Monday, November 3, 2014

ফাঁসির রায়ের পরও মীর কাশেমের ঔদ্ধত্য-সুমি খান

সোমবার, ৩ নভেম্বর ২০১৪, ১৯ কার্তিক ১৪২১

                ঠাট্টা তামাশার মেজাজে কাঠগড়ায় উঠলেন ঘাতক মীর কাশেম। রায় ঘোষণার মুহূর্তে সেই চনমনে মেজাজের চোখ ঠাণ্ডা খুনীর চোখে পরিণত হলো। বেলা দশটা ৪২ মিনিট। বেশ ফুরফুরে মেজাজে কাঠগড়ায় উঠেছেন নীল শার্ট ও অফ হোয়াইট কোট, কালো প্যান্ট কালো জুতো পরা বেশ স্যুটেড ব্যুটেড মীর কাশেম। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তাঁর সিকিউরিটিতে থাকা ধানমণ্ডি থানার ওসিসহ অন্য পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে ঠাট্টা মস্করা করতে থাকেন। আঙ্গুলে তুড়ি দিয়ে মুখ দেখিয়ে বলেন, ‘মুখে টেপ লাগিয়ে কথা বলব।’ এর ১০ মিনিট পর বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন বিচারকের আদালত বসার পর ডান হাঁটুর ওপর বাঁ পা তুলে চেয়ারে হেলান দিয়ে বাঁ হাঁটুর ওপর বাঁ হাতের আঙুল নাচাতে থাকেন। ১১টা থেকে বিস্তারিত রায় শুনতে শুনতে কাশেমের চেহারায় উদ্বেগ বাড়তে থাকে। বাঁ হাতের তর্জনী উঠে যায় বাঁ গালে। ট্রাইব্যুনাল-২ চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ৩৫১ পৃষ্ঠার রায়ের ১১ পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্তসার পড়তে পড়তে সাড়ে ১১টায় দুটি অভিযোগে মীর কাশেমের মৃত্যুদ-ের রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে কাঠগড়ায় উঠে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক বক্তৃতার ভঙ্গিতে ডান হাতের তর্জনী উঁচিয়ে বলে ‘রক্তচক্ষু’ মীর কাশেম আদালতকে বললেন ‘শয়তান...!’ এক মিনিটের মধ্যে দ্বিতীয়বার বলে উঠলেন ... ...‘শয়তান...!! কিছুক্ষণ নীরব থেকে অস্থির হয়ে বলে উঠলেন ‘মিথ্যা ঘটনা... মিথ্যা শাস্তি ..কালো আইন টিকবে না...।’ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ শিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, জামায়াতের শূরা সদস্য ও জামায়াতের বিপুল অর্থের মূল যোগানদাতা মীর কাশেম আলীকে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেন রবিবার। একাত্তরে তার নির্দেশেই চট্টগ্রাম টেলিগ্রাফ অফিস সংলগ্ন এলাকায় হিন্দু মালিকানাধীন মহামায়া ভবন দখল করে নাম দেয়া হয় ডালিম হোটেল। সেখানেই গড়ে তোলা হয় বদর বাহিনী চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঘাঁটি এবং বন্দিশিবির। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় সেখানে অসংখ্য মানুষকে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়, যাদের লাশ পরে ফেলে দেয়া হতো চাক্তাই চামড়ার গুদাম সংলগ্ন কর্ণফুলী নদীতে। আদালতের রায়ে কোনপক্ষ বিক্ষুব্ধ হলে আইনানুগভাবে তার প্রতিবাদ জানাতে পারে। উচ্চ আদালতে প্রতিকার চাইতে পারে। উপস্থিত অনেকে বললেন বিক্ষুব্ধ হলেও কোনভাবে আদালতকে চ্যালেঞ্জ বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে পারে না কেউ। অথচ মীর কাশেম আলী প্রকাশ্যে সেই কাজটিই করেছেন। এতে কেবল আদালত নয়, আইন, বিচারক, সাক্ষী সবার প্রতি প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন একাত্তরের ঘাতক মীর কাশেম আলী। একাত্তরের আলবদর কমান্ডার স্বরূপে তার নক্তপিপাসু ঘাতক চরিত্র আদালতের সামনেই উন্মোচিত করলেন। যুদ্ধাপরাধ আদালতে এর আগে যে ১০টি রায় ঘোষণা হলেও স্বয়ং নিজামী তাঁর মৃত্যুদণ্ডের রায়ের সময়ে নীরব শোকাহত ছিলেন। কাদের মোল্লা বা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী কেউ এতটা ঔদ্ধত্য দেখাননি। বাচ্চু রাজাকার ছাড়া অন্য প্রতিটি আসামি আদালতের কাঠগড়ায় বসে তাঁদের রায় শুনেছেন। কসাই কাদের খ্যাত কাদের মোল্লা ও তার মৃত্যুদ-ের রায় শুনে ‘মিথ্যা রায়’ বলে কিছুটা চেঁচামেচি করেছেন। কিন্তু তাঁদের কেউ ঘাতক মীর কাশেম আলীর মতো আদালত অবমাননার স্পর্ধা কেউ দেখাননি। মীর কাশেম আলী যদি আইনী লড়াই করতে না চান, যদি উচ্চ আদালতে আপীল না করেন, সেই অধিকার তার আছে। কিন্তু তাই বলে ‘আদালত কক্ষে মাননীয় বিচারকদের গালিগালাজ করার অধিকার কারও নেই’ বলে মন্তব্য করলেন উপস্থিত আইনজীবী এবং বুদ্ধিজীবীরা।
রায় ঘোষণা উপলক্ষে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সামনে মুক্তিযোদ্ধারা সমাবেশ করে। রায় ঘোষণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আনন্দের ঝড় উঠে মুক্তিযোদ্ধাদের সমাবেশে। মীর কাশেমের রায়ে সন্তোষ জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতারা। ট্রাইব্যুনালে রায় ঘোষণার সময় বাইরে সর্বোচ্চ সাজার দাবিতে বিভিন্ন সেøাগান দেন মুক্তিযোদ্ধারা। এই মিছিলের সামনে দৈনিক জনকণ্ঠ হাতে দাঁড়িয়েছিলেন সিরাজগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, দৈনিক জনকণ্ঠ প্রথম সাহস করে ‘তুই রাজাকার’ শিরোনামে সেই সময়ে প্রচণ্ড ক্ষমতাধর রাজাকারদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল। তিনি বলেন, প্রতিদিন ধারাবাহিকভাবে সারাদেশে রাজাকারদের নির্যাতনের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেছিল অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের মাধ্যমে। উল্লেখ্য, ২০০০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০০১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে একাত্তরে সারাদেশে আলবদর এবং রাজাকার বাহিনীর তা-বের মূল ক্রীড়নকদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানী এবং সাহসী প্রতিবেদন তুলে ধরে দৈনিক জনকণ্ঠ। ২০০১ সালের ২৭ মার্চ দৈনিক জনকণ্ঠ ‘রাজাকার আলবদরের শীর্ষ সংগঠক চট্টগ্রাম গণহত্যার নায়ক মীর কাশেম আলী এখন রাবেতার কান্ট্রি ডিরেক্টর’ শিরোনামে মীর কাশেমের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন ছাপে। এ প্রতিবেদনে মীর কাশেমের বক্তব্য ও ছাপানো হয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার পাওয়ার শুভ মুহূর্তে অনেকে জনকণ্ঠের এই সাহসী ভূমিকার কথা ভুলে গেলেও এই মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিতে এখনও অমলিন জনকণ্ঠের সেই দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ৭ নম্বর সেক্টরে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, তার আনন্দ একজন কুখ্যাত রাজাকার এবং আলবদর কমান্ডারের ফাঁসির রায়ের মাধ্যমে ন্যায়বিচার পেয়েছে তিরিশ লাখ শহীদের স্বজন এবং নির্যাতিতদের পরিবার। রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের চেয়ারম্যান জেনারেল সফিউল্লাহ জনকণ্ঠকে বলেন, ‘এ রায়ে আমরা সন্তুষ্ট; উচিত সাজা হয়েছে যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর।’ রায়ের পর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল হেলাল মোর্শেদ খান বলেন, ‘প্রত্যেক রায়ের আগে আমরা এখানে আসি যেন বিচারকরা সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে কুণ্ঠাবোধ না করেন, ভয় না পান।’ তিনি বলেন, এর আগে দেখেছি, বয়সের যুক্তিতে অনেক রাজাকারকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়নি। রাজাকারদের মৃত্যুদণ্ড দিয়ে স্বাধীনতাবিরোধীদের তাড়িয়ে দিয়ে নতুন প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী চেতনাকে ধরে রাখতে আমরা এখানে আসি। আদালত প্রাঙ্গণে মুক্তিযোদ্ধা এবং সাংস্কৃতিক সংগঠক নাসিরউদ্দিন ইউসূফ বাচ্চু তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পরে চট্টগ্রামের ডালিম হোটেল ছিল হত্যা, নির্যাতনের জন্য আলোচিত, আগে যার নাম ছিল মহামায়া ভবন। ওই সময় মানুষ ভয়ে ওই হোটেলের পাশ দিয়ে হাঁটত না। ওই জায়গা ছিল আতঙ্কে ভরা। মীর কাশেমের মৃত্যুদন্ডের রায়ের মধ্য দিয়ে জনগণের ওই সময়ের ভীতি, শঙ্কা যে সত্য ছিল তা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।’
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ডের পরিচালক মফিদুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, অসাধারণ এই রায়। রায়ে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে আলবদর বাহিনীতে ২০ হাজার তরুণকর্মী নিয়োগ দিয়ে তাদের মধ্যে এদেশের নিরীহ জনগণ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ঘৃণার মনোভাব তৈরি করা হয়েছে। এদেশের তরুণদের নিজের মাতৃভূমি রক্ষায় প্রাণ হাতে নিয়ে যুদ্ধ করা মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা এবং নির্যাতনে লেলিয়ে দেয়া হয়েছিল। গোলাম আযমের উদ্ধৃতি, মওদুদীবাদের প্রচার এবং প্রসারের বাণী এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে উল্লেখ করা হয়েছে রায়ে। এর মাধ্যমে জাতির জন্য বড় শিক্ষা হলো যারা একাত্তরে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে, তাদের অপরাধ প্রমাণিত সত্য। এর মাধ্যমে জামায়াতের মতাদর্শ ঘৃণা করে যেন তরুণ প্রজন্ম, আমরা প্রত্যেকে এবং পুরো জাতি এই মতাদর্শ প্রত্যাখ্যান করে তারই দিকনির্দেশনা রয়েছে এ রায়ে।
এ মামলার তদন্ত অনেক কঠিন ছিল- বললেন মীর কাশেমের বিরুদ্ধে মানবতার অপরাধ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম। মীর কাশেমের বিরুদ্ধে যত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তদন্ত করেছেন নুরুল ইসলাম। মীর কাশেমের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দায়ের করা চতুর্থ অভিযোগ ছিল মুক্তিযোদ্ধা সাইফুদ্দিন খানকে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। রায় ঘোষণার পর এ মামলার অন্যতম সাক্ষী ফয়েজ আহমেদ সিদ্দিকীকে অভিনন্দন জানান নুরুল ইসলাম।

No comments:

Post a Comment