Saturday, September 7, 2013

আমাদের বিবেকভ্রষ্ট বুদ্ধিজীবি-দেলোয়ার হোসেন



অতীতের কথা বাদ দিলাম । বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকারের গৃহীত কোন ইতিবাচক পদক্ষেপ , আহ্বান , অনুরোধকে বিএনপি কখনও শুধু পাত্তাই দেয়নি , উপরন্তু তাকে সব সময় বাকা চোখেই দেখে আসছে এবং সেসব ক্ষেত্রে কোমর বেঁধে তীব্র সমালোচনায় অবতীর্ণ হয়েছে । উদাহরণ হিসেবে সংবিধান সংশোধন, নির্বাচন কমিশন সংস্কার সহ গুরুত্বপূর্ণ অসংখ্য বিষয় রয়েছে । আওয়ামীলীগ যেখানেই হাত দেয় বিএনপি সেখানেই ষড়যন্ত্র, দুরভিসনধের গন্ধ খুঁজে পায় এবং আমলে নেয়ার অনুপোযুক্ত ও অচ্ছুত বলেই উপস্থাপিত বিষয়গুলোকে স্বভাব সুলভ নিয়মে কালিমালিপ্ত করে বসে । অর্থাৎ আওয়ামীলীগের কোন কিছুই ভাল না । এমনকি যে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে, সেটাও তারা স্বীকার করে না , স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকেও কোন ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে মুল্যায়ন করে না । তারা বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে জিয়াকেই স্বাধীনতার প্রধান পুরুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেস্টায় নিরন্তর লিপ্ত থেকে বঙ্গবন্ধুর শাহাদত বরনের দিবসে পৈশাচিক জন্মোৎসব পালন করে সহজাত ঘৃণা ও তীব্র প্রতিহিংসার বহিপ্রকাশ ঘটিয়ে আসছে দীর্ঘকাল থেকেই । সুতরাং শত্রুর অবস্থানে থেকে মনে প্রাণে জিঘাংসায় ব্রতী হলে প্রতিপক্ষের কোন কিছুকেই ইতিবাচক বলে গ্রহণ করা যায় না । তাই বলা হয়, যারে দেখতে নারি , তার চলন বাঁকা । ঠিক একই অবস্থানে রয়েছে আমাদের বাংলাদেশের তথাকথিত সুশীল সমাজ । তারাও আওয়ামীলীগের কোন ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের প্রশংসা তো দূরে থাক, ফাঁকফোকর খুজে বের করে দলটিকে সর্বদাই আসামীর কাঠগড়ায় দাড় করাতে যেন সিদ্ধহস্ত। বিএনপির কলংকময় অতীত , নজিরবিহীন অপকর্ম নিয়ে তারা মোটেও টু শব্দটিও করেন না। শুধু কি তাই স্বাধীনতা কিংবা বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গ এলে জাতির পিতার সম্বোধন দূরে থাক, এই বুদ্ধিজীবিদের অনেকেই বঙ্গবন্ধু নামটি মুখে উচ্চারন করতে কুন্ঠা বোধ এবং শেখ মুজিব সম্বোধনেই বেশি স্বস্তি বোধ করেন । তাদের ভয় থাকে একটাই যাতে গায়ে বিশেষ শিবিরের সিল না লেগে যায় । এছাড়া আওয়ামীলীগ বা সরকারের সমালোচনা এবং বিরোধী দলের অযৌক্তিক দাবির পক্ষে দ্রুত অবস্থান নিয়ে একজোট হয়ে সর্বত্র কথা বলে জনমতকে প্রভাবিত করার এদের একটা অপচেস্টা এখন মোটা দাগে চোখে পড়ার মত একটি নৈমিত্তিক বিষয় বা রুটিন ওয়ার্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে । যদি দুই নেত্রীর মধ্যে সংলাপ অনুষ্ঠান এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল প্রসঙ্গে আলোকপাত করি তাহলে দেখা যাবে, হাজার মুনীর হাজার মত । তবে সব শেয়ালের এক রা এর মতই মুল কথা একটাই, বিরোধী দলের দাবিটিই যৌক্তিক । এ প্রসঙ্গে সংলাপ বিষয়ে একটি উদাহরন দেই । কদিন আগে চ্যানেল আই এ টক শো তৃতীয় মাত্রা দেখছিলাম। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের একজন শিক্ষক, এক সময় যে বিভাগের ছাত্র আমি নিজেও ছিলাম তাই, যাকে নিয়ে গর্ব বোধ করছিলাম , সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যাই বলি তার একটি মন্তব্য বা মুল্যায়নে আমি এতটাই হতাশ হই যে এই ধরনের বুদ্ধিজীবিদের কথা শোনার আগ্রহ এখন একেবারেই হারিয়ে ফেলেছি । দুই নেত্রীর সংলাপ প্রসঙ্গে তিনি বলছিলেন, যেহেতু খালেদা জিয়াকে তার বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে তাই তার মনের ভেতর ক্ষোভ এবং প্রতিহিংসা তুষের আগুনের মত জ্বলছে এবং তা সহজে নেভার মত নয় । আর অপরদিকে ২১ শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার মত ঘটনাটি শেখ হাসিনারও সহজে ভোলার কথা নয় । তাই দুই নেত্রীর মুখ দেখাদেখি এবং সংলাপ অনুষ্ঠানের প্রধাণ বাধাই হলো এটি । আমি আশ্চর্য হলাম ! কি চমৎকার সরলিকরন ! কি অদ্ভুত সমীকরন এইসব নমস্য বুদ্ধিজীবিদের । যে নেত্রী প্রতিপক্ষ নির্মূলে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ তার পার্টির জন্মলগ্ন থেকেই। জাতির জনকের হত্যার সাথে যে দলের পূর্বসূরী কান্ডারী ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং খুনীদের করেছে পুরস্কৃত এবং যে দল সেই খুনীচক্র এবং স্বাধীনতা বিরোধী, যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব , গনতন্ত্র ও মানবাধিকারের বিপক্ষে তৎপর থেকে জাতির সব অর্জনগুলোকে নস্যাত করার কাজে লিপ্ত – সেই বিষয়গুলো তার বিবেচনা এবং মুল্যায়নে স্থান পায়নি এতটুকু । বিবেচনায় আসেনি এই দলের ঐতিহাসিক সুমহান কীর্তি এবং বর্তমানের যুগান্তকারী ইতিবাচক অর্জন ও তার সহনশীল রাজনীতি যার উল্টো পথে সব সময় চলেছে বিএনপি । বিএনপির এসব সুকীর্তির কথা তারা কখনই উল্লেখ করেন না । যত দোষ নন্দঘোষ, তার জন্যে প্রকৃষ্ট উদাহরণ একমাত্র আওয়ামীলীগই । কেবল মাত্র বাড়ি উচ্ছেদের ঘটনা দিয়েই বিএনপি নামক দলটির সকল পৈশাচিক অপকর্ম জায়েজ করে দিলেন এই বুদ্ধিজীবি তার মুল্যায়নে ! পাড়া-গ্রামে একটা প্রবচন আছে, কিসের মধ্যে কি পান্তা ভাতে ঘি । এই বুদ্ধিজীবির মূল্যায়নটাও হয়েছে ঠিক তেমনই।

এবার আসা যাক নির্বাচন প্রসঙ্গে । এই গুণী শিক্ষকের রয়েছে দেশে-বিদেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করার একটি এনজিও সংস্থা । যিনি এ বিষয়ে একজন এক্সপার্ট । এ পর্যন্ত বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের আমলে যতগুলো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তার সিংহ ভাগ ক্ষেত্রেই বিরোধীদল বিএনপিই জয়লাভ করেছে। সর্বশেষ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে—যেখানে তারা শতভাগ সাফল্য অর্জন করেছে সেক্ষেত্রে এবং এর আগের প্রতিটি নির্বাচনে দেখা গেছে বিএনপি তার স্বভাবসুলভ বিকৃত মিথ্যাচার করে বলেছে, ব্যাপক কারচুপির নির্বাচনের নীল নকশা সরকার আগে থেকেই করে রেখেছে। ফলাফলও সরকার নির্ধারণ করে রেখেছে । কিন্তু বিএনপির সুরের সাথে সুর মিলিয়ে তথাকথিত সুশীল সমাজও পক্ষপাতমূলক নেতিবাচক পূর্বাভাস ব্যক্ত করেছিল এবং সেনাবাহিনী মোতায়েন না করার বিষয়ে উভয় পক্ষ (বিএনপি এবং সুশীল) একযোগে যে মনগড়া আশংকা প্রচার করছিল তার কোনোটাই সত্য বলে প্রমাণিত হয়নি । এমনকি জয়লাভের পরেও বিএনপি তার বদ খাসলত অনুযায়ী বার বারই বলেছে সরকার ব্যাপক কারচুপি করেও বিএনপির বিজয় ঠেকাতে পারেনি । সঙ্গত ভাবেই প্রশ্ন আসে , এইসব নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সুশীলবেশধারী বুদ্ধিজীবি এবং গায়ে সিলমারা শ্রেনীবদ্ধ সুশীলরা একবারও ভুল করে বলছেন না , বিএনপির আমলে বিপন্ন হওয়া প্রশাসন এবং সকল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে (যেমন, নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ) সাংবিধানিক নিয়ম- শৃঙ্খলার প্রবর্তন এবং সেগুলোকে পরিপূর্ণরূপে কার্যকর এবং শক্তিশালীভাবে গড়ে তোলার যে কাজ ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার করে যাচ্ছে তার ইতিবাচক ফল ও সুদুরপ্রসারী প্রভাবের কথা । এখনও তারা বিএনপির দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি পুনর্বহালের পক্ষেই তুলছেন সোচ্চার আওয়াজ । অথচ এই বিএনপিই নজিরবিহীন অপকর্মের মধ্য দিয়ে ধ্বংস ও কালিমালিপ্ত করেছিল এই ব্যবস্থাকে । এটা বেমালুম ভুলে গিয়ে আবারও সেই অগণতান্ত্রিক ও পরিত্যক্ত ব্যবস্থাকেই পুনর্বহালের জন্যে প্রাণপাত করছেন আমাদের সুশীল গণতন্ত্রীরা । এই লেখা যখন লিখছি তখন টিভির খবরে ড, কামাল হোসেনের দাবি শুনছি , আরো দুই টার্মের জন্যে এই ব্যবস্থা বহাল রাখতে হবে । কি অদ্ভুত আমাদের পরম পুজনীয় সংবিধানের জন্মদাতা গণতন্ত্রীদের কথা । মুখেই গণতন্ত্রের কথা, আবার চিরাচরিত গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থা মোতাবেক দেশ পরিচালনার নিয়ম প্রবর্তনে তাদের বিরোধিতা । সত্যিই সেলুকাস ! বিচিত্র এ দেশ, বিচিত্র তার বুদ্ধিজীবি ।

এখন আসি শেষ কথায় । ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকার যদি শেষমেশ বিরোধী পক্ষের তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি মেনেও নেয় , সেক্ষেত্রেও মানি না, মানবো না রোগে আক্রান্ত বিএনপি বাধিয়ে বসবে আরেক ফ্যাকরা । তারা বহু আগেই ঘোষণা দিয়েছে , তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধাণ যিনি হবেন বা নিয়ম অনুযায়ী সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি খায়রুল হকের হবার কথা, তাকে তারা মানবেন না । কারণ তিনি নাকি আওয়ামীলীগের ঘুষ খাওয়া লোক । অর্থাৎ আওয়ামী ঘরানার আজ্ঞাবাহী লোক । বদ স্বভাবি বিএনপির এই অপবাদে সম্মানহানি বোধ করে বিচারপতি খায়রুল হক অবসরে যাবার আগেই স্বগতচিত্তে ঘোষণা দিয়ে বলেছেন তার তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধাণ হবার কোনো খায়েশ কখনই ছিল না এবং সুযোগ এলেও তা তিনি গ্রহণ করবেন না । যিনি নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের রায় দিয়ে গেছেন । সুতরাং আওয়ামীলীগের জন্যে বিএনপি হয়েছে শাঁখের করাত । যাইতেও কাটে, আসতেও কাটে । অতএব উপায় নেই । শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামীলীগ নির্ধারিত নিজস্ব অবস্থানেই অনড় থাকুক । সারা বিশ্ব দেখুক বাংলাদেশে আওয়ামীলীগ দলীয় সরকারের অধীনে সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য , সুষ্ঠু , শান্তিপূর্ণ ও অবাধ একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব । যা সবার কাছেই হবে একটি উল্লেখযোগ্য অনুকরনীয় দৃষ্টান্ত ।

স্টকহোল্ম, ২০১৩, ০৯,০৭

No comments:

Post a Comment