Saturday, January 24, 2015

ধিক্কারের ভাষাও হারিয়ে যায় - সুমি খান


 

শনিবার ২৪ জানুয়ারী শনিবার সন্ধ্যা ৭টার পর। হঠাৎ বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ের ফটকে বড়ো বড়ো দুটি তালা ঝুলিয়ে দেয়া হলো। উদ্দেশ্য একটিই। দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এবং বঙ্গবন্ধু কন্যাকে দেখিয়ে দেয়া কোন পুত্রহারা মাকে সমবেদনা জানাতে সশরীরে হাজির হতে চাওয়াও তাঁর জন্যে অপরাধ!
দেশের এমন বৈরী রাজনৈতিক পরিস্থিতি, যখন দেশের হাসপাতালগুলোর বার্ন ইউনিটে শত শত দগ্ধ মানুষ জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন।তাঁদের শারীরিক যন্ত্রণা ও জীবন বাঁচানোর তীব্র আর্তনাদে হতাশ, ক্ষুব্ধ দেশের জনগণ যখন এর থেকে উত্তরণের পথ খুঁজছে- তখনই এমন বিরল একটি সুযোগ নস্যাৎ করে দিলেন বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা।

১৫ আগষ্টে জাতির পিতা সহ পরিবারের সকলকে হারানো, ২১ আগষ্টে নিজের উপর গ্রেনেড হামলা-সব ভুলে বঙ্গবন্ধু তনয়ার আকুল মাতৃত্ব জেগে উঠেছিলো সন্তানহারা এক মায়ের পাশে গিয়ে সমবেদনা জানানোর জন্যে।তাই বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার কনিষ্ঠ পুত্র কোকোর মুত্যুতে সমবেদনা জানাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খালেদা জিয়ার গুলশানের কার্যালয়ে যান। যার মাধ্যমে দুজনের সাক্ষাত জন্ম দিতে পারতো বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের চরম কাঙ্খিত একটি ক্ষণের। যে ক্ষণটিতে রাজনৈতিক বৈরিতার উর্ধে প্রতিষ্ঠিত হতো মানবিক সম্পর্ক।কিন্তু না,এ বৈরিতা যারা বজিয়ে রাখতে চান-তাদের শক্তির জয় হলো।বেগম জিয়া নিজের কৃতকর্ম বা দায়িত্বশীলতা কোনটিই কখনো বিবেচনা করেন নি।তাই তাঁর নেতাসুলভ উদারতা দেখানোর অসাধারণ একটি সুযোগ সচেতনভাবে হারালেন।যথারীতি তার চুড়ান্ত অভদ্রতায় রাষ্ট্রপ্রধানের সাথে তার প্রত্যাশিত সাক্ষাতটি হলো না!

 ধিক্কারের ভাষাও হারিয়ে যায় !এমন আচরণ করলেন খালেদা-যা ভুলিয়ে দেয়,একসময়ে তিনি এ দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।এর পর ও কি তিনি আশা করেন এ দেশের আপামর জনতা তাকে ভোট দেবেন?

 পুত্রশোকে কাতর বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেগম খালেদা জিয়ার গুলশানের কার্যালয়ে গেলে ফটক বন্ধ রাখা হয়।বারবার প্রমাণ হয়েছে মানুষকে ভালোবাসা উজাড় করে দেবার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু কন্যার মানবিক অনুভূতি বরাবরই অনেকের চেয়ে অনেক বেশি।বিএনপি নেত্রীর  প্রধান ফটকের সামনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর গাড়ি থেকে নামেন রাত ৮টা ৩৫ মিনিটে।পায়ে হেঁটে প্রধান ফটকে গিয়ে তিনি দেখতে পান তাতে বড় বড় দুটি তালা লাগানো। ফটকের সামনে কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত হবার আগে সেখানে যান আওয়ামী লীগের দুই প্রবীণ নেতা আমির হোসেন আমু ও তোফায়েল আহমেদ। ফটকে তালা দেখে প্রধান ফটক খুলে দেয়ার জন্য ভেতরে থাকা নেতাদের অনুরোধ জানান তাঁরা।তালা খুলে দেয়া হলো না। বিএনপির কোন সিনিয়র নেতা আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতাদের সাথে সৌজন্য দেখাতেও বেরিয়ে এলেন না।এর পর খোদ প্রধানমন্ত্রী হাজির হলেন, তবু তারা কেউ বেরিয়ে এসে সামান্য সৌজন্যতা ও দেখান নি। বরং দলীয় কার্যালয়ের ভেতর থেকে জানানো হয়- পুত্রশোকে কাতর বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। এই মুহূর্তে তিনি কারও সঙ্গে দেখা করতে পারবেন না। প্রায় সাত মিনিট প্রধান ফটকের সামনে খোলা আকাশের নিচে অপেক্ষা করেও সাক্ষাত না পেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেষ পর্যন্ত বিএনপির গুলশানের কার্যালয় থেকে গণভবনে ফেরত আসতে বাধ্য হন।প্রধানমন্ত্রী ফিরে যাওয়ার পর ইসলামী ঐক্যজোট এবং জামায়াত নেতারা গেছেন-তাদের জন্যে ফটকের তালা খুলে দেয়া হলো।

বিএনপির একাধিক সূত্র জানিয়েছে,কোকোর মৃত্যুর খবর প্রচারিত হবার পর শনিবার দুপুর থেকেই খালেদা জিয়াকে সান্তনা দিতে বিএনপিসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ তাঁর কার্যালয়ে যান। তাঁদের মধ্যে অনেকের সাথেই কথা বলেছেন খালেদা জিয়া।তবে বিকেলে যখন জানানো হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমবেদনা জানাতে গুলশানের কার্যালয়ে আসবেন,এর পরই পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যায়।বিষয়টি নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, নজরুল ইসলাম খান, ড. আবদুল মঈন খান, খালেদা তারেকের আইনজীবি মাসুদ তালুকদার সহ অন্য নেতারা বিএনপি চেয়ারপার্সনের সঙ্গে কথাও বলেন। খালেদা সিদ্ধান্ত দেন তিনি দেখা তো করবেন ই না , ফটকে বড়ো বড়ো দুটি তালা ঝুলিয়ে দেবেন।চমৎকার সিদ্ধান্ত। দেখা না করার অনেক উপায় আছে। যিনি সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করে সাংবাদিকদের ডেকে তাঁর প্রয়োজনীয় কথাটুকু বলেই উঠে চলে যান-তিনি কারো সাথে সৌজন্য দেখাবেন সেটা অনেকটা অবাস্তব। তবে বাস্তবতা হলো,তিনি মানুষকে অপমান করার চুড়ান্ত মাত্রাটি খুব ভালোভাবে দেখাতে চান অন্যদের।তাঁকে নতুন করে জন্ম দেয়া তাঁর ধর্মপিতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কালো দিন ১৫ আগস্টে ঘটা করে কেক কেটে জন্মদিন পালন করে ঘাতকদের ষড়যন্ত্রে নিহত পিতাকে প্রতি ক্ষণে চুড়ান্ত অপমান করেন যিনি, তাঁর কাছে সৌজন্যতা আশা করা যে কতো বড়ো ভুল- তা আবারো প্রমাণ হলো।আর অপমানের লক্ষ্য যদি হয় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তাহলে অপমানের সর্বনিম্ন স্তরে নামতেও সদা প্রস্তুত খালেদা জিয়া-সেটাই চাক্ষুস করলো জনগণ।

শনিবার সন্ধ্যা ৭টার পর পরই খালেদা জিয়া দলীয় কার্যালয়ের যে রুমে অবস্থান করছিলেন,সেটার দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়।প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি নেত্রীর গুলশানের কার্যালয়ে আসার আগেই বিএনপি হাইকমান্ডের নির্দেশে তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষীরা প্রধান ফটকে দুটি বড় বড় তালা ঝুলিয়ে দেয়।

দীর্ঘসময় ধরে সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকেরা জানেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বিএনপির কার্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন,তখনও ওই কার্যালয়ের ভেতরে দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। গণভবন সূত্র জানায়, সাক্ষাত না পেয়ে গুলশান থেকে সরাসরি নিজের সরকারী বাসভবন গণভবনে ফিরে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে ফিরেই তাঁর সঙ্গে থাকা নেতাদের সঙ্গে অনির্ধারিত বৈঠকও করেন তিনি। জানা গেছে, পূর্ব থেকে জানানো সত্ত্বেও ফটকে তালা ঝুলিয়ে ফিরিয়ে দেয়ায় বিস্মিত, বেদনাহত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় তিনি উপস্থিত রাজনৈতিক নেতাদের বলেন, স্বজন হারানোর বেদনা আমার চেয়ে কে বেশি অনুভব করে?আমি একরাতে বাবা-মা, ভাইসহ সবাইকে হারিয়েছি। আমি তো একজন মা হিসেবে আরেক পুত্রহারা মাকে সমবেদনা জানাতে গিয়েছিলাম। সেটাও করতে দেয়া হলো না!এরপর আর কারো সাথে কোন কথা বলেননি প্রধানমন্ত্রী।

২০০৯ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার মৃত্যুর পর তাঁদের ধানমন্ডির বাসভবন সুধাসদনে গিয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। সে সময় তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সমবেদনা জানান এবং দুই নেত্রীর মধ্যে কিছুক্ষণ কথাও হয়েছিলো।গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দুই নেত্রী একসাথে উপস্থিত থাকলেও তাঁরা কথা বলেননি।সর্বশেষ ২০১৩ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর শোক জানাতে বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া।সেদিন ও খালেদা হাসিনার মধ্যে কথা হয়নি।

বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকার মালিকানাধীন টিভি চ্যানেল বাংলাভিশনের হেড অব নিউজ মোস্তফা ফিরোজ আরেকটি বেসরকারী চ্যানেলের টক শো তে এ ঘটনা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়ে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করতে না পেরে ফিরে আসার পর ইসলামী ঐক্যজোট, জামায়াত নেতারা দেখা করেন বেগম জিয়ার সাথে ।বেগম খালেদা জিয়া কাদের পরামর্শ নিচ্ছেন, যারা দেশের কোটি কোটি মানুষের অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান একটি মুহূর্ত কে এভাবে নষ্ট করে দিলেন? তিনি প্রশ্ন করেন, কী এমন ক্ষতি হতো-যদি দুজনের সাক্ষাত হতো? বরং এ সাক্ষাত হয়তো দেশের চলমান সংকট নিরসন ঘটাতে পারতো।

অনেকে ভুলে গেছেন ২৬ অক্টোবর ২০১৩ সন্ধ্যে সোয়া ছয়টার দিকে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করে ৪০ মিনিট নিস্ফল আলাপ করেন।দেশের তৎকালীন রাজনৈতিক সংকটের চরম পরিস্থিতি সমাধানে সেই সময়কার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করে সংলাপে মাধ্যমে রাজনৈতিক সংকট সমাধানের প্রস্তাব দিতে গিয়ে প্রচন্ড অপমানিত হয়েছিলেন।সেসময়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সঙ্কট নিয়ে টানটান উত্তেজনার মাঝে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করে গণভবনে নৈশভোজের দাওয়াত দেন।হরতাল প্রত্যাহারে প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে সংলাপের প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছিলেন তৎকালীন বিরোধীদল নেতা খালেদা জিয়া।খালেদার বেঁধে দেওয়া দুদিনের সময়সীমার মধ্যে আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে হরতাল কর্মসূচী প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।কিন্তু সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে হরতাল, জ্বালাও পোড়াও কর্মসূচী অব্যাহত রেখেছিলেন ।সেই টেলি সংলাপ প্রকাশ হবার পর দুজনের রুচি এবং মানবিক অবস্থানের চরম বৈপরীত্য উন্মোচিত হয়ে যায় জনগণের কাছে।কতোটা অভদ্র জনোচিত ছিল সেই টেলি সংলাপ সেটা ফিরে দেখলেই হয়।খালেদা।একই ভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চরম অপমান করে পরবর্তীতে যে কোন সময়ে আলোচনা র নাটকীয় বক্তব্য দিলেন এবারেও।
রাত আটটার দিকে গুলশানের কার্যালয়ে অবস্থানরত বিএনপি চেয়ারপার্সনের বিশেষ সহকারী এ্যাডভোকেট শিমুল বিশ্বাস হঠাৎ করেই সাংবাদিকদের ডেকে নিয়ে বলেন,পুত্র হারানোর শোকে কাতর খালেদা জিয়াকে ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।তিনি (খালেদা জিয়া) সুস্থ হলে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতের বিষয়টি জানানো হবে।তবে সকলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য চলমান অবরোধ-হরতাল কর্মসূচী অব্যাহত থাকবে।  

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, সাবেক মন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি,বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন এমপি,প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী,বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিলসহ অন্যান্য নেতারা ছিলেন। কিন্তু প্রধান ফটকে প্রায় সাত মিনিট অপেক্ষা করার পরও সাক্ষাত না পেয়েই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফিরে আসতে হয়। প্রধানমন্ত্রী ফিরে যাওয়ার কিছু সময় পর গুলশানের কার্যালয় থেকে একে একে বেরিয়ে যান ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদসহ দলটির সিনিয়র নেতারা।এটা উপ।এই সিনিয়র নেতারা কি উদ্যোগ নেন নি? নাকি তারাও চান না দুই নেত্রীর দেখা হোক?

রাত সাড়ে নয়টার দিকে আবার প্রেস ব্রিফিং করে খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত সহকারী এ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস বলেছেন শোকের ঘটনা নিয়ে কেউ যাতে নোংরা রাজনীতি না করেন,সে আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমি শোকবই নিয়ে আসতে না আসতেই তিনি (প্রধানমন্ত্রী) চলে গেলেন। প্রধানমন্ত্রী এক মিনিটের মধ্যেই গেট থেকে ফিরে গেছেন। কেউ তাঁর (খালেদা জিয়া) পুত্রশোক নিয়ে কুৎসিত রাজনীতি করুক, আমরা তা পছন্দ করি না। দেশের রাজনীতিতে শালীনতা ও সৌজন্যতা সবাইকে রক্ষা করতে হবে। এ নিয়ে রাজনীতি করে কেউ যেন চলমান সমস্যার সমাধানের পথে কোন বাধার সৃষ্টি না করে। শিমূল বিশ্বাস জানেন গোয়েবলসীয় মিথ্যাচারে এদেশে বেশ ভালোই রাজনীতি করা যায়। শোকবই এনেছেন, দেখাচ্ছেন টিভি ক্যামেরাকে-তাতে একটি স্বাক্ষর ও নেই। হঠাৎ একটা খাতা এনে লিখে দিলেন শোক বই-তাতেই হয়ে গেলো? প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষরের জন্যে শোক বই যদি রাখবেন , আগে থেকে একটি টেবিল চেয়ার তো থাকতো অন্তত। ফটকে তালা লাগিয়ে শোক বই নিয়ে দৌড়ে গেলেন শিমুল বিশ্বাস-এ কেমন সৌজন্যতা?

ডা. দীপুমণি উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন নেত্রী,একটি দলের সভানেত্রী, সর্বোপরি একজন মা হিসেবে পুত্রহারা বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানাতে গিয়েছিলেন। একজন সন্তানহারা মা অসুস্থ হতেই পারেন, তাঁকে ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়ানো হতেই পারে। কিন্তু একজন প্রধানমন্ত্রী সেখানে যাবেন, সেটা বিকেল থেকেই জানানো হয়েছে বিএনপি নেতাদের। প্রধানমন্ত্রী গেলেন এবং ছয় মিনিট বন্ধ ফটকের সামনে অপেক্ষা করলেন।প্রধানমন্ত্রী গুলশানের কার্যালয়ে উপস্থিত হওয়ার মাত্র ৫-১০ মিনিট আগে প্রধান ফটকে তালা দেয়া হলো কেন?  বিয়োগান্তক ঘটনা যে কোন পরিবারে ঘটতে পারে। সমবেদনা জানাতে আসা একজন সাধারণ নাগরিকের সঙ্গে যে সৌজন্য দেখানো হয়, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে সেই ন্যূনতম সৌজন্য দেখাতেও বিএনপি নেতারা ব্যর্থ হয়েছেন।এ ঘটনার কোন মন্তব্য বা ব্যাখ্যা প্রদানের ভাষা আমার জানা নেই।

এছাড়া বিগত কয়েক বছরে একাধিকবার সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে সেনাকুঞ্জে গেলেও কথা বলেননি তাঁরা। ৯৭ সালে সদ্য প্রয়াত খালেদা জিয়ার পুত্র আরাফাত রহমান কোকোর বিয়ের অনুষ্ঠানেও যোগ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে আজকের মতোই ২০১৩ সালের ২৬ অক্টোবর ক্লান্তিকালে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে সংলাপের জন্য খালেদা জিয়াকে ফোন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুজনের মধ্যে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা ফোনালাপ হলেও বরফ গলেনি, বরং সংলাপের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে নির্বাচন বানচালে আন্দোলনের নামে সহিংসতা-ধ্বংসযজ্ঞ অব্যাহত রেখেছিল বিএনপি-জামায়াত জোট। এরপরে দুনেত্রীর মধ্যে আর কোন সাক্ষাত কিংবা কথা হয়নি।

 এরমধ্যে গড়িয়ে গেছে অনেক জল। বর্তমান পরিস্থিতিতে দুই নেত্রীর নেতৃত্বাধীন দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে এখন যোজন যোজন দূরত্ব। গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বয়কট করে বিরোধী দলের নেতার পদটিও হারিয়েছেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া। নির্বাচন বয়কটের আন্দোলনের নামে বিএনপি-জামায়াত জোটের ভয়াল সহিংসতায় প্রায় পাঁচ শতাধিক মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে, মানুষকে পুড়িয়ে মারার মহোৎসব প্রত্যক্ষ করেছে দেশের মানুষ।

 ঠিক এক বছর বাদে গত ৫ জানুয়ারি থেকে অবরোধ-হরতালের নামে একই কায়দায় মানুষ হত্যায় নেমেছে বিএনপি-জামায়াত জোট। গত ৬ জানুয়ারি থেকে শনিবার পর্যন্ত ১৯ দিনে বিএনপি-জামায়াত জোটের নাশকতায় প্রায় ৩৫ জনের মৃত্যু ঘটেছে। পেট্রোলবোমা ও অগ্নিসংযোগে শিশু-কিশোর-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, দিনমজুর, ট্রাকচালকসহ নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ দগ্ধ হয়ে মারা গেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার কঠোর অভিযান চালাচ্ছে। জাতীয় সংসদসহ সর্বত্র বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম জিয়াকে গ্রেফতারের প্রচ- দাবি উঠেছে। অন্যদিকে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত হরতাল-অবরোধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি।

কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, আপনি যদি বঙ্গবন্ধুর কন্যা হয়ে থাকেন তাহলে এই মুহূর্তে পুত্র হারানোর শোকের সান্ত্বনা দিতে খালেদা জিয়ার বাড়িতে যান। একই সঙ্গে দেশকে জ্বালাও পোড়াও থেকে রক্ষা করতে খালেদা জিয়াকে এই মুহূর্তে  হরতাল-অবরোধ তুলে নেয়ার আহ্বান জানান। শনিবার বিকালে উপজেলার ঘোনার চালা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে কালিয়া ইউনিয়ন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ আয়োজিত এক জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

তিনি  বলেন, তারেক রহমান বিদেশের মাটিতে বসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজাকার বলে সাধারণ মানুষের মনে কষ্ট দেয়ায় হরতাল-অবরোধে মানুষ সাড়া দিচ্ছে না। তিনি তারেক রহমানকে এ সব কথা না বলে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাইতে বলেন।

অন্য কাউকে দোষ দেবার আগে সেই টেলিসংলাপ থেকে ফটকে তালা ঝুলানো পর্যন্ত আচরণ জনগণের  বিবেচনা করে ভাবতে হবে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া নিজে ন্যুনতম বিবেচনা বোধ ধারণ করেন কিনা। ২০১৩ টেলি সংলাপ এবং  সর্বশেষ শেখ হাসিনার সমবেদনা প্রত্যাখ্যানের জন্যে ফটকে তালা ঝুলানোর ঘটনার ধারাবাহিকতা প্রমাণ করে বেগম খালেদা তাঁর ব্যক্তিস্বার্থ প্রশ্নে একেবারে আপোষহীন।যিনি নিজেই সামান্যতম ভদ্রতা দেখানো অপ্রয়োজনীয় মনে করেন- তাঁর কাছে দেশের প্রতি দায়িত্মশীলতা আশা করা বাতুলতা মাত্র।### ২৫ জানুয়ারী ২০১৫

Sumikhan29bdj@gmail.com

 

Saturday, January 17, 2015

'আহা হতে পারতাম যদি তোমার মত মালাউন' - জ.শ. তিমির

'মানুষ হিসেবে তোমার সীমানায় পৌঁছাব এমন স্পর্ধা কখনও করিনি পোষন,
গৌরী শৃঙ্গের পানে বিস্ময়াহত চেয়ে থাকি ।তোমার স্মৃতি
চিরকাল বহন করে সঞ্জীবনী গুণ,
 আহা হতে পারতাম যদি তোমার মত মালাউন ।'
শওকত ওসমান

পিতা অপূর্বরত্ন দাশগুপ্ত খ্যাতনামা খেলোয়াড় ছিলেন। মা ইন্দুপ্রভা দাশগুপ্ত , আর মামা ছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশের পিতা সত্যানন্দ দাশ । আদি বাড়ি বিক্রমপুরের গাউপাড়া গ্রামে।  সাহিত্য, সাংবাদিকতা, সংগঠন, ও রাজনীতি, যেখানেই বিচরণ করেছেন ঋষিত্বের স্বাক্ষর একেছেন । নীতি, আদর্শের প্রতি দৃঢ়চেতা এই মানুষ দেশ, মানুষ ও সমাজের প্রতি সঁপে দিয়েছিলেন তার মৃত্যুহীন প্রাণ।অসাম্প্রদায়িক,  শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন, প্রগতিশীল  সমাজ  এবং নতুন প্রজন্ম গড়ার প্রত্যয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন অবিরাম। গত ১৫ ই জানুয়ারী ছিল ঋষিতুল্য এই ব্যক্তি রনেশ দাশগুপ্তর জন্মতিথি। 
অগ্নিযুগ - ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামীদের  সম্পর্কে রনেশ দাশগুপ্ত তার ‘আইরিশ, বাংলা, সিয়ান ও ক্যাসি’ নিবন্ধে লিখেছেন, ‘(আইরিশ) স্বাধীনতা সংগ্রামের সৈনিক টেরেন্স ম্যাকসুইনি কারাগারে রাজনৈতিক মর্যাদা আর দেশের মুক্তির দাবিতে পঁচাত্তর দিন অনশন করে প্রাণ দিয়েছিলেন। ইংরেজ রাজত্ব উচ্ছেদের প্রচেষ্টায় লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত বাংলার যতীন দাস একই ধরনের দাবিতে কারাগারে চৌষট্টি দিন অনশন করে যখন প্রাণ দিলেন, তখন বাংলার যৌবনের মর্মভূমিতে যতীন দাস ম্যাকসুইনি যমজ ভাইয়ের মতো আসীন হয়েছিলেন।
১৯৪০ সালে “প্রগতি লেখক-শিল্পী সঙ্ঘ” যাদের প্রচেষ্ঠাতে গড়ে ওঠে তাদের মধ্যে  একজন  রনেশ দাশগুপ্ত আর আরেকজন শহীদ সোমেন চন্দ । ১৯৪৭ সালে ৪৭ এর দাঙ্গা প্রতিরোধে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সেই মহামারীর তান্ডবের বিরুদ্ধে সারা বাংলা রুখিয়া দাড়াও' এর  ঐতিহাসিক প্লাটফর্মে তার  সক্রিয় অংশগ্রহণ ইতিহাসে মুদ্রিত ।
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে পরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাংলা ভাষাকে উর্দু ও ইংরেজির সাথে গণপরিষদের ভাষা হিসেবে অন্তর্ভূক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হলে বিক্ষুব্ধ ছাত্রবৃন্দ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের ডাকে ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালন করে । ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠিত হওয়ার পর ১১ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ, মুহম্মদ তোয়াহ, আবুল কাশেম, রনেশ দাশগুপ্ত, অজিত গুপ্ত প্রমুখ নেতাদের উদ্যোগে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পালিত সর্বাত্মক সাধারণ ধর্মঘট ডাকা হয়  ১৯৪৮ সালের সাধারণ ধর্মঘট ছিল ভাষা আন্দেলনের ইতিহাসে তথা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এদেশে প্রথম সফল হরতাল। এই হরতালে নেতৃত্বদান কালে বঙ্গবন্ধু পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়ে গ্রেফতার হন।
 
রনেশ দাশগুপ্ত জেলে নাট্যকার মুনীর চৌধুরীকে ‘কবর’ নাটক লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। ‘কবর’ নাটকটি তাদের চেষ্টায় কারাগারে মঞ্চস্থ হতে পেরেছিল। স্বাধীনতার মূল প্রেরণা শক্তি যে ভাষা আন্দোলন সেই ভাষা আন্দোলনের চেতনায় দীপ্ত হয়ে ১৯৫২ সালের ২ মে দৈনিক সংবাদ-এর পাতায় আত্মপ্রকাশ করে খেলাঘর | প্রগতিশীল সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলে সুন্দর আগামী বিনির্মাণের লক্ষ্যে সেদিন কবি হাবীবুর রহমান, শহীদুল্লাহ কায়সার, রনেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন, জহির রায়হানসহ আরো অনেক প্রগতিশীল বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ মিলে জন্ম দিয়েছিলেন খেলাঘর| তিনি উদীচী শিল্পী গোষ্ঠির প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম| 
গোটা পাকিস্তানি আমলে তিনি বহুবার কারাবাস করেছেন। কারামুক্তির পর ১৯৫৫ সালে তিনি ‘সংবাদ’ পত্রিকায় সাংবাদিকতার চাকরি গ্রহণ করেন। এ পত্রিকাকে ব্যাপক অর্থে প্রগতির মুখপত্র করে তুলতে তার অবদান ছিল বিরাট।সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি নিয়মিত সাহিত্যচর্চা করেছেন।স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জনপ্রিয় কিছু অনুষ্ঠান যেসব বুদ্ধিজীবী নিয়মিত অনুষ্ঠান সিরিজে অংশ নিয়েছেন তাদের মধ্যে ছিলেন জামিল শারাফি ছদ্দনামে- সাংবাদিক রণেশ দাশগুপ্ত (দৃষ্টিপাত এ)|
ইতিবাচক এই আজন্ম যোদ্ধা রনেশ দাশগুপ্ত শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের দুর্ভিক্ষের স্কেচ দেখে বলেছেন কখনো মনে হয়নি মানুষ মরে যাচ্ছে শুধু,  বরং মনে হতো মানুষ বেঁচে উঠতে চাইছে।’


Monday, January 5, 2015

একজন সৎ এবং মেধাবী রাজনীতিক কমরেড সুধন দাসের জন্মদিনে কুর্নিশ জানাই-সুমি খান

 
  আমাদের লাল সবুজ পতাকা আর এই সবুজ ঘাসের মাটির পরিচয় যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত-তেমন একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব প্রতিবেশী দেশের বিধায়ক সৎ এবং মেধাবী রাজনীতিক কমরেড সুধন দাস। আজ তাঁর জন্মদিনে অন্তরের অন্ত:স্থল থেকে বিনম্র শ্রদ্ধা!!



মেলাঘর,চোট্টাখোলা,রাজনগর,পালাটানা,বিশ্রামগঞ্জ, বিলোনিয়া...এসব এলাকার এমন কোনো গ্রাম নেই, যেখানে বাংলাদেশের শরণার্থীদের পরম আত্মীয়ের মতো স্বাগত জানানো হয়নি।একাত্তরে বাংলাদেশের  মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ এবং গেরিলা অভিযান পরিচালনার জন্যও গড়ে উঠেছিল অনেক ক্যাম্প। নতুন প্রজন্মের কাছে সেসব গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস তুলে ধরার জন্যে উদ্যোগী হয়েছেন সিপিএম নেতা এবং এলাকার জনপ্রিয়তম জনপ্রতিনিধি কমরেড  সুধন দাস।ইতিহাস সাক্ষী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার অবদান অবিস্মরণীয়।একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের ৪৩ বছর অতিক্রান্ত হলেও ত্রিপুরার মানুষের কাছে সেসব দিনের স্মৃতি এখনও অম্লান। ত্রিপুরা রাজ্যের কোন কোন এলাকার নাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত।
 ১৬ ডিসেম্বর,২০১৩ চোট্টাখোলায় বিধায়ক কমরেড সুধন দাস এবং বন্ধুকবি প্রীতি আচার্য্যের সাথে আমি
 
 মেলাঘর,চোট্টাখোলা,রাজনগর,পালাটানা,বিশ্রামগঞ্জ, বিলোনিয়া...এসব এলাকার এমন কোনো গ্রাম নেই, যেখানে বাংলাদেশের শরণার্থীদের পরম আত্মীয়ের মতো স্বাগত জানানো হয়নি।একাত্তরে বাংলাদেশের  মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ এবং গেরিলা অভিযান পরিচালনার জন্যও গড়ে উঠেছিল অনেক ক্যাম্প। নতুন প্রজন্মের কাছে সেসব গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস তুলে ধরার জন্যে উদ্যোগী হয়েছেন সিপিএম নেতা এবং এলাকার জনপ্রিয়তম জনপ্রতিনিধি কমরেড সুধন দাস।

একাত্তরে কমরেড সুধন দাসের বাবা পরিবারের সকলকে নিয়ে তাদের গোয়ালঘর এবং রান্নাঘরে আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের কয়েকটি মুসলিম পরিবারকে তাঁদের থাকার ঘর ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেই মুসলিম পরিবারটি ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা হলেও এখনো একাত্তরের আত্মীয়তা বুকে ধারণ করছেন। আর তাই বর্তমানে ত্রিপুরার অন্যতম  সফল বিধায়ক সুধন দাস এবং তাঁর পরিবারের প্রত্যেককে  ঢাকায় আমন্ত্রন করেন তাঁদের পরিবারের মানুষ মনে করে।পারিবারিক অনুষ্ঠানের আমন্ত্রনে সুধন দাস সপরিবারে উপস্থিত হতে না পারলে বাংলাদেশী  মুসলিম আত্মীয় ভীষণ অভিমান করেন। এ যেন সম্প্রীতির বন্ধনের চিরকালীন দৃষ্টান্ত, যা অনেকটা হারিয়ে গেছে।
বিধায়ক সুধন দাসের  মা, স্ত্রী এবং  ছোট্ট দুই মেধাবী কন্যা ভীষণ সমাজ সচেতন এবং জনদরদী।আমার দুর্ভাগ্য, তাঁর মায়ের সাথে দেখা করে তাঁর আশীর্বাদ নিতে পারিনি। তবে শ্রদ্ধেয় বৌদী এবং দুই সুকন্যার সাথে কাটানো মহার্ঘ সময়গুলো অমলিন হয়ে আছে আমার স্মৃতিতে। অবসর হচ্ছে না সেসব নিয়ে বিস্তারিত লিখতে। আজ সুধন'দার জন্মদিনের শুভক্ষণে সামান্য  কিছু স্মৃতিচারণ করলাম।পরবর্তীতে বিস্তারিত লিখবার প্রত্যয় মনে গেঁথে রাখলাম।
চোট্টাখোলা মুক্তিযুদ্ধ পার্ক এমনই অসাধারণ উদ্যোগ।এখানে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের ভাস্কর্য করা হয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় স্মৃতিসৌধ, লালবাগ কেল্লা সহ নানান দর্শনীয় স্থানের নিদর্শনের রেপ্লিকার পাশাপাশি ভারতের দর্শনীয় স্থানের রেপ্লিকা তৈরি করা হয়েছে। প্রতি বছরের মতো ২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে এই পার্কে উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। একাত্তরে ২ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক খালেদ মোশাররফের কন্যা, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সদস্য মাহজাবিন খালেদ এ অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। সেখানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। একটি স্মৃতিসৌধও নির্মিত হচ্ছে।
একাত্তরে ত্রিপুরায় লোকসংখ্যার চেয়ে বেশি ছিল বাংলাদেশের শরণার্থীএমন কোনো গ্রাম নেই, যেখানে বাংলাদেশের শরণার্থীদের পরম আত্মীয়ের মতো স্বাগত জানানো হয়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ এবং গেরিলা অভিযান পরিচালনার জন্যেও গড়ে উঠেছিল অনেক ক্যাম্প। ত্রিপুরার নতুন প্রজন্মের কাছে এগুলো তুলে ধরার জন্য অনেক আয়োজন রয়েছে। চোট্টাখোলা মুক্তিযুদ্ধ পার্ক হচ্ছে এমনই একটি উদ্যোগ। করেন।সেখানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।একটি স্মৃতিসৌধও নির্মিত হচ্ছে।২০১৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে সেখানে উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। আমি সেখানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হলো বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবেশনের সাথে সাথে। একাত্তরে জন্ম না নিয়েও যেন একাত্তরের সেই রক্তঝরা যুদ্ধের দিনগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম...... দু'চোখ ভরে উঠলো জলে! সে কী অসাধারণ অনুভূতি তা কখনো ভুলবার নয়;বলে বোঝানোর মতোও নয়।মনে মনে ভাবলাম, যুগে যুগে কালে কালে এই মানুষগুলোর কাছে আমরা ঋণী হয়েই রইলাম। 
সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর একাত্তরে ২ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক খালেদ মোশাররফের কন্যা, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সদস্য মাহজাবিন খালেদ এ অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ  আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী কমরেড মানিক সরকার এই মুক্তিযুদ্ধ পার্কের উদ্বোধন করবেন।এই পুরো কাজে রাজনগর এলাকার পরপর চারবারের নির্বাচিত বিধায়ক সুধন দাস প্রধান ভূমিকা পালন করছেন। বাবরী মসজিদ নিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রতিবাদে সুধন দাস রাজনগরে শতবছরের প্রাচীন মসজিদ পুনরুদ্ধার করে প্রতিবছর সেখানে অসাম্প্রদায়িক অনুষ্ঠান উদযাপন করেন।হরতালের মধ্যে আমাকে আমন্ত্রন জানানো তে অনেক সতর্কতার মধ্যে বিলোনিয়া সীমান্ত পার করালেন কমরেড সুধন দাস।সীমান্ত থেকে আমাকে বরণ করে নিজের বাড়িতে রেখেছিলেন কবি সমরজিৎ সিনহা এবং তাঁর  গুণী স্ত্রী প্রীতি আচার্য্য!
দেশে ফিরবার সময়ে অনেক মিষ্টি কিনে দিলেন কমরেড সুধন দাস। তাতেই শেষ নয়, অবাক বিস্ময়ে দেখলাম সীমান্ত পেরিয়ে বিএস এফ এবংবিজিবি সদস্যদের  ও বিধায়ক মহোদয় নিজের হাতে মিষ্টি বিলালেন! এঁরাই কমরেড! এঁরাই গণমানুষের নেতা!দিনে বাংলাদেশের  পবিত্র মাটি থেকে অতি সাধারণ এক নাগরিক আমি  বিনম্র শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

Monday, December 22, 2014

সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় মঙ্গলবার

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় জানা যাবে ২৩ ডিসেম্বর,২০১৪, মঙ্গলবার।বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন, আটক, ধর্ষণ, মুক্তিপণ আদায়ের মতো ১৬টি অভিযোগে অভিযুক্ত মুসলিম লীগের সাবেক নেতা সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের মামলার রায় দিতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
বিচারপতি ওবায়দুল হাসান নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ মঙ্গলবার সকাল ১০টার পর এই রায় ঘোষণা করবে। এ ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন-  বিচারপতি মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম।সাক্ষ্য, জেরা ও দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে গত ২০ অগাস্ট মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখা হয়েছিল।
 মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন প্রসিকিউশনের চতুর্থ সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী পাঠান। সাক্ষী তার জবানবন্দিতে বলেছেন, ১৯৭১ সালের ২৯ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং কায়সার বাহিনীর লোকেরা মাধবপুর বাজার এবং কৃষ্ণনগর গ্রামে ১৪ থেকে ১৫ জনকে হত্যা করে। ওইদিন বিকেলেই তিনি বাড়ির পূর্ব-উত্তর দিকের চার গোপাটে তার বাবাসহ আরো তিনজনের লাশ পড়ে থাকতে দেখেন। এরপর পাশের জমি থেকে মাটি আর ইট পাথর এনে বাবার লাশটি তিনি মাটিচাপা দেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাবার লাশের হাড়গোড় উঠিয়ে এনে পারিবারিক কবরস্থানে পুনরায় সমাহিত করা হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ সাক্ষ্য প্রদানকালে তিনি এসব কথা বলেন। সাক্ষ্য গ্রহণে ট্রাইব্যুনালকে সহযোগিতা করেন প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত।
মোহাম্মদ আলী পাঠান আদালতে বলেন, ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে মাওলানা আছাদ আলীর নেতৃত্বে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে সিও অফিসের সামনে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করি। একই সাথে থানার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পতাকা উত্তোলন করা হয়। ওইদিন মাধবপুরের জগদিশপুর উচ্চ বিদ্যালয়েও বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল। আর এ নিয়ে পরদিন কায়সার বাহিনীর লোকদের সঙ্গে স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের বাকবিতন্ডা হয়েছিল বলে সাক্ষ্যে উল্লেখ করেন সাক্ষী। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিলের পর যখন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি চলছিল তখন আমরা জানতে পারলাম ঢাকায় শান্তি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সৈয়দ কায়সার ছিলেন সেই শান্তি কমিটির অন্যতম সদস্য। মৌজপুরে থাকা অবস্থায় ২৮ এপ্রিল সন্ধ্যার দিকে খবর পাই পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও কায়সারের লোকেরা আমার পিতা ওহিদ উদ্দিন পাঠানসহ আরো অনেককে হত্যা করেছে। বাবাকে মেরে ফেলার পর মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে আব্দুল কুদ্দুস মাখন তাকে মাধবপুর থেকে আগরতলার কলেজ টিলায় নিয়ে যান। সেখান থেকে প্রশিক্ষণের জন্য তাকে হাপানিয়া ট্রেনিং ক্যাম্পে পাঠানো হয়। ট্রেনিং শেষে নভেম্বরে ১১নং সেক্টরের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার ১৫-২০ দিন পর ঢাকা থেকে মাধবপুরের বাড়িতে আসেন মোহাম্মদ আলী পাঠান। এলাকায় এসে মানুষের আহাজারি শুনতে পান। তাদের কাছ থেকে জানতে পারেন কায়সার বাহিনী এবং পাকিস্তানী সেনারা এই ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে বলেও তিনি তার সাক্ষ্যে উল্লেখ করেন।সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে সাক্ষীকে সংক্ষিপ্ত জেরা করেন আসামীর আইনজীবী আব্দুস সোবহান তরফদার।
সৈয়দ কায়সারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পথ দেখিয়ে বিভিন্ন গ্রামে নিয়ে স্বাধীনতার পক্ষের লোক এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর দমন অভিযান চালাতেন। পরে স্বাধীনতার ঠিক আগে তিনি আত্মগোপন করেন।
 
১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর ১৯৭৮ সালে আবারো রাজনীতিতে সক্রিয় হন কায়সারসহ অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীএই। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১৭ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে দাঁড়িয়ে সাংসদ নির্বাচিত হন।পরে জিয়াউর রহমানের সময়ে তিনি বিএনপিতে যাগ দেন এবং হবিগঞ্জ বিএনপির সভাপতি হন।এরশাদের সময়ে তিনি যোগ দেন জাতীয় পার্টিতে। ১৯৮৮ সালে হবিগঞ্জ-৪ আসন থেকে লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য হন।

অভিযোগ ১: ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল দুপুর দেড়টা থেকে ৩টার মধ্যে সৈয়দ কায়সার তার কায়সার বাহিনী ও পাকিস্তানী সেনাবাহিনীসহ ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলার ইসলামপুর থানা এলাকায় যায়। কায়সারের নির্দেশে ইসলামপুর থানার সামনে জনৈক শাহজাহান চেয়ারম্যানকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। একইদিনে একই থানাধীন কাজীবাড়ী এলাকায় নায়েব আলী নামে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের একজনকে নির্যাতন করা হয়। পরে কাজীবাড়ী এলাকার ১৫টি ঘরবাড়ি লুটপাটও অগ্নিসংযোগ করা হয়।এ ঘটনায় হত্যা ও অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিকল্পনা, সহযোগিতা ও সরাসরি ভূমিকা রাখার অভিযোগ আনা হয়েছে কায়সারের বিরুদ্ধে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর  ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ২০(২), ৩(১) এবং ৪(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
 
অভিযোগ ২: ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল বিকাল ৫টা থেকে ৬টার মধ্যে সৈয়দ মো. কায়সার তার কায়সার বাহিনী ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীসহ হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর থানা এলাকায় মাধবপুর বাজারের পশ্চিম পাশে সাধারণ মানুষের ওপর হামলা চালায়। একইসঙ্গে পার্শ্ববর্তী কাটিয়ারা বাজারে ১৫০টি ঘরবাড়ি ও দোকানপাট লুটপাট করে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক কামিনী রায়, বিনোদ বিহারী মোদক, শচীন্দ্র রায়, হীরেন্দ্র রায়, রতি বাবু, অহিদ হোসেন পাঠানের সম্পত্তি আগুন দিয়ে ধ্বংস করে। এ ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিকল্পনা, সহযোগিতা ও সরাসরি ভূমিকা রাখার অভিযোগ আনা হয়েছে কায়সারের বিরুদ্ধে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর  ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ২০(২), ৩(১) এবং ৪(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
 
অভিযোগ ৩: ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিলহবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর বাজার থেকে আধা কিলোমিটার দূরে কৃষ্ণনগর গ্রামে হামলা চালায় সৈয়দ মো. কায়সার, তার বাহিনী ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। সেখানে অন্তত ৫৫টি ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। কায়সারের নির্দেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অহিদ পাঠান, চেরাগ আলী, জনাব আলী ও মধু সুইপারকে গুলি করে হত্যা করে।এ ঘটনায় হত্যা ও অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিকল্পনা, সহযোগিতা ও সরাসরি ভূমিকা রাখার অভিযোগ আনা হয়েছে কায়সারের বিরুদ্ধে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর  ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ২০(২), ৩(১) এবং ৪(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
 
অভিযোগ ৪: ১৯৭১ সালের ২৮ এপ্রিল সকাল ১০টা থেকে দুপুর আড়াইটার মধ্যে আসামি সৈয়দ মো. কায়সার, তার ‘কায়সার বাহিনী’র ১০/১৫ জন সদস্য এবং ৩০/৩৫ জন পাকিস্তানি সেনা নিয়ে মাধবপুর বাজারের উত্তর-পূর্ব দিকে হামলা চালায়। তাদের ছোড়া এলোপাতারি গুলিতে সাত্তার, বরকত আলীসহ ১৫জন নিরীহ গ্রামবাসী নিহত হন। একইসঙ্গে দেড়শ থেকে দুইশ বাড়িঘর ও দোকানপাট লুটপাট করে পুড়িয়ে দেয় তারা।
এ ঘটনায় হত্যা ও অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিকল্পনা, সহযোগিতা ও সরাসরি ভূমিকা রাখার অভিযোগ আনা হয়েছে কায়সারের বিরুদ্ধে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর  ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ২০(২), ৩(১) এবং ৪(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
অভিযোগ ৫: ১৯৭১ সালের  ২৯ এপ্রিল দুপুর থেকে বিকালের মধ্যে হবিগঞ্জ সদরের শায়েস্তাগঞ্জ খাদ্যগুদাম এবং শায়েস্তাগঞ্জ পুরান বাজারের রেলব্রিজ এলাকায় আব্দুল আজিজ, আব্দুল খালেক, রেজাউল করিম, আব্দুর রহমান এবং বড়বহুলা এলাকার আব্দুল আলী ওরফে গ্যাদা উল্লাহ, লেঞ্জাপাড়া এলাকার মাজত আলী ও তারা মিয়া চৌধুরীকে আটক করে নির্যাতনের পর হত্যা করে সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী।
সাতজন নিরস্ত্র গ্রামবাসীকে হত্যার এ ঘটনার পরিকল্পনা, সহযোগিতা ও সরাসরি ভূমিকা রাখার অভিযোগ আনা হয়েছে কায়সারের বিরুদ্ধে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর  ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ২০(২), ৩(১) এবং ৪(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
অভিযোগ ৬: ১৯৭১ সালের ২৯ এপ্রিল সন্ধ্যার পর হবিগঞ্জ সদরের পুরানবাজার পয়েন্টে সাবেক প্রধান বিচারপতি সৈয়দ এ বি এম মহিউদ্দিনের বাড়িতে হামলা হয়। এছাড়া লস্করপুর রেল লাইনের পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে সালেহ উদ্দিন আহমেদ এবং হীরেন্দ্র চন্দ্র রায়কে ধরে নিয়ে নির্যাতনের পর হত্যা করে সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী।
দুইজন নিরস্ত্র গ্রামবাসীকে হত্যার এ ঘটনায় পরিকল্পনা, সহযোগিতা ও সরাসরি ভূমিকা রাখার অভিযোগ আনা হয়েছে  সৈয়দ কায়সারের বিরুদ্ধে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর  ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ২০(২), ৩(১) এবং ৪(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
অভিযোগ ৭: সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী ১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল হবিগঞ্জ সদরের এনএনএ মোস্তফা আলীর বাড়িসহ ৪০/৫০টি বাড়িঘর, দোকানপাটে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে।
এ ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিকল্পনা, সহযোগিতা ও সরাসরি ভূমিকা রাখার অভিযোগ আনা হয়েছে কায়সারের বিরুদ্ধে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর  ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ২০(২), ৩(১) এবং ৪(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
অভিযোগ ৮: মুক্তিযুদ্ধের সময় ১১ মে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট থানার চাঁদপুর চা বাগানে সাঁওতাল নারী হীরামনিকে ধর্ষণ করে সৈয়দ কায়সারের বাহিনী। সৈয়দ কায়সার এ সাঁওতাল নারীকে ধর্ষণে সহায়তা করেছিলেন বলে অভিযোগ এনেছে প্রসিকিউশন।
এ ঘটনায় ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়েছে কায়সারের বিরুদ্ধে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর  ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ২০(২), ৩(১) এবং ৪(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
অভিযোগ ৯: ১৯৭১ সালের ১৫ মে হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুরের লোহাইদ এলাকার আব্দুল আজিজ, আব্দুল গফুর, জমির উদ্দিন, আজিম উদ্দিন, এতিমুনেছা, নূর আলী চৌধুরী, আলম চাঁনবিবি ও আব্দুল আলীকে হত্যা করে সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী। এদিন আকরাম আলী চৌধুরী (বর্তমানে মৃত) নামে একজনকে জখমও করেন সৈয়দ কায়সার।
নয়জন নিরস্ত্র গ্রামবাসীকে হত্যার এ ঘটনায় পরিকল্পনা, সহযোগিতা ও সরাসরি ভূমিকা রাখার অভিযোগ আনা হয়েছে  সৈয়দ কায়সারের বিরুদ্ধে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর  ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ২০(২), ৩(১) এবং ৪(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
অভিযোগ ১০: এরপর ১৩ জুন হবিগঞ্জ সদর, মোকাম বাড়ি, শায়েস্তাগঞ্জ থানার আর অ্যান্ড এইচ ডাকবাংলো এবং মাধবপুর থানার শাহাজীবাজার এলাকার হামলা চালায় সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী। এ সময় শাহ ফিরোজ আলী নামের একজনকে অপহরণের পর নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। সাবু মিয়া নামের আরেকজনকে অপহরণের পর চালানো হয় নির্যাতন।
এ ঘটনায় হত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছে সৈয়দ কায়সারের বিরুদ্ধে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর  ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ২০(২), ৩(১) এবং ৪(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
অভিযোগ ১১: ১৯৭১ সালের ২৩ জুন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার হরিপুর থানার নাসিরনগরের গোলাম রউফ মাস্টার ও তার পরিবারের লোকজনদের উপর নির্যাতন চালায় সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী। এছাড়া গোলাম রউফ মাস্টারকে অপহরণ ও আটকের পর তার ওপর নির্যাতন চলে। এক পর্যায়ে মুক্তিপণ আদায় করে তার বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
এছাড়া একই দিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর থানার দয়াল গোবিন্দ রায় ওরফে বাদল কর্মকারের বাড়িতে হামলা চালায় সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী। লুটপাটের পর ওই বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
এ ঘটনায় হত্যা ও অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিকল্পনা, সহযোগিতা ও সরাসরি ভূমিকা রাখার অভিযোগ আনা হয়েছে কায়সারের বিরুদ্ধে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর  ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ২০(২), ৩(১) এবং ৪(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
অভিযোগ ১২: সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী অগাস্টের মাসের মাঝামাঝি কোনো একদিন হবিগঞ্জের মাধবপুর থানার বেলাঘর ও জগদীশপুর হাইস্কুল থেকে আতাব মিয়া, আইয়ুব মিয়া, মাজেদা বেগমকে অপহরণ করে। এক পর্যায়ে মাজেদাকে ধর্ষণ করা হয়।
এ ঘটনায় ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়েছে কায়সারের বিরুদ্ধে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর  ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ২০(২), ৩(১) এবং ৪(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
অভিযোগ ১৩: ১৯৭১ সালের ১৮ অগাস্ট হবিগঞ্জের নলুয়া চা বাগান থেকে মহিবুল্লাহ, আবদুস শহীদ, আকবর আলী, জাহির হোসেনকে অপহরণ করে নরপতিতে আব্দুস শাহীদের বাড়ি ও রাজেন্দ্র দত্তের বাড়িতে স্থানীয় শান্তি কমিটির কার্যালয় এবং কালাপুরের পাকিস্তানি আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যায় সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী। অপহৃতদের আটকে রেখে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়।
এ ঘটনায় হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে কায়সারের বিরুদ্ধে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর  ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ২০(২), ৩(১) এবং ৪(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
অভিযোগ ১৪: ১৯৭১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর হবিগঞ্জের মাধবপুরে সোনাই নদীর ব্রিজ এলাকা থেকে সিরাজ আলী, ওয়াহেদ আলী, আক্কাস আলী, আব্দুল ছাত্তারকে অপহরণ করে নিয়ে যায় সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী। তাদের আটকে রেখে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়।
এ ঘটনায় হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে কায়সারের বিরুদ্ধে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর  ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ২০(২), ৩(১) এবং ৪(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
অভিযোগ ১৫: অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি কোনো একদিন সন্ধ্যায় হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুরে শালবন রঘুনন্দ পাহাড় এলাকায় শাহাপুর গ্রামের নাজিম উদ্দিনকে অপহরণের পর আটকে রেখে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।
এ ঘটনায় হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে কায়সারের বিরুদ্ধে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর  ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ২০(২), ৩(১) এবং ৪(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
অভিযোগ ১৬: সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী ১৯৭১ সালের ১৫ নভেম্বর ব্রাহ্মণবড়িয়ার ভাটপাড়া থানার দাউরা, নিশ্চিন্তপুর, গুটমা, বুরুঙ্গা, চিতনা, নূরপুর, ফুলপুর, জেঠাগ্রাম, পাঠানিশা, কুলিতুণ্ডা, আন্দ্রাবহ, তিলপাড়া, কমলপুর, গঙ্গানগর, বাঘি, শ্যামপুর, কুয়ারপুর, নোয়াগাঁও, কুণ্ডা, লক্ষীপুর, করগ্রাম গ্রামের ১০৮ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে।
এ ঘটনায় গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে কায়সারের বিরুদ্ধে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর  ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ২০(২), ৩(১) এবং ৪(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
 

Tuesday, December 16, 2014

যারা এনে দিলেন স্বাধীন দেশ আর জাতীয় পতাকা -বিনম্র শ্রদ্ধায় সালাম -সুমি খান

আজ মহান বিজয় দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধায় সালাম তাঁদের প্রতি যারা এনে দিলেন স্বাধীন দেশ আর জাতীয় পতাকা! প্রথমত: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান , তাঁর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা -এ দেশের তিরিশ লাখ শহীদ, তিন লাখ ধর্ষিতা নারী  এবং কিংবদন্তী নেতা জ্যোতি বসু, ইন্দিরা গান্ধী ,রুশ রাষ্ট্রনায়ক  ব্রেজনেভ!পরাজিত পাকিস্তানী সেনারা বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ চট্টগ্রাম বন্দর ধ্বংস করার জন্যে মাইন পুঁতে রেখে গিয়েছিলো।সেসব মাইন তুলতে গিয়ে ১৯৭২ সালের গ্রীষ্মে পতেঙ্গা সৈকতে নিহত  হন রাশিয়ান নাবিক ইউরি র‍্যাডকিন। আহত হন অনেকে।নিহত আহত প্রত্যেকের প্রতি আমার হৃদয়ের অন্ত:স্থল থেকে শ্রদ্ধা জানাই আজ। আমার বিনম্র সালাম ভারতীয় যোদ্ধা জেনারেল মানিকশ'সহ অসংখ্য ভারতসেনানী - যারা মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে ! বাংলাদেশের ১ কোটি মানুষকে নিজেদের সর্বস্ব উজাড় করে ত্রিপুরা এবং কোলকাতায় অন্ন বস্ত্র বাসস্থান দিয়ে আশ্রয় দিয়েছিলেন যাঁরা সেই মহামানবদের আমার সালাম। মুক্তিকামী জনতাকে সাথে নিয়ে ১৬ডিসেম্বরের মধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় বাঙ্গালী পরাজিত করেছিলো পাকিস্তানী নরঘাতকদের!উইকিপিডিয়া থেকে দুই প্যারা তুলে দিলাম বন্ধু দের জন্যে।
The Indo-Pakistani War of 1971 was the direct military confrontation between India and Pakistan during the Bangladesh Liberation War in 1971. Indian, Bangladeshi and international sources consider the beginning of the war to have been Operation Chengiz Khan, when Pakistan launched pre-emptive air strikes on 11 Indian airbases on 3 December 1971, leading to India's entry into the war of independence in East Pakistan on the side of Bangladeshi nationalist forces, and the commencement of hostilities with West Pakistan.[19][20] Lasting just 13 days, it is considered to be one of the shortest wars in history.Historical events During the war of liberation in 1971, the freedom fighters (naval commandos) conducted a number of attacks from Chittagong port.Many foreign ships were damaged due to bomb explosions. Pakistan army, on the verge of their defeat, planted mines in the port area in order to deadlock the port. After 16 December 1971, the then Soviet Naval Forces came here to clear mines. Several Soviet marines were killed in this mine removal operation.
During the course of the war, Indian and Pakistani forces clashed on the eastern and western fronts. The war effectively came to an end after the Eastern Command of the Pakistani Armed Forces signed the Instrument of Surrender,[23] on 16 December 1971 in Dhaka, marking the liberation of the new nation of Bangladesh. East Pakistan had officially seceded from Pakistan on 26 March 1971.
 Between 90,000 and 93,000 members of the Pakistan Armed Forces including paramilitary personnel were taken as Prisoners of War by the Indian Army.[24][25] It is estimated that between 300,000 and 3,000,000 civilians were killed in Bangladesh.[26][27] As a result of the conflict, a further eight to ten million people fled the country at the time to seek refuge in neighbouring India.[28]

শহীদ বুদ্ধিজীবী ডাঃ আলীম চৌধুরীর কন্যা ডা. নুজহাত চৌধুরী


Monday, December 15, 2014

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইছামতী এবং পড়ার সুখ! -রুদ্রাক্ষ রহমান

পড়ার সুখে যাকে একবার পেয়ে বসে তার পক্ষে অন্য কিছু করা মোটেও সুখকর হয়ে ওঠে না। অবশ্য এটা মানতেই হয় পড়তে না জানলে, নিয়মিত পড়ার অভ্যাস না থাকলে ভালো কিছু আয়ত্বে করা যায় না। যে পড়েছে, সেই এগিয়ে গেছে তার সময় এবং তার সময়ের মানুষদের থেকে। নিজে না পড়লে ক্লাসে ছাত্রদের পড়াবেন কী শিক্ষক!

বন্ধুদের আড্ডায় সেই প্রাণভোমরা হয়ে ওঠে যে একটু বেশি জানে। অন্যরকম জীবনের জন্যে তাই পড়াটা অন্তত জরুরি। আমাদের এই ভূখন্ডে এখন হেমন্ত চলছে। গ্রাম বাংলার মাঠে মাঠে এখন নতুন ফসলের সমারোহ। পাকাধানের ছড়ার মৃদু-মন্দছন্দতোলা বাতাস এখন মাতিয়ে দিচ্ছে চারদিক। কৃষকরে মাঠ থেকে গোলায় উঠছে সোনার ধান। নতুন ধান আর পিঠার গন্ধে নবান্নের বাতাস এখন গ্রামের ঘরে ঘরে। রাতের আকাশ থেকে শিশির পড়া শুরু করেছে। শীতের আগমন বার্তা পাওয়া যাচ্ছে গ্রামের প্রকৃতিতে। এমনি হেমন্ত আর দুরন্ত শীতের সকালে উঠানে খেজুরপাতার পাটি পেতে এদেশে পাঠের অভ্যাসটা তৈরি হয় সেই ছেলে বেলায়।

আর হেলে দুলে ছন্দপড়ার সময় থেকে সেই যে পাঠের আনন্দ তৈরি হয় বুকের ভেতর তা কোনওদিন তা ফুরিয়ে যায় না। ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ অথবা ‘আয় ছেলেরা আয় মেয়রা/ ফুলতুলিতে যাই’, অথবা ‘চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে/ ছাতিম তলায় কে/ হাতি নাচছে, ঘোড়া নাচছে/ সোনামনির বে’ দিয়ে সেই যে পড়ার শোনা তা গেঁথে যায় বুকের গভীর তলে। নানা কারণে হয়তো তা কিছু দিরে জন্যে চাপা পড়ে যায় তবে ফুরিয়ে যায় না চিরদিনের জন্যে। আর একটা বই পড়ার মধ্যে কেবল আনন্দই থাকে না, থাকে অনেক কিছু। ধরা যাক একটা উপন্যাস, সেখানে একটা সময় থাকে, কতগুলো চরিত্র থাকে। সব কেমন প্রাণময় হয়ে চলে আসে অন্য এক সময়ের পাঠকের সামনে।

 বাংলা সাহিত্যের অনেক বড় এক নির্মাতার নাম বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। এক ‘পথের পাঁচালী’র জন্যেই তিনি অমর জায়গা করে নিয়েছেন কেবল বাংলা নয়, বিশ্ব সাহিত্য আসরে। সাদা-সিধে এই মানুষটি ছিলেন প্রকৃতির পূজারী। ‘ইছামতী’ নামে তার একটি অসাধারণ উপন্যাস আছে। বইটি প্রথম প্রকাশ হয় ৬ মাঘ ১৩৫৬ সালে। প্রকাশক মিত্র ও ঘোষ, ১০ শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট, কলিকাতা-১২। বইটার দাম ছিলো ৮ টাকা। ঠিক ৬৫টি বছর আগে প্রকাশিত বইটি ১৯৫০-৫১ সালের রবীন্দ্র পুরস্কার অর্জন করে নেয়। ৬৫টি বছর আগে প্রকাশিত ইছামতীর ঘটনাকাল আরও আগের, বাংলা ১২৭০, ইংরেজি ১৮৬৩। বিভূতি সেই কালের বর্ণনা করেছেন এভাবে‘১২৭০ সালের বন্যার জল সরে গিয়েছে সবে। পথ ঘাটে তখনও কাদা, মাঠে মাঠে জল জমে আছে। বিকেল বেলা ফিঙে পাখী বসে আচে বাব্লা গাছের ফুলে-ভর্তি ডালে।’ ৩৭৬ পৃষ্ঠার একটি বই পড়তে অনেক কষ্ট হয়, সময় বার করতে হয় আর মনোযোগেরও দাবি রাখে। তবে কথা হলো ওই যে, নেশা বা আনন্দ।

বিভূতিভূষণের লেখা পড়লে বোঝা যায় মাত্র ১০০ বছর বা তার কিছু আগে আমাদের গ্রাম বাংলার অবস্থা কেমন ছিলো। জাত-পাতের শেকলে আটকে পড়া সাধারণ হিন্দু পরিবারের কথা বাদ দিয়েই ব্রাক্ষণদের অর্থনৈতিক অবস্থাও যে ভালো ছিলো না তার ছবি ফুটে উঠেছে বিভূতির কলমের আঁচড়ে।

দেশে তখন চলছিলো ইংরেজ শাসন। তখন ইংরেজ সাহেবদের দেখলে সাধারণ মানুষ কেবল পথই ছেড়ে দিতো না, রীতিমত পালাত। আর তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলো এঅঞ্চলের কিছু মানুষ, তারা ইংরেজ শাসন টিকিয়ে রাখতে এবং নিজেদের অবস্থা ভালো করার জন্যে সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার চালাতো, এমনকি খুনও। ইছামতীতে ইংরেজদের নীল চাষের সেই নিষ্ঠুর অধ্যায় ধরা পড়েছে ভেতর থেকে। আবার এই উপন্যাসে ইংরেজ এবং তাদের তাবেদার এদেশীয় দেওয়ানদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ফুঁসে ওঠার বর্ণনাও আছে। মোল্লাহাটির নীলকুঠির বড় সাহেব পথ দিয়ে যাবেন বলে গ্রামের সাধারণ মানুষ, মাথায় মোট নিয়ে হাটে হাটে ঘুর বেড়ানো নালু পাল সব ফেলে রেখে ফসলের ক্ষেতে লুকিয়ে ছিলো। কালক্রমে সেই নালু পাল যখন ওই এলাকাল সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী হয়ে ওঠে, আর নীলকুঠির আলো একটু একটু করে নিবতে থাকে, তখন সেই নালুর কাছেই বিক্রি করতে হয় ওই কুঠি।

 বাংলার পথে পথে, জনপদে ইংরেজ সাহেবরা তখন বাঙালি দেওয়ান আর সঙ্গে চাবুক নিয়ে ঘুরতো। সাহেবী চাবুকের তেজ আর আঘাত এমনি নিষ্ঠুর ছিলো যে মানুষ নাম দিয়েছিলো ‘শ্যামচাঁদ’। এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের গায়ে সেই শ্যামচাঁদের ঘা পড়তো যখন-তখন, পান থেকে চুন খসলেই। কত কষ্ট, কত লাঞ্ছনা, অপমান আর সংগ্রামের ইতিহাস আমাদের। ইংরেজ শাসনের পাঠ চুকেছে ১৯৪৭-এ। পাকিস্তান নামের সাম্প্রদায়িক দুঃশাসনকে আমরা পরাজিত করেছি মহান মুক্তিযুদ্ধে। সুদীর্ঘকালের অভাবের ছায়া, উত্তরাধিকার তখন পর্যন্ত বাংলাদেশকে ছেড়ে যায় নি। খুব বেশি দিনের কথা নয়, মাত্র ৩৫ বছর আগেও আমি এই বাংলাদেশে পদ্মার তীরের মানুষদের কষ্ট দেখেছি। ভরা বর্ষায় অনেকের হাড়িতে ভাত জুটতো না। আলু শাকের সঙ্গে একটু চিংড়ি মাছের মিশেলে দুবেলার আহার হতো। অনেকে কেবল লবন দিয়ে আটা সেদ্ধ খেয়ে দিন কাটিয়েছে তখন।


 দিন কত বদলেছে! আমরাই বদলে দিয়েছি সব। এখন, এই বাংলাদেশে কারো ঘরে ভাতের অভাব আছে এমন কথা শোনা যায় না। ধনি-দরিদ্রের ব্যবধানের রেখাটা হয়তো আরও মোটা হয়েছে, হয়তো ‘মধ্যবিত্ত’ নামের অসাধারণ অহমের ঐতিহ্য আমরা হারিয়েছি, তাই বলে এখন আর কেউ ভাতের অভাবে মরছে না। আজ থেকে ৫০ বছর আগের বাংলাদেশ, ৪০ বছর আগের বাংলাদেশ এবং এসময়ের বাংলাদেশ নিয়ে নিশ্চয়ই কেউ না কেউ লিখেছেন, লিখছেন। এসব সময়, এসব সংগ্রামের কথা নিশ্চয়ই বইয়ের পাতায় পাতায় লেখা থাকবে। আগামী দিনের কোনও এক পাঠক পুরো বইয়ের পাতায় খুঁজে পাবে তার বাংলাদেশকে। যেমন আমি খুঁজে পেলাম ১৫১ বছর আগের বাংলাদেশকে ‘ইছামতী’র পাতায় পাতায়। অর্ধশতাব্দীরও আগে প্রকাশিত বই। সাবধানে ধরতে হয়, নইলে খুলে যায় সেলাই, খসে পড়তে চায় কাগজ! আর সময় যে কীভাবে বইয়ের পাতায় চুপটি করে বসে থাকে তার একটু প্রমাণ দেয়া যাক ইছামতী থেকে।
‘ গ্রামের সকলেই নালু পালকে ভালোবাসে। সকলেই তাকে ভালো ভালো কথা বলে গেল। শম্ভু রায়(রাজারাম রায়ের দূর সম্পর্কের ভাইপো, সে কলকাতায় আমুটি কোম্পানীর হৌসে নকলবিশ) বললে, চলো নালু, আমাদের সঙ্গে সোমবারে কলকাতা, উৎসব হচ্চে সামনের হপ্তাতে খুব আনন্দ হবে, দেখে আসবা রেলগাড়ি খুলেচে হাওড়া থেকে পেঁড়ো বর্ধমান পজ্জন্ত, দেখে আসবা
  রেলগাড়ি জানি। আমার মাল সেদিন এসেচে রেলগাড়িতে ওদিকের কোন জায়গা থেকে। আমার মুহুরী বলছিল।
দেখেচ?


 কলকাতায় গেলাম কবে যে দেখবো?
 চলো এবার দেখে আসবা।
ভয় করে, শুনিচি নাকি বেজায় চোর জুয়োচোরদের দেশ।’
তারপর নালুপাল স্ত্রী তুলসীকে নিয়ে কলকাতা দেখতে গিয়ে ভীষণ এক অভিজ্ঞতা পেলো। গড়ের মাঠে গিয়ে দেখল সাহেবরা বেত হাতে করে সামনের লোকদের মারতে মারতে নিজেরা বীরদর্পে চলে যাচ্ছে। ভয়ে লোকজন পথ ছেড়ে দিচ্ছে। নালু পালের স্ত্রীর গায়ে এক ঘা বেত লেগেছিল। বিভূতি বর্ণনা করছেন, ‘পেছনে চেয়ে দেখে দুজন সাহেব আর একজন মেম, দুই সাহেব বেত হাতে নিয়ে শুধু ডাইনে বায়ে মারতে মারতে চলেচে।… নালু পাল কলকাতায় বাজার করতে গিয়ে দেখল দুধের সের এক আনা ছ’ পয়সা। তাও খাঁটি দুধ নয়, জল মেশানো’। সেময়ের কলকাতার নিষ্ঠুরতা আর বাজারের চড়া পণ্যমূল্য দেখে নালু পাল অবাক হয়েছিলো। আর বিভূতির লেখায় পাওয়া গেলো কলকাতার দুধে তখনিই পানি মেশানোর ঘটনা। আর কলকাতার ঘি যে খাঁটি ছিলো না তার কথা আছে বরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জবানীতে।


 ইছামতী না পড়লে জানাই হতো না দেড়শ’ বছর আগে ইছামতী নদীর দুপারের মানুষের সেই জীবন কথা। আর যদি বিভূতিভূষণ না লিখতেন এই উপন্যাস তাহলে প্রকৃতি ফুটে উঠতো না এমনি করে। উপন্যাস শুরুর আগে একটু ভূমিকা আছে। সেখানে বলা হয়েছে‘ ইছামতীর যে অংশ নদীয়া ও যশোর জেলার মধ্যে অবস্থিত, সে অংশটুকুর রূপ সত্যিই এত চমৎকার, যারা দেখবার সুয়োগ পেয়েচেন, তারা জানেন। কিন্তু তারাই সবচেয়ে ভালো করে উপলব্ধি করবেন, যারা অনেকদিন ধরে বাস করচেন এ অঞ্চলে।’


মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাছি, অদ্বৈত মল্ল বর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম বাদ দিলে নদী তীরবর্তী মানুষের জীবন, তাদের গল্প তেমন করে ধরা পড়েনি আর কোনও উপন্যাসে।
 বিভূতিভূষণ ইছামতীর দুই তীরের মানুষগুলোকে দেখেছেন আপন করে। তিনি তাদের ভাষা বুঝতেন। পিতা সম্পর্কে বিভূতিপুত্র তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেনÑ ‘আমার পিতৃদেব বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকৃতির একনিষ্ঠ উপাসক হিসেবে বাংলা তথা বিশ্বসাহিত্যে অনন্য আসনের অধিকারী। বর্ষণক্ষান্ত শ্রাবণসন্ধ্যায় গ্রাম্য নদী ইছামতীর তীরে সারিবদ্ধ সাঁইবাবলা গাছ, ঘেঁটুফুলের কটুতিক্ত ঘ্রাণে ভারাক্রান্ত বসন্ত অপরাহ্নের মন্থর বাতাস, উদাস দ্বিপ্রহরে নির্জন বাঁশবনে বউ-কথা-কও পাখির ডাক, ধুলোয় ভরা পথের বাঁকে ফুটে থাকা অনাদৃত বুনোফুল এসমস্ত বিভূতিভূষণের সাহিত্য নিজের অনাড়ম্বর সারল্যের প্রভাবে জনচিত্তে চিরস্থায়ী ছাপ ফেলেছে’। বিভূতিভূষণের ‘শ্রেষ্ঠ প্রেমের গল্প’-র( প্রথম প্রকাশ ১৯৮৭ সাল, পত্রপুট, ৩৭/৯ বেনিয়াটোলা লেন, কলকাতা) প্রারম্ভিকীতে আছে কথাগুলো।


 আর ইছামতীতে আছে অনেক মানুষের অনেক গাঁথা। উপন্যাসের এক সাহসী চরিত্রের নাম নিস্তারিণী। অনেক নিয়ম ভাঙা এই নারী তখনি স্বামীকে ঘরে রেখে অন্য পুরুষের প্রেমে পড়ে, তার সঙ্গে জঙ্গলে অভিসারে বেরোয়। একা একা পথে বেরোয়, নদীতে নামে, আর নদীতে ডুব দিয়ে পেয়ে যায় এক অবাক ঝিনুক যার ভেতরে ছিলো একশ টাকার মুক্তো। এখন যার মূল্য লাখ টাকা। এই নিস্তারিণীর কণ্ঠে ইছামতী তীরের বউ-ঝিরা শুনে ভীষণ এক প্রেমের গান।


‘ভালবাসা কি কথার কথা সই
 মন যার মনে গাঁথা
 শুকাইলে তরুবর বাঁচে কি জড়িত লতা
প্রাণ যার প্রাণে গাঁথা।’


আর বিভূতিভুষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ইছামতীর উপসংহারে লিখেন, ‘আজকার এই যে সঙ্গীত, জীবজগতের এইপবিত্র অনাহুত ধ্বনি আজ যেসব কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হচ্চে পাঁচশত কি হাজার বছর পরে সেসব কণ্ঠ কোথায় মিলিয়ে যাবে! ইছামতীর জলের স্রোতে নতুন ইতিহাস লেখা হবে কালের বুকে।’


কালের বুকে অনেক কিছুই লেখা হবে, অনেক কিছুই হয়তো হবে না। আজকের এই সময়ের অনেক কিছুই হয়তো আগামীর মানুষরা জানবে না, তবে কিছু কিছু তো জানবে। তাই কাউকে না কাউকে কালের কথা, কালের গাথা লিখতে হয়, যেমন লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র, জীবনানন্দ দাশ, কাজি নজরুল ইসলাম, সুকান্ত ভট্টাচার্য থেকে শুরু করে একালের হুমায়ুন আজাদ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর শামসুর রাহমান। আর পাঠকের হাতে হাতে সেই লেখা পৌঁছে যাচ্ছে কাল থেকে মহাকালে।


 রুদ্রাক্ষ রহমানঃ গল্পকার

Sunday, December 7, 2014

গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার :৯০তম জন্মদিনে প্রণতি

বাংলা গানের অবিস্মরণীয় জুটি গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার এবং শিল্পী মান্না দে

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রী পরিষদের শপথ অনুষ্ঠানে বাজানো হয় তার সেই বিখ্যাত গান ‘শোন একটি মজিবরের কণ্ঠ থেকে লক্ষ মজিবরের কণ্ঠে সুরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি, আকাশে বাতাসে ওঠে রণি; বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ...।’তার লেখা এ গান একাত্তরের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোতে লক্ষ প্রাণে শিহরণ বইয়ে দিত। অনুপ্রেরণা যোগাত মুক্তিযোদ্ধাসহ মুক্তিপাগল বাঙালির হৃদয়ে।
‘এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো তো’- উত্তম কুমার সুচিত্রা সেনের ঠোঁটে এই গান তখন দর্শকদের অন্য এক স্বপ্নের জগতে নিয়ে যেত। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা রোমান্টিক গান বাংলা চলচ্চিত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। ‘সবার উপরে’ চলচ্চিত্রে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ঠোঁট মেলানো  গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা ‘জানি না ফুরাবে কবে এই পথ চাওয়া, ছলো ছলো আঁখি মোর, জল ভরা মেঘে যেনো ছাওয়া’- গানটির যেন মৃত্যু নেই।  ‘দেওয়া-নেওয়া’ চলচ্চিত্রে শ্যামল মিত্রের কণ্ঠে তার লেখা ‘জীবন খাতার প্রতি পাতায়’ গানটির কথা। 
‘বধূয়া, এই মধুমাস বুঝিবা হলো বিফল’, ‘প্রেম একবার এসেছিল নীরবে, আমারই এ দুয়ার প্রান্তে’, ‘মেঘ কালো আঁধার কালো, আর কলঙ্ক যে কালো’ এমন শত শত গান লিখেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’- গানটি কালজয়ী হয়ে ওঠে সংগীতশিল্পী মান্না দের কণ্ঠে। গানটি লিখেছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত গীতিকার ও সংগীতশিল্পী গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। ৫ ডিসেম্বর বরেণ্য এই গীতিকারের ছিল ৯০তম জন্মদিন। প্রণতি রইল তার প্রতি। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ১৯২৫ সালে উল্লিখিত দিনটিতে পাবনার ফরিদপুর উপজেলার গোপালনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা গিরিজাপ্রসন্ন মজুমদার ছিলেন বিখ্যাত উদ্ভিদবিদ। শৈশবে কলকাতা চলে গিয়ে তিনি ফিরে এসেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। থিতু হয়েছিলেন পাবনা শহরের মজুমদার পাড়ায়। এ সময় সরকারি এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হয়ে পড়াশোনায় মনোযোগী হন। কিন্তু মনের গহীনে যিনি শিল্পীসত্তা বহন করে চলেছেন তিনি তো সুযোগ পেলে সেদিকেই মন দেবেন। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। তার সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠেছিল পাবনার আরেক কৃতিমান সাহিত্যিক, গীতিকবি ড. আবু হেনা মোস্তফা কামালের সঙ্গে। কিন্তু গানের ফুল ভালো করে ফোটার আগেই ১৯৫১ সালে তিনি পুনরায় কলকাতা চলে যান। ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখান থেকেই তিনি ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পাস করেন। পরে আবার বাংলা ভাষা ও সাহিত্যেও তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। 

গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার শুধু যে দ্রোহের গান লিখেছেন তা তো নয়। প্রেম, বিরহ, মানবতা, বিজয়ের গানও লিখেছেন  তিনি। তার বহু গান এখনও লোকের মুখে মুখে ফেরে। এখনও বেজে ওঠে খ্যাতিমান শিল্পীদের কণ্ঠে। এরমধ্যে শিল্পী মান্না দের কথা আলাদাভাবে বলতে হয়। তার লেখা গান কিংবদন্তিতুল্য এই শিল্পীর কণ্ঠে অমরত্ব পেয়েছে। ‘জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমি তো নই’, ‘এই কূলে আমি আর ওই কূলে তুমি’, ‘আমি নিরালায় বসে বেঁধেছি আমার স্মরণ বীণ, একি বেদনার মতো বেঁধেছি আবার হারানো দিন’- মান্না দের কণ্ঠে গৌরীবাবুর এই গানগুলো এখনও হৃদয়ে ঝড় তোলে অনেকের। এমন অসংখ্য হৃদয়গ্রাহী গানের বাণী তিনি লিখেছিলেন সে সময়। 
১৯৩৭ সাল। পাবনা শহরের গোপালপুর লাহিড়ী পাড়ার মৈত্রবাবুর নাতনি পদ্মার বিয়ে। বরযাত্রী কলকাতা থেকে এসেছে । বরযাত্রীর সঙ্গে ঢেঙ্গা-পটকা লিকলিকে একটি ছেলেকেও দেখা গেল। গায়ে তার অদ্ভুত জামা। জানা গেল জামাটির নাম ‘বড়ুয়া জামা’। তখনকার বিখ্যাত অভিনেতা প্রমথেশ বড়ুয়ার জামার আদলে বানানো। আরো জানা গেল ছেলেটি কলকাতার বালিগঞ্জ স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। এই ছেলেটিই  গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ওরফে বাচ্চু মজুমদার। ‘বাচ্চু’ ছিল তার ডাক নাম। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে পড়ার সময়ই তিনি গান লিখতে শুরু করেন। যদিও কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় তার লেখা গান প্রথম রেকর্ড হয়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে শোনা যায় প্রথম গান- ‘ আকাশ মাটি ঐ ঘুমালো, ঘুমায় মেঘ তারা…।’

১৯৭২। স্বাধীন দেশ। ডিসেম্বরে রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়ে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার  ঢাকায় এলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে পা রেখেই মনে পড়ল জন্মস্থানের কথা। ছুটে এলেন কৈশরের স্মৃতিবিজড়িত পাবনা দেখতে। শহীদ সাধন সংগীত মহাবিদ্যালয়ে দুই বাংলার প্রখ্যাত গীতিকবিকে দেওয়া হলো সংবর্ধনা। সেদিন মঞ্চে ছিলেন সহপাঠী ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল এবং অধ্যক্ষ কবি আবদুল গনি। শচীন দেব বর্মনের হাতেই বাচ্চু মজুমদার থেকে গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের জন্ম হয়। একে একে রচিত হতে থাকে কালজয়ী সব গান- ‘আঁখি দুটি ঝরে হায় একা জেগে থাকি, রুধিবে রাঙানো আমি তীর বেঁধা পাখি।’ 

ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যে এমএ পাস করা গৌরীপ্রসন্ন সিভিল সার্ভিসে যোগ দেননি। পিতার ইচ্ছাপূরণে বিলেত যাননি ব্যারিস্টারি পড়তে। তিনি সংগীতে মন সপেছিলেন। গান লিখি দিয়েই তিনি ক্ষান্ত হতেন না। গানে সুরারোপ, মহড়া, এমনকী রেকর্ডিং পর্যন্ত তার উপস্থিতি ছিল অনিবার্য। যদিও তার মধ্যে কখনও পেশাদারী মনোভাব লক্ষ্য করা যায়নি। তিনি নিজের সম্পর্কে একবার বলেছিলেন, ‘চল্লিশ বছর ধরে তো শুধু একই চিন্তা! কথা সাজানো আর মিল জোড়ানো। কোথায় আমার ঘর, আমার সংসার?’এ রকমই ছিল তখনকার সৃষ্টিশীল মানুষের মন ও মনন। ১৯৮৬ সালের ২০ আগস্ট মহান এই গীতিকার দূরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। চলে যেতে হবে আগেই বুঝতে পেরে লিখেছিলেন ‘যেতে দাও আমায় ডেকো না, কবে কি আমি বলেছি মনে রেখ না’। গানটি তার মৃত্যুর পর শিল্পী আশা ভোঁসলের কণ্ঠে রেকর্ড করা হয়। সেই রেকর্ড আজও বাজে বাংলার কোনো না কোনো ঘরে।
-

Saturday, December 6, 2014

মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বিজয় আজ কেন বিপন্ন-কামাল লোহানী


শনিবার  ২৫ আগস্ট, ২০১২আমরা একজন সাক্ষী সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের, দিন ক্ষণের। নিজেকে গর্বিত মনে হয় অমন দৃশ্যকে ভাষায় রূপান্তরিত করে বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে সারা বিশ্বের অগণিত শ্রোতার কাছে বাংলার কিংবদন্তি নেতার স্বদেশ ফেরার কাহিনী তুলে ধরতে পেরেছিলাম। আমরা ইতিহাসের অংশ হয়ে গিয়েছিলাম ওই ঐতিহাসিক মুহূর্তে।
আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, অর্থাৎ ১৯৭১ সালে আমরা প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের সর্বাত্মক সমর্থন পেয়েছিলাম। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের সর্বতভাবে সহযোগিতা করেছিল। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন সরকার আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। আমেরিকা তো সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে ধ্বংস করে দিতে ঔদ্ধত্য দেখিয়েছিল। কিন্তু সেদিন যদি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের দৃঢ় সংকল্প আর মুক্তিফৌজের অদম্য মনোবল মার্কিনী চক্রান্তকে সেদিন হতাশ করে দিয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন যদি জাতিসংঘে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ভেটো প্রয়োগ না করত তবে আমরা কি পারতাম মার্কিন চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে? তবু যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে নস্যাৎ করে নিজেদের প্রভূত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ছেড়ে না দিয়ে ইসরাইলের মতো যুদ্ধোন্মাদ দুষ্টক্ষতকে লেলিয়ে দিয়েছিল মুক্তিকামী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কৌশলে মার্কিনী চক্রের খবরদারির মধ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য। মুক্তিযুদ্ধরত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে আমরা যেন লক্ষ্যে পেঁৗছতে না পারি এবং ওরা যেন নিজেদের অর্থ ও ক্ষমতার দাপট দিয়ে নব্য রাষ্ট্রের ওপর খবরদারি করতে পারে তার জন্য কনফেডারেশন তত্ত্বক জাল বিছিয়েছিল '৭১-এ মুক্তিযুদ্ধকালীন। মুক্তিকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে মার্কিনী পুতুলের ভূমিকায় কাজ করে আসছিলেন যে খোন্দকার মুশতাক সেই আওয়ামী লীগ নেতা এবং প্রবাসী সরকারের একজন মন্ত্রী হিসেবেই স্থানীয়ভাবে 'এজেন্ট' এর কাজ করে যাচ্ছিল। মার্কিনীদের হুকুম তামিল করাই ছিল তার কাজ। যে আমেরিকান স্বার্থ সংরক্ষণের দায়িত্ব পালন করে চলেছিলেন, তিনিই একদিন সফল হলেন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করে। 
একটি লক্ষ্যণীয় বিষয় বাংলাদেশ আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এ পর্যায়ে অতীব উদ্দীপনামূলক ঘটনা ঘটে গেল। বঙ্গবন্ধু যখন মুক্ত স্বদেশে ফিরে এলেন পাকিস্তান জেল থেকে তখন তিনি সোজা লন্ডন হয়ে দিলি্লতে স্টপওভার করে চলে এলেন সদ্যমুক্ত বাংলাদেশের বিধ্বস্ত রাজধানী ঢাকায়। এই দিন ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিক্রমায় অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও আনন্দোল্লাসের দিন। এই দিনেই তেজগাঁও বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে বৃটিশ হাওয়াই জাহাজের সিঁড়িতে ফুলেল সংবর্ধনা জানালেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ এবং বঙ্গবন্ধুর বুকে পড়ে অঝোরে আনন্দাশ্রু ঝরাতে থাকলেন। কিন্তু রানওয়েতে হুইল চেয়ারে অপেক্ষমান ছিলেন শেখ মুজিবের গণিত পিতা শেখ লুৎফর রহমান। বঙ্গবন্ধু সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেন। পিতৃস্নেহে আপ্লুত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি অবর্ণনীয় আবেগে পিতাকে জড়িয়ে ধরলেন। এবারে ঝর ঝর করে ঝরতে থাকল বঙ্গবন্ধুর চোখের জল।
আমরা চারজন_ বাংলাদেশ বেতারের আমি এবং আমার যুদ্ধের সাথী ও স্বাধীন বাংলা বেতারের সংগঠক আশফাকুর রহমান খান ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে দিলি্ল থেকে এসেছিলেন আকাশবাণীর প্রধান সংবাদপাঠক ও ধারাভাষ্যকার সুরজিত সেন, হিন্দি সার্ভিসের সংবাদ পাঠক ও ক্রীড়া ধারাভাষ্যকার যশদেব সিং এবং কলকাতা আকাশবাণীর জনপ্রিয় সংবাদপাঠক ও আবৃত্তিকার দেব দুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। তেজগাঁও বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবনের দোতলার পশ্চিম কোণার ছাদে দাঁড়িয়ে সরাসরি সম্প্রচারে অংশগ্রহণ করছিলাম। ১৭ পৃষ্ঠার পর
গোটা বিমানবন্দরটাই আমাদের চোখের সামনে ভাসছিল। দেখতে পাচ্ছিলাম সবই। তাই সেদিনের স্মৃতিবিজড়িত অপরূপ দৃশ্যাবলী আজও চোখে ভেসে ওঠে স্বপ্নের মতো। 
আমরা একজন সাক্ষী সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের, দিন ক্ষণের। নিজেকে গর্বিত মনে হয় অমন দৃশ্যকে ভাষায় রূপান্তরিত করে বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে সারা বিশ্বের অগণিত শ্রোতার কাছে বাংলার কিংবদন্তি নেতার স্বদেশ ফেরার কাহিনী তুলে ধরতে পেরেছিলাম। আমরা ইতিহাসের অংশ হয়ে গিয়েছিলাম ওই ঐতিহাসিক মুহূর্তে।
সেদিন ঢাকা শহরের যে দৃশ্য দেখেছিলাম তা আগেও দেখেছিলাম বহুবার কিন্তু ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ একটি অনির্বচনীয় আনন্দাশ্রু চোখে উজ্জ্বল যে মুখচ্ছবি দেখতে পেয়েছিলাম সব মানুষের মনে তার বর্ণনা দেয়া আমার পক্ষে খুবই কঠিন। কিন্তু হৃদয়ের ক্যানভাসে ছবিটি অাঁকা হয়ে গেছে, তা মুছে ফেলার নয়। চির জাগরুক থাকবে। রাজনৈতিক অঙ্গনে মানসিকভাবে ভিন্নমত পোষণ করেছি জীবনভর কিন্তু যে কোনো গণতান্ত্রিক সংগ্রামে আমরা একত্রিত হয়েছিলাম পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শক্তির অসম উত্থানের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। যখন মুক্তিযুদ্ধ নামের সংগ্রামের নতুন পর্যায় শুরু হয়েছিল তখনো রাজনৈতিক সংকীর্ণ মানসিকতা লক্ষ্য করেছিলাম আওয়ামী ঘরানার মধ্যে। বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমানের মতো এক অকল্পনীয় জনপ্রিয় এবং অবিসংবাদিত যখন নেতৃত্ব। মনে করি সেই ১৯৪৯ সালের কথা। যখন জুন মাসে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তৎকালীন পাকিস্তানে পশ্চিমা জমিদার-জোতদারদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী সাম্প্রদায়িক দল ছেড়ে শাসকশ্রেণী-মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে প্রথম বিরোধী রাজনীতির পত্তন করেছিলেন। সৃষ্টি করলেন পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের। তাই পূর্ববঙ্গে বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠাতা হয়ে আছেন মওলানা ভাসানী। মনে হয় সেদিনের পূর্ববঙ্গে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ছিল খুবই কঠিন। কারণ তাদের ভিত্তি ছিল ধর্মান্ধতা আর পাকিস্তানের পক্ষে গণভোটে পূর্ববঙ্গের মুসলিম ভোট সবচেয়ে বেশি পড়েছিল। সে কারণে ধর্মভিত্তিতে দেশকে বিভক্ত করার বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত সফল হলেও যাদের হাতে ক্ষমতা গেল সেই মুসলিম লীগ ও তার নেতাদের বৈমাত্রেয় আচরণে দেশভাগের ক'দিনের মধ্যেই ওদের কপট চরিত্র প্রকাশ পেল। নতুন রাষ্ট্রের বিধি-বিধানে পূর্ববঙ্গকে উপেক্ষা-অবহেলার কুৎসিত এবং উদ্ভট চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে শুরু হলো। প্রথমেই আঘাত নেমে এলো আমাদের মাতৃভাষা বাংলার ওপর, আমরা প্রতিরোধ করলাম জীবন বিসর্জন দিয়ে। সেই যে শুরু তার কিছুদিন পরেই মার্কিন আগ্রাসন যেন ক্রমেই বিষাক্ত দংশনে পরিণত হতে থাকল। পঞ্চাশের দশকেই ওরা পিস কোর নামধারণ করে ঢুকেছিল শিক্ষা ক্ষেত্রে, ইংরেজি শেখানোর শিক্ষক হিসেবে। শহরে-মফস্বলে, গ্রামেগঞ্জে ওরা ঢুকে যেতে লাগল, মানুষকে নানা কৌশলে প্রলুব্ধ করে। যেহেতু ইংরেজি শিক্ষাটা উপলক্ষ ছিল, তাই কেউ এর ভেতরে কোনো অসৎ মওকার সুযোগ আছে বলে ভাবত না। কিন্তু ওরা ঘুণ পোকার মতো কাটতে শুরু করে ক্ষতটাকে দগদগে করে ফেলল। এভাবেই ভিড়িয়ে ফেলেছিল পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি করে কেন্দ্রের পাকিস্তান সরকারকে পুরোপুরি ঘায়েল করে ফেলেছিল। সেই সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল সিয়াটা এবং সেন্টো চুক্তি। আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে ধরার সব ফন্দি এঁটে ফেলেছিল।
এখানে একটি বিষয় মনে করিয়ে দিতে চাই, ঢাকা শহরের আওয়ামী মুসলিম লীগের যে খুঁটি ছিল, তিনি হলেন ইয়ার মোহাম্মদ খান। সংগঠনের প্রবল শক্তি তারই দক্ষতায় সৃষ্টি হয়েছিল। সেই ইয়ার মোহাম্মদ খান মওলানা ভাসানীর ন্যাপের চলে যাওয়ায় আওয়ামীরা ঢাকার কুখ্যাত ধনাঢ্য গু-া বাদশাকে ক্ষেপিয়ে জনসভা ভাঙার জন্য লোক লাগিয়েছিল। প্রথমে ভেঙে গিয়েছিল কিন্তু মওলানা ভাসানীর অগি্নবর্ষী বক্তৃতা সেদিন গুন্ডামিকে পরাভূত করে জনসভাকে সফল করতে সক্ষম হয়েছিল।

আওয়ামী মুসলিম লীগ কিন্তু 'মুসলিম' শব্দটি পরিহার করেছিল। কিন্তু মার্কিন প্রভূত্ব এবং সামরিক চুক্তিকে অস্বীকার বা প্রত্যাখ্যান করতে সাহস পায়নি। কারণ মার্কিনীদের নাখোশ করার সাধ্যি ছিল না, তার কারণ শহীদ সোহরাওয়ার্দী তখনো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। এমনিভাবে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক এবং জাতীয়তাবাদী শক্তির উত্থান ঘটল। 

বিজয়ী আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুর জাতীয় নেতৃত্বকে অস্বীকার করে পূর্ববাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের রায়কে অগ্রাহ্য করে সামরিক শাসনকর্তা জেনারেল ইয়াহিয়া খান নির্বাচনে জাতীয় পর্যায়েও পরাজিত পশ্চিমা রাজনীতির ক্ষমতা দখলের প্রতিভূ জুলফিকার আলী ভুট্টোর খপ্পরে পড়ে ঢাকায় ডাকা জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন অকস্মাৎ বাতিল করে দেয়ায় বিক্ষুব্ধ পূর্ববাংলার বিস্তৃত জনপদ আর সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ অগি্নগর্ভ হয়ে উঠেছিল। এমনি পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ এবং তখন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া তো দিয়েছিলেনই বরং তখন জনগণের প্রত্যাশা ছিল মুক্তির। লড়াই করেই জিততে হবে, এমনই ছিল মনোবাসনা। মনোবলে সুদৃঢ় পাহাড়ের মতন তখন জনগণের ঐক্য। কেউ তাকে পারবে না অবণত করতে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং এ দেশে যে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তার প্রত্যেকটি সংগ্রামের পেছনে কমিউনিস্ট পার্টি যে প্রকাশ্যে বা গোপনে থেকে সংগঠন গড়ে তোলা, মানুষকে সংগঠিত করা এবং বিশ্বের নানা দেশের মুক্তি সংগ্রাম থেকে পাঠ-অভিজ্ঞতা এবং আদর্শ চিন্তা করে নিজেদের বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করছিল, সেই গণ-মানসিকতা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে নির্দ্বিধায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল প্রাণপণ যুদ্ধে। কিন্তু অবমূল্যায়িত হয়েছে ওই প্রবলশক্তির ও বলিষ্ঠ মানসিকতার মানুষ। পরে দেশমুক্তির পর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের এমনকি তাজউদ্দিন আহমদের সুষ্ঠু ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে গঠিত সরকারের ন'মাসের মুক্তিযুদ্ধেকেও সঠিকভাবে বিশ্লেষণ এবং মূল্যায়ন করা হয়নি। সত্তরের পাকিস্তানি নির্বাচনের ফল দিয়েই পরবর্তী সরকার গঠিত হয়েছিল। চরম দুঃখজনক ঘটনা, যে তাজউদ্দিন আহমদ দিনরাত্রি পরিশ্রম নয় কেবল, মেধা ও অধ্যবসায় দিয়ে ন'মাসের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছেন মার্কিনী হুমকি ও ইসরাইলী প্রলোভনকে উপেক্ষা করে সেই মহতী অধিনায়ককে প্রধানমন্ত্রীত্ব থেকে প্রথম পরে অর্থমন্ত্রীত্ব থেকেও অপসারণ করা হয়েছিল, তিনি জেলে হত্যা হলেন তার মুক্তিযুদ্ধের সাথী মন্ত্রিসভার সহযোগী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানের প্রাণ দিয়ে যে তিনি সঠিক পথেই চলেছিলেন। পরম পরিতাপের বিষয়, যে খোন্দকার মুশতাক আহমদ কলকাতার বাংলাদেশ মিশনে বসে চক্রান্ত করে যাচ্ছিলেন, বঙ্গবন্ধু সেই মুশতাককেই মন্ত্রিসভায় রেখেছিলেন। 
ধর্মনিরপেক্ষতার স্নোগান দিয়ে সমাজতন্ত্র কায়েম করার জন্য লাখো শহীদের প্রাণের বিনিময়ে যে বাংলাদেশ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর হাত থেকে পুনরুদ্ধার করেছিলাম ১৯৭১-এ বিপুল রক্তখরচে সেই বাংলাদেশ আজ মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি জঙ্গি কার্যকলাপের লক্ষ্যস্থলে পরিণত হয়েছে। এদের মদদদাতা ও সংগঠিত শক্তি হলো জামায়াত-শিবির। যারা আলবদর, আল শামস গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষকে খুন করেছে এবং খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, লুণ্ঠন, অগি্নসংযোগ, ব্যাপকভাবে ক্ষতিসাধন করেছে। এ অপশক্তি যাদের যুদ্ধাপরাধী বলে জানি, বর্তমানে যাদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যাদের বিচার অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল। এ মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের প্রশ্রয় ও আশ্রয় দিয়েছিলেন জেনারেল জিয়া এবং মাদাম জিয়া তাদের পুনর্বাসন এবং রাজনীতি করার সুযোগ দিয়েছেন, তাই নয়, তিনি তাদের কাছে চেপে নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে মন্ত্রীত্ব দিয়ে সুযোগ-সুবিধা দেয়ার মাধ্যমে ভজিয়ে রাখেন ক্ষমতায় যাওয়ার এবং থাকার উদ্দেশে।

মুক্তিযুদ্ধোত্তর ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হলে, নতুন আরেক চক্রান্ত অাঁটে মার্কিনীরা। তাতে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিয়ে ফেলে। লাহোরে অনুষ্ঠিত 'ইসলামী দেশগুলোর সম্মেলন'-এ বঙ্গবন্ধু নিজে উপস্থিত হন অনেকের বারণ সত্ত্বেও। ১৯৭৩ সালে যে দালাল আইন প্রণয়ন করে হাজার হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়, পরে তা সংশোধন করে অনেককে ছেড়ে দেয়ায় হত্যাকারীরা প্রশ্রয় পেয়ে যায়। আর এরই সুযোগ করে জেনারেল জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন বাতিল করে দেন। এবং নিজের ক্ষমতালিপ্সা পূরণ করার পথটাকে সুগম করে নিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অবজ্ঞা অবহেলা করে শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন।
জিয়া যেখানে পাকিস্তানি সৈন্যদের সাহায্যে পাঠান সেনা ও অস্ত্র খালাস করতে গিয়েছিলেন তার কাছ থেকে এর চেয়ে বেশিকিছু কি আশা করা যায়? কিন্তু তার লিজনম্র গৃহবধূ খালেদা যিনি মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানিদের সাথেই বাস করেছিলেন, তিনি যখন ঘোমটা খুলে বিচারপতি সাত্তারকে দলীয় প্রধান পদ থেকে সরিয়ে নিজেই প্রধান হলেন তখন তিনি সংহার মূর্তি ধারণ করলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে সারা দেশের সাধারণ মানুষ যখন, তখন তিনি ক্ষমতার দাপটে শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু আন্দোলন স্তব্ধ হয়নি।

২০০৮ সালের নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে এ দেশের মানুষ গণরায় দিলো মহাজোটের পক্ষে। বর্তমান সরকারের পবিত্র দায়িত্ব আর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পালনের তাগিদে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছেন। ক্ষমতায় না থাকলে কী হবে, খালেদা জিয়া যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করছেন এমনকি সংসদে না গিয়ে রাজপথকে উত্তপ্ত করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য বিক্ষোভ, মানববন্ধন, রোডমার্চ, সমাবেশ, মহাসমাবেশ, হরতাল কত কী করছেন। এ ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারকে বিচারের উদ্যোগ নেয়ায় ধন্যবাদ জানাই।

শুধু বিচার করলেই তো হবে না ওদের শাস্তি কার্যকর করতে তো হবে। এত বছর বসে থেকে এখন যখন এই বিচার করছেন, তখন ভাবছি, আদৌ শেষ করার সুযোগ পাবেন কি?
details&feature=yes&type=single&pub_no=220&cat_id=1&menu_id=78&news_type_id=1&index=2&archiev=yes&arch_date=25-08-2012

Thursday, December 4, 2014

ভিঞ্চির পৃথিবী বিখ্যাত চিত্র মোনালিসা ভিঞ্চির মা চিনা ক্রীতদাসী?

লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির পৃথিবী বিখ্যাত চিত্র মোনালিসা আসলে কে? মুখে মৃদু হাসির এই নারী কে ছিলেন? যুগযুগ ধরে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন শিল্প প্রেমীরা। কে ছিলেন মোনালিসা? ইতালিয়ান এক গবেষকের দাবী রহস্যময়ী  আদতে  এক চিনা ক্রীতদাসী ! এখানেই শেষ নয় অ্যাঞ্জেলো পারাতিকো নামে ওই গবেষকের দাবি  ছবির হাস্যময়ী শিল্পী লিয়োনার্দো দ্য ভিঞ্চির মা!
কারো মতে মোনালিসা লিওনার্দোর গুপ্ত প্রেমিকা। কেউবা বলেন তিনি নাকি এই জমিদার গৃহিণী। কারোর কারো মতে এ নাকি শিল্পীর নিজেরই পোট্রেট।এবার  নয়া এক তথ্য হাজির করেছেন ইতালির  এ গবেষক। নিজের সপক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে অ্যাঞ্জেলো পারাতিকো দাবি করেছেন ছবিতে মোনালিসার পিছনে ছবিটি একটি চাইনিজ ল্যান্ড স্কেপ, মোনালিসার মুখেও তিনি খুঁজে পেয়েছে চৈনিক আদল! আর শিল্পীর মাও ছিলেন প্রাচ্যের নারী। সে সেক্ষেত্রে তিনিই মোনালিসা হতে পারেন।

ধর্ষণে অভিযুক্ত বাঁকুড়ার হাউসস্টাফ গ্রেফতার:সংশয়-বিতর্ক-প্রশ্ন

অভিযুক্ত হাউসস্টাফ। ছবি: শুভ্র মিত্র


বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মূক-বধির তরুণীকে ধর্ষণে অভিযুক্ত হাউসস্টাফকে বরখাস্ত করল রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বৃহস্পতিবার এই খবর জানিয়েছেন। অভিযুক্তকে গ্রেফতারও করেছে পুলিশ। বুধবার রাত তিনটে নাগাদ বাঁকুড়া শহরের গোবিন্দনগরের এক লজে রামকৃষ্ণ সরকার নামে অভিযুক্ত হাউসস্টাফকে ধরা হয়। বৃহস্পতিবার বাঁকুড়ার সিজেএম চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য ধৃতকে ১৪ দিন জেল-হাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
এ দিকে এ দিনই কাঁথির মূক ও বধির স্কুলের এক শিক্ষকের সাহায্যে বাঁকুড়া জেলা আদালতের অতিরিক্ত দায়রা বিচারক (৫) সংযুক্তা সেনগুপ্তের কাছে ওই তরুণী গোপন জবানবন্দি দেন। পাশাপাশি এ দিন সন্ধ্যায় রামকৃষ্ণকে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য বিষ্ণুপুর মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যায় পুলিশ। পরীক্ষার জন্য হাসপাতালের সুপার রবীন্দ্রনাথ প্রধান, স্ত্রীরোগ-বিশেষজ্ঞ প্রদ্যুৎ পান ও প্যাথলজিস্ট তড়িৎকান্তি পালকে নিয়ে তিন সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড গড়া হয়েছে। পুলিশ-সূত্রের খবর, ‘নিরপেক্ষ’ জায়গায় পরীক্ষা করাতেই ধৃতকে বিষ্ণুপুরে নিয়ে যাওয়া হল। প্রসঙ্গত, বুধবার তরুণীটিরও ডাক্তারি পরীক্ষা হয় এসএসকেএমে।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, অভিযুক্তকে গ্রেফতারে এত দেরি হল কেন? অভিযোগ জমা পড়ার পরে কেন গড়িয়ে গেল ছত্রিশ ঘণ্টা?
ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞেরাও জানিয়েছেন, এত দেরিতে অভিযুক্তের মেডিক্যাল পরীক্ষা হলে প্রকৃত সত্য সামনে আসার সম্ভাবনা যথেষ্ট কমে যায়। বাঁকুড়া মেডিক্যালের সুপারের কাছে ধর্ষণ সংক্রান্ত অভিযোগপত্রটি মঙ্গলবার সকালে জমা পড়লেও বিকেল পর্যন্ত তিনি তা পুলিশকে দেননি। মেয়েটির বাবা সে দিন সন্ধ্যায় বাঁকুড়া থানায় গিয়ে লিখিত অভিযোগ দাখিল করার পরে পুলিশ কিছুটা নড়েচড়ে বসলেও অভিযুক্তকে গ্রেফতার ও শনাক্তকরণে ঢিলেমি চলছিল বলে অভিযোগ। বিভিন্ন মহলের অভিমত, সংবাদমাধ্যমের লাগাতার চাপের মুখেই রামকৃষ্ণকে গ্রেফতার করা হয়েছে।



বস্তুত বাঁকুড়া মেডিক্যালের ঘটনাটিকে ঘিরে গোড়া থেকেই নানা সংশয়-বিতর্ক-প্রশ্ন দানা বেঁধেছে। কী রকম?
প্রথমত, সুপ্রিম কোর্ট ডাক্তারি পরীক্ষায় ধর্ষণের চিহ্ন পাওয়ায় ততটা জোর না-দিলেও পুলিশ-প্রশাসনের একাংশ এখনও তদন্ত শুরুর ক্ষেত্রে প্রাথমিক মেডিক্যাল রিপোর্টকেই গুরুত্ব দিয়ে চলেছে। এমনকী, ধর্ষণ হয়েছে না হয়নি, সে সম্পর্কে মেডিক্যাল রিপোর্টের ভিত্তিতেই মতামত জানিয়ে দিচ্ছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! অথচ সেই পরীক্ষা দ্রুত ও যথাযথ ভাবে সম্পন্ন করায় পুলিশ-প্রশাসন কতটা তৎপর, তা নিয়েও সংশয় থেকে যাচ্ছে।
যেমন থেকে গিয়েছে এসএসকেএমে মূক-বধির তরুণীটিকে পরীক্ষার সময়ে। সেখানে ফরেন্সিক, স্ত্রী-রোগ ও মনোরোগ বিভাগের ডাক্তারেরা হাজির ছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, মূক ও বধির তরুণীর বক্তব্য তাঁরা বুঝবেন কী করে? মেয়েটিই বা কী ভাবে ওঁদের জানাবেন তাঁর উপরে হওয়া শারীরিক নির্যাতনের কথা? ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ অজয় গুপ্তের মতে, “শুধু বিচারপতিকে জবানবন্দি দেওয়ার সময়ে থাকলেই হবে না। এ রকম ক্ষেত্রে ইশারায় মনোভাব বুঝতে পারেন, এমন বিশেষজ্ঞেরও মেডিক্যাল পরীক্ষার সময়ে হাজির থাকা জরুরি। না-হলে পরীক্ষা কার্যত অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।” সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের পাশাপাশি তদন্তকারী অফিসারেরও এ বিষয়ে উদ্যোগী হওয়া দরকার ছিল বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
প্রশ্ন উঠেছে অভিযুক্ত পুরুষের ডাক্তারি পরীক্ষায় বিলম্ব নিয়েও। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দাবি: পরিবারের তরফে অভিযোগ পাওয়ার পরে মঙ্গলবার সকালেই সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে চিহ্নিত করতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে আরও উদ্যোগী হতে হতো। অজয়বাবুও জানাচ্ছেন, “মহিলার মতো পুরুষের ক্ষেত্রেও যত দ্রুত সম্ভব পরীক্ষা করালে প্রমাণ মেলার সম্ভাবনা বেশি থাকে। যত ঘণ্টা পেরোবে, সম্ভাবনা তত ফিকে হয়ে আসবে। আর তারই ফাঁক গলে রেহাই পেয়ে যাবে আসল অপরাধী।” সাহিত্যিক সুচিত্রা ভট্টাচার্য বলেন, “মূক-বধির মেয়েটির বক্তব্য জানতে বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়া হল না কেন? মেয়েটির বক্তব্য ঠিকমতো বোঝাটা তো তদন্তেরই অঙ্গ! অভিযুক্ত চিকিৎসকের মেডিক্যাল পরীক্ষাতেই বা এত দেরি কেন?”
এই ‘দেরি’র প্রসঙ্গেই ‘সদিচ্ছা’র প্রশ্ন তুলে ধরেছেন নারী আন্দোলনের কর্মী শাশ্বতী ঘোষ। যাঁর বক্তব্য, “সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকা অনুযায়ী, কোনও মহিলা এই জাতীয় অভিযোগ জানানোমাত্র পুলিশ তাঁর জন্য আইনি সাহায্যের ব্যবস্থা করবে। কোন আইনজীবীরা এই ধরনের কাজে ইচ্ছুক, তাঁদের তালিকাও থানায় থাকার কথা। এ সব মানা হয় না বলেই মেডিক্যাল পরীক্ষাটুকু হতেও এত দেরি হয়ে যায়।” শাশ্বতীদেবীর অভিযোগ, ধর্ষণের ঘটনায় ডাক্তারি পরীক্ষার ব্যবস্থা গ্রামীণ হাসপাতাল স্তরে না-থাকায় মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে। “মেডিক্যাল পরীক্ষার জন্য সব সময়ে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ লাগে না। স্ট্যান্ডার্ড মেডিক্যাল প্র্যাক্টিস চালু থাকা উচিত। মহিলা থানা তৈরির বদলে প্রতি থানায় আলাদা ভাবে এক মহিলা অফিসারকে দায়িত্ব দিলেও মেয়েদের অস্বস্তি কমতে পারত।” বলছেন তিনি।
একই সঙ্গে শাশ্বতীদেবী-সুচিত্রাদেবীরা মনে করছেন, অভিযোগের ছত্রিশ ঘণ্টা পরে অভিযুক্তকে যে গ্রেফতার করা হল, সেটাও অনেকটা সংবাদমাধ্যমের চাপে পড়ে। বাঁকুড়া জেলা সারদামণি মহিলা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ সিদ্ধার্থ গুপ্তের কথায়, “ইদানীং এমন অপরাধ মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছে। সংবাদমাধ্যম তা টানা প্রচার করছে, এটা খুবই ইতিবাচক দিক।”উপরন্তু সুপ্রিম কোর্ট যখন বারবার ধর্ষিত মহিলার মানসিক চাপ (ট্রমা) কমাতে উদ্যোগী হতে বলছে, তখন নানা অজুহাতে তাঁর অভিযোগকে সন্দেহ করার প্রবণতা আদতে তাঁর উপরে চাপই আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে না কি?
সুচিত্রাদেবীর কথায় এ দিন সেই সংশয়েরই সুর। তাঁর আক্ষেপ, “বহু ক্ষেত্রে অপরাধীকে ধরার চেষ্টার বদলে কার্যত অভিযোগকারিণীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর চেষ্টা চলছে। খুবই অমানবিক। পুলিশ ও প্রশাসনকে জোড়হাতে অনুরোধ করছি, প্রথমেই সাজানো ঘটনা বলে দাগ না-মেরে তদন্তের কাজটা ঠিকঠাক করুন।”