Thursday, July 11, 2013

কলুষিত হচ্ছে ভাষা ও সাংবাদিকতা:আব্দুর রউফ



বাংলানিউজে একাত্তর ও সময় টিভি’র দুই সংবাদকর্মীর লেখা দু’টো পড়ে খুবই মজা লাগল। এ দু’টি টিভি চ্যানেলের জ্ঞান গরিমা নিয়ে দু`একটি মতামত এর আগে তুলে ধরেছি। সম্ভবত সেসব লেখা চ্যানেল দু’টির বাঘা (!) সাংবাদিকরা পড়েন নি। এই দু’টি লেখার পর তাদের সাংবাদিকতা নিয়ে সংক্ষেপে কিছু কথা বলতে চাই।

সময় ও একাত্তর। এ দু`টি চ্যানেলের টিকার বা স্ক্রল নিউজ এবং বিভিন্ন নিউজের স্ল্যাগ নেইমে এত বানান ভুল যে, সহজ কথায় বলতে হয় এরা বাংলা ভাষা ও বানানকে ধর্ষণ করছে। ক’টি বিখ্যাত টিভি চ্যানেলের খপ্পড়ে পড়ে ইজ্জত হারাচ্ছে বাংলা ভাষা। অথচ এ নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। এদের বার্তা বিভাগের কারো কারো কাছে এসএমএস করে বানানগুলো ঠিক করার জন্য অনুরোধ করেছি। মাঝে মাঝে ঠিক হয়েছে, আবার মাঝে মাঝে চলছে তো চলছেই। সকাল থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত। আগে ফোন করে বা এসএমএস দিয়ে শোধরানোর অনুরোধ করলেও এখন আর তা করি না। কেননা ইদানীং আমাদের মোহনা টিভিতেও অসংখ্য ভুল যাচ্ছে। বাসায় চলে যাওয়ার পরই দেখি টিকারের কি ভয়াবহ অবস্থা। তাই চুপ থাকি। নিজের ঘরই তো ঠিক না।

তুলনামূলকভাবে একাত্তর টিভি`র সাংবাদিকদের বানানজ্ঞান খুবই কম। আমার রিপোর্টারদের কাছে শুনি, এদের সংবাদকর্মীরা নাকি অন্য চ্যানেলের কাউকে পাত্তাই দিতে চায় না। কি অদ্ভুত ধৃষ্টতা। লিখতে পারে না ভাল করে চার লাইন, তারা আবার অন্য সাংবাদিকদের এত তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে!

আমি আমার রিপোর্টারদের বলে দিয়েছি, এমন পরিস্থিতি আবার হলে, জাস্ট বিনয়ের সঙ্গে একাত্তরের ওই কর্মীকে নিয়ে টিভি’র সামনে বসে যাবে। ওদের চ্যানেল দেখুক পাঁচ মিনিট। ভুলগুলো দেখিয়ে দেবে।

বেশিরভাগ চ্যানেলই বানান ভুলের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমেছে বলা যায়। একদিনের উদাহরণ দিই।

৯ জুন, ২০১৩।আরটিভি।

কার্টুন স্যালাইন, তারেক রহমার, মনস্ত্ত্বাত্ত্বিক, মুলতবি। ছয়টা শব্দের চারটাই ভুল। কার্টন আর কার্টুনের পার্থক্য জানে না। হায় রে সাংবাদিক! রহমানকে লিখেছে রহমার। মনস্ত্ত্বাত্ত্বিক ( আসলে হবে মনস্তাত্ত্বিক) বানানের এমন দশা করেছে যে, এটা পড়লে যে কারো মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা লেজেগোবরে হয়ে যাবে। বানান ভুলে একাত্তরের চেয়েও মাঝে মধ্যে এগিয়ে যায় আরটিভি।

মুলতবি নামে কোন শব্দ নেই অভিধানে। যা আছে তা হলো মুলতুবি (এই বানানটি মোহনা ছাড়া সব টিভিই ভুল লিখেছে। আগামিকাল, মন্ত্রিসভা, মন্ত্রিপরিষদ-এই তিনটি বানানও সব টিভি চ্যানেল অহরহ ভুল লিখছে। সবাই লিখছে আগামীকাল, মন্ত্রীসভা/পরিষদ )।

৯ জুন, ২০১৩। এনটিভি।
আদালত চলাকালীন সময় পর্যন্ত সময় দেয় ট্রাইব্যুনাল-২। পুরো বাক্যটাই লেজেগোবরে। কালীন বললে আর সময় বলা লাগে না, এটা যদি এনটিভি না জানে তবে বলতে হয়, জাতি বড় দুর্ভাগা। প্রায় ছ’মাস আগে এদের একটা টিকার ছিল এমন: বাস-ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে…..নিহত। বাস-ট্রেনের কোনদিন মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় না। তাহলে হয় ট্রেনকে সড়কে চলতে হবে অথবা বাসকে চলতে হবে রেললাইন ধরে। বলা উচিত বাসের সঙ্গে ট্রেনের সংঘর্ষে।

৯ জুন, ২০১৩। মোহনা।
তিন চোরসহ ১৫টি গাড়ি উদ্ধার করেছে ডিবি (চোর উদ্ধার হয়েছে নাকি? বলা উচিত তিন চোর আটক, ১৫টি গাড়ি উদ্ধার….।

১০/০৭/১৩ একাত্তর
জীববৈচিত্র্য কে লিখেছে জীববৈচিত্র, বর্জ্যকে লিখেছে বজ্য (রাজশাহীতে পদ্মার পানি দূষিত নিয়ে যে নিউজটা তার স্ল্যাগ নেইম এ)।

এইদিন টিকারে দেখলাম কানাডার টরন্টোকে লিখেছে টরেন্টো।…এসবই সংক্ষিপ্ত উদাহরণ। ৯ জুন একাত্তর, বাধা দেওয়াকে লিখেছে বাঁধা। প্রতিরোধ বা ঠেকানো অর্থে হলে বাধা বানানে চন্দ্রবিন্দু হবে না, হবে দড়ি বা অন্য কিছু দিয়ে আটকে রাখার ক্ষেত্রে, এটিও জানে না সাংবাদিকরা।

১০/০৭/১৩ সময়
টিকারে লিখেছে পোর্ট অফ স্পেন। সঠিক উচ্চারণ হবে পোর্ট অ স্পেন। ভারতের উত্তরখন্ড নামে যেটি লেখা হয়েছে তা-ও ভুল। ওটা উত্তরাখন্ড।

১০/০৭/১৩ ইন্ডিপেন্ডেন্ট
স্ল্যাগ নেইম এ সূচককে লিখেছে সূচ (একটি টক শো’র আলোচনার বিষয় । এটা আগের রাত থেকে চলছে। কিছুদিন আগে দেখলাম এদের আলোচনার বিষয়: রাজনীতির গ্যাড়াকলে মাইনকা চিপায় আমরা। কই নিয়ে গেছে সাংবাদিকতাকে এরা। এটা কোন টিভি’র ভাষা হতে পারে?

৯ জুন, ২০১৩। ইটিভি
উত্তরাঞ্চচলে নামে একটা শব্দ দেখলাম টিকারের শুরুতে। অতিরিক্ত একটা চ দিব্যি মাঝখানে ঠাঁই করে নিয়ে শব্দটার অর্থের বারো দু’গুনে ২৪টা বাজিয়ে দিয়েছে। আন্তর্জাতিকের একটা টিকারে লেখা, আফগানিস্তানের পশ্চিমাঞ্চেলের…..।

খেলার খবরে ডাকওয়ার্থ লুইস পদ্ধতিকে লিখেছে ডার্ক-লুইস। কি হাস্যকর সাংবাদিকতা!

৯ জুন, ২০১৩। বাংলাভিশন।
ওয়ার্ল্ডকে লিখেছে ওর্য়াল্ড। রেফটা হয়ে গেছে য়’র উপর।

এমন অনেক ভুল সব টিভিই কমবেশি করছে। দেখি, শুনি আর কষ্ট পাই। মানুষ শিখবে কার কাছ থেকে। এভাবেই কলুষিত হচ্ছে বাংলা ভাষা আর বিফলে যাচ্ছে ভাষার জন্য প্রাণদানকারী ভাইদের আত্মত্যাগ, কলুষিত হচ্ছে সাংবাদিকতা। একেবারে প্রকাশ্যেই হচ্ছে সব। তবু দেখার বা বলার কেউ নেই। সার্বিক বিচারে অনলাইন ও প্রিন্ট মিডিয়া শতগুণ সতর্ক। ভাষাগত খানিকটা সমস্যা থাকলেও বানান নিয়ে একশ’তে একশ।

এদের নিউজ স্ক্রিপটিং ও এডিটিংয়ের মানও স্ট্যান্ডার্ড নয়। এক লাইনে একই শব্দের ব্যবহার হচ্ছে বারবার। শব্দের পুনরাবৃত্তি যে দূষণীয় এবং ভাষার রীতিবিরুদ্ধ, তা বোধকরি এরা জানেই না। নিউজ এডিটরও না। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই। এরা বলছে, বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা না হলে, কঠোর আন্দোলনের হুশিঁয়ারি দিয়েছেন বিএনপি`র....(অমুক)....।

বিএনপি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির অমুক আজ একথা বলেন..।
কেমন লাগে শুনতে? মনে হয় কানে পচন ধরেছে। হিসেবটা আসলে সহজ। নিউজ এডিটরের জ্ঞান একেবারে তলানিতে। এই লেখাটায় বলতে হবে, নেতাকর্মীদের নামে দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা না হলে, কঠোর আন্দোলনের হুশিঁয়ারি দিয়েছেন বিএনপি`র....(অমুক)....।

নয়াপল্টন কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের ....(অমুক) আজ এ কথা বলেন..।

শুনতে কত ভাল লাগে। অথচ বিশাল বিশাল সাংবাদিক দিয়ে ভর্তি এ দুটি চ্যানেল জানেই-না যে, দ্বিরুক্ত শব্দের ব্যবহার বাক্যে দূষণীয়। দ্বিরুক্ত শব্দ কি এটাই তো বোধকরি অনেকেই জানেন না। জানলে লিখতেন কি?

স্ক্রিপ্ট এডিটিংয়ের এই ধারায় অন্য সবাই-ও এক। একেবারে এ টু জেড বলা যায। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে এই ভুলটি কম করার চেষ্টা করি। মোহনা টেলিভিশনে বলতে গেলে আমি একা নিউজ এডিটর। তাও পুরোপুরি না, জয়েন্ট নিউজ এডিটর। তিন বছর হলো। কিন্তু চেয়ারম্যান সাহেব প্রমোশন দেবেন না। যাই হোক, এক সিনিয়র রিপোর্টারকে সম্প্রতি জেএনই হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এই হলো মোহনার সম্বল। যেটুকু ভুল আমাদের হয়, তা অনিচ্ছাকৃত। মাত্র দু`জন লোক দিয়ে একটি টিভি চ্যানেলের নিউজ চলছে, এটাই তো নোবেল প্রাইজ পাওয়ার মত ঘটনা।

আমরা সাংবাদিকরা সব চ্যানেল ফলো করি। কে কি লিখলো, বললো। সার্বিক বিচারে একাত্তর, সময়, ইন্ডিপেন্ডেন্ট হয়ত তথ্যটা সবার আগে জানাতে পারে, কিন্তু স্ক্রিপ্ট সম্পাদনা এবং বানানের ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে এদের সংবাদকর্মীরা। একেবারে এ টু জেড। এই দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে একাত্তর। আমার কথা শুনে যদি আঁতে লাগে, তাদের বলছি, টিভি অন করে বসে থাকেন। প্রতি মুহূর্তে একাত্তরের টিকার, স্ল্যাগ বা অ্যাস্টন প্রমাণ দেবে, আমার দাবি/অভিযোগ সত্যি না মিথ্যা। তারপরও এদের ভাবটা এমন যে, মুই কি হনু রে! এদের বানান দেখে আমার সবচেয়ে নবীন রিপোর্টারটাও বলে, ভাইয়া আমাদের যে এত বকা দেন, দেখছেন বিখ্যাত চ্যানেল একাত্তরের অবস্থা? শত শত বানান ভুল। আমি উত্তর দিই, ওরা অধম। তাই বলিয়া তুমি উত্তম হইবে না কেন?

আব্দুর রউফ: যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, মোহনা টেলিভিশন, editorrouf@yahoo.com

Courtesy: Banglanews24.com

নির্বাচনী ফলাফল প্রচারে ঐকমত্যে আসুন:সঞ্জীব রায়


শুধু গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনই নয়, আগের মাসে আরো চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ক্ষেত্রেও ফলাফল প্রচার করতে গিয়ে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো প্রতিযোগিতায় ঘাম ঝরিয়েছে।

সেই প্রতিযোগিতা সুস্থ কি অসুস্থ সে হিসাব মেলাতে গিয়ে আমাদের গণমাধ্যমজগতের বোদ্ধারা সমালোচনা-আত্মসমালোচনারও আর এক প্রতিযোগিতায় সামিল হয়েছেন। এই আলোচনা-পর্যালোচনাগুলো যখন ভুল শুধরে নেবার পথ দেখায় কিংবা সঠিক কাজটি করার তাগিদ দেয় তখন একজন মাঠের সংবাদকর্মী হিসেবে আরো শিক্ষা নেবার চেষ্টা করি।

কিন্তু আমাদের উপরমহলের বোদ্ধা ব্যক্তিরা যখন সমাধানের পথটি না চিনিয়ে কাদা ছুঁড়তে নিজের শক্তি প্রদর্শনের চেষ্টা করেন তখন মনবল হারাই। বিশেষত গাজীপুর সিটি নির্বাচনের পর থেকে অনলাইনে মন্তব্য প্রতিবেদন এবং মতামত হিসেবে বেশ কয়েকটি লেখা নজরে এসেছে।

আর সেখানে কোন লেখায় যখন কী ধরনের ভূল, কী কারণে ভুল, ভুলের প্রতিক্রিয়া কী অথবা ভবিষ্যৎ ভুলের হাত থেকে বাঁচতে করণীয় সম্পর্কে না লিখে প্রতিপক্ষকে হিংস্র পশুর মতো আক্রমণের গন্ধ ছড়ানো হয় তখন তা গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে মেনে নেওয়া যায় না।

খুলনা সিটি করপোরেশন এবং গাজীপুর সিটি করপোরেশনে নির্বাচনপূর্ববর্তী সময় থেকে নির্বাচনকালীন এবং নির্বাচনপরবর্তীকালেও মাঠ পর্যায়ে কাজের সুযোগ হয়েছিলো। একজন রিপোর্টার হিসেবে রাতদিন জেগে মাঠ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সর্বশেষ খবরটি অফিসকে জানানোর চেষ্টা করি। কিন্তু মাঠে থাকতেই যখন টিভি স্ক্রিনের বিভ্রান্তিমূলক তথ্য সম্পর্কে দর্শকরা বিরক্তি এবং ক্ষোভ জানিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন করেন, তখন ঢাকার এয়ার কন্ডিশনড নিউজরুমের দায়িত্বরত ব্যক্তিটিকে সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। পারি না, দূর্ভাগ্য আমাদের। নানাভাবে দর্শকের প্রশ্ন ঘুরিয়ে অন্যদিকে নিয়ে যেতে হয়।

কিন্তু অক্লান্ত পরিশ্রম করে গাজীপুর সিটির নির্বাচন শেষ করে ৭ জুলাই যখন অফিস হয়ে রাতে বাসায় ফিরলাম, তখন নিজেকে ব্যর্থ আর অথর্ব বলে মনে হচ্ছিল। আমি যে বাসায় সাবলেট থাকি, সেই বড় ভাইয়ের সঙ্গে রাতে খাবার টেবিলে বসলে তিনি প্রথমে বললেন, “খুব পরিশ্রম হয়েছে এই ক’দিন তাই না? কিন্তু এটা আপনারা সবাই কী করলেন? ছিঃ ছিঃ Ñ ছিঃ! বিরক্ত হয়ে আমি টিভি দেখাই বন্ধ করে দিচ্ছি।”

খুব কষ্টে খাবারটা গলা দিয়ে নামানোর পর আমতা আমতা স্বরে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে ভাই বলেন তো?”

বেশ উত্তেজিত ভঙ্গিমায় তিনি বললেন, “সব টিভি চ্যানেল উল্টাপাল্টা রেজাল্ট দেওয়া শুরু করছে। কেউ একবার অনেকক্ষণ কোন আপডেট দেয় না। আবার কেউ একলাফে দেখায় ফাইনাল হিসাব। কিছুই বুঝি না।”

ব্যাপারটা কিছুটা বুঝতে পেরে আর কথা বাড়ালাম না। শুধু মনে মনে ভাবলাম, এই মানুষটি অথবা তার মতো সাধারণ দর্শকরা যদি জানতেন আমরা কোন জায়গা থেকে, কীভাবে এই ফলাফল ঢাকায় জানাই, তাহলে হয়তো এতো রাগ থাকতো না তার। আবার একই সঙ্গে সেই গুমোর ফাঁস হয়ে গেলে মিডিয়াকর্মী বা মিডিয়ার প্রতি এতো আস্থা-বিশ্বাসও কমে যেতে পারে- সেই ভাবনাটাও কাজ করলো। কিন্তু পরদিন থেকে যেসব লেখালিখি হয়েছে, তাতে অনেকেই জেনে গেছেন অসমর্থিত সূত্র আর বেসরকারি সূত্রের আদ্যোপান্ত।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ফলাফল প্রচার নিয়ে একই দিনে দু’টি লেখা প্রকাশ পায় বাংলানিউজে। লেখা দু’টি পড়ে খুবই আশ্বস্ত হই যে, মাঠের বাস্তবতাটা অনেকেই হয়তো এবার গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে শুরু করবেন। হিসাবের তারতম্য থাকলে যে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে সে বিষয়টিও লেখাগুলোতে উঠে এসেছে।

ফল প্রকাশের রাতে আজমত উল্লা খানের বাসার নীচে আমরা ক’জন রিপোর্ট‍ার অপেক্ষা করছি। এমন সময় আজমত উল্লাহ খানের সমর্থক দু’জন ছাত্রলীগ নেতা এসে জিজ্ঞেস করলেন, ভাই খবর পাইছি, অবস্থা নাকি আরো ভালো হইছে? নতুন ৫টা কেন্দ্রে ভাই নাকি আগায় আছে অনেক ভোটে? খোজ নেন না একটু!

তাদের এমন আগ্রহে আমাদের মুখ যেনো কালো হয়ে যায়। পরে আমরা রিপোর্টাররা সেই আলোচনাটাই শুরু করি। সত্যি সত্যিই যদি এখন টানা আজমতউল্লাহ খান এগিয়ে যেতে থাকেন, তাহলে তো মহাবিপদ। টিভি চ্যানেলগুলো যে হারে এগিয়েছে, তাতে ফলাফল বাস্তবে যদি অন্যরকম হয় তাহলে দর্শককে বিশ্বাস করানো সম্ভব হবে না।

তখনই কিন্তু আমাদের সবার মধ্যে একটি বিষয় অনুভূত হয় যে, ফলাফল জনসমক্ষে প্রচার বা প্রকাশের ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য এবং দায়িত্বশীল সূত্রের আশ্রয় নিতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই। কিন্তু কে শোনে কার কথা!

দর্শককে তো দেওয়া চাই সবার আগে সর্বশেষ খবর। এই মানসিকতায় বিভোর থেকে একটি কথা মনে হয় আমরা ভুলেই যাই, কোন তথ্য প্রকাশে দর্শকের মধ্যে কী প্রভাব-প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে।

খুব খোলাসা করে বলতে চাই, মাঠে কর্মরত অবস্থায় আমাকে যদি যে কোন মূল্যে সবচেয়ে বেশি কেন্দ্রের ভোটের ফলাফল বের করতে বলা হয়, তবে নানা অসমর্থিত সূত্র থেকে সেই কাজটা আমি বা আমরা যারা মাঠে থাকি করতে পারবো। কিন্তু সেই ফলাফল টিভি পর্দায় দর্শককে জানানো কতোটা দায়িত্বশীলতার প্রমাণ দেবে সেটি মনে হয় বিবেচনা করা উচিৎ।

কারণ, খুলনার কথা মনে পড়ে। রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে একটি নিউজ চ্যানেলের একজন রিপোর্টার বড় ভাই, খানিকক্ষণ পরপর এসে জিজ্ঞেস করছিলেন, “কয়টা দিয়েছো”? যথারীতি আমি যে কটি কেন্দ্রের হিসাব পেয়েছি তাকে জানাচ্ছিলাম। একই সঙ্গে আশপাশে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা বিভিন্ন সূত্রে সর্বোচ্চ যে ক’টি কেন্দ্রের খবর পাচ্ছিলেন সব বলছিলেন। সেই রিপোর্টার বড় ভাই সর্বোচ্চ যে হিসাবটি পাচ্ছিলেন সেটাই সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে ঢাকায় জানাচ্ছিলেন।

এখন এ ধরনের তথ্য সরবরাহ শেষ বিচারে আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতাকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে সেটা ভেবে দেখা উচিৎ। বিভিন্ন উৎস এবং সূত্র থেকে তথ্য নেওয়া হলে এক এক টেলিভিশন এক এক রকম হিসাব দিতে থাকবে। কোনভাবেই তা থেকে পরিত্রাণ মিলবে না। তাই ব্যক্তিগতভাবে আমার মত হলো- যতো দেরিতেই হোক, রিটার্নিং কর্মকর্তার দেওয়া তথ্যই একযোগে সব গণমাধ্যমে প্রচার এবং প্রকাশ করা হোক। যে কথাটা চ্যানেল আইয়ের বার্তা সম্পাদক এবং সময় টেলিভিশনের বার্তা প্রধানের লেখায় খুব স্পষ্ট করে এসেছে। তাদের দু’জনের অভিমত-বিশ্লেষণের পরবর্তী আর একটি লেখার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে।

ব্যক্তিকেন্দ্রিক আক্রমনে ঠাসা সেই রচনা থেকে ভুল শুধরে নিয়ে কোন পথে চলা উচিৎ সেই পথনির্দেশ পাইনি। তবে, দুর্বল সাংবাদিকতার যে সংজ্ঞাটা সেখানে দেওয়া হয়েছে, সেটা সংবাদপত্র না কি টিভি সাংবাদিকদের জন্য জানতে ভীষণ ইচ্ছে হয়। যে কোন রিপোর্ট যখন একাধিক বিশেষজ্ঞ এবং কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে তৈরি করি, তখন কোন একটি লাইনে বা বাক্যে ‘বিশেষজ্ঞরা বলছেন’ ব্যবহার করে থাকি। সেটা ব্যবহার করলেই কি আমি দুর্বল সাংবাদিক হয়ে যাবো?

সবল সাংবাদিক হওয়ার জন্য কি ভয়েসওভারে জনাব অমুক এবং অধ্যাপক তমুক আরো বলছেন- ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়? যাই হোক সাংবাদিকতা শেখার জন্য কর্মক্ষেত্র, বই, প্রশিক্ষণ আর দর্শকের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তাদের অনেকেরই ভাগ্য ভালো যারা নিউজরুমে বসে থেকে দর্শকের প্রতিক্রিয়াগুলো সরাসরি পান না।

তবে, আমাদের বোদ্ধা ব্যক্তিদের কাছ থেকে শুধু এটুকুই আশা করবো, তারা যেনো নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে গিয়ে আক্রমনাত্বক হয়ে না ওঠেন। সমালোচনা সমাধানের পথ তৈরির জন্য কিন্তু আক্রমন আর পাল্টা আক্রমনের মধ্যে কোন পথনির্দেশ নেই। সমালোচনাকে যারা কাদা ভাববেন, তারা কিন্তু আরো কাদা ছড়ানোর কাজে লিপ্ত হবেন। তাদের থেকে নিরাপদ দূরে থেকেই আমাদের একটি সর্বসম্মতিতে আসতে হবে। গঠনমূলক সমালোচনাগুলোকে একত্র করে আমাদের শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিরা বসে ভোটের ফলাফল প্রকাশের বিষয়ে একটি নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌছুলে আমরা রিপোর্টাররা স্বস্তি পাবো। অপেক্ষায় থাকছি সেই সিদ্ধান্তের।

সঞ্জীব রায়, সংবাদকর্মী: royratan.sanjib@gmail.com
Courtesy: Banglanews24.com

ইঁদুর কারা, আয়না কাদের?-অনুপম দেব কানুনজ্ঞ


নির্বাচনের ফলাফল আগে দেওয়া নিয়ে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ইঁদুর দৌঁড় এবং পরবর্তীতে আয়নায় চেহারা দেখা সংক্রান্ত পাল্টা একটি লেখা আমার দৃষ্টি কাড়ে। সময় টেলিভিশনের বার্তা প্রধান তুষার আবদুল্লাহ এবং একাত্তর টেলিভিশনের যুগ্ম বার্তা সম্পাদক পলাশ আহসান-এর তুলনায় ব্রডকাস্ট জার্নালিজমে আমি একেবারেই ‘নাক টিপলে দুধ বের হবে’ টাইপের শিশু হলেও কিছু লেখার ধৃষ্টতা সামলাতে পারলাম না।

একটা সময় ছিল, যখন পরিবারের সবাই মিলে বিটিভি-এর রাত ৮টার সংবাদ দেখতাম। সংবাদ শুরু হতো ‘প্রধানমন্ত্রী …বলেছেন’ দিয়ে। ৮টার সংবাদ মোটেও দেশের খবর জানার জন্য না, আমরা আসলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম ৮টার সংবাদ শেষ হওয়ার পর থেকে ১০টার নিউজ এট টেন শুরু হওয়ার মধ্যবর্তী সময়টুকুর জন্য। কারণ ওই সময়টুকুতেই তখনকার দিনে আকর্ষণীয় সব নাটক, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান দেখাত।

সায়মন ড্রিং-এর একুশে টিভি এসে সব ধারণা ওলট-পালট করে দিলো। ভালো কিছু সম্পর্কে কোন ধারণা না থাকায় ইটিভি যা দেখাতো, তাই গোগ্রাসে গিলতাম। এক বছরেরও বেশি সময় বিটিভি বলে যে একটা টিভি আছে, সেটাই ভুলে যেতে বসেছিলাম আমরা। এরপর সিএসবি আসে দেশের প্রথম নিউজ চ্যানেল হিসেবে। সংবাদ পরিবেশন ও সংগ্রহ সম্পর্কে এক নতুন ধারণা তৈরি হয় দর্শকদের মধ্যে।

এই দুই চ্যানেল বন্ধ হয়ে গেলেও পরবর্তীতে নতুন নতুন নিউজ ও এন্টারটেইনমেন্ট চ্যানেল আসায় অনুষ্ঠান ও নাটকের মান যেমন পড়তে থাকে, সংবাদের মানও পড়তে থাকে। তবে আমার কথা শুধু মান নিয়ে নয়, জ্ঞান নিয়ে। ইটিভি ও সিএসবি, এই দুই চ্যানেলের কর্মীরাই এখন বেশিরভাগ চ্যানেলের উচ্চ আসনে আসীন আছেন। সংবাদ জগতে এই দুই চ্যানেলের কর্মীদের ধরে নেওয়া হয় গুরুর কাতারে। তাই আজকের অবস্থার জন্য দায় তারাও কি এড়াতে পারেন?

যে দু’টি লেখার প্রেক্ষিতে আমার এই লেখা, সে দু’টির মতো কোন সুনির্দিষ্ট চ্যানেলের নাম উল্লেখ করতে চাই না। তবে যারা নিয়মিত টেলিভিশনে চোখ রাখেন, তাদের জন্য ইশারাই কাফি বলে ধরে নিয়ে কয়েকটি ঘটনার কথা বলতে চাই। ঘটনাগুলো কারো কাছ থেকে শোনা নয়, মাঠে থেকে প্রত্যক্ষ করা।

ঘটনা-১
ঘটনাস্থলঃ মোহাম্মদপুর। কোন এক হরতাল। বসে আছি কিছু ঘটার আশায়। সঙ্গে বিভিন্ন চ্যানেলের আরো ক’জন কর্মী। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে কিছু না পেয়ে আমরা খুব হতাশ, চায়ের দোকানে চা খাওয়ার জন্য থামলাম।

‘হরতালে কোথায় কি হয়, সব জানে”-খ্যাতি প্রাপ্ত আমাদের এক সহকর্মীই হঠাৎ বললেন, “কিছু না হলে কেমন হয়? দিনতাই তো মাটি তাহলে। দাঁড়াও দেখি কিছু করা যায় কি না।”

এই বলে তিনি পকেট থেকে মোবাইল বের করে কাকে যেনো ফোন করলেন। ফোনে কার সঙ্গে কি কথা হলো তা আর শুনিনি, তবে ফোন রেখেই আমাদের বললেন, “চলো, জিগাতলার দিকে বাসে আগুন লাগবে।”

প্রতিক্রিয়া
সবার অফিস জ্বলন্ত বাসের ঝকঝকে ছবি চকচকে স্ক্রিনে চালাচ্ছে। অন্য এক চ্যানেলের সহকর্মী ভাই আমার ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থাকায় ছবিটি পাননি। ফলশ্রুতি, অফিস থেকে ঝাড়ি। একটা ক্যাসেট নিয়ে দৌঁড়ে এসে আমাদের কাছ থেকে ফুটেজ নিয়ে অফিসে পাঠালেন, এবার অফিস শান্তি!!!

ঘটনা-২
ঘটনাস্থলঃ রানা প্লাজা, সাভার। জীবিত উদ্ধারের আশা প্রায় ছেড়ে দেওয়ার পর হঠাৎ করেই একটি কক্ষে কয়েকজন জীবিতের সন্ধান মেলে। সাত তলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত কংক্রিট গর্ত করে আটকে পড়াদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে উদ্ধারকারী বাহিনী। প্রায় ঝিমিয়ে পড়া মিডিয়া আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে। সবার আগে সবশেষ ছবিটি যতো ঝুঁকি নিয়েই হোক দেখাতে হবে।

২৪ ঘণ্টা সংবাদভিত্তিক একটি চ্যানেলের একজন সিনিয়র নারী সাংবাদিক ঢুকে গেলেন এমন এক গর্তের ভেতরে। আটকে পড়াদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। একা না, সঙ্গে তার ক্যামেরাম্যান। উদ্ধারকাজে ব্যাঘাত হচ্ছে, তাই দমকল বাহিনীর উদ্ধারকারীরা বাধা দেওয়ার মৃদু চেষ্টা করলো।

সিনিয়র রিপোর্টার ঝাড়ি দিলেন, “বেশি কথা বলবেন না, আমাকে কাজ করতে দিন।”

ঘটনাস্থলে উপস্থিত সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারীরাও ভয়ে কিছু বললেন না, কারণ তাদের বিরুদ্ধে এমনিতেই উদ্ধারকাজে অবহেলার অভিযোগ ছিলই। কয়েক ফুট গর্তের ভেতর দিয়ে চার তলা নিচে নেমে যে অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে আটকে পড়াদের সাক্ষাতকার নিয়ে আসেন আমাদের জ্যেষ্ঠ সহকর্মী, তাতে প্রায় ৩০ মিনিটের মতো বন্ধ ছিলো উদ্ধারকাজ।

প্রতিক্রিয়া
কিছুক্ষণ পরে আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য এক চ্যানেলের এক ছোট ভাই বললো, “ভাই থাকেন, আসতেছি।” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কই যাও?” “আর বইলেন না। গর্তে যাই। অফিস অমুক টিভিতে দেখসে তমুকরে গর্তে নাইমা ইন্টারভিউ নিসে। আমারে ফোন কইরা বলে, তুমি সাভারে বইসা বইসা করো টা কি?”

ঘটনা-৩
ঘটনাস্থলঃ গাজীপুর। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের দিন। টঙ্গীর লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল। ১৪ দল সমর্থিত প্রার্থী আজমত উল্লা খান এসেছেন ভোট দিতে। স্বভাবতই মেয়র প্রার্থী একা আসেন নি। একগাদা লোক নিয়ে তিনি ঢুকেছেন একতলা, পাঁচ কক্ষ বিশিষ্ট ছোট্ট এই কেন্দ্রে। যে কক্ষে তিনি ভোট দেবেন, সেখানে আগে থেকেই অবস্থান নিয়ে আছে দশ-বারোটি টেলিভিশন ক্যামেরা, আজমত ভোট দিচ্ছেন এই ছবিটা সবার খুব ভালো করে চাই। ফলে জনসংখ্যার চাপে অন্য চারটি বুথেও বন্ধ হয়ে গেলো ভোটগ্রহণ।

অন্য সবাই তার বাইট/শট বা সাক্ষাতকার নেওয়ার জন্য বাইরে অপেক্ষা করলেও ‘সবার আগে দেখাতে হবে’, এই চিন্তায় কক্ষের ভেতরে লাইভ শুরু করলেন একটি ২৪ ঘণ্টার সংবাদভিত্তিক চ্যানেলের রিপোর্টার। তিনি লাইভে আজমত উল্লা খানের বক্তব্য প্রচার করে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে গেলেন। ফলাফল, প্রায় ২০ মিনিটের মতো ভোট গ্রহণ স্থগিত।

এখানেই ঘটনা শেষ হতে পারতো। কিন্তু ঠিক কেন্দ্রের প্রবেশ মুখেই উপস্থিত ছিলেন আরেক চ্যানেলের এক নারী সহকর্মী। ‘ভোটারদের অসুবিধা হবে, আমরা বাইরে ফাঁকা জায়গায় গিয়ে বক্তব্য নেই’, সহকর্মীদের বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও ওই জায়গাতেই আজমত উল্লা খানের বক্তব্য নিতে তিনি বদ্ধপরিকর।

শেষ পর্যন্ত জনস্রোতে ওই জায়গা থেকে সরে এলেও বাইরে এসে শুরু হয় বক্তব্য নেওয়ার যুদ্ধ। সবাইকেই আগে বক্তব্য নিতে হবে, সব ভিডিওগ্রাফারকেই পেতে হবে ভালো পজিশন। এই ধাক্কায় আমিসহ আরো কয়েকজন সহকর্মী ছিটকে পড়ি। সিদ্ধান্ত নিই, সবার শেষ হলে আমরা তার সঙ্গে আলাদা কথা বলবো।

প্রতিক্রিয়া
সব চ্যানেলকে বক্তব্য দেওয়ার পর আমরা বাকি কয়েকজন আজমত উল্লা খানকে আবার থামাই। “আবার কথা বলতে হবে আপনাকে।” তিনিও হাসিমুখেই প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তর দিলেন।

লাইভ ফিড সবারই রেডি থাকায় সঙ্গে সঙ্গেই আমরা তা ঢাকায়ও পাঠিয়ে দিলাম। তবে সব মিলিয়ে আমাদের প্রায় ৩০ মিনিট দেরি হয়ে গেলো। একটু পরে দেখি এক সহকর্মী মন খারাপ করে বসে আছে। প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য চ্যানেলগুলো আজমতের বক্তব্য আগের বুলেটিনেই দেখিয়ে দিয়েছে। এজন্য অফিস থেকে ঝাড়ি খেতে হয়েছে ওই সহকর্মীকে।

এমন আরো অসংখ্য ঘটনার উল্লেখ হয়তো করতে পারতাম, কিন্তু এগুলো মাঠে কাজ করা আমার সহকর্মীদের সবারই জানা থাকায় আর চর্বিত চর্বন করলাম না।

আমার প্রশ্ন হলো, সবার আগে, এবং এক্সক্লুসিভ কিছু দেখানোর দৌঁড়ে আমরা এতোটাই মত্ত হচ্ছি দিন কে দিন যে, একজন রিপোর্টার কোন জিনিস কিভাবে মাঠ থেকে সংগ্রহ করলো, তা আমরা কেন চিন্তা করার প্রয়োজনও বোধ করছি না? পরোক্ষভাবে কি উচ্চ আসনে আসীন জ্যেষ্ঠতর কর্মীরাই মাঠকর্মীদের উৎসাহিত করছি না যেনতেন প্রকারের সংবাদ সংগ্রহে? যারা না বুঝেই এমন কাজ করছে, প্রক্রিয়াটা যে সঠিক নয় তাদের শেখাবে কে?

যারা বুঝেই এ কাজগুলো না করছে, তাদের হতে হচ্ছে তিরস্কৃত, এ দায় কাদের? ‘স্পিড’ আর ‘এক্যুরেসি’ –এরও আগে যে এথিক্স বলে সংবাদে একটা জিনিস আছে, তা আমরা ক্ষুদ্র সংবাদকর্মীরা শিখবো কার কাছ থেকে?

নির্বাচনের ফলাফল কেউ আগেই দিয়ে দিয়েছেন বলে জিতে গিয়েছেন, অথবা, পিছিয়ে থেকেছেন বলেই নৈতিকতার দিক থেকে জয়ী হয়েছেন, এমন দাবি করার সময় কি এখনই চলে এসেছে? ফলাফলে বড় ধরনের তারতম্য হওয়ায় সবার নজর এখন গাজীপুর নির্বাচনের দিকে। কিন্তু আমরা প্রতিটি চ্যানেলের সাংবাদিক প্রতিদিনই এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা করে চলেছি মাঠেঘাটে। আমার মনে হয়, পরস্পরকে দোষারোপ না করে ইঁদুর আর আয়নার হর্তাকর্তাদেরই আজ ভাবতে হবে, কোন দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক মিডিয়া?

অনুপম দেব কানুনজ্ঞ, ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন, anupamdkan@gmail.com

আয়নায় নিজের চেহারাও দেখুন:পলাশ আহসান


‘রাবিশ’ শব্দটি এলেই অর্থমন্ত্রীর কথা মনে পড়ে যায়। রেগে গিয়ে তিনি প্রায়ই এই শব্দটি ব্যবহার করেন। আজকাল কোন কোন সাংবাদিক নিজেকে সেই পর্যায়ে ভাবতে শুরু করেছেন।

তবে কারণে-অকারণে ব্যবহারের ফলে ‘রাবিশ’ শব্দটি এখন কেমন গা-সওয়া আর মূল্যহীন হয়ে গেছে। কাউকে বা কোন কিছুকে ‘রাবিশ’ বলা হলেই তা রাবিশ হয়ে যায় না।

দিন দু’য়েক আগে বাংলানিউজে এক লেখায় এই ‘রাবিশ’ শব্দটিই ব্যবহার করেছেন সিনিয়র সাংবাদিক তুষার আবদুল্লাহ। গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ফল প্রকাশে গণমাধ্যম, বিশেষ করে টেলিভিশনগুলোর নানা ত্রুটি, সংকট আর ভুল বিশ্লেষণ করতে গিয়েই তুষার আবদুল্লাহর এই লেখার অবতারণা।

বোঝাই যায়, লেখার সময় তিনি যথেষ্টই রেগে ছিলেন। এজন্যে একাত্তর টেলিভিশনকে লক্ষ্য করে, এবং একই সঙ্গে নামহীন একজনকে উদ্ধৃত করে তিনি লিখেছেন ‘রাবিশ মিডিয়া কোনহানকার’।

দুর্বল সাংবাদিক অনেক সময় তার নিজের মন্তব্য ‘সংশ্লিষ্টরা বলেন’, ‘দায়িত্বশীল সূত্র জানায়’, ‘বিশেষজ্ঞরা বলছেন’ ইত্যাদি বলে চালিয়ে দেন। তুষার আবদুল্লাহও পুরনো সেই কৌশলই বেছে নিয়েছেন। যদিও একই ধরনের ‘ইঁদুরদৌড়ে’ তিনিও ছিলেন। অতিরিক্ত ভোটের হিসাব দিয়ে পিছিয়েও এসেছেন। সেই তিনিই যদি বড় মন্ত্রীর মতো, নিজেকে বড় ভাবতে শুরু করেন, উদ্দেশ্যমূলকভাবে একই ভুলের অভিযোগে অন্যের ত্রুটি খুঁজে বেড়ান, তখন গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে এই লেখা না লিখে পারা যায় না।

অবশ্য নিজের মাছটিও না লুকিয়ে লেখায় রীতিমতো ক্ষমাও চেয়েছেন তিনি। এর মানে হলো নিজের বিরাট ভুলকেও, নিজেই ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখার ‘ভান’ তিনি করেছেন। তবে পুরো লেখা জুড়ে তিনি একাত্তর, ইন্ডিপেন্ডেন্টসহ দু’একটি টেলিভিশনের যে কঠোর সমালোচনা করেছেন, তাতে নিজের দিকে তাকানোর সময়ই হয়তো তিনি ঠিকমতো পাননি।

লেখায় তিনি বলছেন, শুরু থেকেই টেলিভিশন চ্যানেলগুলো রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে প্রকাশিত ফল অনুসরণ করেনি। কথা খুবই সত্য। এমনকি যখন রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে কোনো ফলই ঘোষণা করা হয়নি, তখন অনেক টেলিভিশনই ফল দিতে শুরু করে দেয়। অসুস্থ প্রতিযোগিতার শুরুটা এখান থেকেই। আর কয়েকটি টেলিভিশনের সঙ্গে এই প্রতিযোগিতায় নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে সময় টেলিভিশনকে।

যখন সময় টেলিভিশন ৩টি কেন্দ্র থেকে পাওয়া ফল প্রচার শুরু করে, তখন রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে কি ফলাফল প্রকাশ শুরু হয়েছিল? তারপর অন্য কয়েকটি টেলিভিশনের মতো সময় টেলিভিশন যে গতিতে ফলাফল প্রচার করতে থাকে, সেগুলোর সূত্র কি?

এটা খুবই সত্য যে বিভিন্ন চ্যানেল নানা রকম তথ্য পরিবেশন করছিল। যেসব তথ্যের মধ্যে মিলও খুব বেশি পাওয়া যাচ্ছিল না। এটি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতার ফল। আর এতে দর্শকরা বিভ্রান্ত হয়েছেন।

দর্শক দ্রুত ফল দেখতে চান। আর দর্শকের এই আগ্রহকে মাথায় রেখে বিশেষ এই দিনটিতে অনেক গণমাধ্যম যাচাই-বাছাইয়ের ধার ধারতে চায় না। সেই তালিকায় কি সময় টেলিভিশন ছিল না?

ফলাফল প্রকাশের সম্পূর্ণ অধিকার কেন্দ্রে প্রিজাইডিং কর্মকর্তার, আর সব মিলিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার। পরে সেই ফল গ্যাজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। তাহলে আদর্শ নিয়ম অনুযায়ী, আমাদের সবারই তো রিটার্নিং কর্মকর্তার দেওয়া ফলই অনুসরণ করা উচিত। তাই নয় কি? তাহলে তা কেন সবাই অনুসরণ করলো না?

যে কোনো সূত্র থেকে যেনতেন উপায়ে ফলাফল প্রকাশের ধারা শুরু হয়েছে সাম্প্রতিককালে। বিশেষ করে এই ধারা প্রকট হয়েছে গত চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময়। তাহলে সবাইকেই একটি জায়গায় ঐকমত্যে আসতে হবে। দায়িত্বশীলতার জায়গা থেকে সবাইকে একটা সিদ্ধান্তে তো পৌঁছ‍ুতে হবে। সেটা দর্শকদের স্বার্থেই।

বড় কথা বিভ্রান্তি দূর করার স্বার্থে। আর এভাবে নির্বাচনের ফল প্রকাশের ক্ষেত্রে ফলাফলের উপর প্রভাবও কি পড়ে না, পড়তে পারে না? সেই ঝুঁকি গণমাধ্যমগুলো কেন তৈরি করে দিচ্ছে?

কোন টেলিভিশন কোন সময় কত ভোটের সংখ্যা দেখাচ্ছিল তা উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন তুষার আবদুল্লাহ।

তিনি লিখেছেন, ‘যদিও সময় টেলিভিশন প্রায় এক ঘণ্টা ২০৩টি ভোট কেন্দ্রতে টেলিভিশন প্রতীকের ভোট দেখিয়েছিল ২ লাখ ৩০ হাজার এবং দোয়াত-কলম প্রতীকে ১ লাখ ২৮ হাজার। পরে তারা ভোটের সংখ্যা কমিয়ে আনে’। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেন সময় টেলিভিশন এই সংখ্যা কমিয়ে আনলো? সংকটটা কোথায় ছিল? এর কোনো ব্যাখ্যা কিন্তু লেখায় পাওয়া গেল না।

শুরু থেকেই একাত্তর টেলিভিশন ভুল সংবাদ দেওয়ার চেয়ে সতর্ক থাকার অবস্থান গ্রহণ করে। ফলে তুষার আবদুল্লাহ ঠিকই বলেছেন, ফল প্রকাশের ক্ষেত্রে শুরু থেকেই একাত্তর টেলিভিশন ছিল সংযমী। যাকে অনেকেই পিছিয়ে থাকা বলার চেষ্টা করে। এই অপবাদ মাথায় নিয়েও বস্তুনিষ্ঠতার স্বার্থে গড্ডলিকা প্রবাহে গা না ভাসানোর সিদ্ধান্ত ছিল কর্তৃপক্ষের। তুষার আবদুল্লাহ তার লেখায় এই কৃতিত্ব দিয়েছেন প্রথম আলো আর বিডিনিউজকে।

যে জায়গাটি নিয়ে জনাব তুষার আবদুল্লাহ’র যত ক্ষোভ, দু:খ তা হচ্ছে তারা এতটা এগিয়ে থাকার পর হঠাৎ করে একাত্তর আর ইন্ডিপেন্ডেন্ট কি করে তাদের আগে ব্রেকিং দিয়ে দিল। এতে সংখ্যাগত বড় তারতম্য, তাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চান তিনি। বড় অপরাধী প্রমাণ করতে চান একাত্তরকে।

জনাব তুষারের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে স্বীকার করে নিচ্ছি, সংখ্যাগত তারতম্য একাত্তরে প্রচারিত সংবাদে ছিল। এমন পরিস্থিতিতে কম থেকে কেন হঠাৎ করে চূড়ান্ত ফল প্রকাশের মতো পরিস্থিতি তৈরি হলো, সেই প্রশ্নও এসেছে।

জানার জন্য বলছি, লক্ষ্য করে থাকবেন- একাত্তর ফল প্রকাশে দু’টি উপায় অবলম্বণ করেছে। প্রথমটি স্ল্যাগ এর মাধ্যমে। এখানে অসমর্থিত সূত্র উল্লেখ করে ফল দেওয়া হচ্ছিল। আরেকটি পিআইপিতে গ্রাফিক্স করে।

পিআইপিতে ছিল রিটার্নিং কর্মকর্তার দেওয়া ফল। এটা দর্শকদের কাছে স্বচ্ছ থাকার প্রয়াস থেকে করার চেষ্টা করা হয়েছে। এই কৃতিত্ব তুষার আবদুল্লাহ দিতে না চাইলেও, দর্শক নিশ্চয়ই বুঝেছেন টেলিভিশের মধ্যে একমাত্র একাত্তরই সেদিন রিটার্নিং কর্মকর্তার ফলও সমানতালে দিয়েছিল।

তুষার আবদুল্লাহ লিখেছেন, ‘একাত্তরে একটি পর্যায়ে প্রচার করা হয়, ৩৯২টি ভোটকেন্দ্রের সবগুলোতে অধ্যাপক মান্নান পেয়েছেন ৪ লক্ষ ৬৮ হাজার ভোট। দোয়াত-কলম প্রতীক নিয়ে আজমত উল্লাহ পেয়েছেন ৩ লক্ষ ১২ হাজার ভোট। এতে ভোট দাঁড়ায় ৭ লাখ ৮০ হাজার।’

মজার ব্যাপার হলো- সবাই যে সূত্র ব্যবহার করে ওইদিন ঘোড়দৌড়ে মেতেছিল, এই ফলও সেই একই সূত্র থেকে পাওয়া। এখন কেন্দ্র অনুসারে ফলাফল এবং ভোটারের সংখ্যা যোগ করলে টেলিভিশনগুলো কোন সূত্র উল্লেখ করে যে ফল প্রকাশ করছিল, তার শেষ সংখ্যাটি এটিই দাঁড়ায়। একাত্তর টেলিভিশন মনে করে, চূড়ান্ত এই ফলাফল ‘অসমর্থিত’ ব্যানারে ঘোষণা করা যেতে পারে। যেহেতু একই সঙ্গে রিটার্নিং কর্মকর্তার ফলাফলটিও ছিল।

তারপরও বলছি, তখন পর্যন্ত কি পরিষ্কার জানা গিয়েছিল- আসলে কত শতাংশ ভোট পড়েছিল? প্রথমে জানা গেল, প্রায় ৬০ শতাংশ, পরে তা হলো ৬৫ শতাংশ। পরে বলা হচ্ছিল, ৭৮ শতাংশ। শেষটায় যে প্রায় ৮০ শতাংশ নয়, সে ব্যাপারে কে নিশ্চয়তা দিয়েছিল তখন? হতেও তো পারতো ৮০ শতাংশ ভোট পড়েছে।

অসুস্থ আর অপ-সাংবাদিকতা করার বহু উদাহরণ অনেকের জন্যে প্রযোজ্য। যদিও তা কাম্য নয়। জুতা পরে কবরে নেমে রিপোর্টারের পিটিসি দেওয়া কিংবা রানা প্লাজার অন্ধকূপ থেকে ১৭ দিন পর উদ্ধারের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সময় টেলিভিশন একেবারে আইসিইউতে ঢুকে সরাসরি লাইভ নিউজ করার নামে খুব দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে?

প্রতিযোগিতার কারণে অনেকেই নিজেদের দায়-দায়িত্বও ভুলে যান। তাই আয়নায় নিজের চেহারাটাও দেখুন।
লেখক: যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, একাত্তর টেলিভিশন

Source: Banglanews24.com


ভোটের ফলাফল প্রচারে ইদুঁরদৌড় :তুষার আবদুল্লাহ


দর্শকরা কি আমাকে ক্ষমা করেছেন? যারা ৬ জুলাই বিকেল চারটার পর টেলিভিশন সেটের সামনে বসে ছিলেন, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ফলাফল জানতে। তাদের শুরু থেকেই বিভ্রান্তিতে ফেলে দিয়েছিলাম। বিভ্রান্তির ঘূর্ণিতে নাকানিচুবানি খাইয়েছি তাদের। যেহেতু গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কোনো কেন্দ্রেই ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ছিল না, তাই ভোটগ্রহণ শেষের প্রথম ঘণ্টার মধ্যে কোথাও ভোট গণনা শেষ হয়নি। অবশ্য নির্ধারিত সময় শেষ হবার দেড় ঘণ্টা পরেও ৩৭টি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ চলছিল। টেলিভিশন চ্যানেলে ভোটের ফল প্রচার শুরু হয় সোয়া ছয়টার দিকে। তখন প্রায় সব চ্যানেলেই ১২টি ভোট কেন্দ্রের ফল গ্রাফিক্সের মাধ্যমে পরিবেশিত হচ্ছিল। এই ফলগুলো সংবাদকর্মীরা সংগ্রহ করছিলেন রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে অবস্থান নেয়া বিএনপি প্রার্থীর এজেন্টের কাছ থেকে। কোনো কোনো টেলিভিশনের সংবাদকর্মীরা কিছু কিছু কেন্দ্রের ফল সরাসরি প্রিজাইডিং অফিসারের কাছ থেকে সংগ্রহ করছিলেন। এই সময় পর্যন্ত রির্টানিং অফিসার বেসরকারিভাবে কোনো কেন্দ্রের ফল ঘোষণা করেননি। শুরু থেকেই বিএনপি সমর্থিত প্রাথী অধ্যাপক এম এ মান্নান আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রাথী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লার থেকে এগিয়ে ছিলেন। এই ধারা শেষ অবধি অব্যাহত ছিল। শুধু বেড়েছে ব্যবধান। কিন্তু রাত যতো বেড়েছে ফল জানানোর প্রতিযোগিতায় ততোই বেপরোয়া হয়ে উঠছিল টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। রির্টানিং অফিসার মধ্যরাত পর্যন্ত ফল ঘোষণায় ১০০ কেন্দ্র না পেরোলেও, টেলিভিশন চ্যানেলগুলো এই সময়ের মধ্যে ৩৯২টি কেন্দ্রের ২০০ ভোটকেন্দ্রের ফল প্রচার করে ফেলে। এই ফল তারা কোন সূত্র থেকে পাচ্ছে কোনো চ্যানেলই নিশ্চিত করেনি।

কেউ বলেছে অসমর্থিত সূত্র, আবার কেউ বলেছে নানা সূত্র থেকে প্রাপ্ত। কিন্তু এক চ্যানেলের সঙ্গে অপর চ্যানেলের কেন্দ্র ও ভোটের সংখ্যায় মিল ছিল না। ফলে দর্শকরা নির্দিষ্ট কোনো চ্যানেলকে আস্থায় রাখতে পারছিলেন না। তাই রিমোট কন্ট্রোলের উপর জ্বালাতন বেড়ে যায়। চ্যানেল বদলাতে গিয়ে দর্শকরা পড়ে যান বিভ্রান্তির খাদে, কোন ফলকে তারা বিশ্বাস করবেন। একটা বিষয় দর্শকরা বুঝে গিয়েছিলেন যে এগিয়ে আছেন টেলিভিশন প্রতীক নিয়ে এম এ মান্নান। কিন্তু ভোটের অংক তারা মেলাতে পারছিলেন না। একদিকে টেলিভিশন চ্যানেলের বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত ফলের গরমিল, অন্যদিকে রিটার্নিং অফিসারের পক্ষ থেকে ধীরগতিতে ফল ঘোষণা দেখে, দর্শকরা নানা ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং-র অতীত অভিজ্ঞতার স্মৃতিতে খানিকটা নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছিলেন।

ফল প্রচারের এক পর্যায়ে দেখা যায় টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর বেশ কয়েকটির কেন্দ্রের সংখ্যা একই। কিন্তু ভোটের সংখ্যা এক নয়। প্রথম ভাবা হয়েছিল কেন্দ্রের সংখ্যা এক হলেও, হয়তো কেন্দ্র এক নয় তাই ভোটের সংখ্যা ভিন্ন। কিন্তু এই অবস্থা বেশ কিছুক্ষণ থাকার কারণে সংশয় বাড়ে। দেখা যায় ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশন ২৭৯টি ভোটকেন্দ্রে টেলিভিশন প্রতীকের প্রাথী’র ভোট দেখাচ্ছিল ২ লাখ ৩ হাজার আর সময় টেলিভিশন ২০৩টি ভোট কেন্দ্রে ভোটের সংখ্যা একই দেখাচ্ছিল। দোয়াত কলম প্রতীক প্রার্থীর ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ছিল ১ লাখ ২৮ হাজার। যদিও সময় টেলিভিশন প্রায় এক ঘণ্টা ২০৩টি ভোট কেন্দ্রতে টেলিভিশন প্রতীকের ভোট দেখিয়েছিল ২ লাখ ৩০ হাজার এবং দোয়াত-কলম প্রতীকে ১ লাখ ২৮ হাজার। পরে তারা ভোটের সংখ্যা কমিয়ে আনে। এদিকে একাত্তর টেলিভিশন ফল প্রচারের ক্ষেত্রে রাত ৯টার পর থেকে স্থিতাবস্থায় চলে যায়। সব চ্যানেল এমনকি রিটার্নিং অফিসারের ফল ঘোষণায় গতি এলেও একাত্তর টেলিভিশন মধ্যরাত পর্যন্ত স্থির ছিল ৯৭টি ভোট কেন্দ্রের ফল প্রচারে। মধ্যরাতের পর আচমকা দেখা গেল, একাত্তর টেলিভিশন সর্বশেষ সংবাদ হিসেবে দর্শকদের জানাচ্ছে ৩৯২টি ভোট কেন্দ্রে দোয়াত-কলম প্রতীক পেয়েছে ৩ লাখ ১২ হাজার ভোট এবং টেলিভিশন প্রতীক পেয়েছে ৪ লাখ ৬৮ হাজার ভোট। এই একই ফল ব্রেকিং নিউজ হিসেবে দেশ টেলিভিশন এবং ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনও প্রচার করতে থাকে। বাংলাভিশন নিজে কোনো ঝুঁকি না নিয়ে একই ফল জানাতে থাকে ইন্ডিপেন্ডেন্ট এবং একাত্তর টেলিভিশনের বরাত দিয়ে। এই ঘটনাটি সম্ভবত বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশনের ইতিহাসে প্রথম ঘটলো। যদিও একই সময়ে বাংলাভিশন তাদের টিকার বা স্ক্রলে জানাচ্ছিল ৩২০টি কেন্দ্রের ফল জানাচ্ছিল সেখানে টেলিভিশন প্রতীকের ভোট দেখানো হচ্ছিল ২ লাখ ৫৫ হাজার ৩২১ ভোট এবং দোয়াত –কলমের ১ লাখ ৫২ হাজার ৩২০ ভোট। দর্শকের ভিড়মি খাবার বিষয় হলো যদি টেলিভিশন ৪ লাখ ৬৮ হাজার ভোট পায় আর দোয়াত কলম পায় ৩ লাখ ১২ হাজার তাহলে এই দুই প্রার্থীর প্রাপ্ত মোট ভোট দাঁড়ায় ৭ লাখ ৮০ হাজার। এতে ভোটার উপস্থিতি শতকরা ৮৫ ভাগ ছাড়িয়ে যায়। ভোটার উপস্থিতির এই হার নির্বাচন কমিশন এমনকি কোনো প্রার্থী বা জোটও করার দু:সাহস দেখায়নি। তাহলে একাত্তর এবং ইন্ডিপেন্ডেন্ট এতো ভোট ঐ দুই প্রার্থীর জন্য কোথা থেকে জোগাড় করলো? ভোটের এই যোগানদাতায় পরদিন সকালে কালেরকণ্ঠ পত্রিকাও যোগ দিয়েছে। তারা নিজেরা ভোটের হিসেব করার ফুরসত বা ঝুঁকি না নিয়ে রোববারের পত্রিকার প্রধান খবরে সেই একাত্তর টেলিভিশন এবং ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের হিসেবটিই তুলে দিয়েছে।

শনিবার রাতে অনলাইন পত্রিকাগুলোতে অভিযান চালিয়ে দেখেছি প্রথম আলো অনলাইন, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম, বিডি নিউজ রিটানিং অফিসার ঘোষিত ফলাফলকে অনুসরণ করেছে। বাকি অনলাইন পত্রিকাগুলোর ফলের সংখ্যার সঙ্গে মিল ছিল একাত্তর ও ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের সংখ্যার। শনিবার ও রোববার যারা ভোটের ভুল পরিসংখ্যান দর্শকদের কাছে পরিবেশন করেছেন, সেই টেলিভিশন এবং অনলাইন পত্রিকা এবং সংবাদপত্রগুলোকে দু:খ প্রকাশ করতে দেখিনি। সময় টেলিভশনের একজন রিপোর্টার দু’বার রিটার্নিং অফিসারের অফিস থেকে জানিয়েছেন কেন ভোটের হিসেবে তারতম্য ঘটছে। সূত্রেরও খানিকটা ইঙ্গিত দিয়েছেন। কিন্তু বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিভ্রান্তিহীন এবং একই সংখ্যার ফলাফল ঘোষণার স্বার্থেই জানাটা জরুরি ৮৫ ভাগ ভোটার উপস্থিতির ফল দুটি টেলিভিশন কোন সূত্রে পেলো, এবং যাচাই বাছাই ছাড়া কেন প্রচার করলো, সেই সংগে ঐ সূত্রকে আগামীতে সকলে মিলে বর্জন করার শপথ নিতে হবে। একই সাথে প্রতিযোগিতার ইঁদুরদৌড়ে না নেমে ফল ঘোষণার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলো কেবলমাত্র রিটার্নিং অফিসারের ঘোষিত ফলাফলের প্রতিই আস্থা রাখতেও পারে কিনা। সবাই একই গতিতে ফলাফল প্রচার করলে, অস্থিরতা কমে আসবে। সংবাদকর্মী হিসেবে এই যাত্রায় দর্শকদের বিভ্রান্তিতে ফেলার জন্য দু:খ প্রকাশ করছি।

"৭১ টিভি জানায়, ৩৯২টি ভোটকেন্দ্রের সবগুলোতে অধ্যাপক মান্নান পেয়েছেন ৪,৬৮,০০০ ভোট। দোয়াত কলম প্রতীক নিয়ে আজমত উল্লাহ পেয়েছেন ৩,১২,০০০ ভোট। ফলে অধ্যাপক মান্নান ১,৫৬,০০০ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন।"

এ ব্যাপারে একজনের মন্তব্য: ‘৭১-র এই রিপোর্ট সত্য হইলে তো ভোট দাঁড়ায় ৭ লাখ ৮০ হাজার। এত ভোট আইলো কইত্থে। রাবিশ মিডিয়া কোনহানকার....’---

লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টেলিভিশন- tushar.abdullah@gmail.com

ধর্ষণের পশ্চিমবঙ্গ: বিক্রমজিত ভট্টাচার্য



ভারত সরকারের মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক বলছে, ‘গোটা দেশে ধর্ষণসহ সকল প্রকার নারী নির্যাতনে পশ্চিমবঙ্গ শীর্ষে’।
আর রাজ্যের মহিলা মুখ্যমন্ত্রী বলছেন- ‘সব মিথ্যে কথা, অপপ্রচার’।
পশ্চিমবঙ্গে ‘পরিবর্তনের সরকারের’ এখনও পর্যন্ত ২৬ মাসের মেয়াদে ‘ধর্ষণ’ শব্দটি প্রতিদিন প্রতিটি কাগজ ও নিউজ চ্যানেলে শিরোনাম। খাস কলকাতার পার্ক স্ট্রীট থেকে শুরু করে রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চল-কাটোয়া, গেদে, দিনাজপুর, মুর্শিদাবাদ, কামদুনি-লাগাতার একের পর এক ধর্ষণ। দু’ বছরের শিশুকন্যাও বাদ যাচ্ছে না পৈশাচিক অত্যাচারের হাত থেকে।

বিশৃঙ্খলাবিরোধী নেত্রী থেকে তিনি হয়ে উঠতে পারতেন দায়িত্বশীল মুখ্যমন্ত্রী। রাজনৈতিক উত্তরণ হতে পারত গঠনমূলক ইতিবাচক কর্মকা-ে। সে সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন, দু’ হাত ভরে এই বাংলার মানুষই তাকে সেটা দিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য বাংলার, বিপুল জনরায়কে পুঁজি করে ক্ষমতাসীন হয়েই তার বিখ্যাত স্লোগান ‘পরিবর্তন’ তো দুরস্থান, বর্তমানে হয়ে উঠেছেন নৈরাজ্যের সাক্ষাত প্রতিভু। জনরায়ের সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতার এর চেয়ে বড় উদাহরণ বোধহয় আর কিছু হতে পারে না। আসলে তিনি দলীয় বৃত্তের বাইরে উঠতেই পারলেন না, আর সেই দলীয় বৃত্তটাও ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে চলেছে; কারণ, তাকে কেউ কোনও প্রশ্ন করলেই সেই প্রশ্নকর্তার গাঁয়ে লেগে যাচ্ছে ‘মাওবাদী’ বা ‘সিপিএম’-এর তকমা। তার দলকে ভোট দেয়া মানুষেরাও অবাক হয়ে যাচ্ছেন। কামদুনি যার সর্বশেষ উদাহরণ মুখ্যমন্ত্রীর মূল্যায়নে যে কামদুনি পাশবিক অত্যাচার ও জ্যান্তব উল্লাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের পথপ্রদর্শক হতে পারত তার বিচারে সেই কামদুনিই হয়ে গেল চক্রান্তকারী, তাকে হত্যার ষড়যন্ত্রকারী। দু’ বছর ধরে একই কায়দায় দলীয় বাহিনীর একের পর এক অপকর্মগুলোকে লঘু কিংবা আড়াল করে চলেছেন মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীÑ ‘ছোট ঘটনা, সাজানো ঘটনা, তুচ্ছ ঘটনা’।
তথ্য বলছে, রাজ্যজুড়ে বেশিরভাগ ধর্ষণের অভিযুক্তও সরকারী দলের।
কোন প্রশাসন, কোন বিচার ব্যবস্থা এই সমস্যা সমাধানে উল্লেখযোগ্য ও বাঞ্ছনীয় কোন পদক্ষেপ নিতে পারছে না বা নিতে চাইছে না। আজ বাংলায় শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক মহিলা, গৃহবধূ, কিশোরী ও যুবতী, হোমে বাস করা অন্ধ মহিলা, মানসিক ভারসাম্যহীন নারী সকলেই বিকৃত লালসার শিকার হচ্ছেন। এই বিকৃতি সামাজিক অবক্ষয়কেই তুলে ধরছে আর এই অবক্ষয়কে যারা মদত দিচ্ছে তারা মানুষের শত্রু এবং সভ্যতার কলঙ্ক।
বসিরহাটের মেয়ে। বয়স ৩৭ বছর। প্রতিদিন লোকাল ট্রেনে চেপে দমদম আসেন একটি বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করতে, দৈনিক আয় ১২০ টাকা। ধর্ষিত হন। কোর্টে মামলা চালাবার মতো টাকা নেই, এরা যাবেন কোথায়? সরকারী উদাসীনতা এদের নিমজ্জিত করছে অন্ধকার চোরাবালিতে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো বলছে, পশ্চিমবঙ্গে এই মুহূর্তে মোট ২৯১১৩টি নারী নিগ্রহের মামলা ঝুলছে, যার মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ২০ শতাংশ। কেন্দ্রীয় তথ্য অনুযায়ী প্রতি ২৫ মিনিটে একটি করে নারী নিগ্রহের ঘটনা ঘটে পশ্চিম বাংলায়।
ধর্ষণের প্রতিক্রিয়া শুধু শরীরে নয়, মননে সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। একজন ধর্ষিত মহিলাকে সমাজ আজও সঠিকভাবে গ্রহণ করে না। দেশের আইন বলছে একজন ধর্ষণকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি ৭ থেকে ১০ বছর, কিন্তু ধর্ষিতার মানসিক পীড়ন সারাজীবনের। বাংলার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্ণধার অনুরাধা কাপুর বলছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে এখন মধ্যযুগীয় ব্যবস্থা ফিরে এসেছে। সারা ভারতকে অনেক পিছনে ফেলে ক্রমশ এগিয়ে চলেছে পশ্চিমবঙ্গ’।
মানুষ সামাজিক জীব। এই সমাজ আক্ষরিক অর্থেই রাজনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। প্রত্যেকের রুচিবোধ, দর্শন, ক্রিয়াকলাপ, চিন্তন, মনন, দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক এমনকি ব্যক্তিগত অভ্যাসও গড়ে ওঠার পিছনে রাজনীতির একটি বিশেষ ভূমিকা থাকে। ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যাধি, ফলে ধর্ষণকে রাজনীতির বাইরে দেখার প্রশ্নই ওঠে না। অবাধ উদারীকরণের যুগে আজ সমস্ত কিছুই পণ্য- মাধুরী দীক্ষিতের হাসি থেকে রাহুল দ্রাবিড়ের কভার ড্রাইভ সব কিছুই আজ বিক্রি হয়। ছোটবেলা থেকেই আমরা দেখি যৌনতা একটি রসময় পণ্য। যার দাম নিয়ন্ত্রণ করে পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজ।
কামদুনিতে ২১ বছরের কলেজপড়ুয়া অপরাজিতাকে নির্মমভাবে গণধর্ষণ করে খুন করে ফেলে দেয়া হলো। গ্রামবাসী এবং মিডিয়ার চাপে পড়ে পুলিশ বাধ্য হলো অপরাধীদের ধরতে কিন্তু অপরাধীরা সরকারী দলের, ফলে সেই মুখ্যমন্ত্রীকেই আসরে নামতে হলো ঘটনাটিকে লঘু করে দেখাবার জন্য। কামদুনিতে গেলেও গ্রামের মহিলারা তার সাথে কথা বলতে চাইলেন, অভিযোগ জানাতে চাইলেন যেহেতু তিনি রাজ্যের অভিভাবক, এর ফল হলো উল্টো। মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী সবাইকে বললেন, ‘চোপ’, এসব প্রতিবাদ মাওবাদী আরসিপিএমের সংগঠিত, আগে থেকে ঠিক করা। সারা রাজ্য স্তম্ভিত সেদিনের ঘটনায়। কবি শঙ্খ ঘোষের মতো বুদ্ধিজীবীও কলকাতার রাজপথে মিছিলে নামলেন আইনশৃঙ্খলার অবনতির বিরুদ্ধে, তবু হুঁশ ফিরছে না সরকারের। আসলে শক্তিশালী রাষ্ট্র শক্তি প্রতিবাদের স্থায়িত্ব, ধারাবাহিকতা ও গভীরতা নিয়ে অত্যন্ত সচেতন, নিশ্চিত ও নিশ্চিন্ত। তাই কোন বার নতুন আইনের দোহাই, কোন বার ধর্ষিতাকে ক্ষতিপূরণের দর বেঁধে দিয়ে তারা সুপরিকল্পিতভাবেই শান্ত করে দিচ্ছে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ, আক্রোশকে। কিন্তু বারবার একই রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে মানুষও বুঝতে পারছে সংগঠিত কঠিন একটানা প্রতিবাদ ছাড়া সঠিক বিচার হবে না। কামদুনিই দিশা দেখাচ্ছে সেই নতুন পথের, তাই সরকারও এবার বেকায়দায়।
২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে প্রথম একজন মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন- এটি যেমন একটি রেকর্ড তেমনি আবার দেশের মহিলাদের ওপর নথিভুক্ত অপরাধের ২০ শতাংশ হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে - এটিও একটি সর্বকালীন রেকর্ড।
আসলেই গণতান্ত্রিক দেশে ধর্ষণটাকেও এখন ‘গণতান্ত্রিক অধিকারের’ একটা অঙ্গ ভেবে বসেছে অপরাধীরা, এ ক্ষেত্রে দরকার কড়া আইন এবং তাৎক্ষণিক প্রশাসনিক কঠোর পদক্ষেপ, কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে একদমই নির্লিপ্ত, আইনের রক্ষকরাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপরাধীদের ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন, ফলে বাংলার খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের জোটবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ ছাড়া আর পথ নেই।
লেখক : পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিক, বৃহস্পতিবার, ১১ জুলাই ২০১৩, ২৭ আষাঢ় ১৪২০
Courtesy: Daily Janakantha

আধাঘোষিত যুদ্ধটা যখন বাংলাদেশেরই বিরুদ্ধে:জাহিদ নেওয়াজ খান


বাংলাদেশে বেশিরভাগ গণমাধ্যমেরই নিজস্ব নীতিমালা নেই। কিছুটা কাণ্ডজ্ঞান, কিছুটা সাংবাদিকতার সহজ পাঠ আর কিছুটা সার্বজনীন যে নীতিমালা তাতেই চলে এখানকার গণমাধ্যম। বেশিরভাগ মিডিয়ারই যেখানে নিজস্ব নীতিমালা নেই, সেখানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গণমাধ্যম কর্মীর স্বাধীনতা বা সীমাবদ্ধতা নিয়েও তাই নির্দেশনা থাকার প্রশ্ন উঠে না। পশ্চিমা গণমাধ্যমের মতো আরো বেশি কর্পোরেট হওয়ার আগে কিংবা এরকম কোনো নীতিমালা না হওয়া পর্যন্ত তাই বাংলাদেশের গণমাধ্যম কর্মীরা ‘ফেসবুক-টুইটার-ব্লগে’ এক ধরণের স্বাধীনতা উপভোগ করে যেতে পারবেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেরকম স্বাধীনতা তাদের এখন আছে।

এই স্বাধীনতা প্রশ্নে দেশের সাংবাদিকদের পেশাদারিত্ব নিয়ে এই মুহূর্তে কিছুটা বিতর্ক চলছে। মজার ব্যাপার হলো, এই বিতর্ক যারা শুরু করেছেন, তারা নিজেরাও একটি পক্ষভুক্ত। কিন্তু তারা নিজের অবস্থান ভুলে গিয়ে প্রশ্ন তুলছেন ভিন্নমতের সাংবাদিকদের পেশাদারিত্ব নিয়ে। সেক্ষেত্রে তারা একজন রিপোর্টারের রিপোর্ট কিংবা একজন নিউজ ম্যানেজারের আউটপুট বিবেচনায় না নিয়ে ওই রিপোর্টার কিংবা নিউজ ম্যানেজার ফেসবুক-টুইটার-ব্লগে কিংবা অন্য কোনো মুক্তমত প্রকাশের মাধ্যমে কি বলেছেন, সেটাকেই সামনে নিয়ে আসছেন।
সহকর্মী নাজমুল আশরাফ তাই ফেসবুকেই লিখেছেন: “ইদানিং সাংবাদিকতার শিক্ষকের (?) প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। বিশেষ করে ফেসবুকে। কথায় কথায় তারা সাংবাদিকতা শেখান। সাংবাদিকতা কাকে বলে, কোনটা দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা, কোনটা বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা, নিরপেক্ষতা মানে কী, কে নিরপেক্ষ সাংবাদিক, কে দলীয় সাংবাদিক, সাংবাদিকদের কী করা উচিত, কী করা উচিত না, কোনটা হলুদ সাংবাদিকতা, কোনটা দেশপ্রেমিক সাংবাদিকতা, আরো কত কত শিক্ষা... একটা শব্দও ঠিকমত লিখতে পারেন না, এমন ব্যক্তিও ফেসবুকে সাংবাদিকতার ক্লাস নিচ্ছেন। মাঝে মধ্যে ভাবি, ফেসবুকে যেখানে বিনে পয়সায় সাংবাদিকতা শেখা যাচ্ছে, সেখানে কি দরকার ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে এতোগুলো বছর নষ্ট করার? এক শ্রেণীর ফেসবুকার তো সাংবাদিকদের সনদ দিতেও শুরু করেছেন। উপদেশও দিচ্ছেন, অমুক রহমানের মত সাংবাদিক হন, তমুক করিমের মত নিরপেক্ষ হন। ভাবছি, গীতি ম্যাডামকে বলবো, সাংবাদিকতা বিভাগটা এবার বন্ধ করে দেন।”

যাদেরকে নতুন করে সাংবাদিকতার পেশাদারিত্ব শেখানোর চেষ্টা চলছে, তারা কিন্তু ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ এর আগে যারা জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা করছেন তাদের কাছে পেশাদার সাংবাদিক হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। শুধু পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে নয়, সাধারণ বিচার-বিবেচনাবোধ আর কাণ্ডজ্ঞানের কারণেও তারা যখন মুক্ত মত প্রকাশের জায়গায় প্রধান দুই দলেরই সমালোচনা করে লেখালেখি করতেন, অথবা ফেসবুক-টুইটারে মতামত জানাতেন; দলীয় কর্মী বা সাংবাদিকদের কাছে তা পছন্দনীয় না হলেও তারা এই ভেবে সান্ত¦না পেতেন যে শুধু আমার দল না, প্রতিদ্বন্দ্বি দলেরও তিনি সমালোচক। কিন্তু কাদের মোল্লার রায়ের পর শাহবাগে জনবিষ্ফোরণ থেকে যে গণজাগরণ মঞ্চ, এরপর সেই পেশাদার সাংবাদিকরা তাদের মত প্রকাশের জায়গায় বাংলাদেশের পক্ষে পরিস্কার অবস্থান নেওয়ায় সাংবাদিকদের দুই দলের একটির কাছে তারা হয়ে গেলেন অ্যাকটিভিস্ট, আর অন্য দলের কাছে এতোদিনে লাইনে আসা সাংবাদিক।

শুধু ব্যক্তি সাংবাদিকের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজস্ব মতামত নয়, সামগ্রিকভাবেও মিডিয়ার বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠছে। এখানেও মজার ব্যাপার হলো, যারা এই অভিযোগ করছেন তারা মিডিয়ার যে ছোট অংশ প্রতিদিন লিফলেটের মতো প্রথম পাতায় কিংবা টেলিভিশন সংবাদের মূল অংশে প্রচারণা চালাচ্ছে তাদের ব্যাপারে নীরব। তাদের সমস্ত অভিযোগ মিডিয়ার সেই বড় অংশের বিরুদ্ধে যারা সাংবাদিকতার সাধারণ নীতিমালা মেনেই আকার এবং সময়ের দিক দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষের আন্দোলনকে কিছুটা বেশি কাভারেজ দিলেও অন্যপক্ষের সব বক্তব্য এবং খবরই নিয়মিত প্রচার করছে। এর বড় প্রমাণ জামায়াত-শিবিরের ডাকা হরতাল। পুলিশের তোপের মুখে থাকা জামায়াত এবং ছাত্রশিবির এতোগুলো হরতালের একটিও কোনো সভা-সমাবেশ থেকে ডাকেনি। তাদের সব হরতালই আহ্বান করা হয়েছে হয় ফোন কল অথবা টেক্সট কিংবা ই-মেইল বা ফ্যাক্সে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে। বাংলাদেশের কোন্ টিভি চ্যানেল বা সংবাদপত্র সেই খবর প্রচার করেনি? অনেকেতো মনে করেন, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ব্রেকিং নিউজের প্রতিযোগিতায় হরতাল আহ্বানের খবর যে প্রচার পায়, তাতেই হরতাল অর্ধেক সফল। বাকি অর্ধেক হয়ে যায় নাশকতার আগে সাংবাদিকদের খবর দিয়ে ছবি তোলার ব্যবস্থা করে দেওয়ার মাধমে। এই ‘প্রি-অ্যারেঞ্জড’ নাশকতার খবরের প্রচার নিয়েও বিতর্ক আছে। তবে আপাতত শুধু পেশাদারিত্ব নিয়ে যে বিতর্ক সেই প্রসঙ্গ।

এই মুহূর্তে বাংলাদেশের গণমাধমের বড় অংশের যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যে পক্ষপাতিত্ব তা কি পেশাদারিত্ব বরবাদ হয়ে যাওয়ার সামিল? কেউ কেউ তাই মনে করছেন। কিন্তু তারা ভুলে যাচ্ছেন, এখনকার বিতর্কটা আসলে মিডিয়ার আওয়ামী লীগ অথবা বিএনপির প্রতি পক্ষপাতিত্ব নিয়ে না। এই বিতর্ক হচ্ছে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশবিরোধী শক্তির মধ্যে যে চেতনার লড়াই সেই লড়াইকে কেন্দ্র করে। কোনো কোনো মতলববাজ এটাকে সাংবাদিকতার সাধারণ তুল্য-মূল্যে ফেলতে চাচ্ছেন।

তবে এই চেতনা বলতে শুধু ফখরুলিয়-আশরাফিয় কোনো স্লোগান নয়। এখানে চেতনা হচ্ছে সেইসব মৌলিক বিষয় যার ওপর জনমানস গড়ে উঠে। একটি দেশের জন্য যা একটি দর্শন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাও এরকম কিছু মৌলিক বিষয়ের ওপর গড়ে উঠেছে। তাই গণমাধ্যম যখন সেই দেশ এবং তার সমাজের আয়না, ওই আয়নায় তার মৌল দর্শন বা চেতনাও প্রতিফলিত হবে। সেই দর্শন যখন আঘাতপ্রাপ্ত হবে, প্রতিফলিত হবে সেটাও। এখনকার বিতর্ক সেই আঘাতকে কেন্দ্র করে। এই আঘাতটা যারা করছে, তারা বাংলাদেশের মৌল চেতনার ওপরই আঘাত করছে। এবং এটা তাদের আধা ঘোষিত যুদ্ধ। সুতরাং যে মিডিয়া বাংলাদেশের, সেই মিডিয়া ওই আধা ঘোষিত যুদ্ধটাকে বাংলাদেশের চোখ দিয়ে দেখবে, এটাই স্বাভাবিক। সে দেখাটাকে যারা পক্ষপাতিত্ব মনে করেন তারা আসলে কোন্ দেশের সেই প্রশ্ন তাই থেকেই যাচ্ছে।

এখানে এটাও মনে রাখা উচিত যে, বেসরকারি মিডিয়ার উপরও জনগণের পরোক্ষ মালিকানা আছে। কারণ শেষ পর্যন্ত তারাই এর পাঠক কিংবা দর্শক। একটি গণমাধ্যমকে তাই সেই গণমানুষের কথা মাথায় রাখতেই হয়। গণ বিষয়টাও বুঝতে হয় গণমাধ্যমকে। তবে সেই গণ না যেখানে অনেক লোক চাইলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি মন্দির বা ভারতের প্রেক্ষাপটে একটি মসজিদে হামলাকে উৎসাহিত করা হয়। কথিত বিশেষজ্ঞদের এটাও বুঝতে হবে, স্বাধীনতা সংগ্রাম ছাড়া একটি দেশের নাগরিক আর বাংলাদেশের নাগরিক একই কথা নয়। এই দেশটি আপনা-আপনি কিছু পাহাড়-সমুদ্র-নদী নিয়ে গঠিত হয়নি। এই দেশটির জন্ম ইতিহাস আছে, যে ইতিহাস রক্তাক্ত। যদিও আবেদন করে কোনো দেশেই জন্ম নেওয়া সম্ভব না, তারপরও সেই রক্তাক্ত পথ ধরে জন্ম নেওয়া দেশে জন্ম নিলে, দেশটির জন্মের মৌল চেতনাকে ধারণ করতে হবে। এই চেতনাকে যারা ধারণ করছে না, তারা এখন বাংলাদেশের ভেতরে আরেকটি দেশের জন্য লড়াই করছে। বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রকাঠামো ভেঙ্গে নতুন কোনো ইসলামিক রিপাবলিকের পক্ষে কোনো মিডিয়াও থাকতে পারে। তবে বাংলাদেশের মিডিয়া হিসেবে আপনি এখানে কথিত নিরপেক্ষতার নামে বাংলাদেশের ভেতর বাংলাদেশবিরোধী নতুন কোনো দেশের পক্ষে দাঁড়াবেন কি না সেই বিচার-বিবেচনাবোধ আপনার।

যে পশ্চিমাদের উদাহরণ দিয়ে নীতিবাগিশ নিরপেক্ষতার কথা বলা হয়, তারাও, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র; আমাদের মতো পরিস্থিতির ভেতর দিয়েই গেছে একসময়। সেসময় মিডিয়ারও পক্ষপাতিত্ব ছিলো স্পষ্ট। এখনও তারা তাদের স্বার্থে ঠিকই পক্ষপাতিত্ব দেখায়। ভিন্ন মতের কথা বলে যুক্তরাষ্ট্রে কি ওসামা দর্শন প্রচার সম্ভব অথবা মার্কিন মদদপুষ্ট সৌদি আরবে গণতন্ত্রের সংগ্রাম? এমনকি অভিযুক্ত বা কথিত না বলেই সরাসরি টেরোরিস্ট তকমা বসিয়ে দেয়/দিচ্ছে সেখানকার মিডিয়া। তাহলে বাংলাদেশ কেনো বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা সহ্য করবে?
সর্বশেষ ফটিকছড়ির ভুজপুরে ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর’ আর ‘আল-কোরআনের আলো, ঘরে ঘরে জ্বালো’ স্লোগানে কুপিয়ে এবং পিটিয়ে মধ্যযুগীয় কায়দায় কয়েকজনকে মেরে ফেলার ঘটনার ভিডিও ফুটেজ টিভিতে দেখানো নিয়েও সুশীলিয় প্রশ্ন উঠেছে। যারা এই প্রশ্ন তুলেছেন, তারাই কিন্তু বিশ্বজিতকে কুপিয়ে মেরে ফেলার ঘটনার ভিডিওর রেফারেন্সে মধ্যরাতের আলোচনায় মুখে ফেনা তুলেছিলেন। তখনকার সেই ফুটেজে তাদের মনে হয়নি যে পশ্চিমাদের তৈরি করে দেওয়া সাংবাদিকতার নীতিমালা লংঘিত হচ্ছে। কিন্তু ফটিকছড়ির ফুটেজ দেখে সেই কথাই মনে হচ্ছে তাদের।

কেউ কেউ আবার ভোল পাল্টে এমন প্রশ্ন তুলেছেন, মিডিয়া এখন ফটিকছড়ির ঘটনায় যতোটা সোচ্চার, ছাত্রলীগের ‘বীর পুঙ্গবরা’ বিশ্বজিতকে খুন করে ফেলার পর ততোটা সোচ্চার ছিলো না। তাদের এই কথাও ঠিক না। ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট, দু’ ধরণের মিডিয়াই ওই ইস্যুতে সোচ্চার ছিলো বলেই বিশ্বজিতের খুনীরা এখন গারদের ভেতরে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্বজিত খুন হওয়ার পর তারা যতোটা সোচ্চার ছিলেন, অবশ্যই যে কোনো মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ ওইরকম জঘন্য ঘটনায় সোচ্চার হবেন, ফটিকছড়ির ঘটনার পর তারা কিন্তু একেবারেই চুপ।
শুরুতে ফেসবুক-টুইটার-ব্লগ কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমে স্বাধীন মত প্রকাশের যে কথা বলেছিলাম, সহকর্মী নাজমুল আশরাফ যে প্রেক্ষাপটে সাংবাদিকতার নতুন নতুন শিক্ষক আবিষ্কার হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন; একটা উদাহরণ দিলেই সেই শিক্ষকদের মান বোঝা যাবে। শাহবাগের গণজাগরণের পর থেকে আড়াই মাসে যখনই কোনো সাংবাদিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা মত প্রকাশের মুক্ত জায়গায় কোনো নিজস্ব মতামত দিয়েছেন, অবধারিতভাবে দেখা গেছে সেখানে কেউ না কেউ সাংবাদিক পরিচয়ের কারণে তাকে হলুদ সাংবাদিক বলেছেন, মিথ্যা রিপোর্ট বলেছেন। ওই বিশেষজ্ঞ যারা সংবাদ এবং মন্তব্য কিংবা সংবাদ বিশ্লেষণের পার্থক্যও বোঝেন না; তাদের নিয়ে বলার কিছুই নেই।

তবে সতর্ক থাকতে হবে ভয়ংকর আরেকটি গ্রুপ সম্পর্কে। সাংবাদিকতার নীতিমালা শেখানোর নামে এরা প্রথমে কিছু বাণী দেওয়ার চেষ্টা করে। এরপর যুক্তিতে না পেরে নাস্তিক উপাধি দিয়ে বাঁশের কেল্লা সাইটে তালিকাভুক্ত করে ভুজপুরের পরিণতি বরণের প্রস্তুতি নেওয়ার হুমকি দিয়ে আপাতত বিদায় নেয়। তবে তারা ফিরে আসার চেষ্টা করবে বারবার। বাংলাদেশের সৌভাগ্য এর নিয়ন্তারা ডান-বাম করলেও মূলধারার গণমাধ্যম সব সময় বাংলাদেশের পক্ষেই আছে।

পাদটীকা
সাভার ট্র্যাজেডির পর বাংলাদেশের গণমাধ্যম মানবিকতার পক্ষে যে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশ প্রশ্নেও গণমাধ্যমের সেই মানবিক অবস্থান নেওয়াটাই সৎ সাংবাদিকতা। এখানে যারা ইনিয়ে-বিনিয়ে সাংবাদিকতার নীতিমালার কথা বলে প্রশ্ন তুলে তারা আসলে সেই হেফাজতিদের মতো যারা ‘ডেকে নিয়ে শত শত মানুষ হত্যাকাণ্ডকে’ মতলবি স্বার্থে ‘আল্লাহর গজব’ বলে। তারা আসলে সেই জামায়াতিদের মতো যারা সাভার ট্র্যাজেডির পর বাংলাদেশের শোকের মধ্যে উদ্ধার অভিযান চলার সময়ও হরতাল (চট্টগ্রামসহ কয়েক জায়গায় ২৮ এপ্রিল) ডেকে প্রমাণ দেয় তাদের নাগরিকত্ব আসলে ভিন্ন।

(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা অ্যালামনাই এসোসিয়েশন এর মুখপত্র ‘যোগাযোগ’ এর বর্ষপূর্তি (মে ২০১৩) সংখ্যায় প্রকাশিত)।
জাহিদ নেওয়াজ খান : বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল আই
znewaz@gmail.com

Wednesday, July 10, 2013

অনেক ধন্যবাদ, চট্টগ্রামের আহমদ শফি !!- হাসান মাহমুদ


১০ জুলাই ৪৩ মুক্তিসন (২০১৩)
হাটহাজারী আলজমিয়াতুল আহলিয়া উলুম মাদ্রাসার পরিচালক, কওমী মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান ও হেফাজত-এ ইসলাম বাংলাদেশের আমীর জনাব আহমদ শফি, নারীদের নিয়ে আপনার সাম্প্রতিক ভিডিও'র জন্য আপনাকে হৃদয়ের গভীর থেকে অজস্র ধন্যবাদ। কেন তা পরে বলছি। আপনি জাতিকে উপদেশ দিয়েছেন মেয়েদের ৪/৫ ক্লাসের বেশী না পড়াতে, সর্বদা ঘরে থাকতে, এমনকি জিনিসপত্র কিনতেও বাইরে না যেতে। বলেছেন গার্মেন্ট-নারীরা জ্বেনা করে উপার্জন করে, নারীরা তেঁতুলের মত যা দেখলেই পুরুষের মুখে লালা পড়ে। বলেছেন স্ত্রীদের আল্লাহ "বাদশা" বানিয়েছেন, তারা শুধু স্বামী-পুত্রকে "অর্ডার" করবে আর তারা তা করবে। এছাড়া আরো যা বলেছেন তা উল্লেখ করতে রুচিতে বাধছে। নারীদের নাকি ২২ তাল। তা সেটা ত্রিতাল না আদ্ধা, চৌতাল না ঝাঁপতাল তা বলেন নি।


শুনুন, জনাব শফি। আপনার বক্তব্য ইংরেজীতে অনুবাদ হয়ে বিশ্বময় ছড়িয়েছে। আপনি চট্টগ্রামের হাটহাজারীর গর্তে বাস করেন, এদিকে বিস্তীর্ণ পশ্চিমা বিশ্বে আমাদেরকে ইসলাম-বিরোধীদের ঠ্যালা সামলাতে হয়। আমরা যতই দাবী করি ইসলাম শান্তির ধর্ম, নারী-বান্ধব ধর্ম, আপনি এবং আপনার মত মোল্লারা আমাদেরকে শক্তি না দিয়ে ওদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছেন। এখন ওরা বলছে ফুউহ !! তুমি কে হে বাপু? ওই যে বাংলাদেশ কওমী মাদ্রাসার শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, মাদ্রাসার পরিচালক শিক্ষক, বাংলাদেশ হেফাজতে ইসলামের আমীর আহমদ শফি এই সব নোংরা, হিংস্র কথা বলেছেন- ওটাই হল ইসলাম এবং ওটা মানব-সভ্যতা মানবাধিকারের বিরুদ্ধে একটা কালনাগিনী।
কি জবাব দেব ওদের?


পারমাণবিক শক্তি দিয়ে মেধাবী যাঁরা বিদ্যুত উৎপন্ন করার পদ্ধতি আবিস্কার করেন তাঁরা বৈজ্ঞানিক। ওই শক্তি দিয়ে মেধাবী যাঁরা গণহত্যার জন্য পারমাণবিক বোমা বানানোর পদ্ধতি আবিস্কার করেন তাঁরা বৈজ্ঞানিক নন, তাঁরা রাক্ষস। ঠিক তেমনি, কোরান-রসুল থেকে যাঁরা তুলে আনেন মানুষের মঙ্গল তাঁরাই সত্যিকার আলেম, মাওলানা ও ইসলামের পতাকাবাহী। আর যাঁরা কোরান-রসুল থেকে তুলে আনেন মানুষের অমঙ্গল ও নারীর ওপরে অত্যাচার তাঁরা আলমের ছদ্মবেশে রাক্ষস। নারীর ওপরে অত্যাচারের মধ্যে তাঁরা দেখেন সওয়াব, খোঁজেন বেহেশত। কোরাণ কোরাণ বলে মুখে ফ্যানা তুলে কাজে তাঁরা প্রয়োগ করেন হাদিস। তাও, কোরান-বান্ধব হাদিস প্রয়োগ করেন না, - করেন কোরান বিরোধী নারী-বিরোধী হাদিস। এই প্রচণ্ড ইসলাম-বিরোধী নিষ্ঠুরতার কয়েকশ' উদাহরণ দিয়েছি আমার বই "শরিয়া কি বলে, আমরা কি করি"-তে, এখানে একটা দিচ্ছি। বৌ-পেটানোর মত অমানবিক সন্ত্রাসকে তাঁরা হালাল করেছেন কোরানের (নিসা ৩৪) বিকৃত অর্থ প্রতিষ্ঠা করে আর এই ধরণের নারী-বিরোধী হাদিস দিয়ে - রোজ হাশরে কোনো স্বামীকে নাকি জিজ্ঞাসা করা হবে না কেন সে এই দুনিয়ায় বৌকে পিটিয়েছিল - সুনান আবু দাউদ, ২১৪২।
নবীজী নাকি বলেছেন। অর্থাৎ যত ইচ্ছে বৌ পেটাও, কোনো সমস্যা নেই। এটাই তাঁদের ইসলাম। আমাদের ইসলাম সম্পূর্ণ আলাদা ও নারী-বান্ধব। আমরা জাতিকে জানাই সহি মুসলিমে নবীজীর সুস্পষ্ট ও কঠিন নির্দেশ দেয়া আছে, "বৌকে পেটাবে না". আমি এখানে টাইপ না করে মূল কেতাব থেকে কপি-পেষ্ট করছি:-


Book 11, Number 2138: Narrated Mu'awiyah ibn Haydah: I said: Apostle of Allah, how should we approach our wives and how should we leave them? He replied: Approach your tilth when or how you will, give her (your wife) food when you take food, clothe when you clothe yourself, do not revile her face, and do not beat her.

Book 11, Number 2139:Narrated Mu'awiyah al−Qushayri: I went to the Apostle of Allah peace_be_upon_him) and asked him: What do you say (command) about our wives? He replied: Give them food what you have for yourself, and clothe them by which you clothe yourself, and do not beat them, and do not revile them.


তাহলে? এ ব্যাপারে বিদায় হজ্বের বক্তৃতায় নবীজী কি হুকুম করেছেন সেটাও তাঁরা কখনোই জাতিকে জানতে দেন না - "তাহাদের (স্ত্রীদের) উচিত নয় তোমরা যাহাকে পছন্দ করনা তাহাকে নিজের বিছানায় বসায় - তাহা করিলে প্রহার করিতে পার কিন্তু মৃদুভাবে" - "they should not allow anyone to sit on your bed whom you do not like. But if they do that, you can chastise them but not severely”.- সহি মুসলিম ৭ম খণ্ড ২৮০৩, সহি ইবনে মাজাহ ৪র্থ খণ্ড ৩০৭৮ ইত্যাদি। অনেক ইসলামী বিশেষজ্ঞ "বিছানায় বসা"-র অর্থ করেছেন পরকীয়া। অর্থাৎ নবীজী হুকুম করেছেন – “পরকীয়া ব্যভিচার না করা পর্য্যন্ত বৌয়ের গায়ে হাত তুলবে না”।
বউ পরকীয়া করলে জামাই তাকে পেটাবেই - গ্রন্থে যা কিছুই লেখা থাক না কেন। যাহোক, পরকীয়াই হোক বা "বিছানায় বসা"-ই হোক ওটা ছাড়া অন্য কোনো কারণে বৌযের গায়ে হাত তোলা নাজায়েজ; নানা রকম কুযুক্তি কূটতর্কে সেটা জায়েজ করে রসুলের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করেন তাঁরা । পুরুষ নারীর ওপরে কর্তা, তাই না? কারণ আল্লাহ পুরুষকে নারীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ করেছেন, তাই না? কারণ পুরুষের গায়ে শক্তি বেশী, তাই না? তাহলে তো আশরাফুল মাখলুকাত, সৃষ্টির সেরা সৃষ্টি হতে হয় গণ্ডার বা হাতীকে! নবীজী দোজখে বেশীর ভাগ নারী দেখেছেন, তাই না? হুমম। বেহেশত-দোজখে তো আমরা যাবো কেয়ামতের পরে হাশরের বিচারের পরে। ওই মেয়েগুলো দোজখে চলে গেল তার মানে কেয়ামত হয়ে গেছে? কবে হল? হয়ে গেছে রোজ হাশরের বিচার? কবে হল? বলুন, মিষ্টার শফি? আমরা আপনাদের নারী-বিরোধী হাদিসকে পরাজিত করি ওই কোরান, ওই রসুল থেকেই।


অন্যান্য শিক্ষায় বড় সার্টিফিকেট হাসিল করলেই তাকে সেই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বলা যায়। কিন্তু ইসলামে তা নয়। ডিগ্রী থাকুক বা না থাকুক, যিনি কোরান-রসুল থেকে মানুষের মঙ্গল তুলে আনতে পারবেন তিনিই আসল আলেম, আসল মাওলানা। অতীত বর্তমানে বিশ্ব-মুসলিমের অনেক ক্ষতি করেছেন অনেক ডিগ্রীধারী তথাকথিত মাওলানা। উদাহরণ? দিচ্ছি। বড়পীরের মতো দরবেশকে এক হাজার মাওলানা কাফের ফতোয়ায় স্বাক্ষর করেছিল ইমাম হৌজ-এর নেতৃত্বে-(মুখবন্ধ –ফতহুল.গযব,-তাঁর.বক্তৃতার.সংকলন)।
এজন্যই রসুল বলেছিলেন-উম্মতের জন্য তাঁর "সর্বাপেক্ষা গভীর উদ্বেগ পথভ্রষ্টকারী আলেমদের নিয়া"-সহি ইবনে মাজাহ ৫ম খণ্ড ৩৯৫২।
এটাও দেখুন:-"এ সম্পর্কে হযরত মুজাদ্দেদ আলফে সানী মাকতুবাত গ্রন্থে লিখেছেন যে, জনৈক বুযুর্গ ব্যক্তি একবার অভিশপ্ত ইবলিসকে দেখতে পায় যে, সে একেবারে খোশ মেজাজে ও বেকার বসে আছে। ঐ বুযুর্গ ব্যক্তি ইবলিসকে তার এহেন বেকার বসে থাকার কারণ জিজ্ঞেস করলে প্রত্যুত্তরে সে বলে যে, বর্তমান সময়ের আলেম সমাজ আমাদের কাজ সমাধা করছে, জনগণকে পথভ্রষ্ট করার জন্য তারাই যথেষ্ট –সংগ্রাম-০৩-জুন-২০১৩"।
এখন বিচার করুন আপনি ইবলিশের হয়ে কাজ করছেন কিনা, রসুলের "সর্বাপেক্ষা গভীর উদ্বেগ" আপনাকে নিয়ে কি না।


কিছু ব্যতিক্রম সব সমাজেই আছে, আপনাদের অনেক মাদ্রাসাতেও আছে কিন্তু সাধারণভাবে আমাদের নারীরা অত্যন্ত মেধাবী, সক্ষম, দক্ষ ও শালীন। অর্থনীতি সহ দেশের সর্বক্ষেত্রে তাঁরা অসামান্য অবদান রাখছেন, তাঁরা আপনাদের মতো যাকাতের টাকায় চলেন না বরং তাঁদের উপার্জনের ট্যাক্স ও যাকাত দিয়ে আপনাদের চলতে হয়। তাঁরা আপনার চেয়ে কম মুসলমান নন। আল্লাহ ও তাঁদের মধ্যে কোনো দালালের দরকারও নেই ইসলামে সে সুযোগও নেই। আপনি তাঁদের যথেষ্ট অপমান করেছেন; আপনি অপমান করেছেন পুরুষদেরও। আপনি সব পুরুষদের কামুক জন্তু বানিয়ে ছেড়েছেন। এতো সাহস, এতো স্পর্ধা আপনার কি করে হলো? আপনার ইসলাম আপনাকে এই শিখিয়েছে? আপনি দুনিয়া দেখেন নি, আপনি কিছুই জানেন না। আমরা নারী-পুরুষ একসাথে পড়াশুনা করেছি, একসাথে চাকরী করছি -আপনার মাথায় সবসময় যে নোংরা পোকাগুলো নড়াচড়া করে সেহুলো আমাদের মাথায় নেই। আমাদের কাছে ইসলামী বিশেষজ্ঞদের দেয়া কোরানের- রসুলের নারী-বান্ধব ব্যাখ্যা ও হাদিস আছে।


এবারে বলছি কেন আপনাকে ধন্যবাদ। ইসলামের যে ব্যাখ্যা আপনারা বয়ে বেড়ান সেটা যে কতো নোংরা ও নিষ্ঠুর তা দলিল ধরে ধরে দশ পনের বছর ধরে আমরা জাতিকে জানাতে চেষ্টা করছি। কাজটা কঠিন, সাফল্য আমাদের বেশী নয় কিন্তু কাজ এগোচ্ছে। আপনি সেটাই করে দিলেন এক লহমায়; ইসলামের নামে আপনাদের লুকিয়ে রাখা রাক্ষসের চেহারাটা দেখে আতংকে আঁৎকে উঠছে জাতি। আমাদের কাজ সহজ হয়ে গেল কিছুটা হলেও।


দু:খিত আপনাকে আল্লামা বা আলেম-মাওলানাবলতে পারলাম না কারণ ওগুলো সম্মানার্থে ব্যবহার করা হয়। দোয়া করি আল্লাহ আপনাকে হেদায়েত করুন, বেহেশত নসীব করুন।


কান্ডারি বলো ডুবিছে মানুষ , সন্তান মোর মা’র:সুমি খান


সম্মানিত বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার প্রকৃত রূপ সচেতন মানুষের কাছে উন্মোচিত। সমর্থকদের কাছে তিনি আপোষহীন নেত্রী। ‌এই ‘ ‌দেশনেত্রী’ যদি একবার অন্তত দেশপ্রেম, মানবিকতার প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতেন এদেশের নিরীহ মানুষ গুলোর প্রাণ বেঁচে যেতো। এভাবে বৌদ্ধমন্দির এবং হিন্দু জনগোষ্ঠীর উপর হামলা হচ্ছে সারাদেশে , আপনি কি থামাবেন এদের প্লীজ?
এই প্রজন্মের অসীম সাহসী তরুণ ইমরান এইচ সরকারের নেতৃত্বে শাহবাগে দেশপ্রেমিক তরুণেরা প্রায় একমাস বিনিদ্র আন্দোলন করে যাচ্ছে , এই আন্দোলন অহিংস । সহিংস আন্দোলনে অভ্যস্ত রাজনীতি কি আর অহিংস আন্দোলনের প্রতি শ্রদ্ধা রাখতে পারে? না, পারে না। জামাত বিএনপির কার্যক্রমে জনগণ তাই দেখলো । নিরীহ জনগণ কে তাই প্রাণ দিয়ে বুঝতে হচ্ছে এদেশের রাজনীতি এখনো জনমুখী হয় নি।
একতরফা পুলিশ হত্যা , সংখ্যালঘু নির্যাতনের পুনরাবৃত্তি দেখে ও খুনিদের পক্ষে সাফাই গাইছেন, তাদের মদত দিচ্ছেন খালেদা জিয়া। ফেসবুকে অনেকের কমেন্ট , “আপনি একাত্তরে গণহত্যা দেখেন নি , তাই গণহত্যার কোন সংজ্ঞা আপনার জানা নেই। এ কারণেই আপনি জামাত শিবির চক্রের নির্বিচার হত্যাকে সমর্থন দিয়ে উল্টো অভিযোগ করছেন, সরকার গণহত্যা করছে। একাত্তরে আপনি পাকিস্তানি জেনারেল জাংজুয়া কে কাছে থেকে দেখেছেন । তার প্রতি আন্তরিকতা আর শ্রদ্ধা থেকে এ দেশের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ২০০৭ সালে তার মৃত্যুর সংবাদ শুনে পাকিস্তান ছুটে গিয়েছিলেন।” তিনি এই দেশ এবং এদেশের মানুষকে কখনো ভালো বেসেছেন কিনা, মানবতার প্রতি তার ন্যুনতম শ্রদ্ধা আছে কিনা- মানুষের যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
দৈনিক আমার দেশ এর মাধ্যমে এর সম্পাদক চরম দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি মাহমুদুর রহমান যেভাবে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়াচ্ছেন এর বিরুদ্ধে সরকার এবং দেশের সকল শান্তিপ্রিয় মানুষকে একসাথে সোচ্চার হয়ে কাজ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে অতীতের কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে হচ্ছে।
স্বৈরাচারী এরশাদ তার পতনের অন্তিম মুহুর্তে্, ১৯৯০ সালের অক্টোবরে, মওলানা মান্নানের মালিকানাধীন এবং সম্পাদিত পত্রিকা দৈনিক ইনকিলাবকে ব্যবহার করে স্বৈরচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন নসাৎ করার চেষ্টা করেছিল। মাদ্রাসা শিক্ষক দের টাকা ছিনতাই করে নাকি ইনকিলাব পত্রিকার মালিক হয়েছিলেন মওলানা মান্নান।
যাই হোক্, ১৯৯০ এ অক্টোবরের ৩১ তারিখের দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত বাবরি মসজিদ ধ্বংস-সংক্রান্ত মিথ্যা সংবাদের ওপর ভিত্তি করে মৌলবাদীরা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্থানগুলোতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ঢাকেশ্বরী মন্দিরসহ সারাদেশের হিন্দু উপাসনালয়গুলোতে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। সেসময়ে আমার নিজের চোখে দেখা চট্টগ্রাম শহর এবং প্রত্যন্ত এলাকায় প্রায় প্রতিটি হিন্দু জনপদ, মন্দির আক্রান্ত হয়েছে। কী বিপন্ন সময় কাটিয়েছে নিরীহ মানুষ গুলো।

এসব ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হামলায় মদতদানকারী দৈনিক ইনকিলাব ও তার অবৈধ মালিক একাত্তরে ডা. আলীম চৌধুরীর হত্যায় সহায়তাকারী মওলানা মান্নানকে কখনও এজন্য জবাবদিহি করতে অথবা শাস্তি পেতে হয়নি। শুধুমাত্র ১৭ দিনের জন্য ইনকিলাবের নিবন্ধন সাময়িকভাবে বাতিল করা হয়েছিলো।

ইনকিলাব কে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় উস্কানি দেবার পরও তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না হবার কারণেই নব্বই য়ের পর বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বেড়ে যায়।
মুক্তবুদ্ধি চর্চার মানুষের উপর সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় ও প্রগতিশীল জনগণের ওপর একের পর এক আঘাত আসতে থাকে। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতের হিন্দু মৌলবাদীদের বাবরি মসজিদ ভাঙার পর, দেশব্যাপী হিন্দু সমাজের ওপর যে বর্বর ও ভয়াবহ নির্যাতন নেমে আসে- তা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি মিলিটারি ও তাদের দোসরদের হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ও লুণ্ঠনের বিভীষিকার কথা বার বার মনে করিয়ে দেয়।একই ধারাবাহিকতা স্বাধীন সার্বভৌম দেশে কেন ঘটে চলবে? কেন নিরীহ মানুষগুলোকে বারবার সম্ভ্রম, বাড়িঘর, মহামূল্যবান প্রাণ নিয়ে প্রতিমুহূর্তে শংকার মধ্যে দিন কাটাতে হবে?

বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে, ২০০১ সালে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘু পরিবার এবং মন্দিরে নির্বিচার হামলা,হত্যা এবং ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিলো তা সভ্যসমাজ বা গণতান্ত্রিক সমাজে নজিরবিহীন।
২০০১ সালের নির্বাচনোত্তর হামলার পর বহু হিন্দু পরিবারকে প্রাণের মায়া নিয়ে বসতভিটা ছেড়ে, দেশান্তরী হতে হয়েছিল। জামায়াত-বিএনপির ক্যাডারদের হাতে সম্ভ্রমহানি হওয়া অনেক কে পালিয়ে পালিয়ে থাকতে হয়েছে দীর্ঘদিন। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ছিল কিশোরী পূর্ণিমার প্রতি ভয়াবহ নির্যাতন। বাঁশখালীর জলদিতে দিনমজুর আরতি বালার তিন প্রজন্মকে একসাথে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা এবং একই উপজেলার শীলপাড়ায় এগারোজনকে গানপাউডার ছড়িয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যার ঘটনার পর সরেজমিন রিপোর্ট করতে গিয়ে যে বীভৎসতা আমি প্রত্যক্ষ করেছি,এখনো আমার হৃদয় রক্তাক্ত হয় সেসব বর্বরতার চিত্র মনে করে।
যা বলছিলাম, এসব বর্বরতার মূল পরিকল্পনাকারী আমিন চেয়ারম্যান এর চাচাতো ভাই বাঁশখালীর সাংসদ বিএনপি নেতা জাফরুল ইসলাম চৌধুরী ২০০৮ এর নির্বাচনে ও বিজয়ী হয়েছেন। তার ক্ষমতায় বলীয়ান তার চাচাতো ভাই কালিপুর ইউনিয়নের আমিন চেয়ারম্যান উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে গায়ে হাওয়া দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে । এই ক’দিন আবার তার নেতৃত্বে ভয়াবহ হামলা চালানো হয়েছে বাঁশখালীতে। যার কলমের নির্দেশে এই খুনি বর্বর আমিন জামিন পেয়েছে, তিনি কি হিন্দু সংখ্যালঘু পরিবারের উপর আমিনের এই বর্বরতার দায় এড়াতে পারেন? আর যাদের ব্যর্থতার কারণে জাফরুল ইসলাম ২০০৭ সালে আবারও সংসদ সদস্য পদে নির্বাচিত হয়েছেন চট্টগ্রামের প্রগতিশীল রাজনীতিকেরা কি এর দায় এড়াতে পারবেন?

সে সময়ে আমি সাপ্তাহিক ২০০০ এর চট্টগ্রাম প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছি। আমি দেখেছি চট্টগ্রাম শহর এবং প্রত্যন্ত এলাকায় প্রায় প্রতিটি হিন্দু জনপদ, মন্দির আক্রান্ত হয়েছে। সংখ্যালঘু এবং মুক্তবুদ্ধি চর্চার মানুষের জন্যে ২০০১ থেকে ২০০৫ জামাত বিএনপি জোটের পুরো শাসনামল ছিল বিভীষিকাময় ।

পিটিয়ে হত্যা করার সময় গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নে চারজন পুলিশ সদস্য নিরস্ত্র ছিলেন। মাদ্রাসার কয়েক শ কিশোরকে সামনে রেখে পেছন থেকে হামলার নেতৃত্ব দেয় জামায়াত-শিবির।

বামনডাঙ্গা পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ উপপরিদর্শক আবু হানিফ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘রেলস্টেশনে হামলার পর তিন-চার হাজার লোক তদন্ত কেন্দ্রে হামলা শুরু করলে আমরা তাদের থামতে বলি। তারা পাথর ছুড়ে মারতে থাকে। আমরা বলি, সামনে এগুলো আমরা গুলি করব। এ সময় তারা উল্টো গুলি ছোড়ে। পরিস্থিতি দেখে আমরা শটগান ও রিভলবারের ৩২টি ফাঁকা গুলি ছুড়তে ছুড়তে নিরাপদে সরে যাই। তখন তারা নিরস্ত্র পুলিশ সদস্যদের পেটাতে শুরু করে। যে চারজন পুলিশ মারা গেছেন, তাঁরা সবাই নিরস্ত্র ছিলেন।’

পুলিশ জানায়, বামনডাঙ্গা পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে হামলার পর সেদিন সন্ধ্যায় সুন্দরগঞ্জ থানায় হামলা চালায় জামায়াত-শিবির। এ সময় পুলিশ গুলি চালালে তিনজন নিহত হয়। তবে তাদের পরিচয় গতকালও মেলেনি। চার পুলিশ সদস্য হত্যার ঘটনায় গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় বামনডাঙ্গা শহীদ মিনারে শোকসভা হয়েছে। সভাপতিত্ব করেন গাইবান্ধা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের উপ-কমান্ডার এম এ আউয়াল। সভার আগে এলাকাবাসী একটি শোক মিছিল করে। তারা পুলিশ হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে।
পরদিন শুক্রবার সকালে জামায়াত-শিবির শান্তিরামে পিটিয়ে মারে যুবলীগের নেতা নূরন্নবীকে। গতকালও ওই বাড়িতে ছিল শোকের ছায়া। নূরন্নবীর বাবা মালে উদ্দিন বলেন, ‘আমার ছেলেকে কী কারণে মারল? আমি এর বিচার চাই।’
এ ছাড়া গত দুই দিনে জামায়াত-শিবির হামলা করেছে দুই শতাধিক ঘরবাড়ি ও দোকানপাটে। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বামনডাঙ্গা রেলস্টেশন, আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযোদ্ধা কার্যালয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা সদরসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় এখনো ১৪৪ ধারা জারি আছে। সুন্দরগঞ্জে হামলার ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি করেছে জেলা প্রশাসন। জেলা পুলিশও পৃথকভাবে ঘটনার তদন্ত করছে। গতকাল শনিবার শেষ বিকেলে বামনডাঙ্গার মানুষ যখন বৃহস্পতিবারের তাণ্ডবের কথা বলছিলেন, তখনো তাঁদের চোখেমুখে ছিল আতঙ্ক।
এলাকাবাসী জানান, বৃহস্পতিবার বেলা তিনটা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত টানা এক ঘণ্টা ওই তাণ্ডব চলে। রেলস্টেশন মাস্টারের কার্যালয় ও আশপাশের দোকানপাটে হামলা চালিয়ে ফেরার পথে বামনডাঙ্গা পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের চার পুলিশ সদস্যকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এলাকাবাসীর অভিযোগ, জামায়াত-শিবির মাদ্রাসাছাত্রদের নিয়ে এই নারকীয় ঘটনা ঘটিয়েছে। ৫৫ বছর বয়সী ব্যবসায়ী রনজু মিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘এ কোন দেশ? ২২ বছর ধরে শাড়িকাপড় আর মনোহর সামগ্রীর ব্যবসা করছি। কোনো দিন এমন ভয়াবহতা দেখেননি। প্রকাশ্য দিবালোকে কয়েক শ লোক এসে আমার বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। চলে লুট। ব্যাংক থেকে তিন লাখ টাকা নিয়ে যেসব মালামাল কিনেছি, সব শেষ। চার ছেলেমেয়ে নিয়ে এখন চরম দুশ্চিন্তায় আছি।’
বামনডাঙ্গা রেলস্টেশনের পাশেই চা-বিস্কুটের দোকান চালাতেন ৪৪ বছরের মোহাম্মদ আলিম। ১৪ বছর ধরে তিনি এখানে দোকান করছিলেন। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁর দোকানও। স্টেশনের পাশেই পানের দোকান দিয়ে জীবন-জীবিকা চালাতেন বৃদ্ধা ফাতেমা বেগম। আহাজারি করে জানালেন, তাঁর একমাত্র সম্বল দোকানটিও ভাঙচুর করা হয়েছে। এই বাজারের হরেন, আয়নাল, শামীম, আলমগীর, গনি—সবাই একই আতংকে আছেন। বৃহস্পতিবারে সবার দোকান পুড়িয়ে দিয়েছ সন্ত্রাসীরা। স্টেশনের আশপাশে থাকা ৩০-৩৫টি দোকানের সবাই কম-বেশি হামলার শিকার হয়েছে। আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বামনডাঙ্গা রেলস্টেশনের টিকিটঘর।
স্টেশনমাস্টার আতাউর রহমান জানালেন, নগদ দেড় লাখ টাকাসহ প্রায় ৩০ লাখ টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের লালমনিরহাট বিভাগের বামনডাঙ্গা উপবিভাগীয় প্রকৌশলীর কার্যালয়েও হামলা হয়েছে। প্রকৌশলী অফিসের চৌকিদার সাইফুল ইসলাম জানালেন, অফিসের সবকিছুই জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা মতে, ‘রেলস্টেশনে পরিকল্পিতভাবে হামলা হয়েছে। হামলাকারীরা সামনে রেখেছিল বিভিন্ন মাদ্রাসার কয়েক শ’ কিশোরকে।
রেলস্টেশনে হামলার পর আসরের আজানের সময় জামাত শিবিরের জঙ্গী সন্ত্রাসীরা “নারায়ে তাকবির” বলে পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে হামলা চালায়। পুলিশ ফাঁকা গুলি চালালেও উত্তেজিত শিবির ক্যাডারদের ঠেকানো যায় নি। পুলিশের অস্ত্রের গুলি শেষ হয়ে গেলে পুলিশ পিছু হটে। এ সময়ে হামলাকারীরা চারজন পুলিশকে পিটিয়ে হত্যা করে। বাবলু ও নাজিম নামে দুই পুলিশের লাশ রক্তাক্ত অবস্থায় তদন্ত কেন্দ্রের পেছনে পড়ে ছিল। অন্য দুই কনষ্টেবল হযরত এবং তোজাম্মেল আহত হন,পরে তাঁরাও মারা যান।

হাবিবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘১৯৭১ সালে আমি ১২ বছরের কিশোর ছিলাম। স্বাধীনতার সময়ও এমন তাণ্ডব দেখিনি।’ সুন্দরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘জাতি জামায়াত-শিবিরের এই তাণ্ডব দেখে স্তম্ভিত।’ সাংবাদিকেরা এসব হামলার বিষয়ে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা জামায়াতের আমির ইউনুস আলীর বক্তব্য জানার জন্য তাঁর মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে ইউনুস আলীর সবগুলো ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। জেলা জামায়াতের আমির আবদুর রহিম কারাগারে। সেক্রেটারি আবদুল করিমের মুঠোফোনও বন্ধ।

বামনডাঙ্গা ও সুন্দরগঞ্জে সুনির্দিষ্ট করে সংখ্যালঘুর বাড়ি ও দোকানে হামলা হয়েছে। গাইবান্ধা জেলা পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি রণজিৎ বকসি বলেন, বেলকা ইউনিয়নে দুটি এবং শান্তিরামে তিনটি মন্দির ভাঙচুর করা হয়েছে। অনেক সংখ্যালঘুর বাড়ি ও দোকানে হামলা হয়েছে।
সুন্দরগঞ্জের শান্তিরাম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সুরজিত কুমার বলেন, “বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শান্তিরাম মন্দিরে আগুন দেওয়া হয়। এরপর আমার বাড়িতে হামলা ও লুটপাটের পর আগুন ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে তারা। স্বাধীনতার এত বছর পরও যদি এভাবে আমাদের বাঁচতে হয়, সেই কষ্ট আমরা কোথায় রাখবো?” দেশের প্রতিটি শান্তিপ্রিয় নাগরিক একই বেদনায় ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। একই আতংকে সন্ত্রস্ত। মাননীয় বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে এর দায় নিতেই হবে। তার বক্তব্য এই সাম্প্রদায়িক হামলার উস্কানি দিয়েছে। এই বিপন্ন পরিস্থিতিতে সরকারকে আরো সতর্ক হতে হবে আসন্ন বিপর্যয় ঠেকাতে।
এ প্রসঙ্গে একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ এবং সভ্যতা ধ্বংসে ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ এর অনুসারীদের ধ্বংসাত্মক তৎপরতা এবং তা দমনের ইতিহাস উল্লেখ করতে হয়।
কোন ধর্মীয় পবিত্র স্থানকে “ক্রিমিন্যাল”দের অপরাধীদের আশ্রয়, অপকর্ম অপতৎপরতার কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত হতে দেয়া হয় না কোন দেশেই। একমাত্র ব্যতিক্রম, বোধহয় বাংলাদেশ।

এবার উল্লেখ করি, পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের লাল মসজিদের কথা। ১৯৬৫ সালে নির্মিত এই মসজিদটির এক ইমাম মাওলানা মোহাম্মদ আবদুল্লাহ জেনারেল জিয়াউল হকের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
আমাদের সকলকে মনে রাখতে হবে, জিয়াউল হকই পাকিস্তান নামের এই দেশটিকে কট্টর মৌলবাদী রাষ্ট্র বানিয়ে ছাড়েন। আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের দখলদার বাহিনীকে তাড়াতে আমেরিকা এবং সৌদি আরবের সরাসরি সাহায্য নিয়ে তালেবান, আলকায়েদা এবং ওসামা বিন লাদেনদের মতো দানবদের সৃষ্টি করেন পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউল হক।
লাল মসজিদের ইমাম মোহাম্মদ আবদুল্লাহ জোটবদ্ধ হয়ে জেনারেল জিয়াউল হককে জোর সমর্থন দিয়ে যান। আমাদের দেশেও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বুদ্ধিজীবিদের ঘাতক মওলানা আবদুল মান্নান জোর সমর্থন দিয়েছেন দুই সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং জেনারেল এরশাদকে।

পাকিস্তানে একটি ফতোয়া দেয়ার কারণে ইমামের পদ থেকে অপসারিত করা হলো মাওলানা আবদুল্লাহ কে। তিনি ফতোয়া দিলেন যে, তালেবানরা আফগানিস্তানে আমেরিকানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, জেহাদ করছে, সুতরাং এই তালেবান জেহাদী দের হত্যায় কোন পাকিস্তানী জড়িত থাকলে তার জানাজা পড়া জায়েজ হবে না।


পাকিস্তানের আইএসআই, ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স, দেশটি চালায় – এটা অনেকেই জানেন। আইএসআই এর কাছে এই ফতোয়া ভয়ংকর এক হুমকি হয়ে দাঁড়াল। প্রশ্ন উঠলো-তালেবানদের সাথে যুদ্ধে মারা গেলে তাদের শহীদ হওয়ার কথা!! তা না হয়ে মৃত্যুর পর জানাজাই পাওয়া যাবে না?? তাহলে পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনীর সদস্যরা যুদ্ধে বা জেহাদে যাবে কেন? বাবা- মা’ রাই বা কেন তাদের সন্তানদের পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে অথবা জেহাদে পাঠাতে চাইবেন?

এই ফতোয়া র বুমেরাং থেকে বাঁচতে ইমাম আবদুল্লাহকে অপসারণ করা হলো ঠিকই, কিন্তু তার দুই ছেলে মাওলানা গাজী আবদুল আজিজ এবং মাওলানা গাজী আবদুর রশীদের নিয়ন্ত্রণে থাকল এই লাল মসজিদ।
২০০৭ সালের ৩ জুলাই, লাল মসজিদসংলগ্ন মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীরা কোন রকমের উস্কানি ছাড়াই পাশের এক সিকিউরিটি পোস্টের পুলিশদের আক্রমণ করলো। অস্ত্রশস্ত্রও লুট করলো। কয়েকজন সরকারী কর্মচারীকে জিম্মিও করে ফেললো।
সেই সাথে দাবি তুলল, মহিলাদের লেখাপড়া বন্ধ করতে হবে, টেলিভিশন বন্ধ করতে হবে, ভিডিও দোকান বন্ধ করতে হবে এবং পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা, লেখাপড়া কিছুই থাকতে পারবে না। তাদের আরও একটি দাবি, পাকিস্তানে কোন সংখ্যালঘু, ‘মাইনোরিটি থাকতে পারবে না; সকল বিদেশী এবং ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের পাকিস্তান থেকে তাড়িয়ে দেশটিকে ‘পবিত্র ভূমি’ বানাতে হবে।

৩ জুলাই থেকেই পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে এই সন্ত্রাসীদের সাথে সমঝোতার লক্ষ্যে আলোচনা দেনদরবার চলতে থাকে । কিন্তু তারা তো শান্তির বিরুদ্ধে। সমঝোতায় কেন আসবে তারা?
লাল মসজিদের এই সন্ত্রাসীরা ৬ জুলাই হত্যা করে ১৮ জন পুলিশ সদস্য এবং একজন বেসামরিক নাগরিককে। তারপরও আলোচনা চলতে থাকে। কিন্তু না, এই ধর্মান্ধ মোল্লারা ‘সুইসাইড স্কোয়াড’ এর হুমকি দিতে থাকল। লাঠি হাতে কালো বোরকায় চুল থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা মহিলাদেরও তখন লাল মসজিদে দেখা যায়। ন্যূনতম মানবিক বিবেচনা বর্জিত এই সন্ত্রাসীরা শিশুদেরও বর্ম হিসেবে ব্যবহার করতে থাকলো। এই এক্সট্রিমিষ্ট দের দমনে কঠোর হতে হলো পাকিস্তান সরকারকে।
এমন অরাজকতা, নৈরাজ্য কোন সরকার ই মেনে নিতে পারে না! ধর্মের নামে, ধর্মের এমন অপব্যবহার কোন রাষ্ট্র ই সহ্য করতে পারে না- যদি সেই দেশটি সোমালিয়ার মতো ব্যর্থ রাষ্ট্র না হয়।

জেনারেল জিয়াউল হকের শাসনামলে পাকিস্তানের ‘আইএসআই’ প্রকাশ্যে ও খুব তৎপর ছিল । তখন ‘ইসলামাইজেশন অব পাকিস্তান’, ‘মিলিটারাইজেশন অব পাকিস্তান’ এবং ‘ইসলামাইজেশন অব আর্মি’ চরমে পৌঁছে। কিন্তু লাল মসজিদের দখল- মৌলবাদী এবং ধর্মান্ধদের এত বড় পৃষ্ঠপোষক আইএসআইও মেনে নিতে পারলো না । সরকারী নিরাপত্তা বাহিনী অভিযান চালিয়ে আবার দখলে নিল এই মসজিদটি। এতে ১৭৩ জন নিহত হলো। আহত হলো আরও এক হাজার।

ইসলামধর্ম রক্ষার পবিত্র দায়িত্ব নিয়ে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সৃষ্ট পাকিস্তানে ইসলাম ধর্মের নামে ব্যবসা করতে দেননি পাকিস্তানের একজন জেনারেল- প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ। তাই হয়তো আইএসআই য়ের রোষানলে পড়তে হলো তাকে।
এবার পবিত্র কা’বা শরীফ দখলের প্রসঙ্গে আসা যাক্।
১৪০০ হিজরী সালের রমজান মাসের প্রথম দিন, ১৯৭৯ সালের ২০ নবেম্বর, ভোর ৫টার দিকে যখন মুসল্লিরা ফজরের নামাজের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন জুহায়মান আল ওতাইবি নামের এক পথভ্রষ্ট উগ্রপন্থীর নেতৃত্বে হামলা হয় পবিত্র কাবা শরীফে। তার সাথে চার পাঁচ শ’ উগ্র ধর্মান্ধ লোক ছিলো। কা’বা শরীফে ঢুকেই তারা কা’বা শরীফের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়। মিনারের বিভিন্ন জায়গায় উঠে অবস্থান নেয় এবং গোলাগুলি করতে থাকে। তখন হজের মৌসুম। অনেক মুসল্লি আটকা পড়েন পবিত্র ক্বাবা শরীফে।
ক্বাবা শরীফ দখল করেই জুহায়মান আল ওতাইবি ঘোষণা দেয়, নতুন হিজরী শতাব্দীর পবিত্র দিনে ইমাম মেহেদীর আগমন ঘটেছে। তার দাবিমতে, এই ইমাম মেহেদীর নাম আবদুল্লাহ আল কাহতানী এবং তিনি ওতাইবিরই এক আত্মীয়।
তারা তখন সৌদি রাজপরিবারের বিরুদ্ধে অনেক উদ্ভট অভিযোগ আনে।সৌদি রাজপরিবারের উৎখাতও দাবি করে তারা ।

তখন সৌদি কিং ছিলেন বাদশাহ খালেদ। তাঁর বড় ভাই বাদশাহ ফয়সল এক আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার পর ১৯৭৫ সালে যিনি বাদশাহ হয়েছিলেন। বাদশাহ খালেদের পর যুবরাজ ছিলেন প্রিন্স ফাহাদ এবং তারপর প্রিন্স আবদুল্লাহ।
প্রিন্স খালেদ ১৯৮৩ সালে মারা যাওয়ার পর যুবরাজ ফাহাদ বাদশাহ হলেন । বাদশাহ ফাহাদ মারা যাওয়ার পর যুবরাজ আবদুল্লাহ বাদশাহ হলেন ।এখনো ক্ষমতায় আছেন তিনি।

১৯৭৯ সালের নবেম্বরে কা’বা শরীফে যখন হামলা হয়, তখন যুবরাজ ফাহাদ এবং প্রিন্স আবদুল্লাহ ভিন্ন ভিন্ন সফরে উত্তর আফ্রিকায় ছিলেন।
বাদশাহ খালেদ সেই সংকটজনক পরিস্থিতিতে পবিত্র হারেম শরীফ থেকে সন্ত্রাসীদের উচ্ছেদ এবং উৎখাত করার দায়িত্ব দিলেন ডিফেন্স মিনিস্টার প্রিন্স সুলতান এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স নায়েফকে।

সৌদি রাজপরিবারের এই দুই সদস্য ওতাইবি এবং তার দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর আগে সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতি শেখ বিন বাজের সাথে আলোচনা করলেন। গ্র্যান্ড মুফতি শেখ বিন বাজ এই অভিযান অনুমোদন করতে সম্মত হলেন। সাথে সাথে শুরু হয় জুহায়মান আল ওতাইবিদের উচ্ছেদ অভিযান।
সৌদি সরকারের অনুরোধে পাকিস্তানও তখন একটি কমান্ডো দল পাঠায় কা’বা শরীফ উদ্ধারঅভিযানে সাহায্য করতে। এই অভিযানে প্রায় ১০ হাজার সৈন্য সামন্ত নিয়োগ করা হয়েছিলো। ১৯৭৯ সালের নবেম্বরে এই অভিযানে নিরাপত্তা বাহিনীর ১২৭ জন নিহত হয়, আহত হয় প্রায় সাড়ে চারশ’। ওতাইবির পক্ষে নিহত হয় ১১৭ জন। পরে শরীয়া আইন অনুসারে বিচার করে ওতাইবিসহ ৬৮ জনের মুন্ডু কেটে নেয়া হয়।

লাল মসজিদ এবং পবিত্র কাবা শরীফ দখলে নিয়ে যে অপকর্ম করেছিল সন্ত্রাসী উগ্রপন্থী জঙ্গী রা এবং এই দু’টি পবিত্র স্থান পরে কেমন করে উদ্ধার করা হয়েছিল সব বিস্তারিত তথ্য ইন্টারনেটে পাওয়া যাবে।

ধর্মের নামে এই সন্ত্রাসী দখলদারদের আক্রমনাত্মক ভূমিকার কলংকজনক ইতিহাস বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বারবার জনসমক্ষে তুলে ধরা উচিত। জাতীয় শিক্ষাক্রম এবং উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে লিপিবদ্ধ থাকা উচিত এই ইতিহাস। দেশের নতুন প্রজন্ম কে রক্ষা করার জন্যে এই ধর্মব্যবসায়ীদের প্রকৃত চরিত্র উন্মোচন করা জরুরী হয়ে পড়েছে।
রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মসজিদ, কাঁটাবন মসজিদ এবং আমাদের অনেক মসজিদ মাদ্রাসাকে জামায়াত-শিবির এবং তাদের সমমনা দলগুলোর লোকজন ইসলাম ধর্মের নামে কেমন কলুষিত করে চলেছে, তা অব্যাহত থাকতে দেয়া যায় না। যেমন হতে দেয়া হয়নি পবিত্র কা’বা শরীফ এবং পাকিস্তানের লাল মসজিদে।


জানা যায়, পুলিশ হত্যা, থানা ও ফাঁড়ি ভাঙচুর, সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা ও সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি-দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ, লুটপাটসহ বিভিন্ন অভিযোগে করা মামলায় শুক্রবার রাতে আনোয়ারুল ইসলাম, আবদুর রউফ, লেবু মণ্ডল নামে তিনজনকে এবং শনিবার জিয়াউর রহমান নামে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকালও সুন্দরগঞ্জ পৌর এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি ছিল। মোতায়েন হয়েছে বিজিবি ও অতিরিক্ত পুলিশ। পুলিশ প্রশাসন জানিয়েছে, সুন্দরগঞ্জ থানায় দুটি মামলা হয়েছে। সুনির্দিষ্ট ৬২ জনের নাম উল্লেখ করে ২০ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আহসান হাবিব বলেছেন, হামলার শিকার ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রণয়নের কাজ চলছে। আমার মনে হয়, হামলাকারীদের তালিকা প্রণয়ন অনেক জরুরী। একথা সত্যি, যে, আমাদের প্রশাসনে জনবল এবং দক্ষতা এখনো প্রয়োজনের তুলনায় কম।এখানে মসজিদে আশ্রয় নিয়ে মসজিদ থেকে হামলা চালায় জামায়াত –শিবির-জঙ্গীরা।
এই দেশে একটি পত্রিকা অফিসে আশ্রয় নিয়ে পুলিশ এবং নিরীহ মানুষজনকে টার্গেট করে ভারপ্রাপ্ত ‘চান্স মোহাম্মদ’’ এডিটর জেহাদী মাহমুদুর রহমান ধর্মান্ধ মোল্লাদের উস্কায়। নিরীহ সংখ্যালঘু এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সৈনিকদের ‘নাস্তিক’ বলে তাদের হত্যার হুমকি দেয়।
দেশের গ্যাসসম্পদ বিক্রি করে নাইকো থেকে কোটি টাকার গাড়ি নেয়া সহ সীমাহীন দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত এবং প্রমাণিত ব্যক্তি মাহমুদুর রহমান উচ্চ আদালতে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি- কী করে তিনি একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক হতে পারেন?

রাজীবের হত্যাকারী ৫ জন গ্রেফতার হয়েছে। তারা স্বীকারোক্তি ও দিয়েছে। এবার শহীদ রাজীবের নৃশংস হত্যাকে জায়েজ করার জন্যে তার ‘চরিত্র হননকারী’ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান এবং এই মিথ্যা ষড়যন্ত্রমূলক প্রতিবেদনের প্রতিবেদক মাহমুদা ডলির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবার সময় এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির বিরুদ্ধে সংবাদপত্র কে ব্যবহার করে এ ধরণের মিথ্যা এবং উস্কানিমূলক প্রচারণা বন্ধ করতে হবে। পত্রিকায় বিবৃতিদানকারী ২১ বিশিষ্ট নাগরিকের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমার আবেদন,শুধু বিবৃতি আর কলাম লিখে সীমাবদ্ধ নয় আমাদের কাজ। বাস্তবে কাজ করতে হবে।
বিচ্ছিন্নতা নয় আর, প্রজন্মের নেতৃত্ব দেশ বিদেশের কোটি কোটি মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। এই সাহসী সময়কে ধরে রাখতে হবে। এগিয়ে যেতে হবে অনেক দূর। নজরুলের ভাষায় বলি, হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোন্ জন? কান্ডারী বলো ,ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র।”
আমার ভাই , আমার বোন , আমার মা বিপন্ন । ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এগিয়ে আসতে হবে এই সহিংসতা ঠেকাতে। প্রথাগত পুঁথিগত এবং নির্বাচনী রাজনীতির বাইরে বেরিয়ে এসে কাজ করতে হবে রাজনীতিবিদদের। বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে সকলকে। এর মাধ্যমেই এই উপমহাদেশে ও মুসলিম ব্রাদারহুড বা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কবর রচিত হবে। May 2013 .Sumikhan29bdj@gmail.com

Tuesday, July 2, 2013

একজন নারী সাংবাদিক- সুমি খান



চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন আশৈশব আমার আদর্শ। মনে পড়ে, সেই কিশোরীবেলা থেকেই দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত মোনাজাতউদ্দিনের রিপোর্ট নিয়ে বাবা-মায়ের উচ্ছ্বসিত মন্তব্য শুনতাম। আর মনে মনে ভাবতাম, একদিন আমিও এরকম করে রিপোর্ট করবো, দেশের প্রত্যন্ত জনপদের মানুষের সুখ-দু:খের কথা তুলে ধরবো পত্রিকার পাতায়। তখনো বুঝিনি, আমি এই সমাজের কাছে প্রথমত: ‘মেয়েমানুষ’ - মোনাজাতউদ্দিনের মতো চারণ সাংবাদিক হবার বাস্তবতা আমার নেই।
১৯৮৫ সাল থেকে শুরু করলাম লেখালেখি। ।চট্টগ্রামের স্থানীয় দৈনিক আজাদী, পূর্বকোণে লিখলাম নারী অধিকার, মানবাধিকার, কালো মানুষের অধিকার নিয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকার কালো মানুষের বিপ্লবের গণজাগরণের কবি বেঞ্জামিন মলয়ঁসে কে ১৯৮৫ সালে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়। সেসময়ে স্কুলে পড়ি। মন থেকে মেনে নিতে পারলাম না বিপ্লবের কবি মলয়ঁসের ফাঁসির আদেশ।লিখলাম , “বেঞ্জামিন মলয়ঁসে: মৃত্যুহীন প্রাণ”।
এর আগে রাজধানীতে সোগেরা মোর্শেদ নামে একজনকে সম্ভবত: হত্যা করা হয়েছিলো, এর প্রতিবাদে একটি লিখা দিয়েছিলাম। বলা প্রয়োজন,এই লেখাটি আমাকে লিখে দিয়েছিলেন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম মহানগর শাখার তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আলেক্স আলীম। চিন্তাশীল অনুভূতিকে কাজে লাগানোর এর চেয়ে মোক্ষম উপায় আর কী হতে পারে!
যাই হোক্ দৈনিক পূর্বকোণের জুবলী রোড সিগনেট প্রেস অফিসে গিয়ে এক নারী সহসম্পাদক ‌এর হাতে দিয়ে এলাম লেখাটি। তিনি লিখাটি চিঠিপত্র কলামে ছেপে দিলেন। আমার মতো এক কিশোরীর আবেগঘন প্রতিবাদী লেখাটি কলাম হিসেবে ছাপার যোগ্য মনে করেন নি হয়তো। মনে কিছুটা কষ্ট পেলাম।পূর্বকোণে আর লেখা দিলাম না; আজাদীতে লিখতে থাকলাম। বেঞ্জামিন মলয়ঁসে , ফরাসী বিপ্লবে নারীর অবদান, শ্রমজীবি নারীর শ্রমের অধিকার নিয়ে লিখতে থাকি। একসময়ে দৈনিক পূর্বকোণে লিখতে শুরু করি সাংবাদিক আবুল মোমেনের হাতে লিখা দিয়ে আসতাম।
১৯৯৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক আমার ভাশুরের প্রোমোশান উপলক্ষে বাড়িতে নেমন্তন্ন রক্ষা করতে এলেন অনেকে। তাদের মধ্যে দৈনিক ভোরের কাগজের তৎকালীন চট্টগ্রাম ব্যুরোচীফ আবুল মোমেন অন্যতম। তাকে বললাম, “ মোমেন ভাই, জে এম সেন এর মতো দেশনেতার নামে চট্টগ্রামের একমাত্র এভেনিউ জানতে পারলাম বাবার কাছে। আমি বাবাকে সাথে নিয়ে দেখেছি, দু’য়েকটি হিন্দু মালিকানাধীন দোকান ছাড়া অধিকাংশ দোকানের সাইনবোর্ডেই তার এই নামটি লিখা নেই। এভাবে জে এম সেনের কর্ম, নাম হারিয়ে যাচ্ছে। আমি কি একটা রিপোর্ট করতে পারি , যদি অনুমতি দেন?” আবুল মোমেন তার স্বভাবসুলভ স্মিত হেসে বললেন. “করো”।
তার কাছে কৃতজ্ঞ আমি তিনি আমার রিপোর্টিং এর সুযোগ করে দিয়েছিলেন সেদিন।
আমার অসাধারণ উদ্যমী আর সাহসী বাবা সাইফুদ্দিন খান আমাকে নিয়ে প্রতিটা দোকান মালিক এবং কর্মচারীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। শেখালেন মানুষের সাথে মিশে কী করে তথ্য সংগ্রহ করতে হয়। কোতোয়ালী, লালদীঘি , আন্দরকিল্লা এসব জায়গা বাবার শৈশব, কৈশোর, ভাষা আন্দোলন , শ্রমিক আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি মিছিলের পায়ে পায়ে চেনা। চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থেকে আন্দরকিল্লা পর্যন্ত প্রতিটি দোকানে কথা বললাম। এই এলাকার একমাত্র পেট্রোলপাম্প এর মুসলমান মালিক ( নামটি মনে করতে পারছিনা, তিনি বেঁচে নেই) বললেন এদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অংশ হিসেবে কী করে ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবের অন্যতম সেনানী ব্যারিষ্টার যাত্রা মোহন সেন -জে এম সেনের নাম মুছে ফেলার গভীর ষড়যন্ত্র থেকে সাইনবোর্ডে তার নাম লিখা হয় না। অথচ চট্টগ্রামে তখন পর্যন্ত সেটাই একমাত্র এভেনিউ ছিল। যাই হোক্ জে এম সেনের ইতিহাস এবং জে এম সেন এভেনিউর ইতিহাস তুলে ধরলাম। একটি জাতীয় দৈনিক ভোরের কাগজের চলমান চট্টগ্রামে ১৯৯৩ সালের সম্ভবত: জুন মাসে প্রকাশিত হলো লেখাটি। এর পর নারী বানিজ্যব্যক্তিত্ব, শহীদ পরিবার সহ নানান বিষয় নিয়ে অব্যাহত থাকলো লিখালিখি। বিশ্বজিৎ চৌধুরী বিল করতেন একটা লেখাতে ১০০ টাকা । এসব নিয়ে কোন কথা বলা আমার স্বভাব বিরুদ্ধ। তাই রিপোর্টিং অব্যাহত রাখলাম। বসে থাকতাম রিপোর্টিং য়ের প্ল্যান আর আইডিয়া পাওয়ার জন্যে। না, সে আশার গুঁড়ে বালি। নিজেই ভাবতে থাকি কী করা যায়!
বাবার কাছে শুনেছি ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬২ সাল বাবার প্রথম কারাজীবন কেটেছে দেশের বিভিন্ন কারাগারে। এর পর আরো অনেকবার বাবা গ্রেফতার হয়েছেন। এখনো পংকজ ভট্টাচার্যের লেখায় তার কিছুটা পাওয়া যায়। কারাগার থেকেই বাবা বি.কম পাশ করেছেন।দেশের শীর্ষ অনেক রাজনীতিকের মতো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সাথে ও তার কারাগারে দেখা হয়েছে বলে শুনেছি। রাজবন্দী হিসেবে তারা বেশ সম্মানিত এবং প্রভাবশালী ছিলেন বলেই মনে হতো বাবার প্রাণোচ্ছ্বল গল্পে। তাই কারাগার নিয়ে আমার আলাদা আগ্রহ ছিল।
একদিন বললাম , কারাগার নিয়ে আমি একটা রিপোর্ট করতে চাই। বিশ্বজিৎ চৌধুরী সাথে সাথে বলে উঠলেন, “ কারাগারে আপনাকে ঢুকতে দেবে কেন? রিপোর্ট করতে চাইলেই তো আর করতে দেবে না”।
সামান্য একজন কন্ট্রিবিউটর হয়ে ও কোথা থেকে মনের জোর পেলাম জানি না। জবাবে কিছুটা দৃঢ়তার সাথে বললাম, “আমি করে আনতে পারবো”।
গেলাম চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে। জেল সুপারের রুমের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম বন্দীরা কুয়া থেকে পানি নিয়ে গোসল করছে , হেঁটে বেড়াচ্ছে। বাবার কাছে নাশতার টেবিলে বা খাওয়ার টেবিলে শোনা গল্পগুলো মনে পড়লো।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার এবং জেল সুপার অনেক তথ্য দিলেন। সেসব নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করলাম। বিশ্বজিৎ চৌধুরী চলমান চট্টগ্রামের কাভার ষ্টোরী করলেন। বক্স করে চট্টগ্রাম কারাগারের ইতিহাস আলাদা করে দিলেন। সেটাতে আমার স্বামী আবদুল আলীমের নাম দিলেন। সেদিন প্রথম জানতে পারলাম এবং কিছুটা ধাক্কা খেলাম – আমার কাজ অন্যের নামে প্রকাশ হতে পারে।এভাবে কেটে গেলো দিন।
১৯৯৩ সাল থেকেই প্রগতিশীল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত পত্রিকাগুলোতে চাকরির চেষ্টা করেছি । ভোরের কাগজের কাজ গুলোর ব্যাপক প্রশংসা কাজের স্পৃহা বাড়িয়ে দিতো শতগুণ। কিন্তু চাকরি দেবার আগ্রহ দেখায়না নীতিনির্ধারকেরা।
নারী নেত্রী মালেকা বেগম কে সেই শৈশব থেকে দেখেছি মায়ের সাথে পথে প্রান্তরে নারী আন্দোলনের কাজে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের অন্য সব কেন্দ্রীয় নেত্রীদের মতো মালেকা বেগম ও সাধারণ সম্পাদিকা হিসেবে চট্টগ্রামে গেলে আমাদের বাসাতেই থাকতেন। আমার মা নূরজাহান খান ব্যাংকার ছিলেন। কোনরকমে অফিস পিরিয়ড শেষ হতে না হতেই মালেকা খালাম্মাকে সাথে নিয়ে মা বেরিয়ে পড়তেন । হেঁটে হেঁটে সারা শহরের নারীদের সংগঠিত করতেন। মালেকা খালাম্মার পায়ের চটির দিকে দেখতাম ধুলো- ময়লা মাখামাখি।রাজনৈতিক গল্প, একাত্তরের গল্প, সাংগঠনিক , পারিবারিক গল্প , আড্ডা হৈচৈ করে মা এবং মালেকা খালাম্মা ঘুমাতে যেতেন অনেক দেরিতে। মনে পড়ছে ,এসব করে ও মা আমাদের দেখা শোনা, মেহমান দের জন্যে উপাদেয় রান্না, কোনটাই বাদ দিতেন না। বাবা বেশ উৎসাহের সাথে অনেক বাজার করে আনতেন মেহমানদের জন্যে। ১৯৮৫ সালে প্রথম বান্দরবান যাই ।মালেকা খালাম্মা নিয়ে যান আমাদের। মালেকা খালাম্মার ছেলে সাশা, আমরা তিন ভাই বোন আর মা। খুব আনন্দ করেছিলাম।
১৯৯৩ সালের পর যখন ভোরের কাগজ বা প্রথম আলোর কোন প্রোগ্রামে আসতেন মালেকা খালাম্মা বা মতি চাচা ( প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ), তখন তারা হোটেলে থাকতেন। ১৯৯৫ সালের পর আমার মা মালেকা খালাম্মাকে বলেছিলেন , আমাকে ভোরের কাগজের সাথে যুক্ত করতে। আমি দেখেছি, তিনি কিছুটা বিরক্ত হয়েই বলতেন, “এটা তো মোমেন ই পারে নূরজাহান আপা”।
এর পর একদিন মা আবুল মোমেন কে বললেন, “ মোমেন ভাই, সুমি তো আপনাদের সাথেই কাজ করছে অনেক দিন। আপনারা নতুন ভাবে পত্রিকা শুরু করছেন । ওকে কি আপনাদের কাজের সাথে নিতে পারেন? ওতো কাজ করে ।" আবুল মোমেন হেসে বললেন, “ কাজ একটু বেশী ই করে, কিন্তু এই মুহুর্তে তো সম্ভব না, দেখা যাক্ কী করা যায়।” মাকে এভাবে বারবার বিব্রত হতে দেখে আমার খুব কষ্ট হলো। প্রথম আলো বাজারে এলো। একদিন আমি ই আগ্রহ প্রকাশ করলাম। আবুল মোমেন বললেন, “ চট্টগ্রামে মেয়েদের সাংবাদিকতা করার পরিবেশ নেই। তুমি ফ্রিল্যান্স করছো, করে যাও।” বুঝলাম আমাকে সাংবাদিকতা করার পরিবেশ তৈরি করে নিতে হবে।
একটি কথা প্রসঙ্গক্রমে আনা প্রয়োজন। আমার বড়ো চাচা ডা. কামাল এ খান চট্টগ্রামের আন্দোলন, সংগ্রাম , ক্রীড়া জগৎ, সংস্কৃতিক জগতের নিবেদিতপ্রাণ প্রচারবিমুখ অসাধারণ এক ত্যাগী সংগঠক ছিলেন। দুই বাংলার সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের চট্টগ্রাম সফর মানেই আয়োজক এবং পৃষ্ঠপোষক ছিলেন আমাদের বাপ্পু ডা. কামাল এ খান। তার মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রগবেষক ওয়াহিদুল হক শিল্পকলা একাডেমীতে বলেছিলেন , “ ডা. কামাল এ খানের নামে মেলা হওয়া উচিত এমন নিষ্প্রাণ শোকসভা নয়”।
আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় বাপ্পুর প্রসঙ্গ আনবার কারণ হলো, ভোরের কাগজ এবং প্রথম আলো দু’টি পত্রিকার নীতিনির্ধারক এবং সংবাদকর্মীরা শুরুর সময়ে চট্টগ্রামে প্রথম কিছুদিন অফিস হিসেবে বাপ্পুর চেম্বারেই বসেছেন। কথাটা এজন্যেই বলছি ,বাপ্পু মারা যাবার পর প্রথম আলোতে তার মৃত্যু সংবাদ প্রকাশ করার জন্যে আমাকে বেশ অনেক বার ফোন করতে হয়েছে ঢাকায়। বাপ্পুর পারিবারিক বন্ধু এবং তার অনেক অনুগ্রহের পাত্র হলে ও এই মানুষটির ত্যাগ এবং তিতিক্ষার কথা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার দায়িত্বশীলতা থেকে চট্টগ্রামের সংস্কৃতি সংগঠক এবং সাংবাদিকেরা অনেক দূরে । ডি. কামাল এ খানের মৃত্যুসংবাদ প্রকাশেও ভীষণ হীনমন্যতার প্রকাশ দেখলাম তাদের। সাংবাদিকদের পেশাদারীত্ব আর দায়বদ্ধতার এমন অভাব কাছে থেকে দেখতে হয়েছে আমাকে বার বার।
গোষ্ঠী চিন্তা আর ব্যক্তিকেন্দ্রীকতার উর্ধে উঠে একজন নিবেদিতপ্রাণ মানবাধিকার সংগঠকের স্মৃতির প্রতি সামান্যতম দায়িত্বশীলতার পরিচয় ও দিতে পারলেন না কেউ।আমাদের দুর্ভাগ্য।
যাই হোক্ এক সময়ে ঢাকায় এলাম । দৈনিক সংবাদের বার্তা সম্পাদকের কাছে গেলাম। বললাম আমি মোনাজাত উদ্দিনের মতো কাজ তুলে আনতে চাই প্রত্যন্ত জনপদ থেকে । সম্পাদক আহমেদুল কবীর চাচা তখন গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি । বাবা তার ভীষণ স্নেহভাজন অনুজ। তিনি নিয়মিত বাবাকে ফোন করতেন ল্যান্ড ফোনে। আমি রিসিভ করলে তার ভরাট কন্ঠ শুনে শ্রদ্ধায় নত হয়ে যেতাম।তাকে আমার চাকরির কথা বলতে পারলাম না কেন যেন। বাবা কেও বলি নি।১৯৯৯ সালে যুগান্তরের চট্টগ্রাম ব্যুরোপ্রধান জসীম চৌধুরী সবুজআমাকে বললেন, “ আপনি তো ভালো লিখেন, আমাদের পত্রিকায় আসেন”।
এ্যাপয়েন্টমেন্ট হলো ফিচার এ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে। আরো একজনের একই সাথে এ্যাপয়েন্ট হলো, তাদের কারো আগে কোন রিপোর্টিং য়ের অভিজ্ঞতা নেই। তারা পুরুষ বলেই তাদের রিপোর্টার হিসেবেই চাকরি হলো। নভেম্বর ১৯৯৯ থেকে নভেম্বর ২০০০ ।
এর মধ্যে শিক্ষা বোর্ড এবং নারী নির্যাতন ইস্যুতে অনেক আলোচিত রিপোর্ট করেছি। অনেক রিপোর্ট বাস্কেটে ফেলে দেয়া হতো। এরকম একটি ঘটনা এসিড ছুঁড়ে মারা হয়েছিলো স্ত্রীকে। অপরাধী স্বামীর ছবি জোগাড় করেছি অনেক কষ্টে। দেখলাম সেই ছবি টি ব্যুরোচীফ তার টেবিলের পাশে বাস্কেটে ফেলে দিলেন। অপরাধ কী? এখনো জানি না।একবছরের মাথায় আমাকে যুগান্তর ছাড়তে বাধ্য করা হলো। এর কারণ টি এর আগে আরেকটি লেখায় আমি দিয়েছিলাম। তবু এখানে বলতে হচ্ছে-এক কিশোরী গৃহপরিচারিকা কে ধর্ষণ করে চট্টগ্রামের চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার একটি বাড়ির ছাদ থেকে ফেলে দেয়া হয়েছিলো। সেই রিপোর্ট করে আমি সাংবাদিক সমাজের চোখে অপরাধ করেছিলাম। ধর্ষণকারীর ছোটভাই এবং ভাগ্নী জামাই তখন প্রভাবশালী সাংবাদিক। প্রেসক্লাবে আমার বিচার বসলো আবুল মোমেন এবং অন্যান্য সাংবাদিক দের নেতৃত্বে । যাই হোক্, সে সময়ে সাপ্তাহিক ২০০০ এর চট্টগ্রাম প্রতিনিধির দায়িত্ব পেলাম। প্রথম সারির পত্রিকার সাংবাদিকেরা ও অপেক্ষায় থাকতো আমি সপ্তাহশেষে কী রিপোর্ট দিচ্ছি। দিন রাত খাটনি আর পরিশ্রম করে সপ্তাহের কাভার স্টোরী করতাম। চট্টগ্রাম থেকে একমাসে ৩/৪টা কাভার স্টোরী আমার থাকতো। আমি কাজ করার আগে চট্টগ্রামে পত্রিকার সার্কুলেশন ৭৫/একশ’ কপি ছিল। আমার রিপোর্ট প্রকাশ হতে শুরু করলো আর ৫/৭ হাজার কপি পর্যন্ত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য, জাপান সহ অনেক দেশে সাপ্তাহিক ২০০০ এর সার্কুলেশন । পাঠকদের অনেক চিঠি পাই। অস্ত্র , চোরাচালান , জঙ্গীবাদ, জামাত শিবিরের সন্ত্রাস নিয়ে একের পর এক অনুসন্ধানী প্রতাবেদন করতে থাকি। তরুণ প্রধান প্রতিবেদক গোলাম মোর্তোজা এবং আরো অপেক্ষাকৃত তরুণ নির্বাহী সম্পাদক মোহসিউল আদনান প্রচন্ড সম্মান করেন এবং সহযোগিতা করেন। সাপ্তাহিক ২০০০ চট্টগ্রাম অফিস করা হয় আমাদের বাসার ই একটি ছোট্টরুমে।
২০০২ এর ২৮ নভেম্বর বিকেল ৪টায় আমার অফিস থেকে কোতোয়ালী থানার ও সি রুহুল আমিন সিদ্দিকী এবং এসআই ইয়াসমিন বেগমের নেতৃত্বে একটি দল এসে আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। আমার ছোট ছেলেটার গায়ে সেদিন প্রচন্ড জ্বর। কনভেন্টে প্লে গ্রুপে পড়ে। একা একা পুলিশের গাড়ির পেছনে রাস্তায় চলে যায়, দু’চোখে জলের ধারা। তার মা’কে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে, কারণ কিছুই বুঝতে পারে না । আমার বাবা দুপুর বেলা একটু বিশ্রামে ছিলেন অসুস্থ শরীরে লুঙ্গী পরা অবস্থায় পুলিশের জীপের পেছন পেছন সিএমপি হেডকোয়ার্টারে ছুটে যান। এসি ডিবির রুমে আমাকে দেখে তৎকালীন এসি ডিবি শফিকুর রহমান কে বিনয়ের সাথে প্রশ্ন করলেন , “ আমি তো পাকিস্তান সরকারের সময়ে অনেক জেল খেটেছি, নির্যাতন সয়েছি। এখন স্বাধীন দেশ। আমার মেয়েটাকে কেন ধরে আনলেন?” তিনি বললেন তিনি কিছুই জানেন না। মোর্তোজা ভাইকে মোবাইলে জানালাম। আমার হাতে তখনো মোবাইল ছিল, এর পরেই সীজ করে নেয়। মোর্তোজা ভাই য়ের কাছে এসি ডিবি অস্বীকার করলেন তার রুমে আমার অবস্থানের কথা। সাড়ে ১১ ঘন্টায় দফায় দফায় ইন্টারোগেশান হয়। সিদ্ধান্ত ছিল রাতেই আমাকে ঢাকায় জয়েন্ট ইন্টারোগেশান সেলে পাঠিয়ে দেয়া হবে। রাত সাড়ে তিনটায় আমাকে ছেড়ে দেয়া হয়।
তার দু’দিন আগে সাংবাদিক সালিম সামাদ, প্রিসিলা রাজ, চ্যানেল ফোরের জাইবা মালিক এবং লিও পোল্ডো গ্রেফতার হন ঢাকা এবং বেনাপোল সীমান্ত থেকে। তাদের সাথে আমার কোন চেনা পরিচয় না থাকলেও তাদের সাথে আমাকে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় জড়ানোর চেষ্টা করা হয়। সালিম ভাই পরে বলেছিলেন, ওনাদের কাছে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিলো –তারা যদি সুমি খান কে তাদের কাজের সহযোগী হিসেবে বলেন, তাদের মুক্তি দেয়া হবে। তখন সালিম ভাইয়ের সাথে আমার কোন পরিচয় ছিল না। তিনি এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিস চৌধুরী বিবিসি এবং অন্যান্য মিডিয়াতে বলেন, “সুমি খানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতার যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ আমাদের কাছে আছে । এবার ছেড়ে দিলেও তাকে আবার ধরা হবে”।
পরদিন জানতে পারি আমাকে ছেড়ে দেবার পেছনে আমার সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী, অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ, মাহফুজ আনাম মতিয়া চৌধুরী এবং মালেকা বেগম এবং এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী সহ অনেকে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন । মালেকা খালাম্মা আম্মুকে বলেছেন, “নূরজাহান আপা, আপনি এখন সুমির মা শুধু নন, আপনি মহিলা পরিষদ নেত্রী। একটা মেয়েকে কিছুতেই রাতে থানায় রাখতে দেবেন না”।
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার আমাকে বললেন, “ আমি আইজি কে বলেছি, সুমি কেন্দ্রের সমন্বয়কারী। ওকে ১৯৯৫ সাল থেকে আমি চিনি। যদি ওর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ তোমরা প্রমাণ করতে না পারো, তোমাদের ছেড়ে দেয়া হবে না, মনে রেখো”।
২০০৪ সালের ২৭ এপ্রিল আমি একটি রিপোর্ট নিয়ে রাতের বেলা রিক্সায় করে এস এ পরিবহনে যাবার পথে অন্ধাকার রাস্তায় সন্ত্রাসীরা আক্রমন করে। আমি অজ্ঞান হয়ে রাস্তায় পড়ে ছিলাম। এলাকার ছেলেরা আমায় সেন্টার পয়েন্ট ক্লিনিকে নিয়ে যায় । সাংবাদিকেরা জানতে পেরে আমার বাসায় খবর দেয়।এর আগে থেকে ই আমাকে বেশ কয়েকটা চিঠিতে মৃত্যুপরোয়ানা জারি করে হুমকি দেয়া হয়। আমি মুখে এবং হাতে বেশ আহত হই। আমার বড়ো ছেলে অতুলন ভয়ে আমার দিকে তাকাতো না।আমার ছোট ছেলে গহন তার ছোট ছোট মাটির পুতুল গুলো এনে আমার মাথার কাছে বসে বসে আমাকে খেলতে বলতো, যেন এতে আমার মন ভালো হয়ে যায়। এর মধ্যে ৩ মে ২০০৪ প্রেস ফ্রিডম ডে। হঠাৎ দেখি সালিম সামাদ আমাকে দেখতে চট্টগ্রাম চলে গেছেন। সেদিন ঢাকায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি অতিথি। সব অনুষ্ঠান ফেলে তিনি বললেন চট্টগ্রামে আমার বোন আক্রান্ত হয়েছে, তাকে আমার দেখে আসতে হবে। সেদিন ই প্রথম তার সাথে পরিচয় এবং আপন বড়ো ভাই হিসেবেই তাকে বিপদের সময়ে চট্টগ্রামে পাশে পেলাম। সেই থেকে আজো আমার এই ভাইটির প্রতি আমার এবং আমার পরিবারের প্রত্যেকের বিনম্র শ্রদ্ধা।
কয়েকটা দাঁত ভেঙ্গে গেছে, হাতের আঙ্গুল সোজা করতে পারতাম না। ভেবেছিলাম আর কখনো লিখতে পারবো না। দাঁতের চিকিৎসা চট্টগ্রামে করলাম। হাতের আর নার্ভের চিকিৎসা মাদ্রাজে করলাম। ধীরে ধীরে আমার আঙ্গুল স্বাভাবিক হয়ে আসে। আমার যেন পুনর্জন্ম হলো!
জামাতের শীর্ষসন্ত্রাসী আহমইদ্যা গয়েশ্ব্বর রায়ের হাতে ফুল দিয়ে বিএনপিতে যোগ দিলো। আহমেদুল হক চৌধুরী প্রকাশ আহমদ্যা জামাত সাংসদ শাহজাহান চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ৯০ দিন সময় বেঁধে দিলেন –হয় শাহজাহান চৌধুরী থাকবে, নয়তো আহমদু থাকবে। এসময় আমি চট্টগ্রামের ত্রাস আহমেদুর ইন্টারভিউ নেবার চেষ্টা করি।
তার সাথে যোগাযোগ হয়। আমাকে সময় দিয়েছিলেন সন্ধ্যা ৭টায়, তার লোকজন রেইকি করে আহমদুর নিরাপত্তি নিশ্চিত হবার পর আহমদু আসেন সাড়ে সাতটার দিকে। চট্টগ্রামের জনপ্রিয় ঐ কাবাব হাউজের বাইরে দেখলাম সাংবাদিক নজরুল কবির তার শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের নিয়ে কাবাব খেতে গেছেন। তার সাথে কুশল বিনিময় করে ভেতরে একটি টেবিলে বসলাম ভয়ংকর এ সন্ত্রাসীর ইন্টারভিউ নিতে। খোলামেলা আলাপে বললেন ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়ে ফুলকুঁড়ি আসরের মাধ্যমে তাকে কিভাবে ছাত্র শিবিরের রাজনীতি এবং অস্ত্র হাতে তুলে দেয় শাহজাহান চৌধুরী। লম্বা , ফর্সা আকর্ষনীয় যুবক আহমেদু অকপটে বলে যান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির নেতা কর্মীদের খুন করে তাদের রক্তে হোলিখেলায় শিবির ক্যাডার দের মাতাল করেছেন জামায়াত নেতা এবং সাংসদ শাজহাজান চৌধুরী। বোরকা পরে অত্যাধুনিক অস্ত্র হাতে কয়েকটি খুনের বর্ণনাও দিলেন। গয়েশ্বর রায়ের হাতে ফুলের মালা দিয়ে বিএনপি তে যোগদানের কয়েকটি ছবি ও তিনি আমাকে দিলেন। সাপ্তাহিক ২০০০ টপ কভার ষ্টোরি করলো । মার মার কাট কাট সার্কুলেশন।
এই প্রতিবেদন প্রকাশের পরের শুক্রবার জুমার নামাজের আগ মুহুর্তে র‍্যাবের ক্রসফায়ারে বর্বরোচিত ভাবে হত্যা করা হয় আহমেদু কে। র‍্যাব-৭ এর তৎকালীন পরিচালক কর্ণেল এমদাদ ( পরবর্তীতে বিডিআর বিদ্রোহে নিহত) কে আমি প্রশ্ন করেছিলাম, " কেন আহমেদু কে হত্যা করা হলো ? " তিনি জবাব দিলেন," আপনাকে আহমইদ্যা যা ইন্টারভিউ দিয়েছে এর পর কী আর তাকে বাঁচিয়ে রাখা যায়?" প্রশ্ন করেছিলাম, " তাহলে আহমইদ্যাকে সন্ত্রাসের দীক্ষা যে দিয়েছে, তার মতো অসংখ্য কিশোর তরুণের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছে জামাত নেতা শাহজাহাস চৌধুরী - এই তথ্য নিশ্চিত হয়েই কি শাহজাহান চৌধুরীর জীবনের হুমকি কে সরিয়ে দিলেন?" হাসলেন কর্ণেল এমদাদ। সাপ্তাহিক ২০০০ পরের সংখ্যায় কর্ণেল এমদাদ এর এই ইন্টারভিউ ছাপা হলো।

বিএনপি নেতা এবং সংগঠক জামালউদ্দিন অপহরণ হলেন ২০০৩ সালের ২৬ জুলাই। তিনবছর পর তার কঙ্কাল উদ্ধার করা হয় ফটিকছড়ির জঙ্গল থেকে। এই তিন বছর নানান রকমের গল্প। আমার এক অজানা সোর্সের মাধ্যমে আমি সঠিক তথ্য গুলো পেয়ে যেতাম। জামালউদ্দিনের নব্বইবছর বয়সী মা শুধু আমাকেই ইন্টারভিউ দিলেন। বললেন , “আমাদের রাখালের ছেলে সরওয়ার জামাল নিজাম এমপি আমার ছেলেকে খুন করেছে”।
আমি ধারাবাহিক ভাবে জামালউদ্দিন অপহরণ এবং হত্যা নিয়ে রিপোর্ট করতে থাকি। আক্রান্ত হবান চিকিৎসা করতে গেছি, সরওয়ার জামাল নিজাম সাপ্তাহিক ২০০০ অফিসে ফোন করে মোর্তোজা ভাইকে বললেন, আপনাদের চট্টগ্রাম প্রতিনিধি কী করে চট্টগ্রামে চলাফেরা করে আমি দেখে নেবো। এবার গোলাম মোর্তোজা বিশেষ প্রতিবেদন লিখলেন। সেখানে তিনি আশংকা প্রকাশ করে বললেন এভাবে প্রকাশ্যে আমাদের প্রতিবেদক কে হুমকি দেবার কারণে আমরা তার নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত।আমার কাজ থেমে থাকে নি। কিছু টি শংকা ছিল সন্তান দের নিয়ে। আমি চেষ্টা করতাম তাদের স্কুলে যাওয়া এড়িয়ে চলতে যাতে তাদের উপর হুমকি না আসে।
২০০৫ সালে তিনটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করি।সৎ সাংবাদিকতা এবং প্রেস ফ্রিডম এর জন্যে বিশ্বের একজন কেই এই পুরস্কার দেয়া হয়। ইনডেক্স গার্ডিয়ান হুগো ইয়ং এ্যাওয়ার্ড। লন্ডনের সিটি হলে ২০০৫ এর ৪ মার্চ আমাকে এই পুরস্কার দেয়া হয়। এর পর ই নিউইয়র্ক থেকে পেলাম ইন্টারন্যাশনাল উইমেন মিডিয়া ফাউন্ডেশন এর আই ডব্লিউ এম এফ ‘ক্যারেজ এ্যাওয়ার্ড’।
কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিষ্ট ' সিপি জে 'এ্যাওয়ার্ড পেয়েছি তার আগেই। কিন্তু পুরস্কার পাওয়ার পর অফিসের কারো কারো আচরণ ভীষণ বৈরি হয়ে গেলো। কাজ করা কঠিন হয়ে গেলো । ‘সিপি জে এ্যাওয়ার্ড’ নিতে অস্বীকার করলাম। কর্তৃপক্ষ কে বললাম ,"তোমরা এই পুরস্কার এর ঘোষণা দিও না। আমাকে কাজ করতে দাও। আমি কখনো কোথাও পুরস্কারের জন্যে আবেদন করিনি। পাঠকের স্বীকৃতি ই আমার পুরস্কার। "
‘আইডব্লিউ এমএফ কারেজ এ্যাওয়ার্ড’ নিতে গেছি যখন, তখন সিপিজে থেকে বিশেষ ভাবে অনুরোধ করে তারা একটি চেক দিয়ে আসে আমাকে। এসব নিয়ে পরে বিস্তারিত লিখবার ইচ্ছে আছে ।
এর আগে ডেমোক্রেসী ওয়াচ থেকে আমার কাছে রিপোর্ট চেয়ে পাঠায়। আমি দিতে অস্বীকার করি। পরে তারা ভীষণভাবে চেপে ধরে মানবাধিকার রিপোর্ট পাঠাতে বলে।সেদিন শেষ সময়। তাড়াহুড়ো করে জামালউদ্দিন অপহরণ মামলায় পুলিশ কাস্টডিতে নিহত ফটিকছড়ির কাশেম চেয়ারম্যানের ক্যাশিয়ার অমর কর (সম্ভবত।নামটা এই মুহুর্তে মনে করতে পারছি না) এর উপর সাপ্তাহিক ২০০০ য়ে প্রকাশিত রিপোর্ট পাঠাই। প্রথম আলো , ভোরের কাগজ সহ সব পত্রিকার বাঘা বাঘা রিপোর্টার তাদের রিপোর্ট পাঠায়। একজন অমর করের উপর প্রকাশিত তার রিপোর্টটি পাঠিয়েছিলো। পরে ডেমোক্রেসী ওয়াচ থেকে ফোন করে জানালেন চট্টগ্রাম বিভাগে 'শ্রেষ্ঠ মানবাধিকার রিপোর্ট এ্যাওয়ার্ড 'আমি পেয়েছি। ঢাকায় এসে এই রিপোর্ট নিতে গিয়ে পরিচয় হলো বিখ্যাত রিপোর্টার গৌরাঙ্গ নন্দীর সাথে। খুলনার শ্রেষ্ঠ রিপোর্টার এর পুরষ্কার পেয়েছেন তিনি। পরে ডেমোক্রেসী ওয়াচের এহসান ভাই ফোন করে বললেন, “ সুমি আপা, আপনি যে কিসের মধ্যে কাজ করছেন, আমরা কিছুটা বুঝতে পারছি।“
আমি একটু অবাক হলাম তার কথা শুনে। বললেন , চট্টগ্রামের রিপোর্টার দের যা বকা আমাদের শুনতে হলো! তারা বলছে, “চট্টগ্রামে সুমি খান ছাড়া আর রিপোর্টার নাই আপনাদের চেনা? মেয়েমানুষ বলেই তাকে পুরস্কার টা দিতে হলো”? এহসান ভাই আরো বললেন তাকে কিভাবে বিব্রত করা হয়েছে আক্রমনাত্মক প্রশ্ন করে এবং ‘মেয়েমানুষ’ কে পুরষ্কার দেবার মনগড়া অভিযোগে দায়ী করে। আমি মনে মনে এতো কষ্ট পেলাম, এতো হতাশ হলাম!
কারো সাথে প্রতিযোগিতায় তো নামিনি। কারো কোন কাজে ও ডিসটার্ব করি নি কখনো। নিভৃতে আমার কাজ আমি করে গেছি। তবু কেন তারা আমার উপর এতো ক্ষুব্ধ? কাজ করার পরিবেশ আবো ভেবে ২০০৬ সালে ঢাকায় চলে আসি পুরোপুরি।২০০৬ এর ডিসেম্বর থেকে একুশে টেলিভিশনের সাথে কাজ শুরু করি সম্ভবত: ২০০৭ এর মার্চর ১৯ তারিখ ১৫ মার্চ এর তারিখে আমাকে এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দিতে বাধ্য হয় এইচ আর প্রধান রুহুল আমিন। এ ধরণের ঘটনা ঢাকায় এসেও বার বার আমাকে আঘাত করেছে। সেসব পরে অন্য কোন দিন বলা যাবে । শুভ কামনা থাকলো সকল সাংবাদিক সহকর্মীর প্রতি।১০.০৩.১৩
(ডিআর ইউর নারী দিবস বিশেষ প্রকাশনা তে প্রকাশিত লেখা)

Sunday, June 30, 2013

ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ অনেক বড়ো বিপর্যয় ঠেকাতে পারে। এসো বন্ধুরা - সুমি খান


ফেসবুকে আমার কমেন্ট , পোষ্ট অনেকের মনে অনেক প্রশ্ন জাগায়। প্রতিক্রিয়া জেনে অন্তত তাই বুঝলাম। কাল বিকেলে একুশে টেলিভিশনের পাশের খুপড়ি চায়ের দোকানে বসে পুরনো কলিগদের সাথে চা খেতে খেতে আমার এক অনুজ নারী সাংবাদিক প্রশ্ন করলো ," আপু , আপনার লেখা -পোষ্ট পড়ে মাঝে মাঝে মনে হয় আপনি আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বলছেন। " অতি বাম রাজনীতির সৈনিক আমার এই অনুজ ।তার রাজনৈতিক দীক্ষায় আওয়ামী বিরোধিতা আর ভারত বিরোধিতা বদ্ধমূল ধারণায় গেঁথে রেখেছে। তার যখন এ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়, আমি তখন একুশে টেলিভিশনের প্রধান প্রতিবেদক। আমার অত্যন্ত প্রিয় এবং স্নেহভাজন এই অনুজ কে বললাম, "দ্যাখো, এমন মনে হতেই পারে । কিন্তু আমার কথা গুলো সত্য এবং বাস্তব! কারণ আমরা তো ভুক্তভোগী! ২০০১ থেকে ২০০৫ যারা সাংবাদিকতায় একনিষ্ঠ ছিল, তারা কাছে থেকে দেখেছে জামাত -বিএনপি মানবতা র কী ভয়ানক বিপর্যয় ডেকে আনে। সাংবাদিক নির্যাতন কাকে বলে ....!!" এ কথা গুলো গেলো তিন বছর আরাম আয়েশে বিএনপি বীট করা এ্ই টিভি সাংবাদিক এর কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় নি। তার চোখে বিএনপি নেতা দের 'নিপীড়ন' নির্যাতন' অনেক বড়ো ব্যাপার। তারা তো মানিক সাহা , হুমায়ুন কবির বালু, গৌতম দাস সহ ১৩ সাংবাদিক হত্যা, মুনতাসীর মামুন , শাহরিয়ার কবির , সালিম সামাদ , পিরোজপুরের মিঠু, বরুন বিশ্বাসকে কী ভয়ংকর নির্যাতন সইতে হয়েছে- শুধু সাংবাদিকতা করার অপরাধে- তার কতোটা অনুমান করতে পারবেন এখনকার শখের সাংবাদিকেরা? শখের সাংবাদিক বলতে বাধ্য হলাম। কারণ এখন পর্দায় মুখ দেখিয়ে তারকা হবার জন্যেই টেলিভিশন সাংবাদিকতায় ছুটে আসেন অনেকে। সেই সময়ে জাইবা মালিক, প্রিসিলা রাজ অথবা আমার মতো নগন্য সাংবাদিক কে ও নির্যাতন , গ্রেফতার এবং হত্যার নিরন্তর হুমকির মুখেই বাঁশখালি, সাতকানিয়া, ফটিকছড়ি , সন্দ্বীপ সহ প্রত্যন্ত এলাকার বিপন্ন মানুষের কাছে ছুটে যেতে হয়েছে। বিএনপির বড়ো ডোনার হয়েও অপহরণ, হত্যার শিকার হয়ে তিনবছর গুম রাখা হয়েছে জামালউদ্দিন কে। বাবর শিকার করেছে বিএনপির সাংসদ সারওয়ার জামাল নিজামের থেকে এজন্যে ৫শ'কোটি টাকা নিয়েছে তারেক জিয়া। জামালউদ্দিনের পরিবার এখনো বিপন্ন । কারণ আওয়ামী লীগ নেতাদের কারো তাগিদ নেই এই খুনি কে গ্রেফতার অথবা বিচারের মুখোমুখি করা! এই ঘটনার বিচার হবার জন্যে অন্তত আবার ওয়ান ইলেভেন আসা দরকার বলেই আমার মনে হয়! জামাতের খুনি শাহজাহান চৌধুরীর হত্যাযজ্ঞের প্রধান সাক্ষীআহমদু, প্রকাশ আহমইদ্যা বিএনপি তে যোগ দেয়ার একবছরের মধ্যেই নব্বই দিন সময় বেঁধে হুমকি দিয়েছিলো শাহজাহান চৌধুরী কে। বলেছিলো -" জামাতের এক গুণ- ধর্মের নামে মানুষ খুন। নব্বই দিন পর হয় শাহজাহান চৌধুরী থাকবে, নয় আমি থাকবো। " তার এ ঘোষণার পর আমার সাথে একান্ত সাক্ষাৎকার দেয় আহমেদুল হক চৌধুরী, প্রকাশ আহমইদ্যা। ক্লাস এইটে পদার সময়ে ফুলকুঁড়ি আসরের মাধ্যমে তাকে কিভাবে ধর্মের দোহাই দিয়ে শিবিরের রাজনীতিতে যুক্ত করা হয়। এবং এর অল্পদিন পরেই শাহজাহান চৌধুরী তাকে অস্ত্র হাতে দিয়ে একের পর এক আওয়ামী রীগের নেতা দের হত্যা করিয়েছে- এর বর্ণনা এবং অকপট স্বীকারোক্তি দিয়েছিলো আহমদু। এই সাক্ষাৎকার প্রকাশ হবার সাথে সাথেই আহমদু কে র‍্যাব এর ক্রসফায়ারের মাদ্যমে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করা হয়। এর পর আমার সাথে সাক্ষাৎকারে র‍্যাব-৭ এর তৎকালীন কমান্ডিং অফিসার কর্ণেল এমদাদ ( পরবর্তীতে বিডিআর বিদ্রোহে নিহত) বলেছিলেন," আপনাকে যে সাক্ষাৎ কার দিয়েছ, তার পর তো তাকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না!" আমার প্রশ্ন ছিল , এই সাক্ষাৎকারের পর আপনাদের সুযোগ ছিল সন্ত্রাসের মূলোৎপাটনের- যদি সত্যি আপনারা সন্ত্রাস দূর করতে চান। আপনারা শাহজাহান চৌধুরী কে কেন ক্রসফায়ারে ফেললেন না- যদি সৎসাহস থাকে? উল্টো তার পথের কাঁটা দূর করলেন? " নীরব হাসি ছাড়া আর কোন জবাব ছিল না কর্ণেল এমদাদ এর।
এসব তো এখনকার সৌখিন সাংবাদিকেরা দ্যাখে নি! কী করে ধারণা করবে তারা বিএনপি জামাতের ভয়ংকর রূপ? আওয়ামী সুবিধাবাদী গোষ্ঠী ও একের পর এক হঠকারী ভূমিকা নিয়ে ক্ষুব্ধ করে তুলছে সাধারণ জনগণকে । তাদের ভালো কাজগুলোর চেয়ে অন্যায় আর অপরাধের চিত্র অদূরদর্শী হনগণের কাছে অগ্রগণ্য।... বিএন পির ক্ষমতায়ন তাই তাদের কাছে স্বপ্নের মতো!
.. বিএনপি ক্ষমতায় এলে যদি এই সাংবাদিকরা বিশেষ ভাবে ক্ষমতায়ন না হয়ে সাধারণ সাংবাদিকের কাতারে থাকে- তাদের এই স্বপ্নের ঘোর কাটতে এক ঘন্টা সময় ও লাগবে না... রক্তের বন্যা বয়ে যাবে দেশ জুড়ে!! দেশের বাম নেতা আর বুদ্ধিজীবি তাত্বিকেরা ২০০১-৫ যেমন ঘরে শুয়ে ঘুমাচ্ছিলেন- রোম পুড়লে নিরো বাঁশি বাজায় যেমন - তেমনি অবস্থানে ছিলেন- একই অবস্থানে আবার ফিরে যাবেন তারা !
আর সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার হবে নিরীহ মানুষ আর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি। যারা ৪০ বছর পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এসে পূর্বপুরুষ আর স্বজনদের নারকীয় হত্যার বর্ণনা দিয়ে সাক্ষী দিয়ে গেছে, তাদের এবার কচু কাটা করা হবে! একাত্তরের ঘাতক হায়েনার দল গারদ থেকে বেরিয়ে অট্টহাস্যে ফেটে পড়বে , রক্তপিপাসু জিভে আবার রক্তের স্বাদ নিতে হামলে পড়বে হিন্দু- বৌদ্ধ আর খৃষ্টান দের বাড়ি-ঘর- মন্দিরে....হ্যাঁ, সাথে তাদের জামাত-বিএনপি - আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগীরা সবাই থাকবে- জমি জিরেতের ব্যাপার- ভোগ দখলের ব্যাপার... ভারত সীমান্তে লক্ষ লক্ষ বিপন্ন মানুষ ভীড় করবে প্রাণ বাঁচাতে.... এর প্রতিক্রিয়ায় ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমান দের হত্যা -নির্যাতন করবে বিজেপি আর নরেন্দ্র মোদীর শিষ্যরা। এর প্রতিক্রিয়া সারা বিশ্বের নানান প্রান্তে ছড়িয়ে পড়বে সহিংসতা !! তাই ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধে উঠে আমাদের একটু সচেতনতা, একটু দূরদর্শীতা আর দায়িত্ববোধ নিয়ে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ অনেক বড়ো বিপর্যয় ঠেকাতে পারে। এসো বন্ধুরা মানবতার জয়গানে সব ধরণের সহিংসতা প্রতিরোধ করি!