Monday, March 10, 2014

নারী দিবসে দিই নারী-পুরুষের সমতার ডাক - সুমি খান

Robi

8 March 2014 18:30:00 PM Saturday BdST
0
 

নারী দিবসে দিই নারী-পুরুষের সমতার ডাক

সুমি খান, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
ফন্টের আকারDecrease fontEnlarge font
আজ ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। 'ইনস্পায়ারিং চেঞ্জ' বা 'পরিবর্তনকে উত্সাহিত করো’ -এই প্রতিপাদ্য নিয়ে আজ বিশ্বজুড়ে পালিত হবে দিবসটি। বাংলাদেশ সরকার দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে 'অগ্রযাত্রার মূল কথা নারী-পুরুষের সমতা'। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে 'রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে, নারীর সমতা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করি' প্রতিপাদ্য করে দিবসটি পালন করছে। সমাজকে এগিয়ে নিতে হলে রাজনীতি এবং ধর্মকে আলাদা করতেই হবে।সমাজপ্রগতির সংগ্রামে এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রের কঠোর পদক্ষেপ ছাড়া এর সফলতা সম্ভব নয়। 
আন্তর্জাতিক নারী দিবস (আদি নাম আন্তর্জাতিক কর্মজীবী নারী দিবস) প্রতি বছর মার্চের ৮ তারিখে পালিত হয়। বিশ্বব্যাপী নারীরা সমাজ প্রগতির ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল এবং  প্রধান উপলক্ষ্য হিসেবে এই দিবস উদযাপন করে থাকেন।এই দিবসটি উদযাপনের পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের লড়াকু এবং রক্তাক্ত সংগ্রামের ইতিহাস। সমাজপ্রগতির এই ইতিহাস অনেকের জানা। তবু এ সমাজের নীতিনির্ধারক এবং মাঠ পর্যায়ে দায়িত্বশীলেরা অনেকে এ বিষয়গুলো ইচ্ছে করেই যেন ভুলে থাকেন। তাই মগজে শান দিয়ে  মরচে সরানো এবং চিরপ্রণম্য ক্লারা জেটকিন ও তার সতীর্থ সহযোদ্ধাদের প্রতি হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানানোর  মানসে ইতিহাসের দ্বারস্থ হলাম।

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মজুরিবৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা। সেই মিছিলে চলে সরকারের লাঠিয়াল বাহিনীর দমন-পীড়ন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে নিউইয়র্কের নারী সংগঠন সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটের  পক্ষে আয়োজিত নারী সমাবেশে  জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির  অন্যতম স্থপতি সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হয়। এরপর ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের কোপেনহাগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন। এই সম্মেলনে ক্লারা  জেটকিন নারীর শ্রমঅধিকারের আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাস তুলে ধরে ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চকে মানবসমাজের বিজয়ের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্যে প্রতি বছর ৮ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন।  সেই প্রস্তাবের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হয়, ১৯১১ সাল থেকে নারীদের সমানাধিকার দিবস হিসেবে ৮ মার্চ দিনটি পালিত হবে। দিবসটি পালনে এগিয়ে আসে  পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সমাজতন্ত্রীরা। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ পালিত হতে লাগলো। বাংলাদেশেও  স্বাধীনতার লাভের আগেই  ১৯৭১  সাল থেকেই এই দিবসটি পালিত হতে শুরু করে। বিশ্বের অনেক দেশে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারী ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। 
আফগানিস্তান, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান,বেলারুশ,বুরকিনা ফাসো, কম্বোডিয়া, কিউবা, জর্জিয়া, গিনি-বিসাউ,  ইরিত্রিয়া, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান,  লাওস, মলদোভা, মঙ্গোলিয়া,মন্টিনেগ্রো, রাশিয়া,তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান,  উগান্ডা, ইউক্রেন, উজবেকিস্তান,  ভিয়েতনাম এবং জাম্বিয়াতে। এছাড়া, চীন,মেসিদোনিয়া, মাদাগাস্কার,নেপালে শুধুমাত্র নারীরা সরকারী ছুটির দিন ভোগ করেন। 

দৈনিক শ্রমঘণ্টা ১২ থেকে কমিয়ে আট ঘণ্টায় আনা, ন্যায্য মজুরি এবং কর্মক্ষেত্রে সুস্থ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবিতে আন্দোলন করার অপরাধে  ১৮৫৭ সালে  নিউইয়র্কে কতো নারী আটক হন, তার পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। তবে কারাগারে ও নির্যাতিত হন অনেক নারী শ্রমিক। তিন বছর পরে ১৮৬০ সালের একই দিনে গঠন করা হয় 'নারী শ্রমিক ইউনিয়ন'। ১৯০৮ সালে পোশাক ও বস্ত্রশিল্পের কারখানার প্রায় দেড় হাজার নারী শ্রমিক একই দাবিতে আন্দোলন করেন। অবশেষে আদায় হলো দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ করার অধিকার। সারাবিশ্বে দিবসটি আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালিত হয়। জাতিসংঘ ১৯৭৫ সালে আন্তর্জাতিক নারীবর্ষে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন শুরু করে। 

এরও বহু আগে ১৯১০ সালের এই দিনে ডেনমার্কের কোপেনহাগেনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক সম্মেলনে জার্মানির নেত্রী ক্লারা জেটকিন ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করলে ৬০ বছর আগের পটভূমির বিজয় অর্জিত হয়। তবে যে দাবিতে এই আন্দোলন সমতাভিত্তিক  এবং বৈষম্যহীন কাজের পরিবেশ এখনো আমাদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয় নি। তাই সেই আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে এখনো।

 সমাজ প্রগতির সংগ্রামে  ৮ মার্চ রক্তাক্ত ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল দিন। এমন দিনে মুক্তির মন্দির সোপানতলে যারা প্রাণ দিয়েছে, তাদের স্মরণ করা আমাদের প্রতিটি নারী-পুরুষের ই দায়িত্ব বলে আমি মনে করি। 

যারা ৮ মার্চ কে  নারীকে ‘সুবিধা দেয়ার জন্যে’  বা ‘নারীকে করুণা’ করে ‘বিশেষ কোন দিবস'’ পালন করা হচ্ছে মনে করেন- এখনই তাদের ভুল ভাঙ্গা প্রয়োজন। সে নারী বা পুরুষ যেই হোন-তাদের বিনীত অনুরোধ করি, নারীদিবসের ইতিহাস পড়ুন। অনুধাবন করুন বাস্তব ইতিহাস। যে রক্তাক্ত অধ্যায়ের পরিপ্রেক্ষিতে নারী দিবস প্রবর্তন, তার প্রতি  অশ্রদ্ধা পুষে রেখে নারীর প্রতি কোনো বিরূপ চিন্তা সমাজের জন্যে ক্ষতিকর। 

এ কথা গুলোর অবতারণা করছি যৌক্তিক কারণে। নারী  দিবস নিয়ে  সাক্ষাৎকার এবং আলোচনায়  অনেকেই এই দিবস পালনের চরম বিরোধিতা করেন বিভিন্ন সময়ে। এমন কি দেশের সাংবাদিকতায় সুপ্রতিষ্ঠিত অনেক নারীও বলেন, নারীদের জন্যে তারা আলাদা কোন দিবস চান না। এই নারীদের প্রতি বলতে হয় প্রথমতঃ অনেক নারীর  প্রতি নিপীড়ন , রক্তপাত,  তাদের ক্লান্তিহীন  শ্রম,মেধা আর রাজপথ কাঁপানো আন্দোলনের ফসল  সফল নারীদের আজকের এই রমরমা অবস্থা!

‘শুধু নারীর জন্য কোনো একটি দিন’ (?) পালন করে পুরুষের অধিকার খর্ব  (?) করা হচ্ছে মনে করলে ইতিহাস বিকৃতি হবে। ১৮৫৭ সাল থেকে ১৯৭৫ সালের জাতিসংঘের স্বীকৃতি পর্যন্ত যাদের আত্মদানের ফসল এই মহান নারী দিবস- এই রক্তক্ষয়ী অধ্যায়ের প্রতি বিন্দুমাত্র অশ্রদ্ধা বা অজ্ঞতা প্রায় দু’শো বছর আগের এই দিনে  অধিকার আদায়ের সংগ্রামে রাজপথে প্রাণ দিতে প্রস্তুত  অকুতোভয় বীর নারী এবং যোদ্ধাদের মহান আত্মদানের প্রতি চরম অবমাননা করা হবে !! 

সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে এই দিনে  চেনা অচেনা প্রতিটি নারীকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান পুরুষেরা।  নারীরা সরকারী ছুটি উপভোগ করে প্রিয়জন এবং সন্তানদের সময় দেন। বিজয়ের আনন্দে নারী –পুরুষ একসাথে উদ্ভাসিত হন। আমাদের সমাজে তার কোনো ছায়া নেই। বর্তমান বাম নেতা-কর্মীদেরও সেই চিন্তা চেতনায় উদ্ভাসিত হতে দেখি না। এ-এক ক্রান্তিকাল যাচ্ছে আমাদের। ইতিহাসের দিকে পিঠ ফিরে থাকা প্রজন্ম যেন কোনো এক কালো দিনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে জাতিকে; দূর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে আলোর নিশানা।

সবচেয়ে কষ্ট হয় যখন দেখি  কোনো দল বা মতের বিরোধিতা করতে গিয়ে ফেসবুকে চরম অশ্লীলভাবে আক্রমণ করা হয় নারীদের। মতের বিরোধিতা থাকতে পারে, পথ ভিন্ন হতে পারে , তাই বলে কোনো নারীর প্রতি অশালীন বা বিরূপ মন্তব্য করা যে কারোর চরম মানসিক বিকারের পরিচয়-- এই সাধারণ সত্যটা এ সমাজে প্রতিষ্ঠা হতে আর কতো সময় লাগবে?

বর্তমান সরকার নারীর জাগরণে এবং উন্নয়নে অনেক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।  তবে অনেক পিছিয়ে থাকা মানসিকতা থেকে নিজেদের বের করে আনতে গোড়া থেকে  কাজ করতে হবে। 

 নারীর বিজয় মানবতার বিজয়। এই ইতিহাসের সঠিক প্রচার এবং প্রকাশ  নারীর প্রতি শ্রদ্ধা এবং সম্মান প্রতিষ্ঠায় জরুরি। রাজধানী  থেকে প্রত্যন্ত জনপদ পর্যন্ত  পথে প্রান্তরে   নারী জাগরণের এবং সমাজ প্রগতির প্রতিটি ইতিহাস পর্যালোচনা এবং প্রচার একটু একটু করে বদলে দেবে নারীর প্রতি সমাজের রক্ষণশীলতাকে।

 পরিশেষে উদাত্ত আহ্বান জানাই , নারী দিবস নিয়ে যারা এখনো ভুল ধারণা পোষণ করে আছেন –তারা অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করুন শ্রমজীবী নারীদের আত্মদানের এই দিনটিকে। আপনার পাশের নারীটি আপনার বন্ধু , সহযোদ্ধা । আপনার সর্বোচ্চ সহযোগিতা এবং সম্মান  তার প্রাপ্য; করুণা বা অশ্রদ্ধা নয়।  তবেই নারী তার মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় পুরুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং অনুপ্রেরণা নিয়ে সমাজকে এগিয়ে নেবে।তেমনি নারীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, প্রেরণা আর শক্তিতে পুরুষ এগিয়ে নেবে সমাজকে। আলোকের ঝর্নাধারায় ধুয়ে যাক্ যতো কলুষ, যতো ফাঁকি, যতো  গ্লানি !

 নারী-পুরুষ একসাথে  অনন্ত গৌরবে এগিয়ে যাক্ সমাজপ্রগতির পথে!  নারী দিবস ২০১৪ সফল হোক্!!  Sumikhan29bdj@gmail.com
৮ মার্চ ২০১৪

বাংলাদেশ সময়: ১৮২০ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০১৪
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
0
 
Bookmark and Share
- See more at: http://www.banglanews24.com/new/%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%80%E0%A7%9F/273184-%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%80-%E0%A6%A6%E0%A6%BF%E0%A6%AC%E0%A6%B8%E0%A7%87-%E0%A6%A6%E0%A6%BF%E0%A6%87-%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%80-%E0%A6%AA%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A7%81%E0%A6%B7%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%A1%E0%A6%BE%E0%A6%95.html#sthash.f1Hu1fLz.dpuf

No comments:

Post a Comment