Sunday, November 2, 2014

বদর কমান্ডার মীর কাসেমের প্রাণদণ্ড

যুদ্ধাপরাধে জামায়াত আমির মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ডের রায়ের তিন দিন পর বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দলটির টানা হরতালের হুমকির মধ্যেই এ রায় এলো।
ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও ১৯৮৫ সাল থেকে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ অর্থাৎ মজলিসে শুরার এই সদস্যের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, অপহরণ, নির্যাতনের ১৪টি অভিযোগের মধ্যে আটটি সন্দেহাতীতভাবে ও দুটি আংশিক প্রমাণিত হয়েছে।
আংশিক প্রমাণিত দুটি অভিযোগে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিমসহ আটজনকে হত্যার দায়ে তাকে  মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে ১১ নম্বর অভিযোগে তিন বিচারক সর্বসম্মত প্রাণদণ্ডের রায় দিলেও ১২ নম্বর অভিযোগে ফাঁসির সিদ্ধান্ত হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে। 
মীর কাসেমের বিরুদ্ধে আটজনকে হত্যার অভিযোগ তোলে রাষ্ট্রপক্ষ। তাঁর বিরুদ্ধে ১১ নম্বর অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালে পবিত্র ঈদুল ফিতরের পর যেকোনো দিন মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে চট্টগ্রাম শহরের অজ্ঞাত স্থান থেকে অপহরণ করে আলবদর সদস্যরা। পরে মীর কাসেমের নির্দেশে জসিমকে ডালিম হোটেলে নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে নির্যাতন ও ২৮ নভেম্বর হত্যা করা হয়। পরে সেখানে নির্যাতনে নিহত আরও পাঁচজনের সঙ্গে জসিমের লাশ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। প্রমাণিত হওয়ায় সর্বসম্মত মতে এই অভিযোগে মীর কাসেমকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। ১২ নম্বর অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরের নভেম্বরে মীর কাসেমের নির্দেশে আলবদর সদস্যরা চট্টগ্রামের হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা হাজারী গলির বাসা থেকে রঞ্জিত দাস ও টুন্টু সেনকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়। পরে তাঁদের হত্যা করে লাশ গুম করা হয়। এ ছাড়া পাকিস্তানি সেনা ও সহযোগী রাজাকার-আলবদররা হাজারী গলির ২৫০ থেকে ৩০০ দোকান লুট ও অগ্নিসংযোগ করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে এই অভিযোগে মীর কাসেমকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত আটটি অভিযোগে অপহরণ ও আটকে রেখে নির্যাতনের দায়ের মীর কাসেমকে সব মিলিয়ে ৭২ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।
ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ৩৫১ পৃষ্ঠার রায়ের ১১ পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্তসার পড়ার সময় হালকা আকাশি শার্ট ও ঘিয়ে কোট পরিহিত মীর কাসেমকে শুরুতে কাঠগড়ায় বসে দৃশ্যত ফুরফুরে মেজাজে হাঁটুর ওপর আঙুল নাচাতে দেখা গেলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার চেহারায় উদ্বেগ বাড়তে থাকে।
ফাঁসির সাজা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে তিনি বলে ওঠেন, “শয়তান.. শয়তান..।“মিথ্যা ঘটনা... মিথ্যা সাক্ষ্য... কালো আইন... ফরমায়েশি রায়। সত্যের বিজয় হবে শিঘ্রই... শিঘ্রই।”
প্রসিকিউশন ৬২ বছর বয়সী মীর কাসেমকে আখ্যায়িত করেছে পাকিস্তানের খান সেনাদের সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত হওয়া ‘বাঙালি খান’ হিসাবে, যিনি সে সময় জামায়াতের তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতায় ছাত্রসংঘের বাছাই করা সদস্যদের নিয়ে গঠিত সশস্ত্র আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের কমান্ডার হিসেবে মীর কাসেম যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটান, তা উঠে এসেছে এই রায়ে।
জামায়াত আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের পর মীর কাসেম ছিলেন আলবদর বাহিনীর তৃতীয় প্রধান ব্যক্তি। ব্যাপক যুদ্ধাপরাধে অংশ নেওয়া আলবদর বাহিনীর কেন্দ্রীয় কমান্ডার ছিলেন তিনি। একাত্তরে তার নির্দেশেই চট্টগ্রাম টেলিগ্রাফ অফিস সংলগ্ন এলাকায় হিন্দু মালিকানাধীন মহামায়া ভবন দখল করে নাম দেওয়া হয় ডালিম হোটেল। সেখানে গড়ে তোলা হয় বদর বাহিনী চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঘাঁটি এবং বন্দিশিবির। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় সেখানে অসংখ্য মানুষকে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়, যাদের লাশ পরে ফেলে দেওয়া হতো চাক্তাই চামড়ার গুদাম সংলগ্ন কর্ণফুলী নদীতে।রায় ঘোষণার পর ট্রাইব্যুনালের বাইরে অপেক্ষমাণ মুক্তিযোদ্ধা, রাজধানীর শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আহ্বানে উপস্থিত জনতা এবং চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাধারণ মানুষ উল্লাস প্রকাশ করে। কোথাও কোথাও আনন্দ মিছিলও হয়।
একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০১২ সালের ১৭ জুন গ্রেপ্তার করার পর ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে মীর কাসেমকে কারাগারে পাঠানো হয়।
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন গতবছর ১৬ মে মীর কাসেমের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে। গতবছরের ৫ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মির কাসেমের যুদ্ধাপরাধের বিচার।
এরপর মামলাটি ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ট্রাইব্যুনাল-২ এ স্থানান্তর করা হয় এবং সেখানেই ১৮ নভেম্বর প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সীমন ও রেজিয়া সুলতানা চমনের সূচনা বক্তব্যের (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) মধ্য দিয়ে শুরু হয় শুনানি। গত বছরের ১১ ডিসেম্বর থেকে এবছরের ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন তদন্ত কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলামসহ মোট ২৪ জন। এরপর ২১ ও ২২ এপ্রিল মীর কাসেম আলীর পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দেন তার ছোট বোন মমতাজ নুরুদ্দিনসহ তিনজন।সাক্ষ্য-জেরা এবং দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে চলতি বছর মে মাসে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয়।  


মীর কাসেমের যুদ্ধাপরাধ

No comments:

Post a Comment