Tuesday, September 24, 2013

যুদ্ধাপরাধীদের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের প্রশ্নবিদ্ধ সহমর্মিতা - আঞ্জুমান ইসলাম ও ওমর শেহাব

সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৩

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (HRW) ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল (AI) বিশ্বের নামকরা মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অন্যতম। এসব সংগঠনসহ বেশকিছু আন্তর্জাতিক এনজিও হঠাৎ করে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং আইন ও বিচার ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বেশ উৎকণ্ঠা (!!!) প্রকাশ করে আসছে।ব্যাপারটি বেশ আশাজাগানিয়া হত যদি তারা এর পাশাপাশি বিশ্বজিৎ বা ত্বকী হত্যাকাণ্ড ও এর সুষ্ঠু বিচার নিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে চাপের মুখে রাখত কিংবা ফটিকছড়ি-রামুতে বর্বরোচিত তাণ্ডব বা বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উপর নিপীড়ন ও আগ্রাসনের ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নিতে না পারায় সরকারকে ব্যর্থতার দায়ে অভিযুক্ত করত।

কিন্তু তা না করে দেখা গেল গত এক বছরে তারা তাদের অধিকাংশ রিপোর্ট প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের জন্মের সময়ে নির্বিচারে যারা যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছে শুধুমাত্র তাদের ‘মানবাধিকার’ কোনোভাবে লঙ্ঘন হচ্ছে কিনা সে ব্যাপারে আলোকপাত করে। বিষয়টি আশ্চর্যজনক বটে!

আরও আশ্চর্যজনক ব্যাপার হল প্রত্যেক যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায়ের আগে ও পরে প্রায় চার দশক ধরে যুদ্ধাপরাধীদের পৃষ্ঠপোষক জামায়াত-শিবির যে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করে অমানবিক নৃশংসতা দেখাচ্ছে, সেগুলোকে ‘রাষ্ট্র, বিশেষ করে বিচার ব্যবস্থার প্রতি হুমকি’ বলে উল্লেখ না করে, শুধুমাত্র গোলাম আযমের রায়কে ‘ত্রুটিপূর্ণ’ দেখানোর প্রতি হিউম্যান রাইটস ওয়াচের আগ্রহ বেশি দেখা যাচ্ছে।

বিয়াল্লিশ বছর ধরে বিচারের আশায় বুক বেঁধে মুক্তিযুদ্ধের যে ভিকটিমরা ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধীদের ন্যায্য বিচার ও সাজা দেখার অপেক্ষায় আছেন– সেই নিপীড়িত নর-নারী, আত্মীয়-পরিজনদের উপর ঘটে যাওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি পাশ কাটিয়ে প্রকারান্তরে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নেওয়া এসব মানবাধিকার সংস্থার ব্যাপারে আমরা তাই আগ্রহ বোধ করলাম। তাদের সাম্প্রতিক কিছু রিপোর্ট খুঁটিয়ে দেখলাম এবং যা পেলাম তা খুবই কৌতূহলোদ্দীপক।

উদাহরণ দেওয়া যাক। রাজাকার সাঈদীর যুদ্ধাপরাধের সাক্ষী সুখরঞ্জন বালীকে ডিবি পুলিশ অপহরণ করেছে এ কথা কোত্থেকে জানল সে ব্যাপারে হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে জিজ্ঞেস করলে ওরা ডেভিড বার্গম্যানের সূত্র দিয়ে থাকে।
ডেভিড বার্গম্যানকে জিজ্ঞেস করলে তিনি শুধুমাত্র সাঈদীর আইনজীবী ব্যরিস্টার রাজ্জাকের জুনিয়র হাসানুল বান্না সোহাগকে তার সূত্র হিসেবে উল্লেখ করেন। সোহাগের বস ব্যারিস্টার রাজ্জাককে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন এটি তাকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে!


২০১৩ সালের ২৯ এপ্রিল প্রকাশিত ওমর শেহাবের করা অ্যানালাইসিস “The missing links of the Bali abduction allegation”-এ এই দুর্বল সূত্রের দুষ্টচক্রটি (circle of reference) স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। পাঠক-পাঠিকাদের সুবিধার জন্য আমরা সেই প্রবন্ধ থেকে এই দুর্বল সূত্রের দুষ্টচক্রটির একটি ছবি তুলে ধরলাম।



সুখরঞ্জন বালীর কথিত অপহরণের ব্যাপারে কোন প্রতিষ্ঠান কাকে সূত্র হিসেবে উল্লেখ করছে তার ছবি। প্রশ্নবোধক চিহ্নটি হল একটি ভুতুড়ে সূত্র।
এখন দেখা যাক এই দুষ্টচক্রে অংশগ্রহণকারীদের কাজের সময়ের ব্যবধানের একটি ছবি।

সুখরঞ্জন বালীর কথিত অপহরণের সংবাদ প্রকাশকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রকাশিত প্রতিবেদনের সময়ের ব্যবধান ও তথ্যসূত্রের পরম্পরার একটি চিত্র।

বিদেশি মানবাধিকার ও দাতা সংস্থার এ ধরনের উন্নাসিক ও একপেশে আচরণ আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়। আশার ব্যাপার হল গত বিয়াল্লিশ বছরে জাতি হিসেবে আমাদের অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি তাদের এ বার্তা পৌঁছে দিয়েছে যে তাদের সেই তলাবিহীন ঝুড়ির তকমা আমরা অনেক আগেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি– অধিকার, আইন, নৈতিকতা, সভ্যতা, সমাজ এসব ব্যাপারে তাদের অষুধ গেলাই আমাদের একমাত্র কাজ নয় বরং আমাদের কাছ থেকেও তাদের অনেক কিছু শেখার আছে।

উদাহরণস্বরূপ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কর্মকাণ্ডের পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশের প্রথম সারির জাতীয় দৈনিকগুলোর প্রতিবেদনের গুণগত মান যে কোনো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সমমান এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিখ্যাত পত্রপত্রিকাগুলোকেও ছাড়িয়ে গেছে।

প্রসঙ্গক্রমে, ইকোনমিস্টের সেই প্রতিবেদনের কথা বলা যায় যেটিতে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে তুলনা করার জন্য বহুল-বিতর্কিত নাজি সেনাপতি আইখম্যানের বিচারের কথা তুলে ধরা হয়। যদিও আন্তর্জাতিক আইনের অনেক টেক্সট বইয়ে এ বিচারকে বরং মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি দৃষ্টান্ত হিসেবেই তুলে ধরা হয়।

একইভাবে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর বৌদ্ধদের সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের প্রামাণ্য ছবি উপগ্রহের মাধ্যমে তুলে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রকাশ করলেও, কয়েকদিন পরে মাত্র কয়েকশ মাইল দূরে রামুতে মুসলমান সন্ত্রাসীরা বৌদ্ধমন্দির ও জনবসতিতে যখন স্মরণকালের ভয়াবহ সন্ত্রাসী আক্রমণ ঘটাল তখন আর তাদের উপগ্রহ ছবি তোলার জন্য আমাদের আকাশে আসেনি!

বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের বেশকিছু সংশয় দেখা দেওয়ায় আমরা খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নিলাম যে মানবাধিকার সংস্থা ও এর কর্মীরা আসলে একে অপরের থেকে কতটুকু বিচ্ছিন্ন ও প্রভাবমুক্তভাবে কাজ করে যে একটি সংস্থার বা কর্মীর রিপোর্টের তথ্যকে আরেকটি সংস্থা তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। সে সঙ্গে বর্তমানের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার বিতর্কিত কাজকর্ম যা বিভিন্ন সময়ে উচ্চমহলে নাড়া ফেলেছে তা নিয়েও কিছুটা আলোকপাত করার চেষ্টা করব।

এটা বলার অবকাশ রাখে না দুর্বল ও নির্যাতিত মানুষের পক্ষে নৈতিক সমর্থন দানের জন্যে ১৯৭৮ সালে রবার্ট বারনেস্টাইনের নেতৃত্ব হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর আগে অবশ্য হেলসিংকি ওয়াচ ( Helsinki Watch) নামের এ সংগঠনের কাজ শুরু হয় ১৯৭৫ সালে যার মূল উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত ব্লকের কর্মকাণ্ড হেলসিংকি ঘোষণার (Helsinki Accord) সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা।

কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংগঠনটিতে নৈতিক অবক্ষয় দেখা দেয়। প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান রবার্ট বারনেস্টাইন থেকে শুরু করে টাইম ম্যাগাজিনসহ উল্লেখযোগ্য প্রায় সব মিডিয়াই একমত হয় যে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু জনগোষ্ঠী বা দলের মানুষের অধিকার রক্ষায় কাজ করার কারণে নিরপেক্ষতা হারিয়েছে।

কোনো দেশের “সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ততাবিহীনভাবে কাজ করার নীতি” নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও সৌদি সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের অনুদান গ্রহণ করার অভিযোগে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদেরই প্রাক্তন প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট বারনেস্টাইনে দ্বারা।কাকতালীয়ভাবে এর পর থেকে মুসলিমপ্রধান দেশের, বিশেষ করে ইসলামিস্ট সংগঠনগুলোর কাছে ভীষণ গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে থাকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের। এইচআরডব্লিউ প্রধান কেনেথ রথের কাছে নানান দেশ থেকে খোলা চিঠিও দেওয়া শুরু এই অভিযোগ করে যে কেন কেনেথ রথ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর পক্ষে কথা বলছেন।এমন অভিযোগও করা হয় যে ইসলামের নামে মিশরে মুসলিম ব্রাদারহুড নারীদের স্বাধীন চলাফেরাতে যে বাধা দিচ্ছে তার পক্ষেই সাফাই গাইছেন কেনেথ রথ। শুধু তাই নয়, সাম্প্রতিককালে নানান প্রশ্নবিদ্ধ মানুষকে অ্যাডভাইজরি বোর্ডে নিয়োগ দিয়ে যথেষ্ট সমালোচিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে সংস্থাটি। আমেরিকান সেনাবাহিনীর প্রাক্তন সদস্য ও প্রকাশ্য নাৎসি সমর্থক মার্ক গার্লেস্কোকে (Marc Garlesko) সেখানে নিয়োগ দেওয়ার পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে তাকে বরখাস্ত করতে বাধ্য হয় হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।এখন আবার শাওয়ান জাবারীন (Shawan Jabarin), যাকে ইসরাইলি সুপ্রিম কোর্ট ‘ড. জেকিল ও মিস্টার হাইড’ আখ্যা দিয়ে বলেছে, জাবারীন প্রকাশ্যে নিজেকে মানবাধিকারকর্মী বলে দাবি করলেও আসলে জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্য– এ নিয়োগকে বছর দুয়েক আগে বারনেস্টাইন রীতিমতো ‘হোঁচট খাওয়ার মতো’ বলে উল্লেখ করেছেন।ইরাকের রাসায়নিক অস্ত্র ও নার্ভ গ্যাস ব্যবহারের প্রমাণ আছে বলে রিপোর্ট প্রকাশ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ যা প্রকারান্তরে বুশের ইরাক আক্রমণের পক্ষে রায় দেয়। তাদের দেওয়া সেই ঘোষণাটি পরবর্তীতে শতভাগ মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়। মিথ্যা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে শুরু হওয়া ইরাক যুদ্ধের ৬ লাখ অকারণ মৃত্যুর (আমরা মনে করি এগুলো হত্যাকাণ্ড) দায় হিউম্যান রাইটস ওয়াচ কখনওই স্বীকার করেনি।

এ বছর আবার কেনেথ রথ ও তার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ব্যাপারে অভিযোগ উঠেছে “Martin Ennals” মানবাধিকার পুরষ্কারের জন্যে ফাইনালিস্টদের তালিকায় ‘মনা সাইফ’ নামে জঙ্গি-সমর্থক বলে অভিযুক্ত একজনকে নমিনেশন দেওয়ার। এ রকম বহু একপেশে ও উদ্বেগজনক তথ্য যে কেউ পেতে পারেন “Controversies about HRW” লিখে ইন্টারনেটে সার্চ দিলেই।এছাড়া সচেতন স্বেচ্ছাসেবকরা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নিয়ে সবচেয়ে বড় বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়াতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সমালোচনা (Criticism of Human Rights Watch) শীর্ষক একটি সমৃদ্ধ নিবন্ধ লিখে রেখেছেন এবং নিয়মিত হালনাগাদ করে যাচ্ছেন।তাই এ বিষয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনায়যাব না।

কিন্তু কেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এ বর্তমান অবস্থান ও প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকাণ্ড– বিশেষ করে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের ব্যাপারে অহেতুক সহমর্মিতা কি নিছকই কাকতালীয়?

একটু বিশদ অনুসন্ধানী তথ্য দিচ্ছি নিচে এসব মানবাধিকার সংস্থা, এনজিও ও সাংবাদিকের অর্থের উৎস ও পারস্পরিক সম্পৃক্ততা সম্পর্কে। এটি এখনও কোনো সম্পূর্ণ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন নয়। আমরা এটিকে মনে করি কৌতূহলের প্রথম ধাপ। আমাদের বিশ্বাস এই তথ্যগুলো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংগঠনগুলোর কাজকর্ম বিচারের সময় আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে নতুন কিছু উপাদান যোগ করবে।

১৯৮৭ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তদানীন্তন এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর আরিয়াহ নাইয়ার তার ডেপুটি হিসেবে কেনেথ রথকে নিযুক্ত করেন। ১৯৯৩ সালে নাইয়ার হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ছাড়েন বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী জর্জ সোরসের ওপেন সোসাইটি ইন্সটিটিউট (OSI)-এর প্রধান হিসেবে যোগ দিতে। আর নাইয়ারের স্থলাভিষিক্ত হন রথ। এখন পর্যন্ত কেনেথ রথই সংগঠনটির প্রধান।ওপেন সোসাইটি ইনস্টিটিউট হচ্ছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সবচেয়ে বড় অর্থ যোগানদানকারী সংস্থা। ২০১১ সালে আরিয়াহ নাইয়ার ওপেন সোসাইটি ইনস্টিটউটের পক্ষ থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার অর্থসাহায্য করেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে। মজার ব্যাপার হল, নাইয়ারের স্ত্রী ইভেট নাইয়ার নোবেলবিজয়ী বাংলাদেশি ড. মুহম্মদ ইউনূসের গ্রামীণ ফাউন্ডেশনের বোর্ড অব ডিরেক্টরসের একজন।ওপেন সোসাইটি ইনস্টিটউটের প্রতিষ্ঠাতা জর্জ সোরস হচ্ছেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দুটি গুরুত্বপূর্ণ ডিভিশনের অ্যাডভাইসারি কমিটির সদস্য– আমেরিকা এবং ইউরোপ ও মধ্য এশিয়া।

কাকতালীয়ভাবে কি না আমরা জানি না, জর্জ সোরসেরই আরেকটি প্রতিষ্ঠান “সোরস ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট” গ্রামীণ টেলিকমকে ১০.৬ মিলিয়ন ডলার অর্থ প্রদান করে। গ্রামীণ ব্যাংকের দাতাগোষ্ঠীর মধ্যেও জর্জ সোরস ও তার প্রতিষ্ঠান ওপেন সোসাইটি ইনস্টিটউট অন্যতম এবং সোরস নিজেও মাইক্রো ক্রেডিট ও মাইক্রো ফিন্যান্সের একজন বিশাল প্রমোটার।/b>

জর্জ সোরস কতখানি ক্ষমতাধর তা বোঝানোর জন্যে বোধহয় একটি তথ্যই যথেষ্ট। সোরস হচ্ছেন পৃথিবীর প্রথম ২০ ধনীর একজন যিনি ক্লিনটন পরিবারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তার সোরস ফাউন্ডেশন ও ওপেন সোসাইটি ইনস্টিটউটের তরফ থেকে ক্লিনটন ফাউন্ডেশনকে প্রায় ছয় মিলিয়ন ডলার দান করেছেন তিনি শুধু ২০১২ সালেই।

অন্যদিকে ইউরোপভিত্তিক আরেকটি বিশাল দাতা সংস্থা হল সিগ্রিড রেয়্যুসিং ট্রাস্ট (Sigrid Rausing Trust)। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ১৯৯৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত মোট ৯৪,১৮,৪০০ ডলার অনুদান পায় এই সংস্থাটির কাছ থেকে। সিগ্রিড রেয়্যুসিং (যার নামে সিগ্রিড রেয়্যুসিং ট্রাস্ট) নিজেই আবার ইন্টারন্যাশনাল বোর্ড অব হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এমেরিটাস মেম্বার। মজার ব্যাপার হল সিগ্রিড রেয়্যুসিং ট্রাস্টের নীতি নির্ধারকদের মধ্যে ‘বিশেষ সম্মানিত’ একজন হলেন কেনেথ রথ যিনি কিনা আবার ১৯৯৩ সাল থেকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর অর্থাৎ নির্বাহী পরিচালক!!!

সিগ্রিড রেয়্যুসিং ট্রাস্টের একজন ট্রাস্টি জশুয়া মেইলম্যান। এই মেইলম্যান কিন্তু হিউম্যান রাইটস ওয়াচের একজন এমেরিটাস বোর্ড মেম্বার। জশুয়া মেইলম্যানের নাম এলে ড. ইউনূসের নাম একটু নিতেই হবে। কারণ বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে মেইলম্যান আর ড. ইউনূস অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। জশুয়া মেইলম্যান গ্রামীণ টেলিকমের সহপ্রতিষ্ঠাতা।
তার প্রতিষ্ঠিত অন্য সংস্থাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল টাইডস ফাউন্ডেশন, থ্রেশল্ড ফাউন্ডেশন ও মেইলম্যান ফাউন্ডেশন, সোস্যাল ভেঞ্চার নেটওয়ার্ক, যেগুলো থেকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ নিয়মিত মোটা অঙ্কের অনুদান পায় এবং যার প্রায় প্রত্যেকটিই গ্রামীণ পরিবারের সঙ্গে সম্পৃক্ত।


ইদানিং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল যে বিতর্কিত সাংবাদিক ব্যক্তিত্বের তথ্যসূত্র দিয়ে বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে রিপোর্টগুলো করে, তিনি হলেন ডেভিড বার্গম্যান। প্রথমত ১৯৯৯ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত ডেভিড বার্গম্যান সেন্টার ফর কর্পোরেট অ্যাকাউন্টেবিলিটি (Centre for Corporate Accountability) বলে একটি সংগঠনের প্রধান ছিলেন। সংগঠনটি ২০০৫ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত প্রায় দেড় লাখ পাউন্ড (প্রায় ২ কোটি টাকা) অনুদান পায় সিগ্রিড রেয়্যুসিং ট্রাস্ট থেকে।
এখানে আবার চলে আসে সেই ড. ইউনূসের নাম। ডেভিড বার্গম্যানের স্ত্রী সারা হোসেন এবং সে সঙ্গে ড. কামাল হোসেন অ্যান্ড এসোসিয়েটেস গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূসের আইনজীবী। শুধু তাই-ই নয়, ড. কামাল হোসেনকে গ্রামীণ পরিবারের ‘বিশেষ’ বন্ধু হিসেবে ফ্রেন্ডস অব গ্রামীণ (Friends of Grameen)-এর তালিকায় অনারারি কমিটিতে (Honorary committee) উল্লেখ করা হয়েছে।


আবার আসা যাক অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ব্যাপারে। ২০০৬ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত এই তিন বছরেই অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সাড়ে সাত লাখ পাউন্ড (১০ কোটি টাকা) অনুদান পায় সিগ্রিড রেয়্যুসিং ট্রাস্টের কাছ থেকে। সিগ্রিড রেয়্যুসিং নিজে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এমিরেটাস মেম্বারও।

অন্যদিকে জর্জ সোরস ও তার ওপেন সোসাইটি ইন্সটিউটের কাছ থেকেও নিয়মিতভাবে অনুদান পায় অ্যামনেস্টি। সিগ্রিড রেয়্যুসিং ট্রাস্ট আবার জর্জ সোরসের ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন সংস্থাকে আর্থিক অনুদান দেওয়ার পাশাপাশি অনেক প্রকল্পেই একে অপরের দাতা-সহযোগী হিসেবে কাজ করে।

২০০১ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে যখন অতিমাত্রায় গুম, খুন, আর সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়েছিল বাংলাদেশে। আর সে সময় কয়েকবার অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তদানীন্তন প্রধান আইরিন খান বাংলাদেশে ‘পারিবারিক’ সফরে এসেছিলেন। অথচ নিজের আপন চাচাতো বোনের শাশুড়ি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে ‘অফিসিয়াল’ মিটিং করে এ নিয়ে তাকে ‘শক্ত করে’ কিছু বলেননি।

বিমল কান্তি শীলসহ বাঁশখালির ভিকটিমদের সঙ্গে সরাসরি দেখা করে তাদের হয়ে বিচার দাবি বা অন্যান্য বিচার-বহির্ভূত হত্যা বন্ধ বা তদানীন্তন বিরোধী দলীয় নেত্রীর উপর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ব্যাপারে সোচ্চার প্রতিবাদও করেননি আইরিন। শুধু তাই নয়, চাচাতো বোন যোবায়দা রহমানের স্বামী তারেক রহমান তখন ছিলেন ক্ষমতাসীন বিএনপির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট। বাংলাদেশ সফরের সময় তারেক রহমানের সঙ্গেও একটি ‘অফিসিয়াল’ সাক্ষাত করতে দেখা যায়নি আইরিন খানকে। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, আইরিন তখন তাদের সঙ্গে মিটিং না করলেও তারেক-যোবায়দা দেশছাড়ার পরপরই ‘অফিসিয়াল’ সফরে এসে ২০০১ থেকে ২০০৬-এ ঘটে যাওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে মঈনুদ্দিন-ফখরুদ্দিন সরকারকে চাপ দেওয়া শুরু করলেন।

উপরের আলোচনাতে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর ব্যাপারে খুবই ছোট্ট একটা চিত্র আমরা তুলে ধরলাম যাতে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন রকম আর্থিক ও আদর্শগত স্বার্থ দ্বারা প্রতিষ্ঠানগুলো একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। (খুব সরলভাবে বললেও) এটা স্পষ্ট যে প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে জড়িত মানুষরাও সমালোচনার উর্ধ্বে নন।

তাই আজকে আসলেই সময় এসেছে এটা ভেবে দেখার যে মানবাধিকার সংস্থা থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ সংক্রান্ত রিপোর্টগুলো কতটুকু নিরেপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি বা প্রেক্ষাপট থেকে লেখা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ যোগসূত্রগুলো হয়তো নিদেনপক্ষে ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।আর আমাদের ভাগ্য খুব খারাপ হলে, হতে পারে যে সূত্রগুলো সব আসলে একই সূতোয় গাঁথা!

যেটাই হোক না কেন, বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে তাই আমরা অনুরোধ করব, বাংলাদেশের বাইরে থেকে প্রকাশিত হলেই বা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার বরাত দিয়ে বললেই কোনো সংবাদ বা মন্তব্যকে ঢালাওভাবে স্বার্থহীন, নিরপেক্ষ বা স্বাধীন বলে রায় না দিয়ে দায়িত্বশীলতার খাতিরে আগে একটু যাচাই করে দেখুন, আসলেই তাতে কতটুকু পেশাদার ও নিরপেক্ষ মতামতের প্রতিফলন ঘটেছে।

একটি বিষয় সবসময় মনে রাখতে হবে, যে দেশের জন্ম মানবসভ্যতার ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ গণহত্যা দিয়ে, যে দেশের রাষ্ট্রভাষা জনসংখ্যার বিচারে গোটা বিশ্বে সপ্তম– সে দেশের নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও অর্জনগুলোও কিন্তু কম আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন নয়।

ড. আঞ্জুমান ইসলাম : পানি পরিশোধন ও পরিবেশ প্রকৌশলী। ওমর শেহাব : ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড, বাল্টিমোর কাউন্টিতে কম্পিউটার সায়েন্সে পিএইচ-ডি অধ্যয়নরত।
বিডিনিউজ

Monday, September 23, 2013

শেখ হাসিনা, প্রাইম মিনিস্টার অব বাংলাদেশ- ওয়ান অব দ্য মোস্ট পাওয়ারফুল উইমেন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড: স্যার ডেভিড ফ্রস্টের শেষ সাক্ষাৎকার


সমসাময়িক পরিস্থিতি, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের অবদান, রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য তুলে ধরেছে কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল আল জাজিরা। শুক্রবার রাত দু'টায় খ্যাতিমান ব্রিটিশ সাংবাদিক স্যার ডেভিড ফ্রস্টের নেয়া এ সাক্ষাৎকারটি প্রচার করা হয়।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের সাক্ষাৎকারগ্রহণে অনন্য কীর্তিধারী কীর্তিমান এই সাংবাদিকের নেয়া কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের সর্বশেষ আলেখ্য ছিল এটি । বাংলাদেশের স্বাধীনতার নায়ক বঙ্গবন্ধু শীর্ষক তথ্যচিত্রের অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধুতনয়া শেখ হাসিনা ও দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারও নেন প্রখ্যাত এই সাংবাদিক। ১০ থেকে ১২ জুনের মধ্যে ধারণ করা এই সাক্ষাৎকারে উঠে আসে দেশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ভাবনা, দেশের সমসাময়িক পরিস্থিতি, বর্তমান সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড, নির্বাচন ও রাজনীতির নানা কথা।
তথ্যচিত্রে বঙ্গবন্ধুর কিছু দুর্লভ ফুটেজ স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে বিমান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর পা রাখার ফুটেজও আছে। ফ্রস্টই প্রথম বিদেশী সাংবাদিক, যিনি স্বাধীন বাংলাদেশের নেতা হিসেবে দেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধুর প্রথম সাক্ষাৎকার নেন। তথ্যচিত্রের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে ডেভিড ফ্রস্ট হাইকমিশনার ও তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কয়েকবার বৈঠক করেছিলেন। দীর্ঘ ৪৭ মিনিট ৩৬ সেকেন্ডের এ তথ্যচিত্রের শুরুতেই বলা হয়, শেখ হাসিনা, প্রাইম মিনিস্টার অব বাংলাদেশ। ওয়ান অব দ্য মোস্ট পাওয়ারফুল উইমেন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড।

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ডেভিড ফ্রস্টের নাম। স্বাধীনতাযুদ্ধের পর পরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাৎকার নেন তিনি। ওই সাক্ষাৎকারেই এদেশবাসীর ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর চালানো নির্মম নির্যাতনের বর্ণনা দেন বঙ্গবন্ধু। সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হওয়ার বিষয়টি। সাক্ষাৎকার নিতে কখনও বঙ্গবন্ধুর অফিসে, কখনও তার বিখ্যাত সেই ছোট্ট নীল সরকারি গাড়িতে, কখনও ৩২ নম্বর বাড়ির শোয়ার ঘরে, বারান্দায় বা লনে গেছেন ফ্রস্ট। বঙ্গবন্ধুও ব্যস্ততার মধ্যে ডেভিড ফ্রস্টের সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। ওই সাক্ষাৎকারটি বিবিসিতে প্রচারিত হওয়ার পর পরই সারাবিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ নতুনভাবে সৃষ্টি হয়।
এবার বাংলাদেশের মাটিতে এসে প্রথমেই ব্রিটিশ এ প্রবীণ সাংবাদিক ছুটে যান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে। এ বাড়িতেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে স্বাধীনতার পরাজিত শত্র“দের হাতে সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হন বঙ্গবন্ধু। সেখানে এখনও জাতির পিতার রক্তের দাগ লেগে আছে, বীভৎস হত্যাযজ্ঞের আলামতগুলো এখনও স্পষ্ট। ডেভিড ফ্রস্ট ঘুরে ঘুরে সেই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের আলামত প্রত্যক্ষ করেন এবং তার সঙ্গে থাকা আল জাজিরার প্রতিনিধিরা ডকুমেন্টারির জন্য প্রয়োজনীয় ফুটেজও সংগ্রহ করেন।
এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে হেলিকপ্টারযোগে টুঙ্গিপাড়ায় যান ডেভিড ফ্রস্ট। যেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেখানে গিয়েই প্রধানমন্ত্রীর পর বঙ্গবন্ধুর মাজারে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তিনি। এরপর বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত বাসভবনে প্রায় আড়াই ঘণ্টা অবস্থানকালে ব্রিটিশ এ সাংবাদিক সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। শুক্রবার রাত দুটার দিকে আল জাজিরাতে প্রচারিত হয় এক ঘণ্টার এ সাক্ষাৎকার।

ডেভিড ফ্রস্ট : যুক্তরাজ্যের কেন্টে ১৯৩৯ সালের ৭ এপ্রিল জন্ম নেন ডেভিড ফ্রস্ট। দীর্ঘ ও বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে সাংবাদিকতা, টেলিভিশন উপস্থাপনা, রম্য লেখনীসহ বিভিন্নধর্মী কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন তিনি। দীর্ঘদিন বিবিসিতে কাজ করার পর ২০০৬ সালে কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল আল জাজিরার জন্মলগ্নে এর সঙ্গে যুক্ত হন ফ্রস্ট। তিনিই একমাত্র টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব, যিনি ১৯৬৪ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালনরত আটজন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। পাশাপাশি ১৯৬৯ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে দায়িত্বে থাকা সাত মার্কিন প্রেসিডেন্টেরও সাক্ষাৎকার নেয়ার অনন্য কীর্তি স্থাপন করেন তিনি। ৩১ আগস্ট চৌকস এই সাংবাদিকের মৃত্যু হয়।

সিরিয়ায় ‘যৌন জিহাদ’ করছেন তিউনিসিয়ার নারীরা!


তিউনিসিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লতিফ বেন জেদদৌ বলেছেন, তাঁর দেশ থেকে বহু নারী সিরিয়ায় পাড়ি জমিয়ে সেখানকার সরকারবিরোধী ইসলামপন্থীদের ‘জিহাদে’ যোগ দিয়েছেন। তবে ওই নারীরা অস্ত্র নিয়ে লড়াই চালাচ্ছেন না। ‘জিহাদ-আল নিকাহ’ হিসেবে পরিচিত যুদ্ধকালীন সাময়িক বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তাঁরা মুজাহিদদের ‘উদ্দীপ্ত’ করে পরোক্ষভাবে ‘জিহাদ’ করছেন। ‘হাফিংটন পোস্ট’-এর এক প্রতিবেদনে এ খবর জানানো হয়েছে।
পার্লামেন্ট অধিবেশনে দেওয়া বক্তৃতায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বেন জেদদৌ বলেন, ‘তিউনিসিয়া থেকে সিরিয়ায় যাওয়া ওইসব নারী ২০, ৩০, ১০০ জনের সঙ্গে যৌন সংসর্গে লিপ্ত হচ্ছেন। জিহাদ আল নিকাহর নামে অবাধ যৌনাচার শেষে গর্ভবর্তী হয়ে দেশে ফিরছেন।’ তবে সিরিয়ার জিহাদিদের ঔরসজাত সন্তান পেটে নিয়ে এ পর্যন্ত কতজন তিউনিসিয়ায় ফিরেছেন, সে ব্যাপারে তিনি বিস্তারিত কিছু বলেননি।
সুন্নি সালাফিপন্থী কিছু আলেমের মতে, যুদ্ধকালীন সাময়িক বিবাহ বা ‘জিহাদ আল নিকাহ’ বৈধ। এই ধরনের ‘জিহাদি বিবাহ’তে কোনো মুসলিম নারী কোনো মুজাহিদকে বিয়ে করে তাঁর যৌনসঙ্গী হতে পারেন। আবার দ্রুতই তাঁরা বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন। এই ধরনের সাময়িক বিয়ের মাধ্যমে একজন নারী এক দিনে একাধিক পুরুষের শয্যাসঙ্গী হতে পারেন। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে বিদ্রোহীদের দলে যোগ দিতে তিউনিশিয়ার বিপুলসংখ্যক তরুণ এখন সীমান্ত পাড়ি দিতে চান। এমন ছয় হাজার তরুণকে গত মার্চে আটকানো গেছে বলে জানান তিউনিশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মিডিয়ার খবর থেকে জানা যায়, গত ১৫ বছরে তিউনিশিয়ার কমপক্ষে এক হাজার তরুণ জিহাদিদের দলে যোগ দিয়েছেন। তাঁরা আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ায় গেছেন। মূলত তাঁরা তুরস্ক ও লিবিয়া হয়ে ওই দেশগুলোতে গিয়ে জিহাদিদের সঙ্গে ভিড়েছেন।

Friday, September 20, 2013

আমার বাবা কর্নেল তাহের : জয়া তাহের


আমাকে যখনই কেউ জিজ্ঞাসা করেন, কর্নেল তাহেরের মেয়ে হিসেবে আপনার অনুভূতি কি? আমার চোখের সামনে এক নিমেষেই ভেসে ওঠে ৪০ বছরের অসংখ্য স্মৃতি। আমি অপ্রস্তুত হয়ে যাই। কিছুই আর বলা হয়ে ওঠে না। এ অনুভূতি এক লাইনে বলবার নয়।

আমি ফিরে যাই, আমাদের সেই নারায়ণগঞ্জের বাসায়। শীতলক্ষ্যা নদীর পাশে বড় দোতলা বাড়ি। দোতলায় নদীর দিকে মুখ করে ছিলো পাশাপাশি দু’টি রুম। একটিতে আম্মা যিশু ও মিশুকে (আমার দুভাই) নিয়ে ঘুমাতেন। আর আরেকটিতে আমি বাবার সঙ্গে ঘুমাতাম। আমি সকাল বেলা ঘুম ভেঙ্গেই দেখতে পেতাম, নীল আকাশ।

ঘর থেকে বের হলেই ছিল ঝুলন্ত বারান্দা। বাবা গাড়িতে করে এলেই আমি দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতাম।
সময়টা ছিল ১৯৭৪ সাল। আমি তখন ছিলাম ৪ বছরের। যিশু ২ বছর ও মিশু ৯ মাস।

মাঝে মাঝে রাতের বেলা বাবা-মা বাড়ির লনে ঘুরে বেড়াতেন। আর আমি তাদের পাশে পাশে ঘুরতাম। নিচতলায় ছিলো বসার ঘর আর ডাইনিং রুম। বসার রুমে ছিল সারি সারি বই। ঢাকার এলিফ্যান্ট রোড থেকে আমার ইউসুফ চাচা তার ছেলে শ্রাবণকে নিয়ে বেড়াতে আসতেন। বাবা একপা নিয়েই দৌড়ে আমাদের সঙ্গে ফুটবল খেলতেন।

একদিন খাবার টেবিলে বাবা বললেন, ‘দেখো তো তোমার জন্য নিচে কি অপেক্ষা করছে?’ আমি খাবার টেবিলের নিচে হামাগুড়ি দিয়ে দেখি, একটা বিড়াল। বিড়ালটা বহুদিন আমার সঙ্গে ছিলো। আমরা প্রায়ই ঢাকায় যেতাম। আমি প্রতিবার গাড়িতে বমি করতে করতে ফেরত আসতাম। বাবা বলতেন, ‘কবে যে আমার মেয়েটা ঠিক হবে........’

বাসার পাশেই ছিল বড় পাট গুদাম। যেখানে বানর থাকতো। বানররা কলা খেতে প্রায়ই আমাদের বাগানে চলে আসতো। আমাদের বাসায় কাজ করতো মনিকা নামের একজন মেয়ে। আমাকে একা পেলেই খুব সাজাতো। আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ছিলো তখন।

তারপর হঠাৎ একদিন বাবা বাসায় আসা বন্ধ করলেন। তার কিছুদিন পরই এক জিপ ভর্তি মানুষ রাইফেলের ফাঁকা আওয়াজ করতে করতে বাড়ির চারপাশে টহল দিতে শুরু করে। তারও কিছুদিন পর আমাদেরকে বাসা ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। আম্মা একটা স্যুটকেসে আমাদের সবকিছু নিয়ে কিশোরগঞ্জে নানার বাসায় চলে আসেন।

সবার কাছ থেকে জানতে পারি, বাবা জেলে। তারও অনেক মাস পরে হঠাৎ করে আমাদেরকে জেলখানায় বাবার সঙ্গে দেখা করতে বলা হলো। আম্মা যিশু আর আমাকে নিয়ে ঢাকায় এলেন। মিশু খুব ছোট বলে নানুর কাছে রয়ে গেল। জেলখানার বাইরে দাঁড়িয়ে আমার খুব লজ্জা করছিলো বাবার সঙ্গে দেখা করতে। বাবা আমাকে আর যিশুকে কলা খেতে দিয়েছিলেন। বাবার সঙ্গে সেই আমার শেষ দেখা।

১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই ভোর রাতে বাবার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। আমাদের একটা হেলিকপ্টার দিয়ে পাঠানো হয় আমাদের গ্র্রামের বাড়ি কাজলায়। সংগে ছিলো দাদুমনি, জলি ফুফু, আম্মা, আম্মার কোলে যিশু, ছোট মামা, বড় চাচা, চাচী। যে কাপড় দিয়ে বাবাকে ঢাকা ছিলো তা পুরোপুরি বাবার শরীর ঢাকতে পারছিল না। চুল আর পা বেরিয়ে ছিলো। আমি হেলিকপ্টারের জানালা দিয়ে ছোট হতে যাওয়া মানুষগুলোকে দেখছিলাম। সেই আমার প্রথম হেলিকপ্টারে চড়া।

কাজলায় স্কুল মাঠে বাবাকে নামানো হয়। আমরা অপেক্ষা করি আমাদের আরেক মুইনুদ্দিন দাদার শ্যামগঞ্জের বাসায়। দুপুর বেলা বাবাকে গোসল করানোর পর ছোট মামা কাঁদতে কাঁদতে আমাকে উঁচু করে বাবার মুখ দেখান। আমি দেখতে পাই শান্ত একটা মুখ। আমার তারপরও বিশ্বাস হয়নি, বাবা মারা গেছেন। কল্পনা করেছি কতবার, বোধহয় ওটা সাজানো কোনো ডামি ছিলো। বাবাকে বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি হয়তোবা কোথাও হাঁটছি, আমাকে পেছন থেকে চমকে দিয়ে ফিরে আসবেন বাবা।

সেই কাজলায় রয়ে গেলাম আমরা একমাস। প্রতিদিন আমরা কবরে যেতাম। কবরের পাশে ঘাঁটি গেড়ে ছিল একদল সশস্ত্র পুলিশ। তারা কবরটা একমাস ধরে পাহারা দিয়েছিলেন। আজ ভাবলেও তা হাসি পায়।

সেখান থেকে আমরা চলে আসি কিশোরগঞ্জে। নানা ছিলেন কিশোরগঞ্জের নামকরা ডাক্তার। তার কিছুদিন পরে আমরা ঢাকায় আসি। উঠি মোহাম্মদপুরে বড় চাচার বাসায়। আম্মা চাকরিতে যোগ দেন। তার কয়েক মাস পরে মোহাম্মদপুরে একটি সরকারি কোয়ার্টার পান আম্মা। দুই রুমের একটি ড্যাম্প পরা বাসাটার আশেপাশে ছিল বস্তি। যার থেকে অনবরত ভাবে ভেসে আসতো গালিগালাজ। আম্মা প্রতিদিন হেঁটে গিয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করতেন।

আমাকে ভর্তি করানো হয় কাছের একটি স্কুলে। মিশু রয়ে যায় নানুর কাছে। আরও পরে যিশুকে পাঠানো হয় হোস্টেলে। আমাদের একটি সাজানো সংসার যেন এক নিমিষেই এক কালবৈশাখী ঝড়ে ভেঙে খান খান হয়ে যায়।

যিশু যেদিন প্রথম হোস্টেলে যায়, আম্মা কেঁদেছিলেন আকুল হয়ে। জলি ফুফু ও ডলি ফুফু তাদের স্কলারশিপের সামান্য কিছু টাকা দিয়ে নিয়ে এসেছিলেন যিশুর জন্য নতুন জামা, জুতা। যিশুর পড়াশোনার দায়িত্বভার নিয়েছিলেন আমার লন্ডনে বসবাসরত বড় মামা। আমাদের পুরো পরিবারের কারোরই তেমন কোনো টাকা-পয়সা ছিল না। কিন্তু এক বিশাল বন্ধনে আমরা ছিলাম দৃঢ় অঙ্গীকারাবদ্ধ।

প্রতি বছর আমরা যখন কিশোরগঞ্জে যেতাম, আম্মা মিশুকে নিয়ে শুতে চাইতেন। আস্তে আস্তে বলতেন, আমাকে মা বলো, মিশু কিছুতেই বলতো না। মিশু তখন নানুকে মা ভাবতো। তারপর বছর গড়িয়ে মিশুও আমাদের সঙ্গে ঢাকায় চলে আসে, যখন তার বয়স ৫ বছর। আম্মার সামান্য বেতনটুকুই ছিল আমাদের একমাত্র সম্বল।

ওই সময় জাসদের অধিকাংশ নেতাকর্মীসহ আমাদের সব চাচারা জেলে ছিলেন। আমাদের বাসার সামনে একটা সাদা গাড়ি সারাদিন বসে থাকতো। পরে জেনেছি, তারা ছিলেন স্পাই। আমাদের সব গতিবিধি লক্ষ্য করতেন। আমাদের বাসায় কেউ আসতে পারতেন না। যারা আসতেন তারাও লুকিয়ে আসতেন।

আমরা জেলখানায় ইউসুফ চাচা, বেলাল চাচা, মনু চাচা ও অন্যান্য নেতাকর্মীদের দেখতে যেতাম। আমি প্রতিবার মন খারাপ করে যেতাম। মনে হতো, যদি বাবা থাকতেন। হতোই বা সারা জীবন জেলে, তাওতো দেখা হতো। আমার তখন বোঝার যথেষ্ট বয়স হয়েছে।

১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর চাচারা ও অন্যান্য নেতাকর্মীরা জেল থেকে ছাড়া পেতে শুরু করেন। জাসদ তখন বিরাট এক শক্তি। আমাদের ছোট বাড়িটায় মানুষ গম গম করতো। কত ধরনের মানুষ যে আসতো তখন। তাদের সবার স্বপ্ন ছিলো একই। এক সুস্থ সমাজ ব্যবস্থা যেখানে সবার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। আমার খুব বেশি ভাল লাগতো তাদেরকে। তারা যে স্বপ্নের কথা বলতেন, তা আমি মনোমুগ্ধের মতন শুনতাম। তারা বেশির ভাগ ছিলেন ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট- বুয়েট, মেডিকেল বা ইউনির্ভাসিটির ছাত্র-ছাত্রী। তারা ছিলেন টগবগে সাহসী কিছু তরুণ-তরুণ । সে সময় তাদেরকে একটি শুকনো বিস্কিট আর চা ছাড়া আমাদের দেবার আর কিছুই ছিল না।
আমার খুব বেশি মায়া লাগতো। আম্মার কাছে শুনতাম, তাদের বেশির ভাগই অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলেমেয়ে। একটা নষ্ট সমাজ বদলে দেবার স্বপ্নে তারা সকল কিছু ছেড়ে এসেছিলেন। হাজারো মানুষের মশাল মিছিল হতো তখন।

বেলাল চাচা আমাদের শিখিয়ে ছিলো একটা গান-
‘বন্ধু, বলতে পারো, সামনের পৃথিবীটা কার
শ্রমিক না মজুর, না সর্বহারার
আজকে এসেছে দিন একভাবে
আসবে আবার দিন নতুন করে
সেদিন আবার নতুন করে বিচার হবে
বন্ধু..................’

নিশ্চয় বেলাল চাচার কোনো অবসরে মনে পড়বে সেসব কথা। আমরা কাজলায় রাতের বেলায় আগুনের পাশে গোল হয়ে বসে সুর করে সেই গান গাইতাম।

মনে হয় এইতো সেদিন, রমনার বটমূলে নেমেছিলো হাজারো মানুষের ঢল। আমরা পৌঁছা মাত্র মেজর জলিলচাচা মঞ্চ থেকে ফুল নিয়ে আমার হাতে দিলেন। ‘কর্ণেল তাহের লাল সালাম’ এর প্রতিধ্বনিতে আকাশ বাতাস প্রলম্বিত হয়ে উঠত যেন। আমি সেদিন তাদের প্রত্যেকের চোখের তারায় দেখেছিলাম কর্নেল তাহেরকে।

তারপর কি হলো! যেসব নেতা একদিন স্ত্রী, সন্তান, বাবা, মা, ভাই, বোন কারো কথা চিন্তা না করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এক নতুন সমাজ গঠনের দায়িত্বে, তাদের অনেকেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব, ক্ষমতা, লোভ, লালসার কাছে বিক্রি হতে থাকলেন! আন্দোলন পড়লো মুখ থুবড়ে। যে নেতারা একদিন মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তাদের অনেকেই মাঝপথে যেন সেটাই ভুলে গেলেন!

আর শত শত কর্মী যারা বিশ্বাস করেছিলেন, তাদের নেতাদের কথা- তাদের কেউ কেউ হতাশার গভীরে নিমজ্জিত হয়ে অন্ধকার জগতে চলে গেলেন। কেউ কেউ পাড়ি জমালেন বিদেশে। কেউ কেউ, নীতি আদর্শ বিসর্জন দিয়ে সেই নেতাদেরই তোষামোদ করে টিকে থাকার ব্যর্থ চেষ্টা করলেন। কেউ কেউ ভাঙ্গা মন নিয়ে আবারো ঘরে ফিরে গেলেন।

তাদের সেই ভাঙ্গা মন আর কোনো দিন জোড়া লাগেনি। আর দুই একজনকে আমি হঠাৎ হঠাৎ দেখি- তাদের চশমা হয়েছে ভারি, চুলে পাক ধরেছে। তারা মানাতে পারেননি কোনো কিছুর সঙ্গেই। বড় একা.......

যে কর্নেল তাহের মৃত্যুর আগে তার শেষ চিঠিতে লিখে গেছেন, ছোট ছোট উলঙ্গ শিশুদের নিরাপদ বাসস্থানের কথা, তাদের জীবনেও কোনো পরিবর্তন আসেনি। ছোট ছোট শিশুরা আজও রাস্তায়।

আর আমি- বহু বছর এক তীব্র রাগ, হতাশা, ঘৃণা বুকে পুষে ছিলাম। আম্মা যখন দেশ বদলের আশার কথা বলতেন, তাকে তীব্র অপমানে বিদ্ধ করতে আমার এক বিন্দু বাঁধতো না। পালিয়েছি আমি সকল কিছু থেকে। রাজনৈতিক খবরে আমার ছিল উদাসীনতা। হঠাৎ করে কি ভেবে যেন কর্নেল তাহের সংসদের নামে একটি ওয়েবসাইট তৈরি করি। আসা শুরু হয় শত শত চিঠি। প্রতিদিন.......

অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, চিঠির লেখকদের বেশিরভাগই এই প্রজন্মের তরুণ-তরুণী। তারা জানতে চান কর্নেল তাহেরকে। তারা সচেতন বুদ্ধিমান বলিষ্ঠ নাগরিক। তাদেরকে মিথ্যা দিয়ে ভোলানো এতো সহজ নয়। নেতা চিনতে তাদের কোনো ভুল হয় না।

সেদিন রমনার বটমূলে হাজারো মানুষের ঢলে আমি কর্নেল তাহেরের মুখ দেখেছিলাম। আমি আজ আর কর্নেল তাহেরকে তাদের মাঝে দেখতে পাই না। কর্নেল তাহের তাদের ছেড়ে চলে গেছেন বহু আগে। ছড়িয়ে গেছে গোটা দেশময়।

আজো তাই নতুন যুগের তরুণেরা মনে করেন, বলিভিয়ার চে’ গুয়েভারা যেন বাংলাদেশের কর্ণেল তাহের। তাদের বুকে দেখি, কর্নেল তাহেরের সম্বলিত টি-শার্ট। তারা জেনে গেছেন, বাংলার ইতিহাসে ক্ষুদিরাম-সূর্য সেনের মতো কর্নেল তাহেরও কোনো অন্যায়ের সঙ্গে আপোস করেননি। তাদের বুকে গেঁথে গেছে তাহেরের শেষ চিঠির কয়েকটি শব্দ-

‘নিঃশঙ্ক চিত্তের চেয়ে জীবনে আর বড় কোনো সম্পদ নেই’
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

Thursday, September 19, 2013

বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ, এখানে কেউ ফতোয়া দেবেন না মমতাজ লতিফ


কী যে হলো, হঠাৎ একদল হুজুর সংবাদ সম্মেলন করে ‘ফতোয়া’ জারি করে বসলেন। কই এর আগে কোন মৌলানা দলকে তো কখনই ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যাকারী, বাঙালী নারীর ধর্ষক, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক নেতা বা ডাক্তার, প্রকৌশলী, সেনা, পুলিশ, মুক্তিযোদ্ধাদের পরিকল্পিত হত্যাকা-ের হোতাদের বিরুদ্ধে ‘তারা কাফের, তারা জেনাকারী, হত্যাকারী হিসেবে যে স্বাধীনতার তারা বিরুদ্ধাচারণ করেছে, সেই স্বাধীন দেশে তাদের ঠাঁই হবে না,’ বলে এমন কোন ফতোয়া দিতে শুনিনি। তারা তো ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বা মানবিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় অপরাধীÑ ফতোয়া যদি কেউ দিতে উদ্বুদ্ধ হতেন, তবে এদের ফতোয়া দিয়ে রাষ্ট্র থেকে বহিষ্কারের দাবি করতেন। মাঝখান থেকে তসলিমা নাসরিন বা দাউদ হায়দারকে তালেবানপন্থী একদল কট্টর জঙ্গীবাদী মোল্লা দেশছাড়া করেছিল যে দেশের স্বাধীনতায় ওই মোল্লার দলের কোন অবদান ছিল না। তরিকত ফাউন্ডেশন যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতের সংবিধানবিরোধী অবস্থান ও রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রম নিষিদ্ধের জন্য রিট পিটিশন করে হাইকোর্টের কাছ থেকে একটি কাক্সিক্ষত ঐতিহাসিক রায় জনগণকে উপহার দিয়েছে, এজন্য তাঁরা ধন্যবাদার্হ।
কিন্তু স্মরণ রাখতে হবে, মুসলিম দেশগুলোতে বা ভারতেও মুসলিম নারীরাই মুসলিম পুরুষের অন্যায় ফতোয়ার শিকার হয়েছে। আশ্চর্য হলেও সত্য এই যে, এই মৌলানারা কোন নারীর সন্তান, কোন নারীর কাছ থেকে তাঁরা বিবাহিত জীবনের আনন্দ লাভ করেছেন, কেউ বা প্রেম লাভ করেছেন, তাঁদের সবারই আছে পুত্র ও কন্যা, বোন, খালা, চাচি, ফুফু। নয় কি? তারপরও দেখা গেল, শ্বশুরের দ্বারা ধর্ষিতা নারীটি তার স্বামীর (স্বামীর মতে) সঙ্গে থাকতে চাইলেও ফতোয়াবাজ মৌলানারা শ্বশুরের সঙ্গে থাকার আদেশ দেয়। রাজিব গান্ধীর উদ্যোগে মুসলিম নারীদের সমঅধিকারের আইনটি দিল্লীভিত্তিক মুসলিম মৌলানাদের দলের প্রবল বাধার কারণে সংসদে পাস হতে পারেনি। শ্বশুর দ্বারা পুত্রবধূ ধর্ষণের চেষ্টা বা ধর্ষণ, এমনকি এ কাজে শাশুড়ি বাধ্য হয়ে স্বামীর হুকুম পালনে সহায়তা করেছেÑএমন অসংখ্য উদাহরণ পর্দার অন্তরালে সঞ্চিত আছে-এ কথা মৌলানারাসহ জনগণ ভালভাবেই জানেন।
এ গেল এক ধরনের নারী নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে ফতোয়ার ব্যবহার। ফতোয়ার দ্বিতীয় অপব্যবহার অতি উচ্চমাত্রায় হচ্ছেÑএটি হলো, ‘হিল্লা বিয়ে’ ও ‘তালাক’ হওয়া সম্পর্কিত। এ আলোচনায় যাওয়ার আগে আমি দেশের সব বড় আলেম-মৌলানাদের কাছে একটি প্রশ্ন করব, এই একবিংশ শতাব্দীতে যেখানে খ্রিস্টান, ভারতে হিন্দু নারীরা ‘তালাক’-এর ক্ষেত্রে কোন রকম ‘হিল্লা বিয়ে’ নামের সম্পূর্ণ অমানবিক ঘৃণ্য নারীর জন্য দ্বিতীয় প্রকৃতির ধর্ষণের ব্যবস্থা করে যেসব মৌলানা, তাদের বিরুদ্ধে আপনারা কখনও ফতোয়া দিয়েছেন কি? অথবা তাদেরকে বিচারে সোপর্দ করেছেন কি? জনগণকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে বিচারপতি গোলাম রব্বানী ও বিচারপতি নাজমুন নাহার ফতোয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একটি ঐতিহাসিক রায় দিয়েছিলেন, যেটি খুব সম্ভব আপীল বিভাগে এখনও আটকে আছে। মৌলানাদের নিজ কন্যাদের ও বোনদের আইয়ামে জাহিলিয়া যুগের পুরুষের ইচ্ছায় বিবাহিতা নারীকেও অন্য পুরুষের কাছে ‘আইনী’ভাবে ধর্ষিতা হবার ধর্মের নামে সমাজে প্রচলিত অপরাধমূলক ফাক-ফোঁকরগুলো বন্ধ করতে এগিয়ে আসতে হবে। এটা বলাবাহুল্য। গ্রামেগঞ্জে এই ‘তালাক’ নিয়ে ‘হিল্লা’ বিয়ের মাধ্যমে ধর্ষণ হচ্ছে, তা বন্ধ করা মৌলবী-মোল্লাদের একটি অন্যতম দায়িত্ব। তাঁরা সে দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসবেন এবং অন্তত, কন্যা ও বোনদের নারী নির্যাতক ফতোয়াবাজদের হাত থেকে রক্ষা করবেন, অন্যকিছু করার আগে এটাই তাঁদের জন্য কর্তব্য হিসেবে অগ্রগণ্য।
এছাড়াও মৌলানাদের একটি বড় দায়িত্ব হচ্ছে, দেশের সংখ্যালঘুদের সংখ্যাগুরুর দ্বারা নির্যাতন, খুন, ধর্ষণ এর শিকার হওয়া, তাদের বসত-জমি-জীবিকা দখল হওয়া থেকে রক্ষা এবং সর্বোপরি তাদের প্রাণের নিরাপত্তা প্রদান যে সংখ্যাগুরুর দায়িত্ব, এই তথ্য প্রচারের মাধ্যমে সমাজে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করা, পাড়া-মহল্লায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করা। ইসলামের নবী সঠিকভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সংখ্যাগুরুর হাতে ‘আল্লাহর আমানত’ হিসেবে গণ্য করতে বলেছেন। তাদের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব সংখ্যাগুরুর হাতেই, এ কথা মৌলানাদের উপলব্ধি করতে হবে এবং একই সাথে ইসলাম ধর্মের এ মহৎ সুশিক্ষার পক্ষে জনমত গঠনে ভূমিকা রাখতে হবে। মৌলানা সাহেবরা দেশের সংখ্যালঘুর, হিন্দু আদিবাসী ভূমিগ্রাসকারীদের বিরুদ্ধে ফতোয়া নয়, সামাজিক বয়কট, তাদের বিচারে সোপর্দ করতে এগিয়ে আসবেন, এটিই জনগণের প্রত্যাশা।
মৌলানা সাহেবরা কোথায় আমেরিকায় বাংলাদেশের একজন ব্যক্তি ওই দেশের একটি অঙ্গরাষ্ট্রের আইনী অধিকার সমকামী বিবাহ সম্পর্কে তাঁর ‘ব্যক্তিগত মত’ প্রকাশ করেছেন বলে তাঁকে ‘দেশ ছাড়া’ করবার ফতোয়া দেবার প্রয়োজন ছিল না। মানবাধিকারে ব্যক্তিগত মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে উচ্চ স্থান দেয়া হয়। একটা কথা না বললে এ বিষয়টা পরিষ্কার হবে না। পশ্চিমা দেশগুলোতে ধর্ম ব্যক্তির চর্চার বিষয় কিন্তু রাষ্ট্র সব ধর্মের এবং আস্তিক-নাস্তিক সবার জন্য অধিকার রক্ষার জন্য আইন তৈরি করে। যদিও আমেরিকা বা ইউরোপের দেশগুলোতে সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র কোন ধারা যুক্ত নেই। সত্যি বলতে, ওদের ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মানবাধিকার চর্চার ব্যাপক বিস্তৃতির সুযোগে আমাদের দেশের বা এশিয়া, আফ্রিকার সন্ত্রাসী, খুনী, জঙ্গী জেহাদীরা পশ্চিমা দেশেই ঠাঁই গেড়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী, তাদের সন্তানরা ’৭১-এ অনেক যুদ্ধাপরাধী ও তাদের সন্তানেরা তো পশ্চিমা দেশেই বসবাস করছে। জঙ্গী জেহাদীরা মালয়েশিয়াতেও বসবাস করছে যাদের অনেকেরই টার্গেট ওখান থেকে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া পাড়ি দেয়া। এই জঙ্গীদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ বেশি জরুরী।
আমাদের তদানীন্তন শাসকদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ময়মনসিংহে সে সময়ে সিনেমা হলে জঙ্গীদের বোমা হামলা, ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের ওপর হাওয়াভবনে পরিকল্পিত শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার উদ্দেশ্যে সংঘটিত গ্রেনেড হামলাকে পর্যন্ত অবিশ্বাস্য জেনেও আওয়ামী লীগের দ্বারাই সেসব সংঘটিত বলে যে মিথ্যা ভিত্তিক অপরাজনীতি, দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি করেছিল, সেই মিথ্যা পশ্চিমারা বলে না। কিন্তু তাদের কোন মিত্রকে যদি কখনোও আত্মবিশ্বাসী, আত্মনির্ভরশীল, নিজস্ব সিদ্ধান্ত নিতে দেখে, তাহলে যুদ্ধাস্ত্র যাদের ব্যবসার প্রথম পণ্য, সেই পশ্চিমারা তাকে কিভাবে ধ্বংস করে দিতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ সাদ্দাম ও গাদ্দাফী। এমন কি আফগানিস্তানে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো ধ্বংস করার জন্য তারা জন্ম দিয়েছিল ও বিকশিত করেছিল সস্ত্রাস, জঙ্গী দল আল কায়েদা, তালেবান ও লাদেনকে! সে অবমুক্ত দৈত্যকে আবার পরে তাদেরই হত্যা করতে হয়েছে ও হচ্ছে! দুনিয়ার তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ-সব কিছুর ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পশ্চিমারা এক পুতুল খেলায় রত, যে খেলায় কোন একভাবে দরিদ্র দেশগুলোকেও খেলতে হচ্ছে! তবে পশ্চিমা সাধারণ নাগরিকরা যুদ্ধ ও এসবের বিরুদ্ধবাদী এবং ওদের ব্যক্তি স্বাধীনতা, বাক-স্বাধীনতা ও মানবাধিকার প্রীতি এসবের প্রতি গভীর আস্থা না থাকলে আজ আমাদের লেখক তসলিমা নাসরিন, দাউদ হায়দার, সালমান রুশদীরা প্রাণে বাঁচতে পারত না। খেয়াল করে দেখুন, এই মুরতাদ, কাফের নাম দিয়ে মুসলমান উগ্র জেহাদী মৌলানারাই তাদের কতল করবে বলে ঘোষণা দিচ্ছে-যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ! মসুলমান ছাড়া অন্য কোন ধর্মীয় সম্প্রদায় সারা দুনিয়ায় কোন কবি লেখক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীকে কত্্ল্যোগ্য দাবি করেনি! এমন কি এখনকার জঙ্গী, ইংরেজী মাধ্যমে শিক্ষিত তরুণরাও মুক্তিযুদ্ধপন্থী এখন প্রগতিশীল ব্লগারদের কতল্যোগ্য ঘোষণা করছে, কত্লও করছে!
’৭১-সালের রাজাকার গোলাম আযম, নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদীদের উত্তরসূরী বর্তমান যুগের ইংরেজী মাধ্যমে শিক্ষিতদের মধ্যেও যদি জঙ্গী খুনী জন্ম নিতে পারে, মাদ্রাসায় তো কিছু সংখ্যক জন্ম নিচ্ছেই-তাহলে মৌলানারা এই জল্লাদ-সৃষ্টিকারী মসুলিম মৌলানাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ও সংশোধনমূলক প্রচার কর্মকা- শুরু করবেন।- এটাই অনেক বেশি কাক্সিক্ষত ও প্রয়োজনীয়। পশ্চিমাদের ব্যক্তি স্বাধীনতাকে সম্মান করার ফলে একজন শিশুকে মা-বাবা জন্মদান করে তবে মালিক হতে পারে না, সে নির্যাতিত হলে পুলিশ ঐ মা, বাবা রাষ্ট্রের স্বাধীন নাগরিক সন্তানের দেখভালের উপযুক্ত নয় গণ্য করে শিশুকে নিজেদের তত্ত্বাবধানে নিয়ে যায়!
সবশেষে ছোট্ট করে বলতে চাই- সমকামিতা-দোষে দুষ্ট পৃথিবীর সব দেশের সব সমাজ। আমাদের কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এসবের হোস্টেল, আরও নানা স্থানকে সমকামিতার কেন্দ্রস্থল বলে চুপিসারে মানুষ সমালোচনা করে। পশ্চিমারা ওটাকে ব্যক্তির নিজস্ব অভিরুচি হিসেবে মান্য করে, সেটাকে গোপন বিষয়ে পরিণত না করতে বিবাহের আইন পাস করেছে আমেরিকার কোন কোন অঙ্গরাষ্ট্র। কে কোথায় এ বিষয়ে একমত পোষণ করল তাতে আপনাদের–আমাদের কোন ক্ষতি হবে না। আর যদি আপনারা সত্যিই ধর্ষক, সমকামী, বহু বিবাহকারী, যৌতুকদাবিকারী, নারী হত্যাকারী এবং প্রগতিশীল তরুণ-তরুণী হত্যাকারীদের দেশছাড়া করার ঘোষণা দিয়ে দাবি আদায়ের আইনসম্মত কর্মসূচী গ্রহণ করেন, তাহলে সত্যিই দেশ ও জাতির অগ্রগতি ও উন্নয়নে আপনাদের মৌলানাদের বিপুল ভূমিকা শ্রদ্ধা অর্জন করবে।

Wednesday, September 18, 2013

অগ্নিবীণার দুর্দম বাদক- বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পদক তোমাদের কপালে জোটেনি-কোটি জনগণের লক্ষ সালাম:হাসান মাহমুদ


একাত্তরের মার্চ-এপ্রিলে পাকিস্তানি সৈন্যদের আকস্মিক আক্রমণে ছিন্নভিন্ন পূর্ব পাকিস্তান, ইতিহাসের অন্যতম নিষ্ঠুর গণহত্যা-গণধর্ষণে রক্তে আর্তনাদে ভেসে যাচ্ছে দেশ। বহু মাইল স্রেফ পায়ে হেঁটে সীমানা পেরোচ্ছে লক্ষ লক্ষ আতংকিত গ্রামবাসী বুড়ো বাবা-মা’কে নিয়ে বাচ্চা কোলে নিয়ে। গ্রামবাংলার ধুলিধুসরিত পথে হাতে মাথায় ঘটি-বাটি নিয়ে গরু-ছাগলের রশি ধরে হাজার হাজার পথযাত্রীর ভীড়ে রাস্তায় বৃদ্ধার মৃত্যু রাস্তায় জন্মানো বাচ্চা। কে বিশ্বাস করবে সেই দাবানলের মধ্যে একাত্তরের এপ্রিলে রাজশাহীর ওপারে মুর্শিদাবাদ শরণার্থী শিবিরে এক কাপড়ে উপস্থিত এক পাঞ্জাবী তরুণ! চারদিকে তুমুল হৈ হৈ, ছুটে এসেছে ভারতীয় সৈন্যেরা। কি? না, আমার বাড়ী লাহোর কিন্তু আমি শরণার্থী, আমাকে খেতে দাও থাকতে দাও। ভাঙ্গা-বাংলায় কথা বলছে সে।

‘‘তারপরে কেটে গেছে কত শত কাল, তবু যেন মনে হয় সেদিন সকাল’’।
সাঁইত্রিশ বছর আগে ঘটনার ঘনঘটায় উন্মত্ত জীবন আজ গল্প হয়ে গেছে। বয়সের সব ঝড় বোধহয় এভাবেই থেমে যায় একদিন।

কটা বেড়াল-চোখ কাঁচা সোনা রঙ্গের সুঠাম সুদর্শন তরুণ আনোয়ার শাহেদ খান। যেন সিনেমার নায়ক। সাতষট্টি সালে ইÏটারউইং স্কলারশীপ নিয়ে লাহোর থেকে ফিজিক্স-এ অনার্স পড়তে এসেছিল, থাকত ফজলুল হক হলে। আমি তখন বায়োকেমিষ্ট্রিতে - ওই ফজলুল হক হলেই। কি করে যেন বন্ধুত্ব হল নিবিড়, নিবিড় থেকে নিবিড়তর। খেয়াল করতাম আমার কাছে কাছে থেকে অনুসন্ধিৎসু চোখে সে নিরীক্ষণ করছে আমাদের ওপরে পশ্চিমের নিপীড়ন আর শোষণ। আমি তখন ছাত্রলীগের চির-দুর্ভেদ্য দূর্গ ফজলুল হক হল ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি এবং হল-সংসদের সাংস্কৃতিক সম্পাদক, উন্মত্ত দিন কাটছে রাস্তায় শ্লোগানে মিছিলে, বাংলাদেশের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে ইতিহাস। কাছে থেকে থেকে দেখে দেখে আনোয়ার বুঝতে পারছে কেন আমাদের ছয় দফা, কেন ওদের এত উন্নতি আর আমাদের এত অবনতি। তার শের-শায়েরীর কাব্যিক মন ঠিকই ধরেছে ইসলামের নামে পাকিস্তানী রাজনীতির বিভৎস ঠকবাজী। তারপর সত্তরের নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে এল বিসুভিয়াসের বিস্ফোরণে। ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনষ্টিটিউটে আমি আওয়ামী লীগের পোলিং এজেন্ট আমার সাথে উপস্থিত থেকে আনোয়ার স্বচক্ষে দেখল জনতার ভৈরব গর্জন। মৃদু হেসে পরিহাস করে বলল - ‘‘আব হাম্‌ আপকো অওর রোক্‌ নেহি সাক্‌তে’’ - আর আমরা আপনাদের ঠেকাতে পারব না।

তারপর সে স্বচক্ষে দেখল পঁচিশে মার্চের তান্ডব, জানল গণহত্যা, গণধর্ষণ। সময়ের জঠরে তখন জন্ম-যন্ত্রণায় নড়ে উঠছে পাকিস্তানের মাটিতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অবিশ্বাস্য ভ্রূণ। পঁচিশে মার্চে বাজপাখীর আক্রমণে মুরগীর বাচ্চার মতন জাতি ছিটকে গেল চতুর্দিকে। সবাই ছুটল গ্রাম-জননীর সুবিশাল আশ্রয়ে, জননীও আগ্রহী হাত বাড়িয়ে কোটি সন্তানকে তুলে নিল তার কোলে। কিন্তু আনোয়ার যাবে কোথায়? এখানে তো ওর কেউ নেই, দেশটা ওর চেনাও নেই। কেউ কেউ বলল আর্মির ব্যারাকে যেতে - ওটাই ওর নিরাপদ জায়গা। কিন্তু প্রাণের নিরাপত্তার চেয়েও সৈন্যদের প্রতি ঘৃণা তখন তার অনেক বেশী। আরেক বন্ধুর বাবা তখন রাজশাহীতে চাকরী করেন, সিলেটে বাড়ী। তার সাথে কোনমতে রাজশাহী পৌঁছুল আনোয়ার, তারপরে ঘাতক সৈন্যদলের ধাক্কায় সবাই সীমানা পেরিয়ে ভারতের মুর্শিদাবাদে শরণার্থী শিবির। মে মাসে সেনাপ্রহরায় রাজশাহী ফেরা, সেনাপ্রহরায় ঢাকা এবং পরের মাসে সটান লাহোরে বাবা-মায়ের কোলে।

তারপর সে আমাদের পক্ষে হাতে তুলে নিল তার যুদ্ধের অস্ত্র, কলম। ইতিহাসে এই একটা অস্ত্র অসাধ্যসাধন করেছে বারবার। অত্যাচারীরা যে অস্ত্রকে সবচেয়ে বেশী ভয় করেছে তা হল এই, - কলম। আমাদের জীবন-মরণ মুক্তিযুদ্ধের অজানা অধ্যায় শুরু হল পাকিস্তানেও। ‘‘পদ্মা সুরখ হ্যায়’’ (রক্তাক্ত পদ্মা) নামে পশ্চিমা প্রাসাদ-ষড়যন্ত্রের পঁচিশ বছরের ঠকবাজী ও একাত্তরের গণহত্যা-গণধর্ষণের ওপর আনোয়ারের চাক্ষুষ নিবন্ধ ছাপা হচ্ছ্রে প্রতিদিন একসাথে লাহোরের দৈনিক মুসাওয়াত ও করাচীর দৈনিক ডন’-এর গুজরাটি সংস্করণে, ক্রমাগত তিরিশ দিন। হৈ হৈ পড়ে গেল দেশে। জামাতিরা ওকে কতল করার খোলাখুলি ঘোষণা দিয়ে দিল - সগর্জনে ছুটল ওকে কতল করতে। ছুটে এল সামরিক সরকারের পুলিশ আর গোয়েন্দা, নিজদেশে পরবাসী আনোয়ার লুকিয়ে গেল আন্ডারগ্রাউন্ড।

আমাদের তবু দেশ ছিল গ্রাম ছিল, স্বাধীন বাংলা সরকার ছিল বেতার ছিল, চারদিকে সংগ্রামী জাতি আর মুক্তিযোদ্ধার উপস্থিতি ছিল, আন্তর্জাতিক সমর্থন ছিল, শেষ সম্বল হিসেবে ভারতে আশ্রয় ছিল, ওর কি ছিল চতুর্দিকে অগণিত শত্রু ছাড়া? আকস্মিক আক্রান্ত হয়ে আমাদের তো যুদ্ধ ছাড়া উপায় ছিলনা, কিন্তু ওকে তো কেউ বাধ্য করেনি স্বজাতিরই বিরুদ্ধে এ যুদ্ধে নামতে! এমনকি আমাদের সাথে ওর তো যোগাযোগও ছিলনা! তবু লড়ল আনোয়ার, পাকিস্তানের বুকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নিঃসঙ্গ একা। হিংস্র সরকারের গণহত্যা-গণধর্ষণ তুলে ধরা, বাবা-মা ভাইবোন থেকে দুরে - চাকরী নেই উপার্জন নেই খাবার নেই থাকার জায়গা নেই - একে আমি ‘‘পাকিস্তানের মাটীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’’ বলব না তো কি বলব?

এ হল লাহোর। আর করাচীর মখ্‌দুম?

একাত্তরের প্রথম দিকে জাহিদ মখদুম করাচীর প্রাণবন্ত তুখোড় ছাত্রনেতা। নির্বাচনে আমাদের বিজয়ের বিরুদ্ধে ভুট্টো-ইয়াহিয়ার ষড়যন্ত্র টের পেয়েই সে ছাত্রসমাজকে নিয়ে যুদ্ধে নামল। মিটিং মিছিলের শ্লোগান, দেয়ালে দেয়ালে হাজারো পোষ্টার, সংসদের সামনে বিক্ষোভ, চীৎকারে উত্তেজনায় কাঁপিয়ে তুলল করাচী। একের পর এক বিদ্রোহী নিবন্ধ লিখতে লাগল সিন্ধী দৈনিক ‘‘ইবারত’’-এ। দেশ-শাসন করার জন্য তোমাদের সৈন্যদলে নেয়া হয়নি, জনগণের পয়সায় হাতে অস্ত্র দেয়া হয় নি। নির্বাচনে পুর্ব পাকিস্তান জিতেছে, লক্ষ্মী ছেলের মতো তাদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে ব্যারাকে ফিরে যাও। প্রমাদ গুনল ভুট্টো, প্রমাদ গুনল সরকার। এদিকে শুরু হয়ে গেছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আক্রমণ, ধীরে ধীরে কাদায় পড়ছে নাপাক বাহিনী। ওদিকে সমন জারী হল গ্রেপ্তারের, পালাতে গিয়ে ধরা পড়ল মখদুম। তারপর লারকানা, জেকোবাবাদ, শুক্কুর আর হায়দ্রাবাদ কারাগারে তার শরীরের ওপর নেমে এল কেয়ামত। স্বীকার করো তুমি ভারতের গুপ্তচর, টাকাপয়সার লেনদেন আছে। স্বীকার করো তোমার সাথে বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন যোগসুত্র আছে। লোহার রডের প্রহার, ইলেক্ট্রিক শক্‌, অন্ধকার সলিটারি কনফাইনমেÏেট ঘুমহীন, কখনো খাবারহীন পানিহীন বন্দী জাহিদ মখদুম। কতোদিন? মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয়মাসের পরেও কিছুদিন। অথচ ‘‘ভুল করেছি’’-র মুচলেকা সই করলেই তাকে ছেড়ে দেয়া হত - তার উঁচু সে মাথা সে কখনো নোয়ায় নি।

একেও আমি ‘‘পাকিস্তানের মাটীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’’ বলব না তো কি বলব?

শুধু ওরাই নয়, খুঁজলে কাশ্মীরের হাশিম আর আশরাফ, করাচীর গোলাম মুহাম্মদ ল’ুন কিংবা মকবুল বাট-এর মতো অনেক নামই পাওয়া যাবে। একাত্তরে আমাদের সমর্থন করে চাকরী হারিয়েছেন উচ্চপদস্থ সরকারী আমলা শাফা’য়াত হাসনায়েন। স্বাধীনতার পরে ঢাকায় ছুটে এসেছিলেন পাকিস্তানের কিংবদন্তী পুরুষ ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ - ক্ষমা চেয়ে গেছেন। ওদের লেখক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবি-সুশীল সমাজ অনেকবারই ক্ষমা চেয়েছে আমাদের কাছে। সেদিনও চাইলেন টরেন্টো আন্তর্জাতিক শহীদ মিনারের অনুষ্ঠানে ক্যানাডা লেখক-সংস্থার কর্তাব্যক্তি মুনীর সামী। বললেন,‘‘যে দানবের হাত পা’ ভেঙ্গে তোমরা বেরিয়ে গেছ সেই একই দানবের যাঁতাকলে আমরা এখনও পিষ্ট হচ্ছি। জানিনা পাকিস্তানের কপালে কি আছে’’।

‘‘মানুষের মন চায় মানুষেরই মন’’ - কবিগুরু। তাইতো আন্তর্জাতিক সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে এতো দেয়া নেয়া, তাইতো বম্বের সিনেমায় অভিনয় করেন পাকিস্তানী সালমা আগা, ‘‘শত্রুর দেশে’’ কনসার্ট করেন মেহদি হাসান আর তাঁর সম্পর্কে সে দেশের উচ্চতমা পদ্মশ্রী বলেন - ‘‘উন্‌কা গলে মে ভগওয়ান ঝরতা হ্যায়’’ (‘‘উনার কন্ঠে স্রষ্টা উৎসারিত হন’’ - লতা মুঙ্গেশকর) ।
তাইতো আমাদের মুক্তিযুদ্ধে জর্জ হ্যারিসন গানে গানে টাকা তোলেন, ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের মন্ত্রণাসভা বসে এলিফ্যান্ট রোডের বাটা’র ম্যানেজার অডারল্যান্ড সাহেবের বাসায়। তাইতো বাংলার গায়ক সুমন চ্যাটার্জী সুদুর নিকারাগুয়া’র স্যান্দিনিস্তা গণযুদ্ধে জীবনের ঝুঁকি নেয় এস-এল-আর হাতে, রবিশংকরের সেতারে ক্যারিবিয়ান পল্লীসংগীত আর পশ্চিমা কর্ড, হলিউডের ছবিতে জাকির হূসেন আর মেঘ রাগিনীর সা-রে-মা-পা-ণি-র্সা আর চীনা ভাষায় গেয়ে ওঠেন বাঙ্গালীনি সাবিনা ইয়াসমিন। আশ্চর্য্য নয় ? এত আগুনের মধ্যেও পুরষ্কারপ্রাপ্ত ইসরাইলী ডিরেক্টর অ্যামস্‌ গিতাই-এর ছবিতে অভিনয় করেন পুরষ্কারপ্রাপ্ত প্যালেষ্টাইনী অভিনেতা ইউসুফ আবু ওয়ার্দা, ইসরাইল-প্যালেষ্টাইনের নাট্যকর্মীরা একসাথে নাটক করেন। তাইতো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মুসলিম ‘‘বৌদি’’ আর হিন্দু ‘‘মায়ের সম্মান রক্ষায় বুকের রক্ত ঢেলে হিন্দু আর মুসলিম যুবক ইতিহাসে রেখে যায় মহামিলনের আর্ত আহ্বান।

এরই নাম মানবতার শক্তি, সংস্কৃতির শক্তি। তাই তো ইতিহাসের প্রতিটি বার্লিন-প্রাচীর এত ভঙ্গুর, এত ক্ষণস্থায়ী। এপারে এক ফোঁটা রক্তের পাশাপাশি ওপারে এক ফোঁটা অশ্রু গড়ায় এটা ইতিহাসের সত্য - তা সে বার্লিনই হোক, ইংল্যান্ড -আয়ার্ল্যান্ড হোক, বিভক্ত বাংলা-পাঞ্জাব-কাশ্মীরই হোক, ইসরাইল-প্যালেষ্টাইনই হোক বা পাকিস্তান-বাংলাদেশই হোক। পিন্ডির অলিগলির ঠেলাগাড়ীতে ফল-সব্জী নিয়ে যে ঘর্মাক্ত লোকটা হাঁক দিয়ে বিক্রী করে বেড়ায় সে আমাদের শত্রু নয়। কোহাটের পাহাড়ে যে লোকটা পাথর ভাঙ্গে, যে নারীরা বাচ্চার হাত ধরে ঝিলাম-চেনাব-বিয়াস-সিন্ধু থেকে কাঁখে কলসীভরা পানি টানে তারা আমাদের শত্রু নয়। পাকিস্তানের মসজিদে নামাজে ব্রাশ ফায়ারে যারা রক্তাক্ত মরে পড়ে থাকে তাদের সাথে আমাদের নয়শ’ কুড়িটি বধ্যভুমির তফাৎ সামান্যই। আমাদের সবার শত্রু এক, এবং তারা কারা তা আমরা ভালো করেই জানি। এবং একাত্তরে তাদের পদলেহী ‘‘হাস্যমুখে দাস্যসুখে বিনীত জোড়কর, প্রভুর পদে সোহাগমদে দোদুল কলেবর’’ (কবিগুরু) বাংলাদেশী পিশাচরা কারা তা এদিকে আমরাও জানি ওদিকে আনোয়ার-মখদুমরাও জানে।

এ দানবকে পরাস্ত করা কঠিন, হিমালয়-বিজয় বা উত্তাল সমুদ্র-বিজয়ের মতই কঠিন। সুদুর নিউজিল্যান্ডের এডমন্ড হিলারি’র সাথে সুদুর নেপালের তেনজিং নোরপে’র মিলন ছাড়া এ দুর্গম হিমালয়-বিজয় অসম্ভব। সুদুর পর্তুগালের ভাস্কো-ডা গামা’র সাথে সুদুর ইয়েমেনী সমুদ্র-বিশারদ আবদুল মজিদের মিলন ছাড়া এ দুর্দান্ত সমুদ্র-বিজয় অসম্ভব। আজ যখন দানবের হাতে আছে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মানবের সংগ্রামও তাই আন্তর্জাতিক না হয়ে উপায় নেই। তাই যখন আমাদের সাথে পাকিস্তানেও দাবী ওঠে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই তখন মনে পড়ে সেই একাত্তরেই কয়েকজন পাকিস্তানী বাংলাদেশের অবিশ্বাস্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিল ওই পাকিস্তানের মাটিতেও, - ক’জন জানে!

অগ্নিবীণার দুর্দম বাদক! অসাধ্যসাধনের অদম্য সাধক!! বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পদক তোমাদের কপালে জোটেনি কিন্তু কোটি জনগণের তরফ থেকে তোমাদের লক্ষ সালাম।

Monday, September 16, 2013

প্রাণের পরে চলে গেলো ফারিহা- বসন্তের বাতাস টুকুর মতো -- সুমি খান



 রবীন্দ্রনাথ সকল মৃত্যুশোককে  সহজ করে বরণ করে নিয়েছিলেন
 আকাশের এক  ধ্রুবতারার নাম ফারিহা জাহান !মাত্র সতেরো বছর বয়সে স্বজন পরিবার বন্ধুদের  শোকের সাগরে ভাসিয়ে আকাশে হারিয়ে গেলো গত ৩ মে, ২০১৪ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়!
ফারিহার মা দিবা স্বাভাবিক ভাবেই ভেঙ্গে পড়েছে খুব। প্রথম সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে দশ মাস দশ দিন যে কষ্ট পায় একজন মা, ১৭ বছরের হতেই মেয়েটা চলে গেলে কী থাকে আর মায়ের স্বান্তনা??



৩ মে  ২০১৪, বিকেল ৫ টার দিকে হঠাৎ ঝড় এলো আকাশ কাঁপিয়ে।পাশের বাড়ির খেলার সাথী  ফারিহাকে ডাকতে এলেই ছাদে ছুটে যায় ফারিহা। প্রচন্ড ধুলিঝড়...কৈশোরের অনাবিল আনন্দের বানের তোড়ে মৃত্যুবাণ ছিল কি সেই ঝড়? 

দু'দিন ধরে এজমার টানে কষ্ট পাচ্ছিলো, সেদিন শ্বাসের কষ্টটা একটু কম মনে হওয়াতে ছুটে বেড়াচ্ছিলো কিশোরী মেয়েটা।এরপর আবার বাড়ীতে ঢুকে কী মনে করে ময়দা দিয়ে ঝাল পিঠা বানিয়ে বাবা- মা,দাদী, ছোট বোন ফাইরুজ - সবাইকে খাওয়ালো।কেউ বুঝতে পারলো না দ্বিতীয় বারের মতো ডাষ্ট ইনহেইল করে সর্বনাশ ডেকে আনলো মেয়েটা! প্রচন্ড শ্বাসকষ্টে ছটফট করলো মেয়েটা। ইনহেলার, নেবুলাইজার কোন কাজই করলো না, শ্বাসনালীতে পানি জমে গেছে ইতিমধ্যে। 
বাঁচার আকুতিতে অসহায় আমাদের ফারিহা চিৎকার করে বাড়ির এই কামরা থেকে ঐ কামরা...ডাইনিং থেকে ড্রইং রুমের এপ্রান্ত ওপ্রান্ত আছড়ে পড়লো,"আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না, আমি কি বাঁচবো না? আমি বাঁচতে চাই..."!

খবর পেয়ে গলির মুখ থেকে ছুটে ঘরে ফিরে এলো অসহায় পিতা!  পিতা মাতা , আদরের ছোটবোন, দাদীমা, খেলার সাথী  সবার সামনেই  মৃত্যুযন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে ঘরের দরজায় পড়ে গেলো ফারিহা।

আবার উঠে প্রিয়তম বাবার বুকে ঝঁপিয়ে পড়ে বললো, "আব্বু আমাকে বাঁচাও, আব্বু আমি বাঁচতে চাই, আব্বু, আমি বাঁচতে চাই!!"  সৈয়দ আবু শাকের পাপ্পুর ডাকে নিমেষে ছুটে এলো বন্ধু ডাক্তার মঈনুদ্দীন।কোলে করে গাড়িতে উঠানো হলো, গলি পেরুতেই সদরঘাট পোষ্ট অফিস। গাড়ি স্টার্ট দিতেই বড়ো একটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে গেলো প্রাণোচ্ছল কিশোরী মেয়েটি.! 

ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন  ফারিহার দাদীমা সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা  শওকত আরা জাফর।  তার চোখের দৃষ্টি ছিল পৌত্রী  ফারিহা। রাতে  দাদিমার গায়ে কাঁথা তুলে দেয়া , সকালে তাকে  পত্রিকা পড়ে শোনানো, খাওয়ার সময় বা কোথাও বেড়াতে গেলে  নজরদারী করা -সবকিছু যেন ফারিহার করতে হবে। আজ এ শূন্যতা বড়ো কঠিন হয়ে বাজে দাদীমার বুকে!

আদরের ছোট বোন  ফাইরুজ ষষ্ঠ শ্রেণীর মেধাবী ছাত্রী। পড়ালেখা ছাড়া বাইরের জগত তার খুব চেনা নেই ! সারা দিন খুনসুটি করা একমাত্র বোনের আকস্মিক প্রয়াণে নির্বাক নিস্তব্ধ ফাইরুজ!  ৩ মে দুপুরে ও একই রকমের টপস পরে ছবি তুলে ফারিহা। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই সব শূন্য করে চলে গেলো বোন টি!! ফাইরুজের  নিদ্রাহারা রাতের প্রহর কেটে যায়, খেতে বসলে মুরগীর মাংস দেখলেই বুকে মোচড় দেয়, আদরের বোনটি মুরগীর মাংস ছাড়া খেতেই চাইতো না। ফারিহার স্মৃতিতাড়িত ফাইরুজ আর খেতে পারে না! কী করে চলে গেলো আদরের বোন টি!! কী করে খাবো আমি!

 অবিরল অশ্রুধারায়  ভেসে মায়ের মনে পড়ে  আদরের কন্যাটি দু'দিন আগে ৩০এপ্রিল মায়ের জন্মদিন পালন করেছে ! রাত প্রথম প্রহর -১২ টা ১ মিনিটে ফারিহা 'হ্যাপী বার্থডে টু ইউ' গানটা ছেড়ে মাকে জন্মদিনের শুভকামনা জানালো। দুপুরে   শওকত আরা জাফর অনেক কিছু রান্না করলেন একমাত্র পুত্রবধুর জন্মদিন উপলক্ষে । ।ফারিহা বললো, " দাদী, আজকে তোমার রান্না অনেক মজা হয়েছে! আম্মু,  দ্যাখো, দাদি তোমার জন্মদিনে কী মজা করে রান্না করেছে!"
 এসব বলে অঝোর ধারায় কেঁদে চলেছে সন্তান হারা মা দিবা!...একটা ডিপিএস ম্যাচিউরড হয়েছে ১২ বছরে, দিবার স্বপ্ন ছিল, ফারিহার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান এই টাকায় করবে!!দিবার সবকিছুতে নমিনি করেছিলো ফারিহাকে! প্রথম সন্তান, সবাইকে দেখে শুনে রাখবে-এমন স্বপ্নে ! সব আজ ধুলায় হয়েছে ধুলি!! কী স্বান্তনা আছে সন্তানহারা এই মায়ের??

রবীন্দ্রসঙ্গীতশিখতো  ফারিহা। দাদিমা বললেই হারমোনিয়াম নিয়ে বসে যেতো গাইতে!
রবীন্দ্রনাথের ভাষায় , যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে মুক্ত করো হে বন্ধ- এই বানী চিরন্তন হয়ে গেঁথে ছিলো ফারিহার মনে। আর তাই এইটুকু বয়সেই সবার একজন করে গড়ে তুলেছিলো নিজেকে! 

শুধু কি পরিবারে? প্রতিবেশী , শিক্ষক সবার কাছেই ফারিহা ছিল একান্ত স্বজন! ফ্ল্যাট সংস্কৃতির এই বন্ধ্যা সময়ে  ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবেশীদের অন্তর দিয়ে র্হাদিক বন্ধনে আত্মার আত্মীয় করে নেবার অসাধারণ বিশালত্ব ছিল ফারিহা নামের কিশোরীটির অন্তরে!! যা  আত্মকেন্দ্রীকতার এই নষ্ট সময়ে সত্যিই বিরল! 

চট্টগ্রামের সদরঘাট পোষ্ট অফিস গলি  সনাতন ধর্মবলম্বীদের আদি এলাকা।  সাম্প্রতিক সময়েও তরুণ দের মাঝে এলাকায় অসাম্প্রদায়িক বন্ধন ধরে রেখেছিলো যারা , তাদের মধ্যে ফারিহা ছিল সবার আগে। প্রতিটা পূজা পার্বনে ফারিহার সরব উপস্থিতি মাতিয়ে রাখতো প্রতিবেশীদের!! তাদের আত্মার আত্মীয় ছিল যেন  চঞ্চলা হরিনী এই কিশোরী।  কলা পাতায় করে দেয়া পূজার প্রসাদ তার ভীষণ প্রিয় ছিল। 

পাঁচিলের ওপারে সঙ্গীতা বিশ্বাস পলিরা সপরিবারে থাকে। এই দুই পরিবার গত চার দশকের ও বেশি একসাথে আছেন। হিন্দু-মুসলিম অকৃত্রিম অসাম্প্রদায়িক বন্ধনের চার দশকে এসেও অটুট থাকার প্রধান সূত্র ছিল ফারিহা। ফারিহার বাবার সহপাঠী পলিকে  পাঁচিলের এপার থেকে চিৎকার করে  ডেকে বলতো, "পলি ফুপু, নিরামিষ রেঁধেছো, আমাকে দিও কিন্তু!" পলির ফিজিওথেরাপিষ্ট ছিল ফারিহা। পলিকে প্রতিদিন চলে আসতে হতো। ফারিহার টেবিলে বসে ফারিহার হাতে ফিজিওথেরাপী নিতে হতো। একদিন ফারিহার মা দিবা বললো, আজকে আমি দিই থেরাপী। সেদিন প্রচন্ড হাতে ব্যথা হয় দিবার। মায়ের মন, ফারিহা কে বলে, " আমার একদিনেই হাতে কী প্রচন্ড ব্যথা হচ্ছে, ফারিহা, তুমি প্রতিদিন এভাবে পলিকে  থেরাপি দিওনা, তোমার অনেক কষ্ট হয়!"  ফারিহা হেসে জবাব দেয়, " না, আম্মু, পলি ফুপুর হাতে অনেক ব্যথা। আমি থেরাপি দিলে ব্যথাটা ভালো হয়ে যাবে। সদরঘাট পোষ্ট অফিসের সামনে , গলির ভেতর কালো ব্যানার আর  ফারিহার জন্যে শোক চোখে পড়ার মতো ! মনে করিয়ে দেয় , মানুষের প্রাণের পরে চলে গেলো যে, বসন্তের বাতাস টুকুর মতো ...সে যে চঞ্চলা কিশোরী ফারিহা!   

 ৫ মে তার একাদশ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলো।কথা ছিলো  পরীক্ষা শেষ করে ফারিহা চিরাচরিত নিয়মে আনন্দে মেতে উঠবে। ২য় বর্ষে ক্লাস শুরু করার মানসিক প্রস্ততি নেবে।ওসবের কিছুই হলো না।পরীক্ষার কক্ষে তার আসনটি শূণ্য পড়ে থাকলো।ফারিহার সহপাঠীরা তার জন্য কলেজ ক্যাম্পাসে ঝুলালো কালোরঙ ব্যানার। মৃত্যুর কাছে আমরা কত অসহায়।
প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়ানো চঞ্চলা কিশোরী ফারিহা চোখের পলকে প্রাণহীন নীরব শবদেহে পরিণত হবার রূঢ় বাস্তবতা  এলাকার যারা তার আত্মার আত্মীয় ছিল- শিশু থেকে বৃদ্ধ নারী-পুরুষ !! এদের কেউ  মেনে নিতে পারছেন না -ফারিহা আর কখনো খেলতে আসবে না, পূজা দেখতে আসবে না!  প্রতিবেশীদের   কাছে তার প্রিয় খাবার খেতে আসবে না!! !!

প্রচন্ড শ্বাসকষ্টে সময়মতো জরুরী চিকিৎসার অভাবে অকালে প্রাণ হারাতে হলো এই কিশোরীকে। বাঁচবার আকুল আকুতিতে পিতার বুকে আছড়ে পড়েছিলো ফারিহা! অসহায় পিতা  নিকটস্থ  হাসপাতালে ছুটে গেলেও  তাৎক্ষণিকভাবে  অক্সিজেন এবং জরুরী চিকিৎসা পেতে ব্যর্থ হন। মৃত্যুর অমোঘ নিয়তি কেড়ে নেয় দিবা-পাপ্পুর বুকের ধন , তাদের প্রথম সন্তান ফারিহাকে। ফারিহার মা দিবা এবং বাবা সৈয়দ আবু শাকের পাপ্পুর বুকে পাথর সমান এ ভার বয়ে বেড়াতে হবে আমৃত্যু । ফারিহার প্রাণ ছিল তার দাদীমা শওকত আরা জাফর । অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা শওকত আরা জাফর কোন ভাবেই ভুলতে পারেন না প্রিয়তম নাতনীর বাঁচার আকুতি !, তার দুই কন্যা নুসরাত জাহান রুমা এবং ইসরাত জাহান কণাও  প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রীর আকস্মিক প্রয়াণে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত!

 ফারিহার বালিশ, জামা কাপড় নিয়ে  অবিরল অশ্রুধারায় নির্ঘুম প্রহর কাটছে তার মা  দিবার। কী স্বান্তনা আছে , যা দিয়ে মায়ের শূন্য বুকে ফিরিয়ে আনা যায়, এমন প্রানবন্ত সন্তানকে?

স্বজনদের বেদনার ঝড় কাটাতে শরণাপন্ন হলাম রবীন্দ্রনাথের। 

 রবীন্দ্রনাথের জীবনে পর পর ১৩ স্বজন কে হারাতে হয় !  কবিগুরুর জীবনের সবচেয়ে বড়ো অধ্যায়, শোকবিধুর সেই অধ্যায় স্মরণ করছি।যাকে স্বজন হারানোর শোকে আক্রান্ত হতে হয়েছে বারবার। 

রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন তেরো বছর দশ মাস, তখন তিনি মাকে হারান। 

 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ে করার চার মাস পর ১৮৮৪ সালের ১৯ এপ্রিল আত্মহত্যা করেন  জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্নী কাদম্বরী দেবী ।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আট বছর বয়স থেকে যিনি তার খেলার সাথী ছিলেন। 

  পরিণত বয়সে রবীন্দ্রনাথের বিচ্ছেদশোকের অশ্রুমালায়  যুক্ত হলেন কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী৷   প্রথম সন্তান প্রসবের সময় মৃনালিনীর বয়স কম ছিল বলে কবি যেন ভরসা পেতেন না ।তাই সন্তানের দেখা শোনা অনেকাংশেই রবীন্দ্রনাথ করতেন। তিনি পিতা হয়েও কন্যাকে লালন পালন করতেন মাতৃরূপে। শিশুকে খাওয়ানো, কাপড় পড়ানো, বিছানা বদলানো এসবই তিনি করতেন নিজ হাতে।

১৩০৯ সালে ৭ই অগ্রহায়ণ, ইংরেজী ১৯০২ সালের ২৩শে নভেম্বর, রবিবার মৃনালিনী দেবী  মৃত্যু বরণ করেন। স্ত্রীর  মৃত্যু শয্যায় নিজ হাতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সেবা-যত্ন করতেন। প্রায় দুমাস তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন, ভাড়া করা নার্সদের হাতে পত্মীর সুস্থ্যতার ভার তিনি একদিনের জন্যও দেননি। স্বামীর সেবা পাওয়া সৌভাগ্যের বিষয়! মৃনালিনী দেবী সেটা পেয়েছিলেন ভাগ্যগুনে। তখনকার দিনে ইলেকট্রিক ফ্যান আসেনি । হাত পাখা দিয়ে দিনের পর দিন তিনি বাতাস করেছেন স্ত্রীকে। এক মুহুর্তের জন্যেও হাতের পাখা ফেলেননি।অকালে চলে গেলেন তিনি৷ বয়স তখন তাঁর বয়স মাত্র ঊনত্রিশ৷ 

স্ত্রীর মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ ছাদে চলে গেলেন, নিষেধ করে গেলেন যেন কেউ তাঁর কাছে না যায়৷ মৃণালিনীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে রচিত হলো ‘স্মরণ' কবিতাগুচ্ছ৷ ভাষায় আড়ম্বর নেই, উপমা অলংকারের আয়োজন নেই, জীবনের টুকরো টুকরো ছবিগুলোর মধ্য দিয়ে কবি তাঁর প্রিয়াকে মৃত্যুর পর উপলব্ধি করার যে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন, তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ‘স্মরণ'-এর অনেকগুলো কবিতায়৷ ‘যুগল মিলন' কবিতায় লিখেছেন, ‘‘মিলন সম্পূর্ণ হল তোমা সনে, এ বিচ্ছেদ বেদনার নিবিড় বন্ধনে৷''

রবীন্দ্রনাথের দুই ছেলে, তিন মেয়ে – মাধুরীলতা, রথীন্দ্রনাথ, রেণুকা, মীরা ও শমীন্দ্রনাথ৷ মাধুরীলতার ডাক নাম বেলা, রেনুকার ডাক নাম রাণী৷ স্ত্রী বেঁচে থাকতেই তিনি মাধুরীলতা ও রেনুকার বিয়ে দেন, তাদের অল্প বয়সে৷ বিয়ের পর বছর না ঘুরতেই রেণুকা গুরুতর অসুস্থ হলো। ডাক্তাররা রোগ পরীক্ষা করে রায় দিলেন – যক্ষ্মা৷ ডাক্তারদের পরামর্শে রবীন্দ্রনাথ রেণুকাকে নিয়ে হাওয়াবদল করলেন দু'বার৷

 অসুস্থ রেণুকাকে শোনানোর জন্য লিখলেন ‘শিশু' কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুচ্ছ৷ অবশেষে  মাত্র বারো বছর বয়সে চলে গেলো রেণুকা; মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর দশ মাসের মধ্যে৷ 

১৯০৫-এ পরিণত বয়সে মৃত্যু হলো পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের৷ 

এর মাত্র দু'বছর পর রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ পুত্র এগারো বছর বয়সি শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর মুত্যুবরণ করলো । মুঙ্গেরে বেড়াতে গিয়ে কলেরায় আক্রান্ত হলো শমীন্দ্রনাথ৷ খবর পেয়ে শান্তিনিকেতন থেকে মুঙ্গেরে পৌঁছানোর আগেই মারা গেলো শমীন্দ্রনাথ।

 রবীন্দ্রনাথ তখনো পথে। বলে দিলেন তার জন্যে অপেক্ষা না করে শমীন্দ্রনাথকে দাহ করে ফেলতে। আদরের ছেলে কে শেষ দেখা ও দেখতে পারলেন না কবিগুরু।

 রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘‘...শমী যে রাত্রে চলে গেল তার পরের রাতে রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে, কোথাও কিছু কম পড়েছে তার লক্ষণ নেই৷ মন বললে কম পড়েনি, সমস্তর মধ্যে সবই রয়ে গেছে৷ আমিও তার মধ্যে৷' সে সময়ে রচিত হলো তার অমর সৃষ্টি ," আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে !

আজ জ্যোত্স্নারাতে সবাই গেছে বনে

বসন্তের এই মাতাল সমীঁরণে ।।

যাব না গো যাব না যে, রইনু পড়ে ঘরের মাঝে-

এই নিরালায় রব আপন কোণে

যাব না এই মাতাল সমীরণে ।।

আমার এ ঘর বহু যতন ক'রে

ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে ।

আমারে যে জাগতে হবে, কী জানি সে আসবে কবে

যদি আমায় পড়ে তাহার মনে

বসন্তের এই মাতাল সমীরণে ।।

বড়ো মেয়ে মাধুরীলতার সংসার জীবন শেষ পর্যন্ত সুখের ছিলো না৷ রবীন্দ্রনাথের জীবনে এটাও এক বেদনাত্মক অধ্যায়৷ জামাতা শরতের অন্যায় গর্হিত আচরণ আর মাধুরীলতার প্রতি চরম নির্যাতন সইতে না পারলে ও অসহায় পিতা রবীন্দ্রনাথ কিছুই করতে পারেন নি।
জামাতার সাথে তাঁর সম্পর্ক তিক্ততায় পৌঁছেছিলো৷ মেয়ের বাড়িতে তাঁর যাওয়া আসাও তেমন ছিলো না৷ কন্যার কষ্ট সইতে না পেরে বলতেন." ছোটকালে মাধুরীলতার কঠিন অসুখ হয়েছিলো, সেদিন সে মরে যেতো যদি, আমাকে তার এমন কঠিন সময় দেখতে হতো না।"

একদিন হঠাৎ খবর এলো মাধুরীলতা অসুস্থ৷ রাজরোগ যক্ষ্মায় আক্রান্ত মাধুরীলতা । শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় এসে রবীন্দ্রনাথ প্রায় রোজই মেয়েকে দেখতে যান৷  জামাতার চরম অপমান জনক আচরণ নীরবে সয়ে গেছেন বিশ্বজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর!  লেখিকা হেমলতা দেবী জানাচ্ছেন, ‘‘অতি আদরের মেয়ে বেলা মৃত্যুশয্যায়, সব অপমান চেপে তিনি দেখা করতে যেতেন তার কন্যা বেলা (মাধুরীলতা) র সাথে। শ্বশুর মশাইকে দেখে  শরৎ  টেবিলের ওপর পা তুলে দিয়ে সিগারেট খেত৷ পা নাবাতো না পর্যন্ত – এমনি করে অপমান করত৷ উনি সব বুকের মধ্যে চেপে মেয়ের পাশে বসতেন...৷''মাধুরীলতার মৃত্যু হলো বত্রিশ বছর বয়সে৷

 রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'পিতৃস্মৃতি' গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ‘‘সেদিন ২ জ্যৈষ্ঠ – যখন তিনি শ্রীরামপুরের বাড়িতে পৌঁছলেন, তিনি বুঝতে পারলেন যা হবার তা হয়ে গেছে৷ গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন৷ সেদিন সন্ধ্যা বেলায় বিচিত্রার বৈঠক ছিল৷ বাবা সকলের সঙ্গে হাসিমুখে গল্পসল্প যেমন করেন, সেদিনও তাই করলেন৷ তাঁর কথাবার্তা থেকে একজনও কেউ ঘুণাক্ষরে জানতে পারল না যে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা হয়ে গেছে, মনের কী অবস্থা নিয়ে বাবা তাদের সঙ্গে সদালাপ করছেন৷''

১৯২৩-এ মৃত্যু হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের, ১৯২৫ সালে মারা যান  জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর,  ১৯২৬-এ দ্বিজেন্দ্রনাথ, ১৯৩২-এ দিদি স্বর্ণকুমারী মুত্যুবরণ করেন ৷ 

১৯৩২-এ একাত্তর বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ হারালেন কন্যা মীরার পুত্র কুড়ি বছর বয়সি আদরের নাতি নীতিন্দ্রনাথকে৷ উচ্চতর শিক্ষার জন্য নীতিন্দ্রনাথ গিয়েছিলো জার্মানিতে৷ টেলিগ্রামে নীতুর মৃত্যু সংবাদ এলো৷  শান্তিনিকেতনে তখন 'বর্ষা মঙ্গল' উৎসবের আয়োজন চলছে৷

আয়োজন বন্ধ হলো না৷ রবীন্দ্রনাথ মীরাকে দীর্ঘ চিঠিতে লিখলেন, ‘‘নীতুকে খুব ভালবাসতুম, ... অনেকে বললে, এবার বর্ষামঙ্গল বন্ধ থাক আমার শোকের খাতিরে৷  আমি বললুম, সে হতেই পারে না; আমার শোকের দায় আমিই নেব৷''

শোকের দায় আবার নিতে হলো রবীন্দ্রনাথকে , তার মৃত্যুর এক বছর আগে৷ আরেক প্রিয় ভাইপো সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অকাল মৃত্যুর সংবাদ পেলেন মংপু-তে বসে৷ জন্মদিনের আয়োজন চলছিলো তখন৷ ভাইঝি ইন্দিরাকে লিখলেন, ‘‘তোরা বোধহয় জানিস আমার নিজের ছেলেদের চেয়ে সুরেনকে আমি বেশি ভালোবেসেছিলুম৷'' কবিতা লিখলেন সুরেনের স্মৃতিতে, ‘‘আজি জন্মবাসরের বক্ষ ভেদ করি/ প্রিয়মৃত্যুবিচ্ছেদের এসেছে সংবাদ...''

রবীন্দ্রনাথ একবার চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘‘সাহস যেন থাকে, অবসাদ যেন না আসে, কোন খানে কোন সূত্র যেন ছিন্ন হয়ে না যায়৷ যা ঘটে তাকে যেন সহজে স্বীকার করি৷'' রবীন্দ্রনাথ সকল মৃত্যুশোককে এ ভাবেই সহজ করে বরণ করে নিয়েছিলেন৷ অনায়াসে তাই বলতে পেরেছিলেন, ‘‘ঈশ্বর যাহা দিয়াছেন তা গ্রহণ করিয়াছি৷ আরো দুঃখ যদি দেন তো তাহাও শিরোধার্য করিয়া লইব৷ আমি পরাভূত হইব না৷''

Friday, September 13, 2013

মিনি পৃথিবী -আমেরিকা নিয়ে এক ডজন : মুহম্মদ জাফর ইকবাল



আমার ছয়জন ছাত্রছাত্রী একসঙ্গে আমেরিকা চলে যাচ্ছে। একজন চাকরি করতে, অন্যরা পি.এইচ.ডি. করতে। এরা সবাই এখন আমার সহকর্মী। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতাকে জীবন হিসেবে বেছে নিলে পি.এইচ.ডি. করতে হয়। যত তাড়াতাড়ি করা যায় ততই ভালো। আমি নিজেও আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে ঠিক এই সময়টাতে পি.এইচ.ডি. করতে আমেরিকা গিয়েছিলাম। আমার এই ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বেছে নেওয়ার আগে কোথায় কী ধরণের প্রোগ্রাম, কোন প্রফেসর কী গবেষণা করেন, তাদের র‌্যাংকিং কী রকম এসব নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছে। আমার মনে আছে, আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়টি ঠিক করেছিলাম তার প্যাডের কাগজটি দেখে (না, আমি মোটেও বানিয়ে বলছি না)।

যাবার আগে আমার ছাত্রছাত্রীরা সবাইকে নিয়ে বিশাল একটা পার্টি দিয়েছে। আমি আমেরিকাতে আঠারো বছর ছিলাম, এরপরেও অনেকবার যেতে হয়েছে, তাই পার্টি শেষে সবাইকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কী যাবার আগে সেই দেশটি নিয়ে কোনো বাস্তব উপদেশ শুনতে চাও? যে উপদেশ বইপত্র-ইন্টারনেট কোথাও পাবে না? তারা সবাই আগ্রহ নিয়ে শুনতে রাজি হলো।
আমি তাদেরকে তখন এক ডজন তথ্য এবং উপদেশ দিয়েছিলাম, সেগুলো ছিল এরকম :

০১.
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (বা সহজ কথায় আমেরিকা) পুরো পৃথিবীকে দেখে স্বার্থপরের মতো। কিন্তু তারা নিজের দেশের জন্যে সাংঘাতিকভাবে নিঃস্বার্থ। (একাত্তরে দেশটি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিল কিন্তু তাদের দেশের মানুষ ছিল আমাদের পক্ষে)।
এই মুহূর্তে সারা পৃথিবীতে যে সব দেশে হানাহানি খুনোখনি যুদ্ধ বিগ্রহ হচ্ছে, খোঁজ নিলে দেখা যাবে সব জায়গায় সূক্ষ্মভাবে হলেও আমেরিকার একটা যোগাযোগ আছে। তবে দেশটি যেহেতু নিজের দেশের মানুষকে ভালোভাবে দেখেশুনে রাখে, তাই থাকার জন্যে সেটি চমৎকার একটা জায়গা। সারা পৃথিবী থেকে সব দেশের মানুষ সেখানে গিয়ে এটাকে একটা মিনি পৃথিবী বানিয়ে ফেলেছে। এই দেশে কেউই বিদেশি নয়, তাই থাকার জন্যে, লেখাপড়া বা গবেষণা করার জন্যে আমেরিকার কোনো তুলনা নেই।

০২.
আমেরিকার সাধারণ মানুষেরা গোমড়ামুখী নয়, তারা খুব হাসিখুশি। পথে ঘাটে সুন্দরী মেয়েরা খামোখা মিষ্টি হাসি দিলেই তারা প্রেমে পড়ে গেছে ভাবার কোনো কারণ নেই।

০৩.
পশ্চিমা দেশের মানুষেরা নাম নিয়ে মোটেও সৃজনশীল নয়। তারা ধরেই নেয়, সবার নামের দুটো অংশ থাকবে। প্রথম অংশটা হচ্ছে ঘনিষ্টদের ডাকার জন্য এবং শেষ অংশটা আনুষ্ঠানিক পারিবারিক নাম। পারিবারিক নাম যে নামের প্রথমে থাকতে পারে (শেখ মুজিবুর রহমান) সেটা তারা জানে না। খেয়ালি বাবা হলে যে পারিবারিক নাম নাও থাকতে পারে (বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ, মেজো ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ছোট ভাই আহসান হাবীব) সেটাও তারা জানে না। একটু ঘনিষ্ঠ হলেই নামের প্রথম অংশ দিয়ে ডাকা শুরু করে বলে আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষেরা আমেরিকা পৌঁছানোর কিছু দিনের ভেতরে আবিষ্কার করে সবাই তাদেরকে মোহাম্মদ বলে ডাকছে! তাই ঘনিষ্ঠদের কাছে কে কী নামে পরিচিত হতে চায়, সেটা একেবারে প্রথম দিনে পরিষ্কার করে খোলাখুলি বরে দেওয়া ভালো। আমেরিকায় নামের আগে মোহাম্মদের সংক্ষিপ্ত রূপ MD লেখা খুবই বিপজ্জনক, তারা সেটাকে ডাক্তারি ডিগ্রি মনে করে সবসময়ই নামের পিছনে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে।

০৪.
যখন প্রথম প্রথম কেউ আমেরিকা যায়, তখন তাদের স্কলারশিপ বা বেতনের চেক পায় ডলারে। কিন্তু তারা যখন খরচ করতে যায়, তারা সেটা ডলারে খরচ করতে পারে না, তারা খরচ করে টাকায়। নিজের অজান্তেই কোনো কিছুর দাম দেখামাত্র মনে মনে ৮০ দিয়ে গুণ করে ভিমড়ি খেতে শুরু করে। এক কাপ কফির দাম একশ থেকে তিনশ টাকা, সিনেমার টিকেট আটশ থেকে হাজার টাকা, আইসক্রিমের কোন দুইশ থেকে পাঁচশ টাকা, গানের সিডি প্রায় হাজার টাকা, একটা বই দুই থেকে তিন হাজার টাকা, মধ্যবিত্ত সন্তানের পরিবারের জন্য সেখানে কেনাকাটা করা রীতিমত কঠিন একটা ব্যাপার। (তবে বড় লোকের ছানাপোনারা যারা এই দেশে বনানী গুলশানের হাইফাই দোকানপাট, রেস্টুরেন্টে ঘোরাফেরা কিংবা খানাপিনা করে অভ্যস্ত তাদের জন্য ব্যাপারটা সহজ, এই দেশে তারা মোটামুটি আমেরিকান দামেই কেনাকাটা বা খানাপিনা করে।) কাজেই অন্য সবার প্রথম কাজ হচ্ছে কোনো কিছু কেনার আগে মনে মনে আশি দিয়ে গুণ করে ফেলার অভ্যাসটুকু ঝেড়ে ফেলা।

আমেরিকায় কেনাকাটার আরেকটা বিষয় হচ্ছে ‘টিপস’, এর বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে বখশিশ। কিন্তু বখশিশ শব্দটায় তাচ্ছিল্য কিংবা অবমাননার ছাপ রয়েছে। টিপস শব্দটিতে তাচ্ছিল্য কিংবা অবমাননা নেই। আমেরিকার মূলধারায় প্রায় সব তরুণ-তরুণী জীবনের কোনো না কোনো সময়ে রেস্টুরেন্টে ওয়েটারের কাজ করে বড় হয়েছে। তখন তাদের বেতন বলতে গেলে ছিলই না এবং খদ্দেরদের টিপসটাই ছিল তাদের বেতন। সে দেশের রেস্টুরেন্টের ওয়েটার, নাপিত বা ক্যাব ড্রাইভারকে টিপস দিতে হয়। হতচ্ছাড়া কিপটে মানুষদের হাত গলে ১০% টিপসও বের হতে চায় না, দরাজদিল মানুষেরা দেয় ২০% আর মাঝামাঝি পরিমাণ হচ্ছে ১৫%।
কাজেই বন্ধু বান্ধব সবাইকে নিয়ে কোথাও খেলে গেলে মেন‍্যতে খাবারের দামটা দেখে আগেভাগেই তার সাথে ১৫% থেকে ২০% যোগ করে রাখাটা জরুরি।

০৫.
আমরা হাত দিয়ে ডাল-ভাত-সবজি-মাছ-মাংস মাখিয়ে মাখিয়ে খাই। আমেরিকা গিয়েও বাসার ভেতরে নিজে রান্না করে সবকিছু হাত দিয়ে খাওয়া যাবে। বাইরে হ্যামবার্গার, স্যান্ডউইচ কিংবা পিৎজা (উচ্চারণটা পিজ্জা নয়, পিৎজা) হাত দিয়ে খেতে পারলেও বেশিরভাগ খাবার ছুরি-কাটা ব্যবহার করে খেতে হবে। আমাদের এই অঞ্চলে খাবার জন্য চামচ দেওয়া হয়। ইউরোপ আমেরিকায় কিন্তু ডাইনিং টেবিলে চামচ নেই, শুধু ছুরি আর কাটা। কোন হাতে ছুরি, কোন হাতে কাটা ধরতে হয় সেরকম নানা ধরণের নিয়ম কানুন রয়েছে। সেই নিয়ম আবার ইউরোপে একরকম, আমেরিকায় অন্যরকম। কিন্তু মূল বিষয়টা খুব সহজ। বেশিরভাগ মানুষ ডান হাতে কাজ করে এবং কাটাকাটি করতে একটু জোর লাগে, তাই ছুরিটা থাকবে ডান হাতে (এবং খাওয়ার প্রক্রিয়াতে সেটা কখনো মুখে ঢোকানো যাবে না, প্রয়োজনে আমি ডাইনিং টেবিলে অন্যের ছুরি ব্যবহার করতে দেখেছি।) এটাই নিয়ম। আমেরিকাতে কাটার জন্য কোনো নিয়ম নেই। যারা ডান হাতে কাজ করে অভ্যস্ত তারা ছুরি দিয়ে কাটাকাটি শেষ করে প্লেটে ছুরিটা রেখে ডান হাতে কাটাকা তুলে নিয়ে খায়। শুনেছি বিশুদ্ধ এরিস্টোক্রেট (বাংলা প্রতিশব্দ সম্ভ্রান্ত। শব্দটি এরিস্টোক্রেসি পুরোটা ফুটে উঠে না, তাই আসল শব্দটাই ব্যবহার করতে হলো!) মানুষেরা মরে গেলেও ডান হাতে মুখে খাবার তুলে না। এই নিয়মগুলো কে করেছে এবং কেন এই নিয়মেই খেতে হবে, অন্য নিয়মে কেন খাওয়া যাবে না, আমি তার উত্তর জানি না। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে অনেক আমেরিকানরা কিন্তু চপ স্টিক (দুই টুকরো কাঠি) দিয়ে খেতে পারে। আমার ধারণা একবার চপ স্টিক দিয়ে খেতে শিখে গেলে খাওয়ার জন্য এটা খুব চমৎকার একটা পদ্ধতি।

আমার কিছু আমেরিকান বন্ধু আমাদের দেখাদেখি হাতে খেতে গিয়ে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তারা আঙুল দিয়ে খাবার মাখিয়ে মুখ পযন্ত নিয়ে গেলেও মুখে সেই খাবার ঢোকাতে গিয়ে নাস্তানাবুদ হয়েছে। পাঁচটা আঙুল মুখের ভিতরে ঢুকিয়ে সেখানে খাবারটা ছেড়ে দিতে গিয়ে আবিষ্কার করেছে- কাজটা মোটামুটি অসম্ভব। যারা আগে কখনো লক্ষ্য করেনি, তাদেরকে বলে দেওয়া যায় আমরা কিন্তু মুখের ভেতর আঙুল ঢোকাই না, বুড়ো আঙুল দিয়ে ঠেলে খাবারটা মুখে ঢুকিয়ে দেই। অত্যন্ত দক্ষ একটা পদ্ধতি।

০৬.
খাবারের কথা বলতে হলেই পানীয়ের ব্যাপারটা তার সাথে সাথে চলে আসে। আমেরিকায় ট্যাপেয় পানি বিশুদ্ধ, তাই পানি কিনে খাবার প্রয়োজন নেই। শুনেছি নিউ ইয়র্কের মানুষ মোটা হয়ে যাচ্ছে বলে বিশাল আকারের সফট ড্রিংক বেআইনি করে দেওয়া হয়েছে! তবে এ্যালকোহল জাতীয় পানীয় (সোজা বাংলায় মদ) নিয়ে সবাইকে আশ্বস্ত করা যায়। যারা এটা খেতে চায় না, আমেরিকানরা কখনোই তাদেরকে সেটা খেতে জোরাজুরি করবে না। তবে মদ খাওয়া বাঙালিদের কথা আলাদা, তারা নিজেরা সেটা খায় বলে অন্যদের খাওয়ানোর জন্য বাড়াবাড়িতে ব্যস্ত থাকে। বাঙালিদের আসরে তারা অন্য বাঙালিদের জোর করে, তাদের চাপ দেয় এবং না খেলে তাকে নিয়ে টিটকারি-ঠাট্টা তামাশা করে। এর কারণটা কী, আমি এখনো বের করতে পারিনি।

০৭.
খাবার এবং পানীয়ের কথা বলা হলেই এর পরবর্তী ধাপ হিসেবে টয়লেটের কথা বলা উচিত। লোকচক্ষুর আড়ালে এর খুটিনাটি নিয়ে কথা বলা যেতে পারে কিন্তু ছাপার অক্ষরে কিছু লিখে ফেলাটা শোভন হবে না। এই ভয়ঙ্কর বিষয়টা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে হবে, আমরা যেভাবে শিখেছি!

০৮.
ডাইনিং টেবিল আর টয়লেটের পরে নিশ্চয়ই বাথরুমের ব্যাপারটা আসার কথা। নিজের বাসায় নিরিবিলি বাথরুমের মাঝে কোনো সমস্যা নেই কিন্তু আমেরিকার গণ বাথরুমের মতো ভয়ঙ্কর আর কিছু হতে পারে বলে আমার জানা নেই। আমাকে আগে থেকে কেউ সতর্ক করে দেয়নি, তাই প্রথমবার যখন আমার ডর্মিটরির গণবাথরুমে একজন আমার সামনে জামা-কাপড় খুলে পুরোপুরি ন্যাংটো হয়ে গিয়েছিল, সেই আতঙ্কের কথা আমি কোনোদিন ভুলব না! এরপর অনেকদিন পার হয়েছে, আমি অনেক কিছুতে অভ্যস্ত হয়েছি কিন্তু গণ-বাথরুমে উদাস মুখে শরীরে একটা সূতা ছাড়া সবাই ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেই দৃশ্যে আমি কোনোদিন অভ্যস্ত হতে পারিনি। এই জন্মে সেটা সম্ভব হবে বলেও মনে হয় না।ছেলেরা ছেলেদের সামনে এবং মেয়েরা মেয়েদের সামনে জামা-কাপড় পুরোপুরি খুলে ফেলতে কোনো লজ্জা অনুভব করে না, এই ব্যাপারটা কীভাবে সম্ভব হতে পারে আমি কোনোদিন বুঝতে পারব না!

০৯.
আমেরিকার দৈনন্দিন জীবনে পোশাকের ব্যাপারটা সবচেয়ে সহজ, সেটা নিয়ে কেউই মাথা ঘামায় না। যার যা খুশি পরতে পারে, তাই যে যেটা পরে আরাম পায় সেটাই পরে। টি-শার্ট আর জিনস পরে পুরো জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়। (হাওয়াইয়ে আমার পরিচিত একজন বাংলাদেশের অধ্যাপক বিরক্ত হয়ে গ্রীষ্মকালে ক্লাস নেওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন কারণ ছাত্রীরা বিকিনি পরে ক্লাসে চলে আসে। তবে হাওয়াইয়ের কথা আলাদা, মূল ভূখণ্ডে এত বাড়াবাড়ি নেই!) একজন সহকর্মী হঠাৎ করে মারা যাওয়ার পর তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতে যাওয়ার সময় স্যুট পরে যাওয়া ছাড়া অন্য কখনো আমার স্যুট-টাই পরার সুযোগ হয়েছে বলে মনে করতে পারছি না! আনুষ্ঠানিক পোশাক পরতে হয় সেরকম জায়গা নিশ্চয়ই আছে কিন্তু আমার আঠারো বছরের প্রবাস জীবনে সেরকম জায়গায় খুব বেশি যেতে হয়নি। (কী আনন্দের কথা, দেশে ফেরার পর বাকি আঠারো বছরেও আমায় সেরকম জাযগায় যেতে হচ্ছে না।)

১০.
আমাদের দেশে পান খাওয়ার একটি ব্যাপার আছে, তার সাথে জড়িত আছে পানের পিক। পান চিবুতে চিবুতে এদিক-সেদিক পিচিক করে পানের পিক ফেলাটা প্রায় কালচারের অংশ হয়ে গেছে। (কেউ কী আমাদের সদর হাসপাতালগুলোর দেয়ালের কোনাগুলো দেখেছে? মনে হয় সেগুলো তৈরিই হয়েছে পানের পিক ফেলার জন্য!) শুধু পানের পিক নয়, চিপসের প্যাকেট, ঠোঙা, পানির খালি বোতল, চুইংগামের কাগজ, সিগারেটের গোড়া যেখানে-সেখানে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়াকে কেউ অন্যায় মনে করে না। বাংলাদেশের সবুজ পাসপোর্টটা হাতে নিয়ে পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশে যাওয়ার জন্য প্লেনে উঠার আগে এই অভ্যাসগুরো বাক্সবন্দি করে দেশে রেখে যেতে হয়। আমেরিকার কোনো রাস্তায় অন্যমনস্কভাবে একটা ঠোঙা ছুঁড়ে ফেলার পর যদি কোনো থুরথুরে বুড়ি সেটা তুলে হাতে ধরিয়ে দিয়ে ঠিক জায়গায় ফেলতে বলে তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। (দোহাই লাগে, এরকম কোনো অভিজ্ঞতা হলে কেউ যেন নিজের দেশের পরিচয় দিয়ে দেশের বেইজ্জতি না করে।)

একটা বড়সরো ঢেকুর তোলাটা আমাদের কাছে খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। (আমি শুনেছি কোনো কোনো কালচারাল অনুষ্ঠানে খাওয়া শেষে অতিথিরা ঢেকুর না তুললে সেটাকে অপমান হিসেবে ধরা হয়।) তবে পশ্চিমা দেশে প্রকাশ্য জায়গায় ঢেকুর তোলাটা বন্ধ রাখতে হবে। হাঁচি, কাশি, ঢেকুর এরকম গর্হিত ব্যাপার যদি ঘটেই যায়, তাহলে ‘এক্সকিউজ মি’ বলে ক্ষমা চাইলে সবাই সেই অপরাধকে ক্ষমা করে দেয়। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে এই বাক্যাংশটি ব্যবহার করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

এই সাথে আরেকটা বাক্যাংশ শিখে নেওয়া ভালো। সেটা হচ্ছে- থ্যাংক ইউ। কোন একটা অজ্ঞাত কারণে আমরা যদি কারও প্রতি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ অনুভব করি, তারপরও সেটা মুখ ফুটে বলি না। আমেরিকা গেলে এটা মুখ ফুটে বলা শিখে নিতে হবে। বাক্যংশটি চমৎকার, যে বলে এবং যাকে বলে দু’জনেই এটা থেকে আনন্দ পেতে পারে।

১১.
আমেরিকাতে তরুণ-তরুণীরা (এবং বুড়ো-বুড়িরাও) তাদের ভালোবাসা যথেষ্ট খোলামেলাভাবে প্রকাশ করে। দু’জন তরুণ-তরুণী হাত ধরাধরি করে কিংবা জড়াজড়ি করে হাঁটছে এটা খুবই পরিচিত একটা দৃশ্য। কিন্তু দু’জন তরুণ (কিংবা দু’জন তরুণী) পরস্পরের হাত ধরে হাঁটছে এটা মোটেও পরিচিত দৃশ্য নয়। দু’জন তরুণ (কিংবা দু’জন তরুণী) পরস্পরের খুব ঘনিষ্ট বন্ধু হতে পারে কিন্তু কখনোই তারা একে অন্যের হাত ধরে হাঁটবে না। কারণ তাহলে অন্যরা সেটাকে বিশেষ এক ধরণের সম্পর্ক হিসেবে ধরে নেবে! (কোনো লেখায় আমার নাম থাকলে বাচ্চা-কাচ্চারা সেটা পড়ে ফেলে বলে খবর পেয়েছি –তাই এই বিষয়টাকে আর বিস্তৃত করা গেল না!)

১২.
আমার এক ডজন তথ্য এবং উপদেশের শেষটিতে চলে এসেছি। আসলে এখানে যে কথাটি বলতে চেয়েছি, সেটা বলার জন্য উপরের কথাগুলো একটি ভনিতা মাত্র! উপরের ভূমিকাটি শেষ করে এবারে আমি আসল কথাটিতে চলে আসতে পারি।

আমাদের দেশে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও সেগুলোতে সত্যিকার অর্থে গবেষণা শুরু হয়নি (শিক্ষা এবং গবেষণার জন্য সরকার যে পরিমাণ টাকা খরচ করে, সেটা একটা কৌতুকের মতো)।
তাই এই দেশের উৎসাহী ছেলেমেয়েরা প্রতি বছর বাইরে পি.এইচ.ডি. করতে যায়। এদের অনেকে এত উৎসাহী, এত সৃজনশীল, এত প্রতিভাবান যে, তাদের একটা ছোট অংশও যদি দেশে ফিরে আসতো তাহলে দেশে মোটামুটি একটা বিপ্লব ঘটে যেত। কিন্তু তারা আসলে দেশে ফিরে আসে না। আমি আশায় আশায় থাকি, যে কোনোদিন এই দেশের সরকার একটি দুটি ছোট বিষয় নিয়মের মাঝে নিয়ে আসবে এবং আমাদের এই উদ্যমী সোনার টুকরো ছেলেমেয়েরা দেশে ফিরে আসতে শুরু করবে। যতদিন তারা দেশে ফিরে না আসছে, আমার খুব ইচ্ছে তারা অত্যন্ত এই দেশটির কথা তাদের বুকের ভেতরে লালন করুক, এর বেশি আমার কিছু চাইবার নেই।

আমাদের দেশ থেকে যারা লেখাপড়া করতে বিদেশে গিয়ে সেখানে থেকে যায়, তাদেরকে আসলে মোটামুটি দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক ভাগ কখনো ভুলতে পারে না যে, তারা এই দরিদ্র দেশটির মূল্যবান সম্পদ ব্যবহার করে লেখাপড়া করেছে। প্রতিদানে তারা দেশকে কিছু দেয়নি। দরিদ্র দেশে প্রায় বিনামূল্যে পাওয়া শিক্ষাটুকু ব্যবহার করে আমেরিকাকে (বা সেরকম কোনো একটা দেশকে) সেবা করে যাচ্ছে। সেজন্য তাদের ভেতর একটা অপরাধ বোধ কাজ করে, তারা সবসময়ই দেশের ঋণটুকু শোধ করার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করে।

আরেক ভাগ মানুষ এই অপরাধ বোধ থেকে বের হওয়ার জন্য অত্যন্ত বিচিত্র একটা উপায় খুঁজে বের করেছে। সেটা হচ্ছে- সবকিছুর জন্য নিজের দেশটিকেই দায়ী করা। তারা প্রতি মুহূর্তে দেশকে গালাগাল দেয়। তারা বড় গলায় সবাইকে জানিয়ে দেয়, এই পোড়া দেশে জ্ঞান বিজ্ঞান গবেষণোর সুযোগ নেই, তাদের মেধা কিংবা প্রতিভা ব্যবহারের সুযোগ নেই, এই দেশে জন্ম হওয়াটাই অনেক বড় ভুল হয়েছিল। এখন আমেরিকাতে আসন গেড়ে সেই ভুল সংশোধনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। নিজের দেশটি কীভাবে রসাতলে যাচ্ছে তার সমস্ত পরিসংখ্যান তাদের নখদর্পণে। দেশের অবিবেচক মানুষ কীভাবে রাজনীতি করে, হরতাল দিয়ে, সন্ত্রাস করে দুর্নীতি করে পুরো দেশটাকে ডুবিয়ে দিচ্ছে, সেটা তারা শুধু নিজেদের মাঝে নয়, বাইরের সবার সাথেও আলোচনা করে সময় কাটায়।

আমার যে ছাত্রছাত্রীরা আমেরিকা লেখাপড়া করতে যাচ্ছে, তাদের এই স্বার্থপর অংশ থেকে সতর্ক থাকতে বলেছি। সম্ভব হলে একশ হাত দূরে থাকতে উপদেশ দিয়েছি। পৃথিবীতে যত রকম অনুভূতি আছে, তার মাঝে সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি হচ্ছে ভালোবাসা। আর পৃথিবীতে যা কিছুকে ভালোবাসা সম্ভব, তার মাঝে সবচেয়ে সেরা জিনিসটি হচ্ছে মাতৃভূমি। মাতৃভূমিটি যখন সবকিছুতে আদর্শ হয়ে উঠবে শুধু তখন থাকে ভালোবাসব আর যখন সেটা দুঃখ-কষ্ট যন্ত্রণায় জর্জরিত হবে তখন তাকে ভালোবাসব না, সেটা হতে পারে না। যে সব তেভাগারা নিজের দেশকে ভালোবাসার সেই মধুর অনুভূতি কখনো অনুভব করেনি, আমি আজকাল তাদের জন্য করুণাও অনুভব করি না।

আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে আমি যখন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পি.এইচ.ডি করতে গিয়েছিলাম, তখন আমি ছিলাম সেখানকার একমাত্র বাংলাদেশি (দ্বিতীয় বাঙালি হিসেবে যে ছাত্রীটি এসেছিল, ঝটপট তাকেই আমি বিয়ে করে ফেলেছিলাম!)।
এখন সেই অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আমেরিকার যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন অনেক বাঙালি আছে, খাঁটি বাঙালি।

মাতৃভূমি ছেড়ে প্রবাসী হওয়ার পর বাংলাদেশের সেই মানুষগুলোই হয়ে উঠে পরিবারের মানুষও, হয়ে উঠে আপনজন। সুখে-দুঃখে তারা পাশে থাকে, যখন দেশকে তীব্রভাবে মনে পড়ে তখন এই দেশের মানুষগুলোই তাদের সান্ত্বনা দেয়।

তখন কিন্তু একটা খুব বড় সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সুখে-দুঃখে সার্বক্ষণিকভাবে শুধু বাংলাদেশের মানুষকে নিয়েই সময় কাটাবে, নাকি পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন দেশ থেকে আসা ভিন্ন ভিন্ন কালচারের মানুষগুলোর সাথেও একটা আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তুলবে? যারা শুধু বাংলাদেশের বাঙালিদের সঙ্গেই গল্প-গুজব, আড্ডা, রাজনীতি কিংবা অনেক সময় দলাদলি করে সময় কাটায়, তারা কিন্তু অনেক বিশাল একটা ক্যানভাসে নিজের জীবনটাকে বিস্তৃত করার একটা চমৎকার সুযোগ হারায়। একটা দেশের গণ্ডি থেকে বের হয়ে একটা পৃথিবীর গণ্ডির মাঝে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ কিন্তু অনেক বড় সুযোগ। কেউ যখন প্রথমবার আবিষ্কার করে গায়ের রং, মুখের ভাষা, ধর্ম, কালচার সম্পূর্ণ ভিন্ন হলেও সবাই যে হুবহু একই রকম মানুষ, সেটি অসাধারণ একটি অনুভূতি।

কাজেই আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের বারবার করে বলেছি, তারা যেন নিজের দেশের মানুষের পাশাপাশি আমেরিকার মানুষদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে, সম্পর্ক গড়ে তোলে। ভিন্ন কালচারের বৈচিত্রের সৌর্ন্দয্যটা যেন উপভোগ করে। তারা যেন হাইকিং করে, জগিং করে, ক্যাম্পিং করে, হাজার হাজার মাইল ড্রাইভে করে ঘুরে বেড়ায়, গাড়ি নষ্ট হয়ে গেলে বনেট খুলে ঠিক করে ফেলতে শিখে, তারা যেন তুষারে ঢাকা পাহাড়ে উঠে, সমুদ্রের নিচে স্কুবা ড্রাইভিং করে, ছবি আঁকতে শিখে, গান গাইতে শিখে, মিউজিয়ামে যায়, অপেরা দেখে, কনসার্টে যায় এক কথায় যে বৈচিত্রময় কাজগুলো কখনো করার সুযোগ পায়নি, সেইগুলো করে জীবনটাকে উপভোগ করে। (কেউ কী বিশ্বাস করবে আমার মতো একজন মানুষ পর্বতারোহণের ট্রেনিং নিয়ে আইস এক্স আর ক্লাইমিং রোপ হাতে তুষারে ঢাকা পাহাড়ে উঠে বরফের ওপর ক্যাম্প করে স্লিপিং ব্যাগে ঘুমিয়েছি? পর্বতের চূড়ায় উঠে উল্লাসিত হয়েছি?)

কোনো কিছু থেকে কী সতর্ক থাকার প্রয়োজন আছে? আগে ছিল না, এখন আছে। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ছাত্র কাজী নাফিসের ঘটনাটি হচ্ছে তার উদাহরণ। এই দেশের যুদ্ধাপরাধীদের চেলাচামুণ্ডারা সেই দেশে আজকাল খুবই সক্রিয়। আমেরিকার সকল সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করে তারা শুধু নিজেরা থাকে না, তাদের আগে পিছনের কয়েক প্রজন্মকে সেই দেশে নিয়ে চলে যায়। কিন্তু দেশটিকে তারা মনে করে কাফেরদের দেশ। ভিন্ন ধর্মের জন্য অবজ্ঞা দেখিয়ে যখন কেউ কাফেরদের দেশে থাকার কলাকৌশল শেখাতে এগিয়ে আসবে, তাদের থেকে সাবধান। ভিন্ন ধর্ম আর ভিন্ন কালচার মানে খারাপ ধর্ম আর খারাপ কালচার নয়। ভিন্ন মানে বৈচিত্র আর বৈচিত্র হচ্ছে সৌন্দর্য্য। এটা যত তাড়াতাড়ি জানা যায়, ততই ভালো। যারা জানে না, তারা নতুন পৃথিবীর মানুষ নয়। তাদের থেকে সাবধান।

আর সেই দেশে দীর্ঘ দিন থেকে লেখাপড়া শেষ করে জীবনকে উপভোগ করে কখনো যদি দেশের জন্য বুক টনটন করে তখন কী করতে হবে?

তখন তারা আবার এই দেশটাতে ফিরে আসতে পারবে। মা যেমন করে তার সন্তানের জন্য অপেক্ষা করে দেশ মাতৃকাও ঠিক সেরকম করে তার সন্তানের জন্য গভীর ভালোবাসা নিয়ে অপেক্ষা করে থাকে।

আমি বাড়িয়ে বলছি না –আমি এটা জানি।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল
অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট। priyo.com

Thursday, September 12, 2013

সম্পাদকরা না বুঝেই বিবৃতি দিয়েছেন : তথ্যমন্ত্রী


মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতার ও আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশনা নিয়ে সরকারের কার্যক্রম খতিয়ে না দেখে, না বুঝে জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকরা বিবৃতি দিয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। ভবিষ্যতে না জেনে মাহমুদুর রহমানের পক্ষে 'ওকালতি' না করার ব্যাপারেও সম্পাদকদের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।
আমার দেশ পত্রিকা, দিগন্ত ও ইসলামিক টেলিভিশনের বিরুদ্ধে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ প্রসঙ্গে গত শনিবার দেশের ১৬টি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক একটি বিবৃতি দেন। ওই বিবৃতির পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল সোমবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তথ্যমন্ত্রী সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন।
ইনু বলেন, 'ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া, ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি, অশান্তি
তৈরিতে উস্কানি দেওয়া, সাইবার হ্যাকিং কি অপরাধ নয়? এ ধরনের অপরাধীরা কি আইনের ঊধর্ে্ব থাকবে?'
'আমার দেশ' প্রসঙ্গে তথ্যমন্ত্রী বলেন, 'সংবাদপত্রের স্বাধীনতা যেমন অসীম, দায়িত্বশীলতাও তেমনি অসীম। আমার দেশ পত্রিকা ধারাবাহিকভাবে সেই দায়িত্বশীলতাকে গুরুত্ব দেয়নি। পত্রিকা ও পত্রিকাটির সম্পাদক 'হ্যাকিং' বা চুরি করা এবং মিথ্যা-উস্কানিমূলক সংবাদ ও ছবি ছেপে দেশে নৈরাজ্য ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছে, উন্মাদনা সৃষ্টি করেছে পত্রিকাটি। এসব কাজ ফৌজদারি ও তথ্যপ্রযুক্তি আইনবিরোধী অপরাধ। মন্ত্রী বলেন, সুনির্দিষ্ট অপরাধে দায়ের করা মামলার ভিত্তিতেই আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সরকারের সমালোচনা এবং ভিন্ন মতাদর্শী হওয়ার কারণে আমার দেশের সম্পাদককে গ্রেফতার করা হয়নি।
মন্ত্রী দাবি করেন, এই সরকারের আমলে সংবাদমাধ্যম সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করছে। ভিন্নমত প্রকাশের জন্য কখনও কাউকে বাধা দিচ্ছে না সরকার।
তথ্যমন্ত্রী বলেন, দৈনিক 'আমার দেশ', দিগন্ত ও ইসলামিক টেলিভিশনের বিরুদ্ধে সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে, এর সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সম্পর্ক নেই। তাই মাহমুদুর রহমানের মতো কলঙ্কজনক ব্যক্তির পক্ষে সাফাই গাওয়া সংবাদপত্রের জন্য মঙ্গলজনক নয়। এতে গণমাধ্যমকর্মীদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়।
আমার দেশের ছাপাখানা বন্ধ প্রসঙ্গে ইনু বলেন, আমার দেশ পত্রিকার ছাপাখানা বন্ধ থাকলেও পত্রিকাটি ছাপাতে আইনগত কোনো বাধা নেই এবং বৈধ অনুমতি নিয়ে অন্য ছাপাখানায় তা ছাপাতে পারে।
মন্ত্রী বলেন, 'তথ্যপ্রযুক্তি আইন অনুসারে পত্রিকাটির ছাপাখানায় তল্লাশি চালানো হয় এবং সেখানে অপরাধ সংঘটিত করার যন্ত্রপাতি ও হ্যাকিংয়ের প্রমাণাদি জব্দ করা হয়েছে এবং ছাপাখানা তালাবদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিচারকাজের স্বার্থে যতক্ষণ পর্যন্ত তদন্ত শেষ না হবে, ততক্ষণ পত্রিকার ছাপাখানা বন্ধ থাকবে।'
মাহমুদুর রহমান তার মাকে নিয়েও জালিয়াতি করেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'অন্য ছাপাখানা থেকে সংবাদপত্র প্রকাশের যে নিয়ম রয়েছে দৈনিক আমার দেশ তা পালন করেনি। যে কারণে দৈনিক সংগ্রামের ছাপাখানা আল-ফালাহর বিরুদ্ধেও প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। মাহমুদুর রহমানের মাকে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান দেখিয়ে সত্য গোপন করে সংগ্রাম পত্রিকার ছাপাখানা থেকে তারা পত্রিকা প্রকাশ করেছে।'
তথ্যমন্ত্রী বলেন, দিগন্ত ও ইসলামিক টেলিভিশনের বিরুদ্ধে সরকার কোনো মামলা করেনি। তাদের কারণ দর্শানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তারা চিঠির জবাব দিয়েছে। জবাব সন্তোষজনক হলে চ্যানেল দুটি আবার সম্প্রচারে যেতে পারবে।
১৫ বিশিষ্ট নাগরিকের বিস্ময়
আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মুক্তি দাবি করে ১৬ সম্পাদকের বিবৃতিতে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন ১৫ বিশিষ্ট নাগরিক। গতকাল সম্মিলিত সাংস্কৃৃতিক জোটের নির্বাহী সদস্য হানিফ খান স্বাক্ষরিত এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, পত্রিকার সম্পাদকীয় কলামে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সাম্প্রায়িক সম্প্রীতি, প্রগতি ও মানবাধিকারের কথা বলা হলেও শুধু পেশাগত ঐক্যের কারণে এসব আদর্শে বিরোধিতাকারী, রাষ্ট্রীয় আইন ও শান্তি ভঙ্গের উস্কানিদাতা মাহমুদুর রহমানের পক্ষে দেশের কয়েকজন বরেণ্য সম্পাদকের বিবৃতি প্রদানে আমরা বিস্মিত, হতবাক ও মর্মাহত হয়েছি। বিবৃতিতে শুধু পেশাগত ঐক্য নয়_ মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র, প্রগতি ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বদের দৃঢ় অবস্থান প্রত্যাশা করা হয়। বিবৃতিদাতাদের মধ্যে রয়েছেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, অধ্যাপক অনুপম সেন, চিত্রশিল্পী হাশেম খান, কবি নির্মলেন্দু গুণ, নাট্যকার মামুনুর রশীদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ, নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডা. কামরুল ইসলাম খান, শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, গোলাম কুদ্দুছ ও মুহাম্মদ সামাদ।
সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের বিস্ময়
মাহমুদুর রহমানের মুক্তি দাবি করে ১৬ সম্পাদকের প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে বিস্ময় ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম। রোববার এক বিবৃতিতে ফোরাম নেতৃবৃন্দ মাহমুদুর রহমানকে 'সংবাদপত্রের গণশত্রু' আখ্যা দিয়ে বলেন, আমরা বিস্মিত, মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ।
সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) কেএম সফিউল্লাহ বীরউত্তম, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির ও পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডা. কামরুল ইসলাম খান রোববার এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক পবিত্র কাবা শরিফ এবং মৃত্যুদ প্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে চাঁদে দৃশ্যমান_ এরকম সংবাদ ও ছবি প্রকাশ করে জনগণকে বিভ্রান্ত করে দেশকে সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার হীনউদ্দেশ্যে এ পত্রিকাটি ক্রমাগত মিথ্যা ও বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ পরিবেশন করে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মন্দির-বাড়িঘরে হামলা ও অগি্নসংযোগে নিরীহ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের উত্তেজিত করে। আমরা মনে করি, পরিকল্পিতভাবে সামাজিক নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী এমন একজন সম্পাদককে গ্রেফতার ও পত্রিকা নিষিদ্ধ করা যে কোনো দায়িত্বশীল সরকারের অবশ্য করণীয়।
তারা বলেন, ১৬ সম্পাদকের মধ্যে প্রগতিশীল ও মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন সম্পাদকের সঙ্গে কতিপয় প্রগতিবিরোধী ও ধর্মীয় মৌলবাদী রাজনীতির পৃষ্ঠপোষক সংবাদপত্রের সম্পাদকের নাম দেখে আমরা মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ। আমরা আশা করব, দেশপ্রেমিক সম্পাদকরা এ ব্যাপারে তাদের সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত নেবেন।

সম্পাদকগণ যে বিবৃতি দিয়েছেন; গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী একজন সাংবাদিক হিসেবে তা সমর্থন করি- মনজুরুল আহসান বুলবুল



গত ১৮ই মে দেয়া ১৫ জন সম্পাদকের বিবৃতি ‘সম্ভবত কিঞ্চিৎ চাঞ্চল্য’ সৃষ্টি করেছে বলে বিবৃতিদাতা সম্পাদকরাও মনে করছেন। সে কারণেই কৈফিয়ত না দিলেও বিবৃতি দেয়ার কারণটি আবার ব্যাখ্যা করে বলতে হচ্ছে।

বলে রাখি; সম্মানিত সম্পাদকগণ যে বিবৃতি দিয়েছেন; গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী একজন সাংবাদিক হিসেবে তা সমর্থন করি। যারা মনে করেন মাহমুদুর রহমান সম্পাদক নন তাদের সঙ্গেও দ্বিমত পোষণ করি। দেশের প্রচলিত আইন যেমন সম্পাদক হওয়ার কোন যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেয়নি, আবার কাউকে বারিতও করেনি। মাহমুদুর রহমানকে কেউ ‘‘হঠাৎ সম্পাদক” বলে সন্তুষ্ট হতে পারেন কিন্তু তিনি একজন সম্পাদক বটে। সরকার, সচেতন সম্পাদকমণ্ডলী বা সাংবাদিকদের ইউনিয়ন কেউ এখনও এমন একটি বিধি-আইন-নীতিতে একমত হতে পারেননি যে একটি গণমাধ্যমের সম্পাদক হওয়ার মাপকাঠি কি। প্রভাব থাকলে সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন বা ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের লাইসেন্স পাওয়া যায়, মালিক তো হওয়া যায়ই, প্রিন্টার্স লাইনে নাম লিখে সম্পাদকও হওয়া যায়। বলতে খচ্ খচ্ করলেও সত্যি হচ্ছে, ডিক্লারেশনপ্রাপ্ত একটি সংবাদপত্রের প্রিন্টার্স লাইনে সম্পাদক হিসেবে যাদের নাম প্রকাশিত হচ্ছে তারা সকলেই সম্পাদক। তবে মাহমুদুর রহমানকে নিয়ে বিবৃতি দিয়ে ১৫ জন সম্পাদক নতুন কোন বন্ধুর সন্ধান পেয়েছেন কিনা তা তারাই বলতে পারবেন কিন্তু এই পঞ্চদশের অনেকেই যে তাদের অনেক পুরনো বন্ধুদের বিশ্বাসের ভিতকে নাড়িয়ে দিয়েছেন সে তো নানাভাবেই দৃশ্যমান।

কেন এ বিভ্রান্তি? সাধারণের প্রশ্ন ও পর্যবেক্ষণগুলো এরকম:
১. কেন ১৫ জন সম্পাদক, কেন আরও বেশি নয়? যে ১৫ জন সম্পাদক বিবৃতি দিয়েছেন তাদের মতোই আরও যে সম্পাদকদের আমরা সম্মান করি তারা কেন এই বিবৃতিতে সই করলেন না? মানেটি হচ্ছে: কিছু সম্পাদক আছেন যারা এই ১৫ জনের মতকে ধারণ করেন না; কাজেই তারা এই পঞ্চদশের সঙ্গে নেই।

২. বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে মালিক-সম্পাদকদের পুরনো সংগঠন বাংলাদেশ সংবাদপত্র পরিষদ- বিএসপি। কিন্তু কিছুদিন আগে একটি সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছে; নিউজ পেপার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ- নোয়াব। এই সংগঠন আমন্ত্রণমূলক, সম্মানিত কয়েকজন মালিক সম্পাদক এই সংগঠনটি গড়ে তুলেছেন; তারা যাদের আমন্ত্রণ জানাবেন তারাই কেবল এই সংগঠনের সদস্য হতে পারবেন। সাধারণভাবে সকল মালিক বা সম্পাদক তাদের সদস্য হতে পারেন না। কিন্তু মজার বিষয়টি হচ্ছে; এই বিবৃতিতে নোয়াব এবং অ-নোয়াব একাকার হয়েছে। অর্থাৎ নোয়াব যে সম্পাদকদের তাদের সদস্য হওয়ার যোগ্য মনে করেন না; এই বিবৃতিতে তারাই হয়েছেন নোয়াবের সদস্যদের সহযোদ্ধা। অন্যদিকে নোয়াব-এর তিনজন সদস্য এই বিবৃতিতে সই করেন নি। মানুষ বিভ্রান্ত হবে না কেন?
৩. বিবৃতিদাতাদের অন্তত একজন সম্পাদক বিবৃতিদাতা অপর দু’জন সম্পাদক সম্পর্কে সাংবাদিকতার নীতিমালা লঙ্ঘন করার দায়ে প্রেস কাউন্সিলে মামলা করেছেন, রায়ও তার পক্ষেই গেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সাংবাদিকতার নীতিমালা লঙ্ঘনকারী দুই সম্পাদক এই বিবৃতিতে এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপনকারী সম্পাদকের সঙ্গে। মামলার ফরিয়াদি ও প্রতিপক্ষ একই কাতারে। বিস্ময় এখানেও।

৪. বিবৃতিদাতা সম্পাদকদের দু’জন এমন একটি পত্রিকার সাবেক ও বর্তমান সম্পাদক যে পত্রিকা থেকে ভারতীয় অর্থপুষ্ট সাংবাদিকদের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল কিছুদিন আগে। সেই তালিকায় বিবৃতিদাতা একজন প্রভাবশালী সম্পাদক ভারতীয়দের কাছ থেকে কত টাকা নেন তা-ও উল্লেখ ছিল। নৈতিকতাহীন ও চরম দায়িত্বহীন সেই সংবাদপত্রের সঙ্গে অপূর্ব সম্মিলনী দেখা গেল দায়িত্বশীল ও উৎকৃষ্ট সাংবাদিকতার সেই সম্পাদককেও। হোঁচট এখানেও।

নানা বৈচিত্র্যের মধ্যেও বিবৃতিদাতাদের এই একতা একদিকে যেমন বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে, তেমনি নানা প্রশ্নেরও সৃষ্টি করেছে। বিবৃতিদাতা একজন সম্মানিত সম্পাদক লিখছেন; মাহমুদুর রহমানকে অনেকগুলো অভিযোগে মাসখানেক ধরে জেলে আটকে রাখা হয়েছে যে অভিযোগগুলো আদালতে প্রমাণিত হয়নি। গূঢ়ার্থ হচ্ছে: আদালতে অভিযোগ প্রমাণিত না হলে অভিযোগ থাকলেও কাউকে আটকে রাখা যাবে না। যদি এই যুক্তিতেই এখন বিজিএমইএ রানা প্লাজার আটক গার্মেন্ট মালিক বা প্রকৌশলীদের কোন সমিতি সেই ভবনের নকশা অনুমোদনকারী বর্তমানে আটক প্রকৌশলীদের মুক্তি দাবি করেন? কারণ এখনও তো তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আদালতে প্রমাণিত হয়নি। বিবৃতিদাতাদের এই যুক্তি মেনে নিলে তো গোলাম আযম, নিজামী সবাইকে ছেড়ে দিতে হয়। আদালতে ‘গিলটি’ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তো তারা ‘ইনোসেন্ট’ !

এ বিবৃতি নিয়ে মাননীয় তথ্যমন্ত্রী সম্মানিত সম্পাদকদের প্রজ্ঞার প্রতি যে প্রশ্ন তুলেছেন তারও প্রতিবাদ জানাই। বিবৃতিদাতা সম্পাদকগণ গত কয়েক দশক ধরে দেশ, উপমহাদেশ এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির নিবিড় পর্যবেক্ষক। কাজেই না জেনে-বুঝে তারা এই বিবৃতিতে সই করেছেন এমন সহজ সমীকরণ একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। কেন এই বিবৃতি দিয়েছেন তার পক্ষেও যেমন এই সম্পাদকদের দৃঢ় যুক্তি রয়েছে, যদি তারা বিবৃতি না দিতেন তাহলেও তারা সফলভাবেই সেখানেও যৌক্তিক অবস্থান তুলে ধরতে পারতেন। যে সম্পাদকরা বিবৃতিতে সই করেননি তারাও নিশ্চয়ই যৌক্তিক কারণেই তাদের অবস্থান নিশ্চিত করেছেন। মাননীয় তথ্যমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন, সরকারের প্রোপাগান্ডা মন্ত্রী হিসেবে সকল বিষয়ে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করে যথাসময়ে প্রেস নোট কেন দেয়া হচ্ছে না? স্বয়ং মন্ত্রীর প্রেস ব্রিফিং তো শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক বিবৃতিতে পরিণত হয়। সরকারি প্রেস নোট বিষয় ভিত্তিক সরকারি ব্যাখ্যা তুলে ধরে; হতে পারে সরকারি প্রেস নোট ছলনাময়ীর প্রেমের মতোই মিথ্যা কিন্তু সরকারের অবস্থান স্পষ্টকরণের জন্য এই অন রেকর্ড সরকারি ভাষ্য দেয়ার প্রথাটি পৃথিবী জুড়েই স্বীকৃত। পদ্ধতিটি ভিন্ন হতে পারে।

তবে এত বৈপরীত্য, নানা বৈচিত্র্যের একতা নিয়ে নানা প্রশ্ন ও বিভ্রান্তির মধ্যেও এই সম্মানিত সম্পাদকদের বিবৃতিতে আমরা আশান্বিত হতেই পারি। কারণ সব কিছু ভুলে অভিভাবকের মতো তারা বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার যে অধিকার তা রক্ষায় এগিয়ে এসেছেন। এই রকম অভিভাবক দেশের গণমাধ্যম জগতের দীর্ঘদিনের চাহিদা। একসময়ের প্রভাবশালী সাংবাদিক ইউনিয়ন এখন সেই ভূমিকা কতটা রাখতে পারছে সে প্রশ্ন উঠেছে অনেক দিন আগেই। অনেকে সাংবাদিক ইউনিয়নের ঐক্য নিয়ে আশাবাদী হন। কিন্তু এই ঐক্য তো শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার ঐক্যের মতোই কঠিন। বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা যদি হন এক ইউনিয়নের নেতা আর শেখ হাসিনার টিকিট নিয়ে তার দলের এমপি প্রার্থী যদি আরেক ইউনিয়নের নেতা হন তা’হলে এই দুই ইউনিয়নের মধ্যে নেহায়েৎ অর্থনৈতিক দাবি ছাড়া আর কোথাও ঐক্যের জায়গা তো দেখি না। তার ওপর আবার এক শীর্ষ নেতা এখন লিখিতভাবে নসিহত করছেন যে, নারী সাংবাদিক ও সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের রিপোর্টারদের যেন স্পর্শকাতর বিষয়ে এসাইনমেন্ট দেয়া না হয়। তারপরেও রুটি-রুজির সংগ্রামে সাংবাদিক ইউনিয়নই তো আমাদের ভরসা। এর পাশাপাশি সম্মানিত সম্পাদকগণ যদি পেশার মর্যাদা ও স্বাধীনতা রক্ষায় এক হয়ে এগিয়ে আসেন তা তো আশারই কথা। কিন্তু হতাশা সব সম্পাদকও এখানেও এক হতে পারলেন না।

সে কারণেই আশাজাগানিয়া এই উদ্যোগ নিয়ে একটু হতাশা আছেই। সম্মানিত সম্পাদকদের বিবৃতি প্রসঙ্গে একজন সম্পাদকের ব্যাখ্যায় [দৈনিক সমকাল, ২৪শে মে ২০১৩] যে প্রেক্ষাপট ও বাস্তবচিত্র তুলে ধরা হয়েছে, ১৫ জনের বিবৃতিতে একটি প্যারাগ্রাফেও যদি সেই বর্ণনাটি তুলে ধরা হতো তা’হলেও বিবৃতিদাতারা এতটা প্রশ্নবিদ্ধ হতেন না একথা বলা যায়। জানি না দৈনিক সমকাল সম্পাদকের অবস্থানটি সকলেই সমর্থন করেন কিনা। বিবৃতি দেয়ার প্রেক্ষাপটটির ন্যূনতম বর্ণনা না থাকায় বিবৃতিটি দাতাগোষ্ঠী এবং দূর থেকে উদ্বিগ্ন মানবাধিকার রক্ষাকারী গোষ্ঠীর বিবৃতির মতোই মনে হয়েছে।
প্রাসঙ্গিক কারণেই একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরছি। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় দাঙ্গা প্রত্যক্ষ করেছিলেন সে সময়কার তরুণ শিক্ষার্থী পরে জগৎখ্যাত ইতিহাসবিদ, অক্সফোর্ডের শিক্ষক, বাংলাদেশেরই ‘বরিশালের পোলা’ তপন রায়চৌধুরী। তাঁর ‘বাঙালনামা’য় তিনি লিখেছেন: “... (সেই দাঙ্গার সময়কার বর্ণনা) একজন কোথা থেকে একটা চোথা খবরের কাগজ নিয়ে এল যার নাম আগে বিশেষ শুনিনি। লোমহর্ষক সব কাহিনীতে ভরা ওই কাগজটির বিক্রি নাকি তিন দিনে বেশ কয়েক হাজারে দাঁড়িয়েছিল। এবং তার অসাধারণ কল্পনাশক্তির অধিকারী সম্পাদকটি শুনেছি সমস্ত কাগজখানা নিজের বৈঠকখানা ঘরে বসে লিখতেন। বাইরে বের হওয়া তখন নিরাপদ ছিল না। আর দাঙ্গার আগে ওই কাগজটির যা বিক্রি তাতে সম্পাদক ছাড়া অন্য কোন কর্মচারী রাখার মতো সামর্থ্য বা প্রয়োজন হয়েছে এমন মনে হয় না। এখন ওই বিরল প্রতিভাটি সম্পূর্ণ নিজের মস্তিষ্ক থেকে কলকাতার কুরুক্ষেত্রের ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। ওই বজ্জাতের মনোভূমি কলকাতার রাস্তার চেয়ে দাঙ্গার জন্মস্থান হিসেবে সত্যের আঁকর হয়ে উঠলো। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, রাতারাতি ওই চোথা পত্রিকাটি স্মৃতিশ্রুতির স্থান অধিকার করলো। শহরের সর্বত্র কি ঘটছে না ঘটছে তা ওই অশ্লীল নির্জলা মিথ্যা কথায় ভরা প্রকাশনাটি থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে সবাই আলোচনা করতে লাগলো। যদি প্রশ্ন করা হতো এসব যে সত্যি তা তোমরা কি করে জানলে, তাহলে লোকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে প্রশ্নকর্তার দিকে তাকিয়ে বাক্যালাপ বন্ধ করে দিতো। ... ওই বিষাক্ত পত্রিকাটির কপি এখন আর পাওয়া যায় না। নগণ্য একটি প্রকাশন মিথ্যা প্রচারের মারফত কত অনিষ্ট করতে পারে, বাঙালির দুর্ভাগ্যের বিবরণীতে সে ইতিহাস অলিখিত রয়ে গেল।” -বাঙালনামা, তপন রায়চৌধুরী, আনন্দ, দ্বিতীয় মুদ্রণ, আগস্ট ২০০৭, পৃষ্ঠা ১৫২)

কোন মন্তব্য নেই, শুধু একটিই জিজ্ঞাসা। বিবৃতিদাতা সম্মানিত সম্পাদকবৃন্দ তপন রায়চৌধুরী বর্ণিত দৃশ্যপটের সঙ্গে সামপ্রতিক বাংলাদেশের কোন মিল খুঁজে পান কিনা? কোন চরিত্রের কোন খোঁজ পান কিনা? জাতির বিবেকের কণ্ঠস্বর বলে এই পরিস্থিতি ও চরিত্রগুলো সম্পর্কে বরেণ্য সম্পাদকদের মতামত এবং অবস্থান কি সে প্রশ্ন তো কেউ করতেই পারেন।

এই বাস্তবচিত্র মাথায় রেখেই তবুও আশাবাদী হতে চাই এ কারণে যে, সাংবাদিকতা পেশার অভিভাবকরা যখন একসঙ্গে মাঠে নেমেছেন তখন বোধ করি এই শিল্প ও পেশার জন্য কিছু একটা হবে। প্রত্যাশা; মালিক ও পেশাদার সম্পাদকের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ঘুচিয়ে সম্পাদকগণ দেশের গণমাধ্যমের সঙ্কটের এই সময় দিকনির্দেশনামূলক ভূমিকা রাখবেন। তাদের কাছে এই প্রত্যাশা এ কারণেই যে, একজন সম্পাদককে সাংবাদিকরা জানেন পেশায় তাদের অভিভাবক হিসেবেই। নষ্ট সন্তান বিপদগ্রস্ত হলে তার মুক্তি চাওয়াই যথেষ্ট নয়, সন্তান যাতে ভ্রষ্ট না হয় তা দেখার দায়িত্বও অভিভাবকদের। সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন বা টেলিভিশনের লাইসেন্স নেয়ার আবেদনে এক এক জন মালিক সরকারের কাছে ‘আপনার বিশ্বস্ত’ বলে সব শর্ত মেনে নেয়ার মুচলেকা দেবেন আর লাইসেন্সটি পাওয়ার পর পরই মাথায় স্বাধীনতার শিং গজাবে? যে পণ্য বিক্রির জন্য লাইসেন্স নেয়া হলো দোকান খুলে- সেখানে লাইসেন্সের শর্ত ভেঙে ভিন্ন পণ্য বিক্রি করলে এবং তার পরিণতিতে দোকান বন্ধ হয়ে গেলে তার দায় কে নেবে? একটু পেছনে দেখুন... বাংলাদেশে যে সব গণমাধ্যম বিপদগ্রস্ত হয়েছে তা হয়েছে শুধু মালিকদের অপরিণামদর্শিতার কারণেই। কোন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কোন সাংবাদিকের পেশাগত কোন কারণে বাংলাদেশে কোন গণমাধ্যম বন্ধ হয়নি। সব জেনে শুনে, আইন ভাঙবেন মালিকরা আর বিপদগ্রস্ত হবেন পেশাজীবী সাংবাদিক কর্মচারীরা- এ যেন আমাদের গণমাধ্যমকর্মীদের ভাগ্যলিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকৃতই সাহসী সাংবাদিকতা করতে গিয়ে কোন গণমাধ্যম, সম্পাদক বা সাংবাদিক আক্রান্ত হলে সম্পাদক বা সাংবাদিকরা একযোগে প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়বেন এ ব্যাপারে কোন সন্দেহই নেই। কিন্তু খুব অল্প ক্ষেত্রেই এমন বাস্তবতা পাওয়া গেছে।

দীর্ঘ পথপরিক্রমায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, দায়িত্বশীলতা আর নৈতিকতার মাপকাঠি পৃথিবী জুড়েই আজ একটি দৃশ্যমান জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। এখন আলোচিত হচ্ছে কারা সাংবাদিক, কারা নন- সে প্রশ্ন নিয়ে। বিতর্ক হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আর সনাতনী গণমাধ্যমের সম্পর্কটি কোথায় এসে মিলবে (স্মরণ করিয়ে দিতে চাই: বাংলাদেশেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দৃশ্যত ব্যাপক বিসতৃত, বিবৃতিদাতা বা মধ্যরাতের টকশো কাঁপানো অনেক সম্পাদকের সংবাদপত্রের প্রচার সংখ্যার চেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অনেক যোগাযোগ কর্মীর অনুসারীদের সংখ্যা অনেক অনেকগুণ বেশি ও কার্যকর)।
সাংবাদিকতায় প্রযুক্তির অতিব্যবহার এই পেশার মানবিকতাকে কতটা প্রশ্নবিদ্ধ করছে, সংবাদের তাৎক্ষণিকতার প্রতিযোগিতা সাংবাদিকতা কত সত্যকে হত্যা করছে, সমাজে সাংবাদিকতার অতি প্রভাবের ক্ষমতা কোন কোন গণমাধ্যমকে কিভাবে দানবে পরিণত করছে, সমপাদকদের অতিমাত্রায় বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের চাপ রিপোর্টারকে বেশি বিপজ্জনক জায়গায় ঠেলে দিচ্ছে কিনা এ সব প্রসঙ্গ নিয়ে আলোড়িত এখনকার গণমাধ্যমের শিক্ষা ও গবেষণার জগৎ। গণমাধ্যমের এই সঙ্কট মোকাবিলা করতে হবে গণমাধ্যমকেই এবং তাতে নেতৃত্ব দেবেন অভিভাবক সম্পাদকরাই।

বাংলাদেশের গণমাধ্যমের দিকে তাকালে অনেক অভিভাবককে নিয়েই প্রশ্ন তোলা যায়। এ কারণে কিছুকাল আগে একজন স্বনামখ্যাত সম্পাদক তার বক্তব্যে দাবি জানিয়েছিলেন সম্পাদকদেরই প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা। কিন্তু অভিভাবকদের প্রশিক্ষণ দেবে কে? তবুও শেষ পর্যন্ত অভিভাবকদের প্রতিই আস্থা রাখতে হবে। একটি প্রশ্নবিদ্ধ বিবৃতি আমাদের সম্পাদকদের বিভক্তির চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি যে অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে সেখান থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র পথ- দেশের গণমাধ্যমের চেহারায় গুণগত পরিবর্তন আনতে সকল সম্পাদকের একসঙ্গে এগিয়ে আসা। সাংবাদিক ইউনিয়নের বিভক্তি এবং ইউনিয়নের কতিপয় শীর্ষ নেতার অতিমাত্রার রাজনৈতিক চেহারা যত হতাশাই ছড়াক ইউনিয়ন নেতৃত্ব দেবে রুটি-রুজি আর অধিকার প্রতিষ্ঠায় আর পেশাদার সম্পাদকরা দেবেন পেশাগত উৎকর্ষ সাধনের নেতৃত্ব। এই যৌথ উদ্যোগ দিয়েই অনেক সঙ্কট অতিক্রম করা যাবে।

সর্বশেষ খবর: সম্মানিত সম্পাদকগণ একটি সংগঠন গড়ে তুলেছেন। খুবই আশার কথা, এই সংগঠন নিশ্চয়ই সংবাদ মাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা, পেশাগত মানোন্নয়ন এবং সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে দৃশ্যমান ভূমিকা রাখবে। কোন সম্পাদকের অপেশাদারিত্বের কারণে কারও জীবন ও সম্মান বিপন্ন হলে সেদিকটাও এখন দেখতে হবে এই পরিষদকে (অপেশাদারী সম্পাদকের কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যে তরুণরা বিপন্ন জীবন যাপন করছেন তারা নিশ্চয়ই কথা বলার একটি জায়গা পেলেন)।
এই সংগঠন যাতে কোন অপেশাদার ও সাংবাদিকতার ন্যূনতম নীতি অনুসরণ করেন না এমন কোন সম্পাদকের আশ্রয়স্থল না হয়। তবে শেষতক মালিক-প্রকাশক-সম্পাদক আর পেশাদার সম্পাদকের দ্বন্দ্বটা রয়েই গেল। নবগঠিত সম্পাদক পরিষদের অনেক নেতাই ওয়েজবোর্ডে মালিক হিসেবেই প্রতিনিধিত্ব করছেন।

আবারও বলি: বিবৃতি দিয়ে ১৫ সম্পাদক কতটা অর্জন করেছেন তার মূল্যায়ন হয়তো একদিন হবে কিন্তু তাদের দীর্ঘদিনের পেশাগত জীবনের ধারাবাহিকতার প্রত্যক্ষদর্শী অনেকেই যে হোঁচট খেয়েছেন সে কথা বলাই বাহুল্য। বিবৃতিদাতা অনেক সম্পাদকই যেহেতু অভিভাবকতুল্য- সে জন্যই প্রত্যাশা করি তারা যেন হঠাৎ করে আমাদের কাছে অচেনা না হয়ে যান। অভিভাবকরা প্রশ্নবিদ্ধ হলে পরিবারের নিষ্ঠাবান সদস্যরাও বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন, সে জন্যই এই রচনা। আশা করি, এই রচনায় তারা বিরূপ হবেন না। এই ধৃষ্টতার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী।

মনজুরুল আহসান বুলবুল, সাংবাদিক