Wednesday, October 15, 2014

স্মৃতির মিনার রক্ষায় ১৪ কোটি পরিবার খাড়া রয়েছি তো ! -সুমি খান

 কবি আলাউদ্দিন আল আজাদের ভাষায় বলি, স্মৃতির মিনার ভেঙ্গেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু ? খাড়া রয়েছি তো আট কোটি পরিবার! বায়ান্ন একাত্তরের কুলাঙ্গারদের ঠেকাতে সেই আটকোটি পরিবার এখন ১৪ কোটি পরিবার। একাত্তরের শকুনদের নিয়ত ব্যবচ্ছেদের পর ও বাংলা মায়ের সন্তান এই ১৪ কোটি পরিবার জেগে আছে ! কুলাঙ্গার জারজদের প্রতিরোধ করবে তারা প্রাণ দিয়ে। আর তাই শহীদ মিনারের পবিত্রতা রক্ষায় চেতনার অগ্নিমশাল জ্বেলে জেগে আছে যারা তাদের অভিবাদন।
শুভবুদ্ধির উদয় যে মাঝে মাঝে হয়, এটা তারই প্রমাণ । পিয়াস করিমের লাশ আর শহীদমিনারে নিলো না তার পরিবার। তবে বনানীতে শেষ স্থান হলো এই রাজাকারপুত্র এবং রাজাকার ত্রাতার! কী দুর্ভাগ্য আমাদের!  এই লেখাটি ১৫ সেপ্টেম্বর রাতে লিখেছি। মনের ভার হাল্কা করা আর চেতনা শানিত করার ধারাবাহিকতায়।
 এক বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পিয়াস করিম যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার পর জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রশিবির এ রাষ্ট্রকাঠামোর বিরুদ্ধে যে আধাঘোষিত যুদ্ধ শুরু করেছে, সেটাকে তার প্রতিটি শব্দ এবং বাক্যে সমর্থন জানিয়েছেন। তারা যখন এমনকি শহীদ মিনারও পুড়িয়ে দিয়েছে সেটাকেও সমর্থন করে গেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক  উপাচার্য (ভিসি) ড. এমাজউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, শহীদ মিনার প্রতিবাদের প্রতীক। পিয়াস করিমের মতো ব্যক্তির লাশ যদি শহীদ মিনারে রাখতে না দেওয়া হয় তবে শহীদ মিনারের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে যাবে।  হাস্যকর বটে! শহীদ মিনারের ইতিহাস যারা জানে, যারা শ্রদ্ধা করে , তাদের আগ্রহ চিরঞ্জীব । যাদের শুধু রাজনীতি করার জন্যে শহীদ মিনারকে দরকার, তাদের আগ্রহ কমাই মঙ্গল!

 বাংলানিউজে চ্যানেল আইয়ের বার্তাসম্পাদক জাহিদ নেওয়াজ জুয়েল লিখেছেন, একাত্তরে কামানের গোলা দিয়ে শহীদ মিনার গুঁড়িয়ে দেয়া, হত্যা-গণহত্যা-ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ আর ওই অপরাধের বিচার শুরু হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে রাস্তায় নাশকতা এবং টেলিভিশনের পর্দায় বক্তৃতা একই চেতনা থেকে উৎসারিত।এখন সেই অপচেতনার মানুষকে কেনো শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে হবে?পিয়াস করিমকে শহীদ মিনারে নেওয়া হবে.তখনি প্রতিবাদ শুরু হলো।ঘোষণার উদ্দেশ্যই ছিলো গোলমাল পাকানো। এবং সেই উত্তেজনাটা তারা এরইমধ্যে সৃষ্টি করতে পেরেছেন। এর মধ্যে সরকার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে জড়ানোর একটা চেষ্টাও হচ্ছে। সরকারকে জড়ানোর চেষ্টার কারণ, সরকারের জন্য বিব্রতকর এবং বিরক্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করা। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এর মধ্যে টেনে আনার কারণ যে, এ বিশ্ববিদ্যালয় সেই চেতনার উত্তরাধিকার যে চেতনার পথ ধরে শহীদ মিনার আর যে চেতনার বিরোধী পিয়াস করিম।
  জুয়েল ভাইয়ের সাথে আমি শতভাগ একমত। আমারো প্রশ্ন , কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক কিংবা সৃজনশীল  কিছু কি তার ছিল? শুধুই টক-শো করে আলোচিত পিয়াস করিমকে টক-শো করা অন্যদের কেউ কেউ এখন এমন পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন যে, যেনো তার নাম বলতে হবে পিয়াসটটল কিংবা পিয়াসটিস-চমৎকার লিখেছেন জাহিদ নেওয়াজ জুয়েল। জামাতপন্থীরা  নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থেই বিষয়টাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছেন। সবকিছুর মূলে কিন্তু গর্ত থেকে জামায়াতকে বের করে আনার ফন্দিফিকির,যেটা জীবনের শেষ পাঁচ বছর ভালোভাবেই করে গেছেন পিয়াস করিম।
এ দেশের সাধারণ মানুষের একজন আমি সুমি খান  খুনপিয়াসী জামাতের মুখপাত্র পিয়াস করিমদের মিথ্যাচারের স্বাধীনতা ঠেকাতেই লড়াই করি উত্তরাধিকার সূত্রে। কারণ আমার ধমণীতে শহীদের রক্ত। এ রক্ত কোনদিনো পরাভব মানে নি, কখনো মানবে ও না।একই সাথে জামাতের নব্য দোসর বামদলের একাংশের ভূমিকা নিয়ে জনগণের অবস্থান তুলে ধরতেই আমার এ লেখার অবতারণা।
এদেশে বামদল শতধা বিভক্ত। তবে একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের লাশ নিয়ে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বাস্তবতায় আবারো প্রমাণ হলো মুক্তিযুদ্ধের বেসাতিতে জামায়াত বিএনপির সাথে বামদল গুলোর একটি অংশ চেতনাগতভাবে সম্পৃক্ত। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে রাষ্ট্রক্ষমতায় যে সরকার তাদের জবাবদিহিতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আমারো। কিন্তু তাই বলে সরকার বিরোধিতার নামে যুদ্ধাপরাধী শক্তির সাথে  একাত্মতা ?? এই চিত্র সুস্পষ্ট ভাবে প্রমাণ করে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত অন্ধকারের শক্তির কালোটাকার স্রোতে ভেসে যাওয়ায় তারা নির্লজ্জ।
ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম জেলার সাবেক নেতা তৌহিদ টিপু লিখেছেন. পিয়াস করিমের লেখা ও বক্তব্যের সাথে আমি চূড়ান্তভাবে ভিন্নমত পোষণ করি। কিন্তু আমি তাঁর লাশটিকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য শহীদ মিনারে জায়গা দিতে চাই। সসম্মানে। যদি তাঁর সেটিই ইচ্ছা হয়ে থাকে। কারণ আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই আমি পিয়াস করিমদেরও বলার স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছি। আমার শত্রুকে দেখার দৃষ্টি জামায়াত কিংবা হেফাজত কিংবা আওয়ামীলীগ কিংবা বিএনপির মতো না। আমার শিক্ষায় এটাই কমিউনিজম।  কমিউনিজমের কী হাস্যকর আর বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা!!এরা কোন রাজনীতির ধারক? যারা নিজেদের আত্মপরিচয় রক্ষা করতেই চরম ভাবে ব্যর্থ!
 
এ প্রসঙ্গে অতিবামদের গুরু ফরহাদ মজহারের একটি উক্তি উল্লেখ করতে হয়।ফরহাদ মজহার তার মোকাবেলা বইয়ে লিখেছেন, বাংলাদেশে  কমিউনিজমের ব্যর্থতার কারণ তথাকথিত বামপন্থীরা, যারা এখনো বুঝেন না মার্কসবাদের অ, আ, ক, খ.... যারা মার্কসবাদ ও কমিউনিজমের মুখোশ পড়ে পুঁজির পাহাড় গড়ে তুলছেন সাধারণ মানুষের চোখে ধুলা দিয়ে...!! মেহনতী মানুষের ঘাম আর শ্রমের সাথে একাত্ম হয়ে কার্ল মার্কস, ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস এবং মহামতি লেনিন যে মহান মতাদর্শের প্রবর্তন করেছিলেন। লেনিন তাঁর জীবদ্দশাতেই  কমিউনিষ্টদের হঠকারী এবং স্ববিরোধী ভূমিকার কড়া সমালোচনা করে গেছেন। সেসব পরবর্তীতে লিখবার ইচ্ছে রইলো। তবে বলতে বাধ্য হচ্ছি, বাংলাদেশে তার ঝান্ডাবাহীরা হঠকারী ভূমিকা পালন করছেন। এদের হঠকারী ভূমিকা কয়েকটি প্রজন্মকে কলুষিত করছে। এর পরিণতি নি:সন্দেহে ভয়াবহ্ এবং দুর্ভাগ্যজনক।

এসব কোনভাবেই  আমার একার কথা নয়। সাধারণ মানুষের সাথে মিশলে কমিউনিষ্ট নেতারা নিজেদের এ হতাশাজনক চিত্র অনুধাবন করতে পারতেন। তাদের জনবিচ্ছিন্নতার আরেকটি প্রমাণ , নিজেদের বাস্তবতা সম্পর্কে তারা অন্ধকারেই আছেন। শুধুমাত্র যাদুর বাক্স আর চাটুকার ঘিরে থাকলে যা হয়। ছাত্রইউনিয়নের ছাত্রনেতারা ফেসবুকে যেসব কথা পোস্ট করেন- এতে প্রকাশ হয়, দেশের পরবর্তী প্রজন্মের একটি অংশ (ক্ষুদ্র হলেও মেধাবী অংশ) সরকার বিরোধিতার নামে নিজেদের অজান্তে একাত্তরের পরাজিত শক্তির সাথে একাত্ম হচ্ছে। তিরিশ লাখ শহীদের রক্ত এবং লক্ষ লক্ষ নির্যাতিতের বেদনা আর লাঞ্ছনায় গড়া এই দুর্ভাগা দেশটির জন্যে নি:সন্দেহে  তা অশনি সংকেত।
 যাকে গুরু বলে এই প্রজন্মের সাংবাদিকেরা মানেন,মেধাবী কৃতি সাংবাদিক জাফর ওয়াজেদ ইতিহাসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন আমাদের প্রজন্মকে।আর তাই  আমি ব্যক্তিগত ভাবে তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধায় আভূমি নত হই। একটি পোস্টে বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধৃত করে  জাফর ওয়াজেদ লিখেছেন, "আমাদের বুদ্ধিজীবিদের দায়িত্ব ছিল,স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের জীবনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো যে গণতান্ত্রিক,প্রগতিশীল ও সর্বাংশে গণমুখী সরকার গঠিত হয়েছিল তার বাণী,তার তাৎপর্যবাংলাদেশের মানুষের ঘরে ঘরে পৌছেঁ দেওযা। সে দায়িত্ব পালনে তারা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন। যে কোন কারণেই হোক, শিক্ষিত সুবিধাবাদী শ্রেণীর একাংশ, বিশেষতঃ সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবি মহলের একটি বড়ো অংশ ১৯৭২এর শেষভাগ থেকে শুরু করে সাধ্যমত বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করেছেন এবং তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও বিষোদগার করেছেন।একটা সদ্য স্বাধীন দেশের বুদ্ধিজীবিদের পক্ষে এমন আচরণ স্বাধীনতার পিঠে ছুরিকাঘাতের মতোই নিকৃষ্ট কাজ।বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের পরেও আমাদের দেশের ব্যাপক সংখ্যক সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবিরা বঙ্গবন্ধুর অনুসৃত নীতির তাৎপর্য ও বাংলাদেশের বিকাশের পক্ষে বঙ্গবন্ধুর অনুসৃত পদ্ধতির তাৎপর্য অনুধাবন করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না।"
 এ প্রসঙ্গে একটি ইতিহাস উল্লেখ করা প্রয়োজন।১৯৭৪ সালে আবদুল গাফফার চৌধুরী লন্ডনে প্রথম থাকতে গিয়ে সেই সময় দেশের প্রথম সারির চারজনের অন্যতম কৃতি চাটার্ড এ্যাকাউন্টেন্ট ওসমান কায়সার চৌধুরীর  বাসায় ছিলেন। সম্পর্কে তিনি আমার মামা । দেশের বুদ্ধিজীবি এবং সাংবাদিকদের হঠকারীতায় মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির তান্ডব এবং ষড়যন্ত্র নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে মামা  আমাকে সেই সময়ের একটি গল্প বললেন। গাফফার চৌধুরী ১৯৭৫ সালের শুরুর দিকে কোন এক সময়ে খবর পেলেন  সালভাদর আলেন্দের স্ত্রী হোর্তেনসিয়া বুসি কোলকাতায় যাচ্ছেন। সাথে সাথে কোলকাতা গেলেন তিনি। আলেন্দের স্ত্রী গাফফার চৌধুরীকে বললেন,‍‍ ‍‍ দ্যাখো, তোমাদের দেশের যে অবস্থা আমি বাইরে থেকে দেখতে পাচ্ছি, সব আমাদের দেশের চিত্রের পুনরাবৃত্তি।মুজিব এবং তার পরিবার নিয়ে এই যে প্রোপাগান্ডা  সবই সিআইএর কাজ। তোমরা সাবধান হো , মুজিবকে হত্যা করা হবে।  মায়ের কাছে শুনেছি, এর আগেই বঙ্গবন্ধুকে হুমকি দেয়া হয়েছিলো, তোমাকে আলেন্দের মতো করে হত্যা করা হবে।‍ যা বলছিলাম, আবদুল গাফফার চৌধুরী নাকি আলেন্দের স্ত্রী হোর্তেনসিয়া বুসির এ  আশঙ্কার কথা শুনে হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, মাদাম, আপনি জানেন না, বঙ্গবন্ধু হেঁটে গেলে বুলেট ও থমকে যায়। বাংলাদেশের জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধুকে খুন করার সাহস কেউ  করবে না। ১৫ই আগষ্টে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর আবদুল গাফফার চৌধুরী নাকি এ গল্প ওসমান কায়সার চৌধুরীকে বলেছিলেন। সেক্টর কমান্ডার ও যখন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিয়ে মিথ্যাচার করে, সেই লেখা গণমাধ্যম গুরুত্বের সাথে প্রচার করে , মামা উদ্বেগের সাথে আমাকে এই ইতিহাস বললেন। মামার আশংকার সত্যতা দৃশ্যমান।
 
বর্তমান প্রেক্ষিতে  আবার বলতে হয়,পিয়াস করিম একজন শিক্ষক মাত্র। তার রাজনীতি তার দুর্মর স্বভাবের কথা একপাশে সরিয়ে দেখলেও তাকে কি এমন কিছু ভাবা যায়- যার লাশ শহীদ মিনারে নিতে হবে ? কোন্ যুক্তিতে ?কেন?
 এবার আসা যাক শহীদ মিনার প্রশ্নে। শহীদ মিনার বাঙ্গালীর আত্মপরিচয়ের ভিত। সেই ভিত যাদের কারণে বারবার হুমকির মুখে , যারা বারবার শহীদ মিনার ভেঙ্গে দিয়েছে, যারা বায়ান্ন একাত্তরের আত্মদানকে চরম অশ্রদ্ধার চোখে দেখে এসেছে-সেই কুলাঙ্গারদের শহীদ মিনারে যেতে হবে কেন? তাদের ঠেকাতেই ১৪ কোটি পরিবার খাড়া রয়েছি তো !
 
বুধবার রাতে একটি টকশোতে দেখলাম  ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সংগঠক বাপ্পাদিত্য বসু বললেন, পিয়াস করিমের লাশ শহীদ মিনারে না নেবার জন্যে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে দাবি জানিয়েছেন ।  এ কথা বলার সাথে সাথে পিয়াস করিমের সহচর তথাকথিত বুদ্ধিজীবি সুশীলদের একজন ডা, জাফরুল্লাহ বললেন, তাহলে তো বুঝতে পারছি , পিয়াস করিমের লাশ শহীদ মিনারে নেবার অনুমতি না দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যই নোংরা খেলা খেলছেন ।"  রুহুল কবির রিজভী বুধবার সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, সরকারের পক্ষ থেকে নাকি ছাত্রসমাজকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে ! রুহীন হোসেন প্রিন্স বললেন, নীতিহীন রাজনৈতিক দল গুলো লাশ নিয়ে রাজনীতি করছেন। পিয়াস করিম মুক্তিযুদ্ধের সময়ে রাজাকার ছিলেন না। দেশটা কোথায় চলে যাচ্ছে বলে খুব আফসোস করলেন! প্রিন্স ভাই এবং ডা. জাফরুল্লাহর সাথে রিজভীর কথা একই সুতোয় গাঁথা এবং খুবই হাস্যকর ।
 
রুহীন হোসেন প্রিন্স আমাদের নেতা ছিলেন একসময়। তার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি,  রুহীন হোসেন প্রিন্স ভাই, নিজের দিকে তাকাবেন?নিজেরা কোথায় নামছেন খেয়াল করেছেন? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফিরিয়ে আনার ইস্যুতে পিয়াস করিম ইস্যু নয়?  এটা যদি মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে রাজনীতি হয়, কারা করছে ? সেটাই যদি না বুঝতে পারেন , আপনার রাজনৈতিক দূরদর্শীতা সত্যি্ই সন্দেহ জাগায়। পিয়াস করিম বরাবরই মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে চরম অবমাননামূলক কথা বলে গেছেন।  তার অবস্থান নিয়ে কোন আপত্তি নেই আপনাদের? ডা.জাফরুল্লাহ হতাশা প্রকাশ করলেন গণজাগরণ মঞ্চকে সঠিক পথ দেখানো উচিত ছিল বলে।গণজাগরণ মঞ্চকে ডা.জাফরুল্লাহ দেখাবেন সঠিক পথ? যিনি বরাবরই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করে এসেছেন এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির হযে ক্ষমাও চাইতে বাধ্য হয়েছেন। আরেকটি টকশোতে উপস্থাপক আফসোস করলেন    আজকাল নাকি মানুষের সহনশীলতার খুব  অভাব। চরমপন্থী অতিবাম এই উপস্থাপক ভুলে গেছেন, হাওয়া ভবনের আশীর্বাদে তাদের মতো যারা চোখের পলকে  সাধারণ এক ছা-পোষা সংবাদকর্মী থেকে মিলিয়নীয়ারে পরিণত হয়েছেন, মানুষের সহনশীলতা আছে বলেই তাদের সেই যাদুর বাক্স থেকে এখনো টেনে নামানো হচ্ছে না। এই উপস্থাপক  এবং প্রিন্স বাম রাজনীতির পরস্পর বিরোধী শক্তির ধারক হলেও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রশ্নে এই উপস্থাপক এবং রুহিন হোসেন প্রিন্স পরাজিত শক্তি!
‍‍একাত্তরের চেতনা পরাজিত হয়নি হবে না-যতোক্ষণ চেতনার অগ্নিমশাল উজ্জ্বল থাকবে- মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে আপোষ নেই - সত্যি বলেছেন বাপ্পাদিত্য বসু।
 বাংলানিউজে চ্যানেল আইয়ের বার্তা সম্পাদক জাহিদ নেওয়াজ জুয়েলের অসাধারণ  লেখনিটি পড়লাম আজ ১৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায়। চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, চেতনা আর ন্যায়ের প্রশ্নে  আমাদের কী ভূমিকা আমাদের হওয়া উচিত। নৈতিকতা এবঙ চেতনার বিকাশে এই লেখার ব্যাপক প্রচার জরুরী।  অভিবাদন জুয়েল ভাইকে। তার লেখার কিছু উদ্ধৃতি এ লেখার শুরুতে দিয়েছি। আরো কিছু তুলে ধরছি।
৮৬ বছর বয়সী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে যে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ড. পিয়াস করিমের বাবা অ্যাডভোকেট এম এ করিম তুলে দিয়েছিলেন, সে কারণে নিশ্চয়ই তখনকার কিশোর পিয়াস করিমকে দায়ী করা যায় না।
একাত্তরের এপ্রিলে ৮৬ বছর বয়সী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়ার পর প্রথমেই যে তার দু'
হাত এবং পরে হাঁটু ভেঙ্গে দেওয়া হলো
, সেজন্য নিশ্চয়ই পিয়াস করিমকে দোষী করা যায় না। তার মরদেহ শহীদ মিনারে নিতে সমস্যা কোথায়?

চেতনাগত এবং দর্শনগত জায়গায়। নানা মতাদর্শের পথ মাড়িয়ে পিয়াস করিম শেষ পর্যন্ত যে দর্শন ফেরি করে গেছেন সেটা ওই শহীদ মিনারের মতাদর্শের পরিপন্থী।


নানা ঘাটের জল খেলেও পিয়াস করিম তার বয়সের বিবেচনায় অপূর্ণ জীবনের শেষদিকে এসে তার প্রয়াত পিতার মতোই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিরোধিতা করে গেছেন। পাকিস্তানি মতাদর্শের ভিত্তিমূলে আঘাত করার কারণে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত  পিয়াসের পিতা এম করিমের শত্রু হিসেবে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন সেই পাকিস্তানি আদর্শকেই বুকে ধারণ করেছেন পিয়াস করিম।এখন পাকিস্তানি মতাদর্শকে লালন করা পিয়াস করিমের শেষ শ্রদ্ধার জায়গা কিভাবে হতে পারে শহীদ মিনার?তবে পিয়াস করিমের মরদেহ ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুলে ফুলে ঢেকে দেওয়ার আয়োজনের বিরোধিতাকে কোনো কোনো সুশীল পরমতসহিষ্ণুতার অভাব বলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এটা কি পরমতসহিষ্ণুতার অভাব? নাকি চেতনাগত অবস্থান? পরমত ছিলো সেটা যেটা তিনি দিনের পর দিন টেলিভিশনে বলে গেছেন।

 সেখানে বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু তার কণ্ঠ কি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে? না। তাই তার মরদেহ শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়ার বিরোধিতাকে যারা পরমতসহিষ্ণুতার অভাব বলার চেষ্টা করছেন, হয় তারা বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে অথবা এটা তাদের ইচ্ছা করে এক শয়তানি।

আসলে পিয়াস করিমের মরদেহ শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়ার ঘোষণার মধ্যেই একটা শয়তানি আছে। যেটা তিনি শুরু করেছিলেন শাহবাগে গণজাগরণের পর। এবং তখনই প্রমাণ হয় যে, তিনি তার প্রয়াত পিতার শুধু রক্তেরই না; চেতনারও উত্তরাধিকার।সেই চেতনা হচ্ছে শহীদ মিনারের বিরুদ্ধে, সেই চেতনা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে। তা হলে তাকে কেনো শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা?

সেটা আসলে এজন্য যে গণজাগরণের পর মিথ্যা প্রচারে যেভাবে জাতিকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে, হেফাজতকে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসার পথ করে দেওয়া হয়েছে; এখন একইভাবে তাকে শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে একটা পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে। তাকে শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা যে বাধা দেখবে, এটা জেনেই এর উদ্যোক্তারা এরকম একটা ঘোষণা দিয়েছেন।

 
 ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে ব্যালেন্স করার নামে গণমাধ্যমে  রাজাকার পুনর্বাসন নীতি নিয়ে। নাহিদ এনাম  তার পোস্টে লিখেছেন ,যতদিন এদেশের টিভি চ্যানেলগুলো রাজাকার আর ধর্ম ইস্যু নিয়ে টক শো বন্ধ না করবে ততদিন এরা সরাসরি বাংলাদেশের সমাজ শত্রু হিসেবেই চিহ্নিত এরা অনুষ্ঠান জমিয়ে তোলার তাগিদে রাজাকার সমর্থক এবং ধর্মীয় উগ্রবাদীদের দ্বারা সমাজের সাধারন মানুষের মনের ভেতর বিষ ছড়িয়ে দিতে সবথেকে বেশি ভয়ংকর ভুমিকা রাখছে।
নাজমুল আহসান রাসেল ফেসবুকে  লিখেছেন পিয়াস করিমরা যাদের পক্ষে বলে গেছেন তাদের বলার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে  আমরা লড়াই করি । সক্ষম হলে শক্তি হলে ওদের টুটি টিপে ধরা হবে  হাবিব উল্লাহ লিখেছেন পিয়াস করিম পারিবারিক ভাবেই স্বাধিনতা বিরোধী বলয়ে বড় হয়েছেন। বাবা এমএ করিম ও নানা জহিরুল হক (লিল মিয়া) ছিল কুমিল্লায় শান্তি কমিটির নেতা। দালালি গুরুতর পর্যায়ে যাওয়ায় একাত্তর সালে লিল মিয়া এবং এমএ করিমের বাসায় গ্রেনেড হামলা করে মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযুদ্ধের পর এমএ করিমকে দালালির অপরাধে দালাল আইনে গ্রেফতার করা হয় এবং অনেকদিন সে কুমিল্লা কারাগারে বন্দী থাকে। এসময় ধূর্ত পিয়াস করিম তার বাবাকে বাঁচাতে ছাত্রলীগে যোগ দেয়। পরবর্তিতে যোগ দেয় বাম রাজনীতিতে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার পর একসময় তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটিরও সদস্য ছিলেন। মুলত আনু মোহাম্মদের এই তেল-গ্যাস কমিটির ছায়াতলেই টকশো করার সুযোগ পান। এরপর থেকেই তিনি বিভিন্ন চ্যানেলের টকশোর পরিচিত মূখ হয়ে ওঠেন, পরে তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির কথা ভুলেগিয়ে বিএনপি-জামাত তোষন শুরু করেন।তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি কি ভন্ডের দলে পরিণত হয়ে গেছে...।। তাই এই লেখা লিখলেন...। নাজমুল আহসান লিখেছেন , ভিন্নমত নিয়ে , মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে দুই দিন ধরে বেশআলাপ হচ্ছে এবং সেটা হচ্ছে পিয়াস করিমকে ঘিরে। নির্দিষ্ট ভাবে যদি বলি এই ক্ষেত্রে একটা মহল বেশ চতুরটার সাথে এই দুইটা শব্দ পিয়াস করিমকে নিয়ে আলোচনার শুরুতেই ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে । যারা ঢুকিয়েছে তারা কিছুটা সফল । যারা ঢুকিয়েছে তাদের সাথে পিয়াস করিমের ব্যাক্তিগত সম্পর্ক যেমনি রয়েছে তেমনি রাজনৈতিক দুই একটি এজেন্ডায়ও মিল রয়েছে । একটু খেয়েল করলেই এরা কারা বুঝতে পারবে । পিয়াস করিমের মত বন্ধুকে হারানোর বেদনা , সম্মান প্রকাশ করার জন্যে এই মুহূর্তে পিয়াস করিম এই দুইটি শব্দই রেখে গেছে স্বভাবতই আমাদের এই দুইটা শব্দের প্রতি দুর্বলতা থাকাটাই স্বাভাবিক । কিন্তু আমি প্রশ্ন রাখতে চাই ,জামাত ইসলামী ৭১'র বিরোধিতা করছিলো তার আদর্শের জায়গা থেকে , এখনও সেইটার জন্য তারা ফাইট দিচ্ছে । আপনারা কি এইটাকে ভিন্নমত হিসেবে কিছুটা মার্জনার চোখে দেখবেন ? বা যারা আজ পিয়াস করিমের বক্তব্যকে ভিন্নমত , মতের স্বাধীনতা বলে স্বীকৃতি দিচ্ছে তারা একটু পরিষ্কার করবে পিয়াস করিমের কোন বক্তব্যগুলিকে ভিন্নমত হিসেবে সম্মান দেখাচ্ছেন ? খালি দুইটা শব্দ বলে দিলেইতো হলনা । টিপুর কাছে প্রশ্ন সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার ইতিহাস এই ভিন্নমত চর্চার ক্ষেত্রে কি সাক্ষ্য দেয় ? কী শিক্ষা দেয় ? আমার ব্যাক্তিগত মত হল, ভিন্নমত হবে বটম লাইন ধরে , বটম লাইন মিস করে যে কোন চক্রান্তমূলক , ষড়যন্ত্র মূলক , স্বাধীনতা বিরোধী , শত্রুর হয়ে দালালী ..................... শক্ত হাতে দমন করতে হবে । এখানে ভাবাবেগের কোন জায়গা নাই । আরেকটা বিষয় আমাকে রীতিমত বিনোদন দিচ্ছে সেটা হল বস্তুবাদীদেরও বলতে শুনছি মৃত্যুর পর মানুষ সব কিছুর উর্ধ্বে উঠে যায় ... প্রশ্ন ... পিয়াস করিম কি মরে গিয়েও সব কিছুর উর্ধ্বে উঠতে পারছেন ? মাহাফুজুল্লাহরাও এখন লাশ নিয়ে হুংকার দিচ্ছেন । আমার একটা জিনিস খটকা লাগছে হেফাজতের সমর্থকদের আবার শহীদ মিনারে যাওয়ার ইচ্ছা হয় কিভাবে ? এইখানে কোন রাজনীতি নাইতো ?  আমাদের সমস্যা হল আমারা কোন না কোন ভাবে দ্বিদলীয় ফাঁদে পাড়া দিবই । পিয়াস করিম নিজেই নিজেকে শহীদ মিনারের অযোগ্য অপ্রাসাংগিক করে গেছে , এই দায় দায়িত্ব তার । শেষে আরেকটা কথা বলে যাই পিয়াস করিম যদি সত্যি সত্যি তার মৃত্যুর পর শহীদ মিনারে নেয়ার ইচ্ছার কথা বলে যান তাহলে আরও বেশী করে তার বক্তব্যগুলি যে ভিন্নমত ছিলোনা কমপ্লিটলি ইন্টেনশনালি ব্যাক্তি স্বার্থে , ক্ষমতা , লোভ ,যশ এর স্বার্থে বলছেন সেটাই প্রমানিত হয় । আসলে আমরা অতিমাত্রায় শান্তিপূর্ণ পথে আগাচ্ছিতো তাই একটু ভাবাবেগে পেয়ে বসে । আমাদের মনটা অনেক নরম হয়ে গেছে । কমিউনিজম এই ব্যাপারে কি বলে টিপু ?  
 
নাজমুল হাসানের  এ প্রশ্ন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রত্যেকেরই ।

 চোখে কলুর বলদের যে ঠুলি রুহিস হোসেন  প্রিন্স পরেছেন বা তরুণদের পরাচ্ছেন এর পরিণতি ভয়াবহ।

এই দেশকে যারা বরাবরই  মৃত্যুউপত্যকায় পরিণত করতে চেয়েছে,


সেই অন্ধকারের শক্তির সাথে হাত মিলিয়েছেন আপনারা গুটিকয়েক ব্যক্তি বা দল।

 এর দায় আপনাদেরই বইতে হবে। তবে মনে রাখবেন, সেই পরিণতি ঠেকাতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সাধারণ মানুষ একাত্ম। 

 শরীরে এক বিন্দু রক্ত থাকতে ১৪ কোটি মানুষের স্মৃতির মিনার আমার অস্তিত্বের প্রতীক আমার চেতনার অগ্নিমশাল শহীদমিনার  খুনি, ধর্ষক রাজাকারের তালুক হতে দেবোনা কখনো!  এ ব্যাপারে গণমাধ্যম নিশ্চয়ই তাদের ভূমিকা অনেক জবাবদিহিমূলক করবে।

 
sumikhan29bdj@gmail.com



Monday, October 13, 2014

‘চ্যানেল আই’এর ষোল বছর, ‘সোলবা সাল’-মহিউদ্দিন আহমদ


অক্টোবর ১৩, ২০১৪ বMohiuddin Ahmedব্যক্তিমালিকানায় বাংলাাদেশে যে ছাব্বিশ-সাতাশটি টিভি চ্যানেল আছে তার শীর্ষস্থানীয় চার-পাঁচটি চ্যানেলের একটি হচ্ছে ‘চ্যানেল আই’। এই চ্যানেলটি ১ অক্টোবর তার ষোড়শ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী মহাধুমধামের সঙ্গেই পালন করল। বস্তত এই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান শুরু হয় দশ-বার দিন আগেই। তখন প্রতিদিন ‘চ্যানেল আই’এর আয়োজনে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই আলোচনাগুলোর একটি ছিল টক শোগুলোর গুরুত্ব এবং যথার্থতা নিয়ে। ঢাকার কিছু ডাকসাইটে সিভিল সোসাইটির সদস্য উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা এখানে বক্তব্য দিয়েছেন।
অনুষ্ঠানটি আমি দেখিনি; তবে পরদিন দৈনিক ‘প্রথম আলো’তে এই আলোচনা সভার উপর যে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে তার সঙ্গে আমি একমত, যেহেতু আমাদের জাতীয় সংসদটি অকার্যকর সেইহেতু টক শোগুলো এবং ‘বিবিসি বাংলা’র সাপ্তাহিক বাংলাদেশ সংলাপ জাতীয় অনুষ্ঠান সংসদের অভাবটি পূরণ করে দিচ্ছে। কখনও কখনও আবার এমনও মনে হয় জাতীয় সংসদের বিতর্কের চাইতে এগুলো অনেক বেশি কার্যকর। জাতীয় সংসদে গালাগাল এবং বন্দনাই বেশি হয়। কিন্তু টক শোতে পক্ষ-প্রতিপক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে উপস্থিত রাখার চেষ্টা হয়; এখানে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর বক্তব্য পাওয়া যায়, জাতীয় সংসদের বর্তমান অবস্থায় যা সম্ভব নয়।
এই পর্যায়ে একটি ডিসক্লেইমার; টক শোতে আমি যাই না, দেখিও না এসব প্রোগ্রাম। রাত সাড়ে ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। রাত ৮টার পর সাধারণত টেলিফোনও ধরি না। আর যে কোনো টিভি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার সম্মানী হিসেবে আমি একটি মিনিমাম পরিমাণের টাকা নিয়ে থাকি।
আমার কোনো গাড়ি নেই, আমাকে নিতে হলে আমাকে নিয়ে যেতে হয়, দিয়েও যেতে হয়। তারপর রাত ১০টার পর হলে, ‘সরি, থ্যাংক ইউ’। এতসব শর্ত মেনে আমাকে দাওয়াত করার দরকার কী? আমার চাইতে যোগ্য লোক এই ঢাকা শহরে অনেক, অনেক পাওয়া যায়। যেমন একটু আগেই বলেছি, আমি টিভি টক শো দেখি না, টক শোতে অংশগ্রহণ করি না। তারপরও আমি মনে করি, যে কোনো সরকারের আমলে সরকার পক্ষের লোকজনের কিছুটা জবাবদিহিতা, কিছুটা ভাষ্য, কিছুটা আত্মপক্ষ সমর্থন এখানে আদায় করা যায়। ‘বিবিসি বাংলা’র বাংলাদেশ সংলাপ এই ক্ষেত্রে একটি প্রবল ভূমিকা রেখে চলেছে।
দুই
বাংলাদেশের এই টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর কয়েকটি কোনোভাবে শুধু বেঁচেই আছ। তবে শীর্ষস্থানের চ্যানেল কোনটি– ‘চ্যানেল আই’, ‘এটিএন নিউজ’, ‘এনটিভি’, নাকি ‘চ্যানেল ৭১’– তা সঠিকভাবে জানার উপায় এই বাংলাদেশে এখনও গড়ে ওঠেনি। টিভি চ্যানেল মালিকদের এখানে সাংঘাতিক ব্যর্থতা।
পত্রপত্রিকার প্রকৃত প্রচারসংখ্যা দিয়ে একটি পত্রিকার পাঠকপ্রিয়তা যাচাই করা যায়। কিন্তু এখানে যে গভীর ও ব্যাপক দুর্নীতি চলছে তা সম্যক জানে আমাদের তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর। তারা সঠিক প্রচারসংখ্যা জানার জন্য কখনও কখনও গভীর রাতে পুলিশ, র‌্যাবের মতো পত্রিকা অফিসে আচমকা পরিদর্শনে যায়। যখন ছাপাখানায় পত্রিকা ছাপা হতে থাকে তখন আসল প্রচারসংখ্যা জানার কথা। কিন্তু এখানেও নানা রকমের অনিয়ম বেনিয়ম এবং দুর্নীতির অবিশ্বাস্য রেওয়াজ চালু আছে।
দুনিয়ার উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে পত্রিকা অফিসে টেলিফোন করলেই সেই পত্রিকার প্রচারসংখ্যা জানা যায়। কিন্তু আমাদের দেশে ‘নো’, ‘নেভার’। পত্রিকার প্রকৃত প্রচারসংখ্যা মালিক-সম্পাদকরা ‘অতিগোপনীয়’ হিসেবে গণ্য করেন। এই ক্ষেত্রে দৈনিক ‘প্রথম আলো’ একমাত্র ব্যতিক্রম।
পত্রিকার প্রচারসংখ্যার উপর নির্ভর করে বিজ্ঞাপন রেট; যে পত্রিকার যত বেশি প্রচার সংখ্যা, তার রেট তত বেশি। সুতরাং প্রচারসংখ্যা বেশি দেখাতে পারলে রেটও বেশি হবে, বিজ্ঞাপন থেকে আয়ও বেশি আসবে। আমাদের পত্রপত্রিকার মালিক-সম্পাদকদের বেশিরভাগই এই দুর্নীতি প্রকাশ্যেই করে চলেছেন।
টেলিভিশনের জনপ্রিয়তা যাচাই করা হয় টেলিভিশন রেটিং পয়েন্ট– ‘টিআরপি’ দিয়ে। তো, বাংলাদেশের বর্তমান চ্যানেলগুলোর টিআরপি নিয়ে ‘এটিএন নিউজ’এর প্রভাষ আমিন কী লিখেছেন, তা নিচে উদ্ধৃত করছি। দৈনিক ‘ইত্তেফাক’এর গত রোজার ঈদ সংখ্যা ২০১৪এ ‘‘বাঘের ওপর টাগ” শিরোনামে আমাদের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ওপর প্রকাশিত খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি লেখার এটি শেষ প্যারাগ্রাফ:
‘‘টেলিভিশন মালিকদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানোর আরেকটি কায়দা হচ্ছে টিআরপি । ‘সিরিয়াস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে টেলিভিশন স্টেশনগুলোর দর্শকপ্রিয়তা যাচই করে। টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ এবং বিজ্ঞাপনদাতারা অনেক টাকা দিয়ে এই টিআরপি রিপোর্ট কেনে। কিন্তু সাধারণ দর্শকরা এই টিআরপি রিপোর্ট দেখার সুযোগ পান না। বিজ্ঞাপনদাতারা এই টিআরপি রিপোর্ট দেখার সুযোগ পান না। বিজ্ঞাপনদাতারা এই টিআরপি রিপোর্ট দেখেই বিজ্ঞাপন দেন। তাই এই টিআরপি রিপোর্ট টিভি স্টেশনগুলোর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু এই মহাগুরুত্বপূর্ণ টিআরপি রিপোর্ট কীভাবে তৈরি হয় শুনলে আপনারা হাসতে হাসতে মরে যাবেন। ১৬ কোটি মানুষের এই দেশে মাত্র ২৬০টি বাসার দর্শকদের পছন্দ মনিটর করেই তৈরি হয় এই টিআরপি । তাও কোন ২৬০টি বাসা তা ‘সিরিয়াস’ ছাড়া আর কেউ জানে না। ভুতুড়ে সেই ২৬০ জন দর্শকই নির্ধারণ করেন টিভি স্টেশনের ভাগ্য এবং এই ২৬০ জনের সবাই ঢাকার। তার মানে ঢাকার বাইরের মানুষ টিভি দেখল কী দেখল না তাতে টিভি স্টেশনের মালিকদের কিছুই যায় আসে না।
হাস্যকর বললাম এই কারণে যে, প্রতি সপ্তাহেই টিআরপি রিপোর্ট দেখার সুযোগ হয় আমার। এমন অনেক টিভি টিআরপি রেটিংয়ে এগিয়ে থাকে, যা আপনারা হয়তো কখনওই দেখেননি। অভিযোগ আছে ‘সিরিয়াস’ প্রায়শই এই টিআরপি রিপোর্ট ম্যানিপুলেট করেন। ‘সিরিয়াস’কে সন্তষ্ট করতে পারলে দর্শক দেখুন আর না দেখুক যে কোনো টিভি টিআরপি তে এগিয়ে থাকতে পারে।’’
এই পর্যায়ে ‘চ্যানেল আই’এর কাছে আমার প্রথম প্রস্তাব, কোন চ্যানেলের কী সঠিক রেটিং পয়েন্ট দর্শকদের তা নিয়মিত জানানোর ব্যবস্থা করুন। ‘চ্যানেল আই’ দেশের প্রথম ডিজিটাল চ্যানেল, এই আত্মপ্রচারগুলো আজ বৃহস্পতিবার ২ অক্টোবরও অনেকবার শুনেছি; এই চ্যানেল অনেক কিছু আমাদের ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে চালু করেছে, আমাদের ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে সমৃদ্ধও করেছে। তো, দয়া করে এখন ইলেকট্রনিক মিডিয়ারই এক সাংবাদিক প্রভাষ আমিনের পর্যবেক্ষণ এবং মন্তব্যগুলো যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে সঠিক বস্তুনিষ্ঠ টিআরপি সাপ্তাহিক ভিত্তিতে প্রকাশ্যে চালু করুন।
আমরা ‘চ্যানেল আই’এর সঙ্গে কামাল মজুমদারের ‘মোহনা’ টিভিকে তুলনা করে দেখতে চাই কে কোন অবস্থানে আছে। ‘মোহনা’ টিভি কি কেউ দেখে? এই চ্যানেলের মালিক, আওয়ামী লীগের সাংঘাতিকভাবে বিতর্কিত এক সংসদ সদস্য কামাল মজুমদার নাকি টিভি নাটক এবং অন্যান্য প্রোগ্রামের বকেয়া কোটি কোটি টাকা কয়েক বছর ধরে পরিশোধ করছেন না।
‘চ্যানেল আই’এর দায়িত্বটা এখানে অনেক বেশি। এর মালিকদের একজন, উন্নয়নকর্মী, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ হচ্ছেন ‘অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল উওনার্স’– অ্যাটকো এর মহাসচিব। ‘অ্যাটকো’ এর সভাপতি ‘এনটিভি’র মালিক জনাব মোসাদ্দেক আলী ফালু। দু’জনের চ্যানেল দুটোই জনপ্রিয়তা এবং টিআরপি রেটিংয়ে শীর্ষের কয়েকটি চ্যানেলের দুটি।
এখানে আরও উল্লেখ করি, পশ্চিমা দেশে টিভির রেটিং প্রফেশনালিই করা হয়ে থাকে। পত্রপত্রিকায় কোন টিভি চ্যানেলের প্রোগ্রামের জনপ্রিয়তা কেমন তা নিয়মিতই ছাপা হয়। বিশ্ববিখ্যাত টক শো হোস্ট ল্যারি কিং ‘সিএনএন’ থেকে অবসরে যাওয়ার পর তার জায়গায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল ব্রিটিশ টিভি-ব্যক্তিত্বৃ পিয়ার্স মরগ্যানকে। কিন্তু তিন বছর ধরে ‘সিএনএন’ মালিকপক্ষ লক্ষ করল, পিয়ার্সের এই অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তা কমে যাচ্ছে। সুতরং মাস কয়েক আগে ‘সিএনএন’ থেকে তাঁকে বিদায় দেওয়া হয়েছে।
তিন
বুধবার ১ অক্টোবর ভোর ৪-৩০ থেকে আমি ‘চ্যানেল আই’ দেখা শুরু করি এবং মাঝে মাঝে কয়েক মিনিটের বিরতিসহ সকাল ১১টা পর্যন্ত একটানা দেখি। বুঝলাম, রাত ১২টায় জন্মদিনের অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। ড. কামাল হোসেন, বাণিজ্য মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদসহ আরও কয়েকজন কেক কাটলেন, তাদের সকলকে চিনলামও। কিন্তু বিএনপি থেকে কে একজন থাকলেন, তাকে আগে কোথায়, কোনো টিভিতে বা পত্রিকার পাতায় দেখেছি তা মনে পড়ল না।
সকাল ৭টায় যখন দিনের পত্রিকাগুলো হাতে নিলাম, দেখলাম ‘চ্যানেল আই’এর জন্মদিন উপলক্ষে যে ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়েছে সেখানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং তথ্যমন্ত্রীর বাণী আছে। কিন্তু কোনো বাণী নেই বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া বা জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী রওশন এরশাদের।
তাহলে মানে কী দাঁড়াল? বিএনপি কি এখন ‘চ্যানেল আই’কে নিরপেক্ষ মনে করে না? তাই বিএনপির এই বয়কট, এই বর্জন?
কিন্তু সেই ২০০৩ বা ২০০৪ সালে যখন বিএনপির ‘যুবরাজ’ তারেক রহমান বাংলাদেশের জেলাগুলো সফরে বের হলেন, তখন এই ‘চ্যানেল আই’তে সালেহ বিল্পব নামের এক ছোকরা রিপোর্টার যে উচ্ছাসের আতিশয্য দেখাল তার রিপোর্টগুলোতে, তখন একটি কলাম লিখেছিলাম আমি। সালেহ বিপ্লবকে কেন আমি ‘ছোকরা বিপ্লব’ বলে আমার কলামে বর্ণনা করলাম, তার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন পরে শাইখ সিরাজ, এক অনুষ্ঠানে।
তো, শাইখ সিরাজ, ফরিদুর রেজা সাগররা বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে আছেন বলেও তো মনে হয় না। ‘চ্যানেল আই’ যদি আওয়ামী লীগের সঙ্গেই থাকত, তাহলে শাইখ সিরাজ ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ নামের চ্যাানেলটি পেতেন। কয়েক বছর ধরে শুনে আসছি, তিনি অনেক বছর ধরে এমন একটি চ্যানেলের জন্য চেষ্টা করে আসছেন, কিন্তু সফল হচ্ছেন না।
বরং দ্বিতীয় চ্যানেল জোগাতে সফল হলেন ‘ডক্টর’ মাহফুজুর রহমান। তার ‘এটিএন বাংলা’ আগে থেকেই তো ছিল, অতিরিক্ত তিনি পেলেন ‘এটিএন নিউজ’ টিভি। অথচ এই ‘ডক্টর’ রহমান ২০০৪ বা ২০০৫ সালে বগুড়ার ধুনটে ২০০৬ এর নির্ধারিত সাধারণ নির্বাচনে বিএনপির পরবর্তী সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে গিয়ে ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে এসেছিলেন। তাকে ধাওয়া দিয়েছিল বিএনপির তৎকালীন সিটিং এমপি জিএম সিরাজের লোকজন। জিএম সিরাজ ছিলেন বাংলাদেশ বাসমালিক সমিতির তৎকালীন সভাপতি।
ধাওয়া খাওয়ার এই খবরও দেখেছিলাম ‘ডক্টর’ মাহ্ফুজুর রহমানের এটিএন বাংলার খবরেই। সেদিন ১ অক্টোবর ‘ডক্টর’ মাহফুজুর রহমানকেও দুপুরের দিকে ‘চ্যানেল আই’এর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে দেখলাম। তবে তার সঙ্গে দেখলাম না বাংলাদেশের দ্বিতীয় ‘রুনা লায়লা’, ইভা রহমানকে।
‘চ্যানেল আই’ এর মালিকদের অনেক কিছু গত পনের বছরে হয়েছে। ত্রিশটির মতো কোম্পানি, শত শত কোটি টাকা তাদের এখন। কিন্তু তাদের নেই দ্বিতীয় কোনো চ্যানেল। কারণ তাদের টিমে নেই কোনো তদবিরবাজ, প্রধানমন্ত্রীকে ‘আপা’ ডাকার মতো কোনো সাংবাদিক।
চার
‘চ্যানেল আই’এর জন্মদিনের অনুষ্ঠানগুলো দেখতে দেখতে আমার বার বার একটি কথা মনে পড়ছিল। এর দুই প্রধান পুরুষ, ফরিদুর রেজা সাগর এবং শাইখ সিরাজদের জন্য বন্দনা এবং আত্মপ্রচারের যে প্রতিযোগিতা চলল, তাহলে বিটিভিকে ‘সাহেব-বিবি-গোলামের বাক্স’ বলে অপবাদ দেওয়া কেন? সরকারের মালিকানাধীন বিটিভি সরকারের প্রেসিডেন্ট, প্রাইম মিনিস্টার, ফার্স্ট লেডি, মিনিস্টারদের প্রচারণা চালিয়েছে অতীতে, এখনও চালায়; ‘চ্যানেল আই’ও তো তার মালিকবৃন্দ এবং তাদের স্ত্রী-মা-বোনদের প্রচার চালাচ্ছে!
মঙ্গলবার, ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে পরের কয়েক দিন বাংলাদেশের সবগুলো পত্রিকায়, সবগুলো চ্যানেলে লতিফ সিদ্দিকী এক নম্বর খবর। কিন্তু ‘চ্যানেল আই’তে লতিফ সিদ্দিকীর বিপরীতে ‘চ্যানেল আই’এর বন্দনা ও বিভিন্ন বিশিষ্টজনদের মধ্যে প্রচারের প্রতিযোগিতার খবর সবগুলো বুলেটিনে এক নম্বরে ছিল।
বুধবার সকালে ‘তৃতীয় মাত্রা’র অনুষ্ঠানে উপস্থাপক জিল্লুর রহমান তবু কিছুটা শালীনতা দেখালেন। ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক, সাবেক সচিব মোফাজ্জল করীম, সাবেক সিএসপি এবং লাহোর সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে ১৯৬৭-৬৮ তে আমার সিনিয়র ব্যাচমেট ড. মিজানুর রহমান শেলী এবং রাশেদা কে চৌধুরীকে জিল্লুর রহমান জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘‘চ্যানেল আই’এর কী কী ঘাটতি আছে, এই চ্যানেলে আপনারা নতুন কী দেখতে চান?’’
এখানেও ব্যারিস্টার রফিকউল-হক এবং রাশেদা কে চৌধুরীর মধ্যে বন্দনার প্রতিযোগিতা দেখলাম। রফিকুল হক বললেন, ইটালির ভেনিস সফরকালে তিনি দেখেছেন এক বাংলাদেশির ইটলিয়ান স্ত্রী ‘চ্যানেল আই’এর খবর দেখতে চারতলায় ছুটে গেলেন। আর রাশেদা চৌধুরী বললেন, ভারতের গুজরাটে তাঁর ছেলের শ্বশুরবাড়িতে ‘চ্যানেল আই’ দেখার প্রবল আগ্রহের কথা।
এমন বন্দনা সেদিন প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কথায়ও দেখলাম। গত বছর তিনি ‘চ্যানেল আই’এর ক্রোড়পত্রের জন্য লেখা দিয়েছিলেন। আমার কাছে তখন তা ‘চিপ’ সস্তা মনে হয়েছিল। টেলিফোন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এই শিক্ষককে তখন প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। লিখতে হলে তিনি সম্পাদকীয় পাতায় লিখবেন। যেমন আজ বৃহস্পতিবার ‘প্রথম আলো’তে সৈয়দ শামছুল হকের বন্দনামূলক একটি লেখা দেখছি। সৈয়দ শামসুল হকও ‘চ্যানেল আই’তে কোনো ঘাটতি ত্রুটি ব্যর্থতা দেখতে পান না। ‘চ্যানেল আই’তে তিনি কোনো বিজ্ঞাপন-সন্ত্রাস দেখেন না। সৈয়দ শামসুল হকের এই বন্দনা তাঁর অবস্থানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে মনে করি।
এই বন্দনার প্রতিযোগিতা দেখতে দেখতে আমার আরও মনে হচ্ছিল, এই সব বিশিষ্টজন ‘চ্যানেল ৭১’, ‘এটিএন’ এবং ‘এনটিভি’র জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানেও প্রায়ই এই কথাগুলোই বলবেন। ‘চ্যানেল আই’এর জায়গায় শুধু জন্মদিনের অনুষ্ঠান উদযাপনকারী টিভি চ্যানেলের নাম বসিয়ে দিলেই হল। এই দিনের অনুষ্ঠানগুলোতে আরও বুঝলাম, বাঙালি মাত্রই প্রচারকাতর।
‘চ্যানেল আই’এর ‘কৃষি সংবাদ’টি আমি সুযোগ পেলেই দেখি। দেখি ‘প্রকৃতি ও জীবন’ সংবাদও। আরও দেখি সংবাদ, সকাল ৯টার বুলেটিনের শেষ দিকে প্রচারিত দিনের সংবাদপত্রগুলোর অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ শিরোনাম। তবে এই শিরোনামগুলোর পাঠক মৃদুলা মতিনের ছবি দেখানোতে আপত্তিটা কোথায়? মাঝে মাঝে বড় অশুদ্ধ উচ্চারণ থাকে তার। তারপরও তাকে ‘চ্যানেল আই’এর পর্দায় দেখার একটি আগ্রহ আমার অনেকদিনের।
‘চ্যানেল আই’এর খবর সব সময় বস্তুনিষ্ঠ নয়। উদাহরণ দিচ্ছি, আগের দিন মঙ্গলবার শাইখ সিরাজ ওয়াশিংটনে কোনো এক সেমিনারে গুটি সার সম্পর্কে কী বলেছেন, তা সকাল ৭টার বুলেটিন থেকে শুরু করে রাত ৯টার বুলেটিনেও প্রচার করতে হবে কেন? কারণ কি এই যে, তিনি শাইখ সিরাজ, তিনি একজন মালিক? আত্মপ্রচার কি এমন প্রকট হতে হবে?
জন্মদিনের অনুষ্ঠানেও দেখলাম, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি ‘ইউনিলিভার’, তার সাবান সামগ্রী এবং মোবাইল কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞাপনের দাপট এবং প্রতাপ। পশ্চিমা দেশে, কোনো একজন ‘ইনভেস্টিগেটিভ’ রিপোর্টার, এই জন্মদিনে বিজ্ঞাপন খাতে ‘চ্যানেল আই’এর আয় কত কোটি টাকা, খরচই-বা কত, এমন সব খরচের যৌক্তিকতা, এসবের উপর দীর্ঘ প্রতিবেদন তৈরি করে ছাপাতেন।
আমাদের পত্রপত্রিকা এবং টিভি চ্যানেলগুলো দেশের মানুষদের সচেতনতা বাড়াতে, বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ করতে, মানবাধিকার রক্ষায়, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে প্রবল ভূমিকা রাখছে। কিন্তু এতসব, বড় বড় নন্দিত ভূমিকার পরও যখন দেখি, বাংলাদেশের অনেক মানুষ অত্যাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে একদিকে, আবার চাঁদে দেলাওয়ার হোসেইন সাঈদীকেও দেখছে এবং বিশ্বাসও করছে, তখন আর মেলাতে পারি না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অসাধারণ সময এখন বাংলাদেশে। বাঙালি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রধান উৎসব দুর্গাপুজা চলছে। কয়েক দিন পর কোরবানির ঈদ। পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময়ের এক উত্তম সময় এখন। ক্ন্তিু লক্ষ্য করেছেন কি, হিন্দুদের উৎসব উদযাপিত হয়েছে পুলিশি প্রহরায়! এই দেশে সাম্প্রদায়িকতা বাড়ছে না কমছে? আমাদের গণমাধ্যমের প্রভাব এবং কার্যকারিতা নিয়ে তখন মনে প্রশ্ন জাগে।
‘চ্যানেল আই’তে জাঁকজমকের এত বড় বড় সব অনুষ্ঠান, এত বড় বড় সব লোকের দোয়া শুভকামনা এবং অভিনন্দন জ্ঞাপন, কিন্তু একজন মানুষকে এই বছরের অনুষ্ঠানে দেখলাম না, আগের বছরগুলোতও নয়। ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা এবং এখন চেয়ারম্যান সনজীদা খাতুনকে ‘চ্যানেল আই’এর কোনো অনুষ্ঠানে দেখা যায় না।

শিউলিতলা, উত্তরা
বৃহষ্পতিবার, ২ অক্টোবর, ২০১৪

Saturday, October 11, 2014

মানবের কর্মবিশ্বের সাধক শিল্পগুরু এস এম সুলতানের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ-সুমি খান

শেখ মোহাম্মদ সুলতান, যিনি এস. এম. সুলতান নামে সমধিক পরিচিত, (১০ আগস্ট, ১৯২৩ - ১০ অক্টোবর, ১৯৯৪) বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী।তাঁর জীবনের মূল সুর-ছন্দ খুঁজে পেয়েছিলেন বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন, কৃষক এবং কৃষিকাজের মধ্যে। আবহমান বাংলার সেই ইতিহাস-ঐতিহ্য, দ্রোহ-প্রতিবাদ, বিপ্লব-সংগ্রাম এবং বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে থাকার ইতিহাস তাঁর শিল্পকর্মকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে। তাঁর ছবিতে গ্রামীণ জীবনের পরিপূর্ণতা, প্রাণপ্রাচুর্যের পাশাপাশি শ্রেণীর দ্বন্দ্ব এবং গ্রামীণ অর্থনীতির হালও অনেকটা ফুটে উঠেছে। তাঁর ছবিগুলোতে বিশ্বসভ্যতার কেন্দ্র হিসেবে গ্রামের মহিমা উঠে এসেছে এবং কৃষককে এই কেন্দ্রের রূপকার হিসেবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৯৮২ সালে তাঁকে এশিয়ার ব্যক্তিত্ব হিসেবে ঘোষণা করে। 

 
এস. এম. সুলতান ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ আগস্টে তৎকালীন পূর্ব বাংলা (বর্তমান বাংলাদেশ) যশোরের নড়াইলের মাছিমদিয়া নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্ম হয়েছিলো এক দরিদ্র পরিবারে। তাঁর বাবার নাম শেখ মোহাম্মদ মেছের আলী, তিনি পেশায় ছিলেন রাজমিস্ত্রী। শৈশবে পরিবারের সবাই তাকে লাল মিয়া বলে ডাকতো। তাঁকে বিদ্যালয়ে পড়ানোর মতো অতোটা সামর্থ্য তাঁর বাবার ছিলো না। বহু কষ্ট হওয়াসত্ত্বেও তাঁকে নড়াইলের ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়। তিনি এখানে পাঁচ বছর অধ্যয়ন করেন। এরপর স্কুল ছেড়ে বাড়ি ফিরে রাজমিস্ত্রীর কাজ শুরু করেন। রাজমিস্ত্রীর কাজ করার পাশাপাশি তিনি সেই দালানগুলোর ছবি আঁকতেন। ১০ বছর বয়সে যখন তিনি স্কুলে পড়েন তখন ড: শাম্যপ্রসাদ মুখার্জ্জী স্কুল পরিদর্শনে এসে তাঁর আঁকা ছবি দেখে প্রশংসা করেছিলেন। তাঁর খুব ইচ্ছা ছিলো ছবি আঁকা শিখবেন, এজন্যে দরকার হলে কলকাতায় যাবেন। কিন্তু এরকম আর্থিক সঙ্গতি তাঁর পরিবারের কখনোই ছিলোনা। এসময় তাঁর এলাকার জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। জমিদারের সাহায্য নিয়ে সুলতান ১৯৩৮ সালে কলকাতা যান।


তাঁর ইচ্ছা ছিলো কলকাতায় গিয়ে অর্থ উপার্জনের কোনো চেষ্টা করার পাশাপাশি চিত্রশিল্পের শিক্ষা চালিয়ে যাবার। এই ইচ্ছা নিয়েই তিনি প্রথমে ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের কলকাতার বাড়িতে উঠেন। এসময় তৎকালীন সময়ের প্রখ্যাত শিল্প সমালোচক এবং কলকাতা আর্ট স্কুলের পরিচালনা পরিষদের সদস্য শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে তাঁর পরিচয় হয়। সোহরাওয়ার্দী, সুলতানকে সব ধরণের পৃষ্ঠপোষকতা করতে থাকেন। তাঁর গ্রন্থাগার সুলতানের জন্য সব সময় উন্মুক্ত ছিলো। ১৯৪১ সালে তিনি কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। ভর্তির জন্য প্রয়োজনীয় সব যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও সোহরাওয়ার্দীর চেষ্টায় তিনি ভর্তি হতে পেরেছিলেন। এখানে তিনি তিন বছর পড়াশোনা করেন। পাশ করে একজন ফ্রিল্যান্স চিত্রশিল্পী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।

আর্ট স্কুলে পড়লেও সেখানকার বাঁধাধরা জীবন এবং প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার কঠোর রীতিনীতি তাঁর জীবনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিলোনা। তিনি ছিলেন বোহেমীয় জীবনাচারের অনুসারী। চেতনায় তিনি ছিলেন স্বাধীন এবং প্রকৃতিগতভাবে ছিলেন ভবঘুরে এবং ছন্নছাড়া। প্রকৃতিকে তিনি সবসময় রোমান্টিক কবির আবেগ দিয়ে ভালোবেসেছেন। আবার যান্ত্রিক নগর জীবনকে সেরকমই ঘৃণা করেছেন। ১৯৪৩ সালে তিনি খাকসার আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। এর অব্যবহিত পরেই বেরিয়ে পড়েন এবং উপমাহাদেশের পথে পথে ঘুরে তাঁর অনেকটা সময় কেটে যায়। তখন ছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। অনেক মার্কিন ও ব্রিটিশ সৈন্য ছিলো ভারতে। তিনি ছোট-বড় বিভিন্ন শহরে ঘুরে ঘুরে ছবি এঁকে তা সৈন্যদের কাছে বিক্রি করতেন। এভাবেই তিনি সেসময় জীবনধারণ করেছেন। মাঝে মাঝে তাঁর ছবির প্রদর্শনীও হয়েছে। এর মাধ্যমে তিনি শিল্পী হিসেবে কিছুটা পরিচিতি লাভ করেন। কিন্তু সুলতানের চরিত্রে পার্থিব বিষয়ের প্রতি যে অনীহা এবং যে খামখেয়ালীপনা ছিলো তাঁর কারণে সেই ছবিগুলো রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। সেগুলোর কোনো আলোকচিত্রও এখন পাওয়া যায় না। এছাড়া তিনি কখনও এক স্থানে বেশি দিন থাকতেন না। তিনি বলেন:
একেক জায়গায় এভাবে পড়ে আছে সব। শ্রীনগরে গেলাম। সেখানকার কাজও নেই। শ্রীনগরে থাকাকালীন পাকিস্তান হয়ে গেলো। '৪৮-এ সেখান থেকে ফিরে এলাম। কোনো জিনিসই তো সেখান থেকে আনতে পারিনি। একটা কনভয় এনে বর্ডারে ছেড়ে দিয়ে গেলো। পাকিস্তান বর্ডারে। আমার সমস্ত কাজগুলোই সেখানে রয়ে গেলো। দেশে দেশে ঘুরেছি। সেখানে এঁকেছি। আর সেখানেই রেখে চলে এসেছি।
 
তবে এটুকু জানা গেছে যে, সেসময় তিনি প্রাকৃতিক নৈসর্গ্য এবং প্রতিকৃতি আঁকতেন। তাঁর আঁকা ছবির প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিলো ১৯৪৬ সালে সিমলায়
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান ও ভারতের জন্ম হয়। এই বিভক্তির পর এস এম সুলতান কিছু দিনের জন্য নিজ দেশ তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসেন। এখানে কিছুদিন থেকেই করাচি চলে যান। সেখানে পারসি স্কুলের শিল্প শিক্ষক হিসেবে দুই বছর চাকুরি করেছিলেন। সেখানে চাকুরিরত থাকা অবস্থায় তাঁর সাথে পরিচয় হয় চুঘতাই এবং শাকের আলীর মত বিখ্যাত শিল্পীদের। এর কিছু আগে ১৯৫০ সালে চিত্রশিল্পীদের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যান। সেখানে নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন, শিকাগো এবং বোস্টনে তাঁর ছবির প্রদর্শনী হয়। এরপর লন্ডনেও তিনি প্রদর্শনী করেছিলেন। ১৯৫৩ সালে আবার নড়াইলে ফিরে আসেন। এবার এসে তিনি শিশু শিক্ষার প্রসারে কাজ শুরু করেন যা নিয়ে তাঁর অনেক স্বপ্ন ছিলো। শেষ বয়সে তিনি নড়াইলে শিশুস্বর্গ এবং চারুপীঠ নামে দুটি শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড় তুলেছিলেন। এছাড়া সেখানে "নন্দন কানন" নামের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং একটি উচ্চ বিদ্যালয় এবং "নন্দন কানন স্কুল অব ফাইন আর্টস" নামে[১] একটি আর্ট স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেন।
অনেকটা সময় তাঁর নড়াইলেই কেটে যায়। ঢাকায় আধুনিক চিত্রশিল্পের বিকাশের সময়টায় তিনি প্রায় সকলের অজ্ঞাতেই ছিলেন। ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি শিল্পরসিকদের চোখের আড়ালেই থেকে যান। সত্তরের দশকের মধ্যভাগে তাঁর কিছু শুভানুধ্যায়ী তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। এখানে এসে তিনি কিছু ছবি আঁকেন। তাঁর আঁকা এইসব ছবি নিয়ে ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী এক প্রদর্শনীর আয়োজন করে। এই প্রদর্শনীর মাধ্যমেই তিনি নতুন করে শিল্পসমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। অবশ্য আশির দশক থেকে তিনি আবার নড়াইলেই থাকতে বাধ্য হোন। তাঁর কাছে যেসব মানুষ এবং শিশু আশ্রয় নিয়েছিলো তাদের জন্য তিনি নিজের ঘর ছেড়ে দেন। জীবজন্তুর প্রতি ভালোবাসা থেকে তিনি একটি চিড়িয়াখানা তৈরি করেন এবং সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে শিশুদের জন্য সুন্দরী কাঠ দিয়ে একটি বড় আকারের নৌকাও তৈরি করেছিলেন। তাঁর ইচ্ছা ছিলো শিশুরা সেই নৌকায় চড়ে সমুদ্র পরিভ্রমণে বের হবে আর শিল্পচর্চার উপকরণ খুঁজে পাবে।[৫] আশির দশকের শেষদিকে তাঁর স্বাস্থ্য খারাপ হতে থাকে। ১৯৯৪ সালে ঢাকার গ্যালারি টোনে তাঁর সর্বশেষ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। সে বছরেরই আগস্ট মাসে নড়াইলে ঘটা করে তাঁর জন্মদিন পালন করা হয়। ১৯৯৪ সালেরই ১০ আগস্ট তিনি যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
পঞ্চাশের দশকের মধ্যভাগে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় আধুনিক চিত্রকলার ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছিলো। অনেক শিল্পীই সেখানে নব নব শৈলী, গড়ন এবং মিডিয়া নিয়ে উপস্থিত হচ্ছিলেন। কিন্তু এস এম সুলতান সেসময়ও নড়াইলে থেকে যান, অনেকটা লোকচক্ষুর অন্তরালে। এর কারণ অবশ্য গ্রামীণ জীবনের প্রতি তাঁর চিরন্তন আকর্ষণ এবং সহমর্মিতা। তাঁর শিল্পকর্মের স্বরূপটিও খুঁজে পাওয়া যায় এই গ্রামীণ জীবনযাত্রার প্রেক্ষাপটে। তাঁর সে সময়কার ছবিগুলোতে গ্রামীণ কৃষকদের দেখা যায় পেশীবহুল এবং বলশালী হিসেবে। এর কারণ হিসেবে তাঁর বক্তব্য হলো[৫]:
আমাদের দেশের মানুষ তো অনেক রুগ্ন, কৃষকায়। একেবারে কৃষক যে সেও খুব রোগা, তার গরু দুটো, বলদ দুটো -সেটাও রোগা...। [আমার ছবিতে তাদের বলিষ্ঠ হওয়াটা] মনের ব্যাপার। মন থেকে ওদের যেমনভাবে আমি ভালোবাসি যে আমাদের দেশের কৃষক সম্প্রদায়ইতো ব্রিটিশ সাম্রাজ্য গড়েছিলো। অর্থবিত্ত ওরাই তো যোগান দেয়। ...আর এই যত জমিদার রাজা মজারাজা আমাদের দেশের কম কেউ না। সবাই তো কৃষিনির্ভর একই জাতির ছেলে। আমার অতিকায় ছবিগুলোর কৃষকের অতিকায় অতিকায় দেহটা এই প্রশ্নই জাগায় যে, ওরা কৃশ কেন? ওরা রু্গ্ন কেন- যারা আমাদের অন্ন যোগায়। ফসল ফলায়।
তাঁর ছবিতে গ্রামীণ রমণীদের দেখা যায় সুডৌল ও সুঠাম গড়নে। নারীর মধ্যে উপস্থিত চিরাচরিত রূপলাবণ্যের সাথে তিনি শক্তির সম্মিলন ঘটিয়েছিলেন। একই সাথে তাঁর এ ছবিগুলোতে গ্রামীণ প্রেক্ষাপটের শ্রেণী-দ্বন্দ্ব এবং গ্রামীণ অর্থনীতির কিছু ক্রুর বাস্তবতা উঠে এসেছে। তাঁর এরকম দুটি বিখ্যাত ছবি হচ্ছে: হত্যাযজ্ঞ (১৯৮৭) এবং চরদখল(১৯৮৮)।
১৯৭৬ সালে তাঁর আঁকা শিল্পকর্ম নিয়ে শিল্পকলা একাডেমীর প্রদর্শনীতে তাঁর ছবির মহিমা নতুন করে প্রস্ফুটিত হয়। এই ছবিগুলোর মধ্যে দেখা যায় বিশ্বের কেন্দ্র হচ্ছে গ্রাম আর সেই কেন্দ্রের রূপকার কৃষককে আপন মহিমায় সেখানে অধিষ্ঠিত দেখা যায়। গ্রাম ও গ্রামের মানুষ ছিলো তাঁর শিল্পকর্মের অনুপ্রেরণা আর উপকরণ ছিলো কৃষক এবং কৃষকের জীবন চেতনা। এস এম সুলতান তেলরঙ এবং জলরঙ-এ ছবি আঁকতেন। আঁকার জন্য তিনি একেবারে সাধারণ কাগজ, রঙ এবং জটের ক্যানভাস ব্যবহার করেছেন। এজন্য তাঁর অনেক ছবিরই রঙ নষ্ট হয়ে যাচ্ছিলো, যদিও এসবের প্রতি তিনি তেমন ভ্রুক্ষেপ করতেন না।
এস এম সুলতান আধুনিকতার একটি নিজস্ব সংজ্ঞা গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর তেমন কোনো অনুসারী ছিলোনা যারা একই সংজ্ঞা মেনে শিল্পচর্চা করতেন। একারণেই তাঁর প্রতিষ্ঠিত আধুনিকতার স্বরূপ নিয়ে নতুন কোনো ধারার সৃষ্টি হয়নি। কেউ তাঁর মতো করে আধুনিকতার ব্যাখ্যাও দেননি। এছাড়া তাঁর মতো মাটির জীবন তখনকার কোনো শিল্পী যাপন করেননি। তাঁর কাছে আধুনিকতার সংজ্ঞা কেমন ছিলো তা বলতে গিয়ে বাংলাপিডিয়ায় তাঁর জীবনীর লেখক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম লিখেছেন:
তাঁর কাছে অবয়বধর্মিতাই প্রধান। তিনি আধুনিক, বিমূর্ত শিল্পের চর্চা করেননি; তাঁর আধুনিকতা ছিলো জীবনের শাশ্বত বোধ ও শিকড়ের প্রতিষ্ঠা করা। তিনি ফর্মের নিরীক্ষাকে গুরুত্ব দেননি, দিয়েছেন মানুষের ভেতরের শক্তির উত্থানকে, ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই এবং ঔপনিবেশিক সংগ্রামের নানা প্রকাশকে তিনি সময়ের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থাপন করেছেন। এটাই তাঁর কাছে ছিলো 'আধুনিকতা', অর্থাৎ তিনি ইউরো-কেন্দ্রিক, নগর নির্ভর, যান্ত্রিকতা-আবদ্ধ আধুনিকতার পরিবর্তে অন্বেষণ করেছেন অনেকটা ইউরোপের রেনেসাঁর শিল্পীদের মতো মানবের কর্মবিশ্বকে।
শিল্পী এস এম সুলতান শেষ জীবনে বলে গিয়েছেন:
আমি সুখী। আমার কোনো অভাব নেই। সকল দিক দিয়েই আমি প্রশান্তির মধ্যে দিন কাটাই। আমার সব অভাবেরই পরিসমাপ্তি ঘটেছে।
 

সিডও সনদে সংরক্ষণ-প্রত্যাহার জরুরী -সুমি খান


“কেউ নারী হয়ে জন্মায় না। তাকে নারী করে তোলা হয়…” নারীবাদের বেশিরভাগ সমর্থক সিমন দ্য ব্যুভেয়ারের এই অসামান্য পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত। নারী-পুরুষ হয়ে জন্মানো  এখনো কারো নিজের কৃতিত্ব নয় । ভবিষ্যতে বিজ্ঞানীরা যদি এমন কিছু আবিষ্কার করেন, হয়তো তখন স্বেচ্ছা জন্মের সুযোগ থাকতে পারে। কিন্তু  এখনো নেই। 
তবে সমাজপতিদের নির্দেশনায় 'সভ্যসমাজ' একটি কন্যাশিশুকে ফ্রক পরিয়ে, পুতুল খেলতে দিয়ে, ঘরকন্নায় ব্যস্ত রেখে, ঘরের কোণে আটকে রেখে ধীরে ধীরে  একটি ' অনুগত নারী' হিসেবে গড়ে তোলে।
এর বিরুদ্ধে সঙঘবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে নারী-পুরুষের সমান অধিকার আদায়ের সংগ্রাম এবং  সমান অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠার সংঘবদ্ধ আন্দোলনের ইতিহাস  সমৃদ্ধ হলেও খুব প্রাচীন নয়।

 গত শতকের বিশের দশকে আমেরিকার নারীরা ভোটাধিকার অর্জন করে। এর ধারাবাহিকতায় ষাটের দশকে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে নারী সমাজে ব্যাপক সচেতনতার সৃষ্টি হয়। নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন, প্রতিষ্ঠান নারী-পুরুষের সমঅধিকারের দাবিতে বিশ্বের নানা প্রান্তে আন্দোলন গড়ে তোলে। 

ক্লারা জেটকিন, জার্মান সমাজতান্ত্রিক দলের নারী শাখার অন্যতম নেত্রী, ১৯১০ সালে কোপেনহেগেনে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে প্রথম নারী দিবস পালনের কথাটি উত্থাপন করেন। তিনি প্রস্তাব দেন প্রত্যেক দেশে নারীর অধিকার আদায়ের জন্য একটি নির্দিষ্ট দিবস থাকা প্রয়োজন । সেই সম্মেলনে ১৭টি দেশ থেকে আসা শ’খানেক নারী ক্লারা জেটকিনের এই প্রস্তাবে সমর্থন জানান।


এর ভিত্তিতেই গত শতাব্দীর প্রথম দিকে, ১৯ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হলেও পরে, ১৯১০ সালের ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার জন্য প্রস্তাব গৃহীত হয়। এরপর, ১৯৭৫ সালে প্রথমবারের মতো মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম বিশ্ব নারী সম্মেলন। এই সম্মেলনে ১৯৭৬-১৯৮৫ সময়কাল ‘‘নারী দশক’’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
অন্যদিকে জাতিসংঘ নারীর রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ১৯৭৫ সালটি ‘‘আন্তর্জাতিক নারী বর্ষ’’ হিসেবে ঘোষণা করে। এরই ধারাবাহিকতায় জাতিসংঘ কর্তৃক ১৯৮১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ‘সিডও সনদ’ বা নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য নিরসন সনদ পরিগৃহীত হয়। এ সনদকে

 বলা হয় ‘উওম্যানস বিল অব রাইটস’।এতে ৩০ টি ধারা রয়েছে।এর ১ থেকে ১৬ নম্বর ধারা পর্যন্ত নারী -পুরুষের সমতা-সংক্রান্ত নীতিমালা বর্ণিত আছে। 

বাংলাদেশে নারী অধিকার নিয়ে আন্দোলনরত সংগঠনগুলোর অব্যাহত চাপের মুখে সরকার ১৯৮৪ সালের ৬ নভেম্বর সিডও সনদ স্বাক্ষর করে। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই ঐতিহাসিক স্বাক্ষর করার সময়ে ৩ টি ধারার ৪ টি উপধারা সম্পর্কে সংরক্ষণমূলক নীতি অবলম্বন করে বাংলাদেশ। ধারাগুলো হচ্ছে– ২, ১৩.১ (ক), ১৬.১ (গ), (চ)। ২ নম্বর ধারাতে বর্ণিত আছে– বৈষম্য বিলোপের লক্ষ্যে রাষ্ট্র কর্তৃক যথাযথ নীতি ও পদ্ধতি গ্রহণ। সনদের ২ ধারার সাতটি উপধারায় সংবিধান ও অন্যান্য আইনে নারী-পুরুষের সমানাধিকারের নীতি গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন, বৈষম্য নিষিদ্ধ করার জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থাসহ আইনগত ও অন্যান্য পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা আছে। এছাড়া রয়েছে সমানাধিকারের আইনগত সুরক্ষা প্রতিষ্ঠায় আদালত, ট্রাইব্যুনাল এবং অন্যান্য সরকারি সংস্থার মাধ্যমে যে কোনো বৈষম্যমূলক কাজের বিরুদ্ধে কার্যকর সুরক্ষা নিশ্চিত করা,নারীর প্রতি বৈষম্য সৃষ্টি করে বিদ্যমান এমন আইন, বিধান, সংশোধন বা বাতিল করার জন্য আইন প্রণয়নসহ উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ এবং এমন সব ফৌজদারি বিধিবিধান বাতিল। ধারা ১৩ .১(ক) পারিবারিক কল্যাণের অধিকার। ১৬.১ (গ) ধারায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ও বিচ্ছিন্ন হওয়ার ব্যাপারে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হয়। আর এই ধারা (চ) অনুচ্ছেদে অভিভাবকত্ব, সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়কত্ব ও পালক সন্তান গ্রহণ অথবা জাতীয় আইনে যেখানে অনুরূপ ধরনের ধারণা বিরাজমান রয়েছে সে সব ক্ষেত্রে সমান অধিকার ও দায়িত্ব, সব ক্ষেত্রেই সন্তানের স্বার্থ হবে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। সরকার কর্তৃক সংরক্ষিত চারটি অনুচ্ছেদ সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের আন্দোলনে নতুন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। এর প্রেক্ষিতে নারী সংগঠনগুলোর ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলে ২ ও ১৬.১ (গ) অন্য দুটি ধারার ওপর থেকে আপত্তি তুলে নেওয়া হয় ১৯৯৭ সালে। 

 ২টি ধারার সংরক্ষণসহ সিডও সনদের স্বীকৃতি মূল সনদের চেতনার সঙ্গে কোনভাবেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। জাতিসংঘের নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ বা সিডওর গুরুত্বপূর্ণ দুটি ধারা থেকে সংরক্ষণ প্রত্যাহার করার জন্য আইন কমিশন সরকারকে সুপারিশ পাঠিয়েছে ২০১৩ সালে। এর বিপরীতে সরকার এখন পর্যন্ত এ সুপারিশ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি এবং কমিশনকেও এ বিষয়ে কিছু জানায়নি।
 
আইন কমিশনের সর্বশেষ সুপারিশে বলা হয়েছে, ধারা ২ পুরোটি কোন্ অর্থে 'কোরআন ও সুন্নাহবিরোধী' তার ব্যাখ্যা দেয়নি বাংলাদেশ। অন্য কোনো মুসলিম রাষ্ট্র পুরো ২ ধারাটি 'কোরআন-সুন্নাহবিরোধী' বলে চিহ্নিত করেনি, তা প্রত্যাখ্যান করেনি। এই সনদের সিগনেটরি অন্যান্য দেশ, জার্মানি, বেলজিয়াম, সুইডেন, মেক্সিকো, নেদারল্যান্ডস এই শর্ত সংরক্ষণের বিরোধিতা করে আপত্তিও জানিয়েছে। ধারা ১৬ (১) গ বিষয়ে বলা যায়, এ ধারা সম্পূর্ণভাবে 'কোরআন ও সুন্নাহভিত্তিক শরীয়াহবিরোধী' বলা যাবে না। কেননা দেশে প্রচলিত আইনেই নারীর অনেক অধিকার রয়েছে।
  কমিশনের সদস্য শাহ আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, ১৯৯৬ সালের 'আইন কমিশন আইন' অনুযায়ী কোনো বিষয়ে কমিশন সুপারিশ দিলে সরকার প্রতি বছর সংসদের প্রথম অধিবেশনে কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন সংসদে পেশ করবে। তবে কমিশনের পক্ষ থেকে গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে আইন মন্ত্রণালয় এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠানো হলেও এ দুটি মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অবস্থান হচ্ছে, ‘‘সিডও সনদ বিষয়ে আইন কমিশনের সুপারিশ আমরা পেয়েছি। তবে তা এখনও বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। চার বছর পরপর প্রতিবেদন পাঠানোর বাধ্যবাধকতায় আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘ সিডও কমিটির কাছে বাংলাদেশকে প্রতিবেদন পাঠানোর কথা। সরকার সে প্রতিবেদন তৈরির কাজ করছে। সংরক্ষণ প্রত্যাহারের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’’
অন্যান্য বারের মতো সরকার সর্বশেষ প্রতিবেদনেও (২০১০) সিডও কমিটির কাছে সংরক্ষণ প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এবারও সরকার বলেছে, সংরক্ষণ প্রত্যাহারের বিষয়টি বিবেচনা করছে। অন্যদিকে ২০১১ সালের জানুয়ারিতে জেনেভায় জাতিসংঘ সিডও কমিটির ৪৮তম অধিবেশনে সরকারের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি করণীয় সম্পর্কে সিডও কমিটি সমাপনী সভায় বরাবরের মতো বাংলাদেশ সরকারকে সংরক্ষণ প্রত্যাহারের তাগিদ দিয়েছে।
পারিবারিক বিষয়ে সমন্বিত আইন না থাকায় মুসলিম আইন, খ্রিস্টান আইন ও হিন্দু আইন ইত্যাদি ধর্মীয় আইন দ্বারা ওই সব ধর্মের অনুসারীরা তাদের পারিবারিক বিষয়াদি পরিচালনা করে এবং প্রতিটি ধর্মীয় পারিবারিক আইনেই নারীর প্রতি চরম বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। ১৬ ধারার সংরক্ষণ এরূপ বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে উৎসাহিত করেছে বলে মনে করা হয়।
অন্যদিকে, সিডও সনদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারা হচ্ছে ২ নম্বর ধারাটি। ১৬ এবং ২ নম্বর– এই ধারা দুটো অনুমোদন না করার ক্ষেত্রে শাসক শ্রেণির যুক্তি হচ্ছে, এগুলো ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের অনুভূতিতে আঘাত হানতে পারে। 

অন্যান্য অনেক মুসলমান অধ্যুষিত দেশ সিডও সনদের সম্পূর্ণ অনুমোদন দিলেও, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ (যেহেতু ইসলামিক রিপাবলিক নয়) কেন সংরক্ষণ ব্যতীত অনুমোদন দিতে পারছে না সেটাই আশ্চর্যজনক। বাংলাদেশ  'শরীয়া আইন' দ্বারা পরিচালিত নয়।
 আমাদের সংবিধানের ১০ , ১৯, ২৭, ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদ সমূহ শোষণমুক্ত এবং নারী-পুরুষের বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের কথা বলে।
সিডও সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ও অবস্থা পর্যালোচনামূলক দায়িত্বের অংশ হিসেবে প্রতি ৪ বছর পরপর সিডও কমিটির কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে হয়। পরবর্তী প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় বাংলাদেশ সরকার হয়তো সংরক্ষণ সংক্রান্ত নীতি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এ অবস্থান পরিবর্তন করবে– এমন আশা করছেন সিডও নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো। সংরক্ষণ প্রত্যাহার করলেই সত্যিকার অর্থে কার্যকর হবে সিডও সনদ। 

 

নারী দিবস, সিডও সনদের বার্ষিকী পালনের আয়োজনের জৌলুসের পাশাপাশি নারীর অবস্থান ও অবস্থা পরিবর্তনে আন্তরিক প্রয়াস কাম্য। কেননা লিঙ্গবৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রধানতম হাতিয়ার।


Thursday, October 9, 2014

রাজিয়া ও আলিমার জঙ্গি প্রশিক্ষণ হয়েছিল পাকিস্তানের ওয়াজিরিস্থানে:সুমি খান



রাজিয়া ও আলিমার জঙ্গি প্রশিক্ষণ হয়েছিল পাকিস্তানের ওয়াজিরিস্থানে :চট্টগ্রাম, মুম্বই, চেন্নাই ও কাশ্মীরে যোগাযোগের সূত্র



কোলকাতার তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা নুরুল হাসান চৌধুরীর বর্ধমানের বাড়িতে বোমা বানানোর সময়ে নিহত বাংলাদেশের দুই জঙ্গী শাকিল আহমেদ এবং সোবহান মন্ডলের স্ত্রী রাজিয়া ও আলিমা পুলিশ হেফাজতে বিস্তারিত তথ্য দিচ্ছে বলে জানিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ। এর সূত্র ধরে পলাতক চার জঙ্গীকে খুজছে ভারতের পুলিশ।  হিন্দুস্থান টাইমসের সংবাদে প্রকাশ,  বাংলাদেশে সতর্কবার্তা পাঠিয়েছে দিল্লি।গোয়েন্দা হেফাজতে শাকিল আহমেদ এবং সোবহান মন্ডলের স্ত্রীরা জানিয়েছেন, দশ বছর আগে বাংলাদেশে জেএমবি’র সদস্যপদ গ্রহণ করে আলিমা ও রাজিয়া। তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল পাকিস্তানের ওয়াজিরিস্থানে। হাতের নাগালে পাওয়া রাসায়নিক দিয়ে কীভাবে প্রাণঘাতী বিস্ফোরক তৈরি করা যায়, সেই পদ্ধতি রাজিয়া ও আলিমা শিখেছিল ওয়াজিরিস্থানের শিকক এলাকায় । সেখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশে ফেরে তারা। এদিকে বাংলাদেশের জঙ্গী সংগঠনের সাথে তৃণমূল নেতাদের সংশ্লিষ্টতা উদ্ঘাটন করে এই বোমা হামলা তদন্ত করার মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি কে ‘জিহাদী দিদি’ সম্বোধন করে এ ঘটনায় রাজ্য প্রধান হিসেবে তার জবাবদিহিতা দাবি করেছেন সিনিয়র বিজেপি নেতা সুব্রাহ্মনীয়াম স্বামী ।  এই বোমা হামলার ঘটনায় বাংলাদেশী জঙ্গী সম্পৃক্ততার সূত্র নিশ্চিত করতে একই সাথে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের গভীর তদন্ত দাবি করেছে সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটি।
গোয়েন্দা সূত্রে খবর, রাজিয়া ও আলিমার জঙ্গি প্রশিক্ষণ হয়েছিল পাকি¯তানের ওয়াজিরিস্থানে। সুন্দরবন দিয়ে নৌপথে বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রচুর অস্ত্র ঢুকেছে বলেও জানতে পেরেছে  ভারতের পুলিশ। একই সাথে জঙ্গিবাদে উঠে আসছে বাংলাদেশ ভারত সীমান্তবর্তী এলাকার একাধিক ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম। বর্ধমানের গ্রেনেড কারখানায় বিস্ফোরণ। তার থেকেই মিলল বিশাল এক জঙ্গি নেটওয়ার্কের ইঙ্গিত। তদন্ত যত এগোচ্ছে, ততোই একের পর এক রহস্য উন্মোচিত হচ্ছে। জঙ্গিযোগের একের পর এক তথ্য বেরিয়ে আসছে। খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণস্থলে উদ্ধার সিমকার্ডের কললিস্ট খতিয়ে চট্টগ্রাম, মুম্বই, চেন্নাই ও কাশ্মীরে যোগাযোগের সূত্র পেয়েছে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ।
ঢাকায় ভারতীয় হাই-কমিশনের কাছে বর্ধমান বিস্ফোরণের যাবতীয় তথ্য-প্রমাণ চেয়ে পাঠিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। বুধবার ঢাকায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, বাংলাদেশ সরকার বিস্ফোরণ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানতে চেয়েছে। বাংলাদেশের কেউ এর সঙ্গে জড়িত কিনা এবং সন্ত্রাসবাদ দমনে বাংলাদেশ ভারতকে কী ভাবে সাহায্য করতে পারে তা জানতে চাওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের গোয়েন্দা রিপোর্টেই বলা হয়েছে, বর্ধমান-বোমা বিষ্ফোরণ ঘটনায় বাংলাদেশের জঙ্গিরা যুক্ত।
 শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে জঙ্গিদমনে জোর তৎপরতা বাড়লে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে ঢুকে পড়ে  শাকিল আহমেদ এবং সোবহান মন্ডলের স্ত্রী  রাজিয়া, আলিমা ও তাদের সঙ্গীরা। জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ ও সন্ত্রাসবাদী মতাদর্শে মগজধোলাইয়ের ঘটনায় উঠে আসে বেশ কিছু ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামও। বর্ধমানের বোমা হামলা তদন্ত করতে গিয়ে গোয়েন্দা সূত্রে এসব তথ্য  বেরিয়ে আসছে। গত ২ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের খয়ড়াগড়ায় বোমা বানাতে গিয়ে  দুই বাংলাদেশি জঙ্গি নিহত হয়েছে বলে ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়।  বর্ধমানে বোমা বিস্ফোরণের পেছনে বাংলাদেশের জঙ্গিদের হাত রয়েছে বলেও গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। ভারতের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, জঙ্গি তৎপরতা আটকাতে যে প্রশাসনিক যে উদ্যোগ নেওয়া উচিত,পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকার তা নেয়নি বলে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের সরকারকে দায়ী করেছেন ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম জনকন্ঠকে বলেন , ভারত, বাংলাদেশ , মায়ানমার এবং পাকিস্তানের আল-কায়দা অনুসারীরা সিøপিং সেল পদ্ধতিতে একসাথে সমান্তরাল ভাবে  কাজ করছে। এই পদ্ধতিতে এক বাহিনীর কাজ অন্য বাহিনী জানতে পারে না।

যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় সন্ত্রাসবাদ দমনে ২০০৮-এর ৩১ ডিসেম্বর ভারতে গঠন করা হয় ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি। ন্যাশনাল কাউন্টার টেররিজম সেন্টার গঠনের প্রাথমিক ধাপ হিসাবে  তৈরি এনআইএ জাতীয় স্বার্থে সে দেশের যে কোনও প্রান্তে তদন্ত করতে পারে। সাধারণভাবে, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার চাইলে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে সংশ্লিষ্ট ঘটনার তদন্ত শুরু করে এনআইএ। তবে, ভারতের কেন্দ্র  সরকার যদি মনে করে কোনও ঘটনায় রাষ্ট্রের বিরদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, তাহলে রাজ্যকে অগ্রাহ্য করে এনআইকে তদন্তের দায়িত্ব দিতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আঘাত লাগবে, এই যুক্তিতে বর্ধমান-বোমা হামলা ঘটনার ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ)‘র তদন্তে আপত্তি জানিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বাধীন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার। এরপরও যদি এনআইএ বর্ধমান বিস্ফোরণের তদন্ত শুরু করে,সেটাই হবে ভারতের ইতিহাসে প্রথম ঘটনা- যেখানে রাজ্যের আপত্তি সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের নির্দেশে তদন্ত করবে ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ)। বর্ধমান-বোমা বিষ্ফোরণ ঘটনায় বাংলাদেশি জঙ্গিদের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। তাই, খাগড়াগড় বিস্ফোরণকে শুধুমাত্র রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলার ব্যাপার বলে দেখা উচিত নয়। জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই এনআইএ তদন্ত জর–রি বলে মনে করছেন  ভারতের রাজনীতিক এবং  বিশেষজ্ঞরা।

রাজ্যের আপত্তি অগ্রাহ্য করে কেন্দ্রের নির্দেশে এনআইএ কোনও ঘটনার তদন্ত করছে, এমন নজির এখনও পর্যন্ত ভারতে নেই। ২০১৩ সালের  অক্টোবরে পাটনার গান্ধী ময়দানে নরেন্দ্র মোদির সভায় বিস্ফোরণের তদন্ত প্রথমে এনআইএ-কে দিতে চায়নি বিহার সরকার। যদিও, পরে এনআইএকে তদন্ত করতে দিতে রাজি হন বিহারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী  নীতীশ কুমার। গত মে মাসে চেন্নাই সেন্ট্রাল রেল স্টেশনে বেঙ্গালুরু-গুয়াহাটি এক্সপ্রেসে বিস্ফোরণের পর এনআইএ’র তদন্তে আপত্তি জানান তামিলনাড়–র তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা। পরে রাজ্যের সম্মতি নিয়ে ঘটনাস্থলে যান এনআইএ-র গোয়েন্দারা।  রাজ্যের সম্মতি নিয়ে সন্ত্রাসবাদ সংক্রান্ত চুরাশিটি মামলার তদন্ত করছে ভারতের এনআইএ। রাজ্য সরকারের সম্মতির ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গে দুটি ঘটনার তদন্ত করছে এনআইএ। কোলকাতার কলেজ স্ট্রিটে মাওবাদী নেতা সদানলা রামকৃষ্ণকে গ্রেফতার এবং দক্ষিণ কলকাতার একটি পাঁচতারা হোটেলে হুমকি দিয়ে চাঁদা চেয়ে ইন্ডিয়ান মুজাহেদিনের নামে ফোন করার ঘটনার তদন্ত করছে ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ)।
তদন্ত একটু এগোতেই বোঝা যায় বর্ধমান-কান্ড মামুলি ঘটনা নয়। তদন্তে সিআইডির অধীনে টাস্ক ফোর্স গঠন করে রাজ্য সরকার। বিস্ফোরণের খোঁজখবর করতে গিয়ে রাজ্য পুলিসের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ করেন এনআইএ-র অফিসাররা। ভারতীয় গণমাধ্যমের সংবাদে প্রকাশ, ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ)’র অভিযোগ উড়িয়ে দেন ভারতের স্বরাষ্ট্রসচিব। স্বরাষ্ট্রসচিব এ কথা বললেও তা মানতে নারাজ কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলি। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংকে বর্ধমানের বোমা বিষ্ফোরণের রিপোর্ট দিয়েছে তারা। তাতে  পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর অভিযোগ আনা হয়েছে। বলা হয়েছে, ঘটনার গুরুত্ব বুঝতেই ব্যর্থ হয়েছে রাজ্য সরকার। নেওয়া হয়নি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও। পুলিসি বাধায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করা যায়নি বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।

২০০১ সালের  ২৩ জুলাই ভারতের  তিলজলায় নিজের কারখানার কাছে অপহৃত হন খাদিম কোম্পানীর কর্মকর্তা পার্থ রায়বর্মণ। মুক্তিপণের জন্য শিল্পকর্তার অপহরণের সেই ঘটনার তদন্তে জঙ্গি সম্পৃক্ততার প্রমাণ পান তদন্তকারী দল।
২০০২ সালের ২২ জানুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আমেরিকান সেন্টারে জঙ্গী হামলার ঘটনা এখনো সেই  রাজ্যে সন্ত্রাসবাদী হামলার সবচেয়ে বড়ো ঘটনা। স্বয়ংক্রিয় রাইফেল নিয়ে আমেরিকান সেন্টারে হামলা চালায় বাইকে সওয়ার সশস্ত্র জঙ্গিরা। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যান আমেরিকান সেন্টারের বেশ কয়েকজন নিরাপত্তারক্ষী।
২০১৩ সালের একাধিক ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গে জঙ্গি তৎপরতার প্রমাণ পেয়েছে ভারতের পুলিশ এবং গোয়েন্দা দল। তদন্ত রিপোর্টে প্রকাশ, গত একদশক ধরে ভারতে নাশকতা করে জঙ্গীদের পালানোর পথ হিসেবে বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন পশ্চিমবঙ্গকে ব্যবহার করেছে জঙ্গিরা।অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশ থেকে অনায়াসেই পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে ভারতের  বিভিন্ন  প্রদেশে ছড়িয়ে যায় জেএমবি জামায়াতের জঙ্গীরা এ তথ্য জনকন্ঠকে জানিয়েছে জেএমবির জঙ্গীরাও।
ভারতের মুম্বই ধারাবাহিক বিস্ফোরণ,হায়দরাবাদের মক্কা মসজিদ বিস্ফোরণের ক্ষেত্রে জঙ্গিরা পশ্চিমবঙ্গকেই যাতায়াতের রাস্তা হিসেবে ব্যবহার করেছিল বলে নিশ্চিত হয়েছে ভারতের গোয়েন্দারা। পশ্চিমবঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীগুলির একাধিক সিøপিং সেলের সক্রিয়তা নিয়ে বারবার সতর্ক করেছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলি।
বাংলাদেশে রাষ্ট্রক্ষমতায় পালাবদলের পর পরিস্থিতির বদল হয় বলে জানায় ভারতের গোয়েন্দারা ।তাদের মতে,  বাংলাদেশে  আ্ওয়ামীলীগ প্রধান শেখ হাসনিার নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর জঙ্গিগোষ্ঠীগুলিকে কঠোরহাতে দমন করে শেখ হাসিনা সরকার। গোয়েন্দা সূত্রে খবর, সে সময় বাংলাদেশ থেকে বহু জঙ্গিনেতা পালিয়ে এসে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেয়। গত কয়েক বছরে একাধিক ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গে জঙ্গি সক্রিয়তার প্রমাণ পেয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা।
২০১২ সালের ৮ এপ্রিল তারিখে মেটিয়াবুরুজের মসজিদ তালাওয়ে এলাকায় বোমা তৈরির সময় বিস্ফোরণে দু‘জনের মৃত্যু হয়। ১২ জুলাই ২০১২ তারিখে মেটিয়াবুরুজ বিস্ফোরণের তদন্তে কলকাতায় গ্রেফতার সিমি নেতা হারুণ অররশিদ।২০ ডিসেম্বর ২০১২ তারিখে কলকাতার প্রিন্সেপ ঘাটে গ্রেফতার হুজি জঙ্গি মিজানুর রহমান । ২০১৩ সালের ১৯ ও ২৩ মে দার্জিলিং জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে পাঁচ আইএসআই চরকে গ্রেফতার করে ভারতীয় পুলিস।

তার ই ধারাবাহিকতায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান এলাকায় বিস্ফোরণ ঘটনায় চাঞ্চল্যকর তথ্য পাচ্ছেন গোয়েন্দারা।
বর্ধমান বিস্ফোরণ নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে গোয়েন্দাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে। বর্ধমানের ঘটনায় যুক্ত ভারতের ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন, বাংলাদেশের জামাতুল মুজাহিদিন এবং পাকিস্তানের আল কায়দার শাখা আল জিহাদ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে অভিন্ন ইসলামিক রাষ্ট্র তৈরির আদর্শে হাত মিলিয়েছে এই তিনটি জঙ্গি সংগঠন।এই জিহাদি আদর্শেই দীক্ষিত ছিল পশ্চিমবঙ্গের খাগডাগড়ের ভাড়াবাড়িতে আশ্রয় নেয়া জঙ্গিরা।
২০১৩ সালের শুরুতে পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া, মুর্শিদাবাদ ও মালদহের সীমান্তবর্তী কিছু ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশের মৌলবাদী সংগঠন হেফাজতে ইসলামির কিছু সংগঠক। বাংলাদেশে জামায়াত নিষিদ্ধ ঘোষণা হবার গুঞ্জন এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবার পর থেকে জেএমবি এবং হেফাজতে ইসলামির আডালেই জামাত নেতারা জঙ্গীবাদ প্রচার করতে থাকে। তবে শুধুমাত্র স্থলসীমান্ত নয়, সন্ত্রাস আমদানিতে কার্যত অরক্ষিত জলপথকে ব্যবহারের সুযোগও ছাড়েনি জঙ্গিরা। গোয়েন্দা সূত্রে প্রকাশ, কয়েকমাস আগেই চট্টগ্রাম থেকে জলপথে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র সুন্দরবনের খাঁড়িতে এসেছিল। সে অস্ত্র কোথায় গেল বা কী কাজে ব্যবহার হল তা খতিয়ে দেখছে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ।
ভারতীয় গণমাধ্যমে এ নিয়ে তোলপাড় চললেও আসাদুজ্জামান খান জনকন্ঠকে বলেন, ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো কিছু জানায়নি। অফিসিয়ালি জানানোর পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

গত ২ জুলাই ২০১৪ চিত্পুরের কলকাতা স্টেশন থেকে গ্রেফতার হয় জার্মান বেকারি বিস্ফোরণে অভিযুক্ত ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন জঙ্গি জাহিদ হুসেন। ১৬ অগাস্ট ২০১৪ দিল্লী পুলিস জানিয়েছে আলিপুর জেলে বসেই স্মার্ট ফোনের স্কাইপে সফটওয়্যারের মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে লস্কর জঙ্গি আর্শাদ খান ও সওকত।
আইমান জাওয়াহিরি গত ছয় মাসে দুইটি ভিডিও বার্তায় জোর আত্মবিশ্বাসে দাবি করেছেন বাংলাদেশে তাদের  বেশ কিছু জঙ্গী সংগঠক রয়েছে। এতে বলা হয়েছে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) দক্ষিণ এশিয়া শাখা সংগঠিত করে ভারত, পাকিস্তান বাংলাদেশে সমন্বিত জঙ্গী তৎপরতা সংগঠিত করে বাংলাদেশে বড়ো ধরণের নাশকতা করার প্রস্তুতি নিয়েছে ইসলামিক স্টেটস (আইএস)। তারই প্রমাণ উঠে আসছে একের পর এক বিষ্ফোরণকে কেন্দ্র করে তদন্ত প্রতিবেদনে। এর আগে তৃণমূল নেতা এবং সংসদ সদস্য  ইমরানের মাধ্যমে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বিপুল আর্থিক বিনিয়োগের তথ্য প্রমাণ পেয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয়  গোয়েন্দাদল।
 ভারত সরকার বিস্তারিত তথ্য জানানোর পর বাংলাদেশের গোয়েন্দারা তদন্তে নামবেন বলে জানা গেছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার  মনিরুল ইসলাম জনকন্ঠকে বলেন, বাংলাদেশ সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশনা পেলে তারা পশ্চিমবঙ্গে বোমা হামলায় নিহতদের অনুসন্ধানে মাঠে নামবেন। ০৯.১০.২০১৪

Wednesday, October 1, 2014

জামায়াতের কাছে সারদা গ্রুপের অর্থের চালান তদন্তে এনএসআই তদন্ত দল কোলকাতায়-সুমি খান

বাংলাদেশে জামায়াতের কাছে সারদা গ্রুপের অর্থের চালান তদন্তে ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এনএসআই এর তিন কর্মকর্তার সমন্বয়ে একটি তদন্ত দল কোলকাতায় কাজ শুরু করেছে।এদিকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা প্রশ্নে জামায়াত এবং জঙ্গীবাদের অর্থায়নে নজরদারীর জন্যে এখনো সরকারের উচ্চপর্যায়ে কোন উদ্যোগ নেই।  কাউন্টার টেররিজম নিয়ে এখনো সরকারের উচ্চপর্যায়ে কোন টীম গঠিত হয়নি বলে জনকন্ঠকে জানালেন স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল।
পশ্চিমবঙ্গ আমাদের প্রতিবেশী । মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে অভিযুক্ত  উগ্র সাম্প্রদায়িক দল জামায়াতের সাথে পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর আর্থিক লেনদেন বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্যে উদ্বেগজনক -বললেন স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল । তিনি বলেন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা প্রশ্নে বিষয়টি উদ্বেগ জনক । তবে  এ বিষয়গুলো তদন্তে উচ্চপর্যায়ে টীম গঠন করা সম্ভব হয়নি। তার  দাবি, সরকারী কাজ;  ইচ্ছে করলেও জরুরীভাবে করা সম্ভব হয়না। তাই বিষয়টি সময়সাপেক্ষ বললেন স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী।

 সাম্প্রতিক সময়ে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ আইএস এবং নুসরা সংগঠক গ্রেফতারের পর সরকার এ  নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং  রাষ্ট্রের নিরাপত্তা প্রশ্নে  জরুরী ভাবে কাউন্টার টেররিজম টীম গঠনে তৎপর বলে জানান তিনি। এ ব্যাপারে মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম জনকন্ঠকে বলেন,  মহানগর গোয়েন্দা দলের নিজস্ব কাউন্টার টেররিজম টীম গঠন করে দেশে  আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আল-কায়দার অনুসারীদের  জঙ্গী তৎপরতার তথ্যপ্রমাণ অনুসন্ধান করছি আমরা। তবে এই জঙ্গীদের অর্থের উৎস অনুসন্ধান এবং এই উগ্রবাদী জঙ্গীদের শেকড়ের সন্ধানে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে কোন সুষ্পষ্ট নির্দেশনা আমরা এখনো  পাইনি। এ কারণে আমাদের তেমন কিছু করার নেই ।
সম্প্রতি  গ্রেফতারকৃত আল-কায়দা, আইএস এবং সিরিয়ার  আত্মঘাতী জঙ্গী সংগঠন জাভাত -আল-নুসরা ফ্রন্টের সক্রিয় জঙ্গী সদস্য সামিয়ুন রহমানের ব্যাপারে সিরিয়া পুলিশ এবং ইন্টারপোলের সহযোগিতা নেয়া হবে কিনা জানতে চাইলে মনিরুল ইসলাম  জনকন্ঠকে বলেন, এই জঙ্গীকে রিমান্ডে আনা হয়েছে। তার ব্যাপারে নিঃসন্দেহে গভীর অনুসন্ধান প্রয়োজন। তবে উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনা না পেলে , আমরা এ ব্যাপারে এগুতে পারি না। এক্ষেত্রে আমাদের কিছু করণীয় নেই।
এদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী তার সাম্প্রতিক নয়াদিল্লী সফরে জামায়াতকে সারদা গ্রুপের অর্থ দেবার অভিযোগ তদন্তের দাবি তোলেন ভারত সরকারের  কাছে । এ এইচ মাহমুদ আলী ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোতালকে বলেন, “বংলাদেশের ৫ জানুয়ারীর নির্বাচন বানচালে বড়ো ধরণের নৈরাজ্য ঘটাতে তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ক আহমেদ হাসান ইমরানের মাধ্যমে বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর কাছে সারদা গ্রুপের  বড়ো অংকের অর্থ গেছে।” ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ের এক কর্মকর্তা  নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাংবাদিকদের বলেছেন , আমাদের নিরাপত্তার বিষয়গুলো নিয়ে বাংলাদেশের হাসিনা সরকার খুব সচেতন। তাদেও বিষয়ে আমরা অমনোযোগী হতে পারি না। ”
ভারতের আলোচিত সারদা গ্রুপের অর্থ কেলেংকারী তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশান (সিবিআই) ও এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেট (ইডি) কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন এনআইএ’র তিন কর্মকর্তা। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয় সূত্রে প্রকাশ, সারদার অর্থ কার হাত থেকে কোথায় গেছে এবং এই অর্থ লেনদেনে সম্পৃক্ত রাজনীতিকদের ভ’মিকা কী ছিল-তা এনআইএ তদন্ত দল খতিয়ে দেখছে।
জানা যায়, তৃণমূল নেতা আহমেদ হাসান ইমরানের আদি বাড়ি বাংলাদেশের সিলেটে। ইমরানের বাবা  জামায়াতে ইসলামীর সংগঠক হিসেবে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে এলাকার রাজাকার বাহিনীর নেতৃত্ব দেন বলে  সূত্রে প্রকাশ।  
স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী বলেন, সম্প্রতি ভারত সফরে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমুল সাংসদ আহমেদ হাসান ইমরানের মাধ্যমে অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান সারদার কেলেঙ্কারির টাকা বাংলাদেশে জামায়াতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ প্রসঙ্গে উচ্চ পর্যায়ে আলাপ আলোচনা হয়েছে। ইমরানের আদি বাড়ি বাংলাদেশের সিলেটে, তার বাবা একাত্তরে রাজাকার ছিল, সবই সত্য। তবে এ ব্যাপারে গভীর অনুসন্ধান এবং তদন্ত করার ব্যাপারে কোন কাজ হচ্ছে কিনা আমার জানা নেই। শীগগীর এ ব্যাপারে আমরা কাজ শুরু করবো।
ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ এবং ভারতের সীমান্তে গরু চোরাচালান ও মাদক ব্যবসায় সারদা কেলেঙ্কারির টাকার একটি বিরাট অংশ বিনিয়োগ হয়েছে। বিনিয়োগের লভ্যাংশ দেশের ভেতর অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য ব্যয় হচ্ছে বলে জেনেছেন গোয়েন্দারা। এই বিপুল বিনিয়োগের একটিই উদ্দেশ্য,  মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত করে  একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী অপশক্তি  জামায়াত নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রবর্তন।
ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের দাবি, বাংলাদেশের মৌলবাদী গোষ্ঠী জামায়াতকে দেশের ভেতর অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য কয়েক মিলিয়ন ডলার দিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। তৃণমূল এমপি আহমেদ হাসান ইমরানের মাধ্যমে  অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান সারদার কেলেঙ্কারির টাকা বাংলাদেশে জামায়াতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ হয়েছে।
ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের দাবি, বাংলাদেশের মৌলবাদী গোষ্ঠী জামায়াতকে বাংলাদেশে অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য কয়েক মিলিয়ন ডলার দিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। তৃণমূল এমপি আহমেদ হাসান ইমরানের মাধ্যমে  অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান সারদার কেলেঙ্কারির টাকা বাংলাদেশে জামায়াতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ হয়েছে।
ভারতের কেন্দ্রীয়  স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ সারদা গ্রুপের জামায়াত সম্পৃক্ততা এবং বিনিয়োগ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন বলে সূত্রে প্রকাশ। বিষয়টি বন্ধু-রাষ্ট্র ভারত এবং বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও খুব সংবেদনশীল বলে উল্লেখ করেছেন রাজনাথ সিংহ । আহমেদ হাসান ইমরান ২০০১ সালে ভারতে নিষিদ্ধ মৌলবাদী সংগঠন ‘স্টুডেন্টস ইসলামিক মুভমেন্ট অফ ইন্ডিয়া’ (সিমি)-র পশ্চিমবঙ্গ শাখার সভাপতি ছিলেন। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন  জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ভারতের  নিষিদ্ধ ছাত্র সংগঠন ইসলামিক ষ্টুডেন্টস মুভমেন্ট অফ ইন্ডিয়া (সিমি)  বহুগুণে শক্তিশালী হয়ে ভারত-বিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত।  তিনি এ ও বলেছেন , সিমির প্রাক্তন অনেক নেতা এখন তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনীতিতে যুক্ত।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নিজস্ব গোয়েন্দা বিভাগও ইমরানের বিরুদ্ধে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে একই ধরনের রিপোর্ট করেছিল। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে  পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার নলিয়াখালিতে জঙ্গি-গোষ্ঠীর সংঘর্ষের ঘটনায় ইমরানের সক্রিয় সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। তৃণমূলের আরেক সংসদ সদস্য বিখ্যাত অভিনেত্রী মুনমুন সেন পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’র এবং   পাকিস্তানের তেহরিক-ই ইনসাফ নেতা ইমরান খানের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন বলে ভারতীয় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দার সংস্থা দাবি করেছে। ভারতীয় গোয়েন্দারা বলছেন, মুনমুন, ইমরান খান এবং আইএসআই এর  ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের প্রমাণ তাদের হাতে রয়েছে।

ধর্মীয় উগ্রবাদী-অধ্যুষিত প্রদেশ খাইবার পাখতুনখাওয়াতে ইমরানের তেহরিক-ই ইনসাফের ক্ষমতায় শরিক পাকিস্তানী জামায়াত। প্রদেশটি উগ্র জঙ্গি গোষ্ঠীর স্বর্গরাজ্যে  পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি নেওয়াজ শরীফ সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আইএসআই’র প্রেসক্রিপশনে আজাদি মার্চ করে ইমরানের পিটিআই। ইমরানের উদ্যোগে অন্যায়ভাবে বহিষ্কৃত তেহরিক-ই ইনসাফের চেয়ারম্যান জাভেদ হাশ্মির গণমাধ্যমকে বলেছেন আন্দোলনটি আইএসআইয়ের নির্দেশনায় হয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের উগ্র- সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর মধ্যকার নিবিড় যোগাযোগ মুখ্যমন্ত্রী মমতার মাধ্যমেই হয়েছে মনে করছেন গোয়েন্দারা।  সারদার মাধ্যমে জামায়াতের কাছ থেকে টাকা নেওয়া দেওয়া ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি বিশ্বাসযোগ্য ঘটনা তাই প্রমাণ করে।
পাকি¯তানি হাইকমিশনারের কলকাতা সফর ও মমতার সাথে সাক্ষাতের পেছনে মুনমুন সেন ও ইমরান খানের  আগ্রহ এবং ঘনিষ্ঠতা ক্যাটালিস্ট হিসাবে কাজ করেছে। চির বৈরি পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের সাথে একজন মুখ্যমন্ত্রীর দেখা হতেই পারে। কিন্তু সেই সাক্ষাৎটি যখন আইএসআইপন্থি পাকিস্তানি রাজনীতিবিদ এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুর আগ্রহে অনুষ্ঠিত হয়, তখন এর পেছনের উদ্দেশ্য বেশ পরিষ্কার হয়ে যায়।সাক্ষাতের পরপরই কলকাতার একটি সাংবাদিক দলকে পাকিস্তান সফরের ব্যবস্থা করা হয়। কলকাতায় পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশনারের কাছে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমদের পাকিস্তান যাওয়ার ভিসা পদ্ধতি  সহজ করার অনুরোধের অভিযোগও রয়েছে মমতার বিরুদ্ধে। ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও মুসলিম বাস করেন। সেই প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীদেও কেউ পাকিস্তানী ভিসা সহজ করার অনুরোধ করেন নি। মমতা যদি সারা ভারতের মুসলিমদের জন্য ভিসা পদ্ধতি সহজ করার কথা বলতেন, কারো তেমন কিছু বলার থাকত না।  সাম্প্রতিক ভারত সফরে গিয়ে তারা দেখতে পেয়েছেন এসব নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ উত্তপ্ত -বললেন  স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল ।
বিধানসভা এবং লোকসভার নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় বাংলাদেশের জামায়াতের নেতা-কর্মীরা তৃণমূল পক্ষে কাজ করেছিল। বিশেষ করে মালদা, দক্ষিণ ও উত্তর দিনাজপুর (৬০-৮০%), মুর্শিদাবাদ জেলাতে (৯০%)সহ বাংলাদেশের সাথে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী এলাকায় জামায়াতের কর্মীরা তৃনমূলের পক্ষে গণসংযোগ করেন।ভারতের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে  সারদা ১৩০ কোটি টাকা তৃণমূলের নির্বাচনে অর্থায়ন করেছিল, যার একটি বড় অংশ বাংলাদেশের জামায়াতকে  দিয়েছিল। তিস্তা পানি চুক্তিতে আপত্তির পেছনেও অন্যতম কারণ মমতা তিস্তা তীরে বসবাসকারী ৮০ শতাংশ  ভারতীয় মুসলমানকে রাজলনৈতিক খোলার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন।
ভারতের গোয়েন্দা তথ্যে আরও প্রকাশ, তৃণমূল কংগ্রেসও নির্বাচনে জামায়াতের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়েছিল। গোয়েন্দারা এ ব্যাপারে নিশ্চিত করেছে। সারদা কেলেঙ্কারির অন্যতম মূল অভিযুক্ত কুণাল ঘোষ অর্থের আদান প্রদান বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের কল্যাণ কমিশনের সাথে কথা বলার অনুরোধ জানালেও মমতার সম্পৃক্ততা বেরিয়ে আসার আশঙ্কায়  মমতা সরকারের নির্দেশে গঠিত কল্যাণ কমিশন কুনালকে এড়িয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞ মহল মনে করছেন এবার এনআইএ’র তদন্তে বেরিয়ে আসবে  জামায়াতে সারদা গ্রুপের আর্থিক বিকিয়োগ এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্যে বড়ো ধরণের হুমকি জঙ্গীবাদে ভারতের তৃণমূল নেত্রী মমতা সহ অন্যান্য রাজনীতিকদের সম্পৃক্ততা। 

সারদা কেলেঙ্কারিতে তার তৃণমূল সংসদের জঙ্গি-বান্ধব রাজনীতিবিদ ইমরান থেকে শুরু করে মুনমুন সেনের মত অনেক সেলিব্রেটি জড়িত। যদি ইমরানের মাধ্যমে বাংলাদেশের জামায়াত টাকা নিয়ে ২০১১ সালের বিধান সভা ও ২০১৪ সালে লোকসভার নির্বাচন করেছে এমন প্রশ্ন উঠেছে।
সিরিয়া ফ্রন্টে আল-কায়দা, আইএস এবং সিরিয়ার সশস্ত্র সন্ত্রাসী জিহাদে মুজাহিদ সংগ্রহের জন্যে বাংলাদেশে আসে আইএস এবং জাভাত -আল-নুসরা জঙ্গী ব্রিটিশ নাগরিক  সামিয়ুন রহমান ওরফে ইবনে হামদান।  চরম উগ্রবাদী এই জঙ্গীরা যাদের কে ‘ইনফিদেল’  বা ইসলামের শত্রু মনে করে , তাদের হত্যাা এবং নাশকতার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সামিয়ুন রহমান এবং তার সহযোগীরা। আল-কায়দা, আইএস এবং সিরিয়ার  আত্মঘাতী জঙ্গী সংগঠন জাভাত -আল-নুসরা ফ্রন্টের সক্রিয় জঙ্গী সদস্য সামিয়ুন রহমানের উদ্দেশ্য বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করে আল কায়দা নেতা আইমান আল জাওয়াহিরির ঘোষিত ‘একিআইএস’ বা আল কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাব কন্টিনেন্ট এর জন্য বাংলাদেশ ও মায়ানমারে জঙ্গি নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করা। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম  একথা জানিয়ে জনকন্ঠকে বলেন, গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রমাণ আদালতে উপস্থাপিত করা হবে ।
২৫ সেপ্টেম্বর রাতে গোয়েন্দা পুলিশের জঙ্গিবিরোধী এক অভিযানে রাজধানীর মতিঝিল এলাকা থেকে ‘আইএস বাংলাদেশ’ প্রধান হিসেবে দাবিদার হিফজুর রহমানকে আটক করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তান , বাংলাদেশ এবং মায়ানমারে আইএস দক্ষিণ এশিয়া শাখা সংগঠিত করছিলো হিফজুর ।সিলেটের সরকারি তিব্বিয়া কলেজের ছাত্র জেএমবি সদস্য হিফজুর রহমান ইন্টারনেট বিষয়ে পারদর্শী। ‘আইএস বাংলাদেশ’ নামে ফেসবুক ফ্যান পেজ খুলে আইএস বাংলাদেশ প্রধান বলে নিজেকে দাবি করে। সেই পেজের মাধ্যমে সিরিয়া ও ইরাকে জিহাদ করতে যাওয়ার জন্য উদ্ধুদ্ধ কওে তরুণদের। দেশে ও প্রবাসে থাকা জঙ্গিবাদে উদ্ধুদ্ধ এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে জঙ্গীদের সংগঠিত করার চেষ্টা করে। এর  আগে বুধবার রাজধানীর সেগুনবাগিচা ও রমনা এলাকা থেকে মো. আসিফ আদনান (২৬) ও মো. ফজলে এলাহী তানজিল (২৪) নামের দুইজনকে গ্রেপ্তার করা হয়, যারা ইসলামিক স্টেটে যোগ দেয়ার পরিকল্পনা করছিল বলে  তথ্য নিশ্চিত হয়েছে গোয়েন্দা রা।আদনান ও তানজিল উগ্রপন্থী সংগঠন ‘আনসারউল্লাহ বাংলাটিম’ এর সদস্য। এদের মধ্যে আদনান সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতির ছেলে এবং তানজিলের মা একজন যুগ্ম সচিব (ওএসডি ) বলে গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা  জনকন্ঠকে জানিয়েছেন। ২০ সেপ্টেম্বর নিষিদ্ধ সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদিনের (জেএমবি) একাংশের ভারপ্রাপ্ত আমির তাসনিমসহ সাত জঙ্গিকে গ্রেফতার কওে মহানগর গোয়েন্দা দল। তাসনিম সহ এই সাত জঙ্গী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সঙ্গে যোগাযোগ করে বাংলাদেশে তাদের জন্য কাজ করার পরিকল্পনা করেছিল।
 জঙ্গীবাদ বিষয়ে অনুসন্ধানী কাজে অভিজ্ঞ গোয়েন্দা কর্মকর্তা  মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম জনকন্ঠকে বলেন, কিছুদিন থেকে চরম উগ্রবাদী জঙ্গীরা দেশে বেশ তৎপর। এরা আল-কায়দার অনুসারী বলেও নিশ্চিত হয়েছে গোয়েন্দারা। এদের সাথে জামায়াতের সম্পৃক্ততা খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দারা। তবে জঙ্গীদের অর্থের উৎস সম্পর্কে গভীর অনুসন্ধানের এখতিয়ার তাদের নেই বলে জানান মনিরুল ইসলাম।
এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী জনকন্ঠকে বলেন.সম্প্রতি আমি সৌদী আরব সফরে গিয়ে দেখেছি জামায়াত- শিবির সৌদী আরবের প্রবাসী বাংলাদেশীদের থেকে বড়ো অংকের ফান্ড পায়। ভারতের সারদা গ্রুপের ফান্ড পেয়েছে জামায়াত, এটাও আমরা নিশ্চিত হয়েছি। তবে এ ব্যাপারে আরো গভীর তদন্ত প্রয়োজন বলে মনে করেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।

এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, “এ ব্যাপারে এ পর্যন্ত কথা বলা হয়নি, আমি আইজির সাথে কথা বলবো । যতো দ্রুত সম্ভব এদের বিরুদ্ধে জোর তদন্তে নামতে হবে আমাদের গোয়েন্দা দলের।” আন্তর্জাতিক জঙ্গী তৎপরতার হুমকি থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করতে জঙ্গী দলগুলোর অর্থের উৎস সনাক্ত করা এবং আল-কায়দা দলের অনুসারীদের দমনে কাউন্টার টেররিজম টীম গঠন জরুরী হলেও সমন্য়হীনতার কারণে এ ব্যাপারে কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি বলে বলে স্বীকার করেন স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী ।    ### ০১.১০.২০১৪

Monday, September 22, 2014

এ কে খন্দকারের বই সম্পর্কে কিছু কথা : প্রফেসর সালাহ্উদ্দীন আহ্মদ

বদরুদ্দীন উমর আমার দীর্ঘকালের বন্ধু, অতি আপনজন। কোনো কোনো বিষয়ে বিশেষ করে রাজনৈতিক বিষয়ে আমরা সম্পূর্ণ ভিন্নমত পোষণ করি। তবে এ নিয়ে উমরের সঙ্গে আমি কখনও আলোচনা ও তর্ক করতে চাইনি। বদরুদ্দীন উমরের মতো আমার প্রিয় বন্ধু মঈদুল হাসান। তারা দু'জনেই পণ্ডিত মানুষ, প্রচুর পড়াশোনা করেছেন এবং করেন। আমি তাদের কথা মনোযোগ সহকারে শুনি কিন্তু তাদের সব কথা মেনে না নিলেও উত্তর দেই না বা তাদের সঙ্গে তর্ক বা বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ি না। আমি শান্তি ও সৌহার্দ্যে বিশ্বাস করি। এই দুই বন্ধুকে হারাতে চাই না। বন্ধুরা হয়তো মনে করতে পারেন আমি পণ্ডিতের খোলস পরে বসে আছি; কিন্তু আমি আসলে একটা মূর্খ ও নির্বোধ জীব, কোনো কিছু বোঝার ক্ষমতা নেই। কিন্তু এতে আমার কিছু আসে যায় না। আমার এই লেখা পড়ে এই বন্ধুরা যদি আমার ওপর রাগ করে আমাকে ত্যাগ করতে চান, আমি কিন্তু তাদের ছাড়ছি না। মতবিরোধ যতই থাকুক, মনের মিল তো কোনোদিন নষ্ট হওয়ার নয়।

আমার বয়স হয়েছে, নব্বই পার হয়ে গেছে; আজকাল লেখালেখি করতে খুব কষ্ট হয়। তবু এই লেখাটি লিখতে বসেছি বলতে পারেন নেহাত বিবেকের তাগিদে। গত ১২ সেপ্টেম্বর দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় বদরুদ্দীন উমর 'খন্দকারের বই ১৯৭১ : ভেতরে বাইরে' শীর্ষক একটি অগি্নগর্ভ প্রবন্ধ লিখেছেন। প্রবন্ধটি পড়ে তৎক্ষণাৎ আমার যে প্রতিক্রিয়া হলো সেটাই আমার এ লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করছি।
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ হঠাৎ শুরু হয়নি। এটা ছিল দীর্ঘকালের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার অমোঘ ফলশ্রুতি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবনের প্রথম দিকে পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেছিলেন এই ভেবে যে, এতে এ অঞ্চলের মুসলমানরা, যারা ছিল সর্বক্ষেত্রে অনুন্নত ও পশ্চাৎপদ_ তাদের ভাগ্য পরিবর্তন হবে। ১৯৪০ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের কাউন্সিলে শেরেবাংলা ফজলুল হকের উপস্থাপিত প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব এই দুই অঞ্চলে যেখানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ_ এই দুই অঞ্চলে দুটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র (ওহফবঢ়বহফবহঃ ধহফ ঝড়াবৎবরমহ ঝঃধঃবং) প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু ১৯৪৬ সালের গোড়ার দিকে দিলি্লতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ কনভেনশনে জিন্নাহ এবং মুসলিম লীগের অবাঙালি নেতারা স্রেফ ছলচাতুরীর মাধ্যমে লাহোর প্রস্তাবকে পরিবর্তন করে দুই রাষ্ট্রের বদলে এক রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। বদরুদ্দীন উমরের পিতা আবুল হাশিম, যিনি বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, তিনি এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ করে বলেছিলেন_ এটা সম্পূর্ণ অবৈধ। কারণ ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত হঠাৎ করে বদলানো যায় না। কিন্তু আবুল হাশিমের প্রতিবাদকে অগ্রাহ্য করে দুই পাকিস্তানের জায়গায় একটি পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। শেখ মুজিব তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, তখন থেকেই তার মনে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্রশ্ন জাগতে শুরু করল।
মুসলিম লীগের অবাঙালি নেতাদের বাঙালিবিরোধী চক্রান্ত সম্পর্কে শেখ সাহেব সজাগ হতে শুরু করেছিলেন। উল্লেখ্য, এই সময় অনেক বাঙালি মুসলিম নেতা ও বুদ্ধিজীবীর মনেও এই চিন্তাভাবনা জাগ্রত হয়েছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কিছুদিন পরই যখন কেন্দ্রীয় সরকার উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা এবং আরবি হরফে বাংলা লেখার পরিকল্পনা গ্রহণ করল, তখনই শুরু হয়ে গেল আমাদের মহান ভাষা আন্দোলন। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ দেশে এক নতুন ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটল। 'আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি_' মনীষী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর এই অমর উক্তির মধ্যে নিহিত ছিল এই নয়া বাঙালি জাতীয়তাবাদের মর্মবাণী। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বাঁধতে বেশ কিছুদিন সময় লাগল। কারণ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রথম দিক পর্যন্ত বাঙালি মুসলমানরা ইতিহাসবিদ অধ্যাপক হাবিবুল্লাহর ভাষায় 'পাকিস্তান জ্বরে আক্রান্ত', 'লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান' ও ইসলামী জোশ-এর উন্মাদনা তখনও কাটেনি। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী পড়লেই বোঝা যায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তিনি ভাবছিলেন কীভাবে এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা যায়। স্বাধীনতা কথাটি উচ্চারণ করাই তখন অসম্ভব ছিল। শেখ মুজিব প্রথম থেকেই ভাষা আন্দোলনসহ পূর্ববাংলার মানুষের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন। পাকিস্তান সরকার তাদের প্রধান শত্রুকে চিনতে ভুল করেনি। সামরিক শাসক আইয়ুব খানের বশংবদ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনেম খান ঘোষণা করেছিলেন, যতদিন তিনি গভর্নর পদে থাকবেন, শেখ মুজিবকে জেলে থাকতে হবে।
বস্তুত ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের সামরিক শাসক বাহিনীর লোকেরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করার পর কিংবা হয়তো কিছুকাল আগে থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল এবং ওই স্বপ্ন বাস্তবায়নে গোপনে প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল। দেশের অভ্যন্তরে বিচ্ছিন্নভাবে কর্মতৎপরতার কথা জানা যায়। এমনকি সুদূর লন্ডনে ১৯৫৮ সালের মার্শাল ল' জারির বেশ আগে থেকেই ব্রিটেনে বসবাসরত কিছু বাঙালি বুদ্ধিজীবী গোপনীয় কিন্তু পরিকল্পিতভাবে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার সপক্ষে কাজ শুরু করেছিলেন। আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা ছুটি নিয়ে লন্ডনে পেঁৗছাই ৩০ সেপ্টেম্বর (১৯৫৮)। তার ৭-৮ দিন পরই পাকিস্তানের সামরিক জান্তা মার্শাল ল' জারি করে। লন্ডন যাওয়ার কয়েক মাস পর হঠাৎ আমীর-উল ইসলাম সাহেবের সঙ্গে দেখা হলো ঝঙঅঝ-এর লাউঞ্জে। এই যুবক এবং ব্যারিস্টারি পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছেন। তিনি নিম্নস্বরে বললেন, পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি আলাপ করতে চান। তিনি আমাকে হাতে কবিরউদ্দীন আহমদের লেখা একটি পুস্তিকা দেন_ যার শিরোনাম ছিল 'টহযধঢ়ঢ়ু ঊধংঃ চধশরংঃধহ'. এটিতে পূর্ব পাকিস্তানকে কীভাবে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বঞ্চিত ও শোষণ করা হচ্ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থে, তার বিস্তৃত বিবরণ পরিসংখ্যানসহ দেওয়া ছিল। আমীর আমাকে বললেন, এটা গোপন দলিল, আমি যেন বাসায় নিয়ে পড়ি। তিনি উত্তর লন্ডনের ক্ল্যাপহাম অঞ্চলের একটা ঠিকানা দিয়ে বললেন, আমি যেন নির্দিষ্ট দিনে ওখানে যাই। আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা ছুটি নিয়ে লন্ডনে এসেছি পিএইচডি ডিগ্রির জন্য কাজ করতে। সোমবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ওহফরধ ঙভভরপব খরনৎধৎু-তে কাজ করি। তবু এক সন্ধ্যায় আমীর সাহেবের বাসায় গেলাম। সেখানে দেখি ১০-১২ জন বাঙালি রয়েছেন। তাদের মধ্যে ঢাকার সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, তরিকুল আলম, জাকারিয়া চৌধুরী প্রমুখ ছিলেন। কয়েকদিন আগে ব্র্যাকের স্যার ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে দেখা হলে জানালেন, তিনিও ওই বৈঠকে যোগ দিতেন। ১৯৬০ সালের প্রথম দিকে ঢাকা থেকে আমার পুরনো বন্ধু কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের সহপাঠী সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী ইৎরঃরংয ঈড়ঁহপরষ-এর ংযড়ৎঃ ঃবৎস ঋবষষড়ংিযরঢ় নিয়ে লন্ডনে এলো। জহুর আসায় আমাদের বৈঠক প্রাণবন্ত হয়ে উঠল। সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ফলে পূর্ব বাংলার জনগণের যে কত বড় ক্ষতি হয়েছে সে কথা জহুর বারবার বলল। সে বলত, পাকিস্তান সৃষ্টি করে আমরা যে পাপ করেছি তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে। পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করা ছাড়া বাঁচার আর কোনো পথ নেই_ এ কথার ওপর জোর দিত।
১৯৬০ সালের শেষ দিকে বদরুদ্দীন উমরও অক্সফোর্ডে এসেছিল। আমি ওকে আমাদের বৈঠকে নিয়ে গেলাম। উমর আসায় আমাদের বৈঠক আরও সজীব হয়ে উঠল। তার বক্তব্য ছিল পরিষ্কার এবং বাচনভঙ্গি ছিল চমৎকার। উমর এবং আমার পড়াশোনা ও গবেষণার চাপে আমীরের গোষ্ঠীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয়নি। তবে জহুর থাকতেই এই ভাবনা হয়েছিল যে, আমাদের জীবদ্দশায় বোধহয় পাকিস্তানের কবল থেকে দেশ স্বাধীন হবে না। তবুও আমরা স্বাধীনতার পথে পূর্বসূরির কাজ করে গেলাম। আমার প্রস্তাব অনুযায়ী এই গোষ্ঠীর নাম নেওয়া হলো 'পূর্বসূরি'। এত কথা বললাম এই জন্য, সুদূর লন্ডনে বসে সেই ১৯৪৮-৬০ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য আমরা যে কল্পনা করতে শুরু করেছিলাম এবং পরে জানতে পেরেছি আমাদের দেশের মধ্যেও এ ধরনের চিন্তাভাবনা অনেকেই গোপনে করে যাচ্ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কীভাবে ধাপে ধাপে তিনি দেশকে স্বাধীনতার পথে নিয়ে যাচ্ছিলেন। বঙ্গবন্ধু পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের ইস্যুতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে সমঝোতা সম্ভব নয়। সম্প্রতি শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি নামে এক অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় কূটনীতিবিদ, যাকে বাংলাদেশ সরকার আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য সম্মাননা দিয়েছে, তার একটি বই প্রকাশ হয়েছে। এই বইয়ে তিনি বলেছেন, ১৯৬৩-৬৪ সালে যখন তিনি ঢাকার ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনে জুনিয়র কর্মকর্তা, তখন গোপনে ইত্তেফাকের সম্পাদক মানিক মিয়ার মাধ্যমে শেখ মুজিব তার সঙ্গে দেখা করেন। শেখ মুজিব জানতে চান যে, পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু হলে ভারত সরকার সাহায্য করবে কি-না কিংবা কতটা সাহায্য করবে। শশাঙ্ক বাবু শেখ মুজিবের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে গোপন পথে আগরতলা যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। শেখ মুজিব সেখানে পেঁৗছালে তাকে পরিষ্কারভাবে বলা হয়, নেহরু সরকার এ ব্যাপারে কোনো আশ্বাস দিতে পারবে না। শেখ সাহেব বিফল মনোরথ হয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন। সে সময় ভারত সরকারের পক্ষে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সাহায্য করা সম্ভব ছিল না স্রেফ নিজস্ব নিরাপত্তার কারণে। ১৯৬২ সালে সীমান্ত নিয়ে ভারতের সঙ্গে চীনের যুদ্ধ হয়ে গেছে এবং সে যুদ্ধে ভারত ভীষণভাবে পর্যুদস্ত হয়েছে। চীনের কাছে এই লজ্জাকর পরাজয় নেহরুকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল। এর মাত্র দুই বছরের মাথায় আধুনিক ভারতের রূপকার এবং জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জওয়াহেরলাল নেহরু মৃত্যুবরণ করেন।
ইতিমধ্যে মওলানা ভাসানী, শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো অনেক বাঙালি নেতা মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে এসে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেছেন। পরে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল হিসেবে গঠিত হয়। ১৯৬৩ সালে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের প্রধান নেতায় পরিণত হন। নিজের পরিকল্পনামতো আওয়ামী লীগকে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির আদর্শ অনুসরণ করে পূর্ব বাংলার সব সম্প্রদায়ের মানুষ_ হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাইকে নিয়ে এক ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতিতে পরিণত করতে সক্ষম হলেন। শেখ সাহেবের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো তিনি অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি অনুসরণ করে বিভক্ত বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন, যা তার আগে কোনো নেতা পারেননি। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় থেকে জনসচেতনতা বাড়তে লাগল। জনমনে প্রশ্ন জাগল, পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে থেকে আমাদের কী লাভ? এই চিন্তাধারাকে শেখ মুজিব রূপায়িত করলেন তার ঐতিহাসিক 'ছয় দফায়'। সেখানে বলা হলো, প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি ছাড়া সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ থাকবে পূর্ব পাকিস্তানের হাতে। আলাদা মুদ্রার ও প্যারামিলিটারি ফোর্স গঠন করার প্রস্তাবও করা হলো। বস্তুত বলা যেতে পারে, ছয় দফা দাবির মধ্যে ছিল স্বাধীনতার পূর্বাভাস। সামরিক শাসক আইয়ুব খান সেটা পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তীব্রভাবে দমননীতি শুরু করে। তারা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। কিন্তু ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের ফলে সরকার মামলা প্রত্যাহার করে শেখ সাহেবকে মুক্তি দিল। ১৯৭০ সালের ৫ ডিসেম্বর ঢাকায় এক বিরাট জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঘোষণা করলেন যে, 'এখন থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বাংলাদেশ বলে অভিহিত করা হবে।' এটা ছিল বলিষ্ঠ ঐতিহাসিক ঘোষণা। পূর্ণ স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। বস্তুত বঙ্গবন্ধুর আইডিয়া ছিল আমাদের স্বাধীন হতে হবে। কিন্তু যেতে হবে ধাপে ধাপে। জনগণের কাছে সেটি গৃহীত হতে হবে, পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে পরিষ্কারভাবে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। 'আমরা স্বাধীন হলাম'_ এ কথা না বলে পাক সামরিক শাসকদের নাকের ডগায় বসে তিনি বলেছিলেন, 'যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের ওপর আমার অনুরোধ রইল : প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। এবং ... রাস্তাঘাট যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দেবার না পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।'
তিনি বলেন, 'আমরা [শত্রুদের] ভাতে মারব, পানিতে মারব।' ওই ভাষণে তিনি পাক সৈন্যদের ব্যারাকে গিয়ে থাকতে বললেন এবং যদি তারা না যায় এবং বাঙালিদের ওপর আক্রমণ করে, তা হলে তাদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে বললেন, 'তোমরা আমার ভাই_ তোমরা ব্যারাকে থাক, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা কর না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না।' বঙ্গবন্ধু তার ওই ভাষণের শেষের দিকে বললেন, '... যদি এ দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝেশুনে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রাম, প্রত্যেক মহল্লায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব_ এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।'
আমি এবং আমার মতো অগণিত লোক যারা রেসকোর্স ময়দানে সেই জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শেখ সাহেবের জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনছিলাম, তারা শুনলাম, বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা শেষ করলেন 'জয় বাংলা' বলে। ওই সময় লোকজন বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দিচ্ছিল, সেই হট্টগোলের মধ্যে তিনি জয় বাংলার পর 'জয় পাকিস্তান' কিংবা 'পাকিস্তান জিন্দাবাদ'ও বলেছিলেন কি-না আমি শুনতে পাইনি। আমি বলব, যদি বঙ্গবন্ধু জয় পাকিস্তান বা পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলেও থাকেন, তাহলে কোনো দোষ ছিল না। স্বাধীনতার পক্ষে এত কথা বলার পর জয় পাকিস্তান বলে পাকিস্তানি শাসকদের স্রেফ বিভ্রান্ত করতে নেহাত কৌশলগত কারণে তিনি এ কথা বলতে পারেন। পাকিস্তানের সামরিক শাসকের নাগের ডগায় বসে স্বাধীনতার সংগ্রামের কথা উচ্চারণ করা ছিল দুঃসাহসিক কাজ।
বন্ধুবর বদরুদ্দীন উমর এ কে খন্দকারের বইয়ের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন : ''তিনি (শেখ মুজিব) যদি জনগণের ওপর নির্ভরশীল হতেন এবং সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্যের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন তা হলে ৭ মার্চ রেসকোর্সের ময়দানের বক্তৃতার শেষে দেশের লোককে ঘরে ঘরে দুর্গ তৈরির আহ্বান না জানিয়ে এবং বক্তৃতার শেষে 'জয় পাকিস্তান' না বলে ওই মহাসমাবেশেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে সমবেত লাখ লাখ মানুষকে ক্যান্টনমেন্টের দিকে পরিচালিত করতেন এবং বাঙালি সামরিক লোকদের ক্যান্টনমেন্টের দখল নেওয়ার আহ্বান জানাতেন। বিমানবন্দর দখল সহজ হতো এবং তখনও পর্যন্ত পাকিস্তানি সৈন্যদের সংখ্যা কম থাকায় জনগণের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে বাঙালি সামরিক সদস্যরা ক্যান্টনমেন্ট দখল করতেন। সেই সংঘর্ষে হাজার হাজার লোক নিহত হতে পারত কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে ওইদিনই পাকিস্তান সরকারের পতন হতো।" উমরের এই বক্তব্য পড়ে আমি হতবাক হয়ে গেছি। তিনি তো ফরাসি বিপ্লব ও তার পরবর্তীকালের ইতিহাস ভালো করে পড়েছেন। তিনি কি ভুলে গেছেন ১৮৭১ সালে ফরাসি-জার্মান যুদ্ধে লুই ফিলিপ, যিনি নিজেকে সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন হিসেবে অধিষ্ঠিত করেছিলেন, তার পতনের পর নতুন ফরাসি সরকারের আমলে প্যারিস কম্যুনের বিপ্লবকে কী নৃশংসভাবে ফরাসি সৈন্যবাহিনী দমন করেছিল? প্যারিসের বিপ্লবী জনতার ওপর সৈন্যবাহিনী কামানের গোলা চালিয়ে হাজার হাজার ফরাসিকে হত্যা করে কম্যুনকে ধ্বংস করেছিল। শেখ মুজিব যদি উমরের কথামতো লাখো জনতা নিয়ে ঢাকা বিমানবন্দর ও ক্যান্টনমেন্ট দখল করার চেষ্টা করতেন, তাহলে অবাঙালি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লোকেরা সংখ্যায় যতই কম হোক তাদের হাতে প্রচুর ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদ মজুদ ছিল, তারা নির্বিচারে কামান দেগে শেখ মুজিবসহ লাখো বাঙালিকে হত্যা করত। বাইরের কোনো শক্তি আমাদের রক্ষা করতে আসত না। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম অঙ্কুরেই বিনষ্ট হতো। আমরা চিরদিনের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানিদের গোলাম হয়ে থাকতাম।
এবার খন্দকার সাহেব ও বাঙালি সামরিক অফিসারদের কথা বলি। তারা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে একাধিকবার শেখ সাহেবের কাছে পরামর্শ ও নির্দেশের জন্য গেছেন; কিন্তু শেখ সাহেব তাদের আশ্বাস দিতে পারেননি। এ জন্য খন্দকার সাহেবরা ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। শেখ সাহেব কেন বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কোনো কথা বলতে চাননি তার কারণ ছিল। আমাদের বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের হাতে কি বড় যুদ্ধ করার মতো ভারী অস্ত্র ছিল? অস্ত্র পাওয়া যেত একমাত্র ভারতের কাছ থেকে। কিন্তু ওই সময় ভারত কেন অস্ত্র দিতে যাবে? ভারতের নিজস্ব নিরাপত্তার কারণে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের বাঙালিদের কোনো কার্যক্রমে বড় আকারের সাহায্য করতে ওই সময় প্রস্তুত ছিল না। যদি ভারত সে রকম করত, তখনই পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করত এই অজুহাতে যে, ভারত পাকিস্তানের অখণ্ডতাকে বিনষ্ট করতে চায়। সে সুযোগে চীন ১৯৬২ সালের মতো ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্য আক্রমণ করে বসত, সে আক্রমণকে প্রতিহত করার ক্ষমতা ভারতের ছিল না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকেও আমরা সমর্থন পেতাম না। খন্দকার সাহেব ও অন্যান্য বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের পরামর্শ অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু যদি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করার অনুমতি দিতেন তাহলে ক্ষিপ্রগতিতে নৃশংসভাবে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে পাকবাহিনী আমাদের শেষ করে দিত। আমাদের অবস্থা নাইজেরিয়ার বায়াফ্রার মতো হতো।
সে সময় পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে যত কমই থাকুক, তাদের হাতে যথেষ্ট পরিমাণে ভারী অস্ত্রশস্ত্র ছিল। এই উপলব্ধি আমাদের বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের ছিল না মোটেই, যদিও তারা স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। অনেকেই অভিযোগ করেন যে, শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের কোনো কন্টিনজেন্ট প্ল্যান ছিল না। আমার ধারণা, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর একটা গোপনীয় সমঝোতা হয়েছিল যে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুকূল না হওয়া পর্যন্ত ভারত অপেক্ষা করবে।
বস্তুত মার্চ-এপ্রিল ১৯৭১ আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট আমাদের অনুকূলে ছিল না। বিশ্বে স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল, তখন আমরা এর শিকার হয়েছিলাম। একদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপরীতে আমেরিকা; আবার কমিউনিস্ট চীনের সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মতবিরোধের সুযোগ নিয়ে আমেরিকা চীনের কাছে আসার চেষ্টা করছিল। অন্যদিকে চীন ও আমেরিকার পাকিস্তানের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। শুধু এই দুই পরাশক্তি নয়, সমগ্র মুসলিম বিশ্ব তথা মুসলিম উম্মাহ আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপক্ষে। একদিকে জাতিসংঘের পক্ষেও আমাদের স্বাধীনতাকে সমর্থন করার সম্ভাবনা ছিল না প্রধানত এই কারণে যে, জাতিসংঘের সনদে রয়েছে কোনো সদস্য রাষ্ট্রকে ভেঙে ফেলার উদ্যোগ তারা কখনও সমর্থন করবে না। সে পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে গেলে টিকতেই পারত না। সুতরাং বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন, ধাপে ধাপে সাবধানে আমাদের এগোতে হবে। এ কে খন্দকার সাহেব তার বইয়ে ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে লিখেছেন, ভারত সরকার আমাদের মুক্তিবাহিনীকে যথেষ্টভাবে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছিল না। তখন ভারত চায়নি মুক্তিবাহিনী ভারতের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানের বাহিনীর সঙ্গে কোনো বড় রকম সংঘর্ষে লিপ্ত হোক। তা হলে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধ শুরু হয়ে যেত। ভারত সময় চাচ্ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হতে। তাছাড়া ভারত শীতের আগে চীনের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতে চায়নি। নভেম্বর-ডিসেম্বর নাগাদ যখন উত্তর-পশ্চিম হিমালয় বরফে ঢেকে যাবে সে সময় চীনের পক্ষে ওই অঞ্চল থেকে সৈন্য নামিয়ে ভারত আক্রমণ করতে পারবে না। এপ্রিল থেকে অক্টোবর-নভেম্বর পর্যন্ত যখন পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রায় এক কোটি অসহায় মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছে এবং এর ফলে ভারতের অর্থনীতির ওপর ভয়াবহ চাপ সৃষ্টি হয়েছে, তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সারাবিশ্ব চষে বেড়িয়েছেন বিশ্ববাসীকে সচেতন করে দিতে। এর মধ্যে ভারতের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের পরস্পরকে সাহায্য করার বন্ধুত্ব চুক্তি সই হয়ে গেছে। ভারতের রণকৌশল ছিল, আমাদের মুক্তিবাহিনী গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে পাকসেনাদের ব্যতিব্যস্ত রাখবে। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগণ-সাধারণ মানুষ ভারত সৈন্যবাহিনীকে সব ধরনের সহযোগিতা করবে।
একটা প্রশ্ন অনেকেই করেন। ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু পাক সেনাবাহিনীর হাতে ধরা দিলেন কেন? পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুর যে ছবিটি প্রকাশ করে তাতে দেখা যায়, তিনি অত্যন্ত শান্ত, অবিচলিত ও আত্মমর্যাদাসহ করাচি বিমানবন্দরের লাউঞ্জের একটি সোফায় বসে আছেন। তার চেহারায় ভয়ের লেশমাত্র নেই; বরং একটা প্রশান্তি ও আত্মবিশ্বাসের ছাপ সুস্পষ্ট। বস্তুত তিনি জীবনের বাজি রেখে নির্ভীক ও শান্তভাবে মৃত্যুভয়কে জয় করেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, পাকিস্তানিরা তাকে হয়তো মেরে ফেলতে পারে কিন্তু বাংলাদেশ যে স্বাধীন হবেই_ এ বিশ্বাস তার অটুট ছিল। ২৫ মার্চ রাতে যখন তাজউদ্দীন ও আমীর-উল ইসলাম শেখ সাহেবকে তাদের সঙ্গে চলে যেতে বারবার অনুরোধ করছিলেন, তখন শেখ সাহেব তাদের চলে যেতে বলেন। 'তোমরা চলে যাও, বাংলাদেশ স্বাধীন হবে।' এ কথা তাজউদ্দীনকন্যা রিমি লিখেছেন তার বইয়ে।
পরিশেষে এ কে খন্দকার সাহেব সম্পর্কে আমি একটা কথা বলতে চাই। তার সঙ্গে দীর্ঘদিনের পরিচয়। তিনি অতিশয় সজ্জন ব্যক্তি। তরুণ বয়সে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে যোগ দেন। গভীর স্বদেশপ্রেমের দ্বারা উজ্জীবিত হয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। কিন্তু ইতিহাস ও রাজনীতি সম্পর্কে তার জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত। আমি বলব আমাদের অধিকাংশ সেনা কর্মকর্তা সম্পর্কে এ কথা বলা যায়। স্নেহভাজন অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তার একটা বইয়ে পাকিস্তানের সেনা কর্মকর্তাদের ওপর কাকুল মিলিটারি একাডেমির প্রশিক্ষণের প্রভাব সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। এ কে খন্দকার সাহেবের মতো আমাদের বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা গভীর স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং সাহস ও বীরত্বের সঙ্গে তারা যুদ্ধ করেছেন, অনেকে শহীদও হয়েছেন। তাদের সবার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাতে আমরা যেন কোনো কার্পণ্য না করি। খন্দকার সাহেব তার সীমিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে যা মনে হয়েছে লিখেছেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার শ্রদ্ধার অভাব ছিল না। বলতে হয় অত্যন্ত সীমিত প্রেক্ষাপটে, সীমিত দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি উনিশশ' একাত্তরের জটিল পরিস্থিতিকে নিরীক্ষণ করেছেন, যার প্রকাশ তার বইয়ে প্রতিফলিত হয়েছে।
যারা খন্দকার সাহেবের বইয়ের সমালোচনা করতে গিয়ে তার সম্পর্কে অশালীন উক্তি করেছেন তাদের আমি সমর্থন করি না। খন্দকার সাহেব মুক্তিযুদ্ধের সময় ডেপুটি চিফ অব স্টাফ ছিলেন। সেই ব্যাপারটাকে সম্মান জানানো দরকার। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের সঙ্গে কোনো কোনো বিষয় সম্পর্কে মতপার্থক্য হলেও তাদের অবদানের কথা মনে করে তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন আমাদের কর্তব্য। তেমন যদি আমরা না করতে পারি, তাহলে নিজেদেরই অসম্মান করব।


জাতীয় অধ্যাপক; প্রাক্তন অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ
রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়