বহাল রাখতে হবে । কি অদ্ভুত আমাদের পরম পুজনীয় সংবিধানের জন্মদাতা গণতন্ত্রীদের কথা । মুখেই গণতন্ত্রের কথা, আবার চিরাচরিত গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থা মোতাবেক দেশ পরিচালনার নিয়ম প্রবর্তনে তাদের বিরোধিতা । সত্যিই সেলুকাস ! বিচিত্র এ দেশ, বিচিত্র তার বুদ্ধিজীবি ।

এখন আসি শেষ কথায় । ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকার যদি শেষমেশ বিরোধী পক্ষের তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি মেনেও নেয় , সেক্ষেত্রেও মানি না, মানবো না রোগে আক্রান্ত বিএনপি বাধিয়ে বসবে আরেক ফ্যাকরা । তারা বহু আগেই ঘোষণা দিয়েছে , তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধাণ যিনি হবেন বা নিয়ম অনুযায়ী সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি খায়রুল হকের হবার কথা, তাকে তারা মানবেন না । কারণ তিনি নাকি আওয়ামীলীগের ঘুষ খাওয়া লোক । অর্থাৎ আওয়ামী ঘরানার আজ্ঞাবাহী লোক । বদ স্বভাবি বিএনপির এই অপবাদে সম্মানহানি বোধ করে বিচারপতি খায়রুল হক অবসরে যাবার আগেই স্বগতচিত্তে ঘোষণা দিয়ে বলেছেন তার তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধাণ হবার কোনো খায়েশ কখনই ছিল না এবং সুযোগ এলেও তা তিনি গ্রহণ করবেন না । যিনি নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের রায় দিয়ে গেছেন । সুতরাং আওয়ামীলীগের জন্যে বিএনপি হয়েছে শাঁখের করাত । যাইতেও কাটে, আসতেও কাটে । অতএব উপায় নেই । শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামীলীগ নির্ধারিত নিজস্ব অবস্থানেই অনড় থাকুক । সারা বিশ্ব দেখুক বাংলাদেশে আওয়ামীলীগ দলীয় সরকারের অধীনে সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য , সুষ্ঠু , শান্তিপূর্ণ ও অবাধ একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব । যা সবার কাছেই হবে একটি উল্লেখযোগ্য অনুকরনীয় দৃষ্টান্ত ।

স্টকহোল্ম, ২০১৩, ০৯,০৭

Thursday, September 5, 2013

দুই দেশের নিরাপত্তা এবং জনস্বার্থেই ছিটমহল বিনিময় : ভারতের গণমাধ্যম সোচ্চার:সুমি খান



৫১ হাজার ৫৪৯ জন ‘নাই’ দেশের নাগরিক ছিটমহলবাসী। এরা প্রত্যেকে তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্নে বিশ্ববাসী এক। মঙ্গলবার রাতে এনডিটিভি তে একটি টক শো তে উঠে আসে বাংলাদেশের সাথে ছিটমহল বিনিময় চুক্তির বাস্তবায়ন এবং তিস্তা চুক্তি ।প্রশ্ন তোলা হয়, রাজনৈতিক হঠকারীতার কাছে খারতের পররাষ্ট্রনীতি নতজানু কিনা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে ১৯৭৫ সালে হত্যা করার কারণে ১৯৭৪ সালের ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি। কারণ তৎকালীন সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময়কার আর্দশ থেকে সরে গিয়েছিল। এই ব্যবস্থা অনেকদিন চলেছে। ছিটমহলে পাকিস্তান আমলে ১৯৫১ ও ১৯৬১ সালে জনগণনা করা হয়েছিলো। এর দীর্ঘদিন পর মনমোহন- হাসিনার ২০১১ সালের চুক্তি ছিটবাসীদের আশাবাদী করেছে।
এই নিরীহ মানুষগুলোর জন্যে ও কথা বলতে হবে বাংলাদেশ এবং ভারতের সচেতন নাগরিকদের। সার্বিক ভাবে স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা প্রশ্নে এদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি এবং নিরাপত্তাহীনতা ভারত বাংলাদেশ দুই দেশকেই চরম হুমকির মুখে রেখেছে। এই বাস্তবতা দুই দেশের নীতিনির্ধারক এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে বুঝতে হবে।
ভারতের ভূখণ্ডে বাংলাদেশের ছিটমহলবাসী বাংলাদেশের নাগরিক হলেও বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে কোনো সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না । নেই তাঁদের ভোটার পরিচয়পত্র।একই চিত্র বাংলাদেশে থাকা ভারতের ছিটমহলেও। ছিটমহলবাসীর পরগাছা হিসেবে নিজেদের নাম-পরিচয় লুকিয়ে বাস করতে হচ্ছে ।
ভারতীয় ছিটমহল বা বাংলাদেশের ছিটমহলের প্রকৃত বসবাসকারীরা এখন আর নেই। বাংলাদেশি ছিটমহলে ভারতীয় আর ভারতীয় ছিটমহলে বাংলাদেশিরাই বর্তমানে বসবাস করেন। এটি একটি জটিল সমস্যা। ছিটমহল বিনিময় হলে ভারতের ১০ হাজার একর জমি বাংলাদেশকে দিয়ে দিতে হবে। ভারতের সংবিধান অনুসারে জমি নেয়া যেতে পারে কিন্তু দেওয়া যায় না। এর জন্য সংবিধান সংশোধন করতে হবে। এখানেই তৃণমূল নেত্রী মমতা এবং ভারতীয় উগ্র মৌলবাদী সংগঠন বিজেপির আপত্তি।
বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ভারতে এবং ভারতের ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশে রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার ও জলপাইগুড়ি জেলার ভারত ভূখণ্ডে রয়েছে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল। এর মধ্যে ৪৮টি কোচবিহার জেলায়। অন্যদিকে, বাংলাদেশের ভূখণ্ডে রয়েছে ভারতের ১১১টি ছিটমহল। ১৯১১ সালের ১৪ থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত অনুষ্ঠিত উভয় দেশের যৌথ আদমশুমারী অনুযায়ী, ভারতের ভূখণ্ডে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলে রয়েছে ১৪ হাজার ২১৫ জন নাগরিক বাস করছেন। অন্যদিকে, বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ভারতের ১১১টি ছিটমহলে রয়েছে ৩৭ হাজার ৩৩৪ জন ভারতীয় নাগরিক ( নাগরিকত্ব না থাকলেও জন্মসূত্রে নাগরিক)।
আইন মোতাবেক ভারতের ভূখণ্ডে বসবাসকারী ৫১টি ছিটমহলের বাসিন্দা বাংলাদেশি আর বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ১১১টি ছিটমহলে বসবাসকারীরা ভারতীয় । ভারত-বাংলাদেশ –দুই দেশের নিরাপত্তা এবং জনস্বার্থেই ছিটমহল বাসীর নাগরিকত্ব দেবার সময় এসেছে।
আর কতোকাল প্রতিহিংসার রাজনীতির বলি হতে হবে নিরীহ মানুষকে? ছিটমহলের ‘নাইদেশের নাগরিক’দের মানবেতর জীবনের জন্যে দায়ী রাজনীতিকদের আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর সময় এসে গেছে। ছিটমহল বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক অধিকারকে সুরক্ষিত করা এবং তাঁদের নাগরিকত্ব প্রদানের দাবিতে বিশিষ্ট আইনজীবী অনির্বাণ দাস কোলকাতা হাইকোর্টে গত সোমবার ২ সেপ্টেম্বর ২০১৩ একটি জনস্বার্থ মামলা করেছেন ।
বাংলাদেশ সরকার ও ভারত সরকার ছিটমহল বিনিময়ের জন্য চুক্তি সম্পাদন করতে রাজি থাকলেও বাদ সাধেন ভারতের আসাম রাজ্যের দুই বিজেপি সাংসদ আর পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস। তৃণমূল নেত্রী মমতার দাবি , এই চুক্তিতে পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ ক্ষুন্ন হবে।‘নিজেদের স্বার্থ’ বিসর্জন (?) দিয়ে কোনো বিনিময় চুক্তি হতে দেবেন না তিনি।মুখ থুবড়ে পড়ে ছিটমহল বিনিময়-প্রক্রিয়া।এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ছিটমহলজুড়ে। ছিটমহল বিনিময়ের দাবি আরো জোরালো হয়ে ওঠে ।
মমতা কদিন আগে হঠাৎ বলেন, “ছিটমহলবাসী চাইলে ছিটমহল বিনিময় হবে”। অথচ ১৯৯৪ সাল থেকে ছিটমহল বিনিময়ের দাবিতে ভারত ও বাংলাদেশের ছিটমহলবাসী অবস্থান ধর্মঘট ও অনশন সহ নানান আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। মমতা এসব না জানার ভান করলেন। মমতার এই বক্তব্যকে খণ্ডন করেছেন ছিটমহলবাসী।ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সহসম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত আমাকে বলেছেন, ‘ছিটমহল বিনিময়ের দাবিতে দুই দেশেই আন্দোলন করছি। আমরা চাইছি, ছিটমহলবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি ছিটমহল বিনিময় হোক। এতে ছিটমহলের বাসিন্দারা একটি নির্দিষ্ট দেশের নাগরিক হয়ে বাস করতে পারবে। এটা তাদের মৌলিক অধিকার ।’
সম্প্রতি ছিটমহল বিনিময়ের লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধনী বিল ভারতের আইনসভার উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় পেশ করতে দেয়া হয় নি। তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপি র আসামের দুই সাংসদ আপত্তি করেছে।বিলটি লোকসভায় উথ্থাপন করা যায়নি। এতে ক্ষুব্ধ হয় ছিটমহলবাসী। জ্বলছে তাঁদের মনে ক্ষোভের আগুন। তাঁরা ক্ষুব্ধ হন মমতার বিরুদ্ধে।
ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সহসম্পাদক জানান, ছিটমহল বিনিময়ের লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধনী বিল যদি সংসদে না ওঠে, তবে তাঁরা মাঠে-ময়দানে লড়াইয়ের পাশাপাশি আইনি লড়াইয়ের পথে যাবেন। মামলা করবেন উচ্চ আদালতে।
নাগরিকত্ব না থাকার কারণে ছিটমহলের মেয়েদের বিয়ে হয় না। কোনো সন্তানসম্ভবা মা তার সন্তানের জন্ম দেওয়ার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেন না। শিশুদের টিকাদান কর্মসূচি নেই। এ কারণে এক ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে এই বাসিন্দারা যা এড়াতে পারে না দু’দেশ ।
এই ছিটমহল বিনিময় না হওয়ার ফলে দুদেশের সরকার যে রাজস্ব বা বিভিন্ন প্রকারের কর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তার হিসেব কে করবে? এই সুযোগে একদল অসাধু লোক ছিটের বাইরের লোকেদের সাহায্যে ভয় দেখিয়ে জোর করে নামমাত্র মূল্যে ছিটমহলের নামে স্ট্যাম্প পেপার তৈরি করে জমি -বাড়ি রেজিস্ট্রি করাচ্ছে। এই খবর প্রথম বাংলানিউজে প্রকাশ হবার পর ছিটমহলের নিরীহ বাসিন্দাদের বাড়িতে সন্ত্রাসীরা আগুন লাগিয়ে দেয়।
আগেই বলেছি, নাগরিকত্বের কোনো প্রমাণ নেই বলে বাংলাদেশের নাগরিকেরা থাকছেন ভারতের ছিটমহলে ।পরদেশে পরগাছা হিসেবে বাস করছেন তারা । ছিটমহলের ঠিকানা বদলিয়ে ভারতের কোনো ঠিকানা ব্যবহার করে ছেলেমেয়েদের ভারতীয় বিদ্যালয়ে ভর্তি করছেন,দিনমজুরের কাজ করতে হচ্ছে । ভারতের এলাকায় ভুয়া ঠিকানা দিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন ।সন্তান প্রসবের সময় মায়েদের হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে ভারতের ঠিকানা দিয়ে ।
এমন ই মানবেতর জীবন যাপন করছে ছিটমহলের নিরীহ মানুষ গুলো। এই মানবেতর জীবনযাপন থেকে মুক্তি চান তারা। বাস করতে চান একটি নির্দিষ্ট দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে। সুযোগ-সুবিধাও চান সেই দেশের।বাংলাদেশ তাঁদের গ্রহণ না করলে তাঁরা ভারতের মাটিতেই থাকতে চান। তাই তাঁরা ছিটমহল বিনিময়ের দাবি তুলেছেন ।
আমার বিশ্বাস ,মানবতার প্রতি সম্মান করে যে কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ এই দাবির সাথে একাত্মতা জানাবেন। কারণ, ২০১৩ সালে এসে বিশ্বের কোন প্রান্তে রাষ্ট্রবিহীন নাগরিক থাকবে-এটা মেনে নেয়া যায় না।
ছিটমহল বিনিময়ের অযৌক্তিক বিরোধিতা ছিটমহলবাসীর জটিল সংকট নিরসনের প্রতিবন্ধক ।তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ ঠেকিয়ে দেবার কারণে মমতা-বিজেপি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে স্বাভাবিকভাবেই ছিটমহলবাসী ক্ষুব্ধ ।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ছিটমহল বিনিময়ে দুই দেশ রাজি হলে ছিটমহল বিনিময়ের কয়েক দশকের আন্দোলন সফলতার পথ উন্মুক্ত হয়। সেই সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় ছিটমহল বিনিময় চুক্তি সম্পাদনের উদ্যোগ নেয় উভয় দেশ। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হবার আমন্ত্রণ জানানো হয় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সফরের তিনদিন আগে মমতা হঠাৎ বাংলাদেশ সফর বাতিল করেন । আপত্তি তোলেন ছিটমহল বিনিময়ের বিরুদ্ধে। স্থগিত হয়ে যায় ছিটমহল বিনিময়ের প্রক্রিয়া।
তবে স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়, যাতে দুই দেশের মধ্যে ১৬২টি ছিটমহল বিনিময় এবং ছয় দশমিক এক কিলোমিটার অমীমাংসিত সীমানা চিহ্নিত হওয়ার কথা রয়েছে।
তবু তখন ছিটমহল বিনিময় নিয়ে উভয় দেশের মধ্যে একটি প্রোটোকল স্বাক্ষরিত হয়।
সম্প্রতি একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে জানা যায়, দৈর্ঘ্যে তিন কিলোমিটার আর প্রস্থে পৌনে তিন কিলোমিটার ভারতের বাত্রিগাছ ছিটমহল। এখানে বাংলাদেশের অন্তত ৫০০টি পরিবার বাস করে। ছিটমহলবাসী আজাদ হোসেন, জয়নাল মিয়া, মোহাম্মদ আলী, বকুল মিয়া ও কল্পনাথ রায় হতাশ , ক্ষুব্ধ স্বরে সাংবাদিকদের বলেছেন, “লুকোচুরি খেলে তো জীবনটা শেষ হয়ে গেল। এভাবে আর বাঁচা যায় না।এবার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে তাঁদের বেঁচে থাকার জন্য দিতে হবে ছিটমহল বিনিময়ের সুযোগ”। হচ্ছে না। এবার এই মানবেতর জীবনযাপন থেকে মুক্তি চাইছেন তারা। আকুল আবেদন করেছেন ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে। তারা যেন ছিটমহল বিনিময়ের দাবির পাশে এসে দাঁড়ান।
তিনবিঘা করিডোরে চুক্তির সময় বলা হয়েছিল এবার ছিটমহল বিনিময় হবে। আইনি জটিলতার কারণে কখনো তা বাস্তবায়িত হয়নি।২০১০ সালে ভারতের জনগণনার সময় কোচবিহারের জেলাশাসক বলেছিলেন আমার জেলায় গণনা করতে গেলে বাংলাদেশ সরকারের সাহায্য লাগবে। কারণ বাংলাদেশী ছিটমহল এই জেলায় রয়েছে। তাদের প্রশ্ন তাহলে এই এলাকায় ভারতের সার্বভৌমত্ব কোথায় আছে? ছিটমহলবাসী প্রশ্ন তুলেন, গোয়া, সিকিম যদি ভারতের অর্ন্তভুক্ত হতে পারে তাহলে কেন ছিটমহল বিনিময় হচ্ছে না?
বাংলাদেশ এবং ভারত সরকার কে বিস্তারিত সর্বশেষ তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। সঠিক ভাবে জানতে হবে ছিটমহলের বাসিন্দারা কে কোথায় যেতে চান।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, ছিটমহলগুলো ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন মাদক পাচারের কেন্দ্র । সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ, কোচবিহার জেলার বাংলাদেশি ছিটমহলে প্রায় ১৬ কোটি রুপির গাঁজা নষ্ট করা হয়েছে ২০১২ সালে। জেলাপ্রশাসক সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, উদ্ধারকৃত গাঁজার অর্ধেক নষ্ট করা যায়নি। কেন সেসব রেখে দেয়া হয়েছে-বা কোথায় সেসব –তা বিস্তারিত আসেনি কোন সংবাদমাধ্যমে।
বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় ছিটমহলগুলোতে ৩৭ হাজার ৩২৯ জন বাস করেন। ছিটমহল বিনিময়ের পরে তার মধ্যে মাত্র ৭৪৩ জন ভারতে আসতে চান -এটা জরিপের তথ্য। ২০১২ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিটমহল সংক্রান্ত এক আলোচনা সভায় মনসুর আলি মিঞা বলেন, “আমি আজ যেভাবে এখানে এসেছি, তা রাষ্ট্রের ভাষায় অবৈধ। কারণ আমি খাতা-কলমে বাংলাদেশের বাসিন্দা। কিন্তু আমার বাংলাদেশের কোনো পরিচয়পত্র নেই। আমার জন্ম ব্রিটিশ ভারতে। বাংলাদেশে গিয়ে আমি শরণার্থী হতে চাই না। আমি জন্মেছি ভারতে। ভারতেই মরতে চাই। একই ভাবে বাংলাদেশের ভেতরে ছিটের বাসিন্দারাও তাই চান। একজন মুসলিম হয়ে আমার ইচ্ছা ছিল হজ্বে যাওয়া। সেই অধিকার আমার নেই ।” তিনি প্রশ্ন করেন, “আমার মতো অনেকেই হজ্বে যাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা কি মানবাধিকার হরণের মধ্যে পড়ে না?”
৩ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার রাতে এনডিটিভিতে সম্প্রচারিত এক মুক্ত আলোচনায় বিজেপির মুখপাত্র তরুণ বিজয় স্বীকার করেন, ভারতের ‘জাতীয় স্বার্থেই’ বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন প্রয়োজন।বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবে ভারতীয় পার্লামেন্টের বিরোধী দল বিজেপি তাদের শক্ত অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসেছে মনে হচ্ছে।যদিও তৃণমূল কংগ্রেস ও আসাম গণ পরিষদ এখনো বিরোধিতা করে যাচ্ছে।
এই চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হলে ভারতের সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন। কিন্তু এর জন্য পার্লামেন্টে বিল পাস করতে হলে রাজ্যসভা ও লোকসভায় দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন দরকার, যা কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোট সরকারের নেই।
কেন্দ্রীয় সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ তিন দফা বিল তোলার উদ্যোগ নিলেও দুইবার বিজেপি ও আসাম গণ পরিষদ এবং একবার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের দল তৃণমূল কংগ্রেসের বিরোধিতায় তা সম্ভব হয়নি। মমতার ভূমিকা জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ভ্রান্তি হিসেবে উল্লেখ করে মমতা বন্দোপাধ্যায় এবং তৃণমূলের তীব্র সমালোচনা করা হয় এই টক শো তে।
টিভি টক শোতে বিজয় বলেন, শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন বর্তমান বাংলাদেশ সরকার নিরাপত্তা নিয়ে ভারতের উদ্বেগ প্রশমনে সাড়া দিয়েছেন। এখন বাংলাদেশের মানুষকে ‘সঠিক বার্তাটি’ পৌঁছে দিতে’ ভারতেরও উচিৎ ছিটমহল বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়নের পাশাপাশি তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিতে সই করা।
পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম বিজেপির সাধারণ সম্পাদক বরুণ গান্ধীও গত মাসে টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের পক্ষে মত দেন।
তবে এনডিটিভির টক শোতে বিজয় আবারো বলেছেন, মনমোহন সিং নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের উচিৎ ছিল, বাংলাদেশের সঙ্গে স্থল সীমান্ত চুক্তি করার আগে বিরোধী দলের মতামত নেয়া। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা এ চুক্তির বিষয়ে যে উদ্বেগের কথা বলে আসছেন, তাও কেন্দ্র সরকারের আমলে নেয়া উচিৎ বলে মনে করেন এই বিজেপি নেতা।তবে তৃণমূল সাংসদ স্বাগত রায় এই চুক্তির চরম বিরোধিতা করে এই চুক্তির পক্ষাবলম্বীদের সমালোচনা করেন। এই টক শোতে তিনি দাবি করেন এই চুক্তি হলে ভারত ছিটমহলের ১১ হাজার একর জমি হারাবে। এটা কোনভাবেই হতে দেয়া যায় না। একই সাথে তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় শেখ হাসিনা কে আবারো নির্বাচিত করার জন্যে অনেকে এই চুক্তি করতে চায়, যা ভারতের দায়িত্ব নয়। তার মতে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় যেই আসুক- তাদের সঙ্গেই দর কষাকষির জন্য প্রস্তুত হতে হবে ভারতকে।
কংগ্রেসের মন্ত্রী শশী থারুর ও বাংলাদেশে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত বীণা সিক্রি এ চুক্তি বাস্তবায়নে ভারতে জনমত গড়ে তোলার পক্ষে জোরালো মত দেন।শশী থারুর বলেন, “ঢাকা আমাদের বড় বন্ধু। এখন আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতি অঙ্গীকার রাখতে না পারলে তা হবে একটি বিপর্যয়।”
বীণা সিক্রি বলেন, “ অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ ভারতের প্রতিবেশী। ভারত যদি বিশ্বের কাছে গুরুত্ব আশা করে, তাহলে কোনো দেশের সঙ্গে করা চুক্তি বাস্তবায়নের সামর্থ্য তার থাকা উচিৎ।”স্থল সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন করতে গেলে পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম ভূমি হারাবে বলে যে অভিযোগ তৃণমূল ও আসাম গণ পরিষদ করে আসছে, তাও নাকচ করেন সাবেক এই রাষ্ট্রদূত।
শশী থারুর ও বীণা সিক্রির সঙ্গে একমত পোষণ করে প্রবীণ সাংবাদিক সুবীর ভৌমিক বলেন, পররাষ্ট্রনীতি যদি পাকিস্তানের মতো রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয়-সেটা ভয়ংকর বিপর্যয়। ভারতের ভবিষ্যত এর পূর্ব সীমান্তের নিরাপত্তা ও প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে যোগযোগের ওপর অনেকটা জড়িত। আর এ দুটো ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকার সহযোগিতা দিয়ে আসছে।তার মতে, বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো সবচেয়ে বেশি লাভবান হতে পারে। আর সম্পর্ক উল্টে গেলে ক্ষতিও হবে একই মাত্রার। তিনি প্রসঙ্গক্রমে বলেন , খালেদা জিয়ারশাসনামলের শুরুতেই বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন বেড়ে যায়। বাংলাদেশে উলফার ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার সহ বাংলাদেশে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অবাধ তৎপরতা ভয়ংকর পর্যায়ে যায়। তারেক জিয়া দুবাইতে দাউদ ইব্রাহিমের সাথে দেখা করেন- জঙ্গী সংগঠকদের সাথে তার সম্পৃক্ততা ভারতীয় গোয়েন্দা তথ্যে উদ্ঘাটন হয়েছে । সেই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে হাসিনার শাসন প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের জন্যে নিরাপদ। কারণ , শেখ হাসিনা জঙ্গীবাদ দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। সুবীর ভৌমিক আরো বলেন, “১১ হাজার একর বা কতো জমি-সেটা অতো জরুরী নয়, যতোটা জরুরী এই মুহুর্তে দিল্লীর অনুধাবন করা খালেদা চরম সাম্প্রদায়িক শক্তি জামাতের সাথে জোট করেন- যারা জঙ্গীবাদের সাথে যুক্ত। যারা সংখ্যালঘু নির্যাতন করে।”আলোচনার এই পর্যায়ে বিজেপি নেতা তরুণ বিজয় বলেন, “আমি সুবীর ভৌমিকের সঙ্গে একমত।”
আলোচকদের অধিকাংশই চুক্তি বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধনের পক্ষে মত দেয়ায় একপ্রকার কোনঠাসা স্বাগত রায় ‘কূটনৈতিক কৌশলের’ আশ্রয় নেন। তিনি বলেন, একজন মন্ত্রী হিসাবে শশী থারুরের এমন কিছু বলা উচিৎ নয়, যাতে মনে হয় যে দিল্লি ঢাকাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। জবাবে স্বভাবসুলভ রসিকতার সুরে শশী বলেন, “কার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হবে- মিস্টার রায় এবং তার নেত্রী (মমতা) কি তা নিয়ন্ত্রণ করতে চান? তারা কি ভাবছেন যে ,কে আমার বন্ধু আর কে তা নয়- এটা বোঝার মতো বুদ্ধিও আমার নেই?”
এই টক শো দেখে ছিটমহল বাসীর মনে অন্তত আশা জাগবে তাদের দাবি এবার নীতিনির্ধারকদের নজরে আসবে। উচ্চ আদালত অথবা গণমাধ্যম – সকল প্রচেষ্টা সফল করে ছিটমহলবাসীর নাগরিকত্ব এবং মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে ভারত সরকার সচেষ্ট হবে এমন আশা করছে ৫১ হাজার ৫৪৯ জন ‘নাই’ দেশের নাগরিক ছিটমহলবাসী।
sumikhan29bdj@gmail.com

রাষ্ট্র-পুনর্বার ভাবো, মৌলবাদীরাই তোমার ক্যান্সার:মারুফ রসূল


চারপাশে নানা কিছু চলছে। নানা সংবাদের বাতাবরণে মুখর এখন গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো। সন্দেহ নেই, এগুলো প্রয়োজনেই হচ্ছে।
‘প্রয়োজন’ শব্দটি বড়ই আপেক্ষিক, নানা স্তরে-উপস্তরে তার গ্রহণযোগ্যতার গ্রাফ উঠানামা করে। এখন সময়টি বড়ো নচ্ছাড়। স্বীকার করতেই হবে, তীব্র একটি অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে গোটা জাতীয় জীবন।
বিশ্বায়নবাদীরা যদি ‘জাতীয় জীবন’কে অস্বীকার করতে চান, তবে তাদেরও বলি- আন্তর্জাতিক জীবনেও অস্থিরতা দৌড়ে বেড়াচ্ছে। এই স্থির-অস্থিরের দৌড়োদৌড়িতে চাপা পড়ে যাচ্ছে অনেক খবর, কিংবা গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে না, যতোটা হওয়া উচিত ছিলো।
যৌনপল্লী উচ্ছেদের নানামুখী মহড়া আমরা লক্ষ্য করছি বেশ কয়েকদিন ধরে। হঠাৎ করে এমন একটি ঘটনা কেনো ঘটছে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওযা যাচ্ছে না, বা আমার মতো নগণ্য মানুষের মেধায় তা কুলোচ্ছে না।
তবে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, ভয়ানক দুর্দিন চোখের সামনে ভেসে উঠছে। এটা কেবল এজন্য নয় যে, যৌনকর্মীদের আহত করে জোর করে উচ্ছেদের মাধ্যমে তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে, মাদারীপুরের যৌনপল্লী উচ্ছেদে কিন্তু অমান্য করা হয়েছে হাইকোর্টের রায়ও। উচ্ছেদ অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছে ‘ইসলামে কওম পরিষদ’ নামে একটি সংগঠন। এ সংগঠনটির জন্ম, বেড়ে ওঠা কিংবা দর্শন- নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু এরা যে রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করলো, হাইকোর্টের রায়কে অমান্য করলো, সে বিষয়ে আমার মাথাব্যাথা হবার ঢের কারণ আছে; কেননা, বাংলাদেশের প্রচলিত আইনকে কে বা কারা বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে, কোন দর্শনের ছুতোয় বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার প্রতি কটাক্ষ করে কার্যক্রম পরিচালনা করে, তথাকথিত ‘বাংলা ভাই’ থেকে প্রায় সব ধরনের মৌলবাদী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর ইতিহাস দেখলেই তা বোঝা যায়।
এরা ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে, বিভ্রান্ত করছে সাধারণ মানুষকে এবং দিনের শেষে মানুষের অধিকারের বুকে পদাঘাত করে ন্যায় ও শান্তির মিথ্যা বুলি আওড়াচ্ছে। এরা মৌলবাদী, উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী; অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবুল বারাকাত যাদের অর্থনীতিকে একটি ত্রিভুজের সঙ্গে বিবেচনা করেছেন এবং সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, ত্রিভুজের শীর্ষবিন্দুটি আর কেউ নয়, যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন জামায়াতে ইসলাম ও তাদের পঙ্গপাল দোসররা।
মাদারীপুরে যে ঘটনাটি ঘটেছে, তাকে বিচ্ছিন্ন কিংবা সামান্য ঘটনা ভাবা হবে নিতান্ত একটি বোকামি। একটি দল, যাদের নাম ‘ইসলামে কওম পরিষদ’, তাদের কী এখতিয়ার আছে এ কাজটি করার? এরা কারা? এই যে মৌলবাদীদের আষ্ফালন, উদ্ধত আচরণ, এর মূলে কারণটা কী? এর কারণ খুব পরিষ্কার।
প্রথমত, রাষ্ট্র মৌলবাদীদের প্রশ্রয় দিয়েছে, এবং সেটা করেছে সে ঐতিহাসিকভাবেই। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্র পরিচালনারত রাজনৈতিক দলগুলো এসব মৌলবাদীদের প্রশ্রয় দিয়েছে কেবল ভোটের রাজনীতিতে টিকে যাবার জন্য। মাঝখান থেকে খেসারত দিয়েছে সমাজ; মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নির্ভর একটি অসাম্প্রদায়িক, শোষণ-বৈষম্যমুক্ত সমাজের স্থলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি আতঙ্ক সমাজ, যেখানে জামায়াত-আতঙ্ক, শিবির-আতঙ্ক, হেফাজত-আতঙ্ক মানুষকে তাড়া করে বেড়ায়। শুরু থেকেই এদের দমনে রাষ্ট্রের সক্রিয় হওয়া উচিত ছিলো, কিন্তু রাষ্ট্রের শীতনিদ্রা ভাঙে দেরিতে; আফসোস, মাদারীপুরে ততোক্ষণে লুট হয়ে যায় আমার বোনের সমস্ত সঞ্চয়।
এটা হয়তো সবাই একবাক্যেই মানবেন যে, কেউ যৌনকর্মী হয়ে জন্ম নেন না। আজ যাদের উপর অন্যায়ভাবে খড়গহস্ত চালিয়ে, মধ্যযুগীয় কায়দায় উচ্ছেদের বর্বরতা দেখানো হলো, তারা জন্মেছেন আমাদেরই দেশে, আমাদের কারো পরিবারেই। এরপর সমাজের চোরাগলিতে কতোটা পথ হারিয়ে আজ তারা জীবনের এ জটিল চৌকাঠে এসে দাঁড়িয়েছেন, সে বিশ্লেষণটা না হয় সমাজবিজ্ঞানীরাই করবেন। কিন্তু তাঁদের এ জীবনের জন্য রাষ্ট্র কী দায়ী নয়? রাষ্ট্র কী পারবে এই নারীদের চোখের জলের দায় এড়াতে? রাষ্ট্র ও সমাজের যুগপৎ প্রতারণায় প্রতারিত হয়ে যে নারীরা খুঁজে নিয়েছে নিজস্ব জীবনের ব্যাকরণ, নিজের বেঁচে থাকার অবলম্বন, তাকে কীসের ভিত্তিতে উচ্ছেদ করবে রাষ্ট্র? কার পাপ ঢাকতে? কার লাম্পট্য রাষ্ট্রকে বড়ো বেশি বিব্রত করে তুলেছে? কেনো এই প্রসঙ্গ এলে হেফাজতের নেতা আবদুল আউয়াল ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা শামীম ওসমানের মাঝে কোনো পার্থক্য থাকে না?
এসব উত্তর কে দেবে? বারো বছর আগে নারায়নগঞ্জে যাকে ‘পাপ’ বলে উচ্ছেদ করেছিলো রাষ্ট্র, বারো বছর পর মাদারীপুরেও তাকে ‘পাপ’ হিসেবেই দেখছে। অর্থাৎ, আহ্নিক গতি-বার্ষিক গতি বদলালেও রাষ্ট্রের কপট মানসিকতা বদলায়নি।
এবার কয়েকটি সোজা কথায় আসা যাক। সহজ কথা যেমন সহজে বলা যায় না, তেমনি সোজা কথাও সোজা করে বলা যায় না। যদি কোনো দল নিজেদের ‘ইসলামি’ দল বলে পরিচয় দেয়, তবে তার কাজ হলো ধর্ম প্রচার করা কিংবা ধর্মের যে অমোঘ বাণী, তা নিয়ে কাজ করা। কিন্তু বাংলাদেশে যারা ইসলামি দল বলে নিজেদের পরিচয় দেয়, তাদের মূল আকর্ষণটাই থাকে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করে একটি ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রণয়ন করা। একাত্তর-পূর্ব সময় থেকেই এ বিষয়টি লক্ষ্যণীয়, এমনকি বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে, তার মূলেও ছিলো এসব ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল।
মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলাম এবং তাদের সন্ত্রাসী বাহিনী ইসলামী ছাত্র সংঘ (বর্তমানে ইসলামী ছাত্র শিবির) ধর্মের নামে বাংলাদেশ বিরোধী বর্বরতা চালিয়েছে, পাকিস্তানি হায়েনাদের সঙ্গে লাম্পট্যের কূটনীতি চালিয়েছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরও দেখা গেছে, যতোগুলো ধ্বংসযজ্ঞ, অমানবিকতা ও বিভৎস বর্বরতা ঘটেছে, তার অধিকাংশের মূলেই ছিলো কোনো না কোনো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বা ধর্মাশ্রিত দল। এখানেই মূল খটকা। ধর্ম শান্তি ও ন্যায়ের কথা বলে, কিন্তু সে-ই ধর্মের আওয়াজ তুলে যৌনপল্লী উচ্ছেদের মতো ঘটনা ঘটিয়ে, তাতে লুটপাট করে কী বোঝাতে চায় তারা? আমরা কয়েক মাস আগেই দেখেছি হেফাজতে ইসলাম নামে একটি মধ্যযুগীয় সংগঠন জামায়াত-বিএনপি’র প্রত্যক্ষ মদদে ঢাকার শাপলা চত্বরে কী অমানবিক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, তারপর ভাড়াটে প্রচারযন্ত্র দিয়ে তাকে জায়েজ করার অপচেষ্টা চালিয়েছে।
এর আগে এদেরই কিছু মুর্খ পালের গোদা নারায়ণগঞ্জের যৌনপল্লী উচ্ছেদে জিহাদী ভূমিকা পালন করেছে। এগুলো কি আদৌ ধর্ম প্রচারে বা ধর্মের কোনো কারণে? যে সূফীবাদের হাত ধরে বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসার ঘটেছে, তাঁদের তো কখনও এমন ধ্বংসযজ্ঞ করতে দেখিনি। এই মদদপুষ্ট ইসলামি দলগুলো তবে কোন হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এই কাজে নেমেছে? তারা যাকে অন্যায় বলছে, সেটা আদৌ অন্যায় কি না, সেটার বিষয়ে কোনো আলোচনা কি হচ্ছে? হচ্ছে না। তাহলে প্রশ্ন হলো, এতো সাহস তারা কোথায় পায়? আমি সোজা বাংলায় যা বুঝি, তা হলো- রাষ্ট্রের নির্লজ্জ প্রশ্রয়ের কারণেই এরা এতোটা বাড় বেড়েছ। হাইকোর্ট যৌনপল্লী উচ্ছেদে সময় বেঁধে দিয়েছে, এটা কোনো সভ্যতার মাঝে পড়ে না; কারণ এই উচ্ছেদেই সব সমস্যা চুকেবুকে যাবে না। আর মাননীয় আদালত কী বলবেন- পুরুষের মগজের ভেতরে যে পাপ-লাম্পট্য নষ্ট পুঁজের মতো অবস্থান করছে, তার বিরুদ্ধে রায় দেবার কিংবা না ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করার কোনো সময়সীমা বেঁধে দেয়া সম্ভব কি না?
মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা আর জঙ্গিবাদের বিষবৃক্ষগুলো চারপাশে ভয়ানকভাবে বেড়ে উঠছে। এদের বিষাক্ত নিঃশ্বাসে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানবিক বাঙলাদেশ। রাজনৈতিক দলগুলো যদি অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ না হয়, ভুঁইফোড় মৌলবাদীদের প্রতিহত না করে; যদি এখনও ভোটের হিসেবে নির্ধারণ করে তাদের মৌলবাদঘেঁষা ভবিষ্যৎ কর্মপরিধি, তবে একদিন নমিনেশন দেবার জন্য যোগ্য-আদর্শিক নেতা খুঁজে পাবেন না। শাহ এ এম এস কিবরিয়া, আহসানউল্লাহ মাস্টার, আইভি রহমানের মতো নেতারা আমার এই বক্তব্যের ট্র্যাজিক উদাহরণ।
মারুফ রসূল: সাহিত্যিক ও গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী,

Sunday, September 1, 2013

এই লজ্জা কোথায় রাখি: মুহম্মদ জাফর ইকবাল


১.
কাক কাকের গোশত খায় না- কিন্তু এবারে মনে হয় একটু খেতেই হবে। আমি একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে আমি সাধারণত অন্য বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে কোনো মন্তব্য করি না। কিন্তু এবারে মনে হয় করতেই হবে।

আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলছি। আমার মতোন শিক্ষকরা সেই ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলরকে তার অফিসে আটকে রেখেছেন। খবরে জেনেছি এই মুহূর্তে দয়া করে পনেরো দিনের জন্যে দম নেওয়া হচ্ছে। তারপর সম্ভবত আবার নব উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়া হবে।

আগেই বলে রাখি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর এবং তার শিক্ষকদের ভিতর কী সমস্যা সেটা আমি অনেক চেষ্টা করেও বুঝতে পারছি না। শিক্ষকরা বলছেন তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। ভাইস চ্যান্সেলর বলছেন তদন্ত কমিটি করে সেই অভিযোগ যাচাই করা হোক। তারপরেও সেখানে শিক্ষকরা কেন তাদের ভাইস চ্যান্সেলরকে আটকে রেখেছেন সেটা আমার মোটা বুদ্ধিতে ধরতে পারছি না। পত্রপত্রিকার লেখালেখি থেকে বোঝার চেষ্টা করছি কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হচ্ছে না।

আমাদের দেশে লেখালেখির একটা নতুন স্টাইল শুরু হয়েছে। সবারই একটা নিরপেক্ষতার ভান করতে হবে। তাই কেউ যদি গুরুতর অন্যায়ও করে সোজাসুজি স্পষ্ট করে কেউ লেখে না। ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে গা বাঁচিয়ে লেখে- যেন কেউ কিছু বলতে না পারে। আজকাল পত্রপত্রিকায় ইলেকট্রনিক ভার্সন রয়েছে। সেখানে কোনো লেখা ছাপা হলে তার লেজে পাঠক আবার ভুল বানান এবং অমার্জিত ভাষায় যা কিছু লিখতে পারে! সবাই ভয়ে ভয়ে লেখে, কার আর সত্যি কথা বলে গালমন্দ খেতে ভালো লাগে? আমি অবশ্যি ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে দুর্বোধ্যভাবে কিছু বলার চেষ্টা করছি না- একেবারে সোজাসুজি বলছি, একজন ভাইস চ্যান্সেলরকে তার অফিসে দিনের পর দিন আটকে রাখা খুব বড় একটা অন্যায় কাজ। কথাটা আরেকটু পরিষ্কারভাবে বলা যায়, মানুষটি একজন ভাইস চ্যান্সেলর না হয়ে যদি একজন জুনিয়র লেকচারার কিংবা একজন অপরিচিত ছাত্রও হতো, তাকেও একটা ঘরের মাঝে আটকে রাখা গুরুতর একটি অন্যায়।

স্বাধীন একটা দেশে কাউকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে একটা ঘরে জোর করে আটকে রাখা যায় না। আমি আইনের মানুষ নই। কিন্তু আমার ধারণা দেশের আইনে এটা নিশ্চয়ই একটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষকরা এ কাজটি করছেন আমার এ লেখাটি তাদের চোখে পড়বে কিনা আমি জানি না। যদি পড়ে তাহলে তাদের প্রতি আমার একটা ছোট অনুরোধ। ঘরে তাদের অনেকেরই নিশ্চয়ই কমবয়সী ছেলেমেয়ে আছে। পনেরো দিন পর তারা আবার যখন তাদের ভাইস চ্যান্সেলরকে তার অফিসে অবরুদ্ধ করে ফেলবেন, তখন তারা রাতে বাসায় ফিরে গিয়ে তাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সাথে নিচের এই বাক্যালাপগুলো করবেন!

তারা তাদের ছেলেমেয়েদের বলবেন, ‘বাবা, আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা একটা বিশাল কাজ করে এসেছি!’ ছেলেমেয়েরা তখন বলবে, ‘কী কাজ বাবা (কিংবা কী কাজ মা?)’ তখন তারা বলবেন, ‘আমাদের একজন ভাইস চ্যান্সেলর আছেন, তাকে আমরা দু’চোখে দেখতে পারিনা। তাই তাকে আমরা তার অফিসে আটকে রেখেছি। সেখান থেকে তাকে আমরা বের হতে দিই না।’

আমি ছোট বাচ্চাদের যেটুকু জানি তাতে আমার ধারণা তখন তারা চোখ বড় বড় করে বলবে, ‘বের হতে দাও না?’
‘হ্যাঁ, জেলখানায় যেরকম কেউ বের হতে পারে না, সেরকম। তাকে আমরা অফিস থেকে বের হতে দিই না। জেলখানার মতো আটকে রেখেছি।’

বাক্যালাপের এরকম পর্যায়ে শিক্ষকদের ছেলেমেয়েরা জিজ্ঞেস করতে পারে, ‘তোমাদের ভাইস চ্যান্সেলরের ছেলেমেয়ে নেই? তারা কী বলে?’

‘তাদের আবার বলার কী আছে? একটা মেয়ে শুনেছি লেখাপড়া করতে বিদেশে গিয়েছে। তাকেও বিদায় জানাতে আমরা ভাইস চ্যান্সেলরকে এয়ারপোর্টে যেতে দেইনি।’

বাচ্চাগুলো তখন নিশ্চয়ই শুকনো মুখে তাদের বাবা কিংবা মায়ের মুখের দিকে তাকাবে, চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করবে, ‘সত্যি?’

শিক্ষকরা তখন বলবেন, ‘হ্যাঁ। উচিৎ শিক্ষা হচ্ছে। তোমরা যখন বড় হবে তখন তোমাদের যদি মানুষকে অপছন্দ হয় তাহলে তোমরাও তাকে এভাবে একটা ঘরে আটকে ফেলবে। বের হতে দেবে না!’

আমার ধারণা শিক্ষকদের ছেলেমেয়েরা আলোচনার এই পর্যায়ে এক ধরনের আহত এবং আতংকিত দৃষ্টিতে তাদের বাবা (কিংবা মা) এর দিকে তাকিয়ে থাকবেন। আমার খুব জানার ইচ্ছে এবং আমি খুবই কৃতজ্ঞ হতাম যদি এই শিক্ষকদের কেউ আমাকে জানাতেন এই ধরনের একটা কথোপকথনের পর তাদের ছেলেমেয়েরা কী বলেছে।

২.
পৃথিবীর যেকোনো দেশে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সম্ভবত সেই দেশের সবচেয়ে জ্ঞানী এবং গুণী মানুষ। সবচেয়ে বড় বুদ্ধিজীবী, সবচেয়ে বড় মুক্তবুদ্ধিতে বিশ্বাসী মানুষ এবং সম্ভবত জাতির সবচেয়ে বড় বিবেক। তাই সাধারণ মানুষ যখন দেখে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা স্বাধীন দেশের নাগরিককে জেলখানার মতো একটা ঘরে আটকে রাখছে তখন তারা নিশ্চয়ই হতবাক হয়ে যায়। সবচেয়ে বিচিত্র ব্যাপার হচ্ছে এই পুরো প্রক্রিয়াটার নাম দেওয়া হচ্ছে ‘আন্দোলন’।

মনে হয় আন্দোলন বলা হলেই পুরো বিষয়টাকে ন্যায়সঙ্গত, প্রগতিশীল, সত্যের জন্যে সংগ্রাম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই দেখা গেল মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী সংগ্রামী সকল নেতৃবৃন্দকে আলোচনার জন্যে তার বাসায় ডেকে নিয়ে গেলেন। অর্থাৎ কোনো একজন মানুষকে জোর করে একটা ঘরে আটকে রাখা হলে কাউকেই কোনো ধরনের আইনি ঝামেলায় পড়তে হয় না বরং দেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী তাদের নিজের বাসায় ডেকে নিয়ে যান। সোজা কথায় এতো বড় একটা অনৈতিক এবং বেআইনি বিষয়কে রাষ্ট্রীয়ভাবে নৈতিক সমর্থন দেওয়া হয়।

এই দেশে বিষয়টা অবশ্য নতুন নয়। কাউকে জিম্মি করে কোনো একটা দাবি আদায় করে নেয়া এই দেশের সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। যারা ভদ্রতা করে এটা করে না তাদের মেরুদণ্ডহীন অপদার্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আমি নিজের কানে এই দেশের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষককে বলতে শুনেছি, ‘এমনিতে কাজ হবে না, গিয়ে ঘেরাও কর, রাস্তাঘাটে কিছু ভাংচুর কর তখন কর্তৃপক্ষের টনক নড়বে।’
তাই দাবি আদায়ের জন্যে কাউকে জিম্মি করে ফেলা যে একটি বেআইনি কিংবা অত্যন্ত অমানবিক কাজ হতে পারে সেটা কেউ মনে পর্যন্ত করে না।

শুধু যে দেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী মহোদয় এই ধরনের বেআইনি কাজকে নিজের অজান্তেই গ্রহণযোগ্যতার সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছেন তা নয়, আমাদের দেশের পত্রপত্রিকাও তাদের কাজকে সম্মানের জায়গায় নিয়ে গেছেন। তারা দুই পক্ষকেই সমানভাবে নিজেদের বক্তব্য রাখতে দিচ্ছেন, পত্রিকার পাশাপাশি পৃষ্ঠায় তাদের বক্তব্য ছাপা হচ্ছে। আমি সেগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ার চেষ্টা করছি। সব কিছু যে বুঝতে পেরেছি সেটা দাবি করব না।

আমি বহুকাল থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আছি তাই একটা জিনিস জেনেছি, প্রকাশ্যে যে কথাগুলো বলা হয় সেগুলো সব সময় পুরো কথা নয়, আসল কথা নয়। প্রকাশ্য কথার পিছনে অপ্রকাশ্য কথা থাকে, গোপন এজেন্ডা থাকে অনেক সময় দেখা গেছে সেগুলোই মূল ব্যাপার। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অপরাধের ব্যাপারে কোনটা সত্যিকার কথা সেটা জানি না। তবে অভিযোগ থাকলে তদন্ত হবে শাস্তি হবে কিন্তু আগেই নিজেরা শাস্তি দিয়ে একজনকে তার মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হবে সেটি কোন দেশের বিচার?

পনেরো দিন পরে কী হবে আমরা জানি না। তবে একটা কথা খুব পরিষ্কার করে বলা যায়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা খুব ভয়ংকর উদাহরণ তৈরি হল। কোনো একজন মানুষকে পছন্দ না হলে তাকে সরানোর জন্যে কয়েকজন (কিংবা অনেকজন) মানুষ একত্র হয়ে তাকে একটা ঘরে আটকে ফেলতে পারবেন- এর জন্যে কাউকে কৈফিয়ত দিতে হবে না, দেশের আইন তাদের স্পর্শ করবে না। যেসব শিক্ষকরা অপছন্দের মানুষকে ঘরের ভেতর আটকে ফেলার কালচার চালু করলেন, তাদের কেউ কেউ নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে ভাইস চ্যান্সলর হবেন। ভাইস চ্যান্সেলরের দায়িত্ব খুব কঠিন দায়িত্ব। নিশ্চিতভাবেই তখন তারা সবাইকে সমানভাবে খুশি করতে পারবেন না। তখন তাদেরকে যখন অন্য শিক্ষকেরা ঘরের মাঝে বন্দি করে ফেলবেন তখন তারা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন কী না জানার ইচ্ছে করে।

৩.
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তৈরি হয়েছে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া করানোর জন্যে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এখন মনে হয় সেটা কারো মনে নেই। অনেকেরই ধারণা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের চাকরিটি বুঝি তার নিজের সুখ সুবিধার জন্যে। নিজেদের ‘অধিকার’ আদায় করার জন্য ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ার বিষয়টি যদি পুরোপুরি চাপা পড়ে যায় তাতেও কেউ কিছু মনে করে না। ছাত্রছাত্রীদের কারণে, ধর্মঘট, মারামারি হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে এরকম অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু শিক্ষকেরা তাদের নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করার জন্যে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া বন্ধ করে রেখেছেন সেরকম উদাহরণ খুব বেশি নেই। উদাহরণটি খুব ভালো নয়, সারা দেশে আমাদের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপর খুব বড় একটা গ্লানি নেমে এসেছে। এই গ্লানি থেকে আমরা খুব সহজে বের হয়ে আসতে পারব বলে মনে হয় না।

৪.
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর আনোয়ার হোসেনকে আজ থেকে ছয় বছর আগে ঠিক এই রকম সময়ে মিলিটারি সরকার গ্রেফতার করেছিল। তার লেখা বইয়ে আমি পড়েছি চোখ বেঁধে তাকে নিয়মিতভাবে রিমান্ডে নেয়া হতো। তাই আমরা জানি তার জেল খাটার অভিজ্ঞতা এবং মিলিটারি অত্যাচার সহ্য করার ক্ষমতা বেশ ভালো রকমই আছে। আপাতত শিক্ষকদের চারদিনের রিমান্ড থেকে মুক্তি পেয়েছেন, পনেরো দিন পর যখন আবার শিক্ষকরা তাকে তাদের জেলখানা রিমান্ডে নিয়ে যাবেন আমি আশা করছি তিনি যেন ধৈর্য ধরে সেটা সহ্য করতে পারেন।

ছয় বছর আগে তাকে যখন মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল তখন আমি আর আমার স্ত্রী তাঁর স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে সাহস দিতে তার বাসায় গিয়েছিলাম। পনেরো দিন পর যখন শিক্ষকরা আবার তাকে ঘরে আটকে ফেলবেন তখন হয়তো আমাদের আবার তার বাসায় গিয়ে স্ত্রী পুত্র কন্যাকে সাহস দেয়ার কথাÑ কিন্তু আমার মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আমি তাদেরকে এবার লজ্জায় মুখ দেখাতে পারব না।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল
লেখক, অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

আর নয় প্রীতিদের অপ্রীতিকর চলে যাওয়া:মোহাম্মাদ মাহাবুবুর রহমান



মামুন বৃহস্পতিবার রাতে হঠাৎ করে ফেসবুকে আমার ওয়ালে লিখেছে, ‘ভাইয়া, আপনাকে খুব প্রয়োজন ছিল। অনেকবার কল করেছি। কিন্তু, ফোন বন্ধ পেয়েছি। প্লিজ, আমাকে কি একটা কল দেবেন?’

ছোট ভাই মামুনের কথাগুলো আকূতির মতো শুনালো। ও আমাকে ফোনে পাচ্ছে না। পুরো রমজান মাসে নাকি পায়নি। কথাটি পুরোপুরি সত্য। বিভিন্ন জায়গায় ইফতারের দাওয়াত এড়ানোর জন্যই মোবাইল বন্ধ রাখতাম। আব্বা, ড. অনুপম সেন স্যার, বড় ভাই ডা. মোস্তাফিজ, হেলাল স্যার, আসাদ স্যার, জাকিয়া, আবু হান্নান ভাই এবং আরও অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী আমার ওজন বাড়া নিয়ে খুব চিন্তিত। রোজার পুরো মাসে সিয়ামের ফাঁকে ওজন কমানোর সুযোগ নিতে চেয়েছিলাম। কাজেই বেশিরভাগ সময় ফোন বন্ধ রাখতাম।

অতি প্রিয় ছোট ভাই মামুনকে সত্য স্বীকারোক্তি দিলাম তার ফেসবুকের ইনবক্সে। ও খুব দ্রুত রেসপন্স করলো। খুব আবেগ নিয়ে বললো, ‘ভাইয়া, আপনি নিশ্চয় প্রীতির ব্যাপারটা জানেন?’ বললাম, ‘আমি বাংলানিউজটুয়েন্টিফোরডটকমে পড়েছি’।
তাছাড়া তেহসিনের স্ট্যাটাসটা কয়েক লাইনের বেশি পড়তে পারিনি। ইদানিং নার্ভ দুর্বল হয়ে পড়েছে। অতো লোড নিতে পারছি না’।

মামুন ইনবক্সে লিখলো, ‘ভাইয়া, ওটা আমার স্ট্যাটাস ছিল। সবাইকে শেয়ার করার অনুরোধ করেছি। ঘটনার সময় আমি পাশে ছিলাম’।

মামুন আবেগী মানুষ। মানুষকে সম্মান দেয়। তীব্রভাবে ভালোবাসে। মামুন লিখে চলে, ‘ভাইয়া, রেলপথে পাথর ছুঁড়ে হত্যার বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ শুরু করেছি। ইতোমধ্যে আরম্ভ করে দিয়েছি সাইবার যুদ্ধ। ‘রেলপথে আর কোনো দুর্ঘটনা নয় - প্রীতি দাশ হত্যার বিচার চাই’ এ দাবিতে ১৭ আগস্ট শনিবার সকাল দশটায় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে একটি মানববন্ধনও করবো আমরা সবাই মিলে। এখানে আমরা ড. অনুপম সেন স্যারের মতো একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় মানুষকে পেলে ভালো হতো। স্যার যদি আসেন, তবে আমাদের আয়োজনের মেসেজটা সমাজে ভালোভাবে পৌঁছাতো। ভাইয়া, দয়া করে স্যারকে একটু দাওয়াত দেন’।

আমি মামুনকে বললাম, ‘স্যার আসবেন, তুমি নিশ্চিত থাকো। আগামীকাল আমি কথা বলবো স্যারের সঙ্গে’।

প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললাম। কারণ, স্যারকে যতোটুকু জানি, সময় পেলে এবং শরীর সুস্থ থাকলে তিনি যেকোনো মহৎ কাজে এগিয়ে যান এবং উৎসাহ দেন। এটা তার মজ্জাগত।
আন্তরিক ধন্যবাদ জানালো মামুন। সেই সঙ্গে ফেসবুকের একটি গ্রুপ এবং ইভেন্ট শেয়ার করতে বললো। ও ইনবক্সে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে লিখছে, ‘http://www.facebook.com/groups/justiceforpritidas/ যদি সম্ভব হয় এই গ্রুপটা একটু শেয়ার করবেন... http://www.facebook.com/events/708028025890150/ এটি ইভেন্ট...’।

ক্লিক করে দেখলাম, দু’টিতেই কভার পিকচারে লেখা আছে... ‘এটা নিছক দুর্ঘটনা নয়, এটা হত্যাকাণ্ড/এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই’।

হঠাৎ করে খেয়াল করলাম, মামুন নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টের প্রোফাইল ও কাভার ছবি পরিবর্তন করেছে। বোঝার চেষ্টা করলাম, বন্ধুপত্নীর অপ্রত্যাশিত মৃত্যু ওকে কতোটা শোকাহত করেছে। মামুনের সঙ্গে চ্যাট শেষ করে প্রীতির মৃত্যু নিয়ে দেওয়া ওর স্ট্যাটাসটা পড়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিলাম । ক্লিক করে ওর ওয়ালে ঢুকলাম।

নিঃশ্বাস নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা ও গড়িয়ে পড়া অশ্রু
মামুন লিখেছে, ‘প্রচণ্ড কষ্ট এবং ক্ষোভ থেকে লিখছি। গত পরশু চট্রগ্রাম থেকে ঢাকায় ফিরছিলাম আমি, জুয়েল, মিন্টু এবং প্রীতি বউদি। বউদি বসেছিলেন জানালার পাশে। মিন্টু তার পাশে। দেখা হওয়া মাত্রই বৌদি শুভেছা বিনিময় করেছিলেন আমার সঙ্গে। জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমার বাচ্চা কেমন আছে, পরিবার কেমন আছে?’

‘মিন্টু ঘুমানোর কথা বলে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেয় এবং এয়ারপোর্ট স্টেশনে দেখা হবে বলে জানায়। মিন্টুর কর্মস্থল ঢাকা। বউদিকে নিয়ে যাচ্ছিল। ঢাকায় ভালো লাগে না বউদির। তারপরও সপ্তাহ দুয়েক থাকার ইচ্ছে আছে। নিতান্তই মন না টিকলে ১৪ তারিখেই ফিরে আসবেন। রাত আনুমাণিক সোয়া এগারোটা কিংবা এগারোটা বিশ মিনিটের দিকে ট্রেন ভাটিয়ারি ভাঙ্গা ব্রিজের কাছে পৌঁছায়। আমি জুয়েলের সঙ্গে গল্প করছিলাম’।

‘হঠাৎ ‘ঠাস’ করে একটা শব্দ শুনি। সঙ্গে সঙ্গে একটা পাথর চোখের সামনে ছিটকে পড়ল। কোচের মাঝখানে সামনা-সামনি আসনগুলোর মধ্যবর্তী ফ্লোরে নিষ্ঠুর পাথরটিকে পড়ে থাকতে দেখলাম। বউদি শুধু একটা আর্তনাদ করে নুইয়ে পড়েন। মিন্টু কি হয়েছে, কি হয়েছে বলে বউদিকে ধরে। বুঝতে পারি, পাথরটা বউদির মাথার বাম পাশে আঘাত করেছে। বউদির বাম গালে একটু লাল দাগ লক্ষ্য করি। মিন্টু মাথায় পানি ঢালে। সম্ভব সব রকমের চেষ্টা করা হয় বউদির জ্ঞান ফেরানোর জন্য’।

‘কিন্তু আমাদের এতো চেষ্টার পরেও বউদি কোনো কথা বলছিলেন না। চোখ দু’টো বন্ধ ছিল। চোখের কোণা দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু। ২/৩ মিনিট পর পর হেঁচকি তুলছিলেন। নিঃশ্বাস নেওয়ার নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন’।

‘এতোটা খারাপ কিছু আমি তখনো ভাবিনি। ভেবেছিলাম, একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে। আমি চলে যাই ট্রেনের শেষ মাথায় কোনো ডাক্তার থাকলে আসতে বলার জন্য। আমি আশাহত হয়ে ফিরে আসি। এসে দেখি, বউদি অসাড় হয়ে পড়েছেন। মিন্টু বলছে, আমি পাল্স পাচ্ছি না। আমিও চেক করি, পাইনি। মনে করেছিলাম, অতিরিক্ত উত্তেজনার কারণে পাচ্ছি না। হয়তো মৃদু ভাবে আছে। আমি ধরতে পারছি না’।

হে প্রভু, তুমি বউদিকে নিও না
মামুন আরও লিখেছে, ‘সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সীতাকুণ্ড নেমে যাওয়ার। কোনোমতে মিন্টু, আমি মিলে বউদিকে ধরাধরি করে নামাই। জুয়েল সব ব্যাগ নামায়। বউদিকে বেঞ্চে শুইয়ে আমি দৌঁড়াই একটা ট্যাক্সি ঠিক করার জন্য। পথে একটা রিকশা পাই যাত্রীসহ। তাদেরকে অনুরোধ করলে তারা রিকশাটা ছেড়ে দেন। আমি মিন্টু বউদিকে নিয়ে মূল রাস্তায় পৌঁছে ট্যাক্সি নিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতাল, সীতাকুণ্ডে পৌঁছাই’।

‘আল্লাহ্র কাছে শুধু কায়মনোবাক্যে একটা প্রার্থনা করছিলাম। হে আল্লাহ , হে প্রভু, আমি যদি একটাও ভালো কাজ করে থাকি, আমার যদি একটা এবাদতও তুমি কবুল করে থাকো, যদি একটাও ন্যায়বিচার করে থাকি, তবে তুমি প্রীতি বউদিকে নিও না। ফিরিয়ে দাও। এটা ওর যাওয়ার সময় নয়’।

অতিরিক্ত কষ্টে-আবেগে মামুন লিখেছে, ‘হয়তো প্রার্থনা করতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। হয়তো বা আমি এতোটাই পাষণ্ড, পাপী যে আল্লাহ শোনেননি। মিন্টু তখন শুধু বউদির হাত ধরে বসেছিল। আর কান্নাভেজা কণ্ঠে আকুতি জানাচ্ছিল, প্রিয়তমার কাছে- প্রীতি, ও প্রীতি... কথা বলো, কথা বলো। বউদি নিশ্চুপ- নির্বাক। দৃষ্টি যেন কোথায়! হয়তো অপার্থিব দৃষ্টি, আমি চিনতে পারছিলাম না’!

‘ডাক্তার পরীক্ষা করে যখন অক্সিজেন মাক্স লাগাচ্ছিলেন মিন্টু তখনো বউদির হাত ধরেছিল। আর বলছিল, আমি শক্ত আছি। ডাক্তার সাহেব, আপনি বলেন কি অবস্থা। পৃথিবীর সমস্ত অসহায়ত্ব যেন ডাক্তারের চোখে জমা হয়েছে। ডাক্তার শুধু আমাদের দিকে তাকাচ্ছিলেন আর কি যেন বলতে চেয়েও বলতে পারছিলেন না। ডাক্তার প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমাদেরকে হৃদয়বিদারক সংবাদটি দিলেন। প্রীতি বউদি আর নেই!

মিন্টুর চোখের পানি প্লাবিত করেছে পুরো পৃথিবীকে
মামুন ওর স্ট্যাটাসে আরো লিখেছে, ‘মিন্টু হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে। বলে, আমি ওর বাবা মাকে কি জবাব দেবো! এই মেয়েটা শুধু আমার সঙ্গে থাকার জন্য কি না করেছে। একটা বাবু, শুধু একটা বাবুর জন্য তার সে কি আকূতি! হায়রে ঢাকা! হায়রে চাকুরী! আমি কি জবাব দেবো!’

আমি পড়ছি আর দেখছি, মিন্টুর চোখের পানি মামুনের ওয়ালকে ছাপিয়ে সমস্ত ওয়েবপেজকে ভিজিয়ে পুরো পৃথিবীকে প্লাবিত করছে।

এক পর্যায়ে মামুন ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। অসংখ্য ডট দিয়ে নিজের কষ্ট লাঘব করার চেষ্টা করেছে। অনেকটা গ্যাপ দিয়ে মামুন আবার লিখছে, ‘না । আমরা কেউ ওকে সান্ত্বনা দেইনি। সান্ত্বনা দেওয়ার কোনো ভাষা কারো জানা ছিল না। আমরা তখনো আশাবাদী ছিলাম। ডাক্তারকে বলে বউদিকে নিয়ে আমরা চট্টগ্রাম মেডিকেলের দিকে রওনা দেই। পুরো যাত্রা পথে আমার বন্ধু বউদির হাত ধরে নির্বাক বসেছিল।

চট্টগ্রাম মেডিকেলে পৌঁছার পর ডাক্তারের মুখে একই কথা শুনে সবার মাঝে নেমে আসে শোকাতুর নিস্তব্ধতা। আহাজারি করে ওঠেন বউদির মা, বাবা, ভাই, মিন্টুর বাবা-মাসহ উপস্থিত সকলে। আমি হতবাক। আমার বুক যেন ভেঙে যাচ্ছিল। মুহূর্তেই একটা মানুষের জীবন কিভাবে শেষ হয়ে যায়!’

বিচার সবকিছু ফিরিয়ে দিতে পারে না
মামুন প্রচণ্ড কষ্ট নিয়ে লিখছে, ‘মামলা হয়েছে।পুলিশ চেষ্টা করছে আসামিদেরকে গ্রেফতার করার। হয়তো আসামি ধরা পড়বে। বিচার হবে’।

বিচারক মামুনকে হয়তো মানুষ মামুন প্রশ্ন করছে, ‘মিন্টু কি ফিরে পাবে তার প্রিয়তমা জীবনসঙ্গিনীকে ? বউদির ভাইয়েরা কি ফিরে পাবেন তাদের একমাত্র বোনকে? মা-বাবা কি ফিরে পাবেন তাদের আদরের কন্যাকে? মিন্টুর বাবা-মা কি ফিরে পাবেন তাদের প্রিয় কন্যাসম পুত্রবধূকে?’

মামুনের কম্পিউটারের বাটনগুলো অবশেষে ভাষা খুঁজে পেয়েছে, ‘এটা নিছক কোনো দুর্ঘটনা নয়। মানুষের জীবন কোনো ছেলেখেলা নয়। কারো নিছক খেয়ালের কারণে অন্য কারো জীবন প্রদীপ থেমে যেতে পারে না।

ইতোমধ্যেই পুলিশ সন্দেহভাজন একজনকে আটক করেছে। আমরা চাই, আর কারো মায়ের বুক যেন এভাবে খালি না হয়, কোনো ভাই যেন তার বোনকে, স্বামী যেন তার স্ত্রীকে, বাবা-মা যেন তার মেয়েকে, শ্বশুর-শাশুড়ি যেন তাদের আদরের বউমাকে না হারান। জীবন শুরু করার বা মেহেদির দাগ মুছে যাওয়ার আগেই যেন কারো জীবনে নেমে না আসে নির্বাক দুঃসহ নির্মম নির্জনতা। আমার বন্ধুর মতো কারো জীবন যেন শ্মশানের চিতার আগুনে দাউ দাউ করে না জ্বলে’।

রুখে দাঁড়াতে হবেই
মামুনের কি-বোর্ডে প্রতিবাদের কথা অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলছে, ‘অপরাধীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই আমরা তৈরি করেছি এই গ্রুপ। বন্ধুরা, আপনারা সবাই আপনাদের বন্ধুদের এই গ্রুপের সদস্য করে আমাদের পাশে দাঁড়ান। আগামী শনিবার সকাল দশটায় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে আমরা সবাই সমবেত হবো এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে। সেখানে এই মর্মান্তিক ঘটনার প্রতিবাদে মানববন্ধন, কালোব্যাজ ধারণ, সংবাদ সম্মেলন ও স্মারকলিপি প্রদান করা হবে। বন্ধুরা, এই সামাজিক আন্দোলনে আমরা আপনাদের সহযোগিতা এবং সবান্ধব অংশগ্রহণ চাই। এই পোস্টটি সকল বন্ধুকে শেয়ার করার অনুরোধ করছি’।

আর নয় প্রীতিদের অপ্রীতিকর চলে যাওয়া
শুক্রবার দুপুর বারোটার দিকে সেন স্যারকে ফোন করলাম। কুশল বিনিময়ের পর স্যারকে মানববন্ধনের কথা বললাম খুব সংকোচের সঙ্গে। বললাম, ‘খুব কম সময়ে ফ্রি করে দেবো’। স্যার খুব দরদী গলায় বললেন, ‘কোনো অসুবিধা নেই। যতোক্ষণ দরকার হয় থাকবো।’

ফেসবুকের চ্যাট অপশনে প্রিয় ভাই রমেনকে পেলাম। তার সঙ্গেও শেয়ার করলাম। তিনি ব্যাপারটি আগে থেকেই অবগত আছেন। আমি জানি, রমেন এই মহৎ কাজের জন্য যতোখানি সম্ভব করবেন। জহুর ভাই, বিশুদা, বাহার ভাই, শামসু ভাই, তপনদা, আরিফ ভাই, রিয়াজ ভাই, বুলবুল ভাই, সরওয়ার ভাই, সবুর ভাই, কমল, রেজা ভাই, পারভেজ ভাই, ফারুক ভাই, ফরিদ ভাই, উজ্জ্বল, নজরুল ভাই, মামুন ভাই, আসিফ ভাই, মিন্টুদা, ইমরান ভাই, বোন লিপি, বোন এমেলিয়া খানম এবং আরও অনেকের কথা মনে পড়ছে। তারাও নিশ্চয়ই জানেন। মানুষের অধিকার রক্ষায় এই ভালো মানুষগুলো ইতোমধ্যে সমাজে অসামান্য অবদান রেখেছেন।

সবকিছু মিলিয়ে মনে হচ্ছে, বীর চট্টলার সমস্ত মানব নিজেদেরকে ‘প্রীতি’র বন্ধনে আবদ্ধ করে স্লোগান তুলবেন, ‘রেলপথে আর কোনো দুর্ঘটনা নয়, প্রীতি দাশ হত্যার বিচার চাই’। বীর চট্টলার সন্তানেরা এই স্লোগান বাস্তবায়ন করেও দেখাবেন। আমরা আর প্রীতিদের অপ্রীতিকর মৃত্যু দেখতে চাই না।

মোহাম্মাদ মাহাবুবুর রহমান: যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ সচিব (প্রেষণ), পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

Friday, August 30, 2013

জঙ্গীবাদের সমর্থনে বানোয়াট তালিকার প্রবর্তক - ঠগ আদিলুর রহমানকে কারা সমর্থন দিচ্ছেন?কী উদ্দেশ্যে? -সুমি খান


শাপলা চত্বরে তান্ডবকারী জঙ্গীদের সমর্থনে বানোয়াট তালিকার প্রবর্তক ঠগ প্রবঞ্চক আদিলুর রহমানকে কারা সমর্থন দিচ্ছেন?কী তাদের উদ্দেশ্য ?
আমাদের চাক্ষুষ ঘটনার অপব্যাখ্যা যারা করে তারা যদি আমাদের অন্ধ সমর্থ্ন পায়- ভেবে দেখতে হবে- আমরা কি আমাদের সন্তানদের মঙ্গল চাই কি-না। বুঝে নিতে হবে আমরা সুস্থ সমাজের পক্ষে নই। শুধু দেশেই নয়- এই শক্তি এখন সর্বগ্রাসী। জঙ্গী টুন্ডা -আনসারুল্লাহর প্রশিক্ষণের কারণে নাফিস এর মতো অসংখ্য মেধাবী সন্তান কুপথে ধাবিত হয়েছে। এর জন্যে অন্যতম দায়ী তাদের দীক্ষা গুরু তেঁতুল শফি-বাবুনগরীদের হত্যাযজ্ঞে সমাজের নীতিনির্ধারকদের সমর্থন। আদিলুর রহমান এবং তার দীক্ষাগুরু মাহমুদুর রহমানের মিথ্যা প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে জঙ্গীবাদকে প্রকাশ্য সমর্থন। আর এই সমথর্ন যদি যাদের অঙ্গুলি হেলনে এই বিশ্বরাজনীতি ওলোটপালোট হয়ে যাচ্ছে - সেই মার্কিন শক্তির হয়- সন্দেহের আর অবকাশ থাকে না- এদেশ কে কোন্ দিকে ফেলে দেয়া হচ্ছে! এখানেই আমাদের প্রতিবাদ-এখানেই অশনি সংকেত দেখতে পাচ্ছি আমরা!
৫মে শাপলা চত্বরে হেফাজতের জঙ্গীদের হামলায় নিহত পুলিশের রিকুইজিশন গাড়ির চালককেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হামলায় নিহত বলে অধিকারের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।'অধিকার' এর তালিকাভুক্ত ৫মে পুলিশের হামলায় নিহত বলে দাবি করা ৬১ জনের ১ জন সিদ্দিকুর । তিনি ছিলেন পল্টন থানা পুলিশের রিকুইজিশন করা গাড়ির চালক। হেফাজত কর্মীরা পুলিশের ওপর হামলা চালালে তিনি নিহত হন । সিদ্দিকুর রহমানের মরদেহ গ্রহণকারী ঢাকা-চট্টগ্রাম রোড শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক কাজী সেলিম সরওয়ার বলেন," সিদ্দিকুর একজন ড্রাইভার । পুলিশের রিকুইজিশন করা গাড়ির চালক হিসেবে কাজ করেছিলেন ৫ মে। হেফাজত কর্মীরা পুলিশের ওপর হামলা চালালে তিনি ওই হামলায় পল্টন এলাকায় মারা যান। এরপর আমি শ্রমিক নেতা হিসেবে তার লাশ গ্রহণ করি। তারপর পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করি। "

রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে গত ৫ মে মধ্যরাতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে '৬১ জন' হেফাজত কর্মী নিহত হওয়ার যে তালিকা মানবাধিকার সংস্থা 'অধিকার দিয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে ,সেই তালিকা অসঙ্গতিপূর্ণ। নারায়ণগঞ্জে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত ছয় ব্যক্তিকেও হেফাজতের বিরুদ্ধে শাপলা চত্বরে পুলিশের অভিযানে নিহত বলে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। অধিকারের তালিকায় থাকা তিন ব্যক্তি এখনও জীবিত। শুধু তা-ই নয়, তালিকায় পাঁচ ব্যক্তির নাম দু'দফায় লেখা হয়েছে। কোথাও তাদের নামের পূর্ণ অংশ, আবার কোথাও তাদের নামের অর্ধেক অংশ ও পদবি লিখে তালিকা বড়ো করা হয়েছে। মতিঝিলে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ম্যানেজার কামাল উদ্দিন খান । তাকেও শাপলা চত্বরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হামলায় মৃত বলে ৫৭ নম্বরে তালিকাভুক্ত করা হয়। এই তালিকায় ক্রমিকনম্বরের ভুল সহ অসংখ্য অসঙ্গতি রয়েছে।
অধিকারের তালিকায় একটি ক্রমিক নম্বর ভুল হয়েছে। ক্রমিক নম্বর ৯-এর পর ১০ নম্বর বাদ দিয়ে ১১ করা হয়। তালিকার ৬ নম্বরে লেখা হয়েছে নাহিদ; লাশ গ্রহণকারী শাজাহান। নাহিদের বয়স লেখা হয় ২১ বছর। লালগঞ্জ বিল্ডিং গলি, ৭ নম্বর গলি, ঢাকা। তার বিরুদ্ধে পল্টন থানায় মামলা হয়। একই ব্যক্তির নাম ২১ নম্বর ক্রমিকে লেখা হয়েছে মো. নাহিদ শিকদার, বয়স ২২ বছর। এখানে তার ঠিকানা লেখা আছে_ পিতা-দেলোয়ার শিকদার, গ্রাম-পাতারহাট, থানা-মেহেন্দীগঞ্জ, জেলা-বরিশাল; বাসা-২৭৪ জয়কালী মন্দির। তার বিরুদ্ধে পল্টন থানায় মামলার কথা উল্লেখ করা হয়। তালিকার ১৮ নম্বর ক্রমিকে লেখা আছে মাওলানা সিহাবুদ্দিন, বয়স ৩৫ বছর। প্রভাষক গানীয়াতুল মাদ্রাসা, থানা-সীতাকুণ্ড, জেলা-চট্টগ্রাম। ২০ নম্বর ক্রমিকে লেখা হয়েছে মাওলানা শিহাব উদ্দিন, বয়স-৩২ বছর, শিক্ষক_ বগাচতর ফাজিল মাদ্রাসা, গ্রাম-ডোমখালী, ইউনিয়ন-সাহেরখালী, থানা-মিরসরাই, জেলা-চট্টগ্রাম। একইভাবে ২৩ নম্বর ক্রমিকে লেখা আছে মো. সাইদুল বারী, বয়স-১৭ বছর। পরিচয় লেখা হয় মোহাম্মদপুর বাইতুল ফজল ইসলামিয়া মাদ্রাসার ছাত্র, গ্রাম-ইউসুফদিয়া, থানা-গালতা, জেলা-ফরিদপুর। একই শিশুকে ৪২ নম্বর ক্রমিকে পরিচয় নিহত হিসেবে দেখিয়ে লেখা হয় হাফেজ সাইদুর রহমান। এখানে বয়স উল্লেখ করা হয়নি। পিতা-মৃত সিরাজুল ইসলাম। গ্রাম-ইউসুফদিয়া, থানা-সালথা, জেলা-ফরিদপুর। একইভাবে তালিকাভুক্ত মাওলানা আতাউল্লাহর নাম ১৬ ও ৫৮ নম্বর ক্রমিকে দু'দফায় লেখা হয়েছে। ১৬ নম্বরে তার নাম লেখা হয়েছে হাফেজ আতাউর রহমান। ৫৮ নম্বরে একই ব্যক্তির নাম লেখা হয় মাওলানা আতাউল্লাহ। এমনকি মতিঝিলের হেফাজতের তাণ্ডবের সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া কামাল উদ্দিনকে অধিকারের তালিকাভুক্ত করা হয়।

বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা 'অধিকার' সম্প্রতি দাবি করে, মতিঝিলে শাপলা চত্বরে ৫ মে রাতের অভিযানে ৬১ হেফাজত কর্মী নিহত হয়। এ তালিকা পাঁচটি দেশি-বিদেশি মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানকে সরবরাহ করা হয়। পুলিশ অধিকারের তালিকায় থাকা ৬১ ব্যক্তির ব্যাপারে অনুসন্ধান করে এসব অসঙ্গতি পেয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের তত্ত্বাবধানে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ অধিকারের তালিকার ব্যাপারে এই তদন্ত করে।

গত ১০ জুলাই তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে ৬১ জনের নাম-ঠিকানা চেয়ে 'অধিকার'কে চিঠি দেওয়া হয়। অধিকার সরকারকে তালিকা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা জানায়, তদন্ত কমিশন গঠন করলে ওই তালিকা কমিশনের কাছে দেবে। এরপর তথ্যপ্রযুক্তি আইনে ১০ আগস্ট রাতে অধিকার সম্পাদক আদিলুর রহমান খানকে গ্রেফতার করে ডিবি। এরপর জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা আদিলুর রহমানকে মুক্তি দিতে সরকারকে চাপ দেয়। শাপলা চত্বরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে আড়াই হাজারের বেশি হেফাজত কর্মী নিহত হয়েছে বলে প্রথমে দাবি করে হেফাজত। এ ছাড়া শাপলা চত্বরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে মৃতের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন গুজব ছড়ানো হয়।


পুলিশ জানিয়েছে, হেফাজতের তাণ্ডবের সময় নারায়ণগঞ্জে নিহত ওয়ার্কশপ ব্যবসায়ী পলাশ (ক্রমিক নম্বর ৫০), পথচারী সাদেক হোসেন, রুবেল, আবদুল হান্নান, মাহফুজ খানসহ ছয়জন ভিন্ন জায়গায় নিহত হয়েছে। সাদেক হোসেনের বাবা রইস মিয়া বলেন, আমার ছেলে ঝাড়ের পানির ফিল্টার দোকানে আনা-নেওয়ার কাজ করত। ৬ মে ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডের কাঁচপুরে ঝাড় আনতে গেলে হেফাজত-পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে। সেখানে সে মারা যায়। হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আমার ছেলের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। অধিকারের তালিকায় তাদের শাপলা চত্বরে নিহত বলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে । এমনকি অধিকারের ৬১ জনের তালিকার ১৯ জনের কোনো অস্তিত্বই নেই। তারা হলেন_ মো. মাসুম বিল্লাহ, লুৎফুর রহমান, মাওলানা মোহাম্মদ হাসান, হাফেজ লোকমান হোসেন, আল-আমিন, মাওলানা জুবায়ের, মো. শফিউল্লাহ বাদল, বাবু গাজী, মো. সোহেল, সেকান্দার আলী, ফকির ইবনে মাইজুদ্দিন ফকির, মো. সুলতান, রাজীব, মাওলানা মুতীয়র রহমান, সাবি্বর, তাহের, সাইদ, জালাল আহমেদ ও সিরাজুল।অধিকারের প্রতিবেদনে তাদের অধিকাংশের নামের সামনে পূর্ণাঙ্গ কোনো ঠিকানা লেখা হয়নি। শুধু জেলার নাম লেখা হয়েছে।

অধিকারের প্রতিবেদনে নিহত বলে উল্লেখ করা তিনজনকে জীবিত পাওয়া গেছে।এদের মধ্যে সোহেল উজানী মাদ্রাসার ছাত্র। বাড়ি-চাঁদপুর। এ ছাড়া রাজশাহীর বাগমারার জাহিদুল ইসলাম সৌরভ ও কুমিল্লার জসিম উদ্দিন রয়েছেন।অধিকারের তালিকায় ৫৭ নম্বর ক্রমিকের জসিম উদ্দিন , ৪৯ নম্বর ক্রমিকের মুতীয়র রহমান ও ৩৬ নম্বর ক্রমিকের জাহিদুল ইসলাম সৌরভকে মৃত বলে দাবি করা হয়। পুলিশ খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, হেফাজতের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় যে ১৩ জন নিহত হয়েছে বলে সরকার স্বীকার করেছে, অধিকারের তালিকায় তাদের মধ্যে ৯ জনের নাম রয়েছে। পুলিশের ধারণা, তালিকাভুক্ত অন্যরা পৃথক ঘটনায় পৃথক স্থানে মারা যেতে পারেন। তাদের ব্যাপারেও অনুসন্ধান করা হচ্ছে।

অধিকারের পরিচালক এসএসএম নাসির উদ্দিন এলানের মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি। পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, অধিকারের কার্যালয় থেকে জব্দ করা ল্যাপটপ থেকে এ তালিকা পাওয়া গেছে।
অধিকারের 'কথিত' তালিকা

৫মে হেফাজতের সমাবেশে শাপলা চত্বরে যারা নিহত হয়েছে বলে দাবি করে অধিকার তালিকা দিয়েছে, তারা হলেন
১. দিনাজপুরের সিদ্দিকুর রহমান
২.দক্ষিণ পাইকপাড়ার একেএম রেহান আহসান
৩. যাত্রাবাড়ীর কাজী রকিবুল হক
৪.গাজীপুর কালীগঞ্জের মো. ইউনূস
৫. মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখানের দ্বীন ইসলাম
৬. ঢাকার লালগঞ্জের নাহিদ
৭. ফরিদপুরের কোতোয়ালির মো. আল-আমিন,
৮. ময়মনসিংহের ভালুকার মাওলানা আবদুল ওয়াহাব মোল্লা,
৯. ফরিদপুরের দুর্গাপুরের হাফেজ আল-আমিন ও ফরিদপুরের মধুখালীর হাফেজ সাদ্দাম,
১০. নারায়ণগঞ্জের কটনমিল জামে মসজিদের ইমাম মুহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ,
১১. ময়মনসিংহ ফুলপুর থানার সুতিয়াপাড়া গ্রামের লুৎফর রহমান,
১২. নরসিংদী দাইয়েরপার গ্রামের নজরুল ইসলাম,
১৩. যশোর রায়পাড়া গ্রামের হাফেজ মোয়াজ্জেমুল হক নান্নু,
১৪. ময়মনসিংহ ফুলপুর সুতিয়াপাড়া গ্রামের হাফেজ আতাউর রহমান,
১৫.ভোলা দৌলতখানের মুহাম্মদ আকবর ইবনে নজরুল ইসলাম
১৬. চট্টগ্রাম সীতাকুণ্ডের গানীয়াতুল মাদ্রাসার প্রভাষক মাওলানা সিহাবুদ্দিন,
১৭. কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানার তেলিগাংদিয়া গ্রামের শামসুল আলম,
১৮. চট্টগ্রামের মিরসরাই বগাচর ফাজিল মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা সিহাব উদ্দিন,
১৯. বরিশাল পাতারহাটের নাহিদ সিকদার
২০. বরিশাল ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের ইউনুস মোল্লা
২১. ফরিদপুরের গালতার মোহাম্মদপুর বাইতুল ফজল ইসলামিয়া মাদ্রাসার ছাত্র সাইদুল বারী
২২. নরসিংদী উত্তর বাখরনগর গ্রামের মোক্তার হোসেন
২৩. গাজীপুর শফিপুর হরিণাহাট গ্রামের মাওলানা শামসুল আলম
২৪. নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পাগারপার ফোরকানিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা মোহাম্মদ হাসান
২৫. নরসিংদীর মাটিরপাড়ার বকুলতলা গ্রামের হাফেজ মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান জুবায়ের
২৬. কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের মাওলানা মাহমুদুল হাসান
২৭. নারায়ণগঞ্জের বাবুরাইলের হাফেজ লোকমান হোসেন
২৮. নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার রামারবাগের আল-আমিন
২৯. মুন্সীগঞ্জের বালুচরের সাপেরচর এলাকার মাওলানা জুবায়ের
৩০. গাজীপুরের কালীগঞ্জের দুরবাটি এলাকার শফিউল্লাহ বাদল
৩১. চাঁদপুরের কচুয়ার সেনবাড়ীর দায়চর গ্রামের হাবিবুল্লাহ মুন্সী
৩২. ময়মনসিংহের খলিফার পাড় মাশকান্দা পলিটেকনিক মোড় এলাকার সিরাজুল ইসলাম
৩৩. শরীয়তপুরের নড়িয়ার বাবু গাজী
৩৪. রাজশাহীর বাগমারার নিমাই কাশারীর জাহিদুল ইসলাম সৌরভ
৩৫. চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্র আনোয়ার
৩৬. চট্টগ্রামের মেখল মাদ্রাসার ছাত্র শাহাদাত
৩৭. কুমিল্লার দাউদকান্দির সোহেল
৩৮. বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার শিববাদীর কাতলা এলাকার সেকান্দার আলী ফকির
৩৯. একই এলাকার ইবনে মাইজুদ্দিন ফকির
৪০. চাঁদপুরের শেখদী গ্রামের মাহফুজ খান
৪১. ফরিদপুরের সালথা থানার ইউসুফদিয়া গ্রামের হাফেজ সাইদুর রহমান
৪২. নোয়াখালীর মাওলানা আনোয়ার হোসেন
৪৩. বরিশালের মুলাদীর তায়েফা গ্রামের হারুনুর রশিদ
৪৪. রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর কোনাবাড়ী এলাকার সুলতান
৪৫. ডেমরার কাজলা ভাঙ্গা এলাকার রাজীব
৪৬. নরসিংদীর রায়পুরার আদিয়াবাদ মধ্যপাড়া গ্রামের আবদুল হান্নান
৪৭. চাঁদপুর উজানী মাদ্রাসার ছাত্র সোহেল
৪৮. কুমিল্লার মাওলানা মুতীয়র রহমান
৪৯. নারায়ণগঞ্জের মাদানীনগরের ওয়ার্কশপ ব্যবসায়ী পলাশ
৫০. ঢাকার ডেমরার বক্সনগরের সাদেক হোসেন
৫১.ঢাকার ডেমরার রুবেল
৫২. ঢাকার ডেমরার সাবি্বর
৫৩. ঢাকার ডেমরার তাহের
৫৪.ঢাকার ডেমরার আবু সাঈদ
৫৫.কুমিল্লার জসিম উদ্দিন
৫৬. ঢাকার মতিঝিলের জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ম্যানেজার কামাল উদ্দিন খান
৫৭. গাজীপুরের টঙ্গীর মোদাফানা মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা আতাউল্লাহ
৫৮. পটুয়াখালীর ইব্রাহিম খলিল
৫৯.শরীয়তপুরের জালাল আহমেদ
৬০.কুমিল্লার সিরাজুল ইসলাম।

http://khoborbangla.com/

Thursday, August 29, 2013

আপনাকে ধন্যবাদ- হাসান মাহমুদ



৩১শে আগস্ট ৩০ মুক্তিসন (২০০০ সাল)(৪০ মুক্তিসন ২০০০ সাল থেকে প্রতি বছর ৩১শে আগষ্টে আমি এটা পোষ্ট করি - হাসান মাহমুদ)

আবার এগিয়ে আসছে ভয়াল সেই ৩১শে আগষ্ট। আজ আবার আপনাকে হৃদয়ের গভীরতম স্পন্দন থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি, যেমন জানিয়েছি গত ২৫টি বছরের প্রতিটি ৩১শে আগষ্টে। জানাতে থাকব যতদিন বেঁচে আছি.
আপনাকে দেখেছি মাত্র কয়েক সেকেণ্ড। আপনিও আমাদের দেখছেন মাত্র কয়েক সেকেণ্ড, তাই নিশ্চয় আমাদের কথা আপনার মনে নেই। কিন্তু আপনি যদি ১৯৭৫ সালে ৩১শে আগষ্টে সন্ধ্যায় তেজগাঁ এয়ারপোর্টে (তখনও নুতন এয়ারপোর্ট হয়নি)কর্মরত ইমিগ্রেশন-বস্‌ হয়ে থাকেন, আপনাকে জানাতে চাই আপনাকে আমরা দু’জন কখনো ভুলিনি। পৃথিবীর যেখানেই থাকি এই দিনে আমরা ফোনে সেই দুঃসহ দিনের স্মৃতিচারণ করি আর আপনার উদ্দেশ্যে বলি - ‘‘আপনাকে অনেক, - অনেক ধন্যবাদ’’।

প্রতিটি বিপ্লবের সরব ধ্বংসের পর আসে প্রতিবিপ্লবের নীরব ধ্বংস। এসেছিল বাংলাদেশেও, একাত্তরের পর। সবার হাতে অস্ত্র - ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের তারুণ্য-শক্তি। মতের ভিন্নতা, জেদ, অনভিজ্ঞতা, লোভ আর প্রতিহিংসা-পরায়ণতায় আরো অনেক জীবন ধ্বংস হয়েছিল যা ইতিহাসে জায়গা পায়নি। আমার সদ্য পাওয়া চাকরীটা যায় যায় কারণ অফিসে যাওয়া-আসাও তখন কঠিন। মরিয়া হয়ে আমি আর মঞ্জু দেশ ছাড়ার চেষ্টা করছি। আর্থিক গরীব দু’টি তরুণ – টাকা, যোগাযোগ, গন্তব্য কিছু ঠিক করা নেই - শুধু চেষ্টা চলে যাবার - অন্য কোথা, অন্য কোনখানে। বিস্তর মহাভারত পার হয়ে ফ্লাইট পাওয়া গেল ১৫ই আগষ্ট ১৯৭৫।
গন্তব্য দুবাই। জায়গাটা মধ্যপ্রাচ্যে এইটুকু শুধু জানি - ওখানে আমাদের কেউ নেই।

হিমালয় টলে গেল ভোর রাতে, সপরিবারে খুন হয়ে গেলেন জাতির পিতা। ফ্লাইট বাতিল।আবার অসহ্য অপেক্ষা। ৩১ আগষ্ট বিকেলে মঞ্জু ছুটে এল - দু ঘন্টা পরে ফ্লাইটের সিট পাওয়া গেছে, এখনি পৌঁছতে হবে এয়ারপোর্ট। বাবা-মা ভাইবোন কেউ জানল না, তড়িঘড়ি সামনে কাপড় যা ছিল আর এমএসসি'র সার্টিফিকেট স্যুটকেসে ভরে ছুট। ততক্ষণে সবাই ভেতরে ঢুকে গেছে - প্লেন ছাড়ে ছাড়ে । ইমিগ্রেশন-ক্লার্কের হাতে পাশপোর্ট টিকিট তুলে দিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছি। উত্তেজনায় কিছু হার্টবিট মিস হয়ে যাচ্ছে, চোখেমুখে খুব গরম লাগছে - পা দু’টো পাথরের মত ভারী। কারণ, - আমাদের পাশপোর্ট ‘‘খারাপ’’. আমাদের টিকিটও ‘‘খারাপ’’।

লোকটা পাশপোর্ট-টিকিট দুটো লম্বা সময় হাতে ধরে থাকল। তারপর খুব ধীরে ধীরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। তারপর মরা মাছের চোখের মত ভাবলেশহীন চোখে আমাদের দিকে অপলক তাকাল, - চুপ করে তাকিয়েই থাকল। তার মানে তার অভিজ্ঞ চোখে আমরা ধরা পড়ে গেছি। আমরা জন্ম-ক্রিমিন্যাল নই, পারফেক্ট ক্রাইম করতে পারিনি। ভয় পাবার শক্তিও তখন আমাদের নেই। প্রচণ্ড মানসিক চাপে উত্তেজনায় প্রায় অজ্ঞান হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, ভয়ে আতংকে মঞ্জু শক্ত করে চেপে ধরেছে আমার হাত।
ওদিকে প্লেন ছাড়ে ছাড়ে।


তখন আপনি এলেন, ইমিগ্রেশন চীফ। ঠিক এলেন না, গটগট করে ওদিকে কোথা থেকে কোথা যেন যাচ্ছিলেন। ক্লার্কটা কিউবিক্‌ল থেকে বেরিয়ে আপনার কাছে গেল, আপনি থমকে দাঁড়ালেন। সে আপনাকে পাশপোর্ট-টিকিট দেখিয়ে কি যেন ফিসফিস করল। আমরা তখন দু’টো স্থির মৃতদেহ দাঁড়িয়ে আছি। আপনি আমাদের দিকে ফিরে তাকালেন - আতংকে ত্রাসে পাথর আমরা আরো পাথর হয়ে গেলাম।

এই ৩৭ বছর পরেও হুবহু এখনো কানে বাজে আপনার জলদগম্ভীর কন্ঠস্বরে জীবনের বরাভয় - ‘‘লেট দেম ট্রাই দেয়ার লাক্‌’।

বলেই আপনি গট গট করে চলে গেলেন। লোকটা ফিরে এসে আমাদের পাশপোর্টে ষ্ট্যাম্প মেরে আমাদের বিদায় করল। ছুটে এসে প্লেনে উঠলাম, প্লেন আকাশে উঠল, বুক তখনো ধ্বকধ্বক করছে। আতংকে উত্তেজনায় মঞ্জুর তখন খুব জ্বর উঠে গেছে, আমার হাত ধরে সে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল - ‘‘এভাবে আমরা কোথায় যাচ্ছি? আমাদের কি হবে? আমাদের টাকা কই’’?? তখন খোলা বাজারে বিদেশী মুদ্রা বেআইনী ছিল, মঞ্জু কোত্থেকে একশ পাউণ্ড জোগাড় করে এক মাস্তান-চীফকে দিয়েছিল। কথা ছিল তার লোক প্লেনের মধ্যে আমাদের ওই টাকা দেবে। সে টাকা এলনা। তার মানে আমরা কপর্দকশুন্য।



পরের মহাভারত বলে আপনার সময় নেবনা কিন্তু দু’টো কথা বলতেই হবে। দুবাই-ইমিগ্রেশন ক্লার্কের চোখও অভিজ্ঞ ছিল, ধরা আমরা সেখানেও পড়েছিলাম। কিন্তু সেখানে সেই মাঝরাতে আপনার মত ইমিগ্রেশন চীফ ছিলনা যিনি দুটি অনভিজ্ঞ তরুণের সামনে জীবনের দরজা খুলে দেবেন। আমাদের পাশপোর্ট আটক হল, আমরাও আটক হলাম। কেউই বোধহয় জানেনা প্রতিটি বিমানবন্দরে ছোট্ট একটা জেলখানা থাকে। সারা রাত বন্দী থেকে পরদিন দুপুরে আমরা দুজন সেখান থেকে কিভাবে পালালাম সেকথা থাক, কি অবস্থায় পালালাম সেকথা বলে শেষ করি।

তখন আমাদের (১) পরণের কাপড় ছাড়া কোন কাপড়, স্যাণ্ডেল-টুথব্রাশ-রেজর-চিরুণী কিচ্ছু নেই কারণ স্যুটকেস চিরতরে কোথায় হারিয়ে গেছে, কোনদিনই আর সেগুলো ফিরে পাইনি. (২) কোন শিক্ষা-সার্টিফিকেট নেই, কারণ ওগুলো স্যুটকেসে ছিল, (৩) পকেটে একটা পয়সা নেই, (৪) কোন বন্ধুবান্ধব আত্মীয় স্বজন নেই, (৫) জায়গা চিনি না, (৬) ভাষা জানি না, (৭) ভিসা নেই, কারণ (৮) পাশপোর্টই নেই. আর, এই সবগুলোর চেয়ে আরো অনেক মারাত্মক - (৯)আগষ্টের মধ্যপ্রাচ্য, দোজখের গরম!!

কিন্তু আপনি জেনে রাখুন আপনার শুভেচ্ছা ব্যর্থ হয়নি। সবদিক দিয়ে ভয়াবহ অবস্থা থেকে শুরু করে সেই দুটি তরুণ দানবের শক্তিতে জীবন-যুদ্ধ করেছে এবং পরিপুর্ণ সফল হয়েছে। এখন তারা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দু’টো দেশের বৈধ নাগরিক। সাধারণ মানুষের যা চাইবার তা সবই তারা অর্জন করেছে। শুধু তাই নয় তারা আপনার ঋণ শোধ করার চেষ্টাও করেছে- বেশ কিছু কিশোর-তরুণদের লাক্‌ ট্রাই করার সুযোগ করে দিয়েছে। যাদেরকে দিয়েছে তাদের অনেকেই আজ জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত, - তারাও একদিন পরের প্রজন্মকে সুযোগ করে দেবে। সমাজ এভাবেই এগোয়, মানুষই মানুষের কাজে আসে।

আপনি যেখানেই থাকুন শান্তিতে থাকুন এই কামনা করে আবারো বলি - আপনাকে অজস্র ধন্যবাদ।

Sunday, August 25, 2013

বাংলা গানের অমরাবতী -প্রথম বাংলা গজল রচয়িতা অতুলপ্রসাদ সেনের ৭৯ তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ



অতুলপ্রসাদ এর উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথের লেখা

বন্ধু, তুমি বন্ধুতার অজস্র অমৃতে
পূর্ণপাত্র এনেছিলে মর্ত্য ধরণীতে।
ছিল তব অবিরত
হৃদয়ের সদাব্রত,
বঞ্চিত কর নি কভু কারে
তোমার উদার মুক্ত দ্বারে।

মৈত্রী তব সমুচ্ছল ছিল গানে গানে
অমরাবতীর সেই সুধাঝরা দানে।

সুরে-ভরা সঙ্গ তব
বারে বারে নব নব
মাধুরীর আতিথ্য বিলাল,
রসতৈলে জ্বেলেছিল আলো।
দিন পরে গেছে দিন, মাস পরে মাস,
তোমা হতে দূরে ছিল আমার আবাস।
"হবে হবে, দেখা হবে' --
এ কথা নীরব রবে
ধ্বনিত হয়েছে ক্ষণে ক্ষণে
অকথিত তব আমন্ত্রণে।
আমারো যাবার কাল এল শেষে আজি,
"হবে হবে, দেখা হবে' মনে ওঠে বাজি।
সেখানেও হাসিমুখে
বাহু মেলি লবে বুকে
নবজ্যোতিদীপ্ত অনুরাগে,
সেই ছবি মনে-মনে জাগে।
এখানে গোপন চোর ধরার ধুলায়
করে সে বিষম চুরি যখন ভুলায়।
যদি ব্যথাহীন কাল
বিনাশের ফেলে জাল,
বিরহের স্মৃতি লয় হরি,
সব চেয়ে সে ক্ষতিরে ডরি।
তাই বলি, দীর্ঘ আয়ু দীর্ঘ অভিশাপ,
বিচ্ছেদের তাপ নাশে সেই বড়ো তাপ।
অনেক হারাতে হয়,
তারেও করি নে ভয়;
যতদিন ব্যথা রহে বাকি,
তার বেশি যেন নাহি থাকি


শান্তিনিকেতন, ১৯ ভাদ্র, ১৩৪১

অতুলপ্রসাদ সেন (২০শে অক্টোবর, ১৮৭১- ২৬শে আগস্ট, ১৯৩৪) ছিলেন একজন বিশিষ্ট বাঙালি গীতিকার, সুরকার ও গায়ক। তিনি একজন বিশিষ্ট সংগীতবিদও ছিলেন। তাঁর রচিত গানগুলির মূল উপজীব্য বিষয় ছিল দেশপ্রেম, ভক্তি ও প্রেম। তাঁর জীবনের দুঃখ ও যন্ত্রণাগুলি তাঁর গানের ভাষায় বাঙ্ময় মূর্তি ধারণ করেছিল; "বেদনা অতুলপ্রসাদের গানের প্রধান অবলম্বন"।

অতুলপ্রসাদ সেনের পারিবারিক ভিটে দক্ষিণ বিক্রমপুরের মাগর-ফরিদপুর গ্রামে। তিনি ঢাকায় তাঁর মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। অতি অল্পবয়সেই অতুলপ্রসাদ পিতৃহারা হন। এরপর তাঁর দাদামশায় কালীনারায়ণ গুপ্ত তাঁকে প্রতিপালন করেন। দাদামশায়ের নিকটই সংগীত ও ভক্তিমূলক গানে তাঁর হাতেখড়ি। লক্ষ্মৌতে তিনি যেখানে বাস করতেন তার জীবনকালেই তার নামে ঐ রাস্তার নামকরণ করা হয়। তার উপার্জিত অর্থের একটি বড় অংশ তিনি স্থানীয় জনসাধারণের সেবায় ব্যয় করেন। তার বাড়ী এবং গ্রন্থস্বত্বও তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দান করে গেছেন।

অতুলপ্রসাদ বাংলা গানে ঠুংরি ধারার প্রবর্তক। তিনিই প্রথম বাংলায় গজল রচনা করেন। তাঁর রচিত বাংলা গজলের সংখ্যা ৬-৭টি।গীতিগুঞ্জ (১৯৩১) গ্রন্থে তাঁর সমুদয় গান সংকলিত হয়।[৪] এই গ্রন্থের সর্বশেষ সংস্করণে (১৯৫৭) অনেকগুলি অপ্রকাশিত গান প্রকাশিত হয়। অতুলপ্রসাদের গানের সংখ্যা ২০৮।
অতুলপ্রসাদ সেনের কয়েকটি বিখ্যাত গান হল "মিছে তুই ভাবিস মন", "সবারে বাস রে ভালো", "বঁধুয়া, নিঁদ নাহি আঁখিপাতে", "একা মোর গানের তরী", "কে আবার বাজায় বাঁশি", "ক্রন্দসী পথচারিণী" ইত্যাদি। তাঁর রচিত দেশাত্মবোধক গানগুলির মধ্যে প্রসিদ্ধ "উঠ গো ভারত-লক্ষ্মী", "বলো বলো বলো সবে", "হও ধরমেতে ধীর"।
তাঁর "মোদের গরব, মোদের আশা" গানটি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। অতুলপ্রসাদের গান "দেবতা", "প্রকৃতি", "স্বদেশ", "মানব" ও "বিবিধ" নামে পাঁচটি পর্যায়ে বিভক্ত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই গানের বিশেষ গুণগ্রাহী ছিলেন। "অতুলপ্রসাদী গান" নামে পরিচিত এই ধারার একজন বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়।

হাসির রাজা ভানু বন্দোপাধ্যায়ের ৯৩ তম জন্মদিন আজ



"মাসীমা, মালপো খামু! "

বাংলা চলচ্চিত্র জগতে যদি সেরা দশটি সংলাপের তালিকা কোনোদিন তৈরি করা হয়, তাহলে ওপরের সংলাপটি নিশ্চিতভাবে তারমধ্যে স্থান পাবে। কোন ছবি, সেটা আপামর বাঙালীর ঠোঁটের ডগায়। এই সেই ছবি, যেখান থেকে সূচনা হয়েছিল বাংলা ছবির এক সোনালী অধ্যায়। কিন্তু সে তো অন্য গল্প। আপাতত যাঁর মুখ দিয়ে এই সংলাপ বেরিয়েছিল, তাঁর কথা স্বল্প-পরিসরে বলা যাক। তিনি আমাদের সবার প্রিয় শ্রী ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।

পোষাকী নাম ছিল সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায়, আর জন্মস্থান? এরকম চোস্ত বাঙাল ভাষা যিনি বলতেন, তিনি যে পূর্ববঙ্গেরই হবেন, সে নিয়েও কোন সন্দেহ থাকা উচিত নয়। ভানু জন্মেছিলেন বিক্রমপুর জেলার মুন্সীগঞ্জে � এই সেই বিক্রমপুর, যা কিনা বহু নামজাদা লেখক-শিল্পী-ডাক্তার-মোক্তার-আমলা-হাকিম, এমনকী পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীরও জন্মস্থান। এইরকম একটি খ্যাতনামা অঞ্চল থেকেই উত্থান হয়েছিল ভানুর। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে হাস্যকৌতুকের সংজ্ঞাটাই বদলে দিয়েছিলেন তিনি।

ভানু জন্মেছিলেন ১৯২০ সালের ২৭শে অগাস্ট। সেন্ট গ্রেগরি�স হাই স্কুল এবং জগন্নাথ কলেজে শিক্ষার পাট শেষ করে কলকাতায় আসেন ১৯৪১ সালে। এখানে এসে তিনি আয়রন এন্ড স্টীল কম্পানি নামে একটি সরকারি অফিসে যোগ দেন, এবং বালীগঞ্জের অশ্বিনী দত্ত রোডে তাঁর দিদির কাছে দু�বছর থাকার পর টালিগঞ্জের চারু অ্যাভিন্যু তে পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেন।

ভানুর অভিনয়-জীবন শুরু হয় ১৯৪৭-এ, �জাগরণ� ছবির মাধ্যমে�দেশ স্বাধীন হওয়ার এই সময়টিকেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন নিজের চাকরিজীবনের শৃংখলামুক্তির জন্যে। সেই বছরই �অভিযোগ� নামে অন্য একটি ছবি মুক্তি পায়। এরপর ধীরে ধীরে ছবির সংখ্যা বাড়তে থাকে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল �মন্ত্রমুগ্ধ�(১৯৪৯), �বরযাত্রী�(১৯৫১) এবং �পাশের বাড়ি�(১৯৫২)।
এরমধ্যে �বরযাত্রী� ছবিটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যদিও সেখানে ভানুর উপস্থিতি সামান্যই ছিল।

bhanu banerjee at the 1955 ভানু বাঙালের কিস্স্যা!
১৯৫৫�র উলটোরথ পুরস্কার অনুষ্ঠানে � রাজেন সরকার, সুচিত্রা সেন ও উত্তমকুমারের সাথে।

১৯৫৩ সালে মুক্তি পেল �সাড়ে চুয়াত্তর�, এবং বলা যেতে পারে যে এই ছবির মাধ্যমেই ভানু দর্শকদের নিজের অভিনয়ের গুণে আকৃষ্ট করা শুরু করেন। এর পরের বছর মুক্তি পায় �ওরা থাকে ওধারে��ঘটি-বাঙালের চিরন্তন বচসা নিয়ে এই ছবি, এবং এখানে ভানুর অভিনয় অনবদ্য। এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে এই ছবিতে উত্তমকুমার এবং সুচিত্রা সেন থাকা সত্তেও কিন্তু ভানু তাঁদের পাশে সমানভাবে উজ্জ্বল ছিলেন, বাঙাল গৃহস্বামীর শ্যালক হিসাবে অভিনয় করেছিলেন তিনি।

with jahar roy and ajit chatterjee1 ভানু বাঙালের কিস্স্যা!
জহর রায় ও অজিত চ্যাটার্জির সাথে।

১৯৫৮ সালটি ভানুর জীবনে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, ওই বছরে মুক্তি পাওয়া অনেক ছবির মধ্যে দু�টি ছিল �ভানু পেল লটারি� এবং �যমালয়ে জীবন্ত মানুষ��এর মধ্যে প্রথম ছবিটি থেকে ভানু-জহরের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল। গ্রাম্য ভানুর সেই �জহুরে� সম্বোধন এক কথায় অনবদ্য। জহর রায়ের সঙ্গে ভানুর একটা অসম্ভব রসায়ন ছিল, তাঁদের কমিক টাইমিং, সংলাপ বলার ধরন এবং দুজনের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং এতটাই ছিল যে সেইসব ছবি যারা না দেখেছেন তাদের পক্ষে অনুধাবন করা শক্ত। অবশ্য ভানু-জহর জুটির ছবি দেখেননি, এরকম বাঙালী মনে হয় খুব বেশি নেই।

�যমালয়ে জীবন্ত মানুষ� বাংলা ফিল্ম ইতিহাসে একটি মাইলস্টোন। কাহিনীর বিশদ বর্ণনায় যাচ্ছি না, কিন্তু স্বর্গে গিয়ে ভানু যখন সব দেবতাদের সঙ্গে কথা চালাচ্ছিলেন, এবং তাঁদের যারপরনাই নাজেহাল করছিলেন, সেই দৃশ্যগুলি একদম সাজিয়ে রাখার মতন। এরমধ্যে চিত্রগুপ্তরূপী জহর রায়ের সঙ্গে ভানুর কথোপকথনগুলি দুর্ধর্ষ। দু�একটি নমুনা পেশ করা যাক -

নমুনা একঃ

ভানুঃ অকালমৃত্যুই যদি হবে, তবে জন্মালো কেন?

জহরঃ আজ্ঞে, ঠিকই তো, আমার সব কিরকম গুলিয়ে যাচ্ছে!

নমুনা দুইঃ

জহরঃ আজ্ঞে, সে আপনি ঠিক বলেছেন, দেবতারা যত না খাচ্ছেন, তার থেকে বেশি ছড়াচ্ছেন।

ভানুঃ ছড়াচ্ছেন! ছড়ানো বের করছি, একবার ফিরে যাই, কন্ট্রোলের লাইনে চালের জন্য যারা গুঁতোগুতি করছে, তাদের কাছে ব্যাপারটা ফাঁস করে দিচ্ছি; এরপর তারা যখন স্বর্গরাজ্যে এসে হামলা চালাবেন, তখন কত্তারা বুঝবেন ফুড ক্রাইসিস কাকে বলে!

জহরঃ হেঁ হেঁ হেঁ�তা তো বটেই!

ওখানেই নারদরূপী পাহাড়ি সান্যাল যখন সবে গান ধরার আগে গলা সাধছেন, ভানুর বক্তব্যঃ না না, চলবে না, আধুনিক জানা আছে? না জানলেও ক্ষতি নেই, আমি শিখিয়ে নেব�খন, গলা কাঁপাতে পারেন তো?

�যমালয়ে জীবন্ত মানুষ�-এর আরেকটি অসামান্য মুহূর্ত ছিল �হাম-হাম-গুড়ি-গুড়ি নাচ�, যেটা ভানু ঊর্বশী কে শেখাচ্ছিলেন!! বাংলা কমেডি ছবির ইতিহাসে এই দৃশ্যটি অমর হয়ে থাকবে।

১৯৫৯-এ মুক্তি পায় �পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট��এই ছবিতে ভানু নায়কের ভুমিকায় অভিনয় করেন, বিপরীতে ছিলেন রুমা গুহঠাকুরতা। শুধুমাত্র কৌতুক-অভিনেতাই যে তিনি নন, সেটা তিনি এই ছবিতেই প্রমাণ করে দিয়েছেন। তাঁর লিপে দু�টি গানও ছিল এই ছবিতে, এবং সেইসঙ্গে ছিল কিছু সোনায়-বাঁধানো সংলাপ, যেমনঃ আজ্ঞে আমার আসল নাম রমাপদ, কিন্তু বন্ধুরা �পদ�-ছাড়া করেছে!

এই ছবিতেই ছিল পিয়ানোকে টাইপরাইটার ভেবে ভানুর শিক্ষাদান � এরকম হাসির মুহূর্ত বাংলা ছবিতে খুব বেশি নেই।

ben ashite ashio na2 ভানু বাঙালের কিস্স্যা!

১৯৬৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত �৮০তে আসিও না� ছবিটিতেও ভানু নায়কের ভুমিকায় অভিনয় করেন, এবং এখানেও ওনার বিপরীতে ছিলেন রুমা দেবী। এই ছবিতে মান্না দে�র কন্ঠে তাঁর লিপে �তুমি আকাশ কখনো যদি হতে, আমি বলাকার মত পাখা মেলতাম, পাখা মেলতাম�� গানটি খুবই রোম্যান্টিক এবং সেই সঙ্গে মজারও বটে। এই ছবিতেও প্রচুর দমফাটা হাসির মুহূর্ত আছে, পুকুরে ডুব দিয়ে পুনর্যৌবন-প্রাপ্ত হওয়া নিয়ে লোকজনের মধ্যে বিভ্রাট এবং বিতন্ডা খুবই উপভোগ্য। এখানে জহরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকায় ছিলেন।

smoking a bidi at ভানু বাঙালের কিস্স্যা!
�মিস প্রিয়ংবদা�র সেটে � লিলি চক্রবর্তী ও প্রেমাংশু বোসের সাথে।

১৯৬৭ সালে ভানুর আরো একটি ছবি মুক্তি পায়, �মিস প্রিয়ংবদা� � যেখানে উনি চরিত্রের প্রয়োজনে মহিলা সেজে অতুলনীয় অভিনয় করেন। এখানে ওনার বিপরীতে ছিলেন লিলি চক্রবর্তী।

ভানুর সম্পর্কে আলোচনা �ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট� ছবির উল্লেখ ছাড়া অসমাপ্ত রয়ে যাবে। এই ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৭১ সালে, এবং ভানু-জহর জুটির শ্রেষ্ঠ ছবি বলা যেতে পারে। এই ছবির প্রথম দৃশ্যে যখন এনাদের আবির্ভাব হয়, সেই প্রথম দৃশ্য থেকেই দর্শককে মাতিয়ে রাখে এই জুটি।


ট্রাক লিস্টঃ

ভানু বন্দোপাধ্যায়\ইলেকশন
ভানু বন্দোপাধ্যায়\এমনও দিন আস্তে পারে-১
ভানু বন্দোপাধ্যায়\এমনও দিন আস্তে পারে-২
ভানু বন্দোপাধ্যায়\কর্তা-গিন্নি
ভানু বন্দোপাধ্যায়\কর্তাবাবুর দেশ ভ্রমণ
ভানু বন্দোপাধ্যায়\কলকাতা ও ভদ্রতা (গৌতম বন্দোপাধ্যায়)
ভানু বন্দোপাধ্যায়\ঘটক সংবাদ
ভানু বন্দোপাধ্যায়\চন্দ্রগুপ্ত-১
ভানু বন্দোপাধ্যায়\চন্দ্রগুপ্ত-২
ভানু বন্দোপাধ্যায়\টেলিফোন বিভ্রাট
ভানু বন্দোপাধ্যায়\দুর্গা দুর্গতিনাশিনী
ভানু বন্দোপাধ্যায়\নব রামায়ন
ভানু বন্দোপাধ্যায়\নাইকা সন্ধানে -হরিনারায়ন চক্রবর্তী
ভানু বন্দোপাধ্যায়\পরিবার পরিকল্পনা
ভানু বন্দোপাধ্যায়\ফটিকলাল
ভানু বন্দোপাধ্যায়\ভানু এলো কোলকাতায় -১
ভানু বন্দোপাধ্যায়\ভানু এলো কোলকাতায় -২
ভানু বন্দোপাধ্যায়\ভানু এলো কোলকাতায় -৩
ভানু বন্দোপাধ্যায়\ভানুশ্বরেনান্দ
ভানু বন্দোপাধ্যায়\যুগের অভিযোগ -হরিনারায়ন মুখার্যী
ভানু বন্দোপাধ্যায়\রাজ-জোটক
ভানু বন্দোপাধ্যায়\লর্ড ভনু
ভানু বন্দোপাধ্যায়\সঙ্গীতচয়ন
ভানু বন্দোপাধ্যায়\সাংসারিক প্যাচাল-পবিত্র মিত্র
ভানু বন্দোপাধ্যায়\সার্বজনীন যমপূজা (-হরিনারায়ন চক্রবর্তী)-১
ভানু বন্দোপাধ্যায়\সার্বজনীন যমপূজা (-হরিনারায়ন চক্রবর্তী)-২
ভানু বন্দোপাধ্যায়\সিনেমা বিভ্রাট (পবিত্র মিত্র)
ভানু বন্দোপাধ্যায়\স্পুটনিক
ভানু বন্দোপাধ্যায়\হনুমানের নগরদর্শন
ভানু বন্দোপাধ্যায়\হরিদাস পালের গুপ্তকথা রূপদর্শন
http://www.banglatorrents.com

Saturday, August 17, 2013

জামাতে-পিছলামি বনাম জামাতের পিছলামি- হাসান মাহমুদ


০৯ই আগষ্ট ৪৩ মুক্তিসন (২০১৩)


ছদ্মনামে জামাতকে ব্যঙ্গ করে বছর বিশেক আগে "আল ভোঁদড়" জাতীয় ছড়া আর নিবন্ধ লিখতাম, জামাতে পিছলামী ডট কম ছিল আমার ওয়েবসাইটের নাম । বছর দশেক হল ওগুলো বাদ দিয়েছি যখন বুঝেছি ধর্মের ব্যাপারে ব্যঙ্গ করে লাভ নেই। বিতর্কেও লাভ নেই কারণ বিতর্ক হল বাকযুদ্ধ, - যুদ্ধে প্রথম নিহত হয় সত্য। তার চেয়ে আলাপ আলোচনা ভালো, কেউ মানলে ভালো না মানলে লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালিয়া দ্বীন। যাহোক জামাতে-পিছলামী বন্ধ করেছি কিন্তু ওদিকে প্রবলবেগে চলছে জামাতের নানা রকম পিছলামী। আলোচনার আহ্বান থেকে পিছলিয়ে যাওয়া জামাতের বৈশিষ্ট্য।


(1) জামাত দেশে একটা বড় পরিবর্তন আনতে চায়। ভালো !! কিন্তু দেশটা যেহেতু জামাতের বাপের সম্পত্তি নয় তাই এ ব্যাপারে আলোচনার অধিকার আমাদের আছে এবং সে আলোচনা করতে জামাত আইনগত না হলেও নীতিগতভাবে বাধ্য। জামাতের মৌদুদীবাদ কোরান-রসুল ও মানবাধিকারের প্রতি কি মারাত্মক বিশ্বাসঘাতকতা তা তো আমি দলিল ধরে ধরে জানি। জাতিকে এ দলিলগুলো জানানো দরকার, তাই আমি জামাতের ওয়েবসাইটে যে কন্ট্যাক্ট ঠিকানা আছে তাতে বছর দশেক আগে অন্তত: ১০টা চিঠি দিলাম - আসুন ভিডিও ক্যামেরার সামনে আলোচনা করি যাতে জাতি তা দেখতে পারে, একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কারো কোনো ভুল থাকলে এ আলোচনায় সেটা শুধরে নেয়ার সুযোগ হবে, জাতিও এ ব্যাপারে শিক্ষিত হবে। পিছ্লিয়ে গেল জামাত।


(2) তারপর ভাবলাম নিউইয়র্কের বাংলা সাপ্তাহিকে বিজ্ঞাপনে আলোচনার ডাক দেয়া যাক। এক বন্ধুকে চেপে ধরাতে সে নিজের টাকায় অর্ধেক পৃষ্ঠার ঢাউস বিজ্ঞাপন দিল। নিউইয়র্ক জুড়ে তো জামাতিরা কিলবিল করছে, খবরটা নিশ্চয় পৌঁছেছে। কিন্তু জামাত পিছলিয়ে গেল এবারও। গুরুর খাসলত শিষ্য তো পাবেই, মৌদুদীও নাকি তাই করতেন। ১৯৬৭ সালে একদিন এক জামাতি-শিষ্য মৌদুদীকে বলেছিল মাওলানা গোলাম গাউস হাজরাভি মৌদুদীর সমালোচনা করেছেন - কিন্তু মৌদুদী নীরব কেন। মৌদুদী সেই মওলানার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন - "তোমাদের রাগেই তোমরা মর" ("ইসলামী দল ও নেতৃবৃন্দের প্রতি জামায়াতের নীতি"- গোলাম আজম - ইনকিলাব ০৪ জানুয়ারী ২০০৬)।
বড়ই পিছলা নেতা !! দেশে পরিবর্তন আনতে চান কিন্তু সমালোচনার জবাব না দিয়ে পিছলিয়ে যাবেন! সেই জামাতই গায়ে পড়ে পোপ-কে চিঠি দিয়েছে-“মুসলমান ও খৃস্টানদের মধ্যে সম্প্রীতি গড়ে তুলতে আন্ত:ধর্মীয় সংলাপ খুবই প্রয়োজন” সংগ্রাম ১৭ই অক্টোবর ২০০৭।
পিছলামী আর কাকে বলে-এ ব্যাপারে সংলাপের নাকি কোন বিকল্প নেই। পোপ বোধ হয় সে চিঠি পড়েও দেখেননি কারণ আলোচনার কোনো খবর আমরা পাইনি। {কানে কানে বলে রাখি জামাত আজ যতই উল্টা মারুক গো-আজম কিন্তু শেখ মুজিবকে সরাসরি "জাতির পিতা" বলেছেন - ("জীবনে যা দেখলাম"- সংগ্রাম ১৯ ডিসেম্বর ২০০৮)}।

(3) দল হিসেবে জামাত করুক না করুক জামাতি-তত্বে বিশ্বাসী লোকেরাও এতই পিচ্ছিল যে হাতে ছাই মেখেও তাঁদের ধরা মুশকিল। এমন এক ডাক্তার শারীরিক থাকেন লণ্ডনে, মানসিক থাকেন ধর্মীয় উন্মাদনার এক হিংস্র অবাস্তব দেশে। সেকুলার দেশের সম্পদ-সিস্টেম উপভোগ করেন আর সেকুলারিজম ধ্বংসের গর্জন করেন। প্রায়ই জামাতি পত্রিকায় ঢাউস নিবন্ধে ডন কুইক্সোট-এর মত হুহুঙ্কারে বাতাসে জিহাদের তরোয়াল ঘোরান। কোত্থেকে আমার ইমেইল জোগাড় করেছিলেন, কিছুদিন পাঠিয়েছিলেন লিংক। লণ্ডনে আমার ক্লাসফ্রেন্ডরা থাকে, মাঝে মাঝে আড্ডা দিতে যাই। ডাক্তারকে ইমেইল করলাম, “আসুন ভিডিও ক্যামেরার সামনে চায়ের কাপ হাতে একটু বসি”।
ডাক্তার নিশ্চুপে পিছলিয়ে গেলেন।


(4) পশ্চিমা বিশ্বে সর্বপ্রথম দেশের আইন-সমর্থিত শারিয়া কোর্ট ১৪ বছর চলেছিল ক্যানাডার টরন্টো-তে। জানতে পেরে ইমেইল করলাম, "শরিয়ায় সমস্যা আছে, আলোচনা করতে চাই"। জবাব এল- "নিশ্চয়ই, শিগগিরই জানাচ্ছি"।
তারপর পিছলিয়ে গেলেন, সেই শিগগির কোনকালেই আসেনি। আড়াই বছর উথাল-পাথাল ধ্বস্তাধ্বস্তির পর ১৪ বছর ধরে চলে আসা সেই কোর্ট আমরা চিরতরে উচ্ছেদ করেছি।


(5) সেই কোর্টের ঘোর সমর্থক চণ্ডমূর্তি ক্যানাডা'র আল আজহারী মওলানা। তখন আমার প্রধান কাজ ছিল টেলিভিশনে জাতির সামনে শারিয়া আইনগুলো তুলে ধরা ও শারিয়া-পন্থীদের আলোচনায় আহ্বান করা। বিস্তর সাধাসাধির পরে মওলানা এলেন টিভি-অনুষ্ঠানে। কিন্তু আধ ঘন্টায় কতটুকুই বা হয় তাই বললাম ভিডিও ষ্টুডিওতে দু'জন কেতাব পত্র নিয়ে বসি দু-তিন ঘন্টার জন্য। তিনি রাজী হলেন, আমি ষ্টুডিও ভাড়া করলাম। রেকর্ডিং-এর দিনে তিনি পিছলিয়ে গেলেন - বেমালুম লাপাত্তা, তাঁর মোবাইলও বন্ধ। নষ্ট হল আমার টাকাগুলো। পরে কোনোদিনও তিনি ফোনে বা ইমেইল-এ আমাকে স্যরি বা কিচ্ছু বলেন নি। হায়রে শারিয়া-সমর্থক !


(6) পরাক্রমশালী মেধাবী আইন-বিশেষজ্ঞ, অনেক দেশ বিদেশ মহাদেশ করেছেন। পুলকিত হলাম এত হাই প্রোফাইল পণ্ডিত ব্যস্ততার মধ্যে শারিয়া'র ওপরে আমার "ডিভাইন স্টোন" (নারী) মুভিটা দেখে সমালোচনা পোষ্ট করেছেন। কিন্তু অবাক হলাম - শারিয়া নিয়ে কথা সেখানে আমি শত শত বইয়ের হাজার হাজার পৃষ্ঠার মূল হানাফি, শাফি ও অন্যান্য শারিয়া কেতাব, কোরানের তফসির থেকে আইন নম্বর আর পৃষ্ঠা ধরে ধরে দেখিয়েছি আর উনি কম্পিউটার স্ক্রীন-এর সামনে ক্যামেরা ধরে গুগল মেরেছেন । ওটা না করে বা শারিয়া-অনভিজ্ঞ লোকদের উদ্ধৃতি না দিয়ে নিজের প্রজ্ঞা প্রয়োগ করলে আমার লাভ হত। মুভিতে সুত্র ধরে ধরে দেখানো আছে "এই এই শারিয়া আইন মোতাবেক খুন, জখম, চুরি ডাকাতি পরকীয়া মদ্যপান (হুদুদ ও কিসাস) মামলায় নারীসাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়"। তার পরেই মুভিতে আছে- " কোরান-রসুল এসব মামলায় কখনো নারীসাক্ষ্য বাতিল করেন নি"। এটা তো প্রো-ইসলাম হল, আমি কোরান-রসুলের পক্ষেই মুভিটা বানিয়েছি এত পরিশ্রম এত খরচ করে। কেন এটা তাঁর কাছে ইসলাম-বিরোধী মনে হল জানলে সেটা মেরামত করব ভেবে ফেসবুকে অনুরোধ পাঠালাম আলোচনার জন্য। সরাসরি "না" বলে দিলেন তিনি। নিশ্চুপে পিছলিয়ে যাবার চেয়ে সেটা বরং অনেক ভালো। বাই দি ওয়ে, সৌদি আরবে মালিকি শরিয়া চলে না, চলে হাম্বলী শরিয়া।


(7) এবারে জামাতের অঘোষিত তত্ত্বগুরু শাহ আব্দুল হান্নান। মন্ত্রনালয়ের প্রাক্তন সেক্রেটারী, ইসলামী ব্যাংক-এর প্রাক্তন চেয়ারম্যান। বহু আগে থেকেই ইয়াহুগ্রুপে আদবের সাথে তর্ক করেছি, দুএকবার তিনি কিঞ্চিৎ ফাউল কথা বলেছেন আমি সহ্য করে গেছি কারণ তিনি বর্ষীয়ান সম্মানিত মানুষ। বিস্তারিত আলোচনায় এসেছিলেন মাত্র একবারই। উনি দাবী করছিলেন জামাত গণতান্ত্রিক দল, আমি দাবী করছিলাম গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে জামাত পৃথিবীতে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় শত্রু। উনি দিচ্ছিলেন ব্যক্তিগত মতামত, আমি দিচ্ছিলাম দলিলের উদ্ধৃতি। ওটা পাওয়া যাবে এখানে:-

জামাত আমাদের সাথে আলোচনা এড়িয়ে যায় কারণ সে বোঝে তা করলে ইসলাম ও মানবাধিকারের প্রতি তার বিশ্বাসঘাতকতা জনগনের সামনে প্রমাণ হয়ে যাবে। জনগনকে অন্ধকারে রেখেই সে বেঁচে থাকে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? জামাত ইতিহাসের পরাজিত শক্তি, ঘড়ির কাঁটা পেছনে ঘোরানোর শক্তি তার নেই। সময় তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে, আমাদের সামনে না আসুক সময়ের সম্মুখীন তাকে হতেই হবে।

- See more at: http://www.hasanmahmud.com/2012/index.php/all-articles/articles-in-bangla/islamic/

Thursday, August 15, 2013

জামাত, যুদ্ধাপরাধ ও শারিয়া আইন -(তওবা করলে গণহত্যাকারী গণধর্ষণকারীদের শাস্তি হবে না) - হাসান মাহমুদ



১৬ই ডিসেম্বর ৩৯ মুক্তিসন (২০০৯)

যুদ্ধাপরাধী-বিচারের বাতাস বইবার সাথে সাথে নিজামী গং উচ্চকন্ঠে বলে বেড়াচ্ছেন জাতিকে নাকি বিভক্ত করা হচ্ছে। জাতির ঐক্যের খাতিরে নাকি গণহত্যা-গণধর্ষণের মত ভয়ংকর অপরাধের বিচার শিকেয় তুলে লক্ষ ধর্ষিতাদের সাথে গণধর্ষণকারীদের এবং লক্ষ নিহতের কোটি স্বজনের সাথে গণহত্যাকারীদের ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা নাকি খুবই দরকার।

সাব্বাশ !

জনাব নিজামী, কিছু কথা ও প্রমাণ আপনার মাথায় না ঢুকুক কানে ঢালা প্রয়োজন। ষড়যন্ত্রের খিড়কি দরজা দিয়ে নষ্ট রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পাওয়া আর জাতির হূদয়ে প্রতিষ্ঠা পাওয়া’র মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। আজ বিপদে পড়ে ঐক্যের কথা বলছেন, জাতিকে বিভক্ত কে করেছে রক্তরেখায় ? আপনাদের আর জাতির মাঝখানে লক্ষ লাশ লক্ষ ধর্ষিতার হিমালয় কে তুলেছে ? আপনারাই তুলেছেন। পরাক্রান্ত বিদেশী সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে সেই জীবন-মরণ যুদ্ধে আপনারা আমাদের সাথে ঐক্য করলে আমাদের শক্তি আর মনোবল অনেক বাড়ত। কিন্তু আপনারা বাংলায় জন্মে বাঙ্গালীর সঙ্গে ঐক্য না করে বাঙ্গালীরই বিরুদ্ধে খোলাখুলি জিহাদ ঘোষণা করলেন, জাতির ওপরে বিদেশীদের গণহত্যা-গণধর্ষণে শরিক হওয়াকে ইবাদত মনে করলেন এবং প্রাণপনে সে ‘‘ইবাদত’’ করলেন-ও। আপনাদের সক্রিয় সাহায্য না পেলে অনেক বাঙ্গালী বেঁচে যেত অনেক বাঙ্গালিনী ধর্ষিতা হত না। এর পরেও আশা করেন আমরা আপনাদের সাথে ঐক্য করি ? আটত্রিশ বছর কেটে গেছে আপনারা সে অপরাধের জন্য আল্লা-রসুলের কাছে আর নিপীড়িতদের কাছে ক্ষমা তো চানই নি বরং সগর্বে বলেছেন - ‘‘একাত্তরে আমরা ভুল করিনি’’।

অবশ্যই করেছেন। মহাভুল করেছেন, ঘোর অপরাধ করেছেন। ঐক্য যে করবেন, করবেন-টা কার সাথে ? এ জাতি কখন আপনার নিজের ছিল ? কখনোই না। এ জাতির সংস্কৃতি কবে আপনার সংস্কৃতি ছিল ? কখনোই না। কখনো গেছেন রমণার বটমূলে বর্ষবরণে? যান নি। পালন করেছেন ষড়ঋতু-নবান্নর মায়াময় উৎসবগুলো? করেন নি। এ জাতির মরমীয়া ইসলাম কবে আপনাদের ইসলাম ছিল? কখনোই না। জাতির হাজার বছরের ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ঐতিহ্যে ঘুন ধরিয়ে ইসলামের হিংস্র ব্যাখ্যা আমদানী কে করেছে ? আপনারাই করেছেন। চোখের সামনে ফতোয়াবাজেরা বাঙ্গালিনীদেরকে হিলা বিয়ের নামে ধর্ষণ করায় আপনাদের ইসলামি বুক কাঁপে না। চোখের সামনে শারিয়াবাজেরা ধর্ষিতা বালিকাদের চাবুক আর জুতো দিয়ে পেটায় আপনাদের ইসলামি বুক কাঁপে না। অথচ আপনাদের অঙ্গুলী হেলনে ইসলামের নামে মা-বোনের এই জীবন-ধ্বংস বন্ধ হতে পারত। আপনারা করেন না কারণ ওই অসহায় মা-বোনেরা আপনাদের কেউ নয়। আপনারা যতনা বাংলাদেশী হয়েছেন তার চেয়ে বেশী হয়েছেন পাকিস্তানি। যতনা মুসলমান হয়েছেন তার চেয়ে বেশী হয়েছেন আরবী। তাই আগ্রহ আর উল্লাসের সাথে নিজের জাতিপরিচয়কে, বাংলাদেশীর রক্তকে আর নারীর সম্ভ্রমকে বিদেশীর পায়ে অর্ঘ্য দিয়েছেন। ধর্মীয় উন্মাদনা কতখানি উদগ্র হলে মানুষ এমন করতে পারে তা জাতি ঠিকই বোঝে, এখন ডুডু-ও খাবেন টামাকও খাবেন তা হয় না। গাছের খাবেন তলারও কুড়োবেন তা হয়না।

কিছু মানুষ চিরকাল-ই হিংস্র কসাই থাকবে। কিন্তু আমাদের কষ্টটা হচ্ছে এই যে আপনারা এটা করেছেন ইসলামের নামে। ইসলামি রাষ্ট্র বানিয়ে শারিয়া আইন চালাতে চান। জাতির জানা দরকার একাত্তরের কসাইপনা ও কুকর্মের কি ব্যবস্থা শারিয়া আইনে আপনারা আগে থেকেই করে রেখেছেন, উদ্ধৃতিঃ -

‘‘হিরাবা’র অপরাধ ব্যতীত অন্যান্য অপরাধের ক্ষেত্রে অপরাধী তওবা করিলেও শাস্তি হইতে রেহাই পাইবে না - হিরাবার অপরাধের শাস্তি ব্যতীত তওবা অন্য কোন শাস্তি বাতিল করে না’’ - শরিয়া আইন নং ১৩, বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ১ম খণ্ড পৃষ্ঠা ২১৮ ও ২২২।

সুষ্পষ্ট আইন। অর্থাৎ হিরাবা’র অপরাধীরা তওবা করলে ‘‘শাস্তি হইতে রেহাই পাইবে’’। হিরাবা কি? আবার উদ্ধৃতি দিচ্ছি আপনাদেরই ওই কেতাব থেকেঃ- ‘‘হিরাবাহ্ বলিতে সংঘবদ্ধ শক্তির জোরে আক্রমণ চালাইয়া আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাইয়া জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করা বোঝায়। সম্পদ লুন্ঠন, শ্লীলতাহানী, হত্যা ও রক্তপাত ইহাত অন্তর্ভুক্ত’’।

হল ?

ইসলামেরই নামে ইসলামের প্রতি এই ভয়ংকর বিশ্বাসঘাতকতা কে করেছে? আপনারা-ই করেছেন। ইসলামের নামে আইন বানিয়েছেন ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান হুদুদ অপরাধ অর্থাৎ খুন-জখম-চুরি-ডাকাতি-মদ্যপান -পরকীয়া-কুৎসা করলে শাস্তি তো দুরের কথা - ‘‘তাহার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করা যাইবে না’’ - বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ৩য় খণ্ড আইন নং ৯১৪ গ। এই একটা আইনই ইসলামকে শয়তানের হাতে তুলে দেবার জন্য যথেষ্ট নয়? অজস্র উদাহরণ আছে। যেখানে সুরা তালাক আয়াত ২-তে আল্ কোরাণে সুষ্পষ্ট নির্দেশ দিয়ে রেখেছে স্ত্রী-তালাকের সময় দুইজন সাক্ষী রাখতে সেখানে আপনাদের আইনে স্বামীর জন্য - ‘‘তালাক সংঘটিত হওয়ার জন্য সাক্ষ্য শর্ত নহে’’ - বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন ১ম খণ্ড আইন নং ৩৪৪।
কিছু তরুণ এসব না জেনে না পড়ে আপনাদের বিশ্বাস করে, সমর্থন করে। ওই তরুণরা যেদিন জানবে কি নিষ্ঠুরভাবে ওদের ধর্মীয় আবেগকে পুঁজি করে ওদের আপনারা ঠকিয়েছেন সেদিন ওরাই আপনাদের গলা চেপে ধরবে। তিন খণ্ডের বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন কোন একজনের লেখা নয়, আপনাদেরই ফেইথ-কাজিন ছয়জন পণ্ডিতের টিম-এর লেখা। ওটা কোন ব্যবসায়ী প্রকাশকের লাভের বই নয়, ওটা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ইসলামি ফাউন্ডেশন। একটা গণতান্ত্রিক দেশের সরকারী প্রতিষ্ঠান কিভাবে এ ধরণের বই প্রকাশ করেছে সে দড়িতেও একদিন টান পড়বে।

আমাদের হাজার দোষ থাকতে পারে কিন্তু ইসলাম-বিরোধী হত্যাকারী ধর্ষকদের সাথে আমরা বাংলাদেশীরা ঐক্য করি না ।

জাতি আর কোন চাতুরীতে ভুলবে না - যত হও তুমি সুদক্ষ অভিনেতা
লাশের ওজন ধর্মে যাবে না কেনা - যতই ধুর্ত হোক ক্রেতা-বিক্রেতা।
সূত্র: হাসান মাহমুদ.কম

মিথ্যা বলার অধিকার : মুহম্মদ জাফর ইকবাল


Friday, 16 August 2013 - 12:00am

গত কিছুদিনে আমি একটা বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছি। একটা দেশের মানুষের যেরকম খাদ্য, বাসস্থান এবং শিক্ষার অধিকার থাকে, আমাদের দেশে তার সঙ্গে একটা নতুন বিষয় যোগ হতে যাচ্ছে, সেটা হচ্ছে মিথ্যা কথা বলার অধিকার। এই দেশের মানুষ যেন চাইলেই মিথ্যা কথা বলতে পারে এবং সেই মিথ্যা কথা বলার জন্য দেশে অন্য কারো যত বড় সর্বনাশই হোক না কেন, যিনি মিথ্যা কথা বলছেন তিনি যেন নিরাপদে মিথ্যা বলতে পারেন সেজন্য এই দেশের পত্র-পত্রিকা, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান, গুণী মানুষজন সবাই একত্র হয়ে গেছেন। কেউ যেন মনে না করেন আমি বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলছি, সেজন্য আমি জলজ্যান্ত কয়েকটি উদাহরণ দেই।

ব্যাপারটা শুরু হয়েছে আমার নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ঘটনা থেকে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা নিয়োগ নিয়ে এই দেশের একটা গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকায় একদিন একটা খবর ছাপা হলো। সংবাদটি মিথ্যা -এটাকে মিথ্যা বলা হবে নাকি অসত্য বলা হবে নাকি অর্ধ-সত্য বলা হবে সেসব নিয়ে তর্ক করা যেতে পারে। আমি সেই তর্কে যাচ্ছি না। যেখানে সঠিক তথ্য রয়েছে সেখানে সেই তথ্যটাকে আড়ালে রেখে অন্য কিছু ইচ্ছে করে বলা হলে আমি সেটাকে মিথ্যে বলে বিবেচনা করি। যাই হোক, সেই মিথ্যা সংবাদটির কারণে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু অধ্যাপকের চরিত্রে মিথ্যা গ্লানি স্পর্শ করল, তারা খুব আহত হলেন। ঘটনাক্রমে সেই সাংবাদিক আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে কোনো ছাত্র শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে তাকে তাৎক্ষনিকভাবে শাস্তি দেওয়ার নিয়ম আছে, পরে পুরো ঘটনা তদন্ত করে অপরাধ বিষয়ে নিশ্চিত হতে হয়। কাজেই সেই ছাত্রটির মিথ্যা সংবাদ পরিবেশনের প্রাথমিক তদন্ত করে তাকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করে একটা তদন্ত কমিটি করে দেওয়া হলো এবং আমি সেই তদন্ত কমিটির আহবায়ক। আমি বিষয়টি জোর দিয়ে লিখতে পারছি কারণ তদন্ত কমিটির আহবায়ক হিসেবে আমি খুঁটিনাটি সবকিছু জানি। ছাত্রদের শাস্তি দেওয়ার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিজস্ব কিছু অলিখিত নিয়ম আছে। কম বয়সী ছেলে মেয়েরা দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চাইলে সবসময়ই তাদের শাস্তি কমিয়ে দেওয়া হয়। সবসময়ই চেষ্টা করা হয় তাদের পড়ালেখার যেন কোনো ক্ষতি না হয়। ( একেবারে খুন ধর্ষণ করে পলাতক হয়ে গেলে অন্য কথা, তখন অপরাধটি বিশ্ববিদ্যালয়ের না, দেশের আইনের)।
আমি তদন্ত করতে গিয়ে অত্যন্ত বিচিত্র একটি বিষয় আবিষ্কার করলাম, ছাত্র সাংবাদিকটিকে সেই সংবাদপত্রটি পুরোপুরিভাবে নিরাপত্তা দিয়ে গেল। সেই কারণে তার ঔদ্ধত্য হলো সীমাহীন। শুধু তাই নয়, একদিন আবিষ্কার করলাম হাইকোর্টে রিট আবেদন করে তিন মাসের একটি স্থগিতাদেশ পর্যন্ত বের করে ফেলল! পুরো ঘটনার ফলাফল হলো ভয়ানক। বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র জানতে পারল কিছু মানুষের চরিত্র হননের জন্য সে ইচ্ছা করলেই একটা পত্রিকায় মিথ্যা সংবাদ ছাপাতে পারে এবং সেই পত্রিকা তাকে রক্ষা করবে। আমাদের দেশের একটা পত্রিকা অনেক সময় রাজনৈতিক দল, পুলিশ, র‌্যাব এমন কি সরকার থেকেও বেশি শক্তিশালী। এই ঘটনাটি আমার চোখ খুলে দিয়েছে। দেশের খুব গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকায় (আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগের পরও) যদি এ রকম একটা ঘটনা ঘটাতে পারে, তাহলে নিশ্চয়ই অন্যান্য পত্রিকায় অসংখ্যবার এই ঘটনা ঘটেছে। আমার একটা বড় ক্ষতি হয়েছে, খবরের কাগজে কিছু লেখা হলে আমি আজকাল ভুরু কুঁচকে সেটার দিকে তাকিয়ে থেকে নিজেকে জিজ্ঞেস করি, আসলেই কি এটা ঘটেছে? পত্রিকাটা কি সত্যি কথা বলছে?

যুদ্ধপরাধীদের বিচারের রায় নিয়ে কিছু ব্লগার, তরুণ শাহবাগে একত্র হয়ে এই দেশে একটা অভাবিত আন্দোলন জন্ম দিয়েছে। সেই তরুণদের হেয় করার জন্যে ঢালাওভাবে তাদের সবাইকে নাস্তিক ঘোষণা করে একটা প্রচারণা শুরু করা হলো। সেই প্রচারণাটি শুরু করল ‘আমার দেশ’ নামের পত্রিকা। আমি লিখে দিতে পারি- তারা নিজেরাও বিশ্বাস করে না, যারাই ব্লগার কিংবা যারাই যুদ্ধপরাধীর শাস্তি চেয়ে শাহবাগে গিয়েছে, তারা সবাই নাস্তিক। কিন্তু বিষয়টা সেভাবেই উপস্থাপন করা হলো- ব্লগার মানেই নাস্তিক, শাহবাগে যুদ্ধপরাধের বিচার চাওয়া তরুণ মানেই নাস্তিক। ‘আমার দেশ’ পত্রিকায় ব্লগারদের সাথে আমার ছবি ছাপা হলো, যেভাবে সেই ছবিটি উপস্থাপন করা হলো তাতে কি আমার নিজের জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর পাঠকেরা মে মাসের পাঁচ তারিখ ভোরে আমার কাছে লেখা একটা এস.এম.এস. থেকে পেয়ে যাবেন:

“এই নাস্তিক জাফর ইকবাল, তোদের মৃত্যুর ঘন্টা বাজছে। হতে পারে আজ রাতই তোদের শেষ রাত। কাল হয়তো তোরা আর পৃথিবীতে থাকতে পারবি না। কারণ এই জমানার শ্রেষ্ঠ শায়খুল হাদিস আল্লামা আহমদ শফির ডাকে সারা বাংলাদেশের তৌহিদি জনতা মাঠে নেমে এসেছে। সেই সব তৌহিদি জনতা প্রধানমন্ত্রীসহ তোদের সব ধরে ধরে জবাই করে ছাড়বে। আমার আল্লাহকে নিয়ে, বিশ্বনবীকে নিয়ে কট্যুক্তি করার ভয়ংকর পরিণাম কী, তা আগামী কালকেই হাড়ে হাড়ে টের পাবি তোরা।”
‘আমার দেশ’ স্বাধীন নিরপেক্ষ মত প্রকাশে একটা পত্রিকা না, এটা স্বাধীনতা বিরোধীদের একটা নির্দিষ্ট বিশ্বাসকে প্ররোচিত করার পত্রিকা। তাদের প্ররোচনার কারণে এই দেশে অনেক মানুষের জীবন বিপন্ন হয়েছে। কাজেই এই পত্রিকাটির সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে তার দায়-দায়িত্ব নিতে হবে। তাকে যদি ভয়ংকর মিথ্যা প্রচারনার জন্যে আইনের আওতায় আনা হয়, আমাদের মতো মানুষেরা তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। আমি আমার নিজের চোখকে বিশ্বাসও করতে পারিনি যখন দেখেছি এই দেশের পনেরোটি পত্রিকার সম্পাদক তাকে রক্ষা করার জন্যে এগিয়ে গিয়েছেন। এর অর্থটি কী দাঁড়ালো? এই পত্রিকাটি যা খুশি লিখতে পারবে, দেশের মানুষের প্রাণ বিপন্ন করে এরকম মিথ্যা প্রচারনা করতে পারবে, কিন্তু কেউ তাকে স্পর্শ করতে পারবে না!

আমার মনে আছে সামরিক আর বেসামরিক মিলিয়ে ২০০৬ সালের হাইব্রিড তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এই দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকদের গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছিল। আমরা বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তখন অস্থির হয়ে নানাভাবে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করার চেষ্টা করেছিলাম। কোনো পত্র-পত্রিকা তখন সেসব লেখা ছাপানোর সাহস করেনি। রিমান্ডে নেওয়া সেই শিক্ষকেরা কোনোদিন জানতেও পারেননি এই দেশে কত মানুষ তাদের জন্যে আকুল হয়েছিলেন। অনেক কষ্টে আমার দুই একটা লেখা শুধু কোন পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, সেজন্যে সেই শিক্ষকদের পরিবারের সদস্যদের আমার প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ ছিল না। দুঃসময়ে টিকে থাকাটাই হচ্ছে বিজয়। টিকে থাকতে হলে মনে বল থাকতে হয়; আর সেই মনের বলটি যখন আসে, সবাই জানতে পারে তারা একা নয়। তাদের পাশে অনেকে আছে। আমাদের দুর্ভাগ্য সামরিক বেসামরিক হাইব্রিড সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এই দেশের অনেক পত্র-পত্রিকা সেই সাহসটুকু দেখাতে পারেনি। তাই যখন দেখি সেসব পত্রিকার সম্পাদকদের অনেকেই এখন ‘আমার দেশ’ নামক একটি ধর্মান্ধতা প্রচারযন্ত্রের সম্পাদকের পাশে এসে দাঁড়িয়ে গেছেন, তখন আমি মনে কষ্ট পাই। শুভবুদ্ধির ওপর বিশ্বাস হারানোর আশঙ্কা হয়। সত্য এবং মিথ্যার মাঝখানে নিরপেক্ষ থাকা যায় না – অত্যন্ত এই সহজ কথাটি কি বোঝার জন্য খুব কঠিন?

বিগত বি.এন.পি.-জামায়াত আমলে যখন সারাদেশে একটা রুদ্ধশ্বাস অবস্থা তখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিবেশ ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। দলীয় শিক্ষকেরা নানাধরনের তাণ্ডব করে বেড়াচ্ছেন। প্রায় ডিএনএ (DNA) টেস্ট করে দেখা হচ্ছে রক্তের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রয়েছে কি না? যদি বিন্দু মাত্র চেতনা খুঁজে পাওয়া যায়, তাকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না। আমরা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা জুতা পর্যন্ত নাড়াতে পারি না। কিছু করতে দেওয়া হয় না, কোথাও যেতে দেওয়া হয় না। পাঁচ মহাদেশ থেকে পাঁচ শিক্ষাবিদকে জার্মানির একটা অনুষ্ঠানে ডাকা হয়েছে। আমি তাদের একজন। আমাকে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হলো না। আমি আবিষ্কার করলাম শিক্ষকেরা যখনই একত্র হচ্ছে তখনই কথাবার্তা আলোচনায় শুধু ক্ষোভ আর হতাশা, ক্রোধ আর যন্ত্রণা। একাত্তরে আমি একটা জিনিস শিখেছিলাম, সেটা হচ্ছে যুদ্ধের আসল অস্ত্র রাইফেল নয়, যুদ্ধের আসল অস্ত্র হচ্ছে মনোবল। তাই কখনো মনোবল হারাতে হয় না। সহকর্মীদের মনোবল ধরে রাখার জন্যে আমরা তখন অনেক কিছু করেছি।। তার মাঝে সবচেয়ে জানার বিষয় ছিলো- আমাদের সান্ধ্যকালীন আড্ডা। বেশ কয়েকজন শিক্ষককে নিয়ে আমরা শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, দর্শন এরকম বিষয় নিয়ে আলোচনা করতাম। শ্বাসরুদ্ধকর একটা পরিস্থিতি যখন স্বাধীনতা বিরোধীদের এরকম রমরমা অবস্থা তখন আমাদের এই পুরোপুরি বুদ্ধিভিত্তিক আলোচনাগুলো ছিল খুব আনন্দের, মনোবল ধরে রাখার জন্যে অসাধারণ।

সন্ধ্যাবেলা বসে তরুণ শিক্ষকদের সঙ্গে বুদ্ধিভিত্তিক আলোচনার বিষয়টি আমি পরেও চালু রেখেছি। তাই নিয়মিতভাবে আমি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশেষ করে তরুণ শিক্ষকদের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করি। বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির বাইরে যে বিশাল একটা জগৎ আছে তারা আমাকে অনেক সময়েই তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। কোনো একটা ছুটির পর শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলছি তখন হঠাৎ করে তাদের কাছ থেকে একটা বিচিত্র বিষয় জানতে পারলাম। তারা সবাই তাদের নিজেদের এলাকা থেকে ঘুরে এসেছে এবং সবাই বলেছে যে, তাদের এলাকার সাধারণ মানুষেরা জানে এবং বিশ্বাস করে মে মাসের ৫ তারিখ মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামের কয়েক হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। অনেক বড় একটা মিথ্যা কথাকে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বিষয়টা এমনি এমনি ঘটেনি। এর জন্যে কাজ করতে হয়েছে, পরিশ্রম করতে হয়েছে, অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো- হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে সেই তথ্য প্রচার করা হলেও সেদিন যে অসংখ্য কোরআন শরীফ পোড়ানো হয়েছিল, সেই তথ্যটি কিন্তু প্রচার করা হয়নি। রাতের আকাশে ইউএফও (UFO) দেখা গেছে কিংবা একটা ছাগল মানুষের গলায় কথা বলে এরকম মিথ্যা প্রচারিত হলে ক্ষতি হয় না। কিন্তু রাতের অন্ধকারে গোপনে কয়েক হাজার মুসুল্লিকে হত্যা করা হয়েছে এরকম একটি ভয়ঙ্কর মিথ্যা প্রচার হলে সব দিক দিয়ে ক্ষতি হয়।

কয়েক হাজার মুসুল্লিকে হত্যা করা হয়েছে সেটি প্রচারিত হয়েছে গোপনে। প্রকাশ্যে সর্বশেষ যে প্রচারণাটি ছিল সেটা হচ্ছে- ৬১ জনের, ‘অধিকার’ নামে একটি সংগঠন সেটি দেশ-বিদেশে প্রচার করেছে। কয়েক হাজার থেকে সংখ্যাটি ৬১ তে নেমে এসেছে, তাই সরকারের খুশি হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু সরকার খুশি হয়নি। তারা ৬১ জনের নাম জানতে চেয়েছে, আমিও জানতে চাইতাম। পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় অভিযোগ করলে তার প্রমাণ থাকতে হয়। অধিকার নামক সংগঠনটি নাম প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। কারণটি আমরা বুঝতে পারি। কারণ পুরো ঘটনাটি টেলিভিশনে দেখিয়েছে। সাংবাদিকেরা রিপোর্ট করেছে এবং কোথাও এত বড় একটি সংখ্যা কেউ দেখেনি। সরকার তখন মিথ্যা একটি তথ্য প্রচারের জন্যে অধিকার নামক সংগঠনের সম্পাদক আদিলুর রহমান খানকে গ্রেপ্তার করেছে।
‘আমার দেশ’ এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের পক্ষে যে রকম ১৫ জন সম্পাদক দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। আদিলুর রহমান খানের পক্ষে এখন আরো বেশি মানুষ দাঁড়িয়ে গিয়েছেন। শুধু পত্র-পত্রিকা নয়, বড় বড় মানবাধিকার সংগঠন, রাজনৈতিক দল, দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান, এমন কি আমাদের দেশের জ্ঞানী-গুণী মানুষ দাঁড়িয়েছেন। অধিকার সংগঠনটি যদি বলতো অনেক মানুষ মারা গেছে এবং তখন তাকে যদি গ্রেপ্তার করা হত সেটা বাক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে বলা যেত। কিন্তু যখন সংখ্যাটি অত্যন্ত নিঁখুত ৬১, তখন তাদেরকে এর ব্যাখ্যা দিতে হবে। বিচার বিভাগীয় তদত্ত কমিটির কাছে দেওয়া হবে - সেটি মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়। ২১ আগস্ট ঘটনার পর বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির রিপোর্টের কথা কেউ কি ভুলে গেছে?

এই দেশের যে সকল সুধীজন মে মাসের ৫ তারিখে মতিঝিলে ‘গণহত্যা’র একজন প্রবক্তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, তাদের কাছে আমার শুধু ছোট একটা প্রশ্ন- তথ্যটি যদি মিথ্যা হয় তাহলেও কী আপনি তার পাশে এসে দাঁড়াবেন? বাক স্বাধীনতা চমৎকার বিষয়, আমি কয়েকজন সম্পাদকের বিরুদ্ধে কথা বলেছি তারপরও যদি এই লেখাটি সেই পত্রিকায় ছাপা হয় সেটি বাক স্বাধীনতা। কিন্তু একটা মিথ্যা তথ্য যদি একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে প্রচার করা হয় তখন সেই তথ্য প্রচার করার অধিকার বাক স্বাধীনতা নয়। তখন সেই অধিকার হচ্ছে মিথ্যা কথা বলার অধিকার।

এই দেশে এমনিতেই অনেক মিথ্যা কথা বলা হয়েছে। এখন কী আমাদের অনুষ্ঠানিকভাবে সেটাকে অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে দিতে হবে?

মুহম্মদ জাফর ইকবাল
অধ্যাপক, শাহজাহাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট। source:দৈনিক জনকন্ঠ