Saturday, March 1, 2014

এটা একটা তারবার্তা ছিল না, জনাব রাষ্ট্রদূত - মোজাম্মেল খান


সম্প্রতি বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম, সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস মরিয়ার্টি ২০০৮ সালে তারেক রহমানকে বাংলাদেশে মার্কিন স্বার্থের পরিপন্থ’ী হিসেবে উল্লেখ করে ওয়াশিংটনে যে বার্তা পাঠান তার বিশদ বিষয়বস্তু (যেটা উইকিলিকস ২০১১ সালে প্রকাশ করেছিল) প্রকাশ করে। তারবার্তায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তারেক রহমানের ঢুকতে না দিতে ওয়াশিংটনে সুপারিশ করা হয়েছিল। গত ফেব্রুয়ারির ১১ তারিখে, মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা, বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক শেষে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘আমি শ্রেণীবদ্ধ নথি সংক্রান্ত কোন অভিযোগ নিয়ে মন্তব্য করব না। আপনারা যদি অনেক তারবার্তার একটি নিয়ে কথা বলেন তাহলে সেটাতে ভুল সিদ্ধান্ত প্রতিফলিত হতে পারে। যেহেতু প্রতিদিন অনেক তারবার্তা যাওয়া-আসা করছে, কোন এক বিশেষ তারবার্তা কোন একটা মুহূর্তের চিন্তাকেই প্রতিফলিত করে।’ 
না, জনাব রাষ্ট্রদূত, এটা একটা তারবার্তা ছিল না। এটা ২০০৫ থেকে ২০০৮ সাল অবধি যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকা মিশনপ্রধানদের কয়েকটা তারবার্তা, যার সবই তারেক রহমানের কুকীর্তির বিশদ বিবরণ দেয়া হয়েছে এবং এর সব ক’টি একে অপরের সম্পূরক, সাংঘর্ষিক তো নয়ই এবং সেদিক দিয়ে কোনটাই প্রসঙ্গের বাইরে নয়। নিম্নোক্ত অনুচ্ছেদগুলোতে কালানুক্রমিকভাবে ঐ তারবার্তাগুলোর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলো, যার সবই ৩০ আগস্ট, ২০১১ সালে উইকিলিকস প্রকাশ করে। 
এই তারবার্তাটির শিরোনাম ছিল ‘খালেদা দুর্নীতিগ্রস্ত পুত্রকে রক্ষা করে ব্যর্থ হয়েছেন’ এবং পাঠান রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে টমাস ২০০৫-এর মার্চ মাসে। এ তারবার্তায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মুখ্য সচিব কামালউদ্দিন সিদ্দিকী বাংলাদেশে তখন মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে কি বলেন তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে। তাঁর ভাষায়, খালেদার সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ব্যর্থতা ছিল তার দুর্নীতিগ্রস্ত ছেলে তারেক রহমানকে রক্ষা করা। তিনি [ সিদ্দিকী ] বর্ণনা দিয়েছেন কিভাবে তার দুর্নীতিস্ত পুত্রকে প্রশ্রয় এবং রক্ষা করেছেন।
২০০৫ সালের ১৩ মার্চ মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কামালুদ্দিন সিদ্দিকীর ৪০ মিনিটের একটি বৈঠক হয়। ঐ বৈঠকে ওয়াশিংটনে জ্যেষ্ঠ মার্কিন সরকার কর্মকর্তাদের সঙ্গে তারেকের বৈঠকের অনুরোধ প্রটোকল ও অন্যান্য কারণে সম্ভব নয় বলে রাষ্ট্রদূত সিদ্দিকীকে জানান। সিদ্দিকী এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে সম্পূর্ণ ঐকমত্য পোষণ করে বলেন, উত্তরাধিকারের রাজনীতি একটি উঠতি গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গলজনক নয়। 
মার্কিন দূতের সঙ্গে বৈঠকে সিদ্দিকী আরও বলেন, মার্কিন চাপ এবং ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রথম বিশ্বব্যাংকের বৈঠক বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি রক্ষার খাতিরে খালেদা জিয়া অবশেষে রাজশাহী অঞ্চলে বিএনপির সাংসদ, মন্ত্রী এবং জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ ‘গ্যাংস্টার’দের রক্ষা করা বন্ধের নীতি গ্রহন করেন। সিদ্দিকী বলেন, বিএনপি সরকারের সমস্যা হলো এরা শুধু চাপের মুখে কাজ করে। যার ফলে যে কাজ আগেই করা উচিত; সেটা করেও তার কৃতিত্ব তারা দাবি করতে পারে না। 
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন যার নাম সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ্্ এএমএস কিবরিয়াকে গ্রেনেড হামলায় হত্যা করার অভিযোগে মিডিয়ায় প্রকাশ হয়েছে সে ব্যাপারে রাষ্ট্রদূত জিজ্ঞাসা করলে সিদ্দিকী প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হারিস চৌধুরীর নাম উল্লেখ করেন। সিদ্দিকী জানান, তৎকালীন সিভিল এ্যাভিয়েশন প্রতিমন্ত্রী মীর নাসির উদ্দিন বিমানের জন্য বোয়িং বা এ্যায়ারবাস কিনবে কিনা সে সিদ্ধান্ত নিতেও ঘুষ চেয়েছিলেন। প্রতিমন্ত্রীর ঘুষের ইচ্ছার জন্যই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন। 
দ্বিতীয় তারবার্তাটিও পাঠিয়েছিলেন হ্যারি কে টমাস ১১ মে, ২০০৫ সালে। এটাতে বলা হয়েছিল, বিশ্বস্ততা, ঘনিষ্ঠতা এবং পারিবারিক সম্পর্ক ছিল তার দ্বিতীয় মেয়াদে যে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রক্রিয়ায় প্রধান প্রভাব, কোন প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থানের কোন মূল্যায়ণ তিনি করেননি। তারবার্তায় বলা হয়, খালেদা জিয়ার কাছে আনুগত্য দ্বিমুখী রাস্তা। এটা হলো আদান-প্রদানের ব্যাপার। ১৭ ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হয়েছিল খালেদা জিয়ার ওপর সর্বোচ্চ প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণকারী হিসাবে। এদের তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছিল- ভেতরের, মাঝের এবং বাইরের। এদের অনেকের সঙ্গেই তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। 
ঐ তারবার্তায় তারেক রহমান সম্পর্কে আরও বলা হয়, ‘হাওয়া ভবন’ নামে এক ‘ছায়া সরকার’ তিনি চালিয়েছেন, বিশেষ করে সরকারী নিয়োগ এবং ঠিকাদারি কাজ দেয়ার ব্যাপারে ঐ ভবনের কথাই ছিল শেষ কথা। ২০০১ সালের নির্বাচনের পরে গঠিত ৬০ জনের মন্ত্রিসভার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ তিনিই বিক্রি করেছিলেন। তিনি নৃশংস, সীমাহীন দুর্নীতিবাজ, রাজনীতিতে এবং ব্যবসায় অনভিজ্ঞ, অশিক্ষিত, বাস্তব জ্ঞানবিবর্জিত এবং অমানবিক। 
অন্যান্য ১৫ জনের মধ্যে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়- খালেদা জিয়ার সংসদীয় এবং জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা এ ব্যক্তিটি এক বহুমুখী প্লেয়ার, যাকে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়েছে এবং হত্যাকারী, ধর্ষক এবং অস্ত্র চোরাচালানকারীসহ এমন কোন অপরাধ নেই; যার সঙ্গে তিনি যুক্ত নন। ওআইসি মহাসচিব পদে হেরে যাবার পরও তার প্রভাব বিন্দুমাত্র ক্ষুন্ন হয়নি। শেখ হাসিনাকে তিনি অনেকবার অভদ্র ভাষায় আক্রমণ করেছেন এবং চট্টগ্রাম অস্ত্র চোরাচালানোর সঙ্গে তার জড়িত থাকার কথাও শোনা যাচ্ছে।
পরবর্তী তারবার্তাটি, যার শিরোনাম ছিল, ‘অপ্রতিরোধ্য দুর্নীতি‘, ২৪ আগস্ট ২০০৬ সালে পাঠান প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিস, বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদ শেষ হওয়ার প্রায় দুই মাস আগে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকার তার মেয়াদের শেষদিকে দুর্নীতির একটি দৃশ্যত নজিরবিহীন পর্যায়ে জড়িত ছিল। তারবার্তায় বলা হয়, লোভ এবং আসন্ন রাজনৈতিক প্রচারণায় অর্থ যোগানোর প্রয়োজন দুর্নীতি উর্ধগতিপ্রাপ্ত হয়। এটা ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হতো যে প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য উর্ধ্বতন মন্ত্রীদের পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতির দায়মুক্তি নিম্ন কর্মকর্তাদের দুর্নীতিতে উৎসাহ যুগিয়েছে এবং এটাতে সব পর্যায়ে ছোটখাটো দুর্নীতির ব্যাপক প্রসার ঘটিয়েছে। উদাহরণ দিয়ে কয়েক শ’ মিলিয়ন ডলারের দুর্নীতির বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে যার মধ্যে রয়েছে মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট এবং পুলিশের রেডিও যন্ত্রপাতি ক্রয়ের চুক্তি। আমেরিকান কোম্পানি মটোরোলার সঙ্গে সম্ভাব্য চুক্তি কিভাবে তারেক এবং আরাফাত রহমান কোকোর প্রভাবে বাতিল করে সিঙ্গাপুর টেকনোলজি কোম্পানিকে দেয়া হয়- তার বিবরণও দেয়া হয়েছে তারবার্তায়।
পরবর্তী তারবার্তাটি পাঠান রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি ২০০৮ সালের ৩ নবেম্বরে। ওই তারবার্তায় তারেক রহমানকে, লোভ-লালসা-চোরামি আর দুর্নীতিবান সরকারের এবং হিংস্র রাজনীতির প্রতিবিম্ব হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং তাকে যেন যুক্তরাষ্টে ঢোকার অনুমতি না দেয়া হয় সে সুপারিশ করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস বিশ্বাস করে, তারেক রহমান ‘কুখ্যাত রাজনৈতিক দুর্নীতির দোষে দোষী’ এবং এ ব্যাপারে দূতাবাস তারেকের কিছু বড় ধরনের দুর্নীতির বিবরণ ঐ তারবার্তায় তুলে ধরে। 
এসব তারবার্তা পাঠানোর ৬ মাস পর ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত গীতা পাশি ওয়াশিংটনে আরও একটি তারবার্তা পাঠান। ঐ তারবার্তায় বলা হয়, স্টেট ডিপার্টমেন্ট প্রেসিডেন্সিয়াল ঘোষণার আওতায় তারেক রহমানের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ভিসা প্রত্যাহারের বিষয়টি বিবেচনা করছে। ঐ বার্তায় বলা হয়, তার অপকর্ম সরকারের প্রতি জনগণের আস্থাকে দুর্বল করেছে এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের স্থায়িত্বকে খর্ব করেছে। তার কোটি কোটি ডলারের চুরি এ মধ্যপন্থী মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্থায়িত্ব এবং ভিতকে দুর্বল করেছে এবং যার প্রেক্ষিতে এ দেশে একটা শক্তিশালী রাজনৈতিক ব্যবস্থা সৃষ্টিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যয় ও প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। 
তারেকের দুর্নীতি চর্চা মার্কিন স্বার্থের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে বলে মরিয়ার্টি লিখেন। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে বাংলাদেশে দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাত এবং ঘুষের যে সংস্কৃতি চালু করেছে সেটাতে মার্কিন ব্যবসার অনেক ক্ষতি হয়েছে এবং অনেক অপূরণীয়ভাবে সুযোগ হারিয়ে গেছে, মরিয়ার্টি উল্লেখ করেন ওই তারবার্তায়। সংক্ষেপে, বাংলাদেশের যা কিছু দুর্দশা তার সিংহভাগের জন্য দায়ী তারেক এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গরা। 
এসব কারণে রাষ্ট্রপতি প্রক্ল্যামেশন ৭৭৫০-এর মাধমে মার্কিন রাষ্ট্রদূত তারেক রহমানকে যুক্তরাষ্ট্রে এন্ট্রি ব্লক করার সুপারিশ করেন। 
তারেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, ঘুষ, অর্থ আত্মসাৎ এবং করফাঁকির অভিযোগে একাধিক মামলা থাকা সত্ত্বেও জামিনে তারেকের মুক্তি পাওয়া সম্পর্কে মরিয়ার্টি লেখেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক তার জামিনের বিরুদ্ধে একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও গভীর রাজনৈতিক বন্ধন, যেটা দেশের সর্বোচ্চ আদালতে পৌঁছাতে পারে, সেটা দ্বারা বিচার প্রক্রিয়াকে নিপুণভাবে মানিপুলেটের মাধ্যমে তিনি জামিন পেতে সমর্থ হন।
এসব তারবার্তার বিষয়বস্তু কোনটার সঙ্গে কোনটা সম্পর্কহীন বা কোনটাতে কি কোন অপ্রাসঙ্গিকতা ধরা পড়েছে বা কোন অংশকে কি সম্পূর্ণ তারবার্তাসমূহের বিষয়বস্তুর বাইরে নিয়ে বিবেচনা করা হয়েছে, জনাব রাষ্ট্রদূত?

লেখক : কানাডা প্রবাসী অধ্যাপক এবং সিনেটের ডেপুটি স্পীকার

No comments:

Post a Comment