Tuesday, March 31, 2015

এই 'বোকা মানব' টি কে কারা হত্যা করলো? সুমি খান

"গ্রামে ও শহরে মিশ্রভাবে বসবাসের ফলে আমার মধ্যে একধরনের সংমিশ্রণ ঘটেছে। না হতে পেরেছি শহরের স্মার্ট, মেধাবী, অতি আধুনিক, না হতে পেরেছি গ্রামের পরিশ্রমী, গেছো, ভালো সাঁতারু। দুই স্থানেই আমি একজন অতি বোকা। তাই আমি আজ বোকা মানব।" 'বোকা মানব' নামে একটি ব্লগে নিজের সম্পর্কে এভাবেই আত্মবিশ্লষণ করেছিলেন ওয়াশিকুর বাবু ।অভিজিতের হত্যা তাকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিলো ।নিজের ফেসবুকে তাই বাবু কভার ফটো করছিলো, 'আমিই অভিজিৎ'
 
আত্মবিশ্লেষনে নিজের সম্পর্কে ব্লগে প্রকাশিত একটি লেখায় ক্ষণজন্মা ওয়াশিকুরের গভীর অনুধাবন ফুটে ওঠে। তিনি লিখেছেন, ‘আমার নাম মো. ওয়াশিকুর রহমান। জন্ম গ্রামে হলেও শৈশব কেটেছে ঢাকায়। তবে আট বছর বয়সের সময় বেশ কিছুদিন গ্রামে কাটাতে হয়। তারপর বছর দুয়েক মফস্বল শহরে কাটিয়ে আবার ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করি। কিন্তু মাস ছয়েক না কাটতেই আবার গ্রামে ফিরে যেতে হয়। একটানা ছয় বছর গ্রামে কাটিয়ে পুনরায় ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করি। এখন পর্যন্ত ঢাকাতেই আছি। এভাবে গ্রামে ও শহরে মিশ্রভাবে বসবাসের ফলে আমার মধ্যে একধরনের সংমিশ্রণ ঘটেছে। না হতে পেরেছি শহরের স্মার্ট, মেধাবী, অতি আধুনিক, না হতে পেরেছি গ্রামের পরিশ্রমী, গেছো, ভালো সাঁতারু। দুই স্থানেই আমি একজন অতি বোকা। তাই আমি আজ বোকা মানব।এই ব্লগে তিনি সর্বশেষ ২০১১ সালের ১৭ জানুয়ারি বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান নিয়ে একটি লেখা পোস্ট করেছেন।
এখন প্রশ্ন , এই 'বোকা মানব' টি’কে কারা টার্গেট করলো?কারা এই ঘাতক?
 চট্টগ্রামের  দারুল উলুম মুইনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার তফসির বিভাগের ছাত্র জেএমবি জঙ্গী জিকরুল্লাহ কে শনিবার রাজধানীতে আসতে কে  নির্দেশ দিয়েছিলো?  যে 'বড়ো ভাই' মাসুম  রবিবার বিকেলে হাতির ঝিলে তাহের ,আরিফুল এবং জিকরুল কে ডেকে তিনটি চাপাতি দেয়  এবং  ওয়াশিকুর বাবুর ছবি দেখিয়ে বাবুকে হত্যার 'ঈমানী দায়িত্ব'দেয়, তার প্রকুত পরিচয় কী?? এ প্রশ্ন খুঁজে ফিরছেন গোয়েন্দারা ।
নিহত ওয়াশিকুরের চোখ এবং মুখ বরাবর সমান্তরাল দুইটি কোপে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে মুখমন্ডলের দুইটি অংশ। পুলিশ জানায়, হামলাকারীরা নিহত ওয়াশিকুরের শরীরের শুধু মুখমণ্ডল ও গলাসহ শরীরের ঊর্ধ্বাংশে আঘাত করেছিলেন। তাঁর মুখমণ্ডল ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। চোখ, নাক থেঁতলে চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে। প্রচুর রক্তক্ষরণে ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
 প্রশ্ন উঠেছে কেন এবং কোথা থেকে নিরীহ, শান্ত  তরুণ ওয়াশিকুরকে খুন করার নির্দেশ এসেছে ? যাঁকে হত্যা করা হলো, তিনি কোথায়, কী লিখেছেন? কিছুই জানা ছিল না খুনিদের।
‘ধর্মের অবমাননা’ করেছে এমন অভিযোগ এনে ওয়াশিকুর এর ছবি দেখিয়ে,তার বাসার পথ চিনিয়ে  তাকে হত্যা করার জন্যে ঘাতকদের হাতে চাপাতি তুলে দেয়া হয়েছে । আর সেটা দিয়ে কুপিয়ে নিরীহ এক তরুণকে প্রকাশ্য দিবালোকে নিঃশঙ্ক চিত্তে  নির্বিঘ্নে  হত্যা করেছে তিন তরুণ। প্রথম চাপাতির কোপ দেয় তাহের। দ্বিতীয় চাপাতির কোপ দেয় জিকরুল।এর মধ্যে জনরোষের মুখে  আরিফুলের চাপাতি আর ব্যবহার করা হয়নি।দুই কোপেই ব্লগার ও অনলাইন লেখক ২৭ বছরের তরুণ ওয়াশিকুর রহমানের চোখ এবং মুখ বিভক্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে । ওয়াশিকুরকে হত্যার পর পালিয়ে যাওয়ার সময় ধরা পড়া দু'জনের একজন জিকরুল তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা হাজতে এই প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে  একথা জানায়।
 
 টেলিভিশনের স্ক্রলে ওয়াশিকুর বাবু হত্যার সংবাদ জেনে তার শুভানুধ্যায়ী বন্ধুদের অনেকে  ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে  উপস্থিত হয়েছেন । সোমবার দুপুর থেকে লাশ বাড়িতে নেয়া পর্যন্ত বসেছিলেন তাদের একজন ওয়াশিকুরের পাতানো বোন তামান্না সেতু । এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন,  তার শুক্র এবং শনিবার অফিস খোলা, ওয়াশিকুরের সেদিন আফিস বন্ধ। তাই অনেক;ইন দেখা হয় নি। ২৫ মার্চ শেষবারের মতো তার সাথে ফেসবুকে আলাপ হয় ওয়াশিকুরের সাথে। সেদিন ওয়াশিকুর খুব বলছিলো, "দিদি, ভর্তা দিয়ে ভাত খেতে ইচ্ছে করছে খুব। আপনি কবে সময় দেবেন, আপনার সাথে ভাত খেতে ইচ্ছে করছে অনেক ।" ভাই হারানোর শোকে  শোকাহত সেতু  বলেন," সেদিন কেন যেন কোন রিপ্লাই দেয়া হয় নি। আর কখনো আমার কাছে ভর্তা দিয়ে ভাত খেতে চাইবে না বাবু, এটা কী করে ভাবা যায়? " তিনি জানান, কয়েক বছর ধরে ওয়াশিকুর ফেসবুকে আসুন নাস্তিকদের কটূক্তির দাঁতভাঙা জবাব দেই...শিরোনামে একটি ব্যঙ্গাত্মক লেখা ১০৩ পর্ব পর্যন্ত লিখেছেন। ওই লেখায়  ওয়াশিকুর বিভিন্ন ধর্মীয় রীতি-নিয়ম নিয়ে বাড়াবাড়ি যারা করে , তাদের  খণ্ডন করার চেষ্টা করেছেন । তামান্না সেতুসহ ওয়াশিকুরের বন্ধুরা জানিয়েছেন, অভিজিৎ খুন হওয়ার পর ভীষণ মুষড়ে পড়েন ওয়াশিকুর। তাঁর লেখায় তিনি এর প্রতিবাদ জানান। তখন বন্ধুরা তাঁকে সাবধান করেছিলেন। জবাবে ওয়াশিকুর বলেছিলেন, ‘আমি তো প্রোফাইল পিকচারও দেইনি। আমারে চিনবে ক্যামনে।  তামান্না সেতুর দু'চোখে জলের নীরব ধারা। বললেন,‘ও এমন কিছু লিখত না, যার জন্য কুপিয়ে মেরে ফেলতে হবে। আমরা জানি না, এরপর কার পালা।
 
 হত্যার ঘটনা সম্পর্কে পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সোমবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের দক্ষিণ বেগুনবাড়ী দীপিকার মোড়ে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ওয়াশিকুরকে। জিকরুল্লাহ, আরিফুল এবং তাহের এ হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নীলচে ফুলশার্ট ও জিনস পরিহিত ওয়াশিকুর দীপিকার মোড়ের দিকে যেতেই গলির মধ্যে তিনজন লোকের মধ্যে দুজন তাকে অতর্কিতে কোপাতে শুরু করে। পাশেই কয়েকজন হিজড়া দাঁড়ানো ছিলো।কয়েকজন নারী সহ হিজড়ারা চিৎকার করতে থাকেন । 'কোপাইয়া মাইরা ফেললো, কোপাইয়া মাইরা ফেললোচিৎকার শুনে হামলাকারী দুজন ঘটনাস্থলেই চাপাতি ফেলে দৌড় দেয়। এ সময় হিজড়ারা ঘাতকদের পিছু ধাওয়া করে। এলাকার লোকজনও ধাওয়া করে। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা পুলিশের একটি দল টহল দিচ্ছিলো।তারাও দৌড়ে ধাওয়া করে। হিজড়ারা প্রথমেই জিকরুল্লাহকে ধরে ফেলে। এরপর জনতা ও পুলিশ মিলে প্রায় এক কিলোমিটার ধাওয়া করে একটি ব্যাগসহ আরিফুলকে ধরে ফেলে। খুনের পর রক্তের দাগ যেন বোঝা না যায়, সে জন্য পরিকল্পিতভাবে তাঁরা লাল পোশাক পরে হত্যা করতে যায়। জিকরুল্লাহর পরনে ছিল লাল ডোরাকাটা টি-শার্ট, জিন্স, পায়ে কাপড়ের কেডস। আর আরিফুলের পরনে ছিল লাল টি-শার্ট, কালো প্যান্ট ও স্যান্ডেল। পুলিশ জানিয়েছে, এই দুজনের লাল গেঞ্জির নিচেই আরেকটি গেঞ্জি ছিল। চাপাতির ব্যাগের ভেতরে অতিরিক্ত পাঞ্জাবি ছিল।  পোশাক বদলে সাধারণ মানুষের সাথে  মিশে যাওয়ার জন্য কৌশল করে দুই স্তরের পোশাক পরেছিলো তিন ঘাতক। ঘটনাস্থলে থাকা দু'জন হিজড়া, স্থানীয় ব্যক্তিরা ও পুলিশ ধাওয়া করে দু'জনকে ধরে ফেলে। ঘাতকদের বয়স ২০ থেকে ২৫-এর কোঠায়।
বিজ্ঞানগবেষক অভিজিৎ রায় খুনের এক মাস পর ওয়াশিকুরকে হত্যা করা হলো। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় অভিজিৎকে। এ সময় তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে কুপিয়ে জখম করে  প্রত্যক্ষদর্শী  ও পুলিশের সামনেই পালিয়ে যায় খুনিরা। এর আগে ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মিরপুরে একই কায়দায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে। একই বছরের ১৪ জানুয়ারি রাতে একইভাবে কুপিয়ে আহত করা হয় ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীনকে। রাজীব হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে  জামায়াত নেতা এবং জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টীমের  প্রধান মুফতি মুহাম্মদ জসীমউদ্দিন রাহমানীসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ২৯ জানুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ । মামলাটি এখন বিচারাধীন। ব্লগার আসিফের ওপরও একই সংগঠন হামলা করেছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ।
১৫ নভেম্বর ২০১৩ বিকেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শফিউল ইসলামকে প্রকাশ্য দিবালোকে তার বাড়ির সামনে  একইভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এই হত্যার পর আনসার আল ইসলাম বাংলাদেশ-২নামের একটি ফেসবুক গ্রুপে দায় স্বীকার করে স্ট্যাটাস দেয়া হয়। আর সর্বশেষ অভিজিৎ হত্যার পর আনসার বাংলা সেভেননামের একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে হত্যার দায় স্বীকার করা হয়। একজন হুমকিদাতাকে গ্রেপ্তার ছাড়া পুলিশ আর কাউকেই সনাক্ত করতে পারে নি।
 
ওয়াশিকুর বাবুর তিন ঘাতকের মধ্যে ঘটনাস্থল থেকে গ্রেপ্তার হওয়া দু'জনের মধ্যে জিকরুল্লাহ চট্টগ্রামের দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্র ,আরিফুল রাজধানীর মিরপুরের দারুল উলুম মাদ্রাসার ছাত্র বলে জানায়। জিকরুল্লাহর বাড়ি নরসিংদী, আরিফুলের কুমিল্লা। জিকরুল্লাহ কখনো ওয়াশিকুরকে দেখেনি। তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত কোনো শত্রুতা নেই। ওয়াশিকুর কোথায়, কী লিখেছেন, তা-ও জানে না। তাদের 'বড়ো ভাই'  মাসুম ভাইয়ের কথাতেই তারা ওয়াশিকুরকে হত্যা করেছে।। তাঁরা কোনো ধর্মীয় বা রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত কি না, জানতে চাইলে জিকরুল্লাহ বলেন, ‘আমাদের কোনো দল নাই।তাদের 'বড়ো ভাই' বা 'মাসুম ভাইয়ের পরিচয় জানতে চাইলে তারা জানে না বলে জিকরুল্লাহ।
 
তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় জিকরুল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, তার পূর্বপরিচিত মাসুম ভাইর কথামতো শনিবার তিনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসেন। যাত্রাবাড়ীর দিকে এক মাদ্রাসায়  রাত কাটায়। রোববার বিকেলে হাতিরঝিল লেকের পাড়ে  ডেকে ওয়াশিকুরকে হত্যার দিকনির্দেশনা দেয় তাদের মাসুম ভাই  জিকরুল্লাহ, আরিফুল ও তাহের মিলে প্রথম বারের মতো তখন আলোচনা হয়। সহযোগী ঘাতক আরিফুল এবং  তাহেরকে চিনতোনা জিকরুল। হাতির ঝিলেই তাদের প্রথম দেখা। ওয়াশিকুরের ছবি দেখিয়ে মাসুম তাঁদের  বলে, এই লোক মহানবী (সা.)-এর অবমাননা করেছে, আল্লাহ ও ইসলামকে নিয়ে কটূক্তি করেছেন। তাকে হত্যা করতে হবে। এরপর মাসুম তাদের নিয়ে হাতিরঝিলের কাছাকাছি দক্ষিণ বেগুনবাড়িতে ওয়াশিকুরের বাসা দেখিয়ে দেন।
 
ওয়াশিকুর কখন বাসা থেকে অফিসে যান, কোন্ দিক দিয়ে কীভাবে হামলা করা হবে, সেসব বুঝিয়ে দেয় 'মাসুম'। ওয়াশিকুরের বাসার আশপাশের এলাকা চিনে নেয় ঘাতকেরা। মাসুম তাঁদের তিনজনকে তিনটি চাপাতি দেয়।
 
'মাসুম' এর  নির্দেশনা অন্ধের মতো অনুসরণ করে  মাথায় সাদা টুপি পরে সোমবার সকালে তিন ঘাতক রাজধানীর দক্ষিণ বেগুনবাড়ি দীপিকার মোড়ে অবস্থান নেয়। ওয়াশিকুর অফিসে যাবার পথে  জিকরুল্লাহ ও তাহের চাপাতি বের করে কোপ দেয়। আরিফুল চাপাতি বের করার আগেই স্থানীয় মানুষ ধাওয়া দেয়। চাপাতিসহ ব্যাগ পিঠে ছুটে পালাবার সময়ে আরিফুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার সূর্যবার্তা টোয়েন্টিফোরকে বলেন,   ওয়াশিকুরের লেখার কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে একটি গোষ্ঠী এই হত্যার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করে বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এই হত্যার ধরনের সঙ্গে অভিজিৎ রায়, রাজীব হায়দার হত্যার মিল রয়েছে মনে করছে পুলিশ ।
 
নিহত ওয়াশিকুর বাবু  লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জের টিপু সুলতানের একমাত্র পুত্র। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। ২০০০ সালে তার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ ঘটে যায় । ওয়াশিকুর বাবু তার বাবার সাথেই থাকতো।২০০৬ সালে এসএসসি পাশ করেন।তেজগাঁও কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাসে স্নাতক  করে  মতিঝিলে ফারইস্ট এভিয়েশন নামে একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে শিক্ষানবিশ হিসেবে চাকরি করতো। এই প্রতিষ্ঠানে ওয়াশিকুরের খালা চাকরি করতেন । তিনিই ওয়াশিকুর কে এই চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। সামান্য বেতনের চাকুরে ওয়াশিকুর তার বাবার সাথে  দক্ষিণ বেগুনবাড়িতে  ৭ হাজার টাকা দিয়ে একটি রুম ভাড়া নিয়ে থাকতেন।। ওয়াশিকুরের অফিস যেতে দেরি দেখে ফারইষ্ট এভিয়েশন থেকে ওয়াশিকুরের মোবাইলে ফোন করলে পুলিশ রিসিভ করে সেই ফোন। এর পর ফারইষ্ট এভিয়েশন থেকেই বাবুর খালাকে ফোন করে বাবুর নিহত হবার সংবাদ জানায়। সেই সংবাদ শুনে আত্মীয় স্বজন মর্গে ছুটে আসেন। সোমবার সকালেই বাড়ি গেছেন ওয়াশিকুরের বাবা টিপু সুলতান। ছেলে হত্যার সংবাদ শুনে বারবার জ্ঞান হারাচ্ছিলেন টিপু সুলতান। এ কারণে তাঁর আর রাজধানীতে আসা সম্ভব হয়নি। একমাত্র পুত্রের প্রাণহীণ দেহ গ্রামে  নেবার জন্যে জামাতাকে রাজধানীতে পাঠিয়েছেন তিনি।

Thursday, March 5, 2015

অভিজিৎ-হত্যা, ধর্ম-ব্যঙ্গ ও খুনতত্ব -হাসান মাহমুদ

০৫ মার্চ ৪৫ মুক্তিসন (2015)
শুধু আইনের শাস্তি দিয়ে ধর্ম-খুন বন্ধ করা অসম্ভব। রাষ্ট্র শাস্তি দিতে পারে কিন্তু হেদায়েত দিতে পারে না, কাজটা ধর্মগুরুদের।
 
ড: অভিজিত রায়ের খুনীদের প্রতি বিশ্ব-বিবেক ঘৃণার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। বাংলার অন্যতম বিজ্ঞানমনস্ক সন্তানটির মগজ পড়ে ছিলো রাস্তায়... যে মগজটাকে ওদের যত ভয়। প্রায় বিশ বছর আগে ওর নেতৃত্বে মুক্তমনা আমরাই বানিয়েছিলাম প্রজন্মকে শুদ্ধ আলোচনা বিতর্কের প্ল্যাটফর্ম দেবার জন্য।
 
ওর মেধা, বিশ্লেষণ ও তা উপস্থাপন করার ক্ষমতা অসাধারণ। প্রজন্মের চিন্তা চেতনাকে আরজ আলী মাতুব্বরের পর ও-ই বড় একটা ঝাঁকি দিয়েছে, চিন্তার সংঘাত সৃষ্টি করেছে যা সামাজিক অগ্রগতির চাবিকাঠি। মতাদর্শের ভিন্নতার কারণে প্রায় বছর দশেক আগে আমি মুক্তমনা ছেড়েছি, কোনো পোষ্টও করিনি পড়িও নি। এ ধরনের খুন আগেও হয়েছে, কিভাবে তা বন্ধ করা সম্ভব সেটা বের করা মানবজাতির জন্য অত্যন্ত জরুরী। অভি’র প্রতিষ্ঠিত মুক্তমনায় নাকি রসুল(স)-কে নিয়ে ঠাট্টা মস্করা হত এবং তাকে নাকি হুমকি দেয়া হচ্ছিল। অভি'র বিপক্ষদলের অনেকে আমার ইনবক্সে তার উদাহরণ পাঠিয়েছে কিন্তু ওরা এত বেশী মিথ্যে প্রচার করে যে ওগুলো আমি ধরিনি। তাই মুক্তমনা-ভিত্তিক নয়, সাধারণভাবে বিষয়টাকে দেখা যাক।
 
কোটি কোটি লোক মানুষের শরীর হাতীর মাথা দেবতার আরাধনা করে। তাদেরকে ঠাট্টা অপমান করার অধিকার আমার আছে আর ইন্টারনেটের সুবিধে তো একেবারেই ফ্রি, টাইপ করে ছেড়ে দিলেই হল। কিন্তু আমি কেন তা করতে যাব। সুবিধে বা অধিকার প্রজ্ঞার সাথে প্রয়োগ করাই সভ্যতা। কাজেই যার যা ইচ্ছে যেভাবে ইচ্ছে ধর্ম পালন করুক। প্রতিবাদ প্রতিরোধ ঠাট্টা অপমান তখনই করতে হবে যখন ধর্মের নামে অত্যাচার হয়।
 
এক – অভিকে যে কারণে খুন করা হল খুনীদের সে উদ্দেশ্য কি সফল হয়েছে ?
দুই- ধর্মব্যঙ্গ নিয়ে অন্য ধর্মের লোকেরা কি করেছে ও তাতে কি লাভ-লোকসান হয়েছে?
তিন - কোরান-রসুল(স)ও মুসলিম ইতিহাসে এ ব্যাপারে কি বলা ও করা হয়েছে ও তাতে কি লাভ-লোকসান হয়েছে? বাক স্বাধীনতা ও ধর্মব্যঙ্গ - এ সংঘাতের সমাধান কি আদৌ সম্ভব?
**************************************************
এক – অভিকে যে কারণে খুন করা হল খুনীদের সে উদ্দেশ্য কি সফল হয়েছে?
মোটেই হয়নি, ওদের পদ্ধতিটাই অচল। মূল উদ্দেশ্য রসুলের প্রতি ব্যঙ্গ বন্ধ করা, অভিকে খুন করে তা অর্জন করা তো যায়ই নি বরং এসব সন্ত্রাসের ফলে ভারত সহ পশ্চিমা দুনিয়ায় ব্যাঙের ছাতার মত ইসলামের প্রতি ব্যঙ্গ-সাইট গজিয়ে উঠেছে অজস্র। এই সন্ত্রাসীরাই দুনিয়ায় ইসলাম-ভীতি ও ইসলাম-ব্যঙ্গের জন্য দায়ী। ওদের বিশ্বাস ওরা নবীর সুন্নত পালন করেছে। দলিলে পাওয়া যায় রসুল খুন করিয়েছিলেন কটাক্ষকারী কাব বিন আশরাফ, আবু আফাক, আসমা বিন্তে মারোয়ান, ইবনে কাত্তাল আর তার দুজন "ড্যান্সিং গার্লস"দের (একজন পালাতে পেরেছিল)। ওদের এ বিশ্বাস কেন ইসলাম-বিরোধী তা নীচে দিলাম, জাতিকে ও খুনীদেরকে এটা জানাতে হবে যাতে এমন খুন আর না হয়।
**************************************************
দুই- ধর্মব্যঙ্গ নিয়ে অন্য ধর্মের লোকেরা কি করেছে ও তাতে কি লাভ-লোকসান হয়েছে?
বাইবেলের প্রতি অনেক ব্যঙ্গ হয়েছে হচ্ছে, এমনকি নিউইয়র্কে বোতলের মধ্যে প্রস্রাবের ভেতর যীশুর মুর্তি প্রদর্শনের মত ভয়াবহ ব্যঙ্গ হয়েছিল। পুরো খ্রীষ্টান জগৎ কষ্ট পেয়েছে কিন্তু কোথাও কোনো হিংস্রতা হয়নি বলে ওটা ওখানেই মরে গেছে, পরে আর হয়নি। মনে আছে, এক লোক তার ছেলেকে এনে নবীজীকে বলল- এ এত মিষ্টি খেতে চায়, একটু বুঝিয়ে বলুন। তখন নবীজী বলেছিলেন পরের সপ্তাহে এসো। পরের সপ্তাহে লোকটা এল, নবীজী ছেলেকে বোঝালেন, ছেলে মিষ্টি বন্ধ করল। লোকটা অবাক হয়ে কিজ্ঞেস করল নবীজী তো ছেলেটাকে আগের সপ্তাহেই বোঝাতে পারতেন। নবীজী হেসে বলেছিলেন - বাপু, আমি নিজেই তো মিষ্টি খেতে পছন্দ করি এবং খাই। গত এক সপ্তাহে আমি ওটা কমিয়েছি, তাই বোঝাবার বৈধতা আমার হয়েছে। অর্থাৎ তাঁর বাণী হল অন্যকে যা করতে বল, আগে নিজেরা তাই কর। বহু বছর মধ্যপ্রাচ্যে খবরের কাগজগুলোতে ঈহুদী ধর্ম নিয়ে ক্রমাগত জঘন্য ঠাট্টা-তামাশা আমি স্বচক্ষে দেখেছি। কোন সরকার, মসজিদ বা সুশীল সমাজ তার বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ করেনি। এটা হল হজরত দাউদ (আ) অর্থাৎ ডেভিড'স ষ্টার , ইহুদীদের ধর্মপ্রতীক যেমন আমাদের চাঁদতারা। সবারই ধর্মীয় প্রতীক তার কাছে অত্যন্ত সম্মানের নয়? ইসরাইল একটা গনহত্যাকারী দানব রাষ্ট্র তা দুনিয়া জানে, আঘাত করলে ইসরাইল রাষ্ট্রকে কর, ওদের ধর্মগ্রন্থকে কেন?  (ছবিগুলো আলাদাভাবে দেয়া হল)
*******************************************
তিন - কোরান-রসুলে(স)এ ব্যাপারে কি বলা হয়েছে ও তাতে কি লাভ-লোকসান হয়েছে? বাক স্বাধীনতা ও ধর্মব্যঙ্গ - এ সংঘাতের সমাধান কি আদৌ সম্ভব?
 
পুরো ব্যাপারটাই বিদ্রুপ নিয়ে। ইসলামের প্রতি ব্যঙ্গ হলে আমাদের মনে লাগে। কিন্তু প্রতিবাদের ভাষা তো প্রতিবাদীর চরিত্র প্রমাণ করে। ধর্ম নিয়ে ব্যঙ্গ-সমস্যার শ্বাশ্বত সমাধান শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, শুধু এখনকার জন্য নয়, সর্বকালের সমগ্র মানবজাতির জন্য চোদ্দশ বছর আগে দিয়ে রেখেছে ও আল্‌ কোরাণ। আশ্চর্য্য এই যে সেই নির্দেশ ইহুদী-খ্রীষ্টানেরা মেনে চলেছে বলেই ওরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। কিছু ব্যতিক্রম থাকবেই, কিন্তু সাধারণভাবে আমাদের প্রতি ব্যঙ্গও মরে যাবে অন্তত: কমে যাবে যদি আমরা রসুলের মিষ্টি খাওয়ার উদাহরণ অনুসরণ করি, অন্য ধর্মের প্রতি ব্যঙ্গ বন্ধ করি। আর যদি পালন করি হুকুমদাতার হুকুম - ‘‘কোরাণের মাধ্যমে তোমাদের প্রতি এই হুকুম জারী করে দিয়েছেন যে, যখন আল্লাহ’র আয়াতসমূহের প্রতি অস্বীকৃতিজ্ঞাপন ও বিদ্রূপ হতে শুনবে, তখন তোমরা তাদের সাথে বসবে না যতক্ষন না তারা প্রসঙ্গান্তরে চলে যায়’’ - নিসা ১৪০।
খুনীরা কোরানের এই সুস্পষ্ট কলমাকে অভিজিত রায়ের কলমের কাছে পরাজিত করে দিয়েছে, যদি সে ব্যঙ্গ করেও থাকে তবুও। সে হুকুম না মেনে তারা - ‘‘তা নাহলে তোমরাও তাদেরই মত হয়ে যাবে’’ - পরের আয়াত!! এর চেয়ে কথা স্পষ্ট হয় না।
 
কোরাণের হুকুমটা মৌদুদীবাদীদের পছন্দ নয় কিন্তু এর চেয়ে কার্য্কর উপায় কি? তা কেউ বলে দিক। খুন করে কেউ কোনদিন ধর্ম-বিদ্রুপ ঠেকাতে পারবে না। কোরানে কোথাও নেই ব্যঙ্গকারীকে কতল কর, ওটা আছে হাদিসে। আর, হাদিস হল অরক্ষিত দলিল, ওতে জঘন্য, হাস্যকর ও উদ্ভট অনেক কিছু আছে। অন্যদিকে, কি বলছে সংরক্ষিত দলিল কোরান (হিজর ৯)? খুনীরা আল্লাহ'র কালামকে বিদ্রূপকারীর কলমের কাছে পরাজিত করেছে - "বিদ্রূপকারীদের জন্য আমি আপনার পক্ষ থেকে যথেষ্ট"- হিজর ৯১। খুনীদলের পোষ্টিং-এ হিন্দু দেবদেবীর অপমান ব্যঙ্গের বন্যা এই কালামকে সরাসরি পরাজিত করেছে - "তোমরা তাদেরকে মন্দ বোলনা যাদের তারা আরাধনা করে আল্লাহকে ছেড়ে। তাহলে তারা ধৃষ্টতা করে অজ্ঞতাবশত: আল্লাহকে মন্দ বলবে"- আনাম ১০৮। তাইতো - "রসুল বললেন: হে আমার পালনকর্তা ! আমার সম্প্রদায় এই কোরআন-কে পরিত্যাগ করেছে" - আল ফুরকান ৩০। আল্লাহ'র এ কালামকে খুনীরা তাদের জন্য সত্যি বলে প্রমাণ করল। কাজেই আমরা হয় কোরান মেনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারি, কিংবা হাদিস মেনে খুন খারাবী করতে পারি। কোনটা ভাল?

যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থন করে 'কিন্তু-’ মুহম্মদ জাফর ইকবাল

মুহম্মদ জাফর ইকবাল- ১. যতই দিন যাচ্ছে আমি ততই `কিন্তু’ শব্দটার উপর বিরক্ত হয়ে উঠছি। আমার মনে হয় আমাদের ভাষায় এই শব্দটা তৈরি হয়েছে প্রতারণা করার সুযোগ দেওয়ার জন্যে। সোজা ভাষায় বলা যায় দুই নম্বরী কাজ করার জন্যে। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিস্কার হয়ে যাবে। আমার টেলিভিশন দেখার খুব একটা সুযোগ হয় না কিন্তু নভেম্বরের ৩ তারিখ রাত্রিবেলা আল জাজিরায় বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ওপর একটা অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে অন্যান্যদের সাথে জামায়াতে ইসলামীর আইনজীবী টবি ক্যাডম্যান বক্তব্য রাখছিলেন। তার কথাবার্তা খুবই চমকপ্রদ। সে বলল, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা হয়েছিল, এখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল, জামায়াতে ইসলামী স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল- এ সবই ঠিক আছে কিন্তু…।

টবি ক্যাডম্যান এই ‘কিন্তু’ শব্দটা উচ্চারণ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যে কী পরিমাণ নিন্মমানের এবং কী পরিমাণ অগ্রহণযোগ্য তার বিস্তারিত বর্ণনা দিতে শুরু করল। আমাদের ভাষায় যদি ‘কিন্তু’ শব্দটা না থাকতো তাহলে কী সে এই দুই নম্বরী কাজটা করতে পারতো? ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আর তার পদলেহী জামায়াতে ইসলামীর রাজাকার আলবদর বাহিনী মিলে এই দেশে কী নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে সেই কথাটুকু বলে তার বক্তব্য শেষ করে ফেলতে হতো। তাকে বলতে হতো, এই দেশ কলঙ্কমুক্ত করতে হলে তাদের বিচার করতেই হবে। চল্লিশ বছর পরে হলেও করতে হবে। শুধুমাত্র ‘কিন্তু’ শব্দটার জন্যে সারা পৃথিবীর যত প্রতারক এবং যত ভণ্ড মানুষ আছেন তারা প্রথমে ভালো ভালো কথা বলে শেষে দুই নম্বরী কথা বলতে শুরু করে। তবে টবি ক্যাডম্যানের কথা আলাদা, তাকে জামায়াতে ইসলামী টাকা দিয়ে এইসব কথা বলার জন্যে ভাড়া করেছে; তাকে এই কথাগুলো বলতেই হবে।

তার পরেও কথাগুলো উচ্চারণ করতে গিয়ে তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল- একটু পরে পরে তার পানি (কিংবা অন্য কিছু) খেয়ে গলা ভিজিয়ে নিতে হচ্ছিল! শুধু জামায়াতের ভাড়া করা সাদা চামড়ার মানুষ নয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করার পর ইউরোপ আমেরিকার মতো দেশগুলোকেও এই ‘কিন্তু’ মার্কা কথা বলতে শুনেছি। তারা প্রথমে বলে, ‘অবশ্যই এই নৃশংস গণহত্যার বিচার করতে হবে। তারপর একটু দম নিয়ে বলে ‘কিন্তু’, তারপর ‘গরুর রচনা’ (অর্থাৎ আন্তর্জাতিক মানের বিচার হতে হবে) শুরু করে দেয়। আমাদের ষোল কোটি মানুষের দেশে কতো কিছুই তো আন্তর্জাতিক মানের নয়, লেখাপড়া আন্তর্জাতিক মানের নয় (প্রশ্ন ফাঁস হয়, দুই হাতে গোল্ডেন ফাইভ বিতরণ করা হয়), চিকিৎসা আন্তর্জাতিক মানের নয় (টাকা না দিলে চিকিৎসা শুরু হয় না, বিল শোধ না করলে মৃতদেহ আটকে রাখা হয়), ইলেকট্রিসিটি আন্তর্জাতিক মানের নয় (সারা দেশের গ্রীড ফেল করে দশ ঘণ্টা পুরো দেশ অন্ধকার হয়ে থাকে), নিরাপত্তা বাহিনী আন্তর্জাতিক মানের নয় (র‍্যাব টাকা খেয়ে সাতজনকে খুন করে ফেলে) এমন কী টয়লেট পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মানের নয় (হাই কমোড নেই, ফ্লাশ নেই) কিন্তু ইউরোপ আমেরিকার সেসব কিছু নিয়ে মাথা ব্যথা নেই, তাদের একমাত্র মাথা ব্যথা একাত্তরের কিছু নৃশংস খুনীদের বিচারের বেলায়!

এর আগেও তো এই দেশে কতো বিচার হয়েছে, চুরি ডাকাতি রাহাজানী থেকে শুরু করে খুন ধর্ষণ কিছুই তো বাদ যায়নি, তখন তো কোনো দেশকে বলতে শুনিনি এই দেশে অপরাধীদের মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়ে যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক মানের বিচার হচ্ছে না। আমাদের দেশের সেই একই বিচার ব্যবস্থা যখন পুরোপুরি এই দেশের আইনে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছে তখন হঠাৎ করে তাদের মনে পড়ল যে বিচার আন্তর্জাতিক মানের হচ্ছে না? আমরা এখন সবাই জানি ব্যাপারটা কেমন করে ঘটেছে। শুধুমাত্র আমেরিকাতে জামায়াতে ইসলামী ২৫ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে সেই দেশের গুরুত্বপূর্ণ মানুষকে নিজের দিকে টেনে নেওয়ার জন্যে। পত্র পত্রিকায় এর উপর বিশাল রিপোর্ট বের হয়েছে, পড়ে বমি করে দিতে ইচ্ছে করে। টাকা দিয়ে অনেক কিছু কেনা যায় (ডলার হলে আরেকটু ভালো হয়) কিন্তু একাত্তরে নির্যাতিত মানুষের বুকের ক্ষোভ পৃথিবীর কোনো অর্থ দিয়ে কেনা যায় না। যতদিন এই দেশের মানুষ এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ করে মাতৃভূমির কলঙ্ক মোচন করতে চাইবে ততদিন বাইরের কোনো শক্তি আমাদের ব্যাপারে নাক গলাতে পারবে না।

সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের কাছে কৃতজ্ঞ, আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে কৃতজ্ঞ এবং আমাদের তরুণ প্রজন্মের কাছে কৃতজ্ঞ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি তীব্রভাবে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে। সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ এই সরকারের কাছে যারা আমাদের কথা দিয়েছিল যে নির্বাচিত হলে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে এবং তারা তাদের কথা রেখেছে। ২. সিলেটে কৃষিকাজে ব্যবহার করার জন্যে যন্ত্রপাতি তৈরি করার একটা ফ্যাক্টরি আছে, বেশ কয়েক বছর আগে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সেই ফ্যাক্টরি থেকে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল তাদের ফ্যাক্টরিটা দেখার জন্যে। আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখতে গিয়েছিলাম, আমাদের দেশের একেবারে নিজস্ব প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি যন্ত্রপাতিগুলো দেখে আমার খুব ভালো লেগেছিল। ফ্যাক্টরির মালিক, কর্মকর্তারাও আমাকে সবকিছু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন। চলে আসার আগে তারা তাদের ‘ভিজিটার্স বুক’ বের করে আমাকে অনুরোধ করলেন তাদের উদ্দেশ্যে কিছু একটা লিখে দিতে। আমি আমার কথাগুলো লিখে স্বাক্ষর করার আগে থমকে গেলাম, আমার ঠিক আগে বাংলাদেশের সেই সময়কার শিল্পমন্ত্রীর নিজের হাতের স্বাক্ষর, স্পষ্ট অক্ষরে তার নাম লেখা- মতিউর রহমান নিজামী। আমি কলমটি কিছুক্ষণ ধরে রেখে আমার নিজের নাম স্বাক্ষর করলাম। তীব্র এক ধরনের অপমানবোধ আমাকে গ্রাস করে রেখেছিল, যে মানুষটি বদর বাহিনীর প্রধান হয়ে এই দেশে পৃথিবীর ভয়াবহতম হত্যাযজ্ঞে সহযোগিতা করেছে তাকে এই দেশের মন্ত্রী করে তার গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ এই মানুষটি বাংলাদেশের জন্মলগ্নে গলা টিপে এই দেশটিকে হত্যা করতে চেয়েছিল। এর চাইতে বড় দুঃখ লজ্জা গ্লানি অপমান কী হতে পারে? যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হবার পর অনেকদিন পার হয়ে গেছে, সবাই যে-রমক দ্রুত একটা বিচার দেখতে চাইছিল ঠিক সেভাবে বিচার হচ্ছিল না বলে অনেকের ভেতর এক ধরনের হতাশার জন্ম হচ্ছিল। কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে অনেকের ধারণা আমি বুঝি অনেক ভেতরের খবর জানি, তাই আমার সাথে দেখা হলেই অনেকে জানতে চাইতো কী হচ্ছে? আসলেই কী যুদ্ধাপরাধীর বিচার শেষ হবে?- ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি তখন তাদের পাল্টা প্রশ্ন করতাম, তাদের কী জামায়াত-বিএনপি আমলের সেই জোট সরকারের কথা মনে আছে যখন দুই দুইজন কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী সেই সরকারের মন্ত্রী ছিল? যারা তাদের গাড়িতে এই দেশের পতাকা উড়িয়ে ঘুরে বেড়াতো? যারা প্রশ্ন করেন তারা সবাই মাথা নেড়ে স্বীকার করেন যে, হ্যাঁ তাদের সবারই সেই অবিশ্বাস্য দিনগুলোর কথা মনে আছে। তখন আমি তাদের জিজ্ঞেস করি, তারা কী তখন কল্পনা করেছিলেন যে একদিন সব যুদ্ধাপরাধী গ্রেপ্তার হয়ে জেলে বসে থাকবে, একজন একজন করে তাদের বিচার করা হবে? (মনে আছে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ঘোষণা দিয়েছিল, তাকে স্পর্শ করা হলে সমগ্র চট্টগ্রামে আগুন লেগে যাবে। কোথায় সেই আগুন?) গোলাম আযমকে যখন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়া হয়েছিল তখন সবাই মন খারাপ করেছিল। এখন কী আমরা বলতে পারি না এই দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে এই দেশে থেকে যাওয়ার জন্যেই তাকে ধরে জেলখানায় রাখা সম্ভব হয়েছিল। যুদ্ধাপরাধীর শাস্তি পেয়ে তাকে জেলখানায় মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে এই কলঙ্কমোচনের কাহিনি আজীবনের জন্যে লেখা হয়ে গেল! যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে সরকারের সদিচ্ছার উপর সন্দেহ প্রকাশ করেন তারা সবাই কিন্তু স্বীকার করতে বাধ্য হন জামায়াত-বিএনপির জোট সরকারের আমলে তারা কেউ কল্পনা করেননি সত্যি সত্যি এই দেশের মাটিতে আমাদের জীবদ্দশায় তাদের বিচার শুরু হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে যাদের মনে হতাশা সন্দেহ এবং অবিশ্বাস ছিল গত কয়েকদিনের বিচারের রায় দেখে তাদের সেই হতাশা সন্দেহ এবং অবিশ্বাস অনেকটুকুই কেটে গেছে। আমরা এখন নিশ্চিতভাবে জানি আর কখনোই আমাদের সেই অন্ধকার দিনগুলোতে ফিরে যেতে হবে না। ৩. একটা সময় ছিল যখন দেশদ্রোহী যুদ্ধাপরাধীরা এই দেশে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াতো। একজন আমাকে বলেছেন যে, সেই সময়ে নাকি কিছু রাজাকার একাত্তরে তাদের বকেয়া বেতনের জন্যে সরকারের কাছে আবেদন করেছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার পর খালেদা জিয়া বেশ অনেকবার সেটাকে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র বলে যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি চেয়েছেন। ইদানীং সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। একজন যুদ্ধাপরাধীর রায় বের হবার পর বিএনপি আর তাদের মুক্তির কথা বলে না। দেশের অন্যসব মানুষের মতো গ্লানিমুক্তির আনন্দ উপভোগ করতে পারে না, আবার সেটি নিয়ে তাদের আপত্তিটুকুও প্রকাশ করতে পারে না। গোলাম আযমের জানাজায় বিএনপির কোনো নেতা হাজির থাকার সাহস করেনি; যিনি হাজির ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর হিসেবে তার উপস্থিতি নিশ্চয়ই একটা তামাশার মতো ছিল! গোলাম আযমের ছেলে বিষয়টি নিয়ে খুবই ক্ষুব্ধ, দেশের সেরা দেশোদ্রোহীর সন্তান হওয়ার চাপ নিশ্চয়ই খুব বেশি, সেই চাপেই সম্ভবত তিনি বিএনপিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন যে জামাতের সাহায্য ছাড়া বিএনপি কখনো ক্ষমতায় যেতে পারবে না। তার এই চ্যালেঞ্জটি কী জামায়াতের শক্তির কথা বলেছে নাকি বিএনপি-এর দুর্বলতার কথা বলেছে আমি বুঝতে পারিনি। রাজনীতির জটিল হিসাব আমি বুঝি না, কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষের হিসাব আমি খুব ভালো করে বুঝি। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে দেশটাকে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেয়া হয়েছিল। তখন পাঠ্যবই, রেডিও টেলিভিশন বা মিডিয়াতে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা হতো না, দেশদ্রোহী রাজাকারদের নৃশংসতার কথা বলা হতো না। সে সময় এই দেশে একটা বিভ্রান্ত প্রজন্মের জন্ম হয়েছিল, সে কারণেই জামায়াতকে সঙ্গী করে বিএনপি নির্বাচনে জিতে আসতে পেরেছিল। আমার হিসাবে জামায়াতকে নিয়ে জোট করাটি ছিল এই দেশের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য। আমি তখন নূতন দেশে ফিরে এসেছি, জামায়াতকে নিয়ে জোট করার পর তখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের ছেলেদের হাহাকারের কথা আমি কোনোদিন ভুলব না। তারপর অনেকদিন কেটে গেছে, এই দেশে নূতন প্রজন্ম এসেছে, তারা মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনে বড় হয়েছে, নিজের দেশের জন্যে তাদের বুক ভরা ভালোবাসা, দেশ নিয়ে তাদের স্বপ্ন, তাদের অহংকার। এই নূতন প্রজন্মের দেশপ্রেমের ভেতর যুদ্ধাপরাধীদের কিংবা যুদ্ধাপরাধীর দল জামায়াতে ইসলামের কোনো জায়গা নেই। এক যুগ আগে নির্বাচনে যেটা সম্ভব হয়েছিল ভবিষ্যতে আর কখনো সেটা সম্ভব হবে না! এই দেশের মানুষ হিসেবে আমরা খুব বেশি কিছু চাই না। আমরা চাই সরকারি এবং বিরোধী দল দুটিই হবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল! একটা কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের জন্যে আমি একবার শেরপুরের সোহাগপুরে গিয়েছিলাম, আমি তখন বিধবাপল্লীর সেই বিধবাদের দেখেছিলাম। আমার মাও সেই দুঃখীনি বিধবাদের মতো একজন দুঃখীনি হিসেবে তাঁর জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। আমি তাদের বুকের ভেতরকার কষ্ট আর হাহাকারের কথা জানি, তাদের ক্ষোভটুকু অনুভব করতে পারি। যে দেশের বাতাস এরকম অসংখ্য মায়ের দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে আছে সেই দেশে একটি রাজনৈতিক দল হত্যাকারীদের নিয়ে রাজনীতি করবে সেটি হতে পারে না। বিধবাপল্লীর বিধবাদের অভিশাপ থেকে চল্লিশ বছরেও যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামান মুক্তি পায়নি- অন্যেরাও পাবে না। ৫ নভেম্বর ২০১৪

Wednesday, March 4, 2015

ধর্মের নামে চরম অধর্ম -ইমানুল হক

৪ মার্চ , ২০১৫, ০০:০১:৫২১  দৈনিক আনন্দবাজার

ধর্ম-ব্যবসায়ীরা জানেন কি, রামের গুরু জাবালি ছিলেন নাস্তিক, হজরত মহম্মদের সময়ও বহু মানুষই নাস্তিক ছিলেন?  

ধর্মে বলপ্রয়োগ নেই। বলা হয়েছে আল কোরানে (৪৯:১১)। বলা হয়েছে, তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম এবং আমার জন্য আমার ধর্ম। লেখা আছে: তোমার প্রভু যদি ইচ্ছা করতেন, তা হলে পৃথিবীর সমস্ত মানুষই (ইসলামে) বিশ্বাসী হত, তবে কি তুমি মানুষকে ধর্মের পথে আনবার জন্য তার ওপর বলপ্রয়োগ করতে যাবে? ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে ১৯ মার্চ আরাফত ময়দানে শেষ ভাষণে পবিত্র হজরত মহম্মদ বলেছিলেন, ধর্মের সম্পর্কে কেউ বাড়াবাড়ি করবে না। এই বাড়াবাড়ির জন্য বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। তবু অভিজিৎ রায়কে ধর্মরক্ষার নামে বাড়াবাড়ি করে ‘বলপ্রয়োগ’-এর মাধ্যমে ধর্মের অভিভাবক সেজে নৃশংস ভাবে হত্যা করেছে একদল অসভ্য বর্বর ধর্ম-ব্যবসায়ী সাম্প্রদায়িক। ঘৃণ্য এই হত্যা।  ২  এরা ক্ষমতালোভী ধর্ম-ব্যবসায়ী। গণতান্ত্রিক ভাবে না পেরে, ভয় দেখিয়ে, বোমা ছুড়ে শিশু-নারী হত্যা করে ক্ষমতায় যেতে চায়। সব দেশে, সব কালে ধর্মের নামে প্রবল অধর্মকে লালন ও পালন করে। ইসলামের নামে ইসলামের আদর্শকে হত্যা করে। হিন্দুত্বের নামে হিন্দুত্বের মূল নীতিকে। মুসলমান বা হিন্দু নয়, এদের জাত একটাই: ধর্মব্যবসা। ধর্ম, রাজনীতি ও ক্ষমতার ‘ককটেল’ বানিয়ে অর্থ, প্রতিপত্তি অর্জন করতে চায়। তাই ব্যাংক বানায়, হাসপাতাল চালায়, স্কুল-কলেজ খোলার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ মারে। হত্যা করে কুপিয়ে চপার মেরে।  ৩  ১৯৪৭-এ কলকাতায় শচীন মিত্র, ’৬৪-তে ঢাকায় আমির হোসেন চৌধুরি দাঙ্গার সময় প্রতিবেশীদের রক্ষা করতে গেছেন, একই কায়দায় দুই আপাত-বিপরীত পক্ষ তাঁদের হত্যা করেছে। ২০০৪-এ ধর্মনিরপেক্ষ নারীবাদী লেখক-অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে জামাতিরা ঢাকায় নৃশংস ভাবে আক্রমণ করে প্রকাশ্য দিবালোকে। তাঁর মৃত্যু ঘটে ১১ অগস্ট, ২০০৪-এ। অধ্যাপক এইচ এস সাভারওয়াল ছিলেন উজ্জয়িনীর মাধব কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক। অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের উগ্র সন্ত্রাসী কর্মীদের হাতে তিনি ২৬ অগস্ট ২০০৬ নিহত হন। ব্লগার রাজীব হায়দার প্রকাশ্যে খুন হন ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩। শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের জমায়েত শুরুর দশ দিনের মাথায়। পুণেয় কুসংস্কার বিরোধী আন্দোলনের নেতা, লেখক নরেন্দ্র দাভলকরকে ‘হিন্দু’ ধর্মরক্ষার নামে প্রকাশ্যে সকালে পার্কে হত্যা করেছে ২০ অগস্ট ২০১৩। যে ভাবে প্রকাশ্যে কুপিয়ে অভিজিৎ রায়কে ধর্মরক্ষার নামে হত্যা করেছে ‘মুসলমান’ নামধারী সন্ত্রাসীরা। তাঁর স্ত্রী রফিদা আহমেদ বন্যা পাঞ্জা কষছেন মৃত্যুর সঙ্গে। খুন হয়েছেন ২০১৩-১৪-য় বাংলাদেশে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহম্মদ ইউনুস, অধ্যাপক শফিউল ইসলাম লিলন, মৌলানা নুরুল ইসলাম, ব্লগার আশরাফুল ইসলাম। ভারতে সম্প্রতি খুন হলেন গোবিন্দ পানেসর। লেখা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন তামিল লেখক মুরুগান। এই হত্যাকারী ও হামলাকারীরা ‘হিন্দু’ বা ‘মুসলমান’ নামের কলঙ্ক। অবিশ্বাসী বা নাস্তিক ‘রামায়ণ’-এর যুগেও ছিল। রামদের গুরুদেব জাবালি ছিলেন নাস্তিক। হজরত মহম্মদের সময়েও নাস্তিকরা ছিলেন। পবিত্র মহম্মদ তো এদের হত্যা করেননি বা করাননি।  ৪  কোনও লেখার বিরুদ্ধে কিছু বলার থাকলে লিখেই বলতে হবে। কারও বলার বিরুদ্ধে বক্তব্য থাকলে, বলে। এটাই সভ্যতা। ভয় দেখিয়ে, কুৎসা রটিয়ে বা খুন করে নয়। রক্ত, জিঘাংসা, প্রতিহিংসা কি কোথাও পৌঁছে দেবে আমাদের? অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে ছিলেন পবিত্র মহম্মদ। ক্ষমা করেছিলেন প্রিয় সাহাবির কলিজা ভক্ষণকারী মহিলা হিন্দাহকে। হজরত মহম্মদকে হত্যা করবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন আরবের প্রসিদ্ধ কবি কাব। একদিন কাব চলছিলেন হজরত মহম্মদের বিরুদ্ধে হত্যার উদ্দেশ্য নিয়ে লেখা কবিতা পড়তে পড়তে। শব্দচয়ন আর গীতমাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে কবিতার বিষয়বস্তুর কথা না ভেবে হজরত মহম্মদ নিজের পরিহিত শাসকের শিরোভূষণ পরিয়ে দেন কবি কাবের মাথায়। কাব বিস্মিত হয়ে যান। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।  ধর্মের স্বঘোষিত অভিভাবক হত্যাকারীরা কি শুনছেন?

Tuesday, March 3, 2015

এই অবিশ্বাস ইতিহাসের উত্তরাধিকার-অশোক মিত্র

২০ অগস্ট, ২০১৪ ,আনন্দবাজার

বাঙালি হিন্দুদের সম্পর্কে একটা দ্বৈত মনোভাব দেখা যায় বাংলাদেশে। রাজনীতির পরিসরে এই মনোভাবের প্রতিফলন ঘটেছে বার বার। আজও ঘটছে।


মাতৃভাষা-ভিত্তিক বাংলাদেশি জাতীয়তাবোধের ওই প্রথম বহিঃপ্রকাশ, কিন্তু এই জাতীয়তাবোধের সূচনার সঙ্গে পূর্ববর্তী দশ বছরের ইতিহাস আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো। নতুন ভারত শাসন আইন অনুযায়ী ১৯৩৭ সালে অভঙ্গ বঙ্গপ্রদেশের নির্বাচনের পর ফজলুল হক তাঁর নিজের দল কৃষক প্রজা পার্টি এবং মুসলিম লিগের সমন্বয়ে সরকার গঠন করলেন। তিনিই প্রধানমন্ত্রী (ভারত শাসন আইনে এই পদবিই বিধিবদ্ধ ছিল)। তিনি চেয়েছিলেন কংগ্রেস দলের সঙ্গে মিলে সরকার গড়তে। মুসলিম লিগের সঙ্গে হাত মেলাতে তাঁর গভীর অনাগ্রহ, সরকার গঠনের জন্য কংগ্রেসের দিকে তিনি হাত বাড়িয়েছিলেন।
বিধানসভায় কংগ্রেসের দলীয় নেতা শরৎচন্দ্র বসু ইতিবাচক সাড়া দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব ফরমান জারি করলেন, কোনও প্রদেশেই কংগ্রেস অন্য কোনও দলের প্রধানমন্ত্রীত্বে কাজ করবে না। ব্যর্থমনোরথ ফজলুল হক মুসলিম লীগের সঙ্গে সরকার গড়তে বাধ্য হলেন, দেশের ইতিহাস সেই মুহূর্ত থেকে আমূল পাল্টে যেতে শুরু করল।
বরিশাল জেলার মাঝারি গোছের ভূস্বামী পরিবারে ফজলুল হকের জন্ম। গণিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিভাবান ছাত্র। হাইকোর্টে ওকালতি শুরু করে খুব তাড়াতাড়ি পশারও জমালেন। তাঁর বাগ্মিতার ধরনটা একটু অন্য রকম। বাংলা ইংরেজি মিশিয়ে প্রচুর দেশজ শব্দ ব্যবহার করে, সেই সঙ্গে শ্লেষ জুড়ে এমন জমিয়ে দিতেন যে বিচারপতিরা পর্যন্ত মুগ্ধ। নিজে মাঝারি জমিদার হওয়া সত্ত্বেও নিঃস্ব গরিব চাষিদের মর্মবেদনা উপলব্ধি করতেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জগদ্দল পাষাণে তারা পিষ্ট, জমিদার সম্প্রদায়ের সরকারকে দেয় রাজস্ব হাস্যকর নিচু জায়গায় বাঁধা, অথচ যে কৃষকশ্রেণি হাল টানে, বীজ বোনে, বীজ ছড়ায়, প্রাণপাত পরিশ্রম করে ফসল ফলায়, তাদের উপর জমিদারদের খাজনার বহর বেড়েই চলে। খাজনা দিতে না পারলে জমি থেকে উৎখাত।

উৎ‌খাতের আতঙ্কে কৃষক সম্প্রদায় মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হয়, ঋণের বোঝা ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়। অপরিশোধনীয় ঋণের পাহাড়, দরিদ্র কৃষকদের অনাহারে অপুষ্টিতে দিনাতিপাত। অনুকম্পায়ী ফজলুল হক বুঝেছিলেন, যদিও কৃষককুলের অধিকাংশ মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত এবং জমিদারদের অধিকাংশ উচ্চবর্গীয় হিন্দু, সমস্যাটি সম্প্রদায়-ভিত্তিক নয়, শ্রেণিগত। সংগঠিত কৃষক আন্দোলন তখনও আঁতুড়ঘরে। ফজলুল হক ও তাঁর কৃষক প্রজা পার্টি কৃষকদের রক্ষাকর্তা রূপে কিছু কিছু সংস্কার সাধনে বদ্ধপরিকর। মুসলিম লীগে দু’এক জন বিত্তবান মুসলমান জমিদার ছিলেন, তাঁরা কোনও বাধা সৃষ্টি করলেন না। ফজলুল হক আইন করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে খাজনার হারে রাশ টানলেন। এখানেই থামলেন না, আমূল ভূমি সংস্কারের লক্ষ্যে একটি কমিশন গঠন করলেন। সেই সঙ্গে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে প্রদেশের জনসংখ্যা অনুযায়ী শতকরা চুয়ান্নটি পদ মুসলমানদের জন্য সংরক্ষণের নির্দেশ দিলেন।
উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্তদের মধ্যে হাহাকার শুরু হল। তখনও বামপন্থী চিন্তার প্রসার ঘটেনি, কংগ্রেস নেতৃত্ব ভূস্বামীসংকুল।
শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্তদের মধ্যেও সরকারি কাজে যোগ দেওয়ার সুযোগ কমে যাওয়ায় বিক্ষোভ-উত্তেজনা, কংগ্রেস রাতারাতি উগ্র ফজলুল হক-বিরোধী হয়ে উঠলো। তাঁকে ঘোর সাম্প্রদায়িক হিসেবে বর্ণনা করে জনসভায় বক্তৃতার পর বক্তৃতা, হিন্দু মালিকানায় কলকাতা থেকে প্রকাশিত ইংরেজি ও বাংলা পত্রিকায় দিনের পর দিন আক্রমণ। তিতিবিরক্ত হয়ে তিনি কৃষক প্রজা পার্টির পাট গুটিয়ে সদলবলে মুসলিম লীগে যোগ দিলেন, প্রাদেশিক সরকার পুরোপুরি মুসলিম লীগ সরকারে পরিণত হল। পরবর্তী যে সব ঘটনাবলি, তার ফলেই মুসলিম লীগের অভাবনীয় প্রভাব বিস্তার এবং তার ফলেই ১৯৪৭ সালে দেশভাগ।
ইতিহাস থেকে এখন ফজলুল হকের নাম বিলুপ্ত। কিন্তু তাঁরই উদ্যোগে গৃহীত সংস্কারগুলির পরিণামে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে একটি সচেতন মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্রমশ উদ্ভব, হক-কৃত সংস্কারাদিতে মুসলমানদের জীবিকা ও শিক্ষার সুযোগ বহুগুণ বাড়ল, গরিব কৃষক ঘরের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে শুরু করল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ শহরে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিল, সরকারি কাজে ঢুকল, হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্তদের নানা বাধাদানের মধ্যেও নিজেদের উন্নীত করল, সচেতনতায় একটু একটু করে সমৃদ্ধ হল, বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায় সম্পর্কে তাদের শ্রেণিগত সন্দেহ অথচ বাংলা তাদেরও মাতৃভাষা এই দ্বৈততা তারা বহন করে চলেছে। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবি তুলে নিজেদের অনেক রক্ত ঝরিয়ে তাঁরা অবশেষে সিকি শতাব্দী বাদে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন করতে পারলেন। মুক্তিযুদ্ধের মুহূর্তেও কিন্তু তাঁদের এই দ্বৈত মনোভাব দূর হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে ভারতীয় বাঙালি হিন্দুদের সম্পর্কে এই দ্বৈত মানসিকতা অব্যাহত।
ভারত সরকার শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর দল আওয়ামি লীগ এবং পরিবারের প্রতি বরাবর গভীরতর অনুরাগ প্রদর্শন করায় বাংলাদেশ ন্যাশনাল পার্টি (বিএনপি) গভীর অসুখী। বিএনপি-র পক্ষ থেকে অনবরত বলা হয় যে, আওয়ামি লীগ ভারত ও হিন্দু-ঘেঁষা। জনসাধারণের বেশ কিছু অংশ এই প্রচারে প্রভাবিত হন। বিভিন্ন সংবেদনশীল সমস্যায় এই বিদ্বেষ ছায়া ফেলে। ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের পর গঙ্গার জল ভাগাভাগি নিয়ে বিতর্কেও এই অবিশ্বাসের প্রভাব পড়ে। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান রাজ্য সরকার তিস্তা নদীর জল ছাড়ার ব্যাপারে কোনও বোঝাপড়ায় আসতে অসম্মত হওয়ায় ভারতবিদ্বেষীদের প্রচারের সুযোগ বিদ্যমান।
সন্দেহ ও অনুযোগের পাশাপাশি আছে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্তদের সম্পর্কে এক ধরনের অবজ্ঞা সম্পৃক্ত উন্নাসিকতাও। শত চেষ্টা করেও আপনারা আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারেননি। আমরা লড়াই করে পাকিস্তানের শৃঙ্খল থেকে নিজেদের মুক্ত করেছি, স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন করেছি, আর আপনারা ওই খোট্টাদের চিরকালের গোলাম বনে গেছেন। আপনাদের কলকাতা এখন কেমন পাড়াগেঁয়ে-পাড়াগেঁয়ে ঠেকে। আমাদের ঢাকা দশ গুণ বড়, মস্ত বড় অট্টালিকা-রাজপথে সমাকীর্ণ। কলকাতা বিমানবন্দর টিমটিম করে, ঢাকার বিমানবন্দরে নিরন্তর তিরিশ-চল্লিশটি বিদেশি বিমান সংস্থার বিমান নামাওঠা করছে। আর বাংলা ভাষা তো আমরাই বাংলাদেশে টিকিয়ে রেখেছি, মাতৃভাষার জন্মসূত্র ব্যাকরণ ইত্যাদি নিয়ে যে নিরন্তর গবেষণা আমাদের এখানে চলছে, আপনাদের পশ্চিম বাংলায় তা অকল্পনীয়। রবীন্দ্রনাথকে আমরাই তো আপন করে নিয়েছি, তাঁর সৃষ্টিকর্ম নিয়ে আমাদের বাংলাদেশে যে আকুলতা-ব্যাকুলতা, পশ্চিম বাংলায় তার ছিটেফোঁটাও নেই।
এই গোছের মানসিকতা বাংলাদেশে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। নতুন দিল্লির রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক ঘেঁষা সরকার, সেই সঙ্গে পশ্চিম বাংলার রাজ্য সরকার কী ভাবে আগামী ভবিষ্যতে নিজেদের পরিচালনা করে, এই মানসিকতা কোন দিকে মোড় নেয়, তার উপর তা অনেকটা নির্ভরশীল।

Monday, March 2, 2015

প্রিয় অভিজিৎ ‍- মুহম্মদ জাফর ইকবাল

Sukanta Rakshit's photo.
ঠিক কী কারণ জানা নেই, কোনো ভয়ঙ্কর খবর পড়লেই নিজের অজান্তেই আমি নিজেকে সে অবস্থানে কল্পনা করতে শুরু করি। পদ্মা নদীতে লঞ্চডুবির খবর পড়লে আমি কল্পনায় দেখতে পাই একটা লঞ্চ ডুবে যাচ্ছে, আমি তার ভিতরে আটকা পড়েছি, পানি ঢুকছে মানুষ আতঙ্কে চিৎকার করছে আর পানির নিচে নিশ্বাস নিতে না পেরে আমি ছটফট করছি।
যখন একটা বাসে পেট্রলবোমা দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার খবর পড়ি তখন কল্পনায় দেখতে পাই, আমি বাসের ভিতর আটকা পড়েছি, দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে আর আমি তার ভিতর দিয়ে ছুটে বের হওয়ার চেষ্টা করছি আমার সারা শরীরে আগুন জ্বলছে।
পরশুদিন আমি যখন খবর পেয়েছি অভিজিৎকে বইমেলার সামনে কুপিয়ে হত্যা করেছে তখন পুরো দৃশ্যটি আমি আবার দেখতে পেয়েছি- এই দৃশ্যটি আমার জন্য অনেক বেশি জীবন্ত, কারণ অভিজিৎ যেরকম বইমেলা ঘুরে তার স্ত্রীকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে বের হয়ে এসেছে- আমি আর আমার স্ত্রী গত সপ্তাহে ঠিক একইভাবে মেলা থেকে হেঁটে হেঁটে বের হয়ে এসেছি।
আমি জানি অভিজিতের মতো আমার নামও জঙ্গিদের তালিকায় আছে। কল্পনায় দেখেছি আমার মাথায় আঘাতের পর আঘাত পড়ছে আমার স্ত্রী আমাকে বাঁচাতে গিয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। কাছে- খুব কাছেই পুলিশ নিষ্পৃহভাবে দাঁড়িয়ে আছে। তাকিয়ে তাকিয়ে ঘটনাটা দেখছে কিন্তু কিছু করছে না।
সিলেটে বসে আমি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘটনাটা জানতে পেরেছিলাম। অভিজিৎকে হাসপাতালে নিয়েছে জেনে দোয়া করছিলাম যেন বেঁচে যায়- কিন্তু অভিজিৎ বাঁচল না। অভিজিৎ রায় আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর অজয় রায়ের ছেলে। যারা হাসপাতালে ছিল তাদের কাছে আমাদের স্যারের খবর নিয়েছি- একজন বাবার কাছে তার সন্তানের মৃত্যু সংবাদ থেকে কঠিন সংবাদ আর কী হতে পারে?
আমাদের পদার্থ বিজ্ঞানের স্যার প্রফেসর অজয় রায় এই ভয়ঙ্কর দুঃসময়ে তার বুকের ভিতরের উথাল-পাতাল হাহাকারকে ঢেকে রেখে যে অসাধারণ মানসিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে সন্তানের মৃত্যু সংবাদ গ্রহণ করেছেন, প্রিয়জনের সঙ্গে কথা বলেছেন, গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়েছেন, তার কোনো তুলনা নেই। আমরা তার ছাত্র-ছাত্রীরা যদি তার ভিতরকার শক্তির একটা ক্ষুদ্র অংশও আমাদের জীবনের কোথাও ব্যবহার করতে পারি তাহলে নিজেদের ধন্য মনে করব।আমি আসলে ফেসবুক, নেট, ব্লগের সঙ্গে পরিচিত নই।
আমি জানি সারা পৃথিবীতেই এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, তারপরও আমি শুধু বইপত্র ছাপা খবরের কাগজ দিয়েই দুনিয়ার খবর রাখি। সে কারণে আমি অভিজিত রায়ের ব্লগ জগতের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম না, আমি শুধু তার বইয়ের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম। আমি আমার নিজের লেখায় তার বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছি। আমার খুব আনন্দ হতো যখন আমি দেখতাম একজন তরুণ ইঞ্জিনিয়ার কী সুন্দর ঝরঝরে বাংলায় লিখে, কী সুন্দর বিশ্লেষণ করে, কত খাটাখাটুনি করে একটা বিষয়কে যুক্তি-তর্ক দিয়ে বুঝিয়ে দিতে পারে।
আমি জানতাম না ধর্মান্ধ গোষ্ঠী তাকে এভাবে টার্গেট করেছে। ধর্মান্ধ জঙ্গিগোষ্ঠীর তালিকায় আমাদের অনেকেরই নাম আছে, আমরা ধরেই নিয়েছি এই দেশে এভাবেই বেঁচে থাকতে হয়। কিন্তু সত্যি সত্যি যে তারা অভিজিৎকে এভাবে হত্যা করার একটা সুযোগ পেয়ে যাবে, আমি কল্পনাও করতে পারিনি। স্বজন হারানোর এই দুঃখ আমি কোথায় রাখি? শনিবার দুপুরে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা অভিজিৎ হত্যার প্রতিবাদে একটি মানববন্ধন, মৌনমিছিল শেষে আমাদের লাইব্রেরির সামনে জমায়েত হয়েছিল।
ছাত্র-শিক্ষক নিজেদের ক্ষোভের কথা বলেছে, দুঃখের কথা বলেছে, হতাশার কথা বলেছে, অভিজিতের জন্য গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার কথা বলেছে। সমাবেশের শেষে তারা আমার হাতেও মাইক্রোফোন দিয়ে তাদের জন্য কিছু বলতে বলেছে। মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। তরুণ শিক্ষার্থীদের দিকে তাকিয়ে আমি শেষ পর্যন্ত সবসময় যে কথাগুলো বলি তাই বলেছি।
 এই দেশের ভাবনা-চিন্তায় জগতের দায়িত্বটি এখন এই তরুণদেরই নিতে হবে। বলেছি তাদের দুঃখ পাওয়ার কারণ আছে, তাদের ক্রুব্ধ হওয়ার কারণ আছে; কিন্তু যত কারণই থাকুক, তাদের হতাশাগ্রস্ত হলে চলবে না। অন্ধকার জগতের যে মানুষগুলো পিছনে থেকে এসে একজনকে হত্যা করে আনন্দে উল্লসিত হয়ে যায়, তারা কোন বিষয়টাকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায়, আমরা এখন সেটা জানি।
তারা ভয় পায় বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবাদী চিন্তা, তারা ভয় পায় উদার মনের মানুষ, তারা সবচেয়ে বেশি ভয় পায় মুক্তচিন্তা। আমি আমার ছাত্র-ছাত্রীদের অনুরোধ করেছি, তারা যেন অভিজিতের সম্মানে আর ভালোবাসায় আধুনিক পৃথিবীর উপযোগী মুক্তচিন্তার মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে। সরকার অভিজিতের হত্যাকারীদের ধরতে পারবে কী না জানি না। যদি ধরতে পারে, এ দেশের আইনে শাস্তি দিলেই কী যে বিষ বৃক্ষ এই দেশে জন্ম নিয়েছে তার শিকড় উৎপাটিত হবে?
সারা পৃথিবীতে ধর্মান্ধ মানুষের যে নৃশংসতা শুরু হয়েছে আমাদের দেশেও কী তার ছোঁয়া লাগতে শুরু করল? আমরা কী সেই অন্ধকার শক্তিকে প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুত হয়েছি? অভিজিতের বাবা, আমার শিক্ষক প্রফেসর অজয় রায় তার সন্তানের মৃত্যুর পর যে কথাটি বলেছেন, আমাদের সবারই এখন কী সেই একই কথার প্রতিধ্বনি করার সময় আসেনি? ত্রিশ লক্ষ মানুষ প্রাণ দিয়ে যে বাংলাদেশ তৈরি করেছিল আমরা সেই বাংলাদেশকে ফিরে পেতে চাই। এই বাংলাদেশ আমাদের সেই ত্রিশ লক্ষ মানুষের, তাদের আপনজনের।
এই দেশ অভিজিতের, এই দেশ অভিজিতের আপনজনের। এই দেশ জঙ্গিদের নয়, এই দেশ ধর্মান্ধ কাপুরুষের নয়। খুব দুঃখের সময় আপনজনেরা একে অন্যের হাত ধরে নিজেদের ভিতর সান্ত্বনা খুঁজে পায়, সাহস খুঁজে পায়। অভিজিতের আহত স্ত্রী তার কন্যা, তার বাবা মা ভাইবোনকে বলতে চাই, আপনাদের পাশে আমরা আছি।

একজন দুইজন নয়, লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশের মানুষ। আপনারা হয়তো আমাদের দেখছেন না, কিন্তু আমরা আছি।আপনাদের পাশে আছি। পাশে থাকব।
 

অভিজিৎ হত্যা : বাংলাদেশ কোন পথে ?- শাহরিয়ার কবির

'মুক্তমনা' ওয়েবসাইটের পরিচালক, যুক্তিবাদী লেখক অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ড সমাজের বিবেকসম্পন্ন মানুষদের অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও স্তম্ভিত করেছে। ২৬ ফেব্রুয়ারি (২০১৫) রাত সাড়ে ৯টায় বইমেলা থেকে বাড়ি ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাশের রাস্তায় মৌলবাদী ঘাতকরা তাকে ধারালো ছুরি ও চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। তাকে বাঁচাতে গিয়ে গুরুতর আহত হয়েছেন অভিজিতের সহধর্মিণী রাফিদা আহমেদ বন্যা। ১১ বছর আগে ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রথাবিরোধী লেখক অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে প্রায় একই সময়ে একই স্থানে একইভাবে ছুরি-চাপাতি দিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিল হরকাতুল জিহাদের জঙ্গিরা। আমার 'জিহাদের প্রতিকৃতি' প্রামাণ্যচিত্রে সাবেক হুজিকর্মী তার জবানবন্দিতে বলেছে, হুমায়ুন আজাদের হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে কিভাবে ছাত্রশিবিরের কর্মীরা উল্লসিত হয়ে মিষ্টি বিতরণ করেছিল। হুমায়ুন আজাদের ওপর হুজির বর্বরোচিত হামলার তিন সপ্তাহ আগে জামায়াতের তৎকালীন সংসদ সদস্য দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, তার মতো মুরতাদকে হত্যার জন্য ব্লাসফেমি আইন পাস করতে হবে। হামলার পর হুমায়ুন আজাদ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, এর জন্য জামায়াতের দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও মতিউর রহমান নিজামী দায়ী। হুমায়ুন আজাদের 'অপরাধ' ছিল তিনি ২০০১ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জামায়াত-বিএনপির সন্ত্রাসীদের নজিরবিহীন সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ওপর 'পাক সার জমিন সাদ বাদ' নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন। মুক্তচিন্তার পক্ষে সর্বদা সোচ্চার ছিলেন এই বরেণ্য লেখক। শুধু লেখক নন, তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভাষাবিজ্ঞানী। তাঁর গদ্য ও পদ্য বাংলা সাহিত্যকে বিভিন্নভাবে সমৃদ্ধ করেছে। হুমায়ুন আজাদ বেঁচেছিলেন মাত্র ছাপ্পান্ন বছর। তাঁর একটি অসামান্য উপন্যাসের নাম 'ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল'। হুমায়ুন আজাদের প্রথাবিরোধী, যুক্তিবাদী সাহিত্যের যোগ্য উত্তরাধিকারী অভিজিৎ রায়কে ছাপ্পান্ন বছরও বাঁচতে দেয়নি মৌলবাদী ঘাতকরা। মাত্র বিয়াল্লিশ বছরে অভিজিৎ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। অভিজিতের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের প্রাক্তন অধ্যাপক অজয় রায় আমাদের 'একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি'র অন্যতম উপদেষ্টা। তিনি 'মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী দক্ষিণ এশীয় গণসম্মিলন'-এর অন্যতম সভাপতি। 'হিউম্যান রাইটস কংগ্রেস ফর বাংলাদেশ মাইনরিটিস' এবং 'সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পরিষদ'-এরও সভাপতি তিনি। পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুপরিচিত। কয়েক বছর তিনি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার মনোনয়ন কমিটির সদস্য ছিলেন। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি হাসপাতাল মর্গের অফিসে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে অজয়দা বলছিলেন, 'আমার এই ছেলেটি সব দিক দিয়ে আমাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল।' ২০০৭ সালে আমরা অভিজিতের 'মুক্তমনা' ওয়েবসাইটকে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনে অসামান্য অবদানের জন্য 'জাহানারা ইমাম স্মৃতিপদক' প্রদান করেছিলাম। জামায়াতে ইসলামী তালিকা প্রস্তুত করে শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের হত্যাযজ্ঞ আরম্ভ করেছে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে। বাঙালিকে মেধাশূন্য করার জন্য ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এই হত্যাকাণ্ড আরো পরিকল্পিত ও ব্যাপকভাবে সংঘটিত করার জন্য জামায়াত তখন 'আলবদর' নামে ভয়ংকর ঘাতক বাহিনী গঠন করেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে হিটলারের 'এসএস' বাহিনীর আদলে।
 
২০০১ সালে খালেদা জিয়ার বদৌলতে ক্ষমতার অংশীদার হয়ে জামায়াত হিন্দু নিধনের পাশাপাশি মুক্তচিন্তার বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের হত্যার জন্য শতাধিক জঙ্গি মৌলবাদী সংগঠনের জন্ম দিয়েছে। তাদেরই একটি 'আনসার বাংলা সেভেন' অভিজিৎ হত্যার দায় স্বীকার করেছে। এর আগে ১৯৯৯-এর ১৮ জানুয়ারি জামায়াতের আশীর্বাদপুষ্ট হরকাতুল জিহাদের জঙ্গিরা বরেণ্য কবি শামসুর রাহমানকে হত্যার জন্য তাঁর বাড়িতে গিয়ে হামলা করেছিল। পরিবারের সদস্যদের প্রতিরোধের কারণে সেবার কবি অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন। তখন ক্ষমতায় ছিল শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ। শামসুর রাহমানের হত্যা প্রচেষ্টার সঙ্গে যুক্ত থাকার জন্য প্রথমে তিনজন হুজি ক্যাডারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে গোয়েন্দা বিভাগ মোট আটচল্লিশজনকে গ্রেপ্তার করেছিল, যাদের ভেতর একজন ছিল পাকিস্তানি সাজিদ এবং আরেকজন দক্ষিণ এশিয়ার সাদিক। এরা বলেছিল, আফগানিস্তানে জিহাদের উদ্দেশ্যে মুজাহিদীন রিক্রুট করার জন্য ওসামা বিন লাদেন তাদের ২০ মিলিয়ন ডলার দিয়েছিল, যা তারা ৪২১টি মাদ্রাসায় বিতরণ করেছে। বাংলাদেশে জঙ্গি মৌলবাদীদের নেটওয়ার্ক, বিশেষভাবে আল-কায়েদার সঙ্গে জামায়াতের সম্পৃক্ততা সম্পর্কে তখনই প্রথমবারের মতো জেনেছিলাম আমরা, যা ২০০১ সালের অক্টোবরে জামায়াত-বিএনপি জোট ক্ষমতায় আসার পর থেকে আরো বিস্তৃত হয়েছে। শামসুর রাহমানের ওপর হামলার জন্য যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, জামায়াত-বিএনপির জোটের জমানায় তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে- যারা পরে হুমায়ুন আজাদ হত্যাকাণ্ড, শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড-বোমা হামলার পাশাপাশি অর্থনীতিবিদ কিবরিয়া, অধ্যাপক ইউনূস ও সাংবাদিক মানিক সাহা সহ শতাধিক বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, রাজনীতিবিদ ও সংস্কৃতিকর্মী হত্যা করেছে। এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি এবং হয়নি বলেই এখনো মুক্তচিন্তার লেখক ও ব্লগারদের হত্যাকাণ্ড অব্যাহত রয়েছে। প্রগতিবাদী শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের কেন হত্যা করতে হবে, কিভাবে হত্যা করতে হবে- এসব বিষয়ে জামায়াত এবং তাদের সহযোগীদের বহু প্রকাশনা রয়েছে। তাদের একাধিক তালিকায় 'মুক্তমনা' অধ্যাপক অজয় রায় ও অভিজিৎ রায়ের নাম আছে। পাঁচ বছর আগে অধ্যাপক অজয় রায় 'জিহাদের প্রতিকৃতি' প্রামাণ্যচিত্রে বলেছিলেন, বাংলাদেশকে একটি মনোলিথিক মুসলিম রাষ্ট্র বানানোর উদ্দেশ্যেই জামায়াত-বিএনপির জোট সাম্প্রদায়িক সহিংসতাসহ যাবতীয় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করছে। অভিজিতের হত্যাকাণ্ডের জন্য অধ্যাপক অজয় রায় জামায়াতকেই দায়ী করেছেন। দুই বছর আগে এই ফেব্রুয়ারি মাসেই জামায়াত-হেফাজতের সন্ত্রাসীরা ব্লগার রাজীবকে হত্যা করেছে। ঘাতকরা তাদের ব্লগে এবং জামায়াত-হেফাজতের নেতারা জনসভায় বক্তৃতায় বলেছেন, ধর্মদ্রোহিতার জন্য রাজীবকে হত্যা করা হয়েছে। দুই বছর আগে প্রধানমন্ত্রী নিহত রাজীবের পরিবারকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য তাদের বাড়িতে গিয়ে বলেছিলেন, জামায়াত কোনো রাজনৈতিক দল নয়, এটি একটি সন্ত্রাসী সংগঠন।
 
অভিজিৎ হত্যার পর প্রধানমন্ত্রী তো নয়ই, তার মন্ত্রিসভার কোনো সদস্যও অভিজিতের মাতা-পিতাকে সমবেদনা কিংবা সহমর্মিতা জ্ঞাপন করতে যাননি।
 
 ২৭ ফেব্রুয়ারি দুপুর পর্যন্ত আমি অজয়দার সঙ্গে ছিলাম। বাংলাদেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই এসেছিলেন বিধ্বস্ত অজয়দা ও শয্যাশায়ী বউদিকে সমবেদনা জানানোর জন্য। সরকারের বা রাজনৈতিক দলের কোনো নেতাকে দেখিনি।
 
 বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী মৌলবাদের আশঙ্কাজনক উত্থান ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শক্তির পায়ের তলার মাটি ক্রমেই দখল করে নিচ্ছে। যেসব দল ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী বলে দাবি করে, নেতাদের অনেকের মস্তিষ্কের নিভৃত কোণে মৌলবাদের অন্ধকার অবস্থান করছে।
 
অভিজিৎ নিহত হওয়ার আড়াই ঘণ্টা আগে অজয়দা আমাকে ফোন করেছিলেন। বলেছিলেন, তাঁদের 'মুক্তমনা' ব্লগটি সরকার বাংলাদেশে বন্ধ করে দিয়েছে, এ বিষয়ে কিছু করতে পারি কি না। আমি বিস্মিত হয়ে বলেছিলাম, এটা কখনো সরকারের নীতি হতে পারে না। এই সরকার কেন 'মুক্তমনা'র মতো জামায়াত-জঙ্গিবাদবিরোধী ব্লগ বন্ধ করবে! অজয়দা বললেন, খোঁজ নিয়ে দেখুন কে এ কাজ করেছে। তাঁকে আশ্বস্ত করে বলেছিলাম, এ নিয়ে আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলব। এর পরই আমি টেলিভিশনের একটি আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য বেরিয়ে যাই। আলোচনার মাঝপথে উপস্থাপক জানালেন যুক্তিবাদী লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়ের হত্যার সংবাদ।
 
ফিরে এসে কয়েক দফা স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে ফোন করে লাইন বন্ধ পেয়েছি। সম্ভবত তিনি দেশে নেই। আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হানিফ অবশ্য অভিজিৎ হত্যার নিন্দা করেছেন এবং এর জন্য জামায়াত-বিএনপিকে দায়ী করেছেন।
 
অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, অভিজিতের হত্যাকারীরাও ধরা পড়বে না, মামলা মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে জেলা আদালতের কোনো অন্ধকার কোণে। ঘাতকরা ছুরিতে শাণ দেবে তালিকার পরবর্তী জনকে হত্যার জন্য। জঙ্গিদের বিভিন্ন আস্তানা থেকে এ পর্যন্ত পুলিশ যতগুলো হিটলিস্ট উদ্ধার করেছে, প্রতিটি তালিকায় প্রথম নাম শেখ হাসিনার। '
 
জিহাদের প্রতিকৃতি' প্রামাণ্যচিত্রে হুজি নেতা মুফতি হান্নান বলেছেন, ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার জনসভায় হামলা পরিকল্পনায় জামায়াত-বিএনপির শীর্ষ নেতারা কেন ও কিভাবে যুক্ত ছিলেন। সর্বশেষ ভারতীয় গণমাধ্যম ও গোয়েন্দা সূত্র থেকে জেনেছি, পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে জামায়াতের সাংগঠনিক কার্যক্রমের বিস্তার এবং কিভাবে আত্মঘাতী জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য। কলকাতায় সংবাদপত্র থেকে এটাও জেনেছি, দীর্ঘকাল ধরে জামায়াত ও জঙ্গিরা বাংলাদেশে কোনো ঘটনা ঘটিয়ে পশ্চিমবঙ্গের কোথাও গিয়ে গা ঢাকা দেয়। অনেক সময় পশ্চিমবঙ্গে তারা সরকারি দলের সহযোগিতাও পায়।
 
হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলাকারীরা যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পেত, তাহলে রাজীব অথবা অভিজিৎ হত্যার আগে ঘাতকরা দশবার চিন্তা করত। এসব হত্যার বিচার না হওয়ার কারণে বাংলাদেশে মুক্তচিন্তার বুদ্ধিজীবীরা শুধু নন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নিরাপদ নন।
 
মৃত্যুর এক বছর আগে হুমায়ুন আজাদ একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, যার শিরোনাম 'আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম ?' সরকার পতনের জন্য গত ছাপ্পান্ন দিন যাবৎ অবরোধ-হরতালের নামে জামায়াত-বিএনপির সন্ত্রাসীরা বাস ও অন্যান্য পরিবহনে পেট্রলবোমা মেরে যেভাবে নিরীহ মানুষ হত্যা করছে, হুমায়ুন আজাদের গ্রন্থের শিরোনাম ধার করে প্রশ্ন করতে পারি- আমরা কি এই বাংলাদেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম? এই বাংলাদেশের জন্যই কি ৩০ লাখ নিরীহ মানুষ আত্মদান করেছে? জামায়াত এবং তাদের সহযোগীরা বাংলাদেশকে কোথায় নিতে চায় আমরা জানি।
 
 '৭১-এর পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে হলে, যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার বন্ধ করতে হলে, বাংলাদেশকে মনোলিথিক মুসলিম রাষ্ট্র বানাতে হলে, আল-কায়েদা ও ইসলামিক স্টেটের ঘাঁটি স্থাপন করে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক জিহাদি বলয়ের অংশ করতে হলে চলমান সন্ত্রাস ও হত্যাকাণ্ডের বিকল্প কিছু নেই। ঝাড়েবংশে নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত জামায়াত তাদের এজেন্ডা থেকে একচুলও নড়বে না। সরকার বারবার কঠোর হওয়ার হুমকি দিলেও এবং মাঠপর্যায়ের খুচরা জঙ্গিদের অনেকে গ্রেপ্তার হলেও যাবতীয় সন্ত্রাসের মূল হোতা এবং দার্শনিক ভিত্তি নির্মাতা জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার কোনো উদ্যোগ এখনো দৃশ্যমান নয়। জামায়াত এবং তাদের নতুন ও পুরনো সহযোগীরা বাংলাদেশকে যেখানে নিতে চায়, প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অবস্থানকারী জামায়াত ও জঙ্গি সুহৃদরা একই লক্ষ্যে নিষ্ঠার সঙ্গে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করছে।
 
ঘাতকরা অভিজিৎ ও তাঁর স্ত্রী বন্যাকে যেখানে ছুরিকাঘাত করে, তার অল্প দূরেই পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল। প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য- পুলিশ ঘাতকদের ধাওয়া করলেই ধরতে পারত; কিন্তু তারা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে।
 
গত জানুয়ারিতে প্যারিসে কার্টুন পত্রিকা 'শার্লি এবদো'র দপ্তরে আল-কায়েদার জঙ্গি হামলার পর কয়েক হাজার ফরাসি পুলিশ কিভাবে ঘাতকদের অনুসরণ করে তাদের কুকুরের মতো গুলি করে হত্যা করেছে, আমরা টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছি। প্রশাসনের মতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভেতরও যদি রন্ধ্রে রন্ধ্রে জামায়াত অবস্থান করে, সে দেশে জঙ্গি দমন সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায় 'বন্ধ্যাগমনের মতো নিষ্ফল' হতে বাধ্য। ২০১৩-১৪ সালে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সময় সংবাদ বেরিয়েছে, বহু জায়গায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিষ্ক্রিয় ছিল, কোথাও তারা হামলাকারীদের সহযোগিতাও করেছে। তিন বছর ধরে ক্রমাগত বলছি, প্রশাসন জামায়াতমুক্তকরণের পাশাপাশি আমাদের পুলিশ বাহিনীর জনবল ও রসদ বৃদ্ধি করতে হবে, উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি করতে হবে।

Friday, February 27, 2015

ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে- অভিজিৎ রায়

লেখকের জবানবন্দী
 
আমি কোন প্রথাগত রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ছিলাম না। এখনো নই। আমি মূলত একজন কাটখোট্টা বিজ্ঞান লেখক। যারা আমায় চেনে এই পরিচয়ই হয়তো কিছুটা চেনে। তবে কাঠখো...ট্টা বিজ্ঞানের লেখা লিখলেও রবীন্দ্রনাথকে একদম জানিনা তা তো নয়। তবে সে জানাটাও বিজ্ঞানের মাধ্যমেই। তাঁর শেষ বয়সে লেখা ‘বিশ্বপরিচয়’ নামের প্রিয় বইটা তো সেই ছোটবেলাতেই পড়া হয়ে গিয়েছিল, তারপর ‘বড় হয়ে’ বিজ্ঞানের নানা বিষয় আশয় নিয়ে পত্র-পত্রিকা এবং ব্লগে লিখতে গিয়েই রবীন্দ্রনাথকে নতুন করে আবিষ্কার করা আমার। ততদিনে কেবল বিশ্বপরিচয়ের সাথেই পরিচয় ঘটেনি, পাশাপাশি জানা হয়েছে বিখ্যাত বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর সাথে বন্ধুত্বের কথা, জেনে ফেলেছি আইনস্টাইনের মতো বিজ্ঞানীর সাথে বাস্তবতা, দর্শন এবং প্রাচ্য-প্রতীচ্যের সুরের মূর্ছনা নিয়ে কী ভীষণ নিগূঢ় আলোচনা করেছিলেন কবি। এগুলো নিয়ে আমার কিছু বিশ্লেষণমূলক প্রবন্ধ এখানে ওখানে প্রকাশিতও হয়েছে ততদিনে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কোন পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ আমি কখনো লিখব তা মাথায়ই ছিলো না কখনো।
কিন্তু এ দৃশ্যপট পালটে গেল এ বছরের (২০১৪) সালের জুন মাসে দক্ষিণ আমেরিকা ভ্রমণের সময়। সে ভ্রমণের অংশ হিসেবে আর্জেন্টিনা এবং পেরুতে সপ্তাহ খানেক থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। এক ফাঁকে ঢু মেরেছিলাম আর্জেন্টিনার ‘রবি-তীর্থে’ অর্থাৎ, রবিঠাকুরের আর্জেন্টিনীয় বান্ধবী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর বাড়ি ‘ভিলা ওকাম্পো’তে। আমার মেয়েকে নিয়ে বেশ খানিকটা সময় কাটিয়েছিলাম সে বাড়িতে। বার হাজারের ওপর বইপত্র, নানা পাণ্ডুলিপি, চিঠিপত্র এবং ভিক্টোরিয়ার প্রকাশিত পত্রিকার পুরনো সংখ্যা এবং সে বাড়িতে বিভিন্ন সময়ে আপ্যায়িত মনীষীদের ছবি সম্বলিত সেই বাড়ি দর্শনের অভিজ্ঞতাটা অনেকটা তীর্থস্থান ভ্রমণের সাথে তুলনীয় ছিল যেন।
 
‘ভিলা ওকাম্পো’তে প্রবেশের আগে অনেকের মতো আমিও ভাবতাম ওকাম্পো বোধ হয় কেবল রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য অনুরাগীদের মধ্যে অন্যতম একজন নারী ছিলেন। হয়তো একটু আধটু সাহিত্য রসিক, এবং সাহিত্য অনুরক্ত নারী ছাড়া তিনি তেমন কিছু নন। এছাড়া ওকাম্পোর বলার মতো পরিচয়ই বা আছে কী? কিন্তু সে ধারণা আমূল বদলে গেল আর্জেন্টিনা ভ্রমণ শেষ করে। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথির সন্ধান আমি পেলাম, যার আলোকে ওকাম্পোকে জানার চেষ্টা শুরু করলাম। ধীরে ধীরে জানলাম, দক্ষিণ আমেরিকার সাহিত্য সংস্কৃতিতে আধুনিকতা আনয়ন এবং নারীবাদ প্রতিষ্ঠায় ওকাম্পোর কতখানি অবদান ছিল। পাশাপাশি তিনি ছিলেন ভীষণ এক উদ্যমী নারী। তিনি ‘সুর’ নামে একটি পত্রিকা বের করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন ত্রিশের দশকে, এবং এর ডাকসাইটে সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছিলেন প্রায় চল্লিশ বছর ধরে। বুয়েনোস আইরেস থেকে স্প্যানিশ ভাষায় ছাপানো এ পত্রিকাটি কেবল আর্জেন্টিনায় নয়, সারা দক্ষিণ আমেরিকাতেই খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল পঞ্চাশ, ষাট এবং সত্তরের দশকের তাল-মাতাল সময়গুলোতে। হর্হে লুইস বর্হেস, মার্সেল প্রুস্ত, টমাস মান, টি এস এলিয়ট, হেনরি মিলার, জ্যাক মারিত্যাঁ, পল ক্লোদেল, অল্ডাস হাক্সলি, সিমোন ওয়াইল, লিউইস মামফোর্ড, আঁদ্রে জিদ, মার্টিন হাইডেগার, এজরা পাউন্ড সহ সারা পৃথিবীর বিখ্যাত লেখকেরা সে পত্রিকায় লিখতেন। এই পত্রিকার মাধ্যমেই ভার্জিনিয়া উলফের নারীবাদী লেখার সাথে দক্ষিণ আমেরিকার পাঠক-পাঠিকাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ওকাম্পো। পত্রিকা প্রকাশ ছাড়াও সাহিত্য এবং সামাজিক অঙ্গনে তাঁর অবদানের খোঁজ পেলাম ব্যাপক পরিসরে। ভিলা ওকাম্পোর লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখলাম- রবীন্দ্রনাথ, কাইজারলিঙ, ভার্জিনিয়া উলফের মত প্রথিতযশা মানুষদের নিয়ে তিনি বই প্রকাশ করেছেন। অনুবাদ করেছেন কাম্যু, টি ই লরেন্স, ফকনার, ডিলান টমাস, গ্রাহাম গ্রিন সহ অনেকের কাজ। অসংখ্য পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন সারা জীবনে। ১৯৬৭ সালে বিশ্বভারতী থেকে তাঁকে ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি দেয়া হয়েছিল। ১৯৭৭ সালে আর্জেন্টাইন একাডেমি অব লেটার্স’ এর সভানেত্রী (Alberdi Chair) নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। এত শত পুরস্কারের ভিড়ে আমাকে সবচেয়ে বেশি আনন্দিত এবং উদ্বেলিত করেছে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া সম্মাননাটি। আমি খুঁজে দেখলাম, ওকাম্পোর আগে বিগত ৩৩০ বছরে মাত্র দশজন নারী এই সম্মাননা লাভ করতে পেরেছিলেন।
তবে পুরস্কার নয়, সবকিছু ছাপিয়ে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে আসলো তার নারীবাদী এবং মানবতাবাদী ভূমিকাটি। বিশেষত নারীদের অধিকারের উপর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ লেখা লিখেছিলেন, যেগুলো ছিল তখনকার সময়ের তুলনায় যথেষ্ট সাহসী। সে সমস্ত লেখায় তিনি নারী-পুরুষের সাম্যের কথা বলেছেন, নারীর ভোটাধিকারের কথা বলেছেন, নারীর যৌন স্বাধীনতার কথা বলেছেন, বিয়ে এবং পরিবার নিয়ে সনাতন ধারণার বাইরে গিয়ে লিখেছেন, নারীদের উপর পুরুষদের ধর্ষণের প্রতিবাদ করেছেন, এমনকি জন্মনিয়ন্ত্রণ, একক মাতৃত্ব,গর্ভপাতের অধিকার নিয়েও কথা বলেছেন (‘নারী: তার অধিকার ও দায়িত্বসমূহ’ শিরোনামের তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ লেখার অনুবাদ এই বইয়ের পরিশিষ্টে সন্নিবেশিত হয়েছে)। ১৯৩৬ সালে তিনি আর্জেন্টিনা মহিলা সমিতি স্থাপন করেছিলেন, সে সময় পি.ই.এন-এরও সহ-সভানেত্রী ছিলেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে তিনি আর্জেন্টিনায় নাৎসি অনুপ্রবেশ বন্ধ করার লক্ষ্য নিয়ে নিয়ে ‘একশন আর্জেন্টিনা’ (Acción Argentina) গঠন করেছিলেন। এ করতে গিয়ে সামরিক জান্তার রোষানলে পড়েছিলেন তিনি তখন। বিশেষত পেরন সরকারের (১৯৪৬-১৯৫৫) আমলে তাঁকে নানাভাবে হেনস্থা করা হয়েছিল। গ্রেফতার করা হয়েছিল রাষ্ট্রবিরোধী মুক্তমত প্রচার এবং প্রকাশের অভিযোগে। সেসময় জহরলাল নেহেরু, ওয়ালদো ফ্রাঙ্ক, গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল সহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা ওকাম্পোর অসংখ্য বন্ধুবান্ধবদের প্রচেষ্টা এবং দাবীর মুখে ছাব্বিশ দিনের মাথায় সরকার ওকাম্পোকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ওকাম্পো আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন সহমর্মী বান্ধব ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী গণহত্যার প্রতিবাদে ওকাম্পো প্রতিবাদলিপি দিয়েছিলেন আর্জেন্টাইন সরকারের কাছে। এ নতুন নতুন তথ্যগুলো আমাকে আনন্দিত এবং গর্বিত করেছে।
আর্জেন্টিনা ভ্রমণ থেকে ফিরে এসে আমি বাংলাদেশের জনপ্রিয় অনলাইন পত্রিকা বিডিআর্টসের জন্য একটি লেখা লিখেছিলাম – ‘ওকাম্পো আর রবীন্দ্রনাথ : কিছু অশ্রুত গুঞ্জন’ শিরোনামে। আমার ভিলা ওকাম্পো ভ্রমণ অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া নতুন সব তথ্যের আলোকে নতুনভাবে রবীন্দ্রনাথ-ওকাম্পোর সম্পর্ককে বুঝবার প্রয়াস ছিল সে লেখায়। আমি লেখাটিতে দেখিয়েছিলাম ওকাম্পোর সাথে রবীন্দ্রনাথ কেবল ‘প্লেটোনিক ধরণের’ রোমান্টিক সম্পর্কে জড়াননি, কিংবা ‘বিজয়ার করকমলে’ লিখে ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করেই তাঁর আর্জেন্টিনা অধ্যায় শেষ করে দেননি, বরং পূরবী পরবর্তী বহু কবিতা, গল্প এবং উপন্যাসে ওকাম্পোর উপস্থিতি খুঁজে পাওয়া যায়। ওকাম্পোর প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের অনেক বিখ্যাত চিত্রকর্মেও। শুধু তাই নয়, আমি লেখাটিতে কিছু উপকরণ হাজির করেছিলাম, যার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয় যে, ওকাম্পোর সংশ্রব রবীন্দ্রনাথের প্রথাগত নারীভাবনা শেষ বয়সে এসে কিছুটা হলেও পাল্টাতে সাহায্য করেছিল। লেখাটির শেষদিকে এসে আমি আধুনিক বিবর্তন মনোবিজ্ঞানের প্রেক্ষাপট থেকে রবীন্দ্রজীবনে নারী এবং প্রেমকে বিশ্লেষণ করেছিলাম, যা এর আগে কেউ করেছিলেন বলে আমার জানা নেই। লেখাটি ছিল বেশ দীর্ঘ। আমি ভেবেছিলাম এ ধরণের একঘেয়ে নিরস লেখা পড়তে পড়তে হয়তো পাঠকদের ক্লান্তি চলে আসবে। কিন্তু পাঠকদের কাছ থেকে যে প্রতিক্রিয়া পেয়েছি, তাতে মনে হয় সেরকম কিছু হয়নি। বরং, যে কোন কারণেই হোক, লেখাটি পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল। অনেক পাঠক সে লেখায় মন্তব্য করে লেখাটিকে পূর্ণাঙ্গ বইয়ে রূপ দিতে অনুরোধ করেন। আমি বিশেষভাবে উল্লেখ করব বিডিআর্টসের সম্পাদক রাজু আলাউদ্দিনের কথা। বিডিনিউজ পত্রিকায় আমার পাঠানো প্রবন্ধটি পড়ে সেটিকে আরও কিছুটা বিবর্ধিত করার পরামর্শ দিয়ে পরবর্তীতে একটি বই প্রকাশের কথা বলেছিলেন। এবং সেটি তিনি বলেছিলেন প্রবন্ধটি পত্রিকায় প্রকাশের পূর্বেই। শুধু তাই নয়, আমাকে চাপ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ-ওকাম্পোর মধ্যকার সারাজীবনে প্রেরিত পত্রাবলীর অনুবাদ করিয়ে নিলেন। কেবল তাঁর কারণেই ওকাম্পো-রবীন্দ্রনাথের মধ্যকার পঞ্চাশটি হাতে লেখা চিঠির অনুবাদ এই গ্রন্থের শেষে সন্নিবেশিত হতে পেরেছে। এখানেই শেষ নয়, বইয়ের পাণ্ডুলিপি হয়ে যাবার পর তিনি পুরো পাণ্ডুলিপিটি পড়ে একটা চমৎকার মুখবন্ধ লিখে আমাকে অসীম কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন তিনি।
রাজু আলাউদ্দিন ছাড়াও আরো দু’জনের কথা আমার আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হবে। একজন হলেন বন্ধু রাজর্ষি দেবনাথ। তিনি আটলান্টা থাকাকালীন সময়ে আমার পাণ্ডুলিপিটি মন দিয়ে পড়েছেন এবং বেশ কিছু প্রয়োজনীয় সংশোধনীর পরামর্শ দিয়েছেন। বস্তুত প্রাথমিক প্রুফ-রিডিং এর কাজটুকু হয়ে গিয়েছিল ‘বানান-বিশারদ’ রাজর্ষি থাকার কারণেই।
আর অন্যজন আমার স্ত্রী বন্যা আহমেদ। আমার লেখালিখির সবচেয়ে বড় সমালোচক সে। পাশাপাশি সবচেয়ে বড় প্রেরণাদাতাও। অফিসের ব্যস্ততা, কাজ কর্ম আর জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে বইটার ব্যাপারে যখন উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিলাম, তখন বন্যা আমাকে নিরন্তর উৎসাহ দিয়ে গেছে। শুধু তাই নয় পরিশিষ্টে সন্নিবেশিত ওকাম্পোর ‘নারী: তার অধিকার ও দায়িত্বসমূহ’ শিরোনামের লেখাটার পুরোটা অনুবাদে সাহায্য করেছে নিজের সমস্ত কাজকর্ম শিকেয় তুলে রেখে। বন্যা না থাকলে বইটা আদৌ বের হতো কিনা আমি একেবারেই নিশ্চিত নই।
আর আছেন অবসর প্রকাশনীর সর্বেসর্বা আলমগীর রহমান। এই আলমগীর ভাইকে আমি ভীষণ ভয় পাই। উনি একসময় আমার ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে’ এবং আমার স্ত্রী বন্যার ‘বিবর্তনের পথ ধরে’ বই দুটো প্রকাশ করেছিলেন। সে প্রায় সাত আট বছর আগের কথা। এর পর থেকে বই প্রকাশের জন্য উনার দ্বারস্থ হয়ে উঠা হয়নি। আমার বরাবরই মনে হত, আমার লেখা টেখা উনি বিশেষ পছন্দ করেন না। কিন্তু কোন এক বিচিত্র কারণে এবার বিডিনিউজে আমার লেখাটি প্রকাশের পর তিনি এ নিয়ে গ্রন্থ প্রকাশে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। শুধু তাই নয়, এই পাণ্ডুলিপি যেন তাকে ছাড়া আর কাউকে যেন না দেয়া হয়, দিলে ‘ছিল্লা কাইট্টা’... বলে মহা ভয় দেখিয়েছেন। সেই ভয়ে যার পর নাই ভীত হয়ে পাণ্ডুলিপি তার হাতেই তুলে দিলাম। তবে কানে কানে বলে রাখি বাজারে একটা কথা প্রচলিত আছে যে আলমগীর ভাই নাকি নারকোলের মত। উনার কেবল বাইরের খোলসটাই শক্ত, ভিতরটা নাকি একদম নরম। তবে অনেকেই ভিতরের খবর পায় না। আমি পেয়েছি কিনা বলতে পারব না, তবে বুঝতে পেরেছি তিনি ভাল বই প্রকাশের ব্যাপারে কেবল আন্তরিকই নন, সেই সাথে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রফেশনাল এবং সবচেয়ে ভাল প্রকাশক - উনার কাজের সাথে যারা পরিচিত তাঁরাই বলতে পারবেন। বইটি অবসরের কাছে তুলে দিতে পেরে গর্বিত এবং আনন্দিত বোধ করছি।
বিডিআর্টসে প্রকাশের কিছুদিন পর মুক্তমনা ব্লগেও আরেকটু বিবর্ধিত আকারে লেখাটি প্রকাশ করেছিলাম – ‘ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে’ শিরোনামে। বইটির জন্য এ শিরোনামটিই যুক্তিযুক্ত মনে হওয়ায় সেটাই রেখে দিলাম। নতুন শিরোনাম খোঁজার যন্ত্রণা থেকে অন্তত বাঁচা গেল! বইটি পাঠকদের ভাল লাগলে আনন্দিত বোধ করব।
অভিজিৎ রায়
ইমেইল – charbak_bd@yahoo.com
ফেব্রুয়ারি, ২০১৫
==================