Wednesday, March 20, 2013

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পর জিল্লুর রহমানই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি ছিলেন পুরোদস্তুর রাজনীতিক



চার দশকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রপতি পদে ১৫ ব্যক্তিকে পেয়েছে। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পর জিল্লুর রহমানই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি ছিলেন পুরোদস্তুর রাজনীতিক।


দেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেয়া জিল্লুর রহমানের রাজনীতিতে পদার্পণ স্কুলজীবনে।

তারপর দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলে রাষ্ট্রপতির পদে অধিষ্ঠিত হন তিনি। সেই পদে থেকেই বুধবার মারা গেলেন তিনি।

বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য জিল্লুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডাকতেন চাচা, আওয়ামী লীগে তার অবস্থান ছিল অভিভাবকের মতোই।

শুধু আওয়ামী লীগই নয়, রাজনৈতিক অঙ্গনে তাকে অভিভাবক মানতে কারোই আপত্তি ছিল না। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে তার ডাকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাড়া দেয়া তার নজিরই মেলে ধরে।
শোকবার্তায় তাই বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া বলেছেন, “জিল্লুর রহমান ছিলেন, মিতবাক, ভদ্র, নম্র একজন ভালো মানুষ। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের সম্পর্কে তিনি কখনো আক্রমণাত্মক ও অশালীন মন্তব্য করতেন না।”

দলীয় নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্যের নজিরও ছিলেন জিল্লুর রহমান। নিজের দুঃসময় উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন তিনি।

আর তাই স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যাকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন, দুই দশক পর সেই একই ব্যক্তির ওপর নির্ভরতা খুঁজে নেন বঙ্গবন্ধুকন্যা হাসিনা।

২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার মধ্যে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যাওয়ার আগে শেখ হাসিনা দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করে যান জিল্লুর রহমানকেই।

মৃত্যুতে শোকবাণীতেও শেখ হাসিনা সেই অবদান স্মরণ করে বলেন, “এক-এগারোর চরম দুঃসময়ে জিল্লুর রহমান দলের হাল ধরেছিলেন, তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ আমাকে জেলখানা থেকে মুক্ত করে এনেছিল।”

জিল্লুর রহমানের জন্ম ১৯২৯ সালের ৯ মার্চ কিশোরগঞ্জের ভৈরবে। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে ওই এলাকা থেকে নির্বাচিত হওয়ার পর সব সময় ওই আসন থেকে নির্বাচন করে আসছিলেন তিনি।

ভৈরব থেকে ১৯৭৩, ১৯৮৬, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জিল্লুর রহমান। তিনি রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর ওই আসনে এখন প্রতিনিধিত্ব করছেন ছেলে নাজমুল হাসান।

ছাত্রজীবনেই জিল্লুর রহমান রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ভাষা আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে অনার্সসহ এমএ ও এলএলবি ডিগ্রি নিয়ে ১৯৫৪ সালে আইন পেশায় যোগ দেয়ার প্রস্ততি নেন আইনজীবী মেহের আলী মিঞার ছেলে জিল্লুর রহমান।

তবে আইনজীবী হওয়ার চেয়ে তার ঝোঁক বেশি ছিল রাজনীতিতে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৬ সালে তিনি কিশোরগঞ্জ মহকুমা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হন।

ষাটের দশকে ঢাকা জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেও রাজপথই ছিল তার ঠিকানা।

তবে ২০০৭ সালের শেখ হাসিনাকে কারামুক্ত করতে মুজিব কোট কিংবা পাঞ্জাবির বদলে গাউন পরে সংসদ ভবনের বিশেষ আদালতে দেখা গিয়েছিল তাকে।
১৯৬২ সালের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ’৬৬ এর ৬ দফা আন্দোলন, ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয়তা ১৯৭০ সালে তাকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন এনে দেয়।

এরপর একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জিল্লুর রহমানও তাতে যোগ দেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পরিচালনা এবং জয় বাংলা পত্রিকার প্রকাশনায় যুক্ত ছিলেন তিনি।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগের প্রথম সম্মেলনে অনেক নেতাকে ছাপিয়ে জিল্লুর রহমানই হন দলের সাধারণ সম্পাদক।

এরপর বিভিন্ন দায়িত্বের পর ১৯৯২ সালে পুনরায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। দুই দফা এই দায়িত্ব পালনের পর সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন অনেক দিন।

১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করলে তার মন্ত্রিসভায় স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর দায়িত্ব পান তিনি, ছিলেন সংসদ উপনেতাও।

রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার আগে নবম জাতীয় সংসদেও সংসদ উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন জিল্লুর রহমান। তিনি রাষ্ট্রপতি হলে ওই পদে আসেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী।

আপাদমস্তক রাজনীতিক জিল্লুর রহমানের বিয়েতেও রাজনীতি ছিল বিষয়। অভিজাত পরিবারের সন্তান আইভী রহমানের সঙ্গে দল করার সূত্রে পরিচয়, এরপর পরিণয়। তবে তাদের দুজনকে এক করতে দুই পরিবারকে রাজি করাতে উদ্যোগ নিতে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে।

সক্রিয় রাজনীতিক আইভী রহমান ছিলেন নিজের পরিচয়েই পরিচিত। আওয়ামী লীগের পাশাপাশি দেশের নারী আন্দোলনের নেত্রীও ছিলেন তিনি।

২০০৪ সালে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে গ্রেনেড হামলায় নিহত হন আইভী, রেখে যান স্বামী জিল্লুর, ছেলে নাজমুল হাসান এবং দুই মেয়ে তানিয়া বখত ও তনিমা বখতকে।
স্ত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যুতে অনেকটাই ভেঙে পড়েন জিল্লুর, তবে রাজনীতিতে সক্রিয়তা নষ্ট হয়নি তার।

বরং ২০০৬ এর শেষ দিকে রাজনৈতিক সঙ্কট এবং জরুরি অবস্থার সময় প্রবীণ অনেক রাজনীতিকের অবস্থান বদলে গেলেও দল ও নেতৃত্বের প্রতি অবিচল আস্থা এতুটুকুও কমেনি জিল্লুর রহমানের।

এরপর ২০০৭ সালে শেখ হাসিনা গ্রেপ্তার হলে টানাপোড়েনের মধ্যে আওয়ামী লীগের অভিভাবকত্ব নিতে হয় অশীতিপর এই নেতাকে।

আর সেই ঝড় তিনি ঠিকভাবেই সামাল দিতে পেরেছিলেন বলে মনে করেন শেখ হাসিনা। তাই শোকবার্তায় তিনি বলেছেন, “বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ইতিহাসে জিল্লুর রহমান অবিনশ্বর হয়ে থাকবেন।”

No comments:

Post a Comment