Wednesday, March 4, 2015

ধর্মের নামে চরম অধর্ম -ইমানুল হক

৪ মার্চ , ২০১৫, ০০:০১:৫২১  দৈনিক আনন্দবাজার

ধর্ম-ব্যবসায়ীরা জানেন কি, রামের গুরু জাবালি ছিলেন নাস্তিক, হজরত মহম্মদের সময়ও বহু মানুষই নাস্তিক ছিলেন?  

ধর্মে বলপ্রয়োগ নেই। বলা হয়েছে আল কোরানে (৪৯:১১)। বলা হয়েছে, তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম এবং আমার জন্য আমার ধর্ম। লেখা আছে: তোমার প্রভু যদি ইচ্ছা করতেন, তা হলে পৃথিবীর সমস্ত মানুষই (ইসলামে) বিশ্বাসী হত, তবে কি তুমি মানুষকে ধর্মের পথে আনবার জন্য তার ওপর বলপ্রয়োগ করতে যাবে? ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে ১৯ মার্চ আরাফত ময়দানে শেষ ভাষণে পবিত্র হজরত মহম্মদ বলেছিলেন, ধর্মের সম্পর্কে কেউ বাড়াবাড়ি করবে না। এই বাড়াবাড়ির জন্য বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। তবু অভিজিৎ রায়কে ধর্মরক্ষার নামে বাড়াবাড়ি করে ‘বলপ্রয়োগ’-এর মাধ্যমে ধর্মের অভিভাবক সেজে নৃশংস ভাবে হত্যা করেছে একদল অসভ্য বর্বর ধর্ম-ব্যবসায়ী সাম্প্রদায়িক। ঘৃণ্য এই হত্যা।  ২  এরা ক্ষমতালোভী ধর্ম-ব্যবসায়ী। গণতান্ত্রিক ভাবে না পেরে, ভয় দেখিয়ে, বোমা ছুড়ে শিশু-নারী হত্যা করে ক্ষমতায় যেতে চায়। সব দেশে, সব কালে ধর্মের নামে প্রবল অধর্মকে লালন ও পালন করে। ইসলামের নামে ইসলামের আদর্শকে হত্যা করে। হিন্দুত্বের নামে হিন্দুত্বের মূল নীতিকে। মুসলমান বা হিন্দু নয়, এদের জাত একটাই: ধর্মব্যবসা। ধর্ম, রাজনীতি ও ক্ষমতার ‘ককটেল’ বানিয়ে অর্থ, প্রতিপত্তি অর্জন করতে চায়। তাই ব্যাংক বানায়, হাসপাতাল চালায়, স্কুল-কলেজ খোলার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ মারে। হত্যা করে কুপিয়ে চপার মেরে।  ৩  ১৯৪৭-এ কলকাতায় শচীন মিত্র, ’৬৪-তে ঢাকায় আমির হোসেন চৌধুরি দাঙ্গার সময় প্রতিবেশীদের রক্ষা করতে গেছেন, একই কায়দায় দুই আপাত-বিপরীত পক্ষ তাঁদের হত্যা করেছে। ২০০৪-এ ধর্মনিরপেক্ষ নারীবাদী লেখক-অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে জামাতিরা ঢাকায় নৃশংস ভাবে আক্রমণ করে প্রকাশ্য দিবালোকে। তাঁর মৃত্যু ঘটে ১১ অগস্ট, ২০০৪-এ। অধ্যাপক এইচ এস সাভারওয়াল ছিলেন উজ্জয়িনীর মাধব কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক। অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের উগ্র সন্ত্রাসী কর্মীদের হাতে তিনি ২৬ অগস্ট ২০০৬ নিহত হন। ব্লগার রাজীব হায়দার প্রকাশ্যে খুন হন ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩। শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের জমায়েত শুরুর দশ দিনের মাথায়। পুণেয় কুসংস্কার বিরোধী আন্দোলনের নেতা, লেখক নরেন্দ্র দাভলকরকে ‘হিন্দু’ ধর্মরক্ষার নামে প্রকাশ্যে সকালে পার্কে হত্যা করেছে ২০ অগস্ট ২০১৩। যে ভাবে প্রকাশ্যে কুপিয়ে অভিজিৎ রায়কে ধর্মরক্ষার নামে হত্যা করেছে ‘মুসলমান’ নামধারী সন্ত্রাসীরা। তাঁর স্ত্রী রফিদা আহমেদ বন্যা পাঞ্জা কষছেন মৃত্যুর সঙ্গে। খুন হয়েছেন ২০১৩-১৪-য় বাংলাদেশে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহম্মদ ইউনুস, অধ্যাপক শফিউল ইসলাম লিলন, মৌলানা নুরুল ইসলাম, ব্লগার আশরাফুল ইসলাম। ভারতে সম্প্রতি খুন হলেন গোবিন্দ পানেসর। লেখা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন তামিল লেখক মুরুগান। এই হত্যাকারী ও হামলাকারীরা ‘হিন্দু’ বা ‘মুসলমান’ নামের কলঙ্ক। অবিশ্বাসী বা নাস্তিক ‘রামায়ণ’-এর যুগেও ছিল। রামদের গুরুদেব জাবালি ছিলেন নাস্তিক। হজরত মহম্মদের সময়েও নাস্তিকরা ছিলেন। পবিত্র মহম্মদ তো এদের হত্যা করেননি বা করাননি।  ৪  কোনও লেখার বিরুদ্ধে কিছু বলার থাকলে লিখেই বলতে হবে। কারও বলার বিরুদ্ধে বক্তব্য থাকলে, বলে। এটাই সভ্যতা। ভয় দেখিয়ে, কুৎসা রটিয়ে বা খুন করে নয়। রক্ত, জিঘাংসা, প্রতিহিংসা কি কোথাও পৌঁছে দেবে আমাদের? অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে ছিলেন পবিত্র মহম্মদ। ক্ষমা করেছিলেন প্রিয় সাহাবির কলিজা ভক্ষণকারী মহিলা হিন্দাহকে। হজরত মহম্মদকে হত্যা করবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন আরবের প্রসিদ্ধ কবি কাব। একদিন কাব চলছিলেন হজরত মহম্মদের বিরুদ্ধে হত্যার উদ্দেশ্য নিয়ে লেখা কবিতা পড়তে পড়তে। শব্দচয়ন আর গীতমাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে কবিতার বিষয়বস্তুর কথা না ভেবে হজরত মহম্মদ নিজের পরিহিত শাসকের শিরোভূষণ পরিয়ে দেন কবি কাবের মাথায়। কাব বিস্মিত হয়ে যান। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।  ধর্মের স্বঘোষিত অভিভাবক হত্যাকারীরা কি শুনছেন?

No comments:

Post a Comment