Saturday, August 16, 2014

আজমেরীসহ ১১ আসামি: নয়জন বিদেশে

অভিযোগপত্র অনিশ্চিত: আজমেরীসহ  জড়িত ;৯ জনই এখন বিদেশে

নারায়ণগঞ্জে মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যার ঘটনায় জড়িত হিসেবে আজমেরী ওসমানসহ ১১ আসামির মধ্যে নয়জনই বিদেশে পালিয়ে গেছেন। একজন অন্য মামলায় কারাগারে আছেন। আরেকজন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী একটি বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন। র‌্যাবের তদন্ত দলের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
র‌্যাবের সূত্র আরও বলছে, তদন্ত গুছিয়ে এনে তারা একটি খসড়া অভিযোগপত্রও তৈরি করেছে। তবে কবে নাগাদ অভিযোগপত্রটি চূড়ান্ত করে আদালতে জমা দেওয়া হবে, তা কেউই বলতে পারছে না। মামলার বাদীপক্ষের অভিযোগ, ওসমান পরিবার এই হত্যায় জড়িত থাকায় সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে মামলাটির কার্যক্রম বন্ধ করে রাখা হয়েছে।
গত ৬ মার্চ ত্বকী হত্যার এক বছর পূর্ণ হওয়ার দিনে র‌্যাবের সহকারী মহাপরিচালক (এডিজি) জিয়াউল আহসান বলেছিলেন, শিগগিরই মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হবে। অবশ্য এরপর সাড়ে চার মাস পার হলেও অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি।
র‌্যাবের সূত্র জানায়, তদন্তে প্রধান সন্দেহভাজন হিসেবে ওসমান পরিবারের সদস্য আজমেরী ওসমানের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। আজমেরীর বাবা প্রয়াত সাংসদ নাসিম ওসমান। আর তার দুই চাচা হলেন বর্তমান সাংসদ শামীম ওসমান ও সেলিম ওসমান।
তদন্তে পাওয়া তথ্যমতে, ত্বকী হত্যায় অংশ নেওয়া বাকি ১০ জন হলেন রাজীব, কালাম শিকদার, মামুন, অপু, কাজল, শিপন, জামশেদ হোসেন, ইউসুফ হোসেন ওরফে লিটন, সুলতান শওকত ওরফে ভ্রমর ও তায়েবউদ্দিন ওরফে জ্যাকি। র‌্যাব ও পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এদের মধ্যে মাদক মামলায় লিটন কারাগারে আছেন। আর কালাম শিকদার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছিলেন। র‌্যাবের সূত্র জানিয়েছে, তিনি নিহত হয়েছেন এবং তাঁর লাশ গুম করা হয়েছে।
মামলার প্রধান আসামি আজমেরী ওসমান এখন কলকাতায় আছেন। এই হত্যা মামলায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়া একমাত্র আসামি সুলতান শওকত আছেন দুবাইয়ে। বাকি সাতজন বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে পালিয়ে আছেন বলে র‌্যাব ও পুলিশ জানতে পেরেছে।
অভিযুক্ত ১১ জনের মধ্যে প্রথম আলো ছয়জনের পরিবারের সদস্য ও দুজনের ঘনিষ্ঠজনের সঙ্গে কথা বলেছে। এর মধ্যে সাতজনের পরিবার ও ঘনিষ্ঠজনেরা তাঁদের বিদেশে চলে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
জানতে চাইলে র‌্যাবের মহাপরিচালক মোকলেছুর রহমান বলেন, মামলার তদন্তে র‌্যাব অনেকটাই এগিয়েছে। কিছু কাজ বাকি আছে। সেগুলো শেষ করে অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়া হবে। তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক, কিছু সম্ভাব্য আসামি দেশের বাইরে পালিয়ে আছেন। অভিযোগপত্র দেওয়ার পর তাঁদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো হবে।’
তবে পলাতকদের মধ্যে কালাম, শিপন, জামশেদ, লিটন, সুলতান শওকত ওরফে ভ্রমর ও তায়েবউদ্দিন ওরফে জ্যাকি বিভিন্ন সময়ে পুলিশের হাতে আটক বা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এদের মধ্যে শিপন ও জামশেদকে আটকের পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ভ্রমর ও ও জ্যাকি আদালত থেকে জামিন নিয়ে গোপনে দেশ ত্যাগ করেছেন। এর মধ্যে ভ্রমর গত মার্চে এবং জ্যাকি গত জুনে জামিন পান। র‌্যাব সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া যায়।
মামলার প্রধান আসামি আজমেরী গত ১ মে নারায়ণগঞ্জে এসেছিলেন। ওই দিন তিনি বাবা নাসিম ওসমানের জানাজায় ও দাফনে অংশ নেন। এরপর আবারও তিনি কলকাতায় পালিয়ে যান বলে তদন্তসংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত হয়েছেন। হত্যার পর কিংবা বাবার মৃত্যুর পর কলকাতা থেকে দেশে ঢুকলেও তাঁকে গ্রেপ্তারে পুলিশ বা র‌্যাব কোনো উদ্যোগই নেয়নি।
র‌্যাবের তদন্ত নথিতে বলা হয়েছে, হত্যায় অভিযুক্ত ইউসুফ হোসেন সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত এবং আজমেরীর ঘনিষ্ঠজন। সুলতান শওকত নারায়ণগঞ্জ জেলা জাতীয় পার্টির সাবেক সভানেত্রীর ছেলে। অপরাধজগতে আজমেরীর ডান হাত বলে পরিচিত তিনি। অভিযুক্ত তায়েবউদ্দিনের পরিবারের সঙ্গে ওসমান পরিবারের রয়েছে পুরোনো সম্পর্ক। তাঁর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসেরও অভিযোগ আছে। অভিযুক্ত কালাম শিকদার আজমেরী ওসমানের অন্যতম ঘনিষ্ঠজন ও চাঁদাবাজ। আরেক অভিযুক্ত মামুন আজমেরী ওসমানের খালাতো বোনের জামাই। কাজলকে চাঁদাবাজ ও আজমেরীর অন্যতম ঘনিষ্ঠজন বলে বর্ণনা করা হয়েছে নথিতে। তাঁর ভাই স্থানীয় যুবলীগের একজন নেতা। অভিযুক্ত অপু আজমেরীর তথ্যদাতা। রাজীব ও শিপন আজমেরীর বেতনভুক্ত ক্যাডার। অভিযুক্ত জামশেদ আজমেরীর গাড়িচালক।
এই হত্যাকাণ্ডে শামীম ওসমানের ছেলে অয়ন ওসমানের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠলেও র‌্যাব দাবি করেছে, তারা তাঁর সম্পৃক্ততা পায়নি। অয়নের দুই সহযোগী সালেহ রহমান ওরফে সীমান্ত ও রিফাত বিন ওসমান বিষয়েও র‌্যাব একই কথা বলেছে। এই দুজন গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। এর মধ্যে সীমান্ত এখনো কারাগারে আছেন।
মামলার তদন্তের সঙ্গে যুক্ত র‌্যাবের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ত্বকীকে যারা হত্যা করেছে, তাদের এখন বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো খুবই কঠিন হবে। কেননা, মূল আসামিদের কেউই দেশে নেই। বিদেশ থেকে আসামিদের ফিরিয়ে এনে বিচার করা অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে প্রায় অসম্ভব।
মামলার বাদী ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি প্রথম আলোকে বলেন, তদন্তকারী সংস্থা খুনিদের চিহ্নিত করেছে। অভিযোগপত্র দেওয়ার সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন ছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, হত্যায় ওসমান পরিবারের সদস্য আজমেরী ওসমান জড়িত থাকায় বিচার পাওয়াটা অনিশ্চিত হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘আমি জানি, একমাত্র প্রধানমন্ত্রী চাইলেই এই মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া সম্ভব হবে। নয়তো কোনো দিনই দেওয়া হবে না।’
মামলার সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে র‌্যাবের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অভিযোগপত্র দেওয়ার জন্য র‌্যাবের ওপর উচ্চ আদালত বা অন্য কোনো স্থান থেকে নির্দেশনা এলে অভিযোগপত্র দেওয়া সহজ হবে। তাঁরা অভিযোগপত্র প্রায় প্রস্তুত করে বসে আছেন।
তবে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, স্পর্শকাতর এই মামলার অভিযোগপত্র শিগগিরই দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। তিনি বলেন, ‘হত্যায় অভিযুক্ত ব্যক্তিরা দেশে থাকুক আর দেশের বাইরে থাকুক, তাদের বিচার করা হবে।’
২০১৩ সালের ৬ মার্চ ত্বকীকে নারায়ণগঞ্জে নিজ বাসার কাছ থেকে অপহরণ করা হয়। ৮ মার্চ তার লাশ পাওয়া যায় শীতলক্ষ্যা নদীতে। উচ্চ আদালত র‌্যাবকে এই মামলার তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছেন।

No comments:

Post a Comment