Thursday, July 11, 2013

ধর্ষণের পশ্চিমবঙ্গ: বিক্রমজিত ভট্টাচার্য



ভারত সরকারের মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক বলছে, ‘গোটা দেশে ধর্ষণসহ সকল প্রকার নারী নির্যাতনে পশ্চিমবঙ্গ শীর্ষে’।
আর রাজ্যের মহিলা মুখ্যমন্ত্রী বলছেন- ‘সব মিথ্যে কথা, অপপ্রচার’।
পশ্চিমবঙ্গে ‘পরিবর্তনের সরকারের’ এখনও পর্যন্ত ২৬ মাসের মেয়াদে ‘ধর্ষণ’ শব্দটি প্রতিদিন প্রতিটি কাগজ ও নিউজ চ্যানেলে শিরোনাম। খাস কলকাতার পার্ক স্ট্রীট থেকে শুরু করে রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চল-কাটোয়া, গেদে, দিনাজপুর, মুর্শিদাবাদ, কামদুনি-লাগাতার একের পর এক ধর্ষণ। দু’ বছরের শিশুকন্যাও বাদ যাচ্ছে না পৈশাচিক অত্যাচারের হাত থেকে।

বিশৃঙ্খলাবিরোধী নেত্রী থেকে তিনি হয়ে উঠতে পারতেন দায়িত্বশীল মুখ্যমন্ত্রী। রাজনৈতিক উত্তরণ হতে পারত গঠনমূলক ইতিবাচক কর্মকা-ে। সে সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন, দু’ হাত ভরে এই বাংলার মানুষই তাকে সেটা দিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য বাংলার, বিপুল জনরায়কে পুঁজি করে ক্ষমতাসীন হয়েই তার বিখ্যাত স্লোগান ‘পরিবর্তন’ তো দুরস্থান, বর্তমানে হয়ে উঠেছেন নৈরাজ্যের সাক্ষাত প্রতিভু। জনরায়ের সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতার এর চেয়ে বড় উদাহরণ বোধহয় আর কিছু হতে পারে না। আসলে তিনি দলীয় বৃত্তের বাইরে উঠতেই পারলেন না, আর সেই দলীয় বৃত্তটাও ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে চলেছে; কারণ, তাকে কেউ কোনও প্রশ্ন করলেই সেই প্রশ্নকর্তার গাঁয়ে লেগে যাচ্ছে ‘মাওবাদী’ বা ‘সিপিএম’-এর তকমা। তার দলকে ভোট দেয়া মানুষেরাও অবাক হয়ে যাচ্ছেন। কামদুনি যার সর্বশেষ উদাহরণ মুখ্যমন্ত্রীর মূল্যায়নে যে কামদুনি পাশবিক অত্যাচার ও জ্যান্তব উল্লাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের পথপ্রদর্শক হতে পারত তার বিচারে সেই কামদুনিই হয়ে গেল চক্রান্তকারী, তাকে হত্যার ষড়যন্ত্রকারী। দু’ বছর ধরে একই কায়দায় দলীয় বাহিনীর একের পর এক অপকর্মগুলোকে লঘু কিংবা আড়াল করে চলেছেন মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীÑ ‘ছোট ঘটনা, সাজানো ঘটনা, তুচ্ছ ঘটনা’।
তথ্য বলছে, রাজ্যজুড়ে বেশিরভাগ ধর্ষণের অভিযুক্তও সরকারী দলের।
কোন প্রশাসন, কোন বিচার ব্যবস্থা এই সমস্যা সমাধানে উল্লেখযোগ্য ও বাঞ্ছনীয় কোন পদক্ষেপ নিতে পারছে না বা নিতে চাইছে না। আজ বাংলায় শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক মহিলা, গৃহবধূ, কিশোরী ও যুবতী, হোমে বাস করা অন্ধ মহিলা, মানসিক ভারসাম্যহীন নারী সকলেই বিকৃত লালসার শিকার হচ্ছেন। এই বিকৃতি সামাজিক অবক্ষয়কেই তুলে ধরছে আর এই অবক্ষয়কে যারা মদত দিচ্ছে তারা মানুষের শত্রু এবং সভ্যতার কলঙ্ক।
বসিরহাটের মেয়ে। বয়স ৩৭ বছর। প্রতিদিন লোকাল ট্রেনে চেপে দমদম আসেন একটি বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করতে, দৈনিক আয় ১২০ টাকা। ধর্ষিত হন। কোর্টে মামলা চালাবার মতো টাকা নেই, এরা যাবেন কোথায়? সরকারী উদাসীনতা এদের নিমজ্জিত করছে অন্ধকার চোরাবালিতে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো বলছে, পশ্চিমবঙ্গে এই মুহূর্তে মোট ২৯১১৩টি নারী নিগ্রহের মামলা ঝুলছে, যার মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ২০ শতাংশ। কেন্দ্রীয় তথ্য অনুযায়ী প্রতি ২৫ মিনিটে একটি করে নারী নিগ্রহের ঘটনা ঘটে পশ্চিম বাংলায়।
ধর্ষণের প্রতিক্রিয়া শুধু শরীরে নয়, মননে সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। একজন ধর্ষিত মহিলাকে সমাজ আজও সঠিকভাবে গ্রহণ করে না। দেশের আইন বলছে একজন ধর্ষণকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি ৭ থেকে ১০ বছর, কিন্তু ধর্ষিতার মানসিক পীড়ন সারাজীবনের। বাংলার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্ণধার অনুরাধা কাপুর বলছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে এখন মধ্যযুগীয় ব্যবস্থা ফিরে এসেছে। সারা ভারতকে অনেক পিছনে ফেলে ক্রমশ এগিয়ে চলেছে পশ্চিমবঙ্গ’।
মানুষ সামাজিক জীব। এই সমাজ আক্ষরিক অর্থেই রাজনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। প্রত্যেকের রুচিবোধ, দর্শন, ক্রিয়াকলাপ, চিন্তন, মনন, দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক এমনকি ব্যক্তিগত অভ্যাসও গড়ে ওঠার পিছনে রাজনীতির একটি বিশেষ ভূমিকা থাকে। ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যাধি, ফলে ধর্ষণকে রাজনীতির বাইরে দেখার প্রশ্নই ওঠে না। অবাধ উদারীকরণের যুগে আজ সমস্ত কিছুই পণ্য- মাধুরী দীক্ষিতের হাসি থেকে রাহুল দ্রাবিড়ের কভার ড্রাইভ সব কিছুই আজ বিক্রি হয়। ছোটবেলা থেকেই আমরা দেখি যৌনতা একটি রসময় পণ্য। যার দাম নিয়ন্ত্রণ করে পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজ।
কামদুনিতে ২১ বছরের কলেজপড়ুয়া অপরাজিতাকে নির্মমভাবে গণধর্ষণ করে খুন করে ফেলে দেয়া হলো। গ্রামবাসী এবং মিডিয়ার চাপে পড়ে পুলিশ বাধ্য হলো অপরাধীদের ধরতে কিন্তু অপরাধীরা সরকারী দলের, ফলে সেই মুখ্যমন্ত্রীকেই আসরে নামতে হলো ঘটনাটিকে লঘু করে দেখাবার জন্য। কামদুনিতে গেলেও গ্রামের মহিলারা তার সাথে কথা বলতে চাইলেন, অভিযোগ জানাতে চাইলেন যেহেতু তিনি রাজ্যের অভিভাবক, এর ফল হলো উল্টো। মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী সবাইকে বললেন, ‘চোপ’, এসব প্রতিবাদ মাওবাদী আরসিপিএমের সংগঠিত, আগে থেকে ঠিক করা। সারা রাজ্য স্তম্ভিত সেদিনের ঘটনায়। কবি শঙ্খ ঘোষের মতো বুদ্ধিজীবীও কলকাতার রাজপথে মিছিলে নামলেন আইনশৃঙ্খলার অবনতির বিরুদ্ধে, তবু হুঁশ ফিরছে না সরকারের। আসলে শক্তিশালী রাষ্ট্র শক্তি প্রতিবাদের স্থায়িত্ব, ধারাবাহিকতা ও গভীরতা নিয়ে অত্যন্ত সচেতন, নিশ্চিত ও নিশ্চিন্ত। তাই কোন বার নতুন আইনের দোহাই, কোন বার ধর্ষিতাকে ক্ষতিপূরণের দর বেঁধে দিয়ে তারা সুপরিকল্পিতভাবেই শান্ত করে দিচ্ছে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ, আক্রোশকে। কিন্তু বারবার একই রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে মানুষও বুঝতে পারছে সংগঠিত কঠিন একটানা প্রতিবাদ ছাড়া সঠিক বিচার হবে না। কামদুনিই দিশা দেখাচ্ছে সেই নতুন পথের, তাই সরকারও এবার বেকায়দায়।
২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে প্রথম একজন মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন- এটি যেমন একটি রেকর্ড তেমনি আবার দেশের মহিলাদের ওপর নথিভুক্ত অপরাধের ২০ শতাংশ হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে - এটিও একটি সর্বকালীন রেকর্ড।
আসলেই গণতান্ত্রিক দেশে ধর্ষণটাকেও এখন ‘গণতান্ত্রিক অধিকারের’ একটা অঙ্গ ভেবে বসেছে অপরাধীরা, এ ক্ষেত্রে দরকার কড়া আইন এবং তাৎক্ষণিক প্রশাসনিক কঠোর পদক্ষেপ, কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে একদমই নির্লিপ্ত, আইনের রক্ষকরাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপরাধীদের ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন, ফলে বাংলার খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের জোটবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ ছাড়া আর পথ নেই।
লেখক : পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিক, বৃহস্পতিবার, ১১ জুলাই ২০১৩, ২৭ আষাঢ় ১৪২০
Courtesy: Daily Janakantha

No comments:

Post a Comment