Tuesday, July 15, 2014

বাংলাদেশে হুমকি আছে আইএসআইএসের, নির্দেশনা নেই সরকারের- সুমি খান



বিশ্বজুড়ে আলোচিত জঙ্গী সংগঠন আইএসআইএস ( ইসলামিক স্টেট অব ইরাক লেভেন্ড এ্যান্ড সিরিয়া)-এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে চারটি গোপন সুন্নি মুসলিম জঙ্গী সন্ত্রাসী দল। এদের ভিত্তি দক্ষিণ এশিয়া। এদের সন্ত্রাসী তৎপরতা আরব লীগের জন্য নতুন হুমকি। এক যুগ আগের ইসলামী সন্ত্রাসী জঙ্গী দল জেমা’ ইসলামিয়ার চেয়ে অনেক বড় হুমকি মনে করা হচ্ছে আইএসআইএস’কে।

 আল-কায়দার সহযোগী এই জঙ্গী দল আফগানিস্তানে ওসামা বিন লাদেনের কাছে সরাসরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের নিজেদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম শুরু করেছিল। প্রকাশ্য প্রচারও সেই সময়ে তারা শুরু করেছিল । এখন আইএসআইএস ফেসবুক এবং অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তাদের প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ব্রাসেলসে ন্যাটো বিদেশ মন্ত্রীদের সঙ্গে সভা শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, আইএসআইএস-এর সশস্ত্র বিদ্রোহ এই অঞ্চলে একটি বৃহত্তর সংঘাতের জন্ম দিতে পারে। এই সংগঠনের ডাকা জিহাদে অংশ নিতেই বাংলাদেশের রাকিব আহ্বান জানিয়েছেন। আর লন্ডনের আইটিভি বলেছে, বাংলাদেশ থেকেও জেহাদীরা ইতোমধ্যে ওই অঞ্চলে পৌঁছে গেছে ।


মাত্র ১০ বছর বয়সে বাংলাদেশ ছেড়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে লন্ডনে গিয়েছিল আবদুল রাকিব আমিন। আরও দু’জনের সঙ্গে রাকিবকে আল-কায়েদার পক্ষে সিরিয়ার যুদ্ধে অংশ নেয়ার আহ্বান সংবলিত একটি ভিডিওতে দেখা গেছে সম্প্রতি।  স্কাই টিভি এবং অন্যান্য মিডিয়ায় প্রচারিত এই ভিডিও নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে বিবিসিসহ ব্রিটিশ মিডিয়ায় হৈচৈ চলছে।http://www.lbc.co.uk/british-jihadist-was-prayer-caller-at-mosque-92627

আল-কায়েদা থেকে বেরিয়ে গঠন করা হয়েছিল ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক এ্যান্ড দ্যা লেভান্ট এন্ড সিরিয়া (আইএসআইএস)। সংগঠনটি সিরিয়া ও ইরাক সীমান্তে একটি খাঁটি মুসলিম রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনের স্বপ্ন দেখেছিল। এই স্বপ্ন পূরণে তারা দক্ষিণ এশিয়ার তরুণদের জিহাদে যুক্ত করছে নানান প্রলোভন দেখিয়ে।
আইএসআইএস প্রধান আবু বকর আল বাগদাদী দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ, ফিলিপিন্স, মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশ থেকে তার জঙ্গী সংগঠনে সন্ত্রাসী ‘জিহাদী’ নিয়োগ দিয়ে ইরাকের পথে তাদের নিয়ে অভিযান করার সংবাদ প্রকাশ্যে প্রচারিত করেছে ভিড্ওি বার্তার মাধ্যমে। এই বার্তাকে এলার্ট হিসেবে নিয়ে ফিলিপিন্স, মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড এ নিয়ে জোর তৎপর হলেও বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে এখনও যেন অন্ধকারেই বসবাস করছে। দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে আইএসআইএস-এর কার্যক্রম নিয়ে কোন দিকনির্দেশনা দেয়া হয়নি সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে।

‘জিহাদ ছাড়া আর কোন জীবন নাই’ শিরোনামে এক ভিডিও বার্তায় আইএসআইএস-এর সিনিয়র সংগঠক আবু মুতা’না আল ইয়েমিনী ব্রিটেন থেকে সম্প্রতি বলেছেন-বাংলাদেশ, ইরাক, কম্বোডিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাজ্যে আমাদের ভাইয়েরা অবস্থান করছেন। এই ভিডিওর সূত্র ধরে ফিলিপিন্সে শুক্রবার ১১ জুলাই গ্রেফতার হয়েছেন আইএসআইএস’র সদস্য অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক রবার্ট সেরেন্টোন্ওি। তার বিরুদ্ধে জঙ্গী কর্মকা-ে ফিলিপিন্সের নাগরিকদের সম্পৃক্ত করার অভিযোগ এনেছে ফিলিপিনো সরকার । ফিলিপিন্স পুলিশের কাছে রবার্ট তার জঙ্গী তৎপরতার কথা স্বীকার করেছে। তার তথ্যমতে সুন্নি মুসলিমদের আরও চারটি গোপন জঙ্গী সংগঠন সম্প্রতি সংগঠিত করা হয়েছে, যারা দক্ষিণ এশিয়াতে তাদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রস্তুত। রবার্টের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ৫ মালয়েশীয়কে ফিলিপিন্স পুলিশ খুঁজছে, যারা ফিলিপিন্সে গিয়ে তাদের নেতা আবু সাত্তাফের সঙ্গে আত্মগোপন করে আছে। এদের একজন লতফি আরিফিন । তিনি মালয়েশিয়ার হার্ডলাইন ইসলামী দল পিএএস’র সদস্য ছিলেন। ফেসবুকে তার ২৪ হাজার ৭শ’ ৯৬ ফলোয়ার আছে।

এসব বিষয় নিয়ে এখনও কোন তদন্ত শুরু করেনি বাংলাদেশের গোয়েন্দারা । এ ব্যাপারে কথা বলতে পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তাদের পাওয়া যায়নি। তবে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে এ বিষয়ে কোন নির্দেশনা পাননি বলে জানান র‌্যাবের ্এডিজি লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান।

আইএসআইএস প্রধান বোগদাদীর মতো ভয়ঙ্কর জঙ্গীদের ভাষা আর বাংলাদেশের জঙ্গীদের ভাষা এক। ‘তাগুতি সরকার’, ‘জল্লাদ’ নামে গণতান্ত্রিক সরকার এবং প্রশাসনের নীতিনির্ধারকদের চিহ্নিত করে হত্যার টার্গেট করার ভয়াবহতা থেকে মুক্ত নই আমরা ।

বাংলাদেশ এবং শান্তিকামী বিশ্বের জন্য এখন নতুন হুমকি এই জঙ্গী দল। একই সঙ্গে এদের বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত নেতা আবদুল রাকিব আমিন। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ‘জিহাদী’ রাকিবের ভিডিও পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, সিরিয়ায় যুদ্ধ করাই কেবল তাদের উদ্দেশ্য নয়। তারা জর্ডান, লেবানন ও ইরাকেও যাবে। আর এ জন্য সারাবিশ্ব থেকে জিহাদী আমদানি করছে। তারা বাংলাদেশ থেকেও জেহাদী সংগ্রহ করার দাবি করেছে।

সিরিয়ায় বিমানবিধ্বংসী অস্ত্র হাতে রাকিবের ছবি ‘ডেইলি মিরর’ প্রথম প্রকাশ করে, যা আইটিভি ২৬ জুন সম্প্রচার করেছে।

গার্ডিয়ানের রিপোর্টে প্রকাশ, ইরাকী প্রধানমন্ত্রী মালিকি নিশ্চিত করেছেন যে, সিরীয় যুদ্ধবিমান ইরাকে আইএসআইএস-এর অবস্থানে বিমান হামলা চালিয়েছে। ইরাকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানী সামরিক বাহিনীর পরস্পর বিরোধী উপস্থিতির পটভূমিতে গতকাল ওই বিমান হামলা শুরু হয়।
রাকিবরা বাংলাদেশ থেকে ইংল্যান্ড গিয়ে বাসা নিয়েছিল অ্যাবারদিনের ফ্রগহল এলাকায়। প্রথম দু’বছর সে পড়েছিল সানিব্যাংক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর তাকে পাঠানো হয় সেন্ট মাচার একাডেমিতে। একাডেমিতে দ্বিতীয় বছর কাটানোর পরে তার পিতা তাকে বাংলাদেশে নিয়ে গিয়েছিল। তার বন্ধুদের মতে তার বাবা-মা লক্ষ্য করেছিলেন যে, রাকিব বড় বেশি পাশ্চাত্যঘেঁষা হয়ে পড়েছে। দু’বছর বাংলাদেশে কাটিয়ে রাকিব অ্যাবারদিনে ফিরে আসে। তখন তার বন্ধুরা লক্ষ্য করে রাকিবের মধ্যে একটি পরিবর্তন এসেছে। রাকিব দাড়ি রাখতে শুরু করেছে, বেশি ধার্মিক হয়ে পড়েছে। এরপর সে তার পরিবারের সঙ্গে লেসেস্টারে চলে যায়।

বাংলাদেশী কিশোর রাকিব বেড়ে উঠেছিল অ্যাবেরদিন শহরে। সে যে স্কুলে পড়েছে সেখানকার একজন সাবেক ছাত্র সম্প্রতি লন্ডনের প্রেস এ্যান্ড জার্নাল নামের একটি পত্রিকায় রাকিবের সঙ্গে অতীতের স্মৃতিচারণ করেছেন। তিনি বলেন, ২৫ বছরের এই যুবককে তার চালাক ছেলে বলেই মনে হয়েছে।
যে ভিডিওতে আল-কায়েদা থেকে বেরিয়ে আসা গ্রুপ জিহাদী পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে, তাতে রাকিবের অংশ নেয়ার বিষয়টি সে বুঝতে পারেনি, এটা মনে করার কোন কারণ নেই। আইএসআইএস এখন ইরাকের বেশিরভাগ জায়গার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে জিহাদী নিয়োগের আহ্বান সংবলিত ভিডিও সিরিয়ায় ধারণ করা হয়েছে। রাকিবের বন্ধু আরও বলে, রাকিব স্কটিশ গান গাইতে পারত । সে সব সময় মনোযোগের কেন্দ্রে থাকতে পছন্দ করত। তার এটা ভালই বোঝার কথা যে,এই ভিডিও প্রকাশ পাবে এবং ব্রিটেনে সেটা দেখানো হবে । বন্ধুবান্ধবরা তাকে এতে দেখবে। এবং এটা অনুমান করে তার ভাল লাগারই কথা। সর্বশেষ তাকে ১৮ মাস আগে দেখেছে তার বন্ধু।

অ্যাবেরদিন স্পোর্টস ভিলেজে সে তার সঙ্গে ফুটবল খেলেছিল। আমি আর কখনই তার বন্ধু থাকতে পারি না। তবে তাকে যদি কখনও রাস্তায় দেখা পেয়ে যাই তাহলে ছুটে গিয়ে জিজ্ঞেস করব, কেন তুমি এমন করলে? আমি সত্যি বুঝতে পারি না, মাত্র ১৮ মাসের ব্যবধানে রাকিবের জীবনে এমন কী ঘটল, যাতে সে এমন করে বদলে যেতে পারল? আমি তার কাছে জানতে চাইব, তাকে ওরা নিয়োগ করেছে, নাকি সে নিজ থেকে ওদের দলে গিয়ে নাম লিখিয়েছে। কখনও কখনও আমরা যখন বেড়াতে বের হতাম তখন পথে লোকে তাকে ‘বর্ণবাদী’ বলে টিটকিরী দিত তখন কোন কোন ঘটনায় তাকে রুখে দাঁড়াতে দেখেছি।
এতদিন জঙ্গী পুষে এখন সতর্ক হয়েছে ব্রিটেন। সৌদি আরব বেড়াতে গিয়েছিলেন একটি মসজিদের ইমাম। তাকে আর লন্ডনে ফিরতে দেয়া হয়নি।ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লন্ডনের মসজিদগুলোতে যাতে র‌্যাডিকেল বাণী প্রচার না করা হয় সে জন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে।

বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকরা যতটা প্রশস্তিতে আছেন, বাস্তবতা ততটা প্রশস্তিসূচক নাও হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সরকারের কাউন্টার টেররিজম টিমের সতর্ক এবং জরুরী পদক্ষেপ দমন করতে পারে এদেশে জঙ্গীবাদী গোষ্ঠীর সকল অপতৎপরতা- এমন মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের অনেকে। সারা বিশ্বে মৌলবাদী আছে, এদেশেও আছে। মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুড, পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী নামে একই দল এরা। এদের দমন করতে হলে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। বাংলাদেশে জামায়াত-বিএনপির রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ জরুরী বলে মত প্রকাশ করেন ইতিহাসবিদ এবং গবেষক ড. মুনতাসীর মামুন। তিনি আরও বলেন, পাকিস্তান আমলেও রাজনীতিতে এভাবে ধর্মের ব্যবহার ছিল না, যা সাম্প্রতিকতম সময়ে আমরা তথাকথিত প্রগতিশীল দলগুলোর মধ্যেও দেখতে পাচ্ছি। যতদিন রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বন্ধ হবে না, মুসলিম বিশ্বে অস্ত্র এবং সন্ত্রাসের ব্যবহার বন্ধে সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে বাধ্য করা হবে না ততদিন সারা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ এই সন্ত্রাসী জঙ্গী গোষ্ঠীর অস্ত্র এবং সন্ত্রাসের কাছে জিম্মি হয়েই থাকবে।  দৈনিক জনকণ্ঠ ১৩ .০৭.২০১৪ 

No comments:

Post a Comment