পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান নেই ২ বছর ॥ ১২ হাজার তালিকাভুক্ত শরণার্থীর ভূমিবিরোধ মেটেনি
সুমি খান॥ ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে আওয়ামী লীগ শাসিত সরকার। এর পরে বিভিন্ন পর্যায়ে আওয়ামী লীগ মোট ৯ বছরের অধিক রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকলেও নানান জটিলতার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন প্রয়াস। যে কারণে পূর্ণ বাস্তবায়নের সঙ্কট এখনও মেটেনি। জনকণ্ঠের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এর সঙ্কট ও সমাধান।
গত ৪০ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঘিরে এক ধরনের স্বার্থান্বেষী চক্র গড়ে উঠেছে। পার্বত্য সীমানা এলাকা ঘিরে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অবস্থান এবং অবৈধ অস্ত্র ও মাদক পাচার চক্র ব্যাপক সক্রিয়। এ ছাড়া পার্বত্য এলাকার ভূমির দখল নিয়ে গড়ে উঠেছে নানান ধরনের স্বার্থান্বেষী মহল। পার্বত্য শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন এবং এ সব এলাকায় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর ব্যাটেলিয়ন ক্যাম্প প্রতিষ্ঠার পথে এই স্বার্থান্বেষী মহলগুলো বড় রকমের বাধা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ মহল।
আদিবাসীদের অধিকার পুনরুদ্ধারের প্রয়াসে গঠিত আদিবাসী সংসদীয় ককাসের সভাপতি ফজলে হোসেন বাদশা এমপিসহ সাতজন সংসদ সদস্য খাগড়াছড়িতে সম্প্রতি বিজিবি ব্যাটেলিয়ন হেডকোয়ার্টার এলাকা স্থাপনকে কেন্দ্র করে ১০ জুন ঘটে যাওয়া সংঘর্ষের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ করেন সোমবার এবং মঙ্গলবার। খাগড়াছড়ি থেকে ঢাকা ফেরার পথে মঙ্গলবার এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। এ সময়ে ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, আওয়ামী লীগ শাসিত সরকার দায়িত্ব নিয়ে পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেছে। সেই ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ শাসিত সরকার আদিবাসীদের জন্য ক্ষতিকর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে না। জনকণ্ঠের সঙ্গে সাক্ষাতকারে দৃঢ়ভাবে এ কথা জানান পার্বত্য চট্টগ্রাম আদিবাসী ককাসের সভাপতি ফজলে হোসেন বাদশা। তিনি বলেন, এখনও আদিবাসীদের সঙ্গে সরকারের বড় রকমের শূন্যতা রয়ে যাওয়ার মূল কারণ তিনটি পার্বত্য জেলায় ভারত থেকে প্রত্যাগত উপজাতীয় পুনর্বাসিত জনসাধারণের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য গঠিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইন ২০০১’-এর বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা। ফজলে হোসেন বাদশা এমপি বলেন, এই সঙ্কট সমাধানের ব্যাপারে আমরা দ্রুততম সময়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আলাপ করব।
উল্লেখ্য, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইন ২০০১-এর ৫ ধারা অনুযায়ী কমিশনের চেয়ারম্যানের মেয়াদ ৩ বছর। এই পদে সর্বশেষ চেয়ারম্যান বিচারপতি খাদেমুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর মেয়াদ শেষে অবসরে যান ১৯ জুলাই ২০১২ সালে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত এই পদে কাউকে নিয়োগ দেয়া হয়নি। যে কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনের সকল কার্যক্রম স্থগিত হয়ে আছে গত দুই বছর। একই সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি অনুসারে ভারত প্রত্যাগত শরণার্থীদের মধ্যে প্রায় ১২ হাজার তালিকাভুক্ত শরণার্থীর ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির কাজ এখনও থমকে আছে। কমিশনে অন্তর্ভুক্ত তিন ক্যাটাগরির উপজাতি সদস্যদের কমিশনে অনুপস্থিতি এবং বিচার কাজের পুরো সময় অনুপস্থিতির কারণে সরকারের আন্তরিক সদিচ্ছা থাকার পরও ১৯৯৭ সালে সম্পাদিত শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন কমিশনের পক্ষে সম্ভব হয়নি বলে জাতীয় সংসদে গত ৩ জুলাই জানালেন শামসুর রহমান শরীফ এমপি।
ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, আশির দশকে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং তার পরবর্তীতে এরশাদ আদিবাসীদের বিতাড়িত করে বাঙালী সেটেলারদের পুনর্বাসিত করেছিল তিন পার্বত্য এলাকায়। প্রায় ১৫ হাজার আদিবাসীকে দেশে ফিরিয়ে স্বাভাবিক জীবন দেয়ার জন্য আওয়ামী লীগ শাসিত সরকারই উদ্যোগী হয়ে পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এই ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ শাসিত সরকার আদিবাসীদের জন্য যা কিছু মঙ্গলজনক তা করতে সচেষ্টÑ এই আস্থা এবং বিশ্বাস রাখতে হবে।
শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে প্রধান সঙ্কট তৈরি করেছে শান্তিচুক্তি নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ শাসিত সরকারের অভ্যন্তরে পরস্পরবিরোধী দুইটি মতÑ বললেন ইতিহাসবিদ এবং আদিবাসী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক অধ্যাপক মেসবাহ কামাল। তার মতে, সরকারের দায়িত্বশীল নীতিনির্ধারক এবং কর্মচারীদের মধ্যে দুই রকমের অভিমত রয়েছে। একটি অংশ মনে করে পার্বত্য শান্তিচুক্তি সর্বৈবভাবে বাস্তবায়ন প্রয়োজন, অন্য অংশটি মনে করে পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়িত হলে পাহাড়ে বসবাসরত বাঙালীদের স্বার্থ ক্ষুণœ হবে এবং জাতীয় স¦ার্থের সঙ্গে আপোস করা হবে। অধ্যাপক মেসবাহ কামালের মতে, দ্বিতীয় ধারার মতানুসারীরা আশু লাভালাভে অধিক গুরুত্ব দেয় এবং এক ধরনের জাতিভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতাকে প্রতিনিধিত্ব করে। এরা যথেষ্ট শক্তিশালী বলে, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের পথে এরা বড় অন্তরায় বলে মনে করেন অধ্যাপক মেসবাহ কামাল। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঘিরে এখানে কর্মরত এবং অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বিশেষ স্বার্থ তৈরি হয়েছে গত ৪০ বছরে। এদের সংখ্যা মুষ্টিমেয় হলেও তারা জাতীয়তাবাদী ছায়াকে তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষায় ব্যবহার করছে।
কখনও সভ্যতার উন্নয়ন, আবার কখনও সার্বভৌমত্ব রক্ষার নামে আদিবাসীদের বার বার উচ্ছেদ করা হয়েছে তাদের দখলকৃত ভূমি থেকে। শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করে ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তির ক্রমাগত লঙ্ঘন এবং ধারাবাহিক নিপীড়ন ঠেকাতে প্রয়োজনে যা করার করবÑ সময় বলে দেবে’Ñ বলে সরকারের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)। গত ১ জুলাই জাতীয় সংসদে প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড আইন-২০১৪ একতরফাভাবে পাস, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন সংশোধন এবং রাঙ্গামাটিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির চরম লঙ্ঘন করেছে দাবি করে এ কথা বললেন তিনি।
চুক্তি স্বাক্ষরের ১৭ বছর পরও চুক্তির মৌলিক বিষয় বার বার লঙ্ঘন করছে সরকার এমন অভিযোগ করে সরকারের পার্বত্য জনবিরোধী এই তিন উদ্যোগ বাতিল না করলে সরকারকে যে কোন অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির জন্য দায়ী থাকতে হবে বলে গত ১৪ মে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সন্তু লারমা।
চুক্তি স্বাক্ষরের ১৭ বছর পরও চুক্তির মৌলিক বিষয় পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম (উপজাতি) অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ, পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পরিষদ, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের আওতাধীন বিষয় ও কার্যাবলী কার্যকরকরণ এবং এ সব পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা, পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি, অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু এবং প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থীদের জায়গা জমি প্রত্যার্পণ ও পুনর্বাসন, সেনা শাসন অপারেশন উত্তরণসহ সকল অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার অস্থানীয়দের প্রদত্ত ভূমি ইজারা বাতিল করা, পার্বত্য চট্টগ্রামে সকল চাকরিতে জুম্মদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পার্বত্য এলাকার জুম্ম জনগণকে প্রতিষ্ঠার দাবি জানান সন্তু লারমা। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কিত কোন আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক পরিষদ এবং সংশ্লিষ্ট পার্বত্য জেলা পরিষদের সঙ্গে আলোচনা ও পরামর্শ সংবিধিবদ্ধ বাধ্যবাধকতা রয়েছে, যা লঙ্ঘন করেছে সরকার। গত ৭ জুলাই এক সাংবাদিক সম্মেলনে গবেষক শিক্ষাবিদ সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন. সরকারের সঙ্গে আমরা কোন বিরোধে জড়াতে চাই না। তবে বার বার নিরীহ আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা বন্ধ করতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে বাবুছড়ায় বিজিবি ক্যাম্প স্থাপনকে কেন্দ্র করে ১০ জুন আদিবাসী উচ্ছেদ ঘটনার গণতদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানানোসহ ৫টি সুপারিশ করা হয়।
এ প্রসঙ্গে ফজলে হোসেন বাদশা এমপি বলেন, আদিবাসী বিষয়ক ককাসের সঙ্গে বৈঠক করে এই দাবি পেশ করেছেন সন্তু লারমা। আমরা বিষয়টি গভীরভাবে পর্যালোচনা করছি। আবার আমরা সন্তু লারমার সঙ্গে বসব এবং সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা করে এই সঙ্কট দ্রুত নিরসনের চেষ্টা করব।
No comments:
Post a Comment