Friday, October 17, 2014

সাঁইত্রিশ বছর পরে -সৈয়দা রাজিয়া বেগম




তুমি বেঁচে থাকলে আজ সত্তর বছর পূর্ণ হতো তোমার। আমি, চন্দ্রা, চয়ন, নীলিম, কাজলী আর ওদের ছেলেমেয়ে কুঞ্জ, কবরী, মেঘা আর রৌদ্র উৎসবের সুরভিতে জন্মদিনের আয়োজন করে তোমাকে না জানিয়ে সারপ্রাইজ দিতাম। কিন্তু তা হলো না। মনের কোটরে শতসহস্র জলকণা প্রপাতের মতো অনর্গল ঝরছে চোখ বেয়ে। তুমি নেই। কিন্তু নিঃশব্দ স্মৃতিরা আছে চারপাশে। এই যে সব স্মৃতিমুখর। তার অর্থ কী এই যে তুমি আছ? কী জানি! শরীরটার অনুপস্থিতি বিশাল দেয়ালের মধ্যে আড়াল পড়ে গেছে যেন। চোখে ভাসে তোমার হাসি, কথা, সম্পূর্ণ তুমি। কেবল একটা কাঠামো। আর সেই অবয়ব সাঁইত্রিশ বছর ধরে আমাকে কাঁদাচ্ছে। একেবারে নিভৃতে, সবার অলক্ষ্যে, রাতের বিছানায়।
 সেই ভয়াবহ রাতটি আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তোমাকে যখন পাকিস্তানী সৈন্যরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল তখন আমরা রাতের খাবার খাচ্ছিলাম। রাত তখন ন’টা। এমন কিছু রাত নয়। কিন্তু ওই দিনগুলোতে সকাল-দুপুর-বিকেল সব সময়ই রাতের নিস্তব্ধতা। বিভীষিকা সর্বক্ষণ মনকে নিঃসাড় করে রাখত। তাই রাত ন’টায় যখন দরজার বেল বেজে উঠল। আমরা দ’জনই ভয়ে আতঙ্কে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। অনবরত বেজে চলেছে বেল । তুমি দরজা খোলার জন্য এগিয়ে গেলে আমি তোমার হাত চেপে ধরে পথ আগলে দাঁড়িয়েছিলাম। খুব নিচু স্বরে ফিসফিস করে বলেছিলাম, ‘এত রাতে আর কে আসবে? নিশ্চয়ই আর্মিরা এসেছে। তুমি দরজা খুলতে পারবে না।’ তুমি বলেছিলে ‘তাতে কী? আমরা তো কোন অন্যায় করেনি। যদি আর্মিই এসে থাকে। শুনি কী বলতে চায়।’ আমার কোন অনুরোধ- নিষেধ তুমি শুনলে না। এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলে।
 আমার কথাই ঠিক হলো। বন্দুক হাতে কয়েকজন সৈন্য। ওদের সঙ্গে তিনতলার ভাড়াটে ফজলু হাওলাদার। কিছুদিন ধরেই ফজুল হাওলাদারের কথাবার্তা, চালচলনে পরিবর্তন দেখেছিলাম। তিনতলার ব্যালকনিতে একটা পাকিস্তানী পতাকা টাঙিয়ে রেখেছিল। একতলার ভাড়াটে হুমায়ূন ভাই এবং আমাদের পরামর্শ দিয়েছিল পাকিস্তানী পতাকা ওড়াতে । বলেছিল ‘এ দেশটা পাকিস্তানই থাকবে। আলাদা করার সাধ্য কারো নেই।’ সঙ্গে সঙ্গে আমরা তার কথার প্রতিবাদ করেছিলাম, বলেছিলাম ‘সাতই মার্চের দিন থেকে পাকিস্তানকে আমরা পরিত্যাগ করেছি। আর কিছুদিন অপেক্ষা করুন দেশ স্বাধীন হবেই হবে।’
আমাদের কথায় তার চোখে ফুটে উঠেছিল হিংস্র বিরক্তি। তারপর খুব থেমে থেমে বলেছিল ‘একটা ভুল অনেক ভুলের জন্ম দেয়। একটা কথা অনেক কথার সাক্ষী হয়। আপনারা নিজেরাই নিজেদের বিপদের গর্ত খুঁড়লেন। এই কথাগুলো বলে সেদিন ফজুল হাওলাদার ভীষণ তেজী পায়ের চাপে মাটি আন্দোলিত করে চলে গিয়েছিল। আমরা ফজুল হাওলাদারের সেদিনকার কথাকে ঔদ্ধত্য বলে মনে করিনি। একবারও ভাবিনি ভয়ঙ্কর রাজাকারের তালিকায় নাম লিখিয়ে পাকিস্তান আর্মিদের দোসর হয়েছে। ওদের হাতে হাত রেখে বাংলাদেশের সমৃদ্ধ মানুষদের ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেছে। হায়েনারে পথ চিনিয়ে ঠিকানা হাতে তুলে দিয়ে হত্যা করেছে গৌরবে ভাস্বর জ্ঞানী-গুণী, মেধাবী সম্পদদের। জেনেছিলাম তোমাকে নিয়ে যাবার পরে। ফজুল হাওলাদার বলেছিল ‘ক্যাপ্টেন আসলাম এই সৈন্যদের পাঠিয়েছেন। আপনাকে উনি সালাম দিয়েছেন।। ওরা বাসা চেনে না বলে সৈন্যদের আমি নিয়ে এসেছি।’
তখনও তোমার হাতে ভাত মাখানো তরকারির ঝোল লেগে আছে। একবার তুমি বলেছিল ‘খাবার রেখে উঠে এসেছি। খেয়ে নিয়ে আমি নিজেই ক্যাম্পে চলে যাব। জানতে পারি কেন ওনার আমাকে প্রয়োজন হলো? হাওলাদার বলেছিল তেমন কিছু না। আপনার মতো কীর্তিমান মানুষের সঙ্গে কাপ্টেন আসলামের পরিচিত হবার ইচ্ছা। হাতাটা ধুয়ে নিয়ে চলুন। ফিরে এসে খেয়ে নেবেন। মাত্র তো কিছুক্ষণের আলাপ।
 ঘটনার পরম্পরা তুমি ঠিকই অনুমান করেছিল। ভেতরে গিয়ে হাত ধোবার সময় আমাকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিল ‘আজ রাতের মধ্যে আমি না ফিরে এলে কাল সকালেই এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেও।’ তারপর ঘুমন্ত চন্দ্রা আর চয়নকে বুকে জড়িয়ে আদর করলে আমার পিঠে হাত রেখে বলেছিলে ‘ওদের সব দায়িত্ব তোমার। ওদের মানুষ করবে দেশপ্রেমের জাগৃতি মনে গেঁথে দিয়ে। তোমাদের আমি আল্লাহ্র প্রযতেœ রেখে গেলাম।’ হৃদয় নিংড়ানো কষ্টে ভেঙ্চেুরে আমি অস্ফুট স্বরে বলেছিলাম ‘ওদের সঙ্গে গেলে তোমাকে আর আমি ফেরত পাব না পেছনের পাঁচিল টপকে তুমি পালিয়ে যাও।’ আমার কথায় তুমি হাসলে। বললে ‘তিনতলা থেকে তো নামতে হবে। তারপর না পাঁচিল টপকানো।’ ততক্ষণে আমার শরীর অবশ হয়ে গেছে যেন। কোন শক্তি ছিল না। না মনে না শরীরে। এক রকম চৈতন্যহীন স্থবির পাথর তখন আমি।’
ঘরে ঘরে ছিনতাই হাচ্ছিল মানুষ। একবার ধরে নিয়ে গেলে কেউই আর ফেরত আসেনি। তুমিও আসোনি। এলে না আর। সেই গুমোট অসহায় রাতটিতে তুমি বলেছিলে ‘রাতে না ফিরে এলে পরদিন সকালেই চন্দ্রা আর চয়নকে নিয়ে আমি যেন এ বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ঠাঁই খুঁজে নিই। তুমি তো জান না ততক্ষণে অরক্ষতি হয়ে উঠেছে ঢাকাসহ সর্বত্র। আমি নিঝঝুম স্তব্ধতায়, জৈতন্যে ঘোরলাগা অবসাদ নিয়ে তোমার প্রতীক্ষায় বসে রইলাম। সকাল ফুটলে টেলিফোন করেছিলাম বড় আপা ছোট আপাকে। ওরা দুলাভাইদের নিয়ে চলে এসেছিল। সব কিছু শুনে দুলাভাইরা তোমাকে খুঁজতে বেড়িয়েছিল। একনাগাড়ে দশদিন ওরা চষে বেড়িয়েছে সমস্ত ঢাকা শহর। কোন সন্ধান পায়নি তোমার। সকালে এও শুনেছিলাম হুমায়ূন ভাইকেও ওই রাতে পাশ-রা ধরে নিয়ে গেছে। বুঝলাম, হিংস্র হায়েনা হাওলাদার সেদিনকার কথার প্রতিশোধ ঠিকই নিয়ে ছাড়ল।
 দশদিন এক পৃথিবী শোকের কাঁথায়মুড়ে যখন চেতনা বিলুপ্ত হচ্ছিল বার বার তখন জোর করে দরজায় তালা লাগিয়ে ছোটো আপার বাসায় আমাদের নিয়ে গেল। আমরা দিনরাত একাকার হয়ে থেকেছে। চন্দ্রা আর চয়ন বার বার তোমার কথা জানতে চায়। কোন উত্তরই ফোটেনি আমার ঠোঁটে। ছোটো আপা ওদের আদর করে কাছে বসিয়ে বলেছে ‘দেশ স্বাধীন হলে নিশ্চয়ই তোমাদের বাবা ফিরে আসবে।’ এত কঠিন কথার অর্থ সেদিন ওরা বোঝেনি। বুঝেছিল অনেক পরে।


 দেশ স্বাধীন হলো। বিজয়ের কলরোলে অনেক দুঃখের গাথাও আনন্দের মিছিলে জড়ো হলো। মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে এসেছিল বিজয়ীর হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে। কিন্তু ওদের হাসি আনন্দের আলোময় মুখ নিভে গেল। ওরা দেখল পিশাচ ঘাতকরা হত্যা করেছে ওদের আপনজনদের, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ঝলসে দিয়েছে বাড়িঘর। বিরান শূন্যতায় তখন মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তর বেয়ে নেমেছে কান্নার ধারা। যারা নিরপরাধ তাদের কেন নৃশংস নিপীড়নে মেরে ফেলল? কার কাছে চাইব এর উত্তর? কতিপয় দোসর, যারা এই নির্মম মৃত্যুর পতাকা উড়িয়েছে। তাদের শাস্তির দাবি ওঠে। আপনজন, বাড়িঘর সর্বস্ব খুইয়ে নির্বাক তখন মুক্তিযোদ্ধারা।


 আমার মন অসহিষ্ণু দুশ্চিন্তায় কেঁপে কেঁপে উঠত। জোর করে মন থেকে সরিয়ে দিতাম অজগর দুঃস্বপ্ন এক মন ভাবত অবশ্যই একদিন তুমি ফিরে আসবে। অন্য মন অস্বস্তিকর ভাবনার ঢেউয়ে হাবুডুবু খেত। বুকের খাঁচায় নিঃশ্বাস আটকে যেত। মনে হতো তুমি নেই। কখনও, কোনদিনও ফিরবে না তোমার সুখী গৃহকোণে। শেষের শ্বাসরুদ্ধ ভাবনাই সঠিক হলো। তুমি ফিরে এলে না কিংবা কেউ তোমাকে ফিরেয়েও দিয়ে গেল না। তুমি হলে চিরকালের জন্য নিরুদ্দেশ।


 মাস দুই পরে মিরপুর বধ্যভূমি থেকে আরও অনেকের সঙ্গে তোমাকেও শনাক্ত করা গেল। নিশ্চিত মৃত্যুর সঠিক সংবাদ। তুমি ছবি হয়ে শোকের ঠিকানায় বসতি করলে। অন্য সবার মতো তোমাকেও কবরস্থ করা হলো। তোমার নামের সূচনায় যোগ হলো শহীদ। তিরিশ লাখ শহীদের কাতারে তুমি ঠাঁই করে নিলে। আর আমরা হয়ে গেলাম শহীদ পরিবার। স্বাধীনতা, দেশবিজয়ে তোমার অংশীদারিত্ব এ তো আমাদের বড় অর্জন।
 যাদের সঙ্গে ছিল তোমার অবসরের আড্ডা দেয়ার সখ্য। তাদের সঙ্গে আমারও ছিল একই রকম বন্ধুত্ব। তুমিই আমাকে জোর করে তোমাদের আড্ডায় নিয়ে যেতে। তুমি চলে যাবার পর ওই আড্ডা আমাকে আর মনোযোগী করেনি। ব্যস্ততা বেড়ে গেল। রবং বলা ভাল ব্যস্ততা বাড়িয়ে দিলাম।


সাংবাদিকতা পেশা আমার। সঙ্গে ছিল লেখালেখির চুম্বক আকর্ষণ। তুমি নেই। আমাদের তিনজনের জীবন তো সচল। চন্দ্রা আর চয়ন অবুঝ দু’টি শিশু। ওদের প্রয়োজন-অপ্রয়োজন সবটা দেখভাল করার দায়িত্ব তো তখন একলা আমার। উপার্জনের সিংহভাগ তো রাতারাতি বিয়োগ হয়ে গেল। সব কিছু মিলিয়ে আমি তখন উদ্বেগের কাঁটায় এফোঁড়-ওফোঁড় হচ্ছি। আড্ডার কোন কোন বন্ধু সেই সময় চন্দ্রা, চয়ন আর আমার দায়িত্ব নেবার আগ্রহ দেখিয়েছিল। না, অবশ্য তা তারা করেনি। আমার সিদ্ধান্তটুকুই শুধু জানতে চেয়েছিল। আমিও নীরব থাকা যুক্তিযুক্ত মনে করে ধীরে ধীরে দূরত্ব টেনে দিয়েছি। বন্ধ করেছি বন্ধুত্বের আগল। ওরা অবশ্য পরে আমার কাছে মার্জনা চেয়েছে। আমি অবশ্য কোন রকম প্রতিক্রিয়া দেখাইনি। শুধু সাময়িক যোগাযোগের দোরটা আলগা করেছি।

 কিন্তু তারপরেও বন্ধুত্বের নির্মল সুবাসটুকু আর নেই। কখন যে তা হারাল তা মনেও করতে পারি না। তবে ওরা যে যার মতো ঘরনী খুঁজে নিয়েছে।


 সাঁইত্রিশ বছর তুমি ছাড়া আমার দিন মাস বছর কেটেছে। চন্দ্রা আর চয়নকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছি। ওদের দু’জনের জীবন ঘিরে যারা আছে তাদের নিয়েই আমার অফুরন্ত উদ্বেল সময় কেটে যায়। এতসব কিছুর পরেও তোমার অভাব অনুপস্থিতি ঘরের চারপাশে। রাস্তায় বেরুলে। কোন আনন্দ অনুষ্ঠানে গেলে অনেক বেশি দুঃখময়তা ছুঁয়ে যায়।তুমি একজন মাত্র মানুষ। সেই কবে নেই হয়ে গেছ কিন্তু আজও আছ যেন তাজা সজীব প্রাণ নিয়ে আমার মনে। আমার ভাবনায়। আচ্ছা বল তো এত দীপ্ত হয়ে থাকলে কী করে?
এই এত বছর যুগ অতিক্রম করে এসে, আমিও যখন ষাটোর্ধ বয়সের সোপানে তখন নিজেকে খুব অসহায় লাগে। আমি জানি না ডিসেম্বরের চৌদ্দ তারিখ, স্পষ্ট হয়ে থাকা একাত্তর। এর পর থেকে দীর্ঘ সাঁইত্রিশ বছর। কোন্ মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে তুমি হাড়া আমি একলা হাতে সব গোছাতে পারলাম! কোথাও কোন অনিয়ম কিংবা প্রতিবন্ধকতা যে আসেনি তা তো নয়। কেমন করে যে তার হাল ধরেছিলাম আজ আর তা বলতে পারব না। বোধকরি বেহুঁশ ছিলাম আমি। তোমার শেষ কথাগুলোই যেন আমার শক্তি আর প্রেরণা হয়েছিল।


একাত্তরে আমি ছিলাম তেইশ বছরের একজন তরুণী আর ছিল অবুঝ দুটি সন্তান। কত আগ্রহ-ইচ্ছা-অনুরোধ চারপাশ থেকে এসেছে কেমন করে যেন সব অবজ্ঞা করেছি। ঠেলে দিয়েছি কচুরিপানা সরাবার মতো করে। কখনই অনুভব করিনি আমার একজন সঙ্গী চাই। আমার এই অনমনীয় একরোখা সিদ্ধান্তের তামাশা দেখে অনেকে আশ্চর্য হয়েছে। আবার অনেকে আমাকে নির্বোধও মনে করেছে। আবার অনেকের চোখে-মুখে দেখেছি প্রগাঢ় শ্রদ্ধার আলোময়তা। আমার কেবলই মনে হয়েছে, আমার কোন অপূর্ণতা নেই। কিংবা কখনই ভাবিনি আমি সঙ্গীহীন একা। তবু কারো কারো পরামর্শে বিনীতকণ্ঠে রেখেছি। বলেছি যেদিন আমি বুঝব ক্লান্তি নেমেছে মনে শরীরে। কিংবা তোমার স্মৃতি আবছা হয়ে উঠছে। সেদিন আমি ভাবব। কোন দ্বিতীয় চিন্তা।

আজ পর্যন্ত কোন ক্লান্তি, বিরক্তি, অর্পূণতার ছোঁয়া লাগেনি। আমার মনে কিংবা শরীরে। তবে আর কি প্রয়োজন? আমি যদি আমার জীবনের কোন কষ্ট, দুঃখকে প্রশ্রয় না দিই। তার দায়দায়িত্ব তো আমারই। আমি যদি মনে করি আমি ভাল আছি। বেশ আছি। তবে অন্যের অস্বস্তি কেন? কিন্তু না, আমার ভাবনা আমার থাকে না। আমার আমিত্বকে কেড়ে নিয়ে আবর্জনায় ছুড়ে দেবার লোকেরও অভাব হয় না। তাই তো জীবনের একটা স্বস্তির বয়সে এসে শুনতে হয় দাগ দেয়া কথার অশালীন কথোপকথন। আমি নাকি আমার চরিত্রকে দূষিত করেছি। বিভিন্ন পুরুষের সংস্রবে সময় উদ্যাপন করেছি। আমি কি এতটাই হীন ছিলাম? তুমিই বলো, এসব কথা বলা মানে কি আমার অস্তিত্বকেই চ্যালেঞ্জ করা হয় না?
আমি যদি চাইতাম কিংবা যদি ইচ্ছা হতো তাহলে তো সেই সুনীল বয়সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে একটা আবহ তৈরি করতে পারতাম। তখন তো কারোই কিছু বলার থাকত না। দোষেরও কিছু থাকত না। আমি আমার মতো জীবন গুছিয়ে নিতাম।কিন্তু তা আমি করিনি। করিনি এজন্য যে, আমি তাগিদ অনুভব করিনি। আর তাই চাবুকের আগায় মন বিদ্ধ করে পার করেছি অসম সময়। আমি ভীষণ এক গর্ববোধে উজ্জ্বল থেকেছি একজন শহীদের স্ত্রী হিসেবে। এত সম্মান, এত শ্রদ্ধা, এত অনুরাগ পাবার চেয়ে কি দ্বিতীয় চিন্তায় নিজেকে জড়ানোটা অনেক সুখের হতো? নাকি বিয়ে নামক একটি বন্ধন আমাকে সুখী মানুষ করে তুলতে পারত? চন্দ্রা আর চয়ন যখন বড় হলো তখন ওরাও বন্ধুর মতো আমাকে বলেছিল তুমি কেন আমাদের কথা ভেবে তোমার জীবনকে অনাড়ম্বর রাখলে? ওদের জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম ‘তোমরা দুজন আমার সন্তান। আমি জীবনে কাউকে গ্রহণ করলে তোমরা আমার সন্তানই থাকতে। তখন থেকে তোমাদের সঙ্গে আমার সম্পর্কের বিচ্যুতি ঘটত না। তবে তোমাদের কথা ভেবেই যে আমি নতুন কোন সঙ্গী নিইনি এও যেমন সত্যি ঠিক তেমনি তোমার বাবার সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক কিংবা তার প্রতি আমার যে ভালবাসা সেখানে কোন রকম ইটের গাঁথুনি তুলতে চাইনি। আমার কথায় চন্দ্রা আর চয়ন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। ওদের ঠোঁটে আর কোন কথা জোগায়নি। শুধু চন্দ্রা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কিছুক্ষণ কেঁদেছিল। চয়ন চলে গিয়েছিলো ওর ঘরে।


 আমি চন্দ্রা-চয়নকে নিয়ে নিরবচ্ছিন্ন আনন্দের জগতে দিবারাত্রি কাটিয়েছি। কোন সময় কখনই দীর্ঘশ্বাস পড়েনি আমার। সেই আমি আকস্মিক বাজ পড়ার আদিগন্ত ঝলসানো মানুষ হয়ে গেলাম সেদিন। আমার এক সহকর্মী বন্ধু এক অদ্ভুত গা ঘিন্ঘিন্ খবরটি শোনাল । দেখলাম ওর চোখে-মুখে আগুনের জ্বলন্ত আভা। ও আমার বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকা মুখের রেখা দেখে কেঁদে ফেলে বলেছিল “যারা এসব কথা ভাবে এবং বলে তাদের আমি স্পষ্ট জবাব দিয়ে এসেছি। ওরা বুঝেছে সব কথা সব কুৎসিত ভাবনা সবার জন্য নয়। ওরা অবশ্য কথাগুলো বলার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে। কিন্তু আমার অবাক লাগে, আমার ভাবতেও কষ্ট হয়, মানুষ এত হীন চিন্তা করে কিভাবে? মানুষের জীবন থেকে কি মূল্যবোধের একেবারেই পচন ধরেছে?”


সাঁইত্রিশ বছরে যে চোখের পানি চন্দ্রা আর চয়নের মুখের দিকে তাকিয়ে ঝরতে দিইনি। ওই কথা শোনার পর ক’দিন ঝরেছে আষাঢ় শ্রাবণের ধারা। কেবল মনে হয়েছে ছিঃছিঃ! আমার সব অর্জন কি তাহলে মিথ্যা হয়ে গেল? আমার চুম্বক সময়গুলোকে থেঁতলে যে আমি সদর্পে সড়ক অতিক্রম করেছি, সেই আমাকে কেন এত নোরাং আবর্জনায় ছুড়ে ফেলা হচ্ছে? কারা করছে এসব? যারা আমার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। তারাই কি এ রকম জঘন্য প্রচারণা করছে? আমি তো অনায়াসে একজন পুরুষকে আমার সঙ্গী করতে পারতাম। পারতাম তাকে সমাজের চত্বরে দাঁড় করিয়েও দিতে। অপরিচয়ের দূরত্বের আবরণে নয়, সর্বসম্মুখে পরিচয়ের সুতায় গ্রন্থিবন্ধ করেই। কিন্তু সে রকম কোন প্রত্যাশা, আকাঙক্ষা, ইচ্ছা আমার ছিল না। একেবারেই আমি আমার মতো করে সময় পার করেছি। কোন অনাচারের পথে আমি পা রাখিনি বা হাঁটিনি । এখন তুমিই বলো, এ অপমান আমি সইব কি করে? এক মিথ্যা শত মুখে আছাড় খেয়ে তো সত্যিই হয়ে যায়। কতজনকে আমি জবাবদিহির জবাব দেব! আবার বেশিরভাগ তো কোন প্রশ্ন করবে না। কিংবা জানার আগ্রহও দেখাবে না। কিন্তু মনে মনে স্থির সিদ্ধান্ত তৈরি করে নেবে। বলো, সাঁইত্রিশ বছর পরে কেন আমি এভাবে হোঁচট খাচ্ছি?


একজন নারীর চরিত্রকে পুঁজি করার দিন কবে আমাদের সমাজ থেকে দূর হবে? কত অনায়াসে একজন নারীকে আঁস্তাকুড়ে ছুড়ে দেয়া হয়। তবে তোমাকে বলে রাখছি, আমিও লড়াইয়ের মুখোমুখি দাঁড়াব। আমিও দেখব সত্যকে মিথ্যা ঠেকাতে পারে কিনা?
আজ তোমার জন্মতিথি। একজন শহীদের জন্মতারিখ। আমার একান্ত একজন মানুষের পৃথিবীতে আসবার দিন। এই তারিখটিই আমি মনে রাখতে চাই। ভুলে যেতে চাই ডিসেম্বরের চৌদ্দ তারিখটিকে। বার বার মনে পড়ছে তোমার সঙ্গে পরিচয়ের দিনটি। ওই তারিখটি আমার জীবনে অনন্য, অসামান্য। এত বছর সাথী হয়ে থেকেছে। জীবনের শেষমুহূর্ত পর্যন্ত থাকবে আলোর ঠিকানা হয়ে।


 তোমার চলে যাবার পর থেকে প্রতিবছর এসেছে তোমার জন্মদিনটি। পৃথিবী যতদিন পূর্ণাঙ্গ থাকবে তোমার জন্মতারিখটিও আসবে নিয়মমতো। আমার মনের নিবিড় স্পর্শ নিয়ে তারিখটি আমাকেই আবার সাহস জোগাবে। তাই তো তোমার জন্মদিনটিতে আমার মানসিক আঘাতের ক্ষতচিহ্নগুলো ভরাট করার জন্যই তোমাকে সব কথা বলতে ইচ্ছা হলো। তোমাকে ছাড়া আমি কার কাছে বলব বলো? শুধু তোমাকেই আমি আমার আনন্দ-দুঃখ-ব্যথা-বেদনা-অপমান-সফলতা- সম্মানের কথা বলি আপনমনে। আজও বললাম। তুমি যত দূরেই থাক না কেন। আমার আগামীদিনগুলোর জন্য তো তুমিই দিশা হয়ে থাকবে। দেবে আমাকে সাহসে শক্তির প্রেরণা। কারণ তুমিই তো আমার মনোবলের হাতিয়ার। পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের মনে যদি সূক্ষ্ম এতটুকু সন্দেহের আঁচড় থেকেও থাকে, তুমি তাকে অবজ্ঞা করে আমার সহায় হবে। আমার মাথা উঁচু করে বিস্তৃত আকাশ দেখার অধিকার এখানেই।

No comments:

Post a Comment