Thursday, November 6, 2014

যুদ্ধাপরাধের বিচার নিজামীর জন্য পাকিস্তানের আহাজারি- মশিউল আলম


বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীকে ১৯৭১ সালে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন। এই সংবাদে বেশ বিচলিত হয়েছেন পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নিসার আলি খান। তিনি এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সরকার জামায়াতে ইসলামীর নেতার বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়ার অপপ্রয়োগ ঘটিয়েছে, আইনকে ব্যবহার করেছে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে।...বাংলাদেশে যা ঘটছে তা যদিও দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়, তবু ১৯৭১ ও তার পরবর্তী ঘটনাবলি-সংক্রান্ত বিষয়গুলো থেকে পাকিস্তান দূরে সরে থাকতে পারে না। সেই দুঃখজনক ঘটনাবলির প্রায় ৪৫ বছর পরেও বাংলাদেশ সরকার অতীতেই বাস করছে এবং সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ‘‘ক্ষমা করো এবং ভুলে যাও” নীতিটি সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করছে বলে মনে হচ্ছে।...বাংলাদেশ সরকার কেন অতীতের কবর খুঁড়ে পুরোনো ক্ষতগুলো উন্মোচনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে তা বোধগম্য নয়।’
ইন্টারনেটসূত্রে দেখেছি, পাকিস্তানের ইংরেজি সংবাদপত্রগুলোতে নিসারের বিবৃতির খবরটি গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে। ডেইলি টাইমস নিসারের বিবৃতিকে ‘কঠোর ভাষা’য় লেখা বলে মন্তব্য করে বলেছে, পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বিবৃতি দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের নীতির সঙ্গে প্রবলভাবে বিরোধাত্মক। নিসারের আগে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তরের এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, ‘আমরা অন্যান্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করি না, তবে (বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের) বিচারপ্রক্রিয়া সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মন্তব্য ও খবরাখবর আমাদের নজরে এসেছে।’ পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তরের অবস্থানের সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের এই ‘স্টার্ক কন্ট্রাডিকশন’কে ডেইলি টাইমস ‘ইন্টারেস্টিং’ বলে উল্লেখ করেছে। পররাষ্ট্র দপ্তরের এক কর্মকর্তা নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি টাইমসকে বলেছেন, ‘পররাষ্ট্র দপ্তর কূটনৈতিক রীতিনীতি অনুসরণ করছে, আর স্বরাষ্ট্র দপ্তর কঠোর অবস্থান নিয়েছে পাকিস্তানের পাবলিক সেন্টিমেন্টের প্রতিফলন ঘটাতে; সমীকরণটা ভারসাম্যপূর্ণ।’
অর্থাৎ পররাষ্ট্র দপ্তরের ওই কর্মকর্তা বলতে চেয়েছেন, পাকিস্তানের জনসাধারণ বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের প্রতি সহানুভূতিশীল, এটাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ‘পাবলিক সেন্টিমেন্ট’। তাহলে কি ব্যাপারটা এই যে নওয়াজ শরিফের সরকার আসলে চাইছে পাকিস্তানের জনগণকে খুশি করতে, যে জনগণ বাংলাদেশের জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে একটার পর একটা ফাঁসির রায় ঘোষণার খবরে আহাজারি করছে আর ভাবছে তাদের সরকার কেন বাংলাদেশ সরকারের এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাচ্ছে না? আসলেই বিষয়টা এ রকম?
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের বাঙালি সহযোগীরা নয় মাস ধরে আমাদের এই অংশে যে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, দেশটির পশ্চিম অংশের জনসাধারণ তা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতে পেত না—এই কথা আমাকে নিজ মুখে বলেছিলেন পাকিস্তানের বর্ষীয়ান সাংবাদিক আই এ রেহমান। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে যেসব পাকিস্তানি নাগরিকের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ও আলাপ হয়েছে, তাঁদের মুখেও শুনেছি একই ধরনের কথা। পাকিস্তানের স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে ১৯৭১ সালের ঘটনাবলির ইতিহাস-বিকৃতির খবর দেশটির বিভিন্ন সংবাদপত্রেও কখনো কখনো দেখেছি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে পাকিস্তানের সরকারি ভাষ্যে বর্ণনা করা হয় দেশ ভাঙার ঘটনা হিসেবে, যা ঘটিয়েছে পাকিস্তানের জানে-দুশমন ভারত ও তার বাঙালি চরেরা। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধারণা ও অভিমত সম্ভবত এ রকমই। আজ যখন বাংলাদেশে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর বড় নেতাদের বিচার ও দণ্ড হচ্ছে, তখন পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষই হয়তো দুঃখ পাচ্ছে এই কথা ভেবে যে, যে মানুষগুলো প্রিয় পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করতে চেয়েছিলেন, তাঁদের অন্যায়ভাবে ফাঁসি কিংবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হচ্ছে।
কিন্তু এমন মানুষ কি পাকিস্তানে একদমই নেই, যারা জানে এবং মনে করে যে ১৯৭১ সালে অবৈধ সামরিক স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খানের সামরিক বাহিনী ও তাদের বাঙালি সহযোগীরা পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার নামে বাংলাদেশে ভয়াবহ গণহত্যা চালিয়েছিল, যার বিচার হওয়া উচিত? মানবতার বিরুদ্ধে এত ব্যাপক মাত্রার অপরাধকে একটা দেশের সমগ্র জনগণ কীভাবে জায়েজ বলে মনে করতে পারে?
পাকিস্তানের পত্রপত্রিকার অনলাইন সংস্করণগুলোতে সাধারণ পাঠকদের মন্তব্য-প্রতিক্রিয়া পড়ে এ বিষয়ে ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। দেখলাম, এক্সপ্রেস ট্রিবিউনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিসারের বিবৃতিটির খবরের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকাশিত হয়েছে ৩৪টি মন্তব্য। তাঁদের অধিকাংশই যে পাকিস্তানি, তা মন্তব্যগুলো পড়ে বোঝা যায়। ভারতীয় কেউ কেউও থাকতে পারেন। তবে নিশ্চিতভাবেই পাকিস্তানি কয়েকজন পাঠকের মন্তব্য এখানে উল্লেখ করা যাক। আহমেদ নামে এক পাঠক লিখেছেন, ‘পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়াদির মন্ত্রী কেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সমালোচনামূলক মন্তব্য করছেন? এই ধরনের ‘আনপ্রফেশনাল কনডাক্ট’ দেখাতে পারে পিটিআই (ইমরান খানের দল) বা পিএটি (তাহির উল কাদরির দল), বা পাগলাগারদের কোনো বাসিন্দা। পিএমএলএনএর উচিত (ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ-নওয়াজ) প্রথম সুযোগেই এই লোককে বের করে দেওয়া।’ আনিস আকিল নামে এক পাঠক লিখেছেন: ‘রাবিশ, বাংলাদেশ একটা স্বাধীন দেশ, তারা নিজেদের ব্যাপারে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভাঙার জন্য যারা দায়ী, সেই ক্রিমিনালদের বিচার করার সাহস ও নৈতিক শক্তি যদি আমাদের না থাকে, তাহলে আমাদের অন্তত মুখ বন্ধ করে থাকা উচিত। মেজরিটি অব পাকিস্তানিজ অ্যাডোর দ্য কারেজ অ্যান্ড গাটস অব আওয়ার বেঙ্গালি ব্রেদরেন।’ কেকেএসআর নামে এক পাঠক লিখেছেন: ‘একজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কথা বলছেন একজন দণ্ডিত অপরাধীর পক্ষে!’ মির্জা নামের এক পাঠক লিখেছেন, ‘নিসার একজন গ্লোবাল রাইট-উইং টাউটের আচরণ করছেন, পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা আরও বাড়ানোর অপরাধে তাঁকে বরখাস্ত করা উচিত। তিনি নির্লজ্জভাবে আমাদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ককে আঘাত করছেন এবং অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাচ্ছেন। কামরান নামে এক পাঠকের মন্তব্য: ‘জামায়াতে ইসলামীর আমিরের পক্ষে অন্ধভাবে সমর্থন জানানোর আগে চৌধুরী নিসারের উচিত তাঁর অপরাধগুলোর দিকে তাকানো। তিনি হত্যা ও ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত। নিসার তাঁকে সমর্থন করছেন শুধু এই কারণে যে তিনি জামায়াতের প্রধান।’ করাচি ওয়ালি নামে এক পাঠক লিখেছেন: ‘আমি মনে করি, বাংলাদেশ অত্যন্ত সঠিক ও অতিপ্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত, এর মধ্য দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়।’ সোহেল পীরজাদা লিখেছেন: ‘জানি না, গায়ে পড়ে এ রকম বিবৃতি দিয়ে চৌধুরী নিসার কী হাসিল করতে চান। বাংলাদেশ যা করছে, তা করতে সাহস লাগে। এটা প্রশংসনীয়।’
এ রকম আরও অনেক মন্তব্য আছে। জায়গার অভাবে এখানে আর উদ্ধৃত করা সম্ভব নয়। কিন্তু এই কটি মন্তব্য থেকেই তো ধারণা পাওয়া গেল যে পাকিস্তানের জনসাধারণের মধ্যেও এমন নৈতিক অবস্থান অনুপস্থিত নয় যে একাত্তরে যাঁরা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছিলেন, তাঁদের বিচার ও শাস্তি হওয়া উচিত। পাকিস্তানি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের সরকারকে যেভাবে ‘ক্ষমা করো এবং ভুলে যাও’ নীতিটা স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন, কয়েকজন পাঠক সেটারও কড়া সমালোচনা করেছেন। সংখ্যায় কম হলেও আমাদের দেশেও কিছু মানুষ আছে, যারা মনে করে স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরে কেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে গিয়ে জাতিকে বিভক্ত করা হচ্ছে? কেন অতীতের কথা ভুলে গিয়ে সবাই মিলেমিশে এক হতে পারছি না? কেন ক্ষমা করা ও ভুলে যাওয়া হচ্ছে না? চৌধুরী নিসারের মতো যাঁরা ‘ফরগিভ অ্যান্ড ফরগেট’ নীতির কথা বলছেন, তাঁরা বুঝতে পারছেন না যে ক্ষমা করার প্রশ্ন ওঠে তখনই, যখন অতীতের অপরাধ ও ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়া হয়। পাকিস্তান তো বটেই বাংলাদেশেও জামায়াতের নেতারা কখনো ক্ষমা চাওয়া দূরের কথা, স্বীকারই করেননি যে একাত্তরে তাঁরা কোনো ভুল বা অন্যায় করেছিলেন। তাঁদের বিচার ও দণ্ড কার্যকর করার মধ্য দিয়েই অতীতের হিসাব মেটাতে হবে।
মশিউল আলম: সাংবাদিক
mashiul.alam@gmail.com

No comments:

Post a Comment