Wednesday, March 12, 2014

জঙ্গিরা মারে, রাষ্ট্রও মারে, কিন্তু বলা বারণ-শিলাদিত্য সেন


যে ভাবে স্বাধীন চোখে দেখা ও ক্যামেরায় তোলা এই দেশ ও দেশের মানুষ চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়, আমাদের বোধ-অনুভবে সঞ্চারিত হয়, তা মোটেও পছন্দ নয় আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক নেতৃত্বের।
১৩ মার্চ , ২০১৪, ০৪:০৫:০০
‘সেনগাদাল’ ছবির একটি দৃশ্য।
ট্রেনের টয়লেটে ঢুকে নিঃশব্দে কাঁদছিলেন লীনা মনিমেকলাই। ট্রেনটা তখন রামেশ্বরম-এর লম্বা রেল-সেতু পার হচ্ছে। একটু আগেই পুলিশ এসে তাঁকে ট্রেনে তুলে দিয়ে গেছে। রামনাথপুরমের পুলিশ চৌকি থেকে হুকুম হয়েছে: চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে রামেশ্বরম ছেড়ে চলে যেতে হবে। অপরাধ? লীনা ওই অঞ্চলে তামিল জেলে আর উদ্বাস্তুদের নিয়ে ছবির শুটিং শুরু করেছিলেন। সে কাজ অসম্পূর্ণ রেখে ফিরে যাওয়ার যন্ত্রণা থেকেই কাঁদছিলেন তিনি। পুলিশচৌকিতে কর্তব্যরত অফিসারকে প্রশ্ন করেছিলেন: এঁদের নিয়ে ছবি করাটা কি অপরাধ? উত্তর পেয়েছিলেন: তর্ক করলে জেলে ঢুকিয়ে দেব।
রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ছবি করছিলেন না লীনা। ছবি তুলতে গিয়েছিলেন সেই সব তামিল ধীবরকে নিয়ে, যাঁরা প্রায়ই নিখোঁজ হয়ে যান সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে, কিংবা ফিরে আসেন মৃত অবস্থায়। অঞ্চলটা রামেশ্বরম-এর ধনুষ্কোডি। এই ধনুষ্কোডি প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল ষাটের দশকের এক দানবিক ধূলিঝড়ে। শুধু কিছু ধ্বংসস্তূপ আর বালিয়াড়ি নিয়ে আজ দাঁড়িয়ে আছে, তার সংলগ্ন সমুদ্র আদতে সীমান্ত-সমুদ্র ভারত ও শ্রীলঙ্কার। এখান থেকে প্রায়ই মাছমারা’র দল যায় সমুদ্রে, মাছ ধরতে, আর প্রায়ই আক্রান্ত হয় শ্রীলঙ্কার নৌসেনাদের হাতে। কেউ কেউ বেঁচে ফেরেন ক্ষতবিক্ষত হয়ে, অনেকেই ফেরেন না, লাশ নিয়ে ভাসতে ভাসতে ফিরে আসে নৌকোগুলো। আর আসেন তামিল উদ্বাস্তুরা। শ্রীলঙ্কা থেকে উৎখাত হয়ে পুনর্বাসনের আশায় ঠাঁই গাড়েন ধনুষ্কোডিতে। সম্পন্ন যে-সব তামিল, তাঁরা কবেই, শ্রীলঙ্কায় তিন দশকের রক্তক্ষয় শুরু হওয়ার পরে পরেই চলে গিয়েছেন ইউরোপ বা কানাডায়। বাকি সব নিঃস্ব গৃহহীন, প্রায়ই চলে আসেন এখানে। এদের নিয়েই ছবি করছিলেন লীনা। বাদ সাধে আমাদের দেশের সরকার।
অনেকক্ষণ ধরে থানায় বসে ছবির ফুটেজ দেখিয়ে লীনা তামিল পুলিশ সুপারকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, তিনি আক্রান্ত তামিলদের ছবি তুলতে এসেছেন। চশমা-চোখে হাসি-হাসি মুখে পুলিশের বড়কর্তাটি কিছুতেই লীনার কথা বিশ্বাস করতে চান না। লীনা মেয়ে বলেই বোধহয় আরও বেশি সন্দিগ্ধ হয়ে খোঁজ নেন, এলটিটিই ছবি বানাতে কতটা সাহায্য করছে লীনাকে, সন্দেহ প্রকাশ করেন, ওই নিখোঁজ নিহত জেলে বা উদ্বাস্তুদেরও নিশ্চয়ই সাহায্য করে এলটিটিই!
এ সমস্তই ধরা আছে লীনার ‘সেনগাদাল’ বা ‘দ্য ডেড সি’ ছবিতে। লীনা মুখ্যত তথ্যচিত্রকার, এটি তাঁর প্রথম ফিচার-ছবি। গোটাটাই ঘটে-যাওয়া বাস্তব, ডকুমেন্টেশনের ধাঁচে তুলে এনেছেন, দরকারে আর্কাইভ থেকে ফুটেজও ব্যবহার করেছেন। ফলে দর্শককে সহ্য করতেই হবে, কী ভাবে মধ্যরাতে ভারতীয় নৌসেনাদের একটি দল এসে ধনুষ্কোডির তটে ঘুমন্ত উদ্বাস্তুদের উপর অত্যাচার চালায়, চেষ্টা করে মেয়েদের ধর্ষণ করতে। শ্রীলঙ্কার উপকূল যেহেতু এ-সমুদ্র থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে, ভারতীয় কূলরক্ষীরা, গোয়েন্দা দফতরের কর্মীরা, পুলিশ প্রশাসন ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরীহ ছিন্নমূল মানুষগুলোর ওপর। অন্য দিকে মাঝসমুদ্রে জেলেদের নৌকোয় উঠে, তাঁদের উলঙ্গ করে, গোপনাঙ্গে বন্দুকের নল দিয়ে খুঁচিয়ে তাঁদের রক্তাক্ত করে, বা চোখ বেঁধে গুলি চালিয়ে তাঁদের ‘খতম’ করে তবে স্বস্তি পায় শ্রীলঙ্কার নৌসেনারা। এই তামিলরা দুই রাষ্ট্রেরই চক্ষুশূল।
কিছু দিন আগে মাসখানেকের ব্যবধানে বার দু’য়েক কলকাতা ঘুরে গেলেন লীনা, সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট আর সল্টলেকে এক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ছবিটি দেখানোর সূত্রে। বছর দু’য়েক ধরে দেশে-বিদেশে নানা ফেস্টিভ্যালে ছবিটি দেখিয়ে চলেছেন, সম্মানও জুটছে সে সুবাদে। কিন্তু এই তামিল পরিচালকের সঙ্গে কথায়-কথায় জানা গেল, সেন্সর বোর্ড ছাড়পত্র দিতে নারাজ ছিল, কারণ ভারত ও শ্রীলঙ্কা দু’দেশের সরকারেরই নাকি অবমাননা হয়েছে এ-ছবিতে। অহিংস নিরস্ত্র অসহায় এই তামিলদের কাছে সেনাবাহিনী বা জঙ্গি দুইয়েরই হিংসাত্মক আক্রমণ যে সমান, তা কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে ওঠা যায়নি। ফলে আদালতের দ্বারস্থ হতে হয় লীনাকে, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ছাড়পত্র মেলে শেষ পর্যন্ত। হয়তো উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি রক্ষার খাতিরেই। হয়তো উদারতার একটা গর্ব আছে বলেই। কিন্তু এই কাহিনি বলে দেয়, ব্যক্তির বিরুদ্ধ-স্বরকে রাষ্ট্র মন থেকে মানতে পারে না।
লীনার এই অভিজ্ঞতার আয়নায় বলিউডকে নতুন করে চিনে নেওয়া যায়। ব্যক্তির বিরুদ্ধ-স্বরকে নগণ্য করে দেওয়ার জন্যে রাষ্ট্রের পক্ষে ক্রমপ্রসারিত ভূমিকা নিচ্ছে বলিউড। বলিউড তো ইন্ডাস্ট্রি, তার সঙ্গে সরকারের ব্যবসায়িক বিরোধ থাকলেও সরকার যে সামাজিক আদলে রাষ্ট্রকে সাজিয়ে নিতে চায়, তার বিরোধিতায় সাধারণত যায় না বলিউড। বরং চালু সামাজিক কাঠামোর অনুগত দর্শকরুচি তৈরি করে দিতে পারলেই বলিউডের ‘বাজার’ বজায় থাকে। ব্যক্তির স্বতন্ত্র স্বর নয়, সমষ্টির ক্ষমতাকেন্দ্রিকতাতেই তার বিশ্বাস। সিনেমার ভিতর দিয়ে রাষ্ট্রের আধিপত্যকামী আদর্শ বিস্তারে সদারত বলিউড এখন নানা ‘সামাজিক’ বিষয় তুলে আনছে তার ছবিতে।
গত অগস্টে, স্বাধীনতার মাসে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ম্যাড্রাস কাফে’র কথা এক বার মনে করুন। শ্রীলঙ্কায় তামিলদের পীড়ন-নিধন বা তাদের গৃহহীনতার সমস্যা এ-ছবির ভিত্তিভূমি, অথচ সারা ছবি জুড়ে ভারত সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের গুপ্তচর সংস্থা ‘র’-এর কার্যকলাপ, সেই ‘র’-এর তুখড় প্রতিনিধি জন আব্রাহাম তাঁর অতুলনীয় দক্ষতা সত্ত্বেও জঙ্গি ষড়যন্ত্রের হাত থেকে বাঁচাতে পারেন না প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে, আর সে-ব্যর্থতায় কেঁদে কেঁদে তাঁর চোখের জল শুকোয় না। জন এ-ছবির মূল অভিনেতা নন, প্রযোজকও, বলেছেন: ‘এ-ছবি প্রতিটি ভারতীয়ের দেখা উচিত শুধু এটা জানা বা বোঝার জন্যে যে ওই ঘটনা কী ভাবে ভারতের রাজনৈতিক চালচিত্র বদলে দিয়েছিল।’ শ্রীলঙ্কার ছিন্নমূল উদ্বাস্তু দরিদ্র তামিলদের অবলম্বন করে আসলে এ-ছবি ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষার প্রচার চালায়, জাতীয়তাবাদের জিগির-তোলা এক সমষ্টিবোধকে জনপ্রিয় করে তোলে।
ব্যক্তির স্বর যে বলিউড-শাসিত ভারতীয় সিনেমায় ক্রমশই কোণঠাসা, তার হাতে-নগদ হালফিল উদাহরণ অজিতা সুচিত্রা ভীরা-র ‘ব্যালাড অব রুস্তম’।
 রুস্তম প্রত্যন্ত মফস্সলের ছোট্ট সরকারি অফিসের সাধারণ কর্মী। দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি অফিসার থেকে রক্ষণশীল উচ্চবর্গের লোকজন নিয়েই তার দিনযাপন; তবু উন্নয়নের বাইরে পড়ে-থাকা সেই অঞ্চলের নির্জন নিসর্গ, মানুষজনের মুখ আস্তে আস্তে তার স্বপ্ন বা কল্পনার নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠে। এক ব্যক্তিমানুষের বেঁচে থাকার রাজনৈতিক ভাষ্য যেন এ-ছবি।
অজিতা তেলুগু, হায়দরাবাদের মেয়ে। ছবি নিয়ে কলকাতায় সিনে সেন্ট্রালের ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এসেছিলেন গত নভেম্বরে। লীনার মতো তিনি মূলত তথ্যচিত্রকার, এটিই তাঁর প্রথম ফিচার-ছবি। ইতিমধ্যেই ছবিটি দেখানো ও সম্মানিত হয়েছে নানা চলচ্চিত্র উৎসবে, এ-দেশ ও দেশের বাইরে, ঠাঁই পেয়েছিল অস্কার-এর প্রতিযোগিতাতেও। মুম্বইবাসী অজিতা সযত্নে বলিউড এড়িয়ে চলেন, নিজের গায়ে ‘উওম্যান ডিরেকটর’ লেবেল আঁটতে নারাজ, কথোপকথনে জানালেন, ‘হ্যাঁ, সামাজিক পরিচয়ে আমি এক জন (মেয়ে), কিন্তু সেটা আমার প্রাথমিক পরিচয় নয়। আমি এক জন ব্যক্তি, সেটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড়।’
কিন্তু চলচ্চিত্রোৎসব বাদ দিলে লীনা বা অজিতার ছবি কতটুকুই-বা সাধারণ্যে প্রদর্শিত হওয়ার সুযোগ পায়? তেমন কোনও ‘স্পেস’ তো রাখেনি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কারণটা শুধুই ব্যবসায়িক কিংবা আর্থনীতিক, না কি রাষ্ট্রীয় শাসন বজায় রাখার কোনও প্রচ্ছন্ন কৌশল? লীনা বা অজিতার মতো পরিচালকের স্বাধীন চোখে দেখা ও ক্যামেরায় তোলা এই দেশ ও দেশের মানুষ যে ভাবে চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়, যে ভাবে আমাদের বোধ-অনুভবে সঞ্চারিত হয়, তা মোটেও পছন্দ নয় আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক নেতৃত্বের। শাসক কিংবা বিরোধী যে পক্ষেই থাকুন-না-কেন তাঁরা, শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় প্রভুত্বেরই প্রতিনিধি তাঁরা। নিয়মমাফিক সংসদীয় নির্বাচনের পরেও বোধহয় তার কোনও ব্যত্যয় ঘটবে না।

No comments:

Post a Comment