Wednesday, May 15, 2013

একটি জনমত সমীক্ষা গাঁজার নৌকা পাহাড় ডিঙায় : আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী


বুধবার, ১৫ মে ২০১৩, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪২০

ঢাকার দৈনিক ‘প্রথম আলো’ গত শনিবার (১১ মে) দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে একটি জনমত জরিপের ফল প্রকাশ করেছে। যদিও জরিপটি ছিল ‘প্রথম আলোর’ অনলাইনের তিন নম্বর ‘সর্বাধিক পঠিত’ খবর; কিন্তু আমার নজর সেটি এড়িয়ে গিয়েছিল। তারপর ত্রিমহাদেশীয় টেলিফোনের ধাক্কা। অর্থাৎ এশিয়া, ইউরোপ, এমনকি অস্ট্রেলিয়া থেকেও আমার বাঙালী বন্ধুদের টেলিফোনের পর টেলিফোন, একই জিজ্ঞাসা- ‘প্রথম আলোর’ জনমত জরিপ দেখেছেন? সত্যই কি দেশের মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের এই অভিমত? তাহলে আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি?
বন্ধুদের বলেছি, তিষ্ঠ ক্ষণকাল! খবরটা আগে পড়ি। দেশের জনমত যদি বিভ্রান্ত হয় তাহলে তো আমাদের ঠেকাবার উপায় নেই। তবে এই জনমত জরিপটা ‘প্রথম আলোর’।
সুতরাং হিসাব করে দেখতে হবে এই জরিপ কতটা সঠিক? বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ শেষ করে ‘প্রথম আলোর’ জনমত জরিপের খবরটি খুঁজতে হলো। আমার অনুজ প্রতিম সাংবাদিক (সাহিত্যিকও) সাজ্জাদ শরিফের মন্তব্যযুক্ত জরিপে বলা হয়েছে, জরিপটি করানো হয়েছে ওআরজি-কোয়েস্ট নামে একটি পেশাদার জরিপ পরিচালনাকারী সংস্থা দ্বারা। জরিপ চলেছে তিন হাজার মানুষের (দেশের লোকসংখ্যা ১৫ কোটির মতো) মধ্যে।
এই জরিপের ফলাফল হলো- (ক) তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায় দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ। (খ) যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় দিয়ে সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেনি মনে করে ৮১ ভাগ মানুষ। (গ) যাদের মধ্যে জরিপ চালানো হয়েছে তাদের অর্ধেকের বেশি মানুষ (এখানে শতাংশের উল্লেখ নেই) জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে। (ঘ) পঁচিশ ভাগ মানুষ মনে করে দেশের অবস্থা খারাপ এবং ৩৫ ভাগ মনে করে দেশ খারাপ অবস্থা পার করছে। (ঙ) দেশের এক-চতুর্থাংশ মাত্র (চার ভাগের এক ভাগ) শাহবাগের জাগরণ মঞ্চকে সমর্থন করে। অর্থাৎ তিন ভাগই সমর্থন করে না।
সাজ্জাদ শরিফের মুখবন্ধসহ জরিপটির রিপোর্ট পাঠ করার পর স্বতঃস্ফূর্তভাবে সেই প্রবাদটি আমার মনে পড়েছে, ‘গাঁজার নৌকা পাহাড় ডিঙায়।’ দেশের সকল মানুষকে নিরেট বোকা না ঠাওরালে কোন মিডিয়া এই ধরনের জরিপ প্রকাশ করতে পারে না। জরিপটির রিপোর্ট পাঠ করলেই বোঝা যায়, এটি বানোয়াট নয়, তবে ম্যানিপুলেটেড। আর ম্যানিপুলেটেড সাংবাদিকতায় প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান অদ্বিতীয়। কোন ব্যাপারে তিনি ধরা পড়লেই তওবা করেন অথবা মাফ চান। এক সময় তাঁর কাগজের সাপ্লিমেন্টে মৌলবাদীদের ক্রোধ জন্মায় এমন কার্টুন ছেপে দৌড়ে বায়তুল মোকাররমে গিয়ে খতিবের কাছে তওবা করেছিলেন। আবার সম্প্রতি শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চ সম্পর্কে একটি অশোভন গল্প ছেপে জনরোষের মুখে প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছেন এবং শাহবাগ-সম্পর্কিত দু’টি গল্পই প্রত্যাহার করে নেন।
যদি দেখা যায়, গত শনিবারে প্রকাশিত জনমত ‘জরিপের রিপোর্টটিও ম্যানিপুলেটেড এবং তাতে তার পত্রিকায় পাঠকরা মারমুখো হয়। তাহলে তিনি যে করজোড়ে আবার পাঠকদের কাছে মাফ চাইবেন এবং অনলাইন ও পত্রিকা পাতা থেকে জরিপটি মুছে ফেলবেন তাতে সন্দেহ পোষণ না করাই ভাল। শনিবারের জরিপাটি প্রথম আলোর নিজস্ব জরিপও নয়। তারা একটি জরিপ পরিচালনাকারী সংস্থা ভাড়া করে জরিপটি চালিয়েছেন। ইউরোপ ও আমেরিকায় এখন ‘ওপিনিয়ন পোল’ গ্রহণকারী বা জনমত জরিপের বহু পেশাদার সংস্থা আছে। কোন কোন রাজনৈতিক দল ও সংবাদপত্র তাদের ভাড়া করে থাকে।
এরা পেশাদার সংস্থা হলেও তাদের মধ্যে অনেক সংস্থা আছে, যারা তাদের ক্লায়েন্টদের ইচ্ছামতো জনমত জরিপের ফল তৈরি করে দেয়। ঢাকার ওআরজি-কোয়েস্ট এই ধরনের প্রতিষ্ঠান তা আমি বলছি না। কিন্তু ইউরোপে এই ধরনের বহু পেশাদার জনমত জরিপের সংস্থা আছে, যারা টাকা পেলে ক্লায়েন্টের পছন্দমতো জরিপের ফল তৈরি করে দিতে দ্বিধা করে না। ব্রিটেনের ‘সাচি এ্যান্ড সাচি’ এই ধরনের সংস্থা নয়। বরং একটি পেশাদারি বিখ্যাত বিজ্ঞাপন সংস্থা, যারা সুনামের সঙ্গে জনমত জরিপেরও কাজ করেন।
টনি ব্লেয়ার ব্রিটিশ লেবার পর্টির নেতা-নির্বাচিত হওয়ার পর যখন জন মেজরের নেতৃত্বাধীন টোরি সরকার সাধারণ নির্বাচনে লেবার পার্টির মুখোমুখি হয়, তখন টোরি বা কনজারভেটিড দল ‘সাচি এ্যান্ড সাচি’কে তাদের নির্বাচনী প্রচারের কাজে সাহায্যের জন ভাড়া করে। তারা জনমত জরিপের কাজও চালায়। এই পেশাদারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাচি এ্যান্ড সাচি এমন অপেশাদারি ও অসাধু কাজ বলে বসে যে, সে জন্য টোরি পার্টি ও সাচি এ্যান্ড সাচি উভয়কেই ক্ষমা চাইতে হয়।
সাচি এ্যান্ড সাচির ওপিনিয়ন পোল ছিল- টোরি পার্টি বিপুল ভোটে নির্বাচনে জিতবে। তাতে আপত্তির কিছু ছিল না। জরিপের ফল অনেক সময় সঠিক হয় না। কিন্তু সাচি এ্যান্ড সাচি শুধু জনমত জরিপের বিভ্রান্তিকর ফল প্রকাশ করেই ক্ষান্ত হয়নি; লেবারের নবনির্বাচিত নেতা টনি ব্লেয়ারের একটি ছবি পোস্টারে ছেপে তার চোখ দু’টিতে আগুনের ভাটা বসিয়ে নিচে ক্যাপশন দেয়া হয়- ডেঞ্জার সিগন্যাল। এই পোস্টার দেখে ব্রিটিশ জনমত এত ক্রুব্ধ হয় যে, টোরি পার্টিকে ক্ষমা চেয়ে এই পোস্টার প্রত্যাহার করতে হয়েছিল। বলাবাহুল্য এই জনমত জরিপ অসত্য প্রমাণ করে সেবার নির্বাচনে লেবার পার্টি বিশাল জয়ের অধিকারী হয়। পরবর্তী দু’টি সাধারণ নির্বাচনেও তার জয় অব্যাহত ছিল।
আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেয়ার নিয়ম প্রবর্তনের উদ্দেশ্য মানুষকে আসন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়া। প্রথম মহাযুদ্ধের আগে ইউরোপে প্রত্যক্ষ জনমত জরিপের ব্যবস্থাটি ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচনের আগের তাদের সম্পর্কে ভোটদাতাদের মনোভাব আগাম জানতে চাইতেন এবং নির্বাচকম-লীর ইচ্ছা-অনিচ্ছায় কথা জেনে নিজেদের নীতিতে রদবদল ঘটাতেন। এই জনমত জরিপের পদ্ধতির স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা সম্পর্কে কোন মহলে কোন সন্দেহ ছিল না তখন।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কিছু আগে এই ওপিনিয়ন পোল বা জনমত সমীক্ষার ব্যবস্থাটি নিয়ে ম্যানিপুলেশন শুরু হয়। বিশেষ করে ফ্যাসিবাদ ও ন্যাৎসিবাদের অভ্যুত্থানের মুখে ফ্যাসিস্ট নায়কেরা তাদের গণবিরোধী নীতি যে জনগণের অনুমোদনপ্রাপ্ত তা প্রমাণের জন্য কিছু অর্থলোভী এবং পেশাদার নামধারী জনমত জরিপকারী সংস্থাকে ব্যবহার করতে শুরু করেন। এই সময় ইউরোপে জনমত জরিপাকারী বহু অসাধু সংস্থা গড়ে ওঠে এবং এই জরিপের ক্রেডিবিলিটি ধ্বংস করতে শুরু করে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে মুসোলিনী যখন সোস্যালিস্ট ছিলেন, তখন ছিলেন যুদ্ধবিরোধী। সোস্যালিস্ট পার্টি ছাড়ায় পর তিনি যুদ্ধপন্থী হয়ে ওঠেন এবং তার পত্রিকায় জনমত জরিপের ম্যানিপুলেটেড রেজাল্ট প্রকাশ করে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, ইউরোপের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আরেকটি যুদ্ধ চায়।
বর্তমানে ইউরোপেও জনমত জরিপের গুরুত্ব ও ক্রেডিবিলিটি বহুলাংশে ক্ষুণœ। কারণ, অনেক সময়েই দেখে গেছে, এসব জরিপে সঠিক জনমত প্রতিফলিত হয় না; বরং একশ্রেণীর জরিপকারীর কারসাজির পরিচয় পাওয়া যায়। বড় বড় মিডিয়া, যারা নিজেদের স্বার্থে দেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, তারা নিজেরা অথবা ভাড়া করা জরিপ সংস্থার সাহায্যে এমন জরিপের ফল তৈরি করে ছাপায়, যাতে সঠিক জনমত প্রতিফলিত হয় না, বরং ওই বিগ মিডিয়া বা কোন বিশেষ মহলের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে। তাঁরা চান এই ধরনের ফল প্রকাশ দ্বারা জনমতকে বিভ্রান্ত করে নিজেদের উদ্দেশ্যপূরণে কাজে লাগাতে।
লন্ডনের টাইমস পত্রিকা গ্রুপ একটি অসাধারণ শক্তিশালী আন্তর্জাতিক মিডিয়া গ্রুপ। (অবশ্য সম্প্রতি এক টেলিফোন হ্যাকিংয়ের কেলেঙ্কারিতে তাদের সুনাম ও শক্তি অনেকটাই খর্ব হয়েছে।) তাদের সম্পর্কে বলা হয়, তারা ইচ্ছে করলে কোন দেশে কোন সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে পারে। আবার ইচ্ছা করলে তার পতন ঘটাতে পারে। কিন্তু হালে সকল দেশেই এক শ্রেণীর বিগ মিডিয়ার জনমত জরিপের কারসাজি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের চোখ খুলে যাচ্ছে।
মাত্র কিছুদিন আগে ব্রিটিশ লেবার পার্টির নতুন নেতার নির্বাচন হয়েছে। দু’ভাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। বড় ভাই ডানপন্থী, ব্লেয়ারাইট বলে পরিচিত। অন্যদিকে ছোট ভাই এ্যাড মিলিব্যান্ড বামঘেঁষা এবং ব্লেয়ারবিরোধী বলে খ্যাত। সুতরাং গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের শক্তিশালী মুখপাত্র রুপার্ট মারডোকের টাইমস গ্রুপের কাগজগুলোর দায়িত্ব ছিল এ্যাড মিলিব্যান্ড যাতে লেবার পার্টির নেতা হতে না পারেন, সে জন্য জোর প্রোপাগান্ডা শুরু করা। দিনের পর দিন জনমত জরিপের নামে খবর ছাপা হতে লাগল, কিছু শ্রমিক ইউনিয়ন ছাড়া এ্যাড মিলিব্যান্ডের পক্ষে লেবার পার্টির সাধারণ নেতাকর্মী, পার্লামেন্ট সদস্য কেউ নেই। তাঁর পরাজয় অনিবার্য। নির্বাচনের পর দেখা গেল এ্যাড মিলিব্যান্ড নির্বাচনজয়ী হয়ে লেবার পার্টির নতুন নেতা হয়েছেন। আগামী সাধারণ নির্বাচনের পর হয়ত দেখা যাবে, তিনিই ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ভারতেও এই জনমত জরিপের খেলা দেখা গেছে। বিজেপির অটল বিহারী বাজপেয়ীর সরকার যখন ক্ষমতায় এবং সাধারণ নির্বাচন আসন্ন, তখন দলের তৎকালীন দ্বিতীয় প্রধান নেতা লালকৃষ্ণ আদভানী ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’ নামে বিপুল অর্থ ব্যয়ে এক নির্বাচন অভিযান শুরু করেন। শুরু হয় প্রচার অভিযান এবং জনমত জরিপের খেলা। অসংখ্য জনমত জরিপ সংস্থা গজিয়ে ওঠে এবং তার অধিকাংশই বিজেপি ভাড়া করে। দিল্লী, মুম্বাই, এলাহাবাদ, কলকাতার অধিকাংশ বড় বড় সংবাদপত্রে জনমত জরিপ প্রকাশ করে দেখানো হয়, বিজেপি এই নির্বাচনে কংগ্রেসের চাইতে বহুগুণ এগিয়ে আছে। নির্বাচনে বিজেপির জয় অনিবার্য। নিজেদের দ্বারা ম্যানিপুলেটেড এই জনমত জরিপের ফল দেখে তাতে বিশ্বাসী হয়ে বিজেপি সরকার সাধারণ নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত সময়ের আগে এগিয়ে এনেছিল। সেই নির্বাচনের ফল আজ আর কাউকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার দরকার নেই। কারণ, সেই নির্বাচনের পর কংগ্রেস এখনও দিল্লীর মসনদে আসীন।
জনমত জরিপের যে কোন সুষ্ঠু ও সৎ সংস্থা বর্তমান বিশ্বে নেই তা নয় কিন্তু ব্যাঙের ছাতার মতো অর্থলোভী এবং অসাধু প্রতিষ্ঠান অনেক গড়ে উঠেছে এবং দেশে দেশে একশ্রেণীর রাজনৈতিক দল এবং বিগ মিডিয়া তাদের ব্যবহারও করছে। বাংলাদেশ এমনিতেই সব ব্যাপারে দুই নম্বরী কাজের দেশ। সুতরাং জনমত জরিপের নামে এ দেশেও দুই নম্বরী কাজ হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
তবে জনমত জরিপের নামে জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য ধনবাদী বিশ্বে যে অর্থ ও কারসাজির খেলা চলে, তার তুলনায় বাংলাদেশে প্রথম আলো পত্রিকার খেলাধুলা অনেকটা বালকোচিত। নইলে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত সম্পর্কে জনগণের মনোভাব, দেশে ঐতিহাসিক যুব জাগরণের প্রতীক শাহবাগ মঞ্চ ইত্যাদি এক সঙ্গে এত স্পর্শকাতর বিষয় সম্পর্কে প্রথম আলোর তওবা সম্পাদক জনমত জরিপের নামে অতি চালাকির আশ্রয় গ্রহণে সাহসী হতেন না।
মতিউর রহমানের সাংবাদিক জীবনের ইতিবৃত্ত একটু খুঁজলেই তিনি কেন হঠাৎ দেশের এই সঙ্কট সন্ধিক্ষণে অনেক জামায়াতী প্রচারণাকে জনমত বলে চালাবার জন্য কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন এবং জামায়াতকে প্রোটেকশন দান এবং শাহবাগ মঞ্চ সম্পর্কে তাঁর এতটা প্রতিশোধস্পৃহা দেখানোর কারণ কি তাও বোঝা যাবে। তিনি নিজেকে অতি চালাক ভেবে আগুন নিয়ে খেলতে শুরু করেছেন। শফিক রেহমান ও মাহমুদুর রহমানের পরিণতি দেখে তাঁর কোন শিক্ষা হয়নি।
ধর্মীয় সন্ত্রাসে উস্কানি, রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রীয় মূলনীতির বিরুদ্ধে অনবরত অসত্য ও ধ্বংসাত্মক প্রচারণার দায়ে যখন ‘আমার দেশ’ পত্রিকাটি এবং ‘দিগন্ত’ টেলিভশন বন্ধ করে দেয়া হয়, তখন সরকারী পদক্ষেপের সমর্থক এক বন্ধু আমাকে বলেছিলেন, দুটি মিডিয়াই সাংবাদিক স্বাধীনতার অপব্যবহার করে দেশ ও জাতির বড় ক্ষতি করছিল। আমি তাকে বলেছি, এই দু’টি মিডিয়ার চাইতেও দেশ ও জাতির আরও বড় ক্ষতি করে চলেছে এমন একটি বাংলা দৈনিক আছে। কিন্তু সেটি সরকারের ধরাছোঁয়ার বাইরে। এ দৈনিকটির আবার ‘নিরপেক্ষ প্রগতিশীলতার’ মুখোশ আছে। এই পত্রিকাটিরই বহুরূপী সম্পাদক মতিউর রহমান। এককালে বাম অবতার ছিলেন। এখন কামিনীর কিনা জানি না, কিন্তু কাঞ্চনের অবতার।
ইউরোপের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এই মহাদেশে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সবচাইতে বেশি ক্ষতি করেছে এককালে যারা বামপন্থী ছিলেন এমন লোকরাই। হিটলার এবং মুসোলিনীও প্রথম যৌবনে সোস্যালিস্ট ছিলেন। পরে ফ্যাসিস্ট হন। হিটলার তো জার্মান রাইখ (পার্লামেন্ট) পুড়িয়েছিলেন এক সাবেক কমিউনিস্টের দ্বারা। তারপর এই অগ্নিকা-ের দোষ জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির ওপর চাপিয়ে দলটির ওপর নির্মম নির্যাতনের স্টিমরোলার চালিয়েছিলেন।
বাংলাদেশেও গণতান্ত্রিক ও সেক্যুলার রাজনীতির যতো ক্ষতি এ সাবেক বামেরা করেছে, তত ক্ষতি সাম্প্রদায়িক দলগুলো মিলিতভাবেও করতে পারেনি। সাংবাদিকতাতেও শফিক রেহমান ও মাহমুদুর রহমান বিএনপি-জামায়াতের সমর্থকরা প্রকাশ্য শত্রুতা দ্বারা দেশের গণতান্ত্রিক শিবির ও তার রাজনীতির যত ক্ষতি করতে পারছেন না, তার চাইতে অনেক অনেক বেশি ক্ষতি করছেন সাবেক বাম মতিউর রহমান এবং তার সম্পাদিত পত্রিকাটি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিতে দেশের নির্বাচন অনুষ্ঠান অবশ্যই এখনও একটি বিতর্কিত বিষয়। এ ব্যাপারে কেউ চাইলে অবশ্যই জনমত সমীক্ষা চালাতে পারেন। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার সার্বজনীন দাবি এবং দৈব আশীর্বাদের মতো দেশের রাজনীতিতে আবির্ভূত গণজাগরণ মঞ্চের জনপ্রিয়তাকে প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত করার জন্য ঠিক সময় ও সুযোগ বুঝে কোন দেশপ্র্রেমিক এবং সুস্থমনা সম্পাদক কি তার পত্রিকায় জনমত জরিপের ব্যবস্থা এবং তার ম্যানুপুলেটেড রেজাল্ট প্রকাশের ধৃষ্টতা দেখাতে পারেন?
এ ধরনের ধৃষ্টতা দেখিয়েছিলেন স্পেনে ফ্যাসিস্ট জেনারেল ফ্রাঙ্কোর অভ্যুত্থানের প্রাক্কালে অগাস্টিন সোমস নামে এক সাবেক বাম সম্পাদক। তিনিও নিরপেক্ষতার ছদ্মবেশে তার পত্রিকায় জেনারেল ফ্রাঙ্কোর পক্ষে প্রচারণা চালাতেন। তিনিও স্পেনের মানুষ দুর্বল রাজতন্ত্র চায়, না ফ্রাঙ্কোর শক্তিশালী শাসন চায়-এই প্রশ্নে জনমত জরিপের ব্যবস্থা করেছিলেন এবং নব্বই শতাংশ মানুষ ফ্রাঙ্কোর শাসন চায় বলে জরিপের ফল প্রকাশ করেছিলেন। পরে ফাঁস হয়ে গিয়েছিল, জনমত জরিপের রায়টি নিয়ে অগাস্টিন সোমস নিজে জালিয়াতি করেছেন।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার নামে ফ্যাসিবাদকে ক্ষমতা দখলে সহায়তা যুগিয়ে অগাস্টিন প্রচুর অর্থ ও বাড়ি গাড়ির মালিক হয়েছিলেন। তিনি অর্থের প্রলোভন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করে স্পেনের তৎকালীন বহু বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিককে তার পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত করে তাদের দিয়ে নীতিভ্রষ্ট লেখা লিখিয়েছেন। বাংলাদেশেও মতিউর রহমান যা করছেন তা সম্ভবত এ অগানিস্টন সোমস এরই অনুকরণ। মতিউর রহমানের কুহকে মজে গিয়ে এবং তার মনের মতো লেখা লিখতে গিয়ে অনেক বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী, বিচারপতি ও কলমিস্ট বিতর্কিত হয়েছেন, আগের সুনাম হারিয়েছেন। তাদের মধ্যে একমাত্র আমার বন্ধু প্রবীণ কলামিস্ট এ বিএম মূসাই সম্ভবত এখন পর্যন্ত টোগর বৈষ্ণবীর স্বামী না হয়েও টিকে থাকতে পেরেছেন। তিনি এখন অসুস্থ। আমি তার নিরাময় ও দীর্ঘজীবন কামনা করি।
অগাস্টিন সোমসের শেষরক্ষা হয়নি। ফ্রাঙ্কো তাকে ব্যবহার করলেও বিশ্বাস করতেন না। তিনি যখন ধন সম্পত্তি প্রভাব প্রতিপত্তির চূড়ায়, তখন হঠাৎ একদিন নিখোঁজ হয়ে যান। তার কোন সন্ধান আর মেলেনি, এমন কি মৃতদেহও পাওয়া যায়নি। অনেকের সন্দেহ, ফ্রাঙ্কোর গুপ্ত ঘাতকেরাই তাকে লাপাত্তা করেছিল। বাংলাদেশে মতিউর রহমানের এমন পরিণতি ঘটকু, তা আমি অবশ্যই কামনা করি না। বরং তার ধনশ্বৈর্য আরও বাড়ুক, জীবন আরও সমৃদ্ধ ও দীর্ঘ হোক এই কামনা করি। কেবল প্রার্থনা করি, মতিউর রহমানকে আল্লা সুুমতি দিন। তার “ওয়াছওয়াছা” থেকে বাংলার মানুষ যেন মুক্তি পায়।
বিএনপির দ্বারা প্রভাবিত পরিচালিত ইয়াজউদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং পরবর্তী সেনা তাঁবেদার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিণতি দেখার পর দেশের মানুষ এই ব্যবস্থার প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা হারায়। যার ফলে যে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির প্রথম দাবি তুলেছিল। তারাই পরবর্তীকালে ২০০৮ সালে ক্ষমতায় এসে সংসদে এ ব্যবস্থা বাতিল করে। সর্বোচ্চ আদালতও এই ব্যবস্থা বাতিল করার পক্ষেই ব্যয় দিয়েছে।
এতদসত্ত্বেও প্রচার ও প্রচারণার জোরে মৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কফিনটিকে আবার কবর থেকে তুলে তাতে ভৌতিক প্রাণ সঞ্চারের প্রচেষ্টা চলছে। এ ব্যাপারে বিএনপি-জামায়াত ছাড়া তথাকথিত সুশীল সমাজের যারা এই পদ্ধতির পক্ষের প্রধান প্রবক্তা, যেমন আকবর আলি খান, হোসেন জিল্লুর রহমান, সুলতানা কামাল এবং অনেকেই এক সময় ইয়াজউদ্দীনের হাতে নিহত তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার কফিন বহন করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত বহন করতে ব্যর্থ হয়ে পালিয়েছিলেন। এখন আবার এদের কাঁধে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রেতাত্মা কি করে ভর করেছে, তা বুঝতে পারছি না।
সে যাই হোক, আওয়ামী লীগের প্রচার শক্তি কম, তাই বিএনপি-জামায়াত এবং এই সুশীল সমাজের সমবেত প্রচারণায় এবং প্রথম আলোর মতো দশানন মিডিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের পক্ষে একটা জনমত গড়ে উঠতে পারে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু দেশের নব্বই শতাংশ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায় এমন প্রচার পাগলেও বিশ্বাস করবে কি? মতিউর রহমান নিজেও বিশ্বাস করেন কি?
প্রথম কথা, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য গণতান্ত্রিক দল যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন দ্বারা নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি তোলে, তখন জনমত জরিপ ছাড়াই বোঝা গিয়েছিল, দেশের পঁচানব্বই ভাগ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি চায়। তার প্রকাশ ঘটেছিল এই দাবির পক্ষে বিশাল গণজাগরণ, অসহযোগ আন্দোলন, জনতার মঞ্চ গঠন ইত্যাদির মধ্যে। এই গণবিস্ফোরণের মুখেই আপোসহীন নেত্রী খালেদা জিয়াকে পদত্যাগ করে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছিল।
এবার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের দাবির পেছনে নব্বই ভাগ কেন, পঞ্চাশ ভাগ মানুষেরও সমর্থ থাকত, তাহলে হাসিনা সরকার এতদিন সে দাবি না মেনে ক্ষমতায় থাকতে পারতেন কি? জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে দেশে সর্বাত্মক আন্দোলন, বিক্ষোভ, মিছিলের ডাক দেয়া এবং সর্বত্র সন্ত্রাস সৃষ্টি সত্ত্বেও দেশের মানুষ সেই ডাকে সাড়া দিতে সম্পূর্ণ অনিচ্ছুক ও অনাগ্রহী কেন? বিশাল বিশাল জনসমাবেশ ঘটিয়ে হেফাজতের ব্যানারে মাদ্রাসার ছাত্রদের ঢাকা অবরোধে নামিয়েও সরকারের পতন ঘটানো দূরের কথা, নিজেদেরই পালাতে হলো কেন? দেশের নব্বই ভাগ মানুষ যে দাবির পক্ষে, সে দাবি না মেনে কোন সরকারের পক্ষে একদিনও ক্ষমতায় থাকা সম্ভব কি?
সরকারকে সন্ত্রাসী হেফাজতী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের জন্য বিএনপি ও জামায়াত তো দেশে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করেছিল। অনেকটা প্রাচীন রোমে বারবারিয়ানদের হামলার মতো। তারা নাকি ছায়া মন্ত্রিসভাও গঠন করে ফেলেছিলেন। এত বিশাল ও সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রও সফল হলো না কেন? ৫ মে রাতে এ ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করতে সরকারের লেগেছে মাত্র ঘণ্টাখানেক সময়। তারপর বার বার হরতাল ডেকে বিএনপি ও জামায়াত লোক হাসিয়েছে মাত্র। কোথায় গেল নব্বই ভাগ মানুষের সমর্থন? মতিউর রহমানের কুর্তার আস্তিনের তলায় কি?
অনুরূপভাবে বলা চলে শাহবাগ চত্বরের বিশাল গণজাগরণের পেছনে যদি দেশের চার ভাগ মানুষের মাত্র এক ভাগের সমর্থন থাকে, তাহলে এই সমাবেশ ঢাকায় অর্ধ মাসের বেশি সময় টিকে থাকতে পারত কি? যে সমাবেশ কায়রোর তাহরির স্কোয়ারের সমাবেশকেও টেক্কা দিয়েছে। যদি প্রথম আলোর এই দাবি সঠিক হতো, তাহলে এ গণজাগরণ মঞ্চকে হেয় করার জন্য এক প্রবীণ কথাশিল্পী এবং আরেকজন গল্প লেখিকার দ্বারা অশালীন গল্প লিখিয়ে এবং প্রকাশ করে গণরোষের ভয়ে মতিউর রহমানকে মাফ চাইতে হলো কেন? তার পাঠকেরাই কি ঢাকার রাস্তায় এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রথম আলো পুড়িয়ে বহ্ন্যুৎসব করেনি?
মতিউর রহমানের রাগটা শাহবাগ মঞ্চের ওপর এখানেই। শাহবাগ মঞ্চের ঐতিহাসিক জাগরণের এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সর্বোচ্চ দ-ের দাবি আদায়ে সাফল্যের দরুন মতিউর রহমান তাদের খবর ছাপতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু খুশি ছিলেন না। তার জামায়াতপ্রীতির (পরে এ সম্পর্কে আলোচনায় আসছি) দরুন পরে এই গণজাগরণকে হেয় করার জন্য তার এক নারী কর্মীকে টার্গেট করে দু’টি গল্প লেখান এবং তা ছাপেন। সঠিক খবর কিনা জানি না, প্রথম আলোর ঘরের ভেতর থেকেই খবর পেয়েছি, মতিউর রহমান তার অনুগত সাংবাদিক ও সাহিত্যিক সাজ্জাদ শরিফের দ্বারা (ড. আনিসুজ্জামানের নাত জামাই অথবা ভাগ্নি জামাই) এই গল্প লেখানো ও ছাপানোর ব্যবস্থা করেন। শাহবাগ মঞ্চের সমর্থকদের মধ্যে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়ে ও গল্প দুটি প্রত্যাহার করে তারা পিঠ বাঁচান।
কিন্তু এই অপমানিত হওয়ার রাগ তাদের যায়নি। ফলে শাহবাগ মঞ্চের সমাবেশ আপাতত স্থগিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শাহবাগের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য তাদের জনপ্রিয়তার প্রশ্নটিকে অনাবশ্যকভাবে জনমত সমীক্ষায় টেনে আনা হয়েছে এবং প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে একদিকে জামায়াত নিষিদ্ধ হোক এটা দেশের অর্ধকের বেশি মানুষ চায় না এবং শাহবাগ মঞ্চের জনপ্রিয়তা নেই। দেশের চার ভাগ মানুষের মাত্র এক ভাগ তাদের সমর্থন করে। এ ধরনের মিথ্যাচার জামায়াত ও হেফাজত সমর্থক মিডিয়াগুলোও করার সাহস দেখায়নি। লক্ষ্য করার বিষয় শাহবাগ মঞ্চকে হেয় করার জন্য গল্প লেখানো ও ছাপানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। যে অনুগত সাংবাদিকের দ্বারা, তাকেই আবার গত শনিবারের জনমত জরিপের (যার মধ্যে শাহবাগ মঞ্চের জনপ্রিয়তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে) উপস্থাপনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল।
প্রথম আলোর এই জনমত জরিপে আরও লক্ষ্য করার বিষয়, সাধারণত পত্রিকাগুলো দুটো কি বড়জোর তিনটি প্রশ্নে জরিপ চালায়। কিন্তু প্রথম আলো একেবারে পাঁচ ছয়টি প্রশ্ন এক সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে। সব ক’টি প্রশ্ন লিডিংকোশ্চেন এবং সরকার ও গণতান্ত্রিক শিবিরকে হেয় করে বিএনপি-জামায়াত-হেফাজত চক্রকে বর্তমানের পরাজয়ের গ্লানি থেকে মুক্ত করার অপচেষ্টা।
প্রথম আলোর জনমত জরিপে বলা হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে গিয়ে সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেনি এটা নাকি দেশের ৮১ ভাগ লোক মনে করে। আর দেশের অর্ধেকের বেশি লোক জামায়াত নিষিদ্ধ হোক তা চায় না। কুমতি দ্বারা মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন না হলে কোন সুস্থ মতির সম্পাদকের দ্বারা জনমত জরিপের নামে এমন জালিয়াতি করা সম্ভব নয়।
আমি জানি না, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ইউরোপে এমনকি জার্মানিতেও ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থান রোধের জন্য যখন নাৎসি পার্টি নিষিদ্ধ করা হয়, তখন ইউরোপের কোন দেশের কোন সংবাদপত্রই, দলীয় অথবা অদলীয়, নাৎসি দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার ব্যাপারে জনমত জরিপের উদ্যোগ নিয়েছিল কিনা বা জনমত জরিপ করে এমন কথা প্রচার করেছিল কিনা যে, দেশটির অর্ধেকের বেশি মানুষ নাৎসি বা ফ্যাসিস্ট দলকে নিষিদ্ধ করা হোক তা চায় না।
বাংলাদেশে জামায়াতের নিষিদ্ধ হওয়া উচিত কিনা সে সম্পর্কে প্রথম আলোর জনমত জরিপ ও তার ফল প্রকাশের পর বার্লিনে আমার এক জার্মান বন্ধুকে তার দেশে নাৎসি পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণার উদ্যোগ নেয়া হলে কোন মিডিয়া জনমত জরিপ করেছিল কিনা টেলিফোনে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি বলেছেন, ‘তুমি পাগল হয়েছ! নাৎসিরা গোটা মানবতার বিরুদ্ধে যে জঘন্য অপরাধ করেছে, তারপর জার্মানির একটি বালকও বলতে যাবে যে এই দলকে নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে আমি? জার্মানির কোন সংবাদপত্রের নাৎসি দলের প্রতি গোপন সহানুভূতি থাকলেও তাদের সমর্থনে একটি বাক্য উচ্চারণে কখনও সাহসী হয়নি। জনমত জরিপ করাত দূরের কথা। কারণ, তখন তা ছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার ৬৮ বছর পরও এই বিধান বলবত রয়েছে। জার্মানিতে এখনও কেউ যদি শুধু ‘হাই হিটলার’ ধ্বনি তোলে, তাকেও গ্রেফতার করা হয়।’
এই নাৎসি দলের সঙ্গে বাংলাদেশের জামায়াত দলের কোন পার্থক্য নেই। একমাত্র ধর্মবিশ্বাসে মুসলমান হওয়া ছাড়া জামায়াতের মানবতাবিরোধী অপরাধ নাৎসিদের সমতুল্য। নাৎসিরা তাদের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য বিচারের সম্মুখীন হয়েছে এবং তাদের অধিকাংশের মৃত্যুদ- হয়েছে। কেউ কেউ আত্মহত্যা করে ভবযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছে। তাদের বিচার ও দ-াদেশের বিরুদ্ধে জার্মানি, ইতালি বা জাপানের গোপন ফ্যাসিস্ট সমর্থক দলগুলোও আন্দোলন করা দূরের কথা, কথা বলারও সাহস দেখায়নি। নাৎসি বা ফ্যাসিটদের সম্পর্কে জনমত জরিপের নামে তাদের পক্ষে জনসমর্থন রয়েছে একথা প্রচারের মতো জাতিদ্রোহিতা ও রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক ভূমিকা নিতে কোন সংবাদপত্রই সাহসী হয়নি। অথবা তাদের বিবেক ও দেশপ্রেমে বেধেছে।
বাংলাদেশে ‘প্রথম আলো’ পত্রিকা এবং তার সম্পাদক মতিউর রহমানের এই বিবেক ও দেশপ্রেম এবং সৎ সাংবাদিকতাবোধ আছে কিনা সে প্রশ্নটি আজ আমি বিনা দ্বিধায় তুলছি। যদি তার মধ্যে বিবেক ও দেশপ্রেমের কণামাত্র থাকত তাহলে দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী, দেশের অসংখ্য মানুষ ও বুদ্ধিজীবী হত্যার হোতা এবং সহযোগী একটি ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী দলের পক্ষে ভুয়া জনসমর্থন সংগ্রহে তাকে উৎসাহী হতে দেখা যেত না। তিনি এটাকে রাষ্ট্রদ্রোহ ও জাতিদ্রোহতুল্য অপরাধ মনে করতেন।
বাংলাদেশ এখন এক গভীর সঙ্কটকাল অতিক্রম করছে। ‘৭১ সালের মতো স্বাধীনতার পক্ষের ও বিপক্ষের শক্তি মুখোমুখি। স্বাধীনতার বিপক্ষের শিবিরের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। ‘৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার পর স্বাধীনতার বিপক্ষের শিবির এবং যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থকরা দেশময় যে ভয়াবহ সন্ত্রাস শুরু করেছিল। ৫ মে সরকার তা দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিহত করতে না পারলে দেশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতো। এই সময় কোন দেশপ্রেমিকের পক্ষে এই দুই শিবিরের মধ্যে নিরপেক্ষ সেজে অবস্থান গ্রহণের এবং এই চতুর ভূমিকার আড়ালে জনমত জরিপের নামে দেশবাসীর মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির এবং স্বাধীনতার বিপক্ষ শিবিরকে শক্তি সংগ্রহে সাহায্য যোগানোর কোন অবকাশ আছে কি?
অথচ মতিউর রহমান এবং প্রথম আলো পত্রিকা জাতির এই দুঃসময়ে এই বিভীষণের ভূমিকাটিই গ্রহণ করেছেন। দেশের একটি গণতান্ত্রিক সরকারের উদারতা অথবা দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার আড়ালে মতিউর রহমান যা করে চলেছেন তা সৎ ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা নয়; তা অসৎ ও অপসাংবাদিকতা।
‘আমার দেশ’ পত্রিকার মাহমুদুর রহমান সাংবাদিকতার নামে যে অপকর্মগুলো প্রকাশ্যে করেছেন, ‘প্রথম আলো’ পত্রিকার মতিউর রহমান তার চাইতেও বড় বড় অপকর্ম করে চলেছেন সংগোপনে নিরপেক্ষতার মুখোশের আড়ালে। কেউ কেউ আমাকে বলেছেন, ‘আমার দেশ’ পত্রিকাটির অনুপস্থিতিতে ‘প্রথম আলো’ তার স্থান দখল করার জন্য এগিয়ে এসেছে। তাতে নেপথ্যের ‘প্রভুদের’ নির্দেশ পালন করা যাবে এবং সেই সঙ্গে ‘আমার দেশের’ সাকুলেশনও হাতিয়ে নেয়া যাবে। এখন ‘প্রথম আলোর’ মাস্টহেডের নিচে ‘আমার দেশ ইনকরপোরেটেড’ কথাটা লিখে দিলেই সঙ্গত হয়।
দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ জামায়াত নিষিদ্ধ হোক তা চায় না এ কথা সত্য হলে শহর থেকে সুদূর গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ এত মানববন্ধন করে রাস্তায় দাঁড়ায়? দেশের যেসব বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী মানুষ আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেন না, তাঁরা সভা-সম্মেলন ডেকে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানাতেন? জামায়াতের পালের গোঁদা গোলাম আযমকে গ্রেফতার করা হলে দেশে প্রলয়কা- ঘটবে বলা হয়েছিল’; কই, এই নরপশু গ্রেফতার হওয়ার পর গাছের একটি পাতাও নড়েছে কি? বিএনপির আঁচলের তলায় ঢুকে জামায়াতীদের দ্বারা ‘৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানোর জন্য দেশময় সন্ত্রাসের যে বিভীষিকা সৃষ্টি করা হয়েছিল, হেফাজতীদের মাঠে নামানো হয়েছিল, তার পরিণতি কি হয়েছে? ভাংচুর, গাড়ি-বাড়ি পোড়ানো ছাড়া সিকি ভাগ জনসমর্থন নিয়েও একটি হরতাল ডেকে তা সফল করার ক্ষমতা জামায়াতের আছে কি?
একটি রাজনৈতিক দলের অবস্থানে জামায়াত অবিচল থাকলে তাদের সঙ্গে বিরাট মতপার্থক্য সত্ত্বেও বলতাম, এই দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা উচিত হবে না। কিন্তু জামায়াতের বর্তমান অবস্থান ও ভূমিকা তো একটি রাজনৈতিক দলের নয়। একটি সন্ত্রাসী ও রাষ্ট্রদ্রোহী দলের ভূমিকা তার। যে দলের অতীত ও বর্তমান মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধে পূর্ণ। ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশেও নেহরু সরকার সন্ত্রাসী ও রাষ্ট্রদ্রোহী ভূমিকার জন্য পঞ্চাশের দশকের সূচনায় কমিউনিস্ট পার্টিকে পশ্চিমবঙ্গসহ কয়েকটি রাজ্যে বেআইনী ঘোষণা করেছিলেন। আবার এই নেহরু সরকারই পরে কমিউনিস্ট পার্টি সন্ত্রাস ত্যাগ করে সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরে এলে শুধু তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেননি, পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, ত্রিপুরায় নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় বসতেও দিয়েছিলেন। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ফিরে আসার জন্য ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে তাদের তৎকালীন নেতার ডাঙ্গে ও রণদীভের নীতি এবং নেতৃত্ব বর্জন করতে হয়েছিল।
বাংলাদেশেও জামায়াত অতীতের যুদ্ধাপরাধী নেতাদের বর্জন করে, সন্ত্রাসের পথ ছেড়ে আসুক না সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরে। প্রতিপক্ষকে কাফের মুরতাদ আখ্যা না দিয়ে, তাদের গলা না কেটে, বাংলাভাইদের মতো সন্ত্রাসীদের আশ্রয় প্রশ্রয় না দিয়ে জনগণের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসুক না। কে তাতে আপত্তি করবে? কিন্তু অতীতের যুদ্ধাপরাধের জন্য অপরাধী নেতাদের বর্জন না করে, গণতান্ত্রিক রাজনীতির বদলে ধর্মের মুখোশে সন্ত্রাস ছড়িয়ে তারা দেশ ও দেশের স্বাধীনতার মূল ভিত্তিতে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র চালাবেন, তা তো দেশদ্রোহিতা। কোন দেশদ্রোহী সন্ত্রাসী দলকে কোন গণতান্ত্রিক দেশও অবাধে তৎপরতা চালাতে দেয় কি? দেশের মানুষের অর্ধেকের বেশি জামায়াতকে পছন্দ করলে জামায়াতকে আন্দোলনের বদলে সন্ত্রাসের পথ, চোরাগোপ্তা হামলার পথ বেছে নিতে হতো কি? নেতারা কিছু দলীয় ক্যাডার এবং ভাড়া করা বেকার তরুণকে ভাংচুরের জন্য রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে নিজেরা পালিয়ে থাকতেন কি? মতিউর রহমান কাদের চশমা চোখে দিয়ে জামায়াতীদের নিষিদ্ধ করা সমর্থন করে না এমন অর্ধেকের বেশি মানুষ দেখতে পেয়েছেন তা জানি না। কেউ কেউ ঠাট্টা করে বলেছেন, ‘আমার দেশের’ ‘হঠাৎ সম্পাদকের’ চশমাটি তিনি ভাড়া করেছেন। কারণ, ওই সম্পাদক এখন কারাগারে।
ওই ভাড়া করা চশমার গুণেই কিনা জানি না, মতিউর রহমান তার শনিবারের (১১ মে) জনমত জরিপে আবিষ্কার করেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেনি এ কথা মনে করে দেশের ৮১ ভাগ মানুষ। এটা তওবা সম্পাদকের ইচ্ছাকৃত মতিভ্রম। হাসিনা সরকারের সবচাইতে বড় কৃতিত্ব, বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বিচার ও শাস্তি দেয়া অসম্ভব কাজ বলে দেশের একশ্রেণীর মানুষের, এমনকি একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবীদের মনে বদ্ধমূল ধারণা থাকলেও শেখ হাসিনা নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অসাধ্য সাধন করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার করে শাস্তি দেয়ার চাইতেও বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে হাত দেয়া। অপরাধ করার পর ৪২ বছর ধরে এই অপরাধীরা সামরিক ও স্বৈরাচারী শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় বিচার এড়াতে পেয়েছে। বিদেশে পলাতক অবস্থা থেকে দেশে ফিরতে পেরেছে। সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে পুনর্প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। এমন কি ক্ষমতার অংশীদার হয়েছে। ধর্মের নামে ধোঁকাবাজি এবং বিদেশী কালেকশনে ব্যবসা-বাণিজ্য করে বিশাল অর্থভা-ার গড়ে তুলেছে এবং তা সমাজের একশ্রেণী মাথাওয়ালা লোক ক্রয় ও প্রোপাগান্ডায় ব্যয় করেছে।
এদের কেশাগ্র স্পর্শ করাও ছিল ঘোর বিপজ্জনক। দেশের অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেননি, বর্তমান মেয়াদে হাসিনা সরকার এই বিপজ্জনক কাজে হাত দিতে পারবেন। বাপের বেটি সেই অসমসাহসিক কাজে হাত দিয়েছেন। জামায়াতের ট্রেনিংপ্রাপ্ত ঘাতক ক্যাডারের সংখ্যা কম নয়। তারা শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দিয়েছে। তিনি টলেননি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে এবং তাদের কয়েকজনের মৃত্যুদ-াদেশ ঘোষিত হয়েছে। এই মৃত্যুদ-াদেশের খবরে ‘প্রথম আলো’ অফিসে হয়ত শোকের ছায়া নেমেছে। কিন্তু সারাদেশে উৎসবের প্লাবন বয়ে গেছে।
জামায়াত এবং যুদ্ধাপরাধীদের অন্যান্য সমর্থকের হাতে এখন অঢেল অর্থ ও প্রতিপত্তি। তারা এই বিচারের মুখে নিষ্ক্রিয় বসে থাকবে তা কেউ আশা করেনি। বিএনপির সমর্থনপুষ্ট হয়ে জামায়াত বিচার বানচাল ও সরকার উৎখাতের জন্য গৃহযুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাস সৃষ্টিতে নামে। ভারতে গান্ধী হত্যার পর ঘাতক নাথুরাম গডসে আটক হলে এই ধরনের পরিস্থিতি দেখা দিয়েছিল। হিন্দু মহাসভা দলটি গান্ধী হত্যায় শুধু প্রকাশ্যে মিষ্টি বিতরণ করেনি। কয়েকটি বড় শহরে গডসের মুক্তি দাবি করে যানবাহন, সরকারী সম্পত্তি ভাংচুর শুরু করে। নেহরু সরকার এই পরিস্থিতির মুখে পড়ে হিন্দু মহাসভাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং নিষিদ্ধ দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী গ্রেফতার করে ভারতের জেলগুলো ভরে ফেলে। বিক্ষোভ দমনে পুলিশ নির্বিচার গুলিবর্ষণে দ্বিধা করেনি।
বাংলাদেশে জামায়াত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার জন্য ভারতের চাইতেও ব্যাপকভাবে সন্ত্রাস শুরু করেছিল। দেশের মানুষই ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠে দাবি তুলেছিল জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হোক। কিন্তু পরিস্থিতি মোকাবেলায় হাসিনা সরকারের সবচাইতে বড় কৃতিত্ব, এই সরকার তার গণতান্ত্রিক শক্তিতে এতই আস্থাবান যে, জামায়াতকে এখন পর্যন্ত নিষিদ্ধ ঘোষণা করেনি। বরং রাজপথেই তাদের মোকাবেলা করেছে। যত মানুষ তাতে মারা গেছে, তার অধিকাংশই জামায়াতীদের সন্ত্রাসের কারণে নিহত হয়েছে। নিহত পুলিশের সংখ্যাও কম নয়। অতঃপর ৫ মে ছিল সরকারের সঙ্গে শাপলা চত্বরে জামায়াতী ও হেফাজতীদের চূড়ান্ত শোডাউনের দিন।
দেশে শঙ্কা ছড়িয়ে পড়েছিল, এই শোডাউনে দেশে রক্তের বন্যা বইবে এমন কি সরকারের পতনও ঘটতে পারে। বেগম খালেদা জিয়া নাকি নতুন শাড়ি পরে অপেক্ষা করছিলেন, কখন ক্ষমতা গ্রহণের জন্য তার ডাক পড়ে। কিন্তু আধঘণ্টায় রণাঙ্গন সাফ। কেবলমাত্র এলাকার বাতি নিভিয়ে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়েই পুলিশ এত বিশাল জঙ্গী সমাবেশ বানচাল করে দেয়। তুলনায় হতাহতের সংখ্যা এত কম যে, বিদেশী মিডিয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের যৌথবাহিনীর (সেনা বাহিনী ছাড়াই) এই বিস্ময়কর সাফল্যের প্রশংসা করেছে।
এই শোডাউনে পরাজিত জামায়াত-বিএনপিচক্র মুখরক্ষার জন্য প্রচার করা শুরু করে ৫ মের রাতে দু’ঘণ্টার অপারেশনে নাকি আড়াই হাজার লোক হত্যা করা হয়েছে। প্রশ্ন উঠল, এই হত্যাকা-ের কোন প্রত্যক্ষদর্শী নেই কেন? এই হাজার হাজার লাশ কোথায় গেল? বিডিআর বিদ্রোহেও অসংখ্য লাশ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। শাপলা চত্বরের লাশগুলো কোথায় গেল? শহরের ড্রেনে, নদী-নালায় একটি লাশও তো খুঁজে পাওয়া গেল না। কোন আত্মীয়স্বজনও তো নিহত বা নিখোঁজ আত্মীয়ের সন্ধানে এলেন না। তাহলে? বিএনপি এই গোয়েবলসীয় মিথ্যাটিকে কারও কাছেই বিশ্বাস করাতে পারেনি। বরং মিথ্যাটি প্রচার করতে গিয়ে বিএনপির এক নেতাকে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে।
৫ মের এই শোডাউনের পর পরই বিচার ট্রাইব্যুনাল যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানের মৃত্যুদ-াদেশ ঘোষণা করতে দেরি করেনি বা দ্বিধাও করেনি। তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করার পর উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার কোথায় ব্যর্থ হলো? দেশ-বিদেশে যেখানে সরকারের দৃঢ়তা ও সাফল্য প্রশংসিত হচ্ছে, সেখানে প্রথম আলো সম্পাদকের চোখের কালো চশমায় ধরা পড়েছে, দেশের ৮১ ভাগ মানুষ মনে করে সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেনি। মতিউর রহমান লোভে, স্বার্থে বা হাসিনাবিদ্বেষে মতিছন্ন হতে পারেন। কিন্তু দেশের ৮১ ভাগ মানুষের মতিছন্ন হওয়ার কোন কারণ ঘটেনি।
এই সিরিজের লেখাটি আজ এখানেই শেষ করছি। লেখাটি আমার ইচ্ছার বাইরে অনেক বড় হয়ে গেছে। নইলে মতিউর রহমানের এই জামায়াতপ্রীতি কেন এবং কবে থেকে শুরু তার আলোচনাও এখানে করতাম। তাঁর জামায়াত-কানেকশন ‘ভোরের কাগজের’ সম্পাদকের সময় থেকে। এই কানেকশনের কারণ কি তাও আমার জানতে বাকি থাকেনি। আগামী সপ্তাহে একটি স্বতন্ত্র নিবন্ধে তা আলোচনার আশা রইল।

লন্ডন : ১৬ মে বৃহস্পতিবার, ২০১৩ ॥

সূত্র: দৈনিক জনকন্ঠ

পুলিশ ও আইন শৃঙ্খলা:প্রকৌ. তাওহীদ হাসান



আমি পত্রিকায় লেখা লেখির জীবন শুরু করেছিলাম পুলিশকে নিয়ে লিখে। সাধারনত পুলিশের নামে যেসব লেখালেখি হয়, গতানুগতীক সেসব ধরনের লেখার বাইরে ছিল আমার লেখাটি। পত্রিকার বার্তা সম্পাদক, সম্পাদক অনেক চিন্তা ভাবনা করে লেখাটি ছেপেছিলেন। শিরনাম ছিল “পুলিশের প্রতি কৃতজ্ঞতা”।
আমার একটি ধারনা থেকেই লেখাটি শুরু করা। সারা দেশের মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন নির্ঘুম পুলিশই কিন্তু জনসাধারনের শান্তি-নিরাপত্তা-ঘুম নিশ্চিত করে। তাই তাদের প্রতিও আমাদের অল্প হলেও কৃতজ্ঞতা জানানো দরকার।

সম্প্রতি পুলিশের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর ঘটনা ঘটছে। প্রতিউত্তরে, পুলিশও জনগনকে ফুল দিয়েছে। আমার স্মরন শক্তিতে বাংলাদেশে ঘটনাটি প্রথম। বিশ্বের অন্যকোথাও ঘটেছে কিনা ঠিক জানা নেই। চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানোর কোন দরকার নেই যে, আবারো প্রমানিত হল, পুলিশ জনগনের বন্ধু। আর অন্ধ লোকরাতো কোন দিনই চোখে দেখতে পাবে না।
আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে স্থান পাওয়ার মতই একটি ঘটনা এটি। পুলিশ কমিশনার নিজেও এই “স্যালুট টু পুলিশ” কর্মকান্ডের সাথে জড়িতদের শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। এই কাজের যিনি উদ্দোগতা তিনি আমার বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন সিনিয়র। তার কাজের সাথে আমি স্বশরীরে যুক্ত হতে না পারলেও তিনি যেদিন থেকে যেভাবে কাজ শুরু করেছিলেন সবই আমি জানি। কিন্তু দূঃখ লাগে যখন শুনি এমন একটা কাজও অনেকে সহজে মেনে নিতে পারে নি। আমার ভয়ের জায়গাটা অন্য। এইসব লক্ষণতো ভালো না !
যে পুলিশ জনগনের সেবায় নিয়োজিত তাদের উপর ইদানিংকালে হামলা হচ্ছে। জিনিসটাকে কি হালকা ভাবে নেয়ার উপায় আছে? সামনের দিনে কি দেখতে হবে কে জানে, তবে এসব কর্মকান্ডের নমুনা কিন্তু ভালো নয় !
উদাহরন টেনে বলা যেতে পারে সবচেয়ে বেশি সারা জাগে এপ্রিলের শুরুতে রাজশাহীর ঘটনায়। রাজশাহীতে পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলা চালানো হয়। সে সময় ইট ও হেলমেট দিয়ে মাথায় আঘাত করে এসআই জাহাঙ্গীর আলমকে মারাত্মকভাবে আহত করার ঘটনা ঘটে। এ সময় এসআই জাহাঙ্গীর আলমের পিস্তলও কেড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। অল্পের জন্য প্রানে বাচেঁন তিনি।
১৪ এপ্রিল মৌলভীবাজারের রাজনগরে পুলিশের উপর হামলা চলে। রাত ১০ টার দিকে কয়েকজন আসামী আটক করে থানায় নিয়ে আসার পথে পুলিশের উপর হামলা চালানো হয়। এসময়ে কয়েকজন পুলিশ আহত হন এবং পুলিশের ব্যবহৃত একটি গাড়িও ভাংচুর করা হয়েছিল। ঘটনাটি চিন্তা করতেই কেমন যেন লাগে !
এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে বরিশালের কাটপট্টি এলাকায় বেলা ১২ টার দিকে হরতালের সমর্থনে মিছিলের প্রস্ততিকালে পুলিশের উপর ইটপাটকেল ছোড়া হয়। এতে পুলিশ সদস্য আহত হন।
এপ্রিল মাসের ১২ তারিখের দিকে। বৃহস্পতিবার ডাকা হরতালে পুলিশ কুমিল্লা বাসস্ট্যান্ড এলাকার আল জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদ্রাসা ঘেরাও করে রাখলে পুলিশের উপর ইট পাটকেল, ককটেল নিক্ষেপ করা হয়। এতে ৪ পুলিশ কনস্টেবল আহত হন।
এপ্রিল মাসে রাতে অন্ধকারেই কক্সবাজার শহরে মিছিল বের হয়েছিল। ওই সময় কক্সবাজার শহরের বাজার ঘাটা এলাকায় পুলিশের উপর গুলি বর্ষণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয় কক্সবাজার সদর থানার এসআই জাকির সহ ৪ জন।
পুলিশের উপর ককটেল-গুলি। প্রতিরোধের সময় কি এখনো আসেনি ? এমনভাবে চলতে থাকলে, দেশের নিরাপত্তার কি অবস্থা হবে?
২১ মার্চ সকালে মহেশপুরে পুলিশের উপর হামলা হয়েছে।
পুলিশের উপর হামলার ঘটনা ঘটে শ্যামপুর ইউনিয়নের গোপালনগর গ্রামে ।
রবিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি, সিলেটে আধা বেলা হরতালে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি ঝটিকা মিছিল বের হয়েছিল। নগরীর মদিনা মার্কেট এলাকায় পিকেটারদের হামলায় দুই পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।
জানুয়ারি, ২০১৩। চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার চাম্বল বাজারে দফায় দফায় সংঘর্ষ ঘটে যাতে ১০ পুলিশ সদস্য আহত হন।
হামলার স্বীকার হয়েছেন বেগমগঞ্জ সার্কেল এএসপি মো: মাহাবুবল আলম খানসহ ১৪ জন পুলিশ সদস্য, ঘটনাটি ফেব্রুয়ারি মাসের।
চট্রগ্রামে নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আব্দুল মান্নানকে আহত করার ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনাটি অবশ্য গেল বছরের।
গেল বছরের শেষের দিকে, রোববার পিরোজপুরের জিয়ানগরে, জিয়ানগর থানার ওসিসহ ৫ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছে।
পুলিশের উপর হামলার খুব অল্প কিছু তথ্য এখানে তুলে ধরা হয়েছে। বাস্তবতা আরো নির্মম, ফলাফল ভয়াবহ। এই চক্রকে ঠেকানো দরকার বলে মনে করি। এদের এখনি রুখতে না পারলে, আইনের শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কি আরো খারাপের দিকে যাওয়ার সম্ভবনা নেই?
হ্যা এটা বলা হচ্ছে না, পুলিশ সবাই শ্বর্গীয় দূত। কিন্তু তাদের বিচার দায়িত্ব জনগনকে দেয়া হয়েছে এটাওতো কোথাও বলা হয়নি। পুলিশের উপর হামলা করে একটি ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করার চেষ্টা চলছে। যা মেনে নেওয়া কষ্ট, প্রতিরোধ করা রীতিমত সময়ের চাহিদা না হলে বিপদ অবিশ্বম্ভাবি।

লেখক : প্রকৌশলী
tawheed555@gmail.com

Sunday, May 12, 2013

বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রকাঠামো ভেঙ্গে নতুন কোনো ইসলামিক রিপাবলিকের পক্ষে কোনো মিডিয়াও থাকতে পারে: জাহিদ নেওয়াজ খান




বাংলাদেশে বেশিরভাগ গণমাধ্যমেরই নিজস্ব নীতিমালা নেই। কিছুটা কাণ্ডজ্ঞান, কিছুটা সাংবাদিকতার সহজ পাঠ আর কিছুটা সার্বজনীন যে নীতিমালা তাতেই চলে এখানকার গণমাধ্যম। বেশিরভাগ মিডিয়ারই যেখানে নিজস্ব নীতিমালা নেই, সেখানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গণমাধ্যম কর্মীর স্বাধীনতা বা সীমাবদ্ধতা নিয়েও তাই নির্দেশনা থাকার প্রশ্ন উঠে না। পশ্চিমা গণমাধ্যমের মতো আরো বেশি কর্পোরেট হওয়ার আগে কিংবা এরকম কোনো নীতিমালা না হওয়া পর্যন্ত তাই বাংলাদেশের গণমাধ্যম কর্মীরা ‘ফেসবুক-টুইটার-ব্লগে’ এক ধরণের স্বাধীনতা উপভোগ করে যেতে পারবেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেরকম স্বাধীনতা তাদের এখন আছে।

এই স্বাধীনতা প্রশ্নে দেশের সাংবাদিকদের পেশাদারিত্ব নিয়ে এই মুহূর্তে কিছুটা বিতর্ক চলছে। মজার ব্যাপার হলো, এই বিতর্ক যারা শুরু করেছেন, তারা নিজেরাও একটি পক্ষভুক্ত। কিন্তু তারা নিজের অবস্থান ভুলে গিয়ে প্রশ্ন তুলছেন ভিন্নমতের সাংবাদিকদের পেশাদারিত্ব নিয়ে। সেক্ষেত্রে তারা একজন রিপোর্টারের রিপোর্ট কিংবা একজন নিউজ ম্যানেজারের আউটপুট বিবেচনায় না নিয়ে ওই রিপোর্টার কিংবা নিউজ ম্যানেজার ফেসবুক-টুইটার-ব্লগে কিংবা অন্য কোনো মুক্তমত প্রকাশের মাধ্যমে কি বলেছেন, সেটাকেই সামনে নিয়ে আসছেন।
সহকর্মী নাজমুল আশরাফ তাই ফেসবুকেই লিখেছেন: “ইদানিং সাংবাদিকতার শিক্ষকের (?) প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। বিশেষ করে ফেসবুকে। কথায় কথায় তারা সাংবাদিকতা শেখান। সাংবাদিকতা কাকে বলে, কোনটা দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা, কোনটা বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা, নিরপেক্ষতা মানে কী, কে নিরপেক্ষ সাংবাদিক, কে দলীয় সাংবাদিক, সাংবাদিকদের কী করা উচিত, কী করা উচিত না, কোনটা হলুদ সাংবাদিকতা, কোনটা দেশপ্রেমিক সাংবাদিকতা, আরো কত কত শিক্ষা... একটা শব্দও ঠিকমত লিখতে পারেন না, এমন ব্যক্তিও ফেসবুকে সাংবাদিকতার ক্লাস নিচ্ছেন। মাঝে মধ্যে ভাবি, ফেসবুকে যেখানে বিনে পয়সায় সাংবাদিকতা শেখা যাচ্ছে, সেখানে কি দরকার ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে এতোগুলো বছর নষ্ট করার? এক শ্রেণীর ফেসবুকার তো সাংবাদিকদের সনদ দিতেও শুরু করেছেন। উপদেশও দিচ্ছেন, অমুক রহমানের মত সাংবাদিক হন, তমুক করিমের মত নিরপেক্ষ হন। ভাবছি, গীতি ম্যাডামকে বলবো, সাংবাদিকতা বিভাগটা এবার বন্ধ করে দেন।”

যাদেরকে নতুন করে সাংবাদিকতার পেশাদারিত্ব শেখানোর চেষ্টা চলছে, তারা কিন্তু ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ এর আগে যারা জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা করছেন তাদের কাছে পেশাদার সাংবাদিক হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। শুধু পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে নয়, সাধারণ বিচার-বিবেচনাবোধ আর কাণ্ডজ্ঞানের কারণেও তারা যখন মুক্ত মত প্রকাশের জায়গায় প্রধান দুই দলেরই সমালোচনা করে লেখালেখি করতেন, অথবা ফেসবুক-টুইটারে মতামত জানাতেন; দলীয় কর্মী বা সাংবাদিকদের কাছে তা পছন্দনীয় না হলেও তারা এই ভেবে সান্ত¦না পেতেন যে শুধু আমার দল না, প্রতিদ্বন্দ্বি দলেরও তিনি সমালোচক। কিন্তু কাদের মোল্লার রায়ের পর শাহবাগে জনবিষ্ফোরণ থেকে যে গণজাগরণ মঞ্চ, এরপর সেই পেশাদার সাংবাদিকরা তাদের মত প্রকাশের জায়গায় বাংলাদেশের পক্ষে পরিস্কার অবস্থান নেওয়ায় সাংবাদিকদের দুই দলের একটির কাছে তারা হয়ে গেলেন অ্যাকটিভিস্ট, আর অন্য দলের কাছে এতোদিনে লাইনে আসা সাংবাদিক।

শুধু ব্যক্তি সাংবাদিকের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজস্ব মতামত নয়, সামগ্রিকভাবেও মিডিয়ার বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠছে। এখানেও মজার ব্যাপার হলো, যারা এই অভিযোগ করছেন তারা মিডিয়ার যে ছোট অংশ প্রতিদিন লিফলেটের মতো প্রথম পাতায় কিংবা টেলিভিশন সংবাদের মূল অংশে প্রচারণা চালাচ্ছে তাদের ব্যাপারে নীরব। তাদের সমস্ত অভিযোগ মিডিয়ার সেই বড় অংশের বিরুদ্ধে যারা সাংবাদিকতার সাধারণ নীতিমালা মেনেই আকার এবং সময়ের দিক দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষের আন্দোলনকে কিছুটা বেশি কাভারেজ দিলেও অন্যপক্ষের সব বক্তব্য এবং খবরই নিয়মিত প্রচার করছে। এর বড় প্রমাণ জামায়াত-শিবিরের ডাকা হরতাল। পুলিশের তোপের মুখে থাকা জামায়াত এবং ছাত্রশিবির এতোগুলো হরতালের একটিও কোনো সভা-সমাবেশ থেকে ডাকেনি। তাদের সব হরতালই আহ্বান করা হয়েছে হয় ফোন কল অথবা টেক্সট কিংবা ই-মেইল বা ফ্যাক্সে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে। বাংলাদেশের কোন্ টিভি চ্যানেল বা সংবাদপত্র সেই খবর প্রচার করেনি? অনেকেতো মনে করেন, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ব্রেকিং নিউজের প্রতিযোগিতায় হরতাল আহ্বানের খবর যে প্রচার পায়, তাতেই হরতাল অর্ধেক সফল। বাকি অর্ধেক হয়ে যায় নাশকতার আগে সাংবাদিকদের খবর দিয়ে ছবি তোলার ব্যবস্থা করে দেওয়ার মাধমে। এই ‘প্রি-অ্যারেঞ্জড’ নাশকতার খবরের প্রচার নিয়েও বিতর্ক আছে। তবে আপাতত শুধু পেশাদারিত্ব নিয়ে যে বিতর্ক সেই প্রসঙ্গ।

এই মুহূর্তে বাংলাদেশের গণমাধমের বড় অংশের যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যে পক্ষপাতিত্ব তা কি পেশাদারিত্ব বরবাদ হয়ে যাওয়ার সামিল? কেউ কেউ তাই মনে করছেন। কিন্তু তারা ভুলে যাচ্ছেন, এখনকার বিতর্কটা আসলে মিডিয়ার আওয়ামী লীগ অথবা বিএনপির প্রতি পক্ষপাতিত্ব নিয়ে না। এই বিতর্ক হচ্ছে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশবিরোধী শক্তির মধ্যে যে চেতনার লড়াই সেই লড়াইকে কেন্দ্র করে। কোনো কোনো মতলববাজ এটাকে সাংবাদিকতার সাধারণ তুল্য-মূল্যে ফেলতে চাচ্ছেন।

তবে এই চেতনা বলতে শুধু ফখরুলিয়-আশরাফিয় কোনো স্লোগান নয়। এখানে চেতনা হচ্ছে সেইসব মৌলিক বিষয় যার ওপর জনমানস গড়ে উঠে। একটি দেশের জন্য যা একটি দর্শন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাও এরকম কিছু মৌলিক বিষয়ের ওপর গড়ে উঠেছে। তাই গণমাধ্যম যখন সেই দেশ এবং তার সমাজের আয়না, ওই আয়নায় তার মৌল দর্শন বা চেতনাও প্রতিফলিত হবে। সেই দর্শন যখন আঘাতপ্রাপ্ত হবে, প্রতিফলিত হবে সেটাও। এখনকার বিতর্ক সেই আঘাতকে কেন্দ্র করে। এই আঘাতটা যারা করছে, তারা বাংলাদেশের মৌল চেতনার ওপরই আঘাত করছে। এবং এটা তাদের আধা ঘোষিত যুদ্ধ। সুতরাং যে মিডিয়া বাংলাদেশের, সেই মিডিয়া ওই আধা ঘোষিত যুদ্ধটাকে বাংলাদেশের চোখ দিয়ে দেখবে, এটাই স্বাভাবিক। সে দেখাটাকে যারা পক্ষপাতিত্ব মনে করেন তারা আসলে কোন্ দেশের সেই প্রশ্ন তাই থেকেই যাচ্ছে।

এখানে এটাও মনে রাখা উচিত যে, বেসরকারি মিডিয়ার উপরও জনগণের পরোক্ষ মালিকানা আছে। কারণ শেষ পর্যন্ত তারাই এর পাঠক কিংবা দর্শক। একটি গণমাধ্যমকে তাই সেই গণমানুষের কথা মাথায় রাখতেই হয়। গণ বিষয়টাও বুঝতে হয় গণমাধ্যমকে। তবে সেই গণ না যেখানে অনেক লোক চাইলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি মন্দির বা ভারতের প্রেক্ষাপটে একটি মসজিদে হামলাকে উৎসাহিত করা হয়। কথিত বিশেষজ্ঞদের এটাও বুঝতে হবে, স্বাধীনতা সংগ্রাম ছাড়া একটি দেশের নাগরিক আর বাংলাদেশের নাগরিক একই কথা নয়। এই দেশটি আপনা-আপনি কিছু পাহাড়-সমুদ্র-নদী নিয়ে গঠিত হয়নি। এই দেশটির জন্ম ইতিহাস আছে, যে ইতিহাস রক্তাক্ত। যদিও আবেদন করে কোনো দেশেই জন্ম নেওয়া সম্ভব না, তারপরও সেই রক্তাক্ত পথ ধরে জন্ম নেওয়া দেশে জন্ম নিলে, দেশটির জন্মের মৌল চেতনাকে ধারণ করতে হবে। এই চেতনাকে যারা ধারণ করছে না, তারা এখন বাংলাদেশের ভেতরে আরেকটি দেশের জন্য লড়াই করছে। বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রকাঠামো ভেঙ্গে নতুন কোনো ইসলামিক রিপাবলিকের পক্ষে কোনো মিডিয়াও থাকতে পারে। তবে বাংলাদেশের মিডিয়া হিসেবে আপনি এখানে কথিত নিরপেক্ষতার নামে বাংলাদেশের ভেতর বাংলাদেশবিরোধী নতুন কোনো দেশের পক্ষে দাঁড়াবেন কি না সেই বিচার-বিবেচনাবোধ আপনার।

যে পশ্চিমাদের উদাহরণ দিয়ে নীতিবাগিশ নিরপেক্ষতার কথা বলা হয়, তারাও, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র; আমাদের মতো পরিস্থিতির ভেতর দিয়েই গেছে একসময়। সেসময় মিডিয়ারও পক্ষপাতিত্ব ছিলো স্পষ্ট। এখনও তারা তাদের স্বার্থে ঠিকই পক্ষপাতিত্ব দেখায়। ভিন্ন মতের কথা বলে যুক্তরাষ্ট্রে কি ওসামা দর্শন প্রচার সম্ভব অথবা মার্কিন মদদপুষ্ট সৌদি আরবে গণতন্ত্রের সংগ্রাম? এমনকি অভিযুক্ত বা কথিত না বলেই সরাসরি টেরোরিস্ট তকমা বসিয়ে দেয়/দিচ্ছে সেখানকার মিডিয়া। তাহলে বাংলাদেশ কেনো বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা সহ্য করবে?
সর্বশেষ ফটিকছড়ির ভুজপুরে ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর’ আর ‘আল-কোরআনের আলো, ঘরে ঘরে জ্বালো’ স্লোগানে কুপিয়ে এবং পিটিয়ে মধ্যযুগীয় কায়দায় কয়েকজনকে মেরে ফেলার ঘটনার ভিডিও ফুটেজ টিভিতে দেখানো নিয়েও সুশীলিয় প্রশ্ন উঠেছে। যারা এই প্রশ্ন তুলেছেন, তারাই কিন্তু বিশ্বজিতকে কুপিয়ে মেরে ফেলার ঘটনার ভিডিওর রেফারেন্সে মধ্যরাতের আলোচনায় মুখে ফেনা তুলেছিলেন। তখনকার সেই ফুটেজে তাদের মনে হয়নি যে পশ্চিমাদের তৈরি করে দেওয়া সাংবাদিকতার নীতিমালা লংঘিত হচ্ছে। কিন্তু ফটিকছড়ির ফুটেজ দেখে সেই কথাই মনে হচ্ছে তাদের।

কেউ কেউ আবার ভোল পাল্টে এমন প্রশ্ন তুলেছেন, মিডিয়া এখন ফটিকছড়ির ঘটনায় যতোটা সোচ্চার, ছাত্রলীগের ‘বীর পুঙ্গবরা’ বিশ্বজিতকে খুন করে ফেলার পর ততোটা সোচ্চার ছিলো না। তাদের এই কথাও ঠিক না। ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট, দু’ ধরণের মিডিয়াই ওই ইস্যুতে সোচ্চার ছিলো বলেই বিশ্বজিতের খুনীরা এখন গারদের ভেতরে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্বজিত খুন হওয়ার পর তারা যতোটা সোচ্চার ছিলেন, অবশ্যই যে কোনো মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ ওইরকম জঘন্য ঘটনায় সোচ্চার হবেন, ফটিকছড়ির ঘটনার পর তারা কিন্তু একেবারেই চুপ।
শুরুতে ফেসবুক-টুইটার-ব্লগ কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমে স্বাধীন মত প্রকাশের যে কথা বলেছিলাম, সহকর্মী নাজমুল আশরাফ যে প্রেক্ষাপটে সাংবাদিকতার নতুন নতুন শিক্ষক আবিষ্কার হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন; একটা উদাহরণ দিলেই সেই শিক্ষকদের মান বোঝা যাবে। শাহবাগের গণজাগরণের পর থেকে আড়াই মাসে যখনই কোনো সাংবাদিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা মত প্রকাশের মুক্ত জায়গায় কোনো নিজস্ব মতামত দিয়েছেন, অবধারিতভাবে দেখা গেছে সেখানে কেউ না কেউ সাংবাদিক পরিচয়ের কারণে তাকে হলুদ সাংবাদিক বলেছেন, মিথ্যা রিপোর্ট বলেছেন। ওই বিশেষজ্ঞ যারা সংবাদ এবং মন্তব্য কিংবা সংবাদ বিশ্লেষণের পার্থক্যও বোঝেন না; তাদের নিয়ে বলার কিছুই নেই।

তবে সতর্ক থাকতে হবে ভয়ংকর আরেকটি গ্রুপ সম্পর্কে। সাংবাদিকতার নীতিমালা শেখানোর নামে এরা প্রথমে কিছু বাণী দেওয়ার চেষ্টা করে। এরপর যুক্তিতে না পেরে নাস্তিক উপাধি দিয়ে বাঁশের কেল্লা সাইটে তালিকাভুক্ত করে ভুজপুরের পরিণতি বরণের প্রস্তুতি নেওয়ার হুমকি দিয়ে আপাতত বিদায় নেয়। তবে তারা ফিরে আসার চেষ্টা করবে বারবার। বাংলাদেশের সৌভাগ্য এর নিয়ন্তারা ডান-বাম করলেও মূলধারার গণমাধ্যম সব সময় বাংলাদেশের পক্ষেই আছে।পাদটীকা

সাভার ট্র্যাজেডির পর বাংলাদেশের গণমাধ্যম মানবিকতার পক্ষে যে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশ প্রশ্নেও গণমাধ্যমের সেই মানবিক অবস্থান নেওয়াটাই সৎ সাংবাদিকতা। এখানে যারা ইনিয়ে-বিনিয়ে সাংবাদিকতার নীতিমালার কথা বলে প্রশ্ন তুলে তারা আসলে সেই হেফাজতিদের মতো যারা ‘ডেকে নিয়ে শত শত মানুষ হত্যাকাণ্ডকে’ মতলবি স্বার্থে ‘আল্লাহর গজব’ বলে। তারা আসলে সেই জামায়াতিদের মতো যারা সাভার ট্র্যাজেডির পর বাংলাদেশের শোকের মধ্যে উদ্ধার অভিযান চলার সময়ও হরতাল (চট্টগ্রামসহ কয়েক জায়গায় ২৮ এপ্রিল) ডেকে প্রমাণ দেয় তাদের নাগরিকত্ব আসলে ভিন্ন।

(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা অ্যালামনাই এসোসিয়েশন এর মুখপত্র ‘যোগাযোগ’ এর বর্ষপূর্তি (মে ২০১৩) সংখ্যায় প্রকাশিত)।

জাহিদ নেওয়াজ খান : বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল আই
znewaz@gmail.com

Wednesday, May 8, 2013

রাজাকার, রাজাকারপন্থী, রাজাকারের বাচ্চাদের কর্তৃত্ব এ দেশে আর হবে না : মুনতাসীর মামুন



৩ মে শাপলা চত্বরের জনসভায় শিফন পরিহিত খালেদা জিয়ার হাসি ও ঠাট্টা করার ভঙ্গিতে বক্তৃতা শেষ করায় চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। তার হাসি ও ঠাট্টা জীবননাশী। এমনিতে শুধু আমরা নই, মধ্যবিত্ত ও রাজনীতি বিমুখ অনেকে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধ ঘোষণায়। বিএনপি জামায়াত ঘেঁষা বা নিরপেক্ষ অনেক বিজ্ঞ, টিভিতে এই তত্ত্ব দিচ্ছিলেন যে, এতদিনে একটি তৃতীয় শক্তির আবির্ভাব হলো এবং তা হলো হেফাজতে ইসলাম। তাদের খুশির কারণ, হেফাজত জামায়াত-বিএনপির অনুগত।
আমরা ঘরপোড়া গরু। ৩ মে খালেদা জিয়া যখন চকচকে পোশাক-আশাকে প্রফুল্ল চিত্তে জনসভায় এলেন তখনই শঙ্কিত বোধ করলাম। এর আগে তার সহযোগী শক্তি হেফাজতে ইসলাম ঘোষণা করেছিল, ৬ তারিখে নতুন সরকার গঠন করবে। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সহযোগী, হাটহাজারী মাদ্রাসার আহমাদ শফীকে। হাসিনাকে আত্মসমর্পণ করতে হবে অর্থাৎ আওয়ামী লীগকে হানাদারদের সহযোগীর কাছে আবার আত্মসমর্পণ করতে হবে- এটি অশেষ তৃপ্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল খালেদার কাছে। তার প্রয়াত স্বামী বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিয়েছিলেন পাকিস্তানকে পরাজিত করার জন্য। আর তিনি প্রতিশোধ নিতে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর কন্যার বিরুদ্ধে। এটি তার জন্য আরও আনন্দের, কারণ, ১৯৭২ সালে তাকে যেতে হয়েছিল মাথা নিচু করে বঙ্গবন্ধু কন্যার কাছে সাংসারিক সমস্যা মেটানোর জন্য।
যাক, খালেদা জিয়া জনাব শফীর অনুচরদের সে ঘোষণা মনে রেখেছিলেন। তাই সমবেত সমর্থকদের জিজ্ঞেস করেছিলেন তারা ২৪ ঘণ্টা অবস্থান করবেন কীনা। তিনি, খালেদা একটি ঘোরের মধ্যে ছিলেন, তাই হেফাজতের নামটি পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিলেন। তার সহকারী একজন যিনি এখন নেতা তবে প্রাক্তন লাঠিয়াল ও হাইজ্যাকার, তাকে হেফাজতের নাম মনে করিয়ে দিলেন এবং তারপর খালেদা ঘোষণা করলেন, যেহেতু হেফাজত সমাবেশ করবে সেহেতু সরকারকে তাদের দাবি মেনে নেয়ার ৪৮ ঘণ্টা আল্টিমেটাম দেয়া হলো।
আমরা অনেকেই তখন শঙ্কিত। খালেদার ঘোষণার পর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত আমি ও আমার বন্ধুরা সেলফোন কোম্পানির খাতে মোটা টাকা গচ্চা দিলাম। আমরা অনুমান করছিলাম, হেফাজত যে কোনভাবে ঢাকায় ঢুকবে এবং অবস্থান নেবে। ৫ তারিখ সন্ধ্যায় ৪৮ ঘণ্টা পুরো হলে বিএনপি-জামায়াত (হেফাজতেও তারা আছে সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি ও টুপি পরে) মিলিত হবে হেফাজতীদের সঙ্গে। তাদের মিলিত শক্তি পতন ঘটাবে ‘নাস্তিক’ হাসিনার। বিজয়ী হবেন শফী-খালেদার নতুন প্যানেল। দৈনিক জনকণ্ঠে ওইদিনই একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিএনপি নেতাদের সঙ্গে ইতোমধ্যে হেফাজতী নেতাদের আলাপ-সালাপ হয়েছে এবং হেফাজতীদের কোন্ কোন্ মন্ত্রণালয় দেয়া হবে সে সম্পর্কেও আলোচনা হয়েছে। খালেদার মুখে হাসি থাকবে না তো আমাদের থাকবে!
সেদিন রাতে বহুদিন পর খালেদা চমৎকার ঘুম ঘুমিয়েছেন বলে অনেকের অনুমান। আমাদের কেটেছে বিনিদ্র রজনী। সকালে তাই ফোন করে ঘুম ভাঙ্গালেন আমার বন্ধু শাহরিয়ার কবির। শাহরিয়ার সবসময় বিপ্লবী উত্তেজনায় আক্রান্ত এবং প্রায় সময়ই এ কারণে বিনিদ্র রজনী যাপন করেন এবং তার রাতের চিন্তা ও তত্ত্ব সকালে আমাদের কাউকে না কাউকে শুনতে হয়। খুব সকালে ফোন করলে ধরে নিতে হবে, বিপ্লবী চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে সারারাত জেগেছিলেন। দেরিতে ফোন করলে বুঝতে হবে, বয়সের কারণে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আমরাই শাহরিয়ারকে ফোনের কারণ, তার তুলনায় আমি খানিকটা ভীতু। আমি জিজ্ঞেস করলাম, লন্ডনের ভিসা আছে? শাহরিয়ার জানালেন, ভিসা আছে, টিকেট নেই। আমি জানালাম, দু’টার কোনটিই আমার নেই। কী হবে? উদ্বেগের হেতু হিসেবে জানালাম, ৬ তারিখ শফী-খালেদার সরকার হবে। আমাদের তো বাঁচার উপায় নেই। আর ১৪ দলের নেতারা তো সবার আগে পালাবে ২০০১ বা ২০০৬-এর মতো। শাহরিয়ার জানালেন, ভিসা টিকেট থাকলেও তিনি ১৪ দলের নেতাদের মতো আচরণ করবেন না। তিনি জনগণের সঙ্গেই থাকবেন। তাছাড়া এ সরকারের দুঃসময়ে পাশে থাকা নৈতিক কর্র্তব্য। বুঝলাম, তার সঙ্গে আলোচনা চালানো বৃথা। বাস্তব বোঝা তার পক্ষে কঠিন। ১৪ দল বা নির্দিষ্টভাবে আওয়ামী লীগ যে অনেক আগে থেকেই কোটারির বাইরের সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছে এবং পরামর্শ, সাহায্য-সহায়তা যে অনাকাক্সিক্ষত এটি বোঝার ক্ষমতা আমার বন্ধুটি ক্রমেই হারাচ্ছে বলে আমার ধারণা। অবশ্য, এটিও বলি তার কথা কখনও কখনও আবার ঠিকও হয়ে যায়।
আসলে, সব আমলেই আমাদের অবস্থা খারাপ। আমরা বলতে পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী। সংস্কৃতিকর্মী যারা মুক্তিযুদ্ধ ও ১৯৭২ সালের সংবিধানে বিশ্বাসী। বঙ্গবন্ধু আমলে, সম্পত্তি হারানো থেকে মাঝে মাঝে ধাওয়া খাওয়া ছিল আমাদের অনেকের ললাট লিপি। অন্তত আমাদের পরিবারের। জাতীয় পার্টির আমলে প্রায় সময়ই দৌড়াতে হয়েছে, লাঠির বাড়িও পড়েছে পিঠে, হাতে। স্বৈরাচারী ও ব্যভিচারী জেনারেল এরশাদ আমলের একটি দিনের কথা মনে পড়লে দুঃখের মধ্যেও হাসি পায়। অধিক ওজনের জনপ্রিয় নাট্যশিল্পী আলী যাকের হাঁসফাঁস করে দৌড়াচ্ছেন, পিঠে এরই মধ্যে পুলিশের লাঠির একটি বাড়ি খেয়েছেন। তার পাশে থাকা শিল্পী হাশেম খান ও তার পিছে থাকা আমি হাতে লাঠির বাড়ির জ্বালা সামলাতে সামলাতে দৌড়াচ্ছি। ওই আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার রুমে বোমা পেতে রাখা হয়েছিল। অল্পের জন্য বেঁচে যাই। খালেদা জিয়ার প্রথম আমলে মুরতাদ ঘোষিত হই এবং উদ্যমী ছাত্রদল সমর্থকের পিস্তলের গুলি ও আরেকবার তাদের ছোড়া ভারি পাথর থেকে রক্ষা পাই। দ্বিতীয় আমলে অনেকে জেলে যাই, শাহরিয়ার দু’বার। আওয়ামী লীগ আমরা যাই বলি বা যাই করি তাই ধরে নেয়া হয় সরকার বিরোধিতা হিসেবে এবং ১/১১-এর আগে থেকে যারা শেখ হাসিনার জন্য বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় লড়েছেন তাদের সযতনে পরিহার করা হয়। আমি যে শিক্ষাঙ্গনের সঙ্গে যুক্ত তার কথা বলি। গত কয়েক বছর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য পদে (শিক্ষকদের সবচেয়ে আকাক্সিক্ষত পদ) প্রায় ক্ষেত্রে বেছে বেছে তাদেরই নিয়োগ দেয়া হয়েছে যারা সবসময় শেখ হাসিনার ব্যাপারে নিশ্চুপ বা নিষ্ক্রিয় থেকেছেন অথবা বিরোধিতা করেছেন এবং তাদের শিক্ষাগত ও পেশাগত যোগ্যতাও এমন আহামরি কিছু নয়। তবে, মুক্তকণ্ঠে এ কথা বলা প্রয়োজন যে, শেখ হাসিনার আমলেই আমরা নিরাপদ মনে করি। ৬ তারিখের নতুন সরকার নিয়ে তাই ছিল শঙ্কা। কারণ, ইতোমধ্যে আমাদের অনেককে মুরতাদ ঘোষণা করা হয়েছে। ক্ষমতায় এলে তারা মুরতাদদের ক্ষমা করবে এমন ভাবা বোকামি। তবে একজন মুসলমান হিসেবে অন্তিমে নিয়তিবাদী হয়ে বসে থাকি।
আমাদের শঙ্কার, শুধু আমাদের নয় দেশজুড়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষজন ক্রমাগত সরকারের নতজানু নীতিতে হতাশা ও বিরক্ত হয়ে উঠছিল। সরকার নানা কারণে নানা নীতি পারে, কিন্তু, তাই বলে দলও? এ কারণে, বঙ্গবন্ধু দল ও সরকার প্রধান ভিন্ন রেখেছিলেন অন্তত কাগজপত্রে ও প্রকাশ্যে। সরকারপ্রধান ও তার পার্শ্বচররা বার বার হেফাজতের মধ্যে জামায়াত দেখছিলেন। সেটি সত্য কিন্তু হেফাজত যে স্বেচ্ছায় জামায়াতী হয়ে যাচ্ছিল তাও তো সত্য। সরকার প্রধানের মিনতি দেখে এ অনুমান দেখা দিয়েছিল যে, ১৪ দল প্রধান ক্ষমতা হস্তান্তরে প্রস্তুত। তবে, বিএনপিরা নিশ্চিত ছিল, সরকার পতন হচ্ছেই, হেফাজতীরাও। ৫ মে টাকা না পাওয়া হেফাজত কর্মীরা লং মার্চ করে কমিউনিস্টদের মতো জেহাদের বা সরকার উৎখাতের বাসনায় শহরে ঢুকছিল তখন নাকি বিএনপি নেতাদের অনেকে টিপটপ থেকে সদ্য ইস্ত্রি স্যুট আনতে পাঠিয়েছিলেন। টাকা খাওয়া পান খাওয়া ঠোঁট লাল করা হেফাজতী নেতারা এর আগে রোদ-বৃষ্টিতে লং মার্চ করার ভয়ে দাঁড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে আহমাদ শফীকে নিয়ে প্লেনে ঢাকায় পৌঁছেছিলেন। অবশ্য এর কারণও ছিল, সরকার গঠনে তারা দর কষাকষি করেছিলেন। আহমাদ শফীকে প্রেসিডেন্ট করার শর্ত নাকি মেনে নেয়া হয়। যে কারণে, দুপুরে, জানিয়েছেন আমাকে যুবক কমিশনের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম, হেফাজতীরা তার ও অন্য আরও গোটা দশেক গাড়িতে গান পাউডার ছিটিয়ে আগুন দেয়ার সময় গ্যাংনাম স্টাইলে নাচতে নাচতে উল্লসিত হয়ে সেøাগান দেয়- ‘রাষ্ট্রপতি হবে কে, আহমাদ শফী আবার কে?’। ‘শেখ হাসিনার গদিতে আগুন দে, পুড়িয়ে দে’, ‘আমরা হবো তালেবান, বাংলা হবে আফগান।’ রফিকুল ইসলাম ব্যাংক থেকে ধার নিয়ে গাড়িটি কিনেছিলেন এবং হেফাজতীদের সরকারী ভাষ্য অনুযায়ী অরাজনৈতিক ও ঈমানী শান্ত মুসলমান ভেবেছিলেন। গাড়ি পুড়তে দেখে তা মনে করে অনুশোচনায় ভুগছিলেন। হেফাজতী নেতারাও নাকি লন্ড্রি থেকে পাজামা-পাঞ্জাবি ইস্ত্রি করে এনেছিলেন এবং ক্ষমতা নেয়ার সময় টুপি পরবেন না পাগড়ি পরবেন এ নিয়ে নাকি মৃদু দ্বন্দ্বও দেখা দিয়েছিল। এর প্রতিফলন দেখি ৫ তারিখে হেফাজতের জনসভায় যেখানে কিছু নেতার মাথায় ছিল টুপি, কিছু নেতার মাথায় পাগড়ি।

৫ মে সকাল থেকে অধিকাংশ ঢাকাবাসী ছিলেন টেলিভিশনের সামনে। বিদ্যুতায়িত মাধ্যম এখন অতি শক্তিশালী। প্রায়ই আমি এ তত্ত্বটি উল্লেখ করি তা’হলো, বাঙালীরা জেনেটিক্যালি গ-গোলে জাতি এবং তাদের ঝোঁক ডানপন্থার দিকে। আওয়ামী লীগকে ধরা হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। আসলে তা’ নয়। সম্মিলিতভাবে আওয়ামী লীগবিরোধী ভোটের সংখ্যা বেশি। সে জন্য আওয়ামী লীগ নেতারা সবসময় ভোটার নিয়ে চিন্তিত থাকেন বেশি। আওয়ামী লীগেও ডানপন্থার ঝোঁক প্রবল, হেফাজতী ইস্যুতে যা ফুটে উঠেছে। শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বের দু’টি দিক আছে। তার বর্তমান আমলে, সবচেয়ে বেশি নাশকতামূলক ঘটনা ঘটেছে এবং এর পিছে কোন না কোনভাবে বিরোধীদের চক্রান্ত ছিল। এত চক্রান্ত দমন করে টিকে থাকা দুষ্কর। সে কারণে তিনি মানসিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন গুটিকতক নেতা-আমলা ও সেনাবাহিনীর ওপর। তার পৃষ্ঠপোষকতায় যারা নেতা বা ক্ষমতাবান তারা সবাই যোগ্য ও বিশ্বস্ত এমন কথা শেখ হাসিনার একান্ত শুভার্থীরা তার সামনে বললেও, অপ্রকাশ্যে বলেন না। পৃষ্ঠপোষকতায় যারা নেতা হয়েছেন তারা ‘ইয়েস মিনিস্টার’ ছাড়া কোন পরামর্শ দেয়ার সাহস রাখেন না বা নেতা সেই সুযোগও দেন না। শুধু তাই নয়, মধ্যবিত্ত সিভিল সমাজের সঙ্গে তার সম্পর্কও বিচ্ছিন্ন। এ কারণে, তার অবস্থান এখন দুর্বল, যদিও তিনি ভাবেন সবল। এর প্রতিফলন দেখি, আওয়ামী লীগের মিছিলে যেখানে ৫০ জনের বেশি হয় না বা সমাবেশে যেখানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কতজন আসে সন্দেহ। এ দুর্বলতাগুলো তার মতো রাজনীতিবিদ একেবারে অনুভব করেন না তা নয়, কিন্তু উপেক্ষা করেন। তার আমল শেষ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু গ্রেনেড হামলা, দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা, মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলা এখনও শেষ করা গেল না বা রায় কার্যকর হয়ত করা যাবে না। একদিন এজন্য তিনি আফসোস করবেন।
এ দুর্বলতাগুলো পরিস্ফুট হয়েছিল দেখেই বিএনপি-জামায়াত এমনভাবে মাঠে নামার সুযোগ পেয়েছিল। সব গুরুত্বপূর্ণ পদে নারী দেয়াতে চমক থাকতে পারে কিন্তু তা নারীর ক্ষমতায়ন নয়, ভোট আকর্ষণও নয়। মাদ্রাসা আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক নয়। তাদের তোষামোদ করলেও নয়। এ কথা নীতি নির্ধারকরা বিশ্বাস করেন না- এমন এক কল্পনার জগতে তারা বাস করেন। আওয়ামী লীগ আমলে দু’টি প্রতিষ্ঠান লাভবান হয়- এক. মিলিটারি, দুই. ধর্ম (মাদ্রাসা ইত্যাদি)।
আওয়ামী নেতৃত্বের ধারণা এদের সন্তুষ্ট রাখলেই মোক্ষ হাসিল হবে। দু’টি ধারণাই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তুলনামূলকভাবে মাদ্রাসা শিক্ষা যত লাভবান হয়েছে এ আমলে, অন্য কোন আমলে তা হয়নি। শুধু তাই নয়, শিক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের ইতিহাস (১৯৪৭-১৯৭৫) বাধ্যতামূলক না করে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ধর্ম শিক্ষা যা দেশকে আরও মৌলবাদী করবে। এ আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল আহমাদ শফীর কারণে। তিনি প্রতিদান কী দিলেন?
জামায়াতের বিরোধী আরও ‘ইসলামী’ দল আছে যারা একটা পর্যায় পর্যন্ত আওয়ামী লীগ বা ১৪ দলকে সমর্থন দেয়। ইসলামী দল মানেই ইসলামের ব্যবহার। আমাদের এখানে ইসলামী চিন্তার ক্ষেত্রে ধারা দুটি- দেওবন্দী ও বারলেভি। দু’টিই হানাফি ফিকাহ্্ অনুসরণকারী এবং দুটিই বিশ্বাসী তকলিফে ইজতেহাদে নয়। দেওবন্দীরা নবী (স.) অতীন্দ্রয়বাদীতায় বিশ্বাসী নয়। মাজার, মিলাদ পীর প্রভৃতি দেওবন্দী ধারায় বিদ‘আ। তারা পছন্দ করে না বারলেভি, আহমদিয়া, আহলে হাদিস ও শিয়াদের। দেওবন্দীদের প্রতিক্রিয়ায় বারলেভির আহমেদ রেজা খান (১৮৪৪-১৯২১) গড়ে তোলেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআ’ত। তারাও তকলিফে বিশ্বাসী, কিন্তু নবী (স)-এর অতীন্দ্রয়বাদ, মাজার, পীর তারা মানেন। তারাও বিরোধী তবলিগ, আহমদিয়া, আহলে হাদিস, শিয়া ও দেওবন্দীদের। সুতরাং তফাত সামান্য। মওদুদীবাদের সঙ্গে দেওবন্দীদের কী খুব একটা বিরোধ আছে তাত্ত্বিক দিক থেকে? ওই রকম বিরোধ থাকলে কিন্তু হেফাজতীরা জামায়াতী হতো না। আহমাদ শফী অনেক লিখেছেন জামায়াতীদের বিরুদ্ধে, কিন্তু অন্তিমে মওদুদীবাদকেই গ্রহণ করেছেন- এটি মনে রাখা বাঞ্ছনীয়। বরং এখন দেখা যাচ্ছে বারলেভিদের সঙ্গে বরং তাদের বিরোধটা তীব্র। শাসকদের অধিকাংশ বারলেভিপন্থী; তাই তাদের উচিত ছিল দেওবন্দীদের তোষণ করা নয়, কৌশলগত কারণে বারলেভিদের পৃষ্ঠপোষকতা করা- একথা মনে রেখে যে, অন্তিমে এরা কেউ ১৯৭২ সালের সংবিধান বা সেক্যুলার সমাজে রাজি নয়। কিন্তু, তা না করে দেওবন্দীদের অতি তোষণের ফলে আজ এরকম হযবরল অবস্থা। শোনা যায়, মিথ্যাও হতে পারে- সরকার ও বিরোধী দল দুতরফ থেকেই টাকা খেয়েছে হেফাজতীরা।
ইসলামের ইতিহাসে ইয়াজীদ যে ভূমিকা পালন করেছেন, জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের ইতিহাসে সে ভূমিকা পালন করেছেন। বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় তখন মাদ্রাসা থেকে সেক্যুলার ইস্কুলের সংখ্যা ছিল বেশি। জিয়াউর রহমান ইয়াজীদের মতো ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য ইসলাম ব্যবহার শুরু করলেন। আসলে নবী (স)-এর পর থেকেই ক্ষমতায় থাকার জন্য ধর্মের ব্যবহার শুরু, ইয়াজীদ তার একটি পর্যায় মাত্র। সেই থেকে এখন পর্যন্ত সে ধারায়ই চলছে। তবে, জিয়ার কাছে জাতি কৃতজ্ঞ যে, পাকিস্তানীদের মতো তিনি সবার লুঙ্গি পরীক্ষা করে মুসলমানি করাননি। পাকিস্তানীরা আমাদের মুসলমানত্ব দেখার জন্য ওই পর্যন্তও যেত। ভিকারুননিসা নূন যখন গবর্নর পতœী তখন তার নামাঙ্কিত স্কুলের নামকরণ করতে এসে বলেছিলেন, বাঙালীরা খতনাও করে না, সুতরাং তারা মুসলমান না। পরের দিন পোস্টার পড়েছিল তার সাহসের প্রশংসা করে যে, তার মতো একমাত্র পাঞ্জাবি মহিলাই পারে এতজনের মুসলমানত্ব পরীক্ষা করতে। এরপর থেকে মুসলমানত্ব সম্পর্কে তার যাবতীয় বাতচিত বন্ধ হয়ে যায় এবং এর কিছুদিন পরই ওই দম্পতি ঢাকা ত্যাগ করেন। আসলে এই স্কুলের নামটি বদল হওয়া উচিত। যিনি বাঙালীর খতনায় বিশ্বাসী নন তার নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম থাকা বাঞ্ছনীয় নয়।
যাহোক, জিয়া-এরশাদ ইসলামের নামে খুন-জখম-লুট-ব্যভিচার কিছুই বাদ রাখেননি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ এতে রক্ষণাত্মক ভূমিকা গ্রহণ করে। তারা যে মুসলমান এটি বিএনপি ও জাতীয় পার্টি বা জামায়াতের কাছে পরীক্ষা দেয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে। এভাবে ব্যবহারকারী ও যারা ধর্মকে ব্যবহার করতে চায় না, দু’পক্ষই ধর্মকে স্পেস ছেড়ে দিতে লাগল, সঙ্কুচিত হয়ে গেল ধর্ম-সহিষ্ণুতা বা ধর্মনিরপেক্ষতার জায়গাটা। আমরা কখনও চ্যালেঞ্জ করে বলিনি, যারা আমাদের ধর্ম সম্পর্কে প্রশ্ন তোলে তারাই ধর্মবিরুদ্ধ, তারাই ধর্মদ্রোহী।
এই স্পেস ছেড়ে দেয়ার ফলে চারদিকে শুধু ধর্ম শিক্ষা নিয়ে আলোচনা। পাকিস্তান আমলে যা ছিল না বাংলাদেশ আমলে তা দেখা গেল। বিদ্যুতায়িত মাধ্যমে প্রতিদিন ধর্ম শিক্ষা, রোজার দিন পারলে সারাদিন, কাগজে ধর্ম শিক্ষা, স্কুলে বাধ্যতামূলক ধর্ম শিক্ষাÑ এসব কিছু আমাদের অজান্তে আমাদের মানসিকতায় মৌলবাদের স্পেস করে দিচ্ছে। একটি উদাহরণ দেই। সাংবাদিকরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক সাহসী ভূমিকা রেখেছেন, ইতিবাচকও, কিন্তু বিরাট সংখ্যক সাংবাদিক জেনে না জেনে যা করেছেন গত ফেব্রুয়ারি থেকে, তা হেফাজতীকেই তুলে ধরেছে বা মৌল জঙ্গীবাদকে উজ্জীবিত করছে। হেফাজতের দু’টি সমাবেশই লাইভ ব্রডকাস্ট করা হয়েছে। আহলে সুন্নতের নয়, যদিও তাদের সমাবেশও কম বড় ছিল না। মহিলাদের বড় সমাবেশ হয়েছে মফস্বলে হেফাজতীদের বিরুদ্ধে, সেটিও গুরুত্ব পায়নি। বিভিন্ন টকশোতে হেফাজতীদের এনে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দেয়ানো হয়েছে। ভারসাম্যের নামে মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধীদের সম্পর্কে মিথ্যা তথ্যের বয়ান করা হয়েছে। ৫ মে, ঢাকার উপকণ্ঠ থেকে এক সাংবাদিক আবেগাপ্লুত কণ্ঠে জানালেন, দলে দলে তৌহিদী জনতার সমাবেশ ঘটছে। মনে হচ্ছিল পারলে তিনিও সেখানে যোগ দেন। ওই সাংবাদিক ‘তৌহিদে’র মানে জানেন কী না সন্দেহ। আরেক সাংবাদিক জানালেন, ‘লাখো কোটি’ মানুষের সমাবেশ হচ্ছে উপকণ্ঠে। বিশ্বাসযোগ্য? ‘৭১-এর মতো টিভি, সবার মতে যা ’৭১-এ বিশ্বাসী, তাদের সাংবাদিক জানালেন, ঝাঁকে ঝাঁকে বুলেট ছোড়া হয়েছে। ঝাঁকে ঝাঁকে বুলেট ছুড়লে মৃতের সংখ্যা হতো কতো? একই দিনে বিএনপির এক পাতি নেতা, যাকে প্রায় বিভিন্ন টকশোতে আনা হয়, তিনি বিজ্ঞের মতো জানালেন ১ কোটি মানুষের সমাবেশ হয়েছে। তিন মিটারে আটে দুজন। যদি আয়তন এক লাখ মিটারও হয় আটে কয়জন? এদের সঙ্গে বাহাস করতে যান আওয়ামী লীগ নেতারা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষজন। লজ্জার ব্যাপার আমাদের জন্য যে, ৪২ বছর পর মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল কিনা, যুদ্ধাপরাধী আছে কিনা তা নিয়ে আমাদের বাহাস করতে হবে। এ ভাবে, আমরা সবাই মিলে বিএনপি-জামায়াত হেফাজতী ও অন্য ধর্ম ব্যবসায়ীদের জায়গা ছেড়ে দিয়েছি এবং এ কাজগুলো করছে সমাজে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের হিসেবে পরিচিত টিভি চ্যানেলগুলো। বিরোধীরা এ ভাবে জায়গা ছেড়ে দেয় না। এখন কে যে জামায়াতী পয়সা খাচ্ছে না, আর কে খাচ্ছে, বলা দুষ্কর।
হেফাজতী যখন আমাকে, শাহরিয়ার বা জাফর ইকবালকে মুরতাদ বলে তখন আমাদেরও বলা উচিত তারা মুসলমান কিনা সেটা আমাদের ভেবে দেখতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কাউকে নাস্তিক বললে, যে বলে তাকেও নাস্তিকই বলতে হবে। আহমাদ শফী বা তার দলের নেতারা যখন শেখ হাসিনার মতো ধর্মপ্রাণ মহিলাকে নাস্তিক বলেন এবং বলেন, কেবিনেটের ১৩ জন নাস্তিক তখন তাদের ধরে এনে বলা উচিত, তুমি যে আস্তিক প্রমাণ দাও। খালেদা জিয়ার মধ্যে এসব বদমায়েশগুলো আস্তিকতার চিহ্ন খুঁজে পায়, তাকে বোরখা না পরিয়ে এমনি অবলোকন করতে চায়, আর অন্য পক্ষের হলে নাস্তিক। এ চক্র থেকে আমাদের বেরুতে হবে।
যখন জামায়াত ও হেফাজত খালেদা জিয়ার মধ্যে ইসলাম খুঁজে পায় আর শেখ হাসিনার মধ্যে হিন্দুত্ব খুঁজে পায় তখন প্রকাশ্যে বলার সময় এসেছে, এরা ইসলাম দূরের কথা ধর্মপ্রাণও নয়। মতলবি লোকজন শ্বাপদের মতো শিকারের খোঁজে বেরিয়েছে। হেফাজতের প্রত্যেক নেতাকে সাংবাদিকদের জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল, তারা মক্কার হারাম শরীফ মানেন কিনা? সেখানে নামাজ পড়া সওয়াব কিনা? সেখানে মেয়ে- পুরুষ গাদাগাদি করে নামাজ পড়ে সেটি জায়েজ কিনা? আমি সেখানে সোমালীয় ও ইন্দোনেশীয় মহিলাদের ধাক্কায় কয়েকবার ভূপাতিত হয়েছি। আল্লাহর ঘরে মহিলা-পুরুষ এক সঙ্গে নামাজ পড়লে গুনাহ্্ হয় না আর বাংলাদেশী আহমাদ শফী নামে এক মাদ্রাসা শিক্ষক বললেন, নারী পুরুষ এক সঙ্গে কাজ করতে পারবে না- সেটি কী ভাবে ঠিক? এই লোক কি আল্লার ওপর খোদকারি করতে চায় (নাউজিবিল্লাহ)?
আমরা এসব প্রশ্ন না করে হুজুর হুজুর করি। আমাদের লজ্জা হওয়া উচিত। সাংবাদিকরা হেফাজতীকে অনেক বড় করে দেখিয়ে, তাদের এসব বিষয় না তুলে এনে এক ধরনের অন্যায় করেছেন। হেফাজতীদের মার খেয়েও শিক্ষা হয়নি প্রথমবার। লক্ষ্য করবেন, তারা যেসব চ্যানেলের সাংবাদিকদের ওপর হামলা করেছে তারা অধিকাংশ সময় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ হয়ে কাজ করেÑ মালিকানা একেবারে জামায়াত-বিএনপি ঘেঁষা নয়। সৎ সাহস থাকলে সাংবাদিকদের বলা উচিত হেফাজতকে আর মিডিয়া প্রচার দেয়া যাবে না। হ্যাঁ, যাবে যদি তাদের অপকর্মগুলো প্রচার করা হয়।
এখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তির বলা উচিত আমরা আর এক ইঞ্চি জমিও ছাড়ব না। প্রয়োজনে সবাই মিলে যৌথ ফ্রন্ট করা উচিত এবং সে আহ্বান আসা উচিত এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে শেখ হাসিনার কাছ থেকে। শেখ হাসিনা যেমন একলা নিরাপদ নন- অন্যরাও একা নিরাপদ নন। একথা আর কেউ না বুঝুক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম নিশ্চয় বুঝছেন।
৫ মে যে মুহূর্তে হেফাজতকে ঢাকায় সমাবেশ করার অনুমতি দেয়া হলো সে মুহূর্তে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীসহ সিভিল সমাজের তাদের সমর্থকরা প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এতটা নতিস্বীকার তাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল। অনেকে এও বলেছিলেন, আওয়ামী লীগকে আর সমর্থন করা যায় না। এবং সেটি অস্বাভাবিক কিছু নয়। এরপর হেফাজতী তা-ব।
হেফাজতী তা-বের একটি প্যাটার্ন লক্ষ্য করুন। ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে জামায়াতীরা বিভিন্ন জায়গায় যে তা-ব করেছে হেফাজতের তা-বও সে রকমÑ গাছ কেটে ফেলা, ডিভাইডার ভেঙ্গে ফেলা, গাড়িতে, দোকান-পাটে আগুন, বোমা ও ককটেল ছুড়ে মারা; বিশেষ করে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের মৃত্যু নিশ্চিত করা। তারাও ছিল অস্ত্রসজ্জিত, না হলে নিরাপত্তারক্ষীদের মৃত্যু হলো কিভাবে? ঐ দিন রাত পর্যন্ত যাঁরা এ দৃশ্য দেখেছেন, তাঁদের অনেকে বলেছেন, এ রকম ঘটনা বাংলাদেশে আর ঘটেনি। আসলে তরুণ প্রজন্মের সদস্য সংখ্যা বেশি, তাই তাদের কাছে এটি ভয়ানক মনে হচ্ছে। না এর আগেও দু’বার এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে ১৯৭১ সালের পর। ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু ও পরে ইয়াজিদ জিয়ার নেতৃত্বে জাতীয় চার নেতা ও কয়েক হাজার সৈন্যকে হত্যা ছিল ১৯৭১ সালের পর সবচেয়ে বড় হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনা।
২০০৪ সালে বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউতে গ্রেনেড হামলা ছিল আরো ভয়াবহ। কারণ রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে মন্ত্রী ও প্রশাসন মিলে গ্রেনেড ছুড়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যে ২৭ জনকে হত্যা করে।
এরপর ৫ মের ঘটনা। তুলনামূলক হিসেবে নিহত কম। প্রথমটি যিনি ঘটান বলে সবার অনুমান তিনিও বিএনপি সৃষ্টি করেন। গ্রেনেড ঘটনা ঘটায় বিএনপি-জামায়াত মিলে। ৫ মে’র ঘটনা ঘটিয়েছে হেফাজত-জামায়াত-বিএনপি মিলে। এবং প্রতিটি ঘটনা ঘটানো হয়েছে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। এর অর্থ একটি। সেটি হলো শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে থাকতে পারবে না। হ্যা, যদি পাকিস্তান তারা মেনে নেয় তাহলে তাদের থাকতে দেয়া যাবে। গত ৩৫ বছরে আমাদের জায়গা ছেড়ে দিতে দিতে আজ তারা এ দুঃসাহস দেখাতে পারছে। হেফাজতকে যাঁরা অরাজনৈতিক বলতেন তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নয়। যে সব মন্ত্রী বারবার বলেছেন, হেফাজতে বিএনপি- জামায়াত ঢুকে নাশকতা চালিয়েছে তাঁরাও মানুষকে বিভ্রান্ত করেছেন। তাঁরা হেফাজতের দোষ ঢাকতে চেয়েছেন। এসব রাজনৈতিক কৌশল যে ভ্রান্ত, হেফাজত তা প্রমাণ করেছে। হেফাজত প্রথম থেকে রাজনৈতিক কথা বলে আসছে। হেফাজতের আমির ছিলেন পাকিস্তানের পক্ষেÑ এ কথাটা মনে রাখা জরুরী। তারা এতদিন নীরব ছিল, এখন সরব হয়েছে মাত্র। তথাকথিত আল্লামা সাঈদীর জায়গা নিয়েছেন আল্লামা আহমেদ শফিÑ তফাত এটুকুই মাত্র। হেফাজতের সব দাবিতে যদি রাজনৈতিক মতলব না থাকত বা যৌক্তিক হতো তাহলে তারা বিএনপির ১৮ বছর রাজত্বে সেগুলো তুলল না কেন? এমনকি জামায়াত-বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে কেন ব্ল্যাসফেমি আইনের কথা তোলা হলো না? কেন সাঈদীর বা কাদের মোল্লার রায়ের পর জামায়াতের মতো হেফাজতীরা দাবি তুলে আন্দোলন শুধু নয় সরকার উৎখাতের আহ্বান জানায়? সরকার উৎখাতের দাবি ও ৬ তারিখে সরকার গঠনের দাবি কি রাজনৈতিক না অরাজনৈতিক?
হরতালের সময় জামায়াত-বিএনপি প্রথমে ককটেল ছুড়ে মারে, তারপর গাড়িতে আগুন লাগায়। এবং ভাংচুর করতে হলে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের প্রতিষ্ঠানে ভাংচুর চালায়। তাদের লক্ষ্য অর্থনীতি পঙ্গু করে দেয়া। শেখ হাসিনার আমলের প্রবৃদ্ধি তারা গ্রহণ করতে পারছে না। এই পাকিস্তানীমনা লোকগুলোর মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ পাকিস্তানকে ডিঙ্গিয়ে যাবেÑ তা হতে পারে না। পাকিস্তান ব্যর্থ রাষ্ট্র হলে বাংলাদেশকেও ব্যর্থ রাষ্ট্র হতে হবে। লক্ষ্য করুন, হেফাজত জনতা ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংকে আগুন দিয়েছে। ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ ব্যাংক, ইবনে সিনা ট্রাস্টে নয়। জামায়াত-বিএনপির কাছে ক্রেডিবিলিটি তারা তাদের তুলে ধরতে চেয়েছে, আলেমদের একাংশ ও পত্রপত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী আহমেদ শফির চেলারা প্রচুর টাকা খেয়েছে। সুতরাং যারা টাকা দিয়েছে তাদের কাছে নিজেদের যোগ্যতা তুলে ধরতে হয়। তারা যদি জামায়াতবিরোধী হতো তা হলে জনতা, সোনালী, ব্র্যাক বা গৃহঋণ সংস্থায় আগুন নয়, ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ বা ইবনে সিনাতেও আগুন দিত। তারা জামায়াত-বিএনপি পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি করতে চায়নি। তারা চেয়েছে বিরুদ্ধ পক্ষ এবং পরিণামে বাংলাদেশের যাতে ক্ষতি হয়, যাতে তারা ভিক্ষুক হয়ে যায়। এখানে বিএনপি জামায়াত নেতাদের একটি প্রশ্ন করতে চাইÑ যদি এখন ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনার মতো প্রতিষ্ঠানগুলো মুক্তিযুদ্ধবিরোধী মালিকদের টেলিভিশন অফিস ও অর্থ প্রতিষ্ঠান একই রকম হামলার শিকার হয় তারা বুঝতে পারছেন অবস্থা কী হবে? যদি বেছে বেছে খোকা, মওদুদ ও জামায়াতী নেতাদের গাড়ি টার্গেট করা হয় তখন কী হবে? ধরা যাক, শেখ হাসিনার বদলে বিএনপি ও হেফাজতীরা ক্ষমতায় এলো। পরদিন থেকে ১৪ দল ও সমমনারা যদি একই কাজ করে, ক্ষমতায় থাকতে পারবেন? অর্থনীতি যদি একেবারে ভেঙ্গে পড়ে তাহলে ক্ষতায় থাকা যাবে? সুস্থমনা বা গণতান্ত্রিক রাজনীতি করতে চাইলে এ ধরনের কর্মকা- কেউ করত না। কিন্তু বিএনপি, এরশাদ, জামায়াত আমলে তো গুন্ডারাজই প্রতিষ্ঠিত হয়; সুতরাং তারা এ ধরনের বিকৃত রাজনীতি করবে তাই স্বাভাবিক। ৫ মে’র সমাবেশের ইতিবাচক দিক হলো হেফাজতীরাও যে বিকৃতমনা, অসুস্থ রাজনীতির বাহক সেটি প্রমাণিত হলো।
দুপুর পর্যন্ত ঢাকার মানুষরা ভেবেছিলেন সত্যিই হেফাজতীরাজ বোধহয় প্রতিষ্ঠিত হলো। বিএনপি সন্ধ্যার জন্য অপেক্ষা করছিলÑ যখন তারাও যোগ দেবে হেফাজতীদের সঙ্গে। খালেদা জিয়ার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বোঝা গিয়েছিল, পুরো বিষয়টি পরিকল্পিত এবং কেন ৩ মে বেগম জিয়া এত উৎফুল্ল ছিলেন তাও স্পষ্ট হলো। সে প্রসঙ্গ পরে।
অনেকে বলছেন, হেফাজতীরা ভাড়া করা এতিম তালেবএলেমদের দিয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সেøাগান দেওয়াচ্ছিলেন। সেøাগানটি ছিল ‘শেখ হাসিনার গালে গালে জুতা মার তালে তালে’।
মাদ্রাসার ছাত্রদের তাহজীব-তমুদ্দুন শেখাবার বদলে এইসব বেয়াদবি শিক্ষা দিচ্ছে বাবুনগরীরা। একজন ধর্মপ্রাণ বয়সী মহিলার নামে এই সেøাগান সভ্যতার কোন নিরিখে পড়ে না। হে বাবুনগরী, আহমেদ শফির নামে এ সেøাগান দিলে ভালো লাগবে? না, এ বেয়াদবি সেক্যুলার উদারপন্থীরা করে না। এসব বেয়াদবি শিক্ষা দেয়া হয় বাবুনগরীদের মাদ্রাসায়। এই সব সেøাগানের কারণে শেখ হাসিনা ক্রুদ্ধ হয়ে হেফাজতীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেন। তিনি ক্রুদ্ধ হতে পারেন, কিন্তু এই কারণে হেফাজতীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন এমন মহিলা তিনি নন। রাজনীতি করলে অনেক কিছু সহ্য করতে হয়। ১৯৭৫ সালের পর থেকে যন্ত্রণার যে স্টিমরোলার তাঁর ওপর দিয়ে গেছে, অন্য কারো পক্ষে তা সহ্য করা দুঃসহ হয়ে উঠত।
অনেকের মতে, আওয়ামী লীগ অফিসে ঘণ্টা কয়েকের মধ্যে বহুবার হামলা হেফাজতীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কারণ এটি একটি সামান্য কারণ হতে পারে বটে, তবে মূল কারণ নয়। হেফাজতীদের মতো উঠতি একটি দল আওয়ামী লীগ অফিস বারবার আক্রমণ করবে এবং সরকার আগের মতো নিশ্চুপ থাকবেÑ তাহলে দলই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে। হতাশা আরো বাড়বে। তারপরও বলব এটি মূল কারণ নয়। মূল কারণ, হেফাজতী-জামায়াতী-বিএনপিরা এমন তা-ব সৃষ্টি করছিল যাতে মনে হচ্ছিল, এ সরকার কার্যত আর নেই। দুই-তৃতীয়াংশের বেশি ভোটে নির্বাচিত একটি সরকার তা মেনে নিতে পারে না। তাদের ব্যবস্থা নিতে হয়। তাছাড়া জনগণের জানমাল রক্ষা করাও সরকারের অন্তিম দায়িত্ব।
ইতোমধ্যে হেফাজতী-জামায়াতী-বিএনপিরা বায়তুল মোকাররমের ধর্মীয় বইয়ের দোকানগুলো আক্রমণ করে। গত ৪২ বছরে অনেক দুর্যোগেও এসব ক্ষুদ্র দোকানের ওপর কখনও হামলা হয়নি। কারণ এসব দোকানে কোরান, আমপারা, তসবি, জায়নামাজ, টুপি, আতর বিক্রি হয়। হেফাজতী-জামায়াতী-বিএনপি (সংক্ষেপে এরপর থেকে হেজাবি) যখন দোকানগুলো আক্রমণ করতে যায় তখন ক্ষুদ্র দোকানদাররা বারবার মিনতি করছিল। ইয়াজিদের বরপুত্ররা তা শোনেনি। রসুল (স.)-এর নাতিদের হত্যায় ইয়াজিদের মন কাঁপেনি, আর ইয়াজিদের পুত্রদের হাত কাঁপবে? বরং কোরান-হাদিস যাতে ভালো করে আগুনে পোড়ে সে জন্য গান পাউডার ছড়িয়ে আগুন দেয়া হয়। নিমিষে ৬৩৫ জিল পবিত্র কোরান পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ভস্মীভূত হয় অন্যান্য বই ও সামগ্রী। ক্ষতির পরিমাণ এক কোটিরও বেশি। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্ব দেখল হেজাবিরা ধর্মগ্রন্থ কিভাবে পোড়ায়। পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় পাপ ধর্মগ্রন্থ পোড়ানো। নাস্তিক হওয়াও এত বড় পাপের মধ্যে পড়ে না। এক হিন্দু ভদ্রলোক বলছিলেন, ভাই, মুসলমান না হতে পারি; কিন্তু কোরান তো পবিত্র ধর্মগ্রন্থ, সেটিতে আগুন দিতে বুক কাঁপল না! ধর্মগ্রন্থ পোড়ানো দেখে তাঁর চোখে পানি। একজন বলেছিলেন, যে ইসরাইল ও ইহুদীদের অধিকাংশ মুসলমান রাষ্ট্র ঘৃণা করে তারাও কখনও কোরান পোড়ায়নি।
অনেকে বলছেন, হেফাজতীরা ভাড়া করা এতিম তালেবএলেমদের দিয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সেøাগান দেওয়াচ্ছিলেন। সেøাগানটি ছিল ‘শেখ হাসিনার গালে গালে জুতা মার তালে তালে’। মাদ্রাসার ছাত্রদের তাহজীব-তমুদ্দুন শেখাবার বদলে এইসব বেয়াদবি শিক্ষা দিচ্ছে বাবুনগরীরা। একজন ধর্মপ্রাণ বয়সী মহিলার নামে এই স্লোগান সভ্যতার কোন নিরিখে পড়ে না। হে বাবুনগরী, আহমেদ শফির নামে এ সেøাগান দিলে ভালো লাগবে? না, এ বেয়াদবি সেক্যুলার উদারপন্থীরা করে না। এসব বেয়াদবি শিক্ষা দেয়া হয় বাবুনগরীদের মাদ্রাসায়। এই সব সেøাগানের কারণে শেখ হাসিনা ক্রুদ্ধ হয়ে হেফাজতীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেন। তিনি ক্রুদ্ধ হতে পারেন, কিন্তু এই কারণে হেফাজতীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন এমন মহিলা তিনি নন। রাজনীতি করলে অনেক কিছু সহ্য করতে হয়। ১৯৭৫ সালের পর থেকে যন্ত্রণার যে স্টিমরোলার তাঁর ওপর দিয়ে গেছে, অন্য কারো পক্ষে তা সহ্য করা দুঃসহ হয়ে উঠত।
অনেকের মতে, আওয়ামী লীগ অফিসে ঘণ্টা কয়েকের মধ্যে বহুবার হামলা হেফাজতীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কারণ এটি একটি সামান্য কারণ হতে পারে বটে, তবে মূল কারণ নয়। হেফাজতীদের মতো উঠতি একটি দল আওয়ামী লীগ অফিস বারবার আক্রমণ করবে এবং সরকার আগের মতো নিশ্চুপ থাকবে- তাহলে দলই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে। হতাশা আরো বাড়বে। তারপরও বলব এটি মূল কারণ নয়। মূল কারণ, হেফাজতী-জামায়াতী-বিএনপিরা এমন তা-ব সৃষ্টি করছিল যাতে মনে হচ্ছিল, এ সরকার কার্যত আর নেই। দুই-তৃতীয়াংশের বেশি ভোটে নির্বাচিত একটি সরকার তা মেনে নিতে পারে না। তাদের ব্যবস্থা নিতে হয়। তাছাড়া জনগণের জানমাল রক্ষা করাও সরকারের অন্তিম দায়িত্ব।
ইতোমধ্যে হেফাজতী-জামায়াতী-বিএনপিরা বায়তুল মোকাররমের ধর্মীয় বইয়ের দোকানগুলো আক্রমণ করে। গত ৪২ বছরে অনেক দুর্যোগেও এসব ক্ষুদ্র দোকানের ওপর কখনও হামলা হয়নি। কারণ এসব দোকানে কোরান, আমপারা, তসবি, জায়নামাজ, টুপি, আতর বিক্রি হয়। হেফাজতী-জামায়াতী-বিএনপি (সংক্ষেপে এরপর থেকে হেজাবি) যখন দোকানগুলো আক্রমণ করতে যায় তখন ক্ষুদ্র দোকানদাররা বারবার মিনতি করছিল। ইয়াজিদের বরপুত্ররা তা শোনেনি। রসুল (স.)-এর নাতিদের হত্যায় ইয়াজিদের মন কাঁপেনি, আর ইয়াজিদের পুত্রদের হাত কাঁপবে? বরং কোরান-হাদিস যাতে ভালো করে আগুনে পোড়ে সে জন্য গান পাউডার ছড়িয়ে আগুন দেয়া হয়। নিমিষে ৬৩৫ জিল পবিত্র কোরান পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ভস্মীভূত হয় অন্যান্য বই ও সামগ্রী। ক্ষতির পরিমাণ এক কোটিরও বেশি। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্ব দেখল হেজাবিরা ধর্মগ্রন্থ কিভাবে পোড়ায়। পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় পাপ ধর্মগ্রন্থ পোড়ানো। নাস্তিক হওয়াও এত বড় পাপের মধ্যে পড়ে না। এক হিন্দু ভদ্রলোক বলছিলেন, ভাই, মুসলমান না হতে পারি; কিন্তু কোরান তো পবিত্র ধর্মগ্রন্থ, সেটিতে আগুন দিতে বুক কাঁপল না! ধর্মগ্রন্থ পোড়ানো দেখে তাঁর চোখে পানি। একজন বলেছিলেন, যে ইসরাইল ও ইহুদীদের অধিকাংশ মুসলমান রাষ্ট্র ঘৃণা করে তারাও কখনও কোরান পোড়ায়নি। এমনকি নাসারাদের দেশ আমেরিকার মৌলবাদী এক নাসারা কোরান পোড়ানোর হুমকি দেয়ায় স্বয়ং বারাক ওবামা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছিলেন। কওমিরা কেমন মুসলমান তা প্রমাণিত হলো। হেজাবিরা আমাদের মুসলমানত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলে। কোরান পোড়ানোর অথর্, তারা আর ইসলাম মানে না। আমরা ধর্ম থেকে কী খারিজ হব, এখন বাবুনগরী ও কওমি ও হেজাবিদের প্রমাণ করতে হবে তারা আদৌ ধর্মে বিশ্বাস করে কিনা? তারা শাহবাগের তরুণদের নাস্তিক বলে, কিন্তু এখন প্রমাণ হলো তারা কোরান পোড়ানো নাস্তিক। এক দোকানদার চিৎকার করে বলছিলেন (টিভি ফুটেজ) -এরা ‘আল্লাহর শত্রু’ এরা ধর্মের শত্রু, এরা নবীর (স.) শত্রু। এ কথার যৌক্তিকতা উড়িয়ে দেয়া যায় না। এক তরুণ বিক্রেতাও বলেছিলেন, শফির গুন্ডারা এ কাজ করেছে অর্থাৎ হেজাবিরা। আল্লামা নয়, হজরত নয়, মৌলানা নয় একেবারে শফি। যে সম্মান অর্জন করতে জনাব শফির লেগেছে ৭০/৮০ বছর। এক নিমিষে তা ধুলায় লুটাল। আল্লাহ্ বান্দাকে নানাভাবে পরীক্ষা করেন। আমরা অধিকাংশ সাধারণ বান্দা তাতে পাস করতে পারি না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ক্ষমতার মোহে আহমেদ শফিও অন্ধ হয়ে গেলেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাহিনী কোরান পুড়িয়েছিল। গত ফেব্রুয়ারি থেকে বিএনপির সহযোগী জামায়াতীরা কোরান ও জয়নামাজ পোড়ানো শুরু করে, মসজিদে আগুন লাগানো শুরু করে। বিএনপিও তা পরিপূর্ণভাবে সমর্থন করে। হেজাবিরাও এখন তা করল। আরো নির্দিষ্টভাবে বলতে হয়, হেফাজতের নির্দেশে হেজাবিরা কোরান পোড়ল।
এখানেই শেষ নয়, এরপর এরা বায়তুল মোকাররমের সোনার ও অন্যান্য দোকানে আগুন লাগায়, লুট করে। প্রমাণিত হলো হেজাবিরা কোরান পোড়ায়, আগুন লাগায় ও লুট করে। যদি কার্যকর কোন সরকার থাকে তাহলে এ পরিপ্রেক্ষিতে তাকে ব্যবস্থা নিতে হয়। সরকারও সে ব্যবস্থা নিয়েছে। আওয়ামী লীগও ব্যবস্থা গ্রহণের পক্ষ নেয়। বিকেলে সৈয়দ আশরাফুলের বক্তব্যে অধিকাংশ মানুষ চমৎকৃত ও বিস্মিত হয়। অনেকে বিস্মিত হয়ে বলেন, দেশের এ অবস্থা দেখে আশরাফুল ও আর ঘুমোতে পারেননি। অধিকাংশ আওয়ামী লীগ নেতা বক্তব্যের বদলে প্যান প্যান করেন। আশরাফুল মাপা কথায়, ঠাণ্ডা গলায় যেভাবে বক্তব্য দিলেন, তাতে প্রাণ খুলে তাঁকে অভিনন্দন জানাতে হয়। রাজনৈতিক মারপ্যাঁচের কথা তিনি বলেননি। যে রকম কথা আমরা পছন্দ করি, সরাসরি সে রকমই বলেছেন। মূল বক্তব্য- হেফাজতীদের আর ঢাকায় আসতে দেয়া হবে না। বাড়াবাড়ি করলে বাড়ি থেকে বেরুতে দেয়া হবে না। যারা এসব করছে তারা রাজাকার, রাজাকারের বাচ্চা। মুহূর্তে দৃশ্যপট পাল্টে যায়। দেশের যাবতীয় সেলফোন ব্যস্ত হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ সরকারের নমনীয়তার কারণে যারা বিমষর্, হতাশ হয়ে মুষড়ে পড়েছিল তারা নিমিষে চাঙ্গা হয়ে ওঠে। তবে সংযম দেখায়। চাঙ্গা হয়ে যদি তারা রাস্তায় নামত তাহলে হেজাবিদের খবর ছিল। সাদেক হোসেন খোকাকে ১৯৭২ সালের মতো, মওদুদ আহমেদকে ১৯৯০ সালের মতো দৌড়াতে হতো। আশরাফের বক্তব্য অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাকি কাজ সম্পন্ন করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ‘ধাক্কাতত্ত্ব’ দিয়ে যে জমি হারিয়েছিলেন, ৬ মে সকালে সে জমি পুনরুদ্ধার করেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম এত বড় একটি অভ্যুত্থান বিনা রুক্তপাতে দমন করা হলো।
লন্ড্রি থেকে কাপড়চোপড় এনে, খোশ দিলে বিরিয়ানি খেয়ে বাবুনগরী, জুনায়েদীরা গাড়ি করে দ্বিপ্রহরে শাপলা চত্বরে পৌঁছান। অন্যদিকে, এতিমখানা ও মাদ্রাসা থেকে, ঢাকা শহরে দেখানো, ক্ষমতায় গেলে তারা যা খুশি করতে পারবে, ইসলাম কায়েমের তারা হবে সেনানি- এসব প্রলোভন দেখিয়ে আনা তালেবএলেমরা রৌদ্র বৃষ্টি উপেক্ষা করে দীর্ঘ পথ হেঁটে শাপলা চত্বরে পৌঁছায়। গতবার তাদের জন্য বিরিয়ানি, ফল-মূল, পানি ছিল। এখন সে সব কিছু না দেখে তারা ক্ষুব্ধ হয়। বিরিয়ানি খেয়ে পান চিবুতে চিবুতে বাবুনগরীরা তালেবএলেমদের শহীদ হওয়ার আহ্বান জানায় বার বার। নাস্তিক সরকারকে উৎখাত করে হয় তারা শহীদ হবে নয় গাজী হবে। একদিকে বাবুনগরীদের নির্দেশে শহরের একদিকে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হচ্ছিল অন্যদিকে তারা প্রায় লাখখানেক লোক মজুদ রাখছিলেন রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে। কিন্তু, সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, শহরের অন্যপ্রান্তে আমি রাত ৯টা পর্যন্ত ঘুরে দেখেছি, দোকানপাট খোলা, রাস্তাঘাটে মানুষজন, সব স্বাভাবিক। এর অর্থ কি এই যে, শহরের অনেকে এই সব নিয়ে চিন্তিত নন? পুরো বিষয়টিই কিন্তু কেমন অস্বাভাবিক ঠেকেছে।
সৈয়দ আশরাফের ঘোষণার পর সুর করে বাবুনগরীরা বলতে থাকেন, ‘আশরাফ আগামীকাল কোন্ পথ দিয়ে পালাবে তা ঠিক করো।’ হেজাবিরা তো নিশ্চিত যে, তারা ক্ষমতায় যাচ্ছে। তাই ক্ষমতার দম্ভে নানা ধরনের উপহাস করছিলেন। এবং বাচ্চা ‘জেহাদী’দের উন্মত্ত করে গাছ কাটা, ফুটপাথ তুলে ফেলা, ল্যাম্পপোস্ট উপড়ে ফেলার কাজে লাগাচ্ছিলেন। খেলায় যাকে ওয়ার্ম আপ বলে সে রকমভাবে নিরাপত্তা রক্ষীদের বিরুদ্ধে ‘লড়াই’ করার জন্য তাদের প্রস্তুত করছিলেন।
পুলিশ হেজাবিদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার অনুমতি দিয়েছিলেন এবং বিকেল পাঁচটার মধ্যে তাদের স্থান ত্যাগ করতে বলেছিলেন। এই শর্ত মেনে চুক্তিপত্র করেই হেজাবিরা সমাবেশ করছিলেন। যাঁরা কোরান পোড়ায় তাদের কাছে কথার বরখেলাপ কোন ব্যাপারই নয়। এবং ঠিকই দেখা গেল, হেজাবি নেতারা ঘোষণা করলেন, তাঁরা নড়বেন না। তাদের আল্লামা শফীর বক্তব্য না শুনে তারা নড়বেন না। আমরা যা অনুমান করছিলাম তাই ঠিক হলো। শুধু সমাবেশ নয়, তাঁরা চারদিকে তখনও আগুন লাগাচ্ছিলেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যেভাবে পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করেছিল হেজাবিরাও তাই করেছিলেন। হেজাবিদের প্রায় সব নেতা ১৯৭১ সালে হানাদার পাকিদের সহযোগী শক্তি হিসেবে কাজ করেছেন। পোড়ামাটি নীতি তাঁরা সেখান থেকে শিখেছিলেন। সরকার হেজাবিদের ধমকির বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপই নিতে পারছিল না। বাবুনগরীরা ক্ষমতা দখলে আস্থাবান ছিলেন একটি কারণেÑ তা’হলো, হাটহাজারী, লালবাগ ও লালখান বাজারে জঙ্গী ট্রেনিং দেয়া হয়। শাহরিয়ার কবিরের চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে, আহমাদ শফী ও ইজহারুল ইসলাম জঙ্গী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে আফগানিস্তানে বাংলাদেশী জঙ্গী পাঠিয়েছেন এবং সে জঙ্গী মারা গেলে তার নিঃস্ব পরিবারকে কোন সাহায্য করেননি।
হেফাজতের সেøাগানই বলে দেয় তারা কী চেয়েছিল। তারা তালেবানী রাষ্ট্র করবে, আহমাদ শফী হবেন যার প্রধান। এখন বাবুনগরীর কনফেশনে জানা যাচ্ছে, তাঁরা ঠিকই তালেবানী রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন যার প্রধানমন্ত্রী হবেন বাবুনগরী আর আধ্যাত্মিক গুরু আহমাদ শফী। [আমাদের সময়, ৮-৫-১৩]
ইরানের খোমেনী স্টাইলে আর কি! এখানেও আমরা ষড়যন্ত্রের মধ্যে ষড়যন্ত্র লক্ষ্য করি। খালেদা চাচ্ছিলেন জামায়াত-হেফাজতকে দিয়ে সরকার পতন ঘটিয়ে তিনি তখতে তাউসে বসবেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আহমাদ শফীরা বিএনপিকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় যেতে চাচ্ছিলেনÑ যেখানে খালেদার স্থান নেই। ষড়যন্ত্রের রাজনীতি এমনই হয়। পরস্পর পরস্পরের পিঠে ছুরি মারে।
রাত আটটায় খালেদা ঢাকাবাসীকে জানালেন, হেফাজতের পাশে দাঁড়াতে। ৪৮ ঘণ্টার মাথায় খালেদা এই ঘোষণা দিলেন। বোঝা গেল তাদের পরিকল্পনার দ্বিতীয় পর্যায়ে তাঁরা পৌঁছেছেন। আহমাদ শফী গাড়ি করে রওনা হচ্ছিলেন ক্ষমতা দখলের ঘোষণা দিতে। তবে হেজাবি নেতাদের অনেকে মনে করছিলেন, তিনি হেজাবিদের ফিরে যেতেও বলতে পারেন। পথে আহমাদ শফীর মোবাইল ফোনে দু’টি ফোন আসে। তিনি ঘোষণা করেন, তিনি আর যাবেন না। এটিও প্রচারিত হয়ে পড়ে। কিন্তু, তিনি নির্দেশ দেন হেফাজতিরা যেন স্থান ত্যাগ না করে। দশটা-এগারোটার সময় দেখা গেল খালেদার নির্দেশ সত্ত্বেও মওদুদ, খোকা, আনোয়ার, দুদুরা খাবার, পানি নিয়ে নামছেন না। পরে ভাড়া করা জেহাদীদের কনফেশনে জানা গেছে, তারা প্রায় ২৪ ঘণ্টা অভুক্ত। পেশাব-পায়খানা করতে পারেননি। খাওয়ার পানিও পাননি। ঢাকার রাস্তাঘাট তাঁরা চেনেন না। বাতি নেই, অন্ধকার, কী করবেন বুঝতে পারছেন না। অনেকে ভয়েও স্থান ত্যাগ করতে লাগলেন। স্বদেশ রায় রাত ১১টায় ফোন করে আমাকে জানালেন, পত্রিকার প্রবিবেদক জানিয়েছেন, সমাবেশ থেকে লোকজন চলে যাচ্ছে।
বাবুনগরীরা এবং হেজাবিরা ভেবেছিলেন, এই সমাবেশ ভঙ্গ করার সাহস কারও নেই। আর বিএনপি-জামায়াত ক্যাডাররা যোগ দিলে তো কথাই নেই। সবই তো পরিকল্পনা মাফিক এগুচ্ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি বড় বৈশিষ্ট্য অনিশ্চয়তা। এ কথা অনেকবার লিখেছি, ইতিহাসের পটভূমিকায় এই অনিশ্চয়তা বাঙালীকে অনেক বিপর্যয় থেকে বাঁচিয়েছে। এবারের অনিশ্চয়তা ছিল নিরাপত্তা বাহিনী সমাবেশ ভেঙ্গে দেয়ার চেষ্টা করবে কী করবে না। এক পুলিশ অফিসার আমাকে বলেছেন, পাকিস্তান আমল থেকে এ পর্যন্ত এত বৃহৎ আকারের সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করার কোন পরিকল্পনা কখনও করা হয়নি। এটি ছিল এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। কারণ, এ ধরনের পরিকল্পনা সফল না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
মাঝরাতের পর অভিযান শুরু হয়। ১৫ মিনিটের মধ্যে শাপলাচত্বর মুক্ত। সবার আগে পালান বাবুনগরী, লতিফ নেজামী ও তাদের সাঙ্গোপাঙ্গরা। নিজের সাথীদের ফেলে এ ভাবে পলায়ন তাদের চরম স্বার্থপরতা তা তৃণমূল পর্যায়ের হেজাবিদের মনে রাখা উচিত। তাদের তো লড়াই করে শহীদ হওয়ার কথা। শহীদ না হয়ে পালালেন কেন? এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে জঙ্গীগুরু শাইখ আবদুর রহমানের কথা। জঙ্গী শাইখ ধরা পড়লে তাঁর স্ত্রী আর্তকণ্ঠে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি তো শহীদ হবেন বলেছিলেন, তিনি তো শহীদ হলেন না!
তাঁরা তো লড়াই করে গাজী হবেন বলেছিলেন। কিন্তু লড়াই দূরের কথা, জলকামানের পানি, শব্দবহুল গ্রেনেড আর ফাঁকা রবার বুলেটেই শাপলা চত্বর খালি। একদল এক দৌড়ে যাত্রাবাড়ী হয়ে কাঁচপুরের পথে। বাকিরা এদিক-সেদিক গলি-ঘুপজি আর বিভিন্ন ভবনে। পরের এক চিত্রে দেখা যায়, কান ধরে একদল হেফাজতী বা হেজাবি বসে আছেন। তাঁরা শহীদও হননি। গাজীও হননি; বরং মানুষের কাছে পাজি হিসেবেই পরিচিত হয়েছেন। হেফাজতে শহীদ নয়, হেফাজতে গাজী নয়, এখন তারা হেফাজতে পাজি।
যা সবাই মনে করেছিল অসম্ভব, তাই হলো সম্ভব। বাংলাদেশে তাই বলি দুইয়ে দুইয়ে কখনও চার হয় না। একটা অনিশ্চয়তা থেকে যায়। ভোরে ঢাকাবাসী স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।
নিরাপত্তা বাহিনী যখন শাপলা চত্বর মুক্ত করতে যায় তখন সব টেলিভিশন কর্মী, সংবাদকর্মীরা সঙ্গে ছিলেন। চারটি লাশ পাওয়া যায়, যা হেজাবিরা স্টেজের কাছে রেখেছিলেন পরে জনমনে উত্তেজনা সৃষ্টির জন্য। একজন পুলিশ মারা যায়। মিথ্যা সংবাদ পরিবেশনকারী হিসেবে খ্যাত অধুনা হেজাবিদের মুখপত্র নয়াদিগন্তের খবর অনুসারে পুলিশ-র‌্যাব হেজাবিদের পালানোর জন্য পথ করে দিয়েছিলেন বা কিভাবে পালাতে হবে সে পথ নির্দেশ করে দিচ্ছিলেন। তাদের খবর অনুযায়ী সারাদিনে শহরে মৃত্যুর সংখ্যা ১৬।
পরে সিদ্ধিরগঞ্জ-কাঁচপুরে মাইক দিয়ে মিথ্যা প্রচার করলে আবার সংঘর্ষ বাঁধে এবং তাতে কিছু মৃত্যু হয়। আমার এক সহকর্মী, যার বাড়ি রাউজানে, জানালেন, তাদের গ্রামের মসজিদের ইমাম তাঁকে ফোন করেছিলেন। ইমামকে টাকা দিয়ে ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল। বিভিন্ন জায়গায় হেজাবিরা এভাবে টাকা দিয়ে লোক পাঠায়। অনেক মাদ্রাসা ও এতিমখানা থেকে অভিভাবকদের না জানিয়ে কিশোর ছাত্রদের ঢাকায় নিয়ে আসে। সেই ইমাম কাউকে না জানিয়ে ঢাকায় আসেন এবং শহীদ বা গাজী না হয়ে পাজি হিসেবে এক দৌড়ে যাত্রাবাড়ী আসেন। সকালে গ্রামে ফোন করে জানেন, না জানিয়ে কর্মস্থল ত্যাগ করায় তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। ইমাম এখন তদবির করছেন চাকরি ফিরে পাওয়ার জন্য।
হেফাজতীরা পিছু হটলেন কেন? কারণ হেফাজতীদের নেতারা প্রচুর টাকা খেয়েছিলেন। তাঁদের কর্মীদের মাঝে সে টাকা ভাগ করে দেননি। কোন কোন ক্ষেত্রে যাওয়া-আসার খরচ দিয়েছেন। টাকা খেয়ে একটা পর্যায় পর্যন্ত আন্দোলন করা যায়। টাকা খেয়ে ইসলাম নিয়ে তারা আন্দোলন শুরু করেছিলেন। কিন্তু, কোরান পোড়ানো, লুটপাট আর আগুন লাগিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ করার পর টাকা খেয়েও আর আন্দোলন করতে পারবেন না। ইতোমধ্যে বাবুনগরীদের বিরুদ্ধে টাকা খেয়েও টাকা আত্মসাতের মামলা হয়েছে।
ইসলামের হেফাজত করার বিধান নেই। সৃষ্টিকর্তাই বলেছেন, তিনি এর হেফাজত করবেন। কিন্তু রসুল (স.) ও চার খলিফার পর ইসলামের স্বঘোষিত হেফাজতকারীরা মাঠে নেমে পড়েন এবং ইসলাম শান্তির ধর্ম থেকে অশান্তির ধর্মে পরিণত হয়। নানাজনের উদ্দেশ্যমূলক ব্যাখ্যায় নবীর (স.) শান্তির ইসলাম তিরোহিত হয়। এ অবস্থা চলে নবম শতক পর্যন্ত। আব্বাসীয় যুগে খলিফা মামুন তাঁর রাজত্বের শেষ দিকে এ ভুল বুঝতে পারেন। আমীর আলী লিখেছিলেন, ‘মানুষের মনকে অপরিবর্তনীয় মতবাদের বন্ধনে আবদ্ধ করার ফলে মামুন আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। রাজত্বের শেষ চার বছর রাষ্ট্রকে ধর্ম-প্রভাব থেকে মুক্ত করতে এবং প-িতবর্গ ও শাস্ত্রজ্ঞগণ মানুষের বুদ্ধিকে যে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করেছিলেন তা ছিন্ন করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন।’ এ মুতাজিলাদের বা যুক্তিবাদীদের ধারণা ছিল এরকম। মামুন মুতাজিলা মতবাদ গ্রহণ করেন যার মূল কথা হলোÑ‘মানুষ ভাল ও মন্দের বিচারে স্বাধীনতার অধিকারী...আল্লাহর গুণাবলী তাহার সত্তা থেকে পৃথক নয় এবং কোরান সৃষ্ট বস্তু। মানুষের কার্যাবলী সম্পর্কে কোন চিরস্থায়ী বিধি নেই, যে স্বর্গীয় অনুশাসনসমূহ মানবের আচরণকে নিয়ন্ত্রিত করে তা উন্নতি ও পরিবর্ধনেরই ফল এবং বিশ্বনিয়ন্তা সমগ্র বিশ্বকে যে পরবর্তনের অধীন করেছেন তাও ঐ পরিবর্তনের অধীন।’
এর ফলে বিজ্ঞান, শিক্ষা, সাহিত্যে অভাবনীয় উন্নতি হয়। এই সময়টুকুকে ইসলামের ইতিহাসে স্বর্ণযুগ বলা হয়। মুসলমানরা যে সব বিজ্ঞানী, দার্শনিক, সাহিত্য সম্পর্কে গর্ববোধ করেন তাঁরা ঐ সময়ই বিকশিত হয়েছিলেন। মুতাজিলাদের প্রভাব বেশিদিন ছিল না। ইমাম আহমদ ইবন হাম্বলের উত্থানের ফলে মুতাজিলারা হটে যান। হাম্বলী অনুসারীদের কারণে পরবর্তীকালে অসহিষ্ণুতা, অবিরত বিশৃঙ্খলা, দাঙ্গা ও রক্তপাত শুরু হয়, যা আজও বহমান।
পাকিস্তান আমলেও শাসকগণ ইজতেহাদের পথ বন্ধ করে দেয়। গুরুত্ব দেয় তকলিদের ওপর। ইজতেহাদ প্রতিষ্ঠা করতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যায় বাঙালী। বঙ্গবন্ধুর আমলটুকুকে ইজতেহাদের সময় বলা যায়। ১৯৭৫ সালের পর থেকে ইজতেহাদ লুপ্ত হয় এবং তকলিদের প্রভাব বাড়তে থাকে। নানা ব্যক্তি, গোষ্ঠী ইসলামের স্বঘোষিত ঠিকাদার হয়ে দাঁড়ায়, হেফাজত যার নবতম সংস্করণ। আজ ইজতিহাদের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হেজাবিরা। বর্তমান সরকারকে ইজতিহাদের পথই বেছে নিহত হবে এবং এ কারণে প্রয়োজনে যতটা কঠোর হওয়া প্রয়োজন ততটা কঠোর হতে হবে।

বিএনপি করতে হলে প্রধান যে বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে তা’হলো অবিরত মিথ্যাচার করার ক্ষমতা ও মানুষের প্রধান গুণ লাজলজ্জা বিসর্জন দেয়া। যে যত মিথ্যাচার করতে পারবে সে তত বড় নেতা হতে পারবে। হেফাজতী ঘটনা থেকে কয়েকটি উদাহরণÑ
বিএনপির এক নেতা সাদেক হোসেন খোকাকে দেখলাম ৬ তারিখ সংবাদ সম্মেলনে বলছেন, হাজার হাজার লোক মারা গেছে। সিএনএন, আল জাজিরা বলেছে, আড়াই হাজার লোক মারা গেছে। এর আগে হেজাবিদের তরফ থেকে রটানো হয়েছিল, আট হাজার মারা গেছে। অবাক হলাম, সারারাত টিভি দেখলাম, সংবাদ দেখলাম, কোথাও তো এই সংখ্যা শুনলাম না। তাড়াতাড়ি আল জাজিরা ধরলাম। বাংলাদেশ সম্পর্কিত খবরে বলা হলো মৃতের সংখ্যা ১৪।
৫ তারিখ মোহনা টেলিভিশনের এক অনুষ্ঠানে ১৯৭১ সালে সুন্দরবন সাব-সেক্টরের অধিনায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে ছিলাম। তিনি শ্রোতাদের এক প্রশ্নের জবাবে জানালেন, সাদেক হোসেন খোকা ও শাহজাহান ওমর (বিএনপি নেতা) টেলিভিশনে বলেছেন, সাঈদীকে তিনি চেনেন, তার সঙ্গে সাঈদীর যোগাযোগ ছিল। জিয়াউদ্দিন জানান, খোকা আরেকটি অনুষ্ঠানে জানান, টেলিফোনে তার সঙ্গে জিয়াউদ্দিনের কথা হয়েছে। জিয়াউদ্দিন জানিয়েছেন, সাঈদীর ব্যাপারে খোকা যা বলছেন [অর্থাৎ সাঈদী যুদ্ধাপরাধী নন] তা সত্য নয়। জিয়াউদ্দিন বললেন, ‘এরা দু’জনই ডাহা মিথ্যা বলছেন। তাদের সঙ্গে গত ১০ বছর আমার কোন দেখা- সাক্ষাত নেই। মুক্তিযোদ্ধারা এ রকম মিথ্যাচার কী ভাবে করেন?’ ৯ তারিখ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর সঙ্গে দেখা। বাচ্চুকে ঠাট্টা করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাচ্চু তোর জিগরি দোস্ত খোকা এত ডাহা মিথ্যা বলেন কীভাবে? টেলিভিশনে, সংবাদ সম্মেলনে চোখ খোলা রেখে নির্ভয়ে মিথ্যা বলছেন।’
বাচ্চু বললেন, ‘খোকা হিসেবে সাদেক হোসেন রাজনীতিতে জয়েন করেছিল। এখন তো তার পরিচিতি হয়ে গেছে সাদেক হোসেন ধোঁকা।’
অর্থাৎ, বিএনপি করলে মিথ্যাচার করতে হয়, ধোঁকাবাজ হতে হয়।
৬ তারিখ রাতে ২৪টা টেলিভিশনে ২৪টি টক শো হয়েছিল। প্রত্যেকটিতে বিএনপির পাতি নেতা বা সহানুভূতিশীল নেতাদের আনা হয়েছিল। প্রত্যেকে বলতে লাগলেন যে, কমপক্ষে আড়াই হাজার ব্যক্তি মারা গেছেন। অনেক লাশ গুম করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সঞ্চালক ফুটেজ দেখালেন। ভবি ভুলবার নয়। এক টিভিতে ব্যারিস্টার খোকন এই অভিযোগ তোলার পর তথ্যমন্ত্রী ইনু বললেন, নাম ঠিকানা দেন। খোকন জানালেন, তার প্রত্যেক এলাকার উপজেলায় মানুষ মারা গেছে। ইনু বললেন, নাম ঠিকানা দেন। এক পর্যায়ে খোকন দুটি ছবি দেখালেন। একজন দর্শক পরে জানালেন, ছবিটি নাকি ছিল হাইতির কলেরায় মৃতদের লাশের ছবি। যুক্তিতে না পেরে খোকনের মতো চিৎকার করে ব্যারিস্টার বলতে লাগলেন, গুলি হলো কেন? গুলি হলো কেন?
অর্থাৎ বিএনপি করলে যুক্তি মানা চলবে না, গায়ের জোর দেখাতে হবে।
এমকে আনোয়ারকে তাঁর সহকর্মীরা জানতেন মাথা খালি আনোয়ার হিসেবে। ইদানীং প্রথম সারির নেতা হওয়ার বাসনায় তিনি বেশি কথা বলছেন। সংবাদ সম্মেলনে এমকে বললেন, স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা দেবাশীষের নেতৃত্বে কোরান পোড়ানো হয়েছে। চিন্তা করুন, বাংলাদেশে হিন্দুরা এখন শুধু নাগরিক হিসেবে থাকতে চায়, ভোটাধিকার চায় না, সেখানে এক হিন্দু নাগরিক সবার সম্মুখে কোরান পোড়াবে, একথা কোন পাগলও বিশ্বাস করবে না। এই নির্জলা মিথ্যাচারের উদ্দেশ্য ছিল ৬ মে থেকে যাতে দাঙ্গা লাগানো যায় এবং হেজাবিরা যে কোরান পুড়িয়েছে সে নিয়ে যাতে আলোচনা অন্যখাতে যায়।
অর্থাৎ, বিএনপি করলে মনেপ্রাণে সাম্প্রদায়িক হতে হবে অথবা দাঙ্গা লাগাতে হবে।
অনেক বিএনপি নেতা বারবার বলছেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চেও নাকি এমনটি হয়নি, যা হয়েছে ৫ মে রাতে। এরকম বর্বর গণহত্যার কথা চিন্তা করা যায় না। গণহত্যা শব্দটি বার বার তারা ব্যবহার করছে। এর একটি উদ্দেশ্য, ১৯৭১ সালের গণহত্যাকে খাটো করে দেখানো এবং জনমানসে এ ধারণার সৃষ্টি করা যে, ১৯৭১ সালে তেমন কিছু হয়নি। ফলে, যুদ্ধাপরাধ মামলা জিঘাংসামূলক। প্রকৃত গণহত্যা এখন হচ্ছে এবং এর জন্য মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচার করা হবে। ২৫ মার্চ ঢাকা শহরেই প্রায় দু’লাখ শহীদ হয়েছেন।
অর্থাৎ বিএনপি করলে সংবিধান বিরোধী হতে হবে। সংবিধানে উল্লেখিত মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত যাবতীয় শব্দাবলি উপেক্ষা করতে হবে।
৬ মে বিকেলে আমরা অনেকেই একটি এসএমএস পেয়েছি। তাতে লেখা ছিল, ভারতীয় এজেন্টরা মতিঝিলে হত্যাকা- চালিয়েছে এবং এখনও চালাচ্ছে। এর অর্থ এই সরকার ভারতের দালাল। অবশ্য সংবাদ সম্মেলনে এই উক্তি করা হয়নি।
বিএনপি বা হেজাবি হলে পাকিস্তানমনা হতে হবে।
টেলিভিশনের টক শোতে বিএনপি/হেজাবি সমর্থকদের সাংবাদিকদের অনেকে বলেছেন, তাঁরা ঘটনাস্থলে ছিলেন। টেলিভিশনে ধারণকৃত চিত্র তাঁরা দেখালেন। কিন্তু বিএনপি সমর্থক বা নেতারা বার বার জানালেন, ঘটনা সত্য নয়। তাঁরা তখন নয়া দিগন্ত, ইসলামী টিভি কেন বন্ধ করা হয়েছে এ প্রশ্ন তুলতে লাগলেন। এ দু’টি টিভি যে হেজাবিদের মুখপত্র হিসেবে অনবরত মিথ্যা এবং ৫ ও ৬ মে এমনভাবে সংবাদ পরিবেশন করছিল যে, সারাদেশে দাঙ্গা লেগে যেত। টিভিতে দেখান হলো হেজাবিরা মৃতের ভান করে পড়ে আছে। লাঠির খোঁচা খেয়েই চটপট উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়াচ্ছে। সেটিও মানতে তাঁরা রাজি নন। সত্য কোনভাবে গ্রাহ্য করা যাবে না।
অর্থাৎ বিএনপি করলে নির্লজ্জ বা বেহায়া হতে হবে। আমার এক বন্ধু অনেক আগে বলেছিলেন, ভদ্রলোক হলে বিএনপি করা যাবে না।
হেফাজতী/হেজাবি সমাবেশ ও পরবর্তী ঘটনা নিয়ে বিএনপি নেতারা যা বলছেন এসব তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
বিএনপি যে আড়াই হাজার মৃত্যুর কথা বলছে তার কোন প্রমাণ তারা দেখাতে পারেনি। আড়াই হাজার মানুষ হত্যা করতে হলে কত বুলেটের প্রয়োজন এ হিসাবও তাদের নেই। রবার বুলেট আর বুলেট এক হলে এক ধরনের বুলেটের নাম রবার বুলেট হতো না। কাঁদানেগাস দিয়ে মানুষও হত্যা করা যায় না। আড়াই হাজার মৃতদেহ সরাতে গেলে কত ট্রাক লাগে। টিভিতে কিন্তু কোন ট্রাকই দেখায়নি। ২৫০০ মানুষ মারা গেলে পুরো ঢাকা শহরের একাংশ স্বজনহারাদের আহাজারিতে ভরে যেত। স্বজন হারাদের প্রায় দেখাই যায়নি। আড়াই হাজার কেন এক শ’ লাশও ঘণ্টাখানেকের মধ্যে গুম করা সম্ভব নয়। ডিএমপি কমিশনারের ব্রিফিং বিশ্বাস না করলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দেখুন। ২৫০০ মারা গেলে সারা পৃথিবীর সাংবাদিকরা ঢাকায় চলে আসতেন। হেজাবিরা ভেবেছিলেন, তাঁদের অনেক মিথ্যাচারের মতো বা ক্রমাগত মিথ্যাচার করলে মানুষ তা বিশ্বাস করবে। কিন্তু সরকার একটি কৌশলী পদক্ষেপ নিয়েছিল। এই অভিযানের সময় দেশী-বিদেশী সংবাদ মাধ্যমের কর্মীদেরও সঙ্গে নেয়া হয়েছিল। ফলে, এ বারের মিথ্যাচার সফল হয়নি।
আমার মনে হয়েছে, টক শো বা খবরের কাগজে বিএনপির নেতাদের মন্তব্যের বিপরীতে একটি বিষয় উল্লেখ করা হয়নি; বিষয়টি উল্লেখ জরুরী ছিল। সংঘর্ষে যাঁরা মারা গেছেন তার জবাবদিহিতা সবাই চাইছেন। কিন্তু পটভূমিটা সবাই এড়িয়ে গেছেন। একজন নাগরিকের মৃত্যুও কারও কাম্য নয়। কিন্তু সে যদি নিজে আত্মহত্যা করতে চায়?
সৈয়দ আশরাফ সন্ধের আগে শাপলা চত্বর খালি করে দিতে বলেছিলেন। হেজাবি নেতারা তো তা করেনইনি বরং আশরাফকে নিয়ে ঠাট্টা করেছেন। সারাদিন তারা যে তা-ব চালিয়েছে সেটি কি আন্দোলনের মধ্যে পড়ে? আগুন লাগানো, ভাংচুর, লুট কী অপরাধ নয়? অপরাধ হলে তো ব্যবস্থা নিতে হবে। লক্ষ্য করবেন, হেজাবিরা যখন ঢাকা শহর অগ্নিকু-ে পরিণত করছে, পুলিশকে লক্ষ্য করে পাথর ও বোমা ছুঁড়ছে তখনও কিন্তু পুলিশ প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেনি। করলেও তা অপরাধ হতো কিনা সন্দেহ। গভীর রাতে পুলিশ গিয়ে প্রথমে অনুরোধ করে তাদের চলে যেতে। হেজাবি নেতারা রাজি হয়নি। কারণ তারা তো সরকার গঠন করতে এসেছে, চলে যেত নয়। এর পর পুলিশ এ্যাকশনে যায়। অতর্কিতে যদি পুলিশ হামলা করত তা’হলেও না হয় দোষ দেয়া যেত। আর এ কেমন কথা, কিছু গু-াপা-া সারা শহরে অরাজকতা চালাবে কিন্তু সরকার কিছু বলতে পারবে না!
অনেকে বলেছেন, বিদেশে এরকম সমাবেশ ভাঙতে গিয়ে সমাবেশকারীদের বেশ মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু, এত বড় সমাবেশ প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করে এত কম সময়ে কোথাও মানুষ সরান যায়নি। এই প্রথম অনেকে পুলিশের প্রশংসা করে বলছেন, হেজাবিদের হাত থেকে ঢাকা শহর বাঁচানো যাবে কেউ আশা করেননি। অনেকে এও বলছেন, স্বারাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রচুর নিন্দামন্দ করা যেতে পারে, কিন্তু আল্লাহকে ধন্যবাদ, আগের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন না। ১৯৭৫ সালের পর আর কেউ ধর্ম ব্যবসায়ীদের এমনভাবে কোণঠাসা করার সাহস করেননি। তবে এটিও মনে রাখার দরকার, প্রধানমন্ত্রীর সমর্থন না পেলে এ কাজ করা যেত না। এখন তিনি আর দোদুল্যমানবতায় ভুগছেন না। ভুল হোক ঠিক হোক তিনি একটি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। এবং এখনও সেই সিদ্ধান্তে অটল আছেন। পাঠক, আপনারা বলতে পারেন, আমি ১৪ দলের সমর্থক। তাই অযথা তাদের প্রশংসা করছি। তাহলে বাংলাদেশের এখন সবচেয়ে সিনিয়র সাংবাদিক এবিএম মূসার কথা ধরা যাক। গত চার বছরে কোন লেখায় তিনি বর্তমান সরকারের কোন প্রশংসা করেননি। এখন তিনি অসুস্থ। তারপরও লিখেছেন, ‘গতকাল (৭ মে) আমি এই সরকারের প্রশংসা করেছি হেফাজত ও ধর্মাশ্রয়ী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে শক্ত হাতে দমন করার জন্য। মহাজোট সরকারের অনেক কিছুই সমর্থন করি না সত্য; তার মানে এই নয়, দেশে তালেবান সরকার চাই। হেফাজতী নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে সরকারের অভিযানে দুঃখজনক প্রাণহানি ঘটলেও উপযুক্ত সময়ে সরকারের এই অভিযানকে আমি স্মরণ করি। কারণ তারা অবরোধ ও সমাবেশের নামে হত্যাসহ নৈরাজ্যকর অবস্থা সৃষ্টির পাঁয়তারা চালিয়েছিল, তাতে আরও বেশি প্রাণনাশের আশঙ্কা ছিল। বাংলাদেশকে ধ্বংস করার ফন্দি এঁটেছিল হেফাজত।’ [আমাদের সময়, ৮-৫-১৩]
বাংলাদেশ ব্যাংক লুটের পরিকল্পনা, অন্যান্য ব্যাংকের ক্ষতি সাধন, লুট, পুলিশ হত্যা, নারকীয় সব কর্মকা-, দেশের কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি, সর্বোপরি কোরান পোড়ানোর পরও শেখ হাসিনা হেফাজতী নেতাদের প্রধান আহমাদ শফী ও তার অনুচরদের সৌজন্যের সঙ্গে হাটহাজারী পাঠিয়ে দিয়েছেন। এ কথাটি যেন হেফাজতী নেতারা মনে রাখেন। তাদের সবাইকে আদালতে চালান দিলেও হেফাজতীরা ছাড়া কেউ সমর্থন করত বলে মনে হয় না।
কওমি মাদ্রাসাগুলো চলে যাকাত, কোরবাণীর চামড়া ও অনুদানের ওপর। প্রশ্ন উঠছে, তারা যদি ১-২ লাখ মানুষের সমাবেশ ঘটিয়ে থাকে তা’হলে বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করেছে। এ টাকা এলো কোত্থেকে? এবিএম মূসা সাহসী মানুষ। তিনি লিখেছেন, ‘আমি নাম ধরে বলতে পারি ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনা ট্রাস্ট, আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক নাশকতার অর্থ জুগিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের ধ্বংসাত্মক কাজে ব্যবহার করছে।’ [ঐ] সরকারের উচিত এ বিষয়ে আলাদা একটি তদন্ত করা। আরেকটি বিষয়ও উল্লেখ্য, আমরা নিয়মিত ট্যাক্স দিই। এসব ধর্ম ব্যবসায়ীরা বা তথাকথিত ইসলামী দলগুলোর নেতারা কি ট্যাক্স দেয়? আমরা ট্যাক্স দিই কিনা তা সব সময় কর্তৃপক্ষ নজর রাখে, এসব নেতার ক্ষেত্রে? যদি এরা ট্যাক্স না দেয় তা’হলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া উচিত। না হলে, আমাদের বলতে হবে, সরকার পক্ষপাতিত্ব করছে, যা অসংবিধানিক।
যার এখন গণভবনে থাকার কথা ছিল তিনি এখন ডিবি অফিসের কাঠের বেঞ্চে বসে রিমান্ডে অশ্রুপাত করছেন। কিন্তু এই অশ্রুতে সমব্যথী হওয়ার কোন কারণ নেই। এই জুনায়েদ বাবুনগরী ১৯৭১ সালে মুজাহিদ বাহিনীর নেতা ছিলেন। হেফাজতের নায়েবে আমির মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী জুনায়েদের মামা। মামা-ভাগিনা ১৯৭১ সালের পরও আওয়ামী বিরোধিতা ছাড়েননি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তাঁরা সা.কা. চৌধুরীর হয়ে কাজ করেছেন এবং এই জুনায়েদ বিভিন্ন বক্তৃতায় বলেছেন, যারা আওয়ামী লীগে ভোট দেয় তারা নাস্তিক। ঢাকায় তাদের প্রথম সমাবেশেও টাকা যোগায় সা.কা.র পরিবার [জনকণ্ঠ ১০.৫.১৩]। যার কথা ছিল এখন বঙ্গভবনে আয়েসে দিন কাটাবার, তিনি এখন হাটহাজারি মাদ্রাসায় কাঠের বেঞ্চিতে বসে কাঁদেন। কিন্তু এখানেও সমব্যথী হওয়ার বা সম্মান দেখাবার কোন কারণ নেই। কারণ, তিনিও ১৯৭১ সালে যুক্ত ছিলেন মুজাহিদ বাহিনীর সঙ্গে।
ইতিহাস হচ্ছে অভিজ্ঞতা। সে কারণে আমরা বারবার বলি, ইতিহাসটা দেখ, তারপর সিদ্ধান্ত নাও। আমাদের ইতিহাসের অভিজ্ঞতা বলে, যে একবার রাজাকার সে সব সময় রাজাকার। ১৯৭১ সালে যারা রাজাকারী করেছে তারা কি ঐ পথ ছেড়েছে? একটা উদাহরণ দেখান যাবে? যাবে না। আমরা আরও বলি, যুক্তিযোদ্ধা হওয়া যতটা সহজ ছিল, আজীবন মুক্তিযোদ্ধা থাকা ততটা সহজ নয়। জিয়াউর রহমান ও তার সাথীরা এর বড় প্রমাণ, যাদের সঙ্গে ইয়াজিদের তুলনা করা যেতে পারে। বা সাদেক হোসেন খোকা, যিনি এখন পরিচিত সাদেক হোসেন ধোঁকা নামে; বা মওদুদ, সিভিলিয়ানদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বেশি এ দেশের ক্ষতি করেছেন। তাই আমরা ইতিহাসকে অভিজ্ঞতা হিসেবে মানি এবং কঠিন সত্যে উপনীত হই যে, তাদের সহস্র তোষণ করলেও তাদের পক্ষে আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়া সম্ভব নয়, আওয়ামী লীগকে সমর্থন করা সম্ভব নয়, ভান হয়ত করতে পারে। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এ কথা কখনও বুঝতে চাননি। প্রতিবার ক্ষমতায় গিয়ে তারা তাদেরই গুরুত্ব দিয়েছেন যারা তাদের হয়ে লড়াই করননি বা তাদের হয়ে কাজ করেছেন বলে ভান করছেন। এও এক ধরনের অদ্ভুত মানসিকতা, যা হীনম্মন্যতার তুল্য এবং এ কারণেই তারা সব সময় সমস্যায় পড়েছেন।
বেগম জিয়াও প্রস্তুত ছিলেন। জনাব ধোঁকার বাসায়, বাবুনগরী টাকা-পয়সা হেফাজতে নিতে ও সরকার পতনের বিষয়ে, ৫ মে-তেও আলাপ করেছেন বলে পত্রিকায় প্রকাশ। জানা যায় সরকার পতন ও সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতায় যাওয়ার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ মওদুদও প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। শোনা যায়, সরকার পতন হলে তারাই দ্রুত বিভিন্ন শক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করে আসল ক্ষমতা হস্তগত করে বাবুনগরীদের হাটহাজারি পাঠিয়ে দেবেন। কিন্তু পতন হলো না। বাবুনগরীদের সাহায্যের জন্য খালেদার আহ্বান ঢাকাবাসী কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় তার গলার স্বর আর শোনা যায়নি।
খালেদা বা আহমাদ শফী ক্ষমতায় গেলে জামায়াতীরা জানত, তারাই হবে চাবিকাঠি। সুতরাং বিএনপির চেয়ে তারাই মাঠে নেমেছিল বেশি। এবং সে কারণেই ইসলামী ব্যাংক আক্রান্ত হয়নি, অন্যান্য ব্যাংক আক্রান্ত হয়েছে। ইতিহাসের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, আজ ইসলামী ব্যাংক আক্রান্ত হলে জামায়াত আন্দোলন থেকে সরে যাবে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা জামায়াত ও পাকিস্তানীদের মার দিতে পেরেছিল দেখে তারা নতজানু হয়ে বসেছিল। ৫ মের অভিজ্ঞতা বলে, রাজাকার, রাজাকারপন্থী বা রাজাকারের বাচ্চাদের সঙ্গে যদি নমিত ব্যবহার না করেন তাহলে তারা ঠিক থাকবে। পত্রিকার খবরে প্রকাশ, আহমাদ শফী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ফোন করে অনুরোধ করেছেন, তার পুত্র আনাছ ও দুই খাদেমকে যেন গ্রেফতার করা না হয় [কালের কণ্ঠ, ১০.৫.১৩]।
তার কারণে এতগুলো মানুষের মৃত্যু হলো, জখম হলো, গ্রেফতার হলো, কারও কথা তার মনে হয়নি; শুধু পুত্র ও দুই খাদেমের কথাই মনে হলো! ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার আগেও তিনি শুধু সাংবাদিকদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন, যে অগণিত মানুষের ক্ষতি তিনি করেছেন তাদের কাছে নয়। মনে রাখা ভাল, মানবিকতা তাদের বড় গুণ নয়। হলে, ১৯৭১ সালে তারা নিজেদের মানুষদের হত্যা করতেন না, মা-বোনদের ধর্ষণ করতেন না।
এ সব রাজাকার ১৯৭৫ সালের পর মাদ্রাসা তৈরি করে তাতে আশ্রয় নিতে থাকে। এবং এভাবেই বাংলাদেশে সহস্র মিনি মাদ্রাসা তৈরি হয়। শুনেছিলাম আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেছিলেন, জামায়াত বা কওমি এক ভোট, নারীও এক ভোট। আমাকে দু’ইটাই দেখতে হবে। এখানেই ফ্যালাসি। ইতিহাসের অভিজ্ঞতাকে উপেক্ষা করা। জামায়াত বা মাদ্রাসা ভোট তার পক্ষে যাবে না, কিন্তু নারীর যাবে। সে ক্ষেত্রে মাদ্রাসা ভোট উপক্ষো নয়, গুরুত্ব না দেয়াই সমীচীন।
সরকারের কঠোর অবস্থানের ফলে আপাতত মাদ্রাসাগুলো খুব একটা নড়াচড়া করবে না। এদের নেতারা এত টাকা খেয়েছে যে, নিজেদের স্বার্থ আরও ক্ষুণœ হোক সেটি চাইবে না। কিন্তু তারা সব সময় পাকিস্তানী বাংলাদেশীদের পক্ষেই থাকবে। এছাড়া নিজেদের শক্তির দম্ভ ভেঙ্গে যাওয়ায়ও তারা হতবাক।
বিএনপি-জামায়াত এখন মরিয়া অবস্থায়। তাদেরও নিজেদের শক্তি সম্পর্কে যে বিশ্বাস ছিল তার ভিত নড়ে গেছে। তাদের হরতালের ডাক ব্যর্থ হয়েছে। তাদের লিডার আলবদর কামারুজ্জামানের ফাঁসির দ- হওয়ার পরও তারা আর আগের মতো রাস্তায় সহিংসতা দেখাতে পারেনি। কিন্তু, তারা এও জানে যে, এবার ক্ষমতায় যেতে না পারলে হেজাবিদের সেই রাজনৈতিক শক্তি আর থাকবে না। সুতরাং এখন তারা দেশ ধ্বংসে যা যা করার তা তা করবে। অর্থাৎ সামনের দিনগুলো আরও রক্তক্ষয়ী হওয়ার সম্ভাবনা।
৫-৬ মের ঘটনার অন্য একটি দিকও আছে। তা’হলো, পাকিস্তানী বাংলাদেশী বা হেজাবিরা অপরাজেয় নয়। বরং এই ধারণা তৈরি করতে হবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি অপরাজেয়, তারা ফিনিক্স পাখির মতো। এই শক্তির জায়গা থেকেই আগামী নির্বাচন সামনে রেখে কাজ করে যেতে হবে।
এ জন্য প্রথম কাজটি হবে সব ধরনের মান-অভিমান ভুলে সরকার, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব দল, গ্রুপ, সংগঠন ও ব্যক্তিতে যৌথ ফ্রন্ট গড়তে হবে। লড়াইটা হবে হেজাবি অপশক্তির হাত থেকে দেশকে ও নিজেদের রক্ষা করা। সরকার আমাদের জন্য কী করল, তার চেয়েও বড় কথা আমরা কী করলাম, তা একবার ভাবা; সম্প্রতি বাংলাদেশ বিনষ্ট করার ষড়যন্ত্র দেখে আমাদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তার ভিত্তিতে কাজ করা যায় কিনা তা বিবেচনা করা। সরকারেরও উচিত হবে এ ধরনের বিভিন্ন উদ্যোগ সমন্বয় ও সাহায্য করা।
না, আমি কাউকে পরামর্শ দেব সে রকম বিজ্ঞ নিজেকে মনে করি না এবং সে ধৃষ্টতাও দেখাব না। সিভিল সমাজের স্বার্থে শুধু বলব, রাজনৈতিক নেতৃত্বেই আমরা এগিয়ে যাব। শুধু আশা করব, রাজনৈতিক নেতারা সিভিল সমাজের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতি আরও সংবেদনশীল হবেন এবং গুরুত্ব আরোপ করবেন। কারণ, আমরাও ভোটার। আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপরও তাদের জয়-পরাজয় নির্ভর করে। আমরাও একটি শক্তি এবং আমাদের চিরকালীন দাস হিসেবে ভাবার কোনও কারণ নেই। আমাদের অভিজ্ঞতা এ রকম-
১. ইসলামের নাম নিয়ে অনেকে রাজনৈতিক দল গঠন করে, ধর্ম ব্যবহার করে গোষ্ঠীস্বার্থ উদ্ধারের ব্যস্ত। এ কারণে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তারা নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে এবং করবে। ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে না যাওয়ায় ও সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক রাষ্ট্রধর্ম অটুট থাকায় তাদের মনে এ প্রতীতি জন্মেছে যে, তারা অত্যন্ত শক্তিশালী। এ এক ধরনের জুজুর ভয়। সে কারণে, তারা মনে করে ধর্ম/ ইসলামের নাম ব্যবহার করে তারা যা খুশি তা করতে পারে। এমন কি বিএনপি ও জাতীয় পার্টি ‘ইসলামী’ দল না হয়েও অনবরত ইসলাম ব্যবহার করছে। ডানপন্থা এভাবে শক্তিশালী হচ্ছে। সুতরাং ভেবে দেখার সময় এসেছে, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানে রাখা উচিত কি উচিত নয়। সৌদি আরব পর্যন্ত ইসলামিক রিপাবলিক নয়, কিংডম অব এরাবিয়াও নয়, সৌদি এরাবিয়া। কিন্তু মুসলমানরা এ ব্যাপারে নিশ্চুপ।
এ যুক্তিও উড়িয়ে দেয়া যায় না, সংবিধান থেকে এসব সাংঘর্ষিক বিষয়গুলো রাতারাতি উড়িয়ে দেয়া যাবে না। সময়টা ১৯৭২ নয়। এখন ধর্ম সমাজ- রাজনীতিতে অনেকটা স্পেস নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু এ সাংঘর্ষিক অবস্থা কতটা হ্রাস করা যায় সেটি ভেবে দেখা দরকার। হয়ত, ১৪ দল আরেকবার ম্যান্ডেট পেলে এ বিষয় সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করতে পারে। অথবা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী শক্তি যদি হেজাবিদের থেকে শক্তিশালী হতে পারে এবং হেজাবিরা যে ধর্মের নামে ধোঁকা দিচ্ছে সেটি তৃণমূলে বোঝানো যায়, তা’হলে বিষয়টি সহজ হবে। হেজাবিদের কোরান পোড়ানো একটি সুযোগ এনে দিয়েছে। আমাদের মনে রাখা দরকার, হেজাবিরা একটি দু’টি নয় কয়েক শ’ কোরান, জায়নামাজ ও তসবি পুড়িয়ে ফেলার পরও হেজাবিদের তেমনভাবে ধোলাই দিতে কেউ নামেনি। কিন্তু অন্যপক্ষের কেউ যদি অসাবধানেও একটি কোরান পোড়ান তা’হলে ১৪ দলকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য হেজাবিরা বাংলাদেশ তোলপাড় করে ফেলত। মনে রাখা দরকার, সাঈদীর চাঁদে অবস্থানও এদেশের মানুষ বিশ্বাস করে।সুতরাং বাস্তবধর্মী এবং ইতিবাচক কী পদক্ষেপ নেয়া দরকার সেটি ভেবে দেখা উচিত।
(চলবে)
সূত্র: দৈনিক জনকন্ঠ

Monday, May 6, 2013

আমার গর্বের কষ্টে ছেয়ে আছ তুমি, কায়কোবাদ মামা-- আজাদ রাজিব


লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ০৫/০৫/২০১৩ - ১০:০০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি: স্মৃতিচারণ ইজাজ উদ্দীন কায়কোবাদ সাভার
আমার বিয়ের সময় কোন লাইটিং কোম্পানীর সাথে যোগাযোগ করি নাই। অন্যদের বিয়ে করার সময় ব্যবহার করতে দেখেছি, হাস্যকর লাগত। কিন্তু মনে মনে মজাও লাগত। এটা আমি সারা জীবন মনে রাখব, যে সারাদিন কাজ করে, এত এত দৌড়াদৌড়ির মধ্যে কিভাবে সময় বের করে, নিজের বড় ভাগ্নের বিয়েতে লাইটিং এর ব্যবস্থা করেছিল কায়কোবাদ মামা, কাওকে না জানিয়ে, আমাকে খুশি করতে। আমার লজ্জা লাগছিল, কেন এটা করলা মামা – প্রশ্ন করলে বলেছিল – আরে মামা তুমি কি বল, তুমি আমার ভাগ্নে না। আমি মনে মনে হেসে ভেবেছিলাম, ও এইরকম ই। ছোট, বড় যা কিছু করবে তা হবে least expected.

মামার মত ডানপিটে আর ফানি প্রকৃতির মানুষ আমি জীবনে কম দেখেছি। কারেন্ট চলে গেলে চিৎকার দিয়ে মানুষকে ভয় দেখানোর কথা মনে পড়ছে আমার। বাসায় ঝালমুড়ি বানাচ্ছে, অধীর আগ্রহে বসে আছি কখন খাব আমরা সবাই, মামা কোত্থেকে এসে ইয়া বিশাল মুঠ করে প্রায় পুরোটা একবারে মুখে দিয়ে দিল, আর খালামনি ওই হারামি ওই বলতে বলতে... মামা দিল দৌড়। আমরা হতাশ নয়নে ঝালমুড়ির গামলার দিকে তাকিয়ে আছি।

এই গল্পটা আমার মনে পড়ছে। আমাদের ফার্মগেটের বাসায় চাম্পা কলা বিক্রি করতে এক লোক আসত। লোকটা খুবি খাট প্রকৃতির ছিল, মাথায় ডালাতে কলা রেখে হাক দিত, কলা কলা... চাম্পা কলা। একদিন মামা আর আমি বাজার এ গিয়েছি, সামনে দেখি ওই লোক হেটে যাচ্ছে। মামা দেখলাম পিছনে পিছনে হাটছে আর কলা তুলে খাচ্ছে। আমি ফিসফিস করে বলার পর ও বলল, আরে ও টের পাবে না, তুই ও খা। আমাকে হাতে একটা কলা দেবার পর আমি হা করে তাকিয়ে ছিলাম, করে কি মামা।

এটা বলা ঠিক হবে কিনা জানিনা, তাও বলি। একবার শবে বরাতের বা কদরের রাত্রে মসজিদে গিয়েছি মামার সাথে। বরাবরের মত আমাদের টার্গেট মিলাদ শেষে জিলাপী খাব। মিলাদ শেষ হল, স্পেশাল রাত, তাই অনেক জিলাপী আর মিষ্টির প্যাকেট। এক হুজুর মিষ্টি বিলানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমি অপেক্ষা করছি, আর ঐসময় মামা উঠে গিয়ে ঐ হুজুরকে বলল, আমাকে একটা প্যাকেট দেন, আমিও বিলাই। হুজুর তো ভালো মনে করে দিল এক প্যাকেট, জানিনা এর মধ্যে মিষ্টি নাকি জিলাপী। হুজুর তখন মিষ্টি বিলানো মাত্র শুরু করেছেন, এসময় মামা বলল, বাবু তুই এদিকে আয়। আমি ভাবলাম, হুদাই এই কাজ করতেছে, এখন আমাকেও মিষ্টি সাপ্লাই করতে হবে। আচ্ছা ঠিকাছে, আমি ফলো করতেছি ওকে, ও কাওকে মিষ্টি তখনো দেয় নাই, পেছন থেকে দেয়া শুরু করবে তাই মসজিদের একেবারে দরজার কাছে পৌছে গেল, আর আমি পিছে পিছে। এসময় আমার দিকে ফিরে বলল, বাবু দৌড় দে। আমি এতক্ষনে বুঝলাম ব্যাপারটা কি। কিন্তু ওকে নিরস্ত করার আগে ও দিল দৌড়, এখন আমিও তো accomplice. আমিও দিলাম জান হাতে নিয়ে দৌড়। তারপর বাসায় গিয়ে আমাদের জিলাপী বিলাস। আজো হাসি, এত দুঃখের ভেতরেও।

মামা খেলাধুলাতে ছিল ওস্তাদ। একদিনের কথা বলি, সেন্ট যোসেফ স্কুলের মাঠে একবার বাইরের কিছু ছেলে এসে ক্রিকেট প্র্যাক্টিস করছিল। মামা দেখলাম ওদেরকে কনভিন্স করে কাঠের বল হাতে নিয়ে বলিং করা শুরু করল। তার একটা বলও আমি দেখিনাই, ঐ ব্যাটসম্যান রাও দেখেনাই। আমি তখন নটরডেম এ পড়ি, মামাকে সম্ভবত ওরা চাকিং করছে বলে নিরস্ত করেছিল। কিন্তু আমি শিওর ছিলাম, ওরা আসলে ঠেকাতে পারছিল না মামার বল।

মামার গল্প বলে ফুরানো যাবে না। আমি তাকে বলেছি সবসময়, তোমার পোটেনশিয়াল সেরকম। তুমি লেখাপড়া বা খেলা কিছু একটা তে কাজে লাগাও। ও শুধু শুনত আর হাসত।

তোমার সাহসিকতা আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে মামা। তুমি কেন এত ডানপিটে ছিলে মামা, কেন এত সাহসী ছিলে। কে বলেছিল তোমাকে সাহস দেখাতে এত। নিজের জীবনের পরোয়া তো কখনই করনি, এখন নিজের পরিবারকে, আমাদেরকে পরোয়া করলে না এতটুকু।

আমার গর্বের কষ্টে ছেয়ে আছ তুমি কায়কোবাদ মামা।
সূত্র: সচলায়তন