Monday, September 14, 2015

আইএস-এর টার্গেটে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ?-সুমি খান

বাংলাদেশে জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট-এর (আইএস বা আইসিস) সঙ্গে সরাসরি জড়িত একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই ব্রিটিশ নাগরিক ইরাক ও সিরিয়া ভিত্তিক আইএস-এর সঙ্গে জড়িত বলে দাবি পুলিশের৷ সামিউন ওরফে ইবনে হামদান নামের এই তরুণকে গোয়েন্দারা গ্রেপ্তার করেন রবিবার রাতে৷ তার কাছ থেকে মোবাইল ফোন এবং জঙ্গি তত্‍পরতায় জড়িত থাকার প্রমাণ সম্বলিত কিছু কাগজ-পত্রও উদ্ধার করা হয়েছে৷ জানা গেছে, সামিউনকে গ্রেপ্তার করা হয় এর আগে গ্রেপ্তার হওয়া হাফিজুর রহমান নামে আরেকজনের তথ্যের ভিত্তিতে৷ তার তথ্যমতে, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক সামিউন বাংলাদেশে আইএস-এর তত্‍পরতা জোরদার করার কাজ করছিল৷

গত কয়েক সপ্তাহে আইএস-এর সঙ্গে জড়িত সন্দেহে আরো কয়েকজনকে আটক করে পুলিশ৷ গত বুধবার ঢাকা থেকে জঙ্গি তত্‍পরতায় জড়িত থাকার অভিযোগে মো. আসিফ আদনান ও মো. ফজলে এলাহী তানজিল নামে দুই যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়৷ এদের মধ্যে আদনান সুপ্রিম কোর্টের সাবেক এক বিচারপতির ছেলে এবং তানজিলের মা যুগ্ম সচিব৷ তারা নাকি ‘জিহাদে' অংশ নিতে তুরস্ক ও সিরিয়া যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল৷


 গত কয়েক সপ্তাহে আইএস-এর সঙ্গে জড়িত সন্দেহে আরো কয়েকজনকে আটক করে পুলিশ
গোয়েন্দারা গত ১৯শে সেপ্টেম্বর নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবি-র ভারপ্রাপ্ত আমির আব্দুল্লাহ আল তাসনিম ওরফে নাহিদসহ সাতজনকে আটক করেন৷ তারাও আইএস-এর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিল বলে গ্রেপ্তারের পর সংবাদমাধ্যমকে জানান গোয়েন্দারা৷

মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘বাংলাদেশে আইএস-এর অনুসারীদের তত্‍পরতা তাদের নজরে আসছে৷ কোণঠাসা হয়ে যাওয়া জঙ্গি সংগঠনগুলোর সদস্যরা ইরাক এবং সিরিয়ার ঘটনায় এখন নতুন করে আইএস-এর দিকে ঝুকছে৷ তারা উদ্বুদ্ধ হচ্ছে৷''
তিনি জানান, ‘‘এর আগে আইএস-এর সঙ্গে যোগাযোগ আছে বা যোগাযোগের চেষ্টা করছেন এমন কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে৷ আর রবিবার আইএস-এর সঙ্গে সরাসরি জড়িত একজনকে আটক করা হলো৷''

ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান জানান, ‘‘আটক সামিউনের কাছ থেকে তার ব্রিটিশ পাসপোর্ট, এটিএম কার্ড এবং ৬টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে৷ তাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে যে, সে সিরিয়ায় আইএস-এর সদস্য হিসেবে যুদ্ধ করেছে৷ তার মোবাইল ফোনের এসএমএস থেকেও এর প্রমাণ পাওয়া গেছে৷''
মাসুদুর রহমান জানান, ‘‘এর আগে আটক হওয়া দু'জন জঙ্গি তাদের জানিয়েছেন সামিউন বাংলাদেশে বিশেষ পরিকল্পনা নিয়ে আসে৷ আইএস-এর নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার জন্যই সে বাংলাদেশে এসে কাজ শুরু করে৷ শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে আসার আগে থেকেই সে এখানকার জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলে৷''

তিনি জানান, ‘‘সামিউনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসবাদ করা হবে৷ আর তখনই জানা যাবে আইএস বাংলাদেশে আদৌ কোনো শক্ত নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে পেরেছে কিনা৷''

Saturday, August 29, 2015

আলবদররা কী করেছিল?-মুনতাসির মামুন

হবে কী হবে না? হ্যামলেটের সেই বিখ্যাত উক্তির মতো-‘টুবি অর নট টু বি’। মুজাহিদের দন্ডের দু’একদিন আগে থেকে এ প্রশ্নটিই ঘুরপাক খাচ্ছিল বিভিন্ন মহলে। উন্নয়নের ধাক্কায় যখন রাস্তাঘাট বিপর্যস্ত, মানুষ ঘর্মাক্ত ও বিরক্ত তখনও এ প্রশ্ন ছিল অনেকের মুখে। আমাকে ফোন করে জানতে চেয়েছেন অনেকে, যেন আমি সবজান্তা। আমি পরে নিজেকে প্রশ্ন করেছি, এ উদ্বেগ কেন সবার মাঝে? মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের দণ্ড হওয়ার পর আপীল বিভাগে গেলে কেন এ প্রশ্ন ওঠে? এর অর্থ মানুষের সম্পূর্ণ আস্থা নেই। না থাকার কারণ কি? কারণ, পূর্ববর্তী কয়েকটি রায়ে ইতিহাস অমান্য করে দণ্ড হ্রাস বা মওকুফ। আইন দিয়ে ইতিহাস ঠেকানো কেউ পছন্দ করেনি একমাত্র জামায়াত-বিএনপি ছাড়া। এ বিষয়টি আইনের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সবার ভেবে দেখা উচিত। পদে গেলে পদ এক সময় সবাইকে হারাতে হয়। তখন? উচ্চ আদালতের অনেক বিচারককে প্রকাশ্যে কেন দেখা যায় না পদ হারানোর পর। এর মধ্যে প্রধান বিচারপতিই আছেন কয়েকজন। সাম্প্রতিককালে একমাত্র বিচারপতি খায়রুল হক-ই দিব্যি হেসে খেলে অবসরোত্তর জীবন যাপন করছেন। কেন?
এসব প্রশ্ন আরও তীক্ষè হয়েছিল বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরীকে এই বেঞ্চে না রাখার কারণে। তার ভক্তের সংখ্যা যেমন প্রচুর, তাকে অপছন্দ করেন এমন সংখ্যাও কম নয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে তার অবিচল পক্ষপাত অনেককে বিচলিত করে।
 এখানেই প্রশ্ন আসে আইন ও ইতিহাস নিয়ে। প্রশ্ন ওঠে বিচারের সব পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এবং সেই দৃষ্টিভঙ্গি আইন ও ইতিহাসকে পর্যুদস্ত করছে কিনা তা নিয়ে। সে আলোচনা পরে।

‘যুদ্ধাপরাধ আবার কী? বাংলাদেশে কোন যুদ্ধাপরাধী নেই।’ ২০০১ সালে মুজাহিদ এ রকম ঔদ্ধত্যভরেই কথা বলতেন। তার দাম্ভিকতা ঔদ্ধত্য কখনই কেউ পছন্দ করেনি। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের মধ্যে একমাত্র সাকাচৌ-ই এ বিষয়ে তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেন। মুজাহিদকে আমার সব সময় মানবতাবিরোধী অপরাধীদের মধ্যে সবচেয়ে ঠা-া মাথার ও ধূর্ত মনে হয়েছে। অবশ্য, বলতে পারেন এ ধরনের অপরাধীরা ঠা-া মাথার না হলে এত হত্যাকা- বা ধর্ষণ কিভাবে করেছিলেন? খালেদা জিয়া মুজাহিদকে খুব পছন্দ করতেন। কখনও নির্বাচনে না জিতলেও খালেদা ২০০১ সালে মুজাহিদকে সমাজকল্যাণমন্ত্রী বানিয়েছিলেন। একটি বিষয় লক্ষণীয়, খালেদা জামায়াতের যে দু’জনকে মন্ত্রী বানিয়েছিলেন নিজামী ও মুজাহিদ তারা দু’জনই ছিলেন ১৯৭১ সালে আলবদর কমান্ডার ও উপ-কমান্ডার। রক্তের প্রতি খালেদার এক অদম্য আসক্তি আছে। তার প্রমাণ ২০০১-৬ ও ২০১৩-১৪ সালের ঘটনাবলি। কত মানুষ যে পুড়িয়েছেন তিনি! রক্তের প্রতি আসক্তির কারণেই ঐ দু’জনকে মন্ত্রী করেছিলেন। মুজাহিদ সমাজকল্যাণমন্ত্রী হয়ে সারাদেশে সরকারী টাকায় জামায়াতী প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করেছিলেন। আজ যে বিতর্ক উঠছে বিএনপি জামায়াত ছাড়বে কিনা তার উত্তর- না। আমরা ইতিহাস না জেনে বিতর্ক করি। জিয়াউর রহমান খুনীদের মাঠে এনেছিলেন তাদের ত্যাগ করার জন্য নয়, তার গুন্ডাবাহিনী হিসেবে কাজ করার জন্য। জামায়াত বিএনপির গুণ্ডা বাহিনী হিসেবে কাজ করবে, আর গডমাদার তাকে প্রটেকশন দেবেন। এটি বাস্তব ও সাধারণ সত্য।

 আলবদর আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ১৯৭১ সালে তার বাহিনী নিয়ে প্রথমে অসম পরে দিল্লী জয় করতে চেয়েছিলেন। কেন পারেননি সে প্রসঙ্গ পরে। পালিয়েছিলেন নেপাল, তারপর পাকিস্তান। আলবদর বন্ধু জিয়াউর রহমানের আমলে ফিরে আসেন দেশে। জেনারেল জিয়ার স্ত্রীর আমলে মন্ত্রী। ট্রাইব্যুনালে বিচারের সময় দেখেছি কাঠের বেষ্টনীতে বসে। এত উত্থান পতন একজনের জীবনে খুব কমই আসে। ট্রাইব্যুনালের বিচারকরা যখন রায় পড়ছিলেন তখন মনে হয়েছিল এই আলবদর কমান্ডারকে ১৯৭১ সালে আমরা বলতাম আজরাইল।
 মুজাহিদের পুরো পরিবার রাজাকার। তার পিতা শান্তি কমিটির সদস্য হিসেবে মানুষজন হত্যা, লুটপাট করেছেন। তার পুত্র পৃথিবীর ইতিহাসে হিংস্রতম একটি বদর বাহিনীর উপপ্রধান ছিলেন। বদর বাহিনী যা করেছে তার জন্য মৃত্যুদন্ডও যথেষ্ট শাস্তি নয়।

 ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী বাহিনীর সহযোগী হিসেবে বদর বাহিনীর সৃষ্টি হয়। জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ রূপান্তরিত হয় আলবদর বাহিনীতে। এর বাইরেও যে কিছু লোকজন আলবদর বাহিনীতে যোগ দেয়নি তা নয়। ইসলামী ছাত্রসংঘের (সারা পাকিস্তান) প্রধান মতিউর রহমান নিজামী নিযুক্ত হন আলবদর বাহিনীর প্রধান। মুজাহিদ ছাত্র সংঘের হোমরা চোমরা ছিলেন। ১৯৭১ সালেই তিনি পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রধান হন, সে হিসেবে আলবদরদের উপকমান্ডার। বস্তুত মাঠে মুজাহিদের দাপটই ছিল বেশি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে সাতটি অভিযোগ করা হয়েছিল। আসলে এত অভিযোগের দরকার ছিল না। বুদ্ধিজীবী হত্যায় জড়িত ও নেতৃত্বদানের কারণেই তিনি মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হতেন। আলবদর নেতা হিসেবে হত্যার পরিকল্পনা পন্থা সবই তার নির্দেশে হতো। মুজাহিদের মতো হিংস্র মানুষ খুব কমই দেখা মেলে। তার সেই হিংস্রতা বয়সের কারণেও হ্রাস পায়নি। তার অবয়ব দেখলেই তা অনুমান করা যায়।
 প্রত্যেক আলবদরই যুদ্ধাপরাধী। তারা ছিল পাকিস্তানী বাহিনীর সহযোগী শক্তি, তবে সরাসরি অধীনস্থ। তারা কখনও কখনও স্বাধীনভাবে কাজ করলেও পাকিস্তানী সেনা কমান্ডের অনুমতি ছাড়া সাধারণত কাজ করতে পারত না। তাদের প্রশিক্ষণ, বেতন, অস্ত্রশস্ত্র সব পাকিস্তানী বাহিনীই যোগাত। সুতরাং ১৯৭১ সালের খুন, ধর্ষণ, হত্যা, লুট, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতির দায়দায়িত্ব তাদের ওপরও বর্তায়। পাকিস্তান বাহিনীর ওপর নির্ভরতা ও তাদের হয়ে কাজ করার প্রমাণ এখনও পাওয়া যাচ্ছে। মনসুর খালেদের বইয়ের একটি অধ্যায় আছে ‘আলবদরদের অবদান’। তিনি বিভিন্ন সাক্ষাতকার, পত্রপত্রিকা থেকে আলবদর সম্পর্কে পাকিস্তানীদের বিবৃতি, বক্তৃতা সঙ্কলন করেন।
 এসব পাকিস্তান সরকার ও পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততাই তুলে ধরে এবং এগুলো যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ।

 মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ‘অপারেশন সার্চ লাইটের’ সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বেসামরিক প্রশাসনের দেখাশোনাও তিনি করতেন। বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য তিনি দায়ী এ কথা অনেকেই বলেছেন। আমি ও মহিউদ্দিন আহমদ যখন তার সাক্ষাতকার নিই রাওয়ালপিন্ডিতে, তখন তিনি ১৯৭১ সালের গণহত্যার কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, (১৯৯৮) আমাকে যে রাজাকার, আলবদর, আলশামস সবকিছু ছিল নিয়াজীর নিয়ন্ত্রণে। তিনি এর কিছুই জানেন না। ৯-১০ ডিসেম্বরের একটি ঘটনার কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। তার ভাষায়-
‘শুনুন, জেনারেল শামসের ছিলেন পিলখানার দায়িত্বে। তিনি আমাকে তার সঙ্গে দেখা করতে বলেন। তিনি জানান, আমাদেরকে জেনারেল নিয়াজীর সঙ্গে দেখা করতে হবে। জেনারেল নিয়াজীর সঙ্গে সাধারণত আমাদের কোন বৈঠক হয় না। জেনারেল শামসেরকে বললাম, ঠিক আছে যাব। পিলখানায় পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে এলো। সেখানে দেখলাম কিছু গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে কেন? তিনি বললেন, বিশেষ উদ্দেশ্যে আমরা জেনারেল নিয়াজীর কাছে যাচ্ছি, সে জন্যই গাড়িগুলো এখানে। তারপর বললেন, কয়েকজন লোককে গ্রেফতার করতে হবে। জিজ্ঞেস করলাম, কেন? বললেন, কথাটা নিয়াজীকেই তুমি জিজ্ঞেস কর। এতে তোমার মত কি? আমি বললাম, স্যার, এখন কাউকে গ্রেফতারের সময় নয়, বরং এখন কত লোক আমাদের সঙ্গে আছে সেটিই দেখার বিষয়।’

এই যে গ্রেফতার ও গাড়িগুলোর কথা বলা হচ্ছে, এখানেই ইঙ্গিত আছে আলবদরদের। আলবদররা তখন বিভিন্ন এলাকায় হানা দিয়ে মানুষ তুলে নিচ্ছে। এ গাড়িগুলো আলবদরদের দেয়া হতো মানুষজনকে তুলে নেয়ার জন্য।

 আমাকে যখন জেনারেল ফরমান এ কথাগুলো বলেন, তখন বোধহয় তিনি ভুলে গেয়েছিলেন ১৯৮৩ সালে দৈনিক জং ও দৈনিক নওয়ায়ে ওয়াক্তে এক সাক্ষাতকারে তিনি কি বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আলবদর ও আলশামসের কার্যকলাপের আমি প্রত্যক্ষ দর্শক। এই দুটি সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মোকাবেলায় তাদের জান কুরবান করেছিল।’

জেনারেল নিয়াজী কিন্তু ব্যাপারটা অস্বীকার করেননি। আমাকে তিনি বলেছিলেন (১৯৯৮) ‘আলবদর, আলশামস আমারই সৃষ্টি। এ প্রক্রিয়াটি আমি শুরু করি মে মাস থেকে। ওরা সরাসরি আমার কমান্ডে ছিল।’

২১ মে ১৯৭১ সালে আলবদর বাহিনীর যাত্রা শুরু। যে মেজর রিয়াজ এদের সংগঠিত করেছিলেন। তিনি মনসুরকে জানিয়েছিলেন- ‘তারা বাঙালি হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের অখ-তা ও প্রতিরক্ষাকে ঈমানের অংশ ও দ্বীনের দাবি বলে মনে করতেন। ’
ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিকের নাম আমাদের পরিচিত। ঢাকায় ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন। বইও লিখেছেন। ‘ম্যায়নে ঢাকা ডুবতে দেখা’ গ্রন্থে তিনি লিখেছিলেন, ‘আলবদর আলশামস ও রাজাকাররা পাকিস্তানের জন্য তাদের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। যে কোন আদেশ তারা সম্পূর্ণভাবে পালন করত।’

ভাল বলেছেন আলবদরদের সুপার বস আবুল আলা মওদুদী। ১৯৭৩ সালে করাচীর দৈনিক জসরত পত্রিকায় তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে যখন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলছে তখন আলবদররা পাকিস্তানের ঐক্যের পক্ষে কাজ করছিল। আর যখন পাকিস্তানী বাহিনী দুষ্কৃতকারী ও ভারতীয় বাহিনীর গেরিলাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায় তখন এই তরুণরা পাক বাহিনীর পুরোপুরি সহযোগিতা করে। এমনকি সেনাবাহিনীর সাফল্য এই তরুণদের ওপর নির্ভর করেই অর্জিত হচ্ছিল। কেননা সেনাবাহিনীর বিরাট অংশ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের। তারা পূর্ব পাকিস্তানের রাস্তা-ঘাট ও ভাষা জানত না বা চিনত না। ওই সময়ে এই তরুণরা ইসলামের প্রতি ভালবাসা ও দেশপ্রেমে উদ্বেলিত হয়ে সামনে এগিয়ে যায় এবং তারা ভারতীয় বাহিনীর আগ্রাসী হামলা প্রতিহত করার জন্য স্বদেশী বাহিনীকে পূর্ণরূপে সাহায্য করে। তারা প্রচুর কুরবানী স্বীকার করে। এরাই ছিল সেই নওজোয়ান যারা পাক বাহিনীর অগ্রপথিক ছিল। তাদের মধ্য থেকে প্রায় ৫ হাজার ওই সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে শহীদ হয়েছেন আর যারা জীবিত রয়ে গেছেন তারা আপন বাঙালি ভাইদের হাতে এখন শহীদ হচ্ছেন।’

৫০০০ আলবদর নিহত হলে তো আমরা বেঁচে যেতাম। নিহতের সংখ্যা অনেক কম। আর বাংলাদেশ হওয়ার পর তাদের কোথায় নিধন করা হয়েছে? হয়নি। তবে, ধরে নিতে হবে পাকিস্তানীরা বিশেষ করে পাকিস্তানের জেনারেল ও ‘মৌলানা’রা মিথ্যা বলায় অভ্যস্ত।

 মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত যাদের বিচার হয়েছে তাদের অধিকাংশই আলবদর বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কারণ, তখন তারা তরুণ হিসেবে ইসলামী ছাত্রসংঘের সঙ্গে জড়িত হয়ে গিয়েছিলেন। আর পুরো ছাত্রসংঘ রূপান্তরিত হয়েছিল আলবদরে। মতিউর রহমান নিজামী ছিলেন আলবদর প্রধান, মুজাহিদ উপ-প্রধান, কামারুজ্জামান ছিলেন শেরপুরের কমান্ডার। নয়াদিগন্ত পত্রিকার মালিক মীর কাসিম ছিলেন চট্টগ্রামের, কাদের মোল্লা ছিলেন মিরপুরের।
 সশস্ত্র আলবদররা রাজাকার, শান্তি কমিটি থেকেও ছিল বেশি সংগঠিত,অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ও বেশি হিংস্র। বস্তুত, যুদ্ধাপরাধী যতজন গ্রেফতার হয়েছেন তার মধ্যে মুজাহিদ ছিলেন সবচেয়ে হিংস্র। ১৯৭১ সালে তিনি বলেছিলেন- ‘পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘ পৃথিবীতে হিন্দুস্থানের কোন মানচিত্র স্বীকার করে না। ইসলামী ছাত্রসংঘ ও আলবদর বাহিনীর কাফেলা দিল্লীতে উপনীত না হওয়া পর্যন্ত ছাত্রসংঘের একটি কর্মীও বিশ্রাম গ্রহণ করবে না।
 এখন থেকে দেশের কোন পাঠাগার, গ্রন্থাগার, পুস্তক বিক্রয় কেন্দ্র বা দোকানে পাকিস্তানের আদর্শবিরোধী কোন পুস্তক রাখা চলিবে না। কোন স্থান, গ্রন্থাগার ও দোকানে পাকিস্তানের আদর্শ ও সংহতিবিরোধী পুস্তক দেখা গেলে তা আগুনে পোড়ানো হবে।’

আগে যে বলেছি, আলবদরের সর্বোচ্চ শাস্তিও যথেষ্ট নয় তার একটি কারণ আছে। একজন মানুষ আরেকজনকে খুন করতে পারে গুলি করে, ছুরিকাঘাত করে ও নানাভাবে। কিন্তু ঢাকার আলবদররা মুজাহিদের নির্দেশে সাত মসজিদ রোডের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে মানুষজনকে জড়ো করত এবং নানাবিধ অত্যাচার করত, তারপর হত্যা করত বিচিত্র সব উপায়ে। আজ অনেক তরুণ যখন জামায়াতের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করে তখন বলতে ইচ্ছে হয় এদের পিতা-মাতাকে মুজাহিদদের হাতে তুলে দিলে কেমন হয়? বা বিএনপির যেসব তরুণ জামায়াতের তরুণদের সঙ্গে গলাগলি করে গাড়ি পোড়ায়, পুলিশ হত্যা করে তাদের বা তাদের পিতা-মাতাকে আলবদরদের হাতে তুলে দিলে বা তাদের হাতে মৃত্যু হলে তারা জামায়াত সমর্থন করত?

আলবদররা কী করেছিল? এ প্রশ্ন শুনে অনেকে বলতে পারেন সবাই যা জানে সে বিষয়ে প্রশ্নের তাৎপর্য কী? আলবদর পাকিস্তানীদের সাহায্য করেছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ব্যক্তিদের দমনে। এ কারণে, একদিকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলে গেরিলা/সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। অন্যদিকে, নিরীহ বাঙালিদের বাড়িঘর লুট করেছে, হত্যা করেছে ও ধর্ষণ করেছে। এথনিক ক্লিনজিংয়ে নেতৃত্ব দিয়েছে। কিন্তু, আলবদর আরেকটি কাজ করেছে। তা হলো, সুনির্দিষ্টভাবে বুদ্ধিজীবী/পেশাজীবীদের হত্যা করেছে। আলবদর বাহিনী গঠন হওয়ার পর থেকেই এ হত্যাকা- পরিচালিত হয়েছে, তবে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে অপহরণ ও হত্যাকা- তুঙ্গে ওঠে। সারা বাংলাদেশে একযোগে বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ ও হত্যা করা হয় পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে। অপহরণের পর নিষ্ঠুরভাবে অত্যাচার চালানো হয়। মাঝে মাঝে মনে হয়, আলবদর হোক, রাজাকার হোক, মানুষ কি মানুষের ওপর এমন অত্যাচার করতে পারে? ১৯৭১-৭২ সালের দৈনিক পত্রপত্রিকাগুলো দেখলে আলবদরদের নিষ্ঠুরতার অনেক খবর জানা যাবে।
 রায়েরবাজার ও মিরপুরের বধ্যভূমি যা আবিষ্কৃত হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর, আলবদরদের নৃশংসতার প্রতীক। দুয়েকটি উদাহরণ দেয়া যাক- ‘আর একটু এগিয়ে যেতেই সামনে বড় বড় দুটো মস্ত মানুষ, নাক কাটা, কান কাটা, মুখের কাছ থেকে কে যেন খামচিয়ে মাংস তুলে নিয়েছে হাত-পা বাঁধা।...’

 ‘আর একটু এগিয়ে যেতেই বাঁ হাতের যে মাটির ঢিবিটা ছিল তারই পাদদেশে একটি মেয়ের লাশ। মেয়েটির চোখ বাঁধা । মুখ ও নাকের কোন আকৃতি নেই, কে যেন অস্ত্র দিয়ে তা কেটে খামচিয়ে তুলে নিয়েছে। স্তনের একটি অংশ কাটা.. মেয়েটি সেলিনা পারভীন। শিলালিপির এডিটর।...
‘মাঠের পর মাঠ চলে গিয়েছে। প্রতিটি ফলার পাশে পাশে হাজার হাজার মাটির ঢিবির মধ্যস্থ কঙ্কাল সাক্ষ্য দিচ্ছে কত লোক যে এই মাঠে হত্যা করা হয়েছে।’

 ‘ঢাকার রায়েরবাজারের বধ্যভূমি দেখে এসে এই প্রতিবেদন লিখেছিলেন অধ্যাপিকা হামিদা রহমান। হামিদা রহমান ডা. ফজলে রাব্বীর লাশ দেখে লিখেছিলেন-‘ডা. রাব্বীর লাশটা তখনও তাজা, জল্লাদ বাহিনী বুকের ভিতর থেকে কলিজাটা তুলে নিয়েছে। তারা জানত যে, তিনি চিকিৎসক ছিলেন। তাই তাঁর হৃৎপি-টা ছিঁড়ে ফেলেছে। চোখ বাঁধা অবস্থায় কাত হয়ে দেহটা পড়ে আছে। পাড় থেকে ধাক্কা দিয়ে গর্তের মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে। রাব্বী সাহেবের পা দুখানা তখনও জ্বলজ্বল করে তাজা মানুষের সাক্ষ্য দিচ্ছে। নাক, মুখ কিছুই অক্ষত ছিল না। দস্যু হায়েনার নখের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত।... সামনে চেয়ে দেখি, নিচু জলাভূমির ভিতর এক ভয়াবহ বীভৎস দৃশ্য। সেখানে এক নয়, দুই নয় একেবারে বারো/তেরোজন সুস্থ সবল মানুষ। একের পর এক শুয়ে আছে।’

মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ বলেছিলেন ‘হানাদার পাক বাহিনীর সহযোগী আলবদররা পাক সেনাদের আত্মসমর্পণের পর যখন পালিয়ে যায় তখন তাদের হেড কোয়ার্টারে পাওয়া গেল এক বস্তা বোঝাই চোখ। এ দেশের মানুষের চোখ। আলবদরের খুনীরা তাদের হত্যা করে চোখ তুলে বস্তা বোঝাই করে রেখেছিল।’ [দৈনিক পূর্বদেশ, ১৯.১.১৯৭২] উল্লেখ্য, ডা. আলীম চৌধুরীর চোখ আলবদররা উৎপাটন করেছিল।

মওলানা তর্কবাগীশ আরও বলেছিলেন, ‘খুনীদের নামে এই বাহিনীর নাম দেয়া হলো আলবদর বাহিনী। এ কি কোন মনঃপূত নাম? যে বদর যুদ্ধ ছিল আদর্শের জন্য, ইসলামের প্রথম লড়াই, সেই যুদ্ধের সঙ্গে কি কোন সংযোগ এই নৃশংসতার মধ্যে ছিল? হানাদারদের সহযোগী এই বদর বাহিনী শুধু ইসলামের শত্রু নয়। এরা হলো জালেম।’

 আলবদর কমান্ডার মুজাহিদের ফাঁসির রায় বহাল রেখেছে ট্রাইব্যুনাল। রায়ে এটি সর্বোচ্চ শাস্তি হলেও ৭১-এ তার অপরাধের পরিধি এতই ব্যাপক ছিল যে, কেবল ফাঁসিই তার জন্য যথেষ্ট নয়-সাংবাদিক আনিসুর রহমান শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমি দেখে এসে বলেছিলেন- ‘ইতিহাসে পৈশাচিকভাবে হত্যার অনেক কাহিনী পড়েছি। কিন্তু শিয়ালবাড়িতে ওই পিশাচরা যা করেছে এমন নির্মমতার কথা কি কেউ পড়েছেন বা দেখেছেন? কসাইখানায় কসাইকে দেখেছি জীবজন্তুর গোস্তকে কিমা করে দিতে। আর শিয়ালবাড়িতে গিয়ে দেখলাম কিমা করা হয়েছে মানুষের হাড়। একটা মানুষকে দু’টুকরো করলেই যথেষ্ট পাশবিকতা হয়, কিন্তু তাকে কিমা করার মধ্যে কোন্ পাশবিকতার উল্লাস?

... সত্যি আমি যদি মানুষ না হতাম, আমার যদি চেতনা না থাকত, এর চেয়ে যদি হতাম কোন জড় পদার্থ তাহলে শিয়ালবাড়ির ওই বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে মানুষ নামধারী এই দ্বিপদ জন্তুদের সম্পর্কে এতটা নিচু ধারণা করতে পারতাম না। মানুষ যত নিচই হোক, তবুও ওদের সম্পর্কে যে সামান্যতম শ্রদ্ধাবোধ ছিল তা একেবারেই উবে যেত না, আর মানুষ কেন, কোন প্রাণীই কি পারে এত নির্মম, এত বর্বর, এতটা বোধহীন হতে?... শেষ পর্যন্ত আর দেখতে চাই না বলে মাটি, ভুল বললাম মানুষের হাড়ের ওপর বসে পড়তে হয়েছে। সারা এলাকায় মানুষের হাড় ছাড়া অবিমিশ্র মাটি কোথায়?’
আমরা শিয়ালবাড়ির যে বিস্তীর্ণ বন-বাদাড়পূর্ণ এলাকা ঘুরেছি তার সর্বত্রই দেখেছি শুধু নরকঙ্কাল আর নরকঙ্কাল। পা বাঁচিয়েও হাড়হীন মাটির ওপর পা ফেলতে পারিনি। দেখেছি কুয়ায় কুয়ায় মানুষের হাড়।’ [দৈনিক পূর্বদেশ, ৮.১.১৯৭২]
আলী আকবর টাবী দৈনিক আজাদ উদ্ধৃত করে লিখেছেন, গ্রেফতারকৃত এক আলবদর স্বীকার করেছিল- ‘আর এক সপ্তাহ সময় পেলেই আলবদর বাহিনী সকল বাঙালী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে ফেলত।’ 

'তুতো ভাই -তুতো বোন'- সুমি খান

'তুতো ভাই -তুতো বোন
 পিঠ চাপড়ানো,
ক্ষমতার পাছে পাছে
শুধু দৌড়ানো-
মুখোশটা সরালেই
আগে পরে 'তুতো'রা ই
লেন দেনে মদ -নারী-
নাচানাচি-বেশ !
বাহবা  বাহবা-
 বেশ বেশ বেশ!

খর্ব চিত্তে অর্থ বিত্তে
যতোই লুটোপোটি -
স্বচ্ছ চিত্তে ঘেন্না পিত্তে
 কেবল থুথু ছিটি!


দশদিক দেখিয়া বলি,
শোন পূণ্যবান
আবদেল মান্নানের কথা অমৃতসমান-
"সমান সমান না হলে কি লড়াই জমে আচ্ছা?
ও শুযোরের বাচ্চা!"

২৯ আগষ্ট ২০০৪
রাত ১১টা ১০ মিনিট

Monday, August 17, 2015

দাবি তাই একটাই-প্রবীর সিকদারের মুক্তি চাই - সুমি খান

পিতা মুজিব -
তুমি আমাদের পিতা-
তোমায় নমি বারংবার-
তোমায় স্মরি বারংবার-
তোমার কাছেই কেঁদে মরি বারংবার -
পিতা, দ্যাখো চেয়ে 
তোমার হাতে গড়া দেশের পবিত্র মাটিতে
  কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে  গুমরে মরে
শহীদের রক্তঋণ !
 
তুমি আমাদের পিতা-
কখনো কি ভেবেছিলে- এমন দিনও আসবে এ মুক্ত স্বদেশে ?

 যে দেশের প্রতিটি ধূলিকণা রক্তস্নাত,
সে দেশে শহীদের সন্তানের কন্ঠরোধ করে নিক্ষিপ্ত হবে কারাগারে?
না, এ হয় না পিতা-
রক্তঋণের মুক্তি চাই পিতা!
মুক্তি দাও -মুক্তি চাই, পিতা -
আমার দাদা প্রবীর সিকদারের মুক্তি চাই!

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে  ১১ মাসের সংবিধানেও
আমাকেই সকল ক্ষমতার উৎস করেছিলে-
পিতা আমার -
১৫ আগষ্টের কালো রাতে তোমায় হত্যা করে খন্দকারের দল-
অধিকারহীন করেছে তোমার সন্তানদের-
আর তাই -
তোমার সন্তানেরা আজ ঠুঁটো জগন্নাথ-
ঢাল নেই তলোয়ার নেই -
নিধিরাম সর্দার  আমি
১৩ শহীদের বংশধর প্রবীর সিকদারের দুর্ভাগা ছোট বোন আমি !
আমার দাদা দাগী অপরাধী নন -
তবু তিনি নিক্ষিপ্ত হলেন কারাগারের অন্ধ কুঠুরিতে
তার এক মুহূর্ত আগেও পান নি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ-

রাষ্ট্র তুমি কার?
এমন কলংক যেন না হয় আবার!
রাষ্ট্র , এ দায় এড়াবে কী করে আর?

মুক্ত করো হে সবার সঙ্গে যুক্ত করো হে বন্ধ-
 ঘাতকের আঘাত বারবার যাকে প্রাণহীন করে দেয়!
আবার কী করে যেন মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে আসেন-
 তিনি-প্রবীর সিকদার
র্পর্বপুরুষের পবিত্র রক্ত- শহীদের রক্তে ভেজা মাটি ফিরিযে দেয় তার প্রাণ-
তিনি-প্রবীর সিকদার!

স্বাধীন দেশের এ মাটিতে
কারাগারে নিক্ষিপ্ত হতে হলো এই প্রবীর সিকদারকে-

'অপরাধ' জানবার আগেই কারাগার? কিন্তু কেন, পিতা?
তোমার গড়ে দেয়া এ  রাষ্ট্র -
আত্মপক্ষ সমর্থনের তো সুযোগ দেবে, পিতা!!
জানি, তোমার গড়ে দেয়া রাষ্ট্র
তোমারি রক্তে
 হয়েছে  সিক্ত
এ রাষ্ট্র একাত্তরের পরাজিত শক্তির প্রেতাত্মাদের হাতে জিম্মি-
যে প্রতাত্মারা তোমাকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয় নি -
তোমার প্রতিটি চিহ্ণ বিলীন করে দিতে চেয়েছে মূর্খের দল!
তারা জানেনা তুমি মিশে আছো প্রতিটি বাঙালীর অন্তরে অন্তরে -
এই অপশক্তি বারবার  হত্যা করতে চেয়েছে তোমার কন্যা এ জাতির কান্ডারী শেখ হাসিনাকে -
আগষ্ট কে যেন ভীষণ ভয় তাদের !
আর তাই এই আগষ্টেই যেন তাদের তান্ডব সবচেয়ে বেশি!
দশকের পর দশক-অন্ধকারে ডুবিয়েছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম-নব তারুণ্যকে-

এই আগষ্টেই যারা  মুক্তবুদ্ধির গলা টিপে মারতে চায় -তারা কারা?
সেসব কাদের দোসর?

পিতা তুমি যে লোকেই থাকো-
হয়তো হাসছো-
সত্যি, তোমায় রক্ষা করতে পারে না যে জাতি,
সে জাতি নিজেদের রক্ষা করবে কী করে?
তোমাকে সপরিবারে হত্যা করে যে জাতি -তাষা করবে কী করে?
তোমার কন্যার কাঁধে গুরু দায়িত্ব-
ঘাতকদের একে একে বিচারের কাঠগড়ায় তুলে
রক্তঋণের দায় থেকে জাতিকে মুক্ত করতে
তোমার সুযোগ্য কন্যা  শেখ হাসিনা বদ্ধপরিকর!

যাঁর ত্যাগ এবং তিতিক্ষায় বিশ্বসভায় আজ বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য  দৃষ্টান্ত!
কিন্তু এতো ভালো মনে হয় ভালো নয়!
হায়েনা দের বিষাক্ত নিঃশ্বাসের ছায়া চারপাশে
তোমার সন্তানেরা এই বিষছায়া থেকে মুক্ত হতে পারে নি এখনো-
কখনো পারবে না হয়তো-
দিকে দিকে নাগিনীরা ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস-
নাগপাশে বন্দী প্রশাসন
মুক্তচিন্তা মুক্তিকামী মানুষকে শৃঙ্খলিত করার পথ নিয়েছে-
এ বড়ো সর্বনাশা পথ, পিতা
তুমি জানো!
তোমার সতর্কতায় নজর দেবার মতো সময় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের নেই!
জাতিকে বিপন্ন করে
সকল শুভ কাজের সুফল পন্ড করার
নীল নক্সা কার্যকরে সক্রিয় নীল শক্তি !
সবকিছু নষ্টদের দখলে আজ, পিতা!

  কাকে আর বলি বলো তো?
তুমি বলো না,
রাষ্ট্র যদি সাংবিধানিক অধিকার সম্মান করে-
এমন কালাকানুন বাতিল করতে হবে -
যে আইন ঘাতকের বিচারের জন্যে সহায়ক মনে করে প্রণয়ন,
তা কেন নিরীহের উপর প্রয়োগ ?
এ কি নিপীড়ন নয়?

আর তাই আইনের এমন অপপ্রয়োগ-
 শুধু ঘাতককূলের সহায়ক-

দাবি তাই
একটাই
মুক্তি চাই
মুক্তি চাই!
প্রবীর সিকদারের মুক্তি চাই -
শহীদ পরিবারের  সন্তানের মুক্তি চাই  -

সন্তানেরা -অসহায় স্ত্রী পথ চেয়ে আছে-
চোখের জল বাধ মানে না!

'শোন শোন পিতা-
কহো কানে কানে ,শোনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গল বারতা-
ক্ষুদ্র আশা নিয়ে, রয়েছে বাঁচিয়ে , সদাই ভাবনা- যা কিছু পায়
হারায়ে যায়, না মানে স্বান্তনা..."

শৃঙ্খলিত ইতিহাসের অট্টহাস -সুমি খান


নতুন আগষ্ট আসে!
 শৃঙ্খলিত ইতিহাস
অট্টহাসে!

একাত্তরের রক্তাক্ত ছুরি
মসনদ ঘিরে লুকোচুরি-
সে কোন্ মরীচিকায় বাড়ানো হাত !
টেনে নিলো কারাঘাত!

পিতা-কন্যার রক্তাক্ত সংগ্রামের ফসল
 ঘরে তোলে খন্দকারের দল -
হা!হতোস্মি !
ব্যাভিচারী অপশক্তি-
বিশ্বজয়ী বীর বাংলা
উন্নত শির তব
অধোনত ..পদাবনত....

দরোজায় কড়া নাড়ে আবারো   পঁচাত্তর
নিকষ কালো হাতের সারি.....
লাল সবুজ পতাকা খামচে ধরা
সেই পুরনো শকুন
 হায়েনার সাথে
ত্রস্ত উন্মত্ত
হার্মাদ !

কাতরে বেড়ানো সুখের মরীচিকার ফাঁদে
শৃঙ্খলিত তুমি আমি -
 শ্রাবণের অশ্রুধার
তুমি আমি একাকার-

রসুনের কোষ ঘিরে
হায়েনার উন্মত্ত উল্লাস
অপশক্তির পরাজয়ের আগষ্ট মাস-
 মীরজাফরের রক্তমাখা হাত
ধূলায় লুটিয়ে দেয়-
 লাল-সবুজের জয়নিশান
বিশ্বসভাজয়ী বাংলার বীরোচিত সম্মান- 
কন্টকশয্যা মোর
এ যে কারাগার ঘোর!

শৃঙ্খল ভেঙ্গে উন্মোচিত হোক-
খল নায়কের মুখোশধারী মুখ
মিথ্যাচারী ধ্বজাধারী
জগৎ বলে -'মিথ্যেবাদী , ধিক্ শতবার'-
আমরা আছি লাখো কোটি শহীদ পরিবার !

তাই তো জাগে স্বপ্নের অনন্ত প্রহর -
'জাগো বাহে..........কুন্ঠে সবাই .....'
পিতা তুমি আছো জানি -
মিছে তো নয়-
এখনো তোমারি বরাভয়ে-
তোমারি কন্যার জয়ে -
ফাঁসির দড়িতে ঝুলে ঘাতক শিরোমণিকূল-
আর তাই এখনো বিশ্বাস করি বিলকুল -
দিগ্বিজয়ী  নুরুলদিন হেঁকে যায়-
সত্যবচন হবে না কখনো নির্বাসন!!


সুমি খান ,সকাল ৯টা.১০, মঙ্গলবার ,১৮ আগষ্ট ,২০১৫

Wednesday, June 17, 2015

একজন সাংবাদিককেও বেকার করেননি বঙ্গবন্ধু : তথাকথিত সংবাদপত্রের কালো দিবস প্রসঙ্গ

আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া,বৃহস্পতিবার, ১৮ জুন ২০১৫

১৬ জুন। এই দিনটি আসলেই মৌলবাদী ও স্বাধীনতা বিরোধী রাজনীতির আজ্ঞাবহ একটি ক্ষুদ্র চিহ্নিত মহল ঘটা করে কালো দিবস পালন করে। এবারো ব্যতিক্রম হয়নি। তাদের ভাষায়, এই দিন নাকি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চারটি পত্রিকা বাদে সব সংবাদপত্র বন্ধ করে হাজার হাজার সাংবাদিকদের বেকার করেছিলেন। যা একটি ডাহা মিথ্যাচার। জাতির পিতার মৃত্যুর পর তথ্য সন্ত্রাসের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর চরিত্র হননের যে নিষ্ফল প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল এই তথাকথিত কালো দিবসটি ছিল তার অন্যতম। তৎকালীন বিএফইউজের সভাপতি আহম্মদ হুমায়ুন ও ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিবাহিনীর সহযোগী আনোয়ার জাহিদ ছিল এই কালো দিবস ঘোষণার অন্যতম হোতা। ’৭৫ পরবর্তী সময়ে সামরিক সন্ত্রাসকে খুশি করে নিজেদের আখের গোছানোই ছিল এই অপতৎপরতার মূল লক্ষ্য। তবে আমার সান্ত¡না দেশের সিংহভাগ সাংবাদিক এই অপকৌশলকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন, তারা বরং ২১ জুন দেশব্যাপী সাংবাদিক নির্যাতন দিবস পালন করেন যেদিন বিএনপির লেলিয়ে দেয়া পুলিশবাহিনী জাতীয় প্রেসক্লাবে ঢুকে নির্বিচারে শ্বেত সন্ত্রাস কায়েম করে এবং সাংবাদিকদের নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরীসহ অর্ধশত সংবাদকর্মীকে মারাত্মক জখম করে।
শুধু এই ক্ষুদ্র স্বার্থন্বেষী মহলই নয়, এই বিষয়টি নিয়ে বিএনপি-জামায়াত চক্র সেই ১৯৭৫-এর পর থেকেই মিথ্যাচারে লিপ্ত এবং বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে কালিমা লেপনের ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়ে আসছে। বিএনপি তখন ক্ষমতায়। জাতীয় সংসদের বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে তৎকালীন নৌপরিবহনমন্ত্রী কর্নেল (অব.) আকবর হোসেন হঠাৎ করে সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকদের সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করেন। সরাসরি সংসদের ফ্লোর থেকে সাংবাদিক গ্যালারির প্রতি দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে মন্ত্রী বলেন, এখন যারা সাংবাদিকতা করেন তাদের বয়স ৩১/৩২ বছরের বেশি নয়, আপনারা অনেকেই ইতিহাস জানেন না। আজ আপনারা এখানে বসে সাংবাদিকতা করতে পারতেন না, কারণ ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব মাত্র চারটি সংবাদপত্র রেখে আর বাকিগুলো বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এসে পত্রিকাগুলো মুক্ত করেন। এরপর বিএনপি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ করে। আপনারা ভুলে গেছেন শেখ মুজিব প্রায় ৭-৮ হাজার সাংবাদিককে বেকার করেছিলেন। আর বর্তমানে দেশের সাংবাদিকের সংখ্যা ৩০-৩২ হাজার। এ কৃতিত্ব বিএনপি ও শহীদ জিয়ার। বঙ্গবন্ধু চারটি ছাড়া সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের বেকার করে পথে বসিয়েছিলেন। না। বিষয়টি এমন সরলীকরণের মাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না। এটা কোনো মতেই তৎকালীন যা ঘটেছিল তার বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ নয়। এটা ডাঁহা মিথ্যাচার।
বঙ্গবন্ধুর সময়কার যে সব সাংবাদিক এখনো বেঁচে আছেন কিংবা বহুদিন বেঁচে ছিলেন তাদের স্নেহছায়ায় বসে যখন বঙ্গবন্ধু স্মৃতিচারণ শুনতাম তখন চোখ অশ্রæসজল হয়ে উঠতো। কোনো কোনো সিনিয়র রিপোর্টারের মুখে শুনেছি বঙ্গবন্ধু নিজের প্লেট থেকে নিজ হাতে মেখে সাংবাদিকদের খাইয়ে দিতেন। কারণ কোনো কোনো রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে ভোজপূর্বে এমন বিশৃঙ্খলা হতো যে, কর্মরত সাংবাদিকদের ভিড় অতিক্রম করতে কষ্ট হতো এবং অনেক সময় পেটে নিদারুণ ক্ষুধার আগুন নিয়ে সংবাদ সংগ্রহ ও প্রেরণ করার দায়িত্ব পালন করতে হতো। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ট্যুরে গেলে সাংবাদিকদের ঘুমানোর উপযুক্ত স্থান নির্ধারণের আগে নিজে ঘুমাতে যেতেন না। এমনকি স্বাধীনতার পর বিপন্ন বাংলাদেশে যখন ব্যাংকে একটি কানাকড়িও নেই, সেই সময় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদকে ডেকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে যে দুটি প্রতিষ্ঠানকে বিশাল অর ঋণ দেয়ার জন্য লিখিত নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেই প্রতিষ্ঠান দুটির একটি হলো ‘ইত্তেফাক’ অন্যটি ‘সংবাদ’। অতএব, বঙ্গবন্ধু সংবাদপত্র বন্ধ করে সাংবাদিকদের পথে বসিয়েছিলেন এমন বক্তব্য কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। তবে যে ঘটনাটি ঘটেছিল তা সত্যনিষ্ঠভাবে বিশ্লেষণ করলেই প্রমাণিত হবে তিনি সংবাদপত্র বন্ধ করেননি এবং একজন সাংবাদিককেও বেকার করেননি।
১৯৭৫ সালের ১৬ জুন বঙ্গবন্ধু সরকার নিউজপেপার ডিক্লিয়ারেশন এনালমেন্ট অর্ডিন্যান্স নামে যে আইন পাস করে তা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। এটা ছিল তৎকালীন জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ইতিহাসের এক অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। অনেকেই বলে বেড়াচ্ছেন বঙ্গবন্ধু সরকার একদলীয় বাকশাল (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ) শাসন কায়েম করেছিল। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ রেখে অন্য সব দলের রাজনীতি বন্ধ করে দিলে একদলীয় শাসন বলা যেতো। কিন্তু বঙ্গবন্ধু মূলত বাকশাল নামের একটি জাতীয় প্লাটফর্ম তৈরি করে তার মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতির মেরুকরণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেছিলেন এটি একেবারেই একটি সাময়িক ব্যবস্থা। এর অন্যতম লক্ষ্য ছিল লুটেরা ও ধনিক-বণিক নিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদী অর্থনীতি থেকে সাধারণ মানুষের জন্য কল্যাণমুখী সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তন। এ জাতীয় লক্ষ্য অর্জনের প্রত্যাশিত পদক্ষেপ ছিল একটি অর্থবহ গণমাধ্যম গড়ে তোলা, যা সাধারণ শোষিত-বঞ্চিত মানুষের কল্যাণে নিবেদিত হবে।
কোন পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু নিউজ পেপার এনামেন্ট অর্ডিনেন্সটি জারি করেছিলেন? এ ব্যাপারে দৈনিক দিনকালের উপসম্পাদকীয় পাতায় জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণায় নিবেদিত সাংবাদিকদের নেতা এবং বিএনপি চেয়ারপারসনের এককালের প্রেস উপদেষ্টা রিয়াজউদ্দিন আহমদ একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সংবাদপত্রের কালো দিবস পটভূমি ও ঘটনাপঞ্জি শীর্ষক প্রবন্ধটি লেখার জন্য রিয়াজউদ্দিন সাহেবকে অসংখ্য ধন্যবাদ। যতদূর সম্ভব লেখক তার নিবন্ধে কোনো প্রকার মিথ্যাচার করেননি। তবে চতুর বণিকের মতো তিনি যা করেছেন তা হলো সত্য প্রকাশ না করা। ক্ষেত্র বিশেষে তিনি প্রায় সত্যের কাছাকাছি এসেও শেষ পর্যন্ত এড়িয়ে গেছেন। অথচ সত্য লিখলে তার ব্যক্তিগত কোনো ক্ষতি হতো বলে মনে করি না। বরং একজন সাংবাদিক হিসেবে জাতির কাছে তার যতটুকু দায়বদ্ধতা আছে তা কিছুটা হলেও পূরণ হতো। বঙ্গবন্ধুর প্রতি যে জঘন্য মিথ্যাচার চালানো হচ্ছে তার কিছুটা হলেও লাঘব হতো। অন্যদিকে যে সব ধড়িবাজ লোক জাতীয়তাবাদী আদর্শের পোশাক জড়িয়ে বর্তমানে নিজেদের আখের গোছাচ্ছেন তাদের মুখোশ কিছুটা হলেও জাতির কাছে উন্মোচিত হতো। তবে এমন কাজটি রিয়াজ সাহেব কেনই বা করতে যাবেন?
রিয়াজউদ্দিন তার নিবন্ধে তৎকালীন পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, ১৯৭৪ সালে দেশের রাজনৈতিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে শুরু করে। জুন মাসে অকস্মাৎ বন্যা দেখা দেয় অতিবৃষ্টির কারণে। ফলে ফসল মার খায়। এরপর আগস্ট-সেপ্টেম্বরে প্রচুর বন্যা দেখা দেয় অতিবৃষ্টির কারণে। ফলে ফসল মার খায়। এরপর আগস্ট-সেপ্টেম্বরে প্রচুর বন্যা। দেশে খাদ্যাভাব, মানুষের কাজ নেই, দ্রব্যমূল্য ধরাছোঁয়ার বাইরে, ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রা নেই। তিনি আরো লিখেছেন, ১৯৭৮-এর শেষ দিকে দেশে মারাত্মক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। খাদ্যাভাবে মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে আসতে শুরু করে। কঙ্কালসার মানুষে শহর ভর্তি। শোনা গেল একটি খাদ্যশস্য ভর্তি জাহাজ মধ্য সমুদ্র থেকে অন্য একটি দেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জাহাজটি আসছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে। কিউবার কাছে পাট বিক্রি করার অপরাধে এটি ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে শাস্তি। রিয়াজউদ্দিন আরো লিখেছেন, এ দুর্ভিক্ষের খবর সংবাদপত্রগুলো নির্ভয়ে বস্তুনিষ্ঠভাবে ছাপতে শুরু করে। সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা দৈনিক বাংলা মানুষ মানুষের বমি খাচ্ছে এমন ছবি ছেপেছে। ইত্তেফাকে ছাপা হয় বাসন্তি নামে এক মহিলার ছবি, কাপড়ের অভাবে যে মাছ ধরার জাল জড়িয়ে আব্রু রক্ষার চেষ্টা করেছিল। (যদিও পরবর্তী সময়ে জানা যায়, এটি ছিল একটি বানোয়াট ছবি)। এরপর তিনি আবার লিখেছেন, সোভিয়েত বিরোধী আন্তর্জাতিক মহল দুর্ভিক্ষের পর থেকে শেখ মুজিবের বিপক্ষে কাজ শুরু করে। দেশের ভেতর জাসদ, সর্বহারা পার্টি, হক-তোহা সাহেবরা গোপনে সরকারের ওপর প্রচণ্ড মানসিক ও রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে। সরকারও মরিয়া হয়ে ওঠে। শুরু হয় রাজনৈতিক হত্যা, সঙ্গত কারণেই শাসক দলের লোকই মারা গেল বেশি।
জাতির জনক কেবলমাত্র দেশের মানচিত্র, জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকা বদলানোর জন্য বাংলাদেশ স্বাধীন করেননি। কিংবা দেশের প্রেসিডেন্ট কিংবা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্যও তিনি তার গোটা যৌবনকাল কারাগারে কাটাননি। এটা চাইলে তিনি গোটা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন। এ কথা অবশ্য সবার জানা। রিয়াজউদ্দিন সাহেবের লেখাকেই যদি বস্তুনিষ্ঠ ধরা হয়, তবে সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন আসে দেশের এই মর্মান্তিক পরিস্থিতিতে এবং একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি ভুখা-নাঙ্গা মানুষকে বাঁচানোর জন্য সামাজতান্ত্রিক অর্থনীতির প্রবর্তন করা ছাড়া অন্য কোনো পথ বঙ্গবন্ধুর জন্য খোলা ছিল না। এ কারণেই তিনি দলমত নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে জাতীয় রাজনীতির মেরুকরণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
এবার সংবাদপত্র বাতিলের বিষয়টিতে আসা যাক। জনাব রিয়াজউদ্দিন এক স্থানে লিখেছেন, এমন সময় আমরা সংবাদপত্রের সমস্যা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যাই। তিনি আমাদের দেশের দুরবস্থার কথা বলেন। এরপর রিয়াজউদ্দিন তার নিবন্ধে বঙ্গবন্ধু সেদিন জাতিসংঘ ও ইরাকসহ বিভিন্ন বিষয়ে যে সব কথা বলেন, তার ওপর বিস্তারিত আলোকপাত করেন। কিন্তু সুচতুরভাবে এড়িয়ে গেছেন সেদিন সাংবাদিকদের জন্য এবং সংবাদপত্র শিল্প বিকাশের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর সরকারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কী কথা হয়েছিল। তবে আমরা অনেকেই জানি সেদিন কী কী বিষয়ে সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। রিয়াজউদ্দিন সাহেব ছাড়াও সেদিন বিএফইউজে ও ডিইউজে নেতাদের মধ্যে নির্মল সেন, গিয়াস কামাল চৌধুরী, কামাল লোহানীসহ অন্য নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু নেতাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, সারা দেশে তোদের (আদর করে করে বঙ্গবন্ধু এভাবেই সম্বোধন করতেন) মোট সাংবাদিক সংখ্যা কত? নেতারা বলেছিলেন ৭-৮শ’র মতো। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমার তো কমপক্ষে সারা দেশে ৮-১০ হাজার সাংবাদিক দরকার হবে এবং প্রতিটি সাংবাদিককে হতে হবে চিত্তবিত্তে, জ্ঞান গরিমায় উদ্ভাসিত। শিক্ষিত, মার্জিত, মননশীল ও সুকুমার বৃত্তিতে যারা শ্রেষ্ঠ তারাই থাকবে এ মহান পেশায়। এ কথা শুনে সাংবাদিক নেতারা আবেগাপ্লুত চিত্তে বঙ্গবন্ধুর দিকে চেয়ে থাকেন। বঙ্গবন্ধু বিষয়টিকে আরো পরিষ্কার করে বললেন, আমি চাই দেশে থাকবে প্রচুর সংখ্যক অর্থবহ সংবাদপত্র। উদাহরণ দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ইত্তেফাকে প্রকাশিত দেশ-বিদেশের সংবাদ পড়ে আমার দেশের সাধারণ মানুষের কোনো উপকার হয় না। তোমাদের ঢাকা থেকে প্রকাশিত খবরের কাগজে আমার বিশাল বাংলার গাঁও-গ্রামের কোনো খবর থাকে না। শোন, আমি ইতোমধ্যেই তোদের পেশার সিনিয়র লোকদের সঙ্গে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে একটি আমূল বিপ্লব সাধন করতে চাচ্ছি। সেই লক্ষ্যে আমার সরকারের প্রাথমিক পদক্ষেপগুলো হবে-
এক. দেশে নির্দিষ্ট সংখ্যক জাতীয় দৈনিক থাকবে বাংলা ও ইংরেজিতে। এখানে কর্মরত ব্যক্তিরা, যাদের লেখনীর মাধ্যমে জাতি পাবে সঠিক পথনির্দেশক। দেশের সব পেশা ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে, জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে থাকবে তাদের অবারিত প্রবেশাধিকার। দুই. প্রতিটি পেশার জন্য থাকবে ভিন্ন ভিন্ন জাতীয় দৈনিক। যেমন শ্রমিকদের জন্য শ্রমবার্তা, কৃষকদের জন্য কৃষিবার্তা, মহিলাদের জন্য মহিলাবার্তা, যুবকদের জন্য যুববার্তা, ছাত্রদের জন্য ছাত্রবার্তা, শিশুদের জন্য শিশুবার্তা প্রভৃতি। এ সব পত্রিকায় সংক্ষেপে জাতীয় বিশ্ব সংবাদ ছাপার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট পেশার সব প্রকার সমস্যা ও সম্ভাবনার আলোচনা থাকবে এসব পত্রিকায়। তিন. তোরা জানিস সংবাদ হলো পচনশীল দ্রব্য। গ্রাম বাংলার আনাচে-কানাচে সংগঠিত সংবাদ শহর বন্দর পেরিয়ে রাজধানী ঢাকায় আসতে আসতে পচন ধরে যায়, খবরের পাপড়ি ঝরে যায়, কলি যায় শুকিয়ে। তারপর পত্রিকা অফিসে যখন পৌঁছে তখন এডিটর সাহেব পাঠিয়ে দেন সংবাদ ডেস্কে। পান চিবাতে চিবাতে মফস্বল অডিটর সাহেব সেই শুকনো কলি ফেলে দেন ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে। আর যদি কখনো ছাপা হয় বড় জোর দুই তিন লাইন। গত আগস্টে শৈলক‚পায় স্বামীর প্রহারে স্ত্রীর মৃত্যু অথবা ভাণ্ডারিয়ায় স্বামীর নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে গৃহবধূর আত্মহত্যা। কিন্তু আর কোনো সংবাদ নেই। আমি চাই দেশের ৬২টি জেলার সবকটিতে দৈনিক পত্রিকা থাকবে। বরিশাল বার্তা, চট্টগ্রাম বার্তা, রাজশাহী বার্তা, বগুড়া বার্তা, দিনাজপুর বার্তা প্রভৃতি। চার. প্রতিটি জেলার নিজস্ব দৈনিক পত্রিকা ছাড়াও থাকবে জাতীয় আদলে প্রত্যেক শ্রেণি ও পেশার জন্য ভিন্ন ভিন্ন পত্রিকা এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে থাকবে আকর্ষণীয় বেতন ভাতা ও চাকরির অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা। পাঁচ. তাদের সঙ্গে এবং সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে কোন কোন বাংলা এবং ইংরেজি পত্রিকা জাতীয় দৈনিক হিসেবে থাকবে। একই সঙ্গে সংবাদ সংস্থা সম্পর্কেও অনুরূপ সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। ছয়. নির্বাচিত পত্রিকা এবং সংবাদ সংস্থা ছাড়া অন্য সব পত্রিকা ও সংবাদ সংস্থা আপাতত বন্ধ থাকবে। তবে সেখানে কর্মরত সব সাংবাদিক ও অন্য কর্মচারী নিয়মিত বেতন পাবেন। এ জন্য সাংবাদিক কর্মচারীরা সংশ্লিষ্ট জেলার ট্রেজারি থেকে মাসের প্রথম দিন বেতন ভাতা নিয়ে আসবেন। সাত. চাকরিহীন সাংবাদিকদের নাম তালিকাভুক্ত এবং তাদের বেতন ভাতা নির্ধারণ করার জন্য তোদের প্রতিনিধি নিয়ে কমিটি করা হবে।
উল্লেখ্য, রিয়াজ উদ্দিনের প্রবন্ধের ভাষায়, আমরা শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি বললেন, ভয় নেই, যে সব কাগজ থাকবে না সে সব কাগজের সাংবাদিকরা সরকারি চাকরি পাবে। চাকরি না হওয়া পর্যন্ত সরকারি ট্রেজারি থেকে ভাতা দেয়া হবে। একই নিবন্ধের অন্যত্র রিয়াজ ভাই লিখেছেন, ১৬ জুন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হলো। ঘোষণার নাম নিউজ পেপার ডিক্লিয়ারেশন এনালমেন্ট অর্ডিনেন্স। এর আওতায় দেশে মাত্র ৪টি পত্রিকা থাকলো সরকারি নিয়ন্ত্রণে ইত্তেফাক, অবজারভার, দৈনিক বাংলা আর বাংলাদেশ টাইম। যে সব কাগজ বন্ধ হলো সেগুলোর সব সাংবাদিক কর্মচারীদের চাকরি সরকারের হাতে ন্যস্ত হলো। চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত ভাতা দেয়ার বিধান রাখা হয়। সাংবাদিকদের সুযোগ-সুবিধা দেয়ার জন্য গিয়াস কামাল চৌধুরী, চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদীর সম্পাদক অধ্যাপক মো. খালেদ এবং আরো কয়েকজনকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির প্রধান ছিলেন নুরুল ইসলাম পাটওয়ারী। এবার আবার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাংবাদিক নেতাদের আলোচনায় ফিরে আসি। সাংবাদিকদের বাঁচা-মরার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যে বৈঠক হয়েছিল তার কথা বলতে গিয়ে রিয়াজ সাহেব শুধু ফিদেল ক্যাস্ট্রো, সাদ্দাম হোসেন প্রমুখ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু যা বলেছিলেন সে কথা বলেই প্রসঙ্গটির ইতি টানেন। তিনি বেমালুম চেপে যান বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনার কথা। সংবাদপত্রের সঙ্গে সঙ্গে রেডিও-টেলিভিশনেও যে বিপুল সংখ্যক মেধাবী সাংবাদিকের প্রয়োজন হবে সে সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকে ইউনিয়ন নেতারা আশ্বস্ত করেছিলেন এবং এই বলে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমানে যে সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা কোর্স রয়েছে সেখানে পূর্ণাঙ্গ স্নাতক ডিগ্রি ও মাস্টার্স ডিগ্রি কোর্স এবং প্রেস ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কোর্স চালু, বিদেশে বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন, রুমানিয়া, বুলগেরিয়াসহ বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশে বিপুল সংখ্যক সাংবাদিকের প্রশিক্ষণ ও উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সাংবাদিক সৃষ্টি করা সম্ভব। বঙ্গবন্ধু নেতাদের এ সব সুপারিশ ত্বরিত বাস্তবায়নের আশ্বাস দেন। বিশেষ করে সাংবাদিক নেতারা তৎকালীন সংবাদপত্র শিল্পে বিরাজমান করুণ অবস্থা বর্ণনা করে বঙ্গবন্ধুকে জানান যে, হাতেগোনা ২/৪টি সংবাদপত্র ছাড়া কোথাও নিয়মিত বেতন ভাতা প্রদান করা হয় না। আলু-পটলের ব্যবসায়ী বিভিন্ন ধান্ধায় সংবাদপত্র প্রকাশ করে ব্লু্যাকমেইলিংয়ের মাধ্যমে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিচ্ছে। অথচ সাংবাদিকদের একটি আইডি কার্ড ছাড়া আর কিছুই দেয়া হয় না। অনেক গ্রামীণ সাংবাদিক কেবল কলাটা-মুলাটা নিয়ে এ মহান পেশায় টিকে থাকার সংগ্রাম করছেন। এ পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু দেশের সব শ্রেণির সংবাদপত্র সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আনার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা এক বিরাট বিপ্লব সাধন করবে বলে সাংবাদিক নেতারা মত প্রকাশ করেন। এতে দেশের মেধাবী মুখের সন্ধান পাওয়া যাবে পত্রিকা অফিসগুলোতে। এ পরিকল্পনার জন্য তারা বঙ্গবন্ধুকে ধন্যবাদ জানান। তারা এ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করেন এবং একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত বাকশালে যোগদানের আকাক্সক্ষাও বঙ্গবন্ধুকে জানানো হয়। পরবর্তী সময়ে গিয়াস কামাল চৌধুরী, রিয়াজ উদ্দিনসহ দেশের ৯০ শতাংশের বেশি সাংবাদিক বাকশালে যোগদানের জন্য আবেদন করেন।
আমি দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি থাকার সুবাদে আজাদী সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পাই। একদিন তার বাসায় নৈশভোজের দাওয়াতে গিয়ে দেখি আমাদের প্রিয় ফয়েজ ভাই (ফয়েজ আহমদ) ও বঙ্গবন্ধুর সরকারের এককালীন তথ্যমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুর। কথায় কথায় সেদিন বন্ধ হওয়া পত্রিকার সাংবাদিক-কর্মচারীদের তালিকাসহ প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনায় আসে। অধ্যাপক খালেদ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, আমরা এ তালিকা প্রস্তুতির প্রশ্নে কোনো প্রকার মতপার্থক্যের বিষয়টি বিবেচনায় আনিনি। তদুপরি যারা মাত্র ৮০ থেকে ১১০ টাকা মাইনে পেতেন (অনিয়মিত), তালিকা প্রস্তুতকালে তাদের বেতন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা লেখা হয়েছিল। গিয়াস কামালসহ আমরা সবাই একমত হলাম যে, টাকাটা যখন বঙ্গবন্ধুর উদারতায় ট্রেজারি থেকে দেয়া হবে তখন থাক না একটু বেশি অঙ্কের হিসাব। যাই হোক সেই প্রস্তুত করা তালিকা হিসেবে দেশের সব সংবাদপত্রের সাংবাদিক ও কর্মচারী সংশ্লিষ্ট জেলার ট্রেজারি থেকে বেতন নিয়ে আসতেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কাল রাতের দিন পর্যন্ত দেশের সব সংবাদপত্রসেবী এ বেতন ভাতা ভোগ করেছেন।
সাংবাদিকদের সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণের জন্য গঠিত কমিটির অন্যতম সদস্য গিয়াস কামাল চৌধুরীর মুখে শুনেছিলাম যে, তারা একদিন বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে বলেছিলেন, দেশ সদ্য স্বাধীন, অর্থনৈতিক সংকট, অভাব-অনটনে আপনার সরকার জর্জরিত, এ সময় কাজ না করে প্রতি মাসে ট্রেজারি থেকে বেতন আনতে অনেক সাংবাদিকের মনে হোঁচট লাগে, আপনি আমাদের জন্য উপযুক্ত চাকরির ব্যবস্থা করুন। বঙ্গবন্ধু সেদিন সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের ডেকে তাদের সামনেই নির্দেশ দিয়ে দিলেন- সব অফিসের শূন্যপদে সাংবাদিক নিয়োগ দাও। তাই হয়েছিলও। সদ্য স্বাধীন দেশে খাদ্য, শিপিং, ওয়াপদা, কাস্টমসহ বিভিন্ন অফিসে চাকরিতে সাংবাদিকদের আত্মীকরণ করা হয়েছিল। কেবল বঙ্গবন্ধুর মতো একজন রাষ্ট্রপ্রধানই বলতে পেরেছিলেন, একজন সাংবাদিকও বেকার থাকবে না। যতদিন চাকরি না হয় ট্রেজারি থেকে বেতন নিয়ে আসবে। পৃথিবীর কোনো ধনতান্ত্রিক, সামাজতান্ত্রিক কিংবা অন্য কোনো কল্যাণ রাষ্ট্রের কোনো রাষ্ট্রপ্রধান দেশের একটি গোটা পেশাজীবী সম্প্রদায়কে এভাবে ট্রেজারি থেকে বিনা কাজে বিনা চাকরিতে বেতন নিয়ে আসতে বলতে পারেননি। এই দুঃসাহস কেবল বঙ্গবন্ধু দেখাতে পেরেছিলেন। আর আজ কতিপয় ধান্ধাবাজ এ বলে মেকি ইতিহাস তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন যে, বঙ্গবন্ধু সব সংবাদপত্র বন্ধ করে সব সাংবাদিককে বেকার করেছিলেন। মিথ্যাচারের অভিযোগে একদিন ইতিহাসের কাঠগড়ায় তাদের দাঁড়াতেই হবে এবং সেদিন খুবই নিকটবর্তী।
আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া : সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বাসস।

সুশাসন ছিল ব্রিটিশ আমলে ও সামরিক শাসনকালে ॥ নির্বাচিত সরকার তা ধ্বংস করেছে’ ?

নিউইয়র্কে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের নয়া তত্ত্ব
তারিখ: ১০/০৬/২০১৫

আবদুল মালেক
উত্তর আমেরিকা বিশেষ করে নিউইয়র্ক নগরের বাংলাদেশী কমিউনিটি বছরজুড়ে মেতে থাকে নানা উৎসব-আনন্দে। আর নব্বইয়ের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ থেকে আগত সঙ্গীত, নৃত্য, নাটক, চলচ্চিত্র শিল্পীরা তাতে সঞ্চার করেছেন নতুনপ্রাণ। এছাড়া অনেক প্রবাসী আছেন যারা শুধু বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানাদির মুগ্ধ দর্শক হতে রাজি নন। সেইসঙ্গে তৃপ্ত হতে চান দেশের সম্মানিত প-িত মানুষের দর্শন লাভে ও তাদের মূল্যবান জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য শ্রবণ করে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের নানাবিধ অনুষ্ঠান বা সম্মেলনে প্রায়ই লেখক, সাহিত্যিক ও গুণীজনদের শুভ পদার্পণ ঘটে থাকে।
 বিশ্বায়নের এই কালে বাংলাদেশও হাতের নাগালেই এসে গেছে। দুপুর ১২টা-১টার মধ্যে অনলাইনে আগাম দেশের খবরের কাগজ হাজির। রসগোল্লা আর ইলিশ মিলছে হয়ত কারও এলাকার মোড়ের দোকানেই। টিভির বাংলাদেশী চ্যানেলে অধিকাংশ বাংলাভাষী মানুষের গৃহে সকাল-সন্ধ্যা গান-নাটক-খবর চলছে। সেখানে নানা অনুষ্ঠান উপভোগের সঙ্গে আমরা প্রতিনিয়তই নামী-দামী ব্যক্তিদের দেখা ও বক্তব্য শোনার সুযোগ পাই। কিন্তু চর্মচক্ষুতে সেলিব্রেটিদের দেখা পাওয়া ও স্বকর্ণে তাদের বক্তব্য শুনতে পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। তবে সেই সৌভাগ্য লাভ করতে গিয়ে কখনও দুর্ভাগ্যকেও বরণ করতে হয় বৈকি!
সম্প্রতি (২২-২৪ মে) মুক্তধারা ফাউন্ডেশন আয়োজিত নিউইয়র্কে তিন দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব ও বইমেলা হয়ে গেল। উৎসবের আহ্বায়ক ছিলেন ভয়েস অব আমেরিকার (ভোয়া) বাংলা বিভাগের প্রধান রোকেয়া হায়দার। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশের স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব ও শিক্ষাবিদ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। সবাই জানেন, তিনি সুদীর্ঘ সময় ধরে বই পড়া এবং জ্ঞানের আলোয় আলোকিত মানুষ গড়ার প্রশংসনীয় একটি আন্দোলন করে যাচ্ছেন। অধ্যাপক সায়ীদ ছাড়া বইমেলার সুযোগ্য প্রধান অতিথি আর কেইবা হতে পারেন!
প্রবাসের অনুষ্ঠানে সাধারণত আলোচনাগুলো দুপুরে সেমিনার কক্ষের একান্তে এবং গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শেষ বিকেলের মঞ্চে হয়ে থাকে। এরপরই যাকে বলে উৎসবের প্রাইম টাইম। ওই সময়টিতে নাটক, সঙ্গীত ও নৃত্য ইত্যাদি বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান উপভোগ করে মানুষ। দেশ থেকে আগত প্রকাশনা সংস্থার স্টল থেকে বইপত্র, সঙ্গে নানাবিধ দেশী পণ্য কিনে, ঝালমুড়ি-চা-সিঙ্গাড়া খেয়ে সন্ধ্যার পর শিশুদের হাত ধরে তখনই হলে প্রবেশ করে পরিবারগুলো।
 কিন্তু এ বছর আলোচনার প্রধান বক্তা অধ্যাপক আবু সায়ীদ, সঙ্গে প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার ও কলকাতা থেকে আগত রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতো সম্মানীয় বক্তাদের কারণেই হয়ত কর্তৃপক্ষ প্রাইম টাইমের বিনোদনমূলক সময়ে পাদপ্রদীপের আলোয় এনেছিলেন তাঁদের। তাছাড়া প্রধান বক্তা কেবল একজন সুবক্তাই শুধু নন, মানুষ গড়ার কারিগরও বটে। মানব হৃদয়ের অন্ধকার দূর করার ব্রত নিয়ে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন বিরামহীনভাবে। কিন্তু তাঁর দু’দিনব্যাপী বক্তব্য (প্রথম দিন বক্তৃতা ও দ্বিতীয় দিন প্রশ্নের উত্তর) শোনার সৌভাগ্যটি যে পরিণত হবে দুর্ভাগ্যে সেটি আমি ও অনেক প্রবাসী কল্পনাও করিনি।


 অবশ্য ইদানীং দেশের খবরের কাগজে তাঁর রাজনৈতিক বিষয়ে কিছু কথা নজর কাড়ছিল। কিন্তু তিনি যে হাটুরে রাজনীতিকদের ভাষায় আমাদের সামনে বক্তব্য রাখবেন সেটা ছিল ভাবনার অতীত। তিনি বললেন, বাংলাদেশ এখন ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ সময়টি পার করছে। জাতীয় জীবনে আমাদের অবস্থা এখন মাৎস্যান্যায়ের মতো বড় মাছ ছোট মাছগুলোকে খেয়ে ফেলছে। অধ্যাপক আবু সায়ীদ বক্তব্য রাখছিলেন বাংলাদেশের সুশাসন প্রসঙ্গে।
 যদিও দেশে তাঁর সঙ্গে কখনও ঘনিষ্ঠতার সুযোগ হয়নি, কিন্তু প্রবাসে এসে নব্বই দশকের মাঝামাঝি ডালাসে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনে বেশ কিছু বিদগ্ধজন ও আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল একই মঞ্চে। বাইরেও হয়েছে নানা আলাপ-আলোচনা, কথা-গল্প, হাসি। পরবর্তীতে সাংবাদিকতার সুবাদেও নিউইয়র্কে অনেকবার তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত হয়েছে, কথা হয়েছে। সেসব দিনে তাঁর চমৎকার সান্নিধ্যের কথা এখনও মনে পড়ে।
 কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় তিনি যখন বললেন, বাংলা নামক দেশটিতে নাকি কখনই কোন সুশাসন ছিল না, কেবলব্রিটিশ রাজত্বের দিনগুলো ছাড়া, তখন হতচকিত না হয়ে উপায় ছিল না। গল্পচ্ছলে অধ্যাপক সায়ীদ বললেন, সে আমলে বাংলার বনে-জঙ্গলে যদি একটা ভূতও কোন মানুষকে তাড়া করত, আর সে যদি ছুটতে ছুটতে ব্রিটিশ রাজের তৈরি ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তায় উঠতে পারত, তবে পালানোর পথ পেত না সে ভূত। কারণ রাস্তায় ছিল ব্রিটিশের থানা পুলিশ! এরপর অবশ্য সকৌতুকে বললেন, যদিও পুলিশ কর্তাদের একটু ঘুষ-টুস খাবার সুযোগ তারা করে দিয়েছিলেন। অধ্যাপক আবু সায়ীদের মতো মানুষের মুখে এই নব ইতিহাস রচনা স্বকর্ণে না শুনলে বিশ্বাস করা কঠিন ছিল। নিউইয়র্কের প্রতিটি সাপ্তাহিকীতে তাঁর বক্তৃতার এমন গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো কমবেশি খবর হয়েছে।


 সত্যি বলতে কি, আমি একজন বিজ্ঞ মানুষের মুখনিসৃত এমন বক্তৃতার সুরে বারংবার হতভম্ব হয়ে পড়ছিলাম। তাহলে বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের যে ইতিহাস লেখাপড়া করেছিলাম তার পাতায় পাতায় কি সবই ভুল! দুনিয়াজুড়ে ব্রিটিশ রাজের অত্যাচার ও লুটতরাজের কথা তো দেশে দেশে ইতিহাসের অধ্যায়। দক্ষিণ আফ্রিকায় তরুণ ব্যারিস্টার গান্ধীকে শুধু ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাস কামরার যাত্রী হওয়ার অপরাধে ব্রিটিশ পুলিশের লাঠি পেটার কাহিনী তো আমাদের স্কুলের পাঠ্যবইতেই ছিল। অসংখ্য নির্যাতন-নিপীড়নের আরও অনেক ইতিহাস নিশ্চয়ই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পুস্তকাদিতেও আছে। নেই কি জালিয়ানওয়ালাবাগে সমবেত নিরীহ মানুষের ওপর ব্রিটিশ পুলিশের বর্বর হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'নাইটহুড' উপাধি ত্যাগ করার ইতিহাস? সে সময় নীলকর সাহেবদের অবর্ণনীয় অত্যাচারের কাহিনী, যা দীনবন্ধু মিত্র তাঁর ‘নীল দর্পণ’ নাটকে বর্ণনা করেছেন, সে নাটকের বইটিও কেন্দ্রে আছে বলে বিশ্বাস করি। আজ অবধি কোন ব্রিটিশ দালালও এসব মিথ্যে বলে দাবি করেনি। পুস্তকের সঙ্গে পুস্তক পাঠের জন্য আন্দোলনকারী শ্রদ্ধেয় শিক্ষাবিদের এই মতামত কি এখানে সাংঘর্ষিক হচ্ছে না?

ব্রিটিশ জমানারই মানুষ আমাদের পিতা-প্রপিতামহ তাদের সময়ের পুলিশকুলের অত্যাচার সম্পর্কে যে বর্ণনা প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আমাদের কাছে দিয়ে গেছেন সেটা তো প্রবাদ বাক্যেই স্থান পেয়েছে! তাদের কাছ থেকেই শুনেছি, মাথায় লাল রঙের পাগড়ি পরতেন বলে তখন আমজনতার কাছে পুলিশের নাম ছিল লালপাগড়ি। বলাবাহুল্য, তারা ঘোড়ায় চড়ে গ্রামে আসতেন আসামির সন্ধানে। কোন গ্রামের কোন দূর প্রান্তে ঘোড়ার খুরের শব্দের সঙ্গে লাল রং দেখা গেলেই প্রাণভয়ে নির্বিচারে মানুষ পালিয়ে শূন্য করত গ্রামের পর গ্রাম। কারণ দোষী হোক বা নির্দোষ হোক গ্রামবাসী কাউকে পাওয়া মাত্রই শুরু হতো বেদম প্রহার। হান্টার দিয়ে কমপক্ষে আঠারোটা ঘা না মেরে পুলিশ ছেড়ে দিত না। ওই সময়েই সে প্রবাদটা তৈরি হয়েছিল, যা আজও প্রচলিত ‘পুলিশ ছুঁলে আঠারো ঘা!’
অধ্যাপক সাহেব কণ্ঠে মুগ্ধতা এনে নাটকীয়ভাবে আরও যোগ করলেন, কি সুসভ্য এই ব্রিটিশ জাতি, কি অতুলনীয়, কত প্রাচীন তাদের সভ্যতা! এই বক্তব্যের উত্তরে আমার বলতে ইচ্ছে করেছিল, বটেইতো বটেইতো- বিশ্বজুড়ে তারাই তো সত্যিকারভাবে মানবসভ্যতার ধারক এবং বাহক! কিন্তু ওই পুস্তকগুলোই বাঁধিয়েছে যত গোল। কারণ সেখানেই তো লেখা রয়েছে সুদূর আফ্রিকা থেকে কিভাবে জন্তুর মতো খাঁচায় পুরে কালো মানুষদের ধরে এনেছিল ব্রিটিশ বেনিয়া দল। জাহাজে করে দেশে দেশে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে কিভাবে ফুলে ফুলে বিকশিত হয়েছিল ব্রিটিশ অর্থনীতি তথা সিভিলাইজেসন! অধিকৃত দেশগুলোর যেখানে যত সম্পদ ছিল সবই লুট করে নিয়ে গেছে তারা। ভারতবর্ষ থেকে কোহিনূর মুকুট, ময়ূর সিংহাসনসহ যাবতীয় হীরামণিক্য আজও ভোগ করে চলেছে ব্রিটিশ রাজবংশ। তাদের হাতে মেসোপটেমিয়ার সুপ্রাচীন সভ্যতা ধ্বংস আর লুটপাটের ঘটনা তো ঘটে গেল আমার-আপনার চোখের সামনেই। ক্যাকটাসের ফুলের মতো ব্রিটিশ জাতির নিঃসন্দেহে অনেক নয়নমনোহর দিক আছে। কিন্তু ফুলের নিচে ভয়ঙ্কর কাঁটাগুলো দুনিয়া এড়াবে কিভাবে?


বন্দনার পর্ব শেষ করে অধ্যাপক সাহেব এরপর শুরু করলেন বাংলাদেশ সম্পর্কে, ‘ইংরেজ শাসনের অনেক ভাল দিক ছিল। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তারা সুশাসনের বেশ কিছু ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করে যায়। ব্রিটিশরা যেটুকু সুশাসনের ব্যবস্থা রেখে গিয়েছিল স্বাধীন হওয়ার পর আমরা সেটুকু ধ্বংস করে দিয়েছি। স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশে চলছে মোড়লি শাসন। এই পদ্ধতিতে দেশ চালাতে গিয়ে আমরা ব্রিটিশদের দিয়ে যাওয়া সুশাসনের ব্যবস্থাগুলোও ধ্বংস করে দিয়েছি।’


জানার ইচ্ছা জাগে, পাকিস্তান সময়েও কি সেই ব্যবস্থা অক্ষত ছিল? আইয়ুব-ইয়াহিয়ার খানের সামরিক শাসন আমলেও? আর মোড়লি ব্যাপারটার মাথামুন্ডু আমার রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সঙ্গে সাংবাদিকতা পড়া বিদ্যায় কিছুতেই কুলিয়ে উঠছে না। আমরা জানি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দিয়ে গঠিত সরকারের নেতৃত্বে। সেসব প্রতিনিধি তথা মোড়লই তো জাতীয় সংসদে বসে রচনা করলেন দেশ শাসনের জন্য পবিত্র সংবিধান। এরপর রচিত নয়া সংবিধানের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজয়ী দল সরকার গঠন করে। অবশ্য জ্ঞানী শিক্ষাবিদ প্রশ্নোত্তরে বলেই দিয়েছেন, ‘দেশ ধ্বংসের মূল কারণ আমাদের ওই সংবিধান এবং দুই দল।’ শেষে যদিও একটি প্রশ্নের উত্তরে ব্যাখ্যা করলেন, ‘সংসদ সদস্য দলের বিরুদ্ধে ভোট না দেয়ার ধারাটি পরবর্তীকালে সংবিধানে সংযোজিত হয়েছে,'এটাই দেশকে ধ্বংস করে দিয়েছে।’


তিনি আরও বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকেই আমরা রয়েছি স্বৈরশাসনের মধ্যে। নব্বই সালের পর যে নির্বাচিত স্বৈরশাসনের মধ্যে প্রবেশ করেছি এটা সামরিক স্বৈরশাসনের চেয়ে আরও ভয়াবহ।’ তিনি উষ্মার সঙ্গে বারবার বলেন, ‘একবার এ দল আসে, আরেকবার ও দল, হয় হাসিনা, নয় খালেদা।’
তিনি নিশ্চয়ই বোঝাতে চাইলেন, ’৭৫ থেকে নব্বই পর্যন্ত অভ্যুত্থান, নির্মম হত্যাযজ্ঞ, রক্তপাতের মধ্য দিয়ে জিয়া থেকে এরশাদ নামে যে সব শাসকের আবির্ভাব, গণতন্ত্রের চাইতে তাদের পদ্ধতি উত্তম! তাহলে সেই বন্দুকের নলই কি ক্ষমতার একমাত্র উৎস হবে দেশে।


 সেদিন অধ্যাপকের কাছ থেকে সুশাসন সম্পর্কে এমন সম্যক জ্ঞানলাভ করার পরও অদ্যাবধি কেন যেন আমার অজ্ঞানতা ঘোচেনি। সুশাসনের তত্ত্ব বা থিওরি কখনও সাধারণ মানুষও জানতে চায় না। একদিন এই ভূখন্ডের অভুক্ত-অর্ধভুক্ত মানুষের দুয়ারে দুয়ারে চাওয়া ছিল লবণ দিয়ে একমুঠো ভাত। সেই কোন্ যুগে ঈশ্বরী পাটনী যে দেবীকে নদী পার করিয়ে দেয়ার আশীর্বাদ হিসেবে প্রার্থনা করেছিল, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।’ যুগ-যুগান্তরব্যাপী এমনকি ব্রিটিশের মহাসুশাসনকালীনও সে স্বপ্নপূরণ ছিল কল্পনাবিলাস। বরং সেই ব্রিটিশ আমলের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ-মন্বন্তরের কাহিনী দুঃস্বপ্ন হয়ে তাড়া করে ফিরেছে বারবার। অথচ আর কি আশ্চর্য, দরিদ্র শিশুর দুধ-ভাত খাওয়ার সেই আশীর্বাদ আজ গ্রামগঞ্জের দিকে দিকে। ক’দিন আগেই দেশের সংবাদপত্রে পড়লাম মঙ্গার জন্য বিখ্যাত রংপুরের গঙ্গাচড়া দিয়ে যেতে যেতে এক সাংবাদিক দেখছেন চারদিকে মাঠে মাঠে চড়ে বেড়াচ্ছে শত শত গরু-ছাগল। একদা হতদরিদ্র সুশীলার শিশুসহ গ্রামের অন্য শিশুরা স্বপ্নের দুধ-ভাত খেয়ে ভরে উঠছে স্বাস্থ্যে-আনন্দে! শিশুদের খাইয়ে অবশিষ্ট দুধ বিক্রি করেই জীবিকা নির্বাহ করছে বহু নারী। এরকম আরও ভিন্ন ভিন্ন অভাবিত ঘটনাগুলো যখন ঘটে চলছে দেশের সর্বত্র অধ্যাপক আবু সায়ীদ সাহেবের ভাষায় ‘বাংলাদেশ তখন ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ সময়টি পার করছে।’

 

Tuesday, March 31, 2015

এই 'বোকা মানব' টি কে কারা হত্যা করলো? সুমি খান

"গ্রামে ও শহরে মিশ্রভাবে বসবাসের ফলে আমার মধ্যে একধরনের সংমিশ্রণ ঘটেছে। না হতে পেরেছি শহরের স্মার্ট, মেধাবী, অতি আধুনিক, না হতে পেরেছি গ্রামের পরিশ্রমী, গেছো, ভালো সাঁতারু। দুই স্থানেই আমি একজন অতি বোকা। তাই আমি আজ বোকা মানব।" 'বোকা মানব' নামে একটি ব্লগে নিজের সম্পর্কে এভাবেই আত্মবিশ্লষণ করেছিলেন ওয়াশিকুর বাবু ।অভিজিতের হত্যা তাকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিলো ।নিজের ফেসবুকে তাই বাবু কভার ফটো করছিলো, 'আমিই অভিজিৎ'
 
আত্মবিশ্লেষনে নিজের সম্পর্কে ব্লগে প্রকাশিত একটি লেখায় ক্ষণজন্মা ওয়াশিকুরের গভীর অনুধাবন ফুটে ওঠে। তিনি লিখেছেন, ‘আমার নাম মো. ওয়াশিকুর রহমান। জন্ম গ্রামে হলেও শৈশব কেটেছে ঢাকায়। তবে আট বছর বয়সের সময় বেশ কিছুদিন গ্রামে কাটাতে হয়। তারপর বছর দুয়েক মফস্বল শহরে কাটিয়ে আবার ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করি। কিন্তু মাস ছয়েক না কাটতেই আবার গ্রামে ফিরে যেতে হয়। একটানা ছয় বছর গ্রামে কাটিয়ে পুনরায় ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করি। এখন পর্যন্ত ঢাকাতেই আছি। এভাবে গ্রামে ও শহরে মিশ্রভাবে বসবাসের ফলে আমার মধ্যে একধরনের সংমিশ্রণ ঘটেছে। না হতে পেরেছি শহরের স্মার্ট, মেধাবী, অতি আধুনিক, না হতে পেরেছি গ্রামের পরিশ্রমী, গেছো, ভালো সাঁতারু। দুই স্থানেই আমি একজন অতি বোকা। তাই আমি আজ বোকা মানব।এই ব্লগে তিনি সর্বশেষ ২০১১ সালের ১৭ জানুয়ারি বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান নিয়ে একটি লেখা পোস্ট করেছেন।
এখন প্রশ্ন , এই 'বোকা মানব' টি’কে কারা টার্গেট করলো?কারা এই ঘাতক?
 চট্টগ্রামের  দারুল উলুম মুইনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার তফসির বিভাগের ছাত্র জেএমবি জঙ্গী জিকরুল্লাহ কে শনিবার রাজধানীতে আসতে কে  নির্দেশ দিয়েছিলো?  যে 'বড়ো ভাই' মাসুম  রবিবার বিকেলে হাতির ঝিলে তাহের ,আরিফুল এবং জিকরুল কে ডেকে তিনটি চাপাতি দেয়  এবং  ওয়াশিকুর বাবুর ছবি দেখিয়ে বাবুকে হত্যার 'ঈমানী দায়িত্ব'দেয়, তার প্রকুত পরিচয় কী?? এ প্রশ্ন খুঁজে ফিরছেন গোয়েন্দারা ।
নিহত ওয়াশিকুরের চোখ এবং মুখ বরাবর সমান্তরাল দুইটি কোপে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে মুখমন্ডলের দুইটি অংশ। পুলিশ জানায়, হামলাকারীরা নিহত ওয়াশিকুরের শরীরের শুধু মুখমণ্ডল ও গলাসহ শরীরের ঊর্ধ্বাংশে আঘাত করেছিলেন। তাঁর মুখমণ্ডল ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। চোখ, নাক থেঁতলে চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে। প্রচুর রক্তক্ষরণে ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
 প্রশ্ন উঠেছে কেন এবং কোথা থেকে নিরীহ, শান্ত  তরুণ ওয়াশিকুরকে খুন করার নির্দেশ এসেছে ? যাঁকে হত্যা করা হলো, তিনি কোথায়, কী লিখেছেন? কিছুই জানা ছিল না খুনিদের।
‘ধর্মের অবমাননা’ করেছে এমন অভিযোগ এনে ওয়াশিকুর এর ছবি দেখিয়ে,তার বাসার পথ চিনিয়ে  তাকে হত্যা করার জন্যে ঘাতকদের হাতে চাপাতি তুলে দেয়া হয়েছে । আর সেটা দিয়ে কুপিয়ে নিরীহ এক তরুণকে প্রকাশ্য দিবালোকে নিঃশঙ্ক চিত্তে  নির্বিঘ্নে  হত্যা করেছে তিন তরুণ। প্রথম চাপাতির কোপ দেয় তাহের। দ্বিতীয় চাপাতির কোপ দেয় জিকরুল।এর মধ্যে জনরোষের মুখে  আরিফুলের চাপাতি আর ব্যবহার করা হয়নি।দুই কোপেই ব্লগার ও অনলাইন লেখক ২৭ বছরের তরুণ ওয়াশিকুর রহমানের চোখ এবং মুখ বিভক্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে । ওয়াশিকুরকে হত্যার পর পালিয়ে যাওয়ার সময় ধরা পড়া দু'জনের একজন জিকরুল তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা হাজতে এই প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে  একথা জানায়।
 
 টেলিভিশনের স্ক্রলে ওয়াশিকুর বাবু হত্যার সংবাদ জেনে তার শুভানুধ্যায়ী বন্ধুদের অনেকে  ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে  উপস্থিত হয়েছেন । সোমবার দুপুর থেকে লাশ বাড়িতে নেয়া পর্যন্ত বসেছিলেন তাদের একজন ওয়াশিকুরের পাতানো বোন তামান্না সেতু । এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন,  তার শুক্র এবং শনিবার অফিস খোলা, ওয়াশিকুরের সেদিন আফিস বন্ধ। তাই অনেক;ইন দেখা হয় নি। ২৫ মার্চ শেষবারের মতো তার সাথে ফেসবুকে আলাপ হয় ওয়াশিকুরের সাথে। সেদিন ওয়াশিকুর খুব বলছিলো, "দিদি, ভর্তা দিয়ে ভাত খেতে ইচ্ছে করছে খুব। আপনি কবে সময় দেবেন, আপনার সাথে ভাত খেতে ইচ্ছে করছে অনেক ।" ভাই হারানোর শোকে  শোকাহত সেতু  বলেন," সেদিন কেন যেন কোন রিপ্লাই দেয়া হয় নি। আর কখনো আমার কাছে ভর্তা দিয়ে ভাত খেতে চাইবে না বাবু, এটা কী করে ভাবা যায়? " তিনি জানান, কয়েক বছর ধরে ওয়াশিকুর ফেসবুকে আসুন নাস্তিকদের কটূক্তির দাঁতভাঙা জবাব দেই...শিরোনামে একটি ব্যঙ্গাত্মক লেখা ১০৩ পর্ব পর্যন্ত লিখেছেন। ওই লেখায়  ওয়াশিকুর বিভিন্ন ধর্মীয় রীতি-নিয়ম নিয়ে বাড়াবাড়ি যারা করে , তাদের  খণ্ডন করার চেষ্টা করেছেন । তামান্না সেতুসহ ওয়াশিকুরের বন্ধুরা জানিয়েছেন, অভিজিৎ খুন হওয়ার পর ভীষণ মুষড়ে পড়েন ওয়াশিকুর। তাঁর লেখায় তিনি এর প্রতিবাদ জানান। তখন বন্ধুরা তাঁকে সাবধান করেছিলেন। জবাবে ওয়াশিকুর বলেছিলেন, ‘আমি তো প্রোফাইল পিকচারও দেইনি। আমারে চিনবে ক্যামনে।  তামান্না সেতুর দু'চোখে জলের নীরব ধারা। বললেন,‘ও এমন কিছু লিখত না, যার জন্য কুপিয়ে মেরে ফেলতে হবে। আমরা জানি না, এরপর কার পালা।
 
 হত্যার ঘটনা সম্পর্কে পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সোমবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের দক্ষিণ বেগুনবাড়ী দীপিকার মোড়ে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ওয়াশিকুরকে। জিকরুল্লাহ, আরিফুল এবং তাহের এ হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নীলচে ফুলশার্ট ও জিনস পরিহিত ওয়াশিকুর দীপিকার মোড়ের দিকে যেতেই গলির মধ্যে তিনজন লোকের মধ্যে দুজন তাকে অতর্কিতে কোপাতে শুরু করে। পাশেই কয়েকজন হিজড়া দাঁড়ানো ছিলো।কয়েকজন নারী সহ হিজড়ারা চিৎকার করতে থাকেন । 'কোপাইয়া মাইরা ফেললো, কোপাইয়া মাইরা ফেললোচিৎকার শুনে হামলাকারী দুজন ঘটনাস্থলেই চাপাতি ফেলে দৌড় দেয়। এ সময় হিজড়ারা ঘাতকদের পিছু ধাওয়া করে। এলাকার লোকজনও ধাওয়া করে। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা পুলিশের একটি দল টহল দিচ্ছিলো।তারাও দৌড়ে ধাওয়া করে। হিজড়ারা প্রথমেই জিকরুল্লাহকে ধরে ফেলে। এরপর জনতা ও পুলিশ মিলে প্রায় এক কিলোমিটার ধাওয়া করে একটি ব্যাগসহ আরিফুলকে ধরে ফেলে। খুনের পর রক্তের দাগ যেন বোঝা না যায়, সে জন্য পরিকল্পিতভাবে তাঁরা লাল পোশাক পরে হত্যা করতে যায়। জিকরুল্লাহর পরনে ছিল লাল ডোরাকাটা টি-শার্ট, জিন্স, পায়ে কাপড়ের কেডস। আর আরিফুলের পরনে ছিল লাল টি-শার্ট, কালো প্যান্ট ও স্যান্ডেল। পুলিশ জানিয়েছে, এই দুজনের লাল গেঞ্জির নিচেই আরেকটি গেঞ্জি ছিল। চাপাতির ব্যাগের ভেতরে অতিরিক্ত পাঞ্জাবি ছিল।  পোশাক বদলে সাধারণ মানুষের সাথে  মিশে যাওয়ার জন্য কৌশল করে দুই স্তরের পোশাক পরেছিলো তিন ঘাতক। ঘটনাস্থলে থাকা দু'জন হিজড়া, স্থানীয় ব্যক্তিরা ও পুলিশ ধাওয়া করে দু'জনকে ধরে ফেলে। ঘাতকদের বয়স ২০ থেকে ২৫-এর কোঠায়।
বিজ্ঞানগবেষক অভিজিৎ রায় খুনের এক মাস পর ওয়াশিকুরকে হত্যা করা হলো। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় অভিজিৎকে। এ সময় তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে কুপিয়ে জখম করে  প্রত্যক্ষদর্শী  ও পুলিশের সামনেই পালিয়ে যায় খুনিরা। এর আগে ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মিরপুরে একই কায়দায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে। একই বছরের ১৪ জানুয়ারি রাতে একইভাবে কুপিয়ে আহত করা হয় ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীনকে। রাজীব হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে  জামায়াত নেতা এবং জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টীমের  প্রধান মুফতি মুহাম্মদ জসীমউদ্দিন রাহমানীসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ২৯ জানুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ । মামলাটি এখন বিচারাধীন। ব্লগার আসিফের ওপরও একই সংগঠন হামলা করেছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ।
১৫ নভেম্বর ২০১৩ বিকেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শফিউল ইসলামকে প্রকাশ্য দিবালোকে তার বাড়ির সামনে  একইভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এই হত্যার পর আনসার আল ইসলাম বাংলাদেশ-২নামের একটি ফেসবুক গ্রুপে দায় স্বীকার করে স্ট্যাটাস দেয়া হয়। আর সর্বশেষ অভিজিৎ হত্যার পর আনসার বাংলা সেভেননামের একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে হত্যার দায় স্বীকার করা হয়। একজন হুমকিদাতাকে গ্রেপ্তার ছাড়া পুলিশ আর কাউকেই সনাক্ত করতে পারে নি।
 
ওয়াশিকুর বাবুর তিন ঘাতকের মধ্যে ঘটনাস্থল থেকে গ্রেপ্তার হওয়া দু'জনের মধ্যে জিকরুল্লাহ চট্টগ্রামের দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্র ,আরিফুল রাজধানীর মিরপুরের দারুল উলুম মাদ্রাসার ছাত্র বলে জানায়। জিকরুল্লাহর বাড়ি নরসিংদী, আরিফুলের কুমিল্লা। জিকরুল্লাহ কখনো ওয়াশিকুরকে দেখেনি। তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত কোনো শত্রুতা নেই। ওয়াশিকুর কোথায়, কী লিখেছেন, তা-ও জানে না। তাদের 'বড়ো ভাই'  মাসুম ভাইয়ের কথাতেই তারা ওয়াশিকুরকে হত্যা করেছে।। তাঁরা কোনো ধর্মীয় বা রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত কি না, জানতে চাইলে জিকরুল্লাহ বলেন, ‘আমাদের কোনো দল নাই।তাদের 'বড়ো ভাই' বা 'মাসুম ভাইয়ের পরিচয় জানতে চাইলে তারা জানে না বলে জিকরুল্লাহ।
 
তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় জিকরুল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, তার পূর্বপরিচিত মাসুম ভাইর কথামতো শনিবার তিনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসেন। যাত্রাবাড়ীর দিকে এক মাদ্রাসায়  রাত কাটায়। রোববার বিকেলে হাতিরঝিল লেকের পাড়ে  ডেকে ওয়াশিকুরকে হত্যার দিকনির্দেশনা দেয় তাদের মাসুম ভাই  জিকরুল্লাহ, আরিফুল ও তাহের মিলে প্রথম বারের মতো তখন আলোচনা হয়। সহযোগী ঘাতক আরিফুল এবং  তাহেরকে চিনতোনা জিকরুল। হাতির ঝিলেই তাদের প্রথম দেখা। ওয়াশিকুরের ছবি দেখিয়ে মাসুম তাঁদের  বলে, এই লোক মহানবী (সা.)-এর অবমাননা করেছে, আল্লাহ ও ইসলামকে নিয়ে কটূক্তি করেছেন। তাকে হত্যা করতে হবে। এরপর মাসুম তাদের নিয়ে হাতিরঝিলের কাছাকাছি দক্ষিণ বেগুনবাড়িতে ওয়াশিকুরের বাসা দেখিয়ে দেন।
 
ওয়াশিকুর কখন বাসা থেকে অফিসে যান, কোন্ দিক দিয়ে কীভাবে হামলা করা হবে, সেসব বুঝিয়ে দেয় 'মাসুম'। ওয়াশিকুরের বাসার আশপাশের এলাকা চিনে নেয় ঘাতকেরা। মাসুম তাঁদের তিনজনকে তিনটি চাপাতি দেয়।
 
'মাসুম' এর  নির্দেশনা অন্ধের মতো অনুসরণ করে  মাথায় সাদা টুপি পরে সোমবার সকালে তিন ঘাতক রাজধানীর দক্ষিণ বেগুনবাড়ি দীপিকার মোড়ে অবস্থান নেয়। ওয়াশিকুর অফিসে যাবার পথে  জিকরুল্লাহ ও তাহের চাপাতি বের করে কোপ দেয়। আরিফুল চাপাতি বের করার আগেই স্থানীয় মানুষ ধাওয়া দেয়। চাপাতিসহ ব্যাগ পিঠে ছুটে পালাবার সময়ে আরিফুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার সূর্যবার্তা টোয়েন্টিফোরকে বলেন,   ওয়াশিকুরের লেখার কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে একটি গোষ্ঠী এই হত্যার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করে বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এই হত্যার ধরনের সঙ্গে অভিজিৎ রায়, রাজীব হায়দার হত্যার মিল রয়েছে মনে করছে পুলিশ ।
 
নিহত ওয়াশিকুর বাবু  লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জের টিপু সুলতানের একমাত্র পুত্র। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। ২০০০ সালে তার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ ঘটে যায় । ওয়াশিকুর বাবু তার বাবার সাথেই থাকতো।২০০৬ সালে এসএসসি পাশ করেন।তেজগাঁও কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাসে স্নাতক  করে  মতিঝিলে ফারইস্ট এভিয়েশন নামে একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে শিক্ষানবিশ হিসেবে চাকরি করতো। এই প্রতিষ্ঠানে ওয়াশিকুরের খালা চাকরি করতেন । তিনিই ওয়াশিকুর কে এই চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। সামান্য বেতনের চাকুরে ওয়াশিকুর তার বাবার সাথে  দক্ষিণ বেগুনবাড়িতে  ৭ হাজার টাকা দিয়ে একটি রুম ভাড়া নিয়ে থাকতেন।। ওয়াশিকুরের অফিস যেতে দেরি দেখে ফারইষ্ট এভিয়েশন থেকে ওয়াশিকুরের মোবাইলে ফোন করলে পুলিশ রিসিভ করে সেই ফোন। এর পর ফারইষ্ট এভিয়েশন থেকেই বাবুর খালাকে ফোন করে বাবুর নিহত হবার সংবাদ জানায়। সেই সংবাদ শুনে আত্মীয় স্বজন মর্গে ছুটে আসেন। সোমবার সকালেই বাড়ি গেছেন ওয়াশিকুরের বাবা টিপু সুলতান। ছেলে হত্যার সংবাদ শুনে বারবার জ্ঞান হারাচ্ছিলেন টিপু সুলতান। এ কারণে তাঁর আর রাজধানীতে আসা সম্ভব হয়নি। একমাত্র পুত্রের প্রাণহীণ দেহ গ্রামে  নেবার জন্যে জামাতাকে রাজধানীতে পাঠিয়েছেন তিনি।