Saturday, March 8, 2014

নারীমুক্তি ও আমাদের বাস্তবতা - নূরজাহান খান


রবিবার, ৯ মার্চ ২০১৪, ২৫ ফাল্গুন ১৪২০
নারীমুক্তি ও আমাদের বাস্তবতা
নূরজাহান খান
‘নারী ছাড়া কোন গণআন্দোলন হতে পারে না।’ মহান বিপ্লবী ক্লারা জেৎকিনের সঙ্গে আলাপকালে এ কথা বলেছিলেন মহামতি লেনিন। পিছিয়ে থাকা নারীদের এগিয়ে নেয়ার জন্য তিনি বলেছিলেন, নারীদের বোঝাতে হবে সন্তানধারণ ও সন্তানকে গড়ে তুলতে হলে শিক্ষা এবং জীবনচর্চায় তাদের পুরুষের সমকক্ষ হতে হবে। আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০১৪-এর থিম করা হয়েছে পরিবর্তনের অনুপ্রেরণাকে। আমরা নারীর প্রতি দায়বদ্ধ এবং জবাবদিহিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করে আসছি ১৯৭০ সাল থেকে। গত চার দশকে এর সফলতা অনেক। তবে ব্যর্থতাও কম নয়। সেই ব্যর্থতা কাটাতে সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরী। আমার সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতায় বর্তমান সমাজবাস্তবতার কিছু সফলতা-ব্যর্থতার চিত্র এ লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
রাজপথ থেকে প্রশাসন সর্বত্র নারীর দৃপ্ত পদচারণা। নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা হলেই এদেশে প্রকৃত মানবমুক্তি আসবে। আমরা বলি, পরিবার এবং কর্মক্ষেত্রে নারীকে পুরুষের সমকক্ষ হতে হবে। নারীর শিক্ষার মান বেড়েছে। নারীর সমতা বিধান রাষ্ট্রের দায়িত্ব। বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে সরকার নারীবান্ধব
পরিবেশ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। নারীর নৈতিক ও রাজনৈতিক সচেতনতা নারীমুক্তির অগ্রযাত্রার সহায়ক বলে মনে করছে বর্তমান সরকার। এ কাজে নারীর পাশাপাশি পুরুষেরও এগিয়ে আসা একান্ত প্রয়োজন। ১৯৭৬-৮৫ সালে জাতিসংঘের ঘোষণা ছিল নারীর সমতা, উন্নয়ন ও শান্তি। জাতিসংঘ নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করার জন্য ঘোষণা দেয় কাজ, শিক্ষা, বিশ্রাম, চিত্তবিনোদন, চিকিৎসা প্রভৃতি বিষয়ে। কোন কোন দেশের সংবিধানে আছে নারীরা গৃহকাজের বাইরে অন্য কাজে যেতে পারবে না। মধ্যপ্রাচ্যে এখনও ভোটাধিকারের দাবিতে লড়াই করতে হচ্ছে নারীকে। আমাদের খালাম্মা বেগম সুফিয়া কামাল বলতেন, মঞ্চে কিছু মানুষ নির্ধারিত বক্তব্য বলে যায়, ‘দর্শকরা শুনে যান। এর খুব একটা প্রভাব সমাজে পড়ে না। নারীর প্রতি আন্তরিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দায়িত্বশীলতার কথা সাধারণ মানুষের কাছে গিয়ে বলতে হবে। সমাজ পরিবর্তনের মাঠে নামতে হবে মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষকে। এর কোন বিকল্প নেই। এ আমাদের নিজেদেরই কাজ।’
সচেতনতার অভাবে ফতোয়া, পর্দা, হিজাব আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। সমাজ গবেষক ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল স্বাভাবিকভাবেই এর বিরুদ্ধে তার হতাশা এবং আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। যে কোন সচেতন ব্যক্তিমাত্রই এতে শঙ্কিত হবেন। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় ধর্মের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে নারীকে আবার পর্দার ভেতরে বন্দী করার সংঘবদ্ধ যে অপচেষ্টা তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান আমাদের প্রতিটি সচেতন নাগরিকের।
মুক্ত হাওয়ায় নারীর নিঃশ্বাস নিতেও বাধা? হিজাব তারই প্রকাশ। তবে সমাজের উচ্চশ্রেণীর কিছু নারী স্বেচ্ছায় এ শৃঙ্খলে বন্দী হচ্ছেন। কেউ কেউ আবার হিজাবে ফ্যাশনের বেশ বাহার দেখান।
তাদের প্রতি আমার আবেদন, নজরুলের সেই জনপ্রিয় আহ্বান ভুলে যাবেন না, ‘মাথার ঘোমটা খুলে ফেলো নারী, ছিঁড়ে ফেলো ও শিকল- যে ঘোমটা তোমায় করিয়াছে ভীরু ওড়াও সে আবরণ।’ সৃষ্টিশীল মনকে শৃঙ্খলিত করার মতো স্বেচ্ছাচারিতার কোন অধিকার নিজেরও নেই। এ সমাজে জন্ম, শিক্ষা এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রতিটি মানুষের অবদান আছে। সেই মানুষগুলোর প্রতি, এ সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধ থাকতে হবে।
পর্দাপ্রথা প্রত্যাখ্যান সমাজ সচেতনতার প্রকাশ। এর সঙ্গে ধর্মের কোন দ্বন্দ্ব নেই। আধুনিককালে ধর্মের এমন অপব্যাখ্যা দিয়ে নারীকে আবার অবরোধবাসিনী করার হীন প্রচেষ্টা করা হচ্ছে; যা ঠেকানো জরুরী বলে আমার মনে হয়। নারীকে কূপম-ূকতার দিকে ঠেলে দেয়ার এ হীন প্রচেষ্টা প্রতিরোধ করে এগিয়ে নিতে হবে পরবর্তী প্রজন্মকে। সব সঙ্কীর্ণতার উর্ধে উঠে অসাম্প্রদায়িক চেতনায়, মানবিক মন নিয়ে গড়ে তুলতে হবে এ সমাজ।
স্বাবলম্বী হবার প্রয়াসে অথবা সংসারে সচ্ছলতা আনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হচ্ছে যে নারীরা তাদের কথা এবার বলতে হয়। ক্ষুদ্র ঋণের ফাঁদে পা দিয়েছে গ্রামাঞ্চলের নারীরা। ঋণের ভার বইতে না পেরে আত্মহত্যা করার ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। তবু প্রত্যন্ত জনপদে ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতাদের হার কম নয়। পোশাক কারখানায় কর্মজীবী মেয়েরা শহরে ছোট রুম ভাড়া করে কষ্ট করে থাকে। তবে কোন কোন প্রতিষ্ঠান কোম্পানি নিজেদের পরিবহন ব্যবস্থায় গ্রাম থেকেও কর্মীদের নিয়ে আসছে। গ্রামের প্রতিটি ঘরে ব্যস্ততা। স্বামী সন্তানদের খাবারের ব্যবস্থা করে নিজের খাবার সঙ্গে নিয়ে কর্মক্ষেত্রে রুদ্ধশ্বাসে ছুটছে উদ্যমী নারী। এমনও দেখা যায়, বিয়ের ১৮-১৯ বছর পরও স্বামীর একার রোজগারে সংসার চলে না। ৩৭-৩৮ বছরের নারীও গার্মেন্টসে চাকরি নিচ্ছে। তবে ভীষণ দুশ্চিন্তা হয়, যখন দেখতে পাই দুর্জনেরা কিছু গার্মেন্টস কর্মীর ফাঁদে ফেলে পঙ্কিলতার অন্ধকাওে ডুবিয়ে দিচ্ছে তাদের জীবন। গ্রামের কর্মজীবী নারীর পরিবার এবং সন্তানের নিরাপত্তায় মায়ের অবর্তমানে প্রতিবেশীরা যেন সহনশীলতার সঙ্গে সহযোগিতা করে।
সুখের ব্যাপার, কোন কোন গার্মেন্টসে ডে-কেয়ার সেন্টার আছে, যেখানে গার্মেন্টসকর্মীরা তাদের শিশু-সন্তানকে রেখে নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারে। বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন আজ সত্য। লেডি কেরানি থেকে বিচারপতি সব পদে নারী দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করছে। বিচারিক কাজে নারীর সিদ্ধান্ত খুব কমই ভুল হয়। ব্যতিক্রম থাকতে পারে, তবে তা খুবই নগণ্য। আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানে বার বার উঠে এসেছে বাস্তবে নারী তার কর্মক্ষেত্রে তুলনামূলক বিচারে পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি সৎ এবং পরিশ্রমী।
কন্যা শিশুর বিপন্নতা সমাজের আরেক ভয়াবহ বাস্তবতা। পরিণত বয়স্ক পুরুষ দ্বারাও অনেক সময়ে নির্যাতিত হয়ে তার জীবন সঙ্কটাপন্ন হয়। বিকৃত রুচির মানুষগুলো আইনের কঠোর সাজার তোয়াক্কা কেন করেন না- সেই বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে পারেন অপরাধবিশেষজ্ঞ বা সমাজ গবেষকরা। তবে নিরীহ শিশু বা তরুণীদের জিম্মি করে পর্ণোগ্রাফি তৈরি এবং প্রচারের মতো জঘন্য অপরাধ কন্যা শিশুদের নিরাপত্তাহীন করে তুলেছে। এ এক সঙ্কটকাল অতিক্রম করছি আমরা।
আশার কথা, তথ্যপ্রযুক্তি অপরাধীদের শাস্তির বিধান জারি করে আইন পাস হয়েছে সংসদে। অপরাধীদের অন্তত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া জরুরী, যার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি। অনেক ক্ষেত্রে একটি কিশোরী বা তরুণীর ছবির সঙ্গে অন্য কোন ছবি জুড়ে অশ্লীল, অশালীন বক্তব্যদানকারী ধরা পড়ার পর তাদের বাঁচানোর জন্য দুর্ভাগ্যজনকভাবে সমাজের প্রভাবশালীরা তৎপর হন।
রেলস্টেশন বা বাজারে পথশিশুরা পলিথিন মুখে দিয়ে মাদকে বুঁদ হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকে- তাদের বাঁচানোর উদ্যোগ না নিলে অন্ধকারের গহ্বরে তারা তলিয়ে যাবে।
যারা সমাজকে মাদকের অন্ধকার গহ্বরে তলিয়ে দিতে চায়, সেসব গডফাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সময় এসেছে। একই ভাবে বলতে হয়, মানবপাচার এখন সারা বিশ্বের বড় সমস্যা। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও অনেক সংগঠন এ নিয়ে কাজ করছে। অথচ মূল পাচারকারী শাস্তির বাইরেই থেকে যাচ্ছে, এ ব্যাপারে কারো সদিচ্ছা আছে বলে মনে হয় না।
দু’বছর আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী ইভ টিজিংয়ের শিকার হয়ে এ্যাসিড পান করে। এক বছর মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে মৃত্যুর কাছে হার মানে সেই তরুণী। মামলার আসামি ইভ টিজার তরুণের আইনজীবীর আর্জি মতো ছাত্রটির শিক্ষাজীবন বাঁচাতে মহামান্য আদালত তার জামিন দেয়।
এখানে পেশাগত দায়িত্ব প্রধান, মানবতাবোধ বিন্দুমাত্রও তাড়িত করেনি আসামিপক্ষের আইনজীবীকে। পরিতাপের বিষয়, এ ধরনের ঘটনা যখন ঘটে, সারাদেশে মানববন্ধন, আন্দোলন, সভা সমিতি হয়। তাও একসময়ে গতানুগতিক নিয়মে ভাটা পড়ে।
সেই নিরীহ শিশু, কিশোরী-তরুণীর পাশে কেউ থাকে না। চট্টগ্রামের বাঁশখালীর মাদ্রাসা শিক্ষক আবদুস সাত্তার ২০০৪ সালে চার বছরের একটি কন্যা শিশুকে (বালকরাও মাদ্রাসা শিক্ষকদের বর্বর নির্যাতনের শিকার হয়) নির্যাতন করার পর তার পক্ষে সমাজসেবা অফিসের কর্মকর্তা সাক্ষ্য দেন। আদালতে বললেন, মামলার অভিযোগে উল্লেখিত ঘটনার সময়ে সাত্তার (ধর্ষক) নাকি সাতকানিয়া সমাজসেবা অফিসে ছিলেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তৎকালীন মন্ত্রী, এমপিও এ ধর্ষকের চরিত্র ‘ফুলের মতো পবিত্র’ এমন সনদপত্র দেন। অনেক আইনজীবী আদালতে দাঁড়ান ধর্ষণকারী সাত্তারের পক্ষে, আর নির্যাতিত শিশুটির পাশে দাঁড়িয়ে আমি দেখলাম কেউ নেই। আরও অনেক মামলার মতো এ মামলাটি নিয়েও ৪টি বছর লড়াই করলাম। পাশে পেয়েছিলাম প্রথিতযশা আইনজীবী এ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্তকে (বর্তমানে
মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর)।
২০১০ সালে চট্টগ্রাম মহানগর আদালতের তৎকালীন পিপি আখতার হোসেনের নেতৃত্বে মামলা পরিচালনাকালে আসামির বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হলো। ৭ বছরের সশ্রম কারাদ-ে দ-িত হলো ধর্ষক আবদুস সাত্তার।
তবে খ্যাতনামা এবং উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিদের কেউ কেউ নিজের ব্যবসা, চাকরির সফলতার জন্য নিজের স্ত্রী বা কন্যাকে ক্ষমতাবান কোন পুরুষের হাতে সমর্পণ করেন এমন অভিযোগও রয়েছে। অভিযোগের বিপরীতে অভিযুক্ত ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থন করে কোন বক্তব্য থাকে না। তাদের কোন অপরাধবোধও থাকে না। যা নিঃসন্দেহে নিন্দনীয় এবং সমাজের জন্য ভয়ঙ্কর!
সমাজপতিদের কাছে নারী-পুরুষের শারীরিক কাঠামোগত বৈষম্যই গুরুত্বপূর্ণ। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় সমাজপতিদের চরম অনিচ্ছা আমাদের পিছিয়ে দিয়েছে অনেকখানি। নারী-পুরুষের সমানাধিকার, নারীর স্বনির্ভরতা, শিশুর নিরাপত্তা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। জাতিসংঘ নারীর বৈষম্য দূর করার যে প্রস্তাব রেখেছে, নিজেদেও স্বার্থে, সমাজের স্বার্থে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করতে হবে। এতে পরিবার এবং সমাজ লাভবান হবে।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠার দূরদৃষ্টি নিয়ে বেগম রোকেয়া ‘সুলতানার স্বপ্ন’ দেখিয়েছেন। বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তার উত্তরসূরি বেগম সুফিয়া কামাল আমাদের হাত ধরে রাজপথে নামিয়েছেন। আজ সর্বক্ষেত্রে নারীর সদর্প পদচারণা, সমাজে নারীর যে অগ্রগতি তা তারই সুফল। আর বিভেদ নয়, অসাম্য নয়। নারী-পুরুষ পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক। একসঙ্গে এগিয়ে যাব আমরা। বর্তমানে সরকার নারীমুক্তির যে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, তা বাস্তবায়নের জন্য এগিয়ে আসতে হবে সমাজকেই।
সমাজের সকল অন্ধকার দূর করে একদিন আরও বহুদূর এগিয়ে যাবে নারী। সেই লক্ষ্য পূরণ করতে হলে নারীকে কূপম-ূকতার দিকে ঠেলে দেয়ার সব রকমের হীন প্রচেষ্টা প্রতিরোধ করতে হবে। এগিয়ে নিতে হবে পরবর্তী প্রজন্মকে। সব সঙ্কীর্ণতার উর্ধে উঠে অসাম্প্রদায়িক চেতনায়, মানবিক মন নিয়ে গড়ে তুলতে হবে এ সমাজ। আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০১৪ সফল হোক।

লেখক : মানবাধিকার সংগঠক ও
প্রধান নির্বাহী, লিরো

No comments:

Post a Comment