Thursday, July 11, 2013

কোটার গৌরব, মেধার অনুজ্জ্বল নীরবতা আর শিক্ষার ব্যর্থতা


মোঃ আবদুস সালাম
একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মূল দর্শন যাই হোক না কেন, অন্তত এ কথাটি জোর দিয়ে বলা যেতে পারে যে, শিক্ষা সমাপনান্তে প্রতিটি শিক্ষার্থী রাষ্ট্রের উৎপাদনশীল প্রক্রিয়ার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে। রাষ্ট্র তার নাগরিকের যার যার অর্জিত ফলাফল ও মেধা অনুসারে তাঁর উপযুুক্ত কর্মজগতে (ড়িৎষফ ড়ভ ড়িৎশ) প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি করবে। অর্থাৎ একটি রাষ্ট্রের নৈতিক ও সাংবিধানিক দায়িত্ব হলো তার ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে বসবাসকারী বৈধ নাগরিককে যথোপযুক্ত কর্মজগতে প্রবেশের অধিকার নিশ্চিত করা। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখেই বাংলাদেশের সংবিধান এ বিষয়টি পরিষ্কারভাবে নির্দেশনা দিয়েছে যে, রাষ্ট্র যদি প্রয়োজনবোধ করে তাহলে কোন বিশেষ অনগ্রসর কিংবা পিছিয়ে পড়া শ্রেণী বা গোষ্ঠীকে অন্যদের সমতুল্য করার প্রয়োজনে শিক্ষা থেকে শুরু করে চাকরি পর্যন্ত তাদেরকে বিশেষ সুবিধার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারে। কিন্তু প্রশ্নটি হলো, এ সুবিধাবঞ্চিত পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী কারা, তাদের বিশেষ সুবিধা প্রদানের পরিসংখ্যানিক হারই বা কত হবে তা নির্ধারণ করবে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র প্রয়োজনবোধ করলে এ বিশেষ সুবিধা প্রদানের বিষয়টি যে কোন মুহূর্তে, পরিবর্তন, পরিমার্জন কিংবা পরিবর্ধন করতে পারে।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বোচ্চ ক্যাডারভিত্তিক কর্মকর্তা নিয়োগদানের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন পর্যন্ত এই সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থাটি বিরাজমান-তাতে আমাদের বিশেষ কোন আপত্তি নেই, কিন্তু কতিপয় অনুযোগ রয়েছে যা নিয়ে কিছু আলোকপাতের অতীব প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে ৬০% নারী শিক্ষক নিয়োগের সুবিধায়ন প্রক্রিয়ার বিষয়টি যদিও বা গ্রহণযোগ্য, কিন্তু প্রশ্নটি হলো: যোগ্যতা ও মেধার ফারাকের বিষয়টি একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। উল্লেখ্য যে, একজন নারী যদি মাধ্যমিক সনদ অর্জন করতে সক্ষম হন, তাহলেই তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের যোগ্যতা অর্জন করেন। ভাবার কোন কারণ নেই যে, আমি নারীবিদ্বেষী। বিষয়টি হলো পুরুষের ক্ষেত্রে সেটি কেন স্নাতক সনদের অধিকারী হতে হবে?
যৌক্তিকতা হলো যোগ্যতা ও মেধার সমতা থাকা সাপেক্ষে রাষ্ট্রের চিহ্নিত বিশেষ সুবিধায়ন শ্রেণী বা গোষ্ঠীকে পরিসংখ্যানিক নির্ধারিত হারে (১% থেকে ১০০%) সুবিধা প্রদানই কি যথেষ্ট নয়? এক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ- সেটি হলো: প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতার জন্য নারীরা সর্বোত্তম ভূমিকা পালন করতে পারেন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তাছাড়া আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে এরা সংস্কৃতিগতভাবে (পঁষঃঁৎধষু) নানা কারণে বঞ্চিত, নির্যাতিত এবং পিছিয়ে পড়া। সুতরাং তাদেরকে বিশেষ সুবিধা প্রদানে কোন আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু মেধা ও যোগ্যতার বিষয়টি বিবেচনায় না আনার কারণে দেশের প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান নানা প্রশ্নের মুখোমুখি।
যোগ্যতা ও মেধার বিষয়ে রাষ্ট্রের কোনভাবেই আপোস করা যুক্তিসঙ্গত হবে না। এছাড়া আনসার-ভিডিপিসহ অন্যান্য সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণীর কথা না হয় নাই-ই বললাম। মেধার এই নীরব অবনমনের অধিকার রাষ্ট্রের নেই।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি যদিও বা আপোসযোগ্য, কিন্তু প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা নিয়োগের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের অতিমাত্রায় সর্তক দৃষ্টি প্রদান করা জরুরী। যারা ক্যাডারভুক্ত বা নন-ক্যাডারভুক্ত এই পদগুলোতে যোগদান করবেন, মনে রাখতে হবে তারা প্রজাতন্ত্রের সরাসরি অংশ। রাষ্ট্র পরিচালনায় এদের মেধার তীক্ষèতা, দক্ষতা ও নিরপেক্ষতার ওপরে নির্ভর করবে ঐ রাষ্ট্র কতটা দক্ষ, নিরপেক্ষ ও উন্নত হবে। সুতরাং সঙ্গতকারণে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, অতি সম্প্রতি বাংলাদেশে প্রচলিত ক্যাডারভিত্তিক বা নন-ক্যাডারভুক্ত নিয়োগের সুবিধায়ন প্রক্রিয়ার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। এ বিষয়ে আমি কয়েকটি দিকের প্রতি আলোকপাত করতে সচেষ্ট হব।

॥ এক ॥
বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের কোনভাবেই যোগ্যতা ও মেধার বিষয়টিতে ছাড় দেয়া পুরোপুরিভাবে উচিত হবে না। সাংবিধানিকভাবে বর্ণিত সুবিধা প্রদান প্রক্রিয়া অনুসরণ করা যেতে পারে, তবে যোগ্যতা ও মেধার নীরব হত্যার মাধ্যমে নয়। এটি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্য বুমেরাং হবে।

॥ দুই ॥
বলা বাহুল্য, সুবিধা প্রদান বিধিমালা অনুযায়ী, ৫৬% (জেলা, উপজাতি, নারী, মুক্তিযোদ্ধা ও প্রতিবন্ধী) নিয়োগপ্রাপ্তরা পড়ে যায় নানা সুবিধায় সুবিধায়ন বিশেষ শ্রেণীভুক্তির কাতারে। অর্ধেকেরও কম (৪৪%) প্রার্থী বিবেচিত হয় মেধার বিবেচনায়। তাতে রাষ্ট্রের বহুসংখ্যক যোগ্যতা ও মেধাসম্পন্ন ছেলেমেয়েরা শামিল হয় বেকারত্বের কাতারে। এটা কি ভেবে দেখা রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয় যে, আমার জনগোষ্ঠীর উৎকৃষ্ট ও মেধাবী শ্রেণীর বর্তমান ও ভবিষ্যত কী হবে? একই সাথে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে কার যাওয়ার কথা আর কে যাচ্ছে; তাতে রাষ্ট্রের কী পরিমাণ লাভ কিংবা ক্ষতি হচ্ছে তার দায়ভার দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ওপরই বর্তায়।

॥ তিন ॥
কোটা নিয়ে আমার কোন আপত্তি নেই কিন্তু অনুযোগটি হলো, তার হারের পরিমাণ নিয়ে। মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে উদীয়মান অধিকাংশ মেধাবী তরুণ-তরুণীর দূর লক্ষ্য হলো একটি ক্যাডারভুক্ত চাকরিপ্রাপ্তির অভিপ্রায় পূর্ণ করা। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্র যদি সুযোগটি অতিমাত্রায় সীমাবদ্ধ কিংবা বন্ধ করে দেয়, তবে দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া তেমন কিছুই বলার থাকে না। তবুও বলতে বাধ্য হচ্ছি, যে কোন প্রক্রিয়াই হোক না কেন মেধার বিষয়টি সর্বাধিক বিবেচনায় রেখে বিশেষ সুবিধায়ন প্রক্রিয়ার পর্যালোচনা অপরিহার্য। না হলে আমাদের ক্ষতি হবে অনেক বেশি।
প্রথমত, মেধাবীরা গোড়া থেকেই শিক্ষার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। ফলে শিক্ষা ব্যবস্থার দৈন্যদশা আরও প্রকট হয়ে উঠবে। তাছাড়া, এ সমস্ত মেধাবী তরুণ-তরুণী হতাশগ্রস্ত হয়ে রাষ্ট্রের সমস্যাসঙ্কুল নাগরিকে পরিণত হবে নতুবা মেধা পাচার প্রক্রিয়ার শিকার হতে তারা বাধ্য হবে। তাতে রাষ্ট্রের ক্ষতি হবে।
দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন অর্গানের দক্ষতা, তীক্ষèতা ধীরে ধীরে দুর্বল হতে বাধ্য হবে। মেধা যাচাইয়ের শুরুতেই (প্রিলিমিনারি) বিশেষ সুবিধায়ন প্রক্রিয়ার প্রয়োগ আরও ভয়ঙ্কর। কেননা, মেধা যাচাইয়ের প্রতিটি পর্যায়ে সমহারে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ ও সফলকাম হওয়ার প্রেক্ষিতে চূড়ান্ত পর্যায়ে সুবিধাভোগীদের প্রাধান্য দিলেও হয়ত কিছুটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে। তবে কোনভাবেই প্রচলিত ব্যাপক ব্যবধানের ‘মেধাবীদের’ সুবিধার নামে প্রজাতন্ত্র পরিচালনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার যুক্তিসঙ্গত কোন কারণ আছে বলে মনে করি না।
তৃতীয়ত, রাষ্ট্র তার প্রয়োজনে বিশেষ শ্রেণী বা সম্প্রদায়কে চাকরি থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ে সুবিধা প্রদান করতে পারে। কিন্তু সুবিধা প্রদানের পরিসংখ্যানিক হার কোনভাবেই ১%-৫% ওপরে হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। এতে রাজনৈতিক সুবিধাবাদীদের প্রবেশের সুযোগও কমে আসবে। তখন রাষ্ট্র যারাই পরিচালনা করুক না কেন তাদের ঘাড়ে দোষের বোঝা কম আসবে। কিন্তু বর্তমান প্রচলিত ব্যাপক হারে সুবিধায়ন প্রক্রিয়া মেধাবীদের জন্য মনোযন্ত্রণার কারণ হতে বাধ্য-তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাছাড়া প্রজাতন্ত্রে ‘মেধা ব্যতীত’ যে প্রক্রিয়ার অবতারণায় করা হোক না কেন তাতে রাষ্ট্রের ক্ষতি বৈ লাভ হবার কোন সম্ভাবনা নেই। সুতরাং পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব তার সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে চিন্তা করে অগ্রসর হওয়াই প্রজ্ঞাবানদের জন্য যৌক্তিক হবে।
পরিশেষে একটি কথাই শুধু নিবেদন করি, স্বাধীনতার ৪২ বছর গেছে ধুঁকে ধুঁকে। এখন সময় এসেছে নতুন প্রজন্মের দিকে তাকানোর নতুবা আরও কয়েকটি দশক সময় ‘কালের ইতিহাসে’ মিশে যাবে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র কথিত উন্নয়নশীল দেশ হিসেবেই পরিগণিত হবে। সুতরাং বিবেচনা করুন প্রজ্ঞার সাথে, ভেবে দেখুন সময় থাকতে, তা না হলে আমরাই দায়ী থাকব ওদের কাছে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক,
শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট,
একাডেমিক কাউন্সিল সদস্য
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
e-mail: m_a_salambd@yahoo.com
Courtesy: Daily Janakantha



No comments:

Post a Comment